গল্প - দোলা সেন
Posted in গল্প[১]
“ ও মণিদি, কেমন হয়েছে বলো তো কার্ডটা?”
“এতক্ষণ ধরে একটা কার্ড বানালি? আমারটা দেখ, কি সুন্দর একটা পাখি বানিয়েছি। মিতু, তুই কিছু বানাচ্ছিস না যে!” তিন্নি মুখ না তুলেই বলে উঠল। সে তখন পাখির চোখে পুঁতি বসাতে ব্যস্ত।
“ধ্যেৎ। এগুলো কোনো উপহার হলো? আমি বাপিকে বলব নিউ মার্কেট থেকে একটা খুব সুন্দর গিফ্ট কিনে আনতে”।
মিতু বরাবরই একটু নাক উঁচু। ওর বাবার শাড়ির দোকান আছে। হর হপ্তা কলকাতা যায়।
তিন্নি আর দিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেছে দেখে, মণিদি হাল ধরতে এগিয়ে আসে। সে এতক্ষণ ধরে একটা ফুলসমেত ফুলদানি বানানোর কাজে মেতে ছিল। ওর হাতের কাজ অসাধারণ। সামনে টিচার্স ডে। এই হোস্টেলের মেয়েদের একটা ঐতিহ্য আছে। তারা টিচার্স ডের উপহার আর রাখি কখনো দোকান থেকে কেনে না। ওদের হাতের কাজ বড়দের তত্ত্বাবধানে বরাবরই খুব সুন্দর হয়। যেমন এই ঘরে পাঁচজন তাদের মণিদির কাছে বসে নানারকম জিনিস তৈরি করছিল।
তিন্নি আর দিয়ার মুখটা দেখে মায়া হলো মণিদির। সে হাল ধরল এবার।
‘আসলে কী জানিস, উপহারের আসল দাম তার আন্তরিকতায়। সবসময়েই যে সেটা জিনিসই হতে হবে তার মানে নেই। খুব অন্যরকমভাবেও দেওয়া যায় সেটা”।
দিয়া হালে পানি পেল যেন। খুব উৎসাহভরে বলল – “মণিদিদি, আমি না একটা বিদেশী গল্পে পড়েছিলাম দুটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে তাদের মিসকে ভালোবেসে রক গার্ডেন বানিয়ে দিচ্ছিল। একটা দ্বীপ থেকে পাথর আনার সময় নৌকোডুবি হয়ে...”
দিয়ার গলাটা ভারি হযে এল। মণিদিদি সস্নেহে ওর মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বলল – “বিদেশ যেতে হবে কেন রে? এই আমাদের দেশেই...”
গল্পের গন্ধ পেয়ে সক্কলে হাতের কাজ ফেলে মণিদিদির চারপাশে গোল হয়ে বসে – “বলো, বলো”।
মণিদি একটু হেসেই ফেলল – “এটা শুনতে গেলে একটু ইতিহাসের কথা বলতে হবে কিন্তু”।
রিঙ্কু রঙমাখা হাতটা মনের ভুলে মাথায় বুলিয়ে ফেলে বলে – “তা হোক। তুমি বলো”।
অগত্যা ফুলদানিটা টেবিলের ওপর যত্ন করে সরিয়ে রাখে মণিদি। তারপর হাতটা মুছে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেল
“ বেশ কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে, বুঝলি? ১৯৪৬ এর শেষের দিকে। সে এক অস্থির সময়...”
‘অস্থির কেন?” – দিয়া চুপ থাকতে পারে না মোটেই।
মণিদি তিন্নির দিকে ঘুরল – “এর উত্তর তুই দিতে পারবি?”
তিন্নি আঙুল গোনে – “সাতচল্লিশে ভারতের স্বাধীনতা। তার আগে উমম্... ছেচল্লিশের দাঙ্গা?”
“একদম ঠিক। যার সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেই ব্রিটিশ সিংহের আধিপত্য সারা বিশ্বেই অস্তমিত হবার মুখে। ভারতও তার থেকে বাদ নয়। কিন্তু কে চালাবে সেই সদ্য স্বাধীন দেশ? কিভাবে রক্ষা করা যাবে বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য?
যতই গান লেখা হোক – বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান _ নানা জাতি, নানা মতের মিলনে সে মহাসাগরে সেতু বাঁধা সহজ কাজ নয়। নানা স্বার্থের সংঘাতে জ্বলে উঠল ভারত। উজ্জ্বল শিখায় নয়, প্রবল জাতিগত দাঙ্গায়। সেই কালো দিনের অবসান ঘটাতে নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ভাগ হোক ধর্মের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষও নেতাদের মতোই বিশ্বাস করল – “স্বরাজ আসিছে চড়ে জুড়িগাড়ি”। ইংরেজ ভারত ছাড়লেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে – সূর্যোদয়ের পর যেভাবে রাতের অন্ধকার নিমেষে দূর হয়”।
মিতু চিন্তিতভাবে বলল – “তবে যে বাবা বলে, শাসক বদলালেই উন্নতি হয় না? মানুষদের ভাবনা বদলাতে হয় আগে?”
মণিদি সোজা হয়ে বসল – “কাকু একদম ঠিক বলেছেন রে। তাহলে শোন - ঠিক সেই সময়ে, এই অস্থির চিত্রপট থেকে অনেক দূরে কয়েকজন মানুষ অন্যরকম ভাবছিলেন। তাঁদেরও মনে হয়েছিল, মানুষের মনে যদি চেতনার আলো, শিক্ষার দ্যুতি না পৌঁছানো যায়, তাহলে স্বাধীনতা কথাটির অর্থ বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে। যেমন মনে হওয়া, তেমনি কাজ। তৈরি হলো ‘সেবা সংঘ’। বিভিন্ন অনগ্রসর এলাকায় তাঁরা স্কুল তৈরির কাজে লেগে পড়লেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, কাজটা সহজ নয় মোটেই। এই পিছিয়ে পড়া জনজাতিকে শিক্ষিত করে তোলার পথে প্রধান বাধা দ্বিমুখী। এক - বিদায়ী ইংরেজ শাসক, দুই – স্থানীয় ভূস্বামী বা রাজা”।
রিঙ্কু অস্থির হয়ে উঠল – “কেন মণিদি? ইংরেজ কেন? আমাদের আধুনিক শিক্ষায় ওদের অবদান তো কম নয়! বেথুন সাহেবের কথাই ধরো, কিম্বা হ্যালহেড বা উইলিয়াম কেরি...। মেয়েদের স্কুল, বাংলা ব্যাকরণ তৈরিতে এঁদের অবদান তো আমরা ইতিহাসেই পড়েছি। তাহলে ছেচল্লিশে হঠাৎ তারা শিক্ষবিরোধী হয়ে উঠল কেন গো?”
মণিদি বলল – “তোরা একটা শব্দ বোধহয় খেয়াল করিসনি। সেবা সংঘ কাজ করছিল অনগ্রসর এলাকায়। পিছিয়ে পড়া জনজাতির জন্য। যেখান থেকে ইংরেজ শাসকের, ভূস্বামীদের সেবা মেলে। মজুর, চাষী, জেলে...। এরা শিক্ষিত হলে - সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলে চিনলে - নিঃশব্দে রোজের বেগার খাটবে কে?”
দিয়া বিরক্ত হচ্ছিল – “ গল্পের মাঝখানে নিজেদের জ্ঞান জাহির না করলেই নয়? মণিদি গল্প বলো”।
মণিদি হেসে ফেলে শুরু করল – “আসলে পটভূমিটা না জানা থাকলে, এ গল্পের কোনো মানে থাকে না রে। যাই হোক শোন –
রাজস্থানের দক্ষিণ পশ্চিমে ডুংগারপুর রাজ্য। সেখানকার রাজা – মহারাওয়াল লক্ষণসিংহ। যে সে রাজা নন, রাজ্যে তাঁকে সম্মান জানানোর জ্ন্য পনেরখানা গান স্যালুটে হয়। সে এক বিশেষ সম্মান। খোদ ইংল্যান্ডের মহারানী সে অনুমতি দিয়েছেন! তা স্কুল করার জন্যে, সেই রাজ্যের ভীল অধ্যুষিত গ্রাম রাস্তাপালকে বেছে নিয়েছিলেন সেবা সংঘের কিছু নিবেদিত কর্মী।
প্রস্তাব শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মহারাওয়াল। বুনো ভীলের দল চিরটাকাল মুখ বুজে রাজপুতদের সেবা করে এসেছে। রাজার চাবুককে নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছে ঈশ্বরের প্রসাদের মতো। যে সব সরল চোখে, ঈশ্বর আর মহারাওয়াল সমার্থক ছিল, সেই চোখ ফোটাতে চায় ওই উটকো আপদগুলো? তারপর কি আর ওরা আগের মতো মান্য করবে মহারাওয়ালকে?
না না, এসব কিছুতেই চলতে পারে না। অতএব তিনি ফতোয়া জারি করলেন – এ রাজ্যেতে নাহি রবে শিক্ষা সদাচার... হাঃ হাঃ হাঃ।
থামানো গেল না কিন্তু! রাজা জমি না দিলে কী হবে, এগিয়ে এলেন নানাভাই কণ্ঠ নামের এক মহাপ্রাণ। নিজের বাড়ি তিনি খুলে দিলেন স্কুলের জন্য। শিক্ষকেরও অভাব হলো না, জানিস? এগিয়ে এলেন সেঙ্গাভাই। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা – রাজদণ্ডের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও জুটে গেল!”
তিন্নি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল – “তারপর? ওরা পড়তে পারল?”
মণিদি বোধহয় শুনতে পেল না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল এক অদ্ভুত ক্লাসরুম।
[২]
ব্ল্যাকবোর্ডে ‘ক’ লিখতেই...
“ক সে কলম” – নানা স্বরের ঐকতানে ক্লাসরুমটা গমগম করে ওঠে। নানান বয়েসের মানুষের ভিড় সেখানে। খস খস... পেনসিলের প্রবল ঘষায় খাতা যায় যায়। তবু ক লিখতে পারার আনন্দে কালো মুখগুলি বড় উজ্জ্বল। আর সেই আলোয় উদ্ভাসিত সেঙ্গাভাইয়ের মুখ। শ্রেণিকক্ষে ঘুরে ঘুরে সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছেন তিনি –
“ইয়ে কলম সামহালকে রখনা। ইসকে তাকত..
জানো তো, এই কলমের জোর রাজার দণ্ড, পুলিশের ডাণ্ডার চেয়েও শক্তিশালী। মনে রেখ, শিক্ষাই শক্তির উৎস। যেদিন নিজেদের চিনতে শিখবে, সেদিন তোমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মহারাওয়ালও নয়”।
“রাম, রাম। এইসা মত বোলিয়ে” – বর্ষীয়ান ছাত্রটির মুখে চোখে ভয় – মহারাওয়াল যে স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিভূ!
“রাজাকে খিলাফ কুছ শুননা ভী পাপ হ্যায়।”
সেঙ্গাভাইয়ের চোখদুটো একবার জ্বলে উঠেই শান্ত হয়ে যায়। শুধু এই অন্ধবিশ্বাসের জন্যেই, এই দুর্মর শক্তিশালী ভীলজাতি যুগ যুগ ধরে রাজপুত শাসকের অত্যাচার সয়ে আসছে নির্বিবাদে। আজও ডুংগারপুরের ভীলেরা চরমভাবে নির্যাতিত।
স্বাধীনতা দরজায় কড়া নাড়ছে – মাসকয়েকের মধ্যেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে। একথা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কিন্তু মানুষ যদি স্বাধীনতার অর্থই না বোঝে, তাহলে তাদের অধীনতার শিকল কখনো ঘুচবে না। শিকলের মালিকানার হাতবদল ঘটবে শুধু। তাই সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা। চেতনার যেটি প্রথম ধাপ। এই রাস্তাপাল গ্রামে সেবা সংঘের পাঠশালা প্রতিষ্ঠার কারণ এটাই।
সেঙ্গাভাই বলছিলেন –
“আজ পড়া থাক। একটা গল্প শোন বরং।
এই বনে, পাহাড়ে একসময় শুধু ভীলেরা থাকত। তাদের ছিল – বনের শিকার, খেতির ফসল, চাঁদের আলোয় ঢোলথালের দ্রিমি দ্রিমি, কৌড়ির সুরে ছেলেমেয়েদের নাচ।
প্রায় পাঁচশ বছর আগে গিহ্লোট বংশের এক নির্বাসিত রাজকুমার, তার কিছু অনুচরকে নিয়ে, ভীলরাজা ডুংগারিয়ার আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর একসময় সেই বিশ্বাসঘাতক রাজকুমার, আশ্রয়দাতাকে হত্যা করে, সে নিজেই রাজা হয়ে বসল। সেই ডুংগারিয়ার নাম থেকেই তোমাদের এই রাজ্য - ডুংগারপুর!’
বছর বারোর একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ায় এইবার – ‘এই গিহ্লোট বংশের রাজা নাগাদিত্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ভীলবিদ্রোহ হয়েছিল না? পুরো রাজবংশ ভীলেদের রোষে ছারখার হয়েছিল। উয়োলোগ দেওতা নেহি হ্যায় বাপু। ইনসান হ্যায়। অগর গলতি করে তো...’
সেঙ্গাভাই সস্নেহে তাকিয়ে থাকেন। আগে বলা কাহিনি ঠিক মনে রেখেছে কালিবাঈ। বড় তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী এই মেয়েটি।
চাষী বাপমায়ের মেয়ে। তার বাবার বড় শখ মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। সেঙ্গাভাইধের কাছে আসা দিদিমণিদের মতো। এমন অপমানিত দাসের জীবন হবে না তার।
পড়া এগিয়ে চলছিল – নতুন করে নিজেদের চিনতে শিখছিল সরল মানুষগুলো। ক সে কলম থেকে শুরু করে ইতিহাস, ভূগোল, যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর হয়ে আসা অত্যাচারের আর তার প্রতিবাদের গল্প...
[৩]
মণিদি বলে চলছিল এক ঘোরের মধ্যে –
“ঠিক এখান থেকেই বিপদের আঁচ পাচ্ছিলেন মহারাওয়াল। স্বাধীনতার সঙ্গে সিংহাসনের মতো ভীলদের নিঃশর্ত আনুগত্যও যদি হারাতে হয়, তাহলে তাঁর প্রতিপত্তিরও অবসান ঘটবে! এই জন্যেই পাঠশালা স্থাপনায় এত আপত্তি ছিল ডুঙ্গারপুরের অধিপতি মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংহের। তবু কী অসীম দুঃসাহস ওই নানাভাই কণ্ঠের! সে নিজের বাড়ি পাঠশালার জন্য দান করেছে! এর একটা ব্যবস্থা...”
দিয়ার গলা ভারি হয়ে উঠেছে উৎকণ্ঠায় – “ওদের উপর খুব অত্যাচার করল ওই মহারাওয়াল?”
মণিদি কেমন যেন হাসল – “মহারাওয়াল ভয় পেয়েছিলেন, বুঝলি। আসলে রাজপুত আর কজন? ওঁর সব সৈন্য বা রক্ষকদের বেশিরভাগই তো ভীল। তাদের বাড়ির অনেকেই যাচ্ছে ওই স্কুলে। কে জানে কী শিখে আসছে সেখান থেকে! তাদের উপর ভরসা করতে পারছিলেন না তিনি। যদি তারা ঘুরে দাঁড়ায়? না না, এত বড় ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। বরং খবর পাঠালেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। ইংরেজ তখন জানে এবার তাদের ছেড়ে যেতে হবে এই আরাম আয়েশ আর দৌলত। তারাও হিংস্র হয়ে উঠেছিল। ক্ষোভ উগরে দেবার এই সুযোগটা তারা ছাড়ল না।
তারিখ ছিল - ১৯৪৭ এর ১৯শে জুন। পুলিসবাহিনী এলো পাঠশালা বন্ধ করতে। রুখে দাঁড়ালেন নানাভাই আর সেঙ্গাভাই। পুলিশ এটাই চাইছিল। নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর বীরত্ব দেখাবার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? নির্বিচার লাঠি চলল। নানাভাই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন। সেঙ্গাভাই মারের চোটে জ্ঞান হারালেন। গ্রামের লোককে ভালোমতো শিক্ষা দিতে সেঙ্গাভাইয়ের আহত অচেতন দেহকে গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধল তারা। গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞান দেহটাকে রাস্তায় হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ব্রিটিশের পুলিস। আর ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় পাথর হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল সারা গ্রামের মানুষজন। রাওয়ালের বিরুদ্ধে, পুলিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করাটাই যে এই অসহায় মানুষগুলির যুগ যুগ বাহিত রক্তের শিক্ষা! তারা অঝোরে কাঁদছিল, যেমন করে কেঁদে এসেছে যুগ যুগ ধরে।
সেই সময়, তখন মাঠে কাজ করছিল কালিবাঈ। গোলমাল শুনে কাস্তে হাতেই দৌড়ে এসেছিল। তার গুরুকে ওরা...
‘বাপজিইইই’ – আর্ত চিৎকার করে কাস্তে হাতেই প্রাণপণে দৌড়াল কালিবাঈ। অন্ধ আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল পুরুষানুক্রমে বাহিত সংস্কার। পুলিস মজা দেখার জন্য গাড়ি থামাতেই, মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে দড়ি কেটে ফেলল এক কোপে। তাই দেখে চটক ভাঙল অন্য মেয়েদেরও। তার দল বেঁধে এগিয়ে এল সেঙ্গাভাইয়ের পরিচর্যায়। কালিবাঈ জল আনছিল মুখে দেবার জন্যে।
এত সাহস, পুলিসের কাজে, মজা দেখানোয় বাধা? ক্ষিপ্ত পুলিস গুলি চালাল। রক্তে স্নান করা দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কালিবাঈয়ের আনা জলে মিশে গেল তারই রক্তের ধারা। আর সেই রক্ত তুফান তুলল জমে থাকা অসহায় মানুষগুলোর মনে।
তাদের হতবাক আতঙ্ক ক্ষোভে ফেটে পড়ল এতক্ষণে। শত্রুহননের ডাক দিয়ে, মারু ঢোল বাজতে লাগল উদ্দাম বেগে। সংকেত পেয়ে, ভীলেরা দলে দলে তাদের তীরধনুক, বর্শা নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করল। পালিয়ে বাঁচল পুলিসবাহিনী। সব ভুললেও মারুর ডাক ভোলেনি তারা। পিছু হটলেন রাওয়ালও”।
তিন্নি শুধু বলল – “তারপর?”
মনিদি বলল – “ হ্যাঁ, তারও পর থাকে বইকি। এরপর আরও বড় বাহিনী এসেছিল রাস্তাপালে। ভীলদের গ্রামটাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ছেড়েছিল। কিন্তু কী জানিস, আলো যখন জ্বলে তখন কিছুতেই অন্ধকার জিততে পারে না। এ লড়াই সেখানেই থামল না। অবশেষে হার মানতে বাধ্য হলেন লক্ষ্মণ সিং। ভীলদের পড়াশোনার অধিকার মেনে নিতে হযেছিল তাঁকে”।
মিতু হাঁটুতে মুখ রেখে শুনছিল এতক্ষণ। এবার মুখ তুলল। জলে ভেজা চোখ না মুছেই, ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল – “ডুঙ্গারপুর মনে রেখেছে কালিবাঈকে?”
মণিদি বলল – শহীদের বলিদান বৃথা যায় না রে মিতু। ডুঙ্গারপুর তাকে শুধু মনে রাখেনি, প্রাণে রেখেছে তার শিক্ষার আর্তিকে। গুরুর জন্য, শিক্ষার অধিকারের জন্য শহীদ হওয়া সেই মেয়ে বেঁচে রইল ডুঙ্গারপুরের মানুষের ভাবনায়, কাজে। সেখানে আজ ৮৪.৩৮% জন স্বাক্ষর”।
লম্বা শ্বাস ছাড়ল মেয়ের দল – “আমরাও আর পড়ায়, কাজে ফাঁকি দেব না মণিদি। যেটা ঠিক বলে জানব, তার জন্য লড়ব”।
মণিদি হাসল – “বিপ্লব আলো ছড়ায় যুগে যুগে। কখনো হারিয়ে যায় না, মনে রাখিস।”
********
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর উদযাপনে মূর্তি গড়ছিলেন ভাস্কর। একহাতে কাস্তে, অপর হাতে বই দিয়ে কালিবাঈয়ের মুখে তৃপ্তির হাসিটি বড় যত্ন করে ফুটিয়ে তুললেন তিনি। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হলো।
0 comments: