1
undefined undefined undefined

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৯ পর্ব

ব্রিটিশদের লুন্ঠন এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

ব্রিটিশের এই লুণ্ঠন চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। ঐতিহাসিকেরা বলেন ১৭৫৭ থেকে ১৮১৫ সাল (পলাশি থেকে ওয়াটারলু) পর্যন্ত লুন্ঠনের পরিমাণ তখনকার হিসাবে প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড যার আজকের হিসাবে অর্থমূল্য ২২৫০০ কোটি পাউন্ড অথবা কুড়িলক্ষ কোটি টাকা!! (তথ্যসূত্র পি জে মার্শাল রচিত প্রবলেমস অফ এম্পায়ার –ব্রিটেন এন্ড ইন্ডিয়া-১৭৫৭-১৮১৭)। ঈশ্বরপ্রেরিত এই সম্পদে একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠলো ব্রিটেন।বাংলার শরীর থেকে নির্গত রক্তের রঙ লাল থেকে সাদা হয়ে প্রবাহিত হতে থাকলো ব্রিটেনের দিকে বছরের পর বছর ধরে। ইতিমধ্যে ১৭৬৯-৭০ এ প্রকৃতি বাধ সাধলো।বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সে বছর ধান এবং অন্যান্য শস্যের ফলন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। চাষীদের ঘরে হাহাকার উঠলো। নদীয়ার উত্তর থেকে বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় শস্যহীন হয়ে পড়লো। ভারতীয় এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা যারা আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল যে শস্যাভাবে এবং খাদ্যাভাবে ধুঁকতে শুরু করবে বাংলা এবং বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তারা আগেভাগে ধান এবং শস্য কমদামে কিনে গুদামে মজুত করে রাখলো। এই রক্তচোষা মজুতদারেরা বারে বারে দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মুনাফার পাহাড় বানিয়েছে। পরে সেই মজুত করা শস্য দ্বিগুন তিনগুন দামে বিক্রি করতো এই মজুতদারেরা। ১৭৭০ সালের গ্রীষ্মে অবস্থা চরমে উঠলো। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারা যেতে শুরু করলো। নিরুপায় মানুষ তাদের গরু ছাগল, চাষের সরঞ্জাম দুমুঠো ভাতের জন্য জলের দরে বিক্রি করে দিল মজুতদারদের কাছে। নিজেরা বাঁচার জন্য নিজের ছেলে মেয়েদের বিক্রি করে দিতে লাগলো মানুষ। অবশেষে যখন আর ছেলে মেয়ে বিক্রি করার জন্য খদ্দের পাওয়া গেলনা তখন গাছের পাতা চিবিয়ে খেতে শুরু করেছিল মানুষ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। মানুষের মৃতদেহ শিয়াল কুকুরের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিল মানুষ। ত্রিশলক্ষ দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে দশলক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল কয়েকমাসে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে এই ভয়ঙ্কর সময়ে কোম্পানি ডিরেক্টররা প্রশাসনের কাছে কম খাজনা আদায়ের জন্য কৈফিয়ত চেয়ে চিঠি পাঠালো । সেইসময় খাজনা আদায়ের প্রধান আধিকারিক ওয়ারেন হেস্টিংস যে পরবর্তীকালে ১৭৭৩ সালে বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে আসীন হয়েছিল সে নিশ্চিত করেছিল যে খাজনা আদায়ের পরিমাণ তার আগের বছরের চেয়ে যেন কম না হয়। কিছু কিছু জেলায় আদায়ের পরিমাণ কম হলেও মোট আদায়ের পরিমাণ একই ছিল বলে জানা যায়। ত্রাণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে খরচের পরিমাণ ছিল ৯০০০ পাউন্ড অর্থাৎ আজরের হিসাবে কুড়িলক্ষ পাউন্ড অথবা ১৮ কোটি টাকা।

মিরকাশিমের হাতে জগতশেঠ মাধবরাই আর তার ভাইপো মহারাজ স্বরূপচাঁদ নিহত হবার পর জগৎশেঠেরা আর তাদের হৃতগৌরব ফিরে পায়নি। মাধবরাই এর বংশধরেরা আরও বেশ কিছুদিন ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল। এমনকি ১৭৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ধারও নিয়েছিল। সম্পর্ক আরও কিছুদিন চলেছিল যদিও স্পষ্টতই জগৎশেঠেদের ব্যবসা পরিকল্পিত ভাবেই ব্রিটিশরা খতম করে দিচ্ছিল। পলাশি পরবর্তী সময়ে কোম্পানির আর্থিক উন্নতি এমন পর্যায় গিয়ে পৌঁছোয় যে ইউরোপ থেকে বুলিয়ন নিয়ে আসার আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। জগৎশেঠেরা এই সুবিধা ছাড়তে চাইছিল না। ১৭৫৮ সালে কাউন্সিল অফ কলকাতা মোগলরাজের কাছে নালিশ করলো যে তাদের ট্যাঁকশাল ব্যবসার জন্য আর কোনও কাজে লাগছে না। এর প্রথম কারণ ইউরোপ থেকে কোনও বুলিয়ন আসছে না। দ্বিতীয়ত জগৎশেঠেদের কাছে সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যবসায় বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য সিক্কার বিনিময়মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভ নিজে ১৭৭৩৪ টাকা খরচ করে হীরা -জহরতসহ প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে জগতশেঠকে অ্যাপ্যায়িত করেও কোনও কাজ হয়নি। অবশেষে ১৭৬০ সালে ট্যাঁকশাল হস্তান্তরের আদেশনামার সর্ত্তে মিরকাশিমকে মিরজাফরের ওপরে বসাল ব্রিটিশরা। সেই দিন থেকে মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশালের পতন শুরু হল এবং কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল ট্যাঁকশাল। তার সঙ্গে সঙ্গেই জগৎশেঠেদের সৌভাগ্যসূর্য অস্তমিত হয়ে গেল ভাগীরথীর জলে। কোম্পানি আর ব্রিটিশদের সৌভাগ্যসূর্য বিরাজ করতে শুরু করলো মধ্যগগনে। ট্যাঁকশালের ওপর জগৎশেঠেদের একাধিপত্য বিলুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস সিদ্ধান্ত নিল যে সরকার যে টাকা জগৎশেঠেদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বলা হলো- যে পরিবার কোম্পানির উন্নতির জন্য এত সাহায্য করেছে তাদের রক্ষার দায়িত্ব কোম্পানির কর্তব্য। অনতিবিলম্বেই ব্রিটিশ ব্যবাসায়ীরা এজেন্সি হাউস তৈরি করে অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় নেমে পড়লো। ইউরোপিয়ন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রমবর্ধমান পুঁজি সঞ্চিত রাখার জন্য নিরাপদ ব্যাঙ্কিং এজেন্সির সন্ধানে ছিল এতদিন। নতুন এজেন্সি হাউস ব্যবসায়ীদের পুঁজির টাকা গচ্ছিত রেখে ধার দেবার কারবার শুরু করলো। ১৭৭০ সালে তৈরি হলো পশ্চিমি কায়দায় তৈরি নতুন ব্যাঙ্ক –ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্তান। অবশেষে ১৭৯৯ সালে ট্যাঁকশালের যন্ত্রপাতি এবং বাড়ি নিলাম করে দেওয়া হলো। জগৎশেঠেদের বিপুল সম্পত্তির এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ এখনও আছে মুর্শিদাবাদে যা দেখবার জন্য ভারতের লোকেরা ১৫ টাকার আর বিদেশিরা ১০০ টাকার টিকিট কিনে ভিতরে প্রবেশ করে এখন।

খোশবাগ একসময় ছিল মুর্শিদাবাদের রাজা মহারাজা আর বর্ধিষ্ণু লোকেদের নৌকাবিহারের কেন্দ্র। ১৭৪০ সালে নির্মিত এই বিলাস উদ্যানের সংলগ্ন নদীর ঘাটে বড় বড় লোকেদের ময়ূরপঙ্খী এসে ভিড়ত সন্ধ্যাবেলা। বিলাসব্যসনে মত্ত হয়ে উঠত মুর্শিদাবাদের ধনী সম্প্রদায়। আজ সেই বাগানে সারি সারি মৃত মানুষের সমাধি। তারা কেউ প্রেমিক, কেউবা চক্রান্তকারী আবার কেউবা বিশ্বাসঘাতক। প্রথম সমাধিগুচ্ছে কারও নাম লেখা নেই। সেখানে শায়িত আছে আলিবর্দির পত্নী, সিরাজের মাতামহী সার্ফুন্নিসা। অনতিদূরেই আলিবর্দির জ্যেষ্ঠাকন্যা, সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগমের সমাধি। এই ঘসেটি বেগম তার অন্য এক বোনের ছেলে পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জংকে সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়েছিল এবং যার ফলস্বরূপ অকালে সিরাজের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল শওকত জংকে। তাছাড়াও সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ক্লাইভকে যুদ্ধজয়ে সাহায্য করেছিল এই ঘসেটি বেগম যার পোশাকি নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। তার পাশেই শায়িত ঘসেটি বেগমের ছোট বোন , সিরাজের মাতা, আমিনা বেগম।

এই সমাধিগুচ্ছ থেকে একটু দূরে সতেরটি সমাধি। এরা সবাই সিরাজের পরিবারের লোক যাদের এক অভিশপ্ত নৈশভোজে খাদ্যে এবং পানীয়ে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছিল মিরজাফরের পুত্র মিরান। সিংহাসনের অন্য কোনও দাবিদার থাকার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য সিরাজকে হত্যার অব্যবহিত পরেই এই নৈশভোজের আয়োজন করেছিল মিরান।একটু দূরে বাঁদিকে ফকির দানা শাহের সমাধি। পলায়নরত ক্ষুধার্ত সিরাজ ক্ষণিকের জন্য ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিল এই ফকিরের দাতব্য সরাইখানায়। কিন্তু দানা শাহ সিরাজকে চিনতে পেরে অর্থের লোভে নিদ্রিত সিরাজকে তুলে দেয় মিরকাশিম আর মিরানের হাতে। উপহারস্বরূপ এক হাজার টাকা উপহার দেওয়ার পর দানা শাহকে হত্যা করে মিরান।

এর পরে চারদিক ঘেরা কাঠের থাম এবং প্লাস্টারের ছাদবিশিষ্ট একটি হলঘরে সিরাজের সমাধি। তারই পাশে সিরাজের বিশ্বস্ত অনুচর গুলাম হোসেনের সমাধি। এই গুলাম হোসেনের সঙ্গেই পোশাক বিনিময় করে ছদ্মবেশ ধারণ করে সিরাজ। কিন্তু তার পায়ের জুতো দেখে তাকে চিনতে পেরে যায় দানা শাহ। গুলাম হোসেনের সমাধির দু’পাশে শায়িত আছে সিরাজের হারেমরক্ষক দুই খোজা। মিরান এদেরও হত্যা করেছিল।

সিরাজের নিরাভরণ সমাধির ওপর কোনও কোনও দর্শনার্থীর রাখা গোলাপ, গাঁদা বা অন্য কোনও একটি দু’টি ফুল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বোঝাই যায়না এখানেই শায়িত আছে ব্রিটিশের ত্রাস , দোর্দন্ডপ্রতাপ নবাব সিরাজদ্দৌল্লা। সিরাজের সমাধির পায়ের কাছে শায়িত তার পত্নী লুৎফুন্নিসা। তার ডানদিকে সিরাজের একসময়ের প্রেমিকা, নর্তকী এবং সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের বোন আলিয়ার সমাধি। সিরাজের মৃত্যুর পর তার মা, মাসি, স্ত্রী, কন্যা জোহরা এবং আরও কয়েকজন আত্মীয়া ও পরিচারিকাকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয় মিরান। সেখানে থেকে নৌকাবিহারের নাম করে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে কয়েকজনকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে মিরান। সিরাজের মা এবং মাসি কী ভাবে মারা যায় তা এখনও অজ্ঞাত। কিন্তু কথিত আছে সিরাজের মৃত্যুর পর মিরজাফর এবং মিরান দু’জনেই লুৎফুন্নিসার পানিপ্রার্থনা করে। পিতা এবং পুত্র দু’জনকেই প্রত্যাখ্যান করে সে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি লুৎফুন্নিসা এবং তার মেয়েকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মাসোহারা ও খোশবাগেই থাকার ব্যবস্থা করে। লুৎফুন্নিসা তার বাকি জীবনের প্রতিটি দিন সিরাজের সমাধিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মাথা ঠেকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত। এমনি ভাবে পঁচিশ বছর কাটিয়ে পতিশোকে অর্ধোন্মদিনী লুৎফুন্নিসা ১৭৯০ সালে মারা যায়। একেবারে বাঁদিকের সারির প্রথমে আলিবর্দির সমাধি।তার নিচে সিরাজের কন্যা জোহরার সমাধি। আলিবর্দির বাঁদিকের দু’টি সমাধি শওকত জং এবং তার স্ত্রী মোতি বেগমের। মিরজাফর, ঘসেটি বেগম এবং অন্যান্য চক্রান্তকারীদের উস্কানিতে শওকত জং সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সিরাজের মৃত্যুর একবছর আগে সিরাজের হাতেই নিহত হয়। এই খোশবাগেই শায়িত আছে আলিবর্দি এবং সিরাজের সমগ্র পরিবার ও পরিজন।

ভাগীরথীর অপরপ্রান্তে জাফরগঞ্জে আছে মিরজাফরের প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ। প্রবেশপথের ওপর ভাঙ্গা ফটকটিকে স্থানীয় মানুষেরা নিমকহারাম দেউড়ি বলেই ডাকে। মিরজাফরের সমাধিক্ষেত্রে টিকিট কিনে ঢুকতে হয়। মিরজাফর ছাড়াও এখানে আছে মিরকাশিম এবং মিরানের সমাধি। তাছাড়া আছে চার প্রহরী এবং হিসাব রক্ষকের সমাধি। কথিত আছে আরও অনেক নাম না জানা মানুষের সমাধির মধ্যে একটি মিরানের প্রিয় টিয়াপাখির। এই সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি বরাদ্দ এগারো টাকা অনাদিকাল থেকে এখনও পর্যন্ত চলে আসছে। হতভাগ্য রক্ষণাবেক্ষণকারীরা ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা করে সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংসার প্রতিপালন করে। শোনা যায় এরা মিরজাফরের বংশধর এবং স্থানীয় মানুষেরা এখনও তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার অভিশাপ আর কতো প্রজন্মকে বহন করতে হবে একমাত্র ভবিষ্যৎই তার উত্তর দিতে পারবে।

1 comment:

  1. অনেক কিছুই জানতে পারলাম। তবে এখনও ১১ টাকায় কি করে রক্ষনাবেক্ষণ হয়।

    ReplyDelete