Next
Previous
12

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in






কলেজ পাশ করে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে চায়ের দোকানে যখন একদিন বসে ভাবছি ‘পরবর্তী পদক্ষেপ’ কী নেওয়া যায়, পকেটে রাখা ফোন বেজে উঠল। উফ, একেই বলে ভাগ্য! চাকরির ফোন। তাও আবার স্বয়ং এম ডি ফোন করেছেন। ঢুকেই ম্যানেজারের পদ, কোলকাতার বাইরে এক প্রাইভেট ফার্মে।

ফোন করেছিলেন সত্যেন কাকা, আমার খুড়তুতো কাকা হন, বারাসাতে থাকেন। বললেন, “মধুপুরে আমার যে যাত্রীনিবাস মানে হোটেলটা আছে তার ম্যানেজার কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তুই করবি? মাইনে বেশি দিতে পারব না কিন্তু অভিজ্ঞতা তো হবে …”


দেরি না করে তিন দিনের মধ্যে মধুপুর গিয়ে ‘কার্যভার গ্রহণ’ করলাম। ছোট হোটেল, দোতলা বাড়িতে গোটা আটেক ঘর আছে। দোতলার সামনেটা জুড়ে বেশ চওড়া বারান্দা। সামনে একটু ঘাস, আগাছা আর দু-চারটে কলাবতী ফুলের গাছ নিয়ে একখানা বাগানও আছে। এই অঞ্চলের মোটামুটি চালু হোটেল, সস্তা আর রাস্তার কাছে বলে বোধ হয়।

ওরে বাবা! হোটেল চালাতে তো দেখছি মেলা হ্যাপা! খাটনি আছে তাছাড়া সবকিছু চোখে চোখে রাখতে হয়। মাস খানেক লেগে গেল কাজটা ঠিক করে বুঝতে।

তারপর একদিন সত্যেন কাকার ফোন এলো। ভূমিকা ছাড়াই বললেন, “যা খবর পেলাম তাতে মনে হচ্ছে তুই কাজটা ধরে নিয়েছিস। ভালো। এ মাস থেকে তোর মাইনে একটু বাড়িয়ে দিলাম।”

আমি তো আল্হাদে আটখানা। এক মাসেই এম ডি মাইনে বাড়িয়ে দিলেন!!

সত্যেন কাকা তখনো ফোন কাটেননি। বললেন, “আর শোন, এই ধরনের কাজে ‘সফ্ট স্কিল’ খুব দরকার। সেটা তোর কম, তোকে শিখতে হবে।”

“কী স্কিল বললে?”

“সফ্ট। মানে অতিথিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবি যেন ওদেরই হোটেল। যা চাইবে তাতে কখনো না বলবি না কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব করতে হবে। হ্যাঁ, যতটা সম্ভব ততটা করিস।এতে অতিথিরা বারবার ফিরে আসে। বুঝলি তো ব্যাপারটা।”

কথাটা বুঝলাম। এও বুঝলাম হোটেল চালাতে গেলে এ না হলেই নয়। নিজেকে ‘তরু হতে যে বা হয় সহিষ্ণু’ ধরনের হতে হবে। নিজেকে এই দিকে যতটা পারি পাল্টে নেবার চেষ্টা করলাম, খানিকটা পারলাম বলেই মনে হয়। যেমন সেদিন দুপুরের দিকে এক বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী এলেন। ভদ্রলোক আমাকে দেখে যেন একটু অবাক হলেন। স্ত্রীকে বললেন, “নতুন লোক।”

বললাম. “হ্যাঁ স্যার। আমি এই মাস দুয়েক জয়েন করেছি। কতদিন থাকবেন স্যার … ডবল বেড …”

“ভাড়া আমি জানি, বাড়াওনি তো আবার? তাহলে অন্য হোটেল দেখবো। এই নিয়ে তিনবার এলাম।”

ভদ্রলোক আধার কার্ড বাড়িয়ে দিলেন। নাম দেখলাম সুশীতল বসু। একতলার একটা ঘর দিচ্ছি বলতে উনি আপত্তি করে উঠলেন। “না রে বাবা, আমার দোতলার ঘর চাই। তোমাদের হোটেলের ওই দোতলার বারান্দাটাই তো আসল, বসে বসেই সময় কেটে যায়।”

কাকার কথা মনে পড়ে গেল। খুব বিনীত ভাবে বললাম, “আজ তো খালি নেই স্যার, কিন্তু কাল খালি হচ্ছে। তখন আপনারা ওটা নেবেন। আর বারান্দা? আজকে বিকেলের চা টা স্যার নয় দোতলার বারান্দায় বসেই খাবেন, ব্যবস্থা করে দেবো।”

রাজি হয়ে গেলেন।

মার্কামারা পাতি বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত পরিবার। অন্য জায়গায় কি এত খাতির পেতেন এনারা? এই যে খাতির করছি এটা আমার সদ্য শেখা ‘সফ্ট স্কিল’!

বিকেলে একবার দোতলায় দেখে আসতে গেলাম। বেতের চেয়ারে বসেছেন দুজনে। মহিলার গলা সিঁড়ি থেকেই কানে আসছিল। “বিস্কুটগুলো বড় মিষ্টি, একটাই খাবে। আর এবার থেকে চায়ে চিনি কম করো নয় বাদ দাও। সুগার তো বেশ বেড়েছে।”

“আরে ছাড়ো তোমার সুগার। এখন বাইরেটা দেখ কী সুন্দর। চল, চা-টা খেয়ে বেরোই।”

“ঠাণ্ডা পড়ছে। দুপুরের দিক ছাড়া বেরোনো যাবে না।”

“দুপুরে কি সূর্যাস্ত দেখা যায়!”

“ঠাণ্ডার মধ্যে সূর্যাস্ত দেখবে তো মাফলারটা আনলে না কেন? আলমারি থেকে বারও করে দিলাম, তাও ছেড়ে এলে। এত ভুলোমন...”

“এক কাজ করি, কাল সকালে একটা মাফলার কিনে নিই।”

“আবার নতুন মাফলার! এবার এর মধ্যেই কত খরচ হয়ে গেছে জানো? কুলিই তো নিল দেড়শ।”

আমি এসে দাঁড়িয়েছি দেখে সুশীতলবাবু বললেন, “সময় আছে? একটু বোস না এখানে…”

বসলাম। উনি বললেন, “ভাই, এখানে জমির কীরকম দাম চলছে জানো কি? জায়গাটা এত ভালো লাগে, মনে হয় একটা ছোট্ট বাড়ি করে …”

“আজ্ঞে স্যার, আমি তো এখানে নতুন। খোঁজ নিয়ে বলতে পারি … রাস্তার ধারে দাম শুনেছি খুব বেড়ে গেছে…”

“তবু?”

“ঠিক জানি না তবে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার কাঠা …”

“ওরে বাবা, অত! না, না রাস্তার ধারে নয় আমার ওই পাহাড়ের দিকটায় হলেই হবে …”

উঠে আসতে আসতে শুনলাম মহিলা একচোট নিচ্ছেন স্বামীর ওপরে। “ভীমরতি ধরেছে, এইখানে জমি কিনবে! মুরোদ তো পেনসনের ওই টাকা কটা। শুভার বিয়েতে তো পভিডেন শেষই হয়ে গেল! এসব একদম মাথায় আনবে না …”

দিন দুয়েক পর সন্ধেবেলায় আপিসে বসে আছি। উনি, মানে সুশীতলবাবু ঢুকলেন। “বসব এখানে?”

কদিন দেখছি এই ভদ্রলোক আমকে বন্ধুর মতো ভাবতে শুরু করেছেন। বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বসুন না”

“ওই সেদিনের কথাটাই বলতে এলাম। আসলে উর্মি আপত্তি করে কারণ আমাদের তো তেমন পয়সা কড়ি নেই। তবু কি জান ভাই, কোলকাতায় আর থাকতে ভালো লাগে না, তাই খরচাপাতি হলেও এখানে বারবার চলে আসি। ছোট দোতলা বাড়ি আমাদের। ছেলে থাকে পরিবার নিয়ে নিচের তলায়, ওপরের ঘরটায় আমরা। একে ঘিঞ্জি এলাকা তার ওপর বাড়ির পেছনে একটা ক্লাব হয়েছে। ওদের তো বারো মাসে ছত্রিশ পার্বণ। এই পুজো সেই পুজো এই দিবস সেই দিবস - টানা মাইক চলতে থাকে। যেদিন ওসব থাকে না সেদিন হয় রক্তদান শিবির নয় ছোটদের যোগ-ব্যায়াম প্রতিযোগিতা। মাইকে ‘ঘোষণা’শুরু হয়ে যায় সকাল থেকে। আর সামনের রাস্তায় আজকাল অটোর রুট হয়েছে। অটোওলারা খুচরো ফেরৎ দিতে চায় না, তার ওপর ডাকাডাকি ছোটাছুটি - সারাদিন হৈহৈ চেঁচামিচি।

এই জায়গাটা এত ভালো লাগে … ওই পাহাড়ের গা দিয়ে একটা জঙ্গুলে পায়ে চলা রাস্তা উঠে গেছে। সকালে গিয়েছিলাম ... কী যে সুন্দর।“

“হ্যাঁ, ওই গ্রামের লোকেরা আসা-যাওয়া করে। আদিবাসী মেয়েরা কাঠ কুড়োতে যায়।”

“হে হে এই হল ‘বনপথ’। কি হে, সময় নিচ্ছি বলে রাগ করছ না তো! তোমাদের সময়কার নয়, সে আমদের সময় একটা গান ছিল ‘দূর বনপথে ছায়াতে আলোতে/ ঝরানো পাতার ছন্দ বাজে কার পায়ে পায়ে….’ খুব সুন্দর গানটা। সেই রকমই বনপথ এটা। ওর কাছাকাছি যদি ছোট একটা বাড়ি করে থাকতে পারতাম! হ্যাঁ, তোমাদের হোটেলের বারান্দাটা বড় ভালো, বসে বসে কত দূর অবধি দেখতে পাই...”

“আপনার ভালো লাগে সেটা তো আমাদের গর্ব। আপনারা খুশি হলেই আমরাও খুশি।” নিজের ‘সফ্ট স্কিল’ এর প্রয়োগ দেখে আমি নিজেই খুশি!

“তোমাকে বলি ভাই। আমার একটা ইচ্ছে আছে। স্বপ্নও বলতে পারো – ওই দূরের দিকটায়, এই ধর দেড়-দু কাঠার ওপর হলেই চলে, একটা ঘর যদি বানাতে পারতাম! ছাদ ঢালাই না করে টালির ও করা যায়, খরচা কম। সামনে বাগানের জন্য একটু জায়গা ছেড়ে দিতাম। দিনভর পাহাড় আর বন চোখের সামনে থাকত! কখনো সখনো হয়তো মেঠো বনপথ দিয়ে হেঁটে চলে যেতাম অনেকটা …”

আমি কিছু না বলে মানুষটিকে দেখতে লাগলাম। এনার যা সংগতি তাতে এসব আকাশকুসুম স্বপ্নের কোনো মানে হয় নাকি। ইনি কি তা বোঝেন না? বোঝেন ঠিকই তবু স্বপ্নটুকু নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসেন।

“তুমি যদি একটু খোঁজ-খবর নিয়ে রাখো। ভাবছি এ বছরই আর একবার আসব।”


বেশ কিছু দিন হয়ে গেছে, বছরও ঘুরে গেল, ওনারা আসেননি। আমিও প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আর ওসব জমির খোঁজ-খবর, বলাই বাহুল্য, নিইনি।


একদিন সকালের দিকে আমদের হোটেলের সামনের ডেস্কে যে বসে সে এসে বলল কে যেন আমার খোঁজ করছেন। গেলাম। বছর চল্লিশের একজন, আমি চিনতে পারলাম না।

“আমার বাবা-মা অনেকবার আপনাদের হোটেলে এসে থেকেছেন। আমি সুশীতলবাবুর ছেলে।”

“সুশীতল বসু?” আমার মনে পড়ে গেল, চাকরির প্রথম দিকের ব্যাপার তো।

“হ্যাঁ। উনি গত মাসে মারা গেছেন। মা আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন।”

“ওহ, দুঃখিত। বলুন আমি কী করতে পারি।”

“আসলে ওনারা এই জায়গাটা খুব ভালোবাসতেন, বিশেষ করে বাবা। শুনেছি আপনাদের এখানে দোতলার বারান্দায় বাবা বসে থাকতে খুব পছন্দ করতেন। সকাল বিকেল নাকি বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতেন। ওই মা বলছিলেন আর কি।”

“ঠিকই বলেছেন, আমার বেশ মনে আছে।”

“মা আপনাকে একটা অনুরোধ করেছেন, যদি আপনি রাজি থাকেন …”

আমি একটু সতর্ক হয়ে গেলাম। কাকার কথা মনে পড়ল। অনুরোধ রাখলে অতিথি আবার ফিরে আসেন। কিন্তু উনি তো মার গেছেন, তাহলে?। যাক গে শুনি তো ব্যাপারটা কী।

যে অনুরোধটা এলো সেটা কিন্তু আমি আন্দাজ করিনি।

“মা বলছিলেন, বারান্দাটা বাবার কতখানি প্রিয় ছিল আর উনি ওখানে বসে দূরে পাহাড় জঙ্গলের দিকে দেখতেন। ওনার আবার একটা ছোট বাড়ি করে থাকারও ইচ্ছে হয়েছিল – ওই স্বপ্ন আর কি। তা অবশ্য হয়ে ওঠার কোনো প্রশ্নই ছিল না। তাই মা বললেন ওনার একটা ছবি যদি ওই দোতলার বারন্দায় টাঙিয়ে রাখা যেত… বড় ছবি নয়…”

একফুট বাই দেড়ফুট মতো কাচে ফ্রেম করা ছবি ব্যাগ থেকে বার হলো। হ্যাঁ, চিনতে পারলাম। সুশীতলবাবু।

কি করা উচিত? হোটেলে কি এরকম ছবি রাখা যায়? তবে কেন জানি না ছবিটা দেখে আমার মনটা যেন একটু নরম হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম একটা তো পেরেকের ব্যাপার, ওনার স্ত্রী যখন বলে পাঠিয়েছেন তখন থাক না বারান্দার দেয়ালে।

বললাম, “ঠিক আছে, রেখে যান। আমি সুবিধে মত দেয়ালে লাগিয়ে দেবো”


বিকেলে ছবিটা টাঙিয়ে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু কাচের ভেতর থেকে সুশীতলবাবুর দৃষ্টিটা যেন আমাকে আটকে রাখল। সেই ‘দূর বনপথের’ দিকে তাকিয়ে আছেন অপলক। এ জীবনে যা হলো না তাই হয়তো দেখছেন সেখানে। একটা লাল টালির ছাদওলা ঘর, সামনে একটু বাগান আর সেখানে দুটো বেতের চেয়ার।

একটা কথা মনে হচ্ছিল। শুনেছি গীতায় আছে আত্মা অবিনশ্বর। শরীর শেষ হয়ে গেলেও আত্মার বিনাশ নেই। আচ্ছা, স্বপ্নের কথা কিছু কি লেখা আছে সেখানে? শরীর বিলীন হবার পর এনার মত সাধারণ মানুষের স্বপ্নটুকুর কী হয়। তা কি জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে দূরের বনপথে মিলিয়ে যায় নাকি সবার অলক্ষ্যে পড়ন্ত বিকেলের আলোছায়াতে বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
1

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in




















-"ও দাদা, উঠুন না"!

-"আরে আমাদের বসতে দিন"!

-"ও দাদা, উঠুন উঠুন"!

-"এটা জেনারেল কামরা, আপনার বাড়ির বিছানা নয়"!

একের পর এক চিৎকার আছড়ে পড়তে থাকে ভোরের নীরব কামরায়! কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও লম্বা সীটে দুর্গন্ধের কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে নির্বিকার শুয়ে থাকে অসাড় দেহটা! শেষমেশ বারকয়েক ঠেলাঠেলির পর কোনওমতে বিরক্তির সাথে কাঁচাপাকা চুলদাড়ি আর হতবাক বলিরেখার আঁকিবুকি মুখে নিয়ে উঠে বসেন বছর পঞ্চাশের এক রোদে পোড়া মানুষ!

উঠে বসে চারিদিকে অবাক হয়ে তাকান, আর কিসব বলতে থাকেন কেউ বুঝতে পারে না! আমার পাশের ব্যাঙ্ককর্মী ভদ্রলোক বলেন, "আরে, কেয়া বোলতা হ্যায়? হিন্দি মে বোলিয়ে"! সবাই যখন বিভ্রান্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করে, রোদে পোড়া মানুষটি বলেন,"বিজয়ওয়াড়া, বিজয়ওয়াড়া"! এক ঘুগনিওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলে,"ইয়ে বিজয়ওয়াড়া নেহি হ্যায় ভাই"! জানালার সীট থেকে আরেকজন জানতে চায়, "ইংলিশ আতা হ্যায় আপকো?" রোদে পোড়া মানুষটি শূন্যদৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর বলেন "বিজয়ওয়াড়া, তেলুগু"! আরও কয়েকজন প্রশ্ন করতে থাকলে রোদে পোড়া মানুষটি নিজের নোংরা পুঁটলি থেকে একটা আইডি কার্ড বের করে দেখান, বলেন, "জোসেফ, বিজয়ওয়াড়া, ইন্ডিয়া"!

আইডি কার্ডটা কয়েক হাত ঘুরে এসে পড়ে আমার হাতে। ভোরের ট্রেনে শেষমেশ নিজের ঘুমঘোর বিসর্জন দিতেই হয়। একবার চোখ বুলিয়ে আইডি কার্ডটা ওনার হাতে ফিরিয়ে দিতেই কাচুমাচু মুখে বলেন, "বিজয়ওয়াড়া, তেলুগু"। এবার পকেট থেকে মোবাইলটাকে বার করি, গুগল ট্রান্সলেটর খুলে বাংলাতে টাইপ করি, "আপনি ভুল ট্রেনে উঠেছেন, এই ট্রেন বিজয়ওয়াড়া যাবে না", তারপর সেটাকে তেলুগু'তে ট্রান্সলেট করতে দিয়ে অডিও'টা শোনায় ওনাকে। জোসেফের চোখদুটোয় আলো খেলে যায়! সে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেয়, বুঝতে পেরেছে! আমি আবার একই পদ্ধতিতে টাইপ করি, "আপনাকে এখান থেকে উলটো পথের ট্রেন ধরে হাওড়া যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে বিজয়ওয়াড়া যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে"। তেলুগু অনুবাদ'টা আবার ওকে শোনাতেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি খেলে যায়! আশেপাশের যাত্রীরা তখন অবাক চোখে দেখছে কিভাবে ভাষার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় মানুষের ভিতরে। এবার ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়েই ভোরবেলায় ভাঙা ভাঙা তেলুগু'তে জানতে চাই ও পরিযায়ী শ্রমিক কিনা। জোসেফ বলতে চায় অনেককিছু, কিন্তু কেন জানি না চুপ করে যায়, হাত তুলে বুঝিয়ে দেয় যে ও সন্তুষ্ট হয়েছে। আমিও আর কথা বাড়াই না। পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে চুপচাপ তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেমে পড়ে, তারপর চারিদিকে একবার তাকিয়ে জানালার বাইরে থেকে আমাকে হাত তুলে আশীর্বাদ করে। ট্রেনটা আস্তে আস্তে স্টেশন ছেড়ে কুয়াশার দিকে এগোতে থাকলে আশেপাশের যাত্রীরা রোদে পোড়া মানুষটির মানসিক সুস্থতা নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

আমি আবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করি, কিন্তু চোখে ভেসে ওঠে জোসেফের চোখে দেখতে পাওয়া সেই একচিলতে আলোর রেখাটুকু, যা আমাকে নিয়ে যায় এক ঠিকানাহীন মানুষের সুদূর, শান্ত বাড়ির ভেতর, খালি পায়ে, ভিজে পায়ে ...
0

গল্প - রণজয় দে

Posted in




















প্রথম পরিচ্ছেদ:

হাঁটছে সাওন। আদিগন্ত হিমাচল পেরিয়ে য্যানো হাঁটছে, আসলে কলকাতায়। টালিগঞ্জ বস্তির ভেতরের এই রাস্তাগুলো একটু অচেনা ওর কাছে। ও যাচ্ছে কাউকে একটা ডাকতে। গায়ে য্যানো বল নেই। খুবই ক্লান্ত চলন। দাঁড়ালো ও। হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে না রাস্তা চিনতে পারছে না বোঝা যাচ্ছেনা। আবার শুরু। একটা মৃত গলির শেষ বাড়িটায় ঢুকে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করলো। তারপর দোতলায় এসে কড়া নাড়তেই একজন বৃদ্ধা দরজা খুললেন। সাওন হাতের মুঠো খুলে ওনাকে কিছু একটা দেখাতেই উনি দরজা ছেড়ে সড়ে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধাকে জিনিসটা দিয়ে ভেতরে একটা ভাঙা চেয়ারের পাশ কাটিয়ে তুলো ওঠা একটা সোফার ওপরে গিয়ে বসলো ও। বৃদ্ধা দরজা বন্ধ করে ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গ্যালেন। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে পাশে রাখলো সাওন। সঙ্গে সঙ্গেই ওটা জ্বলে উঠলো নিজে থেকে। ফোন ধরলো সাওন। ওপাশ থেকে একটা মহিলা কণ্ঠস্বর, 'আর কতক্ষণ লাগবে তোমার পৌঁছতে?' সাওন-- 'আর আধঘণ্টা।' ওপার থেকে একটা অস্ফুট আওয়াজ হয়ে ফোনটা কেটে গ্যালো। ফোনটা আবার পকেটে ভরে ছোট, খালি, ঠান্ডা এবং সোঁদা গন্ধওয়ালা ঘরটার দিকে একবার তাকালো। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে ও-ও ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গ্যালো।

ভেতরের ঘরটা মানুষ এবং টুকটাক কিছু জিনিসে তুলনায় ভরা। চারজন বিভিন্ন বয়সী মহিলাদের মধ্যে একজন কিশোরীও ছিলো। সাওন 'টাকা দাও, বেরোবো, তাড়া আছে' বলতেই কিশোরী বাদে বাকি তিনজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। চল্লিশ-পয়তাল্লিশের দিকে যার বয়স, খুবই রঙীন এবং খুবই পুরনো একটি শাড়ি পরিহিত মহিলা বললেন, 'জিনিসটা আমার পছন্দ হয়নি।' বাকি তিনজনের মুখটা এখন একটু ফ্যাকাসে দ্যাখাচ্ছে। সাওন মুখে কিছু না বলে হাত পাতলো। মহিলা জিনিসটা দিয়ে দিলেন। একটা চৌকো কালো রঙের ছোট বাক্স। সাওন হাত মুঠো করে বাক্সটা পকেটে চালান করে দিলো। 'বেরোলাম' বলে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ:

বহরমপুর শহরের ওপর একটা বড় চারতলা অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলায় একটা ফ্ল্যাটের বড়ো ঘর। আসবাব ও বই দিয়ে খুবই সৌখিন মতে সাজানো। ঘরের মাঝে একটা গোল টেবিলের চারদিকে চারটে চেয়ার। টেবিলের ওপর কিছু কাগজ, বইপত্র, দুটো কফিমগের তলায় শেষ হয়ে যাওয়া কফির কালো দাগ ও একটা ছাইদানি। আর একটু পাশে মেঝেতে একটা লাল রঙের ম্যাট্রেসের ওপর খোল, দোতারা, ডুবকী জাতীয় দুয়েকটা লোকসঙ্গীতের যন্ত্র অবিন্যস্ত পড়ে আছে। ম্যাট্রেসের ওপর একজন যুবকও বসে আছে, ফোন ঘাঁটছে। ঘরের দেওয়ালগুলো ছৌ-এর মুখোশ এবং কিছু ছবি দিয়ে সাজানো। ষাটোর্দ্ধ প্রৌঢ় একজন ঘরে ঢুকলেন। চুল-দাড়ি বেশ বড়ো, যার বেশিরভাগটাই সাদা, চুলগুলো পেছনে জড়ো করে বাঁধা, ঢোলা জিন্স এবং পাঞ্জাবী পরিহীত। ঢুকেই যুবককে উদ্দেশ্য করে, 'একি নীচে ক্যানো, চেয়ারে এসে বোসো' বলে নিজে একটা চেয়ারে বসলেন। যুবক উঠে আসলো ধীরে ধীরে। পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে 'কফি চলবেতো?' বলে যুবকের দিকে তাকালেন। যুবক মুখে আলতো হাসি নিয়ে না-সূচক ঘাড় নাড়লো। প্রৌঢ় সিগারেট জ্বালিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে 'বেশ, বলো তবে' বলে টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে তার ওপর তাকিয়ে রইলেন। 'দেখুন, প্রথমেশ বাবু' বলে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে যুবক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। 'আমার কিছু বলার নেই কিন্তু আমি আর পারছিনা' বলে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে আবার মুহূর্তের মধ্যে চেয়ারে বসে পড়লো ছেলেটি। 'কিছু করার নেই, মন্মথ, পারতে তোমাকে হবেই-' বলে লোকটা আবার কাগজে ভাবলেশহীন মুখটা গুঁজে দিলেন। নিঃশব্দে মূর্তির মতো করে চার সেকেন্ড কেটে গেলে প্রথমেশ বাবু একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে আবার বললেন,'যদিও উপায় একটা যে আছে, তা তো তুমি জানো।' ছেলেটার চোখদুটো একটু য্যানো জ্বলে আবার নিভে গ্যালো। একটু থতমত খেয়ে খানিক তুতলে নিয়ে মন্মথ বললো 'না, সেটা তো আমি পারবো না আপনি জানেন।' 'তাহলে যা করছো করে যাও, হপ্তায় হপ্তায় বিরক্ত করতে এসো না তো' বলে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক পায়চারি করতে লাগলেন। 'এভাবে কটা দিন মুখ বুজে এখানে থাকো না' বলে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে যুবকের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে কৃত্রিম হাসিমুখে বললেন, 'তারপরই তো তোমাকে দুবাই পাঠিয়ে দেবো।' বলে আবার হাঁটা শুরু করলেন। ছেলেটা মাথা নিচু অবস্থাতেই খানিক আচ্ছন্নের মতো বললো,' না আমি পরে পালাতে চাই না। হয় আমাকে এখুনি পাঠিয়ে দিন। রোজ রোজ পাশবিক অত্যাচার দ্যাখা একটা নেশার মতো। অভ্যেস হয়ে গেলে এখান থেকে যাওয়া আর সম্ভব হবে না।' 'কিছু করার নেই, মন্মথ, পারতে তোমাকে হবেই' বলে লোকটা আবার কাগজে ভাবলেশহীন মুখটা গুঁজে দিলেন। নিঃশব্দে মূর্তির মতো করে চার সেকেন্ড কেটে গেলে প্রথমেশ বাবু একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে আবার বললেন,'যদিও উপায় একটা যে আছে, তা তো তুমি জানো।' ছেলেটার চোখদুটো একটু য্যানো জ্বলে আবার নিভে গ্যালো। একটু থতমত খেয়ে খানিক তুতলে নিয়ে মন্মথ বললো 'না, সেটা তো আমি পারবো না আপনি জানেন।' 'তাহলে যা করছো করে যাও, হপ্তায় হপ্তায় বিরক্ত করতে এসো না তো' বলে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক পায়চারি করতে লাগলেন। 'এভাবে কটা দিন মুখ বুজে এখানে থাকো না' বলে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে যুবকের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে কৃত্রিম হাসিমুখে বললেন, 'তারপরই তো তোমাকে দুবাই পাঠিয়ে দেবো।' বলে আবার হাঁটা শুরু করলেন। ছেলেটা মাথা নিচু অবস্থাতেই খানিক আচ্ছন্নের মতো বললো, 'না আমি পরে পালাতে চাই না। হয় আমাকে এখুনি পাঠিয়ে দিন। রোজ রোজ পাশবিক অত্যাচার দ্যাখা একটা নেশার মতো। অভ্যেস হয়ে গেলে এখান থেকে যাওয়া আর সম্ভব হবে না।' বলে উঠে দাঁড়িয়ে 'আচ্ছা আমি আসি।' বলে লোকটার দিকে আর না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মন্মথ। দরজার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রথমেশ বাবু। তারপর আবার চেয়ারে বসে একটু জোরে 'আমাকে এককাপ কফি দিও তো' বলে ভেতরের দিকে তাকালেন। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। উনি আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে দেওয়ালে কোনো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। তার দশ মিনিট পর বছর পঞ্চাশের অভিজাত শাড়ি পরা মহিলা একটি ট্রেতে দুটি কফিমগ এনে ওনার হাতে একটা মগ দেওয়া পর্যন্ত ছাই এবং পোড়া সিগারেট ফ্যালা বাদে উনি একফোঁটাও নড়াচড়া করলেন না। মহিলা একটি চেয়ারে বসে কফিতে নিঃশব্দ চুমুক দিয়ে প্রথমেশ বাবুর দিকে তাকালেন।ভদ্রলোক 'মন্মথ' বলে মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করে কফিতে মন দিলেন। মহিলা বিরক্ত সুরে একটু গলা নামিয়ে বললেন, 'ওকে এখান থেকে পাঠিয়ে দাও না, তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।' ভদ্রলোক 'ধুস। তা বললে হয় নাকি' বলে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। 'ওকে এতো সহজে মুক্তি দিলে যে আমার জীবনটা আবার আগের মতো জটিল হয়ে যাবে মাধবী।' বলে প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে গেলেন। মহিলা কিছু বললেন না। 'মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে অর্ধ-শতাব্দী জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পরও আমার কষ্ট হয় মাধবী, খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মনে হত, দি একটানে সব শেষ করে। পারিনি। আজ এতোদিন পর মন্মথকে পেয়ে... ' আর বলতে পারলেন না। গলা য্যানো জড়িয়ে এলো প্রথমেশ বাবুর। মাধবী দেবী উঠে দুটি খালি কফিমগ ট্রেতে নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ :

সকাল এগারোটার সময় কলকাতার রাস্তাঘাট পুরো মহাদেবের জটার মতো হয়ে থাকে। এরকম একটা ব্যস্ত সময়ে বড়োবাজারের মুখে একটা ক্রসিং-এর সামনে অপেক্ষা করছে উপল। হাতে একটা বাজারের থলে মতো ঝোলা আর পরনে গেঞ্জি-জিন্স। আঠাশ থেকে তিরিশের মধ্যে বয়স হবে ওর। উঠে দাঁড়িয়ে কাকে য্যানো দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো। মাঝবয়সী লোকটা এগিয়ে এসে হাত উল্টে গোপনীয়তার সাথে উপলের হাতে একটা প্যাকেট চালান করলো। উপল হাতটা আলতো মুঠো করে একইরকম গোপনীয়তার সাথে প্যাকেটটা দেখে নিলো একঝলক। 'ঠিকাছে' বলে পকেটে রেখে দিলো। গাঁজা। 'সপ্তাহখানেকের মধ্যে আবার ফোন করছি' - কথাটা উপলের মুখ থেকে বেরোতে না বেরোতেই ঢোলা জামা তুলনায় কম ঢোলা ফ্যাকাসে বাদামী প্যান্ট পরা লোকটা ভিড়ের মধ্যে উধাও হয়ে গ্যালো। উপল চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে একটা বাসে উঠে পড়লো। শেয়ালদা আসতে যদিও বেশি সময় লাগার কথা নয় তবুও মিনিট পয়তাল্লিশের বেশি সময় লাগিয়ে দিলো বাসটা। নেমে গ্যালো উপল। সাত-আট পা হেঁটে একটা গলির ভেতর বেশ খানিকটা চলে যাওয়ার পরে হঠাৎ কি মনে হতে আবার পেছন ফিরে উল্টো দিকে আসতে লাগলো।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ :

অন্ধকারের মতো তাকিয়ে আছে মুন্নি। নিঃশ্বাস পড়ছে অথবা পড়ছে না। খুব রঙীন একটা ঘরে বসে আছে ও। ওদের ঘরটাই। পলেস্তারা খসা ভিজে গন্ধযুক্ত খুবই ছোটো, ওই ঘরটাই। রঙটুকু ফিরেছে শুধু। মুন্নির জীবনের সমস্ত রঙ য্যানো নিজের গায়ে মেখে নিয়েছে ঘরটা। মুন্নি, অসাড়, জড়, মৃতদৃষ্টি এবং পেটে পাঁচ মাসের বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। ভূতের মতো দ্যাখাচ্ছে ওকে। একমনে একটা জিনিসের কথা ভাবছে, মানুষ সেলায়ের সুতোটা। বাইরের ঝোড়ো হাওয়ায় জানলাটা একটু নড়তেই মুন্নিও ক্যামন য্যানো কেঁপে উঠলো। বৃষ্টি নামবে বাইরে। খুব জোরে।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ :

সালমা আপা - টালিগঞ্জ বস্তিতে এই নামেই খ্যাত বছর পয়তাল্লিশ কি আরেকটু হবে, ডাকাবুকো চরিত্রের মহিলা। একজন বড় ও দুই ছোটবোনকে নিয়ে থাকেন। বস্তিটা আসলে ওদের পৈতৃক ভিটে। তাছাড়া কলকাতায় দুটো বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে ওর নিজের। একটা আন্তর্জাতিক অবৈধ ব্যবসা চক্রের সাথে যুক্ত এই সালমা আপা। যুবতী মেয়েদের স্তনবৃন্তের ব্যবসার এক কুৎসিত বিরাট চক্র। উনি এখন বসে ছিলেন পার্কস্ট্রীটের জাঁকালো কোনো রেস্তোরাঁর দোতলায়। ওর ব্যক্তিগত গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, যেটা নিয়ে উনি বস্তিতে ঢোকেননা। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা, অনেক সোনার হার ও আঙটিওয়ালা বছর ষাটেকের এক ভদ্রলোক ও স্যুটেড-বুটেড একজন যুবকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আপা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেরিয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, দুজন আরোহীসহ একটি বাইকের পেছনের জনের হাত থেকে দুটি সশব্দ গুলি এসে লাগে আপার কপালের একেবারে মাঝখানে।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ :

সাওন ডাকতে যাচ্ছিলো ওর প্রেমিকার ভাইকে, যাদবপুরে। ডাকতে যাচ্ছিলো বলা ভুল, সঙ্গে করে নিয়ে আসারই হুকুম ছিলো ওপরতলার তরফ থেকে। কিন্তু দেবজ্যোতি আসতে রাজি না হওয়ায় ওকে একাই ফিরে যেতে হচ্ছে। দমদমে মানে বাড়িতে যদিও এখন যাবেনা সাওন। তিস্তাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে যে ওর ভাই পড়াশোনার চাপের জন্য ফোন ধরছে না আর সে কারণেই আজকেও আসতে রাজি হয়নি। উত্তরে অনেককিছু বললো তিস্তা। সেগুলো খুব একটা মন দিয়ে শোনেনি সাওন। ফোন রেখে দিয়ে ধর্মতলার একটা টিকিট কেটে মেট্রোতে উঠে গেলো ও। নেমে কয়েকপা হেঁটে কাছেই একটা বারে ঢুকে পড়লো। হুইস্কির পেগে চুমুক দিয়ে ওর মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো। ধীরে ধীরে ভাবনার জটগুলো স্থান বদলাতে শুরু করলো। যেদিকে এগোচ্ছে ও, ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছে না। শর্মাজিকে এর আগে কখনও ঠকায়নি ও। আট বছর হয়ে গেছে, ও শর্মাজির এখানে আছে। জীবনে অনেক অপরাধ করেছে ও, মানে সেভাবে বলতে গেলে অপরাধ করাটাই ওর পেশা। কিন্তু যার নুনে পেট ভরে, তার পেটে লাথি মারতে কেমন বিবেক অথবা ওরকমই কিছুতে একটা খচখচ করছে। প্রচুর মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে ও জীবনে। মানে খুন ধর্ষণ নয়। স্তনবৃন্ত কেটে সেলাই করে বাবা অথবা স্বামীকে টাকা দিয়ে দেওয়া, এটুকুই। তারপর ধুয়ে বাক্সতে ভরে শর্মাজির লোককে জিনিসটা দিয়ে দেওয়া। এই শেষেরটুকু এবারে আর করেনি ও। সালমা আপা নাকচ করে দিলেও ওর হাতে আরও দুজন রয়েছে। তবুও ক্যামন যেন খুব ভয় করছে সাওনের। তলপেটটা গুলোচ্ছে, বমি পাচ্ছে খুব। মৃত্যুভয়ের মতো কিছু একটা ব্যাপার। আসলে ওটাই। এ লাইনে গোলাগুলিটা টাকাপয়সার মতো। সব সময় ব্যবহার হয়। আট বছরের এই অদ্ভুত জীবনে প্রচুর মেয়ের কান্না শুনেছে সাওন। এসব নিয়ে এর আগে কখনো ভাবেনি ও। কিন্তু আজকে যেনো ওই সবকটা কান্না এক এক করে এসে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলছে। এসব কি ভাবছে সাওন। পাগলের মতো লাগছে। ভাবছে শর্মাজির কাছে যাবে। গিয়ে বলবে ও আর কাজ করবে না। কিন্তু পকেটের জিনিসটা? ওটা দিয়ে কি সব সত্যি কথা বলে দেবে? নাকি ওটাই শেষবারের মতো বিক্রি করে এসবের থেকে পাততাড়ি গুটোবে?

তিন নম্বর পেগটা শেষ করে গ্লাস রেখে টাকা দিয়ে বেরিয়ে গ্যালো সাওন। না, এসব কিছুই ও করবে না। কিন্তু ও এখন ঘুমোবে। বাড়ি গিয়ে স্নান করে গভীর একটা ঘুমের প্রস্তুতি নেবে। দ্যাখা যাক তারপর কি হয়।

সপ্তম পরিচ্ছেদ :

দুঘন্টার বেশি সময় হয়ে গ্যাছে রায়ান এখানে অপেক্ষা করছে। শেয়ালদা স্টেশন থেকে অল্প দূরে একটা গলির ভেতর ওয়োর একটা ঘরে। সকাল থেকেই ও এখানে আছে উপল বলে একজনের সাথে। এখন দুপুর গড়াচ্ছে, সাড়ে তিনটে বাজে। গ্রাইন্ডার বলে একটা ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে উপলের সঙ্গে মাসখানেক আগেই ওর পরিচয় হয়েছে। কথা হতো অনিয়মিত, দুদিন আগেই উপল ওকে প্রস্তাবটা দেয়। খানিক সময় নিয়ে ওও রাজি হয় বিষয়টাতে। ভালোই লাগছিলো উপলকে কাছ থেকে। কিন্তু সেই যে গাঁজা কিনতে বেরোলো তো বেরোলো। একটু আগে ফোনে বললো বড়বাজার থেকে ফেরার বাসে উঠে গ্যাছে। তারপর থেকে একঘন্টা হতে যায় প্রায়। উপল আর ফোন ধরছেনা। শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর বিরক্ত চোখে… ফোন বাজলো। উপল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ :

আরে ওয়োর টাকাটা পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও এরম করছে ক্যানো ছেলেটা। হ্যাঁ, বলেছিলো আসছে, কিন্তু এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। হলো তো এতক্ষন সকাল থেকে, এখন একটু মন্মথকে চোখে চোখে রাখার কাজটা শুরু করতে হবে। 'বলো তো তোমাকেও কিছু পাঠিয়ে দিতে পারি' বলাতে প্রচন্ড জোরে একটা খিস্তি করে ফোনটা কেটে দিলো রায়ান। যাক্, ভালো হয়েছে। সকালে এই ওয়োটাতে ঢোকার আধঘণ্টার মাথায় প্রথমেশবাবু ওকে ফোন করে এই কাজটার কথা জানায়। ও করবে বলাতে ফোন কাটার পরেই প্রথমেশবাবু বেশ কিছু টাকা পাঠিয়েছেন ওকে। এই মুহূর্তে মন্মথ কোথায় থাকতে পারে ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলো উপল।

নবম পরিচ্ছেদ :

সালমা আপার মারা যাওয়ার খবরটা পেয়েছেন প্রথমেশবাবু। নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে আকাশ-কুসুম ভেবে চলেছেন এসব নিয়ে। যদিও এলাইনে এসব জলভাত, উনি ভাবছেন উনি ক্যানো এখানে? উনি ভাবছেন এসব থেকে মুক্তির উপায়। না, প্রথমদিকে অবশ্য এমন ছিলেন না ভদ্রলোক। নার্সিংহোমটা চালু হওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় এক গুরুজী গোছের লোকের সঙ্গে আলাপ হয় ওর। সত্যানন্দ মহারাজ। তখন থেকেই চলছে এসব। গভীর অভ্যন্তরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মেয়েদের নিয়ে আসে মহারাজের লোকেরা, বেশিরভাগই নিচু জাতের মেয়েদের। প্রথমেশের হাসপাতালেই চলে নারকীয় যজ্ঞটা। পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে টাকা আসে ওর পকেটে। ভালই লাগে ওর বিষয়টা, মানে লেগেছিলো। ততদিনই, যতদিন না কোনো গর্ভবতী মহিলার স্বামী টাকার লোভে নিজের স্ত্রীয়ের সাথে - মেয়েটার পাথরের চোখদুটো এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পান প্রথমেশবাবু। মুন্নি। আর ওই সময়েই কপাল জোরে মাধবীর ছোটোপিসি মাধবীকে ফোন করে ওর ছেলের একটু কাজকর্মের - তখন থেকেই মন্মথকে নার্সিংহোমের দায়িত্ব দিয়ে কোলকাতা ছেড়ে উনি মুর্শিদাবাদের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। ভেবেছিলেন একেবারে পুরোনো দিনের মতো বাউল গান গাইবেন আর সরল জীবন কাটাবেন। তা আর হচ্ছে কই? বিভিন্ন ফোনাফুনি আর মন্মথকে বাদ দিলেও মুন্নির চোখদুটো যে অবিরাম জ্বলছে ওর মাথার মধ্যিখানে। তাড়া করছে কোনো অনির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একবার ঠিক করলেন যাবেন, দঃ চব্বিশ পরগনার জয়নগরের দিকে, মুন্নিদের বাড়ি। এতদিন এত মেয়ের জীবন শেষ হয়ে গ্যাছে, কখনো তো কারো নামও মনে রাখেননি প্রথমেশ। তাহলে এখন?

অনেকখানি বয়স হয়ে গ্যাছে। মানুষ হয়ে জন্মানোর জ্বালাস্বরূপ সূঁচগুলো খুব ধারালো হয়ে বিঁধছে। নিঃসন্তান থাকার ভাগ্যকে অভিশাপ মনে হচ্ছে এতদিনে প্রথমবার। উঠে বাথরুমের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেন প্রথমেশ। চোখদুটো ভীষণ ঝাপসা লাগছে। কোনোক্রমে বাথরুমে পৌঁছে জলের তলায় দাঁড়িয়ে শরীরের সব ব্যাথা মনে আর মনের সব ব্যাথা শরীরে চালান করবার সাধনায় নৈরাশ্যের দেবীকে আহ্বান করতে লাগলেন।
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in




















তুমি আসবে বলে
একাকী তপস্বিনী
পম্পা সরোবরের তীরে কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন।

তোমায় একবার দেখবে বলে
মহর্ষি ফিরিয়ে দিল ইন্দ্রের রথ।
বারংবার।

শুধু একবার
ঝরা বকুলের অর্ঘ্য তোমার চরণে রাখবে বলে
আশ্রমিকেরা অপেক্ষায়।

হে পুরুষোত্তম
তুমি আরেকবার এস
এ‌ই ধুলোর ধরণীতে।

0

কবিতা - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in




















ছন্দের উদাসীন ঝংকার। তাই দেখে টু্পটাপ গলে গলে পড়ে সূর্য।
উদভ্রান্ত মন সাঁতরে যেতে চায়। মায়াবী আলোর নদী।
বুকের মধ্যে উথাল পাথাল। সূর্য-গলা নদীর জল লাল।
নাকি তোমার শালোয়ার কামিজ প্রতিবিম্বিত? তারই রঙ নদীতে।
স্টীলের ব্রীজ হাওয়ায় দোলে, তরঙ্গে তরঙ্গে বিদ্রোহিনী উচ্ছ্বাস?
নাকি তুমি এসেছো, তাতেই হাওয়ারা পাগল পাগল? গ্যালন গ্যালন প্রজাপতি!
সবাই মাতাল। নরম পাখনায় উড়ছে সবাই - তোমাকেই দ্যাখে।
অথচ আমি গান গাইতে পারছি না। পঙ্গুগ্রস্ত একটা দোতারা।
না কি আমার মধ্যেই ভয়! তোমাকে না পাবার! তোমাকে হারাবার?
গলে যাওয়া সূর্যটার জন্যে নদীর জল ঘোলা ও হলুদ।
সূর্যকে গিলে নদী ভেসে যাচ্ছে দূর সমুদ্রে, তুমিও সরে যাচ্ছো অজানায়?
নদী পাড়ে আমি একলা, শরীরে শাপ ভ্রষ্ট প্রেম, আমার দূহাত শূণ্য!
সামনে স্মৃতিভ্রষ্ট ছায়াছবি। আকাশ লাল। তোমার সালোয়ার কামিজ উড়ছে।
ডেকে ডেকে দূরে চলে যাচ্ছে ব্যথার পাখি। বেবাক আমি স্থানু।
সূর্য-গলা নদী জল অপসৃয়মান। লাল দৃশ্যের ঝঙ্কারে আমিও উদাসীন।
ছুঁতে যাই, পিছলে যায় মহাকাব্য। পিপাসার্ত আমি, নদীর জলও অচ্ছুত।
চাতক-বারি মন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়, তবু দিনানুদিন স্বপ্নেরা আসে, জলে ভাসে।
অচ্ছুত নদী ধারে অস্পৃশ্য-আমি যুগ যুগ তোমার অপেক্ষায়!
সূর্য-গলা লাল নদী ছুঁতে পারি কই? শালোয়ার কামিজের প্রতিবিম্ব অধরাই!
ছুঁতে পারি না তোমাকেও। আমার রাস্তায় জবরদস্ত রোড-রোলার প্রতিদিন।
একটা স্বপ্নালু আত্মা তোমাকে চায়। অথচও রৌদ্র গলা পীচে তালাবন্দী দুটো পা।
                                            দেখো কি?
অথচ কত অনায়াসেই প্রাত্যহিক লাল পোষাকে তুমি নির্বিকার হাঁটো!
ছন্দের উদাসীন ঝংকারে নিয়তই আহত আমি। টুপ করে গলে পড়ে সূর্য।
সূর্য-গলা নদী লাল? জলস্রোতে তোমার কামিজের রঙ, না কি আমার বুকের রক্ত?
0

কবিতা - অমিতাভ মুখোপাধ্যায়

Posted in






চোখের পাতার
সামান্য নাড়াচাড়ায়
রাধিকার চাহনিতে

যূথিকানগরের ইতিহাস
ভেসে উঠে ওরই চোখে

ওর ওই বিস্তৃত চাহনিকে
গ্রহণের অন্ধকার
আড়াল করে দেয়

বৃষ্টি আসে গ্রহণের শেষে

যৎসামান্য আলোকে
উত্তেজিত করে
বৃষ্টি
অস্পষ্ট আলোয়

ওই ইতিহাসের বাকি আশাকে
গ্রহণের অন্ধকার এড়িয়ে

রাধিকা
এক চোখে
আরেক চোখে
নিজের করে রাখে
হিসেব মতো

খিদের সময় দুই
হাত রাখে টেবিলে

তিনটে কলাপাতা
তিনজনের জন্য
এক এক করে সাজিয়ে দেয়

খোলা বাতাসে
দেখতে পায়
রাধিকা
সবুজ কলাপাতার
প্রতিটি ঘটনার সাথে
ও নিজেই জড়িয়ে আছে

বাতাস পরিষ্কার হয়
ওরই নিশ্বাসে

ধুলো ও মৃত্যু
রাধিকার
চাহনিতে থেকে সরে যায়

থাকে শুধু
রাধিকার দুই চোখে
যূথিকানগরের বাকি ইতিহাস...
0

কবিতা - সব্যসাচী রায়

Posted in
অধ্যায় ১: শূন্যতার পদার্থবিদ্যা

প্রত্যেক ক্রিয়ার জন্য একটি সমান ও বিপরীত শূন্যতা থাকে।
কফি ঠাণ্ডা হয়- 9.8 m/s²-এ, তোমার ছোঁয়ার মতো।
এনট্রপি চামচ নাড়ায়, চিনির বাটিতে নীরব এক ভাঙচুর।
আমি আমাদের x-এর সমাধান করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সমীকরণ ভেঙে গেল—
ডিনোমিনেটরে এক ভৌতিক উপস্থিতি।
তোমার কণ্ঠ, স্পেকট্রাল তরঙ্গ: শোনা যায় কিন্তু দেখা যায় না,
তোমার পিছু হটার ডপলার শিফটে হারিয়ে যায়।

এখন সকালগুলো মেপে দেখি মিস করা দৃষ্টির অর্ধ-আয়ুতে,
উপস্থিতির ক্ষয় গুনে গুনে
যখন বাজপাখি চক্কর দেয় পিছনের উঠোনে, দেহাবশেষের অপেক্ষায়
বা এক অলৌকিক ঘটনার।

বাইরে, বাতাস আমায় ঠাট্টা করে—এ এক বিশৃঙ্খলার ক্যালকুলাস
যেখানে প্রতিটি ভ্যারিয়েবল একাকীত্ব।

আর আমি এখানে,
অস্তিত্বের গরম পাথরে লিখি,
দেখি প্রান্তগুলো বাদামি হয়ে যায়
যখন আরেকটি প্যানকেক কবিতা
শূন্যতায় বুদবুদ তোলে।

অধ্যায় ২: মার্চের গাণিতিকতা

একাকীত্বের সমাধান করো।
দরজায় দাঁড়িয়ে
নিজেকে দিগন্ত দিয়ে ভাগ করি।
বাতাস আমার পাঁজরে
সমীকরণ ঝাঁকায়।
একটি জ্যাকেট যথেষ্ট নয়,
উষ্ণতার অসমতা।

সূর্যাস্ত ≠ শান্তি।
মেঘে অনিশ্চয়তার গ্রাফ,
বক্ররেখাগুলি ঢলে পড়ে
অসীম ধূসরতার দিকে।

বাতাসের দাঁত আছে।
আমার ভগ্নাংশে খায়।
চামড়া ফাটে,
রক্তের সমাধান হয়।

আমার ছায়া ভেঙে যায়—
উপাংশ উপরে,
গুণাংশ নিচে।

রাত প্রমাণ হিসেবে নামে।
আমি এক অনির্ধারিত উপপাদ্য,
যেখানে ছিলাম আর যেখানে হতে পারতাম
তার মধ্যে আটকে থাকা এক অনুমান।

অধ্যায় ৩: বাইনারিতে পাখির গান

কিছু সুর ডিকোড করা যায় না।
01110100 01101000 01100101
পাখিরা গান গায়—
না হয় হয়তো তা শুধুই স্ট্যাটিক।
আমি ভুলে গেছি
কীভাবে শুনতে হয়
স্ক্রিনের ফিল্টার ছাড়া।

কখনো স্বপ্নে দেখেছিলাম রবি।
এখন তাদের স্থানাঙ্ক খুঁজি:
অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ,
বিলুপ্তির হার।
তাদের ডানা অ্যালগরিদম,
তাদের উড়ানের পথ
অবাক হওয়ার জন্য খুব সোজা।

তাদের বিশৃঙ্খলা আমি হিংসা করি।
তাদের সুর কোনো হ্যাশট্যাগ নয়।
তাদের মৃত্যু কোনো ডেটা পয়েন্ট নয়।

যদি আমি খুব স্থির থাকি,
তাহলে হয়তো শুনতে পাই:
এক পৃথিবীর অ্যানালগ ফিসফিসানি,
যা আনপ্লাগড,
এক বধির আকাশে
পালকের স্পন্দন।

অধ্যায় ৪: রাসায়নিক হৃদয়

ভালবাসা এক ভুল প্রতিক্রিয়া মাত্র।
C₂H₅OH আমার মধ্যে প্রবাহিত হয়—
স্মৃতির মলোটভ ককটেল।
তোমার হাসি দাহ করে
আমার ত্বকে,
প্রেমের ছাই রেখে যায়।

আমরা ছিলাম এক্সোথার্মিক বিশৃঙ্খলা,
সামঞ্জস্যের জন্য খুব বেশি প্রজ্জ্বলিত।
তুমি ছিলে NaCl,
আমি H₂O—
আমরা মিলে কিছুইতে দ্রবীভূত হলাম।

এখন আমি শ্বাস নিই
তোমার রেখে যাওয়া অণু,
বিদ্রূপমাখা অক্সিজেন।
আমাদের ভালোবাসা,
একটি অস্থিতিশীল আইসোটোপ:
অর্ধ-আয়ু চিরকালীন,
কিন্তু শুধুই স্বপ্নে।

অধ্যায় ৫: বিষাদের অ্যালগরিদম

ইনপুট: নিঃশ্বাস, চিন্তা, বাসনা।
আউটপুট: একটি যন্ত্র
খুবই মানবিক, তাই কাজ করতে পারে না।

নিয়ম ১: বিষাদ বাধ্যতামূলক।

সমীকরণ থেকে সব আনন্দ বাদ দাও।
একজন চিত্রশিল্পীর হতাশা যোগ করো,
একটি খালি গ্যালারির নীরবতায় গুণ করো।

নিয়ম ২: সেক্স এক ভুল।

তার শরীর ছিল এক প্যারাবোলা,
তার স্পর্শ, এক অ্যাসিম্পটোট।
তারা কখনো ছেদ করেনি,
কিন্তু গ্রাফটি ছিল অশ্লীল।

নিয়ম ৩: কেউ পরিবর্তন হয় না।

পাহাড় রয়ে যায় পাহাড়।
নদী উল্টো প্রবাহিত হয়।
চরিত্রগুলো অনন্ত লুপে ঘুরে,
তাদের ট্রমা রিওয়াইন্ড করে
একটা ক্ষতিগ্রস্ত ভিনাইলের মতো।

চূড়ান্ত আউটপুট: এক জীবন।
না তোমার। না আমার।
শুধু আরও একটি সিমুলেশন,
এক স্ক্রিনে ঝলমলানো পিক্সেল
যা খুবই ম্লান
যত্ন করার জন্য।
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in






শোল মূলা

উপকরণ::

বড় সাইজের শোল মাছ, মুলো, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা, গোটা জিরে, তেজপাতা, ধনে-জিরে গুঁড়ো, আদাবাটা, নুন, হলুদ ও তেল।

পদ্ধতি ::

আদাবাটা ও গুঁড়ো মশলা সামান‍্য জলে গুলে পেস্ট বানিয়ে রাখতে হবে। মাছ একটু ছোট টুকরো করে কাটতে হবে। কাজেই, বড় মাপের শোল মাছ হলেই ভালো হয়। নুন, হলুদ মাখিয়ে মাছ, সোনালী করে ভেজে তুলে রাখতে হবে। মাছ আর মুলো মোটামুটি একই মাপের করে কাটতে পারলে ভালো। মাছ ভাজা হয়ে গেলে, ওই তেলেই গোটা শাদা জিরে, চেরা কাঁচালঙ্কা, ফোড়ন দিয়ে, মুলোর টুকরোগুলো দিয়ে ভাজতে হবে। একটু রঙ ধরলে, নুন, হলুদ, আর গুঁড়ো মশলার পেস্ট দিয়ে কষাতে হবে। মশলার সুগন্ধ বের হলে ভেজে রাখা মাছের টুকরোগুলো দিয়ে মিনিট খানেক কষিয়ে জল ঢেলে দিতে হবে। ঝোল গাঢ় হলে, মুলো সেদ্ধ হয়ে গেলে ধনেপাতার কুচি ছড়িয়ে, পাতিলেবু সহযোগে, গরম গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন।

মুলোর পাশাপাশি আলুও দেওয়া যেতে পারে। রান্নায় সামান‍্য টমেটো বা তেঁতুলগোলা দেওয়া যেতে পারে। তবে, তেঁতুল কিন্তু সব্জি সেদ্ধ হলে তবেই দেওয়া যায়। অন‍্যথায়, তেঁতুলের টক সব্জিকে সেদ্ধ হতে দেবে না।




0

সম্পাদকীয়

Posted in








একটি গান কোনও এক বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর অধরাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু একটি বা দুটি গান রচনা করে, সেগুলিতে সুর এবং কন্ঠ দিয়ে একটি সংস্কৃতিতে চিরন্তন জায়গা করে নেওয়া সহজ কথা নয়। ভিড়ের মধ্যে অনায়াসে অনেক অগুনতি মাথার সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতে পারতেন যিনি, সেই সদ্যপ্রয়াত প্রতুল মুখোপাধ্যায় ঠিক এই রকমই এক উদাহরণ হয়ে রইলেন।

তাঁর নিজস্ব অননুকরণীয় উচ্চারণে তিনি যখন গেয়ে ওঠেন, 'পুবের আকাশ রাঙ্গা হল সাথী/ঘুমায়ো না আর' তখন আর এগুলি কোনও গানের পংক্তি থাকে না। রচয়িতা, সুরকার আর গায়কের স্তর ছাপিয়ে জেগে থাকে সচেতন একটি মানুষের অস্তিত্ব।

২০১৬ সালে বব ডিলানকে সাহিত্যের নোবেল প্রদান নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু নোবেল কমিটি তাঁদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। সত্যি বলতে কী, উৎকৃষ্ট কবিতার পরম আশ্রয়েই তো একটি গান হয়ে ওঠে সঙ্গীত। সেই অর্থে গান রচনা তো সাহিত্যচর্চাই!

এ বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি ১২৬ বছর পূর্ণ করলেন জীবনানন্দ দাশ। ঠিক তার দুদিন আগেই থেমে গেল প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের হাঁটা। প্রসঙ্গত দুজনেরই জন্ম অবিভক্ত বঙ্গের বরিশালে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যে অঞ্চলের খ্যাতি সুবিদিত। প্রতুলের মননও কি জীবনানন্দের মতো ছেয়ে নেই সেই অপরূপ প্রকৃতি? শেষ বিচারে তিনিও তাই এক অনন্য ভাষাশিল্পী।

আজ ভাষাদিবসে এই ভাবনা খুব সঙ্গত মনে হল।

সুস্থ থাকুন, দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in






শীত যাচ্ছে, বাজারে শাকসব্জীর দাম ফের চড়তে শুরু করেছে। বাজেটের দিন এল এবং গেল। তাতে সরকারের আয়ব্যয়ের ফিরিস্তির সঙ্গে রয়েছে আগামী বছরের করব্যবস্থা। মানতেই হবে, বাজেটে একটা ঘোষণা চমকে দিয়েছে। যাদের বার্ষিক আয় ১২ লক্ষ টাকা তাদের নাকি এক পয়সা আয়কর দিতে হবেনা। ঠিক করে বললে—বার্ষিক আয় ১২.৭৫ লক্ষ পর্য্যন্ত জিরো আয়কর। পেনসনভোগীদের জন্য লক্ষণরেখাটি ১৩ লক্ষ। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন হল ৭৫ হাজার, এবং পেনসনভোগীদের জন্য এক লক্ষ। ফলে আমার মত পেনসনভোগী এবং আরও অনেকে প্রথমে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করে নিল।

তারপর একটু ভাবতেই কপালে ভাঁজ। পুরনো আয়কর নিয়মেও ৭ লক্ষ পর্যন্ত বার্ষিক আয়ে কর দিতে হত না। তাহলে তাঁরাই লাভবান হলেন যাঁদের বার্ষিক আয় ৭ থেকে ১৩ লক্ষের মধ্যে! ফলে আমার মত লোকের কোন লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে নাকি মধ্যবিত্তের বা মিডল ক্লাস। এখন এই মিডল ক্লাস সংজ্ঞাটি বড় গোলমেলে। কাকে বলব মিডল ক্লাস?

বিগত ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে বাজেট পেশের (২০২৩-২৪) আগে বিত্তমন্ত্রী সীতারামন বলেছিলেন যে মিডল ক্লাসের কষ্ট উনি বোঝেন, কারণ উনিও তাই। কী কাণ্ড! ওঁর মাসিক বেতন তো ২ লক্ষ টাকা, মানে বার্ষিক ২৪ লক্ষ!

তাহলে আয়করে কী ধরণের ছুট দিলে এই মাগ্যি গণ্ডার বাজারে সাধারণ মানুষের একটু সাশ্রয় হত? এই আলোচনা গুছিয়ে করার আগে একটা কথা বলা দরকার।

আমাদের দেশের কাঠামো হল আধুনিক কল্যাণকারী রাষ্ট্রের। আমরা ধরে নিই সরকার আয়ের জন্য বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স আদায় করবে এবং তার উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং অধিকাংশ মানুষের খাদ্য-বস্ত্র ইত্যাদির গ্যারান্টির খাতে। আমাদের আইনের চোখে সব নাগরিক সমান, প্রধানমন্ত্রী বলেন—সব কা সাথ, সবকা বিকাশ।

বেশ কথা। সরকারের আয়ের একটা বড় অংশ আসে আয়করের মত প্রত্যক্ষ কর এবং পণ্য ও বিক্রয় কর (জিএসটি) গোছের অপ্রত্যক্ষ কর থেকে।

সজাগ নাগরিক হিসেবে কর দিতে কোন আপত্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটা দেখা দরকার যে সেই করের বোঝা কাদের উপর বেশি চাপানো হচ্ছে আর সেই আয় সরকার কাদের উপর বেশি খরচ করছেন। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা শুধু করের ভার নিয়ে আলোচনা হবে।

একটা ভুল ধারণা জনমানসে গেড়ে বসেছে—গরীব মানুষ ট্যাক্স দেয় না, শুধু উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত দেয়। গরীব মানুষ কেবল সরকারের থেকে খয়রাত পায়। কথাটা সর্বৈব ভুল। ট্যাক্সো সবাই দেয়। আমির-গরীব সবাই। কীভাবে?

উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত দেয় আয়কর, সম্পত্তি কর জাতীয় প্রত্যক্ষ কর যা প্রগ্রেসিভ। অর্থাৎ সবার জন্য সমান নয়, যার আয় বেশি তার করের অনুপাত বেশি। কিন্তু গরীব মানুষ দেয় বিক্রয় কর—জিএসটি। এই অপ্রত্যক্ষ কর সবার জন্যে সমান। ওষুধ কিনলে, আনাজপাতি কিনলে, দোকান থেকে জিনিস কিনলে প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য উচ্চবিত্ত বা বিত্তহীন সবাইকে সমান জিএসটি হয়—তাই এই ট্যাক্সটি বিষমানুপাতি বা রিগ্রেসিভ।

গত কয়েকটি ত্রৈমাসিকের আর্থিক তথ্যের বিশ্লেষণ বলছে তিনটে কথা—শিল্পোৎপাদনের নিম্নগতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি। তার সঙ্গে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আর একটা কথা—মধ্যম বর্গ বা মিডল ক্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে।

কেন মধ্যমবর্গের কথিত বিলুপ্তি নিয়ে এত চিন্তা?

কারণ মহানগর ও শহরে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা এই মধ্যম বর্গ। দেশের সমস্ত মল এবং বিপণিতে থরে থরে যে পণ্যসম্ভার সাজানো থাকে তার লক্ষ্য প্রধানতঃ উচ্চবর্গ এবং মধ্যমবর্গ বা মিডলক্লাস। হিসেব সোজা; উচ্চবর্গের উপভোক্তার সংখ্যা কম। তারা কিনবে ইম্পোর্টেড ও প্রিমিয়ার আইটেম, মূলতঃ যেগুলো বিলাসদ্রব্যের আওতায় পরে।

মিডিয়ায় এবং সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য এই বিশাল মিডলক্লাস, যার বিকাশ হয়েছে মূলতঃ এই শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের খোলা বাজার নীতির ফলে। মিডলক্লাসকে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন কনজিউমার লোন বা ভোগ্যবস্তু কেনার জন্যে সহজ ঋণ এবং ওভারড্রাফট দিতে ব্যাংকগুলিও মুখিয়ে আছে।

কিন্তু দুটো দশক পেরোতেই কী হয়েছে?

২০২৪ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের সবচেয়ে বড় এফ এম সি জি হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের প্রফিট ৩.৭% কমে গেছে। এফ এম সি জি মানে ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস; এতে অধিকাংশ মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন ব্যবহারের প্যাকেজ করা ভোগ্য পণ্য যেমন সব খাবার জিনিস, প্রসাধন, ঘর পরিষ্কারের কেমিক্যাল, হেলথ সাপ্লিমেন্ট, বাচ্চার ডায়পার সবই পড়ে।

হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের সিইও রোহিত জাভা, নেসলে ইণ্ডিয়ার চেয়ারম্যান সুরেশ নারায়নন, টাটা কনজিউমার প্রোডাক্টসের এবং আইটিসি লিমিটেডের মুখপাত্র সবার একই সুর -- শহরের মিডল ক্লাসের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, তাই বাজারে ডিমান্ড কমছে, ভোগ্যবস্তুর যোগান কমছে এবং দাম বাড়ছে।

কেন দেশের এই দুরবস্থা? বড় বড় করপোরেট ঘরানা বলছে দুটো কারণ।

এক, শহুরে মধ্যমবর্গের ক্রয়ক্ষমতা সমানে কমছে। মুদ্রাস্ফীতি ও করের বোঝার ভারে ওদের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমহ্রাসমান।

দুই, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ পরিশ্রম বিমুখ, খাটতে চায় না।

আমরা দুটো বক্তব্যকেই খুঁটিয়ে দেখব।

মধ্যবর্গ বা মিডলক্লাস কারা?

আমরা বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরের কথা মনে রেখে একাডেমিক বিতর্ক এড়িয়ে একটি খুব সরল আর্থিক সংজ্ঞাকে বেছে নেব। ভারতের সমাজকে আয়ের ভিত্তিতে মোটাদাগের এই বর্গবিভাগটি করেছেন জনৈক ব্যবসায়ী কিশোর বিয়ানী।

উপভোক্তার বর্গভেদ লোকসংখ্যা গড় বার্ষিক আয়

উচ্চবর্গ ১২ কোটি ১২.৩ লক্ষ টাকা

মধ্যম বর্গ ৩০ কোটি ২.৫ লক্ষ টাকা

আবার ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্ল্যায়েড রিসার্চের মতে মিডল ক্লাস হল যাদের পারিবারিক আয় বার্ষিক ২ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ আয়ের লোকজন।

উচ্চবর্গের রয়েছে বিশাল চল-অচল সম্পত্তি এবং শেয়ারে বিনিয়োগ করার মতন বাড়তি আয়। বিদেশ ভ্রমণ এবং বিদেশি বিলাসিতার পণ্য কেনা এঁদের কাছে জলভাত। এঁদের চিকিৎসাও দরকারে বিদেশে হয়। রাজনীতি এবং ক্ষমতার অলিন্দে এঁদের অবাধ এবং মসৃণ যাতায়াত।

মধ্যমবর্গের অধিকাংশ চাকুরিজীবি; রয়েছে নিজস্ব বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট, ছোট গাড়ি, ব্র্যাণ্ডেড জামাকাপড়, উচ্চশিক্ষা, বীমার সাহায্য নিয়ে প্রাইভেট নামী হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে চিকিৎসার সুবিধে, ছেলেমেয়েদের দামী স্কুলে ভর্তি করা, ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া, ভাল রেস্তোরাঁয় মাঝেমধ্যে খাওয়াদাওয়া এবং সামান্য হলেও কিছু আর্থিক জমাপুঁজি যার জোরে সাময়িক আর্থিক এবং পারিবারিক সংকট সামলে নেয়া যায়।

জনসংখ্যার বাদবাকি অংশ, প্রায় ৯০ থেকে একশ কোটি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঘর চালাতে ব্যস্ত। কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৮০ কোটি জনসংখ্যাকে নিয়মিত, এবং প্রায় বিনামূল্যে রেশন পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে এই বর্গভেদকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই কথা বঙ্গের দুয়ারে- রেশন জাতীয় যোজনার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। শুরু হয়েছিল কোভিডের সময়, এখন বাজারের যা অবস্থা তাতে সরকার বাধ্য হয়েছে অমৃতকালে এই ধরণের অমৃত বিতরণের ব্যবস্থা করতে।

এদের কোন জমাপুঁজি নেই। অসুখ হলে যায় সরকারি হাসপাতাল-- যার অবস্থা সবাই জানেন। উত্তর প্রদেশ এবং কোলকাতায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক শিশুমৃত্যুর খবর এখনও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

গরীব মানুষ আলসে?

বড় বড় শিল্পপতি ঘরাণার কথা শুনুন, মনে হবে দারিদ্র্যের আসল কারণ ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব, ওরা অলস।

ইনফোসিসের নারায়ণ মূর্তির বক্তব্য ভারতের চাকরিজীবিদের সপ্তাহে ৭০ ঘন্টা কাজ করা উচিত। আর একজন বিজ্ঞের মতে সপ্তাহের শেষে শনি-রবি ছুটি নাকি পাশ্চাত্য সংস্কার, আরেকজনের নিদান—রবিবারে বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে অফিসে চলে এস।

কিন্তু বাস্তব চিত্রটি কী?

সব বড় কর্পোরেট ঘরানার লাভ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অথচ কর্মচারিদের বাস্তবিক মাইনে কমছে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির দরের চেয়ে কম দরে বৃদ্ধি হচ্ছে—এটাই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের আসল কারণ।

The FICCI-Quess Corp Income Report 2022-23 বলছে “ profit of Indian corporates across six major sectors increased 4 times. Real Salary growth negative”. এর অর্থ গড় মুদ্রাস্ফীতির দর 5.7% , বেতনবৃদ্ধির দর তারচেয়ে বেশ কম।

খোদ ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি নাগেশ্বরন বলছেন-- Corporate profitability has gone up from 5.3 trillion in FY 20 to 20.6 trillion in FY 23. Wage growth has not grown in the same pace.

এক দিকে তো কোম্পানিগুলো সুপার প্রফিট করছে, অথচ কর্মচারিদের মজুরি বেতন ইত্যাদি বাড়াতে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার কেন্দ্রীয় সরকার তাদেরই কর আদায়ে বিরাট ছাড় দিচ্ছে। ২০১৯ থেকেই মোদী সরকার কর্পোরেট ট্যাক্স কমাতে শুরু করে।

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন গোয়াতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে ভারত সরকারের বিত্ত মন্ত্রক Taxation Law (Amendment) Ordinance 2019 আয়কর আইন (সংশোধন) অর্ডিনান্স জারি করে income Tax Act 1961 Finance (nO.2) Act 2019।তাতে দেশি কোম্পানির জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে ২২% এবং নতুন কোম্পানির জন্য ১৫% করা হয়েছে। আরও অনেক সুবিধে দেয়া হয়েছে, উদ্দেশ্য তাতে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে , শিল্পের বিকাশ হবে এবং আম জনতার চাকরি ও রোজগার বৃদ্ধি হবে। এই ছাড় দেয়ায় সেবছরই ভারত সরকারের ১.৪৫ লাখ কোটি আয় কমে যায়। আর শিল্প , রোজগার এবং বিনিয়োগ যে কী বেড়েছে, কোথায় বেড়েছে সেটা এখন সবাই জানেন।

অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী

এটা খেয়াল করার মত যে ২০১৯ সালে সরকারের কর থেকে আয়ের ৫৮.৩% আদায় হত কর্পোরেট ট্যাক্স থেকে। এখন ২০২৩-২৪ সালে সেই প্রতিশত নেমে এসেছে ৪৬.৫% পর্য্যন্ত। অর্থাৎ আয়কর দাতা মধ্যম বর্গ থেকেই সরকারের কর আদায় বেশি হচ্ছে। এবার ১১.৫৬ লাখ কোটি টাকা বা ট্রিলিয়ন আসছে আয়কর থেকে, আর কর্পোরেট ট্যাক্স থেকে ১০.৪২ লাখ কোটি, (অনুমানিত) ২০২৪-২৫।

দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৩% আয়কর দেয়। কিন্তু ওই ৩% থেকে দেশের সমস্ত কর্পোরেট ঘরাণার থেকে বেশি কর দিচ্ছে।

মনমোহন সিং সরকারের সময় সরকারের সমস্ত আয়ের ৩৫% আদায় হত করপোরেট ট্যাক্স থেকে, বর্তমান সরকারের সময় সেটা নেমে ২৬% হয়েছে।

অনেক আন্তর্জাতিক স্তরের অর্থনীতিবিদের মতে ভারতের মত দেশের সরকারের আমদানি আয়করের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়। মধ্যম বর্গ নিজের মাইনে এবং অন্য আয়ের উপর ট্যাক্স দেয়। কিন্তু করপোরেট ট্যাক্স দেবে নিজের আয় থেকে খরচা কেটে শুধু প্রফিটের উপর। দেশের সবচেয়ে বড় দশটি কর্পোরেট ঘরানা ১৯৮২ সাল পর্য্যন্ত লাভের উপর কোন ট্যাক্স দেয় নি। এদের বলা হয় জিরো ট্যাক্স কোম্পানি। এমনকি রিলায়েন্স ৩০ বছর জিরো ট্যাক্স কোম্পানি ছিল, ১৯৯৬-৯৭ সালে প্রথম ট্যাক্স দেয়। তারপর রয়েছে ট্যাক্স-মুক্ত কিছু দেশে শেল কোম্পানি (কাগুজে কোম্পানি) খুলে ট্যাক্স এড়িয়ে যাওয়া।

সাম্প্রতিক কালে পানামা পেপার্স ঘটনায় আদানি পরিবারের বিনোদ আদানির শেল কোম্পানি নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল।

এই পুঁজিবন্ধু নীতির ফলে দেশের বাকি জনতার কী অবস্থা।

অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার মাথাপিছু আয়ের তালিকায় নীচের দিকের ৫০%

জনতার রাষ্ট্রীয় আয়ে ভাগীদারি মাত্র ১৩% , আর রাষ্ট্রীয় সম্পদে অধিকার ৩% এর কম।

এবার দেখা যাক জিএসটি নামক রিগ্রেসিভ ট্যাক্সের বোঝা কার ঘাড়ে বেশি।

একই অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে নীচের ৫০% থেকে জিএসটির ৬০% এর বেশি আদায় হচ্ছে, আর জনসংখ্যার ৪০% যে মধ্যমবর্গ, তাদের থেকে জিএসটি আদায় হচ্ছে ৩৩%, অথচ শিখরে বসে থাকা উচ্চবিত্ত ১০% দিচ্ছে ৩-৪% জিএসটি।

সবার দরকারি জিনিস যেমন ওষুধের ৮০% আইটেমে, জিএসটি ৯% থেকে বেড়ে ১২%, হয়েছে।

এমনকি জীবন বীমা এবং মেডিক্লেমেও জিএসটি ১৫% থেকে ১৮% প্রতিশত!

তাহলে দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ সরকারের থেকে কী পরিষেবা পাচ্ছে? সরকারি স্কুল ও হাসপাতালের মান খারাপ হলেও সাধারণ মানুষ প্রাইভেট স্কুল ও হাসপাতালে যেতে পারে না। রাস্তাঘাট, পরিবেশ দূষণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু এইসব ইস্যুতে বাজেটের কত প্রতিশত খরচের জন্য নির্ধারণ করা হয়? এসব দেখেই যখন সংসদে দিল্লির এক সাংসদ রাঘব চাড্ডা সরকারের দিকে আঙুল তুলে বলেন যে তোমরা কর আদায় কর ইংল্যাণ্ডের মত, অথচ পরিষেবা দাও আফ্রিকার সোমালিয়ার মত, তখন আমরা সায় না দিয়েই পারি না।

বিশ্ব অসাম্য পরীক্ষাগার

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি (ফ্রান্স) তাঁদের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আয়ের কাটাছেঁড়া করে বলেছেন—আয় বৈষম্যের ব্যাপারে ভারত ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে আয়-অসাম্যের দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। গত কয়েক দশকে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগটাই গেছে জনসংখ্যার উপরতলার ১০% এর পকেটে; ঠিক করে বললে তাদের মধ্যেও উপরের ২% এর হাতে।

ফলটা ভালো হয়নি। সাধারণ মানুষের বাস্তবিক আয় কমেছে। বাজারে উপভোগ বস্তুর চাহিদা কমেছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। এই কথাগুলো নানা ভাবে সরকারের বাজেট পূর্ব আর্থিক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনেও এসেছে। কিন্তু বিত্তমন্ত্রীর বাজেটে তার প্রতিফলন কোথায়? পরিকাঠামোতে বড় বিনিয়োগের কথা রয়েছে, তাতে বড় শিল্পপতি এবং সরকার যুক্তভাবে কাজ করবে এবং বার্ষিক ১২ লক্ষ আয়ে আয়করে ছুট—আর কিছু?

শিক্ষা, গবেষণা এবং স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের প্রতিশত প্রতিবছর কমছে।

সবচেয়ে বড় কথা গত একদশকের বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল, যেসব বড় বড় যোজনার কথা বলা হয়েছিল (যেমন, কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ করা, ‘নমামি গঙ্গে’ যোজনা) তার উপলব্ধি -- সে নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য দেখলাম না।

সরকারের বিত্তীয় ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) কম করার দুটো উপায়— করের মাধ্যমে আয় বাড়ানো এবং খরচ কমানো। দেখা যাচ্ছে সরকার আয়করে কর্পোরেট ঘরাণাকে বড় ছাড় দিয়ে জিএসটি বাড়িয়ে জনতার থেকে নিজের আয়ের ভরপাই করছেন। অন্যদিকে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে হাত টেনে রেখেছেন। চিন স্বাস্থ্যখাতে ৭.১৯% এবং গবেষণায় জিডিপি’র ২.৪৩% , ভারত ১.৮৪% এবং ০.৬৫%।

অন্য উপায়?

পিকেটির মতে উপরের সারির বিত্তবানদের বা কর্পোরেট ঘরাণার থেকে চড়া হারে সম্পত্তি/বিত্ত কর আদায়।

শোনামাত্র অনেকে আপত্তি করছেন।

তাঁদের বক্তব্যঃ ভারতের মত দেশে সম্পত্তি/বিত্ত কর (wealth tax) লাগিয়ে লাভ হবে না। এই কর আদায় করতে আয়ের চেয়ে প্রশাসনিক খরচ বেশি হবে।

কিন্তু যাঁরা সম্পত্তি কর চড়া হারে লাগানোর পক্ষে তাঁরা বলছেনঃ এটা অজুহাত। বর্তমান ভারতে আর্থিক এবং বিত্তীয় লেনদেনের রেকর্ড ডিজিটালাইজেশনের ফলে নির্দিষ্ট রেকর্ডের বা কেনাবেচার পাত্তা লাগানো খুব সোজা।

এরসঙ্গে দরকার সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং পরিষেবার উপর জিএসটি হার কমিয়ে দেয়া। কিন্তু বাস্তবচিত্রটি ঠিক কী?

উপসংহার

জিএসটি কাউন্সিলের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর বিত্তমন্ত্রী সীতারমনের প্রেস কনফারেন্স থেকে জানা গেল পপকর্নের তিনরকম জিএসটি ধার্য হয়েছে। সাধারণ মান—৫%, ব্র্যান্ড –১২% ,ক্যারামেল যুক্ত—১৮%

হাসব না কাঁদব?

এদিকে রোজকার চাল-ডাল-আটা-চিনি-ময়দার উপর জিএসটি দিতে হবে, কিন্তু বস্তা যদি ২৫ কেজির বেশি হয় তাহলে কোন জিএসটি দিতে হবে না।

একসঙ্গে ২৫ ২৫ কেজির দ্রব্য কে কিনতে পারে? হাসিম শেখ, রামা কৈবর্ত? আপনি আমি?

তাই এই বাজেটের আগে আমার বিনীত প্রশ্নঃ শাহেনশাহ্‌ , তুমি কোন শিবিরে?
0

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






ভোর রাত্রের একটা দৃশ্য এরকম – একটা ঘরের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসছে রমণ ও শীৎকারের শব্দ। হরিদাস প্রভাতী নাম সংকীর্তন করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে – তার শব্দ। দূর থেকে এগিয়ে আসছে মৃতদেহ কাঁধে শ্মশানযাত্রীর দল। হরিনাম ধ্বনি ও তাদের খোলকরতালের শব্দ। এতো কিছু শব্দ মিলে সেই ভোর রাত্রের যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হলো, তাতেই এই দুনিয়ায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেলো। পৃথিবীর সময় উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করলো। যে মৃত যুবতীটি একটু আগেই কবরে শুয়ে ছিলো, সে জীবিত হয়ে উঠে এলো। ১৯৮০ সাল ১৯৮১র দিকে না গিয়ে এই দুনিয়ার সময় এগোতে লাগলো পেছনে, ১৯০০ সাল বা প্রাচীন পৃথিবীর দিনগুলোর দিকে। আমরা দেখলাম, এখন যে যুবতীটি মৃত, সে বেঁচে উঠেছে, ঘড়ির কাঁটা আরো পেছনে ঘুরতেই সে ধর্মযাজক দ্বারা ধর্ষিতা হচ্ছে! পৃথিবীর সময় আরো আরো পেছোচ্ছে, সোনার দাম কমছে। সেসব দিনগুলোয় আগের মতো দূষণ বা পল্যুশন নেই, সুন্দর একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ। গল্পকারের দারুণ কল্পনাশক্তি, অসাধারণ পরাবাস্তবতা! এমনটাই লেখে সুবল দত্ত - তার ‘সময়-শোধন’ গল্পে। ঘড়ির কাঁটাকে এরকম পিছিয়ে নিয়ে গেলে আজকের মানুষ বুঝতে পারবে তাদেরই সমূহ ভুলভ্রান্তি। সত্যিই তো, নিজেদের সংশোধনের জন্যে আমাদের অতীতের থেকে শিক্ষা নেয়াটা বড় জরুরী। সময়কে পেছনে নিয়ে যেতে যেতে নানা ঘটনা পরম্পরাকে দেখিয়ে দিতে দিতে, এই গল্পের পরিসমাপ্তিতে লেখক ঘোষণা করলো- মানবতার বিরুদ্ধে সমস্ত জটিল কার্যকলাপ মুছে যাচ্ছে। এরপরে শুভবুদ্ধির প্রতিশ্রুতি। পৃথিবীর সময় আবার আগের মতোই সামনের দিকে এগোচ্ছে। দারুন এ গল্প – অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ভাবনা ! এখানেই গল্পকার সুবল দত্তের স্বকীয়তা!
সুবল দত্ত এসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার। মিডিয়া প্রভাবিত দুনিয়ায় বহির্বঙ্গের এই গল্পকারের পরিচিতি অপেক্ষাকৃত সীমাবদ্ধ। যে ব্যপক পরিচিতি ও প্রচার তার প্রাপ্য , তা তিনি হয়তো এখনো পান নি। সুবল দত্তর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৬ নাগাদ। থাকেন জামসেদপুরে। তার জন্ম পুরুলিয়ার মানবাজারে – ১৯৫৫ সালে। পেশায় স্টেট ব্যাঙ্ক-এর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। চাকুরী সূত্রে তাকে বিহার ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়েছে। ওই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের জীবনযাত্রা , ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি বেশ কিছুটা পরিচিত। লেখক জীবনে তার প্রাথমিক আত্মপ্রকাশ কবি হিসেবে। গল্পও লিখেছেন। প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ করা যায়, সুবল দত্ত একজন শিল্পী – তার করা প্রচ্ছদ রয়েছে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্ত জলশব্দে আমি’ তে। এযাবৎ তার দুটো গল্পগ্রন্থ – ‘প্ল্যাগিয়ারিস্ট’ ও ‘প্রদাহবোধ ১১’, যা প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে। তার প্রৌঢ়ত্বে, রিটায়ার-সময়ের কাছাকাছি। সুবল দত্তের বইদুটো হাতে আসার পর তার গল্পের উপর আমার ভীষণ আগ্রহ জন্মায়। তাই আমি চেষ্টা করেছি তার গল্পকে বোঝবার, তাকে নিয়ে সামান্য লেখবার।
‘শৈলী’ পত্রিকার ৪৭তম / কার্তিক-১৪২৬ সংখ্যা এখন আমার সামনেই। এতে প্রকাশিত হয়েছে সুবল দত্তের একটা গল্প – ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’। আমি এই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ি। দেখি - একটা তামিলভাষী ভিখিরি গোছের মানুষ, তাকে বুঝিয়ে বাজিয়ে টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়া হলো, কেনা হলো লোকটার একটা কিডনী, যেটা অপারেশন করে লাগিয়ে নেয়া হলো পয়সায়ালা মালিক মিহির সিং এর শরীরে। সুস্থ হয়ে কিছুদিন বাদে মিহির সিং এক রাত্রে সুপারভাইজেশনে গেলেন তার কারখানায়। তিনি দেখলেন, অবর্ণনীয় বিষাক্ত পরিবেশে রাত্রে লেবার মজদুরগুলো কাজ করে যাচ্ছে। মিহির সিং আরো দেখলেন, ওই মজদুরগুলোর মুখ কিডনী-বেচা তামিল মানুষটার মুখের মতোই! ওই মজদুরগুলোর ‘পেট থেকে উজ্জ্বল লাল রক্তের মত তরল গড়িয়ে পড়ছে’। এই বর্ণনায় পাঠক থমকে যায় – যে মানুষ একজায়গায় কারখানায় তার শ্রম বিক্রি করছে, সেই মানুষ অন্য জায়গায় তার কিডনীটা বিক্রি করছে! যে দেশ, যে ভাষাই হোক না কেন, তাদের চেহারা এক – তারা হলো নিঃস্ব উপায়হীন শ্রমজীবি মানুষ। তাদের সবার জাতও এক। গল্পটা পড়বার পর আমার চোখে ভাসছে সেই ট্রেনযাত্রী সেই ভিখারীগোছের তামিল মানুষটার মুখ, যে মুখ দিয়ে সে অঙ্গীকার করছে তার দাসত্বের, সে তামিল ভাষায় বলছে - ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’ , যার অর্থ হলো ‘আমার যা আছে সব তোমার।’ এই গল্প লেখকের সমাজ ও দর্শণবোধকে আমি আবার সমীহ জানালাম।
এবার সুবল দত্তের প্রকাশিত গ্রন্থদুটো থেকে পড়া কিছু গল্পকে তুলে ধরা যাক। খুঁজে দেখার চেষ্টা করি তার লেখার চরিত্র বা বিশিষ্টতা।
‘বি পি এল’ – গল্পের মূল চরিত্র রজনী নামের লোকটাকে দেখি একটা সাপকে হাতে পিষে ধরেছে , ছোবল খাবার পরও সাপটার মুখ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ওটার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। যেন সাপটা এই সমাজ ব্যাবস্থারই প্রতিরূপ । রজনী ভূমিহীন, ব্যাঙ্ক-ডিফল্টার, ঋণের দায়ে জেলখাটা, একটা সর্বস্বান্ত মানুষ । ওর কাছে গ্রামের মুখিয়া, বিপিএল কার্ড ইস্যু করা বাবু, ঋণদেয়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, অফিসের ক্লার্ক সবাই বিষাক্ত। তাই বিষাক্ত সাপটার সাথে লোকটার খালি হাতে এই লড়াইও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা লড়াই। যাদের পাবার কথা , তারা বিপিএল কার্ড পায় না। হাজার হাজার চালচুলোহীন মানুষ, পথের ভিখিরী, আরোগ্যহীন কুষ্ঠরোগীর দল এই গল্পে উঠে আসে। গল্পের শেষে দেখি ওই সব মানুষগুলো দলে দলে এগিয়ে আসছে, বাহাতের আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে টিপছাপ দিচ্ছে। না কোন দলিলে নয়, কোন কাগজেও না। বর্জিত প্রান্তে পড়ে থাকা একটা বোবা পাথরের দেয়ালে ওরা ওদের আঙ্গুলের নিস্ফল টিপছাপ রেখে যাচ্ছে! সর্বস্বান্ত মানুষদের নিস্ফল টিপছাপ লাগানোর চিত্রকল্পটার মধ্যে গল্পকারের বক্তব্য একটা ধারালো মাত্রা পেয়েছে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে এই গল্পেই তার লেখনীতে উঠে এসেছে কিছু অসাধারণ বর্ণনা। বিবেচকী লাইন – যেমন ‘গরিবের সংসার হোলো বহতা নিকাশির জল। ঝির ঝির বইতে থাকে তো বেশ। থেমে গেলেই পচা নর্দমা।’ কিংবা ‘দূরে পলাশ ডাবরের পলাশ জঙ্গল যেন দিগন্তে এক বিশাল সাঁঝা চুল্‌হা। যেন এই বিশাল উনুনে সন্ধেবেলার রুটি সেঁকা হবে।’
আদিবাসী উন্নয়নের নামে প্রত্যন্ত গ্রামে নেমে আসে সান্নাটা। খনির মালিক, পুঁজিপতিদের চক্রান্ত। এসবের জীবন্ত ছবি ‘একটি শেষ বিরলতম উপজাতির অন্তিম পার্বণ’ গল্পে। লিদরি লুগুন –এর মতো কমবয়সী সমাজকর্মী, সৎ অ্যাক্টিভিষ্টরা স্বার্থন্বেষী সমাজ ব্যবস্থার গোপন চক্রান্তে খুন হয়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নয়ণ! আদিবাসীদের পার্বণে সবাই চুর হয়ে থাকে, হাড়িয়া বা ডিয়েং পানীয়ের নেশায়। সেই পানীয়তে মেশানো থাকে বিষ। একটা গ্রাম, একটা উপজাতি শেষ হয়ে যায় - সেখানে আর বাঁধা দেয়ার কেউ থাকে না। এদেরই জমি লুটে নিয়ে, বন-জংগল দখল করে তৈরী হয় পুঁজিবাদী উন্নয়ণের ইমারত। লেখক খুব মুন্সীয়ানার সঙ্গে এই উপজাতি সমাজ জীবনকে তার গল্পে একেছেন, তুলে এনেছেন দলিত ও পিছিয়ে থাকা সমাজের কথা, তাদের উপর অন্য একশ্রেনীর মানুষের নির্মম শোষনের ইতিকথা।
ছোটগল্পের বিষয় সূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, জীবনের চলমান স্রোত থেকে গল্পকার সংগ্রহ করেন খন্ড খন্ড উপলব্ধি (perception) , সেটাই হয়ে ওঠে ছোটগল্পের প্রাণবীজ। এমনি ভাবেই ছোটগল্পের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে ওঠে চলমান জীবনের সত্য। সুবল দত্ত বিভিন্ন সূত্রে আদিবাসীদের কাছে গিয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে মিশেছেন। তাই তারই সমূহ উপলব্ধি সামুহিকভাবে মিশে থাকে তার লেখা গল্পগুলোয়।
কুষ্ঠরোগীদের জীবনকেন্দ্রিক গল্প ‘শাম্বর বংশবীজ, অর্জুনের দ্বন্দ্ব’ – এই গল্পে মানবজীবনের সাথে সাথে সমাজজীবনের কুষ্ঠদশার বিবরণই উঠে আসে। বিদেশবাসী ডঃ অর্জুন WHO-র তরফে কুষ্ঠরোগীদের সার্ভে করতে দীর্ঘদিন বাদে নিজের দেশে ফিরে আসে। তার নিখোঁজ বাবাকে সে খুঁজে পায় কুষ্ঠরোগীদের আশ্রমে। আমরা জানতে পারি কুষ্ঠজীবনের অসহায় নির্মমতার কথা, তাদের সমাজ-বিচ্যুত আবরুদ্ধ জীবনের কথা, রোগের চিকিৎসায় ওষুধ কোম্পানীগুলোর ধান্ধাবাজীর কথা। সুবল দত্তের গল্প শুধু কাহিনীমাত্রিকই নয়, গল্পের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে চাবুক মারা নানা উপলব্ধি। এখানে নায়ক অর্জুন উপলব্ধি করে, মানুষ যদি জরায়ু ভেদ করে তার মায়ের গর্ভে পুনর্বার ফিরে যেতে পারে – তাহলেই এ পৃথিবী পিচাশমুক্ত হবে। এই গল্পে লেখক শোনায় – ‘ অসমোসিস প্রক্রিয়াতে মিথ্যে সত্যের ভেতরে ঢুকে গেছে।’ গল্পের উপসংহারে দেখি আরো এক চরম উপলব্ধি! দেখি দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কুষ্ঠ সমাজের মানুষজন, পুড়ে যাচ্ছে পচাগলা বিকৃত সময়ের কাহিনী। গল্পের পরিণতিতে বলা হয় – ‘চরম বিকৃতির পর ধ্বংস তারপর শুদ্ধসৃজন হতে বাধ্য।’ গল্পের পাতায় পাতায় এমনি নানা আশ্চর্য, অপ্রচলিত উপলব্ধি পাঠকে অনিবার্য এক দার্শনিকতার মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে দেয়।
সুবল দত্তের সামাজিক অভিজ্ঞতার ফসল - ‘পুনর্জন্ম’ গল্প। এটা আদিবাসীদের জীবন ও সমাজের গল্প। লেখক নিপাট বর্ণনা করছে এক অপ্রচলিত সমাজের জীবন যাপন, তাদের আচার সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ, এমন কি কথাবার্তা। গল্পের পটভূমি পরিচিত গ্রাম-শহরের বাইরে , স্বতন্ত্র তার পরিবেশ। এমনই পরিবেশের একটা মেলা, লোকজনের জমায়েত। সেখানে আদিবাসী মেয়ে লিদরি-র উপর শারীরিক অত্যাচার ও তার প্রতিবাদ। এই বিষয় নিয়েই লেখা ‘পুনর্জন্ম’ গল্পটা!
গতানুগতিক কাহিনীর বাইরে বেরিয়ে এসে কি করে অভিনব কাহিনী লিখতে হয়, তার ট্যাকটিস সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, তার গল্প ‘নিস্তার’। এই গল্পের প্রধান চরিত্র মাতাল মাহাতো একটা অন্ধকার ঘরে দিনভর বাঁধা থাকে। রোগের কারণে তার চোখে দিনের আলো সহ্য হয় না, তার শরীরে ইয়া বড় বড় চুল গজায়। মাসে মাসে মাতাল মাহাতোর বউ সেই চুল কেটে ফেরিয়ালার কাছে বিক্রি করে। সেটা তার পরিবারের আয়। মাতালের বউ মোহিণীর দুসরা আয় নিজের শরীর বেচে, এই শরীর বেচাটাকে সে স্বাভাবিক ভাবেই উপভোগ করে, তাতে কোন রাখঢাক নেই। একটাই মাত্র ঘর, সেই ঘরের এক কোনে অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত মাতাল দেখে তার ভাই থুলকু ও তার বউ মোহিণী শারীরিক যৌন সম্পর্কে দিনের পর দিন জড়িয়ে থাকে। এই দৃশ্য মাতাল মাহাতোকেও যৌনকাতর করে তোলে। মানুষের আরোগ্যের জন্যে রক্ত খাওয়া কি জরুরী ? যৌন সম্পর্কে অপারগ মাতাল মাহাতো তার বউ মোহিণীর যোনিতে জিভ দিয়ে ঋতুশ্রাবের রক্ত চেটে চেটে খায়। মোহিণীও নিজেকে উলঙ্গ করে তার অসুস্থ স্বামীর কাছে নিজের রক্তাক্ত জরায়ু মেলে ধরে! এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশ, নরকীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর যৌনতা, যা কিনা পবিত্র, অথচ অদ্ভুত। এই ‘নিস্তার’ আমাদেরকে অকল্পনীয় গল্পদৃশ্যের মুখোমুখি পৌছে দেয়। মনে পরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক প্রতিবন্ধী যুগল ভিখু-পাঁচির গল্পের পচাগলা অন্ধকারময় জীবনের কথা !
সুবল দত্ত নারীর হৃদয়কে গভীর ভাবে অনুসন্ধান করে তাকে উপস্থাপন করেছে ‘কনফেশন’ গল্পে । এই গল্পের মেয়েটি নার্সস্টাফ, সে পরপুরুষদের সঙ্গে কয়েকবার শুয়েছে, নিজের ঘরে অন্যের সংগে যৌনসম্পর্কের অভিজ্ঞতাও তার আছে। এই পদ্মাবতী তার ডিউটির হাসপাতালের প্রেমিক ডাক্তারটির সাথে অবাধে মেলা মেশা করে, তার সাথে একান্তে অনেক অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। অথচ এই গল্পেরই অভিমুখ হঠাৎ পালটে যায়। একদিন পদ্মাবতীর শরীরকে ভোগ করার জন্য ডাক্তার তাড়িত-কামুকের মতো হাত বাডায়! তখনই উঠে আসে তীব্র অসম্মতি বা নারীর প্রতিরোধ। কারণ পদ্মাবতী ডাক্তারের মধ্যে এতোদিন একজন প্রকৃত প্রেমিককেই খুঁজেছে, তার ভালোবাসার মানুষটির মধ্যে সে কোন ধর্ষক কিংবা সহজলভ্য কামুক পুরুষকে দেখতে চায় নি। হৃদয়ের যে গভীর অনুসন্ধানটি পদ্মাবতীর মধ্য দিয়ে পাঠকদের কাছে পৌঁছায়, তা হলো শারীরিক যৌন সম্পর্কই সব সময়ে বড় কথা নয় , নারীর হৃদয়ও খুঁজে ফেরে কোন প্রকৃত প্রেম, নিটোল কোনো ভালোবাসা।
গল্পটার নাম ‘সেতু’। একটা নদী, একদিকে গরীব, অন্যদিকে বড়লোক। এই নদীর মাথার উপর দিয়ে বিশাল একটা সেতু। যখন গাড়ী যায়, থর থর করে কাঁপতে থাকে ব্রীজটা। নোংরা নদীপারের কাছেই একটা বস্তীতে থাকে কিসকু আর তার বউ। দারিদ্র, ডায়ারিয়া, এনকেফেলাইটিস এসব নিয়েই অপরিচ্ছন্ন জীবন। এই কাহিনী টানটান একমুখী কোন গল্প নয়। এ গল্প যেন পথ চলতে চলতে চোখ মেলে দেখা – এতে উঠে আসে অনেক ঘটনা, জীবনের অভিজ্ঞতা, ভাবনারা। বৃষ্টি, বৃষ্টি - এ গল্পের দ্রুতগামী ঘটনারা আসে এক অতি-বর্ষণের রাতে। চারদিকে জল থই থই। নদীতে জলের স্রোত। এমন অবস্থায় নদীর উপরের সেতুটা ভেঙ্গে পড়ে। এমনি দুর্যোগের সময় কিসকুর বউ জন্ম দেয় একটা বাচ্চার। বানভাসি জল, না ডাক্তার, না অ্যাম্বুলেন্স। কিসকু তার সদ্যোজাত প্রথম সন্তানটাকে জলের ছাট বাঁচাতে একটা ঝুড়িতে ঢাকাঢাকি দিয়ে রাখে। তারপর সদ্যপ্রসবা বউর হাতে হাত, সদ্যোজাত সন্তান ঝুড়িতে – মাথায় তোলা, কিসকু জলের উজান ঠেলে নির্ভয়ে হাটতে থাকে। সে চায় তার প্রজন্মকে বাঁচাতে, নিজেরা বাঁচতে।
গল্প সমাজ ও জীবনের দর্পণ। বর্তমান জটিল জীবনের বিভিন্ন দিক একই গল্পের মধ্যে মিলে মিশে থাকে। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা / নিতান্তই সহজ সরল’ – এটা ছোট গল্পের পরিচয়। অথচ উক্ত ছোট্ট পরিধিতে আজকের ছোটগল্প যে দাঁড়িয়ে থাকবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই। সুবল দত্তের গল্প চিরাচরিত ছোটগল্পের এই সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে গেছে।

কানু ওরাঁওর বাঘের সঙ্গে মোকাবিলার গল্প ‘দৌড়’। গল্পের পটভূমি জঙ্গলঘেরা অঞ্চল - সরায়বিন্দা, বাঘবিন্দা, মহুলটাঁড়। কানু বাঘ মারতে বেরিয়েছে, বাঘেদের ওপর ওর খুব রাগ। জঙ্গলের মধ্যে বিপদজনক অবস্থা কানু যখন বাঘেদের মুখোমুখি হয়, তখন বোঝা যায় তার সামনে বাঘের মতোই উপস্থিত কিছু হিংস্র, উগ্রপন্থী মানুষ এবং নারীও! এই গল্পের বুনোট খুব আকর্ষনীয় – গল্পে বন জঙ্গল আর আদিবাসী পরিবেশের বর্ণনা পাঠকদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
গল্পের রূপবৈচিত্র্য খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কোন লেখা সাংকেতিক বা প্রতীকধর্মী, কোথাও রয়েছে প্রেম আখ্যান, কোথাও মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন। আবার কোন লেখা প্রত্যন্ত আদিবাসী সমাজকে প্রধান্য দেয়। গল্প হতে পারে বস্তনিষ্ঠ, কিংবা কাল্পনিক, অথবা কাব্যিক। কোন গল্পে বিন্যাস ও আঙ্গিক প্রধান্য পায় । গল্পের বহুধাবিস্তৃত বহুমাত্রিকতার দুনিয়ায় সুবল দত্তের সফর অনেকটাই। তবে তার বেশীর ভাগ গল্পেই বিভিন্ন মাত্রা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। কোন গল্পের বিশেষ মাত্রা কি , তা নির্ণয় করা একটু মুস্কিলের কাজ।
তবুও লেখালেখির বৈশিষ্ট্য ও গুনগত-প্রাধান্যের ভিত্তিতে সুবল দত্তের আরো কিছু গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক।


গল্পের বিন্যাস

‘প্রদাহবোধ-১১’ গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি’। এ গল্পটা প্রভু মন্ডলের, যে কিনা মাস্টার অফ ফার্মেসী পাশ, তারই দশ কিলোমিটার পদযাত্রার গল্প। যাত্রাপথের দু’ কিলোমিটার বাদে বাদে গল্পটার এক একটা পরিচ্ছদের নাম দেয়া হয়েছে কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভ, দম্ভ ও মোক্ষ। গল্পের এই বিন্যাস অভূতপূর্ব! এর পরিচ্ছদগুলোয় শুধু যাত্রাপথের বিবরণই থাকে না, আসে প্রভু মন্ডলের জীবন, যৌনতা, নকলি ওষুধ কোম্পানীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ, প্রতিবাদ। এমনকি ব্যক্তি নির্যাতন, সমাজকে মরনের দিকে ঠেলে দেয়ার মতো লোভ, মোক্ষর নামে ভন্ড অসাধু ও ধর্মীয় মানুষদের নিপাত কামনা ও বিদ্রোহ এ গল্পের পরিচ্ছদে ফিরে ফিরে আসে। নকলি ওষুধ বানিয়ে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা কামায় তাদের বিরুদ্ধে এক ফার্মাসিস্টের লড়াই এ গল্পের মূল উপজীব্য হলেও, সুবল দত্তের লেখনী, কল্পনা , বর্ণনাতে এ লেখা একটা সামাজিক বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। আমার বিচারে, অতুলনীয় এ গল্পের বিন্যাস।

গল্পের প্লট

গল্পের নাম – ‘সীতাহার’। ঘুপসি অন্ধকার ঘর। সেখানে থাকে অন্ধ কানামতি। এই অন্ধকার কামরায় যুবতী কাজের মেয়ে, বিলাতিকে আমরা দেখি। সে কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে লড়াই করছে কানা মতিকামারটার সঙ্গে। সে লড়াই কোন যৌন আক্রমণ বা প্রতিরোধের না। কাজের মেয়েটা সোনার সীতাহার চুরি করেছে, এরপর আরো কিছু হাত সাফাই করার জন্যে মেয়েটা আলমারির চাবির দখল নিতে চায়। কানামতি তা বুঝতে পারে। তাই ঘরের মধ্যে ডান্ডাডান্ডি। একদিকে শক্ত সমর্থ বয়স্ক একটা কানা লোক, অন্য দিকে অল্প বয়েসী একটা মেয়ে। অনেক সময় ধরে এই লড়াইএর পর আঘাতে বিলাতি মারা যায়। গল্পের পরিণতিতে জানা যায় ওই সোনার সীতাহারটা বিলাতির বিয়ের জন্যেই সংরক্ষিত ছিলো। গল্পের শেষে থাকে ছোটগল্পের চমক। একটা আবদ্ধ ঘরে নগ্ন যুবতীর সঙ্গে বয়স্ক কানা লোকটার এই লড়াইএর প্লট ও গল্পের আঙ্গিকটা আমাদের চমকে দেয়!

গল্পের কল্পবিজ্ঞান

কখনো কখনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে ঢুকে পরে সুবল দত্তের গল্প। যেমন গল্পে এসেছে একটা বিশাল ক্রিস্টাল পাথর, যাতে বিশেষ কিছু ধাতব পদার্থ, যার গুণে খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত ওই বিশালাকায় ক্রিস্টাল পাথরটা ব্রহ্মান্ডের অন্য গ্রহগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখার ক্ষমতা রাখে। ওই ক্রিস্টাল পাথরটা টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যম। কোন লোক তিহার জেলে আটকে আছে, কিন্তু এই টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যমে তার ত্রিমাত্রিক শরীর ওই পাথরটির উপর হাজির হয়ে আছে [ গল্প - মোতি লাকড়া]। বিজ্ঞানে এমন হয়েছে কিনা জানি না, গল্পকার এখানে অতি আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক কাহিনী ফেঁদেছে। তাতে আমাদেরই পরিচিত মানুষজন, সামাজিক আচার সংস্কৃতি। কেন্দ্রে কল্পবিজ্ঞানের একটা ক্রিস্টাল পাথর – এমনি ভাবেই টান টান সাসপেন্স রেখে আমরা গল্পটাকে উপভোগ করি।
ভূমিকায় উল্লিখিত ‘সময়-শোধন’ গল্পে নানা শব্দ মিলে যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হয়, তাতে যে সব অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটে যায়, তাতেও কল্পবিজ্ঞানের ছায়া থাকে।
 
গল্পের প্রতীক ধর্ম –

সুবল দত্তের গল্পের প্রতীকের ব্যবহার আছে। মানব সংষ্কার, মানবিক আন্দোলন, বই লেখা সৃস্টিশীলতা – এগুলো কি ব্যর্থ সময়যাপন? একজন মানুষ কিংবা লেখকের মৃত্যু ? একটা কালভার্টের নীচে নালি, সেখানে থকথকে কালো পাঁকে পরে আছে একটা অর্ধপ্রোথিত লাশ – লোকটার হাতে ধরা একটা বই , কিংবা খাতা, ধরা যাক ওটা ডায়েরী। গল্পের মধ্যে দেখি লেখা মন্তব্যটা – ‘সংস্কৃতির দেহ নব্বই অংশ পাঁকে ডুবে আছে’ ! ওই ডায়েরীর মধ্যে ধরা আছে বর্তমানের কবিদের শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা, ওরই মধ্যে আছে মৃতবৎ সংস্কৃতির পুনর্জীবনের দিশা। কেউ কি এগিয়ে আসবে এইসব শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা ও সংস্কৃতিকে উদ্ধার করতে? পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মহীন নামে এক কবি ঝাপিয়ে পড়লো নালায়, পাকের মধ্যে। গল্পের শেষে মহীন সেই ডায়েরী উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। এমনি ভাবেই প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে সংস্কৃতি সম্পর্কে হতাশ মানুষকে সজাগ ও উজ্জীবিত করার গল্প ‘একটি অপ্রকাশিত কাব্য-সংকলনের উদ্ধারের কাহিনী’ আমাদের চমকিত করে।
 
চরম বাস্তবতার গল্প

‘বিকলাঙ্গদের কথা’ প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার কথা বলে। প্রথম সন্তান বিকলাঙ্গ, সেইই ওই পবিবারের একমাত্র পুঁজি। বিকলাঙ্গদের খাতায় অসুস্থ ছেলেটার নাম, তা দেখিয়ে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মাসে মাসে টাকা আসে। রোগগ্রস্থ ছেলেটা যখন অসময়ে মারা যায়, তখন ওর বাপ ফর্মে মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে পৌছে যায় ব্যাঙ্কে। অন্তিম কিস্তির টাকাটা যাতে মার না যায়। শোকগ্রস্থ, শ্মশানযাত্রী ভুকলের ক্ষেত্রে এটাই আসল বাস্তব। সেইদিনই বিকলাঙ্গ ছেলেটির আসন্ন প্রসবা মা, ভুকলর বউ, শ্মশানের কাছে ঝোপের আড়ালে একটি সুন্দর ছেলের জন্ম দেয়। ভুকল সবার অজান্তেই, নিজের নবজাত শিশু পুত্রটির একটা পা দুমড়ে মুচড়ে দেয় – যাতে বড় হয়ে এই সন্তানটিও বিকলাঙ্গ হয়েই বেঁচে থাকে। যাতে ভবিষ্যতেও বিকলাঙ্গ খাতায় এই ছেলেটার নাম দেখিয়ে মাসে মাসে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পাওয়া যায়। এই গল্পের অন্য একটা ডায়মেনশনও আছে। পেটের দায়ে ভুকলর বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে শোয়, ভুকল জানে না সদ্যজাত সন্তানটি তার বীর্যের প্রকৃত উত্তরসুরী কিনা? – নাকি তারই বউএর গর্ভে জমিদার ছোট শর্মার সন্তান! এই টানা পোড়েন, এই বাস্তব পরিস্থিতির আলোকপাতে আলোচ্য গল্পটা এসময়ের একটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হয়ে ওঠে।

গল্পে কাল্পনিকতা

সুবল দত্তের ‘বিস্ফোরক’ গল্পে দেখি একটা লোক পালঙ শাকের থলে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সেই ব্যাগের মধ্যে ভরা আছে দুটো জীবন্ত বোমা; যেগুলো যে কোন মুহূর্তেই ফেটে পড়তে পারে! সেই বোমা দুটো ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে! তাদের আলোচনার বিষয় সমাজ, ধর্ম, ইলেকশন, এমনকি মার্কসের তত্বও! ওই লোকটি নিমিত্তমাত্র, বোমাদুটোই সিদ্ধান্ত নেবে কখন তারা ফেটে পড়বে। ওই বোমাদুটোর মধ্যে রয়েছে যাবতীয় মানবিক গুনাগুন। গল্পের মধ্যে বোমাকে দিয়ে কথা বলানো, লেখকের এই কাল্পনিকতায় আমরা চমকে যাই!
আরেকটা গল্প ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’- এতে বাংলাভাষা প্রেমী এক লেখক হাসপাতালের নির্জন কক্ষে শুয়ে আছে। লোকটা নাম সুবল দত্ত, লেখক নিজেই। বাংলা ভাষা চর্চার ভবিষ্যত নিয়ে লোকটা চিন্তিত। অতি আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে সময় এগোতেই লোকটা তার কল্পনায় আবিস্কার করে তার বেডের চারপাশে আরো অনেক কবি লেখক সাহিত্যিকদের মুখ। কে নেই সেখানে। অশোক মিত্র, বারীন ঘোষাল, কাজল সেন, সমীর রায়চৌধুরী, অজিত রায় – এমন কি স্বয়ং মহাশ্বেতা দেবীও তার বিছানার চার পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাদের সবার মুখে এক একটা করে বেলুন ফুলে উঠতে থাকে – সেইসব বেলুনগুলো থেকে বেরিয়ে আসে অজস্র অক্ষর – উঠে আসে বাংলা ভাষার জয়গান। সুবল দত্ত গল্পে এমনই এক কাল্পনিক আবহ তৈরী হয়, কল্পনার কলমে সে লিখে ফেলে বাংলাভাষাকে উজ্জীবন করার আরোগ্যকথা।

গল্পের পরাবাস্তবতা ও যাদুবাস্তবতা

আধুনিক গল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজম। পরাবাস্তব ও যাদুবাস্তব উভয়ক্ষেত্রেই যাদু ও বাস্তবতার মিশেল থাকে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোস-এর লেখায় এর প্রচুর উদাহরণ আছে। এবার আসা যাক সুবল দত্তের লেখায়।
তার ‘অন্তর্জলি’ গল্পের একটা দৃশ্য – ‘মনে হলো পুরো পুকুরটাই মস্তবড়ো আগুনের গোলা। …… ততক্ষণে জলে প্রচুর লোক নেমে গেছে। …… নাভিজলে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের সবার প্রচন্ড প্রদাহ। নানা রকমের কষ্ট ও দৈন্যতাগুলি ভিন্ন ভিন্ন রঙের অগ্নিশিখা হয়ে তাদের সারা শরীর পোড়াচ্ছে …… ।’ এই বর্ণনাটা পুকুরের মধ্যে খাটে বসানো এক মৃতমুখী মহিলা ও তার ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের দৃশ্য। এখানে হিংসা, ক্রোধ, ভয়, উৎকন্ঠা নিয়ে জড়ো হয়েছে জনতারা – সারা পুকুরটাই যেন মস্তবড়ো আগুনের গোলা হয়ে গেছে। আমরা দেখি পরাবাস্তবতার সফল প্রয়োগ।
‘অমূর্ত’ গল্পের দৃশ্যে দেখি যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া! এখানে শিল্পীর ছবি আঁকার ব্রাশ স্থির, অথচ ক্যানভাস উঠছে, নামছে, সরছে। কোন এক অমূর্ত অদৃশ্য শক্তির চালনাতেই নির্মিত হচ্ছে শিল্প, আঁকা হয়ে যাচ্ছে ছবি, চিত্রমালা। দর্শক নিখিলেশ কিংবা ছবি আঁকে যে ছোট্ট ছেলেটা তারা অনড়, স্থির। গল্পকার এখানে যে বার্তা দিতে চান, তা হলো শিল্পের ক্ষেত্রে এই অদৃশ্য সত্ত্বাটাই মুখ্য – সে কখন যে কাকে দিয়ে কি আঁকিয়ে নেবে তা কেউ জানে না!
 
গল্পের মধ্যে কাব্যকথা

বিপত্নীক বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে স্বামীর ঘরে গোলাপিকে পাঠিয়েছে। তার জীবন দুর্বিষহ! নির্জন জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপি। সে দেখছে, চারাপোনা ব্যাঙাচির ঝাঁক ভারি জলের ভিতর থেকে একটুকরো রুপালি আলো টেনে তুলছে। এই গল্পে একটাই চরিত্র, একজন যুবতীর জলের চোরাপাকে ডুবে আত্মহত্যা করার গল্প। চারপাতার এই গল্প ‘সলিল সমাধি’। এই আলোচ্য গল্পটির কাব্যরূপ আমাদের মনে চিরন্তন হয়ে থাকবে। গদ্যের মধ্যে এমন কাব্যিক আবহ সুবল দত্তের কলমে অনায়াসেই চলে আসে। এটাই তার লেখার গুন!

গল্পের অসাধারণ কিছু টুকরো দৃশ্য

অদ্ভুত অদ্ভুত সব দৃশ্য কল্পনা সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই উঠে আসে। গল্পকারের ছোট ছোট এক একটা লাইন বা কয়েকটা লাইনের বর্ণনা আমাদের চমকে দেয়! কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক,মোতি লাকড়া লোকটা ‘ লিঙ্গতে দড়ি বেঁধে মাল বোঝাই টেম্পো টেনেছে’। [গল্প - মোতি লাকড়া]
‘মরার হাতের টিপছাপ নিয়ে ভুকল টাকা তুলতে এসেছে’। বিকলাঙ্গ মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে সত্যি কেউ কখনো ব্যাঙ্কের থেকে টাকা তোলার কথা কল্পনা করেছে কি?[ গল্প – বিকলাঙ্গদের কথা]
সিঙ্কু নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ করার শাস্তি দিচ্ছে, অকল্পনীয় পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে ধর্ষককে শাস্তি, তার বর্ণনা ‘সিঙ্কু মনোযোগ সহকারে ছুড়ি দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেছিল। লোকটা …… জেগে রয়েছে কি অজ্ঞান বোঝা যায় না। একটু দূরে উইঢিবি ভেঙে ফেলে সেই ঢিবি তার পেটে চাপিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে অজস্র উইপোকা বেরিয়ে তার উন্মুক্ত প্রস্রাবনালীর ভিতর দিয়ে ধুকতে লাগল।’ [গল্প – অন্তর্জলি ]
গুরুদেবের নির্দেশে নিজের মৃতপ্রায় স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের আয়োজন যেভাবে সিঙ্কু যে ভাবে করছে, তা আমার ভাষায় এরকম। - একটা খাট পুকুরের জলে পাতা হয়েছে। পায়াগুলো জলে কিছুটা ডুবে রয়েছে। সিঙ্কুর স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটাকে সেই খাটে রাখা হলো। মৃতপ্রায় দুটো মানুষ , একজন অপরাধী , অন্যজন নিরপরাধ - তারা খাটে বসে আছে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে। ওরা তখন পারলৌকিক শান্তিকামী। এমন অন্তর্জলি যাত্রার বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে আরো আছে কিনা, আমি জানি না। [গল্প – অন্তর্জলি ]
গল্পের শুরুটা এমনি ‘ উঠোনের বাইরে পুটুসের বেড়া। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সেখানে পেচ্ছাপ করতে গিয়ে একটা হলদে তীর পেচ্ছাপের উল্টো স্রোত বেয়ে সমীরণের তল পেটে বিঁধল’। [ গল্প – শূন্যতাবোধ]
ইত্যাদি।
সুবল দত্তের গল্পে অনায়াসেই ঢুকে থাকে জীবনের গূঢ় তত্ব, অদ্ভুত দার্শনিকতা। দিগন্ত প্রসারী তার কল্পনাশক্তি। তার লেখার বিন্যাস ও আঙ্গিক অসাধারণ। তার গল্পের প্লটগুলোও অসামান্য। আমরা দেখেছি গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠকদের নিয়ে যায় অপরিচিত কোনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে। আবার কখনো কখনো তার গল্প হয়ে ওঠে কবিতা। গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠককে আটকে রাখে অসীম কল্পনার দিগন্তহীন জগতে। আদিবাসী প্রত্যন্ত সমাজ সংস্কৃতি ও সাম্প্রতিক সভ্যসমাজ – এ দুটোই তার পরিচিত বিষয়, তাই তার লেখা বৈচিত্রময়। এই লেখকই কখনো চরম বাস্তবতাবাদী, - তারই কলমে বেরিয়ে আসে ‘বিকলাঙ্গদের কথা’, প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার ইতিহাস। আমরা দেখেছি তার গল্পে পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজমের সফল প্রয়োগ।
সব কিছু মিলিয়েই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সুবল দত্ত তার গল্পে বহুমাত্রিকতার সফল স্বাক্ষর বহন করেছেন এবং এসময়ের তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তার লেখার স্টাইল এ সময়ের বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, সম্প্রতি মার্চ – ২০২০তে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মঞ্চে সুবল দত্তকে প্রদান করা হয় ‘একমাত্র সাহিত্য সম্মান-২০১৮’। আমি আশা করবো বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যে এই বিশিষ্ট গল্পকারের গল্প আরো বেশী বেশী পঠিত হোক এবং আলোচিত হোক। তিনি শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকুন। আমি চাই তার গল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার। ভবিষ্যতেও তিনি সক্রিয় থাকুন। আমাদের দাবী, সুবল দত্ত এমনি আরো অনেক অনেক ভালো ভালো গল্প আমাদের উপহার দিন।



[প্রবন্ধটি ধানবাদের একটা কাগজে ২০২০ সালে প্রকাশিত]
0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in





কে কোথায় কতবার গেছেন বা কত দিন থেকেছেন, তার ওপর পারিপার্শ্বিকতা ও সেই মানুষের জীবন যাত্রার যাপনের কথাবার্তা নির্ভর করে না।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো দিন আফ্রিকাতে যান নি, কিন্তু তিনি চাঁদের পাহাড়ের মতো অসামান্য একটি লেখা লিখেছেন যা শুধু বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম সম্পদ।

থাক সেসব প্রসঙ্গ।রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন।ত্রিপুরার মহারাজাদের হৃদ্যতা, হৃদয়ের শব্দ, আন্তরিক আহ্বান কবিকে মুগ্ধ করেছিল এবং কবি কোথায় যেন ত্রিপুরার সঙ্গে এক অদৃশ্য ডোরে বাঁধা পড়েছিলেন, না হলে সেই সময় পরাধীন ভারতবর্ষে যখন অখণ্ড ভারতের ত্রিপুরার সঙ্গে অখণ্ড বঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই

ভালো নয়, তার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বারেবারে ঘুরে ঘুরে এসেছেন ত্রিপুরায় এবং এখানকার রাজাদের আনুকূল্যে তিনি বসবাস করেছেন এখানে।এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, বইপত্র আছে। সেসব আমরা জানি। ফলে নতুন করে এই ব্যাপারটা নিয়ে বলার কিছু নেই।বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাতবার ত্রিপুরায় আসার কথা বলেছি।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন এই যে তিনি সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন তাতে ত্রিপুরার কী এল,কী গেল? তাতে ত্রিপুরার মানুষ, ত্রিপুরার ভূপ্রকৃতি, ত্রিপুরার যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, যা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বর্ধিষ্ণু তার কী এল গেল?

এখন কথা হল যে একজন কবি যিনি আন্তর্জাতিক মাপের এবং একই জাতীয়ও। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক না হলে জাতীয় হওয়া যায় না।অনেক লেখকই আন্তর্জাতিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে আন্তর্জাতিক বোধ ও চিন্তা তা বারবার প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর লেখার মধ্যে,বিশেষ করে প্রবন্ধের মধ্যে তিনি নিজের আন্তরিক চেতনা ও চৈতন্য তুলে ধরেছেন।যেকথা বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথের বার বার ত্রিপুরায় আসার কারণ ত্রিপুরার মানুষের অসম্ভব আতিথ্য এবং অতি যত্ন আত্তি তিনি পেয়েছেন।কিন্তু তাঁর কথা সাধারণ মানুষের কী কাজে লেগেছে? এখন আমাদের কথা হলো একজন বড় লেখক, কবি, সাহিত্যিক একেবারেই নির্দিষ্ট কারওর নন, আবার নিজেরও নন।তাঁর নিজস্ব গতি এবং চলন তাঁর জীবনের সূত্র ধরে তাঁকে অন্য পথে নিয়ে যায়।এবং তিনি সেই পথে চলতে থাকেন এবং চলতে চলতে দুপাশে কখনও পাহাড়ি গোলাপ, কখনওবা বন্য সৌন্দর্য, কখনও কেয়ারী করা মনোরম বাগান।কখনও বা অতি দীর্ঘ বাগিচা দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তার সুগন্ধে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাঁর স্বভাব কৌতূহলে, স্বভাব সৌন্দর্য মুগ্ধতায় তিনি ঢুকে পড়েন সেই বাগানের মধ্যে,সেখানে থাকে অনেক আনন্দ,অনেক মায়া, কায়া, জীবন যাপনের গান।রবীন্দ্রনাথ সেই গানে অবগাহন করেছেন এবং নিজে নিজে সেই সঙ্গীতের যে সুর ও মূর্ছনা তাকে আত্মীকরণ করেছেন এবং তাকে ধরেই অনেকটা পথ অতিক্রম করেছেন।আবার নতুন বাঁকে তিনি ঘুরে গেছেন এবং ঘুরে গেছেন বলেই তাঁর সাহিত্য এবং সৃষ্টি, ছবি আঁকা এবং অন্যান্য কাজ শান্তিনিকেতন তৈরি করা, শ্রীনিকেতন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে কতখানি প্রাসঙ্গিক? এর উত্তর দিতে গেলে এক সমুদ্র জিজ্ঞাসা এবং এক হিমালয় উত্তর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। এর উত্তর খুব সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিঃশ্বাসেই জড়িয়ে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রশ্বাসে জড়িয়ে আছেন।যেমন একজন ভক্ত,আস্তিক মানুষ যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁর যে ইষ্ট মন্ত্র, তাঁর যে জপা এবং অজপা মন্ত্রযান,তা যেমন তাঁকে নিয়ে যেতে থাকে কোনো এক অপার্থিব সুরলোকে, তেমনি একইভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী তিনি মার্কসবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন,তিনি গান্ধীবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন কিংবা অন্য যেকোনো দর্শনে বিশ্বাস রাখতে পারেন এবং সেই দর্শনের যে মূল কথা সেই দর্শনের যে মূল বাণী, সেই দর্শনের যে সমাজ বিপ্লব অথবা অহিংসার পথে এগিয়ে যাওয়ার যে কথাবার্তা, তাকে তিনি আত্মীকরণের মাধ্যমে নিজের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং একজন প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী এবং সংগঠক তাঁর কাজ করে যান সারাজীবন। কখনও বিপ্লবের স্বার্থে, কখনও অহিংসার স্বার্থে, কখনও গ্রাম পুনর্গঠনের স্বার্থে,কখনও আরও কোনো দার্শনিক স্বার্থে।রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে এমনই এক দর্শন কাব্য, তাঁর লেখা পড়লে পরে যে দার্শনিক অভিঘাত, যে দার্শনিক ব্যঞ্জনা, যে দার্শনিক জিজ্ঞাসা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে বারবার তাঁর নাটকে,তাঁর প্রবন্ধে, তাঁর ছোট গল্পে, তাঁর উপন্যাসে,তাঁর গানে। তিনি সর্বত্রগামী। সব কিছু লিখেছেন ,এবং অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। আমরা জানি বা পড়েছি বহু নবজাতক বা নবজাতিকার নামকরণ তিনি করেছেন। তিনি পরাধীন দেশে গ্রাম উন্নয়নের জন্যে শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতন তৈরি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনকে করেছেন আন্তর্জাতিক বিদ্যাচর্চা এবং সারস্বত চর্চার অন্যতম জায়গা।পাশাপাশি শ্রীনিকেতন হয়ে উঠেছে আমাদের গ্রামীণ শিল্পকলা এবং শিল্পকর্মের যে প্রতিভূ তাকে স্পষ্ট করার জন্য কোনো এক সংগঠন।সম্পূর্ণ স্বদেশী চিন্তায়, স্বদেশী ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ এই পথে এগিয়েছেন, আবার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আলো, পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও বোধ,চীন, জাপানের যে দার্শনিক চিন্তা, ইরাণও পারস্যের যে বিবিধ শিল্প সৌকর্য, ইউরোপের কারিগরি প্রভাব ইত্যাদি প্রভৃতি তিনি ভারতে প্রয়োগ করেছেন।পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি বাগিচা চর্চা বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন বিদেশে।এমন নানা কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, যে কীকরে মানুষ ভোর চারটের সময় উঠে রাত্রি বারোটা একটা পর্যন্ত কাজ করতেন।বিনিদ্র চোখে তিনি জেগে থাকেন সাধারণ মানুষের জন্য,গ্রাম উন্নয়নের জন্য,গ্রাম পুনর্গঠনের জন্য,তিনি জেগে আছেন মানুষের কল্যাণের জন্য জন্য,মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য।সেখানে কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই,সেখানে কোনো রাজনৈতিক কাঠামো নেই,রাজনৈতিক বন্ধন নেই। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবত স্বতন্ত্র মানুষ। তার বন্ধন যা আছে তা দেশের বন্ধন। সে মানব বন্ধন। রবীন্দ্রনাথ একজন মুক্ত স্বাধীন মানুষ হিসাবে বারবার বারবার দাঁড়িয়েছেন মানুষের পক্ষে।

তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের হিজলি জেলে গুলি চালনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা হিজলি জেলে বিপ্লবীদের হত্যা করেছিল।জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি পথে নেমেছেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। তখন তিনি প্রচুর গান লিখেছেন ১৯০৫ সালে,গান গেয়েছেন,নিজে পথে নেমে সকল মানুষকে একসঙ্গে সংগঠিত করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন।ব্রিটিশদের অত্যাচারে, দেশবাসীর যন্ত্রণায়, দেশবাসীর যাতনায়, দেশবাসীর রক্তক্ষরণে, নিহত দেশবাসীর মৃত মুখ তাঁকে বারবার আঘাত করেছে।তিনি পরদিন নাইটহুড পরিত্যাগ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর।

আমরা জানি ছবি আঁকা একটা বিরাট পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে তা করে গেছেন ষাটোর্ধ বয়সে। মনে রাখতে হবে তাকে ইদানীং তথাকথিত 'অতি বিজ্ঞ' গবেষক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে রবীন্দ্রনাথ আসলে 'রঙকানা' বা 'কালারব্লাইণ্ড।' কিন্তু একজন মানুষ যদি 'রঙ কানাই' হয় তাহলে তিনি কীভাবে এই সংস্থাপন আলো-ছায়ায়,কালো-সাদায়, রঙে নির্মাণ করলেন আমাদের সামনে। আমরা জানি তার সেই চুম্বন নামের বিখ্যাত ছবিটির কথা।যেখানে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে চুম্বনের আভাসে রয়েছেন এমন কথা ইতিহাস বলে। বিচিত্রগামী লেখক তিনি।তিনি দেবতার গ্রাসের মতো কবিতা লিখছেন।লিখছেন দুই বিঘা জমির মতো কবিতা,আবার লেখেন তোমার শঙখ ধুলায় পড়ে আছে নিয়ে তিনি লিখছেন এমন কোনো লাইন। তিনি লিখছেন 'জানি মোর কবিতা হয় নাই হয় নাই সর্বত্রগামী।'এই যে আফসোস, এই যে হাহাকার, তা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। ঐকতান পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ এই কথা লিখেছিলেন।

আমরা কি মনে রেখেছি রবীন্দ্রনাথকে? প্রাত্যহিকতায় ত্রিপুরার মানুষ, পশ্চিম বাংলার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, যারা বাংলা ভাষায় অন্তত কথা বলেন,লেখেন, তারা কি মনে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে? না কী শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণের মলাট লিখন এক ধারাবাহিক পূজা পদ্ধতি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখে গেছেন 'তোমায় পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।'কিংবা 'তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলে যে যাই'।এই যে নিজেকে দেখতে পাওয়া, নিজেকে নিজের আয়নায় আবিষ্কার করা, তা একজন বড় মাপের দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব।

আমরাও তো তাঁকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়েছি কী? আজকে যখন সমস্ত পৃথিবী দীর্ণ হিংসায় জর্জরিত। 'যখন নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস' এই লাইন কী অমোঘ হয়ে আসে না? কিংবা যখন তিনি বলেন 'আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনিই লীলার তব- এই যে তুমি এবং আমি।এটা কী?

আমাদের অনুভূতিতে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়, পূজা পর্যায়,স্বদেশ পর্যায় বলে আলাদা কিছু হয় না।'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে' বনে এটা কী প্রেমের গান না প্রত্যাখ্যানের গান? কিংবা এইটা নি বিরহের গান না কী প্রাত্যহিক যন্ত্রণার গান, মিলনার্তির গান? যে যন্ত্রণা নিয়ে আমরা সকালবেলা উঠি মেঘার্ত আকাশ থাকলে আকাশকে মনে হয় মেঘ মলিন কোনো ছাদের কার্নিশ। সেই রকম এক মনন নিয়ে যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের গানে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তাঁর ছবিতে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তার নাটকে প্রবেশ করতে থাকি, তখন মনে হয় জীবন কী আসলে এরকম? কিংবা জীবন কী আসলে এরকমই? জীবন কি আসলে এরকমই হওয়ার কথা ছিল? বা হওয়ার কথা ছিল না?

রক্তকরবী নাটকে রঞ্জন, নন্দিনী, বিশু পাগল, অধ্যপক, রক্তকরবীর মালা নন্দিনীর গলায়, তা কি কোনো স্বপ্নিল উচ্চারণ না কী কোনো প্রেমার্তি? না কী তা আসলে বিদ্রোহের সামগ্রিক শোষণ, সামগ্রিক সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের একক জেগে থাকা।রাজা অথবা রক্তকরবী অথবা মুক্তধারা আমাদের বারে বারে জীবন ও বিবিধ বিষয় নিয়ে সতর্ক করে দেয়, যা আজও আধুনিক প্রাসঙ্গিক।

ফলে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমরা কিছুই ভাবতে পারি না।আমরা বাতাস দেখতে পাই না,কিন্তু অনুভব করতে পারি, বাতাস আছে।যখন বুকে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, তখন আমরা বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করি।ঠিক তেমনি আমাদের জীবনে যখনই দুঃখ কষ্ট অনুভব করি, নানাভাবে পর্যুদস্ত হই,তখনই আমরা রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হই।রবীন্দ্রনাথ আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

আমরা যখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পড়ি তখন আমরা সাংস্কৃতিকভাবে সাংস্কৃতিক চেতনা ও চৈতন্যে রাজনৈতিক চেতনা ও ভাবনায় ভয়ানক যাতনায় পরি,তখন একেবারে অন্তিম দশা যেন উপস্থিত হয় আমাদের সামনে, তখন রবীন্দ্রনাথ প্রায় 'সর্বরোগহর' মালিশ এবং ওষুধ হিসাবে আমাদের সামনে আসেন।আমাদের বিশ্বাস সভ্যতা যতদিন থাকবে, যতদিন মানুষ কথা বলবে,যতদিন মানুষ প্রতিবাদ করবে,গান করবে,যতদিন মানুষ সজাগ থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, জেগে থাকবেন,আমাদের হৃদস্পন্দন হয়ে। জীবন ও আধ্যাত্মিকতা, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা, জীবন ও প্রকৃতি চেতনা সব মিলিয়ে এক অন্যন্য সাধারণ ব্যাক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের প্রণাম।আমাদের জীবনের ভালোবাসা, বিরহ, বেদনা, বিচ্ছেদ,সুখ,আনন্দ,দুঃখ, সব কিছুইতেই রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই,রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছেন।তিনি এসেছেন বলে ত্রিপুরার মানুষ যেমন তাঁকে ভালোবেসে খুশি হয়েছেন তেমনি নিজেদের সমৃদ্ধও করেছেন।ত্রিপুরার মানুষ এমনিই অসম্ভব আথিত্য পরায়ণ তাঁরা। তাঁরা জানেন মানুষকে ভালোবাসতে,মানুষকে আপন করে নিতে।মানুষকে বুকের কাছে,বুকের মধ্যে টেনে নিতে। তাঁরা স্বার্থপর নন।তারা স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে অনেক কথা,অনেক উচ্চারণ করতে পারেন,যা অনেকেই পারেন না।সে ত্রিপুরার রাজা বা প্রজা যেই হোন না কেন।আমরা কাউকে ছোট করছি না।কিন্তু ত্রিপুরার মানুষের এই আতিথ্য বোধটুকু অসামান্য, অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ তাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

চির ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ।তিনি ত্রিপুরার মানুষের এই ভালোবাসাটুকু টের পেয়েছেন।এবং পেয়েছিলেন বলেই ত্রিপুরার আকাশে,বাতাসে রবীন্দ্রনাথের কাছে ত্রিপুরার মানুষের কন্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের রচনায়,রবীন্দ্রনাথের লেখায়, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনায়, রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে বার বার উঠে এসেছে।ফলে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় সাতবার এসেছিলেন বলে ত্রিপুরা ধন্য।আবার প্রকারান্তরে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথও খানিকটা ধন্য হয়েছেন এই ত্রিপুরার মাটিকে স্পর্শ করে।ত্রিপুরার মানুষের প্রেম ও ভালোবাসা প্রীতি পেয়ে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন ত্রিপুরার মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, এবং তিনিও ত্রিপুরার মানুষ, প্রকৃতি, আকাশ বাতাসের মতো রাজাদেরও ভালোবাসতেন।রবীন্দ্রনাথ এসে ত্রিপুরাকে ধন্য করেন নি।করা সম্ভব নয় কিন্তু আমাদের কারও কারও জীর্ণ পর্ণ কুটিরের সামনে দিয়ে যদি একদিন কোনো এক প্রবহমান স্বর্ণালী স্রোত বয়ে যায়, যে স্রোতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবন চর্যার আশ্চর্য মোহময়তা। তাকে দেখে কী আমরা মুগ্ধ হব না? অথবা আমরা যারা দেখতে পাই নি তাঁকে, তাঁরাও কি বালির মধ্যে খুঁজে বেড়াই না? তাঁর মুছে যাওয়া পায়ের ধ্বনি। সেই স্বর্ণময় স্রোতের অস্তিত্ব মুখে মুখে কি গল্প-কাহিনি ছড়ায় না? তিনি এসেছিলেন।তিনি এসেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে।'এই যে জানায়ে যাওয়ার কথা সেকথাই হয়তো ফুটে থাকে আমাদের মনের ঘরে। আমাদের চিন্তায়, চৈতন্যে, সাংস্কৃতিক ফসলে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকেন।সকাল বেলা আমরা যারা সাহিত্য,সংস্কৃতি ও মনন চর্চা করি তাদের কথা বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের অনেক লাইন মানুষকে ভরসা দেয়। সকাল বেলা থেকেই মানুষকে মনুষ্যত্ব জাগরণের যে অভিশ্রুতি তা রবীন্দ্রনাথই দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের যে গান, সে গানের লাইন সকাল থেকে গড়াতে গড়াতে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা থেকে রাত্রির দিকে চলে যায় নক্ষত্র স্নান সারতে থাকে, আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক চেতনায় উপস্থিতির জন্য দুঃখে,সুখে আনন্দে, বিরহে,বেদনায় প্রেমার্তিতে, অসফলতায়, সাফল্যে রবীন্দ্রনাথ যেন বা কোনো মহীরুহ সম।তাঁর সেই লাইন- 'আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব।' এই যে আমাকে অশেষ করছ মানে কী? আমার জীবনকে, আমার উচ্চারণকে তুমি অশেষ করেছ।চিরজীবী করছ, মানে এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছুই চিরজীবী নয়। কিন্তু তবুও তাঁর এই গানের কথা,তাঁর এই ছোট গল্পের লাইন,তাঁর এই ছবির কথা,নাটকের কথা, আমরা যখন কোনও ভাবে না কোনও ভাবে মনে করি, তখন আমাদের মধ্যে একটা অন্য ধরনের উন্মেষ তৈরি হয়।'স্ত্রীর পত্র' পড়তে পড়তে আমরা মৃণালের যে যন্ত্রণা, তা সোচ্চার নারীবাদ না হলেও মৃণাল যেভাবে একজন স্বাধীন নারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং মাখন বড়ালের নাম চিহ্নিত গলিতে আর সে ফিরে যাবে না, এই কথা যখন সে উচ্চারণ করে, তখন আমরা বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের হৃদয় স্থবিরতায় অথবা 'ছুটি' গল্পে যখন ফটিক এক বাঁও মেলেনা, দুবাঁও মেলেনা তখন আমরা বুঝতে পারি মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান 'অতিথি' নামক আখ্যানে তারাপদকে তিনি যাত্রা করেন নতুন কোনও এক অভিযাত্রায়।।ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে জীবন উচ্চারণ, নিঃশ্বাস গ্রহণ নিঃশ্বাস পতন সম্ভব নয়।