0
undefined undefined undefined

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in







তীব্র গতিতে পাথর আর লাইন পেরোতে দেখে মাথাটা ছ্যাঁৎ করে ঘুরে যায় ত্রৈলোক্যবাবুর! পিছিয়ে আসেন, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা দ্বিধায়! কিন্তু এগিয়ে যান আবার, লোকাল ট্রেনের দরজায়! সাহস করে ঝুঁকবেন বলে যখন ফের প্রস্তুত হচ্ছেন, সেইসময়েই একটা হাত এসে চেপে ধরে ওনার খাদির পাঞ্জাবীটা!

-"পড়ে যাবেন যে! নামবেন নাকি?"

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রৈলোক্যবাবু ঘাড় নেড়ে জানান "না"!

-"নামবেন না যখন, একটু সরে দাঁড়ালে ভালো হয়! আমরা এখানে একটা রীল বানাবো।"

বাধ্য ছাত্রের মত চুপচাপ দরজা থেকে সরে এসে একটা সীটে বসে পড়েন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বছর সত্তর-বাহাত্তরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহাশয় ছেলে তুষারের ফ্ল্যাটে থাকেন একমাত্র পুত্র, পুত্রবধূ রঞ্জনা ও নাতনী রাহী'র সাথে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা আসতে শুরু করে ভদ্রলোকের জীবনে। সর্বশেষ সমস্যাটা ছিল, পুত্রবধূ রঞ্জনার আধুনিক, স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন, যা খুবই "উচ্ছৃঙ্খল আর অসংযমী" মনে হয়েছিল আদর্শবান, নিয়মনিষ্ঠ একসময়ের সংষ্কৃত শিক্ষক মহাশয়ের চোখে। সেই নিয়ে বাড়িতে প্রায়শই লেগে থাকতো অশান্তি! তুষার প্রথমদিকে এই দ্বন্দ্বটাকে সামলানোর চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রঞ্জনার জেদের কাছে নতিস্বীকার করতেই হয়েছিল। কিন্তু আজ দুপুরের ঝগড়ায় যেরকম শাপ শাপান্ত, বাপ বাপান্ত চললো শ্বশুর আর বৌমার মধ্যে, তাতে ত্রৈলোক্যবাবু ঠিক করেই ফেলেছিলেন, আজ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যাই করবেন! সেইমতো সারা বিকেলটা শুনশান গঙ্গার ধারে কাটিয়ে, সন্ধ্যায় এ রাস্তা সে রাস্তা হেঁটে রাতের লোকাল ট্রেনটা ধরেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো রঞ্জনার বয়সীই আরেকটি মেয়ে! সে ত্রৈলোক্যবাবু'কে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে আধপাগলের মত হাত-পা নাড়িয়ে কিসব অঙ্গভঙ্গি করছে আর মোবাইলে তার ভিডিও করছে একটি শীর্ণকায় ছেলে! তাদের ভিডিও করা শেষ হলে মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো, "আপনাকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছে দাদু! কোথায় যাবেন?"

-জানি না মা!

-কিছু খাবেন?

-নাহ!

-চলুন, আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিই?

-না না, আমি নিজেই চলে যেতে পারবো!

এবার পাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো, "আমরা জানি, আপনি চলে যেতে পারবেন। কিন্তু আমরা যে পারবো না আপনাকে একা ছেড়ে দিতে ... "

বারকয়েকের জোরাজোরিতে শেষমেশ রাজী হতেই হল ত্রৈলোক্যবাবু'কে। ট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা ভদ্রলোক'কে নামিয়ে দিয়ে গেল ওনার বাড়ির সামনে, আর ট্যাক্সিটা ছাড়ার সময় মেয়েটি বললো, "দাদু, আমরা নতুন যুগের মানুষ! একটু আলাদা হতে পারি আপনার থেকে, কিন্তু দিনের শেষে আমরাও তো মানুষই, তাই না? ভুল বুঝবেন না! এই রইলো আমার মোবাইল নম্বর, সমস্যায় পড়লে নিজের মেয়ে মনে করে কল করবেন, চেষ্টা করবো সাধ্যমত ..."

ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে রাহী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে তার দাদু'কে। মাঝরাতের ভেপার আলোর সীমানা পেরিয়ে ট্যাক্সিটা বহু দূরে মিলিয়ে যেতেই আদুরে নাতনি ত্রৈলোক্যবাবুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,"তুমি কোথায় চলে গেছিলে দাদু? মা আর বাবা সেই সন্ধ্যে থেকে তোমায় কত খুঁজছে আর কাঁদছে!"

0 comments: