ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
দিনমণি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
(১২)
পূর্বকথা
দেশে তখন ইংরাজ রাজত্ব চলিতেছে, তৎসত্বেও নানা স্থানে স্বাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা ও জমিদারেরা বসবাস করিতেছিলেন, তাঁহারা নিজেদের মতো করিয়া রাজ্য শাসন করিতেন, রাজন্য প্রথার বিলুপ্তি ঘটে নাই। যদিও দেশের সর্বত্র স্বাধীনতার আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল।
সেই সময়ে অখ্যাত এক গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ হইতে এক বালক গৃহত্যাগ করে। এই গৃহত্যাগের সাক্ষী ও সহায়ক ছিলেন ওই পরিবারেরই আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধা রমণী। বালকটির পিতামাতা অপেক্ষাও তিনি ছিলেন তাহার আপন। বালকটী আর কেহ নহে, সেই সম্পন্ন পরিবারের গৃহকর্তার চতুর্থ ও কনিষ্ঠ সন্তান, জ্ঞানতোষ। একই দিনে বালকের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কারণে গৃহে পুলিশের পদার্পণ ঘটে, যুবকটি ফেরার হয়, কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। ভ্রাতাটির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করার এবং স্থানীয় রেললাইনে বোমা রাখার অভিযোগ পাওয়া যায়।
কিন্তু গৃহসুখে প্রতিপালিত বালকটির গৃহত্যাগের কারণ কি? তবে কি সেও ভ্রাতার ন্যায় স্বদেশী সংগ্রামে লিপ্ত?
গৃহত্যাগী বালকের সংবাদ বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে বাটীস্থ সকলের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছে, গৃহকর্তা পারুলবালা নামক বধূটিকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিতে বধূটি ভয়ে সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়াছেন। বালকের সংবাদ এখনও পাওয়া যায় নাই, কিন্তু যে বৃদ্ধার সহিত বালকটির এত অন্তরঙ্গতা, সেই দিনমণি ভয়ে, দুশ্চিন্তায় দুর্বল শরীরে সংজ্ঞা লুপ্ত হইলেন।
অন্দর মহলেও ভারি ঝড় উঠিল। শিবতোষ দারুণ রোষে সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য ডাকাডাকি করিলেও পারুলবালার কাণ্ড-কারখানা দেখিয়া ভীত হইলেন, পরে বিস্তর চ্যাঁচামেচি করিতে লাগিলেন। বাটিস্থ সকলে তাঁহার ব্যবহারে ভীত সন্ত্রস্ত হইল। বাস্তবিক সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেও দিনমণিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় নাই। সেকথা মনে পড়িতেই শিবতোষ বহির্বাটিতে যাইয়াও ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া পুনরায় অন্দরে প্রবেশ করিলেন।
মালতীকে ডাকাইয়া বিস্তর চীৎকার চেঁচামেচি করিলে ফল হইল এই যে মালতী নিজ ভুল বুঝিতে পারিয়া দিনমণিকে খুঁজিয়া পাইল এবং তাঁহাকে নিজ কুঠুরীতে অচৈতন্য অবস্থায় দেখিতে পাইল। গৃহত্যাগী বালকটিও ইস্কুলের বোর্ডিং হলে স্থান পাইয়াছে এবং দুই একটি বালকের সহিত পরিচিতি হইয়াছে, যদিচ সেই সংবাদ এখনও গৃহে আসিয়া পৌঁছায় নাই। গৃহস্থ সকলে দিনমণির জন্য উদ্বিগ্ন, গৃহে অশান্তি ও ভয়ের ছায়া।
কিন্তু যে বালক শুধুমাত্র বিদ্যাশিক্ষার লোভে গৃহত্যাগ করিয়াছে, কোন কিছুই তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। অদম্য জিজ্ঞাসা আর পাঠতৃষ্ণা তাহাকে সকল কিছু হইতে বিরত রাখিয়াছিল। বিদ্যালয়ের দিনগুলি তাই তাহার জীবনের পরম ধন।
অতঃপর...
বিদ্যালয়ের দিনগুলি পালতোলা নৌকার ন্যায় তরতর করিয়া বহিয়া চলিতেছিল। কোথাও কোনও বিঘ্ন নাই, অসুন্দরের ভ্রুকূটি নাই, শুধু শিক্ষকদিগের নিকট হইতে আহরণ করিবার পালা। যে যত আহরণ করিতে পারিবে, তাহার অন্তরে জমায়েত তত বেশী হইবে।
জ্ঞানতোষ সম্পন্ন গৃহস্থ সন্তান। অন্নবস্ত্রের অভাব তাহাদের গৃহে একপ্রকার নাই, কিন্তু মাসাধিক কাল বিদ্যালয়ে আসিয়া তাহার মনে হইতে লাগিল কিসের যেন অভাব এতদিন ধরিয়া সেও অনুভব করিতেছিল। সে মেধাবী ছাত্র, বিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষাতেই ভাল ফল করিল, সেকারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষকমহাশয়দিগের দৃষ্টিও আকর্ষণ করিতে পারিল। ক্ষেত্রনাথ যে বালকটিকে লইয়া মিথ্যা আস্ফালন করেন নাই, তাহা শিক্ষক মহাশয়েরা, বিশেষতঃ অবনী মাষ্টার মহাশয় বুঝিয়াছিলেন। বিদ্যালয়ে আসিয়া অবনী মাষ্টার মহাশয়ের স্নেহ কিশোরটি যথেষ্ট পরিমাণে পাইতে লাগিল।
এইরূপে প্রায় দুই তিন মাস কাটিল। বিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাসের ভিতরেই তাহার আনন্দ। বিদ্যালয়ে যে মণি-মুকুতার সন্ধান সে পাইয়াছিল, তাহার পূর্ণরূপে সদ্ব্যবহার করিবে এইপ্রকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল। বয়সে বালক হইলেও বুদ্ধি বিবেচনায় সে পূর্ণ বয়স্কের প্রায়।
দিন কাটিতেছিল বিদ্যাভ্যাস করিয়া, খেলাধূলা করিয়া, সাঁতার কাটিয়া, শরীরচর্চা করিয়া...কিন্তু তাহার সহিত আরও একটি কার্য্যের প্রতি জ্ঞানতোষের দৃষ্টি আকর্ষণ হইতেছিল- দেশের কাজ। অবনী মাষ্টারের সাহচর্য্যে এই দিকটির কথা সে কিছু কিছু জানিতে পারিতেছিল। অবনী মাষ্টার সকল প্রকার বালক, কিশোর ছাত্রদিগকেই দেশের কাজে লাগাইতে চাহেন, বুদ্ধি ও সাহসের উপর তাহার প্রকার নির্ভর করে। জ্ঞানতোষের মতো অল্পবয়স্ক ছাত্রদিগকে তিনি কঠিন কার্য্যের ভার দিতেন না। বস্তুতঃ মেধাবী ছাত্রগুলিকে তিনি ছাত্র গঠনের কাজেই লাগাইয়াছিলেন, অবনী মাষ্টার বুঝিয়াছিলেন, দেশ গড়িতে হইলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন উপযুক্ত যুবার দল যাহারা মেধা ও মননের দ্বারা দেশকে চালনা করিবে। তাই প্রয়োজন প্রকৃত মেধাবী ছাত্রদল। সেই কারণেই অমিয়নাথ এবং জ্ঞানতোষের ন্যায় আরো দু'একটি ছাত্রের উপর অপেক্ষাকৃত নিম্ন কক্ষের ছাত্রদিগকের বিদ্যাশিক্ষা ও দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পিত হইল। এই দেখাশুনা শুধুমাত্র বিদ্যাশিক্ষা নয়, সর্বপ্রকারের শিক্ষা, যা তাহারা গোপনে গ্রহণ করিতেছিল অবনী মাষ্টার এবং আরও দু'একজন শিক্ষকের নিকট। কিন্তু শুধুমাত্র সেইটুকুই নহে, বিদ্যাশিক্ষার দায়িত্বের সহিত তিনি জ্ঞানতোষ এবং অমিয়নাথের জন্য শিক্ষাদানের পরিবর্তে মাসিক পারিশ্রমিকেরও বন্দোবস্ত করিলেন। অমিয়নাথের প্রয়োজন ছিল, তাহার মতো দরিদ্র ছাত্র কমই আছে, কিন্তু ইহাতে জ্ঞানতোষও সবিশেষ উপকৃত হইল।
গৃহত্যাগ করিবার সময় জ্ঞানতোষ বোর্ডিং স্কুলে খরচের কথা ভাবে নাই। বিদ্যালয়ে থাকিয়া বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করিতে গেলে প্রতিমাসে কিছু অর্থের প্রয়োজন। পিতাঠাকুর তাহা দিবেন না, একপ্রকার নিশ্চিত। মেজদাদা তাহা যোগাইবেন এইরূপ ভাবিয়াছিল, ভরসাও ছিল। প্রাথমিক পর্য্যায়ে মেজদাদা খরচের যোগান দিলেও তাঁহাকে যে বৃহৎ সংসারের জন্য অর্থের যোগান দিতে হয়, জ্ঞানতোষ তাহা জানে। বোধকরি গৃহশিক্ষক ক্ষেত্রনাথের নিকট জ্ঞানতোষের অবস্থার কথা অবনী মাষ্টার শুনিয়া থাকিবেন। স্কুলের মেধাবী ছাত্রটিকে সম্ভবতঃ সেইকারণেই এইরূপ ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। জ্ঞানতোষের পক্ষেও এই বয়সেই নিজের জন্য কিছু অর্থের সংস্থান করিতে পারা আশ্চর্য্যের কথা বৈকি!
অবনী মাষ্টারের স্নেহ এবং অমিয়নাথের সহিত প্রগাঢ বন্ধুত্ব জ্ঞানতোষের জীবনের পরম প্রাপ্তি। আমৃত্যু এই দুই জনের ঋণ জ্ঞানতোষ স্বীকার করিয়াছে, তাহার জীবনাকাশে এই দুই জন সর্বদা ধ্রুবতারার ন্যায় জ্বাজল্যমান। কখনও তাঁহাদিগকে বিস্মৃত হয় নাই।
তৃতীয় কি চতুর্থ মাসের শুরুতেই বাটি হইতে সংবাদ আসিল, পিতাঠাকুর স্মরণ করিয়াছেন। গৃহশিক্ষক ক্ষেত্রনাথ কর্তৃক বিদ্যালয় ভবনে সংবাদ আসিয়া পৌঁছাইল। তখন সন্ধ্যাকাল। জ্ঞানতোষ অমিয়নাথের সহিত ছাত্রাবাসের সম্মুখস্থ একটি বেঞ্চিতে বসিয়াছিল। সন্ধ্যার শান্ত রূপটি বালক জ্ঞানতোষের মনে অপরূপ একটি ছবি আঁকিয়া দিলেও নানান ভাবনা তাহার চিত্তে খেলিতে লাগিল। পিতাঠাকুর ঠিক কোন প্রয়োজনে তাহাকে স্মরণ করিয়াছেন বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। তবে কি তাহাকে বিদ্যালয় ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে হইবে? হে ঈশ্বর! তাহার আর কিছুর প্রয়োজন নাই, কাহারও নিকট সে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ চাহিবে না, প্রয়োজনে সে বোর্ডিংয়ের কিছু কাজ করিয়া টাকা মিটাইবে, কিন্তু বিদ্যালয় ছাড়িয়া যাইবে না। অমিয়নাথের মাতাঠাকুরাণী বাসন মাজার কাজ করিতে পারিলে সে পারিবে না কেন? পরক্ষণেই তাহার মনে প্রশ্ন হইল--বাটিস্থ সকলে কুশলে আছেন তো? পিতাঠাকুর, মা...পিসি!
ভয়ে তাহার মুখ পাংশু হইল।
(ক্রমশঃ)
0 comments: