2

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








সিলভিয়া প্লাথের কবিতা ও আত্মসন্ধান




সুপরিচিতা
সুস্মি,

তোমার ডাকে শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি। তোমার কাছে অজুহাত মনে হতেই পারে। তবে সত্যিই আমি অসুস্থ ছিলাম। তোমাকে যখন লিখছি বাইরে তখন কালবৈশাখী। খানিক আগেও আকাশ ঝলমল করছিল। চোখের পলকে সকালের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যার মতন অন্ধকার। জীবন তো এমনই তাই না? তোমার চিঠি পড়তে পড়তে সিলভিয়া প্লাথের ডেথ এন্ড কোং কবিতার কয়েকটা লাইন বহুদিন পরে মনে পড়ে গেলো। Two, of course there are two. It seems perfectly natural now — The one who never looks up, whose eyes are lidded And balled, like Blake’s, Who exhibits…

কতটা রিলেট করতে পারছো জানিনা। তবে কলেজ থেকে ফেরার পথে পাদ্রী সাহেবের গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে খুব। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা এইটুকু লিখতেই জীবনবাবুর কবিতা মনে পড়ল- চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে- সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে- কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে ! আমাদেরও দেখা হয়না কুড়ি বছর হলো। আবার অবাক করা কান্ড দেখো যে দুজনের কবিতা মনে হলো দুজনই যেন মিলেমিশে একজন। যাপনে, ভাবনায় এবং মরনেও! যদিও আমি জীবনানন্দ কে এগিয়ে রাখবো। তবুও অস্বীকার করার জায়গা নেই বিশ্বসাহিত্যে নারী কবি হিসেবে যারা সুপরিচিত তাঁদের মধ্যে মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩) অন্যতম। অথচ দেখো এই অমর কবি জীবনের কাছে প্রতারিত হয়েছেন, জীবন তাঁকে ক্রমাগত এক বিষণ্ণ, বেদনার্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। জীবনের করুণ জাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছেন। বেঁচে থাকার একঘেয়েমি কিংবা বেঁচে থাকার লড়াই তাঁকে ক্লান্ত করেছে। জীবন-মৃত্যুর দোলাচল তাঁর কবিতা আর জীবনকে ঘিরে থাকে তার মীমাংসা আমরা করতে পারি না। কেবলই পার্থিব জঞ্জাল আর বেদনাই তাঁকে অপার্থিব জগতে আকৃষ্ট করে।

জীবনানন্দকে গভীর মনোযোগ সহ নিরীক্ষণ করলেও দেখবো , কবির কাব্যশরীরে অন্ধকার প্রসঙ্গ এবং মৃত্যুচেতনার বারবাড়ন্ত যেন একটু গভীর নিকষ কালোর মত লেপ্টে রয়েছে। সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু চেতনা ঠিক জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু চেতনার মতো নয়। মৃত্যুকে জীবনানন্দ প্রেয়সী হিসাবে দেখতে চেয়েছেন প্লাথের ক্ষেত্রে মৃত্যু সর্বরোগহরা ওষুধমাত্র। সিলভিয়া শুধু জীবনাচরণে নন, বরং লেখার মেজাজে অনেকটাই কাছাকাছি থাকেন। এক অন্ধকার জগতে তাঁর কবিতার বসবাস। তবে তাঁর আঁধার জগৎ এডগার অ্যালান পোর অন্ধকার জগৎ নয়। রহস্য, রোমাঞ্চ নয়, বরং তার অন্ধকারের আড়ালে আছে ব্যথা ও বিদ্রোহের সুর। তাঁর কবিতার স্বরে নারী যন্ত্রণা, বেদনা ও মুক্তির গান খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ সিলভিয়া বিশ্ব কবিতায় এমন এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, যাঁর শক্তির উৎস নারীর অহম, বেদনা, গর্ব ও গর্ভ।

সিলভিয়া নিজের নারী এবং কবিসত্তার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি হব পৃথিবীর কতিপয় নারী কবিদের অন্তর্গত এমন একজন সম্পূর্ণত আনন্দিত নারী, কোনো তিক্ত, হতাশ, বিকৃত পুরুষ-অনুকারক নয়, যে অনুকরণ অবশেষে নারী কবিদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি নারী এবং নারীজন্মে আনন্দিত। আমি গান গাইব পৃথিবীর উর্বরতার, ক্ষয়-শোক-মৃত্যুর মধ্যে মানুষের উর্বরতার গান। আমি গায়িকা হব। টেড আর আমার সুন্দর মিলিত জীবন হবে’ (উদ্ধৃতি: ভাবনার ভাস্কর্য, কেতকী কুশারী ডাইসন)।

সিলভিয়া উচ্ছল-উদ্যম জীবনযাপন করলেও তাঁর নিজের কাছেই নিজের জীবনটা খুব অদ্ভূত মনে হতো। ১৯৫২ সালে যখন স্মিথ কলেজে সদ্য ভর্তি হলেন তখন নিজের প্রতিই সিলভিয়ার প্রশ্ন ছিল—‘You walked in, laughing, tears welling confused, mingling in your throat. How can you be so many women to so many people, oh you strange girl?’ প্রথাগত কবিতার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অভ্যন্তরীণ অনুভূতির সমন্বয়ে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় নতুন একটা আবেগ উগরে দেন প্লাথ। এটা কবির মানসিক অবস্থানও বলা যায়। সিলভিয়া প্লাথের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় (Confessional Poetry) অবলীলায় বলে দিয়েছেন অনেক গোপনীয় বিষয়। তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা সংখ্যাগত দিক থেকে অনেক বেশি। এবং ভাষা ও চিত্রনির্মাণ অনেক শক্তিশালী ও উন্নত। এখানে তিনি নির্ভীকভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আবেগ, সংগ্রাম প্রকাশ করেছেন। এসব কবিতার সফল অগ্রদূত বলা যায় তাঁকে। তাঁর আগে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা লিখে থাকলেও ধারাবাহিকভাবে অনেক শৈলীগত দিক, বক্তব্য-পষ্টীকরণ ও শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি দিক থেকে সিলভিয়া প্লাথ আলোচনার মূলকেন্দ্র। তিনি নারী হওয়ায় ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ (বাস্তবতা আরও বেশি ও ঝাঁজালো) করে বিশ্বের নারীবাদীদের ভরকেন্দ্রে রয়েছেন। বলে রাখি কনফেশনাল পোয়েট্রি মুভমেন্ট আমেরিকায় ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি শুরু হয়। রবার্ট লয়্যাল, সিলভিয়া প্লাথ, অ্যানি সেক্সটন এ-আন্দোলনের প্রবক্তা। টি. এস এলিয়ট, ডব্লিউ. বি ইয়েটস প্রমুখ এ-আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এরা সবাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কবিতায় প্রকাশ (কিছুক্ষেত্রে রাখঢাক না করেই) করেছেন। আজকের ‘মি টু’ ইত্যাদি আন্দোলন অনেকটা এ ধারাবাহিকতার নতুন সংস্করণ।
মাত্র ৩০ বছরের জীবন তাঁর। ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ তাঁর স্বামী ছিলেন। কিন্তু পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি স্বামীর সংসারে সুখে ছিলেন বলা যায় না! ফলে সহজেই কবিতা ও লেখায় নারীর অবজ্ঞা, অবহেলা, নেতিবাচক-ধারণা ইত্যাদি বাস্তবজীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নারীদের স্কেচ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। Daddz, Ladz Layarus, Ariel, The Applicant, Kindness, The Arrival of the Bee Box ইত্যাদি কবিতায় নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি, বিবাহপরবর্তী নারীর নির্ভরশীলতা, নারীর স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতা, পুরুষের ওপর নারীর প্রতিশোধ, নারীর স্বাধীনতা সর্বোপরি নারীপ্রগতি ও নারী-উন্নয়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। ছোট ছোট বাক্য, সরল শব্দ ব্যবহার করলেও সিলভিয়ার কবিতায় বহু প্রতীক, পুরাণের ব্যবহার আছে। অন্যদিকে ছোট ছোট শব্দ দিয়েই তিনি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেন, পুরো বাক্য বলেন না। ফলে প্রায়শই তাঁর কবিতা সহজপাঠ্য নয়। প্রায়শই তাঁর কবিতা বাড়তি মনোযোগ দাবি করে, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। নারীবাদী কবিতা, নারীর প্রতি অবহেলা, নারী প্রগতি ও উন্নয়নের কবিতা সিলভিয়া প্লাথকে আলাদা ও সাফল্যমণ্ডিত করেছে। তাঁর কবিতায় নিজের মানসিক অবস্থা, মাতৃত্ব, পরিবার এবং বিভিন্ন সম্পর্ক সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতা অসামান্য এবং দক্ষতাপূর্ণে নান্দনিক ভাষা দিয়ে সৃষ্টি। কখনওবা তিনি বিভিন্ন প্রতীকীর আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর কবিতা পরিচিত বোধের চেনা পরিমণ্ডলকে বারবার আক্রমণ করেছে। চির অস্থিরতার চোরা স্রোত বয়ে চলে প্রতিটি শব্দ আঁকিবুঁকিতে। শ্লেষ্মা ছিটানো গলায় প্লাথ বলেন : And I wear the wry-faced pucker The sour lemon moon. প্লাথের Ariel কবিতা-সংকলন ব্যক্তিগত মানসিক-যন্ত্রণার বিষয়াদি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। ১৯৬২ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্কারে’ প্রকাশিত প্লাথের টিউলিপস কবিতায় একটি হাসপাতালে টিউলিপের তোড়া গ্রহণকারী একজন মহিলাকে চিত্রিত করা হয়েছে। নার্সরা ‘উজ্জ্বল-সুচ’ দিয়ে মহিলাকে অসাড় করে। তিনি অ্যানেস্থেসিয়ায় আত্মহত্যা করেন। কবির কাছে সূর্যের চোখ এবং টিউলিপের চোখ যেন একই সমান্তরালে। যেন টিউলিপগুলি তাকে আঘাত করছে, তাকে দেখছে এবং তার অক্সিজেন চুষে নিচ্ছে। ''টিউলিপ''-এ শব্দের ক্ষমতায় কবিতা সত্যিই যেন দেওয়াল বেয়ে চলা সরীসৃপ। ফুলগুলোর জীবন্ত শ্বাসপ্রশ্বাস তার রোগী মনকে আরো অস্থির করে তোলে। কবিতাগুলির জীবন্ত ধুকপুক হাতের মুঠোয় ধরা যায়। টিউলিপের চোখ ফোটে লেখনীর ছোঁয়ায়। ভেসে ওঠে হাসপাতাল ঘর, শীতলতা, ওষুধের গন্ধ—কেবলমাত্র শব্দের গঠনে। খুব সহজেই শরীরের দখল ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে এক গভীর প্রতিবাদ লুকিয়ে থাকে। অভিমান কিভাবে বিশ্বজনীনতা ছুঁতে পারে প্লাথ না পড়লে বোঝা যায় না। নিজেকে জগৎ স্রষ্টার সাথে তুলনা করার দাপট তিনি দেখিয়েছেন—

I shut my eyes and the world drops dead.

গতানুগতিকতার বেড়ি মনে ও পায়ে তিনি কখনোই পরতে চান নি। অসম্ভব তেজিয়াল এক প্রেমিক সত্তা সমাজের মুখোশ, কৃত্রিম মানব সম্পর্কের জাল ছিঁড়তে চায় বারংবার। তার যন্ত্রণা তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমির সাথে হাত মিলিয়ে জন্মায়—

"The Times are Tidy : Unlucky the hero-born In this province of the stuck record Where the most watchful cooks go jobless"

প্লাথের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রকৃতিপ্রেম খুঁজে পাওয়া যায়, যা ঠিক রোমান্টিক কবিদের মতো না হলেও কবির বুকের অসহায়ত্ব ও আশ্রয় পাবার গভীর আকুতি ধ্বনিত করে। 'The Moon and the Yew tree' এই সত্য তুলে ধরেছে। অনির্বচনীয় সন্তান স্নেহ মেলে ধরেছে Plath-এর মধ্যেকার এক মাকে :

"I want to fill it with color ducks,"

আয়নার আলোতে এগিয়ে আসে আরেক মায়ের প্রতিবিম্ব যার প্রতি একাধারে নির্ভরতা আরেক দিকে বিদ্বেষ, ঘৃণা লক্ষণীয়। Mirror—"I am important to her. She comes and goes,/ Each morning it is her face that replaces the darkness,/ In me she has drowned a young girl and in me old woman".

সিলভিয়া প্লাথ ভালো চিত্রকরও ছিলেন, ছবিতে রঙের ব্যবহার ছবিকে যেমন অনেক বেশি ধ্রুপদী করে তোলে তাঁর কবিতাতেও সেই রঙের ব্যবহার দেখতে পাই খুব নিপুণভাবে। ধারণা করা হয় ১৯৬৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখা ‘প্রান্তরেখা’ (Edge) কবিতাটিই সিলভিয়া প্লাথের লেখা সর্বশেষ কবিতা। আত্মহত্যার মাত্র ছয় দিন আগে লেখা এই কবিতাটি তার ‘সুইসাইড নোট’ বলা যায়। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মানসিকতার একটা উৎকৃষ্ট নমুনা এই কবিতা। এই কবিতায় সিলভিয়া নারীর অর্থহীন জীবনকে তুলে ধরেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের ইচ্ছা ছাড়া নারী কিছুই করতে পারে না। আবার নারীর সব কাজকেই বিশেষত গৃহকর্মকে গুরুত্বহীন, অর্থহীন মনে করা হয়। প্লাথ তাই এমন এক মৃত নারীর কথা বলেছেন যার পূর্ণতা প্রাপ্তি হয় কেবল মৃত্যুতে। তাঁর ভাষায়, মৃত্যুতেই ‘নারীটি স্বার্থক পূর্ণতা পেয়েছে’। নারীর শরীর মৃত্যুর পর হেসে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘প্রান্তরেখা’ সিলভিয়া প্লাথের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন কবিতা (darkest poem)। এই কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রঙের ব্যবহার। সাদা, লাল আর কালো এই তিনটি রং এখানে রবার্ট গ্রেভসের ‘সাদা দেবীগণ’ তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ শতকের মাঝামাঝি পুরাণবিদ গ্রেভস রচনা করেন ‘দ্য হোয়াইট গডেস’। তিনি ইউরোপীয় মূর্তি পূজারিদের দেবীদের সম্পর্কে আলোচনা করে দেখান যে আসলে একজন দেবীই নানা নামে ও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। জন্মদান, জীবন ধারণ আর মৃত্যু আদতে একই নারী সত্তার কুমারীকাল, মাতৃত্বকাল এবং বৃদ্ধাকালের রূপান্তরিত চেহারা। এই তত্ত্ব মতে, সাদা হলো কুমারীর রং, লাল হলো মাতৃত্বের রং আর কালো হলো বয়োবৃদ্ধ কিংবা মৃত্যুর রং। সিলভিয়া এই প্রতীক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তার শেষ কবিতায় ‘সাদা সাপ’ ‘দুধের পাত্র’, ‘গোলাপ’, ‘রক্তাক্ত সৌরভ’, ‘রাত্রি’, ‘চাঁদ’, ‘কৃষ্ণতা’ ইত্যাদি চিত্রময়তা ব্যবহার করেছেন। সিলিভিয়ার সমগ্র কবিতাতেই রঙের প্রতীকী ব্যবহার দারুণভাবে করা হয়েছে। আরেকটি বিখ্যাত এবং জটিল কবিতা ‘লেডি ল্যাজারাস’। সিলভিয়া প্লাথের রচনারীতি বোঝার জন্য এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। ‘ড্যাডি’র মতো এ কবিতাতেও নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার আর হতাকাণ্ডের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাৎসিরা বন্দীদের চামড়া থেকে সাবান আর ল্যাম্পের শেড বানাত—কবিতার চতুর্থ ও পঞ্চম লাইনেই সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সিলভিয়া। অন্যদিকে প্লাথের আত্মহত্যাপ্রবণতা, ক্রমাগতে মরতে চাওয়ার চেষ্টা এই কবিতা এসেছে। ‘ড্যাডি’ কবিতার মতোই এ কবিতাতেও জার্মান ভাষার ব্যবহার রয়েছে তার পিতার উত্তরসূরি সূত্রেই। অন্যদিকে জনাব শত্রু বলতে স্বামী টেড হিউজকে বুঝিয়েছেন তিনি। পুরুষ বলতেই পিতা ও স্বামীর কথা এসেছে তার কবিতায় বারবার। পুরাণের আগুনপাখি ফিনিক্স এ কবিতায় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফিনিক্স সেই পাখি, যাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় এবং পোড়া ছাই থেকে তার বারবার জন্ম হয়। সিলভিয়া প্লাথও যেন বারবার মৃত্যু থেকে ফিরে আসেন। তিনি এ কবিতা যেন ডাক্তার মহাশয়ের উদ্দেশে লিখেছেন। প্রতি দশ বছরে একবার করে মরতে চাওয়া সিলভিয়াকে বারবার ডাক্তাররাই ফিরিয়ে এনেছে। তাই পরেরবার যখন সে মরার প্রস্তুতি নেবে তখন ডাক্তার আর পুরুষদের আগে খাবে।

১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে তোমাকে কি আর দিতে পারি বলো- কলেজ দিনে যেমন কবিতা পাঠাতাম তেমনি কবিতা পাঠালাম তবে আমার লেখা নয়, সিলভিয়া প্লাথের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠালাম। নিরন্তর ভালো থেকো।


পরিত্যক্তা (Jilted)

ভাবনাগুলো আজ শুকনো পাতার মতো—
কোনো এক হলদে বিকেলের স্তব্ধতায় ভেজা,

চোখ জুড়ে অম্ল জল

তিতকুটে চাহনির এক বিষণ্ণ, টক-হলুদ তারা
কাঁপছে নিঃশব্দ বিষাদের জ্বালায়।

রাতের হাওয়া ফিসফিসে—
ভালোবাসা নামে গুজব বয়ে আনে,
চাঁদের মুখে দেখি নিজের ছায়া—
এক পেকে না-ওঠা পাতিলেবুর ভাঁজ।

হৃদয়—
গ্রীষ্মের কাঁচা বরই,
ঝুলে আছে
শুকনো এক ডালে—
ছোট, সবুজ, তেতো।


রাত তিনটার মনোলগ (Monologue At 3 AM)

বরং অস্তিত্বের সব তার ছিঁড়ে যাক
উফ, মাথার ভেতর কী কষ্ট
রক্ত শুধু রক্ত ছিটকে পড়েছে
রক্তে ভিজে যাচ্ছে উজ্জ্বল চৌকি, কার্পেট, মেঝে —
আর দেয়ালের পাশে ঝুলে থাকা সাপ মার্কা বর্ষপঞ্জিকা সাক্ষ্য দেয় —
তুমি বহুদূর —মাঝখানে অস্তিত্বের একদিকে আমি অন্যদিকে তুমি
তুমি বেশ আছো সতেজতায় আর আমি —
এই নিঃশব্দ তারাদের নিচে কালো সময়ের অভিশাপ,
বিদায় সম্ভাষণ, জ্বালা করা চোখে বিদায়ী রেলগাড়ির স্মৃতি জড়িয়ে ধরে
সব হারিয়ে,
তোমার দিকেই তাকিয়ে আমার জগৎ
মুখের উপর দরজা বন্ধ করেছে
আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি আবারও।


ইতি—

বাসু
১৫ এপ্রিল,২০২৫

2 comments:

  1. বড্ড ভাল। আরও লিখুন। প্লাথের কবিতার সুন্দর অনুবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি লেখাটা পড়ে মতামত জানিয়েছেন তার জন্য অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। আপনার মতামত প্রেরনা যোগাবে সব সময়। নিরন্তর ভাল থাকুন...

      Delete