গল্প - রূপশ্রী ঘোষ
Posted in গল্পমনে হয় একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। কী হবে কেউ জানে না। সবাই ভাবছে কিনা তাও জানে না সৃজনী। কিন্ত তার নিজের মনে হচ্ছে কিছু একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আছে। দূরে একটা ট্রেন, তাও যেন কেমন মন খারাপ করে একা হেঁটে যাচ্ছে, দৌড়চ্ছে না। ঢিমে তাল। দুর্দিনটা কীভাবে আসবে এটা নিয়েও ভাবে সৃজনী। ভূমিকম্প রূপে, প্রলয় রূপে, তীব্র ঝড় ঝঞ্ঝা হয়ে? নাকি অন্যকিছু? কিছুই ভেবে উঠতে পারে না সে, কিন্তু একটা দুর্দিন যে আসবে সেটা সে বোঝে। কারণ আর তাদের বাড়ির উত্তর পুর্ব কোণের ছাদে বসে একটা কাক এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে ওটা নাকি খুব খারাপ ব্যাপার! জ্যোতিষ না বললেও, সৃজনীর মনে মনে যেন কিছু একটার আভাস পাচ্ছে। আজ ভোরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দেখল একটা শকুন মনমরা হয়ে দূরের একটা বাড়ির ছাদ থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও কোনো খাবার মেলেনি হয়তো। দুদিন আগেও দেখল সুইমিং পুলের জলে ভোরের চাঁদটা খুব কাঁপছিল। কেন কাঁপছিল সৃজনী জানে না। এই নয় যে, বাইরে খুব জোরে বাতাস বইছিল। বাতাসও কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঝড়ের পূর্বে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, এটা সি স্তব্ধতা কী কে জানে। সবই কেমন যেন একটা ভাসা ভাসা, অনিশ্চিত ব্যাপার। তবুও একটা দুর্দিন যে ঘনিয়ে আসছে সেটা সে খুবই বুঝতে পারছে। দিনদিন রোদ খুব চড়া হচ্ছে। বারান্দার গাছগুলোয় নিয়মিত জল দিয়েও বাঁচানো যাচ্ছে না। কাগজফুল, অর্কিড আর দু একটা নাম না জানা ফুল তার টবে আছে। সে খুব বেশি গাছ চাষও করেনি, আর গাছেদের নামও বিশেষ জানে না। এরমধ্যে স্নেক প্ল্যান্টটা পুরোই মরে গেল। গোড়া উপড়ে ফেলে দিতে হয়েছে গাছটা টব থেকে। আর একটা পাতাবাহার, রোজই প্রায় পাতা ত্যাগ করে খোলস ত্যাগের মতো। দুদিন ছাড়াই দেখা যায় গাছটার গোড়ার দিক থেকে একটা করে পাতা ব্রাউন হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে, অভিমানে না লজ্জায় বোঝা মুশকিল মাথা নত করেই থাকে। গোড়া থেকে সেই পাতাটা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় সৃজনী। জানলার ধারে দাঁড়িয়েও সে দেখে দূরের ঘাস, শহরের গাছ, অন্যান্য বাড়ির ছাদের ফুল সব কেমন শুকিয়ে যেন একটা জেহাদ ঘোষণা করছে। কিসের জেহাদ কে জানে। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত সৃজনী ওই একই জিনিস দেখতে পায়। সবাই যেন প্রতিবাদ করতে করতে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে টাইপের অবস্থা। তবুও কোথাও কি খুশির খবর নেই? আছে তো। আজ মৌমিতা দৌড়ে এসে বলল, সে টিমের ওনার। সে একটা টিম কিনেছে। তাদের কমপ্লেক্সে। হ্যাঁ, একেবারেই আই পি এলের মতো ব্যাপার আর কী। একেবারেই খেলা খেলা ব্যাপার। কারণ খেলোয়াড়রা টাকা পায় না। কিন্তু সব নিয়ম কানুনই হয় ওই আই পি এলের নিয়ম মেনে। এখানেও অকশন বিড হয়, টিম ওনার থাকেন, খেলোয়াড় কেনা হয়, টাকা না পেলেও। একটা মিছিমিছি দাম হাঁকা টাইপের, কিন্তু টিম ওনাররা নাকি টাকা পায় শোনা গেছে। পিচ তৈরি করে, রাতে মাঠে আলো-টালো দিয়েই খেলা হয়। একেবারে ইলাহি ব্যাপার। মৌমিতা দৌড়ে এসে সৃজনীকে বলল,
হাই! হ্যালো! কেমন আছো? গুডমর্নিং
গুডমর্নিং, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো?
ভালো আছি। জানোতো আমি একটা টিম ওনার। কিন্তু সবাই কেমন আমার পিছনে লাগছে। বলছে আমার টিম নাকি হারবে।
ও তাই নাকি? তুমি টিম ওনার? দারুণ ব্যাপার তো। না না জিতবে তোমার টিম চিন্তা কোরো না
সৃজনী মৌমিতার আহ্লাদি আহ্লাদি গলা থামিয়ে দিয়ে তাকে জেতার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে গেছিল। সৃজনীর মনে হল, মৌমিতা নিজেকে কেমন যে নীতা আম্বানি নীতা আম্বানী ভাবতে শুরু করেছে। খুশিতে টগবগ করছে। খুব এন্থুজিয়াসটিক মহিলা, তাকে দেখলেই বোঝা যায়। কোনো একটা ছুতো নাতা পেলেই সে হইহই করতে ভালোবাসে। খুব মজা করে, ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে এনজয় করে সব ব্যাপার। সৃজনীর দেখে মনে হয়, বাঃ এই তো বেশ ভালো ব্যাপার। কোথাও তো খুশি বেঁচে আছে। তার চারপাশের মানুষজন কেমন আনন্দে আছে। এসব দেখতেও বেশ ভালো লাগে। তবুও তার মধ্যেই তার মনে হয় একটা দুর্দিন এগিয়ে আসছে। কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর সে শুনতে পায়। কোথাও কি তাল কেটে গেছে? নাকি একতারার তারটাই ছিঁড়ে গেছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সৃজনী। তাহলে কি আর বাউল গান হবে না? আর কি শান্তিকেতন যাবে না সে? ট্রেনে উঠে কত বাউল শুনেছে সে। এ সুরেও তো মন উদাস হয়েই থাকে। এও তো বিষাদ। বিষাদ সুর শুনে আনন্দ কিংবা সুখ হতে পারে কিন্তু খুশি বা উত্তেজনা কি হবে? উন্মাদনা? বাউলরা তো উন্মাদই। বায়ু রোগ। কে জানে। সৃজনীর ফোন বেজে ওঠে। দূরের গ্রাম থেকে আসা এক খবর। একশো কিলোমিটার দূরে এক ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সেখানে দিঘির শীতল জল আছে। জলের বুকে হাঁস খেলে বেড়ায়। দূরভাষ বেজে ওঠে। দূরভাষের কাজই তাই। দূর থেকে ভেসে আসা, ভেসে যাওয়া। সৃজনীর ভাই জানতে চাইল,
কি রে তুই কী কিছু পার্সেল পাঠিয়েছিস?
হ্যাঁ, গেছে ওটা?
হ্যাঁ, এসেছে তো। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, যার জিনিস সে ঠিক বুঝেছে। সে ওটা পেয়ে খুব খুশি। নিয়ে পুরোনো বাড়িতে চলে গেছে। দিদিদের দেখাতে। সে তো আনন্দে লাফাচ্ছে।
যাক ওটা যে পৌঁছেছে সেটাই দেখার ছিল। ওটা একটা পরীক্ষামূলক পাঠানো গিফট। এখন ওখানে অনলাইন জিনিস পাঠানো যায় কিনা সেটাই দেখার ছিল। যাক তাহলে এবার চাইলে এটা সেটা পাঠাতে পারি।
হ্যাঁ, পারিস তো। সব আসে এখন।
বলে আরও একটা কুশলাদির খবর নিয়ে সৃজনী ফোন রেখে দিল। ভাবল, এই তো খুশি আনন্দ এসব কিছু নেই সে ভাবছে কেন? দিব্যি আছে। খুঁজে নিলেই হয়। সৃজনীর একটা ছোট্ট ভাইজি আছে পাঁচ বছরের, সে লিপস্টিক পাগল মেয়ে। সৃজনীকে দেখলেই বলে, ‘পিসিমনি লিপস্টিক কিনে দেবে। তুমি এবার যখন আসবে লিপস্টিক নিয়ে আসবে আমার জন্যে’। ছোট্ট ভাইঝির আবদার মেটাতে সে এই অনলাইন ব্যবস্থার সাহায্য নেয়। সব সময় অতদূরে যাওয়া সম্ভব হয় না। গিয়ে ফেরাটা একটু পরিশ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সময় সুযোগ বুঝে যেতে হয়। কিন্তু মন তো খচখচ করে ভাইঝির আবদারে। তাই সে অনলাইনেই পাঠিয়ে দেয়। এভাবে দূর থেকেই একটু তার আবদার ছুঁয়ে নেওয়া। একশো কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম। সেখানেও আজ সব জিনিস অনলাইন পৌঁছে যায়। সব সংস্থা থেকেই। কলকাতা বা কলকাতার কাছে হতে হবে এমনটা আর নয়। চোখের সামনে সব দ্রুত কেমন বদলে যাচ্ছে। দৃশ্যগুলো খুব দ্রুত চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। একটা একটা দৃশ্য, তার আয়ু খুব ক্ষীণ। যেন আর বেশিদিন করে টিকতে চায় না, রচিত হয়েই শেষ হয়ে যেতে চায়। গ্রাম শহর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে দেশ বিদেশ হয়েছে। গোটা পৃথিবী এখন গোটা গ্রাম। সত্যিই তো আর তো কোনো তফাৎ নেই। সব কেমন কাছের হয়ে গেছে। কেবল কাছের হচ্ছে না, একজন মানুষের কাছে আর একজন মানুষ। বা কাছের মানুষ বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তারা, সব দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এত দূরে সরে গিয়ে সব যাচ্ছে কোথায়? কেউ জানে না। তবুও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সৃজনীর সেই এক আশঙ্কা কিছু যেন একটা দুর্দিন আসতে চলেছে। সেই দুর্দিনে কী অপেক্ষা করছে কেউ জানে না। জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি। কিন্তু এ দুটোর মাঝে কি আর কোনো দুর্দিন হতে পারে? যদি হয়, তাহলে সেটাই বা কী? সৃজনী নিজেও জানে না, কিন্তু সে খুব ভালোমতো বুঝতে পারছে একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে, কালবৈশাখীর ঘন কালো মেঘের মতোই। রাস্তা খুব প্যাচপেচে। কদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি হল। সে একটু ভিজেও গেছে বেরিয়ে। শোনা যাচ্ছে আরও বড়ো কোনো আশঙ্কার কথা, কারণ সরকার থেকে অরেঞ্জ অ্যালার্ট জারি হয়েছে। এর মধ্যেই সৃজনী তার পরিচিত মানুষদের থেকে মেসেজ পেতে থাকল,
কি রে তোদের ওখানে ভূমিকম্প টের পেলি? খবরে তো দেখাচ্ছে ওদিকের সব সিলিং ফ্যান দুলতে দেখা গেছে…
না, কোনোরকম কম্পনের টের পাইনি। আজকাল ফেসবুক না খুললে বুঝি না যে, ভূমিকম্প হয়েছে।
সে কি? পাসনি?
না, ভূমিকম্প কেবল সোস্যাল মিডিয়ায় হয়। ছোটোবেলার মতো আর শাঁখ বাজিয়ে তুলে দেওয়া হয় না বা কিছুবছর আগে পর্যন্ত যে, কলকাতার হাইরাজগুলো থেকে সব ভয়ে নেমে এসে গেট টুগেদার হত সেসবও হয়। এখন মানুষের অভ্যেস হয়ে গেছে আফটার শকের আর ভয় পায় না…
ভূমিকম্প ঘিরে সৃজনীর অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সবার আগে মনে পড়ল তার প্রতিবেশী সোমালিদির কথা। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অজ্ঞান হয়েই পড়ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামা তো দূরের কথা। ঘর থেকে বেরিয়ে লবিতে বসে বসে কান্না আর কাঁপ। সৃজনী একটুও ভয় না পেয়ে, তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই সে ফেসবুক, টিভি সবই অন করল। চোখ কপালে তুলে সৃজনী কেবল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। দেশলাই বাস্কের মতো গুঁড়িয়ে যাওয়া, ধসে পড়া ধ্বংসস্তুপ আর হাহাকার শুনতে লাগল। থাইল্যান্ডের রজধানী ব্যাঙ্কককের একটা নির্মীয়মান হাইরাইজ চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যাওয়ার ভিডিও সে দেখতে পাচ্ছে… এরপর মৃত্যু নিয়ে আর ভাবার কী আছে তার। মায়ানমারে এমন দুর্দিন মানুষ টের পাচ্ছে, তার প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বকলকাতা দিল্লিও তার সামান্য আঁচ পেয়েছে। যা সৃজনী পায়নি। কিন্তু সৃজনী আরও কোনো বড়ো দুর্দিন আসার সঙ্কেত যেন ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। এটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোন রূপে তা আসবে সেটার সে আজও টের পায়নি। কিন্তু লোকজন বলাবলি, ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে কলকাতা নিয়ে। কলকাতায় এখন অনেক আকাশছোঁয়া বিল্ডিং। সেগুলোও দেশলাই বাক্স হবে কিনা এ বিষয়টা এখন মানুষের বৈঠকি আড্ডার ঢুকে পড়েছে।
সৃজনীর মতো কেউই জানে না সে দুর্দিন কীভাবে আসছে। কিন্তু আসছে। প্রকৃতি নটরাজ হলে কারোর কোনো রেহাই নেই। জীবন এখন গলা পর্যন্ত দুর্দিনে ডুবে থেকেও আরও বড়ো কোনো দুর্দিনের অপেক্ষায়।
কিন্তু কতটা বড়ো কেউ জানে না। সৃজনী কেবল টের পায় একটা দুর্দিন আসছে অবিলম্বে।
এরমধ্যেও তার সেই ছোট্ট ভাইঝি এতটাই খুশি যে, সে রোজ লিপস্টিকের বাক্সটা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোতে যায়। এর থেকে বড়ো শান্তি সৃজনীর কাছে আর কিছু নেই। টিভি বন্ধ করে দেয়।
0 comments: