0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


১১

বের্নহার্ড এখনও চার্লসের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানে না। তবুও তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে প্রাণপণে নিজের বিস্ময় এবং বিরক্তি গোপন করবার চেষ্টা করে যায়। তাছাড়া তার রেওয়াজের সময় অর্ধেকের বেশি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চার্লসের মত এক সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষ কেন তাকে বিশ্বাস করে এত ব্যক্তিগত কথা বলে চলেছে সে একেবারেই বুঝতে পারছে না। এদিকে চার্লস একেবারেই লক্ষ্য করছে না যে বের্নহার্ড অধৈর্য হয়ে উশখুশ করছে। সে বিরতিহীনভাবে নানা কথা বলে যাচ্ছে। এমন ভাবে বলছে যেন এই কথাগুলো এই মুহূর্তে সে শুধুমাত্র বের্নহার্ডকেই বলতে পারে। তার এখন এক সহমর্মী বন্ধু না হলেও, নিদেনপক্ষে একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা প্রয়োজন। ‘কারণ’ সে বলে… ‘আপনি বুঝতেই পারছেন যে আমি একবর্ণ বানিয়ে বলছি না। আমি তো আগাগোড়া আন্তরিক থাকতেই চেয়েছি, কিন্তু এই মুহূর্তে তো সেটাও সম্ভব নয়, তাই না?’ তার মানে সে বলতে চাইছে যে কাউকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে সে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে, মানে তাকে কেউ ঠকিয়েছে। অর্থাৎ সে নিজের কাহিনী একটা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু করেছে। অথচ সে যে সত্যি বলছে, অর্থাৎ তার নিজের যে কোনও দোষ নেই, সেটা বের্নহার্ডের কাছে প্রমাণ করবার কোনও সুযোগ এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। কিন্তু গতকাল তার সঙ্গে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে; ফলে সে একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই ঘটনা হয়তো সে নিজের মধ্যেই গোপন রাখতে পারত, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে আবার অনেকগুলো অতীতের সূত্র আছে। সেই সূত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনাগুলো আবার বেশ দীর্ঘ। সেই পুরো ইতিহাস না বললে বের্নহার্ড কিছুই বুঝতে পারবে না। আবার যাদের নিয়ে এসব ঘটনা, তাদের কাউকে বের্নহার্ড চেনে না। ফলে সবকিছু খুলে না বললে ব্যাপারটা একেবারেই বোধগম্য হবে না।



অবশেষে চার্লস একটু ঠিকঠাক বাক্য গঠন করে কথা বলতে শুরু করে এবং একেবারেই থামতে পারে না সে। সে ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে কথা বলে যায়। বের্নহার্ড মৃদু হাসে তার দিকে তাকিয়ে। সে এই প্রথম হাসল চার্লসের দিকে তাকিয়ে এবং হাসির মধ্যে কোনও মেকি, সাজানো ব্যাপার নেই। তার মনে হল যে যদি সে একটু কষ্ট করে কথাগুলো শোনে, হয়তো তাহলে চার্লসের কষ্টটা একটু লাঘব হবে। সে সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করে, ‘ঠিক কী হয়েছে?’ একটু সামনে ঝুঁকে বসে সে, যাতে বোঝা যায় যে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে সে সব কথা শুনছে। বের্নহার্ডকে চার্লস যেন অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চায়। কথা বলতে বলতে সেও ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপরে। বের্নহার্ডের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে প্রায় তার মুখে মুখ ঠেকে যায়।

‘আপনি আমার বন্ধু’ সে ফিসফিস করে, ‘ওঃ, আমার মনে হচ্ছে যে আপনি আমার বন্ধু হতে চাইছেন, তাই না?’

বের্নহার্ডের একটু অপ্রস্তুত বোধ হয়; যদিও এই ভিনদেশি ছেলেটির আবেগ তাকে স্পর্শ করে, কিন্তু এই আবেগের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ভাসিয়ে নেবার মত গতি আছে, যেটা তার ততখানি পছন্দের নয়। সে মৃদুস্বরে চার্লসের দিকে না তাকিয়েই বলে “Mais oui – soyez tranquille, je vous en prie, soyez tranquille!” (মাই উই— সইয়ে ত্রংকিল, জেভোসেঁপ্রি, সইয়ে ত্রংকিল) যার অর্থ হল ‘কিন্তু হ্যাঁ, শান্ত হোন, দয়া করে শান্ত হোন!’



চার্লস উঠে দাঁড়ায় তার দু’হাত আলোকিত টেবিলের উপরে রেখেই। তার হাতের আঙুলগুলো সরু সরু হলদেটে, বিশ্রী হাতের নখ।

‘ওঃ’ হঠাৎ তার কণ্ঠস্বরে একটু উদাস ভাব আসে, ‘ভাববেন না যে আমি আপনাকে খুব নাটকীয় কোনও গোপন কথা বলব। আমি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি। তাই না? মাপ করবেন। আসলে অনেক সময় আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমি যথেষ্ট শিক্ষিত নই আপনার মত! গতকাল যা ঘটেছে, তার জন্য আমার দুর্বল শিক্ষাদীক্ষা দায়ী; নাহলে হয়তো ওই ঘটনাটা এড়ানো যেত। আপনার জানা আছে আশা করি যে আমার ধূমপানের অভ্যেস আছে। আসলে এটা ঠিক নেশা নয়, কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার সময়ে আমার ধূমপান করা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এই অভ্যেসটা ছাড়তে পারছি না। এটা ভাল নয়, কারণ খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু একটা গোটা সন্ধ্যা যদি ধূমপান না করে থাকতে হয়, তাহলে সেটাও আমার পক্ষে কষ্টকর। না, কষ্টকর নয়, বিষণ্ণ, ওঃ না, বিষণ্ণ সঠিক শব্দ নয় এক্ষেত্রে। বরঞ্চ বলা চলে যে আমার অস্থির লাগছিল, কিছু ভাল লাগছিল না, কী যেন খুঁজছিলাম আমি… জিভের মধ্যে একটা বিশ্রী স্বাদ… সবার সব কথার উত্তরে কটু কথা বলেছি আমি। গতকালের ব্যাপারটা কতকটা এইভাবেই শুরু হয়েছিল। আমরা বন্ধুরা রবার্টের সঙ্গে বসেছিলাম। রবার্টের কাছে কোনও সিগারেট ছিল না। ওইখানে আরও দুটো মেয়ে ছিল, ওরা গান গায়, ওরা বলল যে ওদের সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য হয় না। তো… সেইজন্য আমি সিগারেট কিনতেও যেতে পারছিলাম না, যদিও আমার কাছে পয়সা ছিল (আসলে গতকাল ফাঁকেতালে আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে অনেক আগের ধার দেওয়া টাকাটা ফেরত পেয়েছিলাম।)। কিন্তু মেয়েদুটো যে সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেনা, এটা একেবারে বাজে কথা… কারণ প্রতি সন্ধ্যায় আমি ওদের ঘন ধোঁয়ার মধ্যে বিবি বারে বসে ড্রিঙ্ক করতে দেখি। যাকগে, কে আর প্রমাণ করতে যাবে যে ওরা গায়িকা টায়িকা কিচ্ছু নয়, বরঞ্চ একেবারে সাধারণ অসফল বার গার্ল। কারণ ওরা যদি সফলই হবে… তো ওরা যেটা নয়, নিজেদের সেটা প্রমাণ করবার কোনও দায় থাকত না। মিছে ভান করত না তাহলে!’

চার্লস নিজের সঙ্গেই রাগতস্বরে কথা বলে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরে ঘৃণা এবং অবজ্ঞা ঝরে ঝরে পড়ছে। বের্নহার্ডের অবাক লাগে। সিগারেট খেতে না পারা কিম্বা ওই মেয়েদের আপত্তি, যারা গায়িকা হতে পারে কিম্বা হতেই পারে বার গার্ল… ধূমপান না করা কিম্বা ওই মেয়েদের সফল হওয়া… এইগুলোর মধ্যে কোনওটাই এমন উগ্র আচরণের কারণ হতে পারে না।

চার্লস বের্নহার্ডকে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করে হিংস্রভাবে বলে ওঠে… ‘আপনার এত অবাক হবার মত কোনও কারণ ঘটেনি। আপনি জানেন না যে সারা সন্ধ্যা একঘেয়ে ধরনের মুখে পেইন্ট করা মেয়েদের পাশে থাকা কতখানি বিরক্তিকর, তাদের বোকা বোকা কথা শুনে যাওয়া, সর্বোপরি তাদেরই আপত্তির কারণে সিগারেট না খাওয়া… পুরো ব্যাপারটাই বিশ্রী এবং বিরক্তিকর। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে মেয়েগুলোর কণ্ঠস্বর কতখানি বোকা বোকা এবং অসহ্য! আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। অতিকষ্টে নিজেকে সামলেছি। অবশ্যই আমি চলে আসতে চেয়েছিলাম (ফিরে এলেই ভাল হত!); কিন্তু আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আপনাকে বুঝতে হবে গোটা ব্যাপারটা। সারাদিন স্কুলে, তারপর সন্ধেবেলায় এইসব… নিজেকে স্পঞ্জের মত মনে হচ্ছিল আমার।’

‘আপনি ঘুমোতে চলে গেলেন না কেন?’

-‘আমার রবার্টের সঙ্গে থাকবার কথা ছিল। আপনি বুঝবেন না, কিন্তু ব্যাপারটা খুব প্রয়োজনীয় আমার কাছে। রবার্ট একটু অদ্ভুত ব্যক্তি এবং আপনি যদি তার বন্ধুবৃত্তে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে একটা সন্ধ্যাও রবার্টের সঙ্গ ছাড়া চলবে না আপনার। অনেকের সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। হতে পারে যে ওইখান থেকে নানা যোগাযোগ হল ভবিষ্যতে কাজকর্মের ব্যাপারে। যদিও এখন এসব আমার কাছে অতীত… অবশ্যই অতীত। আমি সেখানে আর যাচ্ছি না। আপনি জানেন জেরাল্ডের উপরে ঐ রোমানিয়ান নেকুপুষুর কতখানি প্রভাব? কিন্তু আপনি তো আবার জেরাল্ডকে চেনেন না।’



বের্নহার্ড গভীরভাবে ভাবতে থাকে। জেরাল্ড নামটা সে এর মধ্যেই শুনে ফেলেছে। এই নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার সঙ্গীতশিক্ষকের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তিনি তাকে তাঁর বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওঁর ভিজিটিং কার্ডটা এখনও আছে তার কাছে। কিন্তু সেই জেরাল্ড চিকিৎসক, একজন নামকরা শল্যচিকিৎসক। চার্লস যার সম্বন্ধে বলছে, হয়তো তিনি অন্য কোনও ব্যক্তি।



(চলবে)

0 comments: