Next
Previous
Showing posts with label প্রাচীন কথা. Show all posts
0

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in

প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যা - মন্দোদরী
দোলা সেন



অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥

পঞ্চকন্যার পঞ্চমা। এই কন্যাটির জন্য সপ্তকাণ্ড রামায়ণে বেশি শব্দ ব্যয় করেননি মহাকবি বাল্মিকী। কিন্তু ব্যক্তিত্বের হীরকদ্যুতির প্রভায় তাঁর এই স্বল্প উপস্থিতিও মনের চোরাকুঠুরিটা আলোয় আলোময় করে তোলে।যত অল্প জায়গা জুড়েই থাকুন না কেন, রামায়ণ পড়লে এই নামটি মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে – আরও হাজার একটা চরিত্রকে পিছনে ফেলে।

শুরুটা অনেক আগে থেকে। এক মেয়ে কৈলাসে এসেছিল শিবের পুজো করতে। তার সৌন্দর্যে কামমোহিত হলেন আশুতোষ। সেই মেয়ে অপ্সরা মধুরা। দেবতাদের তুষ্টিসাধনই তার কাজ। আর আজকের আহ্বানকর্তা তো স্বয়ং দেবাদিদেব। আত্মনিবেদন শেষে ফিরে যাচ্ছিল মধুরা। গোল বাধলো অন্য জায়গায়। পার্বতী বাড়ি ছিলেন না। তিনি এই সময়েই ফিরলেন। রমনতৃপ্ত স্বামীর মুখ তাঁর নজর এড়াল না। পত্নীব্রত স্বামীর মতোই শিবঠাকুর দেবীকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পার্বতীর চোখে পড়ল মধুরার স্তনের উপর মহেশ্বরের ভস্মের চিহ্ন। আর যায় কোথায়! রেগে আগুন হলেন পার্বতী। শিবকে তিরস্কার করেও তাঁর রাগ শান্ত হলো না। মধুরাকে শাপ দিলেন – তুই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাক!

এখানে লক্ষণীয় বিষয় এটাই যে পার্বতী কিন্তু শিবকে অভিশাপ দেননি! নিজের কপালকেই দুষলেন বরং। অপরাধের সব দায় তো সেই সত্যযুগ থেকেই নারীর। “হীরের আংটি”রা সোজা না ব্যাঁকা সেটা ধর্তব্যের মধ্যে কোনকালেই ছিল না।

শিবঠাকুরের বোধহয় একটু খারাপ লেগেছিল। তাই তিনি দেবীকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে অভিশাপটাকে একটু হালকা করে দিলেন। মধুরা এক নোংরা কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকবে আজীবন নয়, মাত্র বারো বছর! শুধু তাই নয়, এই ‘সামান্য’ কটা দিন কেটে গেলেই সে তার সুন্দর রূপ ফিরে পাবে এবং এক মহা পরাক্রমী বীরকে স্বামী রূপে লাভ করবে।

মধুরার আর কোন আপশোষ না থাকারই কথা!

কশ্যপমুনির ছেলে মায়াসুর আর তার বউ অপ্সরা হেমার দুই ছেলে। মায়াবী ও দুন্দুভি। কিন্তু একটি মেয়ের বড় শখ তাদের। তাই দুজনে মিলে বনে গিয়ে শিবের তপস্যা করছিলেন। সেই সময় মধুরার বারো বছর পূর্ণ হলো। নির্জন বনের কুয়ো থেকে মেয়ের গলার কান্না শুনে সেখান থেকে মধুরাকে উদ্ধার করলেন এই দম্পতি। এই কন্যা শিবের দান জ্ঞানে তাকে নিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে এলেন। নাম রাখলেন মন্দোদরী।

দিন যায়। একদিন শিবের বর সত্যি করে রাক্ষসরাজ রাবণের সঙ্গে মন্দোদরীর বিয়ে হলো। যথাসময়ে তাঁদের তিনটি ছেলে হলো – মেঘনাদ, অতিকায় আর অক্ষয়কুমার। শৌর্যে বীর্যে মেঘনাদই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাবার চোখের মণি।

মন্দোদরী পতিপ্রাণা পত্নী। তিনি রাবণকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তবু স্বামীর কোন কাজ অন্যায় বলে মনে হলে, তার প্রতিবাদ করতে কখনো পিছু হটেন না। কিন্তু, সেই চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিকতার সমস্যা! বউয়ের কথা যতই যুক্তিযুক্ত হোক, রাবণ তা মোটেও শোনেন না।

অতএব মন্দোদরীর বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও রাবণ বেদবতীকে ধর্ষণ করবেন এবং অভিশপ্ত হবেন – কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাতে উপগত হলে রাবণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে। রামায়ণের কিছু সংস্করণ অনুযায়ী এই বেদবতীই পরে সীতা হয়ে জন্ম নেন এবং রাবণবংশ ধ্বংসের কারণ হন।

ইতিমধ্যে রাম সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে পিতৃসত্য পালনের জন্য চোদ্দ বছরের বনবাসে এসেছেন। পঞ্চবটী বনে থাকাকালীন রামের আদেশে শূর্পনখার নাক কান কেটে নিলেন লক্ষ্মণ। ছোটবোনের এহেন লাঞ্ছনায় স্বাভাবিকভাবেই রাবণ খুব রেগে গেলেন। রামকে উচিত শিক্ষা দিতে তিনি ছদ্মবেশে সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে এলেন। মন্দোদরী যথারীতি নিষ্ফল প্রতিবাদ করলেন। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সীতার রূপ রাবণকে উন্মত্ত করে তুলল। তিনি সীতাকে বিয়ে করতে কৃতসংকল্প হলেন। সীতার প্রত্যাখ্যান তাঁকে আরও ক্রুদ্ধ করল। কিন্তু বেদবতীর অভিশাপের দরুন তিনি অসহায়। সীতার সঙ্গে কোনরকম জোর জবরদস্তি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাগের মাথায় তিনি সীতাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। এইবার সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করলেন মান্দোদরী। মূলতঃ তাঁর জন্যই প্রাণে বেঁচে গেলেন জনকনন্দিনী। কিন্তু, মজার কথা এটাই যে মন্দোদরী সীতাকে নীচকুলের মেয়ে ভাবলেও স্বামীর প্রতি তাঁর একান্ত নিষ্ঠাকে তিনি শ্রদ্ধা করতে পেরেছিলেন। এমনকী তাঁকে দেবী অরুন্ধতীর সঙ্গে তুলনা করতেও তাঁর বাধে নি। এই চিন্তার প্রসারতা বিশেষ করে সেই যুগে আমাদের বড়ই বিস্মিত করে। ভুললে চলবে না, এ সেই যুগ, যেখানে শূদ্র হযে বেদ পড়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন সর্বশাস্ত্রনিপুণ যুগাবতার রামচন্দ্র স্বয়ং।

মন্দোদরী রাবণকে আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, এক সামান্যা নারীর জন্য রামের মতো মহাবীর এবং প্রভাবশালী রাজপুত্রের সঙ্গে শত্রুতা করা কোন কাজের কথা নয়। বিশেষতঃ তাঁর দৈবী ক্ষমতা ও তাঁর উপর দেবগণের অপার করুণার কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু রাবণের ভারি বয়েই গেছে সে কথা শুনতে!

অতএব যুদ্ধ বাধল। যুদ্ধের শুরুতেই রাবণের ভাই বিভীষণ রাক্ষসদল ত্যাগ করে রামের পক্ষে যোগ দিলেন। এর ফলে রাক্ষসপক্ষের অনেক গোপন কথা রাম আগেভাগেই জানতে পেরে যান। এই জ্ঞান তাঁর যুদ্ধজয়ে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।

একে একে রাক্ষসদের সবাই মারা যেতে লাগল। মন্দোদরী তাঁর তিন পুত্রকেই হারালেন। রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ, বিভীষণের পুত্র তারিণীসেন – সকলেই মারা গেলেন। এবার রাবণের পালা।

রাবণ অত্যন্ত নিষ্ঠাবান পূজারী। যুদ্ধযাত্রার আগে তিনি এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। একাসনে বসে সেই যজ্ঞ শেষ করতে পারলে তাঁকে আর কেউ হারাতে পারবে না। তিনি হবেন অজেয়। স্বভাবতঃই এই খবর রামের চিন্তা বাড়ালো। বিভীষণের পরামর্শে তিনি অঙ্গদকে পাঠালেন যজ্ঞ পণ্ড করতে। অঙ্গদ যজ্ঞস্থলে গিয়ে মন্দোদরীর চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। স্ত্রীর অপমানের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল রাবণের নিজের সুরক্ষার চিন্তা। তিনি আসন ছেড়ে উঠলেন অঙ্গদকে শায়েস্তা করার জন্য। অঙ্গদ তো এটুকুই চাইছিল। সে যঃ পলায়তি স জীবতি অনুসরণ করে প্রাণ রক্ষা করল। এরপরেও কিন্তু রাবণকে মারার পথ প্রশস্ত হল না। কারণ, রাবণকে মারতে হলে একটি বিশেষ তীর চাই এবং সেই একমাত্র বিশেষ তীরটি মন্দোদরীর কাছে গোপনে সুরক্ষিত থাকে। বিভীষণের কাছেই এ তথ্য জানা গেল। মন্দোদরীর সরলতার সুযোগ নিয়ে হনুমান কৌশলে তাঁর কাছ থেকে সেই বিশেষ তীরটি চুরি করে আনল। এরপর রামকর্তৃক রাবণবধ তো শুধু সময়ের অপেক্ষা।

আর মন্দোদরী? আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে তারার মতো আরেক শোকাকুলা রমণীকে পাই – যিনি রামের দ্বারা সহমরণে বাধাপ্রাপ্ত হলেন। হয়ত বা রামের প্রবোধ বাক্যে তিনি কিছু সান্ত্বনা পেয়ে থাকবেন। কিন্তু তিনি বিভীষণকে বিবাহ করতে সম্মত হলেন না। পরিবর্তে নিজেকে অন্তরীণ করে রাখলেন রাজপ্রাসাদের নিভৃত কোণে। তাঁকে বিরক্ত করার সাহস কারো হলো না! তারার থেকে এইখানে তিনি স্বতন্ত্র। তারার দুর্বলতা ছিল পুত্র অঙ্গদ। কিন্তু মন্দোদরীর সন্তানেরা সবাই যুদ্ধে বীরগতি লাভ করেছিল। তাই তাঁর কোন দায়বদ্ধতা ছিলনা।

কিন্তু, সত্যিই কি তাই? তাহলে এর কিছুদিন পরে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে আবার জনজীবনে ফিরে বিভীষণকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নিলেন কেন? চমকের এখানেই শেষ নয়, রামায়ণকার বলছেন, এ নিতান্তই এক কূটনৈতিক বিবাহ। মন্দোদরী কখনোই তাঁর স্বামী, পুত্র ও বংশনাশের অন্যতম কারিগরটিকে স্বামীর মর্যাদা দেননি! তবে রাজ্য পরিচালনার কাজে সহায়তা করেছেন।

মহাকবি মন্দোদরীর জন্য আর কালি খরচ করেননি। কিন্তু মন্দোদরীর এই সিদ্ধান্ত আমাদের মনে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিভীষণকে স্বীকারই যদি না করবেন, তাহলে এ বিবাহের কী প্রয়োজন ছিল? তাহলে কি রাক্ষস সমাজ একজন গৃহশত্রুকে তাদের অধিপতি হিসেবে মানতে রাজি হচ্ছিল না? রাজ্যকে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতেই কি মন্দোদরীর এই পদক্ষেপ? মনে হয় তাই। নয়তো সেই পুরুষপ্রধান যুগে বিভীষণ মন্দোদরীর এই অবস্থান মেনে নিতেন না নিশ্চয়। সিংহাসন বাঁচাবার জন্য তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এই শর্তে রাজি হতে। অবশ্য এসবই আমার যুক্তিনির্ভর অনুমান। প্রকৃত অধিকারী কেউ এ বিষয়ে আলোকপাত করলে কৃতজ্ঞ থাকব।

তারাও খানিকটা এইসব কারণেই সুগ্রীবের পতিত্ব স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মন্দোদরী তাঁর প্রতিবাদী অবস্থানে অনেক বেশি উজ্জ্বল। আর এখানেই তিনি বাকিদের চেয়ে এক কদম এগিয়ে। তিনি আপোষের রাস্তায় চলেননি।

মন্দোদরী রাবণকে ভালোবেসেছিলেন। তাই তাঁর অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও দিনের শেষে স্বামীর অনুগত হতে তাঁর বাধেনি। কিন্তু যখন তিনি বিভীষণকে রাজ্যের প্রয়োজনে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নেন, তখন অন্দরমহলে তার জন্য এক অনতিক্রম্য পাঁচিল খাড়া করে দিলেন। ত্রেতাযুগে তিনি যে অসীম মনোবল এবং স্বাধীন ভাবনার পরিচয় দিলেন, তা আজকের যুগেও এক উদাহরণ হয়ে রইল। নারীর এই রূপ তৎকালীন সমাজভাবনার পক্ষে নিরাপদ নয় বলেই হয়তো বাল্মিকী মন্দোদরীর এই আচরণের ব্যাখ্যায় যাননি।

*

এই পাঁচজন নারীকে শ্লোককার কন্যা বলে উল্লেখ করেছেন। এঁদের পরিচয় দিতে গিয়ে গৃ্হিনী, দুহিতা, সচিব, সখী, ললিতা এমন কি জননী শব্দটাও উচ্চারিত হয়নি। শ্লোককার কি এই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যে এই পাঁচজন শুধুই কন্যা? আপনার পরিচয়ে আপনি ভাস্বর। বাকি অভিধা তাঁর অলঙ্কার হতে পারে যদি সে চায়, কিন্তু তার পরিচয় সে নিজে।

এই নগ্ন সত্য বড়ো কঠিন। তাই কি রূপকের আড়ালে ঠেলে দিয়ে পুজোর বেদীতে বসাবার চেষ্টা? জীবজগত যে পঞ্চভূতে তৈরি সেই জল, আগুন. মাটি, বাতাস আর আকাশের সঙ্গে তুলনা টানা হল অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা আর মন্দোদরীর। জলের স্বচ্ছ্বতা, আগুনের তেজ, মাটির সহনশীলতা, বাতাসের অনিবার্যতা এবং আকাশের উদাসীন সর্বব্যাপী ভাবনার সঙ্গে এই পাঁচ নারীর তুলনা। জীবজগতের সৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মাতৃরূপে সংস্থিতার পূজার্চনা। এর একটা কারণ বোধহয়, রমণীর এই রূপেই পুরুষ নিজেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং অসমালোচিত মনে করে।

রূপক ছেড়ে যদি সাধারণভাবে এই পাঁচজনের জন্ম ও জীবনকথার দিকে তাকাই তাহলে আমরা কী দেখি?

প্রথম কন্যা অহল্যা অযোনিজ। তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসকন্যা। পৃথিবীর মরমানুষের মলিনতা তাঁকে স্পর্শ করে না। নগরজীবন থেকে অনেক দূরে একান্ত প্রকৃতির কোলে তপোবনের পবিত্র পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর সারল্য প্রশ্নাতীত। বিবাহসূত্রে মহামুনি গৌতমের পত্নী।

দ্বিতীয় কন্যা দ্রৌপদী। ইনিও অযোনিজ। তবে রাজা দ্রুপদের সন্তান কামনার যজ্ঞের আগুন থেকে তাঁর আবির্ভাব।মানুষী প্রার্থনা আর দেবতার আশীর্বাদের মিলিত ফসল। রাজপরিবারে বড়ো আদরে সম্মনে বড় হয়ে ওঠা। তেজস্বিনী এই নারী পঞ্চস্বামীর পত্নী।

তৃতীয় কন্যা কুন্তী। রাজবংশে সাধারণ মানবজন্ম। শৈশবেই মা-বাবাকে ছেড়ে অন্য রাজার আশ্রয়ে দাসীর সান্নিধ্যে বড়ো হয়ে ওঠা। অপারগ স্বামীকে সন্তান দান এবং পরবর্তী জীবনে তাদের সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মতো লড়াইটা তিনি জয় করতে পেরেছিলেন।

চতুর্থ কন্যা তারা। দেবতা, রাজপরিবার ছেড়ে এবার সাধারণ ঘরে নেমে এসেছেন শ্লোককার। তারার পিতা অনার্য রাজবৈদ্য। তিনি বিবাহসূত্রে রাজরানী। সামাজিক রীতিনীতি মেনেও পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে রাজ্যচালনায় সক্ষম এক নারী।

পঞ্চম কন্যা মন্দোদরী – দেবতাদের চিত্তবিনোদনে নিবেদিত এক অপ্সরা। তবুও মহেশ্বরের ইচ্ছাপূরণের দায়ে অভিশপ্ত জীবন। এরপর এক অনার্যের কন্যারূপে পালিতা। রাক্ষসরাজ রাবণের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যু পরে নিজের শর্তে জীবন কাটাতে পারা এক বিদ্রোহিনী।

এই যে ক্রমবিন্যাস – এর সবটাই কি সমাপতন? একটু কষ্টকল্পনা লাগছে না কি? কি বলতে চেয়েছেন শ্লোককার? নারীর পরিচয় জন্মে নয়, তার পাতিব্রত্যে নয়, তার পরিচয় তার কর্মে, তার বিশ্বাসের সততায়, চারিত্রিক দৃঢ়তায়? সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা এই পাঁচ নারী একই কর্মসূত্রে বাঁধা। সামাজিক বাধানিষেধ অতিক্রম করে তাঁরা পুরুষের সঙ্গে একাসনে বসেছেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সমাজ তাঁদের দিকে বারবার বাড়িয়ে দিয়েছে বেদনার বিষে নীল পেয়ালা। তাঁরা পান করেছেন, যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়েছেন, কিন্তু স্বধর্মচ্যুত হননি। সমাজ তাঁদের নাম জপ করেছে তাঁদের ভুলতে পারেনি বলেই। প্রভাতে নামজপ করেছে, কিন্তু সন্ধ্যায় নিজের মেয়েকে বলেনি – এদের মতো হও। মানতে পারেনি – হৃদয়ের স্থান, সত্যের স্থান সমাজের উপরে।

তবু তাঁরা আসেন যুগে যুগে। তাঁদের স্মরণে মহাপাপ বিনষ্ট হয়। মহাপাপ কি? আমার স্বল্পবুদ্ধিতে মনে হয়েছে ভয়ের চেয়ে বড় পাপ আর কিছু হয় না। ভয় মানুষকে যত নীচু করে তত আর কিছুতে করে না। পঞ্চকন্যার জীবনধারা বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হলেও এই একটি জায়গায় তাঁরা সবাই এক। তাঁরা নির্ভয়। যন্ত্রণা দিয়ে, অপমান আর অবিচার করেও সমাজ তাঁদের মেরুদণ্ড বাঁকাতে পারেনি। তাই তাঁরা সত্য জীবনের দিগদর্শক। তাই তাঁরা প্রণম্য।
0

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যা - তারা
দোলা সেন 


অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥

এই পঞ্চকন্যা নিয়ে আমার বিস্ময় আর ফুরায় না। এক তো সেই পুরুষশাসিত যুগে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ দেখে তাবড় তাবড় বীর ও জ্ঞানী পুরুষেরা চুপ করে বসে থাকেন। স্ত্রীকে হাতি ঘোড়া রথের মতোই বাজি রাখেন একপঞ্চমাংশের স্বামী। আবার নিজ শৌর্যের পরিচয় দিতে স্ত্রীকে উদ্ধার করার পরেও তাকে এমনই কটু অপমানজনক কথায় বিদ্ধ করেন তথাকথিত ঐশ্বরিক পুরোষোত্তম যে, রমণী ধিক্কারে, ঘৃণায় আগুনে ঝাঁপ দেন। আবার সেই যুগেই এই শ্লোক? দুই মহাকাব্যে এত অজস্র ঋষি মুনি রাজা মহারাজা থাকতে সর্বপাপ বিনাশ করতে পাঁচজন নারীকে বেছে নিতে হল শাস্ত্রকারদের? কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন আমায় তাড়া করে বেড়ায়। আবার এই নির্বাচনে এমন পাঁচজনকে খুঁজে বের করা হয়েছে যাঁরা স্বীয় চরিত্রবলে ভাস্বর। সবচেয়ে বড় চমক বোধহয় এই শেষ দুই নির্বাচনে। সেখানে শ্লোককার আর্য অনার্যের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার অঙ্গনে উপস্থিত হয়েছেন। তীব্র বর্ণবৈষম্যকে পার করে তিনি খুঁজে নিয়েছেন, কাব্যে উপেক্ষিতা দুই অনার্য নারীকে। তারা এবং মন্দোদরী।

রামায়ণ যেহেতু মহাভারতের চেয়েও ভারতবাসীর অনেক প্রাণের কাছের জিনিস, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের জনজীবন তাদের আপন আপন সংস্কৃতি, আচার, মনন অনুযায়ী কাহিনীকে তাদের আপন রসে জারিত করে নিয়েছে অনেক বেশি পরিমাণে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় তার চেহারা এতোটাই বদলে গিয়েছে যে একের সঙ্গে আরেকজনের মিল পাওয়া দুস্কর। তাই মোটামুটিভাবে আমি বাল্মীকি রামায়ণের চলিত রূপটাকেই আশ্রয় করেছি। তবে বিভিন্ন অঞ্চলের রূপবদল যে আমার লেখা বা ভাবনাকে প্রভাবিত করে নি একথা বললে নেহাতই মিছে কথা বলা হবে।

তার এবং মন্দোদরী। আজকের যুগেও যখন এই দুই মানবীর কথা পড়ি, তখন আধুনিকতার সংজ্ঞাটা আরেকবার বুঝে নিই। পুরুষের অন্তরালে বাস নয়, পাশে বসে কর্মক্ষেত্রের ভার নিয়েছেন, এই দুই নারী। বিশেষ করে তারার কথা ভাবতে গেলে আমার বারবার চিত্রাঙ্গদার কথা মনে পড়ে। যুগের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকা এই নারীকে বুঝতে গেলে সেই সামাজিক প্রেক্ষপটটির একটি রূপরেখা আমাদের জানা প্রয়োজন।

তারার জন্ম বানরবংশে। এখানে বানর বলতে অবশ্যই গাছের বানর নয়। সে সময় অনেক অনার্য সম্প্রদায় নিজেদের প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন পশুপাখীর টোটেম ব্যবহার করত। যেমন বানর, সর্প, পক্ষী ইত্যাদি। প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি থাকা এই মানুষগুলির রুচি, শিক্ষা, সামাজিক রীতি আর্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল। শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগদানের কোন বাধা ছিল না বলেই মনে হয়। অন্তত তারার ব্যক্তিত্ব এবং তার সর্বজনগ্রাহ্যতা দেখে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। গোষ্ঠিপতি পুরুষই হতো। কোন নারীর স্বামী মারা গেলে তার উপর স্বামীর ভাইয়ের অধিকার স্বীকৃত ছিল। তবে ভাই জীবিত থাকলে তার পত্নীকে অধিকার করা নিন্দনীয় এবং পাপ বলে পরিগণিত হতো। পারিবারিক আনুগত্য, ভাইয়ে ভাইয়ে সদ্ভাব কাম্য ছিল। গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণভাবে গোষ্ঠিপতি বা রাজার বশ্যতা স্বীকার করে চলত।

অহল্যা বা দ্রৌপদীর মতো দৈবী কৃপায় জন্মাননি তারা। এমন কি কুন্তীর মতো রাজার ঘরেও নয়। তিনি বানরবৈদ্য সুষেণের কন্যা। অপুর্ব রূপশালিনী এই কন্যাটি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী এবং সর্বশাস্ত্রে পারঙ্গমা। বিভিন্ন সময়ে তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় আমাদের বিস্মিত করে। কিস্কিন্ধ্যার অধিপতি বানররাজ বালী তার স্বামী। প্রবল পরাক্রমী এই পুরুষটি তাঁর স্ত্রীর বিচক্ষণতা ও বিচারবোধে মুগ্ধ। তারার পরামর্শে বানররাজ্য ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কাল হলো বালীর শক্তির গর্ব আর ভয়ঙ্কর রাগ। সেখানে আঘাত লাগলে স্ত্রীর কথায় বিন্দুমাত্রও কর্ণপাত করেন না বানররাজ।

একদিন রাতে তিনি ঘুমোচ্ছেন – রাজবাড়ির দরজায় দানব দুন্দুভির বেজায় হাঁকডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। কী ব্যাপার! না, অসীম বলশালী এই দানব শুনেছে, এই পৃথিবীতে তার সমক্ষ একজনই আছে। তার নাম বানররাজ বালী। বালীকে হারাতে পারলেই সে এই জগতের শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী বলে বিবেচিত হবে। তার এক্ষুণি লড়াই চাই।

রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে এসব শুনতে কারই বা ভালো লাগে। বালীরও লাগলো না। তারা যতই নিষেধ করুক, এখনই এই অভদ্র দানবটাকে উচিত শিক্ষা দিতে তিনি কৃতসংকল্প।

অতএব লড়াই হলো। বালী জিতলেন এবং দুন্দুভিকে মাথার ওপর তুলে বাঁই বাঁই করে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বহুদূরে। রাগ আর রাত দুয়ে মিলে দিক বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তিনিও পারলেন না। কপাল খারাপ হলে যা হয়। দুন্দুভির দেহ গিয়ে পড়ল ঋষ্যমূক পর্বতে। সেখানে তখন মার্তণ্ড মুনি তাঁর শিষ্যদর নিয়ে যজ্ঞ করছিলেন। তাঁর পুজো পণ্ড হলো। তিনি বেজায় রেগে শাপ দিলেন – এই ঋষ্যমূক পর্বতের ধারেকাছে আসলেই বালীর মৃত্যু অবধারিত।

কি আর করা যাবে! সারা পৃথিবীতে ঐ একটিমাত্র জায়গা বালীর অনধিগম্য হয়ে রইলো।

কিন্তু লড়াই করতে যে ভালোবাসে, সে নতুন প্রতিপক্ষ খুঁজে নেবেই।। এবারে বালীর লড়াই মায়াবীর সঙ্গে। মায়াবী দুন্দুভির ভাই। ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নিতে সে এসেছে বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। কিন্তু যুদ্ধে হার নিশ্চিত দেখে মায়াবী পালাতে গেল। ততক্ষণে বালীর রোখ চেপে গেছে। তিনি ভাই সুগ্রীবকে নিয়ে মায়াবীর পিছু ধাওয়া করলেন। ছুটতে ছুটতে মায়াবী এক গুহার মধ্যে আশ্রয় নিল। তখন সুগ্রীবকে গুহামুখে পাহারায় রেখে বালী ভিতরে ঢুকলেন। ভাইকে বলে গেলেন, গুহামুখ থেকে যদি সাদা রক্ত বের হয় তাহলে জানবে মায়াবী মেরেছে। তখন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আর যদি দেখ লাল রক্ত বের হচ্ছে তাহলে বুঝবে আমি নিহত হয়েছি। সেক্ষেত্রে তুমি এই গুহামুখ বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে যাবে এবং রাজা হয়ে সবার খেয়াল রাখবে।

দিন যায়। গুহার ভিতর কি হচ্ছে কেউ জানে না। বাইরে বসে বসে অধৈর্য হয়ে পড়েন সুগ্রীব। ক্ষমতার লোভও কি কাজ করে ভিতর ভিতর? যাই হোক, সুদীর্ঘ আঠাশ দিন (মতান্তরে একবছর) পরে গুহামুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে এল লাল রক্ত! সুগ্রীব তড়িঘড়ি গুহার মুখে বিশাল এক পাথর চাপা দিয়ে রাজ্যে ফিরে এলেন। তাঁর মুখে সব শোনার পর বানরকুল তাঁকেই রাজা বলে মেনে নিল। সমাজের নিয়মমতে তারা এখন তাঁর মহিষী!

এদিকে হয়েছে কি, প্রথমটায় গুরুতর আহত হলেও বালী আসলে মরেননি! আরও অনেকদিন তিনি মায়াবীর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করলেন। লড়াই করতে করতে তাঁর একদমই সময়ের খেয়াল নেই। তিনি জানেনই না এর মধ্যে কতোদিন পেরিয়ে গেছে। এইবার তাঁর ফেরার পালা। কিন্তু বেরোতে গিয়ে তিনি ভীষণ অবাক! গুহামুখ বন্ধ কেন? ভাই সুগ্রীবের তো এখানেই অপেক্ষা করার কথা! অতিকষ্টে তিনি পাথর সরিয়ে বাইরে এলেন। তারপর একটু সুস্থ হলে রওনা দিলেন কিস্কিন্ধ্যার উদ্দেশ্যে।

রাজসভায় ঢুকে তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! সুগ্রীব রাজসিংহাসনে! পাশে আবার তারা! বালী রাগে অন্ধ হয়ে গেলেন। সুগ্রীব কতো বোঝালেন, মাপ চাইলেন, রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চাইলেন – কিন্তু বালীর কানে তার কিছুই ঢুকলো না। অন্যরাও চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন ফল হলো না। তখন উপায়ান্তর না দেখে প্রাণ বাঁচাতে সুগ্রীব রাজ্য ছেড়ে ঋষ্যমূক পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। পৃথিবীর এই একটিমাত্র স্থান বালীর হাত থেকে সুরক্ষিত।

বালী আবার রাজা হলেন। সুগ্রীবকে শাস্তি দিতে তিনি সুগ্রীবের বৌ রুমাকে অধিকার করলেন। তারা বারবার মানা করলেন, বোঝাতে চেষ্টা করলেন – এ অন্যায়, এ পাপ। জীবিত ভাইয়ের স্ত্রীতে উপগত হওয়া সামাজিকভাবেও অতি নিন্দনীয়। সুগ্রীব তারাকে মহিষী বানিয়েছিল বটে, কিন্তু সে তো বালীর মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে।

তা রাগ, না চণ্ডাল! রেগে গেলে কবেই বা তারার কথা শুনেছেন বালী? বারবার বিপদে পড়েও তাঁর চৈতন্য হয়নি। অতএব তিনি তাই করলেন যা তাঁর মন চায়। আর এই অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বানরসমাজের প্রমুখ – মহাবীর হনুমান, রাজবৈদ্য সুষেণ, নীলের মতো বিশিষ্ট শক্তিশালী কয়েকজন - তাদের অনুচরদের নিয়ে ঋষ্যমূক পর্বতে সুগ্রীবের কাছে চলে গেলেন।আত্মগর্বী বালী দৃকপাতও করলেন না।

দিন যায়। এর মধ্যে অযোধ্যা থেকে নির্বাসিত হয়েছেন পরমপুরুষ রাম। তাঁর চোদ্দ বছর বনবাসের সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তাঁর পত্নী সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেছেন রাক্ষসরাজ রাবণ। কিন্তু কোথায় যে তিনি সীতাকে লুকিয়ে রেখেছেন কেউ জানে না। সেই খোঁজে ছোটভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে তিনি এসে পৌঁছেছেন ঋষ্যমূক পর্বতে। সুগ্রীব দেখলেন এই সুযোগ। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, রাজ্য ফিরে পেলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে সীতাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করবেন। রামেরও তখন লোকবলের একান্ত প্রয়োজন। কাজেই চুক্তি হতে দেরি হলো না।

রামের ভরসায় সুগ্রীব ঋষ্যমূক পর্বতের আশ্রয় ছেড়ে বাইরে এসে বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। তারা রামের ঋষ্যমূক পর্বতে আসর খবর রাখতেন। দুয়ে দুয়ে চার করতে তাঁর মতো বুদ্ধিমতীর ভুল হল না। বারবার তিনি বালীকে বারণ করলেন। বললেন, সুগ্রীবের মতো ভীতু মানুষ যখন এই দুঃসাহস করছে তখন তার পিছনে নিশ্চয় রামের মদত আছে। রাম নিশ্চয় কোন না কোনভাবে এই যুদ্ধে বালীকে মারার চেষ্টা করবেন। অতএব বালীর উচিত এই আহ্বানে সাড়া না দেওয়া।

বালী শেষবারের মতো তারার অবাধ্য হলেন। তিনি সুগ্রীবের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে যোগ দিলেন। চুক্তি অনুযায়ী রামচন্দ্র আড়াল থেকে তীর মেরে বালীকে ধরাশায়ী করলেন। অমিত শক্তিধর বালী কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ বেঁচে ছিলেন এর পরেও। তিনি প্রথমে রামকে একহাত নিলেন কাপুরুষের মতো পিছন থেকে আঘাত করায়। তারপর বললেন – সীতার খোঁজ নেবার জন্য এই চাতুরির কোন দরকার ছিল না। আমাকে বললে আমিই রাবণকে মেরে তোমার সীতা উদ্ধার করে দিতাম। বালী কাউকে ফেরায় না।

ইতিমধ্যে রাজবাড়িতে খবর পৌঁছেচে। শোকে আকুল হয়ে তারা ছুটে আসছেন রণক্ষত্রে। পথের মাঝে তাকে আটকাল বালীর অনুগত বানরের দল। তারা তারাকে নিয়ে রাজধানী সুরক্ষিত করতে আগ্রহী। দাদার হত্যাকারীর হাত থেকে সিংহাসন বাঁচানোর এই একমাত্র উপায়। তারা দৃঢ়স্বরে জানালেন, বালীই যদি না থাকেন, তাহলে তারার কাছে রাজ্যের কোন মূল্য নেই। তিনি বালীর কাছেই যেতে চান। শত অঙ্গদও( তারা ও বালীর পুত্র) বালীর কাছে তুচ্ছ।

এরপর তিনি পৌঁছালেন বালীর কাছে। তাঁর দুঃখের কান্নায় পাথরের চোখেও জল আসে। সুগ্রীব তো সামান্য বানর। তার অনুতাপের অবধি রইলো না। তারা রামকে বললেন – আর দেরি কেন হে পুরুষোত্তম। যে তীরে আমার স্বামীকে হত্যা করেছেন, সেই তীরে আমাকেও বিদ্ধ করুন। আমি ছাড়া বালী স্বর্গেও ভালো থাকতে পারবে না। আমি শুধু তার সঙ্গেই থাকতে চাই।

তারার কান্নায় রামচন্দ্রও বিচলিত হয়ে পড়লেন। হনুমান তারাকে অনেক প্রবোধ দিলেন। অঙ্গ আর রাজ্যের কথা ভাবতে বললেন বারবার। এমন সময় বালী কথা বললেন –

- ভাই সুগ্রীব, যদি আমরা ভাই ভাইয়ে লড়াই না করে মিলেমিশে থাকতাম, তাহলে আমরা অজেয় থাকতাম। সময়ে তা করা হল না। এখন তুমি রাজ্য ও তারাকে ভোগ করো। তারা অত্যন্ত দূরদর্শী। সবসময় তার কথা শুনে রাজ্য চালনা করো। রাজ্যের এবং তোমার মঙ্গল হবে। অঙ্গদ আমার খুব আদরের। তার যত্ন নিও।

আর অঙ্গদ, তুমি কাকার কথা মান্য করে চলো। তার অনুগত থেকো। তার প্রিয়সাধন করো।

এইসব বলে বালি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আর তারা? মৃত্যুকালে বালী রাম, অঙ্গদ এমনকি সুগ্রীবের সঙ্গেও কথা বললেন, কিন্তু তারার জন্য তাঁর মুখ থেকে একটি বাক্যও বের হলো না! অথচ তারাকে কিভাবে ব্যবহার করলে সুগ্রীব উপকৃত হবেন, তার টিপস দিতে ভুললেন না। তারা কি ভেবেছিলেন, তাঁর মনে কিসের আলোড়ন উঠেছিল, সে বিষয়ে মহাকবি একান্তই নীরব।

গুণীজন, অপরাধ নেবেন না, যদি এইখানে একটি মেয়ের মন দিয়ে আমি তারাকে বুঝতে চাই। তারা দেখলেন তিনি একা। যে স্বামীর জন্য তাঁর কাছে নিজের এমনকি একমাত্র ছেলের জীবনও তুচ্ছ মনে হয়েছিল, তিনি রাজ্যের সঙ্গে স্ত্রীকেও সঁপে দিলেন ভাইয়ের হাতে। নাকি বালীর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল? কিছু কি বার্তা তিনি দিলেন তারাকে? চিরকালের প্রেমিক স্বামী হঠাৎ করে মৃত্যুমুখে এভাবে মুখ ফেরান যদি, তাহলে তার অবশ্যই কোন গূঢ় কারণ আছে। হঠাৎ করে পুরো দৃশ্যের আর একটি অর্থ তাঁর সামনে প্রতিভাত হল।

বালীর সাহায্যে সীতা উদ্ধার করলে রামের কোন কৃতিত্ব থাকে না। কারণ বালী একাই পুরোটা সামলে নেবেন। সে জায়গায় এই মেরুদণ্ডহীন সুগ্রীবকে রাজা করলে তিনি বাস্তবে সম্পূর্ণ বানর বংশকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছেন। এখানে উদ্ধারের সব কৃতিত্ব রামচন্দ্রের। অঙ্গদ ও বানররাজ্যের গভীর সংকট এখন। তাই নিজেকেই নিজে শান্ত করলেন তারা। রামচন্দ্রের বন্দনা করে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করলেন। রামও নিজের কৃত অন্যায় শোধনের একটা রাস্তা পেয়ে গেলেন। তিনি সুগ্রীবের রাজ্যভিষেকের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গদের যৌবরাজ্যে অভিষেকও করালেন। তারা বুঝলেন বানরজাতি ও ছেলেকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর পথ নেই। তাই তিনি সুগ্রীবের মহিষীর পরিচিতিটা মেনে নিলেন।

এখানে তারার যে স্থিতপ্রজ্ঞার পরিচয় আমরা পাই, তা সত্যিই অবাক করার মতো। এরপর আমরা দেখবো তাঁর ক্ষুরধার কূটনৈতিক চালে কিভাবে বশীভূত হন লক্ষ্মণ।

সুগ্রীব রাজা হয়ে যথারীতি আমোদে গা ভাসালেন। রুমা, তারার মতো সুন্দরী যাঁর গৃহে, সে তো শ্রেষ্ঠ রম্য নিকেতন। বনবাসী রামের কথা, সীতা উদ্ধারের কথা তাঁর মনেই রইলো না। তারা অবশ্য বারে বারে মনে করিয়ে দেন পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা, না মানলে কী কী বিপদ হতে পারে সে কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল দুই ভাইয়ের অবাধ্য হবার ব্যাপারে অন্তত বেশ মিল রয়েছে।

কিছুদিন বাদে সীতা উদ্ধারের কোন তোড়জোড় না দেখে রেগে গিয়ে রাম লক্ষ্মণকে পাঠালেন বিষয়টা সরোজমিনে তদন্ত করে দেখে আসতে। লক্ষ্মণ এসে দেখেন সুগ্রীব সুরায় ও নারীতে আকণ্ঠ ডুবে রয়েছেন। এমনকি নেশার ঘোরে লক্ষ্মণের সঙ্গেও যে ব্যবহার করলেন, সেটা ভোটে জেতার পরে নেতারা জনতার সঙ্গে যেমনটি করে থাকেন। লক্ষ্মণ স্বভাবতই খুব রেগে গেলেন। তারা দেখলেন সমূহ বিপদ। রাম আর্যবংশের মহান প্রতিভূ। তাঁকে চটালে বানররাজ্যের সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না। অতএব তিনি পরিস্থিতির হাল ধরলেন।তিনি লক্ষ্মণকে যথাবিহিত আপ্যায়ন করে বললেন –

- আপনি পরম জ্ঞানী। এই তুচ্ছ বানরের উপর রাগ করা আপনার শোভা পায় না। সুগ্রীব সামান্য বানর। তার উপর রাজার ভাই হয়েও দীর্ঘদিন বনে জঙ্গলে বহু দুঃখ কষ্টে দিন কাটিয়েছে। সে তো আপনি জানেন। তাই হঠাৎ এই বিলাস ব্যাসন পেয়ে একটু বিস্মরণ ঘটেছে মাত্র।

- আমি সামান্যা নারী হয়ে আপনাকে কী বোঝাবো। নারীর মোহে যুগে যুগে কতো বড় বড় মুনিঋষির তপোভঙ্গ হয়েছে সে আমার চেয়ে আপনি অনেক বেশি জানেন। আর এ তো বনের বানর। তার সেই শিক্ষাই বা কোথায়?

এইসব বলে টলে তারা যখন দেখলেন লক্ষ্মণ একটু নরম হয়েছেন, তখন তিনি তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রটি বের করলেন। মধুরভাষে জানালেন, একা হাতে সীতা উদ্ধার করা সম্ভব হলে, রামের মতন বীর কখনো সুগ্রীবের মতো সামান্য বানরের সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ হতেন না। সুগ্রীবের যেমন রামকে প্রয়োজন, রামেরও সুগ্রীব ও তার সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজন।

লক্ষ্মণ শান্ত হলেন। ইত্যবসরে সুগ্রীব এসেও ক্ষমা টমা চেয়ে পরিস্থিতি সামলে নিলেন। তারার কূটনৈতিক বুদ্ধি সুগ্রীব তথা বানর জাতিকে রক্ষা করল। এরপরে রামায়ণে আর তারার কোন উল্লেখ পাই না। তাঁর আরব্ধ কাজ করে তিনি আবার কাব্যের অন্তরালে চলে গেলেন।

সত্যিই কি গেলেন? তাহলে পঞ্চকন্যার নাম করতে গিয়ে এই ধীময়ী দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ রমণীর কথা শ্লোককারের মনে পড়ত না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে জানেন – সীতা যখন রামের কটু অপমান সহ্য করতে না পেরে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন, তখন এই অসামান্য নারীটির ভাবনা কেমন ছিল? মহাকবি সে বিষয়ে কোন ইঙ্গিত দেননি।
0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in



প্রাচীন কথা


ধ্রুব জাতক 
অনিন্দিতা মণ্ডল


পর্ব ৩

শ্রাবস্তীর জেতবন বিহার এমন সুবিশাল ও এমন সুন্দর হলো যে, সমস্ত জনপদগুলিতে তার প্রশ্বস্তি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল। এবং শ্রেষ্ঠী সুদত্ত ও জেতকুমারের মিলিত উদ্যোগ ও শ্রদ্ধায় এই বিহার যেন সকলের অতি প্রিয় হয়ে উঠল। যথাকালে তথাগত তাঁর অনুগত শ্রমন ও ভিক্ষুদের নিয়ে পদার্পণ করলেন।

সেদিন সকাল থেকেই চারিদিকে সাজ সাজ রব। একটি শ্বেত হস্তীকে রাজকীয় সজ্জায় সজ্জিত করে বিহারের মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হস্তীটি শুঁড়ে করে ক্রমাগত সুগন্ধপূর্ণ জল সিঞ্চন করে চলেছে। তার পাশে পাশে চারটি সুন্দরী রমণী জলপূর্ণ কলস লয়ে হাতিটির পাশে পাশে চলেছে। হাতি কখনও এ কলস কখনও ও কলস থেকে জল নিয়ে শুঁড় দিয়ে যেন বৃষ্টিপাত করছে। দুই পাশে সমবেত মানুষ সেই সুগন্ধি জলের পরশ পেয়ে যেন পবিত্রতা অনুভব করছে। হাতির পেছনে যুক্তকর সম্মুখে নুইয়ে আসছেন সুদত্ত। তাঁর পিছনে আসছেন তথাগত ও আরও ভিক্ষুগণ। তাঁদের ওপরে পুষ্পবৃষ্টি করছে জনতা। ধীর সুস্থির পদক্ষেপে প্রবেশ করছেন তথাগত। সম্মুখে শ্রদ্ধাবনত সুদত্ত। তথাগত অনুভব করছেন। এক মহৎ প্রাণ। দুঃখীর দুঃখে যার প্রাণ কাঁদে। দুই হাতে অক্লেশে উপার্জিত সম্পদ দান করেন। এর আর নির্বাণের জন্য সাধনার কি প্রয়োজন? নিবৃত্তি না হলে কি এমন করে ত্যাগ সম্ভব? তথাগত প্রবেশ করলেন মুল গন্ধকুটীতে। চারিদিকে চেয়ে দেখলেন এক অদ্ভুত নির্জনতা। সংখ্যায় প্রচুর ভিক্ষুকে স্থান দেওয়া সত্ত্বেও নির্জনতা বজায় থাকবে। ধ্যান ধারণার উপযোগী স্থান বটে। তিনি কিছুক্ষণ একা থাকবেন এবার। উপস্থিত সকলেই তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন। শ্রান্তি অপনোদন প্রয়োজন। এমন সময়ে অনাথপিণ্ডদ এলেন। করজোড়ে নিবেদন করলেন, তাঁর কিছু বন্ধু তথাগতর শ্রীচরণ দর্শনপ্রত্যাশী।

অনাথপিণ্ডদের এই সব বন্ধুরা বহুকাল ধরে অজস্র তীর্থিকের সঙ্গ করেন। আজও যেন একটা নতুন কিছুর আমোদ পেতে এখানে এসেছেন। পাঁচশ বন্ধুর দল এলেন বুদ্ধের সম্মুখে। বুদ্ধ স্থির চোখে দেখলেন এঁদের। উপদেশ বিতরণ বৃথা। এঁরা সদাচঞ্চল। আবারও কোনও অন্য সাধুর কাছে যাবেন। ধর্ম এঁদের কাছে মহত্তর জীবন সন্ধান নয়। ধর্ম এঁদের কাছে অবসরের আমোদ। তবু তাঁর সেই মধুর কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। তিনি এক এক করে বলে চললেন, তাঁর প্রচারিত ধর্মের মহত্ত্ব কি। কেন এখন জনপদে প্রচারিত সমস্ত ধর্মের মধ্যে তাঁর ধর্ম শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধত্বের ওপরে আর কিছু নেই। থাকতে পারেনা। পরিনির্বাণ হলো ধর্মের শ্রেষ্ঠ পরিণতি।

অনাথপিণ্ডদ শুনছিলেন। আপ্লুত হচ্ছিলেন। এমন ভাগ্য যে তাঁর হতে পারে, এ কল্পনাতীত। তিনি লক্ষ্য করলেননা, তাঁর সখাদের সকলেই ঠিক এতটা শ্রদ্ধাশীল নন। তথাগত শুধু অনুভব করলেন।

এই জেতবন বিহারে তিনি অনুভব করলেন পরম শান্তি। আর তাই তাঁর জীবনের বেশির ভাগ বর্ষাবাস ঘটেছিল এই বিহারে। 

সূত্রঃ অপণ্ণক জাতক
0

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যার তৃতীয়া – কুন্তী 
দোলা সেন


দ্বিতীয় ভাগ

হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে একশোপাঁচটি বালক। নিজেদের খেলা, দুষ্টুমির সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্র এবং শস্ত্রবিদ্যায় পারঙ্গম হয়ে উঠতে থাকে তারা। আর কুন্তীর আশা সত্যি করে মেধা ও স্বভাবগুণে পঞ্চপাণ্ডব কুরুকুলের সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। গুরু দ্রোণ তো অর্জুনকে চোখে হারান। পৃথিবীর সেরা ধনুর্ধর হিসেবে তাকে তৈরি করার শপথ তাঁর। এভাবেই একসময় শিক্ষাকাল শেষ হয়। আজ তাদের অধীত শিক্ষা প্রদর্শনের দিন।

প্রত্যেকে একে একে তাঁর নৈপুণ্য দেখাল। প্রত্যাশামতোই সেরা প্রদর্শন অর্জুনের। তৃপ্ত দ্রোণ প্রিয় শিষ্যকে সেরা ধনুর্ধরের শিরোপা দিতে যাবেন, এমন সময় বাধা এল এক জ্যোতির্ময় কিশোরের কাছ থেকে। সে এতক্ষণ বসে বসে দেখছিল অর্জুনের নৈপুণ্য। তার নাম কর্ণ। এবার সে উঠে দাঁড়াল। একে একে অর্জুনের করে যাওয়া সকল কৌশলের পুনরাবৃত্তি করে সদর্পে ঘুরে দাঁড়াল দ্রোণের দিকে। এবার কাকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেবেন গুরু দ্রোণ?

সবচেয়ে বড় চমকটা পেলেন কুন্তী! একে তো তীরন্দাজ অর্জুনকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে এই ভাবনাটাই তাঁকে অবাক করেছিল প্রথমটায়। তারপর স্পর্ধিত যুবককে ভালো করে দেখে মাথা ঘুরে গেল তাঁর। এ কাকে দেখলেন তিনি? ওই দিব্য কবচ-কুণ্ডল যে বড় চেনা তাঁর। ভালো করে দেখলে সেদিনের সেই সদ্যোজাত কচি মুখখানির আভাসও কি নেই এই তরুণ দৃপ্ত মুখে? পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল তাঁর। এই তাঁর প্রথম পুত্র? তাঁর কলঙ্কের সাক্ষী অথচ প্রথম স্নেহের ভাগীদার আজ তাঁর স্বীকৃত পুত্রের প্রতিপক্ষ!কিন্তু কী বলছে সেই ছেলে? সে সূতপুত্র? অধিরথ সারথির সন্তান? সে রাধেয়?

মায়ের এই যন্ত্রণা, দোলাচলের মধ্যেই দ্রুতলয়ে ঘটে গেল পরপর কয়েকটি ঘটনা। ইতিমধ্যে কর্ণ অর্জুনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছে এবং সেই আহ্বানের পথ সুগম করতে দুর্যোধন কর্ণের অঙ্গরাজ্যে অভিষেক করিয়েছে। অসহায় কুন্তী বসে বসে দেখলেন জ্যেষ্ঠ পুত্রের সম্মান ও আদর এবং একই সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করলেন তাঁর দুই মহারথী পুত্রের মধ্যে একটি অপার বিরোধের প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেল। আর কতো নিতে পারেন পৃথা – তিনি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। আর তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরায় তখনকার মতো গণ্ডোগোল থেমে গেল।

পরে সুস্থ হয়ে মাথা ঠাণ্ডা হলে কুন্তী ভাবে দেখলেন, যা হয়েছে তা এখন তাঁর আয়ত্ত্বের বাইরে। একটি স্বীকৃতি তাঁকে হয়ত তাঁর প্রথম নাড়িছেঁড়া ধনকে ফিরিয়ে দেবে; কিন্তু এতে রাজমাতা এবং রাজবধু কুন্তী শুধু নিজেই কলঙ্কভাগী হবেন না একই সঙ্গে আনিশ্চিত করে তুলবেন বাকি সন্তানদের জীবনও। অতএব তিনি মনে মনে কর্ণকে আরও একবার বিসর্জন দিলেন। আঁকড়ে ধরলেন তাঁর পাঁচ পুত্রের ভবিষ্যৎ আর নিজের সুনামকে।

এর জন্যই কুন্তী আমাদের কাছে এক অমীমাংসিত প্রহেলিকা হযে থেকে যান। তিনি এমন একজন মা – যিনি নিজের এবং সপত্নীপুত্রদের মধ্যে কোনদিন কোন বিভাজন করেন নি। বরং মাদ্রীপুত্র সহদেব তাঁর সবচেয়ে আদরের ছিল। তবু সেই স্নেহময়ী জননী তাঁর প্রথম পুত্রকে দ্বিতীয়বারও বিসর্জন দিলেন কী উদাসীন নৈর্ব্যক্তিকতায়! অথচ পিতা দায়িত্ব নিলে কানীন পুত্র তখন সমাজে স্বীকৃত ছিল। স্বয়ং মহর্ষি বেদব্যাস তার প্রমাণ। অথচ কর্ণকে তার পিতা মাতা দুজনেই ত্যাগ করেছিলেন। কেউই তার দায়িত্ব নেন নি!

পাণ্ডবদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও পরাক্রম দুর্যোধনকে ক্রমশঃ অসুখী করে তুলছিল। তাঁরা এখন আর ছোট নেই। অনেকদিন পর্যন্ত দুর্যোধন জানতেন হস্তিনাপুরের ভাবী রাজা তিনি। হঠাৎ করে পাণ্ডবদের আগমণ তাঁর কোনদিনই মনঃপুত হয় নি। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বৈরিতা বেড়েছে বই কমেনি। অতএব শকুনির সঙ্গে পরামর্শ করে দুর্যোধন পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। সেখানে জতুগৃহে তাঁদের পুড়িয়ে মারাই তাঁর উদ্দেশ্য। বিদুরের বুদ্ধিতে পাণ্ডবেরা সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলেন বটে; কিন্তু তার আগে? পালাবার আগের দিন সেই যে এক দরিদ্র নিষাদরমণী তার পাঁচটি ছেলে নিয়ে তাঁদের আশ্রয় নেয়? তাদের খাইয়ে দাইয়ে ঘুমের ব্যবস্থা করে ঘরে আগুন লাগিয়ে পলানোর বুদ্ধিটি কিন্তু কুন্তীর মাথা থেকেই বেরিয়েছিল! যাতে সকালে ছয়টি অগ্নিদগ্ধ দেহ দেখে দুর্যোধন তাঁদের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হন আর কুন্তী তাঁর সন্তানসহ নিরাপদে অজ্ঞাতবাসে থেকে সুসময়ের অপেক্ষা করতে পারবেন।

কুন্তী চরিত্রের জটিলতা ও বৈপরীত্য আমাদের পদে পদে বিস্মিত করে। একদিকে উদার, স্নেহময়ী জননী, আবার অন্যদিকে এক অসম্ভব নির্মম এক রাজনীতিক। যিনি ঠাণ্ডামাথায় সন্তানসহ এক রমণীকে পুড়িয়ে মারতে পারেন, সেই তিনিই আবার বনবাস কালে আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার জন্য অপত্য ভীমকে বকরাক্ষসের কাছে পাঠাতে দ্বিধাহীন! ভীমের জন্য যুধিষ্ঠিরের আশঙ্কাকেও তিনি বিন্দুমাত্র আমল দেন না। আবার যখন তাঁর মনে হয় দ্রৌপদীর মতো বহ্নিশিখা থেকে দূরে থাকা কোন পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, বরং এ নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ বা অসন্তোষের বীজ জন্মাতে পারে – তখন তিনি তাঁর একটি সাধারণভাবে উচ্চারিত কথাকেই সত্য করে তোলেন। দ্রৌপদীর পঞ্চপতির সংসার হয়!

এরপর অল্প কিছুদিনের জন্য কুন্তীর সুখের সময়। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভ, রাজচক্রবর্তী হয়ে ওঠা – কিন্তু জুয়াসক্ত রাজা কবেই বা তাঁর রাজ্য ধরে রাখতে পেরেছেন? ফলে পাশাখেলায় রাজ্য, ধন, পত্নীর সম্মান সব হারিয়ে তিনি সপরিবারে বনবাসী হলেন। কুন্তী একাকিনী রয়ে গেলেন বিদুরের কাছে।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঠিক আগে কুন্তীকে আবার আমরা দেখি সম্পূর্ণ অন্য রূপে। সে সময় যুধিষ্ঠির যে কোন মূল্যে শান্তির প্রার্থী – পঞ্চগ্রামের পরিবর্তে রাজ্যের দাবী ছেড়ে দিতে রাজি – তখন কুন্তী গর্জে ওঠেন। না, সন্তানদের রাজ্যকামনায় নয়। কুরুসভায় দ্রৌপদীর যে চূড়ান্ত অপমান হয়েছিল, তার প্রতিবিধানের জন্য। রাজ্য নয়, সম্পদ নয়, এক নারী হয়ে আরেক নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য। সেই অপমানের বদলা নেবার প্রতিশ্রুতি যে ভোলে, সে আর যেই হোক, তাঁর সন্তান নয় – এমনধারা কঠোর বাক্যও তাঁর মুখে শোনা যায়। সেই পুরুষশাসিত দ্বাপর যুগে দাঁড়িয়ে এই তীব্র প্রতিবাদ আমাদের বহুক্ষণ বিস্ময়াবিষ্ট করে রাখে।

যুদ্ধ শুরু হলো। এইবার কুন্তীর মাতৃহৃদয় সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি খুব ভালো করে জানেন, ভীষ্ম, দ্রোণের মতো মহারথীদের হাতে পাণ্ডবদের বিশেষ ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তাঁরা প্রত্যেকেই এদের প্রতি স্নেহপ্রবণ। একমাত্র ভয়ের জায়গা তাঁরই ঔরসজাত কর্ণ! যে হাত রক্ষাকবচ হয়ে ভাইদের রক্ষা করতে পারত, পরিস্থিতি আজ একশ’ আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে সেই হাতেই অস্ত্র তুলে দিয়েছে। নিরপেক্ষ থাকাই হয়ত তাঁর পক্ষে সঙ্গত ছিল, কিন্তু যে প্রাণগুলিকে তিনি নিজের হাতে লালন পালন করে এত বড় করে তুলেছেন, তাদের দাবীই বড় বেশি ভারি হয়ে দেখা দিল। এই তৃতীয় বারেও তিনি কর্ণকেই বিসর্জন দিলেন।

রোজ ভোরবেলা নদীবক্ষে সূর্যস্তব করেন কর্ণ। উদায়ভানুর সঙ্গে অজানা এক অদ্ভুত বাঁধনে বাঁধা তিনি। পূজাশেষ জল থেকে যখন উঠে আসেন, তখন কোন প্রার্থীর প্রার্থনা তিনি ফেরান না। কুন্তী সেটা জানতেন। তাই ধর্মক্ষেত্র কুরক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে কর্ণের দ্বারে আজকের প্রার্থীর নাম কুন্তী!

কুন্তীর মুখে নিজের জন্মকথা, সূর্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের বা কবচকুণ্ডলের রহস্য জেনে সেই যুবকের মনে যে ঝড় উঠেছিল, তার কতটা আঁচ পেয়েছিলেন অথবা অনুধাবন করেছিলেন পৃথা তা জানা যায় না। হয়তো সেই অবকাশও তাঁর হাতে ছিল না। তিনি তখন কর্ণকে পাণ্ডবপক্ষে নিয়ে আসতে ব্যস্ত –

রাজ্যলোভ – ‘দোলাবেন ধবল চামর যুধিষ্ঠির’ – যদিও কুরুবংশের সিংহাসনে কর্ণের অধিকার কী করে হয়, সে বিষয়টা স্পষ্ট নয়। হয়ত বিজেতারাই নিয়ম তৈরি করে – জাতীয় কিছু হয়ে থাকবে। তাতেও কর্ণের হেলদোল নেই দেখে কর্ণকে দ্রৌপদীর পতি হবার লোভ দেখাতেও বাধল না পাণ্ডবজননীর! নদীতীরে এক নারীর হাতে দ্বিতীয়বার বস্ত্রহরণ ঘটল এক অভাগিনীর। যেন তেন প্রকারেণ কর্ণকে স্বপক্ষে আনার চেষ্টায় কুন্তী তখন অন্ধ।

এইখানে আমার একটু সন্দেহ হয়। কুন্তীর মতো প্রখর বুদ্ধিশালিনী এবং ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞানসম্পন্ন নারী কি সত্যিই কর্ণকে নিজপক্ষে করতে চেয়েছিলেন? অথবা যুদ্ধ থামাতে? নাকি তিনি জানতেন যে, কর্ণের মতো এক মহাবীর ও উদারমনা পুরুষ, তাঁর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ছাড়া অন্য কিছু করতেই পারেন না? দ্রৌপদীর উল্লেখ কি সেই প্রত্যাখ্যান নিশ্চিত করতেই? কর্ণের প্রতি তাঁর সেই স্নেহ থাকলে তিনি তো পাণ্ডবদেরও একথা বলতে পারতেন? কিন্তু তা তো নয়! আসলে তিনি এসেছেন কর্ণের মনোবল ভেঙে দিতে। যাদের তিনি নিজের পুত্র বলে স্বীকার করেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। 

বারবার তিনবার। আর কতবার কত ভাবে পরিত্যক্ত হবেন কর্ণ? অর্জুন বাদে চার পাণ্ডবের প্রাণদান এবং জন্মদাত্রীর গোপনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোধহয় জন্মঋণ শোধ করলেন রাধেয়। আর কুন্তী? এক সফল অভিযানের শেষে ঘরে ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু এই দান গ্রহণের দীনতা তাঁর মর্মভেদ করল। নিজের তুচ্ছতায়, সংকীর্ণতায় রোজ একটু একটু করে মরে যেতে লাগলেন পৃথা।

যুদ্ধ শেষ হল যখন, তখন আর বোধহয় এই গ্লানি বহন করতে পারলেন না পৃথা। পুত্রদের কাছে কর্ণের পরিচয় দিয়ে তাকেও মর্যাদার সঙ্গে দাহ করার কথা বললেন। শোকে আকুল হলেন পাঁচভাই। বিচলিত যুধিষ্ঠির অভিশাপ দিলেন পৃথাকে – নারীজাতি এরপর থেকে সত্য গোপন করার ক্ষমতা হারাল।

চিরকাল যাকে ত্যাগ করে এসেছেন সেই কর্ণ নন, অভিশাপ দিলেন যুধিষ্ঠির – যাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সবকিছু বাজি ধরেছিলেন। চূড়ান্ত আত্মগ্লানি আর নির্বেদ গ্রাস করল কুন্তীকে। পাণ্ডবদের রাজ্যাভিষেকের কিছুদিন পরে তিনিও ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর সঙ্গে বাণপ্রস্থে গেলেন। সেখানেই এক ভয়ঙ্কর দাবানলে তাঁদের মৃত্যু হয়। বাইরের দাবানল পৃথার অন্তরের দাবানলকে প্রশমিত করলে কিনা জানিনা, শুধু তাঁর নশ্বর দেহ ছাই হয়ে গেল।

কুন্তী তাঁর জীবনে চারবার গর্ভধারণ করেছিলেন দেবতাদের আহ্বান করে। একবার স্বেচ্ছায়, বাকি তিনবার তাঁর স্বামীর আদেশে। কিন্তু চিরজীবন তিনি ঐ একবার স্বেচ্ছাধীন হবার মূল্য চুকিয়ে গেলেন। তাঁর ত্যাজ্যপুত্র তাঁকে বর দিল, আর যে স্বীকৃত সন্তানদের জন্য তিনি সারাজীবন প্রাণপাত করলেন, সেখান থেকেই পেলেন অভিশাপ। এর চেয়ে বড় নিয়তির পরিহাস আর কীই বা হতে পারত! তবু কুন্তীর এই হার না মানা চরিত্রের সামনে নতজানু হওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করবার নেই।
0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


ধ্রুব জাতক 
অনিন্দিতা মণ্ডল 



পর্ব ২



এমন অদ্ভুত এক ঘোরে সুদত্ত আবিষ্ট হলেন যে তিনি শ্রাবস্তীতে এসেই তথাগতর উপযোগী একটি স্থান নির্বাচনে উদ্যোগী হয়ে পড়লেন। সন্ধান পাওয়া গেলো একটি অতীব রমনীয় উদ্যানের। সেটি জেত কুমার নামে এক ধনী ব্যক্তির। সুদত্ত চললেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তিনি মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন যে এই উদ্যানটিই তাঁর চাই। এমন রম্য উদ্যান বিনা তিনি বুদ্ধকে কোথায় প্রতিষ্ঠা করবেন? কিন্তু হায়। জেত কুমার এই উদ্যানটির সম্পর্কে ভীষণ মায়া পোষণ করেন। এ উদ্যান তিনি কোনও ভাবেই সুদত্তকে বিক্রয় করতে পারেননা। ক্রমে দুপক্ষেই ভীষণ রকমের বাদ প্রতিবাদ চলতে লাগল।

অনাথপিণ্ডদের পাঁচশত বন্ধু ছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই শ্রাবস্তীর বিত্তশালী বণিক। সকলেই কোনও না কোনও শ্রামনিক ধর্মের আশ্রয়ে আছেন। অনাথপিণ্ডদ একদিন প্রাতে নিদ্রা ভঙ্গ হলে তাঁর গৃহের প্রাঙ্গনে সম্প্রতি যে শ্বেতমর্মরের বুদ্ধ মন্দিরটি রচনা করেছেন সেখানে বসে বুদ্ধ শরণের মন্ত্র ও ধুপ দীপ সহযোগে পুজা অর্চনা করছেন, এমন সময় তাঁর কতিপয় বন্ধুর আগমন ঘটল। তাঁদের দেখেই অনাথপিণ্ডদ ভাব্লেন নিশ্চয় জেত কুমার কোনও সনবাদ পাঠিয়েছেন। এই মহাপুরুষ তথাগতর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। সে সময় তাঁর মনে বিহার স্থাপনের চিন্তা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। কিন্তু বন্ধুরা সম্পূর্ণ অন্য কথা বললেন। তাঁরা বললেন – ওহে শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডদ, জেত কুমার যে কোটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়েও ও কানন হস্তান্তর করবেন না। তুমি ও আশা ছাড়ো। শ্রেষ্ঠী বুঝতে পারছিলেন, বুদ্ধের সদিচ্ছার প্রভাব কতদুর যায় তা এঁরা অনুভব করতে পারছেন না। তিনি হতাশ হলেও মুখে সে কথা স্বীকার করলেন না। সেদিন কোনও মতে কাটিয়ে তিনি যখন নিশা আগমনে আহার শেষে তাঁর ক্ষুদ্র মন্দিরটির সম্মুখে বসে উপাসনারত, তখন হঠাত তাঁর মনে হলো একবার, আরও একবার জেত কুমারের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। বস্তুত এই উদ্যানটি কোশলরাজ প্রসেনজিতের কোনও কুমারের। উদ্যানটি সত্যিই বড় সুন্দর। অনাথপিণ্ডদ অতএব স্থির করলেন আরও একবার কথা বলবেন জেত কুমারের সঙ্গে।

সেদিন জেত কুমার দেখা করলেননা শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে। তাঁর দুত এল শুধু। অনাথপিণ্ডদ অধীর অপেক্ষায় বসেছিলেন। জেত কুমার না এলেও দূতমুখে এক প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী শ্রেষ্ঠী যদি এতটাই আগ্রহী হয়ে থাকেন তবে তিনি বরন তাঁর উদ্যানভূমিকে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ঢেকে দিন। কারন জেত কুমারের কাছে এই উদ্যান থিক ততটাই প্রিয় যতটা একজন শ্রেষ্ঠীর কাছে তাঁর আহৃত স্বর্ণমুদ্রা। দূত দাঁড়ালো না। অনাথপিণ্ডদ লক্ষ করলেন তাঁকে বিরত করতে জেত কুমার যত রকমের পথ হয় সবই অবলম্বন করছেন। তিনি দূত দ্বারা বার্তা বিনিময় করে তাঁকে অপমান করে, উদ্যানের অদ্ভুত বিনিময়মূল্য ধার্য করে অনাথপিণ্ডদকে প্রকারান্তরে প্রত্যাখ্যান করছেন। তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ হলেও অসফল হতে বাধ্য।

অনাথপিণ্ডদ সেদিন ভারী খুশি মনে গৃহে ফিরলেন। তথাগতকে অদেয় তাঁর কিছুই নেই। স্বর্ণমুদ্রার আর মূল্য কি? সেই দুটি কমল নয়নের স্নিগ্ধ সর্বদুঃখহর দৃষ্টি, সেই স্মিত অধরের স্নেহপরশ, সেই সুললিত কণ্ঠের করুণাধারা, তার চেয়ে বেশি কি আছে স্বর্ণমুদ্রায়?

পরদিন প্রভাতে শ্রাবস্তী নগরী হতবাক। স্তব্ধ বিস্ময়ে সকল নাগরিক নিজের নিত্যকর্ম স্থগিত রেখে এসেছেন জেত বনে। এক অভাবনীয় দৃশ্য। গোশকটে করে স্থলীবন্দী স্বর্ণমুদ্রা আসছে উদ্যানে। একদিকে শান্ত স্থির অনাথপিণ্ডদ দাঁড়িয়ে। তাঁর নির্দেশে সেই সব মুদ্রা ঢেলে পরম যত্নে বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে উদ্যানভূমিতে। উদ্যানের ভূমি সূর্যালোকে এক অপূর্ব সৌন্দর্য ধারন করছে। যেন অমরাবতী। নাগরিকগণের মধ্যে ক্রমে মৃদু থেকে উচ্চকিত, গুঞ্জরন থেকে জয়ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে। অনাথপিণ্ডদের জয়। তাঁর মতন এমন মহান আর কে আছে শ্রাবস্তীতে!

চরের মুখে সনবাদ পেয়েছেন জেত কুমার। নাহ। উদ্যান আর রাখা যাবেনা। নিজের চোখে একবার দেখে আসতে হবে। তিনি শিবিকা বের করতে নির্দেশ দিলেন। পথে চলতে চলতে চারিদিকে সেই একই কথা শোনা যাচ্ছে। এই অল্পসময়ের যাত্রাপথেই জেত কুমারের মনের পরিবর্তন ঘটল। কে এই তথাগত? এমন মহান যে অনাথপিণ্ডদ তাঁর সর্ব সঞ্চয় ঢেলে দিচ্ছেন মাটিতে? কেমন তাঁর আকর্ষণ?

উদ্যান দুয়ারে পৌঁছে জেত কুমারের চোখে যেন ভ্রম লাগলো। এ যে মাটিতে দিবাকরের পুনরুদয়! তবে কি ধর্মের আকাশে নতুন সূর্য? তিনি অনুধাবন করতে পারেননি? শিবিকা থেকে নেমে তিনি ছুটে গেলেন অনাথপিণ্ডদের কাছে। জড়িয়ে ধরলেন তাঁর হাত। “ক্ষমা করো। শ্রেষ্ঠী, তোমার মতন মহান আর কে আছে? কী অদ্ভুত দৃশ্য! দয়া করো। আর একটিও মুদ্রা তুমি ভূমিতে রেখনা। তোমার ওই সম্পদের বিনিময়ে কতশত অনাথ অসহায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের প্রাণরক্ষা হয়। ও মুদ্রা তুমি আর ভূমিতে রেখনা। আমি এ উদ্যান আর কোনও মুদ্রার জন্য বিক্রয় করবনা”। অনাথপিণ্ডদের মুখে স্মিত হাসির শিহর। এই ত তথাগতর অলৌকিক করুণা! জেত কুমার অর্ধমুল্যে উদ্যান দিয়ে দিচ্ছেন। তখন জেত কুমার বলে চলেছেন – তুমি মহান, শ্রেষ্ঠী তুমি মহত্তম! কিন্তু সুদত্ত তাঁকে থামিয়ে দিলেন- না, জেত কুমার। মহত্তম তিনিই, জিনি আগামী বর্ষায় এ উদ্যানে এসে আমাদের করুণা করবেন। আসুন আমরা মিলিতভাবে তাঁর জন্য বিহার নির্মিতিতে মন দিই।


ক্রমশ
0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

প্রাচীন কথা


ধ্রুব জাতক
অনিন্দিতা মণ্ডল


পর্ব ১

শ্রাবস্তী থেকে রাজগৃহ সাড়ে সাত যোজন দূরত্ব। কিন্তু শ্রেষ্ঠী সুদত্ত এই পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত। মগধের রাজগৃহের বণিক চন্দ্রাশীষ তাঁর প্রিয় সখা। এমনিই বাণিজ্যের প্রয়োজনে দুই সখায় বিস্তর আলাপ হয়। এখন চন্দ্রাশীষ সুদত্তকে তাঁর গৃহে কিছুদিনের জন্য আতিথ্যের নিমন্ত্রন জানিয়েছেন। সুদত্ত শ্রাবস্তীর বণিক সুমনের পুত্র। অল্প বয়সে মেধা আর কর্মদক্ষতার জন্য তিনি বেশ সম্পন্ন হয়েছেন। যদিও চন্দ্রাশীষ তাঁকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তবু সুদত্ত কর্মহীন জাপনে বিশ্বাসী নন। এবার রাজগৃহের বণিকদের সমিতি তাঁর কাছে নালিশ জানিয়েছে। বজ্জীসঙ্ঘের বণিকরা গঙ্গার কাছাকাছি থাকার দরুন সমস্ত উৎকৃষ্ট পণ্য আগেই ক্রয় করে নেন। এবারে তাই নিমন্ত্রণের ছোলে রাজগৃহের বণিকদের জন্য গোপনে কিছু পণ্য নিয়ে চলেছেন সুদত্ত। 

সবে বর্ষা শেষ। শ্রাবস্তী থেকে রাজগৃহে যাবার অনুকূল সময় এটি। বৃক্ষে বৃক্ষে সবুজের সমারোহ। চতুর্দিকে শস্যে শ্যামল বসুন্ধরা। দুগ্ধবতী গাভীরা গোচারণ ক্ষেত্রে সুখী হয়ে বিচরণ করছে। বাতাসে শীতল প্রলেপ। সুদত্ত অতএব যাত্রার আয়োজন করলেন। সখা জানিয়েছেন এ যাত্রায় তাঁকে নাকি তিনি এমন আলোর সন্ধান দেবেন যে সুদত্ত জাগতিক সব প্রাচুর্য ছেড়ে শুধু সেই আলোর পিছনে ছুটে যাবেন। সুদত্ত নিজের মনকে নানাভাবে নাড়াচাড়া করেছেন। কিন্তু বৈভবের চেয়ে বেশি সুখ কিসে, তা খুঁজে পাননি। তিনি দানশীল। মানুষের দুঃখে করুণায় দ্রব হয়ে যান। এই একটি মহৎ গুণ তাঁর আছে। আপাতত তাঁর সঙ্গে পণ্যপূর্ণ পঞ্চশত শকট বাণিজ্যের কারণে রাজগৃহে এসেছে। 

শ্রান্ত অথচ পূর্ণচিত্তে সুদত্ত পৌঁছিয়েছেন রাজগৃহে। কোনও এক অজানা কারণে তিনি নিজের অন্তরেই একপ্রকার শান্তির ফল্গুধারা অনুভব করছেন। চন্দ্রাশীষ সখার সঙ্গে আলাপে লক্ষ্য করলেন তাঁর সেই শান্ত স্বভাবটি। তাঁর অধরে একটি লুকানো হাসি খেলে যায়। এখনও দর্শন ঘটে ওঠেনি। তাইতেই সুদত্ত এমন অদ্ভুত শান্তি লাভ করেছেন। দর্শন ঘটলে, শ্রবণ ঘটলে না জানি কি অপূর্ব অনুভূতি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু সুদত্ত দেখলেন, প্রতিবারের মতো সখা এবারে তাঁর প্রতি তত মনোযোগ দিতে পারছেন না। কেমন যেন উদাসীন অবহেলায় তিনি অট্টালিকার বাতায়নবর্তী একটি কক্ষে বদ্ধ রইলেন। মানুষের মন! দুঃখ পেলেন। সখা এতটা উদাসীন কেন? কেনইবা তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন তবে? শেষে স্থির করলেন বাণিজ্য সমিতির সভায় যোগদান করে নির্দিষ্ট কর্ম সমাধা করে ফিরে যাবেন। এরপর সখার নিমন্ত্রন রক্ষা করার আগে ভেবে দেখবেন। তাঁর দিক থেকে বন্ধুত্বে তো কোনও ত্রুটি নেই!

চন্দ্রাশীষের অট্টালিকার উন্মুক্ত বাতায়নে বসে সুদত্ত সেদিন প্রভাতে দিনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা স্থির করছেন, এমন সময়ে ব্যাস্তসমস্ত চন্দ্রাশীষ প্রবেশ করলেন। সুদত্তর মুখের ভাবে এমন কিছু ছিল যে তিনি অনুভব করলেন সুদত্ত তাঁর উদাসীনতার কারণে দুঃখিত। চন্দ্রাশীষ সুদত্তর সম্মুখে তাঁর হাত দুটি ধরে বসে পরলেন। হায়, কেন যে বলেননি! তিনি আসল কারণটি ব্যক্ত করলেন। অদূরে রাজগৃহের বেলুবন বিহারে বর্ষাবাসে অবস্থান করছেন এক মহামানব। শাক্যমুনি গৌতম সিদ্ধার্থ। চন্দ্রাশীষ তাঁকে আদরের সঙ্গে শাস্তা বলে অভিহিত করছেন। তিনি বলছেন, সখা কাল প্রত্যূষে চলো তোমায় শাস্তার নিকটে নিয়ে যাই। কিছুটা শুনেছেন সুদত্ত। তবে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেননা। মহাজনপদগুলিতে এখন নানান ধর্মের তীর্থিক নিজেদের ধর্ম প্রচার করে চলেছেন। তাঁদের উপদেশ শ্রবণ করতে আগ্রহী গৃহীরা উপাসক হচ্ছেন। আর যারা সংসার ছেড়ে তাঁদের অনুসরণ করছেন তাঁরা হচ্ছেন শ্রাবক ও শ্রমণ। সুদত্ত শুনেছেন গৌতম এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হচ্ছেন। তবে নিজে এখনও তাঁকে চাক্ষুষ করেননি। চন্দ্রাশীষ একমনে লক্ষ করছিলেন সখাকে। শ্রাবস্তীর বণিকশ্রেষ্ঠ সুদত্ত এতই সম্পন্ন যে সমস্ত মহাজনপদগুলি তাঁকে তোষণ করে। তাঁর স্বর্ণসঞ্চয়ে ঈর্ষা করে। একমাত্র চন্দ্রাশীষ এসবে একেবারে নিরাসক্ত। তিনি জানেন, যতটুকু গ্রাসে ধরে তার চেয়ে বেশি ভক্ষণ প্রকৃতিকে শোষণ করার সামিল। অতিরিক্ত যা কিছু তাইই বর্জনীয়। সুদত্তও চন্দ্রাশীষের এই অনাসক্ত মোহহীনতা উপলব্ধি করেন। আর তাই তিনি তাঁর প্রিয়সখা। এখন এই প্রস্তাবে সায় দিয়ে ফেললেন। 

অতি প্রত্যূষে দুই সখা প্রস্তুত হয়েছেন। সাধু সন্দর্শনে যাওয়া হবে। তাই সুদত্ত সঙ্গে নিয়েছেন প্রচুর উপহার। চন্দন, সুগন্ধি, পুষ্পমালা, মধু, তৈল, গুড়, বস্ত্র, ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে একটি গোশকটে আরোহণপূর্বক দুই সখা চললেন বেলুবন।

বেলুবনের বৃক্ষছায়ায় বসে তথাগত তখন ধ্যানমগ্ন। সবে পুত্র রাহুলকে সঙ্ঘে স্থান দিয়েছেন। প্রব্রজ্যা নিয়েছেন রাহুল। সেই বিভা যেন পিতা ও আচার্যর আননে দৃশ্যমান। সম্মুখে তাঁর অসংখ্য শ্রাবক বসে। কারো নিমীলিত নয়ন। কেউ বা তথাগতর অনির্বচনীয় দেহকান্তি দর্শন করে, তাঁর শরীর থেকে উদ্ভুত পদ্মগন্ধ অনুভব করে মুগ্ধ হয়ে বসে আছেন। সুদত্ত সেখানে পৌঁছে অনুচরদের আজ্ঞা দিতে যাবেন উপহার একত্রিত করে তথাগত চরণে অর্পণ করবার, কিন্তু বাধা অনুভব করলেন। এমন শান্ত নিস্তব্ধ স্থানে অমন কোলাহল কি বিসদৃশ নয়? তিনি চুপ করে বসে পড়লেন। আর ঠিক তখনই তথাগত তাঁর দুটি আয়তনয়ন মেলে দেখলেন তাঁকে। কী যে ছিল সেই চাহনিতে! সুদত্ত যেন স্থানকাল ভুলে এক অদ্ভুত অস্তিত্বে ডুবে গেলেন। 

গৌতম দেখলেন এক মহৎহৃদয় তাঁর সম্মুখে স্তব্ধ হয়ে বসে। এত সহজে সে তার জাগতিক অহংকে ছেড়ে নির্বাসনা হয়ে বসে আছে? শুধু তাঁর সান্নিধ্যে এ বস্তু ঘটে উঠেছে? তবে তো আধার প্রস্তুত! তিনি কাছে ডাকলেন সুদত্তকে। বহুমূল্য বস্ত্র বেশভূষা ও অলঙ্কারে সজ্জিত বণিক তাঁর আরও নিকটে গেলেন। ইতিমধ্যে তথাগতর কাছে চন্দ্রাশীষ নিবেদন করেছেন একটি তথ্য। এই সেই শ্রাবস্তীবাসী বণিক, সুদত্ত। যিনি নিজের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেন দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের জন্য। এমন দানশীল শ্রেষ্ঠী জগতে বিরল। অনাথকে পিণ্ডদানকারী এই বণিক সত্যই মহৎহৃদয়। তথাগতর চন্দ্রাননে মধুর স্মিত হাসি। তিনি সুদত্তর মস্তকে হাত রাখলেন। ডাকলেন, অনাথপিণ্ডদ, তুমি আজ থেকে ত্রিশরণ নাও। উপাসক অনাথপিণ্ডদকে সকল বৌদ্ধ আজ থেকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে। যে ব্রত তুমি নিজের অজ্ঞাতেই গ্রহণ করেছ তা থেকে বিচ্যুত হয়োনা।

বাণিজ্যের কাজ সেরে বাকি সময়টুকু সুদত্ত তথাগতসকাশেই রইলেন। একভাবে শুনে গেলেন তাঁর উপদেশ। মধুর বাণী। মহান মানবের কাছে শিক্ষা নিলেন অমূল্য পাঠের। এ জীবন নশ্বর। পঞ্চভূতে গঠিত দেহের বিনাশে পঞ্চভুতেই বিলীন হয়ে যেতে হবে। সমস্ত অনিত্য বস্তুর মাঝে অবিচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছু নেই। দুঃখ বলেও কিছু নেই, যদি কেউ সেরকম নির্লিপ্ত হতে পারে। নির্লিপ্ততার সাধনা গৃহী উপাসকের জন্য কঠিন। তবে সুদত্তর কাছে নয়। কারণ তিনি এর পূর্বেই নির্লিপ্ততার পরিচয় রেখেছেন। তাঁর উপার্জিত অর্থ তিনি দান করে থাকেন। এই ত্যাগই জীবনের আদর্শ।

তথাগতর মহিমা, তাঁর রূপ ও বাক্যে মোহিত হলেন সুদত্ত। ফিরে আসার আগে একটি নিবেদন রাখলেন। “হে গৌতম, আপনি শ্রাবস্তীতে বর্ষাবাসের আতিথ্য গ্রহণ করুন। আমাদের একান্ত সৌভাগ্য হবে, যদি আপনি আপনার সমস্ত শিস্য সমভিব্যাহারে শ্রাবস্তীতে এসে আতিথ্য গ্রহণ করেন। গৌতম স্মিত আননে চেয়ে রইলেন। এই বণিকের সম্পদ এতটাই, যে তিনি এতগুলি ভিক্ষুসহ গৌতমকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। মহৎ প্রাণ সন্দেহ নেই। তিনি অনুমতি দিলেন।

শান্ত স্থির মনে সুদত্ত ফিরে চললেন শ্রাবস্তী। তাঁর গন্তব্য রাজপুত্র জেতকুমারের ভবন। তাঁর উদ্যানটি ক্রয় করতে পারলে একটি বৃহৎ বিহার নির্মাণ করতে সমস্যা হবেনা। 
0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


মিশ্রি পাক (শেষ পর্ব)
অনিন্দিতা মণ্ডল


সেবা ঠাকুরানী বসেছিলেন ঘর লাগোয়া তিনদিক খোলা এক দালানে। তাঁর সামনে জ্বলন্ত উনুন। সেখানে প্রকাণ্ড কড়ায় কি এক জলের মতো বস্তু টগবগ করে ফুটছে। সেবা ঠাকুমা এক বিরাট ধাতব হাতায় করে নাড়ছেন আর ফেনা সরিয়ে হাতায় করে তুলে তুলে পাশে রাখা আরেকটি বিশাল ধাতব কলসীতে রাখছেন। তাঁর গায়ের রঙ সিস্তানার চেয়ে আরও একটু শ্যামল। চোখ দুটোও যেন বেশি কালো। মাথার চুল সিস্তানার মতোই কোঁকড়া। পরনে ঢিলেঢালা এক কাঁধের এক কাফতান। তবে বাংলা দেশের তুলনায় কি সিস্তানা কি তার ঠাকুমা, দুজনেই বেশ বড়সড় চেহারার। আন্তনি এসে ঠাকুমাকে যথাযোগ্য অভিবাদন করে উঠোনে বাঁধানো পাথরের বেদিটায় এসে বসল। মণিপাল তখনও দাঁড়িয়ে। বাংলা দেশে এসো বোসো না বললে কেউ আসন গ্রহন করেনা। কিন্তু সেবা ঠাকুমা একটু কঠিন তির্যক চাউনি দিলেন। তাই দেখে আন্তনি তাকে ঝটিতি ইশারা করল – আরে বোসো! মণিপাল ধপ করে বসে পরল আন্তনির পাশে। যস্মিন দেশে যদাচারঃ। তারপর আন্তনি আর ঠাকুমার যা কথোপকথন হলো তার সার কথা অনেকটা এইরকম -- 

আন্তনি – ঠাকুমা, এ হলো মণি। আমার অনেকদিনের বন্ধু। আমাদের যেমন ভূমধ্য সাগরের পারে বাড়ি, এর তেমন বঙ্গোপ সাগরের পারে বাড়ি। এ সেই গঙ্গাহৃদি থেকে ফি বছর এখানে বাণিজ্য করতে আসছে। দেখছ না কেমন শ্যামল চেহারা? খুব বড় ঘরের ছেলে। ওদিক থেকে উত্তর এলো – হুঁ। তা আমার কাছে কেন বাছা? এসব খোঁজে আমার কি দরকার? আন্তনি একটুও না ঘাবড়িয়ে বলল – ঠাকমা, তুমি যে সেই প্রাচ্য দেশের পাতলা জলের মতো কাপড়ের পোশাক বড় ভালোবাসো, এ সেই কাপড়ই তো বেচতে আনে! ঠাকুমা এবার হাতা নাড়তে নাড়তে ফিরে চাইলেন। চোখে সন্দেহ আর আশা কেমন খেলা করছে। ধীরে ধীরে জ্বলন্ত উনুনের পেট থেকে দু চারটে আংরা চিমটে করে সরিয়ে রাখলেন। নিভুনিভু উনুন আঁচে কড়া বসিয়ে রেখে ফিরে বসলেন। মুখে যেন কী এক নরম আভা। তারপর বেশ সতর্ক উচ্চারণে বললেন – তা আমি কি ওসব কিনতে পারি বাছা? ওসব রোমক পাড়ার বিলাস সামিগ্রী। এখানে ওসব কি হবে বাছা? মণিপাল এমনই একটা জুতসই সুযোগ খুঁজছিল। সে তৎক্ষণাৎ একটা বেতের তৈরি বাক্স ঠাকুমার সামনে রাখল। আন্তনি হেসে বলল – নাও ঠাকুমা, খুলে দেখো দেখি আমার বন্ধু কি এনেছে তোমার জন্য! সেবা ঠাকুমার সন্দেহ পুরো যায়নি তখনও। কিন্তু বাক্সর ডালা খুলতেই নজরে পড়ল ঠিক ভূমধ্য সাগরের মতো রঙ, এক সাগর রঙের মসলিনের নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে এক মোটা কাপাসের থলে। উজ্জ্বল মুখে ঠাকুরানী যেন গুপ্তধন খুঁজছেন, এমন ভাবে সেই মসলিন সযত্নে সরিয়ে দেখতে পেলেন কাপাসের আস্তরণে সার দিয়ে সাজানো কি এক গুলি গুলি চাকা চাকা বাদামী রঙের বস্তু। মুখ তুলে চাইতেই আন্তনি চট করে একটি নারকেল নাড়ু তুলে মুখে ফেলে দিলো। তারপর সেটি চুষে চিবিয়ে নানা ভাবে মুখের ভেতরে ঘুরিয়ে মুখে এক স্বর্গীয় আহ্লাদ ফুটিয়ে তুলল। ঠাকুমা বুঝলেন এটি খাদ্যবস্তু। তিনি তখন ঈষৎ হালকা বাদামী একটি চাক, মানে তিলের তক্তির কোণ ভেঙে মুখে ফেললেন। ওহ কী অপূর্ব! তাঁর চোখ টানা টানা। সেগুলো পুরো বর্তুলাকার ধারণ করল। অর্থাৎ যারপরনাই বিস্মিত পুলকিত শিহরিত হচ্ছেন। মণিপাল শত হলেও বেনের ছেলে। সে বুঝেছে ওষুধ ধরেছে। অতএব সবুরে কাজ হবে। ওদিকে ঠাকুমা ততক্ষণে উঠে ঘরে চলে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি বেরিয়ে এলেন। হাতে একটি ব্রোঞ্জের থালা। তাইতে ক’টি শুভ্র স্ফটিক খণ্ড। এনে রাখলেন মণিপালের সামনে। মণি ধন্দে পড়ল। এ কী জিনিস? হীরা বা অন্য কোনও মুল্যবান রত্ন? সে একটি হাতে তুলে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। আন্তনি চুপ করে দেখছিল মণিপাল কি করে। এবার সে পূর্ববৎ একটি স্ফটিক খণ্ড তুলে মুখে চালান দিল। মণিপাল এগুলিকে রত্নই ঠাউরে ছিল। ঠাকুমার মতো সেও বুঝল এ খাদ্যবস্তু। সেও তখন একটি খণ্ড মুখে দিলো। ব্যাস। সঙ্গে সঙ্গে এক সুন্দর মধুর রসে তাঁর মুখের ভেতর ভরে গেলো। আহা কি সুন্দর তার স্বাদ! দুপক্ষই যখন মধুর মাধুরীতে আচ্ছন্ন তখন আন্তনি কাজের কথা পাড়ল। সে বলল – ঠাকুমা, তোমার সিস্তানা বড়ই দুষ্টু হয়েছে। রাতেবিরেতে হাটেবাজারে ঘুরে বেড়ায়। একটু শাসন বারণ না করলে ...। ঠাকুমা বিরক্ত হলেন – তাতে তোমার কি বাছা? তার অমন ডাকাতের মতো বাপই যখন আমার ভয়ে তাকে কিছু বলতে পারেনা, তখন তুমি কোথাকার মোড়ল এলে? আন্তনি গলার স্বর বদলিয়ে বলল – আরে না না। সে কথা নয়। রোমকগুলো বড় লোভী। তাই বলা। তা তুমি তো তাকে বেশ ভালো মিশরীয় পাত্র দেখে পাত্রস্থ করতে পারো। সেবা ঠাকুমা তখনও তিলের তক্তি চুষছেন। মুখে কিন্তু একটা দুঃখের ভাব। বললেন – বাছা পালটি ঘরে পাত্রস্থ করার মতো পাত্র কই এখানে? আন্তনি মুখখানা দুঃখে ভরিয়ে বলল – আমি আবার অর্ধেক রোমক কিনা। খাঁটি মিশরীয় তো নই। তাও আবার দাসীর ছেলে। তারপর হঠাৎ যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন ভাবে লাফ দিয়ে উঠে বলল – দেখো তো আমার এই বন্ধুটিকে পছন্দ কিনা? খুব বড় ঘরের ছেলে। ওর সিস্তানাকে ভারী পছন্দ। ঠাকুমা আসলে নীলরক্তের কথা তুলে সিস্তানার মোটেই বিয়ে দিতে চাননা। তাঁর সমস্ত ধনের উত্তরাধিকারিণীকে তো আর যার তার হাতে দেওয়া যায়না। তার ওপরে বিয়ের পর সেই নাতজামাইই আসল মালিক হবে সেসবের। তাই এসব নিয়ে ভাবেননা বিশেষ। এখন আন্তনির কথায় একদম চুপ মেরে গেলেন। তখন তাঁর মুখে হতাশা আনন্দ উৎসাহ, এমন কতশত অনুভূতি যে খেলা করতে লাগল! মণিপালের মনে হলো কয়েকটা মুহূর্ত নয়, এ যেন অনন্ত কাল! একটু পরেই বড় হতাশ হয়ে পড়লেন। কারণ এ ছোকরা ভিনদেশী। এ এখানে রইবে কেন? তারপর সেবা ঠাকুরানী এক আজব শর্ত দিলেন। বললেন – হ্যাঁ বাবা আন্তনি, তোমার মিত্রটি বড়ই সুশীল ও সহৃদয়। সে নিজে সিস্তানাকে কিছু বলতে যায়নি। তার ওপর আমার জন্য কত উপহার এনেছে। আন্তনি কথার মাঝেই বলে উঠল – রাজবংশের কারুর সাথে দেখা করতে গেলে, বুঝতেই পারছ ঠাকুমা...। ঠাকুরানী হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল – দেখো এ বিয়েতে আমি রাজি। তবে শর্ত জানো তো? তা হলো বিয়ের পর পাত্র এখানেই থাকবে। পাত্র একথা জানে তো? মণিপালের মাথায় বজ্রপাত। সে কি করে হয়? গঙ্গাহৃদিতে তার সর্বস্ব! এক কথায় সব ছেড়েছুড়ে এখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাওয়া? কিন্তু আন্তনি গভীর জলের মাছ। সে আগেই জানত যে মিশরী রূপসীর সোয়ামী তার সঙ্গে এদেশেই থাকে। বিয়ের পর কন্যে শ্বশুরবাড়ি যায়না। জামাই এসে ওঠে এখানে। সে ঠাকুমার দিকে করুন চোখে চাইল, যেন কেঁদে পড়ল – ঠাকুমা, এ কেমন কথা! মণি যদি দেশেই না যায়, তবে এসব নাড়ু বড়ি তক্তি, মসলিন কাপড় এসব তোমায় কে এনে দেবে? ঠাকুমা নরম হলেন। আচ্ছা আচ্ছা। তবে মণি যাবে, কিন্তু সিস্তানা নৈব নৈব চ। অগত্যা। রাজি হতেই হয়। মণিপালের দুঃখিত মুখভাব দেখে ঠাকুমা বুঝলেন পাত্র রাজি বটে, তবে দুঃখ আছে মনে। তখন আবার রফা হলো। ফি বারে জাহাজ ফেরবার সময় ঠাকুমার তৈরি স্ফটিক খণ্ড নিয়ে যাবে গঙ্গাহৃদিতে। 


শেষমেশ একদিন মিশরী পল্লীর এক মন্দিরে মিশরী পুরোহিতের পৌরোহিত্যে মণিপালের আর সিস্তানার বিয়ে হয়ে গেলো। সেবারে ফেরবার সময়ে ঠাকুমা সঙ্গে দিলেন স্ফটিক খণ্ড। তাড়াতাড়ি ফিরবে এই আশ্বাস দিয়ে সিস্তানার থেকে বিদায় নিল মণিপাল। সেই মিশরী মিষ্টি নিয়ে সে যখন ফিরল তখন বাঙালির জিভে তার নাম হয়ে দাঁড়ালো মিশ্রি। সেই থেকে মিছরি। আর মিশরে পাকাপাকি ভাবে বাঙালি বণিকদের পরিবার বসবাস শুরু করে দিল। 



1

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যার তৃতীয়া - কুন্তী
দোলা সেন



অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥


কথা হচ্ছিল প্রাতঃস্মরণীয়া পাঁচজন মেয়ের। ভোরবেলায় যাঁদের নাম করলে মহাপাপও বিনাশ হয়। কিন্তু যাঁদের মতো হতে বলেন না কোন আশীর্বাদকই। এই বৈপরীত্যই বারে বারে আমাকে টেনে নিয়ে গেছে মহাভারতের মহাসমুদ্রে। প্রতীক ছেড়ে সহজভাবে খুঁজে বেরিয়েছি তাঁদের মানবী সত্ত্বাকে। জানতে চেয়েছি কোন অপরূপ চরিত্রবলে এঁরা সেই পুরুষপ্রধান যুগেও আপন স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর ছিলেন। তাঁদের চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য ঢাকতে বারে বারে অবতারণা করা হয়েছে রূপকের। কখনো কৃষিসভ্যতার আড়ালে রূপকের জালে তাঁদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কখনো বা পঞ্চেন্দ্রিয়-দেহ আত্মা ইত্যাদির দৈবিক বাতাবরণে তাঁদের মাথায় পরানো হয়েছে অলৌকিক মুকুট। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না – যা নাই ‘ভারতে’ তা নাই ভারতে! প্রথম ভারত মানে মহাভারত। তাই তৎকালীন সমাজের এক সংগ্রামী নারী – যিনি বারবার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর রাজনৈতিক সচেতনতায় উল্টে দিয়েছেন ভাগ্যের হিসাব, যাঁর চরিত্রে মহানতার সাথে মিশে থাকে কিছু স্বার্থান্ধতা, ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয় আবেগ ও মমতা – এবং তারপরেও আমাদের কাছে যাঁর প্রধান পরিচয় একজন জননী – সেই কুন্তীর কথা হোক আজকের আলোয়।


কুন্তী (প্রথম ভাগ)


যাদব বংশের রাজা শূরসেন। পুত্রলাভ উপলক্ষ্যে তাঁর ঘরে আজ মস্তবড় উৎসব। তাঁর একটি সুলক্ষণা শান্ত সুন্দরী মেয়ে আছে বটে, কিন্তু বংশরক্ষা তো আর কন্যা দিয়ে হয় না! পুত্রলাভে তাই আজ তাঁর আনন্দের সীমা নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা এসেছেন, এই আনন্দের ভাগীদার হতে। রাজ্যময় আনন্দের মাঝে একটি মুখ শুধু মলিন। সেই মুখ শূরসেনের ভাগ্নের। নামেই ভাগ্নে, সমবয়েসী দুটি মানুষের মধ্যে আসল সম্পর্কটা গভীর বন্ধুত্বের।

এই ভাগ্নেটি নিঃসন্তান। তাই বন্ধুত্বের কোন এক আবেগঘন মুহূর্তে শূরসেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর একটি সন্তান তিনি একে দান করবেন। তারপর কালের নিয়মে বহু সময় পেরিয়ে গেছে। প্রথম সন্তানের মুখ দেখেছিলেন যখন, তখন এই শপথের কথা তাঁর মনেও ছিল না। কিন্তু আজ এই পুত্রলাভের আনন্দঘন মুহূর্তে ভাগ্নের মলিন মুখটি তাঁকে পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কিংবা হয়ত ছেলে পাবার আনন্দে মেয়েটির গুরুত্ব তাঁর কাছে কমে গিয়েছিল। তা সে যে কারণেই হোক, শূরসেন সর্বসমক্ষে তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করলেন এবং সভামাঝেই ভাগ্নের হাতে কন্যাটিকে দান করলেন। সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল।

এই মেয়ের নাম পৃথা। ভাগ্নের নাম রাজা কুন্তীভোজ, আর যে পুত্রলাভের জন্য এই উৎসব – তার নাম বসুদেব। বসুদেবের পুত্র যুগাবতার শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য পরে বহুবার এই পিতৃস্বসার পাশে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।

কুন্তীভোজের অবস্থা হল আনেকটা সামনে পাহাড় আর পিছনে খাদে আটকে যাওয়া প্রাণীর মতো‎। যখন এই প্রতিজ্ঞা, তখন তাঁর মনের কোণে কোথাও কন্যালাভের বাসনা ছিল না। তাই আজ যখন বসুদেবের বদলে পৃথাকে দান করলেন শূরসেন, তখন তিনি মনে মনে ভারি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। এদিকে শূরসেন অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা। আর এই মুহূর্তে এই মহান দানের স্তুতিগানে সমগ্র যাদবকুল যেভাবে মেতে উঠেছে, তাতে তাঁর প্রতিবাদের ফল যে কোনদিক দিয়েই ভালো হবে না – সেটুকু না বোঝার মতো কাঁচা রাজনীতিবিদ তিনি নন। কাজেই মনে যাই থাক, হাসিমুখেই পৃথাকে গ্রহণ করলেন তিনি। নতুন পিতার নামে তাঁর নতুন নামকরণ হল – কুন্তী। ছোট মেয়েটি কিছু বোঝার আগেই বদলে গেল তার বাবা-মা-ঘর-গোত্র সব, সবকিছু। শূরসেন কন্যাদায় থেকে মুক্ত হলেন, আর কুন্তীভোজ অপ্রসন্ন মনে সেই দায় নিয়ে ঘরে ফিরলেন।

শূরসেনদত্ত কন্যা – তাকে আর যাই হোক অবহেলা করা যায় না। তাই তার জন্য তৈরি হল আলাদা মহল। সেখানে ধাত্রীমাতা ও দাসী পরিবৃত হয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন কুন্তী। হয়ত দাসীসংসর্গের জন্যই তিনি রাজকন্যাসুলভ ঔদ্ধত্য অর্জন না করে এক নরম সেবাপরায়ণা নারী হয়ে বেড়ে উঠছিলেন। রাজপ্রাসাদে তো সমানেই বহু মুনি ঋষির আনাগোনা – তা কুন্তীভোজের মনে হল, খাইয়ে দাইয়ে মেয়েটাকে বড় করছেন যখন, তখন তাঁদের সেবায় কুন্তীকে নিয়োজিত করাই যায়! রাজকন্যার সেবায় তুষ্ট মুনিদের আশীর্বাদে রাজার যশ ও পুণ্য দুইই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে।

যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। কিশোরী কুন্তীর খেলধূলার দিন গেল। ছোট মেয়েটি তাতে দুঃখ পেয়েছিল নাকি বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসতে পেরে খুশি হয়েছিল তা ঠিকমতো জানা যায় না। জন্ম থেকেই তিনি পিতামাতার স্নেহবঞ্চিত – নিজের মনে নিজেকে গুটিয়ে রাখা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।


তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুনি ঋষিরা আসেন। তাঁদের কেউ সৌম্য, কেউ ক্রোধী, আবার কেউ বা স্নেহপরায়ণ। তাঁরা সকলেই এই মেয়ের সেবায় মুগ্ধ, চমৎকৃত। তাঁদের কাছে নানা ধর্মকথা, রীতিনীতি, উপদেশ শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠেন কুন্তী, মননে ঋদ্ধ হন। তাঁর সেবা আর মধুর ব্যবহারের খ্যাতি পল্লবিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে তা একদিন মহর্ষি দুর্বাসার কানে পৌঁছায়।

সদা অসন্তুষ্ট কোপনস্বভাব এই তপস্বী সর্বদাই অপরের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত থাকেন। হয়ত কোন অপ্রাপ্তি তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে। কঠোর তপস্যা তাঁকে সিদ্ধ করেছে। তিনি ত্রিলোকের ভক্তি, সমীহা আর ভয়ের পাত্র। কিন্তু ভালোবাসা? কই সেরকম কিছু তো জমা হয় নি তাঁর ঝুলিতে! তাই কাউকে তা পেতে দেখলেই রাগে অস্থির হয়ে ওঠেন, তাঁর ত্রুটি আবিষ্কার করে অভিশাপ না দেওয়া পর্যন্ত শান্ত হন না। সেই দুর্বাসা কুন্তীর এত প্রশংসা শোনার পরেও পরীক্ষা নিতে আসবেন না, সে কি হয়?

এই আগমনের সংবাদে কুন্তীভোজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঋষিবর ক্রুদ্ধ হলে তাঁর রাজ্যের সমূহ সর্বনাশ। তাই তিনি তড়িঘড়ি কুন্তীর কাছে এলেন, স্নেহবচনে তাঁকে অভিষিক্ত করে দুর্বাসার আগমন এবং উদ্দেশ্য জানালেন।

মনে মনে হাসলেন কুন্তী। দুর্বাসার নানা উপাখ্যান তিনি নানা মুনির কাছে শুনেছেন। তিনি জানেন ঋষির রোষের ভয়ই পিতাকে আজ প্রার্থীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবু এই তাঁর জীবনে প্রথম পাওয়া পিতার স্নেহবচন। তিনি মধুর বচনে কুন্তীভোজকে আশ্বস্ত করলেন – পিতা, আপনি আমায় পালন করেছেন। আপনার কোন ক্ষতি আমি হতে দিতে পারি না। নির্ভয় হোন, ঋষিকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্ব আমার।

নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন কুন্তীভোজ। একবারও ভেবে দেখলেন না কি অসম্ভব এক গুরুদায়িত্ব তিনি তাঁর কন্যার উপর চাপিয়ে দিয়ে গেলেন।

দুর্বাসা এলেন কুন্তীর ভবনে। আর আক্ষরিক অর্থেই অতন্দ্র সেবায় নিয়োজিত হলেন পৃথা। দাসীদের ভরসা করতে পারেন না। একা হাতে সব কাজ করেন। আর ছটফট করতে থাকেন সেই মহাঋষি। কিছুতেই যে তিনি কোন ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছেন নে যার জন্য অভিশপ্ত করে দেওয়া যায় এই নারীর জীবন! গভীর রাত হোক বা দিবা দ্বিপ্রহর, যখন যা আদেশ করছেন ঋষি, হাসিমুখে মুহূর্তমধ্যে তাই পালন করছেন পৃথা। অবাক হন ঋষি। এক মমতাও কি কাজ করে ভিতর ভিতর? নাহলে কেনই বা তিনি পৃথাকে শোনান নানা শাস্ত্রের কথা,সমাজের রীতি, রাজনীতির কথা? কুন্তীকে তিনি গড়ে তোলেন আগামী জীবনের উপযুক্ত করে। বৎসর অতিক্রান্ত হল। তুষ্ট হযেছেন দুর্বাসা, যাবার আগে বর দিয়ে যাবেন মেয়েটিকে। কিন্তু তার আগে শেষ পরীক্ষা করে দেখে নেবেন এই মেয়ে সেই বরের উপযুক্ত কিনা।

ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নানে গেলেন দুর্বাসা। ফিরে এসেই নাকি সদ্যপ্রস্তুত অন্ন চাই তাঁর! কুন্তী তাঁর অভ্যস্ত দ্রুততায় রান্না নিয়ে ঘরে এলেন যখন, তখনই ঘরে ঢুকছেন মহর্ষি। প্রণতা মেয়েটিকে ওঠার মুখে বাধা দিলেন ঋষি। তাঁর পিঠের উপর রাখলেন সদ্যপ্রস্তুত খাদ্য। পিঠ পুড়ে গেল তাপে, তবু একবছর যে মেয়েটি অনিদ্রা ও প্রায় অনাহারে কাটিয়েছে, আজও তার ধৈর্যচ্যুতি হলো না। বেদনার সামান্যতম কম্পনকেও সে বাইরে আসতে দিল না! তুষ্ট হলেন দুর্বাসা। সহনের এই চূড়ান্ত রূপই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর আশীর্বচনে কুন্তীর দহনজ্বালা প্রশমিত হলো। পৃথার কানে তিনি দিলেন এক মন্ত্র। সেই মন্ত্রে যে দেবতাকেই আবাহন করবেন কুন্তী তিনি এসে কুন্তীর বাসনাপূর্ণ করবেন।

চলে গেলেন দুর্বাসা। কিন্তু ছোট থেকে যে বড় হয়েছে দাসীমহলে আর পুরুষ বলতে একমাত্র দেখেছে জিতেন্দ্রিয় তপস্বীদের, সেই সদ্যতরুণীর পক্ষে এই বরের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব ছিল না। শিশুর হাতে নতুন খেলনা এলে সে যেমন সেটিকে নানাভাবে নেড়েচেড়ে ঠুকেঠাকে দেখতে থাকে, কুন্তীর অবস্থা হল অনেকটা সেইরকম।

এইরকমই এক দিনে সে প্রাসাদের লাগোয়া নদীতীরে স্নান সেরে ওঠার সময় তার চোখ পড়ল সদ্যোত্থিত দিবাকরের দিকে। কি জানি কী ছিল সেই সকালের আলোয়, জলের ঝিলিমিলিতে, কিংবা পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় – পৃথার চোখ আর দিবাকরের ওপর থেকে সরল না। তার মুগ্ধ হৃদয় চাইল, এই অর্কপ্রভকে কাছে পেতে, তার মুখ থেকে দুটি কথা শুনতে। তাই সে মন্ত্রোচ্চারণ করে দিবাকরকে আহ্বান করল। এলেন সেই তেজোময় পুরুষ, জানতে চাইলেন কী তার প্রার্থনা। “কী চাই?” – তা তো জানে না পৃথা। তার তো শুধু দেখে ভালো লেগেছিল, একটু কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। তার ইচ্ছেপূরণ হয়ে গেছে, এবার সে দিবাকর এবং দুর্বাসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যেতে চায় তার আপন ঘরে। হাসলেন দিবাকর। তিনি জানেন, কিশোরী পৃথার মধ্যে এক নারী জন্ম নিচ্ছে – সে এখনো তাকে চেনে না। একে পরিণত করতে হবে তাঁকেই। ঋষির বরকে পুরো সার্থক না করে তাঁরও তো আর ফিরে যাবার উপায় নেই! তিনি বালিকাকে বোঝালেন এই আবাহনের প্রকৃত অর্থ। বড় যত্নে বড় সাবধানে দিবাকর পৃথাকে দিলেন নারীত্বের প্রথম স্বাদ। তৃপ্ত হয়ে ফিরে গেলেন দিবাকর। আর ফিরে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না।

আর জীবনের প্রথম অবুঝ ইচ্ছের দাম চুকিয়ে ঘরে ফিরে এলেন পৃথা। এরপর মাসের আবর্তনছন্দে ছেদ পড়তেই ধাইমার ভ্রুকুটি – সব শুনে মাথা চাপড়ে হায় হায় করা ছাড়া আর কিই বা করতে পারেন তিনি। সবদিক বজায় রাখতে গেলে যা করা যায় সেটাই করলেন তিনি। পৃথাকে লোকচক্ষু থেকে গোপন রাখলেন। ন মাস পরে দিব্য কবচ কুণ্ডলধারী এক উজ্জ্বল শিশুর জন্ম হল। কিন্তু সে কানীন। আর পৃথা যে কত একা, কত অসহায় সেকথা ধাইমার চেয়ে বেশি কে জানে? তাই শিশুটিকে এক ডালায় করে আর এক ভোরের আলোয় দিবাকরকে আর ধাইমাকে সাক্ষী রেখে চোখের জলে ভেসে প্রথম সন্তানকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে দিতে পৃথা একমুহূর্তে জীবনের অনেকগুলো ধাপ এক নিমেষে পার করে গেল। নরম মনের মেয়েটা ধীরে ধীরে পালটে যেতে লাগল – সে বুঝে গেল জীবনভোর তাকে একলা চলতে হবে। নিজের বা আপনজনের স্বার্থরক্ষায় তাকে কখনো ক্ষুদ্র, কখনো মহৎ আবার কখনো বা নিষ্ঠুর হতে হবে। এই তার নিয়তি। জীবন তাকে এভাবেই খেলায় নামিয়েছে।

এসব কথার আভাস কুন্তীভোজের কানে পৌঁছেছিল কিনা কে জানে, কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তিনি কুন্তীর স্বয়ম্বরসভা আহ্বান করলেন। কুন্তী হলেন কুরুকুলবধু – রাজা পাণ্ডুর স্ত্রী। একানেও কুন্তীর জন্য কোন সরল জীবন অপেক্ষা করে নেই। বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। তাই ছোটভাই পাণ্ডু রাজা হয়েছেন। রাজনীতির এক জটিল সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। এবার দুভাইয়ের মধ্যে যাঁর সন্তান আগে জন্মাবে সেই রাজ্যাধিকারী। কাজেই পুত্রলাভের তাগাদা দুজনের মধ্যেই থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কাজেই পাণ্ডু দ্বিতীয় বিবাহ করে ফেললেন মদ্ররাজকন্যা মাদ্রীকে।

এদিকে জন্মগতভাবেই দুর্বল পাণ্ডু। তার পাণ্ডুর বর্ণ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। এর উপর তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে সঙ্গমরত এক হরিণদম্পতিকে হত্যা করে বসলেন! একে তো সঙ্গমরত প্রাণীকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ, তার উপর আবার এরা সাধারণ মৃগ ছিল না। এক ঋষিদম্পতি হরিণরূপে নিজেদের দাম্পত্য উপভোগ করছিলেন। মরবার আগে তারা অভিশাপ দিয়ে গেলেন – পাণডু আর কোনোদিনও কোন রমণীতে উপগত হতে পারবেন না। হলে নিশ্চিত মৃত্যু।

হতাশ পাণ্ডু রাজধানীতে ফিরে পত্নীদের সবকথা খুলে বললেন। কুন্তী এখন অনেক পরিণত। জীবন তাঁকে অনেক বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শিখিয়েছে। তিনি স্বামীকে বনবাসী হবার পরমর্শ দিলেন। তিনি জানেন রাজমাতা হবার এই একমাত্র পথ। অভিশপ্ত পাণ্ডুর এমনিতেই আর কিছু ভালো লাগছিল না। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে সামনে রেখে রাজ্যের দায়িত্ব নিলেন সেই পিতামহ ভীষ্ম। ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে খুশিই হলেন। কারণ গান্ধারী তখন সন্তানসম্ভবা। তাহলে তাঁর ছেলেই হবে হস্তিনাপুরের রাজা। বেদব্যাস নিজে বর দিয়েছেন তাঁর শতপুত্র হবে। কিন্তু কোন অজানা কারণে এই গর্ভধারণকাল খুবই দীর্ঘ। এদিকে বনে গিয়েই কুন্তী স্বামীকে দুর্বাসার বরের কথা জানালেন। অবশ্যই কর্ণের কথা গোপন করে। উল্লাসিত হয়ে উঠলেন পাণ্ডু। তিনি জানেন ক্ষেত্রজ পুত্র সংসারে স্বীকৃত এবং বৈধ। এমন কি তাঁরা দুভাইও তো......

তিনি কুন্তীকে বললেন একজন সত্যবাক, ন্যায়পরায়ণ এবং সমদৃষ্টিসম্পন্ন দেবতাকে আহ্বান করতে, যাতে ছেলেও একজন মহান রাজার সবগুণ নিয়ে জন্মায়। কুন্তী অনেক ভেবে আহ্বান করলেন ধর্মরাজ যমকে। জন্ম হল দ্বাপরের শ্রেষ্ঠ ধার্মিক পুরুষ যুধিষ্ঠিরের! বনের এ খবর হস্তিনাপুরেও এসে পৌঁছাল। গান্ধারীর তখনও প্রসব হয় নি। মনের দুঃখে তিনি নিজের পেটে আঘাত করে গর্ভপাত করালেন। কিন্তু ব্যাসদেব সেই অপরিণত মাংসখণ্ড ১০১ ভাগে ভাগ করে মাটির হাঁড়িতে রাখলেন।

পাণ্ডু পুত্র পেলেন বটে, কিন্তু তাঁর মন ভরল না। তিনি নিজে দুর্বল, শান্ত ধীর স্বভাবের ছেলেকে পছন্দ হলো না তাঁর। একজন যখন হয়েছে, তখন আরও একজন কেন নয়? তাই বলবান পুত্রের কামনায় কুন্তী এবার আহ্বান করলেন পবনদেবকে। জন্ম হলো ভীমের। সেই সময় একে একে মাটির কলসীতে রাখা মাংসপিণ্ডেরা প্রাণ পেতে আরম্ভ করেছে। প্রথম জন্ম দুর্যোধনের।

পাণ্ডু প্রথমে ভীমকে দেখে খুশি হয়ে উঠলেও শিগগিরই বুঝতে পারলেন এ ছেলে সরল আর গোঁয়ার। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বোঝা তার সাধ্যাতীত। অতএব আবার একবার। বহু চিন্তায় নির্বাচিত হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। অর্জুনকে পেয়ে তুষ্ট হলেন পাণ্ডু। কিন্তু এদিকে কুন্তীকে দেখে মাদ্রীরও মা হবার বাসনা জেগে উঠল। তিনি ধরে পড়লেন পাণ্ডুকে। স্বামীর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না কুন্তী। তিনি মাদ্রীকে একবারের জন্য মন্ত্রদানে সম্মত হলেন। এইখানে মাদ্রী একটা চালাকি করলেন। তিনি স্মরণ করলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে। নকুল ও সহদেব নামে যমজ ছেলে হলো তাঁর। কুন্তী মনে মনে চটলেও তাঁর আর কিছু করার ছিল না।

ছেলেরা একটু বড় হলে মুনি ঋষিদের সঙ্গে পাঁচ ছেলে নিয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলেন কুন্তী। মুনিদের সাক্ষ্যে পঞ্চপাণ্ডবের জন্মবৃত্তান্ত এবং যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হলো। যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব প্রমাণ হবার অর্থ হলো রাজ্যের উত্তরাধিকারের দাবী। এতদি ধরে যে সিংহাসন নিজের বলে জেনে এসেছেন দুর্যোধন, তাঁর পক্ষে এই পরিবর্তন কাম্য নয় মোটেই। তদুপরি তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসজাত, আর পাণ্ডবরা ক্ষেত্রজ। দুর্যোধনের বিচারে তাই কৌন্তেয়রা পাণ্ডব নন। সিংহাসনের দাবী তাঁদের থাকতেই পারে না। এই সময়ে অবশ্য তিনি সুবিধাজনকভাবে ভুলে যান তাঁর পিতার জন্মকথা।

যাই হোক, কুন্তী জানতেন এমনটাই হবে। প্রখর বুদ্ধিশালিনী এই রমণী বললেন – ছেলেরা সবাই তো এখন অনেক ছোট।কাজেই এখন এনিয়ে আন্দোলন করে লাভ নেই। এখন তাঁদের বিদ্যালাভের সময়। রাজা তো এখন ধৃতরাষ্ট্রই। এ ব্যবস্থার কোনও বদলের দাবী তিনি করতে তিনি আসেননি। বরং এই বংশের বাকী পাঁচটি ছেলেকেও শিক্ষার সমান সুযোগ দেবার অনুরোধটুকুই জানাচ্ছেন তিনি।

কুন্তীর এই চমৎকার বুদ্ধিতে সব গোলযোগ থেমে গেল। ফুটফুটে পাঁচটি শিশু এরই মধ্যে তাদের বিনম্র উপস্থিতিতে কুরুবংশের গুরুজনদের মন জয় করে নিয়েছিল। কাজেই তাদের গ্রহণে আর কোন বাধা রইলো না। কুন্তী প্রাসাদের অংশও দাবী করলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় দেবর বিদুরের গৃহে আশ্রয় নিলেন। এইভাবে তিনি শুধু তাঁর নির্লোভ ব্যক্তিত্বই প্রমাণ করলেন না; সন্তানদের নিরাপত্তাও সুনিশ্চিত করলেন। রাজনীতিতে গুপ্তঘাতকের অভাব তো কোনকালেই ছিল না! তিনি জানেন তাঁর দেবাংশী পুত্রেরা বিদ্যায়, পরাক্রমে ও বুদ্ধিতে সবাইকে ছাড়িয়ে উঠবেই। আর সিংহাসন লাভের জন্য সেটাই হবে তুরুপের তাস। আর এই কাজের জন্য প্রয়োজন জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের উপর বাকি চার ভাইয়ের অসীম আনুগত্য। তা এই বোধ তিনি ছোট থেকেই তাদের মধ্যে দৃঢ়প্রোথিত করেছেন। তাঁর জীবনের এখন একটাই লক্ষ্য – সন্তানদের তাদের পিতার সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া। (চলবে)
0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


মিশ্রি পাক 
অনিন্দিতা মণ্ডল 



প্রথম পর্ব 

খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতক। এক বিশাল পালতোলা জাহাজ দামলিপ্তি বা তাম্রলিপ্তি থেকে রওনা হয়ে বঙ্গোপ সাগর ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগরে সিংহল দ্বীপ ছুঁয়ে আফ্রিকার উদ্দেশে। জাহাজের মালিক শ্রেষ্ঠী মণিপাল। অল্প বয়সেই সে বানিজ্যে বড় উন্নতি করেছে। তার জাহাজে আছে উৎকৃষ্ট মসলিন, মশলা, ল্যাপিস লাজুলি, এবং মৃগনাভি কস্তুরী। একেকটি মসলিন আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যায়। কোনও কোনটি সিঁদুর কৌটোর মধ্যে পুরে রাখা যায়। ইয়োরোপের সভ্য সম্পদশালী দুনিয়ায় এ বস্তুর দারুন চাহিদা। প্লিনি তো লিখেই ফেলেছেন, এই প্রাচ্য ভূখণ্ডটি রোম সাম্রাজ্যের সমস্ত সোনা হরণ করেছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ রপ্তানি এরা শুরু করেছে, আর যা সব পণ্য দিয়ে গ্রীক ও রোমক মহিলাদের মন ভোলাচ্ছে, তাইতে এরপরে রোমে আর সোনা অবশিষ্ট থাকবেনা। কিন্তু এই সতর্কবাণীতে কান দেয় কে? শ্রেষ্ঠী মণিপাল সমতটের বিখ্যাত বণিক। গঙ্গাহৃদির চোখের মণি মণিপাল। যদিও আশঙ্কা ছিল যে হয়ত জাহাজ নিয়ে ফিরে আসতে হবে, তবু বেনের ছেলে সমুদ্রে বাণিজ্যতরী না ভাসালে রাতের ঘুম থাকেনা যে। মণিপাল আজ তিন বছর ধরে তার পণ্য নিয়ে আসছেন মিশরে। মিশরের আলেকসান্দ্রিয়ায় ভূমধ্য সাগরের পারে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বিকিকিনির হাট বসে। লেনাদেনা হয়। তবে দূতমুখে মণিপাল শুনেছিলেন রোম সম্রাট নাকি শিগগির আদেশ দিতে চলেছেন যে, গঙ্গাহৃদি থেকে মসলিন আমদানি আর হবেনা। এমন সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতো কাপড়ে দেহ ঢেকে সুন্দরীরা নিজেদের আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলছে। কিন্তু বাংলার স্বাধীনচেতা বণিকেরা কবেই বা এসবে কান দিয়েছে? তাই ভাসল জাহাজ। এবং বহু পথ পেরিয়ে এসে মণিপাল তার পণ্য নিয়ে হাজির হলেন আলেকসান্দ্রিয়ায়। উটের পিঠে মাল নামিয়ে এনে রাখলেন তার নির্দিষ্ট স্থানে। এখানে হাটের মাঝে বেলে পাথরের তৈরি চারপাশ খোলা, বিপণি ঘর আছে। সেসব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বনিকের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। মণিপালের বান্ধব আন্তনি এই বিপণি গুলোর ভাড়া তোলে। রোম সাম্রাজ্যের খাজনা আদায় করে। তারই হেপাজতে মণিপালের জিনিসপত্র থাকে। আর সরাইখানাটিও আন্তনির। সেখানে মণিপালের ও তার সঙ্গে আসা আরও বন্ধু বণিক এবং কর্মচারীদেরও জায়গা মেলে। মণিপালের জাহাজে তার নিজের পণ্য ছাড়াও অন্য বণিকদের পণ্য এসেছে। অত বড় জাহাজের খোলে তার একার পণ্যই বা থাকবে কেন? অতএব বেশ কটি প্রায় সমবয়স্ক বেনের পো এসেছেন আলেকসান্দ্রিয়ায় বাণিজ্য করতে। 

আলেকসান্দ্রিয়ায় বাজার বসে বিকেল থেকে। রাত পর্যন্ত দীপালোকে চলে বিকিকিনি। নানা রকমের ক্রেতা বিক্রেতার শোরগোলে প্রান্তর ভরে থাকে। এইসব বেচাকেনার ফাঁকে ভিনদেশী বণিকদের মনোরঞ্জনের জন্য সরাইয়ের মালিকরা লাস্যময়ী রমণীদের হাটে ঘোরাফেরা করতে দেন। এতদিন ধরে ঘর ছেড়ে থাকতে হলে এরকম আমোদের ব্যবস্থা না থাকলে যে মারা পড়তে হবে! মণিপাল অবশ্য এইসব রমনীদের দিকে চোখ দেন না। তার দেশে নগরনটী আছেন। তাঁদের সামাজিক স্থান উচ্চে। সে এরকম প্রগলভ রূপোপজীবিনী দের সাহচর্য এড়িয়ে এসেছে এতকাল। সেদিন ভূমধ্য সাগরের পার থেকে সুন্দর হাওয়া উঠেছে। মণিপালের বিপণিতে এক রোমক ক্রেতা এসেছেন যিনি পাইকারী হারে মসলিন নিতে চান। রোমকরা এমনিতেই বড্ড দাম্ভিক। ঠিক সেই সময়ে এক কাজলনয়নী বাদামি ত্বকের সুন্দরী কন্যা বিপনির সামনে এসে উদ্দেশ্যহীন দাঁড়াল। মণিপালের বুক কি জানি কেন কেঁপে উঠল। রোমকটি মণিপালের উদাসীন ভাব দেখে মনে করল সে হয়ত মূল্য বাড়ানোর জন্য এমন ভাব দেখাচ্ছে। সে তখন সে স্থান ত্যাগ করে চলে গেল। এদিকে মণিপাল সেই সুন্দরীর দিকে চেয়ে মুগ্ধ। কিন্তু এ কিরকম আচার? সুন্দরী কিছু না বলেই তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে চলে গেল। শরবিদ্ধ হরিণের মতো বেদনাকাতর মণিপাল বিপণির পাথরের থামে হেলান দিয়ে বসে আছেন, এমন সময়ে আন্তনি এসে চিৎকার জুড়ে দিল। ‘তুমি কি পাগল? অ্যাঁ? বলি অমন শাঁসালো খদ্দের, আর তুমি কিনা স্বপ্নের দুনিয়ায়?’ মণিপাল দুর্বল স্বরে হাত তুলে দেখিয়ে বলল – ও কে? আন্তনি মাথায় হাত দিয়ে বসে তার নিজের ভাষায় প্রথমে বিড়বিড় করল খানিক। তারপর মণিপালের দিকে চেয়ে রাগত স্বরে বলল – তবে যে বল তোমার সুন্দরী ভালো লাগেনা? মণিপাল ওরকমই দুর্বল স্বরে বলল – এ যে অন্যরকম। এই কন্যা তার মনোহরণ করেছে। কিন্তু ভিন দেশে এভাবে তো প্রেম নিবেদন করা যায়না, অগত্যা আন্তনিই গতি। আন্তনি হতাশ ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে মণিপালের কাঁধে হাত রেখে বলল – তুমি যে বন্ধু একেবারে ক্লিওপাত্রার নাতনিকে মন দিয়ে ফেলেছ! এখন কি করি? মণিপালও হতবাক। ক্লিওপাত্রার নাতনি? সখা বিগলিত হেসে বলল – আরে না না। ঠাট্টা করছিলুম। তবে কিনা সিস্তানার ঠাকুমা সেবা বড় রাগী। নিজেকে কি যেন মনে করে। সেবা? মণিপাল বুঝতে পারছেন না আন্তনি ঠাট্টা করছেন কিনা। সেবা, সেবাবতী তো তাঁদের দেশের মেয়েদের নাম! এবারে কিন্তু আন্তনি হাসলনা। বলল আচ্ছা সবুর করো দেখি। দেখি কি করা যায়। চিন্তায় ফেললে তুমি। 

পরদিন দিনের বেলায়, যখন রোদ্দুরে ক্লান্ত হাট দিবানিদ্রা দিচ্ছে, তখন আন্তনি এসে তাকে সরাইয়ের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর মণিপালকে নিয়ে রওনা দিলো উত্তরপূবের রাখোটিসের খাঁটি মিশরীয় পল্লীর দিকে। সে থাকে রাখোটিস আর ব্রুসামের মাঝামাঝি এক পল্লীতে। সেখানে গ্রীক রোমক ও মিশরীয়দের মিশ্র প্রজাতির বাস। খাঁটি মিশরীয় সে নয়। কিন্তু যার প্রেমে মণিপাল পড়েছে সে খাঁটি মিশরীয়। সত্যি সত্যিই ভূমধ্য সাগরের পারে সেই পল্লীর মধ্যে হলুদ পাথরের বাড়ি গুলোর মাঝে সিস্তানাকে দেখতে পাওয়া গেলো। সে তখন পেছনের ক্ষেতে কি সব শাকপাতা তুলছে। মণিপালের মনে পড়ে গেলো বাংলার মাঠঘাট, জলে ভরা দীঘি নদী, সবুজ ক্ষেত। তাদেরও পাকশালে এমন করে শাকপাতা রান্না হয়। আহা, এ যেন সেই সমতট থেকে আরেক সাগর তটে নদীর মোহনা দ্বীপে এসে পড়েছে সে। তার ধ্যান ভাঙিয়ে দিয়ে এদিকে আন্তনি তার কানের গোড়ায় মুখ এনে বলতে লাগল – এমন হাঁ করে দেখতে থাকলে সিংহীর মুখে একা যাও। আমার কম্ম নয় তোমায় বাঁচাই। কাজ নিকেশ হলে অমন অনেক সময় পাবে দেখবার। অগত্যা সিস্তানাকে দৃষ্টিপথের বাইরে রেখে তারা দুজনে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল একটি উঠোনে। আন্তনি আবার সাবধান করে দিলো – সখা মুখটি বন্ধ রেখো কিন্তু। যা বলার আমি বলব। সেবা ঠাকুমা বড়ই উগ্রচণ্ডা। ক্লিওপাত্রার মতোই দেবী আইসিসের পুজো আচ্চা করে। আর এক অপূর্ব সুখাদ্য তয়ের করে। তার হাতের সেই বস্তুটি অমৃত। এমন পাক এ তল্লাটে কেউ করতে পারেনা। মণিপাল বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়ল। সমতটের কেউ যদি তাকে এভাবে দেখে তবে সেই সম্পন্ন বণিক মণিপালকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। এ কি হীন ভাবসাব! কিন্তু প্রেমে পড়লে এমন হয়।