undefined
undefined
undefined
গল্প - রণজয় দে
Posted in গল্পপ্রথম পরিচ্ছেদ:
হাঁটছে সাওন। আদিগন্ত হিমাচল পেরিয়ে য্যানো হাঁটছে, আসলে কলকাতায়। টালিগঞ্জ বস্তির ভেতরের এই রাস্তাগুলো একটু অচেনা ওর কাছে। ও যাচ্ছে কাউকে একটা ডাকতে। গায়ে য্যানো বল নেই। খুবই ক্লান্ত চলন। দাঁড়ালো ও। হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে না রাস্তা চিনতে পারছে না বোঝা যাচ্ছেনা। আবার শুরু। একটা মৃত গলির শেষ বাড়িটায় ঢুকে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করলো। তারপর দোতলায় এসে কড়া নাড়তেই একজন বৃদ্ধা দরজা খুললেন। সাওন হাতের মুঠো খুলে ওনাকে কিছু একটা দেখাতেই উনি দরজা ছেড়ে সড়ে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধাকে জিনিসটা দিয়ে ভেতরে একটা ভাঙা চেয়ারের পাশ কাটিয়ে তুলো ওঠা একটা সোফার ওপরে গিয়ে বসলো ও। বৃদ্ধা দরজা বন্ধ করে ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গ্যালেন। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে পাশে রাখলো সাওন। সঙ্গে সঙ্গেই ওটা জ্বলে উঠলো নিজে থেকে। ফোন ধরলো সাওন। ওপাশ থেকে একটা মহিলা কণ্ঠস্বর, 'আর কতক্ষণ লাগবে তোমার পৌঁছতে?' সাওন-- 'আর আধঘণ্টা।' ওপার থেকে একটা অস্ফুট আওয়াজ হয়ে ফোনটা কেটে গ্যালো। ফোনটা আবার পকেটে ভরে ছোট, খালি, ঠান্ডা এবং সোঁদা গন্ধওয়ালা ঘরটার দিকে একবার তাকালো। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে ও-ও ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গ্যালো।
ভেতরের ঘরটা মানুষ এবং টুকটাক কিছু জিনিসে তুলনায় ভরা। চারজন বিভিন্ন বয়সী মহিলাদের মধ্যে একজন কিশোরীও ছিলো। সাওন 'টাকা দাও, বেরোবো, তাড়া আছে' বলতেই কিশোরী বাদে বাকি তিনজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। চল্লিশ-পয়তাল্লিশের দিকে যার বয়স, খুবই রঙীন এবং খুবই পুরনো একটি শাড়ি পরিহিত মহিলা বললেন, 'জিনিসটা আমার পছন্দ হয়নি।' বাকি তিনজনের মুখটা এখন একটু ফ্যাকাসে দ্যাখাচ্ছে। সাওন মুখে কিছু না বলে হাত পাতলো। মহিলা জিনিসটা দিয়ে দিলেন। একটা চৌকো কালো রঙের ছোট বাক্স। সাওন হাত মুঠো করে বাক্সটা পকেটে চালান করে দিলো। 'বেরোলাম' বলে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ:
বহরমপুর শহরের ওপর একটা বড় চারতলা অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলায় একটা ফ্ল্যাটের বড়ো ঘর। আসবাব ও বই দিয়ে খুবই সৌখিন মতে সাজানো। ঘরের মাঝে একটা গোল টেবিলের চারদিকে চারটে চেয়ার। টেবিলের ওপর কিছু কাগজ, বইপত্র, দুটো কফিমগের তলায় শেষ হয়ে যাওয়া কফির কালো দাগ ও একটা ছাইদানি। আর একটু পাশে মেঝেতে একটা লাল রঙের ম্যাট্রেসের ওপর খোল, দোতারা, ডুবকী জাতীয় দুয়েকটা লোকসঙ্গীতের যন্ত্র অবিন্যস্ত পড়ে আছে। ম্যাট্রেসের ওপর একজন যুবকও বসে আছে, ফোন ঘাঁটছে। ঘরের দেওয়ালগুলো ছৌ-এর মুখোশ এবং কিছু ছবি দিয়ে সাজানো। ষাটোর্দ্ধ প্রৌঢ় একজন ঘরে ঢুকলেন। চুল-দাড়ি বেশ বড়ো, যার বেশিরভাগটাই সাদা, চুলগুলো পেছনে জড়ো করে বাঁধা, ঢোলা জিন্স এবং পাঞ্জাবী পরিহীত। ঢুকেই যুবককে উদ্দেশ্য করে, 'একি নীচে ক্যানো, চেয়ারে এসে বোসো' বলে নিজে একটা চেয়ারে বসলেন। যুবক উঠে আসলো ধীরে ধীরে। পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে 'কফি চলবেতো?' বলে যুবকের দিকে তাকালেন। যুবক মুখে আলতো হাসি নিয়ে না-সূচক ঘাড় নাড়লো। প্রৌঢ় সিগারেট জ্বালিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে 'বেশ, বলো তবে' বলে টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে তার ওপর তাকিয়ে রইলেন। 'দেখুন, প্রথমেশ বাবু' বলে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে যুবক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। 'আমার কিছু বলার নেই কিন্তু আমি আর পারছিনা' বলে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে আবার মুহূর্তের মধ্যে চেয়ারে বসে পড়লো ছেলেটি। 'কিছু করার নেই, মন্মথ, পারতে তোমাকে হবেই-' বলে লোকটা আবার কাগজে ভাবলেশহীন মুখটা গুঁজে দিলেন। নিঃশব্দে মূর্তির মতো করে চার সেকেন্ড কেটে গেলে প্রথমেশ বাবু একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে আবার বললেন,'যদিও উপায় একটা যে আছে, তা তো তুমি জানো।' ছেলেটার চোখদুটো একটু য্যানো জ্বলে আবার নিভে গ্যালো। একটু থতমত খেয়ে খানিক তুতলে নিয়ে মন্মথ বললো 'না, সেটা তো আমি পারবো না আপনি জানেন।' 'তাহলে যা করছো করে যাও, হপ্তায় হপ্তায় বিরক্ত করতে এসো না তো' বলে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক পায়চারি করতে লাগলেন। 'এভাবে কটা দিন মুখ বুজে এখানে থাকো না' বলে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে যুবকের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে কৃত্রিম হাসিমুখে বললেন, 'তারপরই তো তোমাকে দুবাই পাঠিয়ে দেবো।' বলে আবার হাঁটা শুরু করলেন। ছেলেটা মাথা নিচু অবস্থাতেই খানিক আচ্ছন্নের মতো বললো,' না আমি পরে পালাতে চাই না। হয় আমাকে এখুনি পাঠিয়ে দিন। রোজ রোজ পাশবিক অত্যাচার দ্যাখা একটা নেশার মতো। অভ্যেস হয়ে গেলে এখান থেকে যাওয়া আর সম্ভব হবে না।' 'কিছু করার নেই, মন্মথ, পারতে তোমাকে হবেই' বলে লোকটা আবার কাগজে ভাবলেশহীন মুখটা গুঁজে দিলেন। নিঃশব্দে মূর্তির মতো করে চার সেকেন্ড কেটে গেলে প্রথমেশ বাবু একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে আবার বললেন,'যদিও উপায় একটা যে আছে, তা তো তুমি জানো।' ছেলেটার চোখদুটো একটু য্যানো জ্বলে আবার নিভে গ্যালো। একটু থতমত খেয়ে খানিক তুতলে নিয়ে মন্মথ বললো 'না, সেটা তো আমি পারবো না আপনি জানেন।' 'তাহলে যা করছো করে যাও, হপ্তায় হপ্তায় বিরক্ত করতে এসো না তো' বলে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক পায়চারি করতে লাগলেন। 'এভাবে কটা দিন মুখ বুজে এখানে থাকো না' বলে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে যুবকের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে কৃত্রিম হাসিমুখে বললেন, 'তারপরই তো তোমাকে দুবাই পাঠিয়ে দেবো।' বলে আবার হাঁটা শুরু করলেন। ছেলেটা মাথা নিচু অবস্থাতেই খানিক আচ্ছন্নের মতো বললো, 'না আমি পরে পালাতে চাই না। হয় আমাকে এখুনি পাঠিয়ে দিন। রোজ রোজ পাশবিক অত্যাচার দ্যাখা একটা নেশার মতো। অভ্যেস হয়ে গেলে এখান থেকে যাওয়া আর সম্ভব হবে না।' বলে উঠে দাঁড়িয়ে 'আচ্ছা আমি আসি।' বলে লোকটার দিকে আর না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মন্মথ। দরজার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রথমেশ বাবু। তারপর আবার চেয়ারে বসে একটু জোরে 'আমাকে এককাপ কফি দিও তো' বলে ভেতরের দিকে তাকালেন। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। উনি আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে দেওয়ালে কোনো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। তার দশ মিনিট পর বছর পঞ্চাশের অভিজাত শাড়ি পরা মহিলা একটি ট্রেতে দুটি কফিমগ এনে ওনার হাতে একটা মগ দেওয়া পর্যন্ত ছাই এবং পোড়া সিগারেট ফ্যালা বাদে উনি একফোঁটাও নড়াচড়া করলেন না। মহিলা একটি চেয়ারে বসে কফিতে নিঃশব্দ চুমুক দিয়ে প্রথমেশ বাবুর দিকে তাকালেন।ভদ্রলোক 'মন্মথ' বলে মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করে কফিতে মন দিলেন। মহিলা বিরক্ত সুরে একটু গলা নামিয়ে বললেন, 'ওকে এখান থেকে পাঠিয়ে দাও না, তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।' ভদ্রলোক 'ধুস। তা বললে হয় নাকি' বলে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। 'ওকে এতো সহজে মুক্তি দিলে যে আমার জীবনটা আবার আগের মতো জটিল হয়ে যাবে মাধবী।' বলে প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে গেলেন। মহিলা কিছু বললেন না। 'মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে অর্ধ-শতাব্দী জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পরও আমার কষ্ট হয় মাধবী, খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মনে হত, দি একটানে সব শেষ করে। পারিনি। আজ এতোদিন পর মন্মথকে পেয়ে... ' আর বলতে পারলেন না। গলা য্যানো জড়িয়ে এলো প্রথমেশ বাবুর। মাধবী দেবী উঠে দুটি খালি কফিমগ ট্রেতে নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরের দিকে চলে গেলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ :
সকাল এগারোটার সময় কলকাতার রাস্তাঘাট পুরো মহাদেবের জটার মতো হয়ে থাকে। এরকম একটা ব্যস্ত সময়ে বড়োবাজারের মুখে একটা ক্রসিং-এর সামনে অপেক্ষা করছে উপল। হাতে একটা বাজারের থলে মতো ঝোলা আর পরনে গেঞ্জি-জিন্স। আঠাশ থেকে তিরিশের মধ্যে বয়স হবে ওর। উঠে দাঁড়িয়ে কাকে য্যানো দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো। মাঝবয়সী লোকটা এগিয়ে এসে হাত উল্টে গোপনীয়তার সাথে উপলের হাতে একটা প্যাকেট চালান করলো। উপল হাতটা আলতো মুঠো করে একইরকম গোপনীয়তার সাথে প্যাকেটটা দেখে নিলো একঝলক। 'ঠিকাছে' বলে পকেটে রেখে দিলো। গাঁজা। 'সপ্তাহখানেকের মধ্যে আবার ফোন করছি' - কথাটা উপলের মুখ থেকে বেরোতে না বেরোতেই ঢোলা জামা তুলনায় কম ঢোলা ফ্যাকাসে বাদামী প্যান্ট পরা লোকটা ভিড়ের মধ্যে উধাও হয়ে গ্যালো। উপল চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে একটা বাসে উঠে পড়লো। শেয়ালদা আসতে যদিও বেশি সময় লাগার কথা নয় তবুও মিনিট পয়তাল্লিশের বেশি সময় লাগিয়ে দিলো বাসটা। নেমে গ্যালো উপল। সাত-আট পা হেঁটে একটা গলির ভেতর বেশ খানিকটা চলে যাওয়ার পরে হঠাৎ কি মনে হতে আবার পেছন ফিরে উল্টো দিকে আসতে লাগলো।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ :
অন্ধকারের মতো তাকিয়ে আছে মুন্নি। নিঃশ্বাস পড়ছে অথবা পড়ছে না। খুব রঙীন একটা ঘরে বসে আছে ও। ওদের ঘরটাই। পলেস্তারা খসা ভিজে গন্ধযুক্ত খুবই ছোটো, ওই ঘরটাই। রঙটুকু ফিরেছে শুধু। মুন্নির জীবনের সমস্ত রঙ য্যানো নিজের গায়ে মেখে নিয়েছে ঘরটা। মুন্নি, অসাড়, জড়, মৃতদৃষ্টি এবং পেটে পাঁচ মাসের বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। ভূতের মতো দ্যাখাচ্ছে ওকে। একমনে একটা জিনিসের কথা ভাবছে, মানুষ সেলায়ের সুতোটা। বাইরের ঝোড়ো হাওয়ায় জানলাটা একটু নড়তেই মুন্নিও ক্যামন য্যানো কেঁপে উঠলো। বৃষ্টি নামবে বাইরে। খুব জোরে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ :
সালমা আপা - টালিগঞ্জ বস্তিতে এই নামেই খ্যাত বছর পয়তাল্লিশ কি আরেকটু হবে, ডাকাবুকো চরিত্রের মহিলা। একজন বড় ও দুই ছোটবোনকে নিয়ে থাকেন। বস্তিটা আসলে ওদের পৈতৃক ভিটে। তাছাড়া কলকাতায় দুটো বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে ওর নিজের। একটা আন্তর্জাতিক অবৈধ ব্যবসা চক্রের সাথে যুক্ত এই সালমা আপা। যুবতী মেয়েদের স্তনবৃন্তের ব্যবসার এক কুৎসিত বিরাট চক্র। উনি এখন বসে ছিলেন পার্কস্ট্রীটের জাঁকালো কোনো রেস্তোরাঁর দোতলায়। ওর ব্যক্তিগত গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, যেটা নিয়ে উনি বস্তিতে ঢোকেননা। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা, অনেক সোনার হার ও আঙটিওয়ালা বছর ষাটেকের এক ভদ্রলোক ও স্যুটেড-বুটেড একজন যুবকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আপা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেরিয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, দুজন আরোহীসহ একটি বাইকের পেছনের জনের হাত থেকে দুটি সশব্দ গুলি এসে লাগে আপার কপালের একেবারে মাঝখানে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ :
সাওন ডাকতে যাচ্ছিলো ওর প্রেমিকার ভাইকে, যাদবপুরে। ডাকতে যাচ্ছিলো বলা ভুল, সঙ্গে করে নিয়ে আসারই হুকুম ছিলো ওপরতলার তরফ থেকে। কিন্তু দেবজ্যোতি আসতে রাজি না হওয়ায় ওকে একাই ফিরে যেতে হচ্ছে। দমদমে মানে বাড়িতে যদিও এখন যাবেনা সাওন। তিস্তাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে যে ওর ভাই পড়াশোনার চাপের জন্য ফোন ধরছে না আর সে কারণেই আজকেও আসতে রাজি হয়নি। উত্তরে অনেককিছু বললো তিস্তা। সেগুলো খুব একটা মন দিয়ে শোনেনি সাওন। ফোন রেখে দিয়ে ধর্মতলার একটা টিকিট কেটে মেট্রোতে উঠে গেলো ও। নেমে কয়েকপা হেঁটে কাছেই একটা বারে ঢুকে পড়লো। হুইস্কির পেগে চুমুক দিয়ে ওর মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো। ধীরে ধীরে ভাবনার জটগুলো স্থান বদলাতে শুরু করলো। যেদিকে এগোচ্ছে ও, ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছে না। শর্মাজিকে এর আগে কখনও ঠকায়নি ও। আট বছর হয়ে গেছে, ও শর্মাজির এখানে আছে। জীবনে অনেক অপরাধ করেছে ও, মানে সেভাবে বলতে গেলে অপরাধ করাটাই ওর পেশা। কিন্তু যার নুনে পেট ভরে, তার পেটে লাথি মারতে কেমন বিবেক অথবা ওরকমই কিছুতে একটা খচখচ করছে। প্রচুর মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে ও জীবনে। মানে খুন ধর্ষণ নয়। স্তনবৃন্ত কেটে সেলাই করে বাবা অথবা স্বামীকে টাকা দিয়ে দেওয়া, এটুকুই। তারপর ধুয়ে বাক্সতে ভরে শর্মাজির লোককে জিনিসটা দিয়ে দেওয়া। এই শেষেরটুকু এবারে আর করেনি ও। সালমা আপা নাকচ করে দিলেও ওর হাতে আরও দুজন রয়েছে। তবুও ক্যামন যেন খুব ভয় করছে সাওনের। তলপেটটা গুলোচ্ছে, বমি পাচ্ছে খুব। মৃত্যুভয়ের মতো কিছু একটা ব্যাপার। আসলে ওটাই। এ লাইনে গোলাগুলিটা টাকাপয়সার মতো। সব সময় ব্যবহার হয়। আট বছরের এই অদ্ভুত জীবনে প্রচুর মেয়ের কান্না শুনেছে সাওন। এসব নিয়ে এর আগে কখনো ভাবেনি ও। কিন্তু আজকে যেনো ওই সবকটা কান্না এক এক করে এসে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলছে। এসব কি ভাবছে সাওন। পাগলের মতো লাগছে। ভাবছে শর্মাজির কাছে যাবে। গিয়ে বলবে ও আর কাজ করবে না। কিন্তু পকেটের জিনিসটা? ওটা দিয়ে কি সব সত্যি কথা বলে দেবে? নাকি ওটাই শেষবারের মতো বিক্রি করে এসবের থেকে পাততাড়ি গুটোবে?
তিন নম্বর পেগটা শেষ করে গ্লাস রেখে টাকা দিয়ে বেরিয়ে গ্যালো সাওন। না, এসব কিছুই ও করবে না। কিন্তু ও এখন ঘুমোবে। বাড়ি গিয়ে স্নান করে গভীর একটা ঘুমের প্রস্তুতি নেবে। দ্যাখা যাক তারপর কি হয়।
সপ্তম পরিচ্ছেদ :
দুঘন্টার বেশি সময় হয়ে গ্যাছে রায়ান এখানে অপেক্ষা করছে। শেয়ালদা স্টেশন থেকে অল্প দূরে একটা গলির ভেতর ওয়োর একটা ঘরে। সকাল থেকেই ও এখানে আছে উপল বলে একজনের সাথে। এখন দুপুর গড়াচ্ছে, সাড়ে তিনটে বাজে। গ্রাইন্ডার বলে একটা ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে উপলের সঙ্গে মাসখানেক আগেই ওর পরিচয় হয়েছে। কথা হতো অনিয়মিত, দুদিন আগেই উপল ওকে প্রস্তাবটা দেয়। খানিক সময় নিয়ে ওও রাজি হয় বিষয়টাতে। ভালোই লাগছিলো উপলকে কাছ থেকে। কিন্তু সেই যে গাঁজা কিনতে বেরোলো তো বেরোলো। একটু আগে ফোনে বললো বড়বাজার থেকে ফেরার বাসে উঠে গ্যাছে। তারপর থেকে একঘন্টা হতে যায় প্রায়। উপল আর ফোন ধরছেনা। শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর বিরক্ত চোখে… ফোন বাজলো। উপল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ :
আরে ওয়োর টাকাটা পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও এরম করছে ক্যানো ছেলেটা। হ্যাঁ, বলেছিলো আসছে, কিন্তু এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। হলো তো এতক্ষন সকাল থেকে, এখন একটু মন্মথকে চোখে চোখে রাখার কাজটা শুরু করতে হবে। 'বলো তো তোমাকেও কিছু পাঠিয়ে দিতে পারি' বলাতে প্রচন্ড জোরে একটা খিস্তি করে ফোনটা কেটে দিলো রায়ান। যাক্, ভালো হয়েছে। সকালে এই ওয়োটাতে ঢোকার আধঘণ্টার মাথায় প্রথমেশবাবু ওকে ফোন করে এই কাজটার কথা জানায়। ও করবে বলাতে ফোন কাটার পরেই প্রথমেশবাবু বেশ কিছু টাকা পাঠিয়েছেন ওকে। এই মুহূর্তে মন্মথ কোথায় থাকতে পারে ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলো উপল।
নবম পরিচ্ছেদ :
সালমা আপার মারা যাওয়ার খবরটা পেয়েছেন প্রথমেশবাবু। নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে আকাশ-কুসুম ভেবে চলেছেন এসব নিয়ে। যদিও এলাইনে এসব জলভাত, উনি ভাবছেন উনি ক্যানো এখানে? উনি ভাবছেন এসব থেকে মুক্তির উপায়। না, প্রথমদিকে অবশ্য এমন ছিলেন না ভদ্রলোক। নার্সিংহোমটা চালু হওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় এক গুরুজী গোছের লোকের সঙ্গে আলাপ হয় ওর। সত্যানন্দ মহারাজ। তখন থেকেই চলছে এসব। গভীর অভ্যন্তরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মেয়েদের নিয়ে আসে মহারাজের লোকেরা, বেশিরভাগই নিচু জাতের মেয়েদের। প্রথমেশের হাসপাতালেই চলে নারকীয় যজ্ঞটা। পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে টাকা আসে ওর পকেটে। ভালই লাগে ওর বিষয়টা, মানে লেগেছিলো। ততদিনই, যতদিন না কোনো গর্ভবতী মহিলার স্বামী টাকার লোভে নিজের স্ত্রীয়ের সাথে - মেয়েটার পাথরের চোখদুটো এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পান প্রথমেশবাবু। মুন্নি। আর ওই সময়েই কপাল জোরে মাধবীর ছোটোপিসি মাধবীকে ফোন করে ওর ছেলের একটু কাজকর্মের - তখন থেকেই মন্মথকে নার্সিংহোমের দায়িত্ব দিয়ে কোলকাতা ছেড়ে উনি মুর্শিদাবাদের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। ভেবেছিলেন একেবারে পুরোনো দিনের মতো বাউল গান গাইবেন আর সরল জীবন কাটাবেন। তা আর হচ্ছে কই? বিভিন্ন ফোনাফুনি আর মন্মথকে বাদ দিলেও মুন্নির চোখদুটো যে অবিরাম জ্বলছে ওর মাথার মধ্যিখানে। তাড়া করছে কোনো অনির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একবার ঠিক করলেন যাবেন, দঃ চব্বিশ পরগনার জয়নগরের দিকে, মুন্নিদের বাড়ি। এতদিন এত মেয়ের জীবন শেষ হয়ে গ্যাছে, কখনো তো কারো নামও মনে রাখেননি প্রথমেশ। তাহলে এখন?
অনেকখানি বয়স হয়ে গ্যাছে। মানুষ হয়ে জন্মানোর জ্বালাস্বরূপ সূঁচগুলো খুব ধারালো হয়ে বিঁধছে। নিঃসন্তান থাকার ভাগ্যকে অভিশাপ মনে হচ্ছে এতদিনে প্রথমবার। উঠে বাথরুমের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেন প্রথমেশ। চোখদুটো ভীষণ ঝাপসা লাগছে। কোনোক্রমে বাথরুমে পৌঁছে জলের তলায় দাঁড়িয়ে শরীরের সব ব্যাথা মনে আর মনের সব ব্যাথা শরীরে চালান করবার সাধনায় নৈরাশ্যের দেবীকে আহ্বান করতে লাগলেন।
0 comments: