ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক১০
জেরাল্ডের এপার্টমেন্টটার কথা আগেই লিখেছি। তবে সেটার খুঁটিনাটি বর্ণনা এখন থাক। পরে যখন বের্নহার্ড সেখানে যাবে, তখন নাহয় তার চোখ দিয়েই আমরা সেখানকার ব্যাপারস্যাপার জেনে নেব।
আসলে সবারই টাকাকড়ির প্রয়োজন। অদ্ভুত এইসব ছেলেমেয়েগুলো যারা বাড়িঘর ছেড়ে এসে শহরে পড়ে আছে, যাদের এখনও কোনো চাকরিবাকরি জোটেনি, অথচ সবার প্রতিভা আছে। প্যারিসে আসবার পর প্রথম প্রথম সবার বেশ আত্মবিশ্বাস থাকে; কিন্তু কিছুদিন পরে আর ভেবে কূলকিনারা পায় না যে কী ভাবে কোন কাজ করা উচিত। নিজেদের দুর্ভাগা মনে করতে শুরু করে তারা, এবং এই পরিস্থিতি যদি অনেকদিন ধরে চলে, তাহলে যেভাবে হোক টাকাকড়ি রোজগার করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই তখন তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যে পরিণত হয়।
ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু আবার খুব অনায়াস সুন্দরও নয় যখন মানুষ নিজের সহজাত প্রবৃত্তিতেই অস্তিত্বরক্ষার লড়াইতে নেমে পড়ে। পুরো প্রক্রিয়াটা সাধারণত স্থূল প্রকারের হয়; তাছাড়া এই প্রক্রিয়াটা অবিরত চলতে থাকে। সবকিছু হঠাৎ নগ্ন এবং বেয়াব্রু হয়ে পড়ে এবং মানুষ অদ্ভুত উদ্ধত এবং হিংস্র আচরণ করতে শুরু করে। বের্নহার্ড নিজের স্কুলে বা সঙ্গীতবিদ্যালয়ের ছেলেদের মধ্যে এর আগে এরকম ব্যাপার দেখেছে। ফার্দিনান্দের মাসের শেষের দিকে পয়সা ফুরিয়ে যেত। তখন সসেজ আর বাঁধাকপির স্যালাদ খাবার জন্য সে অন্যের কাছ থেকে ধার করত। কিন্তু সবসময় কাছাকাছি কোনো না কোনও অভিভাবক থাকতেনই, বাবা মা কিম্বা মাসি কিম্বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য বা পারিবারিক বন্ধু। কোথাও না কোথাও একটা অবলম্বন বা নির্ভরতা থাকত। কিন্তু এখানে, মানে প্যারিসে, সে এমন অনেককে দেখেছে, যারা বলে যে “জে নে তু সাঁপ্লুমো পেরসোঁ” মানে তাদের একেবারে কেউ নেই। এই “Je n'ai tout simplement personne” শব্দটা, মানে দুনিয়ায় একেবারে কেউ না থাকার ব্যাপারটা বের্নহার্ড প্রথম শুনেছিল এক তরুণ রাশিয়ানের কাছে, যে লাঞ্চ করবার পরে তাকে বলেছিল টাকাটা দিয়ে দিতে, কারণ সে একেবারে কপর্দকশূন্য।
বের্নহার্ডের বাড়িওয়ালী মাদাম দুবোয়ার কাছে আরও একজন ছাত্র থাকে, চার্লস, যে নিজের স্নাতক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেটা বেশ লক্ষ্মীছাড়া ধরনের, উনিশ বছর বয়স, গতবছরের দ্বিতীয় সেমিস্টারে ফেল করেছে। ছেলেটার বাবা একটা ছোট মফস্বল শহরে থাকেন। প্রতি মাসে তিনি ছেলেকে একটা করে চিঠি লেখেন। তিনি মাদাম দুবোয়ার কাছে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেন। মাদাম দুবোয়া সেই টাকা থেকে মাসে চার বার করে প্রতি সপ্তাহে চার্লসের হাতে দরকারি টাকাকড়ি দেন; অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে হিসেব করে তিনি এই কাজটা করেন এবং অগ্রিম একেবারেই দিতে চান না। তাছাড়া তিনি সব কাপড়জামা ধুয়ে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখেন, যদিও সেসব করতে তিনি একেবারেই বাধ্য নন। চার্লসকে তিনি মায়ের মতই যত্নআত্তি করেন। বের্নহার্ড এখানে আসবার আগে সে একাই ছিল মাদাম দুবোয়ার বাড়িতে। কিন্তু এই তরুণ গাঢ় ব্লন্ড চুলের জার্মান এই বাড়িতে এসে তার রাজত্বে ভাগ বসিয়েছে। মাদাম দুবোয়ার হৃদয়ে সম্ভবত চার্লসের জন্য আগের মত স্নেহ আর নেই। অনেক কিছু ঘটেছে। এই নতুন ছেলেটা শুধু যে নিজের ঘরদোর ঠিকমত গোছগাছ করে রাখে, তাই নয়, দেখা হলেই খুব সুন্দর করে মাদাম দুবোয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে সুপ্রভাত জানায় এবং জিজ্ঞেস করে যে কেমন আছেন তিনি। মাদাম দুবোয়া চার্লসের জামাকাপড়, স্যুট ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিলেও সে কখনই উল্টে কিছু বলে না, বরঞ্চ এমন ভাব করে যেন এসব তার জন্মগত অধিকার। এদিকে বের্নহার্ডকে মাদাম দুবোয়া যে কোনও কিছু পরিষেবা দিলেই সে সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ জানায়।
এছাড়াও চার্লসের বেশ কিছু বদ অভ্যাস আছে, যে কারণে ক্রমশ মাদাম দুবোয়ার স্নেহের জায়গাটা থেকে সে সরে যাচ্ছে। প্রতি রাতে সে দেরি করে ফেরে বাড়িতে। এপার্টমেন্টের দরজাটা খুলে ঢুকবার সময় প্রচুর আওয়াজ করে এবং সাধারণত করিডোরের আলোটা নেভাতে ভুলে যায়। মাঝরাত অবধি নিজের ঘরে বসে সিগারেট খায়, তারপর সিগারেটের পেছনের অংশটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে। বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে ঘরে বসে খায় তারপর বাকি খাবার কাগজে মুড়ে ড্রেসিং টেবিলে রেখে দেয় দিনের পর দিন। এইসমস্ত বদ অভ্যাস বাড়িওয়ালীকে সহ্য করতে হয়। তবুও এমনিতে সব মিলিয়ে তার ব্যবহার খারাপ নয় বলে মাদাম দুবোয়া তার এই বদ অভ্যাসগুলিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে থাকেন। তিনি তলিয়ে ভেবে দেখেছেন যে হয়তো শিশুকালের কিম্বা সাম্প্রতিক কোনও যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতার ফলেই চার্লস এত অগোছালো আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এইসব পর্যবেক্ষণ করে মাদাম দুবোয়ার হৃদয় স্নেহে দ্রব হয়ে যায়, আবার একই সঙ্গে তিনি কিছুটা অপরাধবোধেও ভোগেন; কারণ তিনি এরই মধ্যে সুন্দর এই জার্মান কিশোর বের্নহার্ডকে এই অগোছালো তরুণ চার্লসের থেকে একটু বেশি স্নেহ করতে শুরু করেছেন।
একদিন সকালে দু’জনের দেখা হল সিঁড়িতে। চার্লস থেমে দাঁড়িয়ে বের্নহার্ডকে বলে, ‘আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’ বের্নহার্ড বিনীতভঙ্গিতে বলে ‘নিশ্চয়ই’। তারপর চার্লসের পিছুপিছু তার ঘরে যায়। চার্লসের ঘর তার ঘরের উল্টোদিকেই। চার্লস তার ঘরের জানালা বন্ধ করে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। বের্নহার্ড ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে যে বেশ কিছু বই চারদিকে ছড়ানো ছেটানো রয়েছে। বেশির ভাগ পাঠ্য বই, কুর্স সুপেরিয়া অথবা মধ্যযুগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। চার্লসের মেজাজমর্জির সঙ্গে বইগুলো ঠিক খাপ খাচ্ছে না…
দু’জনে মুখোমুখি বসে। তাদের হাত টেবিলের উপরে রাখে। টেবিল ল্যাম্পের আলো পড়ে তাদের মুখে।
চার্লসকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। দুই চোখ দিয়ে যেন সে গোটা দুনিয়াটা গিলে নেবে। প্রতিটি কথার সঙ্গে এলোমেলো নিঃশ্বাস পড়ছে। সে যেভাবে কথা বলছে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটা ভয়ানক ক্লান্তিকর। সে যেন সঠিক শব্দটি খুঁজে পাচ্ছে না কথা বলতে গিয়ে, নিজস্ব বক্তব্যের মধ্যে স্বচ্ছতা আর ব্যাপ্তি আনবার চেষ্টা করতে গিয়ে যেন ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে এই তরুণ। প্রথম সাক্ষাতে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বের্নহার্ডের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছে না যে চার্লস তার কাছ থেকে কী চায়। হঠাৎ তার নিজের স্কুলের বন্ধু কার্লের কথা মনে পড়ল, যার সঙ্গে মিলেমিশে সে লাতিন ক্লাসের প্রজেক্টগুলো করত। কার্লেরও ভাল নাম চার্লস, যদিও এই সামনে বসে থাকা ফ্যাকাসে, ভয়ঙ্কর প্রলাপ বকে যাওয়া ঘোরগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কার্লের তেমন কোনও মিল নেই।
কিন্তু চার্লস তার কাছে ঠিক কী চায়? বের্নহার্ড জানে না যে তার পক্ষে আদৌ কতখানি করা সম্ভব চার্লসের জন্য। চার্লস যে ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের অস্বাভাবিক আচরণ করছে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনও কারণ আছে: চার্লসের জীবনে নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক কিছু ঘটে গেছে। সেগুলোর মুখোমুখি হতে পারছে না সে, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছে। অপ্রত্যাশিতভাবে সে বিস্মিত হয়েছে, নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে তার, অসহায় বোধ করছে সে। তার মনে হচ্ছে যে তার পাশে এখন কেউ নেই।
পুরো ঘটনাতে অবশ্যই তার নিজের দোষ আছে। অদ্ভুত অযৌক্তিক এক জীবন সে যাপন করছে। কোনও কিছুতে পরোয়া নেই, লজ্জা নেই। নিজের শরীরের যত্ন নেই, অথচ সে যে শারীরিকভাবে খুব শক্তিশালী বা সুস্থ, ব্যাপারটা এমনও নয়। শুধু শরীর নয়, তার আত্মাও ভুগে চলেছে তার অতিরিক্ত চাহিদার কারণে। চার্লসকে বাইরে থেকে যতই রুক্ষ এবং নির্মম দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে সে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল। সে যে কাজেই হাত দেয়, সেটা করতে গিয়ে তার কোনও মাত্রাজ্ঞান থাকে না। যে কোনো বিপদ, যে কোনও অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যায় এবং তারপর বিপজ্জনক ভাবে তার মধ্যে ফেঁসে যায়। যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কেন এমন করছে, কারণ সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও এক অর্থহীন জীবন যাপন করছে, তাহলে হয়তো উত্তরে সে বলবে যে সে নিজেকে নিজেই ঘেন্না করে।
‘জে মি দিতেস্ত’ (Je me déteste)… ‘আমি নিজেকে ঘেন্না করি’ এই হল তার প্রতিদিনের লব্জ। যদিও এইসব কথা সাধারণত মানুষ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না, তবুও এইসব কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় তার আত্মধ্বংসী মানসিকতা।
(চলবে)
0 comments: