undefined
undefined
undefined
গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পপ্রথম পর্ব – বারৌনি প্রত্যাবর্তন
হিন্দোশিয়ার বিদেশসচিব আমান্ডা আইনস্টাইনের আতিথ্যে প্রায় ছ’মাস কাটানোর পর একদিন সকালে সমুদ্রতীরে তাদের প্রাসাদোপম বাড়ির ব্যালকনি থেকে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে মাধাই পানু রায়ের কাছ ঘেঁসে এসে বসলো। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ মাধাই, কিছু বলবি?’ মাধাই বলল,’ না তেমন কিছু নয়। ভাবছি আপনি এখন সূর্যোদয়ের আনন্দ উপভোগ করছেন , আপনাকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে কি না?’ পানু রায় বললেন,’ তোর গলায় উৎকণ্ঠার সুর শুনছি। সূর্যোদয়ের আনন্দ তো প্রাত্যহিক ব্যাপার। তুই নির্দ্বিধায় বলতে পারিস।‘ মাধাই হাত কচলাতে কচলাতে বলল,’ এমনি করে আরও কিছুদিন কাটালে আমার কাজকর্মের সূর্যাস্ত হতে আর দেরি হবে না। দেশে ফিরে যাবার কথা কিছু ভাবছেন?’ পানু রায় বললেন,’ দেখ মাধাই, আমি চাইলে আমার বাকি জীবন এখানে বসে বসে কাটিয়ে দিতে পারি। আমান্ডা যে আমায় যেতে দিতে চায় না সে কথা তোরা জানিস। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যি এভাবে সময় কাটাতে থাকলে আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।‘ পাশ থেকে পচা বলল,’ তোমার বয়স তো ১০৫ হল। আরও বেশিদিন বাঁচা মানে কী? আরও কত বছর?’ পানু রায় বললেন,’ ঠিক বলেছিস ,পচা। বেশিদিন আর নেই । বাকি জীবনটা বসে না থেকে নতুন কিছু একটা করতে চাই। এখানে থাকলে তা হবে না। তার চেয়ে চল সবাই মিলে বারৌনি ফিরে যাই। জগাই আর সুন্দরীর মধুচন্দ্রিমা তো অনন্তকাল চলতে পারে না। কেষ্ট, জগাই, সুন্দরীদেরও একটা গোটা জীবন পড়ে আছে। তুই বোকাসোকা মানুষ , তুই না হয় মাধাই এর কাছেই কাজ করবি সারাজীবন।‘ পচা গম্ভীর হয়ে বলল,’ দাদু, তুমি ভুলে যেও না সে দিন আমি দরজা না খুললে আজকের দিন তোমরা কেউ দেখতে পেতে না।‘ পানু রায় বললেন।‘ তুই রাগ করলি পচা। আমি মজা করছিলাম। তোকে আমি সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসি আর তার জন্যে আমায় কম কথা শুনতে হয় না।‘ পচা পানু রায়ের একেবারে কাছে এসে বসে। পানু রায় পচার কাঁধে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়। ততক্ষণে জগাই আর সুন্দরীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে মাধাই। আরও কিছুদিন এখানে কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও মাধাইএর কথায় রাজি হয়ে গেল ওরা। কেষ্টদার কথা অবশ্য আলাদা। কেষ্টদা এখনও শয্যাত্যাগ করেনি।সুস্বাদু খাদ্য এবং সুনিদ্রার ব্যবস্থা থাকলে হিন্দোশিয়ার সমুদ্রসৈকত আর বারৌনির পুকুরপারের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই কেষ্টদার। ব্রেকফাস্টের টেবিলে ঠিক হল যে পানু রায় আজ কালের মধ্যেই প্রসঙ্গটা উত্থাপন করবেন আমান্ডার কাছে। তারপর আমান্ডাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বারৌনি ফেরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ব্যবস্থা করা হয়ত অসুবিধে হবে না। বিনা পাসপোর্টে যখন আসা গেছে যাওয়াও যাবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া আমান্ডা এখনও হিন্দোশিয়ার বিদেশ সচিব। সুতরাং ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। জগাই বলল,’ কিন্তু চিন্তার কথা হচ্ছে যে সোনিয়ার ওজন এখন বেড়ে ৫৫০০ কেজি হয়েছে।‘ সুন্দরী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। বলল,’ তোমরা নিজেরা বসে বসে কী হয়েছ চোখে দেখতে পাচ্ছ? সোনিয়ার একটুখানি ওজন বেড়েছে তাই নিয়ে তোমাদের চিন্তার শেষ নেই।‘জগাই বলল,’ আহা, রাগ করছো কেন? আসার সময় কী হয়েছিল মনে নেই তোমার? প্লেনে তুলতে জীবন বেরিয়ে গিয়েছিল আমাদের।‘ সুন্দরীর রাগ কমল না। বলল,’ শোন, ওকে যদি প্লেনে তোলা না যায় নিতে হবে না সোনিয়াকে। তোমরা চলে যাও। আমি আর সোনিয়া থেকে যাব এখানে।‘ পানু রায় এতক্ষণ ওদের কথোপকথন শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। এবার দেখলেন তিনি না থামালে ঝগড়া বন্ধ হবে না। বললেন,’ সুন্দরী, সোনিয়াকে যখন আমরা এনেছি , নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের। আমরা তো আছি। ৫৫ কেজির মা আর ৫৫০০ কেজির মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাব আমরা। তুমি কি আমাদের এতটা স্বার্থপর মনে কর?’ পানু রায়ের আশ্বাস শুনে রাগ কমল সুন্দরীর। বলল,’ দাদু, ১০৫ বছর বয়সে যে দায়িত্ব তুমি নিতে পারলে, ৩০ বছর বয়সে সে দায়িত্ব জগাই নিতে পারছে না। হাজার হলেও সোনিয়া তো ওর মেয়েই হল, না কি? হস্তিনী বলে কি মানুষ নয় ও? ‘বাস্টার সঙ্গে সঙ্গে চেঁচামেচি করে বুঝিয়ে দিল যে কথাটা ওর জন্যেও সত্যি। সুন্দরী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বাস্টারকে কোলে তুলে আদর করতে করতে সোনিয়ার দিকে এগিয়ে চলল। হাঁ করে জগাই তাকিয়ে রইল সুন্দরী আর তার ছেলেমেয়েদের দিকে। সুন্দরীর এই অপত্যস্নেহ মাঝে মাঝে অবাক করে জগাইকে। ভয় হয় বাস্টারকে কোলে নিয়ে কোথাও যাবার সময় যদি সোনিয়াকে কোলে নেবার জন্য ওকে বলে তাহলে কী করবে ও? পানু রায় জগাই এর পিঠে হাত রাখেন। বলেন,’ কী দেখছিস জগাই? ভয় করিস না। আমি তো আছি। সংসার সমরাঙ্গনে যুদ্ধ করো দৃঢ়পণে, ভয়ে ভীত হয়ো না কাতর।‘পরম ভরসায় ৩০ বছরের জগাই ১০৫ বছরের পানু রায়ের কাঁধে মাথা রাখে। জগাই এর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেন পানু রায়। পানু রায়ের বড় আদরের এই জগাই।
মধ্যাহ্নভোজের সময় আমান্ডার কাছে আস্তে আস্তে কথাটা পাড়লেন পানু রায়। বললেন,’ আমান্ডা, অনেকদিন তো হল হিন্দোশিয়ায়। আর কিছুদিন এমনি করে কাটালে চলচ্ছক্তিরহিত হয়ে যাব আমি। তাছাড়া, আমার নাতি-নাতনিদেরও তো কিছু একটা করতে হবে। তোমার আদরে থেকে থেকে বাঁদর হয়ে উঠলে ওদের ভবিষ্যৎ রসাতলে যাবে যে।‘কথাটা শুনে আমান্ডা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,’ সত্যি করে বল তো তোমাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? ‘সকলে হাঁ হাঁ করে বলে উঠল,’ কী যে বলেন ম্যাম! একথা বললে নরকেও জায়গা হবে না আমাদের।‘কেষ্টদা কথাটা ঠিকঠাক না শুনেই বলে উঠল,’ জায়গা না হলে হিন্দোশিয়ায় ফিরে আসব সবাই মিলে।‘সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কেষ্টদা বোকার মত তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবতে থাকল কী এমন হাসির কথা বলেছে সে? কিছু বুঝতে না পেরে পাশে রাখা মিষ্টির প্লেটের দিকে হাত বাড়াল কেষ্টদা। তার বড় ভালবাসার এই জলভরা সন্দেশ। অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে আমান্ডা বলল,’ ঠিক আছে আমি যদি সকলের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি এখানে তাহলে তো কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। ইন্ডিয়া থেকে কত লোক কত কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে কাজের জন্য আসে। আমি একসপ্তাহের মধ্যে তোমাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর তোমাদের মনে হবে না তোমরা বসে বসে খাচ্ছ।‘পচা আনন্দে একেবারে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল,’এ তো দারুন ব্যাপার! কি কাজ করতে হবে ম্যাম?’ পাশ থেকে সুন্দরী উত্তর দিল,’ সৈনিকের। ম্যাম যুদ্ধে পাঠানোর জন্য তোকে বেছে রেখেছেন। দাদুর সঙ্গে ম্যামের কথা হয়ে গেছে। কাল থেকে তোর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা মিলিটারি ক্যাম্পে। খুশি তো? ‘পচার মুখের হাসি মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। পানু রায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কাঁদোকাঁদো গলায় জিগ্যেস করলো,’ দাদু, সত্যি?’ পচার কষ্ট পানু রায় একদম সহ্য করতে পারেন না। পচাকে সকলের চেয়ে বেশি স্নেহ করেন পানু রায়। পানু রায় হেসে বললেন,’ দুর বোকা, তাই কখনও হয়? ওরা তোকে নিয়ে মজা করছে। তোকে ছেড়ে আমরা কি কেউ থাকতে পারি?‘ হাসিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পচার।
একটু ইতস্তত করে পানু রায় বললেন, ’আমান্ডা, দেশে ফেরাটা আমাদের খুব দরকার। তোমার আতিথ্যে আমরা মুগ্ধ। তোমাদের ছেড়ে যাবার কোনওরকম ইচ্ছে আমাদের নেই সে কথা বলা বাহুল্য। দেশে ফিরে হয়ত এত আদর যত্ন আরাম আমাদের জুটবে না। তবুও ঘরের টান! বুঝতে তো পারছোই। তুমি মন খারাপ করো না, আমান্ডা। আমি তোমার সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা দেখা করব। তোমাকে এখন আর বিরক্ত করব না।‘ আমান্ডা উঠে এসে পানু রায়ের হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ’তুমি আমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধু। তোমাকে ছেড়ে দিতে আমার মন চাইছে না। কিন্তু তোমার কথাও ফেলা যায় না। তুমি আজীবন মুক্ত বিহঙ্গ। কী সাধ্য আমার যে তোমাকে সোনার খাঁচায় বেঁধে রাখি।‘ আমান্ডার চোখ জলে ভরে যায়। পানু রায় বললেন, ’তোমার মত বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতবছর ধরে কত শত জায়গায় আমি ঘুরেছি। কত যে মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তোমার মত কাউকে পাইনি। যখন সারাজীবনের জন্য তোমাকে চেয়েছিলাম তখন পাইনি। আজ আর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে মায়ায় জড়াতে চাইনা। আমান্ডা বলল,’ আমি সে কথা জানি। অন্তর দিয়ে তোমার ভালোবাসা উপলব্ধি করি। তুমি যেখানে ভালো থাকবে সেখানেই থাকো। আমার হৃদয়ে তোমার জায়গা সবসময়। যেদিন ইচ্ছে হবে চলে এসো। সবাইকে নিয়ে এসো। তোমরা আমার পরিবারের চেয়ে কম কিছু নয়।‘ সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আমান্ডা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার আগে পানু রায়কে বলে গেল,’ সন্ধ্যাবেলা এস। কথা আছে।‘
আমান্ডা চলে যাবার পর সুন্দরী পানু রায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। চোখ বড় বড় করে এক গাল ঝকঝকে হাসি মুখে নিয়ে বলে,’ দাদু, তোমার পেটে পেটে এত! আগে গিয়ে আরও কত কী যে দেখব কে জানে?’ ঘরশুদ্ধু সবাই পানু রায়কে ঘিরে দাঁড়ায়। সকলের হাসি মস্করায় মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা আমান্ডার সঙ্গে দেখা করে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল পানু রায়ের। যখন ফিরলেন তখন নৈশভোজের আয়োজন সম্পূর্ণ। সকলে ডাইনিং হলে পানু রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। সুন্দরী স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় এক গাল হেসে বলল,’ দাদু, এত দেরি হল? ছাড়তে চাইছিল না নিশ্চয়ই। পুরনো প্রেম বলে কথা। কত কথা যে জমে আছে!’ পানু রায় হেসে বললেন,’ সে কথা তো শেষ হবার নয়। কিন্তু যাবার ব্যাপারে যা কথা হল তা এই যে আমাদের উড়োজাহাজের ব্যবস্থা আমান্ডা করবে যাতে সোনিয়াসহ আমরা সকলে একসঙ্গেই যেতে পারি। আগামী রবিবার মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা বেরিয়ে পড়ব। হিন্দোশিয়ার প্রথাগত পদ্ধতি মেনে আমাদের বিদায়ী মধ্যাহ্নভোজে হিন্দোশিয়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। অতএব এবার আমাদের গোটাবার পালা। সুতরাং চলো বারৌনি!! মাধাই, তোমার লোকজনদের খবর দিয়ে দাও আমরা সদলবলে রবিবার বারৌনি পৌঁছচ্ছি। এবার খাওয়া শুরু করা যাক।‘
দ্বিতীয় পর্ব - আমান্ডা আর পানু রায়ের কথা
ওরা সবাই বারৌনি এসে পৌঁছেছে প্রায় ছ’মাস হয়ে গেল। অনেকদিন না থাকার জন্য বেশ কিছু কাজ জমে গিয়েছিল সবার। তার ওপর হিন্দোশিয়াতে অতিরিক্ত অনেকটা সময় কাটিয়েছে সবাই। সমুদ্রের ধারে প্রাসাদোপম বাংলোতে আমান্ডার অভাবনীয় আতিথ্য উপেক্ষা করে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না ওদের পক্ষে। অবশেষে মাধাইএর মাথাতেই এই মাত্রাতিরিক্ত অবসর যাপনের অপকারিতার কথা এসেছিল। তা না হলে আরও কতদিন যে ওখানে কেটে যেত কে জানে। যাই হোক সবকিছু ঠিকঠাক করে এখন মোটামুটি সবাই বেশ স্থিতু। আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমান্ডার কথাটা উত্থাপন করল সুন্দরী। আমান্ডার সঙ্গে পানু রায়ের সম্পর্কটা ঠিক কী ছিল সেটা কিছুতেই স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিল না সুন্দরী। দেখে মনে হয় আমান্ডা খুব বেশি হলে পনের বছরের ছোট পানু রায়ের থেকে। একটা মিষ্টি মধুর সম্পর্ক যে এককালে ছিল দু’জনের কথাবার্তায় বেশ বোঝা যায়। একটা রোমান্টিকতার আভাস দু’জনের আচরণে সুন্দরী যে মাঝেমাঝে লক্ষ করেনি তা নয়। ব্যাপারটা আরও বিস্তারিত ভাবে জানার ঔৎসুক্যে ভালো করে ঘুম হচ্ছিল না সুন্দরীর। জগাইএর সঙ্গে কয়েকবার আলোচনাও হয়েছে সুন্দরীর এ নিয়ে। আজ আর নিজেকে সামলাতে না পেরে জিগ্যেস করে বসল,’ দাদু, আমান্ডার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি শুধুই বন্ধুত্বের না আরও কিছু? অনেকদিন ধরে তোমাকে জিগ্যেস করব করব করে সাহস করে উঠতে পারিনি। তারপর মনে হল তুমি তো আমাদের একেবারে নিজের মানুষ। তোমার কাছে আমরা গল্প শোনার আবদার তো করতেই পারি।‘ সুন্দরীর কথা শুনে সবাই হৈ হৈ করে পানু রায়কে ঘিরে বসল। পানু রায় বললেন,’ হ্যাঁ, গল্পই বলা যেতে পারে। খাওয়া শুরু কর সবাই। খেতে খেতে বলছি।‘ পানু রায় যা বললেন তা এইরকম।
আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের কথা। পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে পানু রায় তখন রাশিয়ায়। পানু রায়ের কাজ ছিল ওখানকার জেলবন্দিদের কম্যুনিজমের প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার। যাতে জেলবন্দিরা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং রাশিয়ার প্রতি তাদের ভালোবাসা জন্মায়। সেইসময় নানান জেলে ঘুরতে ঘুরতে পানু রায়ের সঙ্গে দেখা হয় রবার্ট আইনস্টাইনের । রবার্ট জার্মানির লোক। প্রায় তার সমবয়সী। রবার্ট নিজের বয়স কত নিজেও ঠিকমত জানত না। রবার্টের কথা অনুযায়ী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নাকি ওর দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল। হিটলারের অত্যাচারে অনেকেই তখন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সেই সময় আরও অনেকের সঙ্গে জার্মানি ছেড়ে পালায় রবার্ট। পালাতে পালাতে এসে পৌঁছয় রাশিয়ার সীমান্তে। বিনা পাসপোর্টে সীমানা পেরোনোর সময় মিলিটারি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রবার্ট। তারপর প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু বিনা বিচারে রাশিয়ার জেলে বন্দি হয়ে আছে জার্মানিরা। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। হিটলারের ভয়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা জার্মানিতে ফিরে আসছে কিন্তু তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। রবার্টের কাহিনী শুনে তার হয়ে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান পানু রায়। এক বছর ধরে অনেক তদ্বির তদারকি করে রবার্টকে জেলের বাইরে নিয়ে আসার অনুমতি আদায় করেন পানু রায়। পানু রায়ের কাছে থেকে জার্মানিতে যোগাযোগ করে রবার্ট জানতে পারে ইতিমধ্যে তার বাবা এবং কাকা দু’জনেই মারা গেছেন। রবার্টের মা রবার্ট দেশ ছাড়ার অনেক আগে মারা গেছেন। কাকা বিয়ে করেননি এবং তাদের সঙ্গেই থাকতেন। যেহেতু রবার্ট তার বাব-মার একমাত্র সন্তান সুতরাং উত্তরাধিকারসূত্রে পরিবারের স্থাবর এবং অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মালিক এখন রবার্টই। রাশিয়ার বিদেশ দপ্তরে আবেদন নিবেদন করে রবার্ট পানু রায়কে সঙ্গে নিয়ে জার্মানি যাবার অনুমতি সংগ্রহ করল। শর্ত রইল ছ’মাসের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। দেশে গিয়ে জায়গা-জমি-ঘর-বাড়ি সব বিক্রি করে , ব্যাঙ্কের কাজ মিটিয়ে রাশিয়া ফিরে এল দু’জনেই। তারপর রাশিয়ায় বেশ কিছুদিন কাটল দু’জনের। একসঙ্গে থাকতে থাকতে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠল পানু রায় আর রবার্টের। বয়সের ব্যবধান কোনও বাধার সৃষ্টি করল না। রবার্ট ছিল প্রায় দশ বছরের বড়। থাকতে থাকতে পানু রায়ের চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। পানু রায়ের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে রাশিয়া সরকার চুক্তির মেয়াদ এবং অর্থের পরিমাণ দুই-ই বৃদ্ধি করতে রাজি হল। কিন্তু বাধ সাধল রবার্ট । রবার্ট বলল ,’ তোমার জন্য আমার জীবনটা পালটে গেল। আজ যে আমি এত অর্থের মালিক তা তুমি না হলে সম্ভব হত না। তোমাকে আর চাকরি করতে হবে না। চল ক’টা বছর অন্য কোথাও ঘুরে আসি। সব খরচ আমার। তুমি আপত্তি কোরো না।‘ রবার্টের আবদারে অনুরোধে রাজি হয়ে গেল পানু রায়। ফিরে এসে দপ্তরে আবার কাজে যোগদান করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল পানু রায় আর রবার্ট। এখান ওখান ঘুরে অবশেষে হিন্দোশিয়া পৌঁছে মনে হল এখানে সমুদ্রসৈকতে বেশ কিছুদিন কাটানো যেতে পারে। সমুদ্রের ধারে একটা ছোট কিন্তু সুন্দর হোটেল ভাড়া করে থাকতে আরম্ভ করল দুই বন্ধুতে। সেই হোটেলে পরিবেশিকার কাজ করত আমান্ডা। আমান্ডার মাথা আর মন যে কোথায় থাকত কে জানে। তাকে ভদকা আনতে বললে নিয়ে এসে হাজির করত কলার শরবৎ। অমলেট আনতে বললে চিকেন কাবাব নিয়ে এসে হাজির হত। এককথা একশ’বার বললেও মাথায় ঢুকতোনা আমান্ডার। একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল পানু রায়ের। প্রচন্ড রাগারাগি করল আমান্ডার ওপর। আমান্ডা মুখ ভার করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে আবার যে কে সেই। রেগেমেগে পানু রায় চলল ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জানাতে। এই মেয়েকে দিয়ে আর চলবে না তাদের। পানু রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে ধরল রবার্ট। বলল,’ থাক না। আমান্ডার মাথাটা একটু মোটা ঠিকই কিন্তু মুখটা ভারি সুন্দর। একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিলে কোনও অসুবিধে হবেনা।‘ অবাক হয়ে রবার্টের মুখের দিকে তাকিয়ে পানু রায়ের মনে হল রবার্টের চোখ অন্য কিছু বলছে। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ তোমার কী হয়েছে, রবার্ট? সত্যি করে বলতো। তোমার চোখ মুখ তো অন্য কিছু বলছে। তুমি কি শেষ অবধি হাঁটুর বয়সী মেয়েটার…?’ লজ্জায় রবার্টের মুখ লাল হয়ে উঠল। চেয়ারে আবার বসে পড়লেন পানু রায়। ভালোবাসার গতি কি বিচিত্র!
এতটা শুনে সুন্দরী জিগ্যেস করল,’ তারপর? ‘পানু রায় বুঝতে পারলেন সবাই যেটা শুনতে চাইছিল সেটার সঙ্গে গল্পটার কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই হতাশ ওরা সবাই। বিশেষ করে সুন্দরী। পানু রায় মুচকি হেসে বললেন,-তারপর আর কী? সারারাত নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে পরের দিন সকালে আমি আর রবার্ট খুঁজে খুঁজে আমান্ডার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমান্ডা ততক্ষণে হোটেলের জন্য বেরিয়ে গেছে। ওর বাবার সঙ্গে দেখা করে সবকথা বললাম। রবার্ট মাথা নিচু করে বসে রইল সারাক্ষণ। সব শুনে আমান্ডার বাবা বলল,’ আপনারা ঠিক বাড়িতে এসেছেন তো? মানে আমি জানতে চাইছি আপনারা আমার বড় মেয়ের কথা বলছেন? ওর নামও আমান্ডা। সাত আটটা জায়গায় কাজ খুইয়ে ক’মাস হল একটা হোটেলে কাজ করছে এখন। কতদিন করতে পারবে কে জানে?’ আমরা ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করে বললাম,’ হ্যাঁ,আমরা ওনার মেয়ে আমন্ডের জন্যই এসেছি। রবার্ট ওকে বিয়ে করতে চায়।‘ ভদ্রলোক ধাতস্থ হয়ে একগ্লাস জল ঢকঢক করে গলায় ঢেলে তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এলেন। সব জেনেশুনে আমান্ডার বাবা-মা রাজি হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার পথে মনের আনন্দে রবার্ট আমাদের দু’জনের জন্য একজোড়া স্যুট আর জুতো কিনে ফেলল। হোটেলে ফিরে সারাদিন ধরে খাদ্য আর পানীয়ের অর্ডার যোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে কেঁদে ফেলল আমান্ডা। আমিও অবাক হয়ে দেখছি ভুলভাল যা এনে দিচ্ছে আমান্ডা তাই মহানন্দে উদরস্থ করে নিচ্ছে রবার্ট। আজকে একটাও ভুল হয়নি ভেবে নিজেই কেমন যেন ঘাবড়ে গেল আমান্ডা। চোখগুলো বড় বড় করে বোকার মত তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বোধ হয় জিগ্যেস করতে চাইছে,’ সত্যিই কি আমি একটাও ভুল করিনি?’ কিন্তু কী করে আমি বলি,’ ভুল, সবই ভুল’? কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে ভুল সব হিসেব গুলিয়ে গেল আমার। মদে বেহুঁশ হয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ল রবার্ট। আমি আর আমান্ডা দু’জনে মিলে ধরাধরি করে কোনওক্রমে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম।
বিস্ময়ের পালা তখনও শেষ হয়নি।আরও সব গোলমাল হয়ে গেল যখন পরের দিন সকালে আমান্ডা এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল,’ এত বড় সাহস ঐ বুড়ো মাতালটার যে কাল আমি বেরোবার পর বাবাকে বুঝিয়ে এসেছে যে ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। কোনও লাজলজ্জা নেই। ঠিকসময় বিয়ে হলে আমার বয়সী একটা মেয়ে হত ওর। তাই ভাবছি যা দিচ্ছি কোনও কথা না বলে কেন গিলে নিচ্ছে বুড়োটা? এমনতো হবার কথা নয়। আর এই যে তুমি শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। তুমিও গিয়েছিলে ওটার সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্বনাশ করতে।‘কথা শেষ করতে না করতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল আমান্ডা। ওর কান্না দেখে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল রবার্ট। হোটেলের আর আশেপাশের সমস্ত মানুষ হাঁ করে দেখতে থাকল এই দৃশ্য, শুনতে থাকল রবার্ট আর আমান্ডার যুগলবন্দী। কান্না থামলে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে গেল রবার্ট। সারাদিন ঘর থেকে বেরোলো না। একটা দানাও মুখে কাটলো না।‘বাড়ি যাবার আগে আমান্ডা আমার কাছে এল। বলল,’ আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার এতটা উত্তেজিত হওয়া ঠিক হয়নি। উনি আমার বাবার কাছে গিয়ে আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন। সে উনি দিতেই পারেন। রাজি হওয়া না হওয়া আমার ব্যাপার। কিন্তু আমার ওনার প্রতি এই আচরণ ঠিক হয়নি।‘ আমি তো অবাক। যে মেয়ের মাথায় কিছু নেই বলেই আমি জানি আর আজ সকালে যার এমন রণচন্ডী রূপ আমি দেখেছি সেই মেয়ে এত গুছিয়ে শান্তস্বরে কথা বলছে? কে জানে মেয়েরা বোধ হয় এরকমই হয়। বাইরে যতই কঠিন হোকনা কেন ভেতরে তারা সত্যিই কোমল। আমি বললাম,’ এসব কথা আমাকে বলে লাভ কী? তুমি রবার্টের কাছে তোমার অনুতাপের কথা জানিও।‘আমান্ডা বলল,’ সকালের ঘটনার আমি ওনার মুখোমুখি হতে পারবো না। আপনি অনুগ্রহ করে ওনাকে জানিয়ে দেবেন যে আমি আমার আচরণের জন্য সত্যিই দুঃখিত।‘আমি চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম,’ আচ্ছা,একটা কথা বলবে? আজ সকালে তুমি এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করলে কেন? ওনাকে কেন এভাবে আক্রমণ করলে? সামান্য কারণে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যাওয়া কি তোমার স্বভাবজাত?’ আমান্ডা বলল,’ একেবারেই না। আসলে আশাভঙ্গই আমার উত্তেজনার কারণ। আমি যা চেয়েছিলাম তা না পাবার জ্বালা থেকেই আমি এসব করে ফেলেছি। মনের দুঃখ, অপমান চেপে রাখতে পারিনি।‘ আমি বললাম,’ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। রবার্ট তোমার আশাভঙ্গের কারণ হলো কী করে? তা ছাড়া সে তো তোমাকে কোনও কষ্ট, যন্ত্রণা, আঘাত দেয়নি। তাহলে?’ আমান্ডা বলল,’ না না ওনার কোনও দোষ নেই। কেউ কোনও দোষ করেনি। সবই আমার চাওয়া আর তা না পাওয়ার দোষ। আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না।‘আমার মাথায় জেদ চেপে গেল। আমান্ডার বাবার কাছে রবার্টের প্রস্তাবে কী এমন ঘটল আমান্ডার জীবনে যে সে স্থান কাল পাত্র ভুলে রবার্টকে হেনস্থার চূড়ান্ত করল? আমান্ডার বাবা তো এই প্রস্তাবে খুশিই হয়েছিল। আশাভঙ্গ যদি কারও হয়ে থাকে তবে তা রবার্টের। এ তো দেখি উলটো কথা বলে। আমি বললাম,’ কী আশা করেছিলে তুমি যা ঘটলো না? কী চেয়েছিলে তুমি যা পেলে না? তোমাকে স্পষ্ট করে বলতেই হবে।‘ আমান্ডার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। বলল,’ সে আমি আপনাকে বলতে পারবো না।‘ আমি বললাম,’ না তা হয়না । জানতে আমাকে হবেই।রবার্ট আমার বন্ধু। তার অপমান আমারও অপমান। সেই অপমানের কারণ না জানলে আমার মন কিছুতেই শান্ত হবে না।‘ আমান্ডা মুখ নামিয়ে নিজের পা-এর দিকে বলল,’ আপনি যখন জানতেই চাইছেন তাহলে শুনুন। অনেকদিন ধরে আমি আপনাকে লক্ষ করছিলাম। আপনার চোখের ভাষা দেখে আমি আশা করেছিলাম আপনি হয়ত আমাকে প্রস্তাব দেবেন। মনে মনে আমি আপনাকে চেয়েছিলাম। ওনাকে নয়।‘ আমান্ডার কথা শুনে আমার তো প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাবার মত অবস্থা। জীবনে এই প্রথম কোনও মেয়ে আমাকে বলল যে সে আমাকে পছন্দ করে। আমি হাঁ করে আমান্ডার দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ বসেছিলাম কে জানে? সম্বিৎ ফিরল আমান্ডার গলার আওয়াজে। বলল,’ আপনি অবাক হলেন? আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম। আপনি কিছু মনে করবেন না।‘আমি বললাম,’ আমি তো কিছুই বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে সরাসরি বললে না কেন? নিজের ইচ্ছের কথা নিজের মনে গোপন করে রাখতে গেলে কেন? রবার্টকে দেখ। সে তার মনের কথা তোমার বাবার কাছে সোজাসুজি স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে এসেছে। ওর ভালোবাসায় কোনও দ্বিধা নেই, একেবারে নিখাদ। তোমার প্রত্যাখানে ভয়ঙ্কর আঘাত পেয়েছে ও।‘আমান্ডার চোখ দু’টো জলে ভরে উঠলো। আমি বললাম,’ আমান্ডা, রবার্ট আমার বন্ধু। সে তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। তুমি তাকে প্রত্যাখ্যান করতেই পারো। সে তোমার স্বাধীনতা। কিন্তু তোমার ডাকে আমি কী করে সাড়া দিই বল? আমার প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা আমি কী করে করব? আর তুমি হয়ত জাননা তোমার বারবার ভুলের জন্য তোমার নামে আমি তোমার ম্যানেজারের কাছে নালিশ করতে যাচ্ছিলাম। রবার্ট আমাকে নিরস্ত করেছিল। বলেছিল সে তোমাকে ভালোবাসে। এখন আমি বুঝতে পারছি তুমি কেন বারবার ভুল করছিলে? দুঃখ পেয়োনা আমান্ডা। রবার্টের কথাটা ভেবে দেখো। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই হিন্দোশিয়া ছেড়ে চলে যাব। রবার্টকে বিয়ে কর। সে তোমাকে খুব ভালো রাখবে।‘আমার কথা শেষ হবার আগেই আমান্ডা এক দৌড়ে হোটেলের ভিতরে ঢুকে গেল।
সেদিন রাত্রে রবার্ট কিছু খেল না। একবারের জন্যও ঘরের বাইরে এল না। আমি অনেকবার ডাকলাম। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখল। পরেরদিন সকালে আমি যখন লনে গিয়ে বসলাম দেখলাম রবার্ট দূরে একটা পাথরের ওপর বসে একমনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমাকে দেখে একেবারে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। বুঝলাম প্রত্যাখ্যান আর অপমানের জ্বালা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে ওর দুই চোখ দিয়ে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে শান্ত করে ব্রেকফাস্ট টেবিলে নিয়ে এলাম।যা ঘটে গেছে তা অনাবশ্যক জিইয়ে রেখে কোনও লাভ নেই। অস্বস্তির আবহাওয়াটা কেটে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায় ততই মঙ্গল। ভাবলাম আমান্ডাকে বুঝিয়ে তার ব্যবহারের জন্য রবার্টের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে বলব। কিন্তু ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে শুনলাম আমান্ডা আজ আসেনি। ভাবলাম ঠিক আছে কাল বা পরশু যেদিন আসবে সেদিনই ব্যাপারটা মিটমাট করে নেওয়া যাবে। এই মূহূর্তে আমান্ডা হয়ত রবার্টের মুখোমুখি হতে চাইছে না। একটু সময় গেলে আমান্ডা এবং রবার্ট দু’ জনেরই উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হবে । তখন সামনাসামনি কথা বলাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে হয়ত। কিন্তু যা ভাবলাম তা হল না। দেখতে দু’ সপ্তাহ কেটে গেল আমান্ডার দেখা নেই। ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিলাম। সে বলল আমান্ডা কোনও খবর দেয়নি। আর ক’টা দিন দেখে হোটেল আইনমাফিক ব্যবস্থা নেবে। আমার ব্যাপারটা খুব সুবিধের মনে হল না। আমারও যে আমান্ডার প্রতি একটা দুর্বলতা আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিছুটা কৌতূহল কিছুটা আমান্ডাকে দেখার ইচ্ছে সব মিলিয়ে ভাবলাম যদি পরেরদিন সকালেও আমান্ডা না আসে তাহলে বেলার দিকে ওর বাড়িতে একবার যাব। আমি একাই যাব স্থির করলাম। রবার্টকে কিছু বললাম না। কিন্তু তার আর দরকার হলো না। সকালবেলা নিচে নেমে দেখি লনের চেয়ারে আমান্ডা আর ওর বাবা বসে আছে। রবার্ট তখনও নামেনি। আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা দু’জনেই আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমান্ডা আমাকে বলল,’ ওদিকে আসুন, জরুরি কথা আছে।‘ আমি আমান্ডার বাবার দিকে তাকালাম। উনি চোখের ইঙ্গিতে সম্মতি দিলেন। একটু দূরে গিয়ে আমান্ডা আমাকে বলল,’ গত পনেরদিন অনেক ভেবে বাবার সঙ্গে কথা বলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি রবার্টকে বিয়ে করব। কিন্তু একটা শর্তে। তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না। তোমাকে আমাদের সঙ্গেই থাকতে হবে। তুমি যদি রাজি হও তাহলে বাবা আজই রবার্টের সঙ্গে কথা বলবে। তার আগে আমি আমার অন্যায় আচরণের জন্য রবার্টের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।‘ আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। কিন্তু আমান্ডার যা জেদ তাতে আমি কথা না দিলে হয়ত আবার ফিরে যাবে। আমার এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার জন্য যদি ওদের বিয়েটা আটকে যায় তাহলে আমি নিজের কাছে এবং ওদের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব সারাজীবন। বিশেষ করে যখন আমান্ডা রবার্টকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আমি আমান্ডার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। আমান্ডার বাবা আমাদের কাছে সব শুনে বললেন,’ আমি রবার্টকে গিয়ে খবরটা দিই। রবার্টের প্রস্তাবে আমি সম্মত ছিলাম গোড়া থেকেই। মাঝখান থেকে আমার মেয়েটাই পাকালো যত গন্ডগোল। যাক সবকিছু ভালোভাবেই মিটে যাবে মনে হচ্ছে। ‘ আমি আমান্ডাকে বললাম ,’ তুমিও যাও বাবার সঙ্গে। বাবা কথাটা বলার আগেই তুমি ক্ষমা চেয়ে নিও।‘ আমান্ডা শান্ত মেয়ের মত বাবার পিছু পিছু রবার্টের ঘরের দিকে হাঁটা দিল। কত পাল্টে গেছে মেয়েটা গত পনেরদিনে।
এই পর্যন্ত শুনে সুন্দরী বলল,’ আমান্ডার গল্প তো শুনলাম। কিন্তু তুমি কী করলে?’
পানু রায় বললেন- তারপর ধুমধাম করে আমান্ডা আর রবার্ট এর বিয়ে হয়ে গেল। আমি আর কী করি? কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থেকে গেলাম ওদের সঙ্গে। রবার্ট এবং আমান্ডা দু’জনেই আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইল না। যাবার কথা উঠলেই দু’জনে এত ছেলেমানুষি করত যে যাওয়া হয়ে উঠত না। সত্যি কথা বলতে কী ওদের বন্ধন ছেড়ে যেতে আমারও মন চাইত না। দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল। হোটেলের চাকরি ছেড়ে আমান্ডা সরকারি দপ্তরে চাকরিতে ঢুকে গেল। হিন্দোশিয়ায় টাকা খরচ করলে বা বলা ভাল ঠিক জায়গায় টাকা দিতে পারলে ডিগ্রি সার্টিফিকেট আর সরকারি চাকরি জোগাড় করা এমন কোনও বড় ব্যাপার নয়। বলা যেতে পারে সরকারি চাকরি পাবার এটাই একমাত্র রাস্তা ছিল। রবার্টের টাকার কোনও অভাব ছিল না। ঠিকঠাক জায়গায় টাকাকড়ি দিয়ে আমান্ডাকে বিদেশ দপ্তরে ঢুকিয়ে দিল। আমান্ডার বাবার অনেক জানাশোনা ছিল কিন্তু টাকার জন্য কিছু করতে পারছিল না। রবার্ট প্রভূত পরিমাণে টাকা খরচ করে নিজে রাজনীতিতে যোগ দিল। হিন্দোশিয়াতে ভোট হয় ঠিকসময় কিন্তু সরকার পাল্টায় না কোনওবার। গত চল্লিশ বছর ধরে একই দল সরকার চালাচ্ছে। পয়সা খরচ করে কর্পোরেশন ভোটে একটা টিকিট জোগাড় করে ফেলল রবার্ট। হিন্দোশিয়ায় টিকিট পাওয়াটাই আসল। বিরোধীপক্ষ বলে কিছু নেই সুতরাং ভোটে হারার কোনও ব্যাপার নেই। টিকিট পাওয়া মানেই কাউন্সিলর হওয়া। ওপর মহলে আমান্ডার বাবার যোগাযোগ আর রবার্টের টাকা এই দুই এর মিলিত শক্তিতে জনপ্রতিনিধিত্বের প্রথম ধাপ অতিক্রম করল রবার্ট। বাকিটা টাকার খেলা। টাকার অঙ্কের ওপর নির্ভর করবে বিধানসভার সদস্যপদ, মন্ত্রীত্ব, লোকসভার সদস্যপদ ইত্যাদি ইত্যাদি। রবার্ট যেদিন কাউন্সিলর হল আমান্ডা জানাল সে মা হতে চলেছে। আমান্ডা যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রবার্টেরও সময় নেই। মনে ইচ্ছে থাকলেও রবার্ট এবং আমান্ডা কেউই সময় দিতে পারছিল না আমাকে। বুঝতে পারতাম একটা অপরাধবোধ কাজ করছে ওদের মধ্যে। ওদের অস্বস্তি না বাড়িয়ে আমি সুইডেনে একটা চাকরি জোগাড় করে ওদের কাছে বিদায় চাইলাম। রবার্ট প্রস্তাব দিল চাকরির জন্য সুইডেনে যাবার দরকার নেই। হিন্দোশিয়াতেই আমার একটা উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে সে। আমি রাজি হলাম না। বেশ কিছুদিন টানহ্যাঁচড়ার পর ওরা আমাকে যেতে দিতে রাজি হল কিন্তু শর্ত রইল সময় পেলেই আমি যেন হিন্দোশিয়ায় যাই। তারপর যা হয়। প্রথম প্রথম কয়েকবার গিয়েছিলাম। এর মধ্যে রবার্ট মন্ত্রী হল। আমান্ডার বছর বছর পদোন্নতি হতে থাকল। আমান্ডার কোলে দ্বিতীয় সন্তান এল। তারপর যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে গেল। ফোনে যোগাযোগ করাও খুব একটা সহজ ছিল না তখন। বেশ কিছুদিন পরে একদিন খবর পেলাম রবার্ট খুব অসুস্থ। গেলাম হিন্দোশিয়া। বেশ কিছুদিন যমে মানুষে টানাটানির পর রবার্ট চলে গেল। কিছুদিন রইলাম হিন্দোশিয়াতে। ধাক্কা সামলিয়ে আমান্ডা অফিস জয়েন করার পর ফিরে এলাম সুইডেনে। তারপর অনেকদিন আর যাওয়া হয়নি হিন্দোশিয়ায়। বারৌনি আসার পর তোরা সবাই যেতে চাইলি বলে আবার যাওয়া হল হিন্দোশিয়া।
0 comments: