1
undefined undefined undefined

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in




















-"ও দাদা, উঠুন না"!

-"আরে আমাদের বসতে দিন"!

-"ও দাদা, উঠুন উঠুন"!

-"এটা জেনারেল কামরা, আপনার বাড়ির বিছানা নয়"!

একের পর এক চিৎকার আছড়ে পড়তে থাকে ভোরের নীরব কামরায়! কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও লম্বা সীটে দুর্গন্ধের কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে নির্বিকার শুয়ে থাকে অসাড় দেহটা! শেষমেশ বারকয়েক ঠেলাঠেলির পর কোনওমতে বিরক্তির সাথে কাঁচাপাকা চুলদাড়ি আর হতবাক বলিরেখার আঁকিবুকি মুখে নিয়ে উঠে বসেন বছর পঞ্চাশের এক রোদে পোড়া মানুষ!

উঠে বসে চারিদিকে অবাক হয়ে তাকান, আর কিসব বলতে থাকেন কেউ বুঝতে পারে না! আমার পাশের ব্যাঙ্ককর্মী ভদ্রলোক বলেন, "আরে, কেয়া বোলতা হ্যায়? হিন্দি মে বোলিয়ে"! সবাই যখন বিভ্রান্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করে, রোদে পোড়া মানুষটি বলেন,"বিজয়ওয়াড়া, বিজয়ওয়াড়া"! এক ঘুগনিওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলে,"ইয়ে বিজয়ওয়াড়া নেহি হ্যায় ভাই"! জানালার সীট থেকে আরেকজন জানতে চায়, "ইংলিশ আতা হ্যায় আপকো?" রোদে পোড়া মানুষটি শূন্যদৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর বলেন "বিজয়ওয়াড়া, তেলুগু"! আরও কয়েকজন প্রশ্ন করতে থাকলে রোদে পোড়া মানুষটি নিজের নোংরা পুঁটলি থেকে একটা আইডি কার্ড বের করে দেখান, বলেন, "জোসেফ, বিজয়ওয়াড়া, ইন্ডিয়া"!

আইডি কার্ডটা কয়েক হাত ঘুরে এসে পড়ে আমার হাতে। ভোরের ট্রেনে শেষমেশ নিজের ঘুমঘোর বিসর্জন দিতেই হয়। একবার চোখ বুলিয়ে আইডি কার্ডটা ওনার হাতে ফিরিয়ে দিতেই কাচুমাচু মুখে বলেন, "বিজয়ওয়াড়া, তেলুগু"। এবার পকেট থেকে মোবাইলটাকে বার করি, গুগল ট্রান্সলেটর খুলে বাংলাতে টাইপ করি, "আপনি ভুল ট্রেনে উঠেছেন, এই ট্রেন বিজয়ওয়াড়া যাবে না", তারপর সেটাকে তেলুগু'তে ট্রান্সলেট করতে দিয়ে অডিও'টা শোনায় ওনাকে। জোসেফের চোখদুটোয় আলো খেলে যায়! সে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেয়, বুঝতে পেরেছে! আমি আবার একই পদ্ধতিতে টাইপ করি, "আপনাকে এখান থেকে উলটো পথের ট্রেন ধরে হাওড়া যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে বিজয়ওয়াড়া যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে"। তেলুগু অনুবাদ'টা আবার ওকে শোনাতেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি খেলে যায়! আশেপাশের যাত্রীরা তখন অবাক চোখে দেখছে কিভাবে ভাষার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় মানুষের ভিতরে। এবার ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়েই ভোরবেলায় ভাঙা ভাঙা তেলুগু'তে জানতে চাই ও পরিযায়ী শ্রমিক কিনা। জোসেফ বলতে চায় অনেককিছু, কিন্তু কেন জানি না চুপ করে যায়, হাত তুলে বুঝিয়ে দেয় যে ও সন্তুষ্ট হয়েছে। আমিও আর কথা বাড়াই না। পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে চুপচাপ তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেমে পড়ে, তারপর চারিদিকে একবার তাকিয়ে জানালার বাইরে থেকে আমাকে হাত তুলে আশীর্বাদ করে। ট্রেনটা আস্তে আস্তে স্টেশন ছেড়ে কুয়াশার দিকে এগোতে থাকলে আশেপাশের যাত্রীরা রোদে পোড়া মানুষটির মানসিক সুস্থতা নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

আমি আবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করি, কিন্তু চোখে ভেসে ওঠে জোসেফের চোখে দেখতে পাওয়া সেই একচিলতে আলোর রেখাটুকু, যা আমাকে নিয়ে যায় এক ঠিকানাহীন মানুষের সুদূর, শান্ত বাড়ির ভেতর, খালি পায়ে, ভিজে পায়ে ...

1 comment:

  1. কথন শৈলী খুব আকর্ষক।বাহ

    ReplyDelete