undefined
undefined
undefined
প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
Posted in প্রবন্ধঅনেক কিছুই ইতিহাসকে বয়ে বেড়ায়। এমনকি নিজের মনের কথা বলতে না পারা গাছেরাও। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে কোনো কোনো গাছও। সেই গাছ নানাভাবে ব্যক্ত করে থাকে ইতিহাসের কোনও এক করুণ অধ্যায়ের কথা। সেও পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে চায় বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও এক কালো দিনের কথা। অতীতে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুর জেলার মুঘল রোডে অবস্থিত ‘বাওয়ানী ইমলি’ নামক একটি বিখ্যাত তেঁতুল গাছ। বর্তমানে অবশ্য তা ভারতের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ফতেহপুর জেলার বিন্ডকি মহকুমার খাজুয়া শহরের কাছে বিন্ডকি তহশিল সদর দপ্তর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত স্মৃতিস্তম্ভরূপী এই গাছ বহন করে চলেছে ১৮৫৮ সালের ২৮ শে এপ্রিলে ঘটে যাওয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়কে। এই তেঁতুল গাছেই ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ৫৩ জন বিপ্লবীকে! এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে গেছে।
১০ই মে, ১৮৫৭ সালে বাংলার ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিপাহী মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির পর যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই হিসেবে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ শুরু হয় তখন বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয় মঙ্গল পান্ডের জন্মভূমি উত্তরপ্রদেশেও। উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুরে বিপ্লবীরা ঠাকুর যোধা সিং-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহের দিকে পা বাড়ায়। এমনকি যোধা সিং-এর সহকারী ছিলেন ফতেহপুরের ডেপুটি কালেক্টর হিকমত উল্লাহ খান। যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা বিপ্লবীরা প্রথমে ফতেহপুর আদালত ও কোষাগার নিজেদের দখলে নেয়। আসলে, যোধা সিং আটাইয়ার মনে অনেকদিন ধরেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আগুন জ্বলছিল। তাঁর মনে সেই আগুন জ্বালাতে সহায়ক ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের আরেক বিপ্লবী তাঁতিয়া টোপি। মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে বিদেশি ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য এই দুই মহারথী পাণ্ডু নদীর তীরে ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষে জড়ান। মুখোমুখি যুদ্ধের পর ইংরেজ সৈন্যরা মাঠ ছেড়ে পালায়। এই দুই বীর কানপুরে তাঁদের পতাকা উত্তোলন করে। যোধা সিং আটাইয়ার মনের সেই স্বাধীনতার জন্য আগুন এতেও নিভল না। ১৮৫৭ সালের ২৭শে অক্টোবর, মাহমুদপুর গ্রামে যখন একজন ইংরেজ ইন্সপেক্টর ও একজন সৈনিক একটি বাড়িতে ছিলেন তখন তিনি তাঁদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। ভুললে চলবে না যে তখনও দেশে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। এরপর ওই একই বছরের ৭ই ডিসেম্বর তিনি গঙ্গাপার রাণীপুর পুলিশ চৌকিতে হামলা চালান ও একদল ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করেন। আওয়াধ এবং বুন্দেলখণ্ডের বিপ্লবীদের তিনি সংগঠিত করে ফতেহপুর দখল করেন। পরিবহনের জন্য বিপ্লবীরা খাজুহাকে তাঁদের কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। কর্নেল পওয়েল প্রয়াগ থেকে কানপুর যাচ্ছিলেন। সেই সময় একজন বেইমান সর্দার বা প্রধানের খবরে সেই কর্নেল সাহেব সেই স্থানে জড়ো হওয়া বিপ্লবী বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। কর্ণেল পওয়েল চেয়েছিলেন যোধা সিং-এর শক্ত ঘাঁটি ভাঙতে। কিন্তু, যোধা সিং-এর অব্যর্থ পরিকল্পনায় তা হয়ে ওঠেনি। যোধা সিং গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে কর্ণেল পওয়েলকে হত্যা করেন।
কর্নেল পওয়েলের হত্যার পর ব্রিটিশরা কর্নেল নেইলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি নতুন দল পাঠায় যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা সমস্ত বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য। কর্নেল নেইলের হাতে বিপ্লবীরা ভারী ক্ষতির মুখে পড়েন, তবুও যোধা সিং-এর মনোবল একটুও কমল না। তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বড় রকমের যুদ্ধের জন্য নতুন সামরিক সংগঠন করেন আর তার জন্য অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনাও করেন। এইসব কাজের জন্য ছদ্মবেশে যাত্রা শুরু করেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিপ্লবীরাও যেমন ছিলেন যাঁরা নিজেদের দেশ তথা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন ঠিক তেমনি কিছু বিশ্বাসঘাতকরাও ছিল যারা বিপ্লবীদের সমস্ত পরিকল্পনা বিদেশি শাসক ইংরেজদের কাছে ফাঁস করে বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়ে বিপ্লব আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে রোধ করত। হয়তো দাসত্ব বা পশুত্ব এই বিশ্বাসঘাতকদের প্রিয় ছিল। আসলে এই বিশ্বাসঘাতকরা প্রকৃত মানুষের সন্তান ছিল না। অর্গাল নরেশের সাথে আলোচনা করার পর যখন যোধা সিং আটাইয়া খাজুহাতে ফিরে আসেন তখন বিশ্বাসঘাতকেরা এই বৈঠকের খবর ব্রিটিশদের দিয়ে দেয়। ঘোড়হা গ্রামের কাছে ব্রিটিশের সেনাবাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলে। অল্প সংগ্রামের পর, যোধা সিং ও তাঁর ৫১ জন সহ বিপ্লবীগণ ব্রিটিশের হাতে বন্দি হন। অর্থাৎ, আমরা দেখলাম যে, ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে যোধা সিং আটাইয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের দল ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে প্রথমদিকে সফলভাবেই বিজিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাঁদের সেই বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল। নিজেদের জাতির মধ্যে থাকা বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্যে ব্রিটিশরা এই বিপ্লবীর দলকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিল।
২৮ এপ্রিল, ১৮৫৮। ভারতীয় সিপাহী বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক ‘কালো দিবস’। উত্তরপ্রদেশে ফতেহপুর জেলায় অবস্থিত মুঘল রোডের তেঁতুল গাছে যোধা সিং আটাইয়া ও তাঁর ৫১ জন সঙ্গী এবং গৌতম ক্ষত্রিয়— অর্থাৎ মোট ৫৩ জনকে ব্রিটিশ বাহিনী ফাঁসিতে ঝোলায়। তবে এখানেই ব্রিটিশ বাহিনীর নিষ্ঠুরতা থামেনি। তারা গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে যে, “যদি কেউ গাছ থেকে মৃতদেহ নামায় তাহলে তাকেও এই একইভাবে এই তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়া হবে।” গ্রামবাসীরা ব্রিটিশ বাহিনীর এই হুমকিতে বেশ ভয় পেয়ে যায়। তারা আর সাহস করেনি মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামাতে। দীর্ঘ ৩৭ দিন ধরে মৃতদেহগুলো গাছে ঝুলতে থাকে। শকুনের দল সেই মৃতদেহগুলোকে ছিঁড়ে খেতে থাকে। গ্রামবাসীরা কিছুই করতে পারছিল না। অবশেষে, ওই বছরের জুন মাসে, মহারাজ ভবন সিং তাঁর সহকর্মী সহ আসেন এবং মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে সেগুলোর দাহ বা সৎকারের ব্যবস্থা করেন। পরে সাহসী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে সে বাওয়ানী ইমলি গাছটিকে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
বিন্ডকি ও খাজুহার মাঝে অবস্থিত সেই অভিশপ্ত তেঁতুল গাছটি আজ বাওয়ানী ইমলি বা বাওয়ানী তেঁতুল গাছ হিসেবে এক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের প্রতীক। এমনকি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে ১৮৫৮ সালে ২৮ এপ্রিলের দিনটি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এই পঞ্চাশের অধিক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে প্রকাশ্যে তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা আজও অনেকের কাছে অজানা। এমনকি যাঁরা ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে চর্চা বা পড়াশোনা করেন বা পড়ান তাঁদের অনেকেই হয়তো এই ঐতিহাসিক নৃশংস ঘটনার কথা তেমন জানেন না। ইতিহাসের এক অন্ধকারতম দিনটির সাক্ষী সেই তেঁতুল গাছটি আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো ইতিহাসকে ধরে রেখে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে, সেইদিনের নৃশংস ঘটনায় সেই তেঁতুল গাছটিও নিদারুণ কষ্ট পেয়েছে আর তাই সেই গণহত্যার পরে গাছটির বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ, ইতিহাসের কালো দিনের সাক্ষী এক গাছও হয়। সেও প্রকৃত মানুষের মতো অনুভব করতে পারে নৃশংস ঘটনায় মানুষকে হারানোর হাহাকার ও ব্যথা। আর কালো ইতিহাসকে ধরে রাখতে কিংবা বোঝাতে সেও আর বাড়তে চায় না। হয়তো এই গাছের মতো ইতিহাসও থমকে থাকে মানব সমাজে ঘটা কোনও এক নৃশংস ঘটনায়!
0 comments: