0

সম্পাদকীয়

Posted in



শরৎ এসেছে। কাশফুলও। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার ছবিও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে প্রতিবছর এইসময় বঙ্গবাসীর হৃদয়কে যা উদ্বেল করে, সেই আগমনীর সুর কি বেজেছে? এসেছে পুজোর গন্ধ? অতিমারীর তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা এখনও কেটে যায়নি। এ অবস্থায় বার্ষিক এই মহোৎসবের আয়োজন অনেকটাই সাবধানী আর তা সঙ্গত কারণেই। তবু তো আসন্ন শারদোৎসব। এই চারটে দিনের অপেক্ষায় কাটে প্রায় বারোটা মাস! অঞ্জলী ভরে দেবীর পায়ে অর্ঘ্য দেবার সময় আগামী এক বছর ভালো থাকার বর চেয়ে নেবো আমরা আবারও। কিন্তু গত দুবছরে বদলে যাওয়া সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে ভালো থাকা এবং ভালো রাখা সমার্থক হয়ে উঠেছে। দরকার হয়ে পড়েছে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার। একে অপরের হাত ধরে রাখার।

শারদ শুভেচ্ছা সকলকে।

ভালো থাকুন।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমৃত অধিকারী

Posted in





হিংসা প্রবৃত্তিটা যে অন্যান্য সব প্রাণীর মতোই মানুষ নামক দ্বিপদ স্তন্যপায়ীটিরও অন্তর্গত রক্তের ভিতর নিরন্তর খেলা করে, সে কথা প্রমাণ করতে মনোবিজ্ঞানী থেকে আরম্ভ করে জীনবিশারদ অবধি, কেউ কোনও কসুর করেননি। বিবর্তনের পথে প্রতিযোগীদের পিছনে ফেলে এতখানি এগিয়ে আসার পরেও যে তার সেই প্রবৃত্তির নিরসন ঘটেনি, সে কথাও স্বতঃসিদ্ধ। সমাজব্যবস্থার চাপে পড়ে খানিকটা হয়তো অবদমিত হয়েছে, কিন্তু যখন সেই চাপ কাটিয়ে লাফ মেরে বেরিয়ে আসে, তখন তাকে দেখে কে বলবে যে এই প্রাণীটিই হাজার হাজার বছর ধরে শান্তি-সৌহার্দ্যের কথা বলে বসুধা জুড়ে কুটুম্বিতা স্থাপন করার চেষ্টা করে চলেছে!

সিগমন্ড ফ্রয়েডের কূটকচালির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা এ বিষয়টা জানেন। ফ্রয়েড বলেছিলেন, থ্যানাটোস (Thanatos) হলো আমাদের অন্তর্গত সেই প্রবৃত্তি, যা আমাদের আত্মধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। তবে কেন আমরা সবাই পটাপট আত্মহত্যা করে ফেলি না? সেরকমটা হলে তো আজ আর জনসংখ্যাস্ফীতি নিয়ে জাতির জ্যাঠামশাইদের এত ব্যতিব্যস্ত হতে হতো না। ফ্রয়েড বলছেন, সেখানে বাধ সাধে ইরস (Eros), অর্থাৎ আমাদের অন্তর্লীন বেঁচে থাকার ইচ্ছা। এই দুই প্রবৃত্তির সংঘাতে যে ইরসই সাধারণত জয়ী হয়, বলা বাহুল্য। তারপরেও অবশ্য একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সহজাত ধ্বংসকামিতা আমাদের নিরন্তর হিংসা, পরস্পর হানাহানির পথে চালিত করে না কেন? প্রাণীজগতে তো সেরকমই হয়। তার উত্তরও ফ্রয়েড সাহেব দিয়েছেন। তাকে বলে ক্যাথারসিস (Catharsis), যা কিনা অল্প রাগারাগি করে বা নিছক কোনও হিংসাত্মক ঘটনা দেখে জিঘাংসা নিবারণের নামান্তর... যা থেকে প্রমাণ হয়, সলমান খানের ছবিরও একটা শুভঙ্কর দিক আছে!

সে যাই হোক, এখন বিষয়টা হলো এই যে, সিগমন্ড ফ্রয়েডের এই থ্যানাটোস, যা কিনা নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিংসাপ্রবৃত্তি, তাকে তো সামাজিক নিয়মকানুন দিয়ে যা হোক করে চেপেচুপে রাখা যায়। নিতান্তই ঠেলে বেরোলে রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে ঠেঙিয়ে ঠাণ্ডাও করা যায়। কিন্তু সেই রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন হিংসাকে মূলধন করে ব্যবসায় নেমে পড়ে, তখন আমার-আপনার মতন ছাপোষাদের কি কর্তব্য?

ব্যাপারটা আমাদের কারওরই সম্পূর্ণ অজানা নয়। একটু অস্বস্তিকর, তাই আমরা, মানে অধিকাংশ ছাপোষারা, বিষয়টা থেকে আমাদের শান্তিপ্রিয় মনকে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করি। আরে, আমাদের ঘরে তো আর ঘটছে না ওসব! কি লাভ খামোখা ওসব নিয়ে ভেবে? সলমান খান না পোষালেও হলিউড তো আছেই আঙুলের ডগায়, নির্ঝঞ্ঝাট চিন্তার অপর্যাপ্ত খোরাক জোগানোর জন্য। আপাত-স্থিতিশীল একটা আর্থসামাজিক বাতাবরণের ঘেরাটোপে ড্রয়িং রূমের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে মাঝে মাঝে চ্যানেল পাল্টে নিউজ় আপডেট নেওয়া... এই তো বিশ্বনাগরিকের দায়িত্ব। আর কিই বা করার আছে আমাদের?

করার কিছু না থাকলেও, ভাবা যেতেই পারে। তবে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গেলে একটু আগে থেকে শুরু করতে হবে। বেশি না, গোটা পঁচাত্তর বছর। সুমহান ইওরোপীয় সভ্যতার অন্যতম ধ্বজাধারী একটি দেশের মহত্তর নেতৃত্ব তখন একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের পাইকারি হারে গ্যাস চেম্বারে ঢোকাচ্ছে আর এক এক করে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর মহাবিক্রমে চড়াও হচ্ছে। এমন কি সেই ধুন্ধুমার কাণ্ডের গোটা দুয়েক স্যাঙাৎও জুটিয়ে ফেলেছে! শেষমেষ একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে তাদের কোনওক্রমে ঠেকানোও গেলো। সেই অত্যাচারিত, হতপ্রায় জনগোষ্ঠীটির পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও হলো সদ্ধর্মের অনুশাসন মেনে পৌরাণিক প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের একটি ভূখণ্ড অধিগ্রহণ করে। সারা বিশ্বের ছাপোষারা ছলোছলো সমবেদনায় ভাবলো, আহা রে! বেচারাদের যা হোক একটা হিল্লে তো হলো! বিষয়টা নিয়ে এখন ভাবলে কেমন যেন মনে হয় না, যদি চট্টগ্রাম বা শ্রীহট্ট অধিগ্রহণ করে কাশ্মীর থেকে উৎখাত হওয়া পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হতো, তবে কেমন হতো? জায়গাগুলোর নাম শুনেই তো বোঝা যায় যে পুরাকালে সেখানে বৈদিক আর্যদেরই... সে যাক গে! স্বপ্নবিলাস করে লাভ নেই। ঘটনা হলো এই যে, সেই গোটা ব্যাপারটা সারা বিশ্বের জাতির জ্যাঠামশাইদের ধুদ্ধুরি নাড়িয়ে দিলো। তাই তো! যথোচিত শক্তিবৃদ্ধি করতে পারলে এমন কাণ্ড তো যে কেউ করতে পারে... অর্থাৎ, রাতারাতি পাশের দেশের ঘাড়ে চেপে বসে বলতে পারে, অ্যাইও! কাল থেকে সব ট্যাক্সো আমায় দেবে, কারণ আমার গায়ে জোর বেশি। এরকমটা তো হতে দেওয়া যায় না! কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হয়!

ব্যবস্থা নেওয়াও হলো। এতদিনের নির্বিষ ঢোঁড়া League of Nations মহানাগ রাষ্ট্রসঙ্ঘের রূপ ধারণ করে বিশ্বরাজনীতির মাথার উপর ছাতা মেলে ধরলো। এই ব্যবস্থারই ভৌগোলিক অর্থে একটু সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ ভারতবর্ষ পেয়ে গেলো তার স্বাধীনতার পড়ে পাওয়া বাকি ছ’ আনা। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। এখানে কথা হলো, রাষ্ট্রসঙ্ঘ তৈরি হওয়ার তাৎক্ষণিক যে ফলটি ফললো, সে হলো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অন্তত কাগজেকলমে ইতি। কিন্তু সভ্যতার সেই জয়ধ্বনি সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তার আরেকটি ফলশ্রূতি জ্যাঠামশাইদের সামনে প্রকট হয়ে দাঁড়ালো। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশ্বসৌহার্দ্যের পরিবেশে আগ্রাসন নেই, আর আগ্রাসন নেই মানে শত্রুও নেই। শত্রু না থাকলে যুদ্ধটা হবে কার সঙ্গে? এই যে এত কাঠখড় পুড়িয়ে, এতগুলো বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এত অস্ত্রশস্ত্র, এরকম নিশ্ছিদ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হলো, সেগুলোর এবার কি হবে? পড়ে পড়ে জং ধরবে?

সেরকম তো হতে দেওয়া যায় না। বিনিয়োগের দিকটাও তো ভাবতে হবে! মানবসভ্যতা এর আগে কোনওদিন এই পর্যায়ের বিনিয়োগ দেখেইনি! তো, সেই বাজারটাই যদি আর না থাকে তাহলে এই বিনিয়োগের হবে কি? সুতরাং, আশু কর্তব্য, যুদ্ধের একটা নতুন বাজার তৈরি করা। ব্যাপারটা প্রাথমিক পর্যায়ে খুব কঠিনও হলো না। ডান-বাঁয়ের তাত্ত্বিক লড়াই তদ্দিনে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে রাজনৈতিক বিশ্বের দু’প্রান্তে। এমনকি অরাজনৈতিক বিশ্বের ছাপোষারাও বেশ সুবিধাজনকভাবে দু’পক্ষে বিভক্ত। চায়ের পেয়ালাতে নিয়মিত তুফান উঠছে। আর সব চাইতে বড় সুবিধার বিষয়টা হলো, যে যুদ্ধটা আদপে করতেই হবে না, শুধু তাল ঠুকে, পাঁয়তারা কষে মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়লেই হবে, তার থেকে বেশি বিক্রয়যোগ্য আর কি আছে? তাই শুরু হয়ে গেলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠাণ্ডা যুদ্ধ। চার দশকব্যাপী সেই রোমহর্ষক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় অস্ত্র এবং আরও হরেক রকম যুদ্ধসরঞ্জামের পাশাপাশি সংযোগ মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম, বইপত্র থেকে নিয়ে সিনেমা পর্যন্ত আরও কত শত ব্যবসা যে কত হাজার কোটি টাকার মুনাফা লুটলো, সে সব আমাদের মতন ছাপোষাদের যৎসামান্য বিষয়বুদ্ধির অগোচর। আমরা শুধু দেখলাম, স্যাম চাচার ধনতন্ত্রের সঙ্গে চোখ-রাঙানি আর হুমকি-হুমকি খেলতে খেলতে সুমহান সমাজতন্ত্র একসময় হুমড়ি খেয়ে পড়লো... আর সেই সঙ্গে তৎকালীন পৃথিবীর সব থেকে বড় show biz সেই Cold War-এরও ইতি!

বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা আমাদের জন্য যতখানি আকস্মিক ছিলো, জ্যাঠামশাইদের জন্য ততখানি ছিলো না। তাঁদের শ্যেণদৃষ্টি সর্বকালে, সর্বত্র, সর্বদা নিবদ্ধ। তাঁরা অনেকদিন আগেই বুঝেছিলেন, সমাজতন্ত্রের ভিত টলমল করছে। তাই তাঁরা অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতিটা ছিলো বড় মজাদার ব্যাপার। আমাদের চোখের সামনে, প্রায় নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে হয়েছে, কিন্তু আমরা দেখতে পাইনি। কারণ, আমাদের মুখ ঘোরানো ছিলো ধর্মের দিকে। ধার্মিকদের কথা বলছি না। তাঁদের মুখ চিরকালই ধর্মের দিকে ঘোরানো, এবং শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদেরটি ছাড়া আর বাদবাকি সব ধর্মের অপসারণ ঘটলেই যে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে – তাঁদের এই বদ্ধমূল বিশ্বাসও ঈর্ষনীয়। কিন্তু তাঁদেরই প্রতিবেশী আমাদের মতন কতিপয় আক্ষরিক অর্থে ধর্মভীরুও তো আছে, ধর্মসংক্রান্ত কোনও কিছু দেখলেই যাদের ভয়ে পালাতে ইচ্ছে করে! সেই আমাদের কথা বলছিলাম, আর কি। আমাদের মুখও ধর্মের দিকেই ঘোরানো ছিলো। বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমরা ভাবছিলাম, সেই ধর্মের জন্যই যদি এখনও মরতে হয়, মারতে হয়, তাহলে সভ্যতার পথে অ্যাদ্দূর এগিয়ে লাভটা কি হলো? আমরা বুঝিনি, ধর্মের ঘেরাটোপের আড়ালে সযত্নে তৈরি হচ্ছিলো মানবতার নতুন শত্রু। সেই শত্রুর নাম – ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ।

সত্তরের দশক পর্যন্ত মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই কারও কারও? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফুটন্ত কড়াই থেকে নিরাপদ দূরত্বে তাদের দিন কাটছিলো। ধর্ম ছিলো, কিন্তু তার চোখ-রাঙানি ছিলো না। সামাজিক বিধিনিষেধও ছিলো, কিন্তু তখনও তারা মনুষ্যত্বের গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসেনি। কিন্তু ফাঁসের গিঁঠ বাঁধা হচ্ছিলো ধীরে ধীরে। সেই ফাঁসে প্রথম টান পড়লো আশির দশকের গোড়ায়, যখন প্রাচীন পারস্যের দুই বংশধর দেশ মধ্যপ্রাচ্যের আর্থসামরিক প্রাধান্য লাভের জন্য প্রকাশ্যে দাঁত নখ বার করলো। সেই কামড়াকামড়িতে একদিকে যেমন প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিলো স্যাম চাচার ধনতন্ত্রের, অন্যদিকে তেমনি উষ্ণ উস্কানি ছিলো সুমহান সমাজতন্ত্রের। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, যে সাম্যবাদী সমাজতন্ত্র অ্যাদ্দিন ধর্মের টিকিটি দেখতে পেলেই রক্তচক্ষু হয়ে উঠতো, কেমন নির্বিকারে সে সেই ধর্মকেই কাজে লাগিয়ে ফেললো ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে। আমরা পুলকিত হয়ে উপলব্ধি করলাম, একটা গোলাকৃতি গ্রহের বাম আর ডান প্রান্ত দু’টো কি বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি... এমন কি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমাপতিত!

তারপর একসময় পশ্চিম এশিয়ার এক কোণে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো... আর সমাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সে আগুন দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়লো সারা মহাদেশের দক্ষিণপশ্চিম অংশ জুড়ে। আমাদের কানে আসতে লাগলো এক এক করে মুজাহিদিন, তালিবানের মতন কিছু অশ্রূতপূর্ব নাম। তারপর একদিন শুরু হলো আমাদের মহান দেশের ইতিহাস পুনর্লিখন। মহোল্লাসে ভাঙা হলো এক বিদেশী আক্রমণকারীর তৈরি মাত্র সাড়ে চারশো বছরের অর্বাচীন সৌধ... আর আমরাও আমাদের জনগণমন ভাগ্যবিধাতার একটি মোক্ষম চালে হয়ে পড়লাম সেই যুদ্ধখেলার প্রস্তুতির শরিক!

তারপরের ইতিহাস কারও মনে না থাকার কথা নয়। গণমাধ্যমের সৌজন্যে গত শতাব্দীর শেষ থেকেই পৃথিবীটা ছোটো হতে হতে প্রথমে বোকা বাক্সতে, আর তারপর আমাদের হাতের মুঠোতে বন্দী হয়ে গেছে। জাতির জ্যাঠামশাইরা আমাদের যা দেখাতে চান, সে সব কিছু আমরা এখন অবলীলায় দেখতে পাই... আর, যে মানুষ ঐশ্বর্য্য দেখতে পায়, অথচ তার নাগাল পায় না, কেন পাচ্ছে না সেটাও ঠিক করে বুঝতে পারে না, তার নিষ্ফলা ক্রোধের থেকে বড় অস্ত্র রাজনীতির জন্য আর কিছু নেই। এবং, সেই অস্ত্রে অগ্নিসংযোগ করার জন্য ধর্ম-বর্ণ-জাতিবিদ্বেষের থেকে বড় ইন্ধনও আর কিছু নেই। সম্প্রদায়-বিদ্বেষ ব্যাপারটাই রাজনীতির জন্য সবিশেষ সুবিধাজনক। একটা জাতি বা সম্প্রদায়ের হীনম্মন্যতাকে, বিপন্নতাবোধকে বিদ্বেষে রূপান্তরিত করতে পারলেই কেল্লা ফতে। বস্তুত, কাজটা অর্দ্ধেক হয়েই থাকে। আর বাকিটুকু অবলীলায় করে দেওয়ার জন্য তো এখন গণমাধ্যম আছেই। কত রকমের ভয়... অমুক সম্প্রদায় বিপজ্জনকভাবে সংখ্যায় বাড়ছে এবং দেশের সমস্ত আর্থসামাজিক সমস্যার মূলে তাদের সেই সংখ্যাবৃদ্ধি, তমুক দেশ সন্দেহজনকভাবে শক্তিবৃদ্ধি করছে এবং যে কোনও সময় আক্রমণ করে বসতে পারে, দেশদ্রোহী দিগ্গজগুলো দশকের পর দশক ধরে ভুল ইতিহাস পড়িয়ে আসছে, যাতে কেউ কোনওদিন জানতে না পারে এই দেশের মানুষ কি মহদাশয় মহাবীর ছিলো, ইত্যাদি, ইত্যাদি! আমরা ছাপোষারা একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবনযাপনে ক্লান্ত হয়ে এইসব ভয় নিয়ে চায়ের পেয়ালায় বা মদের গেলাসে তুফান তুলি, পাঁচ বছরে একবার করে উজ্জ্বল মুখে ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াই, আর জ্যাঠামশাইরা মুচকি হাসতে হাসতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে থাকেন। সেই সব মহাজাগতিক অঙ্কের অর্থ দিয়ে কি কেনা হয়, কেন কেনা হয়, আদৌ কিছু কেনা হয় কিনা, সে সব আমরা ছাপোষারা কোনওদিন জানতেই পারি না, কারণ সে সব রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বিষয়। আমরা শুধু নিশ্চিন্ত থাকি এই ভেবে যে জ্যাঠামশাইরা আমাদের যথাসম্ভব নিরাপদে রাখছেন।

এই যে সেদিন আমাদের সবার সব থেকে বড় জ্যাঠামশাই ব্যাজার মুখে বিশ্ববাসীকে জানালেন যে, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং তাদের প্রয়োগকৌশলে প্রশিক্ষিত, দস্তুর মতন একটি বিমানবাহিনী এবং তিন লক্ষাধিক লোকবল সম্পন্ন আমাদের পড়শী দেশের সেনাবাহিনী নাকি এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণকারীদের, যাদের একটি বিমান পর্যন্ত নেই, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেই রাজি নয়! শুনে আমরা তো আমরা, তাবড় তাবড় গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত হো হো করে হেসে উঠলেন। এত ভীরুও হয় কোনও সেনাবাহিনী? তাও আবার মাথার উপর বড় জ্যাঠামশাইয়ের অভয়হস্ত থাকা সত্ত্বেও? ঠিক হয়েছে তাহলে। এরকমই হওয়া উচিত! বেশ করেছে জ্যাঠামশাইয়ের লক্ষ্মীসেনারা ব্যাটাদের ছেড়ে চলে গিয়ে।

কিন্তু মজার বিষয় হলো, আমরা কেউ কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করলাম না, ওদের এত প্রশিক্ষিত, এমন সমৃদ্ধ সেনাবাহিনী পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্য নিয়েও একটা সন্ত্রাসবাদী বাহিনীর মোকাবিলা করতে চাইছে না কেন? ওদেশের মানুষদের তো কোনওদিন কাপুরুষতার দুর্নাম ছিলো না। বরং চিরকাল তো উল্টোটাই শুনে এসেছি। তাহলে?

তাহলে একটাই ব্যাখ্যা হয়। সেনাবাহিনীর উপর সেইরকমই নির্দেশ আছে। অর্থাৎ, এই আগ্রাসনের কোনওরকম প্রতিরোধ না করাটাই তাদের বিধেয়। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধব্যবসার পরিপন্থী বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আবার একটু পিছিয়ে ভাবুন, এবং এবার কোনওরকম রাখঢাক গুড়গুড় না করেই ভাবুন। আশির দশকের আফগানিস্তানে সোভিয়েত প্রভাব... সেই প্রভাব খণ্ডন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরন্তর প্রচেষ্টা... রোনাল্ড রেগনের মুজাহিদিন-সমর্থন নীতি... সোভিয়েত রাশিয়ার পতন... মুজাহিদিনের দানব হয়ে ওঠা... এবার তাকে দমন করার জন্য তালিবানের ক্ষমতায়ন... মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-দানব ওসামা বিন লাদেনের আত্মপ্রকাশ... গোটা নব্বইয়ের দশক জুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস... ৯/১১/২০০১... মার্কিনবাহিনীর আফগানিস্তান আক্রমণ... তালিবানের পতন। বেশ একটা সযত্ন-পরিকল্পিত নকশা দেখতে পাওয়া যায় না?

এইবার একটু এগিয়ে ভাবুন। মানে বছর দশক পরের কথা, আর কি। অতখানি সময় এই দফায় নাও লাগতে পারে যদিও। এই যে আজকের এই তালিবান ২.০ কি সুন্দর ভদ্র, মার্জিত আচরণ করছে, মুগুর হাতে কি মিষ্টি করে ‘ভয় পেও না, ভয় পেও না, তোমায় আমি মারবো না’ বলছে, জ্যাঠামশাইদের প্রশংসা পাচ্ছে, সমর্থন পর্যন্ত পাচ্ছে... এর মধ্যেও কেমন একটা পরিকল্পিত নকশার আভাস দেখা যাচ্ছে না? আরে, দানব মারার অস্ত্র দিয়ে কি বামন মারা উচিত? সেটা উলুবনে মুক্তো ছড়ানো হয় না? কিন্তু সমস্যা হলো, দানব মারার অস্ত্র প্রয়োগ করার জন্য তো দানব চাই! তাই, বামনকে দানব হয়ে ওঠার সময় দিতে হবে। তারপর হবে আসল খেলা। তদ্দিন আমরা ছাপোষারা জুলজুল করে দেখবো। যারা একটু সংবেদনশীল, তারা জাতি-বর্ণ-ধর্মকে গালাগাল দেবো, আর নিজেদের অজান্তেই আরও, আরও জড়িয়ে যেতে থাকবো জ্যাঠামশাইদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়।

Long live war! যুদ্ধং দেহি!

0 comments:

1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়






















সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার সময় পর্যন্ত বাংলার বুকে যে সকল জমিদার তথা রাজপরিবারগুলির উত্থান-পতন ও রাজ্য পরিচালনার কাহিনি শোনা যায় বর্ধমান রাজপরিবার নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম। জমিদারির আয়তন ছিল প্রায় পাঁচহাজার বর্গমাইল জুড়ে। বর্ধমান ছাড়া বাঁকুড়া, মেদিনীপুর,হাওড়া, হুগলী ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অঞ্চল ছিল এই জমিদারির অন্তর্গত। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্ধমান রাজবংশ দ্বারা শাসিত এই অঞ্চলটি কিন্তু স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য ছিল না। সেই সময় বাংলায় ত্রিপুরা ও কোচবিহার ছাড়া আর কোন রাজ্য স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত ছিল না। তৎসত্ত্বেও আয়তন, মান-মর্যাদা, রাজকীয় বৈভব, দান-ধ্যান, এবং বৃহত্তম করদাতাদের অন্যতম বলে বর্ধমান রাজপরিবারটি বাংলার অন্যতম রাজবংশ রূপে চিহ্নিত এবং রাজা নামে খ্যাত।
.
সম্রাট আকবরের সময় সুদূর পঞ্জাব থেকে আগত এই বস্ত্র ব্যবসায়ী পরিবারটি বর্ধমানে এসে ব্যবসার সুবাদে বসবাস শুরু করেন ও ক্রমে নবাবের নেকনজরে আসেন। ক্রমশঃ স্বীয় বুদ্ধি ও পরিশ্রমের বলে বংশানুক্রমে উন্নতি ও রাজা হওয়া এক ইতিহাসে পরিণত হয় যা বর্তমানে অনুসন্ধান এবং গবেষণার বিষয়রূপে বহু আলোচিত, বহু চর্চিত।
এই রাজবংশটির তিনশ বছরের রাজত্বকালে রাজত্ব করে গেছেন প্রায় কুড়িজন রাজা বা জমিদার(সতেরো-আঠারো পুরুষ ধরে)। এইসব রাজপুরুষদের নাম-ধাম, বংশমর্যাদা, কার্যকলাপ, রাজ্যশাসন, দান- ধ্যান-মহিমা, নির্মাণের নানান কাহিনি নানাভাবে নানা জায়গায় বর্ণিত, লিখিত, আলোচিত। কিন্তু রাজপরিবারের মহিলাদের মধ্যে কয়েকজন রমণীমাত্র ব্যতিরেকে রাজপরিবারের অন্তঃপুরবাসিনীরা রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। জনমানসে প্রতিবিম্বিত এই কয়েকজন রমণী ছাড়াও এই বিরাট রাজমহলে ছিলেন অনেক মহিষী, অনেক রাজকন্যা, রাজপুরনারীরা যাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষমতা রাখতেন বিদ্যা ও বুদ্ধির। এদের মধ্যে কেউ কেউ বেছে নিতে পেরেছিলেন স্বাধীন মুক্ত জীবন, কেউ বা পেরেছিলেন নিজেকে সম্পুর্ণরূপে ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করতে। আবার কেউ বা চার দেওয়ালের মধ্যেই কাটিয়েছেন রাজঅন্তঃপুরিকার জীবন।
.
একদা বাংলার বিখ্যাত এই পরিবারটির সঙ্গে সুদূর পঞ্জাব থেকে শুরু করে স্থানীয় অনেক নারীর ভাগ্যই যুক্ত হয়েছিল বিবাহ সূত্রে। রাজপরিবারের উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল তাঁদের ভাগ্য। রাজপরিবারের সঙ্গে সঙ্গে এঁদেরও কারো কারো জীবনে নেমে এসেছিল ভাগ্যের বিড়ম্বনা, কারো হয়েছিল ভাগ্য পরিবর্তন, কারো বা জীবন নির্ধারিত হয়েছিল অন্য পথে। আবার কেউ কেউ তা কাটিয়ে ঊঠে প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজপরিবারের সৌভাগ্য। কারো কারো দান-মহিমার কারণে গড়ে উঠেছে মন্দির, দেবালয়, অতিথিশালা। আবার কোনো সুচতুরা নারীর চাতুর্য্যে রাজপরিবারের কোনো ব্যক্তিজীবনে নেমে এসেছিল বিড়ম্বনা। কোন রমণীর ত্যাগ, তিতিক্ষার কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজপরিবারের মহিমা, আবার কখনও বা তার বিপরীত খেলা।
.
রাজপুরুষদের খ্যাতির মহিমা কীর্তন করা হলেও আড়ালে রয়ে গেছে সেই সব নারীদের জীবনের ইতিহাস যা কোন না কোনভাবে যুক্ত হয়ে আছে রাজপরিবারের কাহিনির সঙ্গে। কেমন ছিল সেইসব নারীদের জীবন? কেমন ভাবেই বা লালিত-পালিত হত সেইসব রাজকুমারীদের শৈশব, তাঁদের বিবাহিত জীবন? কিভাবে কাটত সেই রাজবাড়ির দিনগুলি? বিখ্যাত এই রাজপরিবারটিকে ঘিরে অনেক কৌতুহল, অনেক জিজ্ঞাসা। নানান গল্পগাথা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। প্রকাশিত হয়েছে অনেক তথ্য, আবার আড়ালেও রয়ে গেছে অনেক। প্রায় বছর পাঁচেক আগে সুযোগ হয়েছিল এই পরিবারের কনিষ্ঠ মহারাজকুমারের সঙ্গে সেদিনের সেইসব দিন ও সেইসব নারীদের নিয়ে কথা বলার। এই রচনা সেই কথা বলার, আলোচনার ফসল মাত্র।
বর্ধমান রাজপরিবারের কনিষ্ঠ মহারাজকুমার শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাব প্রায় প্রতিবছরই দূর্গাপূজার সময় তিনি বর্ধমানে আসেন। বর্ধমান রাজপরিবারের পটের দূর্গাপূজার কথা হয়তো অনেকেরই জানা আছে। কনিষ্ঠ মহারাজকুমারের নিজস্ব উপস্থিতিতে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর বোধন, অষ্টমীতে কুমারী পূজা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এবং এই সময়ে কয়েকদিন তাঁর সঙ্গে কথাবলার মতো সময় তিনি আমায় দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে রাজপরিবারের এই দিকটি নিয়ে আলোচনার পরেই এবং অনুমতিক্রমেই বর্ধমান রাজঅন্তঃপুরের রমণীদের নিয়ে আমি লিখতে প্রবৃত্ত হই। আলোচনার সূত্র ধরেই উঠে এসেছে অনেক অজানা কাহিনি, অনেক তথ্য যেখানে রাজকীয় বৈভব, সম্মান আর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের আড়ালে রয়েছে সাধারণ মানুষের মত চাওয়া-পাওয়া। যেখানে কঠোর শৃঙ্খলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে মাতৃত্বের আস্বাদ। কখনো বা আত্মাভিমান ও অহংকারের আড়ালে লুকিয়ে ছিল স্নেহ, প্রেম ও ত্যাগের সুকুমারবৃত্তি, আবার কখনো বা প্রকাশিত হয়েছে লোভী কুটিল চরিত্র। বর্ধমান রাজপরিবারের নারীদের মধ্যে ছিল এই সকল রকমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সকল রকম নারীদের মিলমিশ নিয়ে এক অন্দরমহল যার কিছুটা আঁচ হয়তো আমরা পেতে পারি এই রচনার মধ্য দিয়ে। কেমন ছিলেন সেইসব নারীরা, তাঁরা কারা...? সেই আলোচনাই ‘ বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর’ রচনায়......।

(১ম পর্ব)

বর্ধমান রাজপরিবারের অন্তঃপুরনারীদের মধ্যে সকলের আগে যাঁর নাম তাঁরা সকলে এখনও গর্বের সঙ্গে মনে রাখেন , তিনি হলেন বর্ধমান রাজ কৃষ্ণরাম রায়ের কন্য সত্যবতী। মহারাজকুমার শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতে, এর আগের বিশেষ কোন রাজকন্যা বা রাজমহিষীদের নাম সেভাবে জানাও যায় না। হয়তো তাঁর বীরত্ব, তেজস্বীতার জন্যই মহারাজকুমারী সত্যবতীর নামটি রাজপরিবারে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। চিতুয়া বরদার শোভা সিংহের বর্ধমান আক্রমণ ঐতিহাসিক তথ্য। শোভা সিংহের বর্ধমান রাজপুরীতে মৃত্যুও ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্ধমান নৃপতি কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতীর মর্য্যাদা স্খালনের চেষ্টা করলে সত্যবতী ছুরিকাঘাতে শোভা সিংহকে হত্যা করেন। কাহিনি এইরকমই শোনা যায়। তাঁর অসীম সাহস, আত্মমর্যাদাবোধ এবং শোভা সিংহ কে সমূলে বিনাশ করার জন্য বর্ধমান রাজপরিবার এই সাহসিনীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। যদিও, সেযুগে সঠিক কি ঘটনাটি ঘটেছিল, আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই, তবু বংশানুক্রমে চলে আসা বীরগাথাটি এখনও তাঁদের গর্ব ও আত্মসম্মানের বিষয় বলে তিনিও মনে করেন।
.
সত্যবতীর পর যে রাজপুরনারীর নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন রাণী ব্রজকিশোরী, রাজা কীর্তিচাঁদের মহিষী। রাণী ব্রজকিশোরীর নাম দান-ধ্যান, পুষ্করিণী খনন, দেবালয় প্রতিষ্ঠা এসব কাজের সঙ্গেই বেশি যুক্ত এবং রাজকার্য পরিচালনায় তাঁর তেমন কোন ভূমিকা দেখা যায় না, তবু সে যুগের একজন নারী, তিনি রাণী হলেও রাজঅন্তঃপুরের ঘেরাটোপের মধ্যে পর্দানশীন হয়ে না থেকে এতরকম কাজ করতে পেরেছিলেন, সেটি একটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে। বর্ধমান রাজপরিবারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র বা সবচেয়ে উজ্জ্বল নারী চরিত্র বলতে মহারাণী বিষেনকুমারী বা বিষ্ণুকুমারীর নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতে, মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর মত মহিলা রাজপরিবারে না থাকলে বর্ধমান জমিদারির অনেকখানিই ব্রিটিশদের হাতে বাজেয়াপ্ত হত।
.
মহারাণী বিষ্ণুকুমারী ছিলেন মহারাজ তেজচাঁদের মাতা। প্রথম যৌবনে তেজচাঁদ ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, রাজকার্যে অমনোযোগী। তাঁর অমনোযোগিতার কারণে জমিদারি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। কিন্তু সেইসময় মহারাণী বিষ্ণুকুমারী তাঁর জমিদারী রক্ষার জন্য সচেষ্ট হন এবং মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর পরামর্শে মহারাজ তেজচাঁদ ও বিষ্ণুকুমারী উভয়ে জমিদারি রক্ষার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেন। যার ফলে ইংরাজ সরকার তাঁদের প্রতি বিরূপ হলেও তাঁদের কোনভাবেই দমন করতে পারেনি। শেষমেশ ইংরাজ সরকার তাঁদের কয়েকবার গৃহবন্দী বা নজরবন্দী করে রাখলেও ইংরাজদের অধীনস্থ হতে হয়নি এবং ইংরাজ সরকার কোনমতেই কিছু আদায় করতে পারেনি। কখনও মাতা পুত্রের নামে, কখন পুত্র মাতার নামে ক্রমাগতঃ একের পর এক মামলা চালিয়ে যাবার জন্য, এবং ইংরাজ সরকার পূর্বতন মামলার নিষ্পত্তি ব্যতিরেকে পরবর্তী মামলার রায় দান না করতে পারার জন্য একের পর এক পুনঃ পুনঃ মামলা চলার ফলে বারে বারেই ব্রিটিশ সরকারকে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছে, কিন্তু রাজপরিবারের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। যার জন্য পরবর্তী কালে মহতাবচাঁদ তাঁর জমিদারির অনেকখানি পেয়েছিলেন সুরক্ষিত অবস্থায়। এবং তার পরপরই বর্ধমান জমিদারিতে পত্তনিদার প্রথা চালু হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার বর্ধমান রাজের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু সুবিধা করতে পারেনি। ফলে জমিদারিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখ থেকে রাজমাতা বিষ্ণুকুমারীর বুদ্ধিবলেই রক্ষা পায়।
.
পূর্ববর্তী মহারাজ ত্রিলোকচাঁদ ছিলেন অত্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী। কিন্তু পরবর্তী মহারাজা মহতাবচাঁদ বুঝেছিলেন যে ব্রিটিশরাজ সেইসময় পুরোপুরি এদেশে রাজত্ব কায়েম করেছে। তখন ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে শত্রুতা করার চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ধরে রাখতে পারলে বা দেখালে আর যাই হোক জমিদারির দিক দিয়ে তা লাভবান হবে। তাই তাঁর আমল থেকেই বর্ধমানের জমিদারিতে ব্রিটিশ বিরোধী হাওয়ার বদলে কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তার সুফলও মেলে অচিরেই। ইংরাজদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখার জন্য তাঁর আমলেই তিনি প্রথম ‘His Highness Maharajadhiraj’ উপাধি পান। যদিও এই জমিদারি এবং তার আয়ের জন্য মহারাজা মহতাবচাঁদ ও তাঁর পরিবার অনেকখানি মহারাণী বিষেণকুমারীর বা বিষ্ণুকুমারীর কাছে ঋণী। তিনি না হলে এবং তেজচাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে সেই সময় কৌশলে জমিদারি রক্ষার উপায় অবলম্বন না করলে এই বিশাল জমিদারির অনেকখানিই শেষ হয়ে যেত। তাই বর্ধমান রাজপরিবারে তিনি একজন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য নারী বলা যেতেই পারে। বর্ধমানের অনেক দেবালয়, পুষ্করিণী রাণী বিষ্ণুকুমারীর সময়ে স্থাপিত।
.
বর্ধমান রাজপরিবারে যতজন রাজা রাজত্ব করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই মহারাজা তেজচাঁদ এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। ভালো-খারাপ দুই অর্থেই তাঁর সুনাম ও বদনাম আছে বলা যায়। খামখেয়ালী, উচ্ছৃঙ্খল, বিলাসী, যৌবন মদমত্ত রাজা বলা যাতে পারে তাঁকে। আবার পরবর্তীকালে তিনিই প্রজাদের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। তাঁর সম্বন্ধে নানারকম গাল-গল্প প্রচলিত আছে। অনেকের মতে তিনি সাপে কামড়ানোর ঔষধ জানতেন। কিন্তু শ্রী প্রণয়চাঁদের মতে পারিবারিক ইতিহাসে এই বক্তব্যের সমর্থনের কোন হদিশ তিনি পাননি।
.
মহারাজ তেজচাঁদের ছিল ৮জন মহিষী। বর্ধমান রাজপরিবারে তাঁদের ভূমিকা কি ছিল এবং আদৌ কিছু ভূমিকা ছিল কিনা স্বাভাবিকভাবেই তা মনে হতে পারে । কথা প্রসঙ্গে জানা গেল তেজচাঁদের প্রথমা, দ্বিতীয়া এবং তৃতীয়া পত্নীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল একই দিনে। শুধু তাই নয়, তাঁর চতুর্থ বিবাহটিও সম্পন্ন হয় প্রথম তিনটি বিবাহের এক সপ্তাহের মধ্যেই। তেজচাঁদের বিবাহের ঘটনাও চমকপ্রদ। বর্ধমান রাজপরিবারেও এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সাধারণভাবে এই ঘটনা অস্বাভাবিক মনে হলেও বিবাহের ঘটনাটিও মহারাজ তেজচাঁদের চরিত্রের মতই খামখেয়ালীপনায় পরিপূর্ণ। বর্ধমান রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী বিবাহ হত পাত্র ও পাত্রীর করকোষ্ঠীর মিল দেখে। মহারাজা তেজচাঁদের এই তিন রাণীর সঙ্গে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হবার আগে আরো একজায়গায় করকোষ্ঠীর গণনা কার্য চলার সময়ই এই তিন বিবাহ একসঙ্গে হয়। কিন্তু ওদিকে করকোষ্ঠীর মিল হওয়ায় পাত্রীর পিতা বর্ধমান রওনা হয়ে জানতে পারেন যে ইতিমধ্যেই তার আগের দিন মহারাজার তিনজন কন্যার সঙ্গে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়েছে। রাগে এবং দুঃখে সেই পাত্রীর পিতা মহারাজার নামে আদালতে মামলা করেন। সুতরাং বাধ্য হয়ে একসপ্তাহের মধ্যেই সেই নারীটিকেও চতুর্থ পত্নী হিসাবে গ্রহণ করেন। পরে পঞ্চম পত্নী হিসাবে পাণি গ্রহণ করেন পরাণচাঁদ কাপুরের ভগিনী কমলকুমারীকে। কমলকুমারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি পঞ্চমবার বিবাহ করেন। কিন্তু মহারাজের এই পাঁচপত্নীর একজনেরও সন্তানাদি না থাকায় আবার বিবাহ করেন ষষ্ঠ বার, নানকী দেবীকে। একমাত্র নানকী দেবীর গর্ভেই জন্ম নেন তাঁর একমাত্র সন্তান প্রতাপচাঁদ। পরবর্তী কালে এই প্রতাপচাঁদকে ঘিরেই বর্ধমান রাজপরিবারে ঘটে নানান সমস্যা, নানান গল্প গাথা, নানান মামলা, মোকদ্দমা ইত্যাদি।
অনেকের মতে প্রতাপচাঁদের গৃহত্যাগের পিছনে আছে রাণী কমলকুমারীর ষড়যন্ত্র। কমলকুমারী ছিলেন প্রখর বুদ্ধিশালিনী। মহারাজ তেজচাঁদের প্রিয় মহিষী হ’বার সুবাদে রাজপরিবারের অনেক ঘটনার পিছনেই ছিল তাঁর মস্তিষ্ক। অনেকের মতে রাণী কমলকুমারী এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পরানচাঁদ কাপুরের ছিল অর্থলিপ্সা ও উচ্চাভিলাষ। দুয়ের ষড়যন্ত্রে প্রতাপচাঁদ রাণী কমলকুমারীর ফাঁদে পা দেন কিন্তু পিতার মহিষী মাতৃসমা রাণী কমলকুমারীর আচরণে লজ্জ্বিত ও দুঃখিত প্রতাপচাদ বর্ধমান রাজপরিবার ও বর্ধমান ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ফিরে এলে শুরু হয় জাল প্রতাপচাঁদের মামলা। কিন্তু সে অন্য ইতিহাস। রাজপুরনারীদের জীবনবৃত্তান্ত বা রাজঅন্তঃপুরবাসিনীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। যদিও, মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ জাল প্রতাপচাঁদের ঘটনা বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে প্রতাপচাঁদের সপক্ষে কোন রকম রেকর্ডই পাওয়া যায় না।
.
সেকালে জাল প্রতাপচাঁদের মামলা ঘিরে বর্ধমান এবং সারা বাংলা যথেষ্ট আলোড়িত হয়। রবীন্দ্র পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও এই মামলার একজন সাক্ষী হিসাবে আদালতে উপস্থিত হয়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। অনেকের মতে, দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কম্পানীর একজন কর্মকর্তা, বর্ধমান রাজপরিবারের আইনী পরামর্শদাদা ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কোম্পানী। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বর্ধমান রাজপরিবারের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ঘটনা যাই হোক না কেন, শ্রী প্রণয়চাঁদও বিশ্বাস করেন যে প্রতাপচাঁদ মারাই গিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রতাপচাঁদ ছিলেন সুরাসক্ত। নিজের দুই স্ত্রী প্যারীকুমারী এবং আনন্দকুমারী ছাড়াও তাঁর ‘বিলাতী খামুন’ নামে এক বিদেশিনী রক্ষিতা ছিল, যে মহিলা আবার ছিলেন সেই সময়ের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টারের বান্ধবী। অর্থাৎ প্রতাপচাঁদ মদ এবং নারীতে আসক্ত ছিলেন। অতিরিক্ত সুরাপানে তাঁর মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক ছিল। প্রতাপচাঁদের দুই মহিষীর অনুরোধে রাজপরিবারের তহবিল থেকে প্রতাপের মৃত্যুর পর(রাজপরিবারের মতে প্রতাপের মৃত্যুই ঘটেছিল) কালনায় প্রতাপের নামে একটি অসাধারণ টেরাকোটা কারুকার্য মন্ডিত মন্দির নির্মিত হয় যা প্রতাপেশ্বর শিব মন্দির নামে খ্যাত এবং এই মন্দিরটি প্রতাপের নাম এখনও বহন করে চলে...
(ক্রমশঃ)
(রচনাটি পূর্ব প্রকাশিত)
ছবি---মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ মহতাব ও লেখিকা



1 comments:

0

প্রবন্ধ - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত

Posted in











Dithee (2019)

Directed by SumitraBhave
Produced by Mohan Agashe
Screenplay by SumitraBhave
Story by D. B. Mokashi&SumitraBhave
Running Time – 87 mins

সত্যি বলতে কি, আমি সিনেমার কিচ্ছু বুঝি না।

মানে একটা সিনেমা কি করে তৈরি করতে হয়, কিরকম আলোর ব্যবহার করেন ডিরেক্টার, কিরকম মুডের জন্য কিরকম পিকচার টোন হবে যাতে গল্পটার শুরুতেই দর্শকের কাছে বার্তা চলে যায় সিনেমাটি কি গোত্রের - থ্রিলার, নাকি সায়েন্স ফিকশান, নাকি আদ্যন্ত একটি সামাজিক আখ্যান, নাকি সব মিলিয়ে কিছু একটা।

Nolan, Speilberg, Satyajit Ray দেখিয়ে দিয়েছেন এই তিন (এবং আরও অনেক কিছু সামঞ্জস্য-পূর্ণ ভাবে মিলিয়ে) এক-একটি মাস্টারপিস হতে পারে। আবার ঠিক মতো মেলাতে না পারলে কিরকম জগাখিচুড়ি হতে পারে, সেটাও অনেকেই দেখাচ্ছেন।

যাইহোক, যে প্রসঙ্গে আমরা ছিলাম। আমি সিনেমার কলা-কৌশল বিশেষ কিছু বুঝিনা, আমি এখানে শুধুমাত্র গল্পটা নিয়ে আলোচনা করবো।

গল্প


"দিঠি"র পটভূমিকায় আছে মহারাষ্ট্রের একটি ওয়ারকারি সম্প্রদায়ের গ্রাম। ওয়ারকারিরা সর্বভারতীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, ভক্তি আন্দোলন সম্পৃক্ত। তাদের উপাস্য দেবতার নাম ভিত্তল {যিনি বিষ্ণুর এক অবতার),পান্ধারপুরে তিনি অধিষ্ঠান করেন, প্রতি বছর জুলাই মাসে সেখানে "ওয়ারি" বা তীর্থযাত্রা তাদের কাছে বিশেষ পুণ্যের ব্যাপার।

এই গ্রামের বিশিষ্ট সজ্জন ব্যক্তি রামজি, ভিত্তলের চরণাশ্রয়ী, বিগত ৩০ বছর ধরে তিনি ওয়ারিতে যাচ্ছেন। গ্রামের মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি বড় দাদার মতো পাশে আছেন, তাঁর মুখে ভগবানের কথা শুনে শান্ত হয়েছে অনেক শোকগ্রস্ত মন।

এই হেন রামজির যুবক পুত্র একদিন নদীর জলে ভেসে গেল। হঠাৎ, অকস্মাৎ আঘাত করলো মৃত্যু !রামজি শোকে পাথর হয়ে গেলেন। তাঁর একমাত্র সন্তান, প্রৌঢ় বাবার থেকে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছিল একটু একটু করে, হঠাৎ-ই সব শেষ হয়ে গেল। রামজি সারাদিন দাওয়ায় বসে থাকেন, খাওয়া দাওয়া করেন না। তাঁর পুত্রবধূ তখন আসন্নপ্রসবা, তার কাছে রামজি তাঁর পুত্র সন্তান চেয়ে বসলেন। কিন্তু পুত্রবধূ তুলসী জন্ম দিল একটি কন্যা সন্তানের। রামজি তাঁর বহু আকাঙ্খিত সান্ত্বনা পেলেন না, সদ্যজাত শিশুর কান্না তাঁর কাছে হয়ে উঠল অসহ্য !!

এখানেই আমাদের শহুরে তথাকথিত "উচ্চশিক্ষিত" মনে প্রশ্ন জাগে - সন্তান তো সন্তানই, তার আবার ছেলে-মেয়ে হয় নাকি? এই সদ্যজাত শিশুটির মুখ চেয়ে রামজি ভুলে যেতে পারতেন না কি তাঁর সন্তান হারানোর শোক? অন্তত কিছুটা তো লাঘব করাই যেত, নয় কি?

নিশ্চয়ই যেত, কিন্তু এটাই হচ্ছে মানব মনের অদ্ভুত রহস্য। আমরা নিত্যদিন যে বোঝা বহন করে বেড়াই, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় হয়তো আমাদের সামনেই থাকে। কিন্তু আমরা শুধু তা "দেখতে" পাই না। বাধ সাধে আমাদের মজ্জাগত বিচার, সংস্কার। যে রামজির কথা শুনে মানুষ এককালে মনে জোর পেত, সেই রামজিই আজ স্তব্ধ। চোখ দিয়ে অনবরত তাঁর পড়ে জল, সর্বশক্তিমান ভিত্তলের উপর তাঁর বিশ্বাস উঠে গেছে, তিনি প্রশ্ন করেন "ভিত্তল সত্যি না মিথ্যে?", তিনি নিজে সত্যি না মিথ্যে, "এই জগত সত্যি না মিথ্যে"। তিনি ভগবানের কাছে তাঁর ত্রিশ বছরের তীর্থযাত্রার জবাবদিহি চান।

নামগান

অবশেষে প্রবল বর্ষণের মধ্যে অন্য গ্রামবাসিরা রামজিকে নিয়ে যান ভগবানের সাপ্তাহিক নামগানের আসরে। রামজি বেরোবার আগে তাঁর পুত্রবধূকে বলে যান ফিরে এসে তার মুখদর্শন করতে চান না !!

নামগানের প্রতিটা কথা রামজির কানে শূলের মতো বেঁধে। একটা সময়ে তিনি ছিলেন এই আসরের মধ্যমণি।

নৃত্যগীত পরিবেশন দ্বারা ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়া - ভক্তি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে উপস্থিত, অনেকটা আমাদের গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতই। গানের ভাষা ও সুর অত্যন্ত শ্রুতিমধুর।

এমনই সময়ে হঠাৎ রামজির ডাক আসে। গ্রামের গোপালক কানাইয়ের গরু আসন্নপ্রসবা। ধাত্রী হিসাবে পারদর্শী রামজির সেখানে উপস্থিতি একান্ত জরুরী।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে রামজি নামগান ছেড়ে উঠে যান, নিচু জাতের গোপালকের সাহায্যে। প্রবল বারিধারার মধ্যে কোন অদৃশ্য বল তাঁকে যেন টেনে নিয়ে যায় গ্রামের অপর প্রান্তে। কানাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে শুরু হয় জীবনের লড়াই।

অভিযান

আমরা যারা সাধারণ জীবন যাপন করি, তারা হয়তো তার পূর্বের বা তার পরের অবস্থা সম্বন্ধে খবর রাখি না, হয়তো যারা চিকিৎসক, নিরন্তর যাঁদের এপার-ওপার নিয়ে কারবার, তাঁরা রাখেন। প্রত্যন্ত গ্রামের রামজিও বোধয় সেই দলে পড়েন। আর খবর রাখেন তাঁরা, যারা প্রিয়জনের মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। প্রিয়জনের মৃত্যুর আগে-পরে মানুষ পাল্টে যায়। হয়তো একটি জীবনের শেষ হয়ে যাওয়ার শোক একমাত্র লাঘব করতে পারে অন্য একটি জীবন-আনয়নের আনন্দ।

সারা রাত বাইরে প্রবল বারিধারার মধ্যে লড়াই করলেন রামজি, নতুন জীবন ভূমিষ্ঠ করার লড়াই, সহায় সম্বল তাঁর অভিজ্ঞতা, ধৈর্য আর গ্রাম্য প্রাথমিক কিছু জিনিসপত্র, যেমন নারকল তেল, গরম জল, ইত্যাদি। আর আমরা দর্শকরা দম বন্ধ করে বসে থাকি, রামজি মুক্তি পাবেন কিনা দেখার জন্য।

অবশেষে আসে রৌদ্রোজ্জ্বল নতুন সকাল, বৃষ্টিতে যার কলঙ্ক সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। সকলে চেয়ে দেখল ভূমিষ্ঠ হয়েছে একটি সুস্থ সবল গোশাবক ! রামজি যেন তাঁর দৃষ্টি ফেরত পেলেন।

অবশেষে চশমা মুছে তাঁর মনে হোল কোথায় যেন এরকমই একটি শিশুর কান্না শুনেছিলেন - তাঁর নিজের বাড়িতে। তাঁর সদ্যজাত নাতনীর কান্না। এক ছুটে বাড়ি এসে দেখলেন তুলশী জিনিসপত্র গুছিয়ে চিরদিনের বেরোতে উদ্যত। এবার তার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন রামজি, চোখ খুলে দেখলেন তিনি, পারলেন তিনি তাঁর শোক জয় করতে, সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে। আর এই প্রথমবার তাঁর নাতনীকে কোলে নিলেন তিনি।


এদিকে নামগান তো সমাপ্ত হয়নি। কাজেই গ্রামের  অন্য মানুষরা সেখানেই বসে রাত্রিযাপন করেছেন।
রামজি উপস্থিত হলেন সেখানে, সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, যেন নবজন্ম হয়েছে তাঁর। ঠিক যেখানে কাল রাতে নামগান থেমে গেছিল, ঠিক সেখান থেকেই শুরু হোল আজ।


অসাধারণ এই গল্পটি সুমিত্রা ভাবের পরিচালিত শেষ সিনেমা। ১৯ এপ্রিল ২০২১ এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। অদ্ভুত দক্ষতায় আধ্যাত্মিকতা ও মনস্তত্ত্ব মিশিয়েছেন তিনি এই গল্পে। আমরা অনুমান করতে পারি মারাঠি সিনেমার আরেক স্তম্ভ মোহন আগাসে - যিনি এই ছবিতে প্রযোজনা ও অভিনয় করেছেন, যিনি পেশাগত-ভাবে মনস্তত্ত্ববিদ, তাঁর নিশ্চয়ই কিছু অবদান থেকে থাকবে এই গল্পে। বস্তুত মনস্তত্ত্ব নিয়ে সিনেমা সুমিত্রা ভাবে আগেও করেছেন। "দেবরাই", "অস্তু", "কাসাব" এই ছবিগুলি দেখার ইচ্ছা রইল।


প্রশ্ন হচ্ছে - এই ধরণের ছবি বাংলায় আমরা দেখি না কেন?

আমাদের তো উপাদানের অভাব নেই। অভাব নেই শক্তিশালী অভিনেতার। সৃজিত মুখোপাধ্যায় কি সময় নিয়ে, পরিচালনায় যত্নবান হয়ে এই ধরণের একটি সিনেমাও করতে পারেন না? স্বদিচ্ছার অভাব, নাকি "চলবে না" বলে প্রযোজকদের পিছিয়ে আসা? নাকি বাংলায় এরকম সিনেমা আছে, কিন্তু আমরা শুধু জানতে পারি না।

সৃজিত বাবুকে বাদ দিলে ভরসা জাগায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজ। "বাস্তু সাপ", "শব্দ", "খাদ", "ছোটদের ছবি" , "বিসর্জন" ব্যতিক্রমী এবং যথেষ্ট উচ্চমানের কাজ। তাঁর হাত থেকে "দিঠি"র মতো একটি ছবি বেরিয়ে আসতে পারে কি?

দেখা যাক, সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in







একটা বুড়ো মানুষকে এত ভয়?

“ওরা ভয় পেয়েছে জীবনে,
ওরা ভয় পেয়েছে মরণে,
ওরা ভয় করে সেই স্মৃতিকে,
ওরা ভয় করে দুর স্বপনে”

--পল রোবসনের জন্যে নাজিম হিকমতের কবিতা “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না” থেকে।

গত ৫ তারিখে হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মারা গেলেন স্ট্যান স্বামী; ৮৪ বছরের এক বুড়ো, যার পার্কিনসনগ্রস্ত হাতে জলের গেলাস ধরা মুশকিল, চামচ ধরে রাখতে পারেন না, লেখা বা টাইপ করা তো দূরের কথা। আদালত মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকে জেনেছে যে উনি কানেও কম শুনছেন, চোখে দেখেছে যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অভিযুক্ত লোকটি একজন দুর্বল অশক্ত বৃদ্ধ। তবু তার জামিনের আবেদন বারবার খারিজ হয়। মুম্বাইয়ের বিচারাধীন বন্দীদের জন্যে শহরের বাইরে তালেদায় নির্মিত বিশেষ জেলে রাখার জায়গা ১৬০০, রয়েছে ২০০০ এর বেশি। তবুও নয়? কোভিডের সময়ও নয়? আমরা তো শুনেছিলাম যে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন যে এই মহামারীর সময়ে বেশিরভাগ বিচারাধীন বন্দীদের ছেড়ে দিতে? ফাদারের বিরুদ্ধে মামলাই শুরু হয়নি। কোভিডের পরীক্ষাও অনেকদিন করা হয়নি। কিন্তু জামিনের শেষতম আবেদনের শুনানি ঝুলিয়ে রাখা হোল। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

শেষসময়ে মুম্বাই হাইকোর্টের দয়া হল। তাকে মুম্বাইয়ের হোলি ফ্যামিলি প্রাইভেট হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার অনুমতি মিলল।

আগে যতবার মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে জামিনের আবেদন করা হল প্রাণ সংশয়ের কথা বলা হোল,--কারণ ওই জেলটিতে কোন বড় ডাক্তার নেই, তিনজন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার রয়েছে- ততবার এন আই এ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) বাধা দিল; বলল -ন্যাকামি, স্ট্যান মেডিক্যাল গ্রাউন্ডের আড়ালে অনায্য সুবিধে নিতে চাইছেন। আদালত সরকার পক্ষের যুক্তি মেনে নিল।

যাক, ফাদার স্ট্যান স্বামী শেষে মরে গিয়ে প্রমাণ করলেন যে তিনি অন্ততঃ মিথ্যেবাদী ছিলেন না।


খাঁচায় বদ্ধ পাখির গানঃ

জেসুইট পাদ্রী স্ট্যান স্বামী এসেছিলেন তামিলনাড়ু থেকে, কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝারখন্ডের আদিবাসী এলাকাই ছিল তাঁর ঘরদোর, তাঁর পরিবার। থাকতেন চার্চ সংলগ্ন এককামরার ঘরে, লিখতেন প্রচুর—প্রায় ৭০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশের বিষয় সমাজের বঞ্চিতদের অধিকার হননের বিরুদ্ধে।

তাঁর বিশ্বাস ছিল পরম করুণাময় ঈশ্বরে, বিশ্বাস ছিল ভারতের সংবিধানে, আস্থা ছিল অহিংস গান্ধীবাদী পন্থায়। ওই আস্থা থেকে হয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী।

উনি মনে করতেন আইনি পথেই লড়াই করে আদিবাসী, অন্ত্যজ ও অল্পসংখ্যকদের কেড়ে নেওয়া অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। তাই রাঁচির উচ্চ আদালতে স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে ‘পত্থলগড়ী’ আন্দোলনের সংগে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিনাবিচারে বন্দী প্রায় ৪০০০ আদিবাসীর মুক্তির দাবিতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন। সংবিধানের পঞ্চম শিডিউলে ঘোষিত আদিবাসী অঞ্চলে (ছত্তিশগড়, ঝারখন্ড ও অনেকগুলো রাজ্যের নির্দিষ্ট জেলায়) কর্পোরেটের স্বার্থে অরণ্য ও খনিজ সম্পদের লুন্ঠনের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন, জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। বন্দীমুক্তির দাবিতে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত জমায়েতে উপস্থিত হয়েছেন। আবার ঝারখন্ডে সংবিধান প্রদত্ত গ্রামসভার অধিকার, ‘বাগেইচা’ পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব করে উনি অনেকদিনই বিজেপি সরকারের চক্ষুশূল।

ভয় কিসের? ভয় এই জন্য যে বিনাবিচারে বন্দী স্ট্যান কান্নাকাটি করেনি, ও জামিন চেয়েছিল সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে। ও নিজের লোকজনকে তখনই বলেছিল –‘ সম্ভবতঃ আমি বাঁচব না। কিন্তু খাঁচায় বন্দী পাখিও গান গাইতে পারে, তার গান গাওয়ার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারেনা’।

শেষ সময়েও প্রশ্ন তুলেছিল ইউএপিএ ‘র অসাংবিধানিক ধারা নিয়ে।

মনে পড়ছে ইন্দিরা শাসনে ইমার্জেন্সির সময় ফক্কড় কবি নাগার্জুনের কবিতাঃ

“জলী ঠুঁঠ পর বৈঠকর গই কোকিলা কুক,
বাল ন বাঁকা কড় সকী শাসন কী বন্দুক”।
পোড়া গাছের ডালে বসে কোকিল দিচ্ছে কুক,
তার একটি পালকও ঝরেনি দেখে ক্ষমতার বন্দুক”।


স্ট্যানের অপরাধঃ

তিন বছর আগে, ১লা জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে যখন পুণে জেলার ভীমা-কোরেগাঁও এলাকায় এলগার পরিষদ আয়োজিত দলিত অস্মিতার সমাবেশে (১৮১৮ সালে দলিত বাহিনীর হাতে ব্রাহ্মণ নেতৃত্বের পেশোয়া বাহিনীর পরাজয়ের দুশো বছর) গেরুয়া ঝান্ডা হাতে একটা দল ঢুকে পড়ে হামলা চালায়। একজন যুবক মারা যায় ও পাঁচজন আহত হয়। প্রাথমিক অভিযোগ ওঠে দুই হিন্দুত্ববাদী নেতা শম্ভাজী ভিড়ে ও মিলিন্দ একবোটের দিকে। ওঁরা আত্মগোপন করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে তৎকালীন বিজেপি সরকার ১৫ জন মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্টকে ‘আর্বান নকশাল’ নাম দিয়ে গ্রেফতার করে। এঁদের মধ্যে অন্ধ্রের কবি ও কার্যকর্তা আশি বছরের ভারভারা রাও, ছত্তিশগড়ের আদিবাসী ও শ্রমিকদের মধ্যে কাজে নিবেদিত সুধা ভরদ্বাজ, দলিত গবেষক ও লেখক এবং আই আই টির অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বে, সাংবাদিক গৌতম নওলাখা, উকিল সুধীর ধাওলে, রোনা উইলসন ও অন্যেরা। এঁদের বিরুদ্ধে প্রথমে অভিযোগ আনা হয় যে এঁরা নাকি নিষিদ্ধ মাওবাদী দলের সদস্য এবং এলগার পরিষদের আয়োজনে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। শুধু অভিযুক্তরাই নন, আয়োজকদের মধ্যে জাস্টিস সাওয়ান্তের মত তিনজন প্রাক্তন বিচারপতি- সবাই ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর এঁদের কম্পিউটার জব্দ করা হয় এবং অভিযোগ আনা হয়যে এঁরা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার জন্যে মাওবাদীদের টাকা অস্ত্রশস্ত্র সাপ্লাই দেবার কথা ভাবছিলেন এবং সেসব একে অন্যকে ই-মেইল করেছেন!

প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ ই-মেইলের মাধ্যমে!! এমন হাস্যকর অভিযোগ, কিন্তু তিনবছরেও বিচার শুরু হয়নি। অভিযুক্তরা ওই মেইলকে-- যাতে প্রেরক,প্রাপক ও প্রেষণের তারিখ কিছুই নেই- চ্যালেঞ্জ করেছেন। কেন? আমেরিকার এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ‘আর্সেনাল’ নামের সংস্থাটি একবছর ধরে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের পরীক্ষণের ভিত্তিতে রিপোর্ট বের করেছেন যে ওই প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথিত রিপোর্টটি ফেক এবং অভিযুক্তদের কম্পিউটারে পরে প্ল্যান্টেড।

তখন এন আই এ সংস্থা লাগিয়ে দিল ইউ এ পি এ( আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট), এর প্রভিশনে জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই হয়। আদালত বলল, ওইসব এভিডেন্স ফেক নাআসল সেসব যখন মামলা শুরুও হবে তখন কোর্ট দেখবে। এখন সরকার পক্ষের অভিযোগকে সত্যি ধরে নিয়ে সবার জামিন খারিজ। এর ফলে সরকার চাইলেই কাউকে এই অ্যাক্টের জোরে বিনাবিচারে বছরের পর বছর আটকে রাখতে পারে।

স্ট্যানের সঙ্গে কী হলঃ

অগাস্ট ২০১৮ সালে পুণে পুলিশ স্ট্যানের কামরায় হানা দিয়ে ওঁর কম্প্যুটার, বইপত্তর ও কিছু ক্ল্যাসিক্যাল গানের সিডি জব্দ করে নিয়ে গেল, ১৫ ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু অ্যারেস্ট করল না। আবার রেইড হল জুন ২০১৯ সালে, তখনও গ্রেফতার করেনি। কিন্তু এরপর তদন্ত গেল কেন্দ্রীয় সংস্থা এন আই এ’র কাছে। ওরা ৮ই অক্টোবর, ২০১৮তে এসে বলল-তোমাকে আমাদের সংগে মুম্বাই আসতে হবে। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে।

স্ট্যান বললেন -আমি আগেও সহযোগিতা করেছি, এখনও করব। আমার সঙ্গে আপনারা ভিডিও কনফারেন্সে যত ইচ্ছে জেরা করুন, আমি রাজি। কিন্তু এখন কোভিড মহামারী চলছে, ঝারখন্ড সরকার কাউকে, বিশেষ করে বুড়োদের ঘরের বাইরে যেতে মানা করছে। আমার অনেকগুলো স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে।

এন আই এ’র টিম শুনল না। ওরা স্টানকে মুম্বাই নিয়ে জেলে ঢোকাল, কিন্তু, পরবর্তী ছ’মাসে, স্ট্যান মারা যাওয়া অব্দি একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করল না, আদালতে একবারও নিজেদের কাস্টডিতে নেয়ার আবেদন করল না; অথচ জামিনের আবেদন হলেই আদালতকে বলল যে স্ট্যানকে জেলের কুঠুরির বাইরে রাখা নাকি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যে ভারি বিপদ। আর আদালতও মেনে নিল।

ঠিক করেছে, কারণ কে বলে স্ট্যান অথর্ব? শেষ দিনগুলোতেও Sec 43D(5) of UAPA,নিয়ে হাইকোর্টে পিটিশন লাগিয়েছে। হাত-পা-কান অচল হলেও ওর মাথা যে সচল। এই ধারা রদ হলে যখন তখন কাউকে ধরে বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটকে রাখা রাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন হবে। জামিন পাওয়া সহজ হবে। এই ‘বোকা বুড়ো’ যে খালি অন্যদের কথা ভাবে!

এখন মারা যাওয়ার পরও হাইকোর্ট যদি স্ট্যানের আইনি লড়াইয়ের পিটিশনের শুনানি শুরুও করে তাহলে আমাদের পাপের বোঝা কিঞ্চিৎ লাঘব হবে। (চলবে)

কিছু আইনি প্রশ্ন---

তোলো আওয়াজঃ

For the first time, in over 3 years since the fake Bhima Koregaon (BK) charges were filed and arrests made, leaders of 10 political parties have written to the President of India, calling upon him to ensure that the BJP Govt releases all persons arrested on politically motivated charges in BK or other cases, under UAPA. While this is a delayed welcome step, we do know that unless these parties (many of who have been in favour of UAPA) take a clear public position against UAPA, their limited pleas will not have an impact. It is high time all parties and groups which feel that democracy and opposition in India is being throttled by the BJP, must take an open and unambiguous stand against UAPA and sedition.

We record our appreciation for the efforts of the lawyers in this case as well as the occasional benevolent interventions of the Court (such as shifting Fr Stan to Holy Family Hospital). However, we cannot but convey out deepest angst at the manner in which the judiciary, in general, has chosen to deny bails to most political prisoners in the UAPA matters (including Stan), even as trials are pending for years and years! Despite glaring evidence like the Arsenal reports pointing to how the accused activists have been implicated in a malafide manner, neither was the trial process hastened nor were bails granted, especially to the elderly and sick, in Covid times ! We hope, even if posthumously, the Mumbai High Court takes up, in right constitutional spirit, the legal challenge Fr Stan has posed to Sec 43 D (5) of UAPA, which makes bail provisions extremely stringent. This would have an implication for the release of all others arrested as well.

From Gandhi to Gauri or more recently Mahavir Narwal to Fr Stan, we all know that the ideological killers of all these brave-hearts are the same. On the one hand, their singular aim to convert this nation of diverse identities into a monolith Hindu Rashtra needs to be confronted and defeated head on. On the other, their pro-corporate agendas of pushing ahead the Farm Laws and Labour Codes needs broader resistance. The 7 months strong farmers movement is a stellar example of mass people’s resistance.

Our challenge lies in building and supporting similar, collaborative and sustained movements of the working class and oppressed peoples, against dilution of labour laws, environmental laws, draconian laws, corporate attacks and resource loot in Schedule-V areas as well as for ensuring accessible public health, education and livelihood, income security for all. Human rights defenders, social activists, people’s organizations are facing an unprecedented clamp down today. Only a united and defiant push-back by all democratic forces can keep the fascists and authoritarian rulers in check.

Stan has fought his battle powerfully and moved on. Taking inspiration from him, it is now for us, as a people, as a nation, to decide how do we take the struggle ahead. We hope that all the current outrage is channelized constructively into a nation-wide and sustained movement against draconian, anti-people laws and state repression. Laws like UAPA and Sedition which have always been invoked to persecute political activists must be repealed summarily. Institutions like NIA that are an affront on the federal spirit need to be disbanded.

The right to bail, even in UAPA matters, as powerfully upheld by the Delhi High Court recently must be widely publicized and understood as flowing directly from constitutional liberties. Right-wing hate-mongers, be it in the Elgar Parishad case or in the anti-CAA protests, who even now are continuing to vilify deceased Stan and other activists, are the ones who need to be behind bars. A broader movement for release of the Bhima Koregaon 15 as well as all political prisoners, including adivasis, dalits, muslims, transgender persons across the country and prison reforms is the need of the hour. Let us all join forces and work collectively to build upon the momentum for addressing all these.

We also extend our solidarity to the grassroots movements in Jharkhand who are committed to taking forward the work initiated by Stan, including the release campaign of more than 4,000 adivasi undertrials and preserving the Bagaicha resource space in Ranchi, nurturing it as a centre of political learning and action. Acknowledging the empathetic statements by Jharkhand CM both after Stan’s arrest and his departure, we call upon the Hemant Soren Govt. to take a clear stand against UAPA, furnish truthful affidavits in the Ranchi High Court on the PIL filed by Fr Stan and facilitate the early release of all adivasi prisoners across jails in Jharkhand. That would be a true salute to the departed soul of Stan Swamy. Johar.

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in




আমার ভারতবর্ষ-৫

চারমিনার

ইতিহাস খুঁজতে গেলে হাজার বছর পেরোবে। এই প্রিয় শহরটিকে এখন লোকে 'হায়দরাবাদ' নামে চেনে। মধ্যযুগের আগে তার যাই পরিচয় থাক, মুঘল পর্ব থেকেই তার নামডাক। দু'দল তুর্কো-ইরানি ভাগ্যান্বেষীর দৌলতে গড়ে উঠেছিলো এই শহর। ষোলো শতকের গোড়ায় কুতব শাহি শাসন বাহমনিদের থেকে দখল নিয়েছিলো গোলকুণ্ডা দুর্গের। পঞ্চম সুলতান মহম্মদ কুলি কুতব শাহের সময় থেকে দক্কনে সে কালের বিচারে একটা নতুন ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন হয়। যাকে এদেশের ইতিহাসে গঙ্গা-জমনি তহজিব বা সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে। মহম্মদ শাহ ছিলেন যেন এক্জন উপকথার সুলতান। কবি, শিল্পী, সংস্কৃতি প্রেমী, উদার-হৃদয় নৃপতি, যাঁর সৃষ্টি এই হায়দরাবাদ শহর। চারমিনার থেকে শুরু করে আদি উর্দুভাষা বা রেখতা তাঁরই অবদান। তাঁর প্রিয় সঙ্গিনী, নর্তকী ভাগমতী বা হায়দরমহলকে নিয়ে কিংবদন্তি অন্তহীন। তাঁর সময়
দিল্লির অধীশ্বর ছিলেন বাদশাহ আকবর। মানসিকতার প্রসার বিচার করতে গেলে মহম্মদ শাহের চিত্তসম্পদ ও উদারতা গ্রেট মুঘল আকবর বাদশাহকেও ছাপিয়ে যেতো। যেসব দূরদর্শী মুসলিম শাসকদের প্রযত্নে এদেশে আক্রমণকারী বিদেশী রাজাদের ধর্ম ইসলাম বা তাঁদের ভাষা ফার্সি, দেশীয় ধর্মসংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বিত হয়েছিলো, মহম্মদ শাহ ছিলেন তাঁদের অগ্রপথিক। তাঁর সময়েই গোলকোণ্ডা রাজত্বে তেলুগু, রাজভাষার মর্যাদা পেয়েছিলো। এই সুলতান সম্বন্ধে মানুষের কৌতুহল ও প্রীতি বহুবিস্তৃত।

মহম্মদ কুলি কুতব শাহ নির্মাণ করেছিলেন দেশের একটি অতি বিখ্যাত দিকচিহ্ন, হায়দরাবাদের চারমিনার। ১৫৯১ সালে তাঁর নতুন শহরে মারাত্মক প্লেগের উপদ্রব হয়। তিনি শহরের কেন্দ্রে একটি স্থানে বসে রোগশান্তির জন্য প্রার্থনা করেন। প্রতিজ্ঞা করেন যদি মহামারী দূর হয়, তবে এই স্থানেই একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই অনুযায়ী ঐ স্থানে নির্মিত হয় বিখ্যাত মক্কা মসজিদ। সুদূর মক্কা থেকে নাকি ইঁট নিয়ে আসা হয়েছিলো এই কাজে। এর স্থাপত্য আর কারিগরি আজও আমাদের অবাক করে। ত্যাভার্নিয়র সাহেব এটি দেখে মন্তব্য
করেছিলেন, " It is about 50 years since they began to build a splendid pagoda in the town which will be the grandest in all India when it is completed. The size of the stone is the subject of special accomplishment, and that of a niche, which is its place for prayer, is an entire rock of such enormous size that they spent five years in quarrying it, and 500 to 600 men were employed continually on its work. It required still more time to roll it up on to conveyance by which they brought it to the pagoda; and they took 1400 oxen to draw it."

শাহজহানের নির্মাণ করা দিল্লির জামা মসজিদের প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে মহম্মদ কুলি কুতব শাহের তৈরি মক্কা মসজিদ দেশের বৃহত্তম মসজিদ ছিলো। এখনও সেখানে একসঙ্গে বিশ হাজার লোক প্রার্থনা করতে পারেন।

চারমিনার ছিলো ইসলামি স্থাপত্যের বিজয়তোরণ। একটি মৌলিক ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। বর্গাকার চারটি মিনারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই নির্মাণটি ছিলো নতুন শহরের কেন্দ্রবিন্দু। মক্কা মসজিদের দ্বারপথ। তৈরি হয়েছিলো গ্র্যানাইট, চুনাপাথর, সুরকি
আর মার্বলপাথরের গুঁড়ো দিয়ে। এর উপর দাঁড়ালে সারা হায়দরাবাদ শহরের চারদিক দেখতে পাওয়া যেতো। একটা কিংবদন্তি আছে। গোলকোণ্ডা দুর্গ থেকে চারমিনার পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিলো। মূল কারণ দুর্গ আক্রান্ত হলে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছোনোর উপায়। অন্যটা কিংবদন্তি। মহম্মদ কুলি কুতব শাহ নাকি গোলকোণ্ডা থেকে সুরঙ্গপথে এসে হায়দরাবাদে ভাগমতীর সঙ্গে মিলিত হতেন। সুড়ঙ্গটি অবশ্য এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চারমিনারকে ঘিরে চোদ্দো
হাজার বিপণী,বসতবাড়ি, সরাইখানা, হম্মাম, মক্তব-মদ্রাসা এবং মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সুলতান। তার মধ্যে দর-উল-শিফা (হাসপাতাল) এবং আরও কয়েকটি বিশাল ভবন এখনও টিকে আছে। গোলকোণ্ডা পতনের পর অওরঙ্গজেব হায়দরাবাদ শহরের জাঁকজমক দেখে চমৎকৃত হয়ে যান। যদিও বেশিরভাগ নির্মাণই ১৬৮৭ সালে তাঁর সঙ্গে আসা মুঘল সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো।



0 comments:

2

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















ঢিলটা গাড়ির চালে এসে পড়লেও, গাড়ির মাথায় বেঁধে রাখা মালপত্র, তাঁবু এসবের উপরে পড়লো। দ্বিতীয় ঢিলটা এসে গাড়ির মাথায় বাঁধা রান্নার কড়াইয়ের গায়ে একটা ঘষটানো দাগ করে দিল। রান্নার বাসন এভাবে বাঁধা হয়েছে গাড়ির মাথায়, দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ সপ্তাহান্তে পিকনিক পার্টি করতে যাচ্ছে। যে ঢিল ছুঁড়ছিল, সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গর্জন করতে করতে ধেয়ে আসছিল। লোকটা বড়সাহেবের বাংলোর কেয়ারটেকার। বাংলোর পেছনদিকের একটা ঘরে থাকে। লোকটা দৌড়ে গাড়িটার খুব কাছে চলে গেছে। কিন্তু গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। লোকটার হাতে আর কোনো ঢিল নেই। লোকটা নিচু হয়ে ঝুঁকে শাপশাপান্ত করতে লাগলো। রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সামনের যানজট কেটে গেছে। গাড়িটা হর্ন দিয়ে গতিবেগ বাড়াতে শুরু করেছে। একটা ফুলদানি উড়ে এসে পড়লো, এক সেকেন্ড আগে গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তার পাশের নীলচে পাথর গাঁথা ঝকঝকে তকতকে ফুটপাথের উপরে। মাটির ফুলদানিটা ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে গেলেও একটা অদ্ভুত মালার মত আকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে রইল মাটির উপরে। ভাঙা টুকরোগুলোর মাঝে ডাঁটিসমেত লাল জেরেনিয়াম ফুলগুলি অমলিন শুয়ে আছে।

লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সৈন্যদলের মাঝে। লোকটা আর অভিশাপ দিচ্ছে না। লোকটা এখন কাঁদছে। লোকটার চোখের জলের ফোঁটাগুলো নেমে আসছে ওর অপরিচ্ছন্ন গালের উপর দিয়ে। লোকটাকে দেখে যে কারো খুব কষ্ট হবে, আবার একই সঙ্গে ভয়ও করবে। লোকটা ঝুঁকে পড়েছে। হাতদুটো বেঁকে যাচ্ছে, রোগাটে পাঁজরের উপরে নোংরা, পুরনো জ্যাকেটটা দুলে উঠছে। পেছনের উঠোন থেকে এক মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ক্রন্দনরত লোকটি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে চলে গেল সেদিকে।



শ্নাইডার একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল মেয়েটার দিকে। সেটা না দেখার ভান করে জারকা উঠে বসল তার গাড়িতে। হাতে তুলে নিল ঘোড়ার লাগাম আর চাবুক।

‘আমি সিগারেটের বাক্সগুলো নিয়ে আসছি’ চেঁচিয়ে উঠলেন স্মিৎজ, ‘এক মিনিট, একটু অপেক্ষা করুন!’

শ্নাইডার সামনে থেকে শক্ত করে আটকে ধরলো ঘোড়ার লাগাম। মেয়েটার চাবুকের একটা ঘা এসে পড়লো তার হাতে। সে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে রইল। শ্নাইডার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলো যে স্মিৎজ প্রায় দৌড়ে যাচ্ছেন। স্মিৎজ কোনোদিন দৌড় লাগাবেন কোনো ব্যাপারে, এটা সে একেবারেই ভাবেনি। মেয়েটা চাবুকটা আবার তুললো, কিন্তু সেটা এবার আর সামনের দিকে নেমে এলনা। বরঞ্চ পাশে বসবার বাক্সটার উপরে রেখে দিল সেটা। শ্নাইডার অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে মেয়েটার মুখে হঠাৎ একচিলতে হাসি খেলে গেলো। এই হাসিটাই মেয়েটার মুখে দেখা যায় বেশির ভাগ সময়ে, মিষ্টি, স্নিগ্ধ একটা হাসি। লাগাম হাতে রেখেই শ্নাইডার এগিয়ে গেলো ঘোড়াটার পেছনে গাড়ির কাছে, সাবধানে মেয়েটাকে টেনে নামিয়ে আনলো গাড়ির উপর থেকে। মেয়েটা চেঁচিয়ে কী যেন বলে উঠল ঘোড়াটাকে! শ্নাইডার মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বুঝতে পারলো যে ভয়ের ভাব না কাটলেও মেয়েটা বাধা দিচ্ছেনা একেবারেই; কেবল অস্থিরভাবে চারিদিকে চেয়ে দেখছে। রাস্তার এপাশটা বেশ অন্ধকার। শ্নাইডার আলতো করে মেয়েটার গালে, নাকে চুমু খেলো। কালো চুলের গুচ্ছ সরিয়ে গলা আর ঘাড়ের কাছে চুম্বন করতে গিয়ে চমকে উঠলো সে, কারণ স্মিৎজ ফিরে এসেছেন। স্মিৎজ সিগারেটের বাক্সগুলো ছুঁড়ে দিলেন গাড়িটার মধ্যে। মেয়েটা লাফিয়ে উঠে লাল বাক্সগুলোর দিকে চেয়ে দেখলো। স্মিৎজ শ্নাইডারের দিকে ফিরেও তাকালেন না, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেলেন আঙ্গিনার দিকে। মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে, একবার তাকিয়ে দেখলো শ্নাইডারের দিকে, তারপর চোখ সরিয়ে নিল। কী যেন দুর্বোধ্য শব্দ করে ডাকলো মেয়েটা ঘোড়াটাকে, আবার উঠে পড়ল গাড়িটার উপরে। শ্নাইডার লাগাম ছেড়ে দিলো। গাড়িটা প্রায় পঞ্চাশ পা দূরে যাওয়ার পরে নৈঃশব্দের মাঝে চিৎকার করে সে ডাকলো মেয়েটাকে নাম ধরে। মেয়েটা থামলো এক মুহূর্ত, ফিরে এলনা। চাবুকটা নিজের মাথার উপরে একটু তুললে মেয়েটা, বিদায় জানাবার ভঙ্গি করলো, তারপর এগিয়ে গেলো। শ্নাইডার ধীরে ধীরে ফিরে গেল আঙিনায়।

আঙিনায় যেখানে ক্যান্টিন ছিল, সেখানে একটা টেবিল আর বেঞ্চ পেতে সাতজন মানুষ বসে আছে। ওরা খাওয়াদাওয়া সারছে। টেবিলে স্যুপ, রুটি আর মাংস রাখা আছে। আঙিনার পেছনের দিক থেকে ধুপধাপ নানা আওয়াজ আসছে। শব্দ শুনে শ্নাইডার বাকিদের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।

‘বড়সাহেবের বাংলোর কেয়ারটেকার! বাংলোর দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে!’ বলে উঠল ফাইনহালস। একমুহূর্ত পরে সে আবার বলে উঠল, ‘ওঁর অন্তত দরজাটা খুলে রেখে যাওয়া উচিত ছিল। এখন এইসব দরজা ভাঙচুর করে নষ্ট করাটা কোনো কাজের কথা নয়।’ স্মিৎজ চারজন সৈনিকের সঙ্গে চলে গেলেন ভেতরের দিকে। ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার জন্য দরকারি কাজগুলো করা দরকার। শ্নাইডার ওটেন আর ফাইনহালসের সঙ্গে বসে রইলো সেখানে।

‘আমার উপরে একটা দারুণ কাজের দায়িত্ব পড়েছে!’ বলে উঠল ওটেন।

ফাইনহালস একটা ফিল্ডকাপ থেকে লাল শ্নাপ খেতে লাগলো। শ্নাইডারের দিকে বাড়িয়ে ধরলো দু প্যাকেট সিগারেট।

‘ধন্যবাদ!’ বলে উঠল শ্নাইডার।

‘আমার উপরে অর্ডার আছে’... বলে উঠল ওটেন, ‘সব মেশিনগান আর সাবমেশিনগান, এগুলোকে বিভিন্ন জঞ্জালের সঙ্গে পেছনের ছোট পুকুরটায় চুবিয়ে দিতে হবে, যেখানে ওইসব আগের যুদ্ধের বোমার ভাঙা টুকরোটাকরা আছে। ফাইনহালস, আপনি আমায় একটু সাহায্য করবেন।’

‘বেশ’ বলে উঠল ফাইনহালস। সে স্যুপের চামচ দিয়ে টেবিলের উপরে আঁকিবুঁকি কাটছিল। স্যুপ গড়িয়ে গড়িয়ে মাঝখান থেকে কিনারা অবধি একটা বাদামি রঙের চওড়া দাগ হয়ে গেল টেবিলের উপরে।

‘চলুন যাওয়া যাক!’ বলে উঠল ওটেন।

শ্নাইডারের চোখটা লেগে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। খাবারের পাত্রের উপরে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তাঁর জ্বলন্ত সিগারেট পড়ে ছিল টেবিলের কিনারে। মোটা ছাইয়ের শরীর খেয়ে ফেলছিল ধীরে ধীরে ওটাকে। জ্বলন্ত আগুন ধীরে ধীরে জ্বলে টিকিয়ে রাখছিল নিজের অস্তিত্ব; জ্বলতে জ্বলতে টেবিলে একটা কালো সরু দাগ হয়ে গেলো। চার মিনিট পরে ধূসর ছাইয়ের একটা টুকরো লেগে থাকলো টেবিলে। সেই টুকরোটা প্রায় ঘণ্টাখানেক পড়ে ছিল সেখানে। তার পরে শ্নাইডারের তন্দ্রা কেটে গিয়েছিল এবং সেই ছাইটা একেবারেই খেয়াল না করে হাতের ধাক্কায় কখন ফেলে দিয়েছিল টেবিল থেকে, তা সে নিজেও জানে না। আঙিনায় ট্রাক ঢুকবার শব্দে তার ঘুম ভেঙেছিল, এবং দূর থেকে ভেসে আসা আরেকটা গুমগুম শব্দ, যেটা যুদ্ধরত ট্যাঙ্কের, সেটাও একইসঙ্গে শুনতে পেয়েছিল সে।

শ্নাইডার লাফ দিয়ে উঠেছিল। বাকিরা, যারা আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা হাসবার চেষ্টা করেও চুপ করে গিয়েছিল। দূর থেকে ভেসে আসা মৌমাছির গুঞ্জনের মত শব্দটা খুব পরিষ্কার।

‘আচ্ছা!’ স্মিৎজ বলে ওঠেন, ‘গাড়ি এসেছে অবশেষে। কিন্তু এদিকে… ফাইনহালস, আপনি একটু ছাতে গিয়ে দেখবেন যে কিছু দেখা যায় কিনা!’

ফাইনহালস দক্ষিণের বিল্ডিংএর ছাতে উঠে গেল।

বড়সাহেবের বাংলোর জানালার সামনে কেয়ারটেকার লোকটা শুয়ে আছে। লোকটা দেখছে তাদের দিকে। লোকটার বউ ভেতরে কিছু একটা করছে। বোধহয় বাসনপত্র গুনছে। কাচের গ্লাসের শব্দ শোনা গেলো।

‘আমাদের মালপত্র আগে তুলে নিই!’ বলে উঠল স্মিৎজ।

ট্রাকের চালক হাত নাড়ল অধৈর্যভাবে। লোকটাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘দুচ্ছাই!’ বলে উঠল সে, ‘তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো সবাই। বেশি মালপত্র নিতে হবেনা। ফেলে দাও সব… জঞ্জাল!’ লোকটা টেবিল থেকে একটা সিগারেটের বাক্স তুলে নিল। প্যাকেট ছিঁড়ে ধরালো একটা সিগারেট।

‘একটু অপেক্ষা করুন। মালপত্র তোলা হোক।’ বলে ওঠেন স্মিৎজ… ‘তাছাড়া ফাইনহালস ফিরে না আসা অবধি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

ট্রাকচালক কাঁধ ঝাকালো। তারপর বসে পড়ল টেবিলের একপাশে। শ্নাইডারের খাবারের পাত্রের মধ্যে সে ঢেলে নিলো একহাতা স্যুপ।

বাকিরা বাড়িটায় যা ছিল, সেসব নিয়ে ট্রাকে বোঝাই করতে শুরু করলো। একজোড়া বিছানা, একটা উনুন, একগাদা সেনাবাহিনীর ব্যাগপ্যাকেজ, ন্যাপস্যাক, একজোড়া রাইফেল, একটা ফিল্ডবাক্স, যেটার উপরে বাক্সের মালিকের নাম কালো কালি দিয়ে পরিষ্কার লেখা আছে- ওবারলেফটেন্যান্ট ডঃ গ্রেক। এছাড়া একগাদা কাচা কাপড়, বান্ডিল বাঁধা শার্ট, প্যান্ট, মোজা, ফারের লাইনিং দেওয়া গেঞ্জি।

ফাইনহালস চিলেকোঠার জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল… ‘আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। গ্রামের এক সারি পপলার গাছে সব আড়াল হয়ে গেছে। তোমরা কি কিছু শুনতে পাচ্ছ? আমি ভালই শুনতে পাচ্ছি।’

-‘হ্যাঁ!’ চিৎকার করে উঠলেন স্মিৎজ, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি। আপনি নেমে আসুন।’

-‘হ্যাঁ’ বলে উঠল ফাইনহালস। তার মুণ্ডুটা অদৃশ্য হয়ে গেল জানালা থেকে।

-‘কেউ বাঁধের উপরে উঠলে হত,’… স্মিৎজ বলে উঠলেন… ‘নিশ্চয়ই দেখা যেত সেখান থেকে।’

-‘কোনো মানে হয়না,’—বলে উঠল ট্রাকচালক, ‘সেখান থেকেও দেখা যাবেনা।’

-‘কিন্তু কেন?’

-‘শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে যে আসছে, অনেক দূর থেকে আওয়াজ আসে, কিন্তু এখনই দেখা যাবেনা। তাছাড়া, দু দিক থেকে আসছে।’ লোকটা দক্ষিণপশ্চিম দিকে আঙুল দেখালো। লোকটা বলবার পরে সবাই বুঝতে পারলো যে আলাদা আরেকটা গুমগুম আওয়াজ আসছে। দুটো আওয়াজ মিশে যাচ্ছে বলে ওরা বুঝতে পারেনি।

‘যাচ্ছেতাই!’ স্মিৎজ বলে উঠলেন… ‘কিন্তু আমরা কী করব এখন?’

‘পালাতে হবে।’ বলে উঠল ট্রাকচালক। সে সরে দাঁড়ালো, কারণ যে টেবিলে বসে সে খাচ্ছিল, এখন সেই বেঞ্চ আর টেবিলটা ট্রাকে তোলা হচ্ছে।

ফাইনহালস দক্ষিণের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে বলল… ‘একজন পেশেন্‌ট চিৎকার করছে।’

‘আমি যাচ্ছি দেখতে’ বলে উঠলেন স্মিৎজ… ‘আপনারা এগিয়ে যান।’

সবাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থেমে দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত। তার পরে ট্রাকচালক বাদে সবাই স্মিৎজের পেছন পেছন যেতে লাগলো। স্মিৎজ ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বলে উঠল, ‘আপনারা এগিয়ে যান। আমাকে এই অসুস্থ রুগিদের সঙ্গে থাকতেই হবে।’

সবাই থেমে রইলো, তারপর আধসেকেন্ড বাদে আবার স্মিৎজকে অনুসরণ করতে লাগলো।

-‘যাচ্ছেতাই!’ স্মিৎজ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আপনাদের যেতেই হবে। এখনই রওনা দিন এই অভিশপ্ত জায়গাটা ছেড়ে।’

এবার সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। স্মিৎজ দক্ষিণের বিল্ডিংএ ক্লিনিকে ঢুকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে শুধু শ্নাইডার পেছনে গেল। বাকিরা গাড়িতে গিয়ে উঠলো। ফাইনহালস একটুখানি দাঁড়ালো, তারপর কী করবে ভাবতে ভাবতে ঢুকে পড়লো বিল্ডিংএ। …

-‘আপনাদের আর কিছু লাগবে কি?’ শ্নাইডারকে দেখে জিজ্ঞেস করলে সে… ‘আমরা সব মাল ট্রাকে তুলে ফেলেছি।’

-‘রেখে যান কিছু রুটি, মাখন কিম্বা ফ্যাট… আর সিগারেট’। হঠাৎ ক্লিনিকের দরজাটা দুম করে আপনা থেকে খুলে গেল।

-‘হে ভগবান!’ ভেতরে চোখ পড়ায় ফাইনহালস চেঁচিয়ে উঠল… ‘এ যে ক্যাপ্টেন!’

-‘আপনি ওকে চেনেন? প্রশ্ন করলেন স্মিৎজ।

-‘হ্যাঁ’ বলে ওঠে ফাইনহালস, ‘আমি আধা দিন ছিলাম ওর ব্যাটালিয়নে।’

-‘কোথায়?’

-‘আমি জানি না, সেই জায়গাটার নাম কী!’

-‘এখন দয়া করে এখান থেকে চলে যান।’ চিৎকার করে ওঠেন স্মিৎজ… ‘আর কোনো কথা নয়।’

-‘আবার দেখা হবে’ বলে ফাইনহালস আর দাঁড়ায় না।

(চলবে)

2 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in



তখন ভোর হয়ে আসছে। একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে আকাশের রঙ। কালচে ধূসরের মধ্যে মিশে যাচ্ছে কমলা-হলুদ। সূর্যের বর্ণচ্ছটার মধ্যে দিয়ে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে শিশির। উত্তাল সমুদ্রপথ পেরিয়ে আমাদের জাহাজ পৌঁছেছে ডোভার বন্দরে। বাসের জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরে পাতুদা দাঁড়িয়ে। আমরা ইংল্যান্ড পৌঁছলাম।

এর আগের কিস্তিতে ব্রিটিশ ফুডের সঙ্গে আমাদের প্রথম সরাসরি সাক্ষাতের কথা লিখেছিলাম মনিকা কাকিমার হাতে ভাজা বেকন খাওয়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে। কিন্তু সাহেবি হেঁশেল নিয়ে লিখতে বসলে রীতিমত লেখাপড়া করার প্রয়োজন। প্রথমত ব্রিটিশ বলতে আমরা যা বুঝি, তার শ্রেণীবিন্যাস অনেক আর ঠিক কোন সরণি ধরে এই রন্ধন সংস্কৃতি বয়ে গেল এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীর দিকে, সে এক অতি রোমাঞ্চকর কাহিনী। প্রথমত ব্রিটিশ রান্নাবান্না বলতে আমরা যা বুঝি, তার ভাগ অনেক। স্কটিশ, ওয়েলশ বা আইরিশ খাবারের সঙ্গে ইংলিশ ফুডকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না একেবারেই। আজ যা ইংলিশ বলে বিখ্যাত, তার মধ্যে মার্কিনী, চিনা এবং ভারতীয় প্রভাব বিপুল। এর কারণ দুটো। এক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনে অভিবাসী মানুষের ঢল আর দুই, বিদেশ থেকে রান্নার উপকরণের আমদানি, যার সূত্রপাত ঘটেছিল অনেক আগেই। মধ্যযুগ থেকেই সৌখিন খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার জন্য ইংল্যান্ডের বিত্তবান সম্প্রদায় দূরদূরান্ত থেকে নিজেদের পছন্দমতো খাদ্য উপকরণ আনাতেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বিভিন্ন দেশ থেকে রাজত্ব করতে আসা জনজাতির খাদ্য সংস্কৃতির নিবিড় প্রভাব। যেমন রোমানরা নিয়ে এসেছিল ফলমূল এবং সবজি খাওয়া এবং রান্নার অভ্যেস। স্কান্ডিনাভিয়া থেকে এল মাছ-মাংস স্মোকিং আর ড্রায়িং এর কৌশল। আর নর্মানরা শেখালো ওয়াইন খেতে। বানিজ্যিক সম্পর্ক, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসায়িক আদান-প্রদানের ফলে সাহেবি রান্নাঘর ভরে উঠলো জাফরানের গন্ধে। নির্মিত হলো স্বতন্ত্র এক রন্ধন-সংস্কৃতি।

১৯৩৯ এ যখন যুদ্ধ লাগলো, নাৎসি জার্মানি অতলান্তিক দখলে রাখার লড়াইয়ে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ব্রিটেনমুখী জাহাজগুলির পথ অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে এক কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য চালু হয় ‘ফুড রেশনিং’ – যা অনেকাংশে বদলে দেয় সে দেশের খাওয়া-দাওয়ার ধরন-ধারণ। বলা যায় এই সন্ধিক্ষণ থেকেই শুরু হয়ে গেলো ক্যানড বা প্যাকেজড ফুডের যুগ। কিন্তু তার আগে একটু উঁকি মেরে দেখে নেওয়া যাক প্রভাবশালী ব্রিটিশ হেঁশেলটির অন্দরমহলে।

কিপার্স। এই মহার্ঘ বস্তুটি আসলে কী? মনে আছে, এর আগে জার্মানিতে বিশেষ বিশেষ সময়ে হেরিং মাছ খাওয়ার গল্প করেছিলাম? কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল অনেক পরে। ইংল্যান্ডের রান্নাবান্নার মধ্যে স্মোকিং-এর কৌশল জনপ্রিয় হওয়ার পর একটি পদ ওদেশের খাবার টেবিল আলো করেছিল অনেকদিন, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত, যতদিন না ‘ফাস্ট ফুড’ বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলেছে। হেরিং মাছকে প্রথমে লম্বালম্বি চিরে নিয়ে পোড়ানো হতো। তারপর তাতে মাখানো হতো নুন বা আচার। এইবার এই মাছটিকে হুকে ঝুলিয়ে ‘স্মোক’ করা হতো। এই প্রথা জন্ম দেয় একটি ইংরেজি শব্দেরও – tenterhook বা ‘আশঙ্কার দোলাচল’ আর এই শেষ পর্যায়টিই কিপারিং বলে বিখ্যাত হয়েছিল এবং এই পদটির নাম হয়েছিল কিপার্স। শেষমেশ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজন বা নৈশভোজ সর্বত্রই চোখে পড়তে লাগলো এই খাদ্যটি। শুধু বদলে যেত তার অনুষঙ্গ।

তা সেই প্রথমবার বিলেতে পা দেওয়ার আগে পর্যন্ত এই বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। যা হলো উইন্ডসর ক্যাসেল থেকে ফেরার পথে। সেটা ছিল একটা রবিবার। নানুকাকা আমাদের বললেন, চলো, তোমাদের উইন্ডসর ক্যাসেলটা দেখিয়ে আনি। আমাদের সেই অস্থায়ী বাসস্থান থেকে ঘণ্টাদুয়েকের পথ। নয়নাভিরাম সেই যাত্রা। এর আগে এবং পরে অন্যান্য দেশের প্রকৃতির (যার মধ্যে স্বদেশও আছে) সঙ্গে নানান সাক্ষাৎকার হয়েছে, যার মধ্যে ইতালির আমালফিও আছে কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে এই দেশের প্রকৃতির সঙ্গে অন্যদের একটা মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে। সেই তফাৎটা হলো ব্রিটিশদের বাগান করার স্বাভাবিক প্রবণতা, যা ওদেশের প্রকৃতিতে যোগ করেছে আলাদা একটি মাত্রা। সেই আশ্চর্য সুন্দর যাত্রার শেষে যেখানে পৌঁছনো গেলো, বিগত এক হাজার বছর ধরে যেখানে ব্রিটেনের রাজপরিবার বসবাস করে আসছে। বিশেষ ধরণের পাথর দিয়ে তৈরি এই দুর্গটিতে আছে প্রায় আড়াইশোর কাছাকাছি ঘর! আসবাব এবং অন্দরসজ্জা নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে আর্ট হিস্টোরিয়ান হওয়া ভালো। ভিতরে ঢোকার পর আমাদের ঘোর যতক্ষণে কাটলো, ততক্ষণে আমরা ক্ষুধার্ত। নানুকাকা আমাদের নিয়ে গেলেন কাছেই, একটি রেস্তোরাঁয়। অনেকেই দেখলাম সেই বস্তুটি পরখ করে দেখছেন। নানুকাকার পরামর্শে আমরাও ঠিক করলাম কিপার্সই খাবো। ঘ্রাণ যদি অর্ধেক ভোজনের কারণ হয়, আমাদের সেদিন তা হয়েছিল একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অতঃপর স্যালাড সহযোগে ধোঁয়াগন্ধী, ঈষৎ টক স্বাদের (সম্ভবত আচার ব্যবহারের কারণে) সেই মাছটি তারিয়ে তারিয়ে খেয়েছিলাম। আর এই পুরো সময়টা খেতে খেতেই নানুকাকা তাঁর কৌতুকী দৃষ্টি মেলে রেখেছিলেন আমাদের ওপর।

ব্রিটিশ বেকনের কথা তো আগেই লিখেছি। প্রথমবারের সেই বিলেতযাত্রায় আরেকটি বস্তুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। ইয়র্ক হ্যাম। হ্যাম তৈরি হয় শুয়োরের পিছনের পায়ের মাংস থেকে। খাদ্যরসিক মানুষ জানবেন এই হ্যাম প্রস্তুতির সুদীর্ঘ নেপথ্য কাহিনী। আর কোনও কোনও অঞ্চলের চিজ বা ওয়াইন, বিশেষত শ্যাম্পেনের মতোই এই হ্যামও ভীষণভাবে আঞ্চলিক ও আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত। এবং প্রতিটি এমন এলাকার বিশেষ ভৌগলিক ও যুগ-যুগান্ত ধরে মানুষের যাপনের ইতিহাস এর স্বাদ-গন্ধের সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে আছে, যা প্রায় অবিশ্বাস্য। সেই কারণেই এই ইয়র্ক হ্যাম, জার্মানির হ্বেস্টফালিয়ান হ্যাম, স্পেনের জামন সেরানো বা পারমা হ্যাম কিংবদন্তিপ্রতিম। আমরা ইংল্যান্ড পৌঁছনোর আগেই জার্মানিতে সেরা ঘরানার হ্যাম চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। অনেক পরে অবশ্য ইতালিয়ান প্রোসিউতোর স্বাদ রসনায় গ্রহণ করার পর মনে হয়েছিলো তা সর্বোত্তম। পারমার ঢেউখেলানো সবুজ প্রান্তরের মতোই হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়া ছিল সেই আস্বাদন। শোনা যায় ইয়র্ক হ্যাম কিওরিং-এর জন্য একসময় ব্যবহার হতো ওক কাঠের গুঁড়ো। যে ওক কাঠ নাকি ব্যবহার হয়েছিলো ‘ইয়র্ক মিন্সটার’ ক্যাথিড্রাল নির্মাণের কাজে। কিন্তু শুধুমাত্র লোকগাথা নয়। কোনও খাদ্যবস্তুকে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে গেলে সর্বোচ্চ মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হয়।

স্মোকিং-এর কথা যখন উঠলোই স্মোকড হ্যাডক বা স্যামনের প্রসঙ্গ আসবেই। আর সেই প্রসঙ্গে আসবে স্মোকড হ্যাডক সহযোগে তৈরি একটি পদ যার উৎপত্তিস্থল ভারত এবং কালক্রমে যা অর্জন করেছিলো ব্রিটেনের জাতীয় খাদ্যের পদাধিকার। কেডগেরি, যে নামটি এককথায় খিচুড়ির অপভ্রংশ। শতাব্দী-প্রাচীন যে রান্নাটি ভারতের প্রতিটি প্রদেশে আলাদা আলাদা চেহারায় পাতে জায়গা করে নিয়েছে স্বাস্থ্যকর এবং স্বাদু ভাবমূর্তি নিয়ে, ঔপনিবেশিক ভারত থেকে সেই ‘ওয়ান পট’ মিল ধারণ করলো আরেকটি নাম। ১৭৯০ সাল নাগাদ একটি রেসিপি বইতে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বাকিটা ইতিহাস। ভারতীয় খিচুড়ি থেকে বিদায় নিলো ডাল। প্রবেশ ঘটলো স্মোকড বা পোচড মাছ আর সিদ্ধ ডিমের। কেমন দাঁড়াচ্ছে তাহলে বিষয়টা? গোড়াতেই ডিমটা সিদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর ভাত রান্নার পালা। এরপর স্মোকড হ্যাডক বা ওইধরনের কোনও মাছ থাকলে ভালো অন্যথায় মাছের ফিলেগুলো দুধে পোচ করে নিতে হবে। এরপর মেশানোর কাজ। মাখনে পেঁয়াজ অল্প ভেজে নিয়ে তাতে দিতে হবে ছোটো এলাচ আর তেজপাতা, এইবার কারি পাউডার দিয়ে রান্না করা ভাতটি মিশ্রণের মধ্যে দিয়ে কয়েক মিনিট রান্না করতে হবে যতক্ষণ না সেটি সোনালী হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। তারপর মাছের টুকরো আর ডিমকে চার ভাগ করে সেই খিচুড়ি বা কেডগেরিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার কাজ। শেষে ওপরে টাটকা পার্সলি ছড়িয়ে দিলেই পদটি পরিবেশনযোগ্য। ডোভার থেকে ফেরার বাস ধরবো যে বিকেলে, সেদিনই দুপুরে মনিকা কাকিমা আমাদের জন্য রান্না করেছিলেন খিচুড়ির তখনও পর্যন্ত অজানা এই অবতার।

সেবারের ইউরোপ ভ্রমণের পর দেশে ফিরে এক ঘরোয়া আড্ডায় আমি রান্না করেছিলাম কেডগেরি, যেখানে হ্যাডকের পরিবর্তে ব্যবহার করেছিলাম আমাদের অতিপ্রিয় ভেটকি। খাওয়া শেষ হওয়ার পর বন্ধুদের চোখে-মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ দেখে মনে হয়েছিলো সেই নিরীক্ষা বিফল হয়নি। সবচেয়ে বড়োকথা রোস্ট বিফ, ইয়র্কশায়ার পুডিং, কিডনি পাই বা ফিশ অ্যান্ড চিপস্‌-এর প্রচলিত ধারণার বাইরেও যে ব্রিটিশ ফুড বলে আরও কিছ হয়, দীর্ঘ পথ যাত্রা করা, এক মহাদেশ থেকে অন্য আরেক মহাদেশের খাদ্যজগতে নবরূপে নিজের একটা নিজস্ব জায়গা তৈরি করা সহজ ছিল না। আপাত-নিরীহ এই জিনিসটি যা নিশ্চিতভাবেই করতে পেরেছে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - অসিত কর্মকার

Posted in



পর্ব ৪

এখনও ভোর পেরিয়ে ভাল করে সকাল হয়নি। পুবাকাশের রক্তাভ ছাই ছাই মুখ। ভুলন আর ফকরাকে সঙ্গে নিয়ে গয়ান চলেছে ঝগড়ুর কাছে। কাল রাতে হোপনা সোরেন তার দলবল নিয়ে গয়ানের বাড়ি এসে গয়ানকে শাসিয়ে গেছে। মিটিংএ গয়ানের মুখ খোলা চলবে না। যা বলার নেতা বাবুরা বলবে আর নেতাদের পাশে গয়ানকে বসতেই হবে। হোপনা সোরেনের কথাগুলো চুপ থেকে শুনে গেছে গয়ান। টু শব্দটি করেনি গয়ান। গয়ান মনে করে, এখন মাথা ঠান্ডা রেখে ধৈর্য ধরে তাদের এগোতে হবে।
কিন্তু হোপনা সোরেনের অন্যায্য দাবিতে বাহামনির মাথায় আগুন চড়ে। আর ধৈর্য রাখতে পারে না বাহামনি। সে চিৎকার করে বলে ওঠে, তুমহার ই কী অল্যায্য আব্দারট আছে গ, বুঢঢা মিটিনট ডাকল আর সিখানে কথাট বলবেক অই লিতাবাবুরা! কিনহ? বড় বড় চোখ করে আগুন ঝরায় বাহামনি।
সি কইফিয়তট তমাকে দিবক লাই।ই হামার অডারট আছে! হোপনা সোরেনের গলায় তীব্র আদেশের সুর।
হুঃ, অডার! বাহামনির শারীরিক ভঙ্গিমায় আর কন্ঠস্বরে তাচ্ছিল্য, অডারট না মানলেহ কী করবেক? বুঢঢাকে মারবেক? উঃ, সব লিতা হইয়েছে গ! ইত্ত বছ্ছরে ইকটা বিরিজট বানহাইবার ক্ষমতাট লাই, আবার লিতা হইয়েছে! কাজট ত তুমহাদের খালি ভোটট লুট করহা! হোপনা সোরেনের মুখের উপর আঙুল তুলে কথাগুলো বলে যায় বাহামনি।
দেখে প্রমাদ গোনে গয়ান। বুঢঢি, তু চুপ যা! বাহামনিকে থামাবার চেষ্টা করে গয়ান।
হামি চুপট না করলে উয়ারা কী করবেক শুনহি, হামাদের মারবেক? মারিট দিখখুক লা, হামাদের হাঁসুয়া ভি রক্তট লিবেক! বাহামনি গলা ছেড়ে চিৎকার করে ঘোষণা করে। আলোআঁধারিতে তার গনগনে মুখমণ্ডলে চোখদুটো ভয়ঙ্কর হয়ে জ্বলছে। যেন হাঁসুয়াটা হাতে পেলে এক্ষুনি সে হোপনা সোরেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
তারপর থেকে গয়ানের দুশ্চিন্তা, এই মিটিংএর ডাকে ঝগড়ুও আছে।সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে ঝগড়ু। রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারেনি গয়ান। কখন রাত ফুরিয়ে ভোর নামে পৃথিবীতে। সেই অপেক্ষায় খালি ছটফট করে কাটিয়েছে। ঝগড়ুকে সাবধানে থাকার কথা বলতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখে যেন সে। উত্তেজনার বশে বেফাঁস কোনও কথা যেন না বলে বসে। তাহলেই সব আয়োজন মাটি।ঝগড়ু এই লড়াই আন্দোলনের মাথা। বয়স গয়ানের শরীর মনের জোস্ কেড়ে নিয়েছে। বুদ্ধি পরামর্শটুকু দেওয়াই এখন তার সার কাজ।
গয়ানের সঙ্গে ভুলন, ফকরা আর কালকের প্রচারের অনেক যুবকও আছে। আছে কিছু বয়স্ক মানুষও। বয়স্কারা গয়ানকে এই সকালে এতজনের সঙ্গে হাঁটতে দেখেই বুঝেছে, নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যাপার আছে। তাই গয়ানের পাশে দাঁড়াতে তার সঙ্গ নিয়েছে। ঘটনা কী জানতে চেয়েছে। চলতে চলতে গয়ান ওদের কাল রাতের ঘটনাটা বলে। শুনে ওদের শরীরের রক্ত যেন গরম হয়ে ওঠে। হোপনা সোরেনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ব্রিজটা এবার ওরা আদায় করে ছাড়বেই!
ঝগড়ুর ঘরদোরের এ কী ছারখার অবস্থা! দেখে ভিড়টা আৎকে ওঠে। অচেতন ঝগড়ু উঠোনের একপাশে পড়ে আছে। গয়ান বুঝে যায়, এ নির্ঘাত হোপনা সোরেনের কাজ। যা সে আশঙ্কা করছিল। পুরো ভিড়টা একরকম দৌড়ে ঝগড়ুর কাছে এল। গুটিগুটি পায়ে গয়ান ওদের মাঝে এসে দাঁড়াল। বুকের ভেতরটা তার কষ্টে ছেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে ভেঙ্গে পড়ার কথা মনেও আনল না।
মারিট ফিলে লাই ত? শঙ্কাকাতর গয়ান চিৎকার করে ফের বলে, দিখ দিখ, ওয়ার লিশশাসট পড়ছহে কিনা দিখ। বুকটর ধুকপুকট আছহে কিনহা দিখ।জলট লিইহে আয়, মুখটয় ঝাপটাট মার। গাটয় বারবার ধাক্কাট মার।
ওরা মুহূর্তের মধ্যে একেক জন একেকটা কাজে হাত লাগায়। একজন ঝগড়ুর নাকের সামনে হাত রাখে।শ্বাসপ্রশ্বাস খোঁজে। একজন বুকের উপর হাত রাখে। হৃৎস্পন্দন খোঁজে। একজন চোখের পাতা টেনে অক্ষিগোলকে প্রাণের অস্তিত্বের চিহ্ন খোঁজে। একজন দৌড়ে যায় জল আনতে। জ্ঞান ফেরাতে হবে। কয়েকজন মিলে ধাক্কা দিতে থাকে। যাতে এই করেই জ্ঞান ফেরানো যায়।
গাটয় মিলা জ্বর গ, লাঠির বাড়িটর দাহগ ভি অনহেক।
হাঁ, ধুকপুকট আছহে মনে লয় গ খুড়া।
হাঁ হাঁ, নিশশাসট ভি পড়ছহে গ খুড়া। জলটর ঝাপটাট মার ইখহন বেশহিট করহে।
চখ দুটা ভি কথাট বুলছে খুড়া।
মার ধাক্কাট, মার জোর! পিছনের ভিড়টা চিৎকার করে ওঠে।
ভিড়টা ঝগড়ুর নাম ধরে বারবার ডাকতে থাকে। কিছুক্ষণ বাদে ঝগড়ু হাল্কা করে চোখ মেলে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কেঁপে ওঠে। জলের স্বাদ নিতে জিভটা একটু বার করে ঠোঁটদুটো চাটার চেষ্টা করে। ভিড়টা আশান্বিত হয়ে ওঠে, বেঁচে আছে ঝগড়ু! আরও কয়েকবার ডাকতে ঝগড়ু পুরোপুরি চোখ মেলে তাকায়। জলও খায় খানিকটা। সম্বিতে ফেরে সে। চোখের সামনে গয়ানকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
খুড়া গ, দিখ, হোপনা খুড়া হামার কী দশাট করিছে, দিখ।হামি ইকলা অতগুলানের সঙ্গি লড়াইট দিতহে পারলাম লা গ খুড়া। হামার লাঠিট লা সরাই লিলে উয়াদের ক্ষমতাট ইকবার দিখতাম গ খুড়া! ঝগড়ুর কন্ঠস্বরে তেজ ফুটে ওঠে।
হোপনা হামাকে ভি শাসাইট গিইছহে। ইখন তু চুপ যা ঝগড়ু, শরীলট তর ভাল লাই। গয়ান বলে।
সবাই মিলে ঝগড়ুকে ধরাধরি করে দাওয়ার চারপেয়েতে শুইয়ে দেয়। ব্যথায় কাতর ঝগড়ু জিজ্ঞেস করে, অ খুড়া, ইকটা ডালে অনহেক পাতা, ইক ইকটা পাতা মানেট হল ইক ইকট মানহুষ, লয় খুড়া? ইর মানিট হল, ইকট ডালহে অনহেকগুলহা মানহুষ, লয় গ?
শুনে অবাক হয় গয়ান। ওদের সম্প্রদায়ের মাথারা জমায়েতে ডাক দিলে সঙ্গে গাছের ডাল রাখে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন গয়ানের মনে কখনও জাগেনি। এতদিন এটাকে গয়ান নিয়ম বলেই জেনে এসেছে। কারণ, এই নিয়ম কেন, কী জন্য তা তার বাপঠাকুর্দাদের কাছ থেকে গয়ান কিছু জানতে পারেনি। তারা শুধু বলেছে, ইটা লিতে হয়। ব্যস এটুকুই। কিন্তু আজ ঝগড়ু যে ব্যাখ্যাটা দিল তা বড় ভাল লাগল গয়ানের। মন থেকে মেনেও নিতে কোনও দ্বিধা মনে জাগছে না তার। বলল, তু ঠিকহিট বুলেছিস ঝগড়ু। হামাদের জমায়েতট হইল গাছটর সবুজ ডালটর মতহ, একজায়গাটয় অনহেক পাতহার মানহুষ ।
কী আশায় ঝগড়ুর চোখদুটো সহসা চকচক করে ওঠে। তার মুখমণ্ডলজুড়ে সকালের এক ফালি নরম আলো। ওই আলোটুকুই যেন গয়ানের কথায় তার মনে জ্বলে ওঠা আশার আলোর বহিঃপ্রকাশ। বলল, তাহলে খুড়া, হামাদের সকলটর হাতহে হাতহে ডালট থাকহার মানিট হল আরও অনহেক অনহেক মানহুষ!
হাঁ ঝগড়ু, তু ঠিকহি ত বুলেছিস। গয়ান বারকয়েক মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
ঝগড়ুর পাশে এখন অনেকেই। বিশেষ করে গয়ান। মার খেয়ে ঝগড়ু এখন বেপরোয়াও। লড়াইয়ের জমি সে এক ইঞ্চিও ছাড়তে চায় না। তার এই বেপরোয়া মনের জোসই যেন তার শারীরিক যত অক্ষমতাকে দ্রুত ধুয়েমুছে সাফ করে দিচ্ছে। ফলে সে সুস্থ বোধ করছে। উঠে বসে। গয়ান বাধা দিতে এলে বলে, হামাকে শুইহেট থাকলেক হবেক লাই গ খুড়া। সময়ট কম আছহে। গাঁভর মিছিলট ফির ঘুরাইতে হবেক।তমহার বলা দাবির কথাগুলহান মানহুষগুলহানের মনটয় গিঁথহে দিতে হবেক। অই ডালগুলহান হবেক হামাদের জমায়েতেট ডাকার নিশানা আর হামাদের লড়াই আন্দোলনহের পতাকা ভি।
দুলকিগাঁয়ের লড়াই আন্দোলনকারী মানুষগুলোর পতাকা এখন ওদের হাতে হাতে ধরা গাছের সবুজ ডাল।গয়ান সায় দেয় ঝগড়ুর কথায়।
ঝোড়ো বাতাস কী দিনের আলোর চেয়েও দ্রুত সারা গাঁয়ে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। গেল রাতে হোপনা সোরেন তার দলবল নিয়ে এসে গয়ান সরদারকে শাসিয়ে গেছে। আর ঝগড়ুকে তো মেরেই ফেলেছিল প্রায়। সেইসঙ্গে ঝগড়ুর ঘরদোরের অবস্থা লন্ডভন্ড করে রেখে গেছে। ওদের অর্ডার না মানার শাস্তি। সারা গাঁ এখন তাই হোপনা সোরেনের বিরুদ্ধে রাগে ক্ষোভে গনগনে আঁচে ফুটছে যেন।
ওদের মিছিলটা দুলকিগাঁয়ের পথে পথে ক্রমশই বড় হচ্ছে। যেই মিছিলে পা মেলাচ্ছে সেই কাছেপিঠের গাছ থেকে ছোটবড় যাই হোক একটা ডাল ভেঙ্গে নিয়ে হাতে নিচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে হয়, চলমান এক সবুজ বনানী, নদীর মতো বয়ে চলেছে। তা থেকে তারুণ্যের জোস ভরা কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে ওদের দাবি। হোপনা সোরেনের ভিটির সামনে এসে মিছিলটা থমকে দাঁড়ায়। ওদের কন্ঠস্বর এখন আরও তীব্রতর। স্লোগানে নতুন কথা যোগ হয়। হোপনা সোরেন নিপাতট যাও, হোপনা সোরেনটর কালো হাত ভাঙি দাও গুড়াই দাও! মিছিল আরও উত্তাল হয়ে ওঠে।
ঘরে বসে হোপনা সোরেন প্রমাদ গোনে, এবারে ভোট লুঠ করা কঠিন হবে না তো! কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার মানুষ হোপনা সোরেন নয়। আসল সময়ে পার্টিকে না দেখলে সারা বছর পার্টিই বা তাকে দেখতে যাবে কেন? আর পার্টি না দেখা মানেই তো তার প্রভাব, প্রতিপত্তি সবই গেল। আর প্রভাব প্রতিপত্তি না থাকলে সমাজে তার দামটাই বা কী থাকবে।
হোপনা সোরেনের মন তাই আরও জটিল প্যাঁচ কষতে থাকে। কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিরুদ্ধে চলে যাওয়া এই মানুষগুলোকে স্বপক্ষে আনা যায়!
ক্রমশ...

0 comments: