undefined
undefined
undefined
ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৮
হঠাৎ মনি খিলখিল করে হেসে ওঠে… ‘আমি ভেবেছিলাম যে তুমি ভুলে গিয়েছ!’
মনি বের্শেনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কপালে, গালে, নাকের উপরে চুমু দিতে থাকে। ভেজা ভেজা শিশুর ঠোঁটে লেগে থাকা দুধের গন্ধ আর প্রাতরাশের ছোট ছোট গোল রুটির গন্ধ পায় বের্শেন।
বের্নহার্ডের বয়স মোটে সতের এবং এই প্রথমবার সে প্যারিসে এসেছে। সে সাধারণত একটা বাদামি রঙের স্যুট আর সাদা শার্ট পরে। যে মহিলার বাড়িতে প্রথমে সে থাকতো, তিনি বলেছিলেন যে সে যেন রঙিন শার্ট পরে, নাহলে তাকে প্রতিদিন জামা বদলাতে হবে, আর সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। বের্শেন লজ্জিত হয়ে লক্ষ্য করল যে তার শার্টের আস্তিন এর মধ্যেই বেশ ময়লা হয়ে গেছে। তার পর থেকে অবশ্য সে তার নীল স্পোর্টস শার্টটাই পরা শুরু করেছিল। এমনিতে মহিলা ভালই। তাঁর যা বয়স, তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানাদি থাকবার কথা। কিন্তু সেরকম কেউ আছে বলে মনে হয়নি। ফলে বের্শেন ধরে নিয়েছিল যে তার প্রতি ওই মহিলার অপত্যস্নেহ বর্ষিত হবে।
সে তার নিজের দুটি লাগেজ থেকে জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখতে লাগল। তার চিরকালের গোছানো স্বভাব। বিছানার পাশে সে রাখল মনির ছবি। বাবা মায়ের ছবি বিছানা থেকে একটু দূরে রাখা দেরাজের উপরে। তার পাশে চুলের ব্রাশ, স্বরলিপির খাতা আর ক্যামেরা। ডেস্কের উপর রাখা হল আরেকটা ছবি, গের্ট আর ইনেস ঝুঁকে বসে ফ্লককে আদর করছে। এই ছবিটা রূপোলি ফ্রেমে বাঁধিয়েছে বের্শেন। এই ঘরে ডেস্ক না থেকে যদি একটা পিয়ানো থাকত, তাহলে খুব ভাল হত। তবে বাড়িওয়ালি জানিয়েছেন যে সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই বামদিকে বাদ্যযন্ত্রের একটা বেশ বড় বিপণি আছে। বের্শেন দরকার হলে সেখানে গিয়েও অভ্যেস করতে পারে। এই খবরটা পেয়ে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়। তার তখনি সেখানে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তার এখন বেশ খিদে পেয়েছে। বেলা প্রায় দু’টো বাজে। আজ সকালে তার প্রাতরাশ করাও হয়নি।
খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে প্যারিসের মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। এখানে আসবার আগে এই মানচিত্রটা তার মা সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। সে এখন যেখানে বসে আছে, জায়গাটা ওডিয়নের কাছে। লুক্সেমবুর্গ প্যালেস আর বাগানও খুব কাছে। ইচ্ছে হলেই সে ওই বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারবে। মোঁপার্নাস্সে অবধিও সহজেই চলে যেতে পারবে সে। তবে রিভ দ্রোয়াত এখান থেকে অনেকটা দূরে। তার শিক্ষক যেখানে থাকেন, সেই জায়গাটা, অর্থাৎ পাস্সি, সেটাও অনেকটা দূরে। সেখানে পৌঁছাতে তার ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে। অনেকটা দূর যেতে এখন একটুও ভাল লাগছে না তার। ভারি স্বরলিপির ফোল্ডারটা হাতে নিয়ে বাসে কিম্বা মেট্রোতে এতখানি সে কী ভাবে যাবে, সেটা চিন্তা করতে লাগল। তাছাড়া হেঁটে হেঁটে এতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। নিজের ফ্যাকাসে হাতের দিকে চেয়ে রইল সে। ফোল্ডার বয়ে বয়ে হাতে ব্যথা হয়ে, হাত শক্ত হয়ে ফুলে যাবে, ভাবতে লাগল সে। বাজনা বাজাবার জন্য হাত ঠিকঠাক রাখা খুব জরুরি।
অবশেষে পাস্সিতে বের্নহার্ড তার শিক্ষকের বাড়িতে ঠিকঠাকভাবেই পৌঁছেছিল। তবে সেখানে যাবার পরে সব কিছুই অন্যরকম মনে হয়েছিল তার। জায়গাটা তার ভাবনা, তার কল্পনার চেয়েও সুন্দর। বন্ধুত্বপূর্ণ চেহারার এক কিশোরী তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। গানের ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। পুরু কার্পেটে পা ডুবে যাচ্ছিল তার। দেওয়ালে অনেক ছবি ঝুলছে, যেগুলোর কোণে স্বাক্ষর করা। ঘরের বিশাল জানালা দিয়ে বিকেলের রোদ্দুর ঢুকে ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে। ঘরের মধ্যে বিশাল একটা পিয়ানো অদ্ভুত আধিপত্য বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বরলিপির কাগজে ঢেকে গিয়েছে বাদ্যযন্ত্রটার দেহ।
বের্নহার্ড দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পিয়ানোটার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। বাম হাতটা সে পিয়ানোর চাবিগুলোর উপরে রাখলো এবং লক্ষ্য করল যে তার হাত একটু একটু কাঁপছে। সবে দু’ দিন হল সে বাড়ির বাইরে। একটা গোটা দিন অবশ্য কেটেছে যাত্রাপথে। একটা অজানা একাকিত্ব তাকে ঘিরে ধরেছে। নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বিপন্ন মনে হয়েছে। পথে অজস্র মানুষ হেঁটে চলেছে স্রোতের মত। কাউকে সে চেনে না। তাদের কারো সঙ্গে তার কোনও দরকার নেই। এক অন্ধ মানুষের মত ঘুরে বেড়িয়েছে পথে পথে। একটা দোকানের জানালা থেকে আরেকটা দোকানের জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে, যদিও তার বিশেষ কিছু কেনাকাটি করবার প্রয়োজন ছিল না। লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে; পা ব্যথা করছিল । নতুন নতুন রাস্তা যেন খুলে গিয়েছে তার সামনে। সে ইচ্ছেমত যে কোনও একটা ধরে চলতে পারে। ঠাকুমার বাড়িতে থাকাকালীন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাকে ফিরতে হত। খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বাঁধাধরা রুটিন ছিল। এখানে সেরকম কোনো ব্যাপার নেই। কেউ অপেক্ষা করে বসে থাকবে না তার জন্য। দিনের সময়টা অন্তহীন মনে হচ্ছে। রাতও সেরকম। শুরু নেই। শেষ নেই কোনোখানে। রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল তার। মাঝে একবার উঠে জল খেল সে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আবার। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছিল সে। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, সে জানালার শাটারের ফাঁক দিয়ে হালকা আলোর রেখা দেখতে পেল। তার মনে হল যে ভোর হয়েছে।
বাড়িতে থাকাকালীন এমন আলো দেখে সে ভোরের কথাই ভাবতো। ঊষার প্রথম কিরণ, কুয়াশাজড়ানো ভোর। কিন্তু এখানে প্রায় নটা বেজে গিয়েছে। বের্নহার্ড লাফ দিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। তবে উঠেই মনে পড়ল যে তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই। সে বেল বাজিয়ে প্রাতরাশ চাইল। তাকে একটা ট্রেতে সাজিয়ে দুধ ছাড়া এক কাপ কালো কফি আর একটা লম্বাটে রুটি দেওয়া হল। খেয়ে পেট ভরল না তার। একপাশে সরিয়ে রাখল সে ট্রেটা। তারপর আবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ধূসর সিলিংএর দিকে তাকিয়ে রইল সে। এই মুহূর্তে ধূসর রংটা দেখে তার এত অসহ্য লাগছে যে কহতব্য নয়। অতীতে এরকম বিশ্রী দেখতে কখনই মনে হয়নি তার এই রঙটাকে; কেমন যেন নোংরা আর বিষণ্ণ। তার মন হতাশায় আর বিরাগে ছেয়ে গেল। যে দিনটা শুরু হবে, সেই দিনটার প্রতি এবং নিজের প্রতি অবিশ্বাসে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।
সারা সকাল জুড়ে ওই সিলিং-এর ধূসরতা তাকে তাড়না করতে লাগল; তার মনে হল শহরটার আকাশ, বাড়িঘরদোর, পথঘাট সব… সবকিছুই যেন ধূসরতায় ডুবে গিয়েছে। পাস্সি যাবার পথে যে সাবওয়েতে সে ঢুকেছিল, সেখানেও তার মনে হয়েছিল যে তার চোখে যেন একটা ধূসর পর্দা পড়ে গিয়েছে। নিজেকে কেমন যেন অনুভূতিহীন, ভোঁতা, ব্যথাতুর, অকর্মণ্য বলে মনে হচ্ছিল তার।
ধূসর বিষাদ পেরিয়ে এখন এই পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে বের্শেন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। এই মুহূর্তে এই বিরাট শহরে সে একাকী নয়। এখনই এক পরিচিত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠ তাকে সম্বোধন করবে; সে এমন একজনকে দেখবে যিনি গের্টকে চেনেন (কারণ বহুবার সঙ্গীতের ক্লাস শেষ হলে গের্ট তাকে গাড়িতে করে আনতে যেত); হঠাৎ গের্টের কথা ভেবে অপ্রত্যাশিতভাবে বের্শেনের বাড়ির জন্য মন খারাপ হল। মনে হল যে সে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, এখনই তার চোখে জল আসবে।
তার শিক্ষক পাশের ঘর থেকে এসে তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। বের্শেন উত্তেজনায় কাঁপছিল। … ‘ভয়লা দোঙ্ক লে পেতিত কোরাজোঁ’*- উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন শিক্ষক। হৃদ্যতাপূর্ণ প্রবল স্বরে বের্শেনকে জানালার আলোর কাছে নিয়ে এলেন তিনি, ‘তারপর, কেমন আছেন আপনি? পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো? কোথায় উঠেছেন? জায়গাটা ভাল তো? আপনি কঠিন পরিশ্রম করবার জন্য তৈরি তো?’
বের্শেন একটু ঘাবড়ে যায় এত প্রশ্নের সামনে। কারণ, ফরাসি ভাষায় তার খুব বেশি দখল নেই। সে অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে যায় নিজের অস্বস্তি গোপন করার জন্য।
-‘আমি কিছু কিছু অভ্যাস করেছি।’ … বলে সে শিক্ষকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই পিয়ানোর সামনে বসে পড়ে; বসে তার নিজেরই একটু বিব্রত বোধ হয়। অস্বস্তি কাটানোর জন্য সে জোরে জোরে হাতের আঙুল ঘষতে থাকে।
শিক্ষক অনুমতি দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়েন… ‘চলুন, বাজাতে শুরু করুন। অসুবিধে নেই। আমি আমার এক বন্ধুকে খবর দেব, যিনি আপনার বাজানো শুনে খুব খুশি হবেন।’
বের্শেন গত বেশ কয়েক মাস বাখের কম্পোজিশন বাজায়নি। তবুও সে চুপচাপ বাজানো শুরু করল। বাজাতে বাজাতে সে চারপাশের দুনিয়া ভুলে এক ধ্যানের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। সুরের প্রদীপ্তির আবেশ তাকে ঘিরে রেখেছিল। বাজাতে বাজাতে এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে সে একজন অচেনা মানুষকে দেখতে পেল। সেই মানুষটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পিয়ানোর ঢাকনার উপরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। বের্নহার্ডের একটু অদ্ভুত লাগে তাঁর দিকে তাকিয়ে; মুখমণ্ডলে মধ্যে গভীর এক বিষাদ ছেয়ে আছে; তাঁর মুখখানা ভারি ফ্যাকাসে। ঘরের আলোটা ততখানি উজ্জ্বল নয় বলেই তাঁর মুখখানা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কি না, সেটা সে বুঝতে পারে না। সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে মন কেন্দ্রীভূত করে পিয়ানোর চাবির উপরে। সুরের মায়ায়, ঐন্দ্রজালিক স্বপ্নের মাঝে ডুবে যেতে যেতে নেশাগ্রস্তের মত বাজাতে থাকে সে।
(চলবে)
* Voilà donc le petit courageux- ফরাসি ভাষার এই বাক্যবন্ধের অর্থ… ‘তাই তো এই ছোট্ট সাহসী মানুষটি এসেছে।’
0 comments: