প্রবন্ধ
মালদহের জগজীবনপুর
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল
ইতিহাসকে বলা হয়- টাওয়ার অফ এক্সেলেন্স! গৌড় – মালদহ সেই এক্সেলেন্সের এক চরমতম উদাহরণ।
আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে কোনো চাকরি না পেয়ে (এককালে, খুব “শান্ত” থাকায় কোতোয়াল সাহেবরা আমার সম্বন্ধে খুব একটা ভালো ধারণা রাখেননি)।
ফলে, সে কালের স্বপ্ন –কোনো সরকারি বা আধা সরকারি চাকরি জোটেনি, আমার।
যে চাকরি পেয়েছিলাম, তার একটা গাল ভরা নাম থাকলেও আসলে সেটা ছিল, মাথায় ঝাঁকা নিয়ে ওষুধ বেচার চাকরি। পদে,পদে চাকরি হারানোর ভয়।
প্রথমে খুব অস্বস্তি বোধ করতাম। ধীরে ধীরে প্রচুর জায়গা ঘোরার ফলে এবং বহু মানুষের সংস্পর্শে আসায় এই চাকরিকে আর ছাড়তে পারিনি।
ইতিহাসের ওপর, মানুষের ওপর জন্মাল প্রেম। প্রেমের চিহ্ন,হলো ফুল।
কেউ কেউ জানেন, বেশীর ভাগই জানেন না হয়তো – বাংলার প্রাচীনতম ফুল ফুটেছিলো এই মালদাতেই।
“পাললিক শিলাস্তরের ৯২ মিটার তলায় মালদার “মিল্কি” অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিলো গণ্ডোয়ানা স্তর।”
সেখান থেকে আগ্নেয়গিরির লাভা স্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি ফুলের ফসিল পেয়ে, পরীক্ষা করে এটাই প্রমাণিত হলো- প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি বছর আগে এই ফুলটি ফুটেছিল এই মালদার মাটিতেই।
বৈজ্ঞানিকরা নাম রাখলেন – ওয়েল ট্রিকিয়া মালদা এনসিস এস পি নোভা।
বাংলার ইতিহাসে অনেক গৌরবময় অধ্যায় এবং বস্তুদের সঙ্গে নব সংযোজন ঘটলো- এই প্রাচীনতম পুষ্প জীবাশ্মটি। (ঝাড়খণ্ডী বাংলায় – পুপ্স)
(সূত্র :- মালদার ইতিহাস, কমল বসাক।)
আসল নাম হলো মালদহ। অপভ্রংশে- মালদা। যতটুকু জেনেছি, “মালদহ” নামটা কিন্তু সংস্কৃত নয়।
কেউ কেউ বলেন – মলদ, নামে এক জাতি গোষ্ঠীর নামে এই নামটা এসেছে। আবার কেউ বলেন :- “মালদহ” নামটা সৃষ্টি হয়েছে, এই ভাবে- মাল- শব্দটি হলো ফার্সি। অস্যার্থ-ধন/সম্পদ/পণ্যসামগ্রী।
মূল সংস্কৃত থেকে আসা – দহ শব্দটির অর্থ হলো, জলাশয়।
তাই বোঝা যায়- মালদহ একটা ধনশালী দেশকেই বোঝাচ্ছে। এই দেশে- কিছু মারোয়াড়ী ব্যবসায়ীও আসেন সেই সময়ে।
বেশীর ভাগই “আগরওয়ালা”। কালে এঁরা বাঙালি হয়ে যান। এখনও এই জনগোষ্ঠী আছেন, মূলত ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। পরে এরা “ রায়”- “দাস” এই উপাধিগুলো নিয়ে নেন। এই সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পুরোনো লোক এখনও নিরামিষ খান বাড়ীতে, পুরোনো ধারা বজায় রাখতে।
মালদহের ইতিহাস মানেই গৌড় – পাণ্ডুয়ার ইতিহাস। এই ইতিহাস পাল রাজত্বের (আনুমানিক খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে শুরু) আগে পর্যন্ত সে ভাবে পাওয়া যায় না।
যেটুকু জানা যায়, আগেই বলেছি-বেশির ভাগই গালগল্প, যার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। তবু বলি- বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে, অনেক জনশ্রুতির মধ্যে।
সেই গালগল্পই এবারে বলি। এগুলো মিথ হিসেবেই নেবেন, তবু একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
মহাভারতকেও অনেক নব্য যুক্তিবাদী (দাড়িওয়ালা মুখ) উড়িয়ে দেন গালগল্প বলে। আমার বক্তব্য, ধার্মিক দিকটা বাদ দিয়ে বর্ণিত ইতিহাসের ব্যাপারটা দেখাই যাক না।
*Mythology is to be considered to be the parent of all history!!!! Sir William Jones: - History of the primitive world!*
History কথাটার উদ্ভব, বহু হাজার বছর আগের গ্রীক শব্দ HISTOR থেকে। যার অর্থ:- Knowledge and judgment। পরে ল্যাটিন শব্দ Historia আরও একটা অর্থ যোগ করে। সেটা হলো- বর্ণণ বা narration।
কলির ৬৫৩ বছর হয়ে যাবার পর যুধিষ্ঠিরের বর্ণনা আছে মহাভারতে। মহাভারতের মধ্যে, পুণ্ড্র রাজ্যের সীমা নির্দেশ করতে গিয়ে, পূর্ব এবং পশ্চিমে –“করতোয়া” ও “মহানন্দা” এই দুটো নদীর নাম দেখতে পাই।
এই মহানন্দা নদী এখনও বর্তমানের মালদা জেলার মধ্যে প্রবাহিত। এটা বলা যেতেই পারে, মহাভারতের যুগে এখনকার মালদা জেলার সম্পূর্ণ না হলেও অন্তত পূর্বের দিকটা পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
দেবীপুরাণ আর পদ্মপুরাণে পুণ্ড্রবর্ধন নামটা আবার পাই। প্রবাদ আছে, এই জেলার যে জায়গায় পাণ্ডবরা ছিলেন, সেই স্থানের নাম পাণ্ডুয়া হয়েছিল।
অর্জুন যে জলাশয় খনন করেছিলেন, সেটা আজও সাতাইশ ঘড়া নামে আছে। ঘড়ার সাইজটা জানা যায় না, তবে সাতাশ ঘড়া জল দিয়ে অর্জুন এই জলাশয়কে ভরেছিলেন। এছাড়াও আছে- পাণ্ডবরাজ দালান।
বলা হয়, বাংলা নাকি পাণ্ডব বর্জিত দেশ। তা, সেই সময়ে এই মালদহ মগধ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
সুতরাং পাণ্ডবরা (যদি থেকেই থাকেন) এই পাণ্ডুয়া বা পুণ্ড্র বর্দ্ধনে এসেছিলেন বলেই অনুমান করা যায়।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় প্রাগজ্যোতিষপুরের (মোটামুটি ভাবে আসাম) রাজা ভগ দত্ত নাকি এই জায়গা দিয়ে যুদ্ধের হাতী সাপ্লাই দিয়েছিলেন।
মালদা এই বারেন্দ্র ভূমের একটি অংশ।
“গৌড়” এই নামটা, প্রাচীন যুগ থেকেই এক বিশাল সাম্রাজ্যের নাম হিসেবে পাওয়া যায়।
পূর্বভারতের এক সমৃদ্ধিশালী রাজ্য হিসেবে গৌড় চিরকালই বন্দিত। এই নামটা ছিল সম্ভ্রমসূচক। কারণ, এই রাজ্যের লোকপ্রিয়তা।
খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে বিখ্যাত বৈয়াকরণিক পাণিনিও “গৌড়” নামটি উল্লেখ করেছেন।
“গৌড়” বিশেষ্য নামটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, স্থানবাচক শব্দটি “ বিশেষণ” হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে। ব্যঞ্জনাও বেড়ে যায় শব্দটির।
“ওজঃ” (এখানে, সাহিত্যের গাম্ভীর্য সৃষ্টিকারী দীপ্তি) প্রকাশক শব্দের ব্যবহার, আড়ম্বরপূর্ণ সমাসবহুল কাব্য রচনার এক বিশেষ রীতিকে “গৌড়রীতি” বলা হতো।
সারা ভারতবর্ষ, এই গৌড়রীতিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। সংস্কৃত আলঙ্ককারিকরা সংস্কৃত রচনার চার রকম রীতির মধ্যে এই রীতিকে সমাদরে নিয়েছিলেন।
আলঙ্ককারিক ভামরু এবং দণ্ডী সেকালের কাব্য রীতির সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাচীন বৈদর্ভরীতির সঙ্গে গৌড়রীতির কথাও সম্ভ্রমের সাথে বারবার বলেছেন।
সেযুগে সর্বভারত গ্রাহ্য বৈদর্ভরীতির মানের পাশে গৌড়রীতির তার একটা আলাদা আসন নিয়েছিল। প্রাচীন বাংলার এটা একটা দারুণ গর্বের ব্যাপার।
আমার মনে হয়, সেই কারণেই বাংলায় কোনোকালেই কবিদের কমতি হয়নি বা এখনও নেই।
“গৌড়িক” নামে এক খনিজ রূপার ব্যবহার ছিল, এটাও আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানতে পারি। অলঙ্কার তৈরির জন্য এই বিশেষ মানের রূপা “গৌড়েই” প্রস্তুত করা হতো বলে কৌটিল্য (চাণক্য) বলে গেছেন।
প্রসঙ্গত বৃহৎসংহিতা একটি প্রসিদ্ধ জ্যোতিষ গ্রন্থ, গৌড়রীতির পদ্য আকারে লেখা। এতে তিনি জ্যোতিষী দৃষ্টিকোণ থেকে বহু পাথরের বিবরণ এবং প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক তথ্য সন্নিবেশিত করেছিলেন। এছাড়াও এতে সূর্য ও চন্দ্রের গতি ও প্রভাব, আবহবিদ্যা, স্থাপত্য এবং পূর্তবিদ্যার নানা বিষয় প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়েছে। এই বইয়েই তিনি ব্রজলেপ নামে একটি বস্তুর প্রস্তুতপ্রণালী ব্যাখ্যা করেছেন যা আধুনিককালের সিমেন্টের সমগোত্রীয় ছিল। সে সময় ভারতে বরাহমিহির উদ্ভাবিত এই ব্রজলেপ দিয়েই বড় বড় দালান কোঠার ইটের গাঁথুনি তৈরীতে ব্যবহৃত হতো বলে অনেকেই মনে করেন, তবে তথ্যসূত্রের অভাব আছে।
“গৌড়ীয়” ইটের তৈরি বহু, মন্দির- মজসিদ বা বসত বাড়ী এখনও গৌড় মালদায় দেখা যায়।আচার্য যাস্কাচার্যের নিরুক্তে (বেদের দুরূহ শব্দগুলোর ব্যুত্পত্তি ও ব্যাখ্যাসংবলিত বই) “গৌড়ী” নামের এক বিশেষ মদিরার কথা উল্লেখ আছে। বিশেষ এক ধরণের গুড় পচিয়ে এই “গৌড়ী” তৈরি হতো।
রামায়ণে, বনবাস কালে রামচন্দ্র – অন্য দুইরকম মদিরার (পৌষ্টি- পিঠে পচিয়ে তৈরি, মাদ্ধী – মধু থেকে তৈরি) সাথে এই “গৌড়ী” পান করতেন বলে রামায়ণের কাব্যকাররা বলেছেন। রামচন্দ্র কল্পিত চরিত্র যদি হয়েও থাকেন তবুও এটা বলা চলে, এই “গৌড়ী” তখনকার ভারতবর্ষের লোকেরা পান করতেন।
আনুমানিক অষ্টম- নবম শতাব্দীতে রচিত মহাযান বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পে “গৌড়- তন্ত্র” নামের উল্লেখ পাই।
সেই সময়ে এই “গৌড়- তন্ত্র” এক অনন্য স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল।
সঙ্গীত রত্নাকর বইতে সঙ্গীতের যে সব রীতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যে সব রাগ-রাগিনীর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে “গৌড়মল্লার”, “গৌড়সারঙ্গ”, “গৌড়কৌশিক”, “কর্ণাট- গৌড়” এই সব নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাছাড়া চর্যাগীতির মধ্যে বলা “ গবড়া” বা “ গউড়া” নামটি সম্ভবত “গৌড়” নামের সঙ্গে যুক্ত।
ভারতের নাট্য শাস্ত্রে প্রাচীনকালে উল্লেখ আছে যে, নাট্যাভিনয়ে “গৌড়পাত্রগণ” অর্দ্ধ মাগধী ভাষা ব্যবহার করতেন।
সেই সময়ে-পূর্বভারতে প্রচলিত লিপিকে, অর্থাৎ বর্তমানের দুই বাংলা, ওডিশা,আসাম প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত লিপির আদি রূপকে “ গৌড় লিপি” বলা হতো।
আল- বিরুনী, একাদশ শতাব্দীতে এই “ গৌড় লিপি” র কথা বলেছেন।
এখন লজ্জার কথা হলেও, বলা দরকার- মধ্যযুগে দাসদাসী কেনা বেচার প্রথা যে প্রচলিত ছিল, সেটা অভিজ্ঞ পাঠক মাত্রেই জানেন।
গৃহকর্তার অধীনে ঘরের কাজকর্ম করা ছাড়াও দাসীদের কাজ ছিল, কর্তার যৌন লালসার শিকার হওয়া।
গৃহকর্ত্রী জেনেও কিছু বলতেন না। বরং, এই সবে উৎসাহই ছিল। নিজেও এই সবে সাগ্রহে অংশ নিয়ে, “ পুণ্য” করছে বলে ভাবতো।
সে যাই হোক, দাসদাসীর কেনা বেচার লিখিত দলিলের অভিধা ছিল “গৌড়ীয় শত পত্রিকা” ।
সমাজ সংস্কারক হিসেবে চৈতন্য দেব এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
চৈতন্য দেবের প্রবর্তিত ধর্ম- “গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম” ও “গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনা” সম্বন্ধে সবাই জানেন।
অবিভক্ত বাংলাকে “গৌড়দেশ” বলা হতো, আর এদের অধিবাসীদের “গৌড়জন”।
সেই সময়ে ভারত সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা আঞ্চলিক চেতনা “ গৌড়” নামে একটা বিশিষ্ট সংজ্ঞায় খ্যাতিলাভ করতে এবং একটা স্বতন্ত্র ধারার প্রচলন করাতে সফল হয়েছিল।
আজকের গৌড় শহর, ইংলিশবাজার থেকে ১৫ কিমি দূরে। সুবিধে মতো যান- বাহন নিয়ে ঘুরে আসা যায়। গৌড়ের কিছু অংশ বাংলাদেশের মধ্যেও পড়েছে। এখানকার সীমান্ত মহদীপুর । প্রচুর পণ্য চলাচল এখন এই সীমান্ত দিয়ে হয়।
ভ্রমণকারীদের একটা প্রশ্ন জাগে মনে, মাত্র ৫০০ বছর আগে যে শহরের এত জাঁকজমক ছিল, তার এখন এরকম দশা কেন!!!
দেখে নেওয়া যাক, সেই সময়ের গৌড় কেমন ছিল!
১৫৪০ খৃষ্টাব্দের কিছু আগে লেখা এক পর্তুগীজ ব্যবসায়ীর (De Barros) প্রতিবেদন থেকে ইংরেজী অনুবাদ দিচ্ছি :-
“The population of the city is so great and the streets are so thronged with concourse and traffic of the people, especially of such as come to present themselves at the king’s court, that they cannot force their way past one another.
A great part of this city consists of stately and well-wrought buildings.”
এই প্রসঙ্গে De Barros এর ১০০ বছর পর ১৬৪০ খৃষ্টাব্দের কিছু আগে Fariay Souza নামে আর এক প্রত্যক্ষদর্শী পতুর্গীজ ব্যবসায়ীর প্রতিবেদনের হুবহু অনুবাদ হলো :-
“…It (GOUR) contained 1,200,000 inhabitants and was so crowded that at the time of religious, festivals and processions, numbers of people were trodden to death.”
বর্তমানে, কয়েকটি মসজিদ এবং তোরণ ছাড়া, সেযুগের সাধারণ নাগরিকদের তৈরি অট্টালিকা বা বাসস্থানের একটিও গৌড়ে নেই,কিছু ধ্বংসাবশেষ ছাড়া। জগতে কোনো কিছুই কালজয়ী নয়। এর একটা কারণ অবশ্য আছে।
বৃষ্টিস্নাত পলিমাটির দেশ বাংলায় গরম আবহওয়া ইঁটের তৈরি স্থাপত্য শিল্প টিকিয়ে রাখার অনুকূলে নয় ।
১৫৭৪ খৃষ্টাব্দে, খান্ খানান্ মুনিম খাঁ, যখন দিল্লির সুলতানের নিযুক্ত বাংলার শাসন কর্তা হয়ে আসেন, তখন শ্রীহীন গৌড়ের অবস্থান, প্রাচীন প্রাসাদ,জনসাধারণের বাসযোগ্য কিন্তু পরিত্যক্ত অট্টালিকা দেখে এতই মোহিত হয়ে পড়েন, যে পরিত্যক্ত গৌড়ের সংস্কার করে এই গৌড়েই তাঁর রাজধানী করলেন।
বিধি বাম হলে যা হয়, ভয়ঙ্কর প্লেগের প্রাদুর্ভাব । এই মড়কের জন্য গৌড় মনুষ্য বর্জিত শূন্য নগরীতে পরিণত হলো।
ফার্সী বই – “তবকৎ-ই-আকবরী” র ইংরেজী অনুবাদকের ভাষায় বর্ণণাটা এই রকম :-
“ By degrees the pestilence reached to such a pitch that men were unable to burry the deads and cast the corpses into the river...”
বিপদ অন্যরকম ভাবেও এলো। এই নদীর জল পানীয় হিসেবে খেয়ে প্রচুর লোক বিষক্রিয়ায় মারা গেলেন।
ধীরে ধীরে গৌড়ের সমস্ত প্রাচীন প্রাসাদ, জনসাধারণের বাসযোগ্য অট্টালিকা পাষাণ পুরীর থমথমে স্তব্ধতাকে সঙ্গী করে, ক্রমশ ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গেল। জন্তু, জানোয়ারদের প্রিয় আবাস স্থল হলো গৌড়।
অনেক অনেক পরে, গৌড়ের প্রাসাদ ও অট্টালিকার শক্ত ও প্রায় ক্ষয়হীন “গৌড়ীয় ইঁট”গুলো খুলে নিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল।
মুর্শিদাবাদ যখন বাংলা-বিহার-ওডিশার রাজধানী ছিল তখন এখানের সমস্ত বাড়ী ঘর এই “গৌড়ীয় ইঁট” দিয়েই তৈরি হতো।
বর্ষাকালে খাল –ডোবা-নীচু জমিতে জল জমার ফলে নৌকা নিয়ে গৌড়ে ঢোকা খুবই সহজ ছিল। তাই “গৌড়ীয় ইঁট” পাচার করাটা ছিল জল ভাত।
মানুষ নিজের হাতে ধ্বংস করতে লাগল-মহামূল্যবান এই সব প্রাচীন ঐতিহাসিক শিল্পকে।
Mr. Reuben Barrow ১৭৮৭ খৃষ্টাব্দে গৌড় বেড়াতে এসে লিখেছিলেন-
Gaur seems rather to have been destroyed by the removal of the materials for other purpose, than by time.”
এই ঘটনা, ভারতের সব জায়গাতেই ঘটেছে।
গৌড়- এই নামটা এলেই রাজা শশাঙ্কের কথা আসবেই আসবে। শশাঙ্কের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে অতি অল্প তথ্য জানা যায়। ধারণা করা হয় যে,তিনি রোহতাসগড়ের মহা সামন্ত হিসেবে কর্ণসুবর্ণের গৌড় রাজার অধীনে কিছুদিন রাজ্য শাসন করেন।
রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সীলের ছাঁচে লিখিত ‘শ্রী মহা সামন্ত শশাঙ্ক’, বাণ ভট্টের সমসাময়িক সাহিত্য উপকরণ,চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাঙের বিবরণ এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্য মঞ্জুশ্রী মূলকল্প শশাঙ্কের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই বৌদ্ধ গ্রন্থে পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে হর্ষের হাতে শশাঙ্কের পরাজয়ের কাহিনী এবং শশাঙ্কের ১৭ বছরের রাজত্বকাল সম্পর্কে বলা হয়েছে।
উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্ত বংশীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্ত শাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন শশাঙ্ক।
তাঁর ৮ম ও ১০ম রাজ্যাঙ্কে প্রকাশিত দুটি লিপি পাওয়া গেছে মেদিনীপুর থেকে এবং দিনাঙ্ক বিহীন অপর একটি লিপি খড়গপুরের নিকট এগ্রা হতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া শশাঙ্কের অধীনস্থ গঞ্জামের (ওডিশা) রাজা মাধববর্মার তাম্রশাসন (৬১৯ খৃষ্টাব্দের), হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা ও মধুবন তাম্রশাসন এবং কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মণের নিধান পুর তাম্রশাসন থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। শশাঙ্কের উৎকীর্ণ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া গেছে।
আগে দেখে নেওয়া যাক, কর্ণ সুবর্ণ ঠিক কোন জায়গায় ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গার (রক্ত মৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) কাছেই চিরুটি রেল ষ্টেশন। এই চিরুটি হলো কর্ণ সুবর্ণ।
বাংলা, মৌর্য বংশের (খৃঃ পূঃ ৩২৪-১৮৫ খৃঃ পূঃ) শাসনাধীন ছিল। পর্যটক হিউয়েন-সাঙের এর বর্ণনা মতে বর্তমান পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা ও পূর্ণিয়া জেলায় আবিষ্কৃত মুদ্রা এবং মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত সম্রাট অশোকের শিলালিপি হতে নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে মৌর্যরা বাংলাদেশ শাসন করেন।
গুপ্ত শাসনামলের শেষের দিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ এলাকায় ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্র ও সমাচারদের এবং গৌড় এলাকায় স্থানুদত্ত রাজা ছিলেন! হযরত মুহম্মদ (সঃ) যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন ঠিক তখন গৌড় তথা বাংলাদেশের স্বাধীন নরপতি ছিলেন রাজা শশাঙ্ক। অনেকের মতে রাজা শশাঙ্ক গুপ্ত বংশোদ্ভূত ছিলেন।
শশাঙ্ক ছিলেন শিবের ভক্ত। বান ভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ শশাঙ্ককে বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হিসাবে উল্লেখ করেছন। কিন্তু নালন্দায় অবস্থিত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যেখানে হিউয়েন-সাং নিজেও বেশ কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন, এবং শশাঙ্কের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণের উপকণ্ঠে রক্ত মৃত্তিকা মহাবিহারসহ বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মঠের অস্তিত্বের ইত্যাদি থেকে এদের তথ্যকে যথার্থ বলে মনে করা যায় না।
লিপিমালা এবং সাহিত্যিক সূত্রে শশাঙ্ক সংকীর্ণ গৌড়ের শাসক হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। সংকীর্ণ অর্থে পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলই গৌড়। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এক বিস্তৃত এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত হয়। শক্তি সঙ্গম তন্ত্র গ্রন্থের ৭ম পটল ‘ষটপঞ্চদ্দেশবিভাগে’ বলা হয়েছে যে, গৌড়ের সীমানা বঙ্গদেশ হতে ভুবনেশ (ওডিশার ভুবনেশ্বর) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এটি অসম্ভব নয় যে, লেখক শশাঙ্কের রাজ্যসীমা, যা ওডিশার একটি অংশকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল, চিন্তা করেই গৌড় দেশের বিস্তৃতির বর্ণনা দিয়েছেন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির সঙ্গে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংস ও পতন আকস্মিক যুগপৎ সংঘটন। অনেক অপরিচিত এলাকা, যেগুলি সম্ভবত গোত্র প্রধানগণ শাসন করতেন এবং যেখানে জনবসতি ছিল হালকা, ঐতিহাসিক খ্যাতি অর্জন করে। এ এলাকাগুলির মধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর ওডিশা এবং মধ্যপ্রদেশ সংলগ্ন এলাকার (ছোট নাগপুর মালভূমির অংশ) লালমাটি অঞ্চল, যেখানে চাষাবাদ ও বসবাস করা বেশ কষ্টসাধ্য।
এ পরিপ্রেক্ষিতে শশাঙ্ক ভারতের বিভিন্ন অংশে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল মৌখরিদের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থেকে মগধ মুক্ত করা। শশাঙ্ক তাঁর মিত্র মালবের রাজা দেব গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে পুষ্যভূতি রাজ প্রভাকর বর্ধনের জামাতা মৌখরি রাজ গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। গ্রহবর্মা দেব গুপ্তের হাতে নিহত হন। এরপর প্রভাকর বর্ধনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বৌদ্ধ ধর্ম মতাবলম্বী থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধন দেব গুপ্তের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দেব গুপ্তকে পরাজিত ও নিহত করেন। কিন্তু দেব গুপ্তের মিত্র শশাঙ্কের সঙ্গে এক সংঘর্ষে রাজ্যবর্ধন নিহত হন।
অধিকাংশ পণ্ডিত গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাতের বিষয়টি সত্য বলে ধরে নিলেও শশাঙ্কের হাতে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর অভিযোগ এড়িয়ে যান। বাণভট্টের মতে, রাজ্যবর্ধন খুব সহজেই মালবের সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন এবং তিনি ‘গৌড়ের রাজার মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত হয়ে নিরস্ত্র ও একাকী অবস্থায় শত্রু শিবিরে নিহত হন’। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাঙ একই ধরনের বর্ণনা দেন। শশাঙ্কের শত্রুর মৃত্যুর প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের অভাব রয়েছে। তাই রাজ্যবর্ধনের প্রতি শশাঙ্কের আচরণ বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। নিজের পৃষ্ঠপোষকের ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত বাণভট্ট এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ও হর্ষবর্ধনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ হিউয়েন-সাঙ উভয়েই তাদের মনোভাবের জন্য সুপরিচিত। সম্ভবত এ কারণেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সম্পর্কিত বিবরণ দানে আবেগ প্রশমিত করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
গুপ্তবংশের রাজাদের ক্রম (সকলের সময়েই বাংলা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, এমন নয়)
শ্রীগুপ্ত> ঘটোৎকচ> প্রথম চন্দ্রগুপ্ত> নিশামুসগুপ্ত> সমুদ্রগুপ্ত> রামগুপ্ত> দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত> প্রথম কুমারগুপ্ত> স্কন্ধগুপ্ত> পুরুগুপ্ত> দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত>বুদ্ধগুপ্ত> নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য> তৃতীয় কুমারগুপ্ত> বিষ্ণুগুপ্ত> বৈন্যগুপ্ত> ভানুগুপ্ত।
প্রখ্যাত বৌদ্ধ ইতিহাস রচয়িতা তারানাথ এই সময় সম্পর্কে বলেন, 'সমগ্র বাংলাদেশ জুড়িয়া অভূতপূর্ব নৈরাজ্যের সূত্রপাত হয়। গৌড়ে-বঙ্গে সমতটে তখন আর কোনও রাজার আধিপত্য নাই, সর্বময় রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব তো নাইই। রাষ্ট্র ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন; ক্ষত্রিয়, বণিক, ব্রাহ্মণ। নাগরিক স্ব স্ব গৃহে সকলেই রাজা। আজ একজন রাজা হইতেছে, কাল তাহার মস্তক ধূলায় লুটাইতেছে।'
এর চেয়ে নৈরাজ্যের বাস্তব চিত্র আর কি হতে পারে! সমসাময়িক লিপি ও কাব্যে (রামচরিত) এ ধরনের নৈরাজ্যকে বলা হয়েছে মাৎস্যন্যায়। বাহুবলই একমাত্র বল, সমস্ত দেশময় উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল শক্তির উন্মত্ততা; দেশের এই অবস্থাকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তাকেই বলে মাৎস্যন্যায়। অর্থাৎ বড়মাছের ছোট মাছকে গ্রাস করার যে ন্যায় বা যুক্তি সেই ন্যায়ের অপ্রতিহত রাজত্ব।
শত বৎসরের এই মাৎস্যন্যায়ের নৈরাজ্যে বাংলায় আর্থ সামাজিক অবস্থা চরম নাজুক অবস্থায় পতিত হয়। এই নৈরাজ্যে সাধারণ মানুষের জীবনেকি পরিমাণ ভোগান্তি ও দুর্দশা ছিল টা সহজেই অনুমেয়। সংস্কৃত গ্রন্থ মঞ্জুশ্রীমূলকল্প থেকে এই সময় ঘটা এক নিদারুণ দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায়।
শেষ পর্যন্ত এই উৎপীড়ন যখন আর সহ্য হলো না তখন সারা বাংলার রাষ্ট্র নায়কেরা একত্র হয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজন কে অধিরাজ বলেনির্বাচন করলেন এবং তাঁর সর্বময় আধিপত্য মেনে নিলেন। এই রাষ্ট্রনায়ক অধিরাজের নাম গোপাল দেব।
কে এই গোপাল দেব? গোপালের পুত্র ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রলিপি তে বলা হয়েছে "গোপাল দেব ছিলেন দয়িতবিষ্ণুর পুত্র এবং বপ্যটের পৌত্র। মাৎস্যন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজা নির্বাচন করিয়াছিল"।
একটা ব্যাপার লক্ষণীয় পাল রাজাদের রাজ সভায় রচিত কোনও গ্রন্থে নিজেদের বংশ কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়নি। সাধারণ প্রজা দয়িতবিষ্ণুরপুত্র গোপাল দেবের জন্ম ভূমি বরেন্দ্র(রাজশাহী) অঞ্চলে। এবং সেখানে তিনি একজন সামন্ত নায়ক ছিলেন। এবং তিনি যে বাঙালি ছিলেন এতে সন্দেহের অবকাশ নাই।
লিপিতে বলা সংস্কৃত প্রকৃতিপুঞ্জ শব্দের অর্থ যদিও জনসাধারণ, কিন্তু বাংলার সকল জনগণ সম্মিলিত হয়ে গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেছিল এটা মনে হয় না। আসলে তখন দেশ জুড়ে অসংখ্য সামন্ত নায়কেরা ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাহারা যখন দেশকে বারবার বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ থেকে আর রক্ষা করতে পারলেন না, শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারলেন না, তখন একজন রাজা ও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলা ছাড়া বাঁচার আর পথ ছিলনা।তাদের এই শুভ বুদ্ধির ফলে বাংলাদেশ নৈরাজ্যের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা এবং বৈদেশিক শত্রুর কাছে বার বার অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেল।
আনুমানিক ৭৫০ খৃস্টাব্দে গোপাল দেব(৭৫০ খ্রীঃ-৭৭৫ খ্রীঃ) পাল বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা হয়ে সমস্ত সামন্ত প্রভুদের দমন করে নিজের আধিপত্যপ্রতিষ্ঠা করেন, দেশ থেকে অরাজকতা দূর করেন, বহি শত্রু আক্রমণ থেকে দেশ কে রক্ষা করেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে গোবিন্দপালের(১১৬১খ্রীঃ-৬৫খ্রীঃ) সঙ্গে সঙ্গে গোপাল প্রতিষ্ঠিত এই পাল বংশের অবসান ঘটে। সুদীর্ঘ চারশো বৎসর ধরে নিরবচ্ছিন্ন একটা রাজবংশের রাজত্ব খুব কম দেশের ইতিহাসেই দেখা যায়।
বৃহত্তর বাংলাকে সংহত ও শক্তিশালী করে গোপাল মারা যাবার পর হাল ধরেন পুত্র ধর্মপাল। তার নেতৃত্বে বাঙালির সামরিক শক্তি তৎকালীন ভারতেরঅন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। তিনি প্রায় সমগ্র পূর্ব ভারতের একের পর এক রাজয় জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। "কনৌজজয় করার পর এক দরবারের আয়োজন করেন। ঐ দরবারে ভোজ, মৎস্য, মুদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তী, মালব, বেরাব, গান্ধার, পেশোয়ার, কীর প্রভৃতি প্রাচীন রাজ্যগুলির রাজাগণ উপস্থিত হইয়া বাঙালি ধর্মপালকে অধিরাজ বলিয়া স্বীকার করেন" - (খালিমপুর তাম্র লিপি)
পাঞ্জাব থেকে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত বিভিন্ন রাজ্যসমূহ ধর্মপাল জয় করেছিলেন। ধর্মপাল মারা যাওয়ার পর রাজা হন পুত্র দেবপাল। দেবপাল পিতার সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত করেন। হিমালয়ের সানু দেশ হতে আরম্ভ করে বিন্ধ্য পর্যন্ত এবং উত্তর পশ্চিমে কম্বোজ থেকে আরম্ভ করে প্রাগজোতিষ পর্যন্ত তার আধিপত্য স্বীকৃত হতো।
এত বড় সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজন ছিল। আরবের বণিক পর্যটক সুলেমান তার বিবরণীতে বলেন। "বঙ্গরাজ দেবপালের সৈন্যদলে ৫০০০০ হাতি ছিল এবং সৈন্যদলের সাজসজ্জা ও পোশাক পরিচ্ছদ ধোওয়া, গুছানো ইত্যাদি কাজের জন্যই ১০ থেকে ১৫ হাজার লোক নিয়োজিত ছিল"।
একশ বছরের কম সময়ের মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন হতোদ্যম বাঙালি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে শৌর্য বীর্য ও দক্ষতার সাথে বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল। যার যাদু মন্ত্র ছিল বৃহত্তর বাংলার ঐক্যবদ্ধ শক্তি। এই শক্তির ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলে প্রতিষ্ঠাতা গোপাল।
বাংলার ইতিহাসে পালবংশের আধিপত্যের এই চারশো বৎসর নানাদিক থেকে গভীর ও ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। বর্তমানের বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয়েছে এই যুগে। শশাঙ্ক যদিও শুরু করেছিলেন কিন্তু পাল আমলেই বাঙালির রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ লাভ করে এই পাল যুগে। বাংলা ভাষাও লিপির গোড়া খুঁজতে হলে এই চারশো বৎসরের মধ্যে খুঁজতে হবে। এই লিপি, ভাষা, ভৌগলিক সত্ত্বা ও রাষ্ট্রীয় আদর্শকে আশ্রয় করে একটি স্থানীয়সত্ত্বাও গড়ে উঠে এই যুগে।
সেই হাজার বছর আগে পাল রাজাগণ ছিলে অসাম্প্রদায়িক। তারা নিজেরা বৌদ্ধ; অথচ বৈদিক হিন্দু ধর্মও তাদের আনুকূল্য ও পোষকতা লাভ করেছিল। এমনকি একাধিক পালরাজা হিন্দু ধর্মের পূজা এবং যজ্ঞে নিজেরা অংশ গ্রহণ করেছেন, পুরোহিত সিঞ্চিত শান্তি বারি নিজেদের মস্তকে ধারণ করেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মে ব্রাহ্মণের নিয়োজিত হতেন, মন্ত্রী সেনাপতি হতেন, আবার কৈবর্তরাও এই সব পদে স্থান পেত। এইভাবে পালবংশকে কেন্দ্র করে বাংলায় প্রথম সামাজিক সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল।
পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, সারনাথের বৌদ্ধ সংঘ ও মহাবিহারগুলিকে আশ্রয় করে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ জগতেও বাংলা ও বাঙালির রাষ্ট্র এক গৌরবময় স্থান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
এই সকলের সম্মিলিত ফলে বাঙলায় এই সময়েই অর্থাৎ এই চারশো বৎসর ধরে একটি সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়ে উঠে। এটাই বাঙালির স্বদেশ ও স্বজাত্যবোধের মূলে এবং এটাই বাঙালির একজাতীয়ত্বের ভিত্তি। পাল-যুগের এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দান।” -
এই পরম্পরা মেনে রাজা মহেন্দ্রপাল, কুড্ডলখটকা বৈশ্য (জেলা), এবং পুণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্তি (ডিভিশন) প্রজ্ঞাপারমিতা এবং অন্যান্যদের পূজার জন্যবজ্রদেবকে দায়িত্ব দেন এই বৌদ্ধবিহার গড়ে তোলার জন্য।
তা হলে, এখন প্রশ্ন – এই বৌদ্ধবিহারের খোঁজ কি ভাবে পাওয়া গেল?
দিনটা ছিল, ১৩ ই মার্চ ১৯৮৭। স্থানীয় ভাষায় “ নেউ” খোঁড়া মানে, ভিত তৈরি করার জন্য মাটি কাটা। জগন্নাথ গায়েন তাঁর বাড়ি তৈরি করার জন্য ভিত খোঁড়াচ্ছিলেন।
মাটি কিছুটা কাটার পরেই উঠে এল বিশাল এক তামার পাত। জায়গার নাম, “তুলাভিটা” মালদা জেলার হবিবপুর থানায় পড়ে, (অঞ্চল: বৈদ্যপুর জগজীবনপুর)। শহর ইংলিশ বাজার থেকে দূরত্ব প্রায় ৪১ কি মি। বাংলাদেশের রাজশাহী কাছেই।
এই তামার পাতের ওজন- ১১ কে জি ৯০০ গ্রাম, ১৮ ইঞ্চি লম্বা ও ২২ ইঞ্চি চওড়া।
হিজিবিজি লেখা এই তামার পাতের মূল্য, স্বাভাবিক ভাবেই ওই ভদ্রলোকের জানার কথা নয়।
জগন্নাথ গায়েন একটি স্থানীয় স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন।
প্রথমে, এক তামার ব্যবসায়ী এই তামার পাতটি কিনে নিতে চান। কিন্তু, ওই ভদ্রলোকের একটা কিছু মনে হওয়াতে, চলে আসেন ইংলিশ বাজার (মালদা বলে যাকে আমরা জানি) শহরে। সৌভাগ্য বশত মালদার অন্যতম ইতিহাসবিদ শ্রী কমল বসাকের হাতে ওই তামার ফলকটি আসে।
২২ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ সালে, মালদার সংবাদপত্র “ এই মালদা” তে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে জানান :-
এই তাম্রফলকটিতে সিদ্ধার্থ মাত্রিকা লিপিতে লিখিত। ভাষা সংস্কৃত। গদ্য ও পদ্য দুই ধরণের ধাঁচেই এই লিপি উৎকীর্ণ আছে।
রাজা মহেন্দ্র পালকে আমরা এযাবৎ জেনে এসেছিলাম গুর্জর প্রতিহার বংশের। কিন্তু এই ফলকে লেখাতে সেই ভুল ভাঙে।
এই মহেন্দ্র পাল হলেন বাংলার বিখ্যাত পাল বংশের ৪র্থ রাজা দেবপালের ছেলে। এই বংশ সম্বন্ধে আগে বলে নেই, তা হলে আরও সুবিধে হবে, ব্যাপারটা বুঝতে। -
বাঙালি রাজা শশাঙ্কের গৌড়কে কেন্দ্র করে বৃহত্তর গৌড় তন্ত্র গড়ে তুলার প্রচেষ্টা তার মৃত্যুর পর ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শশাঙ্কের ধনুকে গুণ টানার মতো বীর অব্যবহিত পরে আর দেখা গেল না। ফলে এর পর সুদীর্ঘ একশত বৎসর(৬৫০ -৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) সমগ্র বাংলার উপর নেমে আসে গভীর ও সর্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা, মাৎস্যন্যায়ের অরাজকতা।
বারোশো বছর আগের এই বৌদ্ধ বিহার নালন্দা থেকেও বড় – এই কথা, আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া বলেছেন – মাটি খোঁড়ার সময়।
এটা, মালদার গুণিজনেরা ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে স্মারক লিপি দিয়ে অনুরোধ করেন – এটাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হোক, যাতে বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধালম্বীরা এসে দেখতে পারেন।
একটা ইংরেজী সংবাদ পত্রের খবর দিই
Statesman (India)
| December 30, 2001 |
STATESMAN NEWS SERVICE MALDA, Dec. 29. - The government's delay in developing a Buddhist pilgrimage site at Jagajibanpur in Habibpur block was due to the lack of infrastructure, the chief minister said.
Speaking to The Statesman during his visit here on Thursday, the chief minister, Mr Buddhadev Bhattacharya, said: "Jagajibanpur is an important excavation site. But due to lack of infrastructure, we are unable to attract the Buddhist pilgrims, particularly the Japanese, to it. They (international Buddhist tourists) only flock to Bihar and return." He assured that the government was "trying to create the necessary infrastructure at the place".
According to Mr Bhattacharya, the completion of excavation work at the site will take some more time. The Archaeological Survey of India is doing the excavation at the site which includes Tulavita, well known during Pala rule. A part of the site falls in Bangladesh. A Bangladeshi archaeologist, Mr Najmul Haque, is also engaged in the task, he pointed out.
After the Jagajibanpur project is completed, Mr Bhattacharya, said the state would feature in the itinerary of the Buddhist pilgrims. The chief minister also assured that the Malda unit of the West Bengal Democratic Writers-Artists' Association will set up a museum in Jagajibanpur.
The association, however, alleged that the then chief minister, Mr Jyoti Basu, too had promised the museum in March 1994, but no initiative has been taken.
It has also demanded that Malda must be covered in the next issue of the West Bengal Magazine published by Information and Cultural Affairs ministry.
If the demand is acceded to, it will be for the first time in 24 years of Left Front rule that Malda will feature in the magazine.
কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
দুঃখের কথা – মালদার ট্যাক্সি ড্রাইভাররাও তুলাভিটা নামটাও আর জানে না।
যেতে গেলে বলতে হবে- আইহো, বুলবুলচণ্ডীর রাস্তায় মানিকুড়া গ্রাম দিয়ে তুলাভিটা চলুন।
গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ মালদার স্থানীয় গবেষকরা, বিশেষ করে শ্রী কমল বসাক।
এখন শুধু অপেক্ষা। কেউ জানি না- এই ঐতিহাসিক স্থান আর রক্ষা পাবে কিনা!
এই হলো আমার প্রাণের মালদা বা গৌড়। আমি ইতিহাস বেত্তা নই। তাই সঠিক বিবরণ দিলাম কি না কে জানে! তবে, চেষ্টা করেছি আপ্রাণ!
গৌড়ের দ্রষ্টব্য স্থান নিয়ে প্রচুর বই আছে। মালদা যাবার প্রচুর ট্রেন আছে। গৌড় এক্সপ্রেস/হাটেবাজারে এক্সপ্রেস/ইন্টারসিটি/ জনশতাব্দী / কামরূপ এক্সপ্রেস এবং আরও অনেক ট্রেন। হোটেলও পাবেন প্রচুর।
একটা গাড়ী ভাড়া করে ঘুরে আসুন, এই ঐতিহাসিক স্থান থেকে।
ঋণ:-
কমল বসাক (ঐতিহাসিক)
আর্য চৌধুরী (লোকগায়ক)
শ্রী মলয় ভট্টাচার্য
প্রয়াত মটরাদা- যোগেন্দ্রনাথ মালাকার (লোকগায়ক)
প্রয়াত পন্টাদা- পুণ্যব্রত সরকার (মালদা জেলা স্কুলের ভূতপূর্ব প্রধান শিক্ষক)
প্রয়াত বুজুদা – দুর্গাপদ সেন (মালদা জেলার সিপিআইয়ের ভূতপূর্ব সম্পাদক)
প্রয়াত ধীরেনদা (মালদার এইআইআরের সংবাদ দাতা)
প্রয়াত দুর্গাকিঙ্কর ভট্টাচার্য কাকা (মালদা কলেজের অধ্যক্ষ)
এবং গৌড়ের ইতিহাস, রজনী কান্ত চক্রবর্তী
1 comments: