0

কবিতা - গৌতম দাস

Posted in





















জানি এই মুহূর্তে তুমি খুলে দিয়েছ তোমার জানলার কপাট, চাঁদ নেই আকাশে আজ, হাওয়া লেগে কেঁপে কেঁপে ওঠা মোমবাতির আলো খুব সাবধানে তাই আগলে রেখেছ, আমিও এই মুহুর্তে শরীর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এসে দাঁড়িয়েছি রাতের উঠোনে, একলাই, আমার চারিদিকে ছড়িয়ে এখন কোলোকল ঘণ্টা, পুরনো ক্যাথিড্রাল, বিরাট একটা কালো ঘড়ি আর অজস্র পাখির মৃতদেহ

আশ্লেষা বিশ্বাস করো, প্রতি রাতে আমি চেষ্টা করি এত শব পার না হওয়ার

মৃতদের ঘুম ভাঙিয়ে অভিমান না ছোঁয়ার




প্রতিরাত আমার অতীতকে ছুঁয়ে থাকে


আর সেখানে লুকিয়ে থাকে বিরাট এক জিভ, তরল লালা ছিটোয় সে, সরীসৃপের মত তখন আমি বুকে হেঁটে পথ চলি আর জলজ পথ গিয়ে শেষ হয় অসমাপ্ত বিন্যাসে, এসবই আমার প্রতিরাতযাপন অথচ আকাশ ছেয়ে তখন ছড়ানো থাকে দীর্ঘ এক অরুণাভ ইশারা, আর তাই তখনই গল্প থেকে জানলার ফাঁক ধরে প্রখর জোৎস্নায় নেমে আসো তুমি, নেমে আসো আমার ভেঙে পড়া ঘরে, তিনটে বোতাম ছেঁড়া শার্টের ঝুল ধরে, না-কাটা দাড়ির জঙ্গলে লুকোতে থাকো তোমার বিষাদী ঠোঁট, দু'জনেই তখন আমরা মুখ রাখি পরস্পরের ভয়ংকর অংশগুলোতে


দূরে সুপুরি গাছের মাথায় এসে দাঁড়ায় তখন কলঙ্কিনী চাঁদ, ধূসর ফুলদানিতে মাথা দোলায় বাসী রজনীগন্ধা, বিষাক্ত লালায় মিশে যায় যাবতীয় পাপ'পূণ্য আর জন্মায় অক্ষম বিন্দুকণাময় মুহুর্তস্বেদ


অপেক্ষায় থেকো আশ্লেষা, এ আয়োজন শুধু তোমারই জন্য,
নিজের চিতাভষ্ম নিয়ে ঠিক কোনো একদিন এসে দাঁড়াবো আবার


চোখ মেলে তাকিও


দেখবে দরজায় দাঁড়িয়ে পরিচিত বন্য কোনো প্রেত...




কোনো রাতেরই আজ আর কোনো শর্ত থাকে না, চতুর বাতাস তাই সরল জানলার সীমাবদ্ধ গরাদ পার করে হুড়মুড়িয়ে লুটপাট করে টেবিলবাতীর সঞ্চিত আলো, বইমুখে অন্ধকারে পায়চারি করি রাতভর, জিজ্ঞাসা করি, নিঃশব্দ প্রেমিকার সাদা শীৎকারহীন শরীর আসলে কি প্রেম না কি প্রেমিকের অপমান, তুমি তখনই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠো যেন একবার, তারপর দরজা খুলে হেঁটে যাও পরচর্চাকারী জোৎস্নায়


পাহাড়ের নীচেই তো সব সময় থাকে কোনো না কোনো শান্তগ্রাম অথবা উচ্ছ্বল ঝর্ণা


আজ তোমায় ঘিরে তাই সিঁথিছোঁয়া সিঁদুর, শৃঙ্খল, কপালে কখনো বা করুন মেরুন টিপ, হাতে সব সময়ের বৈষয়িক শাঁখাপলা


আর আমার নিরাপরাধ আয়নায় প্রতিদিন প্রতিরাত অর্ধেক কোনো মুখ


আর অর্ধেক হারানো সেই সুখ...




অসতর্ক নিশিডাকে দরজা খুলে যায়, পাঁচিলের গা ঘেঁষে ঘুমন্ত লতাটি তখন জাপটে ধরে তার একমাত্র ফুল, ধ্বংস চুইয়ে নামতে থাকা জোৎস্নার দিকে তাকায় না সে, রাত্রিরেখার খোঁজে রাতজাগা পাখিরা হঠাৎ করেই যেন একসাথে একটানা ডেকে ওঠে


স্বাভাবিক আর শব্দহীন বাতাসে ফিরে ফিরে আসে আরো একবার মনখারাপেরা


প্রতিফলিত আয়নায় তখনই তুমি ভেসে ওঠো, ভেসে ওঠো আমাদের সেই অবিশ্বাস্য সরল অতীত হয়ে


তবু একসাথে আমাদের কোনোদিন রাত্রিরেখা পার হওয়া হয়নি


ভোরের অস্পষ্ট আলোয় হেঁটে গেছি আলাদা আলাদা পথ হয়ে


দূরত্ব তো আসলে এক ছলনা, মৃত তারার আলোয় তাই আজও তুমি পুঁথি খুলে বসো


প্লাটফর্ম ফাঁকা রেখে রেলগাড়ি চলে যায় সময় মত




এসো, ছুঁয়ে দাও আমায়, ভাঙা রোদ স্পর্শ করুক অবুঝ সেই পিয়ানো


শীত ও অসম্পূর্ণ সান্নিধ্যের মাঝে যে ঘুম আমার খুব প্রিয় তাকে আজ বিলিয়ে দেব নির্ধারিত বালিশ অথবা চাদরে, সন্ধ্যার বেদনাময় জলে মিশিয়ে দেব কলঙ্কিত সুরভী, বীঠোভেন বালিকা, এসব শুধু তোমারই জন্য, বৃষ্টি এবং বিদ্যুৎভরা তোমার আঙুলগুলো আজ হোক আবার সংকেতময়, প্রথম দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সিম্ফনির সুরে স্পষ্ট হয়ে উঠুক আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস, চতুর্থ পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ অথবা সপ্তমে খসে যাক সব মুখোশ অথবা পরচুলো, তারপর তুলনামূলক প্রেমে রাত থাকুক আজ অভিসন্ধিময়ী ঈর্ষা হয়ে


সেখান থেকেই না হয় জন্মহোক অষ্টম, নবম


জন্ম হোক ব্যথিত প্রশ্নের অথবা ভ্রুক্ষেপহীন করোটি কিংবা কংকাল


তবু ছুঁয়ে দাও, ছুঁয়ে দাও আমায় তুমি, বেজে উঠুক দশম


তোমার আঙুল ভাসিয়ে দিক আজ মরা মেঘ আঁকড়ে থাকা বৃষ্টি ভেজা এক সকাল




আলো জ্বলেনি, বারণ না মানা চাঁদ তবু জানলা জুড়ে, ঝুঁকে পড়েন কবি লেখার টেবিলে


কবে উঠেছিল এই ঘুর্ণিঝড়, কবে থেকে আমাদের ঘিরে পরস্পর উন্মাদ হয়েছিল ঝরাপাতা বা কাগজের সব টুকরো, বিচূর্ণ আলোর মত সেদিন কি তুমি ছড়িয়ে পড়েছিলে সৌখিন কোনো মেঘের পরতে পরতে


আর হয়ত বা আমার সব অবৈধতার জন্ম সেদিন থেকেই, উন্মাদ লিপ্সায় সেদিন থেকেই দৌড়চ্ছি আমি, দৌড়চ্ছে আমার প্রতিটি শিরা আর ধমনী, শহরের ব্যস্ত জনপথে তারা অহর্নিশ খুঁজে বেড়ায় তোমায়, খোঁজে চলন্ত বাসে, পরিত্যক্ত গির্জায়, ঝিমিয়ে পড়া অফিসবাড়িতে অথবা হাইরাইজের ফাঁকে, তারপর প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম মেনে এসে বসি আমার কবিতার পাতায়, পরিচিত সকলের নজর এড়িয়ে অবগহন করি অগণন কবিতায়, সেখানে ডুবতে ডুবতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার, মুখের দু'কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে সাদা ফেনা, জলজ শিকড়রা বারবার পেঁচিয়ে ধরে কণ্ঠনালী, তারপর বাঁচবার জন্য, শুধু বেঁচে থাকবার জন্য প্রতিদিন নতুন করে লিখি রূপকথা আমার


আর এসব অবৈধতার মাঝে তুমি এসে দাঁড়াও নিস্পাপ এক বালিকা হয়ে


কান্না আমার দত্তক নিয়েছিলে একদিন আশ্লেষা, প্রেমকে করেছিলে সেদিন অবিনশ্বর


জানলা থেকে চাঁদ সরে গেছে, কলম নামান কবি


বেঁচে আছি আমি যাকে একদিন ডেকেছিলে তুমি অসমাপ্ত ঈশ্বর




সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছেন কবি, হেঁটে চলেছেন, কখনও বা থমকে দাঁড়াচ্ছেন, ভাঙ্গাচোরা মধ্যবয়স্ক মানুষটি বড় যেন ক্লান্ত, বড় জীর্ণ, দু পা ধুলোময় তার, হাওয়াই চপ্পলদুটো কখন যেন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে যেভাবে লেখার টেবিলে ছিটিয়ে থাকে তাঁর মুখখোলা কলমেরা


সাদা পাতায় আমরা দেখি কবিতা


আজ বড়ই অস্থির তিনি, অসম্পূর্ণ কবিতায় তাকে দিতে হবে স্বীকৃতি অথবা অস্বীকার


আর এখানেই আমি আর তুমি দাঁড়িয়ে আশ্লেষা


আজও আমরা জানি না আমাদের পরিচয়, স্বীকৃতি না অস্বীকার


স্বাক্ষর করো, বলো আশ্লেষা, শুধু না হয় কবিকেই গোপনে তুমি বলো


কবি তোমার অস্বীকার না স্বীকৃতি




বুকপকেট জুড়ে রয়েছে শুধু ভুল শহরের ঠিকানা, পথে পথে আজও খুঁজে বেড়াই পরিত্যক্ত সেই ভাঙা স্টেশন, বাসনা আর আয়ত্ত তো ছিল বিপন্ন এক রেলপথ, দ্বিধাহীন জটিলতায় সেখানে কখনো কখনো এসে দাঁড়াতো ভরদুপুরের রেলগাড়ি আর চলা শেষে তা পৌঁছত নিরুত্তাপ নামহীন কোনো স্টেশনে


ভুল হয়, তবু ছুটে আসি আজও, ছুটে আসি দুটো বিয়াল্লিশের উদাসী গাড়ির শব্দে, নিরুত্তাপ প্লাটফর্ম একসময় গুমগুম শব্দে অন্যমনস্কতায় ক্রমশই ফিকে হয়ে আসে আর স্টেশন মাস্টার এসে বসেন তার অলস বারান্দায় মেয়ের অঙ্ক খাতায় সরল জ্যামিতিক হিজিবিজি নিয়ে


আশ্লেষা এই সব ছবি একদিন একান্তই আমাদের ছিল আর ছিল আমাদের রোজকার অনিশ্চিত যাপন


আজ চরিতার্থহীন বেলা শেষে অনুযোগহীন কিছু শব্দ নিয়ে প্রতিদিন এসে বসি


বসি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা কোনো একদিন লেখা হবে তার প্রতীক্ষায়




কিছু চাইনি আমি


অভিমতহীন গল্পের মত স্মৃতিরা উড়ে বেড়ায় অথবা তারা খোঁজে অতিরিক্ত চলাচলটুকু পায়ে পায়ে, থাকে সরল ঘূর্ণি অথবা জটিল আশ্বাস তবু মন মনে মনে থাকে অনুযোগহীন, জানে শিমুল তো বসন্ত খুঁজবেই, জানে শেষবিকেলে তুমি চুল খুলে এসে দাঁড়িয়েছ এখন কোনো একতলা সরল বজ্ঞা বাড়ির বিধিবদ্ধ ছাদে, ক্লান্ত পথিক আমি, তাই এই দৃশ্যের শেষে সামান্য কমা দিয়ে থমকে যাই, শ্বাস নেই, অপেক্ষায় থাকি রাতভর স্বপ্নের যেখানে প্রতিরাতে তুমি আমায় ছারখার করো


আশ্লেষা প্রতিরাতেই এভাবে আমরা মৃত্যুবদল করি, মৃত্যুবদল করি উদাসীন এক ভোরের দিকে চেয়ে যেখানে দুপুরের রোদ ক্রমশ ফিকে হয়ে এসে পড়ে


পড়ে জীবনের জটিল লতাপাতায়


১০


তোমার জানলার গরাদ ছুঁয়ে আজ রাতের আকাশদীঘি, সেখানে শিশিরের টুপটাপ ঝরে পড়া, এলোমেলো জোৎস্নায় বারবার উচাটন তোমার আনমনা ওড়না আর বারণ না মানা ছায়াপথ ক্রমশ যেন ঝুকে পড়েছে, ঝুকে পড়েছে তোমার কপাল বেয়ে, নীচে, নিষ্পাপ জ্যামিতিক সরলরেখায়,
ঘুমিয়ে পড়ো না আশ্লেষা, এসব আয়োজন তোমায় শেষ চুম্বন উৎসর্গ করব বলে


শেষবার আগুন হব আমি


উন্মাদ কবি জ্বলতে জ্বলতে চিনে নেবে আজ তার লেখা না হওয়া কবিতার লিপি


১১


হয়তো বা তোমার বাড়ির সামনের আকাশে মেঘের পরত এখন, আসলে যে দিন প্রতিদিন শেষ হয় তারা সব পুরনো মনখারাপ আর তুমি আমি আনমনা হই তখন, মনে পড়ে মৃত সেই কোনো সর্ম্পক, চোখ মেলে তাকাই, আয়ত চোখে নেমে আসে মৃত সব বৃষ্টিরা


আশ্লেষা এই বৃষ্টিফোঁটারা এখন আর আমাদের নয়, নিজেদের জন্য তো আমরা আর কাঁদি না,
শুধু নিঃস্ব মেঘদুটো কখনও কখনও ফুঁপিয়ে ওঠে, আর তখনই পৃথিবীতে নেমে আসে আশ্চর্য সব জটিল প্রেম, আশ্চর্য সব সরল বৃষ্টি


তুলি ধরেন কবি


এ গল্পের শুরু হয় আকাশে আয়ত দুই মেঘ নিয়ে


অভিশাপ নিয়ে যারা বেঁচে থাকে গায়ে বৃষ্টিজল মেখে


১২


জীবনে যে প্রেম কখনো আসেনি বা আসবে না তার নাম অপেক্ষা


পিছন ফিরে তাকালে শুধুই সরলরেখায় হেঁটে চলা, বাতাস তা সে যতই হোক না অসাবধানী তাকে তো আমরা অনেক বেশী জানি, স্বপ্নে মিথ্যে মেশায় মন, মিথ্যে চুম্বনের স্বপ্নে ঘুম ভাঙে, বাইরে তখন শুধুই অন্ধকার, এই অন্ধকারে দুটো ভিন্ন রূপকথায় ক্রমশ ডুবে গেছি আমরা, ডুবে গেছি দুটো ভিন্ন ঝর্ণাধারায়, ক্লান্ত হয়ে খুঁজছি শ্যাওলা মাখা কোনো ঘর


অবসন্ন সন্ধ্যায় সে ঘরে তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবাতি দাও আর আমি ফিরে ফিরে আসি ক্লান্ত করণিকের প্রেতাত্মা বয়ে,
শুধু আকাশ থেকে যেদিন খসে পড়ে কোনো এক রক্তলাল তারা, ছারখার হয় বুকের মধ্যে রাখা জমানো সব স্মৃতিছায়াপাড়া


খোলা ছাদে তুমিও তখন এসে দাঁড়াও,চোখ মেলে দেখো


কালপুরুষ সেজে দাঁড়িয়ে আছে আমি, আসলে দাঁড়িয়ে আছে ব্যর্থ কিছু তারা


১৩


সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে, হেঁটে যান কবি, শেষ বিকেলে ছায়া সামান্য ঝুকে এখন, শিকড় জুড়ে স্মৃতির অনিয়ন্ত্রিত টান, বারবার পিছু ডাকে, পীড়িত রাত্রির ক্ষুধা কবিকে ভাবায় না, নোঙর তোলেন তিনি যেমন দ্রুতগামী বাতাসেও পাল ওড়ে টানটান স্পর্ধায়,আশ্লেষা আর কিছুক্ষণে


তারপর হয়তো মিলিয়ে যাবে নিহিত শব্দের সব ঘ্রাণ, শুধু পরিযায়ী পাখিরা যে পালকের স্তুপ ফেলে গিয়েছিল তা আর কুড়ানো হবে না


বিকেল মিলিয়ে যাবে দ্রুত কোনো আহত সন্ধ্যায়


ঢলে পড়বে সূর্য পশ্চিম আকাশে


ঢলে পড়বে কবির বারান্দায়


১৪


অক্ষত্রিয় আমি


ভেঙ্গে যায় প্রতিরোধ সব, ভুল হয় বৃষ্টির বিন্যাসে, বিষণ্ন মাধবী আজ একা একা ফুটে আছে, তোমায় নিয়ে সেদিন শহরতলীর ট্রেন ছুটে গিয়েছিল, মুখরিত আত্মায় মিশে গিয়েছিল তা আমাদের সময়ের গুঞ্জন, অবলীলায় রোজকারের খুঁটিনাটি সেরে তুমি বলেছিলে, নিহিত সন্ধ্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলে আমাদের আলোর সন্ন্যাস


মন্ত্রমুগ্ধ কবি কান পাতেন, শোনেন স্মৃতির কণ্ঠস্বর, আঁকড়ে ধরেন পূর্বজন্ম যার বৈভব আজ গোধূলিবেলায়, দূরে উপকুলে দাঁড়িয়ে ঝাউবীথি, দাঁড়িয়ে নক্ষত্রের সারি, কবি লিখে যান


আগে কখনো জানিনি জীবনের সমস্ত অভিষেক আসলে অনুভূতিরই বিস্তৃতি, রক্তে আনে তা ঝড়ের জাগৃতি, অলৌকিক বাগান থেকে তাই বহুবর্ণ পাতা ঝরে পড়ে অন্ধকারে আসলে ঝরে পড়ে আমারই রক্ত হয়ে,
আশ্লেষা তোমায় ডাকতে পারতাম আমি রাধা কিংবা খাদিজা কিংবা মারিয়া বলে, অথবা অন্য কোনো নামে, কিন্তু পারিনি, আর তাই ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে আমার মস্তিস্কের উজ্জ্বল কর্টেক্স, নিভে এসেছে আমার সেই দীপ্ত চোখদুটো, তবু দেখো অবেলায় আজও অবিরল ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে আমার জীবন, বয়ে যাচ্ছে তা আমার সারা শরীর বেয়ে, অনিঃশেষ আবেগের স্রোতে, আজ না হয় ভিজে যাক আবার জাহাজের পাটাতন, জলমগ্ন না হয় হোক আজ আবার সব স্মৃতি, ভেসে যাক না হয় রঙিন সব ফানুস


তবু আমি বর্মহীন থাকিব আজও


অক্ষত্রিয় হব আজ আবার


অভিশপ্ত চক্রব্যূহই হবে আমার শেষ অহঙ্কার


১৫


আমার দ্বিতীয় সত্তা আজ শহরের পথে পথে, খুঁজে বেড়ায় সে না লেখা উপন্যাসের সেই সব চরিত্র, ব্যস্ত রাজপথ, একাকী চিলেকোঠা অথবা রাতের আকাশ আজ বিদ্ধ করে আমার চোখের মণি, আর আমার উপন্যাস হয়ে যায় আমারই মত কলঙ্কভাগী, দিনের শেষে সেখানে পড়ে থাকে না পরা সব মুখোশ, পড়ে থাকে প্রাণহীণ চরিত্র আর গ্রিনরুম থেকে যায় নির্বাক, সংলাপহীন, আচ্ছা, মৃত্যুর আগে মানুষ কি খুব কাঁদে, জানি না, তবু কবি এসে দাঁড়ান জলপ্রপাতের নীচে, পলকহীন চোখে দেখে যান বয়ে যাওয়া জলের স্রোত, সতী নির্মাণের জন্য তো কতবার জেগেছে এই শ্মশান, কতবার পুড়েছে ফুল, পুড়েছে বেলপাতা, চন্দনকাঠ, এই শ্মশানেই তো তিনি দেখেছেন অগ্নি আর বায়ুর অশেষ মৈথুন, দেখেছেন ভাঙ্গা কলসি, কালো ছাই, অর্ধদগ্ধ কাঠ, ইত্যাকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নির্মোহ নিস্পৃহ শ্মশান


তারপর পুড়ে গেছে সবকিছু একদিন


তবু নিশ্চল রাতে ক্ষীণকায়া নদীর তীরে ফিরে ফিরে আসেন কবি আবার, ফিরে আসেন ভাঙা সেই সাঁকো বুকে নিয়ে


এই ফিরে আসা শুধু তোমারই জন্য আশ্লেষা


ফিরিয়ে দিও না কবিকে তুমি আবার


১৬


গোল হয়ে পাখীরা ওড়ে আকাশে আর পালকের রঙে অন্ধ হন কবি, যা দেখেন তা শেষ হয় না তাই ঢাল নীচে নামে, নীচে ছোট্ট সেই ডোবা, তিন ধাপ তার সিঁড়ি, সিঁড়িবেয়ে একফালি উঠোন, আর উঠোন শেষে কাঠের দরজা, দরজার ওপারে খাট, ছোট তোশক, হাতেতোলা মাটির উনোন, কুলুঙ্গিতে শুধু শূন্যতা, সামনের দাওয়াও ফেটে চৌচির, চৌচির বুনো শেকড়ের আলপনা, বছরের পর বছর তাতে ধুলো পড়ে ঝরঝর, বালি পড়ে ঝুরঝুর, কান পাতেন কবি, সেদিনের মতই পাতাভাঙার অস্পষ্ট শব্দ, শাড়িতে জড়ানো বুনোকাঁটা, মাথাছোঁয়া গুলঞ্চলতা, জানি এ পায়ের শব্দ তোমারই, চোখ মেলেন কবি, চুলে কুটো, কপালে কাঁচপোকা, নাকে ঘাম, বুকে ওঠা-পড়া


বারবার ছায়াচ্ছন্ন বয়স হয়ে তুমি ফিরে ফিরে আসো আশ্লেষা, সন্ধ্যা হয়, পাখীরা গোল হয়ে আকাশে ওড়ে আর পালকের রঙে অন্ধ হন কবি আবার


স্মৃতিরা তখনই নীচে নামে যদিও


চড়াই জুড়ে এখন শুধুই স্মৃতিটান




১৭


আজও স্বপ্ন দেখি আশ্লেষা আর সে স্বপ্নে তুমি এসে দাঁড়াও, চারপাশে তখন আমার অন্ধ অতীত, তোমাকে ছোঁওয়ার জন্য হাত বাড়াই আর বাড়ানো সে হাত কে যেন আচম্বিতেই নিজের আগলে বন্দী করে নেয়, যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠি আর দেখি তুমিও আমার মতই যন্ত্রণায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছ অক্ষরহীন কিছু পংক্তিতে, বিচূর্ণ সূর্যের গান গেয়ে তখনই মানুষের নিঃসঙ্গ জীবনে ফিরে আসে লুব্ধক নক্ষত্র, গভীর রাতে তখনই শরীর মিশে যায় একরাশ নিহত কুয়াশায়, কালি ও কলম পাশাপাশি এসে দাঁড়ায় তবু ঈশ্বর রয়ে যান শব্দহীন,
রঙহীন বিবর্ণ নদী হয়ে আবর্তিত হতে থাকি ফেলে আসা অতীতে, আবর্তিত হতে থাকে আমার স্বপ্নরা, পড়ন্ত বিকেলে তখনই উদ্দেশ্যহীন দিন শেষ হয়, নিভে আসে শেষ বিকেলের আলো, ঘরে ফেরে পাখিরা, সন্ধ্যার নিয়ন পেরিয়ে অতিক্রম করতে থাকি একটার পর একটা বৃত্ত, যদি খুঁজে পাই ঘর, ঘর নয় বাসা, দূর বহুদূর হেঁটে যাই, হাঁটতে থাকি যতক্ষণ না একটা মরচে ধরা ভোর একতারা হাতে আমাকে স্বাগত জানায়, ডেকে নেয় তার সুরহীন চলার পথে, চলতে থাকি আমি, চলতে থাকে আমার নিঃশব্দ ছায়া


ঘুর্নিঝড় তখনই শব্দের পেখম মেলে, চোখ মেলি,
চশমার ভাঙ্গা কাঁচে বৃষ্টির জল এসে পড়ে


আশ্লেষা, প্রিয় উৎসবের ফুল আজও রাখা আছে নির্ধারিত টবে, হয়তো বা কখনো আবার ভোর হবে আর শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদুরে চলে গিয়েও সেদিন ঠিক ফিরে আসব তোমারই কাছে


ভোরের আজান শেষে নতজানু কবি আজও লেখে অক্ষরহীন প্রেমকথা


১৮


সেদিনও বৃষ্টি হবে আশ্লেষা যেমন হয়েছিল কোনো একদিন, বৃষ্টির একপারে থাকবে তুমি, অন্যপারে আমি, দুঃখমেঘ তারপর কখন জানি কান্না হয়ে যাবে, ছুঁয়ে যাবে তোমার চোখ, অপলক আমি, বিন্দুজলকণা চিবুক ছুঁয়ে টলমলো প্রতীক্ষায় আর আমি লম্পটের মত চুরমার করব স্মৃতির সব আয়না, উড়িয়ে দেব বুকের কোনে থাকা বেহিসেবী সব যন্ত্রণা, নীলশিখায় পুড়ব


পোড়াব তোমার সব পাপ


নিজের চিতাভষ্ম দুহাত ভরে বলবো ভালবাসি


আরো একবার, শেষবার


১৯


আকাশের বুকে শুয়ে আছে নক্ষত্রের এক আশ্চর্য নদী আর আধভাঙ্গা চাঁদ নেমে আসে উঠোনের পোড়া নিমগাছে, তবুও অসমাপ্ত কবিতার খাতায় অক্ষরগুলো যেন বড়ই অনুজ্জ্বল আজ, ফিকে জোৎস্নায় দাঁড়ান কবি


পলাশগড়ে আজও সন্ধ্যার ট্রেন সময় মেনেই হয়তো থামে আর তড়িঘড়ি তুমি হেঁটে যাও তোমার পাঁচিলঘেরা ডানামেলা বাড়িটার দিকে যাকে তুমি সাজিয়েছ নিয়মবেঁধে, সাজিয়েছ তোমার সম্পর্কের রোদ ও রোদ্দুরে


রাত গড়ায়, দরজা বন্ধ হয়, রাতজাগা পাখীরা ঘরে ফেরে আর আশ্চর্য কষ্টরা আবার ডানা ঝাপটায় একা একা


বারোটা বছর অনেকখানি সময় আশ্লেষা


আজও জোৎস্নায় একা একা স্নান করেন কবি


জলপায়ে আবার যদি হেঁটে আসে একদিন নদী


২০


আশ্লেষা, বাড়ি ফিরে তুমি কি এখন চুল খুলে দাঁড়িয়েছ, দাঁড়িয়েছ তোমার আয়নার সামনে, তোমার ঘরের অনিশ্চিত হাওয়ায় বারবার কি ফিরে আসছে ভালবাসি বলতে না পারার সেই আত্মরক্ষাহীন অপরাধবোধ, তোমার শরীরে হয়তো পলাশ রঙ এখন, কপালে উজ্জ্বল স্বঘোষিত টিপ, বিধিবদ্ধ আত্মীয়রা তোমার নিরীহ আর সমাজসম্মত জানলার কপাট হয়তো বন্ধ করে দেবে একটু বাদে আর অনুযোগহীন কোনের ঘরে তুমি পাতবে আর এক সফল রাত-বিছানা


হেঁটে যেতে যেতে আমি এখন অভিমতহীন এই দৃশ্যের শেষে একটি সামান্য কমা দিয়ে থমকে যাব


না বলা না লেখা কোনো রূপকথারই অপেক্ষায়


২১


শেষবার যখন দেখা হলো তুমি কাঁদছিলে আশ্লেষা, আমি দু'হাত পেতে দিয়েছিলাম, ফোঁটা ফোঁটা জলে ক্রমশ দগ্ধ হচ্ছিল আমার হাতের পাতা, তারপর পুড়ে গিয়েছিল আমার বাহু, বুক, আর সবশেষে মন, সেই থেকে রাত্রির আকাশে দাঁড়িয়ে আমি অর্দ্ধদগ্ধ এক মানুষ


সারারাত মাথা ঝাঁকাই, চিকিচিকি তারারা খসে পড়ে, হাত বাড়াই, চাঁদ সরে যায় আর শেষরাতে পায়ে পায়ে নেমে দাঁড়াই তোমার ঘুমের মাঝে, মাংসহীন আঙুল ছোঁয়াই তোমার চুলে, পোড়া ঠোঁটে ফিসফিসিয়ে বলি


বলি তোমার ঘুমকে


জ্বলন্ত শরীর নিয়ে আনন্দ আজও যে জল চায় চণ্ডালিনীর কাছে


২২


"যদি ছুঁয়ে যাই তোমার দু-খানি হাত, সারাদিন-সারারাত..."


ঘুম আসে না, অস্থির কবি একা রাত্রি পোড়ান, শব্দ খোঁজেন


"চারিদিকে বড় কোলাহল, বৃষ্টির কাছে যাবে কি তুমি আশ্লেষা, খুঁজে এনে দেবে দু-ফোঁটা চোখের জল..."


বৃষ্টি আসে না


ধুলোবালি করে দিতে চান তাই কবি সব পাওয়া সম্মান


বারবার যে এ জীবনে ভুল হয় জীবনের বানান


২৩


পিছন ফিরে তাকান না


আনমনা আলো মেখে কবি দাঁড়িয়ে, পিছে বিস্তৃত উতরাই, চেনা-অচেনারা ফিরে গেছে এ পথ বেয়ে আর কুলীন বাতাস বয়ে এনেছে দীর্ঘশ্বাস ...


অসংখ্যবার এই শরীরের মৃত্যু হয়েছে অথচ কখনো গুনিনি মৃত্যুর ঠিক কতদিন বাদে আবার বেঁচে উঠি, এই যে ঘুমের মধ্যে পুরনো সময়ের দিকে হেঁটে যাওয়া, এই যে প্রতিদিন জেগে ওঠা, এক টুকরো আয়নায় দু'জনার তাকিয়ে থাকা যেখানে তুমি কথা বলো আমার প্রতিবিম্বের সঙ্গে আর আমি তোমার ছায়ার হাতে হাত রাখি


হেঁটে যান কবি চড়াইয়ের পথে, আরো বেশী বেশী করে কাছে যেতে চান আকাশের, আশ্লেষা যদি কোনোদিন ফিরে আসো, যদি দেখো পথ ভুল করেছে কেউ, দিগন্তে কেউ ভুলে ফেলে গেছে তার গান জানবে সে আসলে আমারই ছায়া, তুলে নিও পড়ে থাকা মৃত সে কবিতার খাম


লেখা আছে দেখো 'ভালবাসা' যা ছিল তোমাকে দেওয়া আমার ডাকনাম


আনমনা আলো গায়ে কবি দাঁড়িয়ে, পিছনে বিস্তৃত উতরাই


পিছন ফিরে তাকান না কবি...


২৪


আকাশের বাতিল তারা কবির ঘরে এখন, জোৎস্নারা টলোমলো করছে যেন দুজনার হাতে, ছায়াপথ টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে যাচ্ছে গ্লাসে গ্লাসে


হয়তো বা প্রেমিকার কথা বলছিল তারা তখন, হাঁটখোলা কলেজের সামনের সেই রাস্তা, কপালে সিঁদুরের ছোঁয়া, চোখদুটো জলে ভাসা


তোমাকে পাওয়া আর না পাওয়ার সুখে আমি ঘুমিয়ে পড়ব এবার আশ্লেষা, আর ঘুমের মধ্যে অভিশাপে পুড়ে যাবে আমার সমস্ত ভালবাসা


হয়তো একদিন হয়ে যাবে তা হীরের কোনো নাকছাবি


একলা কবি কাঁদেন,একলা কবি বাঁচেন


আজও সাথে নিয়ে অসম্ভবের শেষ আশা

0 comments: