0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








দেবযানী অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। দেবযানীর জীবনের প্রেম পূর্ণতা লাভ করে না। কচ ও দেবযানীর জীবনের ব্যর্থ প্রেমের এক বেদনা বিধূর উপাখ্যান শোনাতে চাই। দেবলোকের আচার্য বৃহস্পতি ছিলেন দেবতাদের পরম পূজনীয়। অন্যদিকে অসুর সম্রাজ্যে পূজনীয় ছিলেন আচার্য শুক্রাচার্য। বৃহস্পতি পুত্র কচ ও শুক্রাচার্যের বিদূষী পরমা সুন্দরী কন্যা দেবযানী। দেবতা ও অসুরের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকতো। দেবতাদের সাথে যুদ্ধে যে সকল দৈত্য নিহত হতেন শুক্রাচার্য তাঁর সঞ্জীবনীমন্ত্রের সাহায্যে তাঁদের জীবনদান করতেন। বৃহস্পতির এই বিদ্যা জানা না থাকার কারণে তিনি নিহত দেবসৈন্যকে জীবিত করতে পারতেন না। এই মন্ত্র জানার জন্য দেবতাদের অনুরোধে বৃহস্পতি তাঁর পুত্র কচকে শুক্রাচার্যের কাছে পাঠান। কচ শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এক হাজার বৎসর তাঁর গৃহে অতিবাহিত করেন। এই সময় কচ ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করে গুরু শুক্রাচার্য এর সেবা করেন।তিনি গুরুকন্যা রূপসী তরুণী দেবযানীর সান্নিধ্যও আসেন। এক সময় দেবযানী কচের প্রতি আকৃষ্ট হন। ঘটনাক্রমে তা ভালোবাসায় পরিণত হয়। দেবযানী কচকে ভালোবেসেই বারবার দৈতদের কবল থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন তিনি তাঁর বাবা শুক্রাচার্যকে বলে। একসময় দৈত্যরা কচের অভিসন্ধি জানতে পারেন। সেই কারণে, দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহকে খণ্ড খণ্ড করে কুকুরের খাবার হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য তাঁকে জীবিত করেন। এরপর দৈত্যরা কচকে দ্বিতীয়বার হত্যা করলেও দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য আবার কচকে জীবিত করেন। তৃতীয়বার দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহ ভস্ম করেন। এরপর উক্ত ভস্ম মদের সাথে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে পান করান। দেবাযানীর পুনঃপুনঃ অনুরোধে তিনি আবার কচকে জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এইবারে শুক্রাচার্য দেখলেন কচ জীবিত হলে তাঁর পেট চিরে বের হবে। তাই তিনি উদরস্থ কচকে প্রথমে সঞ্জীবনী মন্ত্র শেখালেন। এরপর মন্ত্রবলে কচকে জীবিত করলে, কচ শুক্রাচার্যের পেট থেকে বের হন, কিন্তু শুক্রাচার্য মারা যান। এরপর কচ, শুক্রাচার্যকে জীবিত করেন। এরপর আরো পাঁচশত বৎসর শুক্রাচার্যের আশ্রম থেকে কচ স্বর্গে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এই সময় শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী তাঁর কাছে প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু কচ গুরু-কন্যা বিবেচনায় দেবযানীকে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সাথে তিনি জানালেন যে তাঁরা দুজনই শুক্রাচার্যের শরীরের অভ্যন্তর হতে জাত, সেই কারণে দেবযানীর সাথে তাঁর সম্পর্ক দাঁড়ায় ভাই-বোন। ক্ষুব্ধ দেবযানী কচকে অভিশাপ দিলেন যে, তিনি যে সঞ্জীবনী বিদ্যা অর্জন করেছেন, তা কার্যকরী হবে না। কচ পাল্টা দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন যে, দেবযানীর অন্তরের ইচ্ছা পূরণ হবে না। কোন ব্রাহ্মণ বা ঋষিপুত্র তাঁকে বিবাহ করবেন না। এরপর কচ স্বর্গে চলে যান। ইনি অভিশাপের কারণে নিজে কখনও এই বিদ্যার সুফল পান নি। তবে তিনি যাঁদেরকে এই বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা ফললাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর " বিদায় অভিশাপ" কাব্য নাটকেকচের মুখ দিয়ে অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। এই বলে
কচ: আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে । । ভুলে যাবে সৰ্ব্বগ্লানি বিপুল গৌরবে । রবীন্দ্রনাথে "বিদায় অভিশাপ " তার এই বর বাস্তবে দেবযানীর কপালে জোটেনি।আগের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। কচ শেষে দেবযানীর কাছে এসে প্রার্থনা করলেন নিজের দেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে। দেবযানী বিষণ্ণ হলেন। কচকে ডেকে তাকে বিবাহ করতে অনুরোধ করলেন। কচ একথায় বিস্মিত হলেন। কারণ গুরুকন্যা তার কাছে ভগিনীর সমান। দেবযানী বললেন – তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমার জন্যই তুমি বার বার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছো। এখন আমায় এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কচ চিন্তিত হলেন। তিনি দেবযানীকে বোঝাতে চাইলেন। দেবযানী কচকে বললেন
--হায় সখা, এ তো স্বগর্পুরী নয়। পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মর্মমাঝে, বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে,
লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারম্বার ফিরে
মুদ্রিত পদ্মের কাছে। হেথা সুখ গেলে
স্মৃতি একাকিনী বসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
শূন্যগৃহ--হেথায় সুলভ নহে হাসি।
যাও বন্ধু, কী হইবে মিথ্যা কাল নাশি--
উৎকণ্ঠিত দেবগণ।
যেতেছ চলিয়া ?
সকলি সমাপ্ত হল দু কথা বলিয়া?
দশশত বর্ষ পরে এই কি বিদায়? কচ বললেন,আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয় সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময় বাহিরে তা কেমনে দেখাব।
দেবযানী--জানি সখে,
তোমার হৃদয় মোর হৃদয়-আলোকে
চকিতে দেখেছি কতবার, শুধু যেন
চক্ষের পলকপাতে; তাই আজি হেন
স্পর্ধা রমণীর। থাকো তবে, থাকো তবে,যেয়ো নাকো । সুখ নাই যশের গৌরবে।
দেবযানীর আঁকুতি ব্যক্ত করলেন--
হেথা বেণুমতীতীরে মোরা দুই জন
অভিনব স্বর্গলোক করিব সৃজন।'
কচ--নহে, নহে দেবযানী।
'দেবযানী প্রশ্ন --নহে? মিথ্যা প্রবঞ্চনা! দেখি নাই আমি মন তব? জান না কি প্রেম অন্তর্যামী?
বিকশিত পুষ্প থাকে পল্লবে বিলীন--
গন্ধ তার লুকাবে কোথায়? কতদিন
যেমনি তুলেছ মুখ, চেয়েছ যেমনি,
যেমনি শুনেছ তুমি মোর কণ্ঠধ্বনি,
অমনি সর্বাঙ্গে তব কম্পিয়াছে হিয়া--
নড়িলে হীরক যথা পড়ে ঠিকরিয়া
আলোক তাহার। সে কি আমি দেখি নাই?
ধরা পড়িয়াছ বন্ধু, বন্দী তুমি তাই
মোর কাছে। এ বন্ধন নারিবে কাটিতে।
ইন্দ্র আর তব ইন্দ্র নহে । কচ-
শুচিস্মিতে,
সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে
এরি লাগি করেছি সাধনা ?
দেবযানী কচের কথার প্রতিবাদ করে প্রশ্ন করলেন--
বিদ্যারই লাগিয়া শুধু লোকে দুঃখ সহে
এ জগতে? করে নি কি রমণীর লাগি
কোনো নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি
করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে
প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত? হায়,
বিদ্যাই দুর্লভ শুধু, প্রেম কি হেথায়
এতই সুলভ? সহস্র বৎসর ধরে
সাধনা করেছ তুমি কী ধনের তরে
আপনি জান না তাহা। বিদ্যা এক ধারে,আমি এক ধারে-- কভু মোরে কভু তারে চেয়েছ সোৎসুকে; তব অনিশ্চিত মন
দোঁহারেই করিয়াছে যত্নে আরাধন
সংগোপনে। আজ মোরা দোঁহে এক দিনে আসিয়াছি ধরা দিতে। লহো, সখা, চিনে যারে চাও। বল যদি সরল সাহসে "বিদ্যায় নাহিকো সুখ, নাহি সুখ যশ! দেবযানী কচকে বোঝালেন অতীত বছরগুলোতে উভয়ের নষ্টালজিক প্রেমময় অনুষঙ্গের কথা। বললেন তাঁকে দেবলোকে ফিরে না গিয়ে তাঁকে বিয়ে করে থেকে যেতে।
কচ দেবযানীর অনুরোধ উপেক্ষা করে বললেন –দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। তোমার যেখানে উৎপত্তি, শুক্রাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী। অতএব আর ওরূপ কথা বলো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ করো, সাবধানে আমার গুরুদেবের সেবা করো।
একথা শুনে দেবযানী ক্রোধিত হলেন। তিনি অভিশাপ দিলেন, নারী হয়ে তিনি বারবার অনুরোধ করলেন কচ তাও কথা রাখলেন না। তাই তার পিতার কাছ থেকে কচ যত বিদ্যা শিখেছেন সব নিষ্ফল হবে। ও বাক্যে কচ ব্যাথিত হলেন। বললেন, বিনা অপরাধে তাকে দেবযানী এত বড় অভিশাপ দিলেন। কামে উত্তেজিত হয়ে তিনি কচকে অভিশাপ দিলেন। কচ ঠিক করলেন তাকেও শাপ নিতে হবে।কচ দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ শুক্রের কন্যা হয়ে তাকে ক্ষত্রিয়ের স্ত্রী হতে হবে। দেবয়ানী ও কচের প্রেম পূর্ণতা পেল না।

সূত্র: মহাভারত। উদ্ধৃতি রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ।

0 comments: