0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৯.২

এসব তো সকালের ঘটনা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হবার আগে থানায় দু’পক্ষেরই রিপোর্ট লেখানো হয়ে
গেল। যার থেকে বোঝা গেল যে স্কুল মাস্টারের দল মারামারি করেছে এবং একে অপরকে খুন করতে
চাইছিল। কিন্তু তখন ওদের থামানোর জন্য কেউ ছিল না। তাহলে একটাও খুন হল না কেন?
পুলিশের মনে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠায় ওরা এবার উলটো দিক থেকে তদন্ত শুরু করল।

সেদিন দুপুরের দিকে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় এ’নিয়ে ভারি কাটাছেঁড়া শুরু হল। সেখানে হাজির সাধারণ
নাগরিকদের মনে হল—ব্যাপারটা আরও একটু গড়ালে ভাল হত। ঠিক আছে, নিজেদের কারও হাড়
ভাঙেনি—সেটা ভাল, তবে খানিকটা রক্ত বেরনোর মত চোট লাগা উচিত ছিল। তবেই দুশমনদের
বিরুদ্ধে একটা খাসা মামলা দাঁড়াতে পারত। শনিচর ভাবল—গ্রামপ্রধান নির্বাচিত হওয়ার আগে
আরেকটু নেতাগিরি করে নিই। অতএব, নিঃশুল্ক উপকার করার চেষ্টায় বলল,-- প্রিন্সিপাল রাজি
হলে আমি ওনার হাতে কোঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে রক্ত বের করে দিই? তাহলে ওটাও খান্না মাস্টারের
কাজ বলে থানায় লিখিয়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু ছোটে পালোয়ান ওকে দূর দূর করে চুপ করিয়ে দিল।
সেই দুপুরে রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন, নিজে একবারও মুখ খোলেননি।
সেটা অবশ্য শিবপালগঞ্জে বোকামির চিহ্ন। আসলে ওরা ভেতরে ভেতরে প্রিন্সিপালের উপর রাগে
ফুঁসছিলেন। খানিক বাদে রূপ্পন বাইরে এসে বললেন—এই শালা বাবাকে কোর্ট-কাছারির দিকে নিয়ে
যাচ্ছে, এরপর জেলের ভাত খাইয়ে তবে শান্ত হবে।
এদিকে বৈদ্যজী সেই দুপুরে প্রিন্সিপালের মুখে খান্না মাস্টারের উৎপাতের গল্প গম্ভীর মুখে
শুনছিলেন। শেষে এমন একটা কথা বললেন যার সঙ্গে এই মামলার কোন সম্পর্ক নেই। কথাটি
একদম সত্ত্বগুণ সম্পন্ন এবং সেটা কোন লোককে নীরোগ করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
উনি বললেনঃ
“জেলা স্কুল ইনস্পেক্টরের ধর্মে মতি দেখে আমি তো হতভম্ব। গত মঙ্গলবার শহরে যেতে
হয়েছিল। দেখলাম, একজন লোক হনুমানজীর মন্দিরের সামনে মাটিতে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করছে।
যখন ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল দেখি আর কেউ নয়—আমাদের জেলা স্কুল ইনস্পেক্টর। চোখ থেকে,
কী আর বলব, প্রেমের অশ্রুধার বইছিল। আমি নমস্কার করায় উনি প্রতি নমস্কার করে রূদ্ধ
সরে ‘হাউ হাউ’ করে কীসব বলে ফের চোখ বন্ধ করলেন।
“ পরের বার পাঁচ -ছয় সের উত্তম ভৈঁসা ঘি নিয়ে যেতে হবে। এমন ধার্মিক মানুষ! খামোখা ডালডা
বনস্পতি খেয়ে খেয়ে ধর্ম নষ্ট করছে।
মহাকালের লীলা”।
একটা পুরনো শ্লোক ভুগোলের একটি উপপাদ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেটা হল—সূর্য কোন
নিয়ম মেনে পূর্বদিকে উদিত হয় না, বরং যেদিকে ওঠে সেটাই পূবদিক হয়ে যায়।তেমনই উঁচু স্তরের
সরকারি আমলা কাজের প্রয়োজনে ট্যুর করেন না। তিনি যখন ইচ্ছে যেদিকে যান, তখন সেখানেই
প্রয়োজন সৃষ্টি হয়। এই নবীন সূর্য সিদ্ধান্তের নিয়ম মেনে এক মহাপুরুষ সেদিন বিকেল চারটে
নাগাদ শহর থেকে মোটরগাড়ি চড়ে গ্রামের পথে যাচ্ছিলেন। পথের চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ
দেখে উনি নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলেন—হ্যাঁ, গতবছর যে লেকচার দিয়ে গেছলেন তার ফলেই
এদিকের গাঁয়ে এবার রবি ফসলের বাড়-বাড়ন্ত। চাষির দল ওনার পদ্ধতি মেনেই চাষ করেছে।

ওরা বুঝতে পেরেছে যে এই খেতগুলো লাঙল দিয়ে চষতে হবে। আর তাতে খালি সার দিলে হবে না,
বীজও বুনতে হবে। এই সব তত্ত্ব ওরা বুঝে নিচ্ছে এবং নবীন পদ্ধতির চাষের ব্যাপারে ওদের ভয়
দূর হয়েছে। কিসান এবার প্রগতিশীল হয়েছে, তবে ওরা আজও আগের মত চাষা-কে- চাষাই রয়ে
গেছে, সেজন্যেই পিছিয়ে পড়েছে।
মোটরগাড়ি চলছে তীব্র বেগে, আর রাস্তায় এঁকেবেঁকে চলতে থাকা লোকজন ঝড়ের মুখে শুকনো
পাতার মত উড়ে উড়ে রাস্তার কিনারে সরে যাচ্ছে। ফের নিজেকে ধন্যবাদ! যত আলসে নাগরিক ওঁর
মোটরের গতিবেগের ধাক্কায় কেমন চটপটে হয়ে উঠছে! দেখ, ওরা কেমন চালাক হয়ে গেছে! এমন
দ্রুতবেগে চলা গাড়ির চাকায় ওদের একটা বুড়ো আঙুলও পিষে যায়নি! উনি পরম সন্তোষে একবার
নিজেকে, ফের একবার গোটা ভারতকে বললেন—সাবাশ! তোর ভবিষ্যৎ উজ্বল বটে।
গাড়ি ছঙ্গামল ইন্টার কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আন্ডারওয়ারের উপরে বুশশার্ট এবং
ডোরাকাটা পাজামার উপর গেঞ্জি -ছাড়া- জামা পরা ছেলের দল নালার পাশে ছোট্ট পুলের উপর
বসেছিল। দুটো দল নিজেদের মধ্যে তিতির-বুলি’র সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা চালাচ্ছিল। সাহেব
এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে বুঝে ফেললেন যে এরাই ছাত্র।
গাড়ি প্রায় এক ফার্লং এগিয়ে গেছল। কিন্তু মহাপুরুষের খেয়াল হল যে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় উনি
নবযুবকদের কোন লেকচার দেননি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে এই তাজা তরুণদের জন্য উনি কত না
দুঃখ সয়েছেন! ওদের ভালর জন্যেই উনি গ্রামে নিজের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে বাংলোয়
থাকছেন। পুকুর পাড়ে বসে থাকার বদলে সকাল-সন্ধ্যে একটা ছোট্ট কামরায় বসে থাকার অভ্যেস
করেছেন। নিজেকে কত বদলে ফেলেছেন!
যেই মনে হল যে ওনার বিশেষ পছন্দের নওজোয়ানদের সঙ্গে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় কোন
কথাবার্তা হয়নি, অমনই খেয়াল হল—আরে! এতক্ষণ বিনা লেকচার ঝেড়ে রয়েছি? আমার মনে এত
ভালো ভালো চিন্তা উঁকি দিচ্ছে আর আমি কিনা সেসব স্বার্থপরের মত নিজের কাছে চেপে রেখেছি?
সত্যি, আমি আজকাল বড্ড কিপটে হয়ে গেছি। ধিক্‌ ধিক্‌! এই দেশে জন্মেও এতক্ষণ মুখ বন্ধ?
আটচল্লিশ ঘন্টা! মানে ২৮৮০ মিনিট? আর ৬০ দিয়ে যদি গুণ করি তো যা হবে তত সেকেন্ড; –
আচ্ছা, কত সেকেন্ড? এতটা সময় নওজোয়ানদের উৎসাহ দিতে কিছু জ্ঞান বিতরণ না করে
রয়েছি! আমার হলটা কী? পক্ষাঘাত নয় তো!
এক পলকে উনি ডিসিশন নিলেন—ড্রাইভার, গাড়ি ঘোরাও! এই কলেজটার স্ন্যাপ ইনস্পেকশন
করব।
উনি কলেজে পৌঁছে গেলেন আর ছুটির ঘোষণা হয়ে গেল। ছেলের দল ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে
বসে পড়ল। স্থানীয় সরকারি আমলা, মাঠে ঘাটে কড়ি খেলার জুয়াড়ির দল, তাড়িখানায় বসে থাকা
নেশাখোর—সবাই দেখতে দেখতে এসে ভীড় জমিয়ে দিল। বেশ বড়সড় মিটিং হয়ে গেল। এরা না
এলেও মিটিং হত। বক্তা নির্লজ্জ হলে একটা ল্যাম্পপোস্টকেও শ্রোতা বানিয়ে একাই মিটিং করে
নেয়। কিন্তু এখানে তো সত্যি সত্যি ভালরকম মিটিং হল।
ছেলেপুলের ব্যাপারটাই এ’রম। ওদের ক্লাসের মধ্যে আটকে রাখ তো কলেজ হয়, আর ক্লাস থেকে
বার করে খোলা মাঠে ছেড়ে দাও তো মিটিং!
উনি ছেলেদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের ভবিষ্যৎ আর মাস্টারদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের
ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। ছাত্র এবং মাস্টার এসব আগে থেকেই জানত। উনি ছেলেদের ধমকাতে
লাগলেন – কেন ওরা, আটচল্লিশ ঘন্টা তো দূর, আটঘন্টাও চুপ করে শুনতে পারেনা। তারপর উনি
টিচারদের ধমকালেন—কেন ওরা ছেলেগুলোকে সংযম শেখাচ্ছে না? উনি নালিশ করলেন—এই

ছোকরাগুলো জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে কিচ্ছু জানে না। আর মাস্টারের দল এসব
দেখেও খালি মাগ্যিভাতা বাড়াও, বেতন বাড়াও বলে চেঁচায়।
মাস্টার এবং ছেলের দল এসব নিয়ে তলিয়ে ভাবার আগেই ঊনি অন্য বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। সেই
বিষয়, যেটা স্কুল-কলেজে লেকচার দিতে আসা সব মহাপুরুষই না বলে ছাড়ে না।
বললেন—“আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এই ব্যবস্থায় পড়াশুনো করে সবাই খালি ক্লার্ক হতে
চায়”।
ছাত্রদের পরামর্শ দিলেন যে এই শিক্ষা-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা দরকার। উনি অনেক
বিদ্বান, বিশেষজ্ঞ এবং শ’য়ে শ’য়ে সমিতি ও কমিশনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বোঝালেন যে
বর্তমান শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। বিনোবাজী এবং গান্ধীজির নামও বাদ পড়ল না। তখন কলেজের
ম্যানেজার বৈদ্যজীও মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন-- আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। তারপর কলেজের
প্রিন্সিপাল, ওঁর দলের মাস্টার, যত ভবঘুরে, নেশাড়ু সবার মাথা নাড়ানোর পালা। এইভাবেই ওরা
মেনে নিল যে আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এবার উনি বললেন - গত শতাব্দীর শিক্ষা পদ্ধতি
যে ভালো ছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হল সবাই সাত তাড়াতাড়ি বুঝে গেল-- আমাদের শিক্ষা-
পদ্ধতি খারাপ।
ছাত্রদের বললেন যে ওদের উচিৎ চাষ করা, দুধ খাওয়া, শরীর চর্চা করা, আর আগামী দিনের
নেহেরু-গান্ধী হবার জন্য তৈরি থাকা। মুশকিল হল, এসব ছেলের দল ওনাকেও বলতে পারত। এসবের
পর উনি সমন্বয়, দেশের ঐক্য, রাষ্ট্রভাষা প্রেম ইত্যাদি হরেক বিষয়ে এক একটি বাঁধাগতের
বুলি বলে , কলেজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার বার্ষিক আশ্বাস দিয়ে, কিছু মেওয়া ইত্যাদি খেয়ে,
চা খেয়ে ফের ঘন্টায় সত্তর মাইল বেগে ফুরুৎ হয়ে গেলেন। মাস্টার আর ছাত্রের দল খানিকক্ষণ
ওনার “ভাইয়োঁ ঔর বহেনোঁ’ জাতীয় বাঁধা বুলির নকল করে যে যার ঘরে চলে গেল। ফলে শিক্ষা-
পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল কলেজের মালী, চাপরাসি ও মজুরদের ঘাড়ে।
ক্লার্ক মেওয়ার প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল মাত্র একটা কাজু পড়ে রয়েছে। সেটা তুলে ময়ূখে
দিতে গিয়ে কী ভেবে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলল।

(চলবে)

0 comments: