1

সম্পাদকীয়

Posted in



শুভ নববর্ষ!

অতি সন্তর্পণে, গুঁড়ি মেরে পেরিয়ে এলাম বিষাক্ত একটা বছর। সতর্কতা শেষ হয়নি এখনও। বিশ্বের নানা দেশে নতুন করে জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। পাশাপাশি আবার এই মারণ রোগের প্রতিষেধকও এসে গেলো আমাদের হাতে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? প্রতিষেধক কি এলো? কি বলব একে? এই বৈজ্ঞানিক অবিমৃষ্যকারিতা ঠেকানোর কি কোনওই উপায় নেই? যে ঘটনা আমাদের পিছিয়ে দিল এতগুলো মাস, বদলে দিল জীবনযাত্রা, তার দায়িত্ব কেউ নিয়েছে এখনও পর্যন্ত? এই সম্পাদকীয় যখন লিখছি, আমেরিকায় তখন পট পরিবর্তনের তোড়জোড়। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার উদগ্র বাসনা যে মানুষের শুভ বোধ, যাবতীয় নীতি ও মূল্যবোধ কীভাবে কেড়ে নিতে পারে, বিদায়ী রাষ্ট্রপতির সমর্থকরা তা প্রমাণ করেছেন ক্যাপিটল হিলে তাণ্ডব চালিয়ে। আবার এর মধ্যেই, এই অন্ধকারে আলোর রোশনাই ছড়িয়ে ভারতীয় ক্রিকেটাররা ব্রিসবেনে রুদ্ধশ্বাস জয় উপহার দিলেন আমাদের। অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটারই একে সর্বকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ জয় বলছেন। আর সন্দেহাতীতভাবে তাইই। এই প্রজন্মের একঝাঁক ঝকঝকে তরুণ আমাদের উপহার দিলেন অনেকখানি আশা আর উদ্দীপনা। ভবিষ্যতের জন্য।

আসলে এটাই মূল কথা। আশা অপরাজেয় নিরবধি। জীবন অপ্রতিরোধ্য সর্বব্যাপী। সূর্যমুখী ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতায় প্রতিশ্রুতিময়।

আসুন, সেই ভবিষ্যতে বাঁচি আমরা।

ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর!

1 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















 (২)

ভূমিকা

সরকার ও কিসানঃ ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে

ভারত সরকারের তিনটে কৃষি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন প্রায় ৬০ দিন ছুঁতে চলেছে । ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আন্দোলনরত বিভিন্ন কিসান ইউনিয়নের চল্লিশ প্রতিনিধির আলোচনা নয়বার বৈঠকের পরও ব্যর্থ। কোন সমাধান-সূত্র বেরোল না। কিসানদের দাবি তাড়াহুড়ো করে পাশ করানো তিনটে কৃষি সংস্কার আইন বাতিল করতে হবে, কারণ ওগুলো কৃষকের স্বার্থবিরোধী এবং বিগ কর্পোরেটের স্বার্থে তৈরি। সরকার বলছেন, আইন বাতিল করা যাবেনা। কিছু কিছু ধারা বদলানো যেতে পারে।

কিন্তু কৃষকদের এক কথা। ওই তিনটে খামতিভরা গন্ডগোলের আইনে কোন আধাখ্যাঁচড়া পুলটিস লাগানো চলবে না। আগে তিনট্রে আইন বাতিল করতে হবে। তারপর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে নতুন ত্রুটিহীন আইন পাশ করতে হবে। ইতিমধ্যে কৃষকদের ইউনিয়নের সংযুক্ত কমিটি লিখিতভাবে সরকারের সংশোধনী প্রস্তাবে অসহমতি জানিয়ে দিয়েছে। এবার কী হবে?

কৃষকেরা বলছেন করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! ফতে না করে ফিরব না। আরও ছ’মাস ধর্নায় বসতে তৈরি হয়ে এসেছি। আরও বলছেন-আন্দোলনের এলাকা বৃদ্ধি হবে, গতি তীব্র হবে। প্রথম চরণে ১২ ডিসেম্বর দিল্লি-জয়পুর ন্যাশনাল হাইওয়ে বন্ধ করা হয়েছিল। ওইদিন কোন টোল ট্যাক্স আদায় হয়নি। এরপর আছে জেলায় জেলায় শাসক দল বিজেপির অফিস ঘেরাও করা, ঘেরাও করা হবে ওই দলের সাসংদ ও বিধায়কদের, বাদ যাবেন না মন্ত্রীরাও। তারপর ১৪ই ডিসেম্বর ভুখ হরতাল হয়ে গেছে। দু’সপ্তাহ আগে জনতার রোষে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার নির্ধারিত সভাস্থলে নামতে পারেনি।ভবিষ্যতে হয়ত আরও একবার ভারত বন্ধ হবে।

এতদিন আন্দোলন শান্তিপূর্ণ পথে চলেছে। যদিও সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কেরা এবং কিছু মিডিয়ার লোকজন ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের পেছনে খালিস্তানি ও মাওবাদীদের উস্কানি ও মদতের কথা বলেছেন কিন্তু কোন প্রমাণ বা ঘটনা দেখানো যায়নি। দিল্লি-গুরগাঁও-নয়ডার রাজপথে লাখো কৃষক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রচন্ড শীতেও রাস্তা অবরোধ করে শিবির লাগিয়ে বসে আছেন। আন্দোলনচলাকালীন শীতলহর, বার্ধক্য ও আত্মহত্যা মিলিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রায় ৬০ জন মারা গেছেন।

কিন্তু এরপর? এভাবে অনন্তকাল তো চলতে পারেনা। আমরা যারা শহরে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে এই আন্দোলন দেখছি তাদের মনে হচ্ছে “ সির্ফ হঙ্গামা খড়া করনা মেরা মকসদ নহীঁ, মেরী কোশিশ হ্যায় কি ইয়ে সুরত বদলনী চাহিয়ে”।

‘শুধুমুদু ঝামেলা বাড়াতে কেন চাইব, চেষ্টা করি যাতে এই অবস্থাটা বদলে যায়’।

বিচারপতিদের বিশেষ অবস্থান ও কিছু উদ্বেগজনক ঘটনা

ইতিমধ্যে ঘটে গেছে কিছু ঘটনা।

কৃষকেরা ঘোষণা করেছেন যে আগামী ২৬ জানুয়ারি তারিখে সাধারণতন্ত্র দিবসে তাঁরা রাজধানী দিল্লিতে সরকারের সৈন্যবাহিনীর শৌর্য প্রদর্শনের সমান্তরাল এক ট্র্যাক্টর র‍্যালি করবেন। তাতে দিল্লি পুলিশ শান্তিশৃংখলা বিঘ্নের আশংকায় সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে পিটিশন দাখিল করে। অবশ্য সেদিন 4thpillars.com পোর্টালের একটি ভিডিও আলোচনায় কোলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বললেন—পুলিশ হল হোম ডিপার্টমেন্টের অধীন বিভাগ। ওদের কাজ হল আদেশ পালন করা । নীতিগত প্রশ্নে সুপ্রীম কোর্টে যাওয়া ওদের কাজ নয় , সেটা হোম ডিপার্টমেন্ট করবে।

আবার সংবিধান অনুযায়ী কৃষি রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ে। তাতে আইন তৈরি করার কাজ রাজ্যের, কেন্দ্র শুধু নীতিগত পরামর্শ দিতে পারে।কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে ‘সংযুক্ত সূচীতে খাদ্যের পরিবহন ও যোগান’ রয়েছে এই যুক্তিতে কৃষি ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের আইন প্রণয়ন করেছেন তা ‘অসাংবিধানিক’ বলে বাতিলের দাবিতে সুপ্রীম কোর্টে কিছু পিটিশন আগেই জমা পড়েছে।

সুপ্রীম কোর্ট সাংবিধানিকতার প্রশ্নটি আপাততঃ মূলতবি রেখে আগামী আদেশ পর্য্যন্ত ওই তিনটি আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখতে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে।এটি একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। কারণ, সংসদে পাশ হওয়া কোন আইনকে পরীক্ষা করে সর্বোচ্চ আদালত তাকে বাতিল করতে পারে কিন্তু মাঝপথে স্থগিতাদেশ দিতে পারেনা। এই যুক্তিতেই সুপ্রীম কোর্ট ধারা ৩৭০ বাতিল বা সি এ এ বা ‘লাভ জিহাদ’ আইন স্থগিত করেনি। বলেছে সবার যুক্তি-তক্কো শুনে হয় সঠিক নয় বেঠিক (অতঃ বাতিল)নির্ণয় দেবে।এটাকে কৃষকেরা তাঁদের নৈতিক জয় হিসেবে দেখছেন। কারণ, তাহলে এই আন্দোলনকে জনমানসে খালিস্তানি, পাকিস্তানি বা মাওবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া একটু কঠিন হয়ে পড়ে বৈকি!

কিন্তু এখানে সরকার স্থগিতাদেশ দিয়ে চারজনের এক কমিটি বানিয়ে নির্দেশ দিয়েছে কমিটি যেন দু’মাসের মধ্যে দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে তার রেকমেন্ডেশন কোর্টে পেশ করে।এছাড়া সুপ্রীম কোর্ট কৃষকদের আন্দোলনের অধিকার মেনে নিয়েছে , কিন্তু বলেছে ১) অন্যের অধিকার খর্ব করাও ঠিক নয়, ২) রিপাবলিক ডে’র অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি ঠিক নয়।

কিসানদের সংযুক্ত মোর্চার ঘোষণা – ওরা সরকারের সঙ্গে আরও আলোচনায় বসতে রাজি আছে, কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের তৈরি ওই কমিটির কাছে যাবেনা।

কারণঃ,

১ কৃষকরা তো সুপ্রীম কোর্টে কোন পিটিশন দেয়নি, কোন কেস বা প্রকরণে পার্টিও নয়। ওরা তো সরকারের কাছে আবেদন দিয়েছে ওদের মত না নিয়ে ওদেরই স্বার্থের পরিপন্থী আইন বাতিল করে দিতে।

২ এই একতরফা চারজনের কমিটি নিরপেক্ষ নয়। চারজনই ইতিমধ্যে সরকারের আইনের পক্ষে এবং আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখে বা ইন্টারভিউ দিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। যেমন, অর্থনীতিবিদ সুরজিত ভাল্লা, যিনি নীতি আয়োগ এবং সরকারের কৃষি মূল্য নির্ধারণ কমিশনে যুক্ত। অথবা মহারাষট্রের বড় বড় গন্না-কৃষকদের স্বার্থে খোলাবাজার এবং রপ্তানির দাবিতে বহুবছর ধরে মুখর “শ্বেতকারী সংঘটণা”র প্রতিনিধি। আজ ১৯ তারিখ কমিটির প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা । তার আগেই গ্রহণ লেগে গেল। ১৫ তারিখে একজন সদস্য, যিনি সরকারপক্ষীয় একটি কৃষক ইউনিয়নের নেতা, বর্তমান আন্দোলন এবং পাঞ্জাবের কৃষকদের সমর্থনে পদত্যাগ করলেন।

কেন্দ্রীয় সরকার আদালতে এবং সর্বত্র বলছেন- এটা মিথ্যে কথা যে রাজ্য সরকারদের সঙ্গে আলোচনা না করে সহমতি না নিয়ে এই তিনটি বিল তৈরি করা ও পাশ করানো হয়েছে। নীতি আয়োগের তত্ত্ববধানে কাউন্সিল অফ চিফ মিনিস্টারদের বৈঠকে এর খসরা অনুমোদিত হয়েছিল। অথচ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং, যিনি ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন, জোর দিয়ে বলছেন- এসব কিছুই এজেন্ডাতে ছিল না, আলোচনাও হয় নি। তাহলে কে সত্যিকথা বলছেন?

এই বৈঠক হয়েছিল জুন ২০১৯শে। বর্তমানে ‘সূচনার অধিকার’ আইনের সক্রিয় কার্যকর্তা অঞ্জলি ভার্গবের পিটিশনের উত্তরে নীতি আয়োগ জানিয়েছে যে এখনও(১৬ মাস পরেও) ওই বৈঠকের রিপোর্ট ও রেকমেন্ডেশন নীতি আয়োগের কাছে পেশ হয়নি।কাজেই ওরা উত্তর দেবে না। এই পারদর্শিতার অভাবই কৃষকদের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। ফলে ওরা সরকারের আশ্বাসন—মৌখিক বা লিখিত- কোনটাতেই ভরসা করতে পারছে না। তাই ওদের দাবি পার্লামেন্টের শীতকালীন সেশনে ওই তিনটে আইন বাতিল করে নতুন আইন পাশ করানো। কিন্তু সরকার করোনার অজুহাতে শীতকালীন সত্র পিছিয়ে সোজা বাজেট সেশনে মিলিয়ে দিচ্ছে।

গত সপ্তাহে সুপ্রীম কোর্টে ভারত সরকারের এটর্নী জেনারেল বলেন যে এই আন্দোলনের মধ্যে খালিস্তানি আতংকবাদীরা ঢুকে পড়েছে।আদালত বলে এমনি নয়, এফিডেফিট করে কে বা কাহারা ওই আতংকবাদী সেটা বলতে হবে।

তাই গত সপ্তাহের মাঝামাঝি এন আই এ(ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) গন্ডাখানেক আন্দোলনের সক্রিয় কার্যকর্তাকে – যারা খাবারের স্টল, তাঁবু ইত্যাদির বন্দোবস্ত করেছে এমন- বৃটেনের একটি খালিস্তানি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত বলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নোটিস দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে।

আন্দোলনকারী চাষিরা এটাকে আন্দোলনকে বদনাম করে ল’ এন্ড অর্ডার ক্যাটিগরিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখে ঘোষণা করেছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আগামী ১০ম বৈঠকে তারা এন আই এ’র নোটিস ইস্যু গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করবে।

সব মিলে কেস গুবলেট। ব্যাপারটা আদৌ সমাধানের দিকে এগোচ্ছে না। আমরা যারা শহুরে মধ্যবিত্ত তাদেরও এসব ক্রমাগতঃ শুনতে শুনতে ‘ঘিলু যায় ভসকিয়ে’ অবস্থা।

আপাততঃ আমরা দু’পক্ষের উক্তি-প্রত্যুক্তির জট ছাড়িয়ে ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।

উক্তি-প্রত্যুক্তির জট

মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে কৃষকদের সমস্ত আপত্তি মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবিত সংশোধনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কৃষকরা কেন অবুঝ? কারা ওদের মাথা খাচ্ছে? যারাই করুক, তারা সত্যিকারের কৃষকহিতৈষী নয়। বরং চাইছি, কৃষকেরা আন্দোলনের রাস্তা ছেড়ে আবার আলোচনায় বসুক।

আন্দোলনকারীরা বলছেন—বাজে কথা। আমরা কোন দলের কথায় নাচি না।সরকার আমাদের মূল দাবিকে এড়িয়ে গোল গোল কথা বলছে। আমরা চাইছি কিছু, সরকার বলছে অন্যকিছু, অর্ধসত্য। সবটা মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় সরকার নিজের এজেন্ডায় কোন পরিবর্তন করতে রাজি নয়।কাজেই আন্দোলন চলবে।

দু’পক্ষ নিজের নিজের অবস্থানে অনড়। ধনুকের ছিলা টানটান।

এখন ‘আল্লা জানে ক্যা হোগা আগে’।

সরকার বলছে গোটা দেশে ব্লক স্তরে বৈঠক এবং প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের কৃষক এবং আমজনতাকে বোঝানো হবে ওই তিনটি কৃষি সংস্কার আইন কৃষকদের ভালোর জন্যে আনা হয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের আশংকাগুলো কেন ভিত্তিহীন।

আসুন, আমরা বোঝার চেষ্টা করি দু’পক্ষের বক্তব্য, দু’পক্ষের যুক্তির ভালোমন্দ, দুভাগে। আমরা দেখব আন্দোলনের গোড়ার দিকে কিসানদের আইনগুলো নিয়ে কী সমস্যা ছিল , ওদের যুক্তির পক্ষে কী বলা হত। পরের পর্বে সমঝোতা প্রস্তাব ও আন্দোলনকারীদের আপত্তি।

সরকারের সংশোধনী প্রস্তাবগুলোঃ

সরকারের কৃষকদের কাছে পাঠানো সংশোধনী প্রস্তাবে আইন তিনটের মধ্যে এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট বা খাস্যশস্য মজুত করার অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে কোন কথা নেই। কিন্তু বাকি দুটো নিয়ে আছে।

এপিএমসি অ্যাক্ট বা মন্ডী তুলে দেওয়া এবং এমএসপি বাতিল করা নিয়ে সংশোধনী প্রস্তাবঃ

আইনে কোথাও মন্ডী বা এপিএমসি তুলে দেওয়ার কথা তো বলা হয়নি। তবু আমরা লিখে দিচ্ছি দুটোই থাকবে। মন্ডীর ভেতরে ন্যুনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) থাকবে, বাইরে থাকবে খোলা বাজার।

কৃষকেরা বলছেন--ধেত্তেরি। বাইরে ট্যাক্স ও কমিশন নেই, ভেতরে আছে। তাহলে বাইরের ক্রেতা সহজেই মন্ডীর চেয়ে বেশি দামে কিনবে। এভাবে দ্রুত মন্ডী এবং এমএসপি উঠে যাবে। আইনে লেখা নেই তো কি হয়েছে? তাইতো বলছি আইন করে দাও যে এমএসপির চেয়ে কম দামে কেউ কিনলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।ওই তো আমাদের রক্ষাকবচ, ওটা কেন কেড়ে নিচ্ছ?

ওটা সম্ভব নয়।

কারণ ক) এমএসপি কোনদিন আইন ছিল না, সরকারী আদেশে ১৯৬৬ সালে শুরু হয়েছিল, সরকারের আদেশে এখনও বলবৎ থাকবে।

খ) ন্যুনতম দাম বেঁধে দিলে আর ‘খোলা বাজার’ কথাটার কী মানে? মার্কেট প্রাইস ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরির মাধ্যমে ঠিক হবে। সরকার নাক গলাবে না।

কিন্তু লেভেল প্লেইং ফিল্ডের যুক্তি মানছি। রাজ্য সরকার চাইলে বাইরের ক্রেতার জন্যেও মন্ডীর সমান ট্যাক্স লাগাতে পারে। এবার হল তো?

কৃষকদের আপত্তি ছিল যে নতুন আইন মোতাবেক মন্ডীর বাইরে যে কেউ এসে প্যান কার্ড দেখিয়ে ফসল কিনতে পারে। এতে কৃষকদের ঠগের হাতে পরার সম্ভাবনা। নকল প্যানকার্ড তৈরি আকছার হচ্ছে।তাই সরকারের সংশোধনী হল বাইরেও ক্রেতাকে নামধাম রেজিস্টার করতে হবে যাতে কোন অজ্ঞাতকুলশীল এসে মাল নিয়ে পেমেন্ট না করে কেটে পড়তে না পারে।

এর পরে আর কী চাই?

বিচার ব্যবস্থার মধ্যস্থতা চাই। চাষীর কোর্টে যাবার অধিকার চাই। সরকার বলছেন তোমাদের ভালোর জন্যে বললাম যে ক্রেতা-বিক্রেতা মতভেদ হলে সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা কালেক্টরের তৈরি সমিতির মধ্যস্থতায় সমঝোতা করে ঝামেলা মিটিয়ে নাও। কেন খামোকা উকিলের পয়সা খরচ করে ‘তারিখ পর তারিখ, তারিখ পর তারিখ’ নেবে?

কৃষকদের বক্তব্যঃ ওসব বুঝেছি। খামোকা কেউ আদালতের দরজায় কড়া নাড়ে না। কিন্তু যদি কালেকক্টরের ফয়সালা আমার না পোষায় তাহলে কোর্টে যাব। সেই অধিকার কেন কেড়ে নিলে?

--বেশ, কৃষি বিবাদ সমাধানের জন্যে আলাদা একটা কোর্ট গোছের ব্যবস্থা করছি। আর কিছু?

কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক চাষ নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই আইনে ক্রেতার বা অগ্রিম দাদন দিয়ে নির্দিষ্ট দামে নির্ধারিত কোয়ালিটির ফসল কেনার কন্ট্রাক্টের পরও বাজারে দাম চড়লে ক্রেতা (যাকে আইনে ‘স্পন্সর’ বলা হচ্ছে) কোয়ালিটি বা পেস্টিসাইড বেশি এইসব অজুহাতে ফসল কিনতে অস্বীকার করতে পারে।মানে বিয়ের মন্ডপে বসে পাত্র ‘আমাকে অন্য মেয়ের ফটো দেখানো হয়েছিল’ বলে বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে যেতে পারে। এবং উলটে চাষীদের থেকে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। পাঞ্জাবে পোট্যাটো চিপ্স বানানোর জন্যে আলু কেনার কন্ট্র্যাক্টে আলুচাষীদের থেকে এক কোটি ক্ষতিপূরণ চেয়ে পেপসি কোম্পানির মামলার ঘা’ এখনো শুকোয়নি।

সরকার বলছে-আরে একটু মন দিয়ে দেখ।কৃষকের স্বার্থে এতে ভারতীয় কন্ট্র্যাক্ট অ্যাক্টের ‘ফোর্স মেজর’ (Force Majeure) শর্ত ঢোকান হয়েছে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা আকস্মিক মৃত্যু ইত্যাদির জন্যে যদি কৃষক চুক্তির শর্ত পূর্ণ করতে না পারে ,তাহলে তাকে কোন পেনাল্টি দিতে হবে না। বা কোন কারণে কালেক্টরের বা কোন কোর্টের বিচারে যদি কৃষক কোন লোকসানের দোষী হয় তাহলে তাকে শুধু বিবাদের টাকার মূল ফেরৎ দিতে হবে।যদি অন্য পক্ষ বা ক্রেতা শর্ত পূরণ না করে তাহলে তাকে শর্তের চেয়ে ৫০% বেশি পেনাল্টি দিতে হবে।

আন্দোলনকারীদের ভয় বড় কোম্পানি কোন না কোন অজুহাতে কৃষকের জমি নিয়ে নেবে বা বেচতে বাধ্য করবে। সরকার বলছে, এর ধারা ১৫ দেখ। স্পন্সর বা দাদনদেনেওলা পার্টি চাষির জমি বন্ধক রাখতে পারবে না বা জমিতে কোন স্থায়ী ধাঁচা দাঁড় করাতে পারবে না।যদি কোন অস্থায়ী কিছু বানায় সেটা চুক্তি শেষ হতেই স্পন্সরের নিজের খরচায় ভেঙে দিতে হবে, নইলে চাষি এর মালিক হয়ে যাবে।

কৃষক সন্তুষ্ট নয়। ভারত কিসান ইউনিয়নের নেতা বলছেন এই আইনের ধারা ১৬ তো বলছে- যদি রায় চাষির বিরুদ্ধে যায় তাহলে সরকার ল্যান্ড রেভেনিউ অ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তার মানে তো, সেই দাঁড়াল যে ওর জমি নিলাম করে বকায়া টাকা আদায় হবে।

কট্র্যাক্ট অ্যাক্টে দরাদরি করে দাম নির্ধারণের পদ্ধতি কী হবে? যদি খোলা বাজারে দাম বেড়ে যায়? তবে তো চাষির লোকসান!

সরকার বলছেন—দু’রকম দামের ব্যবস্থা রয়েছে। একটা হল আগে থেকে ফিক্সড প্রাইস। তাতে বাজারে দাম পড়ে গেলেও কৃষকের ক্ষতি নেই, বেড়ে গেলে লোকসান।

অন্যটি হল, একটা অংশ ফিক্সড বা পূর্ব নির্ধারিত , অন্য অংশটি ভ্যারিয়েবল বা বাজার দামের ওঠাপড়া (ধরুন এমএসপির চেয়ে খানিকটা বেশি বা কম) হিসেবে দু’পক্ষ মিলেমিশে বা দরাদরি করে জুড়ে নেবে। এতেও আন্দোলনকারী কৃষক সন্তুষ্ট নয়?

কৃষকেরা বলছেন ওসব হল শুদ্ধ আইনের কথা। গরীব বা সাধারণ কৃষক কবে আম্বানী আদানীদের সঙ্গে মামলা লড়ে পেরে উঠবে? সরকার কেন নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সরে যাচ্ছে? ছোট ও ক্ষূদ্র শিল্পের জন্যে ব্যাংক লোনের ব্যাপারে যেমন ১০০% গ্যারান্টি নিয়েছে তেমনই চাষিদের জন্যে এগিয়ে আসতে কেন অনীহা?

তাই চাষিদের দাবিঃ ১) ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের জন্যে আইন হোক। এর নীচে কেনা বেচা – মন্ডীর ভেতরে বা বাইরে, পাঞ্জাবে বা বাংলায়—আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষিত হোক। ওটাই হবে বেঞ্চমার্ক, ওটাই সরকারের পক্ষ থেকে চাষির জন্যে গ্যারান্টি।

২) ওই এমএসপি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে C2 উৎপাদন মূল্যের দেড়গুণা বা ১৫০% হোক।

সরকার এটা মানতে রাজি নয়।

কিন্তু যদি মিয়া-বিবি রাজি না হয় তাহলে সুপ্রীম কোর্টের কাজি কী করতে পারে!

কেন এই অচলাবস্থা? বর্তমান প্রতিবেদকের মতে এ হল পারস্পরিক

অবিশ্বাস ও দুটো আলাদা ইকোসিস্টেমের লড়াই।

আগামী কিস্তিতে আমরা আলোচনা করব ওই দুটো পয়েন্ট, এমএসপির কেন এল, খাদ্য সুরক্ষা আইন, রেশন ব্যবস্থা এবং উন্নত দেশের কৃষি ও খোলা বাজার নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসবে এই আন্দোলন শুধু দুটি রাজ্যের কৃষকের সমস্যা কিনা? এমএসপি কি শুধু কৃষকের স্বার্থে নাকি দেশের স্বার্থেও? সবশেষে আমাদের দেশে কৃষির সংস্কার চাই কিনা ও চাইলে কেমন সংস্কার চাই। (ক্রমশঃ)

0 comments:

2

প্রবন্ধ - স্যমন্তক দাস

Posted in


রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্তের জন্ম ১১ জুলাই ১৯১৫ সালে, কলকাতায়। প্রাথমিক শিক্ষা কলকাতায়, ম্যাট্রিক পাস ১৯৩১এ। তারপর Scottish Church College থেকে ১৯৩৫এ BA আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি তে MA, ১৯৩৭এ। পরে উনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে PhD করেন ১৯৫০এ, আর ১৯৫৫এ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জন মিলটন নিয়ে ওঁর DPhil গবেষণা, হেলেন গার্ডনারের তত্ত্বাবধানে শেষ করেন ১৯৫০এর দশকে। অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন কলকাতা, দিল্লি ও আন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। রবিবাবু ছিলেন International Comparative Literature Associationএর প্রথম ভারতীয় executive member। পরে জাতীয় গ্রন্থাগারের (National Library), Director General। কিন্তু, আজ আমি সেই অধ্যাপক রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্তের বিষয়ে বিশেষ কিছুই বলব না, আজ আমি সেই রবিবাবুর কথা বলব যিনি বাংলার ও কলকাতার অন্তত পক্ষে এক অংশ মানুষকে তাঁর পান্ডিত্য ও মানবিকতা দিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন, এবং তাঁর জীবন ও লেখার মাধ্যমে সেই মানুষদের একটা স্বচ্ছ, স্বাধীন চিন্তা ও ভাবনার পথ প্রদর্শন করেছিলেন।

রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় গত শতাব্দীর ৮০-র দশকের শেষের দিকে। আমি তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ পড়ছি। রবিবাবু কিছুদিন আমাদের প্লেটোর রিপাবলিকের উপর ক্লাস নিতেন। প্রথম থেকেই ওঁর বিষয়ে তিনটে জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল : অগাধ পাণ্ডিত্য, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং ওঁর হাস্যরস, যা কঠিন তত্ত্বকেও স্বচ্ছ্ব, সাবলীলভাবে আমাদের মতন প্রায় অশিক্ষিত ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে দিতে সমর্থ ছিল।

পরে যখন রবিবাবুর বাংলা ও ইংরেজি লেখাপড়ি, তখন এই তিনটি চারিত্রিক গুণ আবার স্পষ্ট দেখতে পাই। সাথে আরও দুটি গুণ উপলব্ধি করি। প্রথমত, ওঁর ইতিহাসচেতনা ও দ্বিতীয়ত, ওঁর বিনয়। আসলে শ্রেণীকক্ষে ও এই ইতিহাসবোধ আর বিনয় নিঃসন্দেহে উপস্থিত ছিল, আমরা কেবল সেগুলিকে তেমনভাবে লক্ষ করিনি।

আশির দশকের শেষ দিকেই নীরদচন্দ্র চৌধুরির আত্মজীবনীর দ্বিতীয় ভাগ, Thy Hand, Great Anarch! প্রকাশিত হয়। একদিন ক্লাসে রবিবাবু বললেন, “আসলে নীরদবাবুর আত্মজীবনী একজন মধ্যবিত্ত বাঙালীর ডিভাইন কমেডি।” মানে? আমরা প্রশ্ন করলাম। “মানে আর কী? নীরদ সি চৌধুরির জন্য কলকাতা হচ্ছে ইনফার্নো, দিল্লী পুর্গাতোরিও আর অক্সফোর্ড... (এখানে রবিবাবু একটু মুচকি হেসে, দু’-হাত ছড়িয়ে বললেন) অক্সফোর্ড হচ্ছে প্যারাডিসো!”

তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু এই একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে রবিবাবুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও যাকে ইংরেজিতে বলে critical acumen তা বোঝা যায়। ১৯৬৭ সালে নীরদবাবুর "দুই রবীন্দ্রনাথ" নামক প্রবন্ধ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর প্রমথনাথ বিশির অনুরোধে রবিবাবু একটি অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন – “পড়তে হয়েছে বিস্তর” (‘কথাসাহিত্য’, ১৩৭৪) – যেখানে এক-এক করে নীরদচন্দ্রের উক্তি খণ্ডন করে রবিবাবু প্রমাণ করেন যে বাস্তবে নীরদবাবুর প্রবন্ধের বিষয় রবীন্দ্রনাথ নন, বরঞ্চ উনি স্বয়ং। রবিবাবুর ভাষায় “প্রবন্ধটি মূলত আত্মকথা” (বাঙালী কি আত্মঘাতী ও অন্যান্য রচনা, পৃ ৩৩)। নীরদবাবুর লেখা যে মূলতঃ তাঁর নিজের বিষয়েই, এবং তারই জন্য সে লেখার মধ্যে ইতিহাস বা critical vision প্রায় অনুপস্থিত, তা রবিবাবু অন্য লেখাতেও দেখিয়েছেন, যথা ‘বাঙালি কি আত্মঘাতী?’ (পরিচয়, ১৪০৫) যেখানে রবিবাবু নীরদবাবুর লেখার বিষয়ে বলেছেন, “বাঙালি তুমি দুঃখ করিয়ো না। - নীরদবাবুর হাতে কেবল তুমি মর নাই, সারা বিশ্ব মরিয়াছে।”

নীরদবাবুর বিষয়ে রবিবাবুর লেখা দিয়ে শুরু করার একটা কারণ হল – নীরদবাবু যে যে বিষয়ে বাঙালির অক্ষমতা বা ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তার মধ্যে অনেক বিষয়ে রবিবাবু দেখিয়েছেন যে বাঙালির অনেককিছুই আছে যা নিয়ে সে গর্ববোধ করতে পারে। এইসব প্রবন্ধে রবিবাবু রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, নজরুল, বিবেকানন্দ থেকে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে যা লিখেছন তা এখনও পাঠককে নতুনভাবে এই মনীষীদের নিয়ে ভাববার ইন্ধন যোগাতে পারে।

রবিবাবুর সব লেখা আলোচনা করার সময় ও স্থান এখানে নেই। একটি প্রবন্ধ থেকে আমি যা বলতে চাই তা বোঝাতে চেষ্টা করছি। ১৯৫৬তে দেশ পত্রিকাতে প্রকাশিত ‘মাইকেল ও বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে রবিবাবু লিখেছিলেন যে যদিও ‘আপাতদৃষ্টিতে’ মধুসূদন ও বিদ্যাসাগর ‘দুই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ’ কারণ ‘একজন বিলাসী, উচ্ছৃঙ্খল, আশঙ্কায় প্রমত্ত; আর একজন বিলাসিতা শূন্য, সংযত, নিরাসক্ত’ বাস্তবে ‘এই বৈসাদৃশ্যকে আমি বাহিরের বৈসাদৃশ্য বলিয়া মনে করি’। বাকি প্রবন্ধে রবিবাবু মধুসূদন ও বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ও তাঁর সাথে মধুসূদনের জীবন ও কাব্য রচনার এক চমৎকার ব্যাখ্যা করেন। “মাইকেল বিদ্যাসাগর সম্পর্কের ... শেষ অধ্যায়টির ট্র্যাজিডি” আলোচনা রবিবাবু যদিওবা করেছেন, ওঁর উক্তি হল যে এই দুই মহাপুরুষ “বাংলার নূতন যুগের যমজ সন্তান”।

বাংলার এই নতুন যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক রবীন্দ্রনাথ – “আমি রবীন্দ্রনাথকে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বলি কারণ তিনি যেন আমাদের সমস্ত মনপ্রাণ জুড়িয়া আছেন।” (‘শ্রেষ্ঠ বাঙালী কে’, ‘দৈনিক স্টেট্‌স্‌ম্যান',২০০৪) – তাঁর বিষয়ে রবিবাবু বহু প্রবন্ধ লিখেছেন, বাংলায় ও ইংরেজিতে।

ইংরেজি লেখাগুলির মধ্যে একটিতে রবিবাবু বিলাপ করেছেন যে ‘এক অর্থে বাঙালীরা রবীন্দ্রনাথকে অবহেলা করেছেন।‘ এই প্রবন্ধ (‘Poet of Poets’) রবিবাবু শেষ করেন এই প্রশ্ন করে, “When will Bengal rediscover its Bengali poet?”

বাস্তবে পঞ্চাশের দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের উপর রবিবাবুর যে প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলি যদি একটা সংকলনে পুনঃপ্রকাশ করা যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঙালি পাঠক বহুমুখী রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারেন। তবে এই ইন্টারনেট আর মেগাসিরিয়ালের যুগে এই কাজ কি কেউ করতে রাজি হবেন?

এই ধরণের সংকলন যদি প্রকাশিত নাও হয়, রবিবাবুর লেখায় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে লেখা প্রবন্ধগুলি ছাড়াও অন্যান্য লেখায় রবিবাবু রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, ভাবনা, কবিতা, প্রবন্ধ ও যাকে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন, তার ব্যবহার প্রায়শই করেছেন। যেমন ধরা যাক ১৯৯৯-এর ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন’ বক্তৃতাটি (চন্দন ভট্টাচার্য স্মারক বক্তৃতা, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ২৫ এপ্রিল ১৯৯৯)। বক্তৃতা শুরু করেছেন রবিবাবু এই বলে, “এখন চারিদিকে তাকাইয়া মনে হয় বাঙালি প্রাণহীন হইয়া পড়ে নাই, মননশীলতায়ও সে তাহার পূর্বগৌরব হারাইয়াছে।” আর এই অধঃপতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবিবাবু লিখছেন, “মননশীলতা বা চিন্তাশীলতা গভীর অধ্যয়নের ফলে লাভ করা সম্ভব। কিন্তু হৃদয় কোথায় পাইব?... এই হৃদয়ের দুয়ার কী করিয়া খুলিব? ইহা বন্ধ করিল কে?... আমরা হৃদয়হীন কারণ আমরা আত্মাভিমানী কিন্তু এই অহংবোধ কী করিয়া বর্জন করিব?” এই প্রশ্নের উত্তর উনি দু’জন মহাপুরুষের জীবন ও বাণীতে খুঁজে পান। একজন হলেন বুদ্ধদেব, আর দ্বিতীয়জন হলেন রবীন্দ্রনাথ।

এই দুইজনের জীবন, কর্ম ও উক্তিতে রবিবাবু পেয়েছেন সেই গুণ, যা মানুষকে তার আত্মকেন্দ্রিকতা অতিক্রম করতে সাহায্য করে : করুণা। ঠিক যমন বুদ্ধদেব “করুণাকে চিত্তের শ্রেষ্ঠ সম্পদ” বলে মনে করতেন, ঠিক তেমনই রবীন্দ্রনাথও “তাঁহার মাতৃমন্দিরের সকল সাধককে একত্র হইতে বলিয়াছিলেন”। এই সাধক কারা? কবির ভাষায় “সকল যোগী, সকল ত্যাগী, সকল দুঃসহ দুঃখভাগী”। রবিবাবু বলছেন, আমাদের দেশে যদি এখন এক দুঃসময় আসিয়া থাকে তাহা হইলে তাহার প্রধান কারণ এই যে আমরা আমাদের আপনজনের দুঃখে দুঃখ পাইনা। আমরা কাহারও দুঃখ দূর করিতে সচেষ্ট হই না”, অর্থাৎ, আমাদের এই স্বার্থপর, স্বেচ্ছাচারি জীবনে এখনও রবীন্দ্রনাথের থেকে আমরা শিখতে পারি কিভাবে আবার কবে করুণার উন্মেষ ঘটিয়ে আমরা মানুষের মনুষ্যত্ব ফিরে পেতে পারি।

এক অর্থে, রবিবাবু যখনই কোন ব্যক্তির বিষয়ে লিখেছেন, সেই লেখা হচ্ছে সেই ব্যক্তির মনুষ্যত্ব, তাঁর মানবিকতার এক ধরণের সন্ধান। এবং এই মনুষ্যত্বের সঙ্গে অনেক সময়ই জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিকতা। রাজা রামমোহন রায়ের বিষয়ে রবিবাবু লিখছেন, “যে আন্তর্জাতিকতার আদর্শ আমরা আজ মাথায় করিয়া চলিতেছি তাহার কতিপয় প্রবর্তকের মধ্যে রামমোহন অন্যতম।” আর এই আন্তর্জাতিকতা যে একই সঙ্গে গভীর দেশপ্রেমের প্রতীক তা এই উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় : “রামমোহনের নিবিড় বঙ্গবোধ এক নিবিড়তর ভারতবোধে পরিণত এবং সেই ভারতবোধই তাঁহার বিশ্ববোধের উৎস” (‘রাজা রামমোহন রায়’, দৈনিক স্টেট্‌স্‌ম্যান, ২২ মে ২০০৫)।

রামমোহনের মধ্যে যে মানবিক আন্তর্জাতিকতা রবিবাবু পেয়েছেন, সেটা উনি আর কয়েকজন ভারতীয়ের মধ্যে চিহ্নিত করেছেন। যেমন ধরা যাক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের উপর প্রবন্ধ, যেখানে তিনি লিখছেন : “আমি মনে করি মার্ক্সবাদের সঙ্গে ভারতের আদর্শের আত্মীয়তা প্রসঙ্গে হীরেনবাবু যত কথা বলিয়াছেন তাহা সারা বিশ্বের সামনে উপস্থিত করার সময় আসিয়াছে”। রবিবাবুর দৃষ্টিতে, রামমোহনের মত হীরেন্দ্রনাথের মধ্যেও সেই একই ধরণের মানবিকতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই যেটা দেশের মাটি থেকে উৎসারিত হয়ে সারা বিশ্বকে নিজের করুণার আওতায় নিয়ে আসতে চায়।

এই চারিত্রিক গুণ রবিবাবু পেয়েছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জীবন ও কর্মে। “আমরা যাহারা বাঙালিকে এক চিন্তাশীল জাতি বলিয়া কিছু গর্ববোধ করি, আমরা মনে করি, রামেন্দ্রসুন্দর বাঙালির চিন্তার ইতিহাসে এক শ্রেষ্ঠ পুরুষ” (‘আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর’, আলেখ্য, ১৯৩৭ বঙ্গাব্দ)। যে রামেন্দ্রসুন্দরকে বাঙালি আজ প্রায় ভুলে গেছে, তাঁর আদর্শকে রবিবাবু এইভাবে বর্ণনা করেছেন : “আমরা যাহাকে আধ্যাত্মিকতা বলি তাহার আভাসমাত্র রামেন্দ্রসুন্দরের রচনায় নাই। অথচ তিনি মানুষের এক মহৎ আদর্শে বিশ্বাসী”।

এই মানবমুখী আদর্শবাদ রবিবাবু সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, স্বামী বিবেকানন্দ, হেনরি লুইভিভিয়ান ডিরোজিও, এবং আরও অন্য মনীষীদের মধ্যে লক্ষ করেছেন। যদিও এই মানবিকতা, এই আদর্শবাদ, এবং যেটাকে আমরা আন্তর্জাতিকতা বলছি, তার প্রকাশ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আলাদা, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তার একটা নিজস্ব রূপ, একটা নিজস্ব বিকাশ, একটা নিজস্ব গতি আছে। রাধাকৃষ্ণণের ক্ষেত্রে সেটা যদি হয় এই যে, উনি “ভারতীয় ধর্ম-দর্শন, ভারতীয় সংস্কৃতির সার কথা, ভারতীয় সভ্যতার আদর্শ জগৎসভার প্রচার” করা (‘যুগশিক্ষক রাধাকৃষ্ণন’; দৈনিক স্টেটসম্যান; ৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৪), তাহলেডিরোজিওর ক্ষেত্রে এই মানবিকতার প্রকাশ পায়, রবিবাবুর উক্তিতে, “তিনিই আমাদের প্রথম স্বাদেশিকতার কবি” (“ডিরোজিও”; ১৭ এপ্রিল ১৯৯৫, প্রেসিডেন্সি কলেজের ডিরোজিও হলে প্রদত্ত ভাষণ)। এই ভাষণে রবিবাবু ডিরোজিওকে “একজন ইংরেজভাষী বাঙালি” বলে চিহ্নিত করেছেন, এবং এই উক্তির পিছনে আছে রবিবাবুর বিশ্বাস, শ্রেষ্ঠ মানুষ সেই যে নিজের সংকীর্ণ অহংবোধের উর্দ্ধে গিয়ে বৃহৎ মনুষ্যত্বের জন্য সহানুভুতি বোধও প্রকাশ করতে পারে।

ঠিক এই ধরণের কথা আমরা দেখতে পাই যখন রবিবাবুর‘কাজী নজরুল ইসলাম’ (পরিচয়, শারদীয় ১৪০৬ বঙ্গাব্দ) প্রবন্ধটি পড়ি। এখানে উনি লিখেছেন : “তাঁহার সমস্ত রচনার মধ্যে এক উজ্জ্বল সরস ব্যক্তিত্বের পরিচয়। সেই ব্যক্তিত্বের বিচিত্রভাব, বিচিত্র চিন্তার সমাবেশ, এবং এই ধারণা ও চিন্তার যেমন বিস্তার তেমন গভীরতা। তাঁহার কাব্য আমরা যে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখতে পাই তাহার মূলে এই চিন্তা ও ভাবের বিস্তার ও গভীরতা”। নিজের সংকীর্ণ ধর্মীয় পরিচয়ের উর্দ্ধ যেতে সফল হয়েছিলেন বলেই, “নজরুল নিজেকে বাঙালী বলিয়া মনে করিতেন। তিনি হিন্দু কি মুসলমান এই প্রশ্ন তাঁহার কাছে অবান্তর এবং বাঙালী সম্বন্ধে তাহার একটা গর্ববোধ ছিল।

রবিবাবুর বাংলা ও ইংরেজি লেখার বৈচিত্রের মধ্যে কেবল দু’টি দিক ইঙ্গিত করে এই ছোটো লেখা শেষ করব।

প্রথমদিকটি হ’ল রবিবাবুর দেশপ্রেম বা যাকে বলা যেতে পারে জাতীয়তাবোধ। প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে রবিবাবু এটা দেখিয়েছেন যে ভারতবর্ষ বিশ্বকে যা দিয়েছে – তা মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ হোক বা বিবেকানন্দের মানবদর্শন, বাল্মীকের কাব্য বা রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা –তার একটা নিজস্ব সত্তা আছে যা ইউরোপীয় প্রভাব দ্বারা ব্যাখ্যা করা অনুচিত। এই সত্তা, এই ভারতীয়তা, আমরা বোধহয় আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছি, এবং এই সত্তা হারালে দেশের ও দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষতি হতে বাধ্য। দুই ভাষায় রচিত প্রবন্ধে রবিবাবু তাঁর পাঠকদের সতর্ক করেছেন যে একটা গোষ্ঠি, জাতি বা দেশ শুধু অনুকরণ করে মহান হতে পারে না, গোটাবিশ্ব থেকে তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহ করে সেগুলিকে বুঝে, আপন করে, সঠিক প্রয়োগ করলেই একটা গোষ্ঠী/জাতি/দেশ নৈতিক ও মানসিক অগ্রগতির পথে পদার্পণ করতে পারে।

হিন্দুধর্ম বনাম হিন্দুত্ব নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রবিবাবু নিজেকে হিন্দু বলে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করতেন না, তবে উনি স্পষ্ট বলেছেন যে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে সব হিন্দুত্ববাদী দলগুলি হিন্দু ধর্ম ব্যবহার করে ক্ষমতা গ্রাস করার চেষ্টা করছে তারা না হিন্দু ধর্মকে বোঝে না ভারতবর্ষকে। “What is Hinduism” প্রবন্ধে উনি লিখেছেন – “The Sangh Parivar is degrading our sublime and humane religion into an aggressive or Jehadi decline”।

হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলি যে এককথায় ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে অগ্রাহ্য করছে, তা রবিবাবুর অনেক প্রবন্ধ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে সে সব প্রবন্ধ যেগুলিতে উনি সরাসরি হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ করছেন বা করেননি। (অনেক ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে কারণ ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে হিন্দুত্ববাদী দলগুলির আবির্ভাবের আগেই এই লেখাগুলি রচিত হয়েছে।)

‘ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ’ (দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ) বা ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ বা ‘বঙ্কিম কল্পিত মানবধর্ম’ (দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ) বা বিবেকানন্দ বিষয়ে রবিবাবুর উক্তি পড়লে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যে হিন্দু ধর্মের কথা রবিবাবু বলছেন, সেটা একটা গোঁড়া, সংকীর্ণ, ইসলাম-বিরোধী ধর্ম নয়। রবিবাবুর শব্দে, “...মানবধর্ম কি না সকল মনুষ্যের ধর্ম অর্থাৎ বিশ্বজনের ধর্ম। রবীন্দ্রনাথও এই অর্থে মানবধর্ম শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন, Comte বল, রামমোহন বল, কেশব সেন বল, বিবেকানন্দ বল, শ্রীঅরবিন্দ বল – সকলেই তাঁহাদের স্ব স্ব ভাষায় এই মানবধর্মের কথা বলিয়াছেন।... বঙ্কিমের মানবধর্ম এই মানবতার ধর্ম। সে ধর্ম মানুষের ধর্ম, বিশ্বমানবের ধর্ম। ইহা মানবতার ধর্ম বলিয়াই সকল মানুষের ধর্ম” (‘বঙ্কিম কল্পিত মানবধর্ম’)।

ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধে রবিবাবু এই বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছেন, বিশেষ করে গান্ধিজির উপর রচিত প্রবন্ধগুলিতে।‘Swami Vivekananda’s Concept of Morality’প্রবন্ধে রবিবাবু দেখিয়েছেন যে বিবেকানন্দের ন্যায়বোধ, বুদ্ধের বা রবীন্দ্রনাথের ন্যায়বোধের মতন, অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল সেই করুণাবোধের উপর। “It (এই করুণাবোধ যেটা আবার একধরনের মানবমুখী আদর্শবাদ) is also the foundation of his (বিবেকানন্দ) ideal of universal religion, of human fellowship and of man’s true freedom.”।

অন্যত্রও রবিবাবু দেখিয়েছেন কিভাবে যদি আমরা কেবলমাত্র নিজেদের (বা নিজেদের দল বা গোষ্ঠী বা ধর্মের) জন্য ভাবনা-চিন্তা করি তাহলে আমরা শুধু অন্যদের নয়, আমাদের নিজেদের ক্ষতি করতে বাধ্য।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।“ এই পাপ রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত কখনো করেননি। কিছু লেখায় যদিও উনি ভারতীয়দের, এবং বিশেষ করে বাঙালিদের মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাকে তিরস্কার করেছেন, মোটের উপর উনি মানুষের উপর আস্থা হারাননি। লেখার পর লেখায় উনি আমাদের দেখিয়েছেন কীভাবে, এত অনাচার, এত মিথ্যাচারের মধ্যেও, মানুষের সৃজনশীলতা মানুষের মূল্যবোধ এখনো ধরে রাখার যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে। এই মানবিকতার জন্য আজও রবিবাবুর লেখার মূল্য অপরিসীম।

2 comments:

7

প্রবন্ধ - দেবাশিস বিশ্বাস

Posted in

অজ্ঞতার দিনরাত্রি

ছোটবেলায় আমরা জানতাম যে আমাদের মানুষ হতে হবে আর মানুষ হওয়া মানে দেশ ও দশের মুখ উজ্জল করা। উজ্জল করা কাকে বলে সেই বিষয়ে খুব একটা পরিস্কার ধারনা না থাকলেও একটা বিষয় বুঝতাম যে বিশাল বাড়ি বা দামী গাড়ি থাকলেই মানুষ হওয়া বোঝায় না।দারুন বৈভবশালী জীবন যাত্রাও খুব একটা গৌরবের বস্তু নয়।বরং হঠাৎই কিছু দামী জিনিস কেনা হয়ে গেলে সেটা জাহির করতে লজ্জাই লাগত।বস্তুত যে সব বন্ধু ও খেলার সাথিদের সাথে বড় হয়ে উঠছিলাম তাদের মধ্যে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে বা সাট্টা খেলে- হয়ত অল্প নেশাভাং ও করে- এবং পড়াশুনার সাথে কোনও রকম সম্পর্কহীন ছেলেরাও প্রচুর সংখ্যায় ছিল।অনেকেই বস্তীতে থাকত, তাদের যে ঠিকঠাক খাবার দাবার জুটত এমনও নয়।এখন স্পনসরশিপ নিয়ে নানা ছুঁতমার্গের কথা শুনি, অথচ আমাদের অনুজপ্রতীম বন্ধু ভুতো সাট্টায় আশাতিরিক্ত অর্থ রোজগার করে, অর্থাৎ তিনটি সংখা ক্রমপর্যায় সহ মিলিয়ে দিয়ে, সেই অর্থে একদিন ব্যাপি ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।ভুতো মেমোরিয়াল শিল্ড নামক সেই প্রতিযোগিতায় আমরা সকলেই খেলেছিলাম, এবং সবচেয়ে বড় কথা, নিরপেক্ষতার স্বার্থে ভুতো শুধু যে খেলেনি তা নয়, বরং রেফারি হিসেবে সবকটি খেলা পরিচালনা করেছিল। অথচ আমরা কয়েক জন ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে পড়তাম আর টাই পড়েই ইস্কুলে যেতাম।হেলথ ড্রিঙ্ক আর জীবাণুরোধক পাঁচিলের আড়ালে নিরাপদে থেকে কেরিয়ার তৈরির জন্য প্রস্তুত হওয়ার পরিবেশটাই ছিল না।সন্তানদের পুষ্টি বা ইমুইনিটি দূরে থাক, ছোটখাটো শরীর খারাপ বা চোট আঘাত নিয়েও বাবা মায়েরা সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিলেন।আমাদের পেট পরিস্কার না হলে তাদের কখনও চিন্তিত মুখে বাথরুমের সামনে অপেক্ষা করতে দেখিনি।বেশী মিষ্টি বা লজেন্স খেলে যে দাঁতে পোকা (আমরা ক্যাভিটির নামই শুনিনি তখন) হবে সেই বিষয়েও তাদের উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলায় অথবা ইস্কুলের স্পোর্টসে আমরা হারলাম কী জিতলাম সেটাও তাদের কাছে খুব একটা পাত্তা পায়নি।বাচ্চাদের জন্য আলাদা ঘরের কথা ভাবাই যেত না।আমাদের “ক্রাঞ্চি ব্রেকফাস্ট” ছিল না, রোজকার খাবার দাবারের মধ্যে এনারজি জোগাবার জন্য “ফ্রুট আ্যন্ড নাট” ছিল না। আমাদের মা বাবারাও ফাইবার, প্রবায়োটিক এত সব জানতেন না। ফলে আমাদের মত শয়তানদের সামলানোর জন্য তারাও সেসব খেতেন না।তা সত্বেও তাদের চড়-থাপ্পর অথবা হাতপাখার দাপট কিছুমাত্র কম ছিলনা।টিফিনে প্রায় বাঁধাধরা ছিল চিনি লাগানো বিস্কুট আর বিবর্ণ একটি সন্দেশ বা রুটি তরকারী। ফলে আমরা নির্বিচারে ফুচকা-ঘুগ্নী-কুল-ঝালমুড়ি এবং হজমি খেয়েই মোটামুটি স্বাধীন জীবন যাপন করতাম। এমনকি আমাদের পেট পরিষ্কার হলো কিনা তা জানতে বাড়ির বড়রা চিন্তিত মুখে বাথরুমের সামনে অপেক্ষা করতেন না।কঠিন নজরদারি না থাকায় আমাদের স্বাধীনতা ক্ষেত্র বাড়ির মধ্যেও অল্প বিস্তর বিস্তৃত ছিল। নিজেদের বাড়ির রেডিও বা রেকর্ড-প্লেয়ার (যে অল্প সংখ্যক বাড়িতে ছিল)তার গুনমান নিয়ে বড়াই যে করে অন্যদের পরিহাস করা যেতে পারে সে কথা মনে হয়নি কখনও। দুপুরের রান্না শেষ হলে খোলা উনুনের পড়ে যাওয়া আঁচে বড় গামলায় সোডা ও গোলা সাবানের মিশ্রণে ছাড়া জামাকাপড় সিদ্ধ হত।তারপর উঠোন জুড়ে দড়ি টাঙ্গিয়ে শুকোন।তারপরে আবার আরেকটা তরল লাগিয়ে সেগুলিকে যে সুগন্ধী ও আরামদায়ক করা দরকার সে ধারনাও ছিলনা।ইস্কুলের বই আর মাস্টারমশায়দের পড়ানো থেকেই মোটামুটি পড়াশোনা হয়ে যেত, “লারনিং অ্যাপ” ছিলও না আর তার প্রয়োজনও বোধ করিনি।বরং আগ্রহ ছিল লুকিয়ে পড়া হলদে মলাটের বইয়ের পাতায়।সকালে (ছুটির দিনে) খেলা অথবা ইস্কুল, বিকেলে খেলা ও সন্ধে্বেলা পড়তে বসে ঘুমনো। এই রকম নিরুপদ্রব ও অনুত্তেজক দিন যাপনের ফলে আমরা না হতে পেরেছি কম্পিটিটিভ না হতে পেরেছি কেরিয়ার ওরিয়েন্টেড।লেখাপড়া শেষ করে বাবা কাকাদের মতো হাতব্যগ ও টিফিনকৌটো নিয়ে দশটা পাঁচটা অফিস করবো এই ছিল সর্বোচ্চ আকাঙ্খা। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র যে আসলে প্রতিযোগীতা এবং সেই প্রতিযোগীতায় জিততেইই হবে, এরকম কোন তাগিদ আমাদের মধ্যে ঢোকানোই হয়নি। আমাদের মায়েরা ভোরবেলা কয়লার উনুনে আঁচ তুলে ইস্কুল-কলেজ-অফিস যাত্রীদের পাতে সময়মতো ভাত দিতে এত ব্যস্ত থাকতেন যে আমাদের সঙ্গে দৌড়ে আমাদের মনে জেতার অভ্যাস তৈরী করাটাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেননি। ।ফলে যা হওয়ার তাই হল।আমরা স্মার্ট হলাম না; অনলাইনে জিনিস কেনায় সড়গড় হতে পারলাম না। সেই বাজারে গিয়ে মাছের দোকানে-আলুর দোকানে আড্ডা মেরে রিকশা করে বাজার আনার প্রাচীন অভ্যাস রয়েই গেল।রেস্তোরায় খেতে গিয়ে খাদ্য-পানীয় পরিবেশকদের কিভাবে ডাকবো সে বিষয়ে শিক্ষা না থাকায় একবার অর্ডার দেওয়ার পরে সেটা আর পালটানো গেলনা।শর্টস পড়ে শিস দিতে দিতে আঙ্গুলের ডগায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে গাড়িতে স্টার্ট দেওয়া অধরাই রয়ে গেল।বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন-জন্মদিন-শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে পার্টি করার সুযোগ হলনা। বারমুডা যে এক রকমের প্যান্ট সেকথা জানতে এত দেরী হয়ে গেল যে আমরা বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের রহস্য উদ্ধার করতে পারলাম না।ঢোলা পায়জামা পড়েই দিন কেটে গেল।ভোরবেলা কয়লার উনুনে আঁচ দেওয়ার ধোঁওয়ায় দিনের শুরু আর রাতে সদর দরজায় তালা পড়ে দিনের শেষ, এই সীমার মধ্যেই ছিল আমাদের সব গতিবিধি।আমরা জানতেই পারলাম না যে কোনটা আধুনিক গ্লোবাল উচ্চারন, ‘ডিরেক্ট’ না ‘ডাইরেক্ট’; ‘ফিনান্স’ না ‘ফাইনান্স’।‘সিওর’ কে ‘স্যুয়োর’ বলার কায়দাও রপ্ত হল না।সরস্বতী পূজো আর দোলের দিনে আমাদের চিত্ত নিশ্চিত ভাবেই একটু বেশীই চঞ্চল থাকত।আড় চোখেই যেটুকু দেখা। রোজকার চেনা হলেও, “হাই বেবী” বলে সম্বোধনের সাহস দেখাতে পারিনি। ইস্কুল শেষ করে কলেজ এবং তারও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরেও আমাদের জীবন যে একই রকম রয়ে গেল তার প্রধান কারণ ছিলেন আমাদের শিক্ষককুল।পেপার লেখা বা বিদেশ যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্বন্ধে আমাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না করে তারা আমাদের সেই সব আকাশছোঁওয়া প্রাতিষ্ঠানিক মিনারগুলিকে প্রশ্ন করতে শেখালেন।নিতান্তই আটপৌরে দিনযাপন করা এই মানুষগুলির কাছেই জানলাম কিভাবে পাড়া-প্রতিবেশী-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনদের সামনে বিদেশী ডিগ্রীধারী-সুউপায়ী-প্রবাসী ভালো ছেলের উদাহরণ না হয়েও জীবন কাটানো যায়।সোজা কথায় স্যানিটাইজারের বদলে খোলা আকাশের নীচে বৃষ্টির জলেই ভিজতে হলো।“Reading Capital” পড়ে আমরা জীবনের রকমারি অর্থ খোঁজার কাজে ব্যাপ্ত হলাম।সুশীল সমাজের আজীবন-সদস্য পদ গ্রহণ করা, আলিগরী পায়জামা পড়ে পচিশে বৈশাখ নিয়ম করে রবীন্দ্রসদনে যাওয়া আর অষ্টমী পূজোয় অঞ্জলি দেওয়া সব অধরাই থেকে গেল।কন্টিনেন্টাল খাবারকে বিজাতীয় ভেবে আমরা অনাদির মোগলাই পরোটা আর কষা মাংসের আকর্ষণেই আটকে থাকলাম।

জ্ঞান ও জীবন এখন পরিস্থিতির কারনে মশা-ছারপোকা-উই অথবা আরশোলা কিংবা ইদুর মারার ওষুধের থেকেও জনপ্রিয় হয়েছে করোনা ঠেকানোর ওষুধ। মাস্ক-সাবান-স্যানিটাইজার ছাড়িয়ে এখন বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে যে কোন কোন কোম্পানীর তৈরী দেওয়ালের রঙ মায় প্লাইউডও করোনা ঠেকাতে কার্যকর। আর ইমিউনিটির তো কথাই নেই। দুধ-হলুদ থেকে শুরু করে রান্নার তেল, এমনকি কাঁচাকলা ও তেলাকুচো পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে ইমিউনিটির জমিদারি নিয়ে বসে আছে। এখন চেনাজানা মানুষেরা, যাদের আমরা কখনও সন্দেহ করিনি, তাদের স্বাস্থের গূঢ় রহস্য প্রকাশ করছেন। আমরা এখন জানতে পারছি বুলবুলি পিসীর মাসতুতো ননদের জা ছোট থেকেই হলুদ ছাড়া দুধ খাননি। অথবা পাড়ার টাবলুদার খুড়তুতো শালা দুবেলাই ভাতের পাতে তিতপটলের পাতা পাঁচফোড়ন দিয়ে বেঁটে খান। রহস্যের কি শেষ আছে! বাচ্চার ঘ্যানঘ্যানে কান্নার আসল কারণ যে ভেজা ন্যাপি, অথবা রান্নায় কোন তেল দিলে এন্তার তেলেভাজা খেলেও যে কলজে টসকে যাবেনা, অথবা ফাইবার দেওয়া বিস্কুট খেলে যে পেট পরিষ্কার হয়ে মন ভালো থাকে, ইত্যাদি নানাবিধ বিজ্ঞাপনী তথ্য রোজই আমাদের জ্ঞান বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন এখন সৌন্দর্য বৄদ্ধির উপাদান অথবা স্বাস্থবর্ধক পানীয়ের সীমানা অতিক্রম করে আমাদের জীবনধারনের সচেতনতা তৈরী করতে সক্রিয় হয়েছে। বিজ্ঞাপনের পর্দায় বাবা মায়েরা যখন সন্তান কে উইনার অথবা গ্লোবাল তৈরী করার পন্থা তুলে ধরছেন, তখন এটাও বোঝা যায় যে বিজ্ঞাপন আমাদের মূল্যবোধ তৈরীর ক্ষেত্রেও হাত বাড়িয়েছে। বিজ্ঞাপন আমাদের বোঝাচ্ছে যে আধুনিক হতে গেলে প্রত্যেককে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দী হতে হবে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রচন্ড গতিতে ছুটে প্রথম হতে হবে। স্মার্ট ফোন আর স্মার্ট টেলিভিশন সেটের সাথে মানানসই স্মার্ট মানুষ, যার সমস্ত দিনটাই ডিজিটাল ও দ্রুতগতি। সেই স্মার্ট পরিবারের শিশু অনলাইনে অডিও ভিসুয়াল শিক্ষা লাভ করে। তার মা পাশে বসে সেই স্টাডি মেটিরিয়ালের মান পরখ করেন। বাবা চিন্তিত সেই শিক্ষার সময়োপযোগিতা নিয়ে। শিশুরা একসাথে বসে কম্পিউটারে ব্রেন-গেমস খেলে। সন্তানদের বন্ধু বেছে দিতে অভিভাবকেরা যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন। সন্তান দ্রুত কম্পিউটার কোড লিখতে শিখলে মা-বাবা গর্বিত হন। অনলাইন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পরা কিশোর-কিশোরীর স্বপ্ন কম্পিটিটিভ পথ ধরে লঙ ড্রাইভে মোটা মাইনের কর্পোরেট চাকরী- বিদেশী গাড়ি-বিদেশে ছুটি কাটানো-পঁচিশতলার ফ্ল্যাটে দূষণহীন প্রাকৄতিক পরিবেশে দিনযাপনের দরজায় পৌছে যায়। হঠাৎ রাস্তায় বা আপিস অঞ্চলে বন্ধুদের সাথে আর দেখা করার দরকার হয়না। সারাদিনই ফেসবুক অথবা গ্রুপ-হোয়াটস্আ্যপ পোস্টে দেখে বা পূর্ব নির্ধারিত গেট-টুগেদারে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি রেস-ট্র্যাকে প্রতিদ্বন্দীদের তুলনায় আমি কতটা এগিয়ে আছি। সেলফির জন্য গলাগলি করে পোজ দিলেও অকারনে হেসে উঠতে পারিনা। পিছিয়ে পরলেই ডিপ্রেশন জড়িয়ে ধরে। তখন বারান্দায় একলা বসে রাতের আকাশ দেখতে দেখতে মদ খাই। জড়াজড়ি করে দুজনে যৌনক্রীড়া করি, আমি আর আমার স্মার্টফোন। সিগনাল মেনে চলুন ছোটবেলায় জেনারেল নলেজ সিলেবাসে ট্র্যাফিক সিগনালের নিয়ম পড়তে হত। এখন মার্কেট সিগনাল বুঝতে শেখাটা আবশ্যিক, না হলে কম্পিটিশনে পিছিয়ে যেতে হবে । এই কথাটা মাইক্রোচীপ আকারে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেই সফল হয় শিক্ষা। দ্রুত সিড়ি চড়তে শুরু করি। আকাশ ছোঁওয়া উচ্চতায় সকলের আগে একলাই উঠতে চাই কেননা ওখান থেকে দুনিয়াটা যেমন দেখা যায় তেমন আর কোনখান থেকে নয়। ক্রমশঃ সুতো ছিড়ে যেতে থাকে। মেঘ ছাড়িয়ে আরও একলা হয়ে যাই। স্মার্ট মস্তিষ্ক আমাকে বিষন্ন হতে দেয়না। এবার শুরু হয় নিজের সাথে রেস। সীমাহীন একটা মাঠে চলতে থাকে নিরন্তর দৌড়। আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে যায় মার্কেট সিগনাল। রক্ত-মাংস-আবেগ-মোহ-ভালোবাসা সবই চলে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের প্রোগ্রাম মাফিক। জীবন চলতে থাকে অনলাইন। অর্থহীন হয়ে ওঠে চায়ের দোকান-পাড়ার রোয়াক-লেবুতলা বাজার।


ভার্চুয়াল কম্যুনিটি

বাড়িতে অতিথি সমাগম হলে আমরা ছোটরা বিশেষ উৎফুল্ল হতাম। প্রথমত পড়তে বসা থেকে রেহাই। তবে দ্বিতীয় কারনটা আরও অনেক বেশী আকর্ষনীয়। আগমন পূর্বনির্ধারিত হলে তো কথাই নেই, হঠাৎ এসে পড়া অতিথিদের ক্ষেত্রেও লুচির সাথে আলুর দমের (শীতকালে ফুলকপি) আর হাঁসের ডিমের কষার থেকে আমরাও বাদ যেতাম না। এখন সামাজিকতাও স্মার্ট হয়েছে। আমাদের মাস্টারমশায় কল্যান সান্যাল বলতেন ভারচুয়ালও এবং সেটা গৄহকর্তা ও অতিথি দুই পক্ষেরই জানা এবং সেই নিয়ম তারা মেনেও চলেন। বিষয়টা উনি বুঝিয়ে ছিলেন একটা অসম্ভব উদাহরন দিয়ে। এখন নাকি প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া খাবার খাওয়ার নিয়ম নেই। খাবার পরিবেশিত হলে প্রশংসা করে ও ধন্যবাদ জানিয়ে তা প্লেটেই রেখে দিতে হয়। তারপর অতিথি বিদায় নিলে গৄহকত্রী বিধি মেনে সেগুলি আবার তুলে রাখেন পরের বার পরিবেশনের জন্য। এই ভাবে একই খাবার দিনের পর দিন চলতে থাকে। এর ফলে এখন নাকি আসল খাবার আর তৈরীই হয়না। সবই মাটির। কৄষ্ণনগরে বানানো হয়। হয়তো সব সম্পর্কও এখন এই ভাবেই তৈরী হয়। আর তৈরী হয় সেগুলি চালানোর সিগনাল বিধি।

ফুটনোট

কয়েক দিন আগে একটা সিনেমা দেখলাম, নাম Wall-E । একটা দৄশ্যে দেখলাম অনেক মানুষ পথ হাঁটছেন। সবাই একা। কেউ কারো সাথে কথা বলছেন না। আর সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত নিজের নিজের গন্তব্যে পৌছনোর জন্য। হঠাৎই এক জন পড়ে গেলেন। অন্য কেউ এগিয়ে এসে তাঁকে তুললেন না। মানুষটিও যেন এটা জানতেন। তিনি কাউকে অনুরোধও করলেন না। পকেট থেকে একটা যন্ত্র বের করে সিগনাল পাঠালন, কয়েকটা রোবট এসে ওনাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

7 comments:

0

বিশেষ ক্রোড়পত্র - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Posted in


উত্তর আধুনিক শিল্পী
রঞ্জন মিত্র


তখন রাত একটা বাজে। সকাল থেকেই টেলিভিশনের সামনে বসে ছিলাম। একটিবারের জন্য উঠতে পারিনি। সারাদিন শুধু অঝোরে কান্না। এ কান্না স্মৃতি হয়তো আমার জীবনের শেষ সজ্ঞান মুহূর্ত পর্যন্ত থেকে যাবে। চল্লিশ বছরের সম্পর্ক, কম দিন নয়- আজ যেন একটা সমাপ্তির সামনে এসে দাঁড়াল। চল্লিশ বছরের সম্পর্ক কথাটা যেমন সত্য, আবার এটাও ঠিক যে সম্পর্ক সবসময় সমান ঘনিষ্ঠতার চেহারায় ছিল না। নানান উত্থান-পতন, ওঠা নামা গেছে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে আমার কোনও সাময়িক বিচ্ছেদও কখনও ঘটেনি। একটি বারের জন্য তাঁর কাজের প্রতি আমার কোনও অনাগ্রহ তৈরি হয়নি। আজ একরাশ শূন্যতার সামনে আমি বসে আছি। ব্যথায় বুকটা টানটান করছে, পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে- প্রথম ছবি ওঁর সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার; আপর্ণার আকস্মিক মৃত্যুর পরে প্রায় বৈরাগী, জীবনবিমুখ অপু তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির পাতা এক এক করে উড়িয়ে দিচ্ছে বনজঙ্গল, পাহাড় ঘেরা নিসর্গে। সময় যেন স্তব্ধ দুঃখে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে অপুর সামনে, চারিদিকে শুধু অসীম শূন্যতা। এইক্ষণে আমার মনের অবস্থাও যেন কতকটা অপুর-ই মতন।

পথের পাঁচালী, অপরাজিত, পরশপাথর, জলসাঘর - সত্যজিৎ রায়ের করা হয়ে গেছে তখন। এই চারটি ছবির কোনটাতেই প্রচলিত কোনও নায়কের প্রয়োজন পড়েনি; যেমন দরকার হল অপুর সংসারের বেলায়। সেই সময়ে বাংলায় সিনেমার কোনও নায়ক/অভিনেতা-কে সত্যজিৎ রায় নিজের ছবির নায়ক করে তুলতে রাজি ছিলেন না। তাঁর প্রয়োজন হল নিজস্ব এক নায়ক নির্মাণের। নিজের মনের মতো গড়ে নিলেন সৌমিত্র-কে। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পরে, তাঁকে নিয়ে লেখা অসামান্য গ্রন্থ- ‘মানিকদার সঙ্গে’, সৌমিত্র লিখেছিলেন- ‘উনি অসাধারণ যত্ন ও ভালোবাসায় শেখাতে চেয়েছিলেন আর আমি শিখতে চেয়েছিলাম। উনি যা চেয়েছিলেন, তা ওঁকে অনুসরণ করেই করতে পেরেছিলাম বলে মনে হয়। উনিও তখন যথেষ্ট পরিণত বয়সের মানুষ নন, সেই প্রথম অ্যাডাল্ট অপুকে নিয়ে কাজ করবেন। সে জন্য যথেষ্ট সতর্ক হয়ে কাজ করছিলেন এবং আমাকেও তৈরি করে নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, উনি কিন্তু অন্য কোনও অভিনেতার জন্য এতটা সময় দেননি, এতটা উদ্যোগ নেননি।’ প্রথম ছবিতে সৌমিত্র সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনাকে আত্মস্থ করে অভিনয়ে এমন উৎকর্ষ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন- যা শুধু বিশ্বমানেরই নয়, সিনেমার আন্তর্জাতিক মানের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের অভিনয়ের সমতুল্য। প্রথম ছবিতেই সৌমিত্র দেশে-বিদেশে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এদেশের সিনেমার অভিনয়ে এক নতুন অভিনয় ধারার সূচনা হয় তাঁরই হাত ধরে। অপর্ণা সেন, সৌমিত্র বিষয়ক এক নিবন্ধে, সঠিকভাবেই লিখেছিলেন- 'পুলুদা(সৌমিত্র ডাকনাম) বাংলা ছবির অভিনয় ধারায় এক নতুন দিক উন্মোচন করেছেন। খুব স্বাভাবিক, বাস্তব আর জীবন্ত অভিনয়ের এক নতুন ধারা এনেছেন তিনি৷' অপুর সংসার ছবিতে অভিনয়ের পরে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সিনেমায় তাঁর যে যুগ্ম পরিক্রমণ শুরু হয়েছিল, সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণেরর পূর্ব মুহূর্ত অবধি তা নিরবচ্ছিন্ন থেকেছে। ১৯৯০ সালে কলকাতার সিনে সেন্ট্রালের আয়োজনে সৌমিত্র রেট্রোস্পেকটিভ 'তিন দশকের সৌমিত্র' অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায় লিখেছেন- 'সৌমিত্রর ওপর আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে, এটা আমি জানি।'

অপুর সংসারের পরের বছরের সৌমিত্রর দুটি ছবি ক্ষুধিত পাষাণ ও দেবী। ক্ষুধিত পাষাণ বাংলা সিনেমার সর্বকালের অন্যতম বড় হিট ছবি। খুব দ্রুত পাকাপোক্ত হয় বাংলা সিনেমায় সৌমিত্রর স্থান। এই পর্যায় ক্রমে ক্রমে মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অসিত সেন, অজয় কর প্রমুখ বড়ো পরিচালকদের ছবিতে নানান ধরনের ভূমিকায় বিবর্তিত হতে থাকেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সমসময়ে নির্মিত তিনটি সিনেমায়, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী চরিত্রে অসামান্য অভিনয়ের সূত্রে- [ঝিন্দের বন্দী(১৯৬১), অভিযান(১৯৬২) এবং সাত পাকে বাঁধা(১৯৬৩)] জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় স্টার ও তুমুল শক্তিমান অভিনেতা উত্তম কুমারের গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার দিনে একজন সমান্তরাল নায়ক রূপে খুব দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন সৌমিত্র। এই সময়কালেই বাঙালীর চিরসুন্দর বিবাদ, উত্তম বনাম সৌমিত্র- আরম্ভ হয়ে যায়- যা অদ্যবধি অব্যাহত থেকেছে। জানি না, সৌমিত্রর প্রয়াণের পরে সেই ঝগড়া বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে পরিণত হবে কিনা! তবে এই পরিণত মধ্য পঞ্চাশের উপান্তে পৌঁছে এখন মনে হয় - সেই ঝগড়ার মধ্যে আর যাই থাকুক যুক্তি বা বুদ্ধিজনিত বিশ্লেষণের কোনও স্থান ছিল না। আমরা তর্কের উত্তেজনায় উপলব্ধি করতে ভুলে গেছি যে - আমরা কত বিরল সৌভাগ্যবান যে, প্রায় দুই দশক এই স্তরের দুজন নায়ক/অভিনেতা-কে আমরা পাশাপাশি অভিনয় করতে দেখেছি। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিনয় ধারা, অথচ কি অতুল ঐশ্বর্য, দুটি ধারা যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়- একে অপরের পরিপূরক। সারা ভারতবর্ষের মানুষের কাছে এঁদের সহবস্থানের জন্য আমরা তো গর্ব করতে পারি।

প্রথম থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্য ছিল নায়ক চরিত্রের চরিত্র-অভিনেতা হওয়ার। শুধুমাত্র রোমান্টিক নায়কের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করতে চাননি। নানান ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অদম্য বাসনা ছিল তাঁর। নানাবিধ অনুশীলনী, নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের অভিনয় শৈলী, অভিনয়ের ক্রাফটকে এমন উচ্চপর্যায়ে সম্প্রসারিত করেন যে, যখন-ই অন্য ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ এসেছে - কোথাও কখনও এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ বোধ করেননি। চারুলতা(১৯৬৪) সিনেমায় ধ্রুপদী নায়কের ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয় তো আজ বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে রয়ে গেছে। এরই পাশাপাশি অনায়কোচিত চরিত্র - অয়নান্ত(১৯৬৪), আকাশকুসুম(১৯৬৫), বাঘিনী(১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে(১৯৬৯)- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিনয় সার্থকভাবে করতে পেরেছিলেন। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের অমন রূপবান চেহারাকে ডিগ্লামারাইজ করতে কখনও আপত্তি করেননি, সাহসের অভাব মনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিজের নায়ক জীবনের প্রভূত পরিমাণ জনপ্রিয়তার দিনেও সৌমিত্রর অশনি সংকেত(১৯৭১), সংসার সীমান্ত(১৯৭৫), গণদেবতা(১৯৭৯), অগ্রদানী(১৯৮৩), কোনী(১৯৮৬) ছবিগুলোতে তাঁর অসামান্য চরিত্রাভিনয়ের সার্থক রূপদান ইতিহাস হয়ে আছে। সারাজীবন অসংখ্য বড় পরিচালকের অসামান্য সব সিনেমায় অভিনয়ের দুর্লভ সুযোগ সৌমিত্র পেয়েছেন (ভারতবর্ষের অন্য কোনও অভিনেতা ভাল পরিচালকের উল্লেখযোগ্য ছবিতে এমন সুযোগ পাননি)- সেই সব সিনেমায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করে নিজেকে একজন উচ্চস্তরের ভার্সেটাইল অভিনেতা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। মধ্য পঞ্চাশে উপনীত হয়ে যখন সৌমিত্র পুরোপুরি একজন চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠেন, তাঁর উল্লেখযোগ্য পূর্বপ্রস্তুতি-দরুণ সেই সব ভূমিকায় অনায়াসে স্বাচ্ছন্দে মানিয়ে যান।

নিজের নায়কজীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের দিনে তাঁর তিনটি ছবিতে তিন ধরনের অসামান্য চরিত্রচিত্রন তাঁকে ভার্সেটাইল অভিনেতার স্বীকৃতি দিয়েছিল। অশনিসংকেত, সোনার কেল্লা এবং সংসার সীমান্তে কিন্তু প্রায় সম সময়ে নির্মিত। অথচ কি বৈচিত্রে ভিন্নধর্মী তিনটি চরিত্র নির্মাণে সৌমিত্র তাঁর চূড়ান্ত অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। একজন অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতা হিসেবে কমেডি চরিত্রেও খুব ভালো অভিনয় করতে পারতেন সৌমিত্র। অভিনয় জীবনের প্রায় প্রথম পর্বেই বাক্সবদল(১৯৬৫), একটুকু বাসা(১৯৬৫), হঠাৎ দেখা(১৯৬৭) এবং সত্তর দশকে নির্মিত সিনেমা বসন্ত বিলাপ(১৯৭৩), ছুটির ফাঁদে(১৯৭৫) এবং মন্ত্রমুগ্ধ(১৯৭৭)- ছবিগুলিতে প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন কমেডিয়ানদের পাশে দাঁড়িয়ে কি তুমুল হাসির অভিনয় সার্থকভাবে করেছিলেন সৌমিত্র। পুরোপুরি চরিত্রাভিনয়ে সরে আসার সময়ে তাঁর সারাজীবনের অভিজ্ঞতা, নিবিড়চর্চা ইত্যাদিকে মূলধন করে আতঙ্ক(১৯৮৬), একটি জীবন(১৯৯০), গণশত্রু(১৯৯০), শাখা-প্রশাখা(১৯৯১), মহাপৃথিবী(১৯৯১), অন্তর্ধান(১৯৯২) বা হুইলচেয়ার(১৯৯৪)- সিনেমায় অমন উচ্চস্তরের সার্থক অভিনয়ের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। নিজের অভিনয়কে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার বিশ্লেষণ করবার এক দুলর্ভ ক্ষমতা ছিল তাঁর। মু্ক্তচিন্তা, যুক্তিবাদী মনের অধিকারী এবং অতৃপ্ত ও অসন্তুষ্ট স্বভাবের মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের কাজের দিকে তাকাতে জানতেন। এ ক্ষমতা সকলের থাকে না। সমস্ত পৃথিবীর সিনেমার অভিনয়ের বদলও তাঁর প্রখর দৃষ্টিতে ধরা পড়তো। দীর্ঘদিন অভিনয় কর্মে রত থাকলে অভিনয়ে একটা একঘেয়েমি আসতে পারে। সচেতন শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের মৌলিক অভিনয় শৈলী, নাটক বর্জিত সংলাপ উচ্চারণ, শান্ত, নিরুচ্চার অনুচ্চ অভিনয়ের ধারা অক্ষুন্ন রেখেও নানা পরিবর্তন এনেছেন। পারমিতার একদিন বা অসুখ নয় দশকের শেষভাগে নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রে সৌমিত্র সম্পূর্ণ অন্য এক অভিনয় করেছিলেন। ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গৌতম ঘোষের দেখা সিনেমায় সৌমিত্রর অভিনয় তো তাঁর সারা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্য। এই সময়কালে তৈরি ছবি সাঁঝবাতির রূপকথা বা আবার অরণ্যে, কালবেলা বা আরও কিছুকাল পরের ছবি পদক্ষেপ, অংশুমানের ছবি, রূপকথা নয় প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অভিনয় আজকের দিনের বিচারেও চূড়ান্ত আধুনিক। ছ’টি দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে অভিনয়ের পর তিনি একজন আধুনিক সিনেমার অভিনেতা রয়ে গেছেন- কখনও পুরনো হননি। অভিনয় জীবনের প্রায় শেষ পর্বে এসে মঞ্চে রাজা লিয়ার(নভেম্বর,২০১০; নির্দেশনা- সুমন মুখোপাধ্যায়) এবং সিনেমা ময়ূরাক্ষী(ডিসেম্বর,২০১৭; পরিচালনা- অতনু ঘোষ) অভিনয়ে সৌমিত্র তাঁর আধুনিক মনন ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ নিদর্শন রেখে গেছেন। প্রায় সব ধরনের সিনেমার সঙ্গে নিজের অভিনয়-কে মানিয়ে নেওয়ার কারণে হাল আমলের মূলধারা ছবি বেলাশেষে বা পোস্ত- তেও তিনি আশ্চর্য ভালো অভিনয় করেছেন এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতে পেরেছেন। ভারতীয় সিনেমায় মূল ধারার ছবি ও অন্য ধারার শিল্প সম্মত সিরিয়াস সিনেমা- দুটি ক্ষেত্রেই এমন অনায়াস বিচরণ, অভিনয় ক্ষমতার সহজাত প্রকাশ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যতীত আর কাউকে স্মরণকালে ঘটাতে দেখা যায়নি। সেই দিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে সৌমিত্র এক বিরল প্রতিভা সম্পন্ন অভিনয় শিল্পী। মানুষের জীবনের সঙ্গে নিরন্তর যোগ বিপুল পঠন-পাঠনের নিয়মিত অভ্যাস, মনন ক্ষমতা, তীব্র পর্যবেক্ষণ শক্তি, এক অদ্ভুত দার্শনিক মন, শিল্পীর সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন যোগ- এসবের সংমিশ্রণেও প্রায়োগিক ক্ষমতায় ভারতীয় সিনেমার একজন বিশিষ্টতম অভিনেতা হয়ে উঠতে পেরেছেন সৌমিত্র, জীবিতকালেই হয়ে উঠেছেন এক প্রতিষ্ঠান। সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব অভিনেতা রূপে সৌমিত্র আন্তর্জাতিক সিনেমার অঙ্গনে ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান, মান্যতা পেয়েছেন বহুদিন আগেই, সেই বিচারে তিনি আন্তর্জাতিক সিনেমার চৌহদ্দিতে সবচেয়ে মান্যতা প্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা।

বাংলা ভাষার উপর তাঁর অসামান্য দখল, উচ্চারণ, ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষমতা- যে নিবিষ্ট চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি আয়ত্ত করেছেন- তাঁর সংলাপ উচ্চারণে, কথা বলার যে সহজ প্রকাশ দেখা যায় অভিনয় কালে- তেমন বৈচিত্র্যময় উচ্চস্তরের প্রকাশ স্মরণকালে কোনও বাঙালি অভিনেতার মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। আসলে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ থেকে বাংলা সিনেমায় আসেন সৌমিত্র। তার মানে এই নয় যে, তাঁর আগে বা পরে আর কোনও শিক্ষিত সুদর্শন বাঙালী অভিনেতা আসেননি। অনেকেই এসেছেন। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে যে বিপুল সংযোগ, চর্চা সৌমিত্রর ছিল তেমন আর কারোর ছিল না। আদতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নির্মাণ করেছে এক বিশেষ সময়। অন্য এক শিক্ষায়, রাজনৈতিক বিশ্বাসে, ভিন্নতর পঠন পাঠনে, অন্যতর সংস্কৃতির উজ্জীবনে তাঁর মন ও মনন ঋদ্ধ হয়েছিল। যৌবনের শুরুর দিনগুলোয় পেয়েছিলেন দুজন অসামান্য প্রতিভা সম্পন্ন মানুষের শিক্ষা, দিকনির্দেশ- শিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং সত্যজিৎ রায়-কে। সিনেমায় যোগদান এবং প্রথম ছবিতেই তুঙ্গজয়ী সাফল্য, তাঁর মনকে নষ্ট করতে পারেনি। এক অতি উচ্চমানের পত্রিকা এক্ষণ সম্পাদনা যুগ্মভাবে করেছেন বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে। সিনেমার অভিনয়ের প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও দীর্ঘ আঠারো বছর অক্ষুন্ন থাকে তাঁর এই পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশের সঙ্গে সংযোগ। গদ্য রচনায় প্রথম থেকেই সৌমিত্র তাঁর মৌলিক চিন্তা-ভাবনা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার আকৈশর কবিতা লেখা অনেক সুসংহত হয়েছে তাঁর কলেজ জীবনে কবিবন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কৃত্তিবাসী কবিদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। কবি সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতার পঠন-পাঠনের ফলে এবং প্রায় সমসাময়িক কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, এঁদের প্রভাব আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন প্রকাশরীতি বা বাচনভঙ্গি খুব দ্রুত অনুধাবন করে, নিবিড় অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ক্রমে ক্রমে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে ওঠেন। কবিতার প্রতি এই আজন্ম ভালোবাসা আবৃত্তিকার হিসেবে সৌমিত্রকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রায়াণের পরে একটি লেখায় কবি জয় গোস্বামী একদম সঠিক কথা লিখেছেন - কোনও ভারতীয় অভিনেতার একইসঙ্গে কবিতা সমগ্র, নাটকসমগ্র এবং গদ্য সমগ্র নেই- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া। তাঁর বিপুল কবিতা লেখা, গদ্য রচনা, নাটক রচনা, রূপান্তর, আবৃত্তিকার, পত্রিকাসম্পাদনা, নাটকে অভিনয়, নাটক নির্দেশনা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ- এ সব নিয়ে পৃথক বই লেখা যেতে পারে। বাংলা থিয়েটারে তাঁর অসামান্য অবদান, পেশাদার থিয়েটারে তার একক লড়াই- অবশ্যই আলাদা বই লিখে আলোচনা করার যোগ্য। চিত্রকর রূপেও তাঁর কাজ ইতিমধ্যে শিল্পক্ষেত্রে তাঁর সম্পর্কে অন্য এক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ রায়ের সর্বোচ্চ উত্তরাধিকার এসে পৌঁছেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুবিধ শিল্পচর্চার মধ্যে। তাঁর নানাবিধ কাজ, তাঁর মৌলিকচিন্তা, গভীর জীবনবোধ তাঁকে এক অনন্য সাধারণ শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছে। শোক সন্তপ্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এত সব কাজের দিকে তাকাই, তখন মনের মধ্যে এক সান্ত্বনা পাই, মৃত্যুতে সৌমিত্রকাকু ফুরিয়ে যাবেন না। 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়'- এই অমোঘ উচ্চারণ আমরা ক’জনের ক্ষেত্রে করতে পারি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া।


*************************


মাস্টারক্লাসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: প্রসঙ্গ অপুর সংসার
অতনু ঘোষ


২০১৭ সালের মে মাস। আমার জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায়।সবে ‘ময়ূরাক্ষী'র চিত্রনাট্য লেখা শেষ করেছি। তখনও ঘষামাজা চলছে। ছবি সংক্রান্ত বিবিধ ভাবনাচিন্তা মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। চার মাস বাদে শুটিং । এরমধ্যেই এলো সেই অভাবনীয় প্রস্তাব। অভিনয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে দশটি মাষ্টারক্লাস নেবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সঞ্চালক হিসাবে আমার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা জানতে চান আমি আগ্রহী কিনা। বলা বাহুল্য, হ্যাঁ বলতে ঠিক একমুহূর্ত লেগেছিল। অমন এক মহীরুহের টানা সঙ্গ পাওয়া, দশদিন ধরে অভিনয় সংক্রান্ত যত খুশি প্রশ্ন রাখার সম্ভাবনা, নানান বিষয় ঘিরে ওঁর মতামত, বিশ্লেষণ শোনা, বহু অজানা গল্প, ইতিহাস জানা, এমন সুযোগ কজনেরই বা ভাগ্যে জোটে!

আমরা প্রায়ই বলে থাকি, একজন তুখোড় অভিনেতার কাজ গভীরভাবে জীবনকে চেনায়। সত্যের অনুষঙ্গকে স্পষ্ট করে তোলে। বিশ্বের বিভিন্ন অভিনয়গুরুর শাস্ত্রে যত কৌশলের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে কোনটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? কোন কোন ধাপে একজন সিনেমার অভিনেতা পরিণতির লক্ষ্যে এগোন? ক্যামেরার সামনে কিভাবে নিজের মানসিক ও মনস্তাত্বিক আধার তৈরি করতে হয়? এমনই হাজারখানেক প্রশ্ন লিখে খাতা ভরিয়ে ফেললাম। আসলে নিজে অভিনেতা না হয়েও, অভিনয় ঘিরে আমার প্রবল উৎসাহ, অনন্ত কৌতূহল। প্রথমদিন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয়পর্বের পর ওঁকে বললাম - 'যেসব বৈশিষ্ট্যের বলে একজন অভিনেতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন, যেমন প্রখর বোধবুদ্ধি, মানসিক একাগ্রতা, শৈলীর ওপর দখল, সেসব আপনার ঝুলিতে বাড়বাড়ন্ত। অনেক পরিশ্রম, অনেক সাধনায় অর্জিত। তাও সবাই জানে। কিন্তু তার সঙ্গে আরো কিছু নিজস্বতা আছে, যা একান্তই আত্মিক, দার্শনিক। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আপনার অনন্য জীবনবোধ, যার প্রয়োগে আপনার কাজ ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে। ক্যামেরার সামনে আপনি এত বছর ধরে অভিনয় করছেন। নিজেই বলেছেন একটা মুল ধারা বজায় রেখেও বার বার নিজের অভিনয়শৈলী ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন, নতুন বাঁক নিয়েছেন, অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। আপনার এই দীর্ঘ যাত্রাপথের হদিস পেতে আমরা প্রথমেই ফিরে যাবো ১৯৫৮ সালের ৯ই আগস্ট। যেদিন আপনি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন।’

উনি কফির কাঁপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকালেন। টেলিভিসান পর্দায় তখন অপুর সংসারের নতুন ঝকঝকে প্রিন্ট চলছে। Criterion Collection-এর re-master করা প্রিন্ট। তরুণ অপু, হাতে ছাতা নিয়ে অন্ধকার গলিপথ পেরিয়ে ফ্যাক্টরির ঘরে ঢুকে দেখছে কিভাবে বোতলে লেবেল লাগানো হয়। ওঁর জীবনের প্রথম শট। এবং প্রথম চেষ্টাতেই যা পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কাছে গুণমানে সঠিক বিবেচিত হয়েছিল। শট শেষ হতেই খুশি হয়ে বলেছিলেন - ‘Excellent. Ok’ সিনেমার অভিনয়ের যে প্রকৃত স্বরূপ - একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত, নির্ভার যে অভিনয়ধারা, যা সেই সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পাচ্ছে, সেটা উনি কিভাবে তাঁর প্রথম ছবিতেই অনায়াসে ধরে ফেললেন, ভাবতে খুব অবাক লাগে। কারণ ওই নতুন অভিনয়ধারা বাংলা কেন, ভারতীয় ছবিতেই তখনো সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, পরশ পাথর, জলসাঘর ছবিতে অবশ্যই এর প্রয়োগ আছে। কিন্তু এসব ছবি তৈরি হয়েছে অপুর সংসারের মাত্র কয়েক বছর আগে।তার পূর্ববর্তী বাংলা সিনেমার যে অভিনয় ধারা, সে তো একেবারেই আলাদা।এবার এক নতুন অভিনেতা, যার তখন ২৩ বছর বয়েস, যে মূলত থিয়েটার করেছে, তার সব পড়াশুনা,অনুশীলন সবই থিয়েটার ঘিরে। বেশ কয়েক বছর ধরে প্রবাদপ্রতিম নাট্য ব্যক্তিত্ব শিশির ভাদুরির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সংযোগ। এরপরেও সে যখন প্রথম সিনেমায় অভিনয় করতে আসছে, সেখানে কিন্তু থিয়েটারের কোন প্রভাব নেই, আগেকার বাংলা সিনেমার অভিনয় ধারার চিহ্নমাত্র নেই! এটা সত্যিই অবাক করে দেয়।

এবার আসা যাক অপুর চরিত্রায়নে । প্রথম বৈশিষ্ট্য, বিপরীতধর্মী সংঘর্ষের প্ররোচনা ও নানান ঘটনার অভিঘাত। যার ফলে অপুর জগত ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সে ঘোরতর সমস্যায় ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু সেই টানাপোড়েনে যেমন হতাশা, অসহায়তা আছে, তেমনি প্রবল সংগ্রামও আছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার মধ্যেও তার স্বপ্ন, কবিতা, চেতনা, আবেগ কোনকিছুই হারিয়ে যাচ্ছেনা। ক্যামেরার সামনে সারা ছবি জুড়ে এই চূড়ান্ত বৈপরীত্যের নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখা যথেষ্ট শক্ত কাজ। বিশেষ করে এক নবীন অভিনেতার পক্ষে। এটাও মনে রাখতে হবে অপুর চরিত্র খুব ছোট গণ্ডির মধ্যে সূক্ষ্ম বিশ্বাসযোগ্যতার ঘেরাটোপে ঘোরাফেরা করে। সেখানে হাতপা ছড়িয়ে তীব্র আবেগ প্রকাশের উপায় নেই। কারণ সেটাই সিনেমার আধুনিক অভিনয়ধারার বিশেষত্ব।

মাস্টারক্লাসে আমরা অপুর সংসারের কয়েকটা দৃশ্য ছাত্রছাত্রীদের দেখাতাম। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে কোন কোন ভাবনা ও দৃষ্টিকোণের আশ্রয়ে তিনি পর্দায় অপুকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। শুরু করতাম ওই অবিস্বরনীয় দৃশ্য দিয়ে, যেখানে অপু তার বন্ধু পুলুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে লেখার প্লট নিয়ে আলোচনা করছে - সৃষ্টির উত্তেজনায় আপ্লুত এক তরুণ গল্পকার তার আপাত অসংলগ্ন মনের ভাব বা আবেগ প্রকাশ করছে - 'সে মহৎ কিছু করছেনা, তার দারিদ্র্য যাচ্ছেনা, তার অভাব মিটছে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না, সে পালাচ্ছে না, সে এস্কেপ করছে না, সে বাঁচতে চাইছে, সে বলছে বাঁচার মধ্যে স্বার্থকতা, তার মধ্যেই আনন্দ, he wants to live!’ কি তুমুল উচ্ছ্বাস, কিন্তু কি বিশ্বাসযোগ্য, একেবারে যেন মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত। মনে আছে, একদিন এই দৃশ্য দেখে আবেগতাড়িত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম - ‘এই যে বিভিন্ন expression মনের গভীর থেকে উঠে এসে চোখমুখের নানান পেশিতে নানান শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে, এটা কি বহুদিনের অনুশীলন করা craft দিয়ে প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব?' কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর শান্তস্বরে বললেন - ‘বোধহয় না। ওটা ভেতর থেকেই উঠে আসবে।’ ক্লাসের মধ্যে একেবারে পিন পড়ার নৈঃশব্দ্য। অভিনয়ের পাঠ নিতে আসা নবীনের দল এবার বুঝতে পারছে মনের ভেতর থেকে এই অনুভব নিংড়ে বের করে আনার কাজটা কত দুরূহ! ততক্ষণে পর্দায় দৃশ্য পাল্টে গেছে। অপুর মনে নানান ধরণের সংশয় দেখা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনে সে অক্ষম। অন্য কারুর সঙ্গে বিয়ে হলে তার স্ত্রী সুখী হত। অপু অপর্ণাকে বলছে - 'তোমার অনুশোচনা হয়না?’ অপর্ণা অত শক্ত কথার মানে জানে না। অপু তাকে বোঝাতে চাইছে। চরিত্রের আরও এক দিক। inner conflict বা অন্তরদ্বন্দ্ব - তার অস্থিরতা, হীনমন্যতা প্রকাশ পাচ্ছে। এরপর অপুর জীবনে নেমে আসবে তুমুল বিষাদ। সেই দৃশ্য, যেখানে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে একা খাটে বসে আছে অপু। কি গভীর শূন্যতা! যে ইতিবাচক নায়কের গল্প সে একদিন শোনাতে চেয়েছিল, জীবনবিমুখ হয়ে সেই পাণ্ডুলিপির পাতাই হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে। তখন সে এক অন্য মানুষ।

একই চরিত্রের এতগুলো স্তর! অনায়াসে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারতো বা একই জায়গায় ঘোরাফেরা করে montony তৈরি করতো। দুঃখের দৃশ্য মানেই মুখে যন্ত্রণা, আর উচ্ছ্বাস মানেই হাসিমুখ, এই গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকলে আমরা কবেই পর্দার অপুকে ভুলে যেতাম। আজ এত বছর পরেও ছবিটা দেখে এই যে আমরা নতুন করে কত কি আবিষ্কার করছি, এত ভাবনা, বোধ, দর্শন বেরিয়ে আসছে, তার একটাই কারণ। চিত্রনাট্যের নানান স্তর নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অপুর চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সিনেমার অভিনয়ে এই internalise বা আত্মস্থ করার প্রক্রিয়া যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সে প্রসঙ্গে Elia Kazan বলছেন - Whereas you can—and many effective actors do get away with faking, posturing, and indicating emotions on stage, it’s difficult, if not impossible, to get away with anything false before the camera. That instrument penetrates the husk of the actor; it reveals what’s truly happening—if anything, if nothing. A close-up demands absolute truth. It’s a severe and awesome trial.

সেদিনের ক্লাসে বার বার আলোচনায় উঠে এলো এই প্রসঙ্গ - নাটক ও সিনেমার অভিনয়ের তফাৎ। সিনেমার অভিনয় কৌশলের সঙ্গে অনেকেই ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ছবির মিল পান। ভ্যান গগের ছবিতে আমরা এক অমূল্য উপাদান খুঁজে পাই- তাঁর নিজস্ব সত্ত্বা, তাঁর অন্তরাত্মা, যা মিলেমিশে আছে রঙে, রেখায়, আকারে, নানান খন্ড খন্ড অস্তিত্বে। তাই ভ্যান গগ অভিনয়শিল্পীদের কাছে এক অসাধারণ অনুপ্রেরণা। সিনেমার অভিনয় শুধু শৈলীর ওপর নির্ভর করে হয় না। চিত্রনাট্য থেকে চরিত্রের কাঠামো, চলন, ও বৈশিষ্ঠের আদলটুকু পাওয়া যায়। তারপর অভিনেতা তাঁর মন, সত্ত্বা, শরীর সবকিছুকে নানান বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে গিয়ে ওই চরিত্রকে রক্তমাংসের মানুষ করে তোলেন। সিনেমায় প্রতি শটে নিজের মনের গভীর অন্তরের অন্তস্থলকে জাগ্রত করতে হয়। নিজের অন্তরাত্মাকে উন্মুক্ত করতে হয়। তবেই হয় সততার যথার্থ প্রকাশ। তারপর আসে শরীরি ভাষা, সংলাপ বলার ভঙ্গি, গতি, ছন্দ, সবকিছুর নিখুঁত ভারসাম্য। বহির ও অন্তরদ্বন্দের তুমুল সংঘাতের মধ্যেও অপুর সংসারে নিজের লক্ষ্যে স্থির সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অভিনয়শৈলীর বিচারে এই ছবিতে উনি ভীষণরকম আধুনিক এবং যথার্থ অর্থে আন্তর্জাতিক। সিনেমার অভিনয় যারা শিখতে চায়, বুঝতে চায়, তাদের বার বার ফিরে আসতে হবে অপুর সংসারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাজে।

সেদিন ক্লাস শেষ করে আমরা একসাথে বাড়ি ফিরছি। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। চুপচাপ গাড়ির জানালার কাঁচের বাইরে তাকিয়ে আছেন। একসময় মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন - ‘তুমি যে ওই প্রশ্ন করলে, ওই পুলুর সঙ্গে দৃশ্যের বিভিন্ন expression শুধুমাত্র craft দিয়ে প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব কিনা ...?’

আমি বললাম - 'আপনি বললেন - বোধহয় না।'

সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠলেন - 'এখন আরও firmly বলছি - না, করা যায় না। সম্ভব নয়।'

টীকাঃ এই লেখার মধ্যে ব্যবহৃত ইংরেজি অংশটি গৃহীত হয়েছে এলিয়া কাজনের গ্রন্থ....Elia Kazan: A Life. Elia Kazan. Published by Alfred.A.Knopf.page 579.

















***************************


আলোকবর্তিকা
চন্দন সেন

প্রত্যেক মানুষের জীবনে কয়েকটি বা কয়েকজন আলোকবর্তিকা থাকেন। যাঁরা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে আমাদের মানস গড়ে উঠতে সাহায্য করেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার জীবন এ তেমনই একজন আলোকবর্তিকা। চলচ্চিত্রের বাইরে ওনার আমার ওপর প্রথম প্রভাব এক্ষণ পত্রিকা! ৮০ দশকের গোড়ায় এক্ষণের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়ে একটি সংখ্যা বাবা আমার হাতে তুলে দেন। সেই শুরু, আমার নিজস্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর সাথে পরিচয়। এর পর আমার সামান্য সৌভাগ্য হয় ঘরোয়া কিছু আড্ডায় ওনার আবৃতি বা পাঠ শোনার। বিখ্যাত “খেরো খাতা” দেখার। আমার মা শ্রীমতী সন্ধ্যা চক্রবর্তী ওনার সাথে অভিনয় করার সুবাদে আমার কিঞ্চিৎ স্নেহ প্রাপ্তি ঘটেছে শৈশবে - কৈশোরে।

আমার প্রথম বিস্ময় তৈরি হয় “নাম জীবন” নাটক দেখে। ওই একই সময়ে রঙ্গনায় গনেশবাবু বেশ কিছু ভালো প্রযোজনা করলেও, সামগ্রিকভাবে পেশাদার নাটকগুলির মান তখন বেশ অধোমুখী! সেই সময়ে “নাম জীবন” অভিনয়ে-মঞ্ছসজ্জায়-আলোক ভাবনায় চমকে দিয়েছিল! নিছক বিনোদন নয়, পেশাদার মঞ্চে দাঁড়িয়ে অমন বোধের নাটক এক বিরল অভিজ্ঞতা! আচার্য শ্রী শিশির ভাদুরির শিক্ষা, আচার্য শ্রী উৎপল দত্তের সান্নিধ্য, ৫০ এর উত্তাল সাংস্কৃতিক ঔতিহ্যের আলোকছটা এবং সর্বোপরি পারিবারিক শিক্ষা সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়ে এক অনন্য সংমিশ্রন! নিজের বৌদ্ধিক চেতনাকে ক্রমাগত উন্নীত করে চলতেন পড়ায় – লেখায় – সঙ্গে। তৎকালীন বাঙালীর অন্যতম বৌদ্ধিক চেতনা বিস্তারের প্রধান উপাদান ছিলো – সঙ্গ! পাড়ার রোয়াক থেকে কফিহাউস পর্যন্ত পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে আগ্রহ – পড়াশোনা – উত্তেজনা -বিমর্ষতা কলকাতা তথা শহুরে বাঙালিকে আন্তর্জাতিক করে তুলেছে! ইদানিং সঙ্গের বিবর্তন সৌমিত্রদাকে বড্ড পীড়িত করতো! বার বার করে বলতেন, বর্তমানে নাটক না থাকলে উনি “সৎ সঙ্গ” থেকে বঞ্চিত হতেন! মানুষ কি ধরনের সঙ্গ করেন বা করছেন, তার উপরেই তো তার মানস নির্ভর করে!

সৌমিত্রদার সাথে সামান্য ব্যাক্তিগত আলাপচারিতায় শিখেছি অন্য অভিনেতাদের প্রতি সন্মান জানানো! সে যদি বয়সে ছোটও হয়, কিম্বা সমবয়সী! কি অনায়াসে উত্তম কুমারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারতেন! আজকের দিনে যা শুধু বিরল নয়, প্রায় উধাও! বিশ্বের অনেক তাবড় অভিনেতাদের সাথে পরিচয় ছিল, সে কথা সর্বজন বিদিত। অথচ নতুন অভিনেতাদের সম্পর্কেও কি অনন্য অনুসন্ধিৎসা! কেউ নতুন কোন বিষয় নিয়ে কথা বললে, কি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন! তিনি বয়সে ছোট বা অখ্যাত হলেও! আমদের সৌভাগ্য হয়েছিলো আমাদের নাটকের দল নাট্য আনন এর প্রযোজনা “বাসনা বৃক্ষমূলে” নাটকটি দেখতে এসেছিলেন, ওনার স্মৃতি কথায় তার উল্লেখও রেখেছেন! দেখা হলেই জানতে চাইতেন কি নাটক করছি বা ভাবছি! নতুন কোন নাটক পড়লাম কিনা, বা শুনলাম কিনা! উনি জানতেন, আমার সৌভাগ্য হয়েছে NEWYORK OFF OFF BROADWAY তে ওদেশের পেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে নাটক নির্দেশনা করার। অন্য কাজেও আমার বারবার ওই শহরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাই ফিরে আসার পর দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করতেন নতুন কি কি নাটক দেখলাম! কোনো নাটকের বই পেলাম বা এনেছি কিনা! যারা ওঁর সঙ্গে নাটক করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা জানেন কি অসম্ভব নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতেন রিহার্সাল থেকে অভিনয় পর্যন্ত! বিশেষ করে “রাজা লিয়র” এ যারা ওনার সাথে অভিনয় করেছেন বা বয়সে অতো ছোটো শ্রী সুমন মুখোপাধ্যায় বা সহ শিল্পীদের সাথে নিজের অভিনয়ের ত্রুটি নিয়ে পর্যন্ত অনায়াসে আলাপ করতে পারতেন! সুমন নিজে সে কথা বিস্ময়ের সাথে উল্লেখ করেছেন! দুর্ভাগ্য এ দেশের, যে নাটক সারা ভারত ঘুরে অভিনীত হওয়ার কথা, তা এক নির্বোধ সরকারি কোপে বন্ধ হোয়ে গেলো!!! নতুন প্রজন্ম এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হোল!

ব্যক্তিগতভাবেও আমি সৌমিত্রদার কাছে ঋণী। প্রখ্যাত চিত্রকর নিলাঞ্জনাদি আমার চিকিৎসার সাহায্যার্থে কিছু ছবি এঁকেছিলেন, উদ্বোধন করেছিলেন সৌমিত্রদা। ওনার খুবই কাজের চাপ ছিল সেদিন। তবু আমার জন্য এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন! যতদিন বেঁচে থাকবো, এ আমার জীবনের অন্যতম বিরল প্রাপ্তি! আজীবন কৃতজ্ঞ আমি।

সৌমিত্রদাকে নিয়ে চারণ করার মতো স্মৃতির পূঁজি আমার সামান্যই! কিন্তু ওই স্বল্পদিনেই আমার বোধের ভাণ্ডার অনেক খানি পূর্ণ করেছেন উনি! ব্যক্তিজীবনের স্মৃতি চারণ লিখে কতো অ-কিঞ্ছিতকর মানুষ বড়াই করেন – সৌমিত্রদা লেখেন আস্ত একটা নাটক! এখানেই বোধের তফাৎ। এখানেই সংস্কৃতির তফাৎ!

ওনার লেখা, বক্তৃতা, আলাপচারিতায় সব চেয়ে আমায় উদীপ্ত করেছে চরিত্র নির্মাণের প্রতি যত্ন! তথাকথিত Hiro Image র তোয়াক্কা না করে, চরিত্র নির্মাণের পথে হেঁটেছেন বহুবার! কি চলচিত্রে, কি নাটকে! একজন প্রকৃত অভিনেতার যা সারা জীবনের অনুসন্ধান থাকে! অভিনয়ের সামান্য ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি সউমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন চরিত্র নির্মাণ নিয়ে দিনের পর দিন Class করা যায়ে! শ্রদ্ধেয় অনবদ্য অভিনেতা শ্রী নাসিরুদ্দিন শাহ্‌ কে স্বচক্ষে দেখেছি তার নিজের সন্তানকে বলছেন – “প্রনাম করো, এনাকে দেখে আমি অভিনয় করতে শিখেছি!”

সৌমিত্রদা আমাদের জন্য রেখে গেছেন প্রচুর! আমাদের দায় তা বহন করা, পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে তাদের বোধের পথকে আরও সুগম করা। এই অন্ধকার সময়ে স্বৈরাচারী - ধর্ম ব্যবসায়ী – আদ্যন্ত বানিয়ার দালালদের বিরুদ্ধে উনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন ওনার শিল্প বোধ দিয়ে, ওনার কবিতা – নাটক – গান দিয়ে! বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি সোচ্চার থেকেছেন আজীবন। আমার শ্লাঘা যে শেষ বিদায়ে আমি আমার লাল সেলাম জানাতে পেরেছি।

টীকাঃ এক্ষণ পত্রিকার আয়ুষ্কাল ১৯৬১ থেকে ১৯৯৫। পঁয়ত্রিশ বছরের বেরিয়েছিল সর্বমোট আটাত্তর টি সংখ্যা। তার মধ্যে প্রথম সাতান্ন টি সংখ্যা, ১৯৬১ থেকে ১৯৭৯, এই আঠারো বছর এক্ষণ প্রকাশ পায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্যের যুগ্ম সম্পাদনায়। এরপরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে এক্ষণ পত্রিকা থেকে বিযুক্ত করে নেন। বাকি একুশটি সংখ্যা নির্মাল্য আচার্যের একক সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। শেষ সংখ্যা, শারদীয় ১৪০২।


*********************


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যের অভিনয়
অরুণ মিত্র

কোন জায়গায় দাঁড়ালে একজন মানুষকে ঠিকমতো চেনা যায় এবং চেনানো যায় তা নিরূপণ করা খুব সহজ নয়। প্রায় সব মানুষই জটিলতায় জড়ানো। সেই জটিলতা ছাড়িয়ে তার ব্যক্তিতার ছন্দ উন্মোচিত করতে হয়। তখন চেনা যায় লোকটা কে এবং কেওম্ন। এই কাজে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যের সমকক্ষ আর কাউকে অভিনয় জগতে দেখি না। এর জন্যে মানুষকে ভেতর থেকে দেখার প্রয়োজন হয়। এ-বিষয়ে সৌমিত্রর ক্ষমতা অসাধারণ। যে-চরিত্রে সে অভিনয় করে তাকে সে সম্পূর্ণ অধিকার করে নেয়। সেই কারণে তার অভিনয় আমাকে এত মুগ্ধ করে।


'বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ' বিষয়ে
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সাক্ষাৎকার


একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। এবং তা হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার প্রায় কোনও সম্পাদনা ছাড়াই, তাঁর বলা কথা টেপ থেকে তুলে শুধু যতিচিহ্ন ব্যবহার করে ছাপা হয় ।

এতটাই তাঁর দখল ছিল বাংলা ভাষার উপর ।

"''''''''''''''''"''''''''''''''''''''''''''''''""""""

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার যে সংকট আছে তা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। বাঙালি আজ তার নিজের ভাষা ভালো করে শিখছে না, বলছে না, ব্যবহার করছে না। এর উৎসটা কোথায় সেইটে ভাবার চেষ্টা করা বোধহয় ভালো। সেটা ভাবতে গেলে আমার কীরকম জানি মনে হয়, সংকটটা আসলে মূল্যবোধের সংকট । যে মূল্যবোধ থেকে মানুষ তার জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, একটা সমাজ পরিচালিত হয়, সেই সব মূল্যবোধের জায়গাতেই বিরাট কতগুলো ঘাটতি তৈরি হয়েছে। মূল্যবোধের মধ্যে একটা বড় জিনিস থাকে, সেটা হচ্ছে ----- নিজেকে বোঝা, নিজেকে খোঁজা, নিজেকে উপলব্ধি করার একটা মন সক্রিয় থাকে। সেই মন থেকেই সে বুঝতে পারে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায়, তার অবস্থানটা কোথায়। সেই দিক থেকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের একটা সমস্যা বহুদিন থেকেই তৈরি হয়েছে। বাঙালি যেন ভুলে গেছে তার আত্মপরিচয়, তার ঐতিহ্য। এই শিকড়হীনতার কারণেই বাঙালি বুঝতে পারে না তার ভবিষ্যৎ। তাই থেকেই বাঙালির মধ্যে ভয়ংকর রকম বেশি পরামাণে আছে অনুকরণপ্রিয়তা। বাঙালি এক সময় সাহেবদের অনুকরণ করতো, এবং এখন যারা দিল্লিশ্বর তাদের অনুকরণ করছে। অর্থাৎ তাদের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি যখন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন বাঙালির এমন কোনও শক্ত মূল্যবোধের ভিত নেই যার দ্বারা সে এই চাপিয়ে দেওয়া ভাষা - সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি এবং নিজের জাতিগত অস্তিত্বকে রক্ষা করতে পারে ।

কলকাতায় যে সমস্ত সিনেমা হল রয়েছে, তার মধ্যে একটি মাত্র চেইনই এখন বাংলা ছবির জন্য অবশিষ্ট আছে। মানে মাত্র তিনটি প্রেক্ষাগৃহ। বাকি সব জায়গায় হিন্দি ছবিই চলে। কোনও ভাষার বিরুদ্ধে আমার কোনও রাগ নেই । কিন্তু আমার ভাষাকে যদি কেউ উচ্ছেদ করতে আসে, রুখে দাঁড়াতেই হয়, কলকাতা দূরদর্শনেই বা আমরা কতটুকু বাংলা দেখতে পাই ? সেখানে হিন্দির যে দৌরাত্ম তা তো সাম্রাজ্যবাদী চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে বহু বছর ধরেই। এবং এইভাবে বাঙালিকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও বাংলার সংস্কৃতির শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার উপর একটা অবক্ষয়ী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে । এসব কেন মেনে নেওয়া হচ্ছে ?

এক্ষেত্রে সেই মূল্যবোধটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, যে মূল্যবোধ থেকে একজন মানুষ তার নিজের সম্পর্কে সচেতন থাকে । একটা পরিবার তার পারিবারিক গৌরবকে মনে রাখে, একটা পল্লি, একটা মহল্লা এমনকি একটা বৃহত্তর সমাজ নিজেদের গোষ্ঠীর যে ঐতিহ্য তাকে সাদরে বহন করে নিয়ে চলে । বাঙালির জাতীয় জীবনে মূল্যবোধের এই সংকটাই আসল । এটা বহু দীর্ঘদিন ধরে ঘটছে । আজকে এই সংকট এবং চাপের মধ্যে বাংলা ভাষার দিকে মুখ ফেরানো, বাংলা বলা যেমন একটা আশু কর্তব্য, অন্যদিকে সমগ্র বাঙালি জাতির নিজের দিকে মুখ ফেরানো আরও বেশি জরুরি। এবং এই মূল্যবোধ আজও যেখানে জেগে আছে ঠাকুমা দিদিমাদের মতো প্রাচীনদের মধ্যে, সর্বোপরি বেশি করে গ্রাম বাংলায়।

যদিও এই বিষাক্ত বাতাস সেখানেও পৌঁছে গেছে, তবুও সেখানেই গরিষ্ঠ বাঙালি বাস করেন । গ্রাম বাংলার মানুষের জীবন চর্চার মধ্যে আজও বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি প্রাধান্য পায় ।‌ তাই তাদের দিকে মুখ ফেরালে হয়তো আমরা একটা পথের নির্দেশ পেতে পারি ।‌ যেহেতু অনেকরকম কাজের মধ্যে তাদের ভাষাকে নিয়ে যেতে হয়,‌সেই কারণে তাদের মুখের ভাষা এখনও কলকাতা শহরবাসীর মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাষা থেকে অনেক বেশি ঐশ্বর্যশালী ভাষা।

একটা ফসল বুনতে গেলে কয়েকশ এমন শব্দ তাদের ব্যবহার করতে হয়, যা শহরবাসী মধ্যবিত্ত বাঙালি জানেই না। শহরবাসী বাঙালি মধ্যবিত্ত ক'টা বাংলা শব্দ ব্যবহার করে সারাদিনে ? সকালে ঘুম থেকে উঠে, এই চা দাও, বাজারটা করে আনি । তারপর ট্রামে - বাসে, ঠেলছেন কেন ? অফিসে বড়বাবু কী হলো? এই তো তার বাংলা শব্দের পুঁজি।

এছাড়া সে আর যে বাংলা শব্দ ব্যবহার করে, তা হলো খবরের কাগজ থেকে শেখা নপুংশক কতগুলো বাংলা । সেইজন্যই বলছি, বাঙালি নিজের দিকে ফিরুক, নিজেকে চিনতে শিখুক, নিজের বিস্মৃতির থেকে বেরিয়ে আসুক । এইটেই বোধহয় বাঙালির সংকটের মুক্তির রাস্তা ।


সাক্ষাৎকার : কেশব মুখোপাধ্যায়
সুচরিতা মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
'সাহিত্য সূচিপত্র' পত্রিকার প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৯ প্রকাশিত ।
সাক্ষাৎকারটি টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে গ্রহণ করা হয় ।



*************************


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা বিষয়ক এক-আধ কথা
অমিতাভ নাগ


অগ্রজপ্রতিম বন্ধু রঞ্জন মিত্র যেদিন ফোন করে বলেছিলেন, 'শোনো সৌমিত্রকাকুর ওপর তোমায় লিখতে হবে, ওনার কবিতার ওপর', তখন বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। রঞ্জনদার আন্তরিক সম্ভাষণে অরাজি হওয়া প্রায় অসমম্ভব । অন্যত্র বলতে হয় যে সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়ের সিনেমার অভিনয় তথা থিয়েটার-নাটকের অভিসঞ্চার সম্বন্ধে কিয়ৎ আমার অকিঞ্চিৎকর ভাবনা যদি বা লিপিবদ্ধের চেষ্টা করে থাকি কখনো সখনো, ওনার কবিতা বিষয়ে আলোচনা করার মতো যোগ্যতা আমার নেই । বস্তুত স্বীকার করে নেওয়াই ভালো যে কবিতা-বিষয়ক আমার অদীক্ষিত অনুপ্রয়াসে যেকোনো কবিতা বিষয়ক আলোচনাই আমার জন্য প্রায় স্পর্দ্ধাপ্রদর্শন । তাই কবিতার মূল্যায়ন আমার অনধিকারচর্চা । কিন্তু নিজের অপ্রতুল কাব্যচেষ্টার অভিজ্ঞতায় আমার সুযোগ হয়েছিল ওনার ৫০টি কবিতার ইংরেজি তর্জমাপ্রকাশের । সম্ভবত 'Walking through the mist' নামক সেই কাব্যগ্রন্থটি তাঁর কবিতার প্রথম ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ । প্রকাশিত হয়ে সেটি তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগের দিন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন শেষবারের মতো তাই বইটি নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া আমার শেষপর্যন্ত জেনে নেওয়া হয়নি । যদিও অনুবাদ চলাকালীন সময়ে আমি একাধিক নির্বাচিত কবিতার নিগূঢ়ার্থ নিয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম । এই লেখায় আমি হয়তো ভাবার চেষ্টা করব আমার এই অনুবাদপ্রয়াসের যাত্রাকালে তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার যাপনচিত্রটি ।

তার আগে আরো একটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা থেকেই যায় । আমি যখন ওনার ওপর 'Beyond Apu' বইটি লিখছি ২০১৫ সালে তখন অব্দি ওনার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫, সিগনেট থেকে 'কাব্যসমগ্র' বাদ দিলে । দে'জ থেকে 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৯৩) এবং খলিল জিব্রানের 'দ্রষ্টা' (যা 'The Prophet'র বঙ্গানুবাদ) এই ১৫র অন্তর্গত । অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ২০১৫ এই চার দশকে তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫ । অথচ তার পরের ৫ বছরে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় সমানুপাতিক গ্রন্থের সংখ্যা । ৮০ থেকে ৮৫ বছর বয়সে ওনার কবিতার বইয়ের সংখ্যা, অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি বেড়ে গিয়েছিলো অনেকটাই । এবং এই সময়কালে তিনি চুটিয়ে ছবিও এঁকেছেন, এবং ছবি আঁকাতেই এক অনাবিল আনন্দও পাচ্ছেন স্বঘোষিতভাবেই । নাটকে ক্রমশঃ ছোট করে আনছেন অভিনয়বৃত্ত, সিনেমাতেও । আর প্রকাশিত হচ্ছেন বহুস্বরে পংক্তিতে, রেখায় ।

আগেই লিখেছি এই লেখা কোনোভাবেই তাঁর সমগ্র কাব্যসুষমার প্রতি অক্ষম দৃষ্টিপাত নয় । আমার অভিপ্রায় আমার অনুবাদচর্চায় কীভাবে আমি কবিকে আবিষ্কার করেছি সে বিষয়ে দুয়েক কথা জ্ঞাপন করা মাত্র ।

আমি মূলত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম তিন দশকের কবিতাই চয়ন করি আমার কাজে । এর কোনো নির্ধারিত কারণ দর্শিত করা দুরূহ । তবে এটুকু বলাই যায় যে সৌমিত্রবাবুর একদম প্রথম দিকের বেশ কিছু কবিতা থেকেই আমি চমকে বিদ্ধ হয়েছি ।

ধরা যাক তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'জলপ্রপাতের ধরে দাঁড়াবো বলে'র কয়েকটি পংক্তি -

"জনারণ্যে ফিরে এসে শিকড় নাবিয়ে খুঁজি রস
জীবনের, আর প্রেম অপ্রেম চাই না প্রেমিকা না,
চাই নারী একজন যে হবে দোসর, যার জানা
কেন এইখানে আসা কেন শুরু হয়েছে ভ্রমণ,
শেখাবে রহস্য এই বাঁচবার; চাই না রমণ ।"

অনূর্ধ্ব-চল্লিশে সৌমিত্রের এই অনুভূতি গভীর, যা হয়ত আগামী আরও পঁয়তাল্লিশ বছরের জিয়ৎকালের অভিজ্ঞতাও হতেই পারত । কিন্তু সেই প্রকাশের ভঙ্গি, এবং তার শব্দের সঞ্চরণপথ অনেকটাই সেকেলে, সাবেকি । এইটা বলার কারণ কিছুটা এইটাই, যে সৌমিত্রের যৌবনে যে দুই কবি বন্ধুর সঙ্গে তাঁর ওতোপ্রোতো বাঁধন সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু ইতিমধ্যে রবীন্দ্র এবং রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রভাব কাটানোর বিষয়ে ক্রিয়াশীল এবং অনেকাংশে সফলও । বাংলা সাহিত্য ততদিনে অনুভব করেছে 'হাংরি আন্দোলন'এর তীব্র অভিঘাতও । সেই নিরিখে সৌমিত্রের এই কুন্ঠিত পদচারণায় সংকোচের অলংকার যেন। এই সংকোচ-লালিত অভিযোজন থেকে সৌমিত্রের পদ্য, আমার কাছে, সাধারণভাবে বিচ্যুত হয়নি । তিনি স্বকৃত চেতনায় ফর্ম ভেঙেছেন, প্রকাশিত হয়েছেন শব্দের মুখ অবলোকনে, কিন্তু কোথাও যদি তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে থাকে, তা এই সঞ্চিত সৌন্দর্যের মিত প্রকাশেই ।

একাধিক ব্যক্তিগত আলাপে তিনি আমায় বলেছেন যে কবিতায় কখনো ভনিতা করা যায় না, কবিতা অমোঘ, তাই সত্য । এও বলেছেন যে নিজের একান্তের কিছু কথা যা মুখে প্রকাশ করার বাধা আছে তা তিনি কবিতায় ব্যক্ত করেছেন । তাঁর অনেক কবিতা পড়তে পড়তে আমার বারংবার মনে এসেছে এক একাকী বিষন্ন মানুষের অবয়ব -

"কোপাই-এর জলে ট্রাক ধুচ্ছে খালাসি
কোপাই-এর জলে ব্যথা ভেসে যাচ্ছে
একটা দিন আসবে
আমি এখানে নেই
কোপাই-এর জলে নতুন খালাসি ।"

('শব্দরা আমার বাগানে' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'কোপাই-এর জলে'কবিতা)

অথবা,

"আমরাও আজ বুঝি দুটি নৌকারই মত
দুদিকে গিয়েছি সরে
প্রতিমা ভাসান দিয়ে
সন্ধ্যা হয়ে এল
পুনরাগমনের মন্ত্র জানা নেই -
প্রায় অন্ধকারে
দুটি নৌকার মাঝে জলস্রোত ছলছল করে"

('মাঝে জলস্রোত' কবিতার অংশ,'হে সায়ংকাল' কাব্যগ্রন্থ)

যে কোনো কবিই যুগপৎ অলীক বিষন্নগ্রাহী এবং সায়াহ্নের স্বপ্নের মতোই অভ্রান্ত মিথচারী । সৌমিত্রকে কবি হিসেবে মেনে নিয়েও তাই সংশয়াত্তীর্ণ বিস্ময়ে মনে হয়, এতো কবিতা (প্রায় তিন অংকের প্রকাশিত কাব্যসংখ্যা) তিনি লিখলেন কোন অবসরে? ব্যস্ত নায়ক-অভিনেতার আপাত সময়হীনতার মধ্যেও কী করে তিনি রচনা করলেন এক দুর্ভেদ্য অগম্য দুর্গ যেখানে তিনি নিভৃতচারী, সংবেদী, বিবেকতাড়িত - "শুধু কাজ চালিয়ে যাচ্ছি যন্ত্রই বলা ভালো" অথবা "বল একবার সত্যি করে বল / স্বপ্নে অন্তত তোর ভেঙেছে শৃঙ্খল" ('ধারাবাহিক তোমার জলে' কাব্যগ্রন্থ থেকে দুটো কবিতার পংক্তি), অন্যত্রে "চলতে চলতে যাদের দেখি / তারা কেউ কেউ আমার সঙ্গে থেকে যায় / কিছু কিছু নদী / আমি রক্তের মধ্যে রেখে দিয়েছি" ('জন্ম যায় জন্ম যাবে' কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা থেকে)।

এই বিবেকের তাড়না থেকেই বোধকরি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বারবার স্মরণে আনার চেষ্টা করেন এই দেশের মানুষের প্রতি ঋণশোধের কথা । কবিতা তাঁর কাছে তখন আর নিছক মনের অন্তর্লীন ভাবপ্রকাশের মাধ্যম থাকে না, তা এক গভীর দায়স্বীকারের আশ্রয়ও হয়ে ওঠে । এতো দীর্ঘকাল কবিতাচর্চা এবং প্রায় সমকাল ধরে আবৃত্তিচর্চায় নিয়োজিত থাকা নিঃসন্দেহে তাঁর অভিনয়ক্রমকে বিন্যস্ত করেছে, বিস্তৃত, ব্যাপ্ত করেছে । তাঁর অভিনয়ের গভীরে প্রোথিত যে অনভিনয়ের অপ্রতিম ধারা তা জারিত হয়েছে কবিতাশিল্পের লঘিষ্ঠ অবভাসে । তাঁর অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর কবিতাও ক্রমশ: সংহত হয়েছে অর্ধ-শতাব্দীর পার করে । বাংলা সাহিত্যের, বিশেষ করে কাব্য-সাহিত্যের যে সুচারু ধারা, সেই অববাহিকায় কবি সৌমিত্র অক্লান্ত উজ্জ্বল থাকবেনই সেই নির্ঘোষ সন্দেহাতীত নয় । কিন্তু ছয় দশক ধরে অভিনেতা সৌমিত্রের যে উদার ধ্রুবরেখা তাকে স্পর্শ করার প্রগলভ অভিলাষও প্রায় কোনো সমসাময়িক অভিনেতার পরিকল্পিত অভিসন্ধানে দেখতে পাওয়া যায় না । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামক রূপকথার অনন্তযাত্রা একারণেই কাব্যসুষমায় চিহ্নিত থাকবে, তাঁর কবি পরিচিতিকে স্বভাবেই অতিক্রম করে ।


*******************


মনের মানুষ সৌমিত্রদা
সুদেষ্ণা রায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে নিয়ে লিখতে বসলে দুটি জিনিস নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়- কি নিয়ে লিখব, কতটা লিখব! আসলে সৌমিত্রদার কাজ, ওঁর জ্ঞান, ওঁর অভিজ্ঞতার পরিধি এত বিশাল যে সবকিছু নিয়ে লেখা সত্যিই শক্ত। তাই সৌমিত্রদা কে নিয়ে লিখতে বসে ঠিক করলাম ওঁর সান্নিধ্যে যে সময়টুকু কাটিয়েছি সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখব।

খুব অল্প বয়সেই ‘সমাপ্তি’ ছবিতে সৌমিত্রদাকে প্রথম দেখি। তখন টিনেজও হয়নি। এরপর একটু বড় হতে দেখি ‘পরিণীতা’। শরৎচন্দ্রের এই কাহিনী আমার পড়া ছিলো। সদ্য টিনেজার আমি মনে মনে যেমনটি ভেবে রেখেছিলাম আমার স্বপ্নের শেখর কে, সৌমিত্র তার শতগুণ সুন্দর, হ্যান্ডসাম ও রোমান্টিক ছিলেন। এই সময়ই ওঁর সঙ্গে প্রথম দেখা, ১৯৭১ হবে। একটা বিয়ে বাড়িতে। দূর থেকে আমার মনের মানুষ ‘শেখর’ কে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে যাই। উনি তো আমার চেনা মানুষ। কিন্তু আমি তখন ছোট মেয়ে ফ্রক পরা টিনেজার। উনি শুধু হেসেছিলেন। সেই যথেষ্ট। সেই সময় জানতে পারি ওঁর ছেলে সৌগত আমার ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলে পড়ে। শুনে একটু মনে মনে ব্যথা পেয়েছিলাম। তবে সব ব্যথার উপশম হয়ে যায় ‘সোনার কেল্লা’ দেখে। ফেলুদা ও সৌমিত্রদা হয়ে গেল সমার্থক। এরপর বড় হয়েছি। কলেজে থাকাকালীন ওঁর পুরনো নতুন নানা ছবি দেখেছি। দেখেছি ‘অপুর সংসার’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘কোনি’, ‘চারুলতা’ ‘ঘরে বাইরে’, ‘গণদেবতা’ অগুনতি ছবি। আসলে স্কুলে থাকতে তেমন সিনেমা দেখা হত না, তাই কলেজে এসে পুষিয়ে নিয়েছিলাম। ততদিনে টিভিও এসে গেছে, তাই রবিবার করে সিনেমা দেখতাম। দেখতে দেখতেই সৌমিত্রদাকে বার বার চিনেছি। ওঁর ফ্যান হয়ে উঠেছি। ওঁর গুনমুগ্ধ ফ্যান। এরপর চলে আসি সাংবাদিকতায় তখন আশির দশক। সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে থিয়েটার জগতে বিচরণ ছিল, তাই দেখলাম মঞ্চেও সৌমিত্রদার অভিনয়। কাজ করতে করতে কেমন করে যে সৌমিত্রদা দূরের তারকা থেকে অতি পরিচিত মানুষ হয়ে উঠল তা বোঝা মুশকিল। এটাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জাদু। উনি তারকা, কিন্তু এমন নয় যে ধরাছোঁয়ার বাইরে। খুব কাছ থেকে জানার ও চেনার সুযোগ এলো যখন নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে শুরু হল ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘অসুখ’। এই ছবিতে সহকারী ছিলাম ঋতুপর্ণর। প্রধানত পোশাক, অন্দর সজ্জা, অভিনেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ ছিল আমার। তাই শুটিংয়ের প্রথমেই চলত কথোপকথন। কী কী দৃশ্য হবে, কী পোশাক আর তার সঙ্গে খাও্যা দাও্যা, পরিস্থিতি ও অবশ্যই ওঁর কর্মজীবনের নানা ঘটনা। গল্পকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অর্থাৎ যিনি সভাতেই মধ্যমণি হবার উপযুক্ত তাঁকে কাছে থেকে দেখতে পেয়ে ধন্য হয়ে উঠি। মনে আছে, উত্তম বাবু সম্পর্কে তাঁর গভীর শ্রদ্ধা; সত্যজিৎ রায়ের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা ও সশ্রদ্ধ আনুগত্য। নিজের কাজের প্রতি, বিভিন্ন পরিচালক যেমন তপন সিংহ, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার তাঁদের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ নিয়ে কত কথা, কত গল্পগাথা। সেই সঙ্গে উপরি পাওনা, ওঁর লেখা কবিতা শোনা।

আমার ও অভিজিতের সৌভাগ্য হয় সৌমিত্রদাকে নিয়ে দুটি ছবি করার। এক, ২০০০ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের কাহিনী ‘প্রতিহিংসা’ অবলম্বনে একটি টেলিছবি ও তারপর ২০১৭-২৮ তে ‘শ্রাবণের ধারা’ বড় পর্দার জন্য। এই দুটি ছবিতেই সৌমিত্রদার সঙ্গে অভিনয় করে গার্গী। প্রথম ছবিতে গার্গী হয়েছিল, গৌরীকান্ত চরিত্রে সৌমিত্রদার পৌত্রি ইন্দ্রানী। আর ‘শ্রাবণের ধারা’তে শুভা রূপী গার্গী হল অমিতাভ সরকার চরিত্রে সৌমিত্রের স্ত্রী। যখন প্রথম সৌমিত্রদাকে এই চরিত্রায়ণ নিয়ে বলি, সৌমিত্রদা হেসে বলেছিলেন, ‘বলতে হবে তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে গার্গীরও পদোন্নতি হয়েছে। আমার পৌত্রি থেকে এক লাফে আমার স্ত্রী’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া এই ছবির রূপায়ন সম্ভব হত না। অ্যালজাইমার রোগে আক্রান্ত একজন মানুষের যে বাঙ্ময় অভিব্যক্তি প্রয়োজন তা উনি ছাড়া আর কেউই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন্না। একটি মানুষের প্রয়োজন ছাড়া আর কেউই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। আসলে তার কারণ, উনি নিজে। ছবির কাহিনীকার ডাঃ শুভেন্দু সেন ওঁর বিশেষ পরিচিত। ডাঃ সেন ওঁকে চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছিলেন। এবং অ্যালজাইমার রোগ সংক্রান্ত খুঁটিনাটি উনি ওঁর কাছ থেকে বিস্তারিতভাবে জেনেছিলেন। এবং যখন আমরা হাসপাতালের দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দি করি তখন ডঃ সেন সঙ্গে ছিলেন। শট দেও্যার পর সৌমিত্রদা প্রতিবারই জিজ্ঞেস করতেন, চরিত্রগতভাবে অভিব্যক্তি ঠিক তো! আমরা পরিচালকদ্বয় যেমন এই বিষয়ে ডঃ সেনের পরামর্শ নিতাম; সৌমিত্রদাও সেটা গ্রহণ করতেন। শেখার ইচ্ছা, জানার পরিধি তাঁর ছিল অন্তহীন।

শান্তিনিকেতনে শেষ দৃশ্য শুটিং করতে গিয়ে আমার একটা নতুন সংযোজন করি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঘ’ কবিতাটি।চিত্রনাট্যে প্রথমে ছিল না। কিন্তু গার্গীই বলে এটা দিয়ে শেষ করলে কেমন হয়? কথাটি সৌমিত্রদাকে শুটিং এর আগের দিন বলি। উনি জার্নি করে এসেছেন, একটু জিরিয়ে নিয়ে গল্প করতে করতে কথাটি উত্থাপন করি। এক মিনিট স্তব্ধতা, তারপর বলএন, ’প্রথম চার পংতি মনে আছে, বাকিটা বার করে দিও, এখন আর সব মুখস্থ থাকেনা। তবে এই কবিতাটি এই ছবির শেষ হিসাবে খুবই যথাযথ।’

এই কথাগুলো, ওঁর সঙ্গে গল্প, একসঙ্গে খাও্যা, ওঁর ছোট ছোট ভাললাগা, ওঁর দৃপ্ত পদক্ষেপ এই সবই আমাদের হৃদয়ে ঐশ্বর্য হয়ে যাবে। আর তার সঙ্গে মনের মণিকোঠায় জড়ো হয়ে আছে ওঁর নানা অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ‘মানিকদা’ জড়িয়ে নানা কাহিনী।

সত্যজিৎ বাবুর প্রতি ওঁর ভালোবাসা অপরিসীম। সর্বদাই ওঁর কথা বলতে ভালোবাসতেন। সত্যজিত বাবুর চোদ্দটি ছবিতে ওঁর উপস্থিতি স্মরণীয়। তবে একটা দুঃখ ছিল ওঁর শেষ অবধি। গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমায় গুপীর চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছা। ‘কিন্তু মাণিকদা রাজি হলেন না। আমি অনেক করে বললাম, একটু স্ক্রিন টেস্ট নিয়ে দেখুন। তবুও না। বললেন, তোমাকে গুপি হিসাবে দেখতে পাচ্ছিনা। ব্যাস এর উপর কথা চলে না। আর তপেন যেরক্ম অসভ্যের মতো ভাল অভিনয় করেছিল গুপী হিসাবে, তারপর আর আপসোসের মানেই হয় না।’ সৌমিত্রদার এই ইতিবাচক চিন্তাধারা অনুকরণীয়, নিজের না পাওয়াটাও কি সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারতেন উনি।

ওঁকে উত্তম কুমার নিয়ে ওঁদের প্রতিদ্বন্দিতা নিয়ে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি। সৌমিত্রদার স্রল উক্তি, ‘উনি আমার চেয়ে অনেকটাই বড় ছিলেন বয়সে। তাই আমি যখন এসেছি, তখন উনি সুপ্রতিষ্ঠিত। আমার আগমনে আরেকজন নায়ক এসেছিল বাংলা সিনেমা জগতে ঠিকই। কিন্তু আমাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার গরল ছিল না, একটা সুন্দর চ্যালেঞ্জ ছিল। উত্তম দাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ওঁর কাজের প্রতি আমার মুগ্ধতাও ছিল। উনিও আমার খুবই ভালবাসতেন। কিন্তু আমরা দুজনে যখন একসঙ্গে অভিনয় করতাম; দুজনের একজনও এক চিলতে ফাঁক ছাড়তাম না একে ওপরকে। ফলে দুজনের পারফর্ম্যান্স আরো উন্নত, আরো ক্ষুরধার হত।’

সৌমিত্রদার একটা ক্ষোভ ছিল উনি দেশ-বিদেশ থেকে অভিনয়ের জন্য এত পুরস্কার পেয়েছিলেন অথচ চারদশকের ওপর অভিনয় করার পরও উনি জাতীয় পুরষ্কার পাননি। যখন উনি অভিনয় ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন না দিয়ে ২০০১ সালে গৌতম ঘোষের ছবিতে অভিনয়ের জন্য স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড দেওয়াতে সৌমিত্রদা তা প্রত্যাখান করেন। ওঁর এই সততা, সাহসিকতা সত্যি প্রশংসনীয়। ‘কারণ আমি এর আগে বহু পাওয়ারফুল চরিত্রে অভিনয় করেছি; যেমন ‘কোনি’, সে বছর আমি পাইনি শশী কাপুর পেলেন আর এখন অনিল কাপুর পুকারের জন্য পাচ্ছে আর আমি কনসোলেশন প্রাইজ’। এই ধরনের কথা বলতে উনি কখনো দ্বিধা করেননি। ঠিক যেমন গত বছরও জেএনইউ কাণ্ড নিয়েও প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি। অবশেষে ২০০৪ এ পদ্মভূষণ ও ২০০৮ সালে সুমন ঘোষের ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান সৌমিত্রদা। এবং সে সময় তিনি তাঁর দর্শক ও গুণমুগ্ধদের কথা স্মরণ করে পুরস্কার গ্রহণ করেন। কারণ, ওঁর কাছে দর্শক ও শ্রোতারাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।

সৌমিত্রদার জীবন জুড়ে ছিল অভিনয়। কিন্তু লেখালেখি বা ছবি আঁকাও বাদ যায়নি। ওঁর কভিতা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত অভিব্যাক্তি। ক’দিন আগে, অর্থাৎ পুজোর কদিন আগেই আমি গিয়েছিলাম আমাদের অধিকার সুরক্ষা আয়োগের পত্রিকা ‘হুল্লোড়’এর জন্য কবিতা চাইতে। সঙ্গে সঙ্গে লিখেদিলেন ‘গণ্ডার’ নামের কবিতা। তার প্রথম চার লাইন উদ্ধৃত করলামঃ

এক ছিল গণ্ডার
বয়স্কালে হল ভীষণ মনের অসুখ তার।
শুধোয় তাকে বনের যত গণ্ডার গণ্ডারনি
‘কী হল বাছা। দুঃখ কিসের, কী আছে যা পাসনি?’

আসলে সবই উনি পেয়েছেন। পেয়েছেন অজস্র মানুষের ভালবাসা। কিন্তু গণ্ডারদের উনি সতর্ক করে গেলেন, ‘চোর শিকারির হাতে মরার পরিণাম জঘন্য…’ তাই এই কবিতাই এখন আমার কাছে তাঁর দেওয়া শেষ উপহার।


********************


মন ভাল নেই
সোহিনী সরকার


বেশিরভাগ মানুষকেই যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আজ পর্যন্ত কোন সময়টা দুরন্ত কাটিয়েছ- বেশিরভাগ লোকজনই, সে পাড়ার পার্থদা হোক বা তুলিদি, সেলিব্রিটি বা নন-সেলিব্রিটি- লেখক, গায়ক, সবাই বলে থাকেন স্কুল লাইফ বা কলেজ লাইফ। আমিও অবশ্য এদের দলেরই অন্তর্ভুক্ত। যদিও ভেবে দেখেছি মানুষের জীবন খুবই পরাধীন - ওই সময়টায় বিশেষকরে। সাধারণ সাধারণ জিনিসেও প্রচুর সীমারেখা টানা থাকে। নিজের পছন্দমত খাওয়া যায় না, ঘোরা যায় না, টিভি দেখা ইচ্ছে মত-কিছুই নয়। তখন দুঃখ যেন অসীম। সুতরাং তারই মধ্যে এক-আধ ঘন্টার জন্য নিজের মত কিছু করার স্বাধীনতা পেলে তা এক নিমিষে চেটেপুটে সাবাড় করে দেওয়ার ইচ্ছে হত। আমার ছোটবেলায় এই রকমই এক চরম স্বাধীনতার মুহূর্ত ছিল গরমকাল বা পুজোর স্কুল ছুটির সময় ‘ছুটিছুটি’ দেখার। তখন কেউ বলবে না- টিভি বন্ধ করো, ওই সময়টুকুতে আস্ত টেলিভিশন সম্পূর্ণ আমার দখলে। আমার সেই সাদাকালো টেলিভিশনেই আমার ছোটবেলার নায়ককে অপলক দেখেছি – সে কখনো আমার ফেলুদা, কখনও উদয়ন পন্ডিত, কখনও বা ক্ষিদ্দা। ছুটিছুট-তে প্রতিদিন পনের মিনিট করে সিনেমা দেখানো হত বাকিটুকু দেখার জন্য আবার পরের দিনের অপেক্ষা। আমার ক্ষিদ্দাকে নিয়ে আমি পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি।আমার পুরো শৈশব কৈশোরকাল জুড়েই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কিন্তু এও মনে মনে জানি কোনও শব্দচয়ন দিয়েই সেই অধীর অপেক্ষার আনন্দকে প্রকাশ করা অন্তত এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

মনে এল কোন একবছর দুর্গাপুজোর সময় তখন আমি ক্লাস সিক্স, ষষ্ঠীর দিন। প্রতিবছর পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। পাড়ার দিদিরা লাল পার শাড়ি, দাদারা ধুতি পাঞ্জাবি। আমরা তখন নেহাতই দুধভাত, তাই যা খুশি পরার অনুমতি মিলতো আমাদের। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলতো জমিয়ে রিহার্সাল। এরই মধ্যে একদিন শোনা গেল অপামার বাঙালির হার্টথ্রব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি আমাদের পাড়ায় আসবেন। সিপিএমের সময় তখন এবং ফেসবুকের জামানা শুরু হয়নি সেই সময়। ফলত, তাই খবরটির সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই রিহার্সালের বহর বেড়ে গেল এবং একপ্রকার আমি নিশ্চিতভাবেই জানি পাড়ার অধিকাংশ কাকিমা, জেঠিমারা পুজোর জন্য কেনা সেরা শাড়িটা ষষ্ঠীর সন্ধ্যেতেই পরেছিলেন। অবশেষে গুজব বলে যা ভাবা হয়েছিল তাকে সত্যি করেই, সন্ধে সন্ধে ছ’টার সময় আমার ছোট্ট পাড়ায় এসে পৌঁছলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সামনাসামনি সেই প্রথম দেখা। অসামান্য রূপবান পরনে চওড়া পাড়ের ধুতি আর লাল পাঞ্জাবী। কবিতা পাঠ করেছিলেন এটুকু মনে আছে। আমি তো তখনও ছুটিছুটি-র ঘোর থেকে বেরোতে পারি নি। সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দা থেকে আমার চোখের সামনে জ্যান্ত ফেলুদা- তখন ছোট ছিলাম তাই সবকিছুতে বিস্ময়বোধও ছিল অন্যরকম। কিন্তু এত সবকিছুর মধ্যেও আমাদের পাড়ার বেশ কয়েকজন সৌমিত্রের পরনের লাল পাঞ্জাবি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন- তার কারণ অবশ্য আমার অজানা।

এরপর সময় এগিয়ে চললো আর নিজের খেয়ালে। আমিও তখন অভিনয় জগতে পা রেখেছি। আমার দ্বিতীয় ছবি- অতনু ঘোষ এর পরিচালনায় রূপকথা নয়। ছবিতে আমার একটা দস্যি মেয়ের চরিত্র। বেশ কয়েক দিনের কাজ তার মধ্যে একটি প্রায় গোটা দিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কাজ। ম্যাডক্স স্কোয়ার শুটিং চলছে, শীতের সকাল তারিখটা ছিল ১৩ ডিসেম্বর ২০১০। দূর থেকে শুনতে পেলাম অতনু দা কে বললেন- মেয়েটিকে সব বুঝিয়ে দিয়েছো তো কি কি করতে হবে। আমার সেদিন চূড়ান্ত টেনশন, ওঁর সঙ্গে আমায় অভিনয় করতে হবে। আর অন্যদিকে একজন ফটোগ্রাফার দাদাকে পইপই করে বলে রেখেছি – আমি সৌমিত্রর বসা মাত্র পটাপট ছবি তুলে নেবে। ভালো ছবি উঠেছে কিনা আমার মাথার মধ্যে সেই ভাবনা কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও সেই দাদা ভদ্রলোক তার দেওয়া কথা রাখেন নি- আজ পর্যন্ত কোন ছবি আমি পাইনি। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অবশ্য কথা দিয়ে তা না রাখার ঘটনা অহরহ ঘটে।

কিন্তু সেই দুঃখ বা হতাসা আমার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ছবির প্রমোশনে অনেকবার দেখা হল আমার নিজস্ব নায়কের সাথে। এ কবার দেখা সাক্ষাতের মাঝে অনেক কথাো হল। ফলে সম্পর্ক খানিকটা সহজ হয়ে গেল। তবে সবচেয়ে বাড়াবাড়ি রকমের আনন্দ হল যখন ছবি রিলিজের দিন, প্রিমিয়ারের পর পার্টিতে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করলেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই সুবাদে আমিও মহা আনন্দে ওঁকে একটু জড়িয়ে ধরে ছবি তুলে ফেললাম। ধীরে ধীরে কখন যে আমার স্বপ্নের নায়ক সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় ‘জেঠু’ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ২০১৪ সালে আবার ওঁনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ এলো, ‘সেলফি’ ছবির সূত্রে। সেই সময় ওর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা হয়েছে সহজ চেহারায়। সেই আড্ডার বিষযয়ের মধ্যে ছবি বিশ্বাস থেকে সুচিত্রা সেন- সব প্রসঙ্গই অন্তভুক্ত থাকত। সেই সব আড্ডায় উনিই কথা বলতেন, আমরা শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মত সে সব শুনতাম। বাংলা ভাষার ওপর ওনার দখল ছিল ভীষণ রকমের। এত সুন্দর ভাষা, আমি তো আর কারোর কথা বলার মধ্যে আজ অবধি আর শুনতে পাই নি। ওনার কথা শুনতে শুনতে ওনাকে আমরা উসকে দিতাম, সৌমিত্র জেঠুও মহা আনন্দে অতীত দিনের নানান ঘটনা আমাদের শোনাত। ‘সেলফি’ ছবির শুটিং চলাকালীন আমি ওকে ভাস্কর চক্রবর্তীর একটি কবিতার বই উপহার দিয়েছিলাম। সৌমিত্র জ্যেঠুও ওনার নিজের লেখা একটা কবিতার বই আমাকে দিয়েছিলেন। মনে পরে, হয়তো কোথাও আমার ফড়িং ছবিতে অভিনয়ের কিছু প্রশংসা তাঁর কানে গিয়েছিল। একদিন আমাকে জেঠু বলল- ফড়িং তার দেখা নেই তবে দেখতে চান।আমি শোনা মাত্রই সৌমিত্র জেঠুকে ফড়িং সিনেমার একটি ডিভিডি দিয়েছিলাম।

সৌমিত্র জেঠুর সঙ্গে আমার খুব যে একটা নিয়মিত যোগাযোগ ছিল- এমনটা নয়। মাঝে মাঝে কথা হত বা দেখা সাক্ষাৎ হত। তাও জানতাম সৌমিত্র জেঠু আছে, আমাদের মধ্যে ভীষণভাবে আছে। এতটাই প্রবল উপস্থিতি ছিল ওর। এই তো এই কিছুদিন আগেই ফোন করেছিলাম পৌলমিদিকে, জেঠু কেমন আছে জানতে। পৌলমিদি বলল হাঁটতে গেছে, বাড়ি ফিরে এলেই কথা বলিয়ে দিচ্ছি তোমার সঙ্গে। আমি বললাম, না কথা বলাতে হবে না- ভালো আছেন ব্যাস; এটা জানতেই ফোন করেছিলাম। কে জানতো তখন, আর কোনদিন কথা হবে না। আজ এই লেখা যখন লিখতে বসেছি- মন চলে যাচ্ছে আট বছর আগের একদিন এমনি এক শীতের সকালে। রূপকথা নয় ছবির প্রধান চরিত্র শিশির রায়ের কাছে নিজের সব দুঃখ কষ্ট ব্যাথা উজার করে দিয়েছিল করে দিয়েছিল দস্যি মেয়ে সদ্য বিবাহিতা অহনা। আবার এসেছে শীতের সময়- কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আমার মন ভালো নেই।


*******************

Soumitra Chatterjee - A thorough gentleman
Rajaram Yagnik

It was sometime in 1961 that I first met Soumitra Chatterjee in a party at Anglo India Jute Mills, Jagadalapur. I was working in nearby Kankinara Jute Mill and was courting Lakshmi now my better half whose father was working in another next door mill. Lakshmi was friendly with Anju, the younger sister of Deepa, wife of Soumitra Chatterjee. Deepa’s father was also working in Anglo India Jute mills. It was thus that I was in the party where Anju sister-in-law of Soumitra introduced me to him. I had seen him in Apur Sansar so was very thrilled. A handsome tall shy smiling soft spoken person!

Next viola I met him in 1986 on the sets of Nirupama(Dena Paona) Rabindranath Tagore's short story being filmed in 1 hour movie format for TV in Hindi by Bijoy Chatterjee who was the director of this film and producer of the entire 10 stories series for Doordarshan. I was the father of the groom and he was the father of the bride played by Rupa Ganguly, her first appearance like me. What an experience! We all were on a 7 day shooting schedule in Bolpur and stayed in a big lodge where Tapan Sinha was on holiday stay. One day I was called by Mr Tapan Sinha in his room where both his wife Arundhuti Debi (an eminent actress and director) and Soumitra were there. We got familiar with each other and on the last day I was asked to meet Mr Tapan Sinha at his residence in Kolkata. During the entire shooting schedule Soumitra was so helpful and guided me as it was my 1st TV project. we became quite friendly and he asked me to work in his directorial venture the 3rd story in the series Stree Ka Patra also featuring Rupa Ganguly. Imagine the great experience! He was very clear in his concept and took my help in Hindi pronunciation for which the Hindi dialogues were written by Ms. Usha Ganguli.
Next I met him on the sets of Satyajit Ray's Ganashatru in 1989. He was such a good actor that he used to straight away conceive the behaviour and speech pattern of character.
Again we met on the sets of Shakha Proshakha in 1990. He had a very complex role and to achieve perfection he kept aloof sitting in a corner alone thinking of his character only till he was needed on the set. He was a perfectionist. Unlike many other artists he never read books in green room. He was either writing or thinking. We met after our shoots also. He took me to his new house in Golf Green, showed me his study in a separate building in the same compound, a place for his creativity. He was very much a Theatre person. He wrote plays, directed ,acted. He invited me to see his play Tiktiki (based on Anthony Shaffer's 'Sleuth')

He was a great fan of Shishir Bhaduri and used to tell many stories about his acting. I remember about one scene in which Mr Bhaduri was confronting someone. He himself was standing and the other character sitting at a distance. He had to threaten this character with a gun which was in his side pocket of kurta. instead of taking out his gun for this he took a large key and just banged outside his pocket creating a sound repeatedly which was more menacing then gun itself without any dialogue.

A thorough gentleman, a rare specie. His death is an irreparable loss

0 comments: