0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২১.১

সাত সকালে গোটা গাঁয়ে খবর চাউর হল যে পুলিস জোগনাথকে গ্রেফতার করেছে। সবাই অবাক,

ব্যাটা জোগনাথ তো বৈদ্যজীর লোক। ওকে ছুঁতে পুলিসের হিম্মৎ হল? গ্রামের গুণ্ডার দল এবং

ভালোমানুষ –সবাই ঘাবড়ে গেল। গুন্ডাদের চিন্তা—যখন বৈদ্যজীর খাস আদমীকে পুলিস ছেড়ে কথা

কয় নি, তো আমরা কিসের খয়ের খাঁ! ভালোমানুষের দল ভাবল—পুলিস যখন নিজেদের লোকের সঙ্গেই

এমন করেছে, তখন সময় খারাপ হলে আমাদের সঙ্গেও কী করবে , কী না করবে -কে জানে!

পুলিশের সমস্ত গ্রেফতারি বেশ নাটকীয় হয়, এটাও ব্যতিক্রম নয়।

এটা না বললেও চলে যে ব্যাপারটাকে নাটকীয় করে তোলার সমস্ত কৃতিত্ব পুলিশের। দারোগাজীকে

পড়ানো হয়েছিল যে বিপদজনক আসামীদের ধরতে উপযুক্ত সময় হল রাতের চতুর্থ প্রহর। তাই

জোগনাথকে ধরার জন্য ব্রাহ্মমুহুর্তই ঠিক হল--- যদিও সারাদিন জোগনাথকে গ্রামের মধ্যে

খোলাখুলি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এবং তাকে থানায় ডেকে এনে আটকে রাখা খুব সহজ।

ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ পুলিস এসে জোগনাথের বাড়ি ঘিরে ফেলল। এটা জানা কথা যে এখানে

গোলাগুলির কোন সম্ভাবনা নেই। তাই সব পুলিসের হাতে রাইফেল! দারোগাজী তাঁর পিস্তলে গুলি ভরে

হেড কনস্টেবলের কানে কানে বললেন—কানপুর থেকে একদল বদমাশ কাল এদিকে এসেছে। হতে পারে

ওরা জোগনাথের ঘরে লুকিয়ে আছে।

হেড কনস্টেবল—হুজুর, কানপুর থেকে যারা এসেছে ওরা আচার্য ভাবের ভুদান আন্দোলনের

কার্যকর্তা।

‘ওটাই তো’, দারোগাজী ফুসফুস করে বললেন,’ আগেকার দিনে বদমাশেরা সাধুর বেশ ধরে ঘুরে বেড়াতো,

আজকাল অন্য বেশ ধরেছে’।

সমস্ত সিপাহী প্রথমে বজরঙ্গবলীর নাম জপল, তারপর বৌ-বাচ্চার মুখ মনে করল। অবশেষে

হাতিয়ার তুলে বদমাশের দলের সঙ্গে মুখোমুখি হতে এগিয়ে চলল। সবাই নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে তৈরি,

সবার প্রাণ ধুকপুক করছে।

বাড়ি ঘেরাওয়ের পর বড় বড় পদক্ষেপ নেয়া হল। সমস্ত সেপাই খৈনি না ডলে, বিড়ি না খেয়ে পজিশন

নিয়ে পাথরের মূর্তির মত আধঘণ্টা অপেক্ষায় বসে রইল। কেউ হাসে নি, কেউ কাউকে হাসায় নি।

একজন সেপাই জুতো খুলে বুকে হেঁটে সবার কানে কানে মন্তর দিতে লাগল—ধৈর্য ধর, কোন বিপদের

সম্ভাবনা নেই।

সবাই অভিজ্ঞ, জানে যে বিপদ কারও মুখের কথায় কাটে না। তাই সবাই বিপদের মধ্যেই ঘাঁটি গেড়ে

বসে রইল। দারোগাজী পিস্তল নিয়ে এবং হেড কনস্টেবল রাইফেল হাতে জোগনাথের দরজায় দাঁড়িয়ে।

একটা লোক গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে হেড কনস্টেবল ইশারায় ডাকল, কাছে এলে কানে কানে

প্রশ্ন করল,--পালাচ্ছিলে?

ও পালটা জবাব দিল—পালাবো কেন? সাতসকালে আপনাদের মুখদর্শন করার থেকে রেহাই চাইছিলাম।

দারোগাজী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন—স্‌ স্‌ স্‌!




হেড কনস্টেবল—এই বারান্দায় বসে পড়। সাক্ষী দেবে।

ও বলল, --এখানে বসার কী দরকার? কাল, পরশু, তরশু যেদিন ইচ্ছে খবর দেবেন। এসে সাক্ষী দিয়ে

যাব। আমি আপনাদের পর তো নই।

ও কেটে পড়ছিল। হেড কনস্টেবল ফের ওর কানে কানে বলল,--ঠিক আছে, যাও। কিন্তু খবরদার!

আমরা যে এখানে রয়েছি সেটা কাউকে বলবে না।

ও হেড কনস্টেবলের কানে নিজের নাক ঢুকিয়ে বলল—বলার কী আছে? গোটা গাঁ জেনে গেছে।

লোকটা চলে গেল। ঘরের পেছনে ওত পেতে বসে থাকা সেপাইদের এবার বিড়ি-খইনির নেশা চাগাড় দিচ্ছে।

প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে। একটু দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ পেছনের সারির

সেপাইদের কানে এল খড় খড় শব্দ। কেউ বোধহয় বাইরের দরজাটা খুলছে। চটপট কথাবার্তার আওয়াজ

ভেসে এল। এরা বুঝে গেল –ধর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের লগ্ন এসে গেছে। এরা বন্দুক ও

সঙীন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।




ওদিকে দরজার কাছে কথাবার্তার স্বর আরও দ্রুত লয়ে চলছে এবং ক্রমশঃ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সেপাইয়ের দল শরীরের ভেতর এক অস্বস্তি বোধ থেকে ছটফট করে কাশতে লাগল এবং প্রত্যেক

কাশির সঙ্গে শরীরের সমস্ত ছিদ্র থেকে পবন-মুক্তাসন! একটু পরে কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স এল।

বিপদ সংকেতের সিটি বেজে উঠতেই এরা দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। সেখান থেকে দৌড়ে পঞ্চাশ

গজ দূরের আমবাগানে। একেবারে নাটকীয় পরিস্থিতি!

ওরা দেখল-- জোগনাথ মাটিতে বসে আছে। দারোগাজী ওর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছেন। হেড

কনস্টেবল অন্যদিক থেকে সঙীন উঁচিয়ে রয়েছে। স্টেজে ব্লকিং হিসেবে দারুণ। শুধু ড্রপসিন নামাটাই

বাকি। সেপাইয়ের দল এসে দ্রুত কম্পোজিশন বদলে দিল। ওরা জোগনাথের শরীরের যতটুকু ভাগ

পিস্তল সঙীনের নিশানা থেকে বেঁচে রয়েছে সেখানে কব্জা করল। জোগনাথের একটুদূরে একটা বদনা

উলটে পড়ে আছে। পাশের খানিকটা জমি জলে ভেজা। দারোগাজী একটা সেপাইকে হুকুম করলেন—“ ওই

লোটা বাজেয়াপ্ত কর, প্রমাণ পেশ করতে কাজ দেবে”।

সেপাই বদনা তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারিফের সুরে বলল—মোরাদাবাদী পিতলের লোটা! তারপর কী

ভেবে বলল—সীল লাগিয়ে দিই?

--এখন না, পরে হবে’খন।

সেপাই লোটার জল পড়ে ভিজে যাওয়া জমি দেখতে দেখতে বলল—‘ওই মাটিও খানিকটা তুলে নিয়ে রাখি?

এটাও প্রমাণ হতে পারে’।

হেড কনস্টেবল ধমকে উঠল—বেশি চালাকি কোর না। যতটুকু বলা হয়েছে ততটাই কর।

দারোগাজীর হুকুমে জোগনাথকে দাঁড় করানো হল। ওর শরীর সার্চ করা হল। ফের বেয়নেট খাপে ঢুকে

গেল, পিস্তল চামড়ার হোলস্টারে। সেপাইদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হল।

একজন বলল-- ‘এ ব্যাটা বোধহয় সাতসকালে পেট সাফ করতে মাঠে গিয়েছিল।




দ্বিতীয়—কে বলতে পারে, হয়ত কাছাকাছি কোন বদমাশের দল আস্তানা গেড়েছে। ওদের খাবার এবং

জলটল দিতে গেছল।

তৃতীয়—এবার বৈদ্য্যজী ঝামেলা পাকাবেন।

চতুর্থ নীচুগলায় বলল—বৈদ্যজী এখন দারোগাজীর পকেটে; এবারের রেইড কাপ্তান সাহেবের হুকুমে

হয়েছে।

পঞ্চম—চুপ! চুপ! ওদিকে দেখ, কেমন তামাশা জমেছে।

জোগনাথ নিজের জায়গায় কোন লোকনৃত্যের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে ও নাচবে না।

হঠাৎ দারোগাজী ওর গালে জোরদার থাপ্পড় লাগিয়ে বললেন—লোটা নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল?

আঘাত সামলাতে ও খানিকক্ষণ চোখ মিটমিট করল। তারপর দারোগাজীর চোখে চোখ রেখে

বলল—আমাকে টুকরো করে কেটে ফেললেও উকিল না আসা পর্যন্ত কিস্যু বলব না।

দারোগাজী হেড কনস্টেবলকে বললেন—ব্যাটাকে হাতকড়ি লাগিয়ে নিয়ে চল। এখন ওর ঘরের

খানাতল্লাসি নেয়া দরকার।

‘একে জেরা করাও দরকার’, হেড কনস্টেবলের মন্তব্য।




পুরো ঘটনার বিবরণ দারোগার মুখ থেকে শুনতে চাইলে উনি যেমন বলবেনঃ

আজ থেকে আট দিন আগে গাঁয়ে চোর এসেছিল। পুলিস গ্রাম-রক্ষা-সমিতির সাহায্যে ওকে ধরার চেষ্টা

করেছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, চালাক চোর দলের একজন স্থানীয় লোককে ছেড়ে

দিয়ে অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায়। পুলিস ও গ্রাম-রক্ষা সমিতির সক্রিয়তার ফলে ওর অপরাধ করার

প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু দলের স্থানীয় লোকটি গ্রাম জুড়ে চোর নিয়ে চেঁচামেচির ফাঁকে গয়াদীনের

বাড়িতে হাত সাফ করতে ঢুকে পড়ে।

গ্রাম রক্ষা সমিতির হাঁক শুনে গয়াদীন পরিবারের সবাই জেগে ওঠে। তখনই কেউ দেখতে পায় যে

একজন সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাচ্ছে। পুলিস হাওয়ার বেগে পৌঁছে যায়, কিন্তু লোকটা বেমালুম হাওয়া। এই

সময় গয়াদীন পুলিসের হাতে চুরি হওয়া গয়না-অলংকারের লিস্টি ধরিয়ে দেয়। জায়গাটাতে ভাল করে

খোঁজাখুঁজি করে পুলিস চলে যায়। ফের পনের দিন ধরে কড়া তদন্ত চলতে থাকে। শেষে পুলিস এই

সিদ্ধান্তে পৌঁছয় –হ্যাঁ, গয়াদীনের ঘরে সেই রাতে চুরি হয়েছে বটে! শুধু তাই নয়, যে চটপট সিঁড়ি ভেঙে

ছাদে চড়ছিল সে চোর না হয়ে যায় না!

তারপর গুপ্তচরের থেকে পুলিস জানতে পারল যে জোগনাথ পিতা রামনাথ, সাকিন শিবপালগঞ্জের ঘরে

এমন কিছু গয়না আছে যা গয়াদীনের বাড়ির হলেও হতে পারে। পাকা খবর পাওয়ায় আজ ভোর ভোর

পুলিস ওর ঘরে পৌঁছে যায়। জোগনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে লোটা হাতে কোথাও যাচ্ছিল। পুলিসের মুখোমুখি

হয়ে ও নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং নিজের সামনে ঘরের তল্লাশি করিয়েছে। এই তল্লাশি

আইন মেনে একজন সম্ভ্রান্ত লোকের উপস্থিতিতে হয়েছে।

বলে রাখা ভাল, এইসব পাড়ায় প্রথমত, লোকের দেখা পাওয়াই মুশকিল। দ্বিতীয়ত, যদি পাওয়া যায়ও

সে যে সম্ভ্রান্ত হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। সে যাই হোক, তল্লাশি দু’জন সাক্ষীর সামনে হয়-- ছোটে




পালোয়ান পিতা কুসহর প্রসাদ এবং বৈজনাথ পিতা ত্রিবেণী সহায়। তবে বৈজনাথ হল ভিন গাঁয়ের

বাসিন্দা। এই ‘সম্ভ্রান্ত’ ব্যক্তিটিকে পাশের গ্রাম থেকে ডেকে আনা হয়।

জোগনাথ দেখিয়ে দিলে ভেতরের ঘরের একজায়গা খুঁড়ে একটা হাঁড়ি পাওয়া যায়। সেই হাড়িতে কিছু গয়না

ছিল। তার বিবরণ নিম্নানুসারঃ

একটি রূপার করধন (কটিবন্দ), দাম হবে পঞ্চাশ টাকা; এক জোড়া বিছিয়া, দাম ধর তিন টাকা; একটা

চাঁদির গয়না, দাম পঁচিশ টাকা। একটা নাকে ফুটো করে পরার সোনার গয়না, দাম হবে তিরিশ টাকা।

এগুলো বাজেয়াপ্ত করে লিস্টিতে ওই দুই সাক্ষীর সই নেয়া হয়েছে। হাঁড়ি সমেত গয়নাগুলো একটা

কাপড়ে বেঁধে সীল করা হয়েছে। সমস্ত প্রক্রিয়া জোগনাথের ঘরে বসে করা হয়েছে।

জোগনাথ গ্রেফতার হওয়ার সময় ঝগড়া হাতাহাতি করেছিল। ওকে ধরতে গিয়ে হেড কনস্টেবলের জামা

ছিঁড়ে যায় এবং হাতে চোট লাগে। জোগনাথকে কাবু করতে ন্যুনতম শক্তি প্রয়োগ করা হয়—ব্যস,

যতটুকু দরকার। পরে আহত সেপাই এবং জোগনাথের ডাক্তারী পরীক্ষা করানো হয়। সেপাই দুই

সপ্তাহের মেডিক্যাল লীভ নিয়ে নিজের গ্রামে চলে গেছে। জোগনাথের শরীরে গোটা কুড়ি নীলচে নিশান

আর চল্লিশটা আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে। সবগুলো মামুলী চোট, মাটিতে পড়ে যাওয়ার ফল।

এই কাহিনীটি বৈদ্যজীকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনানো হল। –পুলিস যা করে ঠিকই করে, এমন শাশ্বত

তত্ত্বে প্রথমবার বৈদ্যজীর সন্দেহ হল।

অবশ্য জোগনাথের সম্বন্ধে বৈদ্যজীর ধারণা খুব যে ভাল ছিল, এমন নয়। কিন্তু উনি যে দুনিয়ায় বাস

করেন সেখানে লোকের সম্মান সে কতটা ভালমানুষ তা দিয়ে ঠিক হয় না—দেখা হয় সে কীরকম কাজের

লোক। ওনার দলের লোকের মধ্যে একমাত্র জোগনাথ খোলাখুলি মাল খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর মদের

পয়সা যেখান থেকেই আসুক—নিজের পকেট বা অন্যের—দারু গেলার পরিমাণ কখনও কম হয়না। সব

মিলিয়ে ওকে একটি মাঝারি ধরণের গুণ্ডা বলা যায়।

বৈদ্যজীর সন্দেহ হচ্ছিল যে জোগনাথের গ্রেফতারির পিছে কোন রাজনীতির প্যাঁচ আছে। কিছুদিন ধরে

দারোগাজী যে ওনার বদলে রামাধীন ভীখমখেড়ীকে বেশি কেউকেটা ভাবছেন -এটা ওনার চোখে পড়েছে।

গোড়ায় মনে হচ্ছিল রামাধীন বোধহয় আফিমের চোরাই কারবারে দারোগাজীকেও পার্টনার বানিয়ে

ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে দারোগাজী ধোঁকা খেয়েছেন। বোধহয় ভেবেছেন যে রাজনৈতিক ল্যাং মারার

খেলায় রামাধীন ভীখমখেড়ী বৈদ্যজীর চেয়ে বেশি কাজের। সে যাই হোক, বৈদ্যজী সার বুঝেছেন যে

বর্তমান পরিস্থিতিতে জোগনাথের গ্রেফতারি হলে প্রথমে দারোগা যা চাইবেন তাই হবে। আসলে

রামাধীন ভীখমখেড়ী যা চাইছে তাই দারোগা চাইবেন।

কিন্তু রূপ্পন বাবু জিদ ধরেছেন—রামাধীনকে থানাতেই জামিন করিয়ে ছাড়িয়ে আনা হোক। তাই বৈদ্যজী

ইচ্ছে না হলেও দারোগার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন।

দারোগাজী এখন আর ভোর বেলায় দুঁদে দারোগা নন, মানে যিনি চোখ পাকালে গ্রামবাসীর গায়ে নীলচে

নিশান আর আর আঁচড়ে দাগ ফুটে ওঠে। এখন ওর ভারী শরীরের উর্ধভাগে সিল্কের পাঞ্জাবি আর

নিম্নাংগে খাদির পায়জামা। ঠোঁটের কোনায় পানের পিক চুঁইয়ে পড়ছে। ওঁর মুখ থেকে বৈদ্যজীর পুরো

ঘটনা শোনা হয়েছে। বৈদ্যজী অবাক হন নি, কিন্তু একটা খটকা লাগছে—জোগনাথের ঘর থেকে পুলিস

একটা দেশি কাট্টা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেনি!




পুলিসের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সম্পর্কের দরুন উনি জানেন –এইধরণের গ্রেফতারির সময় পুলিস

অপরাধীর ঘর থেকে নিদেনপক্ষে একটা লোহার টুকরো হলেও বাজেয়াপ্ত করে। সেটাকে পিস্তল ধরে

নেয়া হয় আর একনজর দেখলেই কেন আঠেরশ এবং উনিশশ শতাব্দীতে মুষ্টিমেয় ইংরেজের সামনে

ভারতীয়রা হেরে যেত—সেই ঐতিহাসিক সত্য স্পষ্ট হয়।

ওনার মনে হল দারোগাজীকে ভদ্রতার খাতিরে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। তার ভূমিকা বাঁধতে গিয়ে উনি

প্রশ্ন করলেন—জোগনাথের ঘর থেকে শুধু গয়নাপত্র উদ্ধার হয়েছে? গাঁজা-ভাঙ-চরস বা আফিম

নয়?

--আমি আফিমের তল্লাসি করিনি তো। তাহলে লোকে বলত সেবার এক পার্টির এক চেলা আফিম শুদ্ধ

ধরা পড়েছে তাই এবার অন্য পার্টির একটাকে ধরা হয়েছে।




বৈদ্যজীর চোখ কপালে।

--পার্টি? কিসের পার্টি? এসব আপনি কাদের ভাষা বলছেন?

উত্তর এল রূপ্পন বাবুর থেকে—‘পুলিসের ভাষা’।

দারোগাজী চোখ মিটমিট করে ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিজের মাথা সাফ রাখতে চেষ্টা করলেন। মনে মনে

ভাবলেন—বিলেতি মদের মধ্যে ‘জিন’ হল বড্ড দাগাবাজ। দেখতে সাদা জলের মত, কিন্তু পেটে পড়লে

জিভের আড় থাকে না। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলি!

উনি চোখ খুললেন। বৈদ্যজীর চেহারা বেশ গম্ভীর। দারোগা ভাবলেন—এইবার কোন ত্যাড়া কথা শোনা

যাবে, তাই উনি মন দিয়ে বৈদ্যজীর মুখের দীপ্তি দেখতে লাগলেন।

(চলবে)

0 comments: