0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















ষষ্ঠ পর্বঃ

পানু রায় অফিসের দরজা ঠেলে ঢুকতেই সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ কিছু খোঁজ পেলে, দাদু?’

পানু রায় বললেন,’ জানিনা আমি কতটা ঠিক তবে বড়কালীর অফিসে কিছুতো একটা ঘটেছে বা এখনও ঘটছে। সুন্দরী, শেষ কবে আমরা বড়কালীর সঙ্গে কথা বলেছি?’

- মনে পড়ছে না। দাঁড়াও কল লিস্ট দেখে বলছি। আমার কাছে সব ফাইল করা আছে।

-দেখে বল। তাড়াতাড়ি।

সুন্দরী দ্রুত হাতে ফাইলের পাতা উল্টোতে উল্টোতে বলল,’ মনে হচ্ছে এক বছর হবে…একটু দাঁড়াও…এই তো পেয়েছি… ঠিকই আন্দাজ করেছি…একবছরের কিছু বেশি, ধর তেরো মাস।‘

পানু রায় বললেন,’ তার মানে এই নতুন সেক্রেটারি আসার পর বড়কালী আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।‘

-এমনতো হতে পারে যে যোগাযোগ করার মত কিছু ঘটেনি?

-হয়তো তাই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এলিনা আসার পর একটা কিছু পরিবর্তন তো হয়েছে বড়কালীর অফিসে। ঠিক আছে। একটা কাজ করো সুন্দরী। কাঠমান্ডুর সাভেরা মোটেলে ফোন করে দেখ বড়কালী ওখানে আছে কি না। যদি থাকে বলো পানু রায় কথা বলতে চায়। যে ফোন করছে তার নামটা যেন ওরা ঠিক করে বুঝতে পারে।

-এখুনি করছি দাদু। এক মিনিট সময় দাও।

সুন্দরী ফোন করল,’ আমি কৃষ্ণকালী চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে পারি? পানু রায়ের অফিস থেকে বলছি।‘অপর প্রান্ত থেকে মনে হয় অপেক্ষা করতে বলল। সুন্দরী মুচকি হেসে পানু রায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। ওপাশ থেকে কৃষ্ণকালীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল ,’মিঃ রায়?’ সুন্দরী বলল, ‘ হ্যাঁ,হ্যাঁ, একটু ধরুন। দিচ্ছি, এখানেই আছেন।‘ পানু রায় সুন্দরীর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বললেন,’ আমি পানু রায় বলছি।‘ ওপাশ থেকে চাপা আওয়াজ ভেসে এল,’ আমি কৃষ্ণকালী বলছি।‘

-তুমি কি যেখানে আছ সেখান থেকে কথা বলতে পারবে?

-পারব। তবে বেশিক্ষণ পারবো না।

-শোন, আজ সকালে এক সুন্দরী মহিলা আমার কাছে এসেছিল। সে বলছিল একটা কোম্পানিতে তার চল্লিশ শতাংশ মালিকানা আছে এবং তুমি সেটা কিনতে চাও। তার কাছে নাকি কে একজন এসেছিল যে তোমাদের দু’জনেরই…’ কথা শেষ হবার আগেই ওপাশ থেকে কৃষ্ণকালী বলল,’আর কিছু বলতে হবে না। আমি আপনাকে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফোন করছি।‘

-ঠিক আছে, আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।

কৃষ্ণকালী ফোন কেটে দিল।

পানু রায় বললেন,’ এখন চারটে বাজে।একঘন্টা একটু অন্য কাজ করা যাক। সুন্দরী, তুমি ভেতরে যেতে পার। আমাকে এককাপ কফি পাঠিয়ে দিও। তুমি পাঁচটার সময় একটু অফিসে এস।‘পানু রায় পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলেন। আলমারি থেকে একটা বই টেনে নিয়ে বইএর মধ্যে ডুবে গেলেন। মনে হল সারাদিনে যা যা ঘটেছে তার থেকে এখন অনেক অনেক দূরে তার মন।

ঠিক পাঁচটার সময় সুন্দরী ফিরে এসে দেখল পানু রায় বই এর মধ্যে ডুবে আছেন। সুন্দরী কোনও আওয়াজ না করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। ঠিক পাঁচটা কুড়িতে ফোন বেজে উঠলো। বড়কালী ফোনের ওপারে।

-কী হয়েছে, মিঃ রায়? আমাকে ডিটেলে বলুন। কিন্তু কারও নাম নেবেন না, প্লিস।

-যে মেয়েটি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার কাছ থেকে সম্পত্তির মালিকানা কেনার জন্য কোনও রহস্যজনক ব্যক্তি প্রস্তাব দিয়েছে। মনে হয় ঐ ব্যক্তি তুমি এখন যে শহরে আছ সেই শহর থেকেই এসেছে। ঐ ব্যক্তি আগামীকাল মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চায়। মেয়েটির মনে হয় ওর আর তোমার যৌথভাবেই সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। যে কোনও একজন যদি একা সিদ্ধান্ত নেয় এবং মালিকানা বিক্রী করে তাহলে সেটা অপরজনের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করবে।

-বুঝতে পেরেছি।

-আমি তোমাকে অযথা বিরক্ত করলাম না তো? তোমাকে খুঁজে পেতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হল। সময়ও গেল অনেক।

- শেষ অবধি আমাকে খুঁজে পেলেন কি করে?

- অবশেষে আমাকে মনীষা ঝা মানে মনীষা প্রসাদের দ্বারস্থ হতে হল।

-কিন্তু ও কী করে জানল আমি কোথায়? আমি তো ওকে কিছু জানাইনি।

-মনীষা জানে সাধারণত তুমি ওখানে গেলে কোথায় থাকো।

-এত কান্ড কেন করতে গেলেন? আমার অফিসে যোগাযোগ করলেই তো পারতেন। এই খবরের জন্য আমার একবছরের পুরনো সেক্রেটারির কাছে যাবার কী দরকার ছিল?

-দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি তোমার নতুন সেক্রেটারি এলিনা রাইএর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও আমাকে কোনও খবর দিতে পারলো না।

-তার মানে?

-মানে আবার কী? বলতেই পারলো না তুমি কোথায়।

-এসব কী বলছেন আপনি? আমি এলিনার সঙ্গে এবং অফিসের অন্যান্য সকলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।

-এমন হতে পারে যে তুমি এলিনাকে ফোন করার আগেই আমি এলিনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তখন হয়তো ও জানত না তুমি কোথায়। আমি তোমার অফিসে ধর আড়াইটে –পৌনে তিনটের সময়ে গিয়েছিলাম। ওতো কিছু বলতেই পারলো না।

-কী করে হতে পারে? আমি একবার সাড়ে এগারটার সময় আর একবার পৌনে দু’টোর সময় ওর সঙ্গে কথা বলেছি।

-তাহলে হয়তো এলিনা আমাকে কোনও খবর জানার যোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করেনি। যাইহোক, ছেড়ে দাও । এই নিয়ে বেশি ভেবো না।

-জানিনা। তাহলে আপনি যা বলছেন তাই হয়তো ঠিক। আচ্ছা, আপনি ঐ লোকটা যে মহিলাটির সঙ্গে দেখা করতে চাইছে তার নাম জানেন?

-না, মেয়েটি তো বলল ‘জনৈক রহস্যময় ব্যক্তি’।

-আমার মনে হচ্ছে আমি লোকটাকে চিনি। লোকটা আত্মগোপন করে আছে। লোকটা কিন্তু ভয়ঙ্কর। আপনাকে একটা উপকার করতে হবে মিঃ রায়। দেখতে হবে মেয়েটির নিরাপত্তা যেন কোনও ভাবেই বিঘ্নিত না হয়। ওকে বলুন যে আমার পনের শতাংশ বিক্রীর ব্যাপারে যতক্ষণ না আমি ফিরছি ততক্ষণ আপনি আমার প্রতিনিধিত্ব করছেন। সুতরাং ঐ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির নাম এবং ঠিকানা জানার ব্যাপারে আপনার সম্পূর্ণ অধিকার রইল। জানার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দয়া করে জানাবেন। আপনি সাভেরা মোটেলে ফোন করবেন এবং জুলিকে চাইবেন।জুলিকে নাম আর ঠিকানা দিয়ে দেবেন।

-শুধু জুলি বললেই হবে?

-হ্যাঁ, শুধু জুলি বললেই হবে।

-তুমি কি চাও আমি কোনও দাম বলি?

-না, এখন নয় । আগে দেখা যাক ওরা কত দিতে চায়। আমার মনে হয় ঐ লোকটা দামের কথা তুলবে না। আপনি বলবেন যে আমি এবং আপনি দু’জনেই এর মধ্যে জড়িত। স্পষ্ট করে বলে দেবেন যে ওরা যদি মনে করে ওরা ঐ মহিলার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলছে সেটা ওদের পক্ষে ভুল হবে। আমি এখন রাখছি। আর একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছে।

বড়কালী ফোন রেখে দিল।




সপ্তম পর্বঃ

রেবা কৈরালা পরেরদিন ঠিক দশটার সময় পানু রায়ের অফিসে এসে হাজির হলো। পানু রায় রেবাকে বসতে বলে বললেন,’ আমার সঙ্গে কাল কৃষ্ণকালীর কথা হয়েছে।‘

রেবা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,’ উনি কোথায়?’ পানু রায় বললেন,’ উনি আমাকে কাঠমান্ডু থেকে ফোন করেছিলেন।উনি আমাকে ওনার মালিকানা বিক্রী সংক্রান্ত কথাবার্তার ব্যাপারে দায়িত্ব দিয়েছেন যতক্ষণ না উনি ফিরছেন।আপনি যাকে জনৈক রহস্যজনক ব্যক্তি বলছেন তার সম্বন্ধে আমাকে জানার এবং বোঝার দায়িত্ব দিয়েছেন।যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে আমার মতামত জানাচ্ছি ততক্ষণ কোনও দাম ঠিক করা যাবে না।‘রেবা কিছু বললোনা। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনার কিছু বলার আছে?’

-না, আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম। কিন্তু কৃষ্ণকালীবাবু যখন এটা চাইছেন তখন আমার কোনও আপত্তি নেই।

-তাহলে, আপনি আমায় বলুন যে ঐ ব্যক্তি কে এবং কোথায় গেলে ওনাকে পাব?

রেবা একটু ইতস্তত করে বলল,’ লোকটার নাম শিবুলাল রেগমি। আজ সন্ধ্যাবেলা ৮-৩০ মিনিটে রিজেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে ২১১ নং ফ্ল্যাটে শিবুলালের সঙ্গে আমার দেখা করার কথা আছে। রিজেন্ট অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা ৯৪, ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ। আপনি কৃষ্ণকালীবাবুকে বলবেন যে এই ব্যাপারে উনি যা বলবেন তাই হবে। আমি শিবুলালের সঙ্গে দেখা করব কিন্তু সেটা কেবলমাত্র আলোচনা চালিয়ে যাবার স্বার্থে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমি এখন আসি।‘মৃদু হেসে ঘর থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল রেবা কৈরালা।

রেবা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী পানু রায়ের কাছে এসে বলল,’দাদু, আমি বাজি রেখে বলতে পারি ও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল তার কারণ ও ভয় পাচ্ছিল পাছে তুমি ওকে কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন কর।‘পানু রায় বললেন,’ তার মানে? আমি ওকে কী অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে পারতাম যে ও তাতে ভয় পেয়ে চলে গেল? কষ্টকল্পনার একটা সীমা আছে সুন্দরী।‘ সুন্দরী মুচকি হেসে বলল,’ ওতো জানে না যে তুমি জান না।‘ পানু রায় বললেন,’ সকাল সকাল হেঁয়ালি রেখে বলো কী হয়েছে।‘ সুন্দরী নিজের টেবিলে গিয়ে আজকের খবরের কাগজটা নিয়ে এসে পানু রায়ের সামনে খুলে বলল,’ দেখ, কী হয়েছে!’ পানু রায় দেখলেন খবর বেরিয়েছে যে কালীকৃষ্ণ অর্থাৎ ছোটকালী গতকাল একটি মেয়েকে বিয়ে করে পাটনা থেকে ফিরেছে। খবরের সঙ্গে নবদম্পতির ছবিও ছাপা হয়েছে। খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে পানু রায় বললেন,’ বাঃ, বেশ দেখতে মেয়েটিকে। মেয়েটির সম্বন্ধে কিছু লিখেছে কাগজে?’ সুন্দরী বলল,’ মেয়েটি কাঠমান্ডুতে মডেলিং করত। ওখানেই মাসদুয়েক আগে আলাপ হয়েছিল ছোটকালীর সঙ্গে। পানু রায় হেসে বললেন,’ছোটকালী কোনও কাজে দেরি করেনা দেখছি।‘ সুন্দরী বলল,’ কে জানে? তাড়া কার ছিল? মেয়েটিরও থাকতে পারে।‘পানু রায় বললেন,’ সুন্দরী, একটা কাজ করো। সাভেরা মোটেলে ফোন করে দেখ বড়কালীকে পাও কি না।যদি না পাও জুলি বলে কেউ আছে কি না দেখ।যদি জুলিকে পাও তাহলে ওকে শিবুলালের নাম, ঠিকানা দিয়ে দাও।‘সুন্দরী একটু দূরে গিয়ে ফোন করে খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল যে বড়কালীকে পাওয়া যায়নি তবে জুলিকে শিবুলালের নাম, ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে।পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ জুলির পুরো নাম বা জুলি কী করে জানতে পারলে?’

-না, তবে কথাবার্তার ধরণ থেকে মনে হল মহিলা ঐ মোটেলের ম্যানেজার বা ঐ জাতীয় কিছু।আমি জুলিকে চাইলাম এবং যে ফোন তুলেছিল সে বলল সেই জুলি।আমি তোমার নাম বলাতে ও জিজ্ঞাসা করল আমি বড়কালীর জন্য কোনও মেসেজ দিতে চাই কি না। আমি ওকে শিবুলালের নাম, ঠিকানা দিলাম। দাদু, এখন তুমি কী করবে ভাবছ?’

-ভাবছি আজ সন্ধ্যাবেলা রেবার আগেই আমি শিবুলালের সঙ্গে দেখা করব। আর তুমি একটা কাজ করো। হাজার পাঁচেক টাকার মধ্যে ছোটকালীর জন্য একটা উপহার কিনে রেখ।

-শিবুলাল তোমার সঙ্গে কথা বলবে মনে হয়?

-জানিনা। তবে ঐ ঠিকানায় শিবুলাল থাকলে আমি নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলবো।

0 comments: