0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in



















।। ১ ।।

কোজাগরী জোৎস্না।মাথার উপর থালার মতো চাঁদ। রুপোলি আলোর প্লাবনে হাবুডুবু খাচ্ছে সারা গ্রাম।গাছগাছালি,ঘর-বাড়ি,মাঠ-ঘাট জ্যোৎস্নায় বিভোর। খিলখিল করছে সর্বত্র।তার আভায় পাড়ার খেলার মাঠও এখন টইটুম্বুর।বউ-ঝি,ছেলে-পুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে।গোটা মাঠ এখন কয়েকটা ভাগে সীমানা তৈরি করেছে।

এই কোণে বউ-ঝিরা।

বউ-বসান্তি খেলছে। ঐ তো, একটা মেয়ে

কিৎকিৎ কিৎকিৎ করে, বউয়ের মাথা ছুঁয়ে, দৌড়ে তাড়া করছে অপর পক্ষের মেয়েটাকে।সেও আঁক-কেটে, বাঁক-কেটে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।তার দলের অন্যরা তখন বউকে মুনে আছে,যাতে উঠে পালাতে না পারে!

মাঠের মাঝে ছেলে-পুলের দল।

কাবাডি খেলছে। অন্যের কোর্টে ঢুকে একজন লাফাচ্ছে আর কাউকে ছুঁয়ে পালিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে

-কাবাডি,কাবাডি…

-ভোলা, মেরেই আসবি। দম ফেলবি না। যাহ, মেরে এলেই আমার শালী তোর… মার ভোলা। মেরে আয়য়য়য়…

উত্তর দিকটায় মাঝবয়সীরা গল্প-গুজবে মশগুল।কারো কারো হাতে বিড়ির আগুন জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলোয় তাদেরই একটা দল আবার তাস খেলছে।

রাস্তার কোলটা বয়স্কদের।ইটের রাস্তায় বসে, পা ঝুলিয়ে আছেন মাঠে।একথায় সেকথায় তাঁরাও চন্দ্রতাপে বার্ধক্যকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ফেলে আসা কোজাগরী রাতে।

এ গ্রামের বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো। বলতে গেলে প্রায় সবাই রাত জাগে। ভরা জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে, হুল্লোড়ে, গল্প করে কাটিয়ে দেয়। এটুকুতে সবার ছাড়।কেউ কাউকে বকেও না।এ রাতটার জন্য সমবচ্ছর অপেক্ষা করে তারা।

সন্ধ্যা থেকেই হরিনামের দল, বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়ায়। দু'পাড়ার দুটো দল।যেমন পুরোহিত নিয়ে কাড়াকাড়ি,তেমনি ঐ গানের দলের। পুরোহিত না পেলে নিজেরাই সেরে নেয়,কিন্তু হরিনামের দল লাগবেই।বলতে গেলে তারা সারারাত গান গেয়ে, সব বাড়ি তাই শেষ করে উঠতে পারে না। কার বাড়ি আগে যাবে? সেই নিয়ে রাগারাগি। তবুও পুজোর উপাচার নিয়ে অপেক্ষা করে। কি করবে? হরিনামের দল ছাড়া যে পুজো সম্পূর্ণ হয় না।অগত্যায়,অপেক্ষা করতে করতে কারো চোখ ঢুলুঢুলু। 'পুজো দেখব', 'পুজো দেখব' করে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে শেষে। তবে সারারাত খোল-করতালের আওয়াজের সঙ্গে তাদের সমবেত ক্লান্ত গানও বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়।

রাস্তায় লোকজনেরও কমতি থাকে না। এপাড়া ওপাড়া থেকে কচিকাঁচা তো আছেই, সঙ্গে বউ-ঝি-বুড়িরা। প্রসাদ, নাড়ু তো তারা নিচ্ছেই, সঙ্গে কোনো কোনো বাড়ি থেকে বিলিয়ে দেওয়া বাতাসা-খই-মুড়ি। কারো কোঁচড়ে, কারো বা পুটলিতে।

পীযুষদের বাড়ির পুজো-বাতাসা-খই-মুড়ি বিলিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। লুচি, ছোলার ডাল খেয়ে এসে সে সবেমাত্র মাঠে পা দিচ্ছিল।

অম্লান দৌড়ে এল তার কাছে। হাঁপাচ্ছে।

-ও-দা, যা-যাবে না?

-কোথায় রে?

-সে-সেই, ব-বলেছিলে না !

-অহ! কিন্তু এখন তো অনেক রাত !

-তাতে কি হয়েছে? দিনের আলোর মতো তো দেখা যাচ্ছে সব। চলো…

-হ্যাঁরে, পটকা নেই এখানে? ওকেও নয় ডেকে নে?

-দুর, চলো তো।আর কাউকে জোড়াতে হবে না।

আজ লক্ষ্মীপূজোর বাজার করে ফেরার সময় পীযুষ দেখেছিল ব্যাপারটা। সাইকেল থেকে নেমে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলকে।

-এ মাঠে শালতি নৌকা? তেলেডোঙা ছাড়া এ বস্তু তো দেখা যায় না! এল কোথা থেকে? মাঠের টলটলে জলে শালতিটা তরতর করে চলছে।

-আরে, ওঠা কে? বারুণকা' না?

ধজি জলের ভেতরে চেপে ধরে নৌকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে যাচ্ছে।আবার তুলে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

তখনই মনটা নেচে ওঠে...

-আজ রাতে যদি ঐ নৌকায় চড়ে সারা মাঠটা ঘোরা যায়? ওহ ,কি যে আনন্দ

হবে! জোৎস্না রাত।ফুরফুরে হাওয়া।জলের ঝিকমিকি !

ওহ,আর সে ভাবতে পারছে না।

-নাহ, আজ রাতে আসতেই হবে। যার নৌকা হোক, আমি চাইলে বরুণকা না করবে না।

পথে অম্লানের সঙ্গে দেখা।তাকেই একথা সে বলেছিল।

-ও দা, নৌকা দেবে তো?

-চল না দেখি।আমি চাইলে হয়তো না করবে না। কিন্তু…

-কিন্তু কি?

-ভরা পূর্ণিমা।তায় আবার এত রাত।

-কার নৌকা জানো?

-না। তবে শুনলাম নাকি রাতে পাহারা দেবার জন্য ওটা ভাড়া করেছে।মাঠে নাকি কারা বেশ কিছুদিন জাল পাতছে। মাছ চুরি হচ্ছে খুব। তাই কাল থেকে রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করেছে।

-কারা ভাড়া করেছে?

-আরে, ঐ, স্বর্নজয়ন্তী স্ব-রোজগার যোজনার যে গ্রূপ আছে না,তারাই।ওরাই তো মাছ চাষ করেছে।

কথা বলতে বলতে তারা এখন এপাড়ায়। বরুণদের উঠোনে।

-এরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে!

-হ্যাঁ।তাই তো।চল… ফিরে যাই।

-একবার নয় ডেকেই দেখো না? যদি…

-বলছিস। কিন্তু… দাঁড়া, একবার ডেকেই দেখি।…কাকা। ও… কা… কোমর সমান মাটির বারান্দা।একটা বিছানা পাতা রয়েছে। মশারিও খাঁটানো।

ভেতরে কেউ একজন শুয়ে আছে মনে হয়।

পীযুষ হতাশ হয়ে পড়ল।

-নারে, সাড়া দিল না।

-আর একবার ডাকোই না।

আশাভঙ্গের ভয়ে পীযুষ অম্লানের কথা রাখল।

-কাকা, ও কাকা… জেগে আছো? কাকা…

মশারির ভেতর থেকে বিরক্তিকর গলা ভেসে এল

-কে পলাশ? আরে, একটু শুতে দে। ক'টা বাজে? এক্ষনি ডাকছিস?

-সবেমাত্র চোখটা জুড়ে এসেছে।এসে হাজির হলি।

ইতস্তত করছে পীযুষ। আমতা আমতা করে উঠল।

-কা-কাকা আ-আমি। পীযুষ।

এবার মশারির বাইরে মুন্ডুটা বেরিয়ে এল।

-এত রাতে? তোমার তো সেই সন্ধেয় আসার…

-না… মানে… আসলে…

-তোমার কাকীমা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল, যদি আসো। এই তো কিছুক্ষণ আগেই শুয়ে পড়ল।দাঁড়াও।ডাকি?

-না, না। আসলে আমি… নৌকা চড়ব বলে… একটু দেবে?

-দেখো কান্ড!

-দাও না, কাকা… কি বলবে পীযুষকে? মেয়েটা তার কাছে পড়ে। পাড়ার আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় সে। বেশ মেধাবী। কলেজে পড়ছে। নিজের খরচা নিজেই চালায় টিউশন করে। বাজে নেশাও নেই।গ্রামে একটা সুনাম আছে তার।ব্যবহারও ভালো। অনেকেই তাকে স্নেহ করে। বরুণও তাদের মধ্যে একজন। নিজের পাড়ার ছেলেরা বলেছিল

-আজ রাতে নৌকাটা দিও। একটু ঘুরব।

কিন্তু তাদের ভাব-গতিক ভালো ঠেকেনি বরুণের।মাল-খেয়ে কোথায় আবার বিপদ বাধিয়ে বসবে… তাই তাদের না করে দিয়েছে। কিন্তু পীযুষ তো তাদের থেকে আলাদা। কি যে বলবে? ভাবছে।

-ও কাকা,কি হল? দাও না…

-ঠিক আছে। এই দেখো, চাবিটা আবার কোথায় রাখলুম?

টর্চ জ্বেলে বিছানা হাতড়াচ্ছে।

-কিন্তু আমাদের তো আবার একটু পরেই বেরতে হবে… আচ্ছা… সে নয় দেখব'খন।

চাবিটা নাও। কিন্তু মাঠের মাঝখানে যাবে না। বড় বড় পুকুর। বেশ গভীর। আর ঐ পোতাগুলো ভালো নয়। দূরে থেকো। আর সাবধান, ঘোর পূর্ণিমা কিন্তু। সঙ্গে আমি নয় যেতুম। কে আছে আর? সবেমাত্র শুয়েছি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। একটু না ঘুমলে…

-আমি আর অম্লান। ঠিক আছে,

মনে থাকবে।

চাবিটা হাতে নিল পীযূষ। আহ্লাদে তাদের পা যেন মাটিতে পড়ছে না। এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে।

দুটো বাড়ির পরেই মাঠ। শালতিটা শিকল দিয়ে রাস্তার গাছের সঙ্গে বাঁধা। তালা লাগানো।

অম্লান আগেই উঠে গেছে। পীযুষ তালা খুলে শিকল ছুঁড়ে দিল নৌকায়। দু-হাতে নৌকা ঠেলে লাফিয়ে পড়ল তার খোলে।


।। ২ ।।

তিনটে গ্রাম। তাদেরকে জুড়ে আছে তিনটে রাস্তা। রাস্তা জুড়ে গাছ আর গাছ। আর তাদের মাঝে কয়েকশ বিঘে জমি ঘিরে এই বিশাল মাঠ। মাঠে কয়েকটা পুকুর। সুতিখাল। সবটা জুড়েই ফিসারি।

পঞ্চায়েতের সহযোগিতা আছে বলে মালিকদের সঙ্গে কোনো-প্রকার আলোচনা ছাড়াই এই মাছচাষ। ইনকাম হলে নাকি রাস্তার কাজে লাগাবে। তাই কাউকে একটা পয়সাও দেয়নি। বর্ষায় অনেকেই জাল পেতে মাছ ধরত। সেটাও বন্ধ। তা নিয়ে অনেকের ক্ষোভ। সকলের সন্দেহ লাভের টাকা নাকি ওরাই মেরে দেবে। তাই লোক চুরিচামারী করে, জাল পাতে।

মাঠের কোথাও এক-মানুষ জল। কোথাও বেশি। দু-এক জায়গায় শোলা-চাষ। ধানগাছ নেই বললে চলে। বর্ষায় সব হেজে গেছে। কোথাও কোথাও ঘাস আর ঘাস। বাদ বাকিটায় কেউ যেন রুপো গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে। তবে সারা মাঠের বুকে দুটো উঁচু পোতা, তাল-খেজুর-বাবলাকে বুকে নিয়ে দ্বীপের মতো জেগে আছে তারা।

আলতো আলতো বাতাস বইছে। তিরতির করে ঢেউ উঠছে। তাদের নৌকা চলেছে তরতরিয়ে। আকাশ-গঙ্গায় যেন দুই অচিন নাবিক পরিক্রমায় বেরিয়েছে। এ জলরাশি, নদীর মতো দরাজ বুকে তাদের যেন কাছে টেনে নিয়েছে। নৌকার এক মাথায় বসে আছে পীযূষ। যেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র তার স্বর্গরাজ্যে বিরাজ করছেন। নীরবতায় অবিমিশ্র জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে তার শরীর। অম্লান ধজি চেপে এক প্রান্ত থেকে হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে আসছে। প্রত্যেকবার এসে যেন সে প্রণাম ঠুকে যাচ্ছে।

-কিরে অম্লান, কেমন লাগছে বললি না তো?

একটু হাঁপিয়ে গেছে সে। তার প্রাণের মাঝে আনন্দের স্রোত বইছে হু হু করে।

-কি বলব দাদা? পারলে যেন সাঁতার দেই। কি যে ভালো লাগছে! রাতে বাড়ি ফিরব না। ও… বরুণকা যা বলে বলুক। সেই সকালে…

-দূর পাগল। রাতে হিম পড়বে।ঠান্ডা লেগে যাবে।

-ও লাগুক গে।

-লাগুক গে? তারপর তোর বাবা-মা যদি জানতে পারে যে সঙ্গে আমি ছিলাম।আমাকে ছাড়বে?

-ওসব আমি জানি না।

আজ অম্লানকে দেখে পীযুষের খুব ভালো লাগছে।

এই তো ক'দিন আগেই পীযুষই তাকে সবার সামনে মেরেছিল। আর মারবেই না কেন?

তার লেখা চিঠিটা পড়বে তো পড়বে একেবারে সুরমার বাবার হাতে। মেয়েকে প্রেমপত্র? মেনে নিতে পারে? সোজা চলে এসেছিল পীযুষের পড়ানোর জায়গায়। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল

পীযুষের। তার আস্কারাতেই অম্লান নাকি এমন করেছে। এখানে সে নাকি গুপ্ত-বৃন্দাবন তৈরি করেছে! পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে নাকি এসব শেখানো হয়!

সারা গ্রামে কেউ কোনোদিনই তার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেনি। নিজে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে।তাও আবার টিউশনি করে। ঠিকমতো মাইনেও দেয় না অনেকেই। তবুও সে কোনোদিন তার দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি। অথচ এই লোকটা একঘর ছেলেমেয়ের সামনে তাকে এত বড়ো একটা অপবাদ দিচ্ছে? অপমান করছে?

ডাকিয়ে এনেছিল অম্লানের বাবা-মাকে। তাদের ছেলে এমন করতে পারে সে কথা তারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।কিন্তু সুরমার বাবা তোড়পে যাচ্ছে সমানে।

অম্লানও কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছে না।

প্রথম থেকেই না না করছে। কিন্তু সুরমা? বাবার ভয়ে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। সবার সামনে বলেই ফেলল

-হ্যাঁ, ও আমাকে চিঠি দিয়েছিল।

অম্লান মরিয়া হয়ে ওঠে

-এ-এই মি-মিথ্যে কথা একদম বলবি না।

সুরমার পাশেই ছিল পুটু। সে ফুঁসে উঠল।

-মিথ্যে কথা না? ঠিক আছে,এসব বাদ দে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তুই ওর গায়ে হাত দেসনি? কিরে বল, এটাও মিথ্যে?

মাথা আর ঠিক রাখতে পারল না পীযুষ। ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দিল অম্লানকে।

-এসব শেখাই এখানে? কিরে? বল? তোর জন্য আমি অপমানিত হব? এতজনের সামনে আমাকে… ছিঃ ছিঃ…

কাল থেকে আর তুই পড়তে আসবি না। বের হ। দূর হয়ে যা…

অম্লানের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মুখে কোনো কথা নেই। মাথা নিচু করে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অম্লানের মা কেঁদে উঠল।

-আর কত জ্বালাবি? তোর জন্য কারো কাছে কি মুখ দেখাতে পারব না? মর না, মর। মরলে তো আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগে।

-ওহ, তুমি আর গোল পাকিও না। থামো দেখি।

বলতে বলতে অম্লানের বাবা,এগিয়ে গেল সুরমার বাবার কাছে। তার হাত দুটো ধরে বলল

-দাদা, ছেলে মানুষের কাজ। মাপ করে দিও। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, ও আর এমন করবে না। সব ভুলে যাও, দাদা। পাঁচ-কান হলে আরো খারাপ হবে… সুরমা, মা রে, মন খারাপ করিস না।পীযুষ, এখন আসি বাবা, পরে কথা বলব।

সপ্তাখানেক পরে অম্লানের বাবা-মা পীযুষের হাতে ধরে বলেছিল

-বাবা, ওকে একবার ক্ষমা করে দিতে পারো না? স্কুলেও যাচ্ছে না। ঘর বন্ধ করে থাকে। ঠিক মতো খায় না। তুমি একবার আমাদের বাড়িতে যদি যেতে....

-ঠিক আছে কাকিমা, আমি যাবো। এতজনের মাঝে ওকে মেরেছি তো, তাই হয়তো ও খুব কষ্ট পেয়েছে।

অম্লান আবার স্কুলে যেতে শুরু করে। পীযুষ তার সেই দগ্ধ ঘায়ে অল্প অল্প করে প্রলেপ লাগিয়ে দিতে থাকল। সেও পীযুষের আরো কাছের হয়ে উঠল।

এখন দেখলে তা আর মনে হবে না যে, সে ক'দিন আগেই এমন একটা কাজ করেছিল।


।। ৩ ।।

জামা স্যাঁতস্যাঁত করছে। চুল ভিজে ভিজে ভাব। হিম ঝরছে। জোলো হাওয়া বইছে ফুরফুর করে। পীযুষের শীত শীত করছে।

-অম্লান, এবার চল ফিরি। ওরা তো আবার পাহারা দিতে বের হবে। চল।

-আর একটু থাকি না দাদা?

-না, চল অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এবার তুই বস। তখন থেকে তো বাইছিস। আমি চালাই।

-তুমি চালাবে? পারবে?

-ধজিটা তো দে.....

-হ্যাঁ হ্যাঁ, নাও। সোজা ঐ পোতায় নিয়ে গিয়ে তোলো। তারপর সেই পুস্কর গুনীনের মতো ভুতে আমাদের আটকে রাখুক সারারাত।

-মন্দ হবে না। কি বলিস?

অন্য গ্রাম ঘেঁষেই চলছিল তারা। পুকুর পাড়ের মাচা মাঠের উপর ঝুলছে, জল ছুঁই ছুঁই ভাব। অম্লান কিছু একটা ধরে টান দিল।

-আরে কি ছিঁড়ছিস? চারদিকে জল। মাচায় কি কোথায় উঠে থাকবে কে জানে?

-ওহ, কত বড় শসা! খাবে?

-না, চল। লোকে খারাপ বলবে।এমন করে?

-তথাস্তু বৎস।

-পাকামি করছিস। ওদিকে বরুণকা'রা হয়তো অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ রে সোজা যাব?

অম্লানের মতের অপেক্ষা না করে সোজা বাইতে শুরু করল। পীযুষের অপটু হাতে শালতি এঁকে বেঁকে চলছে। চাইছে সোজা নিয়ে যেতে, কিন্তু বেঁকে যাচ্ছে অন্যদিকে।

অম্লান নৌকার মাথায় ছোট্ট বেদির মতো চৌকোয়, উল্টোমুখ করে বসে, পা ঝুলিয়ে দিয়েছে জলের উপর। পীযুষ নাজেহাল হচ্ছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে আছে নিজের ঘোরে।

অনেকখানি এগিয়ে এসেছে তারা। মাঝমাঠ। পীযুষ অনন্তর পোতা এড়িয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু নৌকা যেন সেই দিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় করছে তার। পোতার লম্বা লম্বা তালগাছগুলো যেন কোন মায়াবলে তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আর শীত শীত করছে না। পোতার একদম কাছেই এসে পড়েছে।

ধজিটা জোরে চাপল পীযুষ।

-একি! থৈ পেল না কেন? পুকুরে পড়লাম নাতো ?

টান পড়ল ধজিতে। টানার চেষ্টা করছে সে।

-জালে আটকায়নি তো? বোধহয় পুকুরের মুখেই জাল পেতেছিল। একি! ধজিটা নৌকার তলায় ঢুকে যাচ্ছে যে!

প্রাণপনে টানছে সে। জোরে টানতে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছে।

-অ-অম্লান, আ-আমরা মনে হয় পুকুরে পড়েছি। ধজিটা জালে আটকেছে মনে

হচ্ছে! কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।

পোতার কাছে বড়ো পুকুরের উপর তারা ভাসছে। নৌকা দুলতে দুলতে শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে পুকুরের ভেতরে। পীযুষ ঝুঁকে পড়ে ধজিটা টানার চেষ্টা করছে সমানে।

-কই রে? দেখ…

অম্লান এগিয়ে এল পীযুষের কাছ। ধাক্কা মারল সজোরে। ঝপাস করে জলে পড়ল পীযুষ। কেঁপে উঠল পুকুরের জল।

-সবার সামনে আর মারবি আমাকে? বল? সুরমার সামনে তুই চড় মেরেছিলি?

পীযুষ ভুস করে ঠেলে উঠল জলের উপর। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরাচ্ছে। নাকে-মুখে জল ঢুকছে।

-এ-এ-এটা কি ক-ক-করলি তু-ই?

সাঁতরে কাছে আসছে সে। অম্লান রাগে ফুঁসছে। হাতে শিকলটা তুলে নিয়ে পাক দিচ্ছে শূন্যে।

তার মূর্তি দেখে পীযুষ শিউরে উঠছে। সাঁতার ভুলে যাচ্ছে সে। তার উপর এই গভীর পুকুর, পোতা, সঙ্গে ভরা পূর্ণিমা-রাত তার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে।

নৌকার কাছে এল পীযুষ। লোহার শিকলটা সপাট করে আড়ছে পড়ল তার মাথায়।

-আ-আ-আ…

ডুবে গেল পীযুষ।

-তোর জন্য স্কুলে সবাই টিটকারী করেছিল। সেই থেকে স্কুলে ঢুকতে পারিনা। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই। পাড়ার লোকও আমার দিকে কেমন করে তাকায়। সব, সব তোর জন্য। মর তুই মর…

-অম্লা…

লোহার শিকলের আঘাতে মাথা ঘুরছে পীযূষের। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্ধকারে সে তলিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে…

অম্লানের খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল জোলো মাঠে।

শূন্যে ঘোরানো শিকল আসতে আসতে গতি হারিয়ে নেমে এল তার কাছে। দরদর করে ঘামছে সে।

অপেক্ষা করছে জলের দিকে তাকিয়ে।

নৌকা এখন পুকুরের মাঝখানে ভেসে আছে স্থির হয়ে।

জলের তোলপাড় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

অম্লান জেগে বসে রইল সেখানে।

0 comments: