প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সঞ্চিতা বসু
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধদ্বারকেশ্বর নদীর ধারে বালি-দেওয়ানগঞ্জ, আরামবাগের গোঘাট অঞ্চলের একটি গ্রামই বলা চলে। গোঘাটেরই একটি অঞ্চল কামারপুকুর। ১৮৮০ সালে এই বালি-দেওয়ানগঞ্জে বাড়ি বানিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত বংশীধর মোদক। নতুন বাড়িতে যাওয়ার আগে তাঁর ইচ্ছা ঠাকুর ও মা তাঁর বাড়িতে একবার পদার্পণ করুন, সুযোগের অপেক্ষা করছেন। এল সুযোগ! একদিন ভাগ্নে হৃদয়ের সঙ্গে শ্রীমাকে নিয়ে ঠাকুর কামারপুকুর যাচ্ছেন, পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি প্রচণ্ড বৃষ্টি! নৌকো এসে ভিড়ল বালি-দেওয়ানগঞ্জে, সম্ভবত দ্বারকেশ্বর নদীতেই। ঠাকুর, শ্রীমা ও হৃদয়কে নিয়ে তিন দিনের জন্য থেকে গেলেন বংশীধর ও তাঁর স্ত্রী গিরিবালার বাড়ি। স্থানীয়দের সঙ্গে শাস্ত্রালাপে ও আনন্দে কেটে গেল তিন দিন, ধন্য হল বংশীধরের বালি-দেওয়ানগঞ্জের তৎকালীন নতুন বাড়িটি। এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বংশীধরের বাড়ির একটি ঘরে রয়ে গেল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা ও স্বামী বিবেকানন্দর ছবি, তিন দিনের স্মৃতিচিহ্ন ও আজীবনের অভিজ্ঞান। তাছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ বালি দেওয়ানগঞ্জে এখনও নিয়মিত সংগঠিত হয়।
এবার আসা যাক অন্য প্রসঙ্গে। বালি-দেওয়ানগঞ্জ আরামবাগের একটি বিখ্যাত মন্দির অঞ্চল। একাধিক মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্যর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় এই অঞ্চলে। ১৯৭২-এ David McCutchion, তাঁর ‘Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification’ বইতে এই অঞ্চলের মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্যর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। শুধু বৈশিষ্ট্যই নয়, মন্দিরগুলির মাপও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বালি-দেওয়ানগঞ্জের চারটি মন্দিরের উল্লেখ করতেই হয়।
১. দুর্গা মন্দির, ২১’১০’’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে জোড়-বাংলা রীতির ওপর নবরত্ন মন্দির (আনুমানিক উনিশ শতক)১
২. সর্বমঙ্গলা মন্দির বা বিষ্ণু মন্দির (বা দামোদর মন্দির David McCutchion-এর উল্লেখ অনুযায়ী), ২২.৫’’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে পঞ্চরত্ন মন্দির (আনুমানিক উনি শতক)২
৩. দামোদর মন্দির, ২২’ x ১৯.৫’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে ঘোষ পরিবারের উনিশ শতকীয় মেদিনীপুর ঘরানার আটচালা রীতির মন্দির (১৮২২)৩
৪. মঙ্গলচণ্ডী মন্দির, ত্রিতল ত্রয়োদশরত্ন, কিন্তু প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত (ফলে David McCutchion-এর উল্লেখ অনুযায়ী এটি কথিত তথ্য)৪
দুর্গামন্দিরের পাশের মন্দিরটি এই মুহূর্তে লোকমুখে সর্বমঙ্গলা মন্দির বা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিষ্ণু মন্দির হিসেবে পরিচিত, কিন্তু David McCutchion তাঁর বইতে মন্দিরটিকে রাউতপাড়ার দামোদর মন্দির২ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ তথ্য আর অন্য কোনো সূত্র দ্বারা সমর্থিত নয় বলেই আমরা মন্দিরটিকে সর্বমঙ্গলা বা বিষ্ণু মন্দির বলে উল্লেখ করছি। বালি-দেওয়ানগঞ্জের মন্দিরের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুর্গা মন্দিরটি। কারণ এর স্থাপত্য। মন্দিরটির নীচের অংশ জোড়-বাংলা রীতিতে গঠিত, অর্থাৎ পাশাপাশি দুটি দোচালা মন্দিরকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দুটি আয়তাকার দোচালাকে জুড়ে দিয়ে যেন একটি বর্গাকার মন্দিরভিত্তি প্রস্তুত হয়। দোচালা রীতি স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মাটির বাড়ি ও মাথায় ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে আসা খড়ের ছাউনিকে মনে পড়িয়ে দেয়। দোচালা মন্দিরকে একবাংলা রীতির মন্দিরও বলা যায়।৫ সেই হিসেবেই পাশাপাশি দুটি দোচালা মন্দিরই হল জোড়-বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো মন্দির শুধুমাত্রই দোচালা বা জোড়-বাংলা রীতিতে গঠিত। কিন্তু বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই মন্দিরটিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে এই জোড়-বাংলা রীতির মন্দিরের ওপরের নবরত্ন স্থাপত্যটি। দুটি দোচালার মাঝের অংশ দিয়ে উঠে গেছে এই নবরত্ন স্থাপত্য। এর জন্য জোড়-বাংলার ওপরে আরো দুটি তল নির্মাণ করতে হয়েছে। জোড়-বাংলা অংশের ঠিক ওপরে রয়েছে ত্রিখিলান যুক্ত একটি অংশ, যার চারদিকে রয়েছে চারটি রত্ন। এরও ওপরে রয়েছে আরো একটি ত্রিখিলান-যুক্ত তল, সেখানেও চারদিকে রয়েছে চারটি অপেক্ষাকৃত ছোটো রত্ন। আর এই অংশটির মাথার ওপর দিয়ে উঠে গেছে নবম রত্নটি, যেটি আকারে সব থেকে বড়ো। প্রতি তলের ছাদগুলি ঢালু। ত্রিখিলান-যুক্ত প্রবেশ পথের মধ্যে মাঝে সমান দূরত্বে দুটি পূর্ণ খিলান আর দুপাশে দুটি অর্ধ-খিলান দেখতে পাওয়া যায়। যেন মনে হয় তিনটি দরজা। জোড়-বাংলার ওপরে নবরত্ন মন্দির হিসেবে এই দুর্গা মন্দির আলাদা। তাছাড়া, এটির অনন্য হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ, জোড়-বাংলা অংশের মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা প্যানেল। অনেক গুলি ছোটো ছোটো প্যানেল ছাড়াও মন্দিরের ত্রিখিলান প্রবেশ পথের ওপরের জ্বলজ্বল করছে টেরাকোটার দুর্গাপ্যানেল, সঙ্গে লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিক। সম্ভবত এটিই পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরগাত্রের সবথেকে বড়ো টেরাকোটার দুর্গা প্যানেল। এখানে দুর্গা ও তার চারটি পুত্রকন্যা একই সঙ্গে সন্নিবিষ্ট নন। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা মন্দিরাকৃতির কারুকার্য খচিত বর্ডার তৈরি করা হয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে স্টাকোর কাজ। প্রতিটি মূর্তির নির্মাণশৈলী ত্রিভঙ্গ স্টাইল বা নাচের মুদ্রার মতো, যা খুবই শিল্পসম্মত। চারটি মূর্তি যেন পাশাপাশি চারটি আলাদা মন্দিরের কারুকার্য খচিত বর্ডারের মধ্যে নৃত্যরত, দুর্গা মূর্তিটি অন্য মূর্তিগুলির থেকে একটু বড়ো। দুর্গা মূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত, অন্য মূর্তিগুলি তুলনায় ভালো অবস্থায় রয়েছে। দুর্গা, গণেশ ও কার্তিকের বাহন থাকলেও লক্ষ্মী, সরস্বতীর বাহন নেই, লক্ষ্মীর হাতে পদ্ম দেখতে পাওয়া গেলেও সরস্বতীর বীণা মনে হয় এখন ক্ষতিগ্রস্ত, শুধু বীণা ধরার ভঙ্গিটি পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি মন্দির চূড়ার মাথায় একটি করে ছোটো লাল পতাকা উড়ছে। একদম ওপরের অংশে কয়েকটি পুরুষমূর্তি মন্দির গাত্রে চুন-সুড়কি দিয়ে খোদিত, যাকে অমিতাভ গুপ্ত বলছেন স্টাকোর কাজ, যেন তারা মন্দিরের রক্ষী, হাতে অস্ত্র নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে মন্দিরকে। জোড়-বাংলা অংশের মন্দিরের গায়ে ছোটো ছোটো অনেকগুলি টেরাকোটা প্যানেল রয়েছে। এই সব প্যানেলে দেব-দেবীর মূর্তির প্রাধান্যই বেশি, অল্প কিছু সাধারণ নর-নারীর মূর্তিও রয়েছে। তারাপদ সাঁতরা উল্লেখ করছেন এই প্যানেলের মধ্যে ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের দৃশ্যর কথা। এছাড়া, শিব-পার্বতী, কালী, মৈথুনরত নরনারী, গঙ্গা, গণেশজননী, হুঁকো খাওয়ার দৃশ্য রয়েছে। হুঁকোসেবনের প্যানেলে অনেকেই শৈব প্রভাব খুঁজে পেতে পারেন। এছাড়াও একাধিক প্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত। তবে দেবদেবী, নরনরী মূর্তির প্রাধান্যই বেশি। একটি প্যানেলে টুপি পরা এক সাহেবের সঙ্গে এক দেশিয় ব্যক্তিকে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখা যায়। প্যানেলের বিষয়ের দিক থেকে এগুলিই জনপ্রিয় বলা যেতে পারে।
আরো একটি কারণে মন্দিরটি মনে রাখার মতো। সেটি হল ত্রিখিলান যুক্ত অংশের ঠিক ওপরে উল্লম্ব অবস্থানে থাকা তেকোনা বর্শা ফলক বা মৃত্যুলতা প্যানেল। এই মন্দিরে চারটি বর্শা ফলক বা মৃত্যুলতা প্যানেল আছে। যার মাঝের প্যানেলগুলিতে নরনারীর মূর্তি এবং ধারের দুটি প্যানেলে অশ্বপৃষ্ঠে সৈনিক বা জীবজন্তু বা নারীমূর্তি খোদিত রয়েছে। এই বর্শা ফলক সম্পর্কে জরুরি তথ্য দিয়েছেন তারাপদ সাঁতরা।৬ তাঁর মতে রত্নশৈলীর ধরনটির সঙ্গে রথের গঠন কৌশলের মিল আছে। রথ নির্মিত হত কাঠ দিয়ে। কাঠখোদাইয়ের ভাস্কর্যের ছাপ পড়েছে রত্ন রীতিতেও।
“কাঠের রথের প্রতি কোণে কোণে (সূত্রধর স্থপতিদের পরিভাষায় যা ‘বর্শা’ নামে খ্যাত) খাড়াভাবে উৎকীর্ণ করা তিনকোনা আকারের যে কৌণিক ভাস্কর্যটি দেখা যায়, সেটিতে রূপায়িত হত হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, হরিণ ও মোষ প্রভৃতি জন্তুজানোয়ারের মিছিলের উপর সন্নিবদ্ধ বর্শা হাতে কোনো অশ্বারোহী সৈন্য অথবা কোনো নর্তকী বা নারী প্রভৃতি খোদিত মূর্তি। রথের এই কৌণিক ভাস্কর্যের মতোই বিশেষ করে বাংলার রত্ন মন্দিরের অলংকরণ সজ্জা হিসাবে মন্দিরের চারকোণে এই ধরনের ‘বর্শা’ ভাস্কর্য প্রযুক্ত হয়েছে...।”৭
খেয়াল করার দুর্গা মন্দিরের জোড়-বাংলা অংশের চার কোনায় নয়, খিলানের ওপরের চারটি অংশে বর্ষা ফলক বা মৃত্যুলতা খোদিত রয়েছে। যেন মন্দিরে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় মোহমুক্তির দিক নির্দেশ করবে এই প্যানেলগুলি। হাতে বর্শা নিয়ে সৈন্যরা যুদ্ধরত, এজন্যই হয়ত নাম বর্শা ফলক। আবার যেন মৃত্যুকেই এই ফলকগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে, লতার মতো মন্দিরগাত্রে উল্লম্ব ভাবে সজ্জিত, তাই এর নাম মৃত্যুলতা, তাও হতে পারে।
দুর্গা মন্দিরের ঠিক পাশের রয়েছে সর্বমঙ্গলা মন্দির। একে স্থানীয়রা বিষ্ণুমন্দিরও বলে থাকেন। আবার David McCutchion-এর মতানুযায়ী এটি দামোদর মন্দির। কিন্তু আপাতত এটিকে সর্বমঙ্গলা মন্দির বলে উল্লেখ করা গেলেও, David McCutchion-এর আরো একটি উল্লেখ এখনকার দৃশ্যর সঙ্গে মেলে না। তাঁর মতে এটি পঞ্চরত্ন মন্দির। কিন্তু মাঝের রত্নটি ছাড়া এই মন্দিরের অন্য কোনো রত্ন অবশিষ্ট নেই, এমনকি মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা কাজগুলিও নেই। তবে কোনো এক সময়ে এটি সে একটি সুসজ্জিত মন্দির ছিল, তার ছাপ এখনো রয়ে গেছে। এই মন্দির গুলির পেছনের অংশের রয়েছে মঙ্গলচণ্ডীর মন্দির। যেটি ত্রয়োদশ রত্ন বলে লোকমুখে কথিত, কিন্তু যার ভগ্নাবশেষটুকুই এখন অবশিষ্ট, এবং David McCutchion-ও এই ভগ্নাবশেষের উল্লেখই করেছেন। চারটি মন্দিরের মধ্যে এটিই সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত, যার ইঁটগুলিই শুধু এখন দেখা যায়, মন্দিরের দেওয়ালে। শুধু মাত্র একটি অর্ধভগ্ন রত্ন কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। খুব সামান্য ভাস্কর্যই দেখতে পাওয়া যায় মন্দিরের ওপরের ও নিচের দিকের অল্প অংশে। মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে দামোদর মন্দির। এর গঠনে উনিশ শতকীয় মেদিনীপুরের চালা রীতির ধরন দেখতে পাওয়া যায়। David McCutchion এই মন্দিরটিকে আটচালা ধরনের মন্দির বলেছেন, যার রীতি মেদিনীপুরের আটচালার মতো। তিনি আটচালা মন্দিররে দুটি আলাদা শৈলী লক্ষ করেছিলেন, যেটি হুগলি, হাওড়া ও দুই চব্বিশ পরগণায় দেখতে পাওয়া যায় যেটি তাঁর মতে আঠারো শতকের হুগলি-বর্ধমান রীতির অন্তর্গত আটচালা, অন্যটি উনিশ শতকের মেদিনীপুরের ধরন। এক্ষেত্রে চারচালা মন্দিরের মতো ‘রথপগ’ বিন্যাসটি আটচালা মন্দিরের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। এই ‘রথপগ’ বিন্যাসের আটচালা রীতিকেই McCutchion উনিশ শকের মেদিনীপুরের রীতি বলতে চেয়েছিলেন। বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই দামোদর মন্দিরটির সামনের অংশে একটি টিনের ছাউনি অনেক পরে লাগানো হলেও, এর বেশ কিছু টেরাকোটা প্যানেল এখনও বেশ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরের ওপরের অংশের কারুকার্যও অনেকটাই দেখতে পাওয়া যায়। প্যানেলগুলির মধ্যে অনেকগুলিতেই বিষ্ণুর দশাবতারকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তারাপদ সাঁতরা এই মন্দিরের ষষ্ঠীদেবীর মূর্তির প্রতি আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।৮ কারণ তাঁর মতে পৌরাণিক দেবদেবীর প্রাধান্য থাকলেও লৌকিক দেবদেবীকেও শিল্পী পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে পারেননি।
নিঃসন্দেহে মন্দিরগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের একটি সাইনবোর্ড মন্দির সংলগ্ন অংশে দেখতে পাওয়া গেলেও, প্রশ্ন থেকেই যায় সংরক্ষণ নিয়ে। এই লেখাটি ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের। পরবর্তী পাঁচ বছরে মন্দিরের কিছু সংরক্ষণ হয়েছে বটে। তবে তাকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ, ইউ টিউবের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে মন্দিরটি রঙ করা হয়েছে এবং কিছু অংশ সারানো হয়েছে। সমস্যা হল, এ ধরনের মন্দির সারানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু ভিডিওগুলি দেখে মনে হচ্ছে সারানো হলেও দুর্গামন্দিরের ওপরের নবরত্ন অংশটির সূক্ষ্ম কারুকার্য আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বা নতুন করা রঙের আড়ালে তার বেশ কিছুটা অদৃশ্য। এমনভাবেই রঙ করা হয়েছে যে, অপরের নবরত্ন অংশটির সঙ্গে নিচের জোড়-বাংলা অংশের রঙের সাদৃশ্য নেই, বেশ একটু বেমানান লাগছে। অনেক পর্যটকেরই মনে হতে পারে, আশেপাশের মানুষজনের আনাগোনা মন্দিরটির ক্ষতি করছে, হয়ত কিছুটা সত্যিই। কারণ মন্দিরের সামনের অংশ ও সামনের প্রাচীর স্থানীয়দের অবাধ ব্যবহার্য, তা ওপরের তোলা ছবি থেকেই পরিস্কার। তবে এখন সামনের অংশ রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, তাতে কতটা উন্নতি হয়েছে তা জানা যায় না। তাছাড়া মন্দিরের দেখভাল যে স্থানীয় মানুষেরাই করেন, এ বিষয়ে সংশয় নেই। মন্দিরের পুজোর আয়োজনও তাঁরাই করেন। মন্দিরগুলির ভেতরের দেবদেবীর মূর্তি দেখার সৌভাগ্য হয়নি ২০১৯-এ, বাইরের কারুকার্য দেখেই মন ভরাতে হয়েছিল, তা এতই দৃষ্টি আকর্ষণকারী ছিল। তাছাড়া, মন্দিরগুলি বিখ্যাতই হয়েছে মন্দিরের বহির্ভাগের কারুকার্যের জন্য।
বালি-দেওয়ানগঞ্জ নামটি অনেকের কাছেই পরিচিত নয়। রাস্তা খুঁজে রাউতপাড়ার মন্দির পর্যন্ত পৌঁছতে ২০১৯-এ বেশ অসুবিধেই হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মন্দির নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের লেখায় এই অঞ্চল এবং দুর্গা মন্দিরের কথা একাধিকবার উঠে এসেছে, এবং খুবই পরিচিত নাম। কারণ এত অনন্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। তাছাড়া কামারপুকুর থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত না হওয়ার কারণে এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সেবামূলক কাজের জন্য জায়গাটির পরিচিতি ক্রমশ বাড়ছে। মন্দির সংরক্ষণের দিকটিতে আরো একটু মনোযোগ দেওয়া গেলে হয়ত জায়গাটি আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন উনিশ শতকের শেষভাগে বালি-দেওয়ানগঞ্জে এসেছিলেন, মন্দিরগুলির অস্তিত্বও তখনও ছিল হয়ত, অন্তত গবেষকদের হিসেব তাই বলছে। মন্দির সংলগ্ন অংশ থেকে দ্বারকেশ্বর নদী খুব দূরে নয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়ের লাল আভা, নদীর ধারের লাল মাটি, দ্বারকেশ্বরের জল ও চারপাশকে যখন রাঙিয়ে দেয়, তেমনই সূর্যরশ্মি রাঙিয়ে দিয়ে যায় মন্দির চত্বর। ঠিক সেই মুহূর্তগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের সম্ভবত সবথেকে বড়ো দুর্গা প্যানেলের ওপরের উড়ন্ত লাল পতাকা তাতে যে আরো একটু রঙ যোগ করে তাতে কোনো সন্দেহই নেই।
তথ্যসূত্র:
১. McCutchion, J, David, Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification, The Asiatic Society, Kolkata, 1972, Page – 28-29
২. Ibid, Page – 47
৩. Ibid, Page – 36
৪. Ibid, Page – 55
৫. সাঁতরা, তারাপদ, পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির ও মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা – ১৭
৬. ঐ, পৃষ্ঠা – ২৬
৭. ঐ, পৃষ্ঠা – ২৬
৮. ঐ, পৃষ্ঠা - ৬০
সহায়ক গ্রন্থ:
১. সান্যাল, হিতেশরঞ্জন, বাংলার মন্দির, কারিগর, কলকাতা, জানুয়ারি ২০২৩
২. সাঁতরা, তারাপদ, পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির ও মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮
৩. সাঁতরা, তারাপদ, কলকাতার মন্দির-মসজিদ: স্থাপত্য-অলংকরণ-রূপান্তর, আনন্দ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৬
৪. রায়, প্রণব, বাংলার মন্দির: স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, পূর্বাদ্রী প্রকাশনী, তমলুক, জানুয়ারী, ১৯৯৯
৫. McCutchion, J, David, Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification, The Asiatic Society, Kolkata, 1972
৬. Michell, George (Edited), Brick Temples of Bengal: From the Archives of David McCutchion, Princeton University Press, Princeton, December 1983
৭. Companions and Followers of Sri Ramakrishna, Advaita Ashram, Uttarakhand, March 2021
সহায়ক ওয়েবলিঙ্ক:
১. Bali Dewanganj, Holy Trio Footprints.com, A Virtual Pilgrimage
https://holytriofootprints.com/bali-dewangunj/, Date: 22.09.2024
২. Datta Rangan, Bali Dewanganj: Terracotta at its Best, Wordpress.com
Date: 2.1.2022
৩. Gupta, Amitabha, The Most Unique Brick Temple of Bengal, Wordpress.com
Date: 2.1.2022
৪. Bansidhar Modak and Giribala – Biographies, biographies.rkmm.org
Date: 22.09.2024
0 comments: