Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in





















১. বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা



জ্যোৎস্না-ধোয়া সাদা বাড়ির ভেতর থেকে কেউ চাপা গলায় হেসে উঠল যেন! খটকা লাগল। থামলাম। নাহ্‌, মনের ভুল- আমি ফের পা চালাাই। সেই বিশেষ অসমান জায়গাটার কাছে এসেই হুমড়ি খেলাম। জায়গাটার সিমেন্ট, বুনো ফুল এবং অযত্নে বাড়া ঘাসের ঝাড় হাপিস হয়ে গেছে। আামি বাসু মনে পড়ছে আমার কথা? দশ বছর ধরে আমি এই একই রাস্তায় সকাল-সন্ধ্যা মাইলের পর মাইল হাঁটছি কিন্তু অদ্যাবধি এক মুহূর্তের জন্যেও আরেকটি প্রাণের দেখা মেলে নি। সুস্মির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আমি এবং সুস্মি প্রেমিক- প্রেমিকা। ও আমাকে ওর ছেলেবেলার অনেক গল্প শোনাত। ওর বাবা প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যেতো। ওর মা ওর সব জামাকাপড় বানিয়ে দিতো। ওর দিদার গা থেকে সবসময় ডিল ব্রেড ও ভ্যানিলার গন্ধ মৌ মৌ করে ভেসে আসতো। আমি হা করে এসব গল্প গিলতাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হোত যদিও সেটা করতে পারতাম না। আর সেইসব রূপকথা যেগুলোকে ও ভাবতো যে সবার জীবনেই আছে সেগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সুস্মি অনেক বছর দেশের বাইরে আমাদের ঠিক কেন কবে কোন কারণে কথা বন্ধ হয়েছিল আমার মনে নেই। মৃত একটা সম্পর্ক নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি, কিন্তু এতবছর পরে সু্স্মির হাতে লেখা চিঠি যখন হেমন্তের এক বিকালে ধূলোমাখা ডাকবাক্সে আলো ছড়াচ্ছিল তখন ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল শীতার্ত মনে।

খাম খুলে বেশ অবাক হলাম। চারটি সাদার পৃষ্ঠার পরে পঞ্চম পাতার শেষে লেখা-

‘সুন্দর জ্যোৎস্না ভেঙেচে নদীজলে- কি অপূর্ব্ব শোভা! ভগবানকে ডেকে বললুম- তোমার নিত্য সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই- ঐ সন্ধ্যাতারার মত রহস্যের মধ্যে, জ্যোৎস্নালোকিত আকাশের উদার ব্যাপ্তির মধ্যে, বনপুষ্পের সুবাস ও বিহঙ্গকাকলীর মধ্যে আমায় তোমার খেলার সঙ্গী করে রেখো যুগে যুগে। তুমি আপন মনে বিশ্বের বনতলে নবীন কিশোর সেজে বনফুলের মালা গলায় উদাসী হয়ে বেড়াও- কে তোমায় পোঁছে? কেউ না। সবাই ধন, জন, মান, যশ নিয়ে ব্যস্ত। কে দেখেচে এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশার অপূর্ব্ব মনমাতানো শোভা! আমায় দেখবার চোখ দিও জন্মে জন্মে।’

– ইতি, সুস্মি

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্মির প্রিয় কথাসাহিত্যিক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৭ মে ১৯৪৩ সালে লেখা ডায়েরি থেকে সুস্মি এটা লিখেছে, এটা লিখতে গিয়ে চারটি পাতা খালি রাখার রহস্য বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে খামে জ্বলজ্বল করা সুস্মির ঠিকানায় একটা চিঠি লেখার লোভ সহসা পেয়ে বসলো। মোহাচ্ছন্ন আমি খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম।

সুপরিচিতাষু সুস্মি,

এক যুগ পরে তোমাকে লিখছি। কেমন আছো? হেমন্তের পড়ন্ত বিকালে তোমার চিঠি পেলাম। চার পাতায় যা যা লিখবে ভেবেছিলে আমি যেন তা পড়তে পারছি সাদা পাতায়। আমার মনে হলো তোমার চিঠির উত্তর তোমার প্রিয় লেখকের কথাতেই দেই। ২৮ অগাস্ট, ১৯২৫-এ, ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন: ‘…Sadness জীবনের একটা অমূল্য উপকরণ- Sadness ভিন্ন জীবনে profundity আসে না- যেমন গাঢ় অন্ধকার রাত্রে আকাশের তারা সংখ্যায় ও উজ্জ্বলতায় অনেক বেশী হয়, তেমনই বিষাদবিদ্ধ প্রাণের গহন গভীর গোপন আকাশে সত্যের নক্ষত্রগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত ও জ্যোতিষ্মান হয়ে প্রকাশ পায়। তরল জীবনানন্দের পূর্ণ জ্যোৎস্নায় হয়ত তারা চিরকালই অপ্রকাশ থেকে যেত।’

প্রকৃতিপ্রেমিক, রোম্যান্টিক এমন নানা অভিধায় বিভূতিভূষণকে ধরা যায়, এ কথা ঠিক। কিন্তু বিভূতিভূষণের সৃষ্টি মৃত্যুর কথাও বলে, যে মৃত্যু শাল-পিয়ালের বনে সন্ধ্যা নামার মতো নিবিড়। তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে মন চাইছে, খুব খুব জানতে ইচ্ছে করছে তরুণী সু্স্মির মনে দোলা দেয়া বিভূতিভূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতিপ্রেম ছাপিয়ে কি বিগতা যৌবনার মনে কোথাও বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা ছায়া ফেলেছে? যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় তবে বলতেই হবে বয়স হয়েছে তোমার! তোমার মনে আছে কিনা জানিনা। কলেজের দিনগুলোয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় মৃত্যুচেতনা নিয়ে কথা বলায় তুমি খুব রেগে বলেছিলে জীবনানন্দ দাশ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি গুলিয়ে ফেলেছি। সেইদিন বলতে না পারলেও আজ এতগুলো বছরের শেষে তোমাকে লিখতেই পারি আমার ভাবনা। রাগ করবে না আশা করি।

বিভূতি-সাহিত্যে মৃত্যুর ধারণাটির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদের একটি কাহিনির কথা মনে পড়ে। ঘটনাচক্রে, সৌরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে বিভূতিভূষণ বলছেন, ‘আমি সারা জীবন ধরে জন্ম-মৃত্যু রহস্যের আলোচনা করেছি ও রহস্য জেনে ফেলেছি।’ ওই চিঠিতেই তিনি বিশেষ ভাবে ‘বৃহদারণ্যক’ ও ‘ঈশোপনিষদ’-এর কথা উল্লেখ করছেন। এই সূত্রেই ওই কাহিনিটির অবতারণা। সেখানে মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন, ‘ধরা যাক, গোটা পৃথিবী বিত্তে পরিপূর্ণ। তা আমার নিজস্ব সম্পত্তি হলে, আমি কি ‘অমৃতা’ হব?’ যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর, ‘বিত্তের দ্বারা ‘অমৃতত্ত্বের’ আশা করা নিরর্থক।’ বস্তুত, অমৃতের একটি অর্থ যদি অমরত্ব হয়। অন্য একটি নিগূঢ় অর্থ, আনন্দ।— জীবন-মৃত্যুর ধারণা নিয়ে বিভূতিভূষণ এই আনন্দেরই পিয়াসী। সেই তেষ্টা থেকেই তাঁর ‘আর্টের’ জন্ম।

জীবনের শেষ পর্বে বিভূতিভূষণ যখন ব্যারাকপুরে ছিলেন তখন সেখানে দেখা পেয়েছিলেন এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে। ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছেন জেনে, বিভূতিও তাঁর কাছে নিত্য যাতায়াত বাড়িয়েছিলেন। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! বিভূতিভূষণ রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে। তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস। মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে। মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা? শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে? কী ভাবে উড়ে যায়? ফিরে আসে কি? সব প্রশ্নের উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে তাঁর লেখায়। মৃত্যুর আগের জীবন সম্পর্কে আমরা সকলেই ওয়াকিবহাল কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে এটাই মানুষের চির-কৌতূহলের বিষয়। এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে দেবযান। উপন্যাসটা পড়া শেষ করে মনে হয়েছে, এ তো শুধ মৃত্যু চেতনা নয় এর ভিতরে ধরা আছে স্রষ্টার গভীর চিন্তা ও বিশ্বাসের জগৎ। আছে সুগভীর রোমান্টিক চেতনাবোধ। তোমার সতের কিংবা আঠারতম জন্মদিনে তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম দৃষ্টিপ্রদীপ ও দেবযান। বইগুলো কি তোমার সঙ্গে আছে নাকি বন্ধ বাড়ির বুকসেলফে উদাস তাকিয়ে আছে? এখনো নিয়ম করে রোজ রাতে কবিতা পড়ো? নাকি কর্মব্যস্ত কর্পোরেট জীবনে কবিতারা বই বন্ধি হয়ে পড়ে থাকে ল্যাপটপের পাাশে নিঃসঙ্গতায়? তুমি তো জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস করতে। তাই না? ভারতীয় নিয়তিবাদ দুটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে— জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ। প্রথমে উদ্ভূত হয় জন্মান্তরবাদ, এবং লক্ষণীয় যে, প্রথম উল্লেখে এটি পুনর্জন্ম নয়, পুনমৃত্যু। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ধারণাটি প্রথমে মানুষকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত হয়নি, দেবতাদের সম্পর্কেই এর আদিমতম উল্লেখ। জন্মান্তরবাদ প্রবর্তিত হল কেন? একটা সহজ কারণ হল, মানুষের জীবনপ্রীতি; মৃত্যুর ওপারে জীবনকে বিস্তারিত করে দেখার বাসনা এবং সে কারণেই যুক্তিগত ভাবে জন্মের পূর্বেও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, জন্মান্তরে বিশ্বাস করলে এক জীবনে যত অভিজ্ঞতা হওয়া সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞতালাভের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তৃতীয়ত, এ বিশ্বাস অনুসারে মানুষের এ জীবনের ভুলত্রুটি জন্মান্তরে সংশোধনের একটা অবকাশ পাওয়া যেতে পারে। চতুর্থত, এ বিশ্বাসে চূড়ান্ত অন্তিমতা বা আত্যন্তিকতার আতঙ্ক মন থেকে অন্তর্হিত হয়, যে-আতঙ্ক মানুষকে সর্বদেশে সর্বকালে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু এ-ও সত্য যে কেবলমাত্র জন্মান্তরবাদ মানুষের আধ্যাত্মিক বা ব্যবহারিক উন্নতির আশ্বাস বহন করে না। যাই হোক ধান ভাঙতে এসে শিবের গাজন গাওয়ার মতো কথা বলছি। বিভূতিভূষণের লেখায় মৃত্যুচেতনা বারবার চোখে পড়ে।

‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ এবং ‘দেবযান’ পরলোক এবং জন্মান্তরবাদ বিশ্বাসের কথা বলে। জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়তো অবিশ্বাস করার উপায়ও ছিলনা। প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’-র প্রকাশের সময় (পরে এই অংশটি বাদ যায়) তার মধ্যেও ছিল সেই অপার্থিবের ছায়া – ‘‘এ আমি কাকে দেখলুম বলব? আমাদের এই পৃথিবীর জীবনের বহু ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত রাজ্যে অনন্তের পথের যাত্রীরা আবার বাসা বাঁধবে, হয়তো সে দেশের আকাশটা রঙে রঙে রঙিন, যার বাতাসে কত সুর, কত গন্ধ, কত সৌন্দর্য, কত মহিমা, ক্ষীণ জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া কত সুন্দরী তরুণীরা যে দেশের পুষ্পসম্ভার-সমৃদ্ধ বনে উপবনে ফুলের গায়ে বসন্তের হাওয়ার মতো তাদের ক্ষীণ দেহের পরশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই অপার্থিব দিব্য সৌন্দর্যের দেশে গিয়ে আমাদের এই পৃথিবীর মা-বোনেরা যে দেহ ধারণ করে বেড়াবেন – এ যেন তাঁদের সেই সুদূর ভবিষ্যৎ রূপেরই একটা আভাস আমার বউদিদিতে দেখতে পেলুম।’’

‘দেবযান’- উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল, সারান্ডার জঙ্গলে ভ্রমণের সময়। অরণ্যের ‘সমাহিত স্তব্ধতায়’ লেখা উপন্যাসটির পরিকল্পনা বিভূতিভূষণ সম্ভবত সব থেকে বেশি দিন ধরে করেছিলেন। জন্ম-মৃত্যুর ভাবনাকে এক সূত্রে বাঁধতেই কি তাঁর এই সময় নেওয়া? আবার ‘তৃণাঙ্কুর’-এ যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো করে তিনি প্রত্যাশা করছেন, অন্ধকার ‘জ্যোতির্ময় হউক’। এ ভাবেই হয়তো মৃত্যুও একটি প্রাণচক্রের অংশীভূত হয়ে এক বিরাট পরিধিতে ধরা দেয়। এখান থেকেই অভীষ্ট ‘অমৃত’ তথা আনন্দের সঙ্গে এক সরলরৈখিক গাঁটছড়া বাঁধে মৃত্যু ও জন্ম।

স্বভাব-উদাসীন এই মানুষটি নিজের লেখার বিরূপ সমালোচনা নির্লিপ্তভাবেই নিতেন, কিন্তু অতিলোকচিন্তা নিয়ে তর্ক উঠলে নিজের অভিজ্ঞতায় ভর করে সোচ্চার হয়ে উঠতেন। সজনীকান্ত দাস তাঁর আত্মস্মৃতিতে বলেছেন – “আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আচারে ব্যবহারে কালাপাহাড় বলে অখ্যাতিও আছে।” পরলোকচর্চার জন্য বিভূতিভূষণকে তীব্র ব্যঙ্গ করতেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন – “পথভ্রষ্ট(?) বৈজ্ঞানিকদের আলোচনায়ও দেখিয়াছি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে অনেক তত্ত্ব জানিয়াছি। বিভূতিকে বাহির হইতে কখনও আমল দিই নাই, ঠাট্টা করিয়া তাহার দৃঢ় বিশ্বাসকে উড়াইয়া দিয়াছি ; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফল্গু ধারার মতো মৃত্যু পরপারের এই টুকরা রহস্যটি আমাকে বরাবরই প্রভাবিত করিয়াছে আর বিভূতিকে স্বীকার করিয়াছি।”

পথের পাঁচালীর দুর্গার মৃত্যু মাইলফলক হয়ে আছে। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে মৃত্যু সর্বদা একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে এসেছে। মহাভারতের মতো অতি বড় বীর, অনিবার্য যার প্রয়োজন সেও অবলীলায় ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্গা ও অপুর বেড়ে ওঠা, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দুর্গা ধীরে ধীরে পরিণতি পায়। আকস্মিক দুর্গা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেলে কণ্ঠ ছিঁড়ে কান্না আসে। মৃত্যুকে বিভূতিভূষণ তার উপন্যাসে এক প্রতীকী মাত্রায় তুলে ধরেছেন,—‘দুর্গা আর চাহিল না। আকাশের নীল আস্তরণ ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে অনন্তের হাতছানি আসে—পৃথিবীর বুক থেকে ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া গিয়া অনন্ত নীলিমার মধ্যে ডুবিয়া নিজেদের হারাইয়া ফেলে—পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূর পারে কোনো পথহীন পথে—দুর্গার অশান্ত, চঞ্চল প্রাণের বেলায় জীবনের সেই সর্বাপেক্ষা অজানা ডাক আসিয়া পৌঁছাইছে।’ দুর্গার মৃত্যুর অবব্যহিত পরে ‘নতুন কাপড় পরাইয়া ছেলেকে সঙ্গে লইয়া হরিহর নিমন্ত্রণ খাইতে যায়। একখানা অগোছালো চুলে-ঘেরা ছোট মুখের সনির্বন্ধ গোপন অনুরোধ দুয়ারের পাশের বাতাসে মিশাইয়া থাকে—হরিহর পথে পা দিয়া কেমন অন্য মনস্ক হইয়া পড়ে।’ পাঠক চোখে অশ্রু না এনে পারে না।

‘অপরাজিত’-য় নদীর পাড়ের আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর এক নব-রূপ প্রতীত হয়। মনে হয় জন্ম-মৃত্যুর চক্রটি এক ‘দেবশিল্পীর হাতে আবর্ত্তিত হইতেছে...সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি— বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট।’

ইছামতী উপন্যাসে অত্যাচারী নীলচাষি শিপটন সাহেবের মৃত্যুদৃশ্যও আমাদের নাড়া দেয়। সুদূর ইংল্যান্ডের কোনো এক গ্রাম থেকে আসা। মৃত্যুকালে রক্ষিতা গয়া মেম আর রাম কানাই কবিরাজ মুচি বাগদিরা ছাড়া তেমন কেউ তার পাশে ছিল না। যখন সাহেবের কথা বন্ধ, শ্বাসকষ্ট—দেওয়ান হরকারী বলল, এ কষ্ট আর দেখা যায় না। মৃত্যুর চূড়ান্তপর্বে কষ্ট হয় কি না—মানুষের জানা সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ লিখলেন—

শিপটন সাহেবের কষ্ট হয় নি। কেউ জানত না সে তখন বহুদূর স্বদেশের ওয়েস্টমোরল্যান্ডের অ্যান্ডসি গ্রামের ওপরকার পার্বত্যপথ রাইনোজ পাস দিয়ে ওক আর এলম গাছের ছায়ায় ছায়ায় তার দশ বছর বয়সের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে চলেছিল খরগোশ শিকার করতে, কখনো বা পার্বত্য রদ এল্টার-ওয়াটারের বিশাল বুকে নৌকায় চড়ে বেড়াচ্ছিল, সঙ্গে ছিল তাদের গ্রেট ডেন কুকুরটা...

হয়তো মৃত্যুর আগে মানুষের অবচেতনে তার শৈশবের স্মৃতিই বেশি ভেসে ওঠে।

আসলে ‘মৃত্যুকে কে চিনিতে পারে, গরীয়সী মৃত্যু-মাতাকে? পথপ্রদর্শক মায়ামৃগের মতো জীবনের পথে পথে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে, অপূর্ব রহস্যভরা তার অবগুণ্ঠন কখনো খোলে শিশুর কাছে, কখনো বৃদ্ধের কাছে..।’

মানুষ নিজের মধ্যেও অনেকবার মরে যায়, তার দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে। শারীরিক অস্তিত্ব বিলয়ের জন্য যদি দুঃখবোধের উদয় হয়। কিন্তু কোন সে শরীর, মৃত্যুর সময় আমরা কোন শরীরের কথা বলি। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, এমনকি বার্ধক্যেও মানুষ এক রূপ থেকে অন্য রূপে যায়।

অশনি সংকেত নতুন করে পড়ে দেখতে পারো, পড়তে পড়তে মৃত্যুকে বিজয়ের প্রতীক মনে হবে কিংবা মৃত্যুর কাছে বর্ণের হার দেখে শত কষ্টেও সুখ অনুভব করবে।

মতির মৃতদেহ আমতলাতেই পড়ে আছে। কত লোক দেখতে আসচে। দূর থেকে দেখে ভয়ে ভয়ে চলে যাচ্চে। আজ যা ওর হয়েচে, তা তো সকলেরই হতে পারে! ও যেন গ্রামের লোকের চোখ ফুটিয়ে দিয়ে গেল। একটি মূর্তিমান বিপদের সংকেত স্বরূপ ওর মৃতদেহটা পড়ে রয়েচে আমগাছটার তলায়। অনাহারে প্রথম মৃত্যুর অশনি সংকেত।

কিন্তু মৃত্যু থেকেই এক নবজন্মের শুরু হয়। এই আখ্যান সেই কালের যে কালে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নীচু জাতের তফাৎ ছিল খুব বেশি। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যু যেন সেই তফাৎকে ঘুচিয়ে দিল। অনঙ্গর অনুনয়কে ফেলতে পারেনা গঙ্গাচরণ, ব্রাহ্মণ ভটচাযও যোগ দেয়। সঙ্গে কাপালীদের ছোট বৌ। দুর্ভিক্ষের মৃত্যু এক নতুন সমাজের জন্ম দিল, জাতপাতের ঊর্ধে মানুষ মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে পারলো। অনঙ্গ-বৌ এর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হার মানতে হয়েছে গঙ্গাচরণের ব্রাহ্মণত্বের অহমিকাকে।

তেমার খুব প্রিয় আরণ্যক উপন্যাাসে আছে কলেরা নামক মহামারীর ছোবলের কথা। কী নির্মমভাবে মহামারীতে গ্রামের অগণিত মানুষ অকালে ঝরে পড়ছে; চিকিৎসার অভাব, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব- এ জনপদে কী ভয়াবহ ইতিহাস গড়ে তুলছে, তারই বিশ্বস্ত ভাষ্য নির্মাণ করেছেন বিভূতি পরম মমতায় আর অভিজ্ঞতার নির্যাসে। প্রকৃতপক্ষে আরণ্যক এমন এক উপন্যাস যেখানে জীবনের বৃহৎ পরিসরে বিচিত্র রূপে মৃত্যুই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। মৃত্যু ভালো না জীবন ভালো আমরা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারি না। বিভূতিভূষণের উপন্যাস ছাড়া ছোটগল্পেও মৃত্যুর নানা প্রতীকী ব্যবহার যেমন আছে তেমন বিশালভুবন তাঁর মৃত্যু দিয়ে গড়া। ‘পুঁইমাচা’ গল্পটির উল্লেখ না করলে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক্ষেন্তির মৃত্যু কিন্তু মরণের গল্প নয়, এ জীবনেরই গল্প, যখন দেখি লেখক মাচার উপর দিয়ে পুঁইঝাড়ের দৃশ্য রচনা করলেন। বিভূতিভূষণ মৃত্যুভীতি থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো কথাসাহিত্যে শ্রমের নিরলস তাজমহল নির্মাণ করে চলেছিলেন।

সব ঘরেই মৃত্যু আছে, মৃত্যু ছাড়া প্রাণ নেই। একদিন এক বৃদ্ধ মা তার একমাত্র সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে বুদ্ধের কাছে মাতম করে বললেন, ‘হে মহাস্থবির আমার পুত্রের জীবন ভিক্ষা দিন। বুদ্ধ বললেন, যাও, একটি বিল্বপত্র নিয়ে এসো—সেই বাড়ি থেকে, যে বাড়িতে কেউ মারা যায় নি।’ যেখানে বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় আটটি পথের ক্রমাগত অনুশীলন বলে দর্শানো হয়েছে, বিভূতিভূষণ সেই দুরূহ পথের প্রতিস্থাপন করেন প্রকৃতিকে দিয়ে। আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গটিকে বোঝা যাক। বিভূতিভূষণ লিখছেন,

‘জগতের অসংখ্য আনন্দের ভান্ডার উন্মুক্ত আছে। গাছপালা, ফুল, পাখী, উদার মাঠঘাট, সময়, নক্ষত্র, সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না রাত্রি, অস্ত সূর্য্যের আলোয় রাঙা নদীতীর, অন্ধকার নক্ষত্রময় উদার শূন্য… এসব জিনিস থেকে এমন সব বিপুল, অবক্তব্য আনন্দ, অনন্তের উদার মহিমা প্রাণে আসতে পারে, সহস্র বৎসর ধরে তুচ্ছ জাগতিক বস্তু নিয়ে মত্ত থাকলেও সে বিরাট অসীম, শান্ত উল্লাসের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই কোন জ্ঞান পৌঁছয় না।… সাহিত্যিকদের কাজ হচ্ছে এই আনন্দের বার্ত্তা সাধারণের প্রাণে পৌঁছে দেওয়া… তাদের অস্তিত্বের এই শুধু সার্থকতা।’

সংসার যদি দুঃখের সাগর হয়, তা হলে তার প্রতিকার, এই অসীম আনন্দের চাবি তিনি তুলে দিলেন প্রকৃতির হাতে। আর সাহিত্যিকের কী ভূমিকা? সাহিত্যিক হলেন যাজক। তিনি প্রকৃতি আর বিস্মৃত সাধারণ মানুষদের যোগস্হাপন করেন, মার্গপ্রদর্শক। অসীম আনন্দের আকরের সন্ধান দেওয়া তাঁর কাজ। আশ্চর্যের বিষয়, স্বভাববিনীত বিভূতিভূষণের প্রত্যয় এই ব্যাপারে বেশ দৃঢ়, বিশ্বের প্রেক্ষিতে তাঁর ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই। একটা কথা এখানে বলা হয়তো প্রয়োজন। দুঃখের অনুভুতিকে বিভূতিভূষণ অবাঞ্ছিত রূপে দেখেননি, বরং জীবনের প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হিসাবে দেখেছেন।

সময় অণুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধূলো ওড়ে না। ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই তার! সন্ধ্যা গড়িয়ে কখন রাত নেমে এসেছে বুঝতেও পারিনি। তোমার উত্তর পাবো কিনা জানিনা তবে অপেক্ষায় থাকবো। চিঠির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘এই জীবনের ওপারে সেই বিরাট জীবনের জন্যে সকলে অপেক্ষায় থাকুক।’— এই অপেক্ষাতেই আমরা না হয় দু’দণ্ড রইলাম!

ভালো থেকো নিরন্তর।


ইতি-

বাসু

০৩ নভেম্বর,২০২৪
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















বের্শেন ইনেসের কথাই ভাবছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন…

‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না যে তোমার বন্ধুর গ্লাস একেবারে খালি? আরেকটু মনোযোগী হও। এইসব বিষয়ে আরও শিখতে হবে তোমাকে।’

বের্শেনের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। সে একটা গবলেট নিয়ে গের্টের জন্য ওয়াইন ঢালতে শুরু করলো (গের্ট একটা গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে বসেছিল)। কেন জানা নেই, হঠাৎ তার একটা অস্বস্তি হতে লাগল এবং মনে হল এটা নিয়ে পরে গের্ট তার সঙ্গে তামাশা করবে। তাড়াহুড়ো করে গের্টের দিকে ওয়াইন ভর্তি গবলেটটা ঠেলে রাখবার সময় এক দু’ ফোঁটা ওয়াইন চলকে পড়ল টেবিলক্লথে। বের্শেনের মা সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বোতলটা রেখে দিলেন ওয়াইনের দাগ ধরা জায়গাটার উপরে।

খাবার পর কালো কফি খেতে খেতে বের্নহার্ড ভাবছিল যে এবার ঘুমোতে গেলেই হয়; আসলে সেভাবে তার দিকে কারো নজর নেই। তার অভিমান হচ্ছিল, কিন্তু সে প্রকাশ করল না। তবে সে খুবই খুশি হয়েছে এটা দেখে যে তার বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে বাড়িতে সবার মনে একটা ভাল ধারণা তৈরি হয়েছে। সে ফ্লকের সঙ্গে মেঝেতে বসে খেলতে শুরু করল। নানা আদুরে নামে তাকে ডাকতে লাগল। রান্নাঘর থেকে রুটি নিয়ে এল সে ফ্লকের জন্য। তবে রুটির মাঝে সসেজের টুকরো গুঁজে দিয়েছিল সে, নাহলে ফ্লক শুধু শুকনো রুটি একেবারেই খাবে না।

সে যখন ফ্লকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার নোংরা পশম ঝেড়ে দিচ্ছিল, তখনি কে যেন এসে তার ঘাড়ে হাত রাখল। বের্শেন মুখ ফিরিয়ে দেখল যে ইনেস। ইনেস নিচু হয়ে অনুচ্চকণ্ঠে বলল যে তাদের এখন বেরতে হবে। বের্শেন মনে মনে চমকে উঠল। সে তার বন্ধুদের চলে যাবার ব্যাপারটা এতক্ষণ ভাবেনি। তার মাথাতেই আসেনি যে ওরা এখন ফিরে যাবে ওকে এখানে রেখে। যদি ওরা অন্তত ফ্লককে রেখে যেতেও রাজি হয়…

পরে, নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বের্শেনের মনে পড়ল যে তার হোমওয়ার্কের ফাইলটা শহরেই পড়ে আছে এবং সে আগামীকাল নিজের হোমওয়ার্ক করতে পারবে না।

‘ধুত্তোর’… বলেছিল গের্ট। কিন্তু নিজের কাজ তার কাছে কতটা দরকারি, সেটা গের্ট বুঝবে কী ভাবে? এখন গের্ট ইনেস আর ফ্লককে নিয়ে ড্রাইভ করে ফিরছে। হঠাৎ ভীষণ রাগ, অভিমান একসঙ্গে এসে বের্শেনের মন ভারি করে দিল। সে বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করল।


বের্নহার্ড থিয়েটারস্ট্রাসে* ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। সবে সাতটা বেজেছে। ওর সঙ্গীসাথির দল কেউই এসে এখনও পৌঁছায়নি। সাড়ে সাতটার আগে অবশ্য কেউ আসবেও না। আজকে ওরা সবাই মিলে কোণের ছোট পাবে খেতে যাবে, তারপর যাবে গের্টের বাড়িতে। আজ ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টি, যে আগামীকাল বার্লিনে চলে যাবে। ফার্দিনান্দের তেইশ বছর বয়স; সে মিউজিক কন্ডাকটর হতে চায়। সে ভীষণ ভাল বেহালা বাজায়। শহরের থিয়েটার হলে বেহালাবাদকের চাকরি তার পাকা। এমনকি সঙ্গীতশিক্ষকেরাও তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই চাকরিটা নিয়ে নেবার জন্য। কিন্তু ফার্দিনান্দের ভেতরে একটা অদ্ভুত একগুঁয়ে অদম্য আবেগী উচ্চাশা আছে। যে চাকরি পাওয়ার জন্য তার সঙ্গীসাথিরা সবাই তাকে ঈর্ষা করছিল, সে কিনা সেই চাকরিটা হেলায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে! জেদ ধরে প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় বার্লিন চলে যাচ্ছে সে। সে বলে সে ফুর্টভ্যাংলার এবং ব্রুনো ওয়ালটারের সঙ্গীত শুনতে চায়। আরও শুনতে চায়, আরও শিখতে চায় সে। বলে যে পড়াশুনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করে সে পয়সা রোজগার করবে। খুব রোগা আর লম্বা চেহারা ফার্দিনান্দের। এত রোগা যে ওর জামার কলারগুলো পর্যন্ত বিরাট বলে মনে হয় ওর অবয়বের উপরে। সুদর্শন বলা যাবে না তাকে। মুখটা এত ফ্যাকাশে যে ধূসর বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। মুখে দৃঢ় একটা অভিব্যক্তি সবসময়। সে যখনই ঠোঁটদুটো ফাঁক করে, মনে হয় যেন খুব তেষ্টা পেয়েছে তার। শুধু তার চোখগুলো তার মুখে অদ্ভুতরকম বেমানান। শুধু বড় নয়, চোখগুলো বিশাল আয়তাকার, কিন্তু লাজুক এবং বিষণ্ণ। ইনেস বলে যে শুধু চোখ দেখেই ওই ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ।

তাহলে ফার্দিনান্দ আগামীকাল যাচ্ছে। সঙ্গে থাকবে বেহালা, একটা পুরনো হাতব্যাগ আর ছোটখাট কিছু প্যাকেট যেগুলো বন্ধুরা স্টেশনে নিয়ে যাবে। কেক, আপেল, রুমাল, নানা ছোটখাট জরুরি জিনিসপত্র থাকবে সেই উপহারের প্যাকেটে। বের্শেন এমন একটা উপহার নিয়ে যাচ্ছে, যেটা ফার্দিনান্দকে একইসঙ্গে অবাক এবং খুশি করবে। সে নিয়ে যাবে ইনেসের একটা ছবি, যেটা সে চুপিচুপি ইনেসের কাছ থেকে চুরি করেছে। কারণ ফার্দিনান্দও ইনেসকে ভালবাসে। হ্যাঁ, নিশ্চিত ভালবাসে!

বের্শেন ঘড়ির দিকে তাকায়। এখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে এবং তার খিদে পেয়ে গেছে। সে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রেস্তোরাঁর আলোআঁধারি ঘরটায় ঢুকে পড়ল। ছোট ছোট টেবিলে ছাত্ররা বা মোটা মোটা সরকারি কর্মচারীরা বসে তাস খেলছে। সে সঙ্গীতশিক্ষার্থীদের জন্য রিজার্ভ করে রাখা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। তারপর বাঁধাকপির স্যালাদ আর সসেজ অর্ডার করল বেশ উচ্চস্বরে।


‘স্যার, আপনি কি খাবারের সঙ্গে বিয়ার পান করবেন?’ ওয়েট্রেস জিজ্ঞেস করল তাকে।

বের্শেনের একটু অস্বস্তি হলেও সে পাল্টা একটা ধন্যবাদ দিল পরিবেশনকারিনীকে।


ফার্দিনান্দের হয়তো পাবে বসেই একটু একটু নেশা হয়ে গিয়েছিল। এখন সে গের্টের বাড়িতে একটা বিশাল চেয়ারে এলিয়ে পড়ে আছে সিলিঙের দিকে চেয়ে। তার চোখেমুখে এক বিষণ্ণ অভিব্যক্তি। বাকিরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে খোশমেজাজে জোরে জোরে আড্ডা মেরে যাচ্ছে। গের্ট, যে কিনা এখন বাড়ির মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে সমানে এদিক ওদিক যাচ্ছে, সিগারেট নিয়ে আসছে এবং এখন একটু অনুকম্পামিশ্রিত সৌহার্দের সঙ্গে ফার্দিনান্দের সঙ্গে কথা বলছে। এই পার্টিতে মেয়েরা কেউ আসেনি। যদিও সঙ্গীত শিক্ষালয়ের ছাত্রদের অনেকেরই মেয়েবন্ধু আছে, তাছাড়া শিক্ষালয়ে একই ক্লাসে ছাত্রীরাও আছে; কিন্তু এই ধরণের পার্টিতে সাধারণত মেয়েদের ডাকা হয় না। যদিও তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষদের কাছে ব্যাপারটা একটু হুমকির মত শোনাবে, যদিও ব্যাপারটা পুরুষদের নিজেদের যথেষ্ট আধুনিক হিসেবে প্রমাণ করবার পরিপন্থী, তবুও এটা এখানে পুরুষ ছাত্রদের বিয়ার টেবিলের প্রচলিত রীতি। অবশ্য সব রীতির ব্যতিক্রম আছে। এখানে এই ব্যতিক্রমের নাম ইনেস। ইনেসকে সব সময় আমন্ত্রণ করা হয়। যদিও সে অনেক মেয়েদের চেয়ে গম্ভীর আচরণ করে এবং স্বল্পবাক, তবুও সে এই জমায়েতে যোগদান করতে অস্বস্তিবোধ করে না। দশ পনের জন পুরুষের মাঝে একমাত্র মহিলা হিসেবে তাকে সবসময় অসাধারণ দেখায়। কিন্তু আজ সে আসেনি।

এদিকে ফার্দিনান্দ বার বার ইনেসের কথা জিজ্ঞেস করছে। এখন আবার বলছে যে ইনেসকে নাহয় আবার ফোন করে ডাকা হোক। বাকিরা গের্টের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘এখন প্রায় রাত এগারোটা, ওই বুড়ো… ওর বাবা ওকে বেরতে দেবে না এখন। তাছাড়া ইনেসও ভাববে যে আমরা অভদ্র আচরণ করছি’… গের্ট অসহায় কণ্ঠে নিজের দ্বিধা ব্যক্ত করে।

‘তাহলে বের্নহার্ড ফোন করুক।’ ফার্দিনান্দ বলে

‘আহা, সেটাও কি খুব ভাল হবে?’

‘অবশ্যই ভাল হবে। কারণ ইনেস বের্শেনের উপর রাগ করবে না।’

‘খুব ভাল। বের্শেন!’


বের্নহার্ড এত কথা কিছুই শোনেনি। তাকে জোর করে আধা গেলাস বিয়ার খাইয়ে দিয়েছে। তার বিয়ার খেতে খুব বিশ্রী লাগছিল। কেমন টক টক স্বাদ। কিন্তু গের্ট এবং ফার্দিনান্দ চেপে ধরে খাইয়ে দিয়েছে তাকে। সে এখন গের্টের বিছানায় আধোঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। সে এখন ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে নানা কথা ভাবছে। গের্ট তাকে মডেল করে যে ছবিগুলো এঁকেছিল, তার মধ্যে চার পাঁচটা গের্টের ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে। সেগুলো সবাই দেখেছে এবং সেগুলো নিয়ে খিল্লি করছে। বের্নহার্ড বুঝতে পারছে না কেন তার এত বিরক্ত লাগছে। তার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। কেমন যেন লজ্জা করছে সবার মাঝে থাকতে। তবে ছাত্ররা সবাই তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু এই মুহূর্তে বের্নহার্ড একা একা একটু ঘুমোতে চায়। সে চায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এরা যেন এই ঘর ছেড়ে চলে যায়। তার বদলে এরা চারদিকে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি চালিয়ে যাচ্ছে। সবাই চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘আরে, তোমরা চাও কি শুনি? কি চাও?’ চুপ করার বদলে সবাই আরও জোরে হেসে ওঠে।



(চলবে)



*স্ট্রাসে (straße) শব্দের অর্থ সরণী।
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৭

রাতের প্রথম পহর। বৈদ্যজীর ঘুম চটে গেছে, কারণ বড্ড শীত করছে। চব্যনপ্রাশ, স্বর্ণভস্ম, এবং বাদাম পাকের ব্যারিকেড ভেঙে ঠান্ডা ওনার চামড়ার নীচে ঢুকে পড়েছে আর মাংসের বেশ ক’টি পরত ভেদ করে হাড়মজ্জায় সেঁদিয়েছে। লেপটাকে ভাল করে গায়ে জড়াতে জড়াতে ওনার মনে পড়ল—বিছানায় একলা শুলে শীতের অনুভূতি বেশি হয়। এরপর ধেয়ে এল স্মৃতির মিছিল। তাতে লাভ হল এই যে একটু যেন চোখ লেগে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় একটু শান্তি। কিন্তু একটু পরেই শুরু হল পেটের ভেতর দুরন্ত হাওয়ার ক্রান্তি।

পেটের মধ্যে হাওয়ার চাপ দেহের নীচের ভাগ থেকে ঘন ঘন ঘোর নিনাদে বেরোতে লাগল। উনি লেপচেপে কয়েকবার পাশ ফিরলেন এবং শেষে বিপ্লবের এক ভয়ানক বিস্ফোটের পর ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে বিপ্লবের হাওয়া এক পোষা কুকুরের মত লেজ নাড়তে নাড়তে শুধু ওনার নাকের ফুটো দিয়ে শব্দ করে যাতায়াত করতে লাগল। উনি ঘুমিয়ে পড়লেন এবং ঘুমের মধ্যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।

দেখলেন গণতন্ত্র ওনার খাটের পাশে মাটিতে উবু হয়ে হাত জোড় করে বসে আছে। ওর চেহারাটা খেতে হাল জোতা চাষির মত, আর ইংরেজির কথাছেড়েই দিলাম, ওতো ঠিক করে হিন্দিও বলতে পারে না। তবু ও কাকুতিমিনতি করেই চলেছে আর বৈদ্যজী শুনছেন। উনি বারবার ওকে চৌকির উপর বিছানাতে উঠে বসতে বলছেন।ওকে বোঝাচ্ছেন—আরে গরীব তো কী হয়েছে, তুমি হলে আমার আত্মীয়; কিন্তু গণতন্ত্র তবু ওনাকে হুজুর হুজুর, সরকার--এইসব করে চলেছে।

অনেক বোঝানোর পর গণতন্ত্র উঠে এসে বৈদ্যজীর চৌকির কোণায় বসলো। আরো খানিক সান্ত্বনার পর যখন বুঝল এবার কিছু কাজের কথা বলা যেতে পারে তখন বৈদ্যজীর কাছে নিবেদন করল –আমার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে গেছে, আমি প্রায় নগ্ন হয়ে গেছি। এই অবস্থায় কারও সামনে বেরোতে লজ্জা করে। তাই বলছি, হে বৈদ্যজী মহারাজ! দয়া করে এই অধমকে একটা সাফ-সুতরো ধূতি দিন, পরে দেখি।

বৈদ্যজী বদ্রী পালোয়ানকে বললেন ভেতর থেকে একটা ধূতি এনে দিতে, কিন্তু গণতন্ত্র মাথা নাড়তে লাগল। বলল—আমি আপনার কলেজের গণতন্ত্র। আর আপনি ওখানকার বার্ষিক সভা অনেক বছর ধরে ডাকেননি। ম্যানেজারের নির্বাচনও সেই কলেজ খোলার পর থেকে আর হয়নি। আজকাল আপনার কলেজ সব ব্যাপারে এগিয়ে চলছে, শুধু আমিই এককোণে অবহেলায় পড়ে রয়েছি। একবার আপনি নিয়মমাফিক নির্বাচন করিয়ে দিন। তাতেই আমার শরীর ঢাকার এক নতুন কাপড় হয়ে যাবে। আমার লজ্জা চলে যাবে।

এসব বলে গণতন্ত্র বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল আর বৈদ্যজীর ঘুমটিও ফের ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই উনি লেপের তলায় ওনার ভেতরের ক্রান্তির এক তাজা বজ্রনির্ঘোষ শুনতে পেলেন। তখনই ঠিক করলেন যে দেখতে যেমনই ফালতু লাগুক, গণতন্ত্র লোকটা ভালোমানুষ, ওনার নিজের লোক এবং ওকে সাহায্য করা দরকার। ওকে অন্ততঃ একটা নতুন ধূতি দেয়া হোক। তাহলে ও আর পাঁচজন সভ্যভব্য লোকের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারবে।

পরের দিন কলেজের প্রিন্সিপালকে আদেশ দেওয়া হল—কলেজের বার্ষিক সভা ডাকা হোক এবং সমস্ত পদের সঙ্গে ম্যানেজারেরও নির্বাচন করা হোক। প্রিন্সিপাল অনেক বোঝালেন যে নতুন নির্বাচন করা দরকারী নয়, জরুরীও নয়। কিন্তু বৈদ্যজী নাছোড়, বললেন—তুমি থামো। এটা নীতির ব্যাপার।

কিন্তু প্রিন্সিপাল থামার পাত্র নন। বলে চললেন—আরে কোন খবরের কাগজে সমালোচনা হয়নি, ওপরমহলে নালিশ যায়নি, না কোন মিছিল বেরিয়েছে, না কেউ অনশনে বসেছে। সব শ্যালক নিজের নিজের গর্তে সেঁধিয়ে রয়েছে। কেউ তো বার্ষিক সভা ডাকার কথা বলছে না, আর যে বলছে সে ব্যাটা কে? সেই ব্যাটা খান্না মাস্টার, সেই রামাধীন ভীখমখেড়বী আর ওনার দু’চারটে চামচে। ওদের চালে ফেঁসে সভা ডাকার ফল ভাল হবে না।

বৈদ্যজী সব শুনলেন, তারপর বললেন—তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এসব তোমার বুদ্ধির অগম্য। কারণ এটা হল নীতিগত সিদ্ধান্ত। যাও, গিয়ে সভা ডাকার ব্যবস্থা কর।

সেদিনই সন্ধ্যে নাগাদ গয়াদীনের বাড়িতে পাঠানো হল। উদ্দেশ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ওনার মতিগতির একটু আঁচ পাওয়া। গয়াদীন হলেন কলেজ কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। কাজেই এখন ওনার অপরিসীম গুরুত্ব। জানা দরকার যে উনি এবার কাকে ম্যানেজার করার কথা ভাবছেন। আর যদি ওনার ভাবনা বৈদ্যজীর পক্ষে না হয়, তাহলে কী কৌশলে ওনার হৃদয়-পরিবর্তন করা যেতে পারে? রঙ্গনাথ এবং রুপ্পনবাবু প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করতে ওখানে গেছেন।

তবে গয়াদীন গোড়া থেকেই পুরো ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন। উনি দু’জনকে আপ্যায়ন করে চারপাইতে বসালেন, রঙ্গনাথের শহুরে শিক্ষার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওদের বিশুদ্ধ ঘী দিয়ে তৈরি মটরী ও লাড্ডু খাওয়ালেন, তারপর নির্বাচনের কথা উঠতেই সাফ বলে দিলেন—“সব কাজ ভাল করে ভেবেচিন্তে করা উচিত। সময়ের হাওয়ার সঙ্গে বয়ে গেলে চলবে না। ম্যানেজার পদের জন্য নির্বাচন করাতে হবে, ভাল কথা। কিন্তু ম্যানেজার বৈদ্যজী মহারাজই থাকবেন, কারণ কলেজটা ওনারই। অন্য কাউকে ম্যানেজার করার প্রশ্ন উঠছে কেন? এসব ভাল করে ভাবা উচিত”।

ওনার কথাশুনে মনে হল যেন খোদ রঙ্গনাথ আর রূপ্পনবাবু বৈদ্যজীর বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছে, এবং বৈদ্যজীর তরফ থেকে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব গয়াদীন নিজে সামলাচ্ছেন। রঙ্গনাথের মজা লাগছে। ও বলল,”আপনারা হলেন পুরানো লোক। প্রত্যেক বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু ওদিকে যে ভীখমখেড়বী আর অন্য কিছু লোকজন মামার জায়গায় অন্য কাউকে ম্যানেজার করতে চাইছে। জানি না কেন এসব করছে”?

গয়াদীনের কাশি উঠল। ধীরে ধীরে বললেন,” অভিজ্ঞতা নেই, তাই। ওরা ভাবছে ম্যানেজার অন্য কেউ হলে ওরা কিছু করে দেখাবে। কিন্তু এভাবে কোন কিছু হয় নাকি”? তারপর একটু থেমে কথা শেষ করলেন,” যেমন নাগনাথ, তেমনই সাপনাথ”।

কথাটা রঙ্গনাথের পছন্দ হল না। এই উপমায় ওর মামাজী বেশ খাটো হয়ে গেলেন যে! ও তাড়াতাড়ি বলল,”সে বুঝলাম, কিন্তু মামাজীর সঙ্গে তুলনায় ওরা দাঁড়াতে পারে?”

উনি ফের ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, “দেখ একথাটা তো আমি আগেই বলে দিয়েছি। কলেজ বৈদ্যজীর, ওনার হাতেই থাকুক। পঞ্চায়েত রামাধীন ভীখমখেড়ীর, সেটা ওর হাতে থাকুক। সবাই নিজের নিজের ঘরে বসে সন্তুষ্ট হোক। ---

“নির্বাচনের তামাশায় আছেটা কী? নতুন লোককে ক্ষমতায় বসাবে? সেও একইরকম খারাপ হবে। সব একই ধরণের। তাই বলছি—যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই নির্বাচিত করে দাও। পড়ে থাকুক নিজের গুহায়। খামোকা ওলট-পালট করে কী লাভ”?

রুপ্পনবাবু বাটিতে পড়ে থাকা শেষ লাড্ডুটিকে মন দিয়ে দেখতে দেখতে “খাব-কি-খাব না” চিন্তায় মগন। যেই শুনেছেন যে গয়াদীন বৈদ্যজীকেই ম্যানেজার বানানোর পক্ষে, ওনার কথাবার্তায় আগ্রহ শেষ হয়ে গেল। উনি বুঝে গেছেন যে এরপরে খালি ফালতু বকোয়াস হবে। কিন্তু রঙ্গনাথ গয়াদীনের ভাবনায় কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পেল।

যেমন, নির্বাচনে যারাই দাঁড়ায়, তাদের অধিকাংশই অধম এবং নীচ প্রকৃতির লোক। তাহলে যাদের বদমাইশি এবং প্যাঁচ-পয়জার লোকজন চিনে ফেলেছে, তাদের সরানো উচিত নয়। রঙ্গনাথ মনে মনে গণতন্ত্রের এই থিওরির নাম দিল ‘গয়াদীনবাদ’। ওর ইচ্ছে হল আরও কিছু শোনে।

গয়াদীন বলছিলেন, “নতুন লোক এসে কিছু করতেও যদি চায়, তো করবেটা কী? যদি লোকে কিছু করতে দেয় তবে না! আজকাল যে সময় পড়েছে, কেউ কাউকে কিছু করতে দেয়? এখন তো খালি---“।

ছংগামল ইন্টার কলেজের ছেলেদের খেলাধূলার জগতের সঙ্গে ভালরকম পরিচয় আছে। কারণ, কলেজ প্রতিমাসে ওদের থেকে খেলাধুলোর ফীস কান ধরে আদায় করে, যদিও কলেজের কাছে খেলেধুলোর জন্য কোন মাঠ নেই। কিন্তু এনিয়ে কারও হেলদোল নেই। সবাই সন্তুষ্ট। খেলাধুলোর দায়িত্ব গেমস টিচারের। ফলে তাঁর কাছে অফুরন্ত সময়। তাই তিনি মাস্টারদের দুটো দলের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে তাদের ভেতরের খবর বের করে নেন।

এতে প্রিন্সিপালেরও খুব আরাম। এখানে হকি স্টিক নিয়ে মারপিট হয় না, কারণ এদের কোন হকি টিম নেই। আর এসব থেকে কলেজের ডিসিপ্লিনেও কোন আঁচ লাগে না। ছাত্রদের বাপও খুশি, কারণ ছেলেদের খেলার ঝামেলা শুধু ফীস দিলেই মিটে যাচ্ছে। আর ছেলেরাও সত্যি সত্যি কোন খেলোয়াড় হবে না। ছেলেদের দলও খুশো। কারণ ওরা জানে যে হাতে হকিস্টিক নিয়ে একটা ঢিলের টুকরোর মত ছোট্ট বলের পেছনে এই গোল থেকে ওই গোলপোস্ট পর্য্যন্ত পাগলের মত দৌড়তে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণে এক কুঁজো তাড়ির রস গেলা যায়। অথবা, জুয়োর আসরে দাঁও লেগে গেলে চার-ছ’টাকা পকেটে পোরা যায়।

এই ছেলেগুলোর হাতেই আজ হকিস্টিক এবং ক্রিকেট ব্যাট। সেগুলো ওরা এমন কায়দায় ধরেছে যেন ওদের হাতে কেউ রাইফেল গুঁজে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশটা ছেলে এইসব হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে কলেজের গেটের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। রঙ্গনাথ ওদের এই অপরূপ সাজসজ্জা দেখে জানতে চাইল—হয়েছেটা কী? আজ কি স্কুল ইনস্পেক্টরের আসার কথা?

ছোটে পালোয়ান উত্তর দেবার চেষ্টা করল, অর্থাৎ কোমর থেকে আলগা হওয়া লুঙ্গির গিঁট কষে বাঁধল। তারপর বলল,”এইসব পটাপট ঝামেলার মধ্যে কার ইনস্পেকশনের দায় পড়েছে? এসব আয়োজন তো বার্ষিক সভার জন্য “।

ছোটে পালোয়ান কলেজের সমিতির সদস্য বটে। ছেলেরা ওকে দেখে হর্ষধ্বনি করল। গেটের কাছে ওর দেখা হল প্রিন্সিপালের সঙ্গে। উনি বললেন,”আসুন ছোটেলালজী! আপনারই অপেক্ষায় আছি।

--“এসেছি যখন, পালিয়ে যাব নাকি? আপনি আমার আগে চলুন”। এটা ছোটেলাল ভালো মনে বলল। রর্ষাকালে কুকুর বৃষ্টিতে ভিজলে এক বিশেষ ধরণের শব্দ করে হাঁচে। অপ্রস্তুত প্রিন্সিপালের হাসির চেষ্টায় গলা দিয়ে খানিক ওইরকম আওয়াজ বেরোল। উনি পালোয়ানের আগে আগে চলতে চলতে বলা শুরু করলেন,” রামাধীনের দলও কোমর কষেছে। বেজেগাঁওয়ের লাল সাহেবের সাহায্যে আরও কয়েকজনকে ভাঙিয়ে নিয়েছে। লালসাহেব কেন যে এই সব ঝামেলায় নাক গলিয়েছেন। থাকেন তো শহরে, কিন্তু গাঁয়ের সব বিষয়ে নাক গলানো চাই”। রামাধীনের দেমাক বেড়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছেনা যে কতজন এদিকে আর কতজন ওদিকে”।

ছোটে পালোয়ান কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে ফুলের কেয়ারির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রিন্সিপাল বিড়বিড় শুরু করলেন –‘বৈদ্যজী মহারাজও মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যে কী আর বলি—কী দরকার ছিল এই নির্বাচন-টির্বাচন করানোর---‘?

পালোয়ান তখন একটা জনপ্রিয় কীর্তনের লাইন আউড়ে দিল—‘কেন শুনি বাকি লোকেদের কথা, আমার কৃষ্ণ যে প্রাণাধিক—‘!

গেট পেরিয়ে ভেতরে যেতে যেতে প্রিন্সিপাল বললেন—‘আপনিও আসুন রঙ্গনাথ বাবু, আপনার কোন মানা নেই’।

রঙ্গনাথ মাথা হেলিয়ে জানালো যে ও আসছে, কিন্তু ভেতরে গেল না। এবার একজন দু’জন করে কলেজ পরিচালক সমিতির সাধারণ সদস্যরাও ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে আসতে শুরু করেছেন। কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের একজন ডায়রেক্টর এলেন পায়ে হেঁটে। কিন্তু এমন বেগে এলেন এবং এত তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলেন যে ছোকরার দল ওনাকে না দেখে নিজেদের মুখ দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে ঠিকেদার সাহেব এলেন –কলেজের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে, ফসল পায়ে দলে। কিন্তু উনি গেলেন অন্যদিকে, যেখানে কিছু মজুর কোন কাজ করছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু জিনিস আকাশে তুলে মাটিতে পটকে দেওয়ার অভিনয় করে উনি হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলেন। একটু পরে এলেন বাবু গয়াদীন, ধীর পায়ে এসে গেটের কাছে কালভার্টের উপর ছোট সিমেন্ট বাঁধানো জায়গাটায় বসে পড়লেন। উনি উদাসী চোখে দেখতে লাগলেন---ছেলেদের হাতে হকিস্টিক আর ব্যাট এবং একটি ছেলের হাতে ক্রিকেট বল। তারপর ওই বলের দিকে এমন একাগ্র হয়ে তা্কিয়ে রইলেন যেন সম্মোহন করছেন।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন—চলুন মেম্বার সাহেব, অন্য সবাই এসে গেছেন।

উনি এমনভাবে তাকালেন যেন ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন, আর ওনাকে সাক্ষীদের সামনে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে যেতে বলা হয়েছে। অসুস্থ গলায় বলেন, ‘চলুন’। তারপর পেঙ্গুইনের মত পা ফেলে ফেলে উনি গেট পেরিয়ে কলেজ ভবনের মধ্যে অন্তর্হিত হলেন।

আরেকটু পরে সড়কে এক ঘোড়সোয়ারের আবির্ভাব হল, তার মাথায় পাগড়ি। দেখলে মনে হবে যেন ইতিহাসের দ্বাদশ শতাব্দীর পাতা থেকে এক্ষুণি ফরফর করে বেরিয়ে এসেছেন। ছোকরাদের মধ্যে একজন বলে উঠল—“এখন আর কেউ বৈদ্যজীর একগাছিও ছিঁড়তে পারবে না। ঠাকুর বলরাম সিং এসে গেছেন”।

বলরাম সিং এসেই ঘোড়ার লাগাম একটি ছেলেকে ধরিয়ে দিলেন। এখন উনি অষ্টাদশ শতাব্দীর চরিত্র। যেন দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহের খবর দিতে আগ্রার কেল্লায় ঢুকেছেন এমনি গতিতে কালভার্ট অব্দি এসে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘মারপিট হয়নি তো’?

--‘কিসের মারপিট? আমরা প্রিন্সিপালের দলে, অহিংসাবাদী’।

বলরাম সিং গোঁফে তা’ দিতে দিতে হেসে ফেললেন।

--‘তোরাও কিছু কম যাস না। হাতে হকিস্টিক আর ডান্ডা, আবার গান্ধীজির চেলাগিরি’!

ছেলেটা-‘মহাত্মাও লাঠি নিয়েই চলাফেরা করতেন। আমাদের হাতে কোন লাথি নেই। আর হকিস্টিক? এতে একটা বলও মরে না, মানুষ কোত্থেকে মরবে’?

প্রিন্সিপাল আবার বাইরে এসেছেন। ‘চলুন মেম্বার সাহেব, ভেতরে চলুন। কোরাম পুরো হয়ে গেছে। এবার মিটিং শুরু হবে’।

বলরাম সিং পাগড়ির কোনা দিয়ে ঘাম মুছলেন। বললেন,’কোন চ্যালাকে বলে দিন, ঘোড়াকে দানাপানি দিতে। আমি ভেতরে গিয়ে কী করব? আমার যত কোরাম, সব এখানেই’।

প্রিন্সিপাল খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন। বলরাম সিং পাঞ্জাবীর পকেটটা শক্ত করে ধরে বললেন,’বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখুন। কেমন কড়া! এটাই আসল কোরাম’।

প্রিন্সিপাল না ছুঁয়েই বললেন,’ ধরে নিন, ছুঁয়েছি। আরে আপনার কথা কি মিথ্যে হতে পারে’?

বলরাম সিং—‘ আসলী বিলেতি মাল, ছ’ঘরা। দেশি দোনলা নয় যে একবার ফুট্ট্‌ হয়ে থেমে যাবে। ঠাঁয় ঠাঁয় শুরু করে দিলে রামাধীনের দলের ছ’জন চড়াই পাখির মত ফুরুৎ হয়ে যাবে’।

--“ আহা, আপনার জবাব নেই! লা-জবাব”! প্রিন্সিপাল এমন ‘বাহ্‌ বাহ্‌’ করে উঠলেন, যেন বলরাম সিং কোন মুশায়েরাতে কাব্যপাঠ করছেন। উনি যেতে যেতে বললেন—“আমি ভেতরের মিটিংয়ে যাচ্ছি। বাইরেরটা আপনি সামলাবেন”। ফের পেছন ফিরে মহাত্মা বিদুরের বাণী ঝাড়লেন, “যাই করুন, শান্তিপূর্ণ ভাবে”।

বলরাম সিং ফের গোঁফে তা’ দিলেন। “ এখানে সব শান্তি। আমার উড়ুর নীচে গোটা পঞ্চাশেক শান্তি বিরাজ করছে”।

প্রিন্সিপাল সাহেব ভেতরে গেলেন। বলরাম সিং ফের কালভার্টের উপর পুলিয়াতে বসে পড়লেন। খানিকক্ষণ পিচির পিচির করে পানের পিক ফেললেন। তারপর যে ছেলেটা নিজেকে মহাত্মা গান্ধীর থেকে বড় অহিংসাবাদী ডায়লগ ঝেড়েছিল তাকে বললেন,” যাও তো ছেলে; একবার গোটা কলেজ চক্কর মেরে এসো। দেখে এস, আমার লোকজন ভেতরে ঠিক ঠিক জায়গা আটকে পাহারা দিচ্ছে কিনা? আর ব্যাটা রমেসরাকে বলে দাও—সালা যেন কারও সঙ্গে হাঙ্গামা না করে। যে বোঝালেও বুঝবে না তাকে এদিকে গেটের কাছে পাঠিয়ে দেয়, ব্যস্‌”।

ছেলেটা হালচাল বুঝতে ভেতরে চক্কর মারতে গেল। ও যেন একটা বয়স্কাউট, যে ভাবছে দেশের জয়-পরাজয় স্রেফ ওর মিশনের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে। আশপাশের ছেলেগুলোর ছটফটানি বাড়ছে। তাই দেখে বলরাম সিং বললেন—“যাও ব্যাটারা; বেশ বড় চক্কর মেরে ঘুরে এস। আর নিশ্চিন্ত থাক, আমি যতক্ষণ পুলিয়াতে বসে আছি কোন দুশমন এদিকে ঘেঁষবে না”।

বেলা তিনটে। রাস্তা দিয়ে ট্রাক আর বলদে টানা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। বলরাম সিং পুলিয়ার উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে স্বপ্নিল চোখে ওই আসাযাওয়া দেখছেন। একবার ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করে উঠল। উনি বললেন,”সাবাশ মেরে চেতক! সবুর কর। সময় হলে দানাপানি পাবি”।

চেতক সবুর করল এবং প্রমাণস্বরূপ খানিক পরে পরে জল ছাড়তে লাগল। ্কিছু ছেলে ওকে ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার নৈসর্গিক কাজকম্মের আগে ওপরের অবস্থা মন দিয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে পেরাইভেট হাসাহাসি করতে লাগল।

হঠাৎ কলেজের সামনের রাস্তায় একটা ট্রাক এসে থামল। একটি লোক তার থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত পায়ে কলেজের দিকে এগোতে লাগল। তার পরণে পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবী-টুপি আর হাতে একটা ছড়ি। ট্রাককে থামতে দেখেই ছেলের পাল এদিক ওদিক থেকে দৌড়ে দৌড়ে পাকলেজের সামনে পুলিয়ার দিকে দলবেঁধে আসতে লাগল। বলরাম সিং ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে বললেন-- আপনার চরণ স্পর্শ করি পণ্ডিত!

লোকটি বিড়বিড় করে কোন আশীর্বচন বলে সিধে কলেজের গেটের দিকে এগোতে লাগলেন। বলরাম সিং বললেন—“পণ্ডিত, একটু ধীরে। কেউ তোমাকে তাড়া করছে না”।


লোকটি থতমত খেয়ে হাসল। বললেন—মিটিং শুরু হয়ে গেছে না?

বলরাম সিং উঠে দাঁড়ালেন। মাপা পায়ে পণ্ডিতের কাছে এলেন। ছেলের দল এগিয়ে আসছে, প্রায় ঘিরে ফেলছে। উনি ধমকে উঠলেন—“ ভেগে পড় ছেলের দল। একটু দূরে গিয়ে খেলাধূলো কর”। তারপর পণ্ডিতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন-“পণ্ডিত, মিটিংয়ে তোমার হাজিরি লেগে গেছে। এবার ফিরে যাও”।

পণ্ডিত কিছু বলতে চাইল। কিন্তু উনি এবার পণ্ডিতের গায়ে গা লাগিয়ে বললেন—“কিছু ভেবেই বলছি। ফিরে যাও”।

পণ্ডিতের মনে হল জঙ্ঘার কাছে কিছু শক্ত জিনিস ধাক্কা দিচ্ছে। উনি বলরাম সিংয়ের পাঞ্জাবীর পকেটের দিকে তাকালেন এবং হড়বড়িয়ে দু’পা পেছনে হটে গেলেন।

ওনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বলরাম সিং ফের বললেন—“পণ্ডিত, চরণ-বন্দনা”!

লোকটি চুপচাপ ফিরে গেল। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, ট্রাক চলে গেছে। ও এবার কোন একদিকে দ্রুত পায়ে চলতে চলতে হঠাৎ দৌড়তে লাগল। একটা ছোকরা বলল—গেছে!

বলরাম সিং বললেন, “পণ্ডিত সমঝদার; বুঝতে পেরেছে”।

“সমঝদার তো বুঝলাম। কিন্তু অমন করে পালাবার কী হয়েছিল?” –একটি ছাত্রের প্রশ্ন।

বলরাম সিং—“এখনো চ্যাঙড়া বয়েস। একটু বড় হও তখন বুঝবে এমন সময়ে সমঝদার মানুষ এভাবেই দৌড়য়”।

একজন বিদ্যার্থী ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছিল। ঘোড়া ফের চিঁহি করে উঠল। এবার বলরাম ধমকে উঠলেন—“চুপ বে চেতক”!

বয়-স্কাউট ছেলেটি ফিরে এসেছে। বলরাম ঘোড়াকে ধমকানোর সুরেই বলেন, “ কিঁউ বে, ক্যা খবর হ্যায়”?

স্কাউট গেল ঘাবড়ে। ক্লাসে ঘাবড়ে যাওয়া সাধারণ পড়ুয়ারা যেমন দাঁত বের করে তেমনি করে

হেসে বলল,” হ্যাঁ ঠাকুর সা’ব; সব ঠিকঠাক চলছে”।

“ক’জন আদমী এসেছিল”?

“সবাই বুঝে গেছে? নাকি কেউ অবুঝপনা করেছে”?

“সব্বাই বুঝে গেছে”। ছেলেটার সাহস ফিরে এল। দূরে পালাতে থাকা পণ্ডিতের দিকে ইশারা করে বলল, “ওনার মতই ধড়ফড় করে সবাই ফিরে গেল”।

ছেলেটা এবার প্রাণ খুলে হাসল। বলরাম সিং বললেন,” বেশি বুঝে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত”।


কলেজের ভেতর থেকে জয়ধ্বনি ভেসে আসছে। কেউ বলছে—‘ বোল্‌ সিয়াবর রামচন্দ্রকী জয়’!

জয় বলার ব্যাপারে হিন্দুস্তানিদের মোকাবিলা কে করবে? শুরু হল ‘সিয়াবর রামচন্দ্র’ থেকে, ফের ‘পবনপুত্র হনুমানের জয়’। ফের, কেউ জানেনা কেমন করে, ঝটপট মহাত্মা গান্ধীর জয়ে পৌঁছে গেল।

--“বোল্‌ মহাত্মা গান্ধী কী জয়”! ব্যস্‌ সবুজ পতাকা নাড়া হয়ে গেছে। পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু একবার ‘জয়’ পেলেন। তারপর প্রদেশের সব নেতাদের একটা করে। এক-একটা জেলার নেতাদের। এবার আসল জয়ধ্বনি—“ বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী জয়”!

বর্শায় বেঁধা শুওরের মত চিঁচিঁ করতে করতে প্রিন্সিপাল সাহেব বাইরে এলেন। উনিও চেঁচিয়ে উঠলেন—বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী!

‘জয়’ বলার জন্যে পরের প্রজন্ম গেটের সামনে হাজির ছিল।

কলেজের সামনে যেন মেলা বসেছে। প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বোঝাতে লাগলেন, “চলুন, বৈদ্যজী মহারাজ ফের সর্বসম্মতিতে ম্যানেজার নির্বাচিত হয়েছেন। এবার দেখুন কলেজ কেমন দ্রুত উন্নতি করে—ধকাধক, ধকাধক, ধকাধক! ্তুফান মেলের মত গতি”! উত্তেজনায় ওনার চেহারা ক্রমশঃ লাল হচ্ছে।

ছোটে পালোয়ান বলল, “এ প্রিন্সিপাল, বেশি ভড়ভড় করবে না তো। আমারও একটা কোথা শুনে নাও। এই যে ছোঁড়াগুলো হকির ডান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের এক একটা বলও ধরিয়ে দাও। আর বলো কিছু লক্ষ্যভেদ করা শিখতে। এদের মধ্যে একটাও নেই যে বলে ডান্ডা মারতে পারে। সবকটা সাপমারার মত করে ধুলোর মধ্যে লাঠি পেটায়”।

-“অবশ্য, মেম্বার সাহেব, অবশ্য। খেলাধূলোর ব্যবস্থাও হবে। আগে এই ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পাই —“।

ছোটে, “রেহাই তো পেয়ে গেছ। এবার আমাকে বলতে দাও। সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলা তোমার একটা স্বভাব। কিন্তু তোমার লাঙল-চষা ক্ষেতে একটা মূলোও জন্মায় না। খেলাধূলোর ব্যাপারটাও তাই। তোমার ছেলেগুলো শুধু হকির ডান্ডাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজকেই যদি দরকার পড়ত তো ওরা খালি হাওয়াতে ডান্ডা ঘোরাতে থাকত, ব্যস্‌। কারও পিঠে নিশানা করে চালালে সেটা লাগত হাঁটুতে। দরকারের সময় নিশানা ঠিক হওয়া চাই”।

পেছন থেকে বৈদ্যজীর কন্ঠস্বরঃ “খেলাধূলোরও গুরুত্ব আছে প্রিন্সিপাল সাহেব! ছোটের কথা অনুচিত নয়”।

“হেঁ হেঁ”, প্রিন্সিপাল পালোয়ানের দেহসৌষ্ঠব প্রেমিকার চোখে দেখে বললেন, “এ পালোয়ান, নাকি হাসিঠাট্টার ফুলঝুরি! এ কখনও অনুচিত কিছু বলে না”।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






উনিশ

কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষের চেতনা এখনও হয়নি । গাছ কাটা এখনও অব্যাহত আছে ।তাইতো এত গরম ।বৃষ্টির দেখা নেই ।বিজয় খুবই চিন্তার মধ্যে আছে । রাতে তার ঘুম হয়না । বর্ষাকাল চলছে ।সমুদ্র ফুলে উঠেছে আক্রোশে ।কি হয় ,কি হয় ।খুব ভয় ।বিজয় ভাবে,মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বেইমানি করেছে । এর প্রতিশোধ প্রকৃতি নেবেই । তারপর অন্য কথা ।একদিন বর্ষাকালে রাতে সবাই ঘুমিয়ে আছে কিন্তু জেগে আছে সমীর আর বন্যার জলের বিষাক্ত ফণা । মাঝ রাতে বন্যার একটা বড় ঢেউ এসে সমীর ও তার গ্রামের সবাই কে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ধ্বংসের পথে । এখন সেই গ্রাম শ্মশানের মত ফাঁকা ।প্রকৃতি এখনও সুযোগ দিয়ে চলেছে বারে বারে । সাবধান হলে বাঁচবে । পৃথিবীকে সবুজের ঘেরাটোপে সাজাতে হবে। বাঁচার একমাত্র পথ গাছ, শুধু গাছ। বন্যা কমে গেলে নদীর পাড়ে ভাঙা বাঁধটা দশ গ্রামের লোক এসে একত্রে বাঁধলো মাটি আর বাঁশ দিয়ে শক্ত করে। বিজয় বলে সকল গ্রামবাসীকে , আমাদের গ্রামটা সবুজ গাছ করে দাও সবাই একত্রে গাছ রোপণ করে।তাহলে আমদের গ্রাম বাঁচবে।...

একদল বলাকার দল উড়ে এল রিমির মনমেঘে।তখন সে সাদাশাড়িতে সতের।দেহের সাগর ঘিরে উথালপাথাল ঢেউ।ঠিক সেই সময়ে নোঙর করে তার মনের তীরে পূর্ব প্রেমিক সমীরণের ছোঁয়ায় তার শিরশিরে পানসি নৌকার অনুভব।ধীরে ধীরে পালতোলা জাহাজের মত দুজনের প্রেম তরতরিয়ে এগিয়ে চলে।শত ঝিনুকের মুক্তোর সোহাগে দুজনেই রঙীন হয়ে উঠত।

চিন্তার রেশ কাটতেই বিপিন বলে উঠল,রিমি তুমি এত কী চিন্তা করছ?

- কিছু না।এমনি করেই কাটুক সময়।

- আমাদের বিয়ের পাঁচ বছরে একটা অনুষ্ঠান করলে হয় না?

- থাক ওসবে আর কী হবে? এই বেশ বসে আছি নদীর তীরে।

- তোমার অতীতের কথা বলো। আমি শুনব।

- কেন তোমার অতীত নেই

- আমার অতীত বর্তমান হয়ে রাজুর বউ হয়ে বসে আছে।

- ও, রাজুর বউ তোমার পূর্ব প্রেমিকা ছিল?

- হ্যাঁ ছিল একদিন। গ্রামের মন্ডপতলায় গেলেই মনে পড়ে বাল্যপ্রেম।কাঁসর ঘন্টা বাজত আরতির সময়।আমি ভালো কাঁসর বাজাতাম।আর তাছাড়া ওর মুখ দেখার লোভে ছুটে চলে যেতাম পুজোমন্ডপে। আরতির ফাঁকে দেখে নিত ওর চোখ আমাকে।তার চোখের নজর আমার দিকেই থাকত। সারাদিন তাকিয়ে থাকতাম ওদের বাড়ির দিকে।যদি একবারও দেখা যায় ওর মুখ। অসীম খিদে চোখে কেটে গেছে আমার রোদবেলা।

- আমারও অতীতের ভালোবাসা সমীরণ, ভেসে গেছে অজানা স্রোতে।এসো আজ আমরা আবার নতুন মনে এক হই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ চেয়ে।

- হ্যাঁ ঠিক বলেছো তুমি। পুরোনো ব্যাথায় মলম লাগাব দুজনে দুজনকে।চলো আজ নৌকাবিহারে আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করি।

- চলো। নব উদ্যমে এগিয়ে যাই আমরা নবসূর্যের আহ্বানে।

রিমি লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর ভক্ত।বিপিন পুণ্যদাস বাউলের গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।কিন্তু দুজনে দুজনের পছন্দকে শ্রদ্ধা করে।

রিমি বিপিনকে বলে তার প্রিয় লেখিকার কর্মজীবনের কথা,সাহিত্যের কথা।রিমি বলে, পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুরের শবর জনজাতির সঙ্গে মহাশ্বেতা জড়িয়ে ছিলেন আজীবন । তাকে মা হিসেবে মেনে নিয়েছিল শবরাও । পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর ব্লকে লােধা শবর , বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ , রাইপুর এবং পুরুলিয়ার তেরােটি ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী খেড়িয়া শবরদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষে কাজ করেছেন তিনি । এদের উন্নয়নে মহাশ্বেতারকর্মসূচি ছিল শিশুশিক্ষা , বয়স্কশিক্ষা , নারীশিক্ষা , শবরদের মদ্যপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি , তাদের হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করা এবং ব্রিটিশ যুগ থেকে শবরদের গায়ে লেগে থাকা ‘ অপরাধপ্রবণ জনজাতি’রতকমা থেকে তাদের মুক্ত করা।

বিপিন বলে,আমি পড়েছি,এজন্য আইনি লড়াইয়েও পিছপা হননি তিনি । ২০০৩ সালে এই শবরমাতা ম্যাগসাইসাই ’ পুরস্কারের ভূষিত হন । পুরস্কার মূল্যের দশ লক্ষ টাকা পুরােটাই তিনি দিয়েছেন এদের উন্নয়নার্থে । গ্রামে কোন সমস্যা হলেই তিনি সেইসব গ্রামে সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে গেছেন ।

রিমি আবার বলে, মহাশ্বেতার সাহিত্যিক জীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল আরাে অনেক বছর আগে । ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় পদ্মিনী ও যশোবন্তি গল্পদুটি লেখেন মহাশ্বেতা দেবী । পঞ্চাশের দশকের গােড়ায় মহাশ্বেতা দেবী গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে ।১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রাণী, এইমধ্যপ্রদেশের লােককথা ও ইতিহাসের মিশেলে তৈরি । ষাট দশকের গােড়ায় অবিভক্ত বিহারে পালামৌ , হাজারিবাগ , সিংভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সেখানকার বেগার শ্রমিক প্রথা এবং জনজাতিদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে লেখেন ‘ অপারেশন বসাই টুডু, অরণ্যের অধিকার এবং ‘ চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর ‘ । ১৯৭৪ সালে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘ হাজার চুরাশির মা ‘ বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল । পরবর্তীতে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের বিভিন্ন বাংলা পাঠ্যপুস্তকও সম্পাদনা করেন মহাশ্বেতা । ১৯৭৯ সালে বাবা মণীশ ঘটকের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘ বর্তিকা’র দায়িত্ব নেন । ১৯৮৩ সালে পুরুলিয়ার অবহেলিত জনজাতিদের উন্নতির জন্য গড়ে তােলেন পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি । তিনি তার বহু পুরস্কারের অর্থ দান । করেন এইসমিতিকে ।
1

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৯ পর্ব

ব্রিটিশদের লুন্ঠন এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

ব্রিটিশের এই লুণ্ঠন চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। ঐতিহাসিকেরা বলেন ১৭৫৭ থেকে ১৮১৫ সাল (পলাশি থেকে ওয়াটারলু) পর্যন্ত লুন্ঠনের পরিমাণ তখনকার হিসাবে প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড যার আজকের হিসাবে অর্থমূল্য ২২৫০০ কোটি পাউন্ড অথবা কুড়িলক্ষ কোটি টাকা!! (তথ্যসূত্র পি জে মার্শাল রচিত প্রবলেমস অফ এম্পায়ার –ব্রিটেন এন্ড ইন্ডিয়া-১৭৫৭-১৮১৭)। ঈশ্বরপ্রেরিত এই সম্পদে একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠলো ব্রিটেন।বাংলার শরীর থেকে নির্গত রক্তের রঙ লাল থেকে সাদা হয়ে প্রবাহিত হতে থাকলো ব্রিটেনের দিকে বছরের পর বছর ধরে। ইতিমধ্যে ১৭৬৯-৭০ এ প্রকৃতি বাধ সাধলো।বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সে বছর ধান এবং অন্যান্য শস্যের ফলন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। চাষীদের ঘরে হাহাকার উঠলো। নদীয়ার উত্তর থেকে বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় শস্যহীন হয়ে পড়লো। ভারতীয় এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা যারা আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল যে শস্যাভাবে এবং খাদ্যাভাবে ধুঁকতে শুরু করবে বাংলা এবং বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তারা আগেভাগে ধান এবং শস্য কমদামে কিনে গুদামে মজুত করে রাখলো। এই রক্তচোষা মজুতদারেরা বারে বারে দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মুনাফার পাহাড় বানিয়েছে। পরে সেই মজুত করা শস্য দ্বিগুন তিনগুন দামে বিক্রি করতো এই মজুতদারেরা। ১৭৭০ সালের গ্রীষ্মে অবস্থা চরমে উঠলো। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারা যেতে শুরু করলো। নিরুপায় মানুষ তাদের গরু ছাগল, চাষের সরঞ্জাম দুমুঠো ভাতের জন্য জলের দরে বিক্রি করে দিল মজুতদারদের কাছে। নিজেরা বাঁচার জন্য নিজের ছেলে মেয়েদের বিক্রি করে দিতে লাগলো মানুষ। অবশেষে যখন আর ছেলে মেয়ে বিক্রি করার জন্য খদ্দের পাওয়া গেলনা তখন গাছের পাতা চিবিয়ে খেতে শুরু করেছিল মানুষ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। মানুষের মৃতদেহ শিয়াল কুকুরের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিল মানুষ। ত্রিশলক্ষ দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে দশলক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল কয়েকমাসে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে এই ভয়ঙ্কর সময়ে কোম্পানি ডিরেক্টররা প্রশাসনের কাছে কম খাজনা আদায়ের জন্য কৈফিয়ত চেয়ে চিঠি পাঠালো । সেইসময় খাজনা আদায়ের প্রধান আধিকারিক ওয়ারেন হেস্টিংস যে পরবর্তীকালে ১৭৭৩ সালে বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে আসীন হয়েছিল সে নিশ্চিত করেছিল যে খাজনা আদায়ের পরিমাণ তার আগের বছরের চেয়ে যেন কম না হয়। কিছু কিছু জেলায় আদায়ের পরিমাণ কম হলেও মোট আদায়ের পরিমাণ একই ছিল বলে জানা যায়। ত্রাণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে খরচের পরিমাণ ছিল ৯০০০ পাউন্ড অর্থাৎ আজরের হিসাবে কুড়িলক্ষ পাউন্ড অথবা ১৮ কোটি টাকা।

মিরকাশিমের হাতে জগতশেঠ মাধবরাই আর তার ভাইপো মহারাজ স্বরূপচাঁদ নিহত হবার পর জগৎশেঠেরা আর তাদের হৃতগৌরব ফিরে পায়নি। মাধবরাই এর বংশধরেরা আরও বেশ কিছুদিন ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল। এমনকি ১৭৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ধারও নিয়েছিল। সম্পর্ক আরও কিছুদিন চলেছিল যদিও স্পষ্টতই জগৎশেঠেদের ব্যবসা পরিকল্পিত ভাবেই ব্রিটিশরা খতম করে দিচ্ছিল। পলাশি পরবর্তী সময়ে কোম্পানির আর্থিক উন্নতি এমন পর্যায় গিয়ে পৌঁছোয় যে ইউরোপ থেকে বুলিয়ন নিয়ে আসার আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। জগৎশেঠেরা এই সুবিধা ছাড়তে চাইছিল না। ১৭৫৮ সালে কাউন্সিল অফ কলকাতা মোগলরাজের কাছে নালিশ করলো যে তাদের ট্যাঁকশাল ব্যবসার জন্য আর কোনও কাজে লাগছে না। এর প্রথম কারণ ইউরোপ থেকে কোনও বুলিয়ন আসছে না। দ্বিতীয়ত জগৎশেঠেদের কাছে সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যবসায় বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য সিক্কার বিনিময়মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভ নিজে ১৭৭৩৪ টাকা খরচ করে হীরা -জহরতসহ প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে জগতশেঠকে অ্যাপ্যায়িত করেও কোনও কাজ হয়নি। অবশেষে ১৭৬০ সালে ট্যাঁকশাল হস্তান্তরের আদেশনামার সর্ত্তে মিরকাশিমকে মিরজাফরের ওপরে বসাল ব্রিটিশরা। সেই দিন থেকে মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশালের পতন শুরু হল এবং কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল ট্যাঁকশাল। তার সঙ্গে সঙ্গেই জগৎশেঠেদের সৌভাগ্যসূর্য অস্তমিত হয়ে গেল ভাগীরথীর জলে। কোম্পানি আর ব্রিটিশদের সৌভাগ্যসূর্য বিরাজ করতে শুরু করলো মধ্যগগনে। ট্যাঁকশালের ওপর জগৎশেঠেদের একাধিপত্য বিলুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস সিদ্ধান্ত নিল যে সরকার যে টাকা জগৎশেঠেদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বলা হলো- যে পরিবার কোম্পানির উন্নতির জন্য এত সাহায্য করেছে তাদের রক্ষার দায়িত্ব কোম্পানির কর্তব্য। অনতিবিলম্বেই ব্রিটিশ ব্যবাসায়ীরা এজেন্সি হাউস তৈরি করে অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় নেমে পড়লো। ইউরোপিয়ন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রমবর্ধমান পুঁজি সঞ্চিত রাখার জন্য নিরাপদ ব্যাঙ্কিং এজেন্সির সন্ধানে ছিল এতদিন। নতুন এজেন্সি হাউস ব্যবসায়ীদের পুঁজির টাকা গচ্ছিত রেখে ধার দেবার কারবার শুরু করলো। ১৭৭০ সালে তৈরি হলো পশ্চিমি কায়দায় তৈরি নতুন ব্যাঙ্ক –ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্তান। অবশেষে ১৭৯৯ সালে ট্যাঁকশালের যন্ত্রপাতি এবং বাড়ি নিলাম করে দেওয়া হলো। জগৎশেঠেদের বিপুল সম্পত্তির এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ এখনও আছে মুর্শিদাবাদে যা দেখবার জন্য ভারতের লোকেরা ১৫ টাকার আর বিদেশিরা ১০০ টাকার টিকিট কিনে ভিতরে প্রবেশ করে এখন।

খোশবাগ একসময় ছিল মুর্শিদাবাদের রাজা মহারাজা আর বর্ধিষ্ণু লোকেদের নৌকাবিহারের কেন্দ্র। ১৭৪০ সালে নির্মিত এই বিলাস উদ্যানের সংলগ্ন নদীর ঘাটে বড় বড় লোকেদের ময়ূরপঙ্খী এসে ভিড়ত সন্ধ্যাবেলা। বিলাসব্যসনে মত্ত হয়ে উঠত মুর্শিদাবাদের ধনী সম্প্রদায়। আজ সেই বাগানে সারি সারি মৃত মানুষের সমাধি। তারা কেউ প্রেমিক, কেউবা চক্রান্তকারী আবার কেউবা বিশ্বাসঘাতক। প্রথম সমাধিগুচ্ছে কারও নাম লেখা নেই। সেখানে শায়িত আছে আলিবর্দির পত্নী, সিরাজের মাতামহী সার্ফুন্নিসা। অনতিদূরেই আলিবর্দির জ্যেষ্ঠাকন্যা, সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগমের সমাধি। এই ঘসেটি বেগম তার অন্য এক বোনের ছেলে পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জংকে সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়েছিল এবং যার ফলস্বরূপ অকালে সিরাজের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল শওকত জংকে। তাছাড়াও সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ক্লাইভকে যুদ্ধজয়ে সাহায্য করেছিল এই ঘসেটি বেগম যার পোশাকি নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। তার পাশেই শায়িত ঘসেটি বেগমের ছোট বোন , সিরাজের মাতা, আমিনা বেগম।

এই সমাধিগুচ্ছ থেকে একটু দূরে সতেরটি সমাধি। এরা সবাই সিরাজের পরিবারের লোক যাদের এক অভিশপ্ত নৈশভোজে খাদ্যে এবং পানীয়ে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছিল মিরজাফরের পুত্র মিরান। সিংহাসনের অন্য কোনও দাবিদার থাকার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য সিরাজকে হত্যার অব্যবহিত পরেই এই নৈশভোজের আয়োজন করেছিল মিরান।একটু দূরে বাঁদিকে ফকির দানা শাহের সমাধি। পলায়নরত ক্ষুধার্ত সিরাজ ক্ষণিকের জন্য ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিল এই ফকিরের দাতব্য সরাইখানায়। কিন্তু দানা শাহ সিরাজকে চিনতে পেরে অর্থের লোভে নিদ্রিত সিরাজকে তুলে দেয় মিরকাশিম আর মিরানের হাতে। উপহারস্বরূপ এক হাজার টাকা উপহার দেওয়ার পর দানা শাহকে হত্যা করে মিরান।

এর পরে চারদিক ঘেরা কাঠের থাম এবং প্লাস্টারের ছাদবিশিষ্ট একটি হলঘরে সিরাজের সমাধি। তারই পাশে সিরাজের বিশ্বস্ত অনুচর গুলাম হোসেনের সমাধি। এই গুলাম হোসেনের সঙ্গেই পোশাক বিনিময় করে ছদ্মবেশ ধারণ করে সিরাজ। কিন্তু তার পায়ের জুতো দেখে তাকে চিনতে পেরে যায় দানা শাহ। গুলাম হোসেনের সমাধির দু’পাশে শায়িত আছে সিরাজের হারেমরক্ষক দুই খোজা। মিরান এদেরও হত্যা করেছিল।

সিরাজের নিরাভরণ সমাধির ওপর কোনও কোনও দর্শনার্থীর রাখা গোলাপ, গাঁদা বা অন্য কোনও একটি দু’টি ফুল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বোঝাই যায়না এখানেই শায়িত আছে ব্রিটিশের ত্রাস , দোর্দন্ডপ্রতাপ নবাব সিরাজদ্দৌল্লা। সিরাজের সমাধির পায়ের কাছে শায়িত তার পত্নী লুৎফুন্নিসা। তার ডানদিকে সিরাজের একসময়ের প্রেমিকা, নর্তকী এবং সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের বোন আলিয়ার সমাধি। সিরাজের মৃত্যুর পর তার মা, মাসি, স্ত্রী, কন্যা জোহরা এবং আরও কয়েকজন আত্মীয়া ও পরিচারিকাকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয় মিরান। সেখানে থেকে নৌকাবিহারের নাম করে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে কয়েকজনকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে মিরান। সিরাজের মা এবং মাসি কী ভাবে মারা যায় তা এখনও অজ্ঞাত। কিন্তু কথিত আছে সিরাজের মৃত্যুর পর মিরজাফর এবং মিরান দু’জনেই লুৎফুন্নিসার পানিপ্রার্থনা করে। পিতা এবং পুত্র দু’জনকেই প্রত্যাখ্যান করে সে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি লুৎফুন্নিসা এবং তার মেয়েকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মাসোহারা ও খোশবাগেই থাকার ব্যবস্থা করে। লুৎফুন্নিসা তার বাকি জীবনের প্রতিটি দিন সিরাজের সমাধিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মাথা ঠেকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত। এমনি ভাবে পঁচিশ বছর কাটিয়ে পতিশোকে অর্ধোন্মদিনী লুৎফুন্নিসা ১৭৯০ সালে মারা যায়। একেবারে বাঁদিকের সারির প্রথমে আলিবর্দির সমাধি।তার নিচে সিরাজের কন্যা জোহরার সমাধি। আলিবর্দির বাঁদিকের দু’টি সমাধি শওকত জং এবং তার স্ত্রী মোতি বেগমের। মিরজাফর, ঘসেটি বেগম এবং অন্যান্য চক্রান্তকারীদের উস্কানিতে শওকত জং সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সিরাজের মৃত্যুর একবছর আগে সিরাজের হাতেই নিহত হয়। এই খোশবাগেই শায়িত আছে আলিবর্দি এবং সিরাজের সমগ্র পরিবার ও পরিজন।

ভাগীরথীর অপরপ্রান্তে জাফরগঞ্জে আছে মিরজাফরের প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ। প্রবেশপথের ওপর ভাঙ্গা ফটকটিকে স্থানীয় মানুষেরা নিমকহারাম দেউড়ি বলেই ডাকে। মিরজাফরের সমাধিক্ষেত্রে টিকিট কিনে ঢুকতে হয়। মিরজাফর ছাড়াও এখানে আছে মিরকাশিম এবং মিরানের সমাধি। তাছাড়া আছে চার প্রহরী এবং হিসাব রক্ষকের সমাধি। কথিত আছে আরও অনেক নাম না জানা মানুষের সমাধির মধ্যে একটি মিরানের প্রিয় টিয়াপাখির। এই সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি বরাদ্দ এগারো টাকা অনাদিকাল থেকে এখনও পর্যন্ত চলে আসছে। হতভাগ্য রক্ষণাবেক্ষণকারীরা ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা করে সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংসার প্রতিপালন করে। শোনা যায় এরা মিরজাফরের বংশধর এবং স্থানীয় মানুষেরা এখনও তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার অভিশাপ আর কতো প্রজন্মকে বহন করতে হবে একমাত্র ভবিষ্যৎই তার উত্তর দিতে পারবে।
0

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in







তীব্র গতিতে পাথর আর লাইন পেরোতে দেখে মাথাটা ছ্যাঁৎ করে ঘুরে যায় ত্রৈলোক্যবাবুর! পিছিয়ে আসেন, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা দ্বিধায়! কিন্তু এগিয়ে যান আবার, লোকাল ট্রেনের দরজায়! সাহস করে ঝুঁকবেন বলে যখন ফের প্রস্তুত হচ্ছেন, সেইসময়েই একটা হাত এসে চেপে ধরে ওনার খাদির পাঞ্জাবীটা!

-"পড়ে যাবেন যে! নামবেন নাকি?"

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রৈলোক্যবাবু ঘাড় নেড়ে জানান "না"!

-"নামবেন না যখন, একটু সরে দাঁড়ালে ভালো হয়! আমরা এখানে একটা রীল বানাবো।"

বাধ্য ছাত্রের মত চুপচাপ দরজা থেকে সরে এসে একটা সীটে বসে পড়েন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বছর সত্তর-বাহাত্তরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহাশয় ছেলে তুষারের ফ্ল্যাটে থাকেন একমাত্র পুত্র, পুত্রবধূ রঞ্জনা ও নাতনী রাহী'র সাথে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা আসতে শুরু করে ভদ্রলোকের জীবনে। সর্বশেষ সমস্যাটা ছিল, পুত্রবধূ রঞ্জনার আধুনিক, স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন, যা খুবই "উচ্ছৃঙ্খল আর অসংযমী" মনে হয়েছিল আদর্শবান, নিয়মনিষ্ঠ একসময়ের সংষ্কৃত শিক্ষক মহাশয়ের চোখে। সেই নিয়ে বাড়িতে প্রায়শই লেগে থাকতো অশান্তি! তুষার প্রথমদিকে এই দ্বন্দ্বটাকে সামলানোর চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রঞ্জনার জেদের কাছে নতিস্বীকার করতেই হয়েছিল। কিন্তু আজ দুপুরের ঝগড়ায় যেরকম শাপ শাপান্ত, বাপ বাপান্ত চললো শ্বশুর আর বৌমার মধ্যে, তাতে ত্রৈলোক্যবাবু ঠিক করেই ফেলেছিলেন, আজ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যাই করবেন! সেইমতো সারা বিকেলটা শুনশান গঙ্গার ধারে কাটিয়ে, সন্ধ্যায় এ রাস্তা সে রাস্তা হেঁটে রাতের লোকাল ট্রেনটা ধরেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো রঞ্জনার বয়সীই আরেকটি মেয়ে! সে ত্রৈলোক্যবাবু'কে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে আধপাগলের মত হাত-পা নাড়িয়ে কিসব অঙ্গভঙ্গি করছে আর মোবাইলে তার ভিডিও করছে একটি শীর্ণকায় ছেলে! তাদের ভিডিও করা শেষ হলে মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো, "আপনাকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছে দাদু! কোথায় যাবেন?"

-জানি না মা!

-কিছু খাবেন?

-নাহ!

-চলুন, আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিই?

-না না, আমি নিজেই চলে যেতে পারবো!

এবার পাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো, "আমরা জানি, আপনি চলে যেতে পারবেন। কিন্তু আমরা যে পারবো না আপনাকে একা ছেড়ে দিতে ... "

বারকয়েকের জোরাজোরিতে শেষমেশ রাজী হতেই হল ত্রৈলোক্যবাবু'কে। ট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা ভদ্রলোক'কে নামিয়ে দিয়ে গেল ওনার বাড়ির সামনে, আর ট্যাক্সিটা ছাড়ার সময় মেয়েটি বললো, "দাদু, আমরা নতুন যুগের মানুষ! একটু আলাদা হতে পারি আপনার থেকে, কিন্তু দিনের শেষে আমরাও তো মানুষই, তাই না? ভুল বুঝবেন না! এই রইলো আমার মোবাইল নম্বর, সমস্যায় পড়লে নিজের মেয়ে মনে করে কল করবেন, চেষ্টা করবো সাধ্যমত ..."

ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে রাহী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে তার দাদু'কে। মাঝরাতের ভেপার আলোর সীমানা পেরিয়ে ট্যাক্সিটা বহু দূরে মিলিয়ে যেতেই আদুরে নাতনি ত্রৈলোক্যবাবুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,"তুমি কোথায় চলে গেছিলে দাদু? মা আর বাবা সেই সন্ধ্যে থেকে তোমায় কত খুঁজছে আর কাঁদছে!"
0

গল্প - জাকিয়া শিমু







আকাশে সুরমারঙের মেঘের দল, ছুটোছুটি ভুলে যেয়ে হঠাৎ করেই যেন দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর মেঘের বরন কালো হয়ে পাহাড়ের মতো জমাট বেঁধে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে ভাবছি-এমন ভারি মেঘে নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে পাল-পাড়ার মাঠে গোঁড়ালী-ছুঁয়া পানি জমবে। ফুটবলটি মাঠের ধারে অশথগাছের জটাতলে লুকানো আছে। কথা আছে- আকাশ কালো হতে সবাই গাছতলায় জড়ো হব! লাল-হলুদ দলের গতকালের বাকি খেলাটুকু আজ বৃষ্টির ভেতর শেষ হবে। বাকিরা হয়তো এতক্ষণে এসে গেছে! আমি মায়ের কাছ থেকে কোন ছুতু ছাতায় ছাড়া পেলে ভূদৌড়ে ছুটে যাবো মাঠে! কিন্তু মা জিগাআঠার মতো আমার গায়ে আরাম করে হেলান দিয়ে কুরুশকাঁটায় সোয়েটার বুনছেন। আমি খাঁচায়বন্দী চড়ুইয়ের মতো ছটফট করছি। এসময়ে সত্যি সত্যি আকাশ ছেড়ে মেঘেরদল ঝুমঝুম ছন্দে ঝরতে শুরু করলো আর তখনই আমার স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল!

ঘুম ভাঙ্গলেও টিনেরচালে বৃষ্টির ঝুপঝাঁপ-শব্দ আমার কানে রয়ে যায়! আমি জেগে উঠলাম নাকি এখনো স্বপ্নলোকে আছি, বুঝতে পারছি না। ঘরের এককোণায় হারিকেনের মৃদু আলো দেখি। বুঝতে পারি এখনো রাত কাটেনি কিন্তু সময় রাতের কোনভাগে বইছে, ঠাহর করতে পারি না। কান পেতে শুনি,দূরে তাঁতিপাড়ার মাকুর ছন্দধ্বনি। এরপর পাশেরবাড়ির জগা কাকার লালমুরগের ডাক। ভোরের খুব পরিচিত এসব শব্দ শেষরাতের ইশারা দেয়। আরও পরে খোলাসা হই, ও-যে টিপটপ শব্দ তা বৃষ্টি নয়, শিউলি ঝরার শব্দ। এখন আশ্বিন মাস। আমাদের ঘরঘেঁষা পুরনো শিউলিগাছের লম্বা ডাল ঘরের চালের উপর ঝুলে আছে। ডাল থেকে বোটা খসে টুপটাপ শব্দে ফুল ঝরছে টিনের চালে। এসময় আমি অধীর অপেক্ষায় থাকি; কখন বাবা জেগে উঠবেন! এবং খট আওয়াজে কপাটের খিল খুলবেন। কপাটের একপাশটা খুলতেই বাবার হাতের কনুঁয়ের ঠিক নিচ দিয়ে সচেতন পায়ে, মা জেগে উঠার আগে বাড়ির সীমানা পেড়িয়ে যাবো! বাবা মৃদু হাসবেন, ও প্রশ্রয়ের হাসি। ও হাসি আমার সারা দিনের সমস্ত দস্যিপনার আশ্রয়। আমি অনেকটা পথ দৌড়ে বাড়ির পূবদিকে বাংলাঘরের ছঞ্চাতলে খানিকক্ষণ জিরোব। তখনও ভোরের নীল আলো ঠিকঠাক ফোটে ওঠে নাই। আমাদের বাড়ি বেশ পুরনো আমলের,কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস। চার-পাঁচ পুরুষ আগে লাগানো গাছপালায় ভর্তি। রাতে এদের দিকে তাকালে ভয় ধরে যায়। মনে হয় যেন অন্ধকারের পাহাড়! বাড়ির সীমানা ছাড়াতে এক চিলতে নদী-আশ্বিন মাসের পাতলা মেঘের মতো শান্তস্নিগ্ধভাবে বয়ে চলেছে। আমি নদীপাড়ে যেয়ে থামি। অন্ধকার তার শাড়ির আঁচলের ভাঁজ পড়তে পড়তে খুলতে শুরু করে। ততক্ষণে নদীর অপরপাড়ে ঠাকুরঘরের কাছ ঘেঁসে বিশাল যে বটগাছটা আছে,তার মাথা বেধ করে লাল টকটকে গর্ভিণী গোলকাকৃতির সূর্যটা আড়মোড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। অন্ধকার পুরোপুরি বিদায় হয়। সকালের সকালের স্নিগ্ধকোমল রোদের চাদর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

নদীরপাড় ঘেঁষে সাপের দেহের মতো আঁকাবাঁকা সরু চিকন মেটেপথ। পথের দু’ধারে অসংখ্য বন-গুল্ম, ঝোপঝাড়- লতাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের গায়ের বুনোগন্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। সে হাওয়া গায়ে মেখে অচেনা একস্বপ্ন পথে আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলি। পথে বিছানো দূর্বাঘাসের গায়ে লেপটে থাকা শিশিরের আদরস্পর্শে আমার খালি পা ভিজে ওঠে। নদীর দু’পাশে জেগে উঠা চরে অসংখ্য কচুঁরীপানা আটকা পড়ে আছে। বিস্তীর্ণ তীরজুড়ে রঙের খেলা। হালকা গোলাপির মাঝে নীল আর বেগুনির বেষ্টনী মাঝখানে হলুদের ছুঁয়া- একফুলের পাঁপড়িতে এমন অসংখ্য রঙয়ের আলপনা অন্যকোনো ফুলে আছে বলে আমার জানা নেই। দু’হাত ভরে কচুরিপানা ফুল নিয়ে আমি আবার পথ ধরি।

খানিকটা পথ পেরুলে পথটাকে বাঁশে্রসাঁকো ঠিক মাঝ বরাবর চিঁড়ে আলাদা করে দিয়েছে। পথের ও-প্রান্তে যেতে হলে সাঁকো পেরুতে হবে! আমার সাঁকোতে বড্ড ভয়! একদিন সাঁকোর মাঝ বরাবর যেতে পা পিছলে ধপাস করে পানিতে পড়ে যাই। ভাগিস্য, জগাচাচা অল্পদূরে তিনকোণা জালে ইচা মাছ ধরছিলেন। আমাকে জল কাদায় মাখামাখি অবস্থায় তুলে এনে, চাচার সে কী হাসি! আমি ভয় আতঙ্কে কেঁদেকেটে অস্থির। চাচার হাসির কারণ অবশ্য অমূলক নয়। সাঁকোর নিচের জলের গভীরতা ছিল আমার শরীরে উচ্চতার অর্ধেক। আমি ভয়ে পানিতে না দাঁড়িয়ে, শুয়ে পড়ে একহাড়ি জল পেটে পুরেছি। কিন্তু সাঁকো যে আমাকে পার হতেই হবে।

আমার গন্তব্য ক্ষেত্রমোহন দাদার বাড়ি। বাবা ডাকেন ক্ষেত্রদা’। আমিও তাঁকে সে নামেই ডাকি। অবশ্য দাদার বউকে জ্যাঠি ডাকি। জেঠিকে আমার ভিন্ন জগতের মানুষ মনে হয়। আমার সাথে তার তেমন আলাপি সখ্যতা নেই, আমার ধারণা অনেকের সাথেই নেই। তিনি ভারী ব্যক্তিত্বের মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের আব্রুবেড়া ভেদ করে সংস্পর্শে আসতে পারে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। তবে আমাকে সে খুব স্নেহ মমতায় জড়িয়ে রাখেন। তা অবশ্য আমি বুঝতে পারি। আমি তাঁকে ভয় নয়, সমীহ করি। আমি আজ অবধি তার পুরো মুখখানা দেখতে পাইনি। শুভ্র সাদা জমিনে লালপেড়ে তাঁতের শাড়ির আঁচলে মাথার ঘোমটা কপাল পেরিয়ে চোখের খানিক অংশ ঢেকে থাকে। হেসে উঠলে তার পান খেয়ে লাল করা ঠোঁট দু’খানা ভারি রহস্যময় লাগে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখার চেষ্টা করি। ভাঁজপড়া কপালে লাল টকটকে চন্দনের টিপটাকে আমার কাছে চোত- মাসের পরিষ্কার আকাশে ভোরবেলার লাল টকটকে সূর্যটার মতো মনে হয়। সদ্য স্নানে লম্বা এলোমেলো চুলের গুছা আঁচল পেরিয়ে কোমরে এসে দোলে। আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। পুজোর ডালা হাতে তুলসি তলে তাঁর উলুধ্বনি আমাকে কেমন উদাস করে তোলে। সাদা ধবধবে সুতির লাল পেড়ে শাড়িতে শীর্ণ দেহটাকে কলার খোলসের মত করে ঢেকে যখন ধীর পায়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়ান,আমার মনে হয় মেঘেরদেশ থেকে নেমে আসা শরৎ মেঘেরকন্যা বুঝি মাটিতে নেমে এসেছে। আমার পাঁচ বছর বয়সের কল্পনাজল্পনার প্রায় সমস্তটাই এই মেঘকন্যাকে ঘিরে!

আমি সকাল হলে প্রায়ই এ-বাড়ি চলে আসি। বিশেষ করে হাটবার হলে তো কথাই নেই। আমার বাড়িতে আমার ঠিকঠাক স্বাধীনতা নেই। আমার মায়ের প্রায় সবকিছুতে শাসন, বাধা। আমার অমন বদ্ধ চলায় চরম অনীহা। রাতে বাড়ি ফিরে অবশ্য নিয়মমাফিক মায়ের তালপাতার পাখার প্রহার অবধারিত! ওসব উপেক্ষা করে আমি ক্ষেত্র’দা’র বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করি। বাড়ির বাইরের পথঘাট ঠিকঠাক চিনি না, তবে এবাড়ির পথ আমার জানা। বাঁশের সাঁকোর ওপারে খানিকটা পথ পেরুলে স্বর্ণলতায় জড়ানো বরই গাছটা ঘেঁষে, ডান দিকে খেতেরআল বেঁয়ে যে পথটা গিয়েছে, সেখান থেকে ক্ষেত্র’দা’র বাড়িটা স্পষ্টই দেখা যায়। বাবার সাথে সেই বুঝতে অবুঝ বেলা হতে এপথ ধরে আসা যাওয়া।

ক্ষেত্রদা’র বাড়িটি পটে আঁকা ছবির মতোন। বাড়ির তিন পাশটা জুড়ে ফসলের মাঠ, সেসব ছাড়িয়ে আরও দূরে- ধু ধু চোখে পড়ে গাছগাছড়ায় জড়িয়ে থাকা লোকালয়। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে নানান রঙবর্ণের ফসলে ভরে ওঠে মাঠগুলো। অপরপাশে ময়না পিসির বাড়ি। ময়না পিসিকে নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যথা নেই! অবশ্য ময়না পিসিও তাবৎ দুনিয়ার কিছুকে পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। একখানা পাড়বিহীন শাদা শাড়িতে নিজের শীর্ণকায়া দেহটাকে অবিন্যস্তভাবে গুঁটিয়ে রাখেন। আধঃমাথায় ঘোমটা মাঝেমধ্যে টেনে রাখলেও আব্রুসচেতনটা নিয়ে তার কোন বাড়তি আগ্রহ নেই। সারাদিন নিজের মনে বিরবির করে কথা বলেন। মেজাজের আঁচ অতি উষ্ণ। কথায় কথায় ছ্যাঁত করে উঠেন! দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতর থাকেন। পারতপক্ষে কেউ তাকে ঘাটায় না। ক্ষেত্রদাকে বলতে শুনেছি; অল্প বয়সে একমাত্র ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছেন। ছেলে লায়েক হয়ে ওপার বাংলায় চলে গিয়েছে। মা কে অবশ্য নিজের কাছে নিতে চায় কিন্তু তিনি কিছুতেই স্বামীভিটে ছেড়ে যাবেন না। স্বামীর ভিটে থেকে সরাসরি চিতেয় যাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। ক্ষেত্রদা’র কাছের স্বজন, তিনিই তাকে দেখাশুনা করেন। আমি খুব প্রয়োজন না হলে তার সীমানায় ঘেঁষি না। তবে ময়না পিসির ভিটেয় একটি কাঁচামিঠে বরই গাছ আছে। গাছেরতলা বিছিয়ে থাকে ঝরা-বরই। মাঝেমধ্যে লোভ সামলে উঠতে না পেরে সুযোগ বুঝে বরইতলায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। আর তার চোখে পড়লে রক্ষা নেই, মরা চিৎকার জুড়ে দেন! কী নাকি জাতপাত চলে যায়! আমি মুসলিম, সে সনাতন। আবার ক্ষেত্রদা’, জেঠি এরাও সনাতন। এদের জাতে ঘা না লাগলেও ময়না পিসির জাত যায়। এতসব জটিল কথা বুঝি না, আমি দ্রুত তার উঠোন থেকে পালিয়ে আসি!

ক্ষেত্রদা’ আমাকে তাঁর মেয়ের মতো ভালোবাসেন। তাঁর বাড়িটা আমার নিজের বাড়ির চেয়ে আপন মনে হয়। এখানে আমার স্বাধীনতার ঘাটতি নেই। যা খুশি তাই আবদার চলে। এবাড়িতে সুখের কোন অভাব নেই। তবে বিশেষ একটি দিনে এ-বাড়ির চালচিত্র একদমই মরাবাড়ির মতো হয়ে যায়! সেইদিনে,কালিপদ পোষ্ট মাষ্টার একটা ঝুলি কাঁধে নিয়ে ‘ক্ষেত্রমোহন মহাশয় বাড়ি আছেন’-বলে দরাজ গলায় হাঁক তুলেন। ক্ষেত্রদা’ হয়তো তুলসিতলা ঘেঁষে যে পড়ো-ভিটেটি পড়ে আছে,সেখানে বসে নির্ভারে হুক্কা টানছেন। এবং আমি তাঁর পাশে বসে খড়ি দিয়ে মাটিতে আঁকাঝুঁকি করছি। কালিপদ’র হাঁক শুনে ক্ষেত্রদা’র কুচকুঁচে চেহারায় আরেক প্রস্ত কৃষ্ণবর্ণের প্রলেপ পড়ে। হুঁকা থেকে মুখ তুলে নিয়ে আমাকে চোখের ইশারায় কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের কাছে যেতে বলেন।

আমি হাতের খড়ি ছুঁড়ে ফেলে, এক লাফে কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের সামনে যেয়ে দাঁড়াই। কালিপদ তাঁর কাঁধে ঝুলানো লম্বা খাকি রঙয়ের ঝুলা হতে অনেকগুলো নীল খামের ভিতর থেকে একটা নির্দিষ্ট খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ময়না পিসির উঠোন দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়! জেঠি হয়তো রান্নাঘরে মাটির হাঁড়িতে উপচে পড়া ভাতের ফেনা সামলে উঠতে ব্যস্ত। সেকাজ ফেলে হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকেন, যাতে খামটা দাদার হাতে না পড়ে। আমি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে হাত বাড়িয়ে নীলখামটা জেঠির হাতে দিয়ে ভুদৌড়ে শূন্যভিটেয় ক্ষেত্রদা’র গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু পরিচিত সেই ক্ষেত্রদা’কে আর খুঁজে পাই না। তিনি বিমর্ষ মুখে চুপচাপ বসে থাকেন! সারাদিনে মুখে আর বাক্য ফুটে না! জেঠিও মুখ গোমরা করে থাকেন। ক্ষেত্রদাকে উদ্দেশ্য করে নিজের মনে কথা বলেন! এসময়ে ময়না পিসি ক্ষেত্রদা’র দলে ভিড়েন। ময়না পিসির ছেলের সাথে ক্ষেত্রদা’র দু’ছেলেও চলে গেছেন ওপার বাংলায়। ক্ষেত্রদা’ ভুলেও তাদের নাম মুখে আনেন না। এরপর জেঠির চাপাচাপিতে সন্ধ্যা নামলে ক্ষেত্রদা’ তাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসেন। আমার বাবা গম্ভীর হয়ে নীল খামের ভেতর থেকে পত্র বের করে তাদের পড়ে শুনান। ক্ষেত্রদা’ হু হু করে কেঁদে ওঠেন। পত্রের ভারি কথাগুলো আমার বোধগম্য হয় না যদিও এসময় আমি ক্ষেত্রদা’র গা লেপটে পোষা বিড়ালের মতো বসে থাকি।

ক্ষেত্রদা’র বাড়ির দক্ষিণদিকে দমকলের পানি, নালার পথ ধরে ছুটে যায়, দূর ধানক্ষেতের মাঠে। নালার জল কুচকুচে কালো কিন্তু পরিষ্কার। আমি নালারপাড়ে দু’পা ঝুলিয়ে গোঁড়ালী জলে ভিজিয়ে বসে থাকি। দত্তপাড়ার বউ-ঝিরা এসময় সংসারের যাবতীয় বাসি কাপড়,বাসন কোসন পরিষ্কার করতে নালের পাশে ভিড় করে। এবং নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প পাতে। আমি সেসব গল্পে কান পাতি। ওসব গল্পের পুরোটাজুড়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের কষ্টের কথা থাকে। এপার বাংলা ছেড়ে, যারা ওপার বাংলায় গিয়েছে তাদের বিভিন্ন দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভরে এসব আপনজনের কাছে নীলখামে চিঠি আসে। ক্ষেত্রদা’র মতো চিঠি পেয়ে এরাও ফুঁপিয়ে কাঁদে। একসময় এরা একে একে গোপনে বাড়িঘর বেচাবিক্রি করে নিজদেশ ছেড়ে ওপারবাংলায় চলে যায়। কেনো চলে যায় কিংবা কীসের বেদানায় কাঁদে আমি তখনো এসবের কিছুই বুঝি না তারপরও ওদের কষ্টে আমার বুকটা ভার হয়ে আসে।

ওদিকে ক্ষেত্রদা’র বেলা বয়ে যায়। আজ হাটবার। হুঁকায় গুটিকয় টান দিয়ে আমাকে নালার পানি ছেড়ে উঠে আসতে তাগাদা দেন। আমি ফিরে এসে সকালের নরম রোদমাখা শূূন্যভিটেয় শীতলপাটির বিছানায় জোড়াসনে বসে পড়ি। ক্ষেত্রদা’র বাড়িতে বছরজুড়ে নাড়ুমুড়ির আয়োজন। পূজাপার্বণে অবশ্য পদের সংখ্যা ঢের বেশি থাকে। দুধের ক্ষীর দিয়ে বানানো নারিকেলের নাড়ুর সাথে বাড়িতে ভাঁজা কালিকোড়া চালের মুড়ি অমৃতসম। জেঠি বাঁশের সাজিতে মুড়ির ঠিক মাঝখানে নানান পদের নাড়ু সাঁজিয়ে আমাদের সামনে রাখেন। ক্ষেত্রদা’ আমাকে তাড়া দেন, সবজি তুলতে বেলা বয়ে যায়- হাটবার বলে কথা। কিন্তু ওরকম স্বাদের পদ রেখে উঠতে আমার বড্ড দেরি হয়ে যায়। একসময় ক্ষেত্রদা’ চাঙ্গাড়ি কাঁধে নিয়ে ভিটের পথে হাঁটতে শুরু করলে আমি বাকি নাড়ুমুড়ি কুঁচরে পুরে তাঁর হেঁটে যাওয়া পথে ছুটে যাই।

ক্ষেত্রদা’র ভিটেয়, জমি থেকে ঈষৎ উঁচু জায়গা বলে সবসময় আগাম ফসলে ভরে থাকে। শীতেরসবজি শীত না আসতে ভিটেয় উপচে পড়ছে। মূলা,ধনেপাতা,ঢেড়স,পেঁয়াজ- কাঁচা মরিচ, লাউ- কুমড়ো কী নেই তাতে ! কাঁচা সতেজ সবজির গা জুড়ে শিশির বিন্দু নরম রোদের আঁচড়ে ঝিলমিল করছে। আমি ভিটেয় ফিরে কুমড়ো মাচায় এগিয়ে যাই। কুমড়ো ফুল তুলে নিতে। মটর ডালের সাথে আতপ চালের গুঁড়ায় সামান্য হলুদ আর কাঁচা মরিচে অমৃত স্বাদের কুমড়ো বড়ার স্বাদের তুলনা হয় না। মাচা ভর্তি হলুদ কুমড়ো ফুল, মৌমাছিরা মনের আনন্দে হেসে খেলে মধু নিয়ে ছুটছে। ক্ষেত্রদা’র ভিটে ঘেঁসে ডোবা। ডোবা ভর্তি স্বচ্ছ কালো জল। ডোবায় কচুরিপানা দিয়ে ডিবির মতো উঁচু করে ভেলা বানিয়েছেন। কচুরির ছোবার পুঁটুলি বানিয়ে তাতে লাউয়ের বীজ কৌশলে ঢুকিয়ে দিলে কয়েকদিন না যেতে চারাগাছ শিকড় ছেড়ে ছোবার পুঁটুলি ভেদ করে বেরিয়ে আসে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার আগেই লাউগাছে ছেয়ে যায় ভেলা। তার কিছুকাল পরে লাউয়ে লাউয়ে ভেলা ভরে ওঠে! কী মনোরম সে দৃশ্য! আমি ভিটেয় বসে পা জলে ভিজিয়ে ক্ষেত্রদা’র এসব ছইয়ালি কাজ খুব পরখ করে দেখি। ওদিকে ক্ষেত্রদা’র চাঙ্গাড়ি ভরে উঠে হাটে বেচার শাকসবজিতে।

আমরা সবজি নিয়ে ফিরতে জেঠির ব্যস্ততা বাড়ে। মাটির হাঁড়িতে ধোঁয়া উঠা খুদের ভাতের ভেতর থেকে সেদ্ধ বন শিম,আলু বের করতে ক্ষেত্রদা’ তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাঁক দেয়- বেলা গেলো বলে! জেঠি, এক হাতে পেয়াজের খোসা ছাড়েন, অন্য হাতে শুকনো মরিচে জলন্ত ছাই ঢালেন। গরম ছাই এর ভেতর থেকে বিশেষ কৌশলে পোড়া মরিচ বের করে এনে পেয়াজ,ধনেপাতার সাথে ঘানী ভাঙ্গানো সরিষার তেল মাখেন। ততক্ষণে সাদাবেগুন পোড়ার গন্ধ বেরোয় মাটির চুলা থেকে। আলুমাখায় ঘিয়ের মিশ্রন দাদার খুব প্রিয়। জেঠি শিকেয় তুলে রাখা বয়াম থেকে কয়েক ফোঁটা খাঁটি গাওয়া ঘি সাবধানী হাতে মিশিয়ে দেন আলুমাখায়। গতদিনের শিংমাছের ডিম আলাদা করে খোলা বারান্দায় আড়ার সাথে শিকেয় রাতভর ঝুলানো ছিল। সামান্য লবণ আর হলুদ মেখে কচি লাউয়ের পাতায় মুড়ে রান্না শেষে জ্বলন্ত চুলার ছাইয়ের তলায় এরই মাঝে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। তা না হলে যে ক্ষেত্রদা’ চটবেন! গতকাল ডিমওয়ালা শিং এনে জেঠিকে স্মরণ করিয়েছে যে! জেঠি চটজলদি পাতাসহ মাছের ডিমের সাথে সরিষার তেল, মরিচ-পেঁয়াজ ডলে অমৃত বানিয়ে গরম ভাতে ছড়িয়ে দেন। আমরা আমরা একনিমিষে পরম তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে শেষ করি।

“হাটে ছেলে ধরা আছে’। আর সামান্য বড় হলে তবেই আমাকে সাথে নেওয়া হবে”! হাটবার এলেই ক্ষেত্রদা’র এই আশ্বাস-অজুহাত! পরের সপ্তাহের জন্য আমি অধীর অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু পরের সপ্তাহেও আমি উপযুক্ত বড় হই না। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকি উঠোনের পাশে তুলসী তলায়। ক্ষেত্রদা’ আমাকে আদর করে জেঠি- মা ডাকেন। কিন্তু আমি যদি অতিরিক্ত জ্বালাতন করি,তখন খুকি বলে ডাকে! তবে আমাকে একবার খুকি ডাকা মানে তাঁর সারাদিন বিষিয়ে ফেলা! মুখ ফুলিয়ে বসে থাকি এবং সবরকম কথা বন্ধ! আমার ধারণা খুকি নামটা তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে- ইচ্ছে করে এমন যন্ত্রণা কে কাঁধে নেয়! এরপর সে আমার মান ভাঙ্গাতে কত কী যে করে! ওদিকে হাটের বেলা বয়ে যায়। ক্ষেত্রদা’ ব্যর্থ হয়ে জেঠিকে পাঠায়, আমি স্থানু হয়ে বসে থাকি তুলসীতলে। ওদিকে জোর হাতে ক্ষেত্রদা’ আমার কাছ ঘেঁষে বসে থাকে। আমাদের এমন মান-অভিমান খেলায় জেঠি ভীষণ মজা পান। তিনি পান খাওয়া রক্ত জবার মতো ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে ধরে- আমার পক্ষ হয়ে ক্ষেত্রদাকে ভৎসনা করেন। ওদিকে বেলা বাড়তে থাকে। ক্ষেত্রদা’ মাফ পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে-ই থাকে! শেষমেশ অবশ্য আমিই জিতে যাই। মণ্ডা মিঠাই, বিন্নি বাতাসা আর মণ্ডলের দোকানের ফুলরি আমার খুব পছন্দের ফর্দ তাঁকে ধরিয়ে দিয়ে সে যাত্রায় মাফ করে দিই। এবং ক্ষেত্রদা’ ধবধবে সাদা ধুতির উপর হালকা নীল রঙয়ের পাঞ্জাবি গায়ে জড়াতে জড়াতে হাটের পথে দ্রুত পা বাড়ান।

বেশকিছুদিন ধরে কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের আনাগোনা বড্ড বেড়ে যায়। নীল খামের চিঠিগুলোর ভারে ক্ষেত্রদা’ আজকাল অতিরিক্ত বিমর্ষ থাকেন। তুলসিতলার কাছে উঠোনে পা মাথা নিচু করে বসে থাকেন। আমি তাঁকে তাড়া দিই- নামার বিলে শালুক তুলতে যাবো বলে। কিন্তু সে নড়ে না ঠায় বসেই থাকে। জেঠি ক্ষেত্রদা’কে খুব ভালোবাসেন। সে-ও তাঁর পাশে চুপচাপ বসে থাকে। পাল পাড়ার রণজিৎ পাল,ক্ষেত্রদা’র খুব কাছের বন্ধু। তিনি তাঁর বাড়ির পরে এলে তাঁকে ধরে হাঁউমাঁউ করে মরা কান্না জুরে দেন। সময় সময় আমাকে ধরেও ঢুকরে কেঁদে ওঠেন। জেঠিকে আমি আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি। সেই জেঠিও তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে কাঁদেন। ময়না পিসির বিরবির করে কথা বলার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে ক্ষেত্রদা’র বাড়ির স্বাভাবিক চিত্র খুব দ্রুত বদলে যায়! আমি এসবের রহস্য ভেদ করতে পারি না। কিন্তু কষ্টে আমার বুকটা ভেঙ্গে যায়! প্রচণ্ড রাগ হয়, কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের উপর। নীল খামের ভেতর ভাঁজ করা কাগজটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে ইচ্ছে হয়।

একদিন ভর সন্ধ্যায়, জেঠিসহ ক্ষেত্রদা’ আমাদের বাড়ি এসে খুব কান্নাকাটি করেন! আমাকে জড়িয়ে ধরে বেহুঁশে মতো হয়ে যান। বাবা তাঁকে বুঝান, কীসের যেন প্রতিশ্রুতি দেন! এরপরও ক্ষেত্রদা’ কাঁদেন কিন্তু গলা ছেড়ে নয়। কী যেন সবাই লুকায় কিন্তু ওটুকু বয়সে আমি টের পাই না! তবে তাঁর বুকের ভেতর কষ্টের পাহাড় সেটা বুঝতে পারি! বিদায় বেলায় আমাকে বললেন, দিন কয়েকের জন্য বেড়াতে যাবেন এবং ফিরে এসে আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবেন। খালি বাড়িতে যাতে না যাই।

এরপর দিন যায়, মাসও কেটে গেল কিন্তু ক্ষেত্রদা ফিরে আসল না! আমি অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হই। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। আমি স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলে যাই কিন্তু মন পড়ে থাকে ক্ষেত্রদা’র বাড়ি- দাদা, জেঠির কাছে। কিন্তু ক্ষেত্র দা’ আর ফিরলেন না! আমি হাঁপিয়ে ওঠি। আমার ভেতর ভয়ংকর ভাঙ্গাগড়া চলে। আমার প্রচণ্ড জ্বর হয়। জ্বরের ঘোরে আমি ক্ষেত্রদা’ বলে চিৎকার করি। আমাকে নিয়ে আমার বাড়ির মানুষ অস্থির হয়। ডা.আমাকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হয়। এতকিছুর পরও ক্ষেত্রদা’রা ফিরে আসে না!

একদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে খুব ভোরবেলায় অন্ধকারে পালিয়ে ক্ষেত্রদা’র বাড়ি যাই। কিন্তু বাড়ির সামনে যেয়ে থমকে দাঁড়াই! এই যে এক ভিন্ন জায়গা! ক্ষেত্রদা’র বাড়ির সাথে এর ছিটেফোঁটা মিল নেই! আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। তখন অন্ধকার কেটে সূর্য প্রায় উঠো উঠো করছে। আমার ভ্রম হয়। সংশয় হয়, ভুল করে ভিন্ন বাড়ি চলে এসেছি না তো! কিন্তু না,সবই ঠিক আছে কিন্তু বাড়িটি যে এর পূর্বের বাড়িটি নেই! জেঠির সেই লেপাপোছা ধবধবে শাদা মাটির ঘরটি নেই, আধঃখোলা রান্নাঘর সেটাও নেই,পড়ো ভিটেটি সেও উধাও! বাড়িটির সমস্ত ভিটেগুলো গুঁড়িয়ে সমান করা হয়েছে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে উঁচু করে ইট-বালু স্তুপ পালা দেওয়া! ইট কাটের দালান উঠবে হয়তো। আমি প্রচণ্ড বিমর্ষ হয়ে পড়ি। শরীরটা অবসন্ন লাগে! অনেকটা জোর করে অবশ-পায়ে তুলসীতলার দিকে এগিয়ে যাই। তুলসী গাছের কোন অস্তিত্ব নেই, মরে পচে মাটির সাথে মিশে গেছে! ঘন সবুজ শ্যাওলায় ঢেকে আছে গোবরে লেপা জেঠির সেই তুলসীতলা! ময়না পিসির ঘরটায় একটি নতুন তালা ঝুলছে! অর্থাৎ মালিক বদল হয়েছে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে! বুকেরপাঁজর দুমড়ে মুচড়ে বের হয়ে যাবে মনে হয়! শরীরটা অবশ হতে হতে, চোখদুটো আলগোছে মুদে আসে! এরপর আমি অসীম শূন্যতায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকি! তারপরের কিছু মনে নেই। একটা সময় পর হুঁশ ফেরে। চোখ মেলে দেখি, আকাশ ভরা মেঘ! আমি মেঘের উপর ভাসছি! হঠাৎ মেঘের ফাঁকে চোখ পড়তে চমকে উঠি! দেখি - দূরে আকাশের পরে ক্ষেত্রদা’র বাড়িটি ভাসছে! আমি দু’হাত মেলে উড়ে সেই বাড়ির পথে এগিয়ে যাই!
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in





ঈশ্বর যাদের ভাত বরাদ্দ করেনি
ঈশ্বরে গভীর আস্থা তাদের।

ক্ষিদে নত হতে শেখায়।

আস্থার পরাকাষ্ঠা মানুষগুলো
অলৌকিকের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি করে।

0

কবিতা - শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in






হিজল কাশের দেশে একদিন গিয়েছি বেড়াতে
সবুজ সুপুরি ক্ষেতে জোলো হাওয়া
উদার আকাশ জুড়ে তারাদের দিয়েছে প্রশ্বাস
ধূসর জগত থেকে জেগে ওঠে স্টিমারের সুর
গোয়ালন্দ কতদূর, গোয়ালন্দ আর কত দূর...

কেন এত ব্যবধান ভাটিয়ালী বাউলের মাঝে ?
এপারে ওপারে ব্যথা
এপারে ওপারে কান্না
এপারে ওপারে বাঁশি একই কথা বলে
গোয়ালন্দ আমাদের ধূসর জগত
গোয়ালন্দ একদিন ছিল ।

হিজল কাশের দেশে ফের আমি গিয়েছি বেড়াতে
সবুজ গ্রামের সীমা পার হয়ে ঝকমকে শহরের পথে
উদার আকাশ জুড়ে আজও তারা ফোটে
মেছুয়া মাঝির দল আজও সেই এক সুর বুকে নিয়ে
ভেসে যায় জোয়ারের বুকে
তিরতিরে জোলো হাওয়া আজও ঠিকই বয়
ফিসফিস বলে যায় –
দূরে নয়, গোয়ালন্দ বেশী দূরে নয়...

2

কবিতা - ঝানকু সেনগুপ্ত

Posted in







একটা নদী বুড়ো হলে
পাল্টে যেতে পারে তার বোধ
জেগে উঠতে পারে উচ্চারণের বহুত্ব

একটা নদী বুড়ো হলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in







কুমড়ো পাতার শুক্তো

তেতো ছাড়া শুক্তো করতে হলে এটি বানানো যেতেই পারে। এই শুক্তো বানাতে উপকরণও বেশী কিছু প্রয়োজন নেই। বেশ অনেক গুলি কুমড়ো পাতা, আঁশ ছাড়িয়ে, কুচিয়ে রাখতে হবে। আদা, রাঁধুনি ও সামান‍্য ধনে একসঙ্গে বেটে একটি মশলা তৈরী করে নিতে হবে। সামান‍্য সর্ষে বেটে রাখতে হবে। রাঙালু বা কুমড়ো টুকরো করে কেটে নিতে হবে।

তেল গরম করে বড়ি ভেজে উঠিয়ে রাখতে হবে। সামান‍্য সর্ষে ফোড়ন দিয়ে ওইটুকরো করা সব্জিগুলি দিয়ে ভাজতে হবে। সামান‍্য নুন হলুদ দিয়ে রান্না করতে হবে। মিনিট পাঁচেক পর প্রথমে ওই মশলাটা দিয়ে মিনিট খানেক ভেজে, কুচিয়ে রাখা কুমড়ো পাতাগুলি দিয়ে আঁচ কমিয়ে রান্না করতে হবে। পাতা থেকে জল বের হয়ে সেই জলেই রান্না হবে। পাতা সেদ্ধ হয়ে গেলে সর্ষেবাটা ও বড়ি দিয়ে আরোও একটু সময়ে রান্না করে নামাতে হবে।

রাঙালু বা কুমড়ো দিলে চিনি দেবার প্রয়োজন হয় না। তবে, সেই ধরণের সব্জি না থাকলে আলু ব‍্যবহার করা যেতে পারে বা কোনো সব্জি ছাড়াও পাতা রান্না করা যাবে। সর্ষেবাটা না দিলেও চলে। নুন একটু কম হাতে দেওয়াই ভালো।




0

সম্পাদকীয়

Posted in






বিচারের আশায় ইতিমধ্যে দু'মাস অতিক্রান্ত। প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রিতার যাবতীয় আয়োজন চূড়ান্ত হয়েছে নিয়ম মেনেই। প্রাথমিকভাবে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্বে যাঁদের থাকার কথা ছিল, অনেক আগেই তাঁরা নিজগুণে নিষ্কৃতিলাভ করেছেন। এখন দোষারোপ এবং পাল্টা দোষারোপের খেলা চলছে। অবশ্য আগেই বলা হয়েছিল, 'খেলা হবে'। সে প্রতিশ্রুতির অন্যথা হয়নি।

মুশকিল হল কয়েকটি অবাধ্য ছেলেমেয়েকে নিয়ে। যারা প্রশাসনিক রদবদল এবং আরও কিছু অস্বস্তিকর দাবিদাওয়া নিয়ে আজ দু'সপ্তাহব্যাপী অনশনে। অনেক বিদ্রূপ, প্রলোভন এবং চাপের মুখেও এরা অনড়। অনমনীয়। এদের মূল শক্তি তারুণ্য এবং আদর্শবোধ। যার ভিত্তি নিশ্চিতভাবেই এক ধরনের মূল্যবোধের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা।

এমন দৃশ্য এ রাজ্য তো বটেই, এ দেশও দেখেনি কখনও। জটিল রাজনীতির আবহে এবং আবর্তে ভবিষ্যতে এই আন্দোলনের অভিমুখ কী হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। তবু টগবগে এই ছেলেমেয়েগুলি যে নতুন করে আমাদের ভাবতে শেখালো, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। মেকি অনেক সম্পর্কের খোলস খসে গেল দমকা এই হাওয়ায়। আগলহীন হয়ে পড়ল দম্ভের অট্টালিকাগুলি।

সুস্থ থাকুন। মননে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।