0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in










হৃদিবরেষু সুস্মি,

গত পরশু এসেছি কিন্তু পাহাড় থেকে ফিরতে মন চায় না, ব্যস্ততম শহরের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে আর তখন বারবার মনে পড়ে মেঘ-পাহাড়ের মিতালি। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনা। পাহাড়গুলো যেন এক জায়গায় এসে হেলে পড়েছে আকাশে। চারদিকে শুধু সবুজ। সকালে ঘুম ভাঙলেই পাখির ডাক। পাহাড়ের গায়ে কান পাতলে শোনা যায় চার্চের ঘণ্টার ধ্বনি। পাইন ও কফি গাছের সমারোহে আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে নদী ও জলপ্রপাতে।

কেমন হয় একজন পুরুষের নারীবিহীন জীবন? অনেকেই তো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেন। তারপর চাইলেই কি তাকে ভুলে থাকা সম্ভব হয়?একজন একাকী ছেলে, নিজের জীবন নিয়ে ডুবে থাকে, সে কি পারে না প্রেমে পড়তে? অথবা নারীদের আজীবন ঘৃণা করে চলা পুরুষটি যদি হুট করে কোনো নারীর প্রেমে পড়ে যায়? আমাদের গেছে যে দিন সেগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে জামাল উদ্দিন রুমির কথা খুব মনে পড়ে- যা কিছু হারিয়েছো তার জন্য দুঃখ করো না। তুমি তা আবার ফিরে পাবে, আরেকভাবে, আরেক রূপে। এইবার পাহাড়ে গিয়ে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে পরিচয় হলো, এক সন্ধ্যায় বন্ধন, মায়া নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, অতীতকে প্রাধান্য দিও না, ভবিষ্যত নিয়ে দিবাস্বপ্নও দেখবে না। তার চেয়ে বরং বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে ভাবো। আমি জানতাম না গৌতম বুদ্ধ এই কথাটি বলেছিলেন তাই আমি যখন তার ভাবনা জগৎ নিয়ে প্রশংসা করছিলাম আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জানান এই বানী বুদ্ধদেবের। পরক্ষণেই তিনি জানতে চাইলেন আমি হারুকি মুরাকামির লেখা পড়েছি কিনা? একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর মুখে ধর্মকথা বাদ দিয়ে সাহিত্যের কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম তাই হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললাম না। কিন্তু আমি জানি হারুকি মুরাকামি এই শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। যদিও জাপানি এই লেখকের বিরুদ্ধে খোদ জাপানে একটি অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে যে, তিনি জাপানি ভাষায় মার্কিনি উপন্যাস লেখেন। যেখানে জাপানি সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে ভিনদেশি পাঠকের মানসিক ও সামাজিক অবস্থার বয়ান বেশি থাকে। আধুনিক জাপান যে ধরনের সংযত, পরিশ্রমী, সুশৃংখল, কর্মনিষ্ঠ জীবনধারার জন্য বিখ্যাত মুরাকামির গল্প-উপন্যাসে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। তবে মুরাকামির কাহিনিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পণ্য নির্ভর অতি আধুনিক সমাজের দেখা মেলে। অথচ এই আধুনিক, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও হাতের নাগালে স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম উপকরণ থাকা মানুষগুলো কোথায় এসে যেন থমকে যায়। এক আশ্চর্য একাকীত্ব, কখনো একঘেয়েমি বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে গ্রাস করে প্রতিনিয়ত। তাদের হাতের নাগালে সুখে থাকার সব উপকরণ থাকলেও কোথাও না কোথাও জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে তারা। বিষন্নতা, নিঃসঙ্গতা, অপূর্ণতা বিরাজ করে তাদের মানস জগতে।

বৌদ্ধ ভিক্ষু আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে কি বুঝলেন জানিনা তবে তার ঠোঁটের কোণে যে হাসি ফুটে উঠেছিল তা দেখে আমার মনে হলো সে হাসিতে আমার জন্য বিদ্রুপ আঁকা কিংবা তিনি মনে মনে আমাকে সস্তার পাঠক ভেবে হাসিতে বলতে চাইছিলেন তোমার পাঠের পরিধি বড় কম! কিছু কিছু সময় মানুষ বোধ করি হেরেও জিতে যায়। যেমন ঠিক সেই সময়টায় আমি! তিনি চোখ বন্ধ রেখে বৌদ্ধকে স্মরণ করলেন হয়ত বা আমাকে কী কী বলবেন সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে চোখ খুলে বলতে শুরু করলেন সত্যি বলতে হারুকি মুরাকামির লেখাকে এর আগে আমি কখনো এইভাবে বৌদ্ধ দর্শনের নিরিখে পড়িনি। সত্যি বলতে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা শোনার পরে নিজেকে বড় নির্বোধ মনে হচ্ছিল কিন্তু আমার চোখ খুলে দেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল করিনি।

ছোটগল্প নাকি আজকের দিনে এক ‘মৃতপ্রায় শিল্প’ বা ‘ডায়িং আর্ট’, কারণ পরিসংখ্যান প্রমাণ দিচ্ছে যে আধুনিককালের বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা আর ছোটগল্প লিখছেন না। গত কুড়ি বছরে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভক্ষতির হিসেবেই জাপানের হারুকি মুরাকামি’র ছোটগল্প বিশিষ্ট আসন লাভ করেছে। জাপানি-ভাষায় রচিত লক্ষাধিক কপি বিক্রি হওয়া তাঁর উপন্যাসগুলো ইংরেজিসহ বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে আজ বেস্টসেলার। সেরকমই মুরাকামি’র ছোটগল্পের অনুবাদও তাঁর উপন্যাসের মতো একইরকম আদরণীয়। মুরাকামি’র ছোটগল্প-সংকলনগুলোর অধিকাংশই আগের শতকের শেষবেলায় প্রকাশিত, কিন্তু ইংরেজি-অনুবাদে বইগুলোর বিশ্বের বাজারে পদার্পণ বেশিদিন আগেকার নয়। জাপানি-ভাষার হালের সবচাইতে জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের ছোটগল্পে কী এমন বিষয়ধর্মীতা রয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের পাঠকের কাছে নিরবচ্ছিন্ন আবেদন রেখে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে? ব্যাপারটিকে আধুনিক এক-সংস্কৃতির বিশ্ব বা বিশ্বায়নের নিরিখে ভাবতে চাইছেন অনেকেই। মুরাকামি’র বিশ্বে পূর্ব আর পশ্চিমের সংস্কৃতির পাশাপাশি বয়ে চলা রয়েছে, সংঘাত এবং পরাভব রয়েছে, কিন্তু দুই সংস্কৃতির ‘এক’ হয়ে যাওয়ার কথা কোত্থাও বলা নেই।

বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘হাতিটা উধাও’ গল্পটি নিয়ে কথা শুরু করে বলেছিলেন এই গল্পটি পড়লে দেখবেন, বৃদ্ধ হাতি মাহুতসহ একদিন উধাও হয়ে যায়। যে মাহুতের সাথে হাতিটার এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ এই সম্পর্কের ঠিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তবে হাতিটা বৃদ্ধ, সে যেকোনো সময় মরে যেতে পারে। সে একটা বিশাল গরাদে বন্দি অবস্থায় থাকে, এ অবস্থায় সে কিভাবে মাহুত সমেত উধাও হয়ে যেতে পারে! এই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সবাই তার তত্ত্বাবধায়নকারী সিটি কর্পোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করতে থাকে। কিন্তু এই গল্পের কথক জানান, হাতিটা তিনি মাহুত সমেত আকার পরিবর্তন করে উধাও হয়ে যেতে দেখেছেন। অর্থাৎ হাতিটা তার আকার পরিবর্তন করে ছোট হয়ে গরাদের বাইরে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আবার একই সাথে বিষয়টি তার কাছে অতো পরিস্কারও নয়, যেন ঝাপসা এক ঝলক মাত্র। এই ঘটনা কথকের ভেতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তিনি কিছু একটা করতে চান বলে ঠিক করেন আবার পরক্ষণেই ভাবেন, ব্যাপারটা করা আর না করার মধ্যে পার্থক্যটা কি! এক ধরনের দোলাচলে ভোগা লোকটা ভাবেন, চারপাশের সবকিছুর সঠিক ভারসাম্য যেন নেই। বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে যদি চিন্তা করেন ঠিক এই পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তি তখন ধর্মহীন৷ ‘ধর্মহীন’ শব্দটির বৈদিক ও বৌদ্ধ অর্থে, বা ব্যুৎপত্তিগতভাবে ভাবলেও, সেই ব্যক্তি এমনই এক সত্তা যার কোনও ‘আধার’ বা ‘ধারক’ নেই। এই ‘মুক্ত’ সত্তাটির জন্য কোনও চেতনার রূপান্তর বা চেতনা হতে চেতনায় পৌঁছে যাওয়া, বা ‘চেতনান্তর’ ঘটবে না। অর্থাৎ বাইরের পৃথিবী আর তার অন্তর্জগতের মধ্যে কোনোরকম সাম্যতা লক্ষিত নাও হতে পারে। তাই তার দৃষ্টিতে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে, কার্য-কারণের সাধারণ হিসেবও গুলিয়ে যেতে পারে। সে যেন আজকের পৃথিবীর বহুল পরিচিত সেই মানুষ, যার সব থাকা সত্ত্বেও সে অন্তর থেকে অসুখী এবং আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা কেউ একজন। এমন মানুষের পরিচয় ইতিপূর্বে পশ্চিমের সাহিত্যে আমরা হয়ত অনেকবারই পেয়েছি। কিন্তু এই নিরিক্ষা সেসব ক্ষেত্রে একান্ত অনুপস্থিত। মুরাকামি’র নিরিক্ষা একান্তভাবেই পূর্বদেশীয়, যা পশ্চিমের অধিকাংশ আলোচকদের চোখে ‘এ সাটল টাচ অফ জেন! ইস্টার্ন ম্যানিফেসটেশন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার গ্লোবালাইজেশন!’ ভিন্ন আর কিছু নয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু গল্প ধরে ধরে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে প্রতিটি গল্পকে মিলিয়ে দিচ্ছিলেন আমার ভাবনায় তখন রামায়ণের একটা কাহিনি ভেসে ওঠে। যেখানে রামচন্দ্রের প্রেমে পড়ে সূর্পণখা নামের এক রাক্ষস, এবং রাম তার কুৎসিত রূপ দেখে তার নাক কেটে দেয় ও প্রেম প্রত্যাখ্যান করে। হারুকি মুরাকামি রামায়ণ পড়েছেন কিনা জানিনা তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় মুরাকামি জাপানের উন্নত সাহিত্য ধারণায় নিজেকে আটকে না রেখে বিচরণ করছেন বিশ্বজনীনতায়, আধুনিকতায়। তাই হয়ত ভাবনায় বা চেতনা জগতে রাম ও সূর্পণখা এসে মিলে মিশে যায় ‘একটি ছোট্ট সবুজ রাক্ষস’গল্পে, যেখানে বাগানের মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসা ক্ষুদে এক সবুজ রাক্ষস প্রেম নিবেদন করে এক নারীকে। যে নারী তার স্বামী কাজে বাড়ির বাইরে বের হয়ে যাওয়ার পর সারাদিন নিঃসঙ্গ সময় কাটান। ওই কুৎসিত দর্শন রাক্ষস নিশ্চয়ই তার কল্পনা নয়! আবার অখণ্ড অবসর কাটানোর উপাদানও হতে পারে না। তবু লেখক কেন প্রেমপ্রার্থী হিসেবে এমন এক কুৎসিত, ভয়ংকর দর্শন রাক্ষসকেই নির্মাণ করলেন! যার প্রেম তো অকৃত্রিম। কিন্তু তার কদাকার চেহারা ওই নারীর কাছে একই সাথে ভয়ঙ্কর ও বিরক্তি উদ্রেককারী। রাক্ষস দীর্ঘদিন ধরে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে টানেলের মত তৈরি করে তার ভেতর থেকে ক্রোলিং করে এসে যেভাবেই প্রেম নিবেদন করুক না কেন, নারীর তাতে সম্মতি দেয়ার কোনো কারণ নেই! সে মনে মনে রাক্ষসটাকে যতরকম ভয়ংকর ও বীভৎস নির্যাতন করা যায় তা ভাবতে থাকে। নারীর এই ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রভাব রাক্ষসটার ওপরে পড়তে থাকে। নির্যাতিত রাক্ষস ক্রমাগত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। সে যতই বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে এভাবে নির্যাতন করার কথা ভেবো না। নারী তত তাকে আরো ভয়ংকর নির্যাতনের কথা ভাবে। এবং বলে, ‘এবার দেখো খুদে রাক্ষস তুমি জানো না, মেয়ে মানুষ কি জিনিস! তোমাকে যে কি কি করার কথা আমি ভাবতে পারি তার শেষ নেই।’ আপাতদৃষ্টিতে কাহিনীটি অদ্ভুত মনে হলেও! এর গভীরে রয়েছে ব্যক্তির হতাশা, বিষন্নতা বা অবিশ্বাস।

মুরাকামির গল্প উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে সংগীত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদি থেকে পপ, জ্যাজ থেকে র‌্যাপ, বারোক সংগীত থেকে রবিশঙ্কর, মোৎজার্ট থেকে বেটোফেন, আবার মাইলস ডেভিস, জোহান স্ত্রাউস বা হালকা চালের হুলিও ইগ্লেসিয়াশ। এছাড়াও ব্রুস স্প্রিংস্টিন, জেফবেক, ডোরস সহ অসংখ্য ঘরানার দেখা মেলে। মুরাকামির লেখায় পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সব দেশের শিল্প- সংস্কৃতি বা সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুরাকামি আদতে তাঁর কাহিনীজুড়ে চেতনাতে বড়ো ইতিহাসকে নতুন করে বিশ্লেষণ করতে এগিয়ে আসছে ছোট ইতিহাসের নানান ঘটনা, আবার বড়ো ইতিহাস সরাসরি কিভাবে ছোট ইতিহাসের নির্মাণে অংশ নিচ্ছে, কিংবা একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা তার চিন্তার মধ্যে কীভাবে বিশ্বজগতকে ধারণ করে রেখে দিতে পারে, বা তাকেও বিপরীত অভিমুখে দেখতে চাইলে দেখা যাবে যে, প্রতিনিয়ত তার স্মৃতির ভেতর নিত্যনতুন অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ সব সত্তার জন্ম এবং একইসঙ্গে মৃত্যুও ঘটছে। একটি মানুষ আসলে অতি-বৃহৎ একটি মানুষ, যে কিনা একসঙ্গে মানব-ইতিহাসের অনেকটা ধারণ করে রেখেছে তার সত্তার ভেতরে। তার প্রকাশ কখনো সরাসরি সত্তার প্রকাশে, কখনো বা বহিরঙ্গে সাদৃশ্যহীন এক পৃথিবী, জীবনযাপন, কিংবা বিসদৃশতায়। কদর্য, রূপহীন, বা কুরূপ নয়। আকারহীন বা সম্পূর্ণ নিরাকারও নয়। একটি জীবন, বা একটি মানুষ যেন বিসদৃশ। ফ্রানৎস কাফকা উত্তরাধুনিক সাহিত্যকালের যত লেখককে কমবেশি প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাফকা’র চরিত্রদের মতোই অসংখ্য বিসদৃশ চরিত্রের আনাগোনা তাঁর উপন্যাস আর ছোটগল্প জুড়ে। ‘একটি জানলা’ গল্পের সেই প্রোটাগনিস্ট, কোনও এক সংস্থার তরফে যে চিঠি লিখে বিষাদগ্রস্ত বা প্রেমে আঘাতপ্রাপ্ত একলা মহিলাদের কাউনসেলিং করত, বা ‘অঘটন পথচারী’ গল্পের সেই নিঃসঙ্গ পিয়ানো টিউন-করা ভদ্রলোক, কিংবা ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পের সেই নারী, যে অবিকল কাফকা’র এক নারী-চরিত্রের মতোই চিরকালের নীরব। নিঃসঙ্গ মানুষ নয় তারা কেউই, কিন্তু প্রত্যেকে পৃথিবীর সামনে একটু যেন বিসদৃশ। মুরাকামি আমাদেরকে দেখিয়ে চলেছেন এই দৃশ্যমান এবং চোখে সয়ে যাওয়া জগতটার বাইরেও একটি জগত রয়েছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের ছোট্ট উপাংশ অচেনা এক বিশ্বের ছোঁয়া দিয়ে চলেছে। একটি ‘লেডার-হাওজেন’ বা ইয়োরোপের মহিলাদের জন্য নির্মিত একরকম লেদারে প্রস্তুত গরম মোজা, যেটি দেহের মাপে মিলে যাওয়া মাত্র এক নারী জীবনের একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করে ফেলে, অথচ এতকাল সেই সাহসটুকু তার কাছাকাছি এসেও কীভাবে যেন অধরা রয়ে যাচ্ছিল। কিংবা অত্যন্ত পছন্দের এক পুরুষকে খুঁজে পেয়ে এক নারী জানতে পারে যে সে আসলে ‘গে’, কিন্তু কিছুতেই তাকে পরিত্যাগ করার মতো জোর খুঁজে পায় না। কিংবা, ‘এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়েটিকে দেখে’ একটি ছেলে বলে ওঠে, ‘আমি যে সারা জীবন তোমাকেই খুঁজছি। তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু তুমিই আমার ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়ে।’

মুরাকামি কখনই তার ছোট গল্পের সোজাসাপ্টা সমাপ্তি করেননি। সবসময় পাঠকদের সমাপ্তি ভেবে নেবার সুযোগ করে দেন। যেন গল্পটি তার, কিন্তু পাঠক গল্পটি তার নিজের মতো করে গ্রহণ করবে। ছোট গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ঐ কথার মতই “শেষ হয়েও হইলো না শেষ।” মুরাকামির গল্পে প্রতিটি বিষয়েরই যেন অস্তিত্ব আছে। যাকে ঠিক কল্পনা বলেও ধরে নেয়া যায় না, আবার যে কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অতি বাস্তবের প্রতীক। তিনি তাঁর গল্পে বসবাসকারী চরিত্রদের সুপ্ত বাসনা বা আকাঙ্ক্ষার একটা অদ্ভুত রূপ দেন। তাই মুরাকামি’কে নিশ্চিত করে কোনও নির্দিষ্ট ঘরানা বা গোলার্ধের লেখক বলে আখ্যায়িত করে ফেলাটা অন্যায়। মানুষে জীবনের গভীরতা উঠে আসে মুরাকামির লেখায়। বিষণ্নতা যে গভীর, সে কথাই নানাভাবে বলেন তিনি। ‘ঘুম’ গল্পটাতে আমরা দেখি টানা ১৭ দিন-রাত না ঘুমানো একজন ইনসোমনিয়ার রোগী ঘুম না হওয়াকে এক সময়ে ভাবছেন, ঘুম না হলে হবে না, তবে এই নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে না ভুগে বরং এটা ভাবতে হবে যে সে তার জীবনটাকে প্রসারিত করছে। অর্থাৎ যে সময়টায় সে ঘুমাতো সেই সময়টা এখন তার একান্ত নিজস্ব একটা সময়। যে সময়টাতে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না, যদিও এভাবে টানা নিদ্রাহীনতা তাকে বাঁচাতে পারেনি, যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঘুম গল্পটার মতো তাঁর এমন অনেক গল্পে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনকে সাধারণ বা একঘেয়ে মনে হতে পারে,তবুও তার ভেতরেও থেকে যায় যন্ত্রণাময়, বিপজ্জনক বা কখনো মায়াবী এক কাহিনি। ‘কিনো’ গল্পটি, কিনো নামের এক ছেলেকে নিয়ে। যে একটি বার চালায়, শহর থেকে দূরে খুব নিরিবিলি এক এলাকায়। ফাঁকা জায়গা, নিশ্চুপ পরিবেশের ভেতরই কেমন একটা বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ে। এর চেয়েও বিশাল বিষণ্নতা কিনোর ভেতরেই বসবাস করে। যদিও এ ব্যাপারে সে উদাসীন, তার স্ত্রী এবং সংসার হারানোর কষ্ট সে অনুভব করে না। কিন্তু তার বিষণ্নতা লেখক বারবার পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন, এমনকি সে যে তার অজান্তেই একাকিত্ব থেকে মুক্তি চাইতে শুরু করে, তা-ও পাঠকের সামনে মেলে ধরেন লেখক। কী অদ্ভুত এক খেলা শুরু হয়, গল্পের মূল চরিত্রের সাথে পাঠকের যেন সরাসরি দেখা হয়ে যায়, লেখক আড়াল থেকে বিষণ্নতাগুলো ফুটিয়ে তোলেন। এর চেয়েও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, পাঠকও একাকিত্ব অনুভব করতে শুরু করে!

হারুকি মুরাকামির গল্পে যৌনতার উপস্থিতি লক্ষণীয়। যৌনতা, গল্পে একটি আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আসে। কিন্তু সেগুলো আরোপিত মনে হয় না; বরং চরিত্রগুলোর সংকট প্রকাশের একটি ভাষা হয়ে ওঠে। মুরাকামি আসলে সমস্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং সবার সামনে নশ্বর পৃথিবীর নগ্নতাকে প্রকাশ করে দেয়। আমরা মানুষকে চিনতে পারি বলি বটে, কিন্তু আদতে চিনতে পারি না। প্রেম কি কেবল একটি স্বপ্ন যা আমরা আমাদের একাকী অস্তিত্বের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার জন্য দেখি? মানুষের মানসিক এমন সব আলোচনা, যা মানুষ আসলে বলতে চায় না, কিন্তু পুষে রাখে। কেমন হয় একজন মানুষের নিঃসঙ্গ জীবন? মানুষের বিষণ্নতা কেমন করে তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যখন কেউ তার নিজের ভালবাসার নারীকে হারিয়ে ফেলে? এসবের মনস্তাত্ত্বিক দিক আর সে সময়ের বিষণ্ণতা নিয়ে মুরাকামি ‘দম দেয়া পাখি আর মঙ্গলবারের মেয়েরা’ গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হয় কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক পরিবেশে যেন কেউ পেঁজা তুলার মত হাওয়ায় ভাসছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস পরস্পর শ্রদ্ধাহীনতা তাঁর গল্পে এই প্রতিটি বিষয়েরই যেন বাস্তব অস্তিত্ব আছে। যা দেখা যায় না ঠিকই, আবার নিছক কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কখনো কখনো কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অজানা অতি বাস্তবের প্রতীক। ‘ক্যাঙ্গারু বার্তা’ গল্পটাতে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার তার কাছে পাঠানো ক্রেতার একটি অভিযোগপত্র পেয়ে হঠাৎই ওই অজানা অচেনা নারীর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এখানে প্রেম ঠিক ওভাবে নেই। একটা নির্দোষ, সাদামাটা, বা একটু ভিন্নধর্মী অভিযোগপত্র পেয়ে কেউ কারো প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করতে পারে এমন অদ্ভুত কাহিনি মুরাকামির পক্ষেই লেখা সম্ভব! যেখানে কাহিনি ছাপিয়েও এর ভেতরে রয়েছে ব্যক্তির বিষণ্নতা। বান্ধবী থাকা সত্বেও তার মানসিক নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ সবকিছু হাতের নাগালে থাকতেও এক অদ্ভুত শূন্যতায় আচ্ছন্ন তাদের জগৎ। এই শূন্যতার প্রতীকী প্রতিফলন প্রকাশ পায় প্রায় তাঁর প্রতিটি লেখায়। এই অশান্তির অর্থ কি? উপশম কিসে? সেই খোঁজ কি রয়েছে মুরাকামির সব লেখায়? ব্যক্তি তার একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে একদম একা। এক ধরনের বিমর্ষ একাকীত্ব নয়, আলাদা নানারকম একাকীত্ব আছে। যা খুবই যন্ত্রণার। স্নায়ু ছিড়ে যাওয়ার মতো। একইভাবে ‘মানুষ খেকো বেড়াল’ গল্পে আমরা দেখতে পাই, মানুষ তার সারাজীবন ধরে একজন আদর্শসঙ্গীর অপেক্ষায় থাকে। আর যে কোন সময় সেই সঙ্গীর দেখা পেতে পারে সে। হয়ত বিয়ের কয়েক বছর পরেও মিলতে পারে এমন কোন সঙ্গীর দেখা। দাম্পত্য সম্পর্ক হয়তো মসৃণভাবে চলছে, যেখানে অভিযোগ করার মত তেমন কিছু নেই। শ্রদ্ধা, ভালবাসা সব থাকার পরও হয়ত এমন কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাকে দেখলে মনে হয় এর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মেলে ধরা যায়। মুরাকামি এই ধারণাটাকে ঠিক ভালোবাসার লেবেল দিতে চাননি। এ যেন পরিপূর্ণ সহমর্মিতা। তিনি বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্কটাকে এত স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন, এতো সহজতায় যে তাদের জৈবিক সম্পর্কটা যেন ঠিক যৌনতার জন্য নয়, ভালোবাসার এক শান্ত সমহিত প্রসন্ন টান। মুরাকামি’র উপাখ্যানে বাস্তব জগতে যে ‘বিসদৃশতা’ লক্ষ্য করা যায়, পশ্চিমের আলোচকেরা সেটিকে কাফকা’র কাহিনিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো বিচিত্র সব মানব-চরিত্র বা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ততোধিক বিচিত্র ঘটনাবলির সঙ্গে তুলনা করলেও, এই বিসদৃশতা-কে একান্তভাবে পশ্চিমের উত্তরাধিকার-ভাবনা বলা চলে না। ‘খামার-দহন’ গল্পটাতে এক যুবক জানায়, দুমাস পর পর এক একটা খামার পোড়ানো তার শখ। এখানে সে কোন নৈতিকতার ধার ধারে না। নৈতিকতা তার কাছে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের ভারসাম্য। একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব। যেন একই সাথে টোকিওতেও আছে আবার টিউনেশিয়াতেও। ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পে নিজের দেশ জাপান’কে লিখতে বসে আমেরিকা, এবং আমেরিকা’র এক বিপরীত-সংস্কৃতি হিসেবে চায়না’কে নতুন করে মেলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। এক নিঃসঙ্গ চাইনিজ ভদ্রলোক, যিনি টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে তোকিয়ো শহরে বসবাসকারি চাইনিজ’দের ফোন নম্বর বের করেন, এবং তাদের বাড়ি গিয়ে ‘চাইনিজ এনসাইক্লোপেডিয়া’ বিক্রি করেন। এটিই তার পেশা। তার সঙ্গে একসময়ে যখন কাহিনির প্রোটাগনিস্টের দেখা হয়, তার মনে পড়ে যায়, ভদ্রলোক আসলে ছিলেন তার উচ্চতর ক্লাশের সহপাঠী। আজ তিনি শহরের চাইনিজ’দের বাড়িতে ঘুরে এনসাইক্লোপেডিয়া বিক্রি করেন। মুরাকামি একথাটি একবারও লেখেননি কোথাও, কিন্তু পাঠক নিজের থেকে উপলব্ধি করবেন, স্বদেশ ও সংস্কৃতির প্রতি সমর্পিতপ্রাণ যে ‘চাইনিজ’ ছেলেটি এককালে তার সহপাঠী ছিল, সে আজও একইরকম ‘চাইনিজ’ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাহিনির প্রোটাগনিস্ট অর্থাৎ জাপানি ছেলেটি কীভাবে যেন নিঃশব্দে ‘আমেরিকান’ হয়ে গিয়েছে। এক অভূতপূর্ব প্যাসিভ ন্যারেটিভ হচ্ছে সুদীর্ঘ এই উপাখ্যানের প্রাণস্পন্দন, যা চরম উপভোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছে।

হারুকি মুরাকামি সামান্য ছোটগল্পকেও বৃহৎ পরিসরে লিখে থাকেন। আর কাফকা অন দ্য শো’র পরিসরই বৃহৎ, যা মুরাকামির লেখনীতে হয়ে উঠেছে অকল্পনীয় এক সৃষ্টি। জটিলভাবে গল্প না বললেও গল্পের বিষয়বস্তু জটিল হবার কারণে এই বই বিশ্লেষণ করা অনেকের কাছেই ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার। একাকীত্ব, বিষণ্ণতা, নীরবতা, ভালোবাসা, মানুষের বাস্তবিক জীবনের গল্পের কথা মুরাকামির লেখায় বার বার ফুটে উঠেছে। এসব বিষয়কে পাশে রেখে মুরাকামি বাস্তব ও কল্পনাকে মিশিয়ে ফেলতে ভালোবাসেন। তিনি এমন এক ঘরানা নিয়ে লেখালিখি করেন যে ঘরানার লেখক বর্তমানে হাতে গোনা। মানুষের জীবনের গল্প বা একটি মানুষের বেঁচে থাকা জীবনকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন প্রত্যেকটা গল্পে তা মুগ্ধতাকেও ছাড়িয়ে যায়। হিয়ার দ্য উইন্ডো বইতে মুরাকামি একটি কথা বলেছিলেন, “যখনই আমি সমুদ্রের দিকে তাকাই, সবসময় তখন আমার কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখন আমি কারও সাথে কথা বলি, তখন আমার ইচ্ছা করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি এরকমই অদ্ভুত একজন মানুষ।” বাস্তব ও পরাবাস্তব নিয়ে প্যাঁচ লাগানো নিয়মতান্ত্রিক লেখকের জীবন কি আসলেই এমন অদ্ভুত?

নিরন্তর ভাল থেকো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আশা করি হারুকি মুরাকামির লেখায় পেয়ে যাবে কিংবা আমারও…

ভালবাসা সহ-

বাসু
১২ মার্চ,২০২৫

0 comments: