Next
Previous
0

গল্প - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in






আজ পয়লা এপ্রিল। আজ থেকেই শুরু করব খেলাটা। আমার বেডসাইড টেবিলে একটা স্বচ্ছ কাঁচের শিশি। শিশির মধ্যে একই রকম দেখতে তিরিশটা ক্যাপসুল। রাত বারোটায় প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে একটা করে ক্যাপসুল খাব। তারপর টেবিলেই রাখা ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে সেই তারিখের পাশে একটা টিক দিয়ে শুয়ে পড়ব। খেলাটায় একটা সাসপেন্স আছে। কতগুলো তারিখে টিক পড়বে তা অনিশ্চিত। একটা মাত্র পড়তে পারে আবার তিরিশটাও পড়তে পারে। তবে ক্যালেন্ডারের এই পাতাটা ওলটাতে হবে না কোনোদিনই। পয়লা মে আমাকে দেখতে হবে না সেটা নিশ্চিত। এই তিরিশটার মধ্যে ঊনত্রিশটা ভিটামিন ক্যাপসুল হলেও একটার খোলে ভরা আছে পটাসিয়াম সায়ানাইড।

***

ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেল। তার আগে এখানেই জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট পদে ছিলাম পাঁচ বছর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরখানেক পর আমাকে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মন্ত্রকের প্রধান সচিব পদে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই পদ নিতে অস্বীকার করে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বিশেষ বেতনক্রম দিয়ে আমাকে এই পদেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা প্রায় তিন বছর আগের কথা। বিশেষ বেতনক্রম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার আমকে একটি বিশেষ প্রোজেক্টের দায়িত্বও অর্পণ করে। চূড়ান্ত গোপনীয় প্রোজেক্ট। তিন মাস অন্তর এই প্রোজেক্টের প্রোগ্রেস রিপোর্ট বিভাগীয় মন্ত্রীর হাতে আমাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কাজ শুরুর আগে এই গবেষণায় আমার সহকারী হিসাবে একজন জুনিয়ার বিজ্ঞানীকে নিযুক্ত করেছে সরকার। নিয়ম অনুসারে ইউপিএসসি একটি ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করেছিল ঠিকই। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে সেই পদে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করার সম্পূর্ণ অধিকার ও দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই আমিই পছন্দ করেছিলাম মধুমিতাকে। সে অক্সফোর্ডের ডক্টরেট। অবশ্য সে ছাড়া আরও দুজন প্রার্থী বিষয়ের উপর যাবতীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটির হাই-পাওয়ার চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখের আত্মবিশ্বাসী চাহনিই শেষ পর্যন্ত পার্থক্যটা গড়ে দিল। কাজ শুরু হওয়ার পর উপলব্ধি করেছিলাম আমার প্রার্থী-নির্বাচন নির্ভুল। মধুমিতা মেধাবী, পরিশ্রমী, দায়িত্ববান এবং বিষয়ের উপর যথেষ্ট দখল আছে তার। আমি ভাবতেই পারিনি সে আমার বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে।

***

আমি নিজেও বুঝি আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে আমার মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি। আমি অমিশুক, সামাজিকতায় স্বচ্ছন্দ নই, এবং কোনো ঘনিষ্ঠ বা আন্তরিক সম্পর্কে ঢুকে পড়ায় আমার স্বাভাবিক অনীহা আছে। আমার বাল্য ও কিশোরকাল অত্যন্ত অবহেলায় কেটেছে বলেই হয়তো আমার চরিত্রটা এমনই গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাগ্রহী কাকার পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল। সেখানে দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে সংসারের বহুরকম কাজ করতে হত। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ রাখতে বাড়ির কাছে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কাকা। ভাগ্য ভালো, মেধা আর ইচ্ছের জোরে পড়াশুনাটা অব্যাহত ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে অসাধারণ রেজাল্ট করার পর আমাকে আর ভাবতে হয়নি। কাকার বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে উঠেছিলাম। সেখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন স্বাভাবিক তরুণের মতো হয়ে উঠতে পারলাম না। পড়াশোনার জগতে একা একা কাটানোই আমার নিয়তি হয়ে উঠল। একজন সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে-থা, সংসার ইত্যাদির চিন্তা কোনোদিনই আমার মনে ঠাঁই পায়নি। এই করেই প্রৌঢ়ত্বে প্রায় পৌঁছে গেলাম। আগামী পয়লা মে পঁয়তাল্লিশে পা দেওয়ার কথা। সেদিন আমার এই প্রোজেক্টের কাজের সময়সীমাও অতিক্রান্ত হবে। আর ঠিক তিরিশ দিন বাকি আছে সেই দিনটি আসতে। সে-পর্যন্ত যেতে পারলে জন্মদিনই হতে পারে আমার মৃত্যুদিন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তিরিশের মধ্যে মাত্র এক।

***

এই ইন্সটিটিউটে মধুমিতার যোগদান করার দিন থেকেই আমি প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছিলাম। এর জন্যে বিশেষভাবে তৈরি ল্যাবরেটরিটি ইন্সটিটিউট-চত্বরের এক প্রান্তে অবস্থিত। এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়ার ইনস্পেকটরকে এই পরীক্ষাগারের সুরক্ষা-ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আমার থাকার জন্য পরীক্ষাগারের লাগোয়া দুই-ঘর বিশিষ্ট একটি আবাসও আছে। খাবারের ব্যবস্থা ইন্সটিটিউটের ক্যান্টিনে।

প্রথম বছরটা প্রায় শেষ হয়েছিল গবেষণার কাজে নিমগ্ন থেকে। আমার স্বভাব অনুযায়ী মধুমিতার সঙ্গে সম্পর্কটা কাজের স্তরেই আটকে ছিল। মধুমিতা চেষ্টা করেও আমার নিরাসক্তির বর্মে আঁচড় কাটতে পারেনি। আমি তার কাজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলার উপক্রম করলেই আমার দীর্ঘকালীন অভ্যাসে রপ্ত করা উদাসীন চাহনিটি ঝুলিয়ে দিতাম চোখে।

আমার রক্ষণ আলগা হতে শুরু করল ঠিক দশ মাসের মাথায় যখন অপ্রত্যাশিত অল্প সময়ে প্রোজেক্টের প্রথম ধাপে সফলতা এসে গেল। এই ধাপে আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের জেনোমে এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার জিনগুলিকে শনাক্ত করা। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ‘অপর’ একজনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ব্যথাযন্ত্রণাইত্যাদি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে। তার জন্যে যে-জিনগুলি দায়ি সেগুলিই হল এমপ্যাথির জিন। এগুলো শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল যে আমার পুরনো কাজের সূত্রেই আমি নিশ্চিত ছিলাম এই জিনগুলো কেবলমাত্র মস্তিস্কের নিওরন-কোষেই অবস্থান করে। ফলে আমার অনুসন্ধানের কাজটা একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা ছিল প্রোজেক্টের সিংহভাগ সময় নেবে এই শনাক্তকরণ। দ্বিতীয় ধাপের কাজটা তুলনায় সহজ। এই ধাপে এমপ্যাথির জিনে মিউটেশন ঘটিয়ে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। এটা সহজ, কারণ মাইক্রোইভোলিউশন ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা অঙ্গ, যার ফলে কোনো কোনো কার্যক্ষম জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, আবার উলটোটাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ, যেটা স্বাভাবিকভাবে এবং দীর্ঘ সময়ান্তরে ঘটে সেটা আমাকে কৃত্রিমভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে।

যেদিন এই শনাক্তকরণ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হল, সেদিন আনন্দের আতিশয্যে আমি বোধহয় খানিকটা লঘুচিত্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেই সুযোগে মধুমিতা আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছিল। বলেছিল, - এই সাফল্যটা আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত স্যার।

সেদিনই সম্ভবত প্রথম আমি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মধুমিতাকে লক্ষ করলাম। তার দৃষ্টিতে একটা সহজ আন্তরিকতা ছিল, সে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চশমা খোলার জন্যেই কি না জানি না, তার চোখের পাতা ভারী, দৃষ্টি গভীর। সহসা তার মুখটিকে আকর্ষণীয় মনে হল আমার। উদার হয়ে বললাম, - বেশ, কী করতে চাও বলো।

সে বলল, - কাল কোনো কাজ নয়, আমাদের অনেক ছুটি পাওনা হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে খেতে খেতে আপনার জিভে নিশ্চয়ই কড়া পড়ে গেছে। কাল বাড়ি থেকে আমাদের দুজনের জন্য একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে এনে একসঙ্গে বসে খাব। আর সারাদিন গল্প করব। কাজের কথা কিন্তু নয় স্যার। সেটা বাদ দিয়ে আমাদের দুজনের যা ইচ্ছে হবে সেসব নিয়েই কথা হবে।

আমার অস্বস্তি হলেও আপত্তি জানাতে পারলাম না।

***

সেই শুরু। আস্তে আস্তে দেখা গেল প্রতি সপ্তাহে একটা দিন তার বাড়ির রান্না-করা খাবার নিয়ে এসে একসঙ্গে খাওয়াটা রুটিন করে ফেলেছে মধুমিতা। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তার আদানপ্রদান খুবই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। একদিন সে দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, - আপনি বিয়ে করেননি কেন স্যার?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আমি চুপ করে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। সেই অবসরে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল মধুমিতা। আমি আনমনা হয়ে উত্তর দিয়ে চলেছিলাম। পরে বুঝলাম আমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত আমার জীবনকাহিনির পুরোটাই জেনে নিল সে। আমার বিয়ে না করা নিয়ে আর কোনোদিন কোনো প্রশ্ন সে করেনি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে মধুমিতার ব্যক্তিজীবন নিয়ে আমারও একটা আগ্রহ জন্মাচ্ছিল। জানতে চাওয়ার ব্যাপারে আমি সংকোচহীন হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মধুমিতা যেন টের পেয়ে গিয়েছিল আমার আগ্রহটা। ফলে ধীরে ধীরে জেনে গেলাম তার মা-বাবা কর্মসূত্রে ইউ কে-তে আছেন দীর্ঘকাল। মধুমিতার স্কুলশিক্ষা কলকাতায় হস্টেলে থেকে সমাপ্ত হলেও গ্র্যাজুয়েসন, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রি সে অক্সফোর্ড থেকে করেছে। কিন্তু তারপরেই সে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এদেশে চলে এসে কর্মজীবন শুরু করে আজ থেকে বছর ছয়েক আগে। এখানে সে পৈতৃক ফ্ল্যাটে একাই থাকে। একদিন বলল, - আপনি তো বাইরে বেরনই না। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? একদিন চলুন না আমার ফ্ল্যাটে?

আমি বললাম, - তুমি একা থাকো – যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না।

মধুমিতা কৌতুকের সুরে বলল, - একা থাকি না স্যার। সঙ্গে থাকে একজন। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। চলুন না –

একটি যুবতী মেয়ের প্রাইভেট লাইফ নিয়ে কৌতূহল হওয়া ঠিক নয় কিন্তু অন্যায্যভাবে সেটাই জেগে উঠল মনে।

একদিন সে নিয়ে গেল তার ফ্ল্যাটে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার সেই ‘একজন’-কে। পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। ঢলোঢলো মুখে মায়াভরা চোখ নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেই মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, - কে?

একচোখ হাসি নিয়ে মধুমিতা বলল, - আমার মেয়ে।

--তুমি বিবাহিতা – বলোনি তো –

--মা হতে গেলে বিবাহিত হতেই হবে স্যার?

--না – মানে – আমি কথা খুঁজে গেলাম না।

মাধুমিতার ফ্ল্যাটে একজন সাহায্যকারীও আছেন। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকেন। মধুমিতা জানাল তিনি প্রশিক্ষিত পালিকা। মেয়ের দেখাশোনা করাই তাঁর প্রধান কাজ। চুক্তির বাইরে গিয়ে গৃহকর্মের কাজেও সাহায্য করেন। মেয়ের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াত তাঁকেই করতে হয় বেশির ভাগ সময়।

সেদিন তার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া শেষে তার মা হওয়ার গল্প শোনাল মধুমিতা। অক্সফোর্ডের পড়াশুনা শেষ করে মা-বাবার সঙ্গে এক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল মধুমিতা। ওখানে কয়েকটা কাজের অফার ছিল। ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই ঠিক ছিল। এখানে থাকতে একদিন পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিল মধুমিতা। একটা লঞ্চ ভাড়া করে তিনদিনের ভ্রমণ। সেই লঞ্চে চালকের সহযোগীদের মধ্যে তার বউও ছিল। বউ-এর কোলে তিন-চার মাসের একটা বাচ্চা। মধুমিতা লক্ষ করল বয়স্ক চালকের যুবতী বউটি প্রায়ই বাচ্চাটাকে ইঞ্জিন ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রেখে অন্য একজন তরুণ সহযোগীর সঙ্গে হাসিগল্পে মজে থাকছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কেঁদেই চলেছে, কোনো হুঁশ নেই বউটার। বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে এসে বিঁধতে লাগল। থাকতে না পেরে বউটাকে গিয়ে ধরল, - তোমার বাচ্চা কাঁদছে, শুনতে পাচ্ছো না?

বউটা বলল, - আমার বাচ্চা কেনে হবে, ননদটা বিয়োতে গিয়ে মরেচে, তার সোয়ামিটাও খ্যাপাপাগলা। কেউ দায়িত্ব নিলনিকো – আমার ইনি সাধু সেজে মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাইপ্পে দিল। আমার নিজেরই তিনটা আছে। সেগুলাকে ঘরে থুয়ে এসচি, এই কচিটার ভার কে লেবে? খিদার জ্বালায় কেন্দে মচ্চে, কত আর দুধ গুলে খাওয়াই!আমার মাই তো শুককে গেছে।

বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে স্থায়ী হয়ে গেল। ফেরার সময় চালকের সঙ্গে কথা বলে তার ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় ফিরেই একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দত্তক নেওয়ার আইনকানুন বুঝে নিয়ে চালককে সব জানাল। এদিকে লন্ডনে ফেরার সময় এসে গিয়েছিল। মধুমিতা গেল না। এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তিন দিন ধরে বাদানুবাদ চলল। মধুমিতা সংকল্প থেকে নড়ল না। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর দত্তক দলিল তৈরি হল। নির্দিষ্ট দিনে চালক মেয়েটাকে নিয়ে একাই এসেছিল। রেজিস্ট্রি হওয়ার পর লোকটির চোখে জল। বলল, - আমার অভাগী বুনের আত্মাটা শান্তি পাইল মা। একটা সোন্দর জীবন অনাথ মেয়েটার কপালে লেখা হয়ে গেল।

একটা বিখ্যাত পালিকা কেন্দ্রের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিল মধুমিতা। এই ভদ্রমহিলা সেদিন থেকেই বাচ্চাটির দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।

***

প্রোজেক্টের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেছিলাম। একের পর এক উৎসেচকের ব্যবহার এবং ডিএনএ-এর বেস বদল করতে করতে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই পদ্ধতিতেই জিন ফ্রিকোয়েন্সির এমন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যাতে উদ্দিষ্ট জিনগুলি স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। বছরখানেকের মধ্যেই আংশিক সফলতা এল। এমপ্যাথির জিন নিষ্ক্রিয় হল কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। আমি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়েও নিস্ক্রিয়তাকে স্থায়ী করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন একই ফল পেতে পেতে আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। ভালো করে খতিয়ে দেখে মনে হল, নিষ্ক্রিয় জিনের সক্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়, কেউ যেন এদের উপর রিভার্স পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করছে। একটু ভাবতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগল মাথায়! মধুমিতা ছাড়া আর কারোর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তবে কি মধুমিতাই! কিন্তু কেন?

নিমেষেই মনে পড়ে গেল মধুমিতা একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল, - এই প্রোজেক্টের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে ভেবেছেন স্যার? সহমর্মিতাহীন মানুষ মানে তো ভয়ংকর এক জীব। তাদের বুদ্ধি থাকবে, দক্ষতা থাকবে অথচ মানবিক বোধ থাকবে না। যে কোনও ধরনের পৈশাচিক কাজে তাদের ব্যবহার করতে পারবে সরকার। ধরুন এদের নিয়ে কোনো গুপ্ত বাহিনী গঠন করল সরকার। তারপর সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের সব ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে এদের ব্যবহার করতে লাগল।

আমি বলেছিলাম, - এসব তো রাজনীতির কথা। আমরা বিজ্ঞানী, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করাই আমাদের একমাত্র কাজ।

তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করে গিয়েছিল মধুমিতা। প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথায় ঢুকে পড়েছিল। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। মধুমিতা আগেভাগেই আমাকে সন্দেহপরায়ণ করে তুলতে চায়নি। তাহলে তাকে গবেষণা থেকে ছেঁটে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

প্রোজেক্টের সময়সীমা শেষ হতে দুটো মাসও বাকি নেই। মধুমিতাকে ছেঁটে দিয়ে নতুন করে আরম্ভ করার সুযোগ মিলছে না। আমার ক্যারিয়ারে এর আগে কোনোদিন ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়নি। সরকারের অগাধ আস্থা ছিল আমার উপর। সেটা তো গেলই, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী হিসাবে আমার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। এতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করল মধুমিতা! নিমেষে সব রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল আমার। রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। দ্রুত পায়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলাম। মধুমিতা তার চেয়ারে বসে কিছু একটা করছিল। আমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তারপর ডান আর বাঁ হাত দিয়ে সপাটে চড় কষাতে লাগলাম তার দুই গালে।

কতক্ষণ পরে থেমেছিলাম জানি না। মধুমিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এক চুলও সরেনি। আমি থামার পর ধীরে ধীরে বসল চেয়ারে। তার রক্তলাল দুই গাল বেয়ে ঝরে চলল অশ্রুধারা। তার ভেজা চোখ তখনও নিবদ্ধ আমারই দু-চোখে। জানি না সহসা কী দেখলাম সেই দৃষ্টিতে, তীক্ষ্ণ কিছু একটা এসে বিঁধে গেল আমার বুকে। আর আমার মন জুড়ে অনুভবের পরিব্যক্তি ঘটে চলল। আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মধুমিতার কোলে মুখ গুঁজে দিলাম।

***

সেদিনের পর মধুমিতা আর আসেনি। ক্যুরিয়ার মারফৎ তার পদত্যাগপত্র আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা আজ অব্দি আমার ড্রয়ারেই পড়ে আছে। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। ল্যাবে উপাদান ছিলই। পটাসিয়াম সায়ানাইড তৈরি করতে সময় লাগেনি। দোকান থেকে পঞ্চাশটা ক্যাপসুলের একটা শিশি কিনলাম। ল্যাবে গিয়ে কুড়িটা ক্যাপসুল বের করে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে একটা ক্যাপসুলের খোল খুলে সেটা খালি করে তার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড ভরে নিলাম। শিশির বাকি ঊনত্রিশটা ক্যাপসুলের সঙ্গে সেটা মিশিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে রেখেছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনির্দেশ্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। মৃত্যু নিশ্চিত করেছি বলে তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করার অধিকার আমার নেই।

আজ পয়লা এপ্রিল। বেশ কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। ফাঁকা মগজ, শরীরময় আলস্য। মোবাইল বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি এখানের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইনস্পেকটর। বললেন, - মধুমিতা ম্যাডাম এসেছেন, কিন্তু সঙ্গে একটি ছোটো মেয়ে। কোনো অসুবিধে নেই তো স্যার?

অবাক হওয়ার উদ্যমও বুঝি অবশিষ্ট নেই আমার। একটি পরেই মধুমিতা তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকল। আমি তাদের শোয়ার ঘরে নিয়ে এসেই বসালাম। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মধুমিতা বলল, - সরি স্যার।

কেন দুঃখপ্রকাশ জানতে চাইলাম না। মধুমিতা বলল, - সেকেন্ড ফেজের কাজ নতুন করে শুরু করেছেন তো স্যার। আমার মনে হয় বাকি এই এক মাসেই আপনি লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন।

মধুমিতা সোফায়। মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে বিছানায় বসেছে। আমি তার চুলে হাত ডুবিয়ে বললাম, - মন্ত্রকে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেওয়াও অসম্ভব হবে না, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি মধুমিতা। তোমার মতো আমিও পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছি। দুটো চিঠি একসঙ্গেই অফিসের ড্রয়ারে রাখা আছে। দুটোর স্বাক্ষর একই তারিখের। আমি দৈবাৎ ভুলে গেলে তুমি মন্ত্রকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও।

মধুমিতার চোখে যেন একটা চমক দেখলাম। তারপরেই তার চঞ্চল দৃষ্টি সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। এই প্রথম এই ঘরে ঢুকেছে সে। তাই কি খুঁটিয়ে দেখছে? একটু পরে সোফা আর বিছানার মাঝখানে রাখা টেবিলে তার দৃষ্টি স্থির হল। সামান্য অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। সে একটু ঝুঁকে ক্যাপসুলের শিশিটা খুঁটিয়ে দেখল। বলল, - রোজ খান?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকালাম। সামলে নিয়ে বললাম, - মাঝে মাঝে।

কয়েক মিনিট নীরবতা। মধুমিতার মেয়ে একটা মোটা বই খুঁজে বের করেছে। রঙিন ছবিওলা অ্যানাটমির বই। একমনে পাতা উলটে উলটে ছবি দেখে চলেছে। খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। হঠাৎ মধুমিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, - একবার ল্যাবে যেতে পারি স্যার?

আমি হাসলাম, - যাও না – স্যাবোটেজ করার কোনো সুযোগ তো আর নেই।

কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল মধুমিতা। তখনই আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঢুকল। ক্যাপসুলের কাজ করে আসার পর থেকে আর তো যাইনি ল্যাবে। সব এলোমেলো পড়ে আছে। বাস্কেটে অতগুলো ক্যাপসুল - কেসিএন তৈরির কোনো ক্লু ছেড়ে আসিনি তো?

বোধহয় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল মধুমিতা। সোফায় বসে খানিক আনমনা স্বরে বলল, - আপনার কোনোদিন কোনো মেজর অপারেশন হয়েছে স্যার?

--হঠাৎ এই প্রশ্ন?

--না, অচেতন থেকে চেতনায় ফেরার কথা ভাবছিলাম। একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা!

--তুমি কী অর্থে বলছো?

মধুমিতা কেমন যেন একটা হাসল। বলল, -- না না, অন্য কিছু নয়। মেজর অপারেশনের আগের অ্যানেস্থেসিয়ার কথাই বলছি। আমার হয়েছিল। লন্ডনে। তখন মাস্টার্স করছি। য়ুফেরেক্টমি, সিস্টের জন্য ওভারি বাদ দিতে হল। দুটোই।

আমি হতভম্ব। যতোটা না এই নিদারুণ সংবাদে, তার চেয়ে বেশি সেটা জানানোর সময় বাছার জন্য। কোনো একটা কার্যকারণ সম্পর্কের হদিশ হাতড়াচ্ছিলাম। তখনই সোফা থেকে উঠে এল মধুমিতা। যেন ছোঁ মেরে ক্যাপসুলের শিশিটা তুলে নিল হাতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিশি হাতে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পরেই ফ্লাশ টানার শব্দ পেলাম। চোখের সামনে দ্বিতীয় অন্তর্ঘাতটি ঘটাল মধুমিতা।

***

বারটা বাজল বোধহয়। ইংরাজি ‘বোকা দিবস’ অস্তে গেল। পয়লা মে যে আমার জন্মদিন সে-খবরটাও মধুমিতার জানা। এই মুহূর্তে সে সোফায় আধশোয়া। তার মেয়ে আমার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মধুমিতা এবং আমার মাঝখানে থাকা টেবিলের শূন্যজায়গাটার দিকে তাকিয়ে মধুমিতার চূড়ান্ত অন্তর্ঘাতের প্রতীক্ষা করছি।


সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ ২০২১
0

গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

Posted in







কে? কে ওখানে?

হাল্কা সুতির পর্দার ওপারে কার যেন অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রামেসিস একটু খাড়া হয়ে উঠে বসল।

কে?…তিয়ে! তিয়ে তুমি এসেছ? সত্যি? দূরে দাঁড়িয়ে কেন? আমার কাছে এস।

বয়সের সাথে বোধহয় মানুষের বুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে যায়। নাহলে রামেসিস কখনও তিয়ের গায়ের সুগন্ধি চিনতে না পারে!

কি হল তিয়ে, কাছে আসবে না?

তিয়ে যেন একটু ইতস্তত করছে। তারপর ধীরে ধীরে পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল। যেন নববধূটি।

রামেসিস নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আজও তিয়ের রূপ তাকে পাগল করে দেয়। সেই কাজলটানা মদির চোখ, পাটে বসা সূর্যের চেয়েও লাল ঠোঁট, গোলকধাঁধার মতো রহস্যময় হাসি...

কি এক দুঃখ হঠাৎ তীর হয়ে তার বুকে বিঁধে যায়।

তুমি আর আমার কাছে আস না কেন, তিয়ে?

তিয়ে ধীরে ধীরে রামেসিসের কাছে এসে দাঁড়াল। আবার সেই রহস্যের চেয়েও গভীর হাসি – যা সহজ উত্তরকেও গোলমাল পাকিয়ে দেয়।

“তুমি জান না কেন আসি না?”

রামেসিস তিয়ের হাত দুটো টেনে একেবারে নিজের কোলের কাছে বসিয়ে নিল।

“জান তিয়ে, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম পদ্মপুকুরের ধারে…পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তোমার মুখের ওপর, সন্ধের হাওয়া তোমার চুলের সুগন্ধ সারা বাগানে ছড়িয়ে দিয়েছিল...আমার মনে হয়েছিল তোমার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কেউ নেই!”

তিয়ের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

“সত্যি? আমি এত সুন্দর? কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তো আইসিস আর তিয়িতির নাম লেখা হবে বলে শুনছি।”

রামেসিস তিয়েকে নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। ইয়ামোসে যেমন করে হাতে সাপ জড়িয়ে খেলা দেখায়।

“তুমি সাধারণ গৃহবধূ নও তিয়ে। তুমি রাজার স্ত্রী। এইসব কথা কি তোমার মুখে মানায়? আইসিসকে আমার বিয়ে করতে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। আর তিয়িতি আমার বোন, তাকে তো স্বীকৃতি দিতেই হবে। সেসব তো প্রেমের বিয়ে নয়, তুমি সেকথা ভালোভাবেই জান।”

“তোমার অন্তঃপুরে কি শুধু আমরা তিনজনেই আছি?”

রামেসিস হেসে ফেলে। আজও মেয়েটার ছেলেমানুষী গেল না।

“আরো অনেকে আছে। কিন্তু তুমি আমার নেফারতারি। নেফারতারি তার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিল, জান তো? আমিও তোমার চোখে চাঁদ সূর্য উঠতে দেখি!”

তিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাল।

“কই, নেফারতারির মতো আমার কোন মন্দির তো এখানে দেখছি না। আমাকে দেবী হাথরের প্রতিমূর্তি বলে আঁকা কোন ছবিও দেখছি না।”

“যার নামে আমার নামকরণ হয়েছিল, সেই রামেসিসও কি নিজের রাজধানীতে নেফারতারিকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছিলেন? তাই তো মরুভূমি পেরিয়ে অতদূর যেতে হয়েছিল মন্দির বানানোর জন্য।”

তিয়ির চোখে ছায়া নেমে আসে।

“আমাদের ছেলেও তো শুনলাম রাজা হবে না।”

রামেসিসের হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আসে।

“নিয়ম অনুযায়ী আমার বড় ছেলেই রাজা হবে। এ নিয়ে তুমি আর জেদ ক'র না।”

“বড় ছেলে, তাই রাজা হবে, না তিয়িতির ছেলে তাই রাজা হবে?”

“এসব ঈর্ষা মনে পুষে রেখে তুমি কি পাচ্ছ, তিয়ে? দিন দিন তোমার আর আমার মধ্যের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। পেন্তাওয়ারেতকে আমিও ভালোবাসি। সে আমারও ছেলে। কিন্তু ঐতিহ্য আর যোগ্যতা, দু'দিক থেকেই এই রাজ্য রামেসিসকেই যুবরাজ বলে দাবি করছে।”

তিয়ে রামেসিসের হাতের ওপর আঙুল বোলায়।

“তোমার আর আমার মধ্যের সব সমস্যা ওই সিংহাসনকে ঘিরে। তুমি আমার ছেলেকে যুবরাজ ঘোষণা করে দাও, আমি আবার আগের মতো তোমার কাছে ফিরে আসব। তুমি চাও না, আমি আবার আসি?”

“চাই…খুব চাই…”

কিন্তু…

“তুমি জান না তুমি কি চাইছ, তিয়ে। সিংহাসন চেয়ে তুমি পেন্তাওয়ারেতের জন্যে সুখের চাবিকাঠি কিনছ না।”

আমি রাজ্য অধিকার করে নিয়েছি, কিন্তু তোমাকে সুখের চাবিকাঠি দিয়ে যেতে পারব না...

হঠাৎ করে তিয়ের মুখটা পালটে গিয়ে বাবার মুখ হয়ে যায়। কিভাবে তা সম্ভব হল তা নিয়ে রামেসিস প্রশ্ন করে না। বরং ভাবে, কতদিন বাবাকে দেখেনি! তিরিশ বছরের ওপর তো বটেই।

“চারিদিকে শত্রুরা থাবা মেরে বসে আছে। রাজ্যের মানুষ যুদ্ধে যুদ্ধে জর্জরিত। বাড়িঘর ছেড়ে সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে। এই সময়টা সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার পক্ষে প্রশস্ত, সিংহাসন ধরে রাখার পক্ষে নয়। পারবে তুমি, নিজের পুরুষকার দিয়ে পরিস্থিতির গতি বদলে দিতে?”

“পেরেছি।”

নিজের গলা শুনে রামেসিসের কেমন অসঙ্গতি বোধ হয়। তারপর বুঝতে পারে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় এই কথাগুলো বলেছিল তখন তা শুনেছিল তরুণ রামেসিস। আজ বর্ষিয়ান রামেসিস তার জবাব দিচ্ছে – যার যুদ্ধ জেতা বলিষ্ঠ হাত এখন কুঁচকে গেছে, দাড়িতে পাক ধরেছে, পেটের ডানদিকে চিনচিনে ব্যথা। রাজবৈদ্য গোপনে জানিয়েছে, রাজার দিন এখন হাতে গোনা মাত্র।

সেতনাখতে সামনে রাখা মদের পাত্র তুলে নিলেন। ঈষৎ ভুরু নাচিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“বটে? পেরেছ? তা কিভাবে পারলে?”

রামেসিস সামান্য ঝুঁকে বসল। এটা বাবার মৃত্যুশয্যা নয়। বরং দু'জন রাজা মুখোমুখি দুটো আরামকেদারায় বসে আছে, শুধুই খোশগল্প হচ্ছে।

“তুমি মারা যাওয়ার পরে রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল।”

সেতনাখতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

“রাজ্য দখল করেছিলাম শুধু। শাসন করার সময় পাইনি।”

“সেই জন্যই তো প্রথম কিছু বছর যুদ্ধ, বাণিজ্য, সবকিছু মুলতবি রেখে রাজ্যে ঐক্য আনার আর সেনাকে মজবুত করার কাজে লেগে পড়ি। পাঁচ বছর বাদে যখন লিবিয়ার শত্রুরা আক্রমণ করে, আমাদের সেনা তখন প্রস্তুত। সহজেই তাদের হারিয়ে দেয়। সেখান থেকে শুরু।”

সেতনাখতের মুখে কৌতুক ঝিলিক দিল।

“ওহো! লিবিয়ার ওরা আবার হেরে বাড়ি গেল বুঝি? জান নিশ্চয়ই, রাজা মারনেপ্টাহের সময়েও একই ব্যাপার হয়েছিল।”

রামেসিসের সামনেও ভেল্কির মতো মদের পাত্র এসে গেছে। সে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল।

“সে তো কিছুই না। আসল বিপদ ঘটল যখন সমুদ্র মানবরা আক্রমণ করল।”

“সমুদ্র মানব? কারা তারা?”

“পেলেসেত, দেনিয়েন, শারদানা, মেশোয়েশ – অসভ্য বর্বর জাতি সব। শুনেছি অনেক বড় বড় সভ্যতাকে নষ্ট করতে করতেই আসছিল। রাজ্যে এসে প্রথমে তারা স্থলপথে আক্রমণ করেছিল। জাহির যুদ্ধে তাদের হারিয়ে দিই। তখন তারা জলপথে আক্রমণ করে।”

“সেকি! আমাদের নৌবাহিনী তো খুবই দুর্বল! তুমি কি তাদেরও মজবুত করেছ?”

রামেসিস মাথা নেড়ে 'না' বলল।

“সেই সুযোগ পাই নি। আক্রমণের কথা জানতে পেরেই রাজ্যের সব জাহাজকে হুকুম দিলাম নীলনদের মোহনার মুখে চলে যেতে। সেনা না পৌঁছনো অবধি কেউ যেন জায়গা থেকে না নড়ে। জাহাজের পেছনে তীরন্দাজদের দাঁড় করিয়ে দিলাম। শত্রুর জাহাজ আসামাত্র তীরন্দাজরা নির্মম আক্রমণ শুরু করল। শত্রুপক্ষ তীরের জবাব দিতে ব্যস্ত এমন সময়ে আমাদের নৌসেনা ওদের জাহাজে উঠে পড়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করে দিল। ওরা পালানোর পথ পেল না।”

“সাবাশ! এতো ঐতিহাসিক বিজয়!”

রামেসিস মনে মনে সম্মতি জানায়। আবার মদে চুমুক দেয়।

“লিবিয়ার নির্লজ্জগুলো আরেকবার আক্রমণ করেছিল, আবার গোহারান হেরে ফেরত গেছে। তারপর থেকে সীমান্ত সুরক্ষিতই রয়েছে।”

সেতনাখতে নাকের ডগাটা চুলকে নিলেন। রামেসিসের মনে পড়ল, কোন অপ্রিয় প্রসঙ্গ তোলার আগে এটা করা বাবার অভ্যেস ছিল।

“তা, রাজ্যের লোকজন এসব ঘটনার ব্যাপারে কি মনে করে?”

“যুদ্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই ভাণ্ডারে টান পড়ে। সবাই তাই নিয়ে খুশী হয় না। বিশেষ করে যুদ্ধ যখন নিজের সীমান্তে হয় তখন ক্ষয়ক্ষতির আকড় লুকিয়ে রাখা একটু মুশকিল হয়ে যায়। তার ওপর ভালো শস্য না হওয়ার দরুন সেত মা'আত হের ইমেনতি ওয়াসেতের কবর খননকারী আর চিত্রশিল্পীদের মাইনে আর খাবার পৌঁছাতে কিছু দেরি হয়েছিল।”

“তাই নিয়ে তারা বিদ্রোহ শুরু করে?”

“বিদ্রোহ ঠিক নয়, কর্মবিরতি বলতে পার। মন্দিরের সামনে ধর্না দিয়েছিল বলে শুনেছি।”

“কর্মবিরতি? ধর্না? এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি!”

“সব খবর আমার কানেও আসেনি। আমার মন্ত্রীরাই সামলে নিয়েছে।”

“এখন পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে?”

রামেসিস আরামকেদারায় হেলে বসল।

“সমস্যা এখনো চলছে। কিন্তু পুন্তের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছি। তিমনার খনি থেকে প্রচুর পরিমাণ তামা আনিয়েছি। সাইনাই থেকে দামী পাথর এসেছে।”

“আর মন্দির? নতুন স্থাপত্য কিছু বানিয়েছ?”

“আমার জন্য 'তৃতীয় রামেসিসের কোটি বছরের আবাসন, চিরকালের জন্য আমুন ভগবানের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত' বানিয়েছি। তাছাড়া রাজ্যের অনেক মন্দিরে জমি দান করেছি, সোনার মূর্তি বসিয়েছি।”

“তার মানে আমি রাজ্যকে যে অবস্থায় রেখে গেছিলাম তুমি তার আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছ। তোমার ছেলের জন্য সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি রেখে যাচ্ছ, যা আমি তোমার জন্য করে যেতে পারিনি।”

রামেসিস গালের ওপর হাত বুলিয়ে নিল।

“জানিনা, বাবা। রামেসিস বার বছর বয়স থেকেই যুবরাজ হয়েছে। অনেক কাজ শিখেও উঠেছে। কিন্তু রাজা হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। মোটে একুশ বছর বয়স ছেলেটার। ও কি পারবে সামলাতে?”

“আলবাত পারবে!” সেতনাখতে হাঁটুতে চাপড় মেরে বলেন। “একুশ বছর বয়সে জানার আগ্রহ থাকে, শেখার আগ্রহ থাকে। রাজার ভূমিকা পালন করতে করতে অভিজ্ঞতা আপনেই এসে যাবে। কিন্তু তুমি…”

দেখতে দেখতে সেতনাখতের মুখ এক দিব্য আভায় ভরে উঠল।

“তুমি যেভাবে আমার বংশে গরিমা এনেছ, যেভাবে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছ, তার জন্য ইতিহাস তোমাকে চিরকাল মনে রাখবে। আমার আশির্বাদ আর মা'আতের কৃপায় তুমি অনন্তকাল আমুনের রাজ্যে বাস কর।”

“সত্যি? সত্যি বলছ?”

কিন্তু সেতনাখতে ততক্ষণে মিলিয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় রাখা আছে তুলাদণ্ড। তার একদিকে মা'আতের পালক। অন্যদিক ফাঁকা। রামেসিসের হৃৎপিণ্ড সেখানে রেখে যাচাই করা হবে। সামনে আনুবিস দাঁড়িয়ে৷ আর কিছু দূরে হোরাস।

এ তো শেষের বিচার…

“রামেসিস,” আনুবিস গম্ভীর গলায় ডাক দেন, “তুমি কি পেরেছ রাজা হিসেবে সফল হতে? মা'আতকে ধরে রাখতে পেরেছ? তুমি দেশের রাজা – অন্য সব পরিচয়ের থেকে এটাই কি তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হয়েছে?”

রামেসিস ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে। চোখের সামনে এক এক করে ছবি ভাসতে থাকে – সমুদ্র মানবদের বিরুদ্ধে লড়াই, লিবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই, রামেসিসকে যুবরাজ ঘোষণা করা, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা, মন্দির বানানো…

তারপর হঠাৎ করে সব মুছে গিয়ে তিয়ের মুখটা ভেসে ওঠে।

“তোমার বাবার প্রশংসার এখানে কোন জায়গা নেই,” আনুবিস কঠোর স্বরে বলে চলেন, “তোমার নিজের হৃদয়কে যাচাই করে দেখ, তুলাদণ্ডে ফেললে তার কি পরিণতি হবে।”

রামেসিস তিয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পলক।

প্রিয়তমা স্ত্রী তিয়ে…আমার নেফারতারি…

কিন্তু…

রামেসিস আর তিয়ের মধ্যে যোজনব্যাপী দূরত্ব তৈরী করা সেই 'কিন্তু'…

আমাকে ক্ষমা কর তিয়ে, শুধু তোমার স্বামী হয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে যতই ভালোবাসি না কেন, রাজার কর্তব্যকে অবহেলা করে তোমার অন্যায় আবদার মানতে পারব না।

“এটাই কি তোমার সিদ্ধান্ত?” আনুবিস প্রশ্ন করেন।

“…হ্যাঁ…”

পর্দার আড়ালে টুংটাং আওয়াজ ওঠে। ঘরের মধ্যে পদ্মের সুগন্ধ ফেলে রেখে তিয়ের অবয়ব মিলিয়ে যায়। শুধু তেরচা করে আসা চাঁদের আলো রামেসিসের বন্ধ চোখের ওপর আলতো করে আঙুল বোলায়।

রাত আরো গভীর হলে ধারাল অস্ত্র হাতে আততায়ীর দল রাজার ঘরে ঢুকে আসে। রাজা তখন আরামের বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে। মুখে প্রশান্তির হাসি।

****

সেদিন সন্ধেবেলায় গুপ্তচর এসেছিল। রামেসিস তখন রাজ্যের করব্যবস্থা দেখতে মগ্ন। গুপ্তচরকে দেখে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কি সংবাদ?

গুপ্তচর কয়েক পা এগিয়ে এল। গলা নীচু করে বলল,

“সংবাদ ভালো নয়, মহারাজ। রানী তিয়ে তাঁর ছেলে রাজপুত্র পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য চক্রান্ত করছেন। রাজপ্রাসাদেরই কয়েকজন সদস্য চক্রান্তের মধ্যে আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।”

“কেমন চক্রান্ত?”

গুপ্তচর গলা আরো নামিয়ে আনল।

“মহারাজের প্রাণ সংশয় হতে পারে।”

“কবে?”

“সে খবর এখনো পাইনি। সম্ভবত কিছু ঠিক হয়নি এখনো।”

“বুঝলাম।”

রামেসিস চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

তিয়ে? শেষটায় তিয়ে আমাকে মারতে চায়?

সেটা অবশ্য বিষ্ময়কর নয়। খুব ঈর্ষা, খুব অভিমান তার। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও খুব। নিজেই কতবার বলেছে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার কথা। রামেসিস প্রত্যেকবার হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু… এবার তো মহা ফ্যাসাদ হল।

“ইহজগতের দুঃখ আর আপনাকে বেশীদিন ভোগ করতে হবে না।”

রাজবৈদ্যের বলা কথাগুলো রামেসিসের কানে বাজতে থাকে।

কারা চায় না আমার পরে রামেসিস রাজা হয়? যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে রাজভাণ্ডার খালি হয়ে যাচ্ছে বলে যারা অনুযোগ করছে তারা? নাকি তাদের অন্য কোন দাবি আছে? তাদের বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হওয়ার আগেই যদি আমার দিন ফুরিয়ে যায়?

তাহলে আমার মৃত্যুর পরে গৃহবিবাদ লেগে যাবে। রামেসিসের বিরুদ্ধে পেন্তাওয়ারেতকে সদস্য খাড়া করে চক্রান্ত চলতে থাকবে। আমার অন্য ছেলেরাও সুযোগ বুঝে দাঁও মারার চেষ্টা করবে। রামেসিসের মাত্র একুশ বছর বয়স। এই বয়সে রাজার দায়িত্ব বুঝে নিতেই ওর সময় চলে যাবে। তার ওপর গৃহবিবাদ সামলানো ওর দ্বারা সম্ভব হবে না। আর এসব খবর বাইরে গেলে শেয়াল কুকুরের দলের থাবা মারতে ছুটে আসতে সময় লাগবে না। আমার সারা জীবনের চেষ্টায় রাজ্যে যে শান্তি, যে সুরক্ষা এনেছি, এক মূহুর্তে তা নষ্ট হয়ে যাবে।

টুকরো টুকরো ছবি পরপর বসে গালিচা বনে যায়। রামেসিসের মাথায় সমাধানটা স্পষ্ট হয়।

নাঃ, আমাকে তিয়ের চক্রান্তেই মরতে হবে। আর তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতকে আমার সঙ্গে মরতে হবে। রাজদ্রোহের দায়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। গুপ্তচরের খবর এতক্ষণে রামেসিসের কাছেও পৌঁছে গেছে। কাল আমার মৃতদেহ পাওয়া গেলে রামেসিস অনুসন্ধান শুরু করতে পারবে। উত্তরাধিকারের লড়াই তখন খুনের মামলায় রূপান্তরিত হবে। চক্রান্তকারীরা হয়ে যাবে রাজদ্রোহী। তবেই রামেসিসের হাতে সুরক্ষিত রাজ্য তুলে দিতে পারব। আমার পূর্বপুরুষদের কাছে মুখ দেখাতে পারব। বলতে পারব, নিজের পুরুষকার দিয়ে ভাগ্যের প্রতিকুলতাকে জয় করতে পেরেছি।

রামেসিস যখন চোখ খুলল ঘর তখন খালি। গুপ্তচর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে প্রধান পরিচারক পেবেক্কামেনকে ডেকে পাঠাল।

তিয়ে যদি সত্যিই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে থাকে, তাহলে আমার প্রধান পরিচারককে দলে না নিয়ে তার উপায় নেই। একটা হিসেবের খেলা খেলে দেখি, কি হয়।

“মহারাজ ডেকেছেন?” মার্জিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে পেবেক্কামেন মাথা নোয়াল।

“হ্যাঁ। আজ আমার রাতের খাবারের পরে তুমি মদের ব্যবস্থা করবে।”

“যথা আজ্ঞা।”

“সে মদ যেন এমন হয় যে হাজার ডাকাডাকিতেও আমার সারারাত ঘুম না ভাঙে।”

মূহুর্তের জন্যে পরিচারকের মুখের অভিব্যক্তি কি পালটে গেল, না তা শুধুই রাজার কল্পনা?

“অবশ্যই, মহারাজ।”

“যাও, প্রস্তুতি শুরু কর।”

পেবেক্কামেন চলে গেলে রাজা মিটিমিটি হাসে। সুখের চাবিকাঠি পরপারের সম্পত্তি। এই পৃথিবী শুধুই দুঃখ ভোগ করার জন্য। একদিন চলে যেতে হবে সবাইকেই।

কিন্তু রাজার চাল চেলে যাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয় ক'জনের?



· হারেম চক্রান্ত : প্রাচীন মিশরের রাজা তৃতীয় রামেসিসের স্ত্রী তিয়ে এবং রাজার হারেম এবং প্রাসাদের কিছু সদস্য মিলে রাজাকে হত্যা করেন, তিয়ের ছেলে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য। কিন্তু চক্রান্তকারীরা ধরা পড়ে যান, এবং অধিকাংশই মৃত্যুদণ্ড পান। তৃতীয় রামেসিসের হত্যার পর তাঁর ছেলে চতুর্থ রামেসিসই রাজা হন।
0

গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in






সে বালিকা না কিশোরী সে নিজেই জানে না। অট্টালিকার প্রাচুর্য তাকে টানে না। কিন্তু এই হর্ম্যের রহস্য তাকে আকর্ষণ করে।কেন করে সে বোঝেনা।
এই যে পাখিটি বারান্দায় উড়ে এসে জুড়ে বসল তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়... তার গায়ে এত রঙের বাহার।সে এগিয়ে যায়।তার কৌতুহল আন্তরিক। পাখি তাকে বিশ্বাস করেনা।সে একটা বিচিত্র শব্দ করে উড়ে যায়। সকালের অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। উদ্যান পরিপাটি। তার চোখে মুখে মৃদু আনন্দ ও বিস্ময়।সে এখন কী করে? প্রত্যেক নারী কি এই সংশয়ে ভোগে? সদ্য বালিকার সব প্রশ্নের উত্তর হয়না।
সে নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়। তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে নিজের কক্ষে দর্পণে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।তার চোখ এতো গভীর আর টানা টানা? ভুরু আর চোখের পাতা এতো সুন্দর?এতো দীর্ঘ আর কালো তার চুলের ঐশ্বর্য?সে এখনই ৫ ফুট ৫, আরও লম্বা হবে?,,,তার আঙুল, তার নখ,তার কটিদেশ, তার পায়ের গড়ন এ সব কবে হল? কীভাবে হল?সে রঙ লাগায় না। তবু তার ওষ্ঠ, তার হাত ও পায়ের নখগুলো এতো উজ্জ্বল।সদ্য অঙ্কুরোদগম হয়েছে তার। ব্যথা লাগে কোথাও তবু সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই সামান্য উদ্ভাসিত মুকুলের দিকে।যেন এক মহা সমারোহে প্রকৃতির মতো সেও বেড়ে উঠছে। শুধু সেই অদৃশ্য জায়ফলটিকে সে চেনেনা।
তার একটাই অভাব যে তার কোনো অভাব নেই।
স্নানের ঘর থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার পর সে‌ কিছুক্ষণের জন্য একাকীত্ব হারিয়ে ফেলবে। এটাই এ বাড়ির নিয়ম। প্রাতরাশ টেবিলে সাজিয়ে রাখা টাটকা ফল,ফলের রস,দুধ, ডিমের পোচ, ওটস ইত্যাদির মধ্যে সে পছন্দ মতো খাবার বেছে নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে দুবছর আগে।
তার মা একজন গরিষ্ঠ সমাজ কর্মী.. ব্যস্ত মানুষ।
তার বাবা এই উপনগরীর সম্মানীয় আইনজীবী।সে একমাত্র সন্তান। পৈতৃক সূত্রে অর্জিত এই সুরম্য অট্টালিকা রক্ষা করতে লোকবল ও অর্থ লাগে।যা তাদের আছে।
সে এখানকার সবচেয়ে অভিজাত বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
গাড়িতে করে ইস্কুলে যাওয়া আসার ফাঁকে সে দেখতে পায় পায়ে হেঁটে, সাইকেল রিক্সায় , ভ্যানে চেপে মেয়েরা ইস্কুলে যায়। তাদের বিনুনির মধ্যে খেলা করে হালকা রোদ্দুর,পাশ থেকে উড়ে আসে পতঙ্গের মৃদু গুঞ্জন।দূর থেকে এসব দেখতে ভালোই লাগে।
এই বালিকার কোনো নাম নেই? অবশ্যই আছে। নামে কি আসে যায়?

তার ক্লাসে মহিমা নামে একটি বালিকা আছে। তথাকথিত সুন্দরী নয়। কিন্তু পড়াশোনায় তুখোড়।সে অবলীলায় প্রথম হয় পরীক্ষায়.. অবহেলায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
মহিমার সঙ্গে তার সহজ সম্পর্ক। অথচ কোথায় একটা দূরত্ব আছে।
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in






হায়েনার দল হরিণীটিকে পেছন থেকে খাচ্ছিল।
তখনও বেঁচে ছিল সে—
জানান দিচ্ছিল তার অসহায় পা ছোঁড়া।

দূর থেকে চিতাকে আসতে দেখে
অনাগত ভ্রূণ চিরে বার করে নিয়ে পালাল হায়েনা।

তারপর চিতা
লাল লাল নরম মাংস দ্রুততার সঙ্গে ছিঁড়ে খেতে লাগল।

আমি পৃথিবীর কাছে এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করেছিলাম।

যে গর্ভ থেকে জন্ম,
যে গর্ভ থেকে সৃষ্টি,
যে গর্ভকে ঈশ্বর বলি—
সে‌ই হিরণ্যগর্ভের শিরায় শিরায় শুধু আদিমতা!

আমি কার কাছে ন্যায় ভিক্ষা করব?
0

কবিতা - কুমকুম বৈদ্য

Posted in






ভলিউম যত বাড়ছে মাথার শব্দকোষে
হারিয়ে যাচ্ছে কথার মানে মুদ্রাদোষে
কথা যে সব দেওয়াই ছিল অনুচ্চারে
ভুলিয়ে দিচ্ছে ঝুলিয়ে রাখা অনুস্বারে
হারিয়ে গেলেও কথার মালা খুঁজতে নেই
ফুরিয়ে গেলে কথার কবর খুঁড়তে নেই
0

কবিতা - সুস্মিতা মজুমদার

Posted in






ক্রমশ জটিল হচ্ছে দিন
আবার ইতিহাস ফুঁড়ে যেন জেগে উঠেছে গুহামানবের দল ।
দুচোখ জুড়ে রয়েছে তাদের কাঁচা মাংসের উল্লাস,
মানুষ যখন সভ্যতার চাপে
এগিয়ে চলেছে দিন প্রতিদিন
কিছু মানুষের জিহ্বায় লেগে আছে
এখনো রক্তের স্বাদ ।
সময় যেন কিছু মানুষকে পৌছেঁ দিয়েছে সেই অন্ধকার পাথুরে সভ্যতায়
যেখানে মানুষ ক্ষুধার্ত, নেশাগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত ।
ক্রমশ আবছা হতে হতে ঘণ কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে
কথোপকথনের অসমাণ সিঁড়িপথ।
সামনে এসে দাঁড়ায় কিছু উন্মাদ মানুষ
তীক্ষ্ম দহনে তাঁরা চেঁচাচ্ছে
সবকিছু থাক তাদের ইচ্ছেমতো ।
অস্থির মাতাল হাওয়ায় করে চলেছে
জাতের নামে বজ্জাতি
সমস্ত হাড়ের ভিতর আধশোয়া ঘৃণার দল !
আর্তনাদ শুনবে না কেউ
অগোচরে রক্তপাত শুধু
হৃৎপিন্ড জুড়ে নিঃশর্ত সমপর্ণে।
0

কবিতা - আশীষ কুমার বিশ্বাস

Posted in







একটা কবিতা
তাঁর ভালো লাগা , মন্দ লাগা ।

তারপর প্রিন্টিং প্রেস
অচেনা প্রচ্ছদ
তাঁর জন্ম , লিটিল ম্যাগজিন ।

একটা যুদ্ধ জয়
প্রকাশিত কবিতা
বার বার তাঁর ওপর চোখ বোলানো ।

মনে কবি হওয়ার শখ জাগে
রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ , নজরুল , সুকান্ত
মনের গভীরে সুপ্ত বাসনা ।

আবার কলম-কাগজ , নির্জনে চিন্তা
ভাবনার গোড়ায় শিকড় গজানো ।

অক্ষরে অক্ষরে , শব্দে শব্দে
নতুন লাইন ।
আরো একটা কবিতার জন্ম ।

ঠিক এই ভাবেই - আরো একটা
কিম্বা অন্য ভাবে
আরো একটা ।



0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in







এগ পরিজ

উপকরণ ::

রোলড ওটস ১/২ কাপ
ডিম ৪টি
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ
কড়াইশুঁটি ১/২ টেবিল চামচ
গাজরের টুকরো ১ টেবিল চামচ
কাঁচালঙ্কা ২টি
অলিভ অয়েল ১ টেবিল চামচ
নুন স্বাদ মতো
একচিমটি দারচিনি গুঁড়ো



পদ্ধতি::

প্রথমে রোলড ওটস বেশ কয়েকবার ঠান্ডা জলে ধুয়ে, শাদা জল ফেলে নিতে হবে। এক চিমটি গুঁড়ো দারচিনি দিয়ে সেদ্ধ বসাতে হবে। ফুটে উঠলে তাতে একে একে গাজর ও কড়াইশুঁটি দিয়ে একটু ফুটিয়ে ঢাকা দিয়ে আঁচ বন্ধ করে চুলার ওপর বসিয়ে রাখতে হবে।

ফ্রাইং প‍্যানে অলিভঅয়েল দিয়ে একটু গরম হতে হতে ডিমের গোলা ঢেলে দিতে হবে। নিয়মিত খাওয়া হলে, ডিম কিন্তু দুটি গোটা এবং দুটির শাদা অংশ নিয়ে বানাতে হবে। যদি হঠাৎ কখনও বানানো হয় তখন চারটি ডিম গোটাই ব‍্যবহার করা যেতে পারে। ডিমের গোলায় নুন দিতে হবে। ডিমের গোলাটি নাড়িয়ে স্ক্রাম্বলড্ এগ বানাতে হবে। একটু টেনে এলে পেঁয়াজ ও কাঁচালঙ্কা কুচি দিয়ে রান্না করতে হবে। এরপর ওই সেদ্ধ করা ওটস ডিমের প‍্যানে ঢেলে হাল্কা হাতে মিশিয়ে নিলেই তৈরী হয়ে যাবে এগ পরিজ।

অলিভ অয়েল কিন্তু পুরো গরম হওয়া অবধি অপেক্ষা করার দরকার পড়ে না। যদি ওটস সেদ্ধতে জল থাকে সেটা সহ দিয়ে জল টানিয়ে নেওয়া যেতে পারে বা মাঢ় ঝরানোর মতো ঝরিয়ে নিয়েও ডিমের সাথে মেশানো যেতে পারে। গোলমরিচ গুঁড়ো ছড়িয়ে পরিবেশন করা যেতে পারে। নুন কিন্তু একটু কমের দিকে রাখাই ভালো, তাই শুধু ডিমের গোলায় ডিম দিলেই যথেষ্ট। ঝাল বেশী পছন্দ হলে কাঁচালঙ্কার পরিমান বাড়িয়ে নিতে হবে। পরিবেশনের সময়ে এক টুকরো মাখন দেওয়া যেতে পারে। তবে নিয়মিত এগ পরিজ খেলে মাখন না দেওয়াই শ্রেয়।
0

সম্পাদকীয়

Posted in



































'বহির্বিমুখিতা' বা 'আত্মমগ্নতা' কি অসুখ? নাকি ব্যক্তিত্বের একটা ধরন? অজ্ঞতাবশে যে ধরনটি বুঝতে ভুল হয়ে যেতে পারে আমাদের। এমন ভ্রান্তি শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটলে তাকে কোনওভাবে ছাড় দেওয়া যায় কি? অমার্জনীয় কাজ তাহলে আর কাকে বলা হবে? 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্ম শুধু তো কতিপয় খাঁচার তোতাপাখি তৈরি করা নয়! চারপাশকে চিনতে এবং আতশকাচের তলায় জরিপ করতে শেখানোই তো ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলা। তাদের মূল্যবোধের বুনিয়াদি গঠন তো নির্মিত হয় শিক্ষাক্ষেত্রের আবহেই। যে মূল্যবোধ সহজেই চিহ্নিত করতে পারে একটি ব্যাধি আর স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিত্বের মাঝবরাবর অবস্থান করা সূক্ষ, প্রায় অদৃশ্য একটি রেখাকে। তা যদি না হত, গরিষ্ঠের স্থুল বিচারে অনেক কালজয়ী প্রতিভাই হয়ে যেতেন ব্রাত্য। কারণ তাঁরা আর পাঁচজনের মত ছিলেন না। 

তবুও তাঁদের সৃষ্টির সামনে নতমস্তকে দাঁড়াতে হয় আমাদের। এটাই স্বাভাবিক। তাই অটিজম-এর দোহাই দিয়ে যখন একটি বিদ্যালয় একটি ছাত্রকে দলবদ্ধ ভ্রমণ থেকে বাদ দিতে চায়, শরীরে রক্তস্রোত দ্বিগুণ বেগে বইতে শুরু করে।

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর!
1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৈকত মণ্ডল

Posted in






বাল্মীকি রামায়ণে অনেকগুলি উপেক্ষিত চরিত্রের মধ্যে শান্তা অন্যতম। কাব্যে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন শুধু আদিকাণ্ডেই। তার পরিধি খুবই সামান্য, কিন্তু রামায়ণ কাব্যে তাকে নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। রামায়ণে তিনি ঠিক কার কন্যা সেটাই একটা রহস্য। তিনি ঋষ‍্যশৃঙ্গের পত্নী। এই ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সাহায্য নিয়ে রাজা দশরথ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন ও ফলস্বরূপ তাঁর চারটি পুত্র হয়। রামায়ণ ব্যতীত অন্যত্র কবিরা শান্তাকে কেমন ভাবে দেখেছে এই সমস্ত দিক গুলো নিয়ে এই লেখাটির বিষয়বস্তু, তবে শুরুতে বাল্মীকি রামায়ণে শান্তার জন্ম নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত রূপে সমস্ত ভারতবর্ষে যতগুলি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, সেটিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই বিভাজন পন্ডিতরা করেছেন লিপি ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনুযায়ী। সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব কোনো হরফ / স্ক্রিপ্ট নেই। এটি যে কোনো লিপিতে লেখা যায়। এমনকী রোমান হরফেও। দক্ষিণ ভারতের লিপি - গ্রন্থ, তেলুগু ও মালায়লমে - যে সমস্ত বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তাদের একাডেমিক ভাষায় বলা হয়েছে দক্ষিণ /সাউথ রিসেন্সন। সহজ ভাবে বললে দক্ষিণ ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি। দক্ষিণের পাণ্ডুলিপির মধ্যে পাঠান্তর থাকলেও মোটামুটি ভাবে টেক্সটগুলির মধ্যে তেমন বিশেষ ফারাক নেই। তার উপর দক্ষিণের পন্ডিতদের (ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের) মধ্যে একটা সুদীর্ঘ্য কাল ধরে রামায়ণের উপর টীকা লেখার চল ছিল। মধ্যযুগের পন্ডিত গোবিন্দরাজ ও তিলকদের টীকা ও টেক্সট কালের প্রবাহে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে তিলকের টেক্সট (যার মধ্যে বাল্মীকি রামায়ণের টেক্সট ও তিলকের নিজের টীকা আছে) প্রচলিত টেক্সট / ভালগেট টেক্সট হিসেবে পরবর্তী কালে মান্যতা পায়। তেমনি ভাবে উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি রয়েছে বাংলা, মৈথিলি, কাশ্মীর, ওড়িয়া, ও নেপালি লিপিতে। এরা হলো নর্থ রিসেন্সন। এই নর্থ রিসেন্সন আবার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি গৌড়-বঙ্গ থেকে নেপালের ধারা নিয়ে বয়ে চলেছে, অর্থাৎ ভারতের নর্থ-ইস্ট রিসেন্সন, অন্যটি কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান (বিভাজনের আগে) হয়ে, অর্থাৎ নর্থ-ওয়েস্ট একটা আলাদা ঘরানায় গড়ে উঠেছে। দেবনাগরী লিপি নর্থ ও সাউথ দুটোতেই পাওয়া যায়। নর্থ ও সাউথের টেক্সট মোটামুটি ভাবে একই থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কাহিনী স্তরে ও শ্লোক গঠনে তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। ঠিকই এমনই একটি আকর্ষক অংশ হলো শান্তার জন্ম রহস্য।

প্রচলিত টেক্সটে (অষ্টম সর্গ থেকে) আমরা জানতে পারি রাজা দশরথ অপুত্রক। তিনি পুত্রলাভের আশায় সুমন্ত্র (প্রধান মন্ত্রী) ও বিভিন্ন পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করছেন একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করার। সরযূ নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত ভূমি নির্মাণ করে, একটি অশ্বকে ভ্রমণের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। তারপর সুমন্ত্র রাজাকে গোপনে একটি কাহিনী বলেন। তিনি ঋষিগণকর্তৃক কথিত একটি শ্রুতি-কাহিনী শুনেছিলেন বহু পূর্বে -- ব্রহ্মার পুত্র সনৎকুমার ঋষিদের জানিয়েছিলেন কীভাবে রাজা দশরথ পুত্রলাভ করতে পারবেন। গল্পটি এরকম: কাশ্যপ মুনির একটি পুত্র আছেন, যিনি বিভান্ডক নামে প্রসিদ্ধ। তার পুত্র হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ যার ব্রহ্মচর্য্যের গুন সংসারে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। সমসাময়িক অঙ্গদেশে রোমপাদ নামে এক মহাপ্রতাপশালী রাজা রাজ্যপালন করতেন। তার দুরাচরণের জন্য অঙ্গরাজ্যে দারুন অনাবৃষ্টি হয়। এর থেকে মুক্তির পথ একটাই বেরিয়ে আসে, সেটি হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনিকে যেভাবেই হোক অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসতে হবে, এবং তার সঙ্গে রাজার কন্যা শান্তাকে বিধিপূর্বক সম্প্রদান করতে হবে - "প্রযচ্ছ কন্যাং শান্তাং বৈ বিধিনা সুসমাহিত (১/৯/১৩)"।

এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম শান্তার কথা। উনি রাজা রোমপাদের কন্যা। তারপর ছলের দ্বারা (বার্বনিতা দের সাহায্যে) ঋষ‍্যশৃঙ্গকে রাজ্যে আনা হলো, এবং তিনি নগরে পা দেওয়া মাত্রই বৃষ্টি আরম্ভ হলো। ঋষিকে এভাবে ছলনাপূর্বক আনয়ন করার ফলে তার অন্তরে যেন ক্রোধের উদয় না হয়, তাই বিধি অনুসারে শান্তাকে শুদ্ধমনে সমর্পণ করে রাজা আনন্দ লাভ করলেন। সুমন্ত্র দশরথকে বলেন ঐ "জামাতা" ঋষ‍্যশৃঙ্গ আপনার পুত্রপ্রাপ্তিসম্পাদন করতে পারবেন (১/৯/১৯)। এটাকে দুটিভাবে ব্যখ্যা করা যায়। রোমপাদের মেয়ে-জামাই যেন দশরথেরও মেয়ে-জামাই তুল্য। সনৎকুমার এটাও বলেছিলেন যে ইক্ষ্বাকু বংশে দশরথ নামে একজন সত্যনিষ্ঠ রাজা জন্মাবেন, দশরথ নামে, এবং অঙ্গরাজ্যের রাজা রোমপাদের সঙ্গে তার মিত্রতা হবে। তাই মিত্রের কন্যা-জামাইকে নিজের মেয়ে-জামাই ভাবতে দোষ কোথায়? দ্বর্থক অর্থে তেমনি এটাও হতে পারে, শান্তা হয়তো রাজা দশরথের কন্যা। উনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছিলেন।

সনৎকুমারের কথা অনুযায়ী দশরথ রোমপাদের কাছে গিয়ে বলবেন - "আমি নিঃসন্তান। আপনার জামাতা, শান্তার স্বামী, ঋষ‍্যশৃঙ্গকে আপনার আদেশমত যজ্ঞ করতে বলুন। সেটা হলে আমার বংশরক্ষা হয় (১/১১/৪-৫)"। ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি আসবেন, যজ্ঞ করবেন ও রাজার চারটি পুত্র হবে। এই শুনে রাজা দশরথ তার তিন স্ত্রী ও অন্তঃপুরস্থিত মহিলাগণদের সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদেশে উপস্থিত হলেন। ওখানে সাত-আটদিন কাটানোর পর, একদিন দশরথ তার মিত্রকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন - "আপনার কন্যা শান্তা পতিসহ মদীয় নগরী অযোধ্যায় গমন করুন - শান্তা তব সুতা রাজন্! সহ ভর্ত্রা বিশাংপতে (১/১১/১৯)"। রোমপাদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে বললেন - "তাই হোক, তুমি পত্নীর সহিত গমন করো।"

রামায়ণের একজন বিখ্যাত স্কলার ও অনুবাদক রালফ গ্রিফিথের এই অংশটির অনুবাদ পড়লে মনে হয় শান্তা যেন দশরথের নিজ কন্যা।

“This king,” he said, “from days of old
A well beloved friend I hold.
To me this pearl of dames he gave
From childless woe mine age to save,
The daughter whom he loved so much,
Moved by compassion's gentle touch.
In him thy Śántás father see:
As I am even so is he."

(Canto X)

শান্তা ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি দীর্ঘ্য সময় অযোধ্যায় কাটিয়েছিলেন। ঋষ‍্যশৃঙ্গর তত্ত্বাবধানে অশ্বমেধ ও পুত্রেষ্টি যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এবং তাদের দুজনই বিশেষভাবে পূজিত হয়ে আবার অঙ্গদেশে ফিরে যায়। তাহলে লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রচলিত টেক্সটে দু-একটি জায়গায় হাল্কা ইঙ্গিত থাকলেও কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই শান্তা দশরথের মেয়ে। এমনকী তিনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছেন একথা কোথাও উল্লেখ নেই।

এবার নর্থ রিসেন্সন দেখা যাক। এখানকার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্গদেশের রাজার নাম রোমপাদ নয়, বরং লোমপাদ - "এতস্মিন্নেব কালে তু লোমপাদঃ প্রতাপবান্ (১/৮/১১)"। দশম সর্গতে সুমন্ত্র জানায় তিনি সনৎকুমারের শ্রুতিকথনে জেনেছিলেন অঙ্গরাজ লোমপাদের সঙ্গে রাজা দশরথের মিত্রতা হবে। রাজা দশরথের শান্তা নামে সৌভাগ্য-শালিনী একটি কন্যা জন্মলাভ করবে।

ইক্ষাকুবংশজো রাজা ভবিষ্যতি মহাযশাঃ।
নাম্না দশরথো নাম ধীমান্ সত্যপরাক্রমঃ॥২॥
সখ্যং তস্যাঙ্গরাজেন ভবিষ্যতি মহাত্মনঃ।
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ॥৩॥

অঙ্গরাজের কোনো সন্তান হবে না। তিনি রাজা দশরথের নিকট প্রার্থনা করবেন - "সখা, আমি নিঃসন্তান। তুমি প্রসন্ন মনে তোমার এই শান্তা নাম্নী অসামান্য-রূপ-লাবন্যবতী তনয়া আমাকে প্রদান কর - আমি "পুত্রিকা" করব। করুনহৃদয়ের রাজা তার হৃদয়-নন্দিনীকে প্রদান করবেন (১/১০/৫-৮)"।

দশরথ ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সামনে, লোমপাদ আরো বলেন - "ঋষিকুমার! এই রাজা দশরথ আমার পরম-প্রিয় সখা। আমার সন্তান না হওয়াতে আমি "পুত্রিকা করবার নিমিত্ত" ইঁহার আত্মজা বরবর্ণিনী শান্তাকে যাচঞা করেছিলাম। ইনিও তৎক্ষণাৎ অক্ষুব্ধ-হৃদয়ে এই প্রিয়তমা কন্যা আমায় প্রদান করেছিলেন। আমার ন্যায় এই দশরথও সম্পর্কে আপনার শ্বশুর হন। আপনি শান্তাকে নিয়ে অযোধ্যায় গমন করুন (১/১০/২৫-২৯)"।

তাহলে নর্থ রিসেন্সন (সমগ্র উত্তর ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপিতে) রামায়ণে পরিষ্কার উল্লেখ পাই শান্তা দশরথেরই কন্যা। রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ (ক্রিটিক্যাল এডিশন) এক্ষেত্রে দক্ষিণের পাঠ রেখে দিয়েছে। ক্রিটিক্যাল এডিশন রামায়ণের টেক্সট গঠনের মেথড একটু ভিন্ন ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারতের টেক্সট গঠনের থেকে। মহাভারতে যেমন শারদা (কাশ্মীর) ও মালায়লম লিপিকে একটা একটা base ধরে বাকি পাণ্ডুলিপির প্রক্ষেপ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে (এটা খুবই সরল ভাবে বলা হলো, আসল প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল), রামায়ণের ক্ষেত্রে সেরকম নয়। এখানে দক্ষিণের টেক্সটের ৭৫% রাখা হয়েছে এবং সেই অংশগুলো দক্ষিণের টেক্সট থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে যেগুলো উত্তর ভারতে সাক্ষ্য দেয় না। কিন্তু উত্তর ভারতে যদি কোনো অংশ এক্সট্রা থাকে যেটা আবার দক্ষিণে সাক্ষ্য দেয় না, সেক্ষেত্রে তারা সেটিকে বাদ দিয়েছে, তাদের মেথড এটাকে প্রক্ষেপ বলে মনে করে।

এখানে সমস্যাটি আরো গভীর। তার কারণ বহু রামায়ণ গবেষকদের মতে আদিকান্ডের বেশ অনেক অংশ পরের সংযোজন। জন ব্রকিংটন Rama the Steadfast: The Early Form of Ramayana তে লিখছেন গোটা আদিকান্ড টাই পরে যোগ হয়েছে। ওঁর মতে রামায়ণের একদম প্রাথমিক স্টেজে মূল কবির হাতে আদিকান্ড রচনা হতে পারে না, এবং এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত বলা যায় না। হার্মান জেকবি, কামিল বুলকে, রবার্ট গোল্ডম্যান, চিন্তামনি বৈদ্য, ক্রিটিক্যাল এডিশনের প্রত্যেকটি এডিটর ও আরো অনেক পন্ডিতরাই মনে করেন আদিকান্ডের মধ্যেও অনেক স্তর আছে যেগুলির সময়কাল ইতিহাসের মেথড দিয়ে বের করা সম্ভব। ব্রকিংটনের মতো পুরোটাই পরে রচিত হয়েছে না বলে, বেশিরভাগ পন্ডিত এটাই বলেন শুরুতে আদিকান্ডের খুব অল্প অংশ মূল কাব্যের অন্তর্গত ছিল।

জেকবি তার বিখ্যাত বই Das Ramayana তে লিখছেন রামের জন্ম ও গোটা ঋষ‍্যশৃঙ্গ অধ্যায়টাই পরের সংযোজন। উনি মনে করেন কাব্যের নায়কের জন্মের একটা সংক্ষিপ্ত কাহিনী হয়তো একটি ছিল, কেমন আকারে জানা নেই, কিন্তু সেটা কোনো অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেছে। সেটাকে পূরণ করতে এরকম একটি কাহিনীর অবতারণা করতে হয়েছে যেখানে বিষ্ণু নিজে অবতার রূপ ধারণ করে দসরথের পুত্র হয়ে জন্মাবেন। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে রাম শুরুতে বিষ্ণুর অবতার ছিলেন না, এটির ধারণা টেক্সটে ঢুকছেন অনেক পরে, যখন বিষ্ণু-কাল্ট ভারতে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ক্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬০০ তে এই কাব্যের গোড়ার স্টেজে (গোল্ডম্যান বালকাণ্ডের ভূমিকা) লেটার-বৈদিক পটভূমিকায় বিষ্ণু অবতার রূপে কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। ফলে রামের জন্মের পুরো অধ্যায়টাই হয়তো পরে রচিত হয়েছে, এমনটা অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে, শান্তার কাহিনীও পরে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে এটা বলাটা খুবই মুস্কিল নর্থ রিসেন্সনে বর্ণিত অংশগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রক্ষেপ কিনা। এটা বলা যায় না কারণ কোনো রাজা নিজের কন্যা অন্য মিত্র রাজাকে দান করেছেন, এরকম উদাহরণ আমরা মহাভারতেও দেখেছি, কুন্তীর ক্ষেত্রে। তেমনি রোমপাদ / লোমপাদ যদি পুত্রিকা হিসেবে কন্যাকে গ্রহণ করেন, সেক্ষত্রে ব্যাপারটি খুবই ইন্টারেস্টিং হয়ে যায়। একটু বিশদে আলোচনা করা যাক।

মহাভারতে রামকথার একটি অংশ পাওয়া যায় বনপর্বে। ওটি ছাড়াও সমগ্র মহাভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক উপাদান আছে যেগুলিকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। তীর্থযাত্রা পর্বে (৩/১১০) আমরা জানতে পারি অঙ্গদেশের রাজার নাম লোমপাদ। মূল কাহিনীটি মোটামুটি রামায়ণের সঙ্গে এক, শুধু এখানে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে ছলনা করে এনে মেয়েদের কক্ষে রাখা হয়েছিল। বিভান্ডক ঋষি তার পুত্রকে না খুঁজে পেয়ে রেগে আগুন হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে তার পুত্রকে অঙ্গরাজ নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে তার মন গলে যায়। রাজাকে বলে শান্তার গর্ভে সন্তান আসার পর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যেন বনে ফিরে আসে। বাধ্য সন্তানের মত ঋষ‍্যশৃঙ্গ বনে ফিরে যেতে চাইলে শান্তাও তার সঙ্গে পতিব্রতা নারীর মত সঙ্গ দিতে চায়। সেক্ষেত্রে শান্তার সন্তান অঙ্গরাজ্যেই রয়ে যায় (অনুমান করা যায়), এবং ঋষ‍্যশৃঙ্গ-র পরের সন্তান (অনুমান করা যায়) শ্বশুরের বংশের দ্বীপ হয়ে জন্মলাভ করার কথা। পুত্রিকা হলো সেই কন্যা যার সন্তান তার মায়ের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেই নারী ক্ষতিকারক হতে পারে যে বংশে তার বিয়ে হচ্ছে তাদের কাছে। মহাভারতে এই উদাহরণ প্রচুর আছে - চিত্রাঙ্গদা, সাবিত্রী, ইত্যাদি। যেমন চিত্রাঙ্গদা ছিলেন পুত্রিকা। অর্জুন তাকে বিয়ে করতে চাইলে চিত্রাঙ্গদার বাবা বলেন তার একমাত্র কন্যার পুত্র-ই এই বংশের রাজা হবে। অর্জুন সেটি জানা সত্ত্বেও তাকে বিবাহ করে। তাদের পুত্র হয় বভ্রুবাহন। এই বভ্রুবাহন কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। কিন্তু পরে বাবা আর ছেলের মধ্যে যুদ্ধ হয় (অনেকটা পারস্য কাব্যের শাহনামের সোহরাব ও রোস্তমের কাহিনীর মত) এবং সেখানে অর্জুন মারা যায়। আবার সে অলৌকিক ভাবে উলুপির (তার অন্য একটি পত্নী) কৃপায় বেঁচে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে। সেখানে তার বিধবা পুত্রবধূ পরীক্ষিত নামে একটা সন্তানের জন্ম দেয় ও যুধিষ্ঠিরের পরে সেই বংশের রাজা হয়। কিন্তু যেসব ব্যক্তির অর্জুনের মত একাধিক পত্নী নেই এবং একটি মাত্র স্ত্রী-ই যদি পুত্রিকা হয়? তাই শান্তার বিষয়টি খুবই আকর্ষক। এটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার যে শান্তা তার স্বামীর সঙ্গে বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রামায়ণে এরকম কোন ইঙ্গিত নেই। তেমনি মহাভারতের রামোপাখ্যান অংশে পুত্রেষ্টি যজ্ঞেরও উল্লেখ নেই।

তাহলে কী দাঁড়ালো?

রামায়ণের ভিন্ন রিসেন্সনে শান্তার জন্ম নিয়ে পাঠ্ভেদ আছে। প্রচলিত টেক্সট শুধু এটুকুই বলে দশরথ ও রোমপাদ ছিলেন ভালো বন্ধু, এবং শান্তা রোমপাদের কন্যা (১/৯/১৩ ও ১/১১/১৯)। যখন শান্তা অযোধ্যায় আসে ওর স্বামীর সাথে টেক্সট কিন্তু বলেনি যে সে তার বাপের বাড়ি ফিরে আসছে, বা শান্তার দিক থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া কবি জানায়নি, যেটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তেমনি টেক্সট এটাও বলে দশরথ অনপত্য (১/১১/৫) অর্থাৎ নিঃসন্তান ছিলেন। এমনকী নর্থ রিসেন্সনে শান্তাকে লোমপাদের কন্যাও বলা হয়েছে (গৌড়ীয় ১/৮/২৬; লাহোর এডিশন ১/৮/২৫)। মহাভারতে শান্তা লোমপাদেরই কন্যা এবং কবি জানাচ্ছেন না যে দশরথ তাঁর পুত্রীকে দান করেছিলেন (৩/১১০/৫; ১২/২২৬/৩৫ ও ১৩/১৩৭/২৫)। তেমনি হরিবংশ পুরাণ (১/৩১/৪৬), মৎস্য পুরাণ (৪৮/৯৫), বায়ু পুরাণ (১১/১০৩) এগুলিতে শান্তাকে লোমপাদের মেয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে দক্ষিণী পাঠের মধ্যেই সুমন্ত্রের কথায় আমরা ইঙ্গিত পাই (১/৯/১৯) যে শান্তা হয়তো দশরথের কন্যা ছিলেন। তেমনি (১/১১/২-৩) শ্লোক গুলি খুবই ইনটারেস্টিং।

ইক্ষাকূণাং কুলে জাতো ভবিষ্যতি সুধার্মিক:৷
রাজা দশরথো নাম্না শ্রীমান্সত্যপ্রতিশ্রব: II
অঙ্গরাজেন সখ্যং চ তস্য রাজ্ঞো ভবিষ্যতি৷
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ৷৷

ক্রিটিক্যাল এডিশন টেক্সট "অস্য" রেখেছে যেটা অঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু দক্ষিণের প্রচুর পাণ্ডুলিপিতে এটি আছে "তস্য"। উত্তর ভারতের লিপিগুলোতে তো আছেই (ক্রিটিক্যাল এডিশন ফুটনোট - ১/১০/৩) তস্য, যেটা পরিষ্কার ইঙ্গিত করে শান্তা দশরথের কন্যা। নর্থ রিসেন্সনে ঠিক এই শ্লোকের পরে আমরা জানতে পারি কোন পরিস্থিতিতে রাজা দশরথ শান্তাকে দান করেছিলেন (পূর্বেই লিখেছি - ১/৯/৪-৫)।

এই সমস্যার মূল উৎপত্তি হয়তো অন্যত্র। হরিবংশ, মৎস, বায়ু ও ব্রহ্ম পুরাণে অঙ্গরাজার নাম চিত্ররথ। তার পুত্রের দুটি নাম - লোমপাদ ও দশরথ। এমনটি হয়তো হয়েছিল শান্তা প্রথমে অঙ্গের রাজা দশরথের কন্যা ছিল, কিন্তু ততদিনে অজের পুত্র দশরথ খুবই জনপ্রিয় রাজা হয়ে উঠেছেন। এবং তার পর থেকে শান্তা দশরথের কন্যা বলেই পরিচিতি লাভ করেছে। তেমনি বিষ্ণু পুরাণ (৪/১৪/১৪), ভাগবত পুরাণ (৯/২৩/৮), ভবভূতির উত্তররামচরিত, স্কন্দ পুরাণ, পদ্ম পুরাণের পাতালকান্ড, আনন্দ রামায়ণ (১/১/১৬-১৭), সরলা দাসের ওড়িয়া মহাভারতে শান্তা দশরথের কন্যা। ১৬-শতাব্দী বলরাম দাসের রামায়ণে আমরা প্রথম জানতে পারি শান্তা হলো কৌশল্যার মেয়ে। কৃত্তিবাস রামায়ণে (১/২৯) দশরথ তার কন্যাকে দান করেন লোমপাদকে। মেয়েটির নাম হেমলতা। অনুমান করতে অসুবিধা হয়না ইনিই শান্তা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ও কাশ্মীরি রামায়ণে আমরা পাই কৈকেয়ীর একটি কন্যার কথা যে সীতাকে সহ্য করতে পারতো না। একই থিম আমরা পাই সুবর্চ রামায়ণে যেখানে সীতা শান্তাকে অভিশাপ দেয়। ইন্দোনেশিয়ার "হিকায়েত সেরি রাম" এ শান্তা হলো ভরত-শত্রুঘ্নর নিজের বোন। সিয়াম এর রাম-জাতকে শান্তার বিয়ে হয় রাবণের সঙ্গে। তেমনি প্রাচীন পালি টেক্সট দশরথ জাতকে সীতা রাজা দশরথের মেয়ে। ফলে দশরথের কন্যা ছিল এটা এনটিকুইটি সাক্ষ্য দেয় -- বাল্মীকি ও অন্যান্য রামকথায় আমরা পাই। তবে সব থেকে বিচিত্র কাহিনী পাওয়া যায় মাধবদাসের বিচিত্র রামায়ণে। ওখানে এক ঋষি রাজাকে অভিশাপ দেন ও বলেন সে নিঃসন্তান হবে। পরে আবার দেখা হলে ও রাজা ক্ষমা চাইলে, ঋষি অভিশাপ পাল্টে ফেলে বলেন তার প্রথম সন্তান একটি কন্যা হবে এবং তার বিয়ে হবে ঋষ‍্যশৃঙ্গের সঙ্গে। তারপর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যজ্ঞ করলে তার চারটি সন্তান হবে। তারপর শান্তার বিবাহের বয়স উপস্থিত হয়ে স্বয়ম্বর আয়োজন করা হয়। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হন পরশুরাম। তিনিই বলেন শান্তার সঙ্গে ঋষ‍্যশৃঙ্গের বিবাহ দেওয়া হোক।


পাঠ্যসূচী

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - যে দুজন ব্যক্তি আমাকে উপকার করেছেন এটি লিখতে, রবার্ট গোল্ডম্যান ও কনাদ সিংহ।

১) আকর সূত্র

পঞ্চানন তর্করত্ন - রামায়ণম
আর্য্যশাস্ত্র - বাল্মীকি রামায়ণ
রামায়ণ সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
বাল্মীকি রামায়ণ ক্রিটিক্যাল এডিশন - Vol 1
রবার্ট গোল্ডম্যান - The Ramayana of Valmiki vol 1
ভগবৎ দত্ত - The Ramayana of Valmiki (North West Recension)
অমরেশ্বর ঠাকুর - বাল্মীকি রামায়ণম
এম এন দত্ত - দি মহাভারত (vol 2)
বিষ্ণু সুকথঙ্কর - ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারত (আরণ্যক পর্ব)
জন স্মিথ - দি মহাভারত
রালফ গ্রিফিথ - The Ramayana of Valmiki
এম এন দত্ত - হরিবংশ
সাইমন ব্রডব্রেক - Krishna's lineage: The Harivamsa of Vyasa's Mahabharata
শান্তি লাল নগর - আনন্দ রামায়ণ

২) রামায়ণের টেক্সট গঠন

জন ব্রকিংটন - Rama the Steadfast: The Early form of Ramayana
হার্মান জেকবি - Das Ramayana
এল এ ভ্যান ডালেন - Valmiki's Sanskrit
রবার্ট গোল্ডম্যান - Vol 1 ভূমিকা
জি এস আলটেকর - Studies on Valmiki Ramayana

৩) পুত্রিকা

কনাদ সিংহ - From Dasrajana to Kurukshetra
সাইমন ব্রডবেক - Putrika interpretation of the Mahabharata
সাইমন ব্রডবেক - The Mahabharata Patriline

৪) ভিন্ন রামকথা

ভি রাঘবন - The Ramayana tradition in Asia
ভি রাঘবন - The Greater Ramayana (পুরাণ নিয়ে আলোচনা)
শ্রীনিবাস আইয়েঙ্গার - Asian variations in Ramayana
কামিল বুলকে - অনুবাদ প্রদীপ ভট্টাচার্য: The Rama Story - Origins and Growth
অভদেশ কুমার সিংহ - Ramayana through the ages
0

প্রবন্ধ - পিয়ালী বসু

Posted in





















“The end is in the beginning and yet you go on.” ― Samuel Beckett, Endgame .

১৯০৬ সালের ১৩ এপ্রিল। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী 'ডাবলিন ' শহরে জন্মগ্রহণ করেন অনন্য এক নাট্যকার ... স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট ( Samuel Barclay Beckett ) ... বিংশ শতকের সাহিত্যিকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে তাঁর নাম আজও অমর।
.
বেকেটের বাবা উইলিয়াম ফ্রাঙ্ক বেকেট ছিলেন একজন স্বখ্যাত মানুষ । বাবা'র প্রভাব বেকেটের জীবন এবং সৃষ্টিতে বেশ স্পষ্টমান ।
.
১৯২৩ -১৯২৭ সাল ...এই পাঁচ বছরে বেকেট তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ট্রিনিটি কলেজ থেকে । স্বাভাবিক ভাবেই বেকেটের প্রতিটি সৃষ্টিতে শিক্ষার এই আলোক গভীরতা বিশেষভাবে দৃশ্যমান |
.
১৯২৯ সালে প্রকাশের আলো দেখে তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ... ' দান্তে...ব্রুনো...ভয়েজ জেমস জয়েস'... , অগ্রজ লেখক জেমস জয়েসের লেখার দুর্বধ্যতা নিয়ে সে সময়ে সমালোচনায় তোলপাড় সাহিত্য মহল , বেকেটের উদ্দেশ্য ছিল , জয়েসকে সহজবোধ্য করে আপামর সমালোচকদের সামনে হাজির করা ... এবং সে প্রয়াসে সার্থক ছিলেন তিনি ।
.
১৯৩৮ সাল । প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'মুরফি ' । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ন্যাৎসিদের চূড়ান্ত বর্বরতা এবং অমানুষীকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেকেট যোগ দেন ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মমতা, অনৈতিকতা, এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিত্র ফুটিয়ে তোলেন বেকেট তাঁর উপন্যাসে ।
.
বেকেটের শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম 'ওয়েটিং ফর গডো' প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে ... ১৯৫৩ সালে প্যারিসের থিয়েটার ডে ব্যাবিলনে মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো । প্যারিসের নাট্যপ্রেমীদের জন্য নাটকটির ফরাসি নাম রাখা হয় 'এন অ্যাটেনডেন্ট গডো'... অর্থাৎ গডো 'র জন্য প্রতীক্ষা । বেকেটের অন্যতম প্রিয় বন্ধু জেমস নেলসনের কথায় ... নাটকটির শো ছিল হাউসফুল ! প্রিয় বন্ধুর রচিত নাটকটির বিখ্যাত হবার অন্যতম কারণ হিসেবে নেলসন জানান , ... নাটকটি'র ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন নাট্যপ্রেমী মানুষ , আর এই কারণেই বিশেষ কোন কালের গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে দর্শকদের কাছে এ নাটক হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ ,সর্বজনীন ।
.
১৯৫৪ সালে নিউইয়র্কে প্রকাশিত হয়'ওয়েটিং ফর গডো'র ইংরেজি অনুবাদ, ... তারপর থেকে সম্ভবত ২৩টিরও বেশী দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে এ নাটক এবং ৩২-৩৩ টি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে । এই কাল্ক্রমিক ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে 'ওয়েটিং ফর গডো'র অনন্যতা ।
.
১৯৫৫ সালে লন্ডনের আর্ট থিয়েটারে চব্বিশ বছরের তরুণ পরিচালক পিটার হল'এর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় ওয়েটিং ফর গডো' । নাট্য সমালোচক কিনিথ টাইনান এক প্রেসমিটে জানান --- " Waiting for Godot frankly jettisons everything by which we recognise theatre. It arrives at the custom house, as it were, with no luggage, no passport and nothing to declare: yet it gets through as might a pilgrim from Mars. It does this, I believe, by appealing to a definition of drama much more fundamental than any in the books. A play, it asserts and proves, is basically a means of spending two hours in the dark without being bored. " (August 7, 1955)
.
রূপকাশ্রয়ী এবং প্রতীকী এই নাটকটিতে bleak themes এর সার্থক প্রয়োগ করেন বেকেট|

দুটি অ্যাক্টে পরিবেশিত এ নাটকটিকে 'ট্র্যাজিক কমেডি' হিসেবেও চিহ্নিত করা হয় । ESTRAGON এবং VLADIMIR এর চরিত্র দুটি আসলে সমকালীন বিধ্বস্ত মানুষের দুঃখের প্রতীক হিসেবেই খ্যাত । নাটকের শুরুতে দেখা যায়, ভবঘুরে ছন্নছাড়া দুই লোক ভলাডিমির ও এস্ট্রাগন তেমনি এক ছন্নছাড়া ধূসর এক প্রান্তরে কোন এক মি. গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। নাটকের শেষেও তারা প্রতীক্ষাই করে; কিন্তু মনে হয় যেন তারা অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করছে... অর্থহীন এই প্রতীক্ষা, কারণ গডো আসেন না , কোনদিন আসবেন সে নিশ্চয়তাও নেই , তবু মুক্তি নেই তাদের... প্রকারান্তরে আমাদের । যাবতীয় ধর্মবিশ্বাসের বিসর্জনে, মানুষের বিপর্যস্ত অবস্থায় একটি সামগ্রিক শূন্যতার মধ্যে এই নাটক আসলে মানব সত্তাকে তার চূড়ান্ত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চায়... দেখিয়ে দিতে চায় ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সবকিছুই অবলুপ্ত ... আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই ।
.
১৯১৩ সালে 'ওয়েটিং ফর গডো'র ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান আবারও মনে করিয়ে দেয় , কাল্পনিক চরিত্র নয় , এ নাটক আসলে কালজয়ী চরিত্র সৃষ্টিতে চূড়ান্ত ভাবে সার্থক ।
.
আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে'র Druid থিয়েটারে Garry Hynes এর পরিচালনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো'। Druid থিয়েটারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ব্রশিওরে জানানো হয় -- " On a bare road in the middle of nowhere, two world-weary friends await the arrival of the mysterious Godot. While waiting, they speculate, bicker, joke and ponder life’s greater questions. As dusk begins to fall, two figures appear on the horizon "
.
অ্যাবসার্ড নাটক হিসেবে আজও উজ্জ্বল ভাবে উল্লেখ্য ওয়েটিং ফর গডো'র নাম । গোটা নাটক জুড়ে শুধুমাত্র কিছু ঘটেনা... নেই কোন সংঘাত অথবা দ্বন্দ্ব ...প্রধান দুই Protagonist চরিত্র শুধু একটি কাজই করে আর তা হলো অপেক্ষা। তারা অপেক্ষা করে গডো’র জন্য , তারা বিশ্বাস করে গডো এলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হবে, তারা মুক্তি পাবে এই প্রাত্যহিক অভিশপ্ত জীবন থেকে। আমরা যে কী ভীষণভাবে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় তারই এক একটি জ্বলন্ত উদাহরণ থিয়েটার অব দ্য অ্যাবসার্ডের নাটকগুলি ,

সার্থক অ্যাবসার্ড নাটক হিসেবে আজীবন আমাদের মনের মণিকোঠায় স্বযত্নে বাস করবে 'ওয়েটিং ফর গডো' ।
.
" We are all born mad. Some remain so"' ― Samuel Beckett

মানুষ হিসেবে বেকেট ছিলেন স্পর্শকাতর, অনুভূতিপ্রবণ এবং প্রচারবিমুখ ... নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি , ... অনেকে বেকেট কে দুঃখবাদী ' বলে অভিহিত করেন , দুঃখবিলাসিতা অবশ্যই তাঁর জীবন যাপনে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তবুও বেকেট আশাবাদী মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত ... " Ever tried. Ever failed. No matter. Try Again. Fail again. Fail better. " তাঁর এ প্রখ্যাত উক্তি প্রমাণ করে শৈল্পিকতা বিরাজ করতো তাঁর মনের অলিন্দে ।
.
" Nothing matters , but the writing . There has been nothing else worthwhile .. a stain upon the silence " ― Samuel Beckett ১৯৮৯ সালের ২২ শে ডিসেম্বর । ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নাটকে উত্তর আধুনিকতার ধারক স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট ।

--------------------------
ছবি - (১) -- আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে'র Druid থিয়েটারে Garry Hynes এর পরিচালনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো'... এটি তারই পোস্টার ছবি -(২)-- স্যামুয়েল বেকেট ছবি -(৩) -- মঞ্চে 'ওয়েটিং ফর গডো


তথ্যসূত্র :
--------
Samuel Beckett : The Complete Dramatic Works . ______Faber & Faber

Wating For Godot : Analysis .

____ Mateuez Brodowicz








0

প্রবন্ধ - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in






প্রেম কি শুধুমাত্রই অপর একজনের প্রতি মনের আর্তি? অপর একজনের সঙ্গে গভীর সংযোগের আবিষ্কার? না কি প্রেম এমন একধরনের মহাজাগতিক সংযোগ, যা আবিষ্কার করলে এই মহাজগতের এক ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করা যায় নিজস্ব অবস্থানের মাহাত্ম্য। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে মাহাত্ম্য শব্দটি উচ্চারণ করলাম, তা কি নিজের অহংকে এক বিন্দু হলেও বাড়িয়ে দিল? না কি এই অনুভূতিমালা নিজেকে আরও ক্ষুদ্র এক অস্তিত্বেই পরিণত করল? এমন এক ক্ষুদ্র অস্তিত্ব, যা আসলে এক অখণ্ড অস্তিত্বের অংশ। নিজের খণ্ড অস্তিত্বকে অখণ্ড অস্তিত্বের মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখাই মনে হয় এই জীবনের এক মহার্ঘ্য অনুভূতি। প্রেম, এই অনুভূতি দেয় আমাদের। যেমন দেয় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, যেমন দেয় একাকী এই প্রকৃতির মধ্যে অবগাহন। কিন্তু কীভাবে? আমাদের চারপাশে শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা বা প্রেমের কবিতার সংকলন প্রচুর দেখতে পাই আমরা। অনেকের অনেক প্রেমের কবিতার সংকলন রয়েছে আবার রয়েছে কবিতার সংকলনের মধ্যে বহু প্রেমের কবিতা। সেই সব প্রেমের কবিতা কালজয়ী। কিন্তু এখানে একটা ছোট্ট অভিযাত্রা হতে আমাদের। তিনজন কবির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং বিনয় মজুমদার। তবে, আলোচনার প্রসঙ্গে যে অন্য কবিদের আমরা ছুঁয়ে যাব না, তাও নয়।

রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি ধরি, তিনি প্রেম এবং পূজাকে একত্র করে দিয়েছিলেন। এই একই অনুভূতি আমরা বৈষ্ণব পদাবলীতে বা মীরার ভজনেও পাই, পাই সূরদাসের ভজনে বা কবীরের দোঁহায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেম শুধুই ভগবৎ দর্শনের মধ্যে একাত্ম হওয়া নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের মধ্যে যে ‘তুমি’, সেই ‘তুমি’ আমারই তো এক অখণ্ড অংশ। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কবিতায় বা গানে এই তুমির মধ্যে সমগ্রের এক বিস্তার ঘটান, তখন সেই ‘তোমার’ মধ্যে নিজেকেও প্রসারিত হয়ে যেতে দেখি। এ প্রসঙ্গে ‘তুমি আমার সাধের সাধনা’ যখন রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ শীর্ষক গানে, তখনই বুঝতে অসুবিধা হয় না, কীভাবে, রবীন্দ্রনাথ প্রেমিকার সঙ্গে এক অদ্বৈত সম্পর্ক তৈরি করে নিচ্ছেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমি তো তার জন্যই সাধনা করছি, যে ‘আমি’ নই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেমে নিজেকে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়ার বেদনা এবং চেতনাই মনে হয় সেই কবিতা, যা আমাদের প্রেমের এক বিস্তারিত আকাশের দিকে নিয়ে চলে গেল। এখানে এসে প্রশ্ন আসতেই পারে, তবে প্রেমের কবিতা মানেই আধ্যাত্মিক কবিতা? এখানে বলতে বাধ্যই হচ্ছি, আধ্যাত্মিকতা এবং ধার্মিক ভাবনার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রেম অবশ্যই এক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক আমাদের শরীরকে সাধনার এক অংশ হিসেবেই ব্যবহার করে। ঠিক যেমন, এই শরীরটা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি, তেমনই, শরীর আছে বলেই প্রেমের প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে। একটি অব্যক্ত অনুভূতি, ব্যক্ত হচ্ছে। এই অব্যক্ত অনুভূতির তো ব্যক্ত হয়ে ওঠার প্রয়োজন আছে বলেই জগতের সৃষ্টি এবং তার প্রকাশ। এই দেখুন, এই কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত পংক্তি- ‘ আমরা যাইনি মরে আজো, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’। কিংবা মনে হতে পারে, জীবনানন্দ যে হাজার বছর ধরে পথে হেঁটে যাওয়ার কথা বলছেন, বলছেন, সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী, আর তারপর থাকে পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। ভাবুন আকাশলীনা কবিতাটির কথাও, যেখানে জীবনানন্দ প্রায় তার্কোভস্কির দ্য স্যাক্রিফাইসের লং শটের মতো ‘আকাশের ওপারে আকাশ/ বাতাসের ওপারে বাতাস’-এর রচনা করেছেন। জীবনানন্দের প্রেম কি আধ্যাত্মিক নয়? অনেক গভীর ভাবে আধ্যাত্মিক, তা না হলে তিনি প্রায় উত্তরাধুনিক এক প্রশান্তিতে এমন এক দৃশ্যের ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন –“ এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে—জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা”। এই যে ‘-‘- এর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জীবনানন্দ এক অব্যক্তকে ব্যক্ত করলেন, তা আধ্যাত্মিকতার সংযোগ ছাড়া সম্ভব ছিল না।

তবে, আমরা মনে হয় এই জায়গা থেকে প্রেমের কবিতার দিকে তাকাতে পারি। সার্থক প্রেমের কবিতা কিংবা গান, আধ্যাত্মিক হতে বাধ্য। তা আধ্যাত্মিক, কারণ তা সময় স্থান কালের যে সীমাবদ্ধতা তা পেরিয়ে মানুষকে এবং মানুষের অনুভূতিমালাকে সংযুক্ত করে। প্রেম এক সংযোগ বলেই কি তাই বিনয় মজুমদার বারবার বলেছেন অঘ্রাণের অনুভূতিমালার কথা,যে অঘ্রাণ নিয়ে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “ লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো মৃত/ মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো/ মৃতেরা কোথাও নেই, আছে?/ কোনো কোনো অঘ্রাণের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়”। এই অঘ্রাণ আমাদের কাছে বিষাদের বার্তা নিয়ে আসে। আর এই বিষাদকে রবীন্দ্রনাথ বলেন বড়ো দুঃখের আধার”। বড়ো দুঃখ এবং করুণ রাগিনী ছাড়া প্রেমের গভীরতম প্রদেশে আলো ফেলা যায় না। বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্থে এই বিষাদ এবং করুণ রাগিনীকেই এবং এই সংযোগকেই আবিষ্কার করে গেছেন নিয়ত। “ আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমেষেই/ গলাধঃকরণ তাকে না করে ক্রমশ রস নিয়ে/ তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ফুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে”। আমরা এই কবিতা পড়তে পড়তে আশ্চর্য হই, কারণ বিনয় মজুমদারের কবিতা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই একে অপরের সঙ্গে সুরের হারমনি তৈরি করতে করতে উঠে যায় অর্থের চূড়ায়। বিনয় মজুমদার আসলে কাব্যের এই সংযোগের ভাষাটি তৈরি করে গেছেন নিপুণভাবে তাঁর প্রতিটি কবিতার মধ্য দিয়েই। গভীর এক আধ্যাত্মিকতার রচনা তিনি করেছেন। কিন্তু তাকে আধ্যাত্মিকতার কোনও চেনা ছকের মধ্যে ফেলা যাবে না। কারণ বিনয় এক প্রকৃত ভাস্করের মতো সেই বুনন রচনা করেছেন, যা এক অখণ্ড সমগ্র। প্রত্যেক মহৎ কবিই আসলে এই সংযোগের সাধনাই করে থাকেন। “ নিষ্পেশণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে/ হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত”। প্রেম আমাদের এই আত্মসমাহিত এক জায়গাতেই নিয়ে চলে যায়। যেখানে আমি আর আমি হয়ে থাকি না। নিজেকে তোমার মধ্যেই আবিষ্কার করি শুধু তাই নয়, তোমার মধ্য দিয়েই আমি নিজেকে দেখি। আর তুমি তো প্রকৃতিরই এক রূপ। আমিও প্রকৃতির এক রূপ। যখন তোমার মধ্য দিয়ে আমি এই প্রকৃতির দিকে তাকাই, তখন আমি নিজেকেও দেখতে পাই। আর ধীরে ধীরে আমি আলাদা ভাবে কাউকেই দেখতে পাই না। যেমন,প্রকৃতি কি পারে নিজের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে? কিন্তু প্রকৃতিরও তো নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাকুলতা আছে। আর তাই তো সে একটি ফুলের মধ্য দিয়ে, একটি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, একটি কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। তার নিজেকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় আধারের। আমাদের সমস্ত শিল্প সাধনা হল প্রকৃতি এবং প্রকৃতির নিজেকে প্রকাশের আধারের মধ্যে সংযোগসাধনটুকু তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার তাঁদের কাব্যে এই প্রেমের অরূপটুকুকেই নির্মাণ করে গেছেন।
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






বাংলা কবিতায় জীবনানন্দই প্রথম কবি, যিনি নারীর দিকে তাকিয়েছিলেন আধুনিক দৃষ্টিতে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নারী ঘোর রহস্যঘন, তার দেহরূপ, আর অলঙ্কারের বর্ণনার তলে চাপা পড়ে যায় তার মানস, আর রবিঠাকুরের গানগুলিকে যদি প্রেমের গান ধরি, তাহলে, রবীন্দ্র কবিতায় নারী তেমন নয়, যেমন তার জীবনে; রবীন্দ্র কবিতায় নারী এক কল্পলোকের জগতের আলোছায়া।
নজরুলের কবিতায়ও তাই, নজরুল একধাপ এগিয়ে। তার কবিতায় নারীকে করে তুলেছে দেবীতুল্য হিসাবে। মোটকথা, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতার নারী ইহজগতের কেউ নন। তারা ‘প্রিয়া’, ‘স্বপ্ন-সহচরী’, ‘প্রিয়তমা’; তাদের কোন নাম নাই, নামহীন এক দূরতম রূপের জগত তারা। নারী তাদের কবিতায়, অতিশয় পবিত্রও বটে! তারা ব্যথা দিলেও, হৃদয় ভাঙলেও, তাদের পদতলে পড়ে থাকাই যেন প্রাপ্তি, যেন তারা ঈশ্বরী, যেকোন মূল্যে তাদের খুশি করাই প্রেমিক তথা পুরুষের অভীষ্ট! রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের এহেন ‘নারীবাদ’ বঙ্গে যে নারীদর্শনের জন্ম দিয়েছে, সেখানে, নারীর প্রসঙ্গ এলে সকলেই অপার্থিব জগত থেকে নামিয়ে আনেন শব্দমালা, আর মালা গাঁথেন মহান কল্পলোকের রূপকথায়। তারপর, সেই দেবীটিকে পুজা করতে থাকেন।
জীবনানন্দ আমাদের কবিতায় তো বটেই, মননে-মস্তিষ্কেও, এ ভূখণ্ডের প্রথম পরিপূর্ণ আধুনিকতম পুরুষ। খেয়াল করুন, জীবনানন্দের দাম্পত্যের কথা, যা আমাদের আধুনিক দাম্পত্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জীবনানন্দ সেই যুগে বিয়ের কন্যাকে যেন বলি দেয়া হত।
সেই যুগে তিনি, কাদামাখা একটা শাড়িসমেত কলেজফেরত লাবণ্যকে একঝলক দেখে পছন্দ করেছিলেন, যাতে আশ্চর্য হয়েছিলেন স্বয়ং লাবণ্যও! যৌতুকও নেননি, সেইসময়, যৌতুক যখন গায়ে হলুদের মতই, বিয়ের কার্যবিধিরই অংশ। নারীর ব্যাপারে জীবনানন্দের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় তার দাম্পত্যজীবনের আরো খুঁটিনাটি ঘটনায় ।

জীবনানন্দ কবিতায় প্রথম, নারীকে তার দৈহিক রূপের জন্য যে পুজো দেয়া হয়েছে বিগত শতাব্দীতে, তাকে মনুষ্যসমাজ থেকে আলাদা করে যে কল্পলোকের দেবীর আসনে বসানো হয়েছে, সেই কল্পলোকটিকে ভেঙে দিয়ে, নারীকে নিয়ে আসেন মাটির পৃথিবীতে, মানুষের ভীড়ে। অধিকাংশ বাঙালি কবির দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট হয়েছে, কেবল, নারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর গয়নাগাটির জৌলুশের বর্ণনায়, তাদের নারীরা অনুভবনীয় না, হয়ে উঠেছেন দর্শনীয়, তাদের যা কিছু প্রশংসা করা হয়েছে, তা ওই সবেধন নীলমনি দেহটির কারণেই, তাদের মননের, মেধার, স্বভাবের কোন বিশ্লেষণ বা উপস্থাপন, সেসবের প্রতি আগ্রহ কারো হয় নাই। কিংবা তাদের ক্লেদ, পাপ; তাদের দেবীতুল্য দেহের ভেতরে যে মানুষ তার সহজাত স্খলনের কথা, কেউ বলে নাই। জীবনানন্দের নারীদর্শন আশ্চর্যরকম নির্মোহ। সেখানে নারীকে দেবী করার প্র‍য়াস নাই, তার কাছে নিজেকে জলাঞ্জলি দেয়ার প্রতীতি নাই, বিংশ শতকের নারীবাদে সায় নাই, নারীর প্রতি কুটিল বিদ্বেষেও মতি নাই-এক আশ্চর্য নিরপেক্ষতায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নারীদের তিনি দেখেছেন বাস্তবজগতের একজন, ‘পুরুষ’ না, ‘মানুষ’ হিসেবে। আর তাই, ‘প্রিয়া’, ‘স্বপ্ন-সহচরী’, ‘প্রিয়তমা’ বা ‘দেবী’দের নয়, জীবনানন্দ ভালোবেসেছেন ‘মেয়েমানুষেরে’! ভালোবাসা জীবনের অতলান্তিক সমুদ্রে একবিন্দু জলের মত ঘটনা, প্রেয়সী আরো দশটা মেয়ের মতই মেয়েমানুষ। প্রেমিক তার পুজারী না। জীবনানন্দ অকপটে বলছেন, তিনি ঘৃনাও করেছেন ‘মেয়েমানুষেরে’! কারণ, তারা দেবী নন, তারা মর্ত্যের মানুষ, তারা বিংশ শতকের সমূহ বিনষ্টের চিৎকারকে ধারণ করে। জীবনানন্দ নারীকে আর কী কী বলে ডেকেছেন? ‘মানুষী’, নারীর জন্য মানুষের বিপরীতে এই আশ্চর্য শব্দ প্রথম তিনিই ব্যবহার করেছিলেন। জীবনানন্দের নারী ‘মানসী’ নয়, যার বাস মানসজগতের কল্পরাজ্যে, তার নারী এই মর্ত্যলোকের ‘মানুষী’।
জীবনানন্দের নারী ‘পুজা’ নেয় না। নারী রূপকথার দেশে না, মানুষের ভীড়েই হারিয়ে যায়! ‘তোমার শরীর,/তাই নিয়ে এসেছিলে একবার, তারপর মানুষের ভীড়/তোমারে নিয়াছে কবে টানি!’
জীবনানন্দ জানেন, ধ্রুব অমর প্রেম বলে বিংশ শতকের পৃথিবীতে কিছু নাই, বা, আসলে প্রেম কখনো ধ্রুব নয়, হয় না। প্রেমের ইতিহাসে বেদনাই বিজয়ী। ফলে জীবনানন্দ জানেন, ‘প্রেম শুধু একদিন এক রজনীর’! আর তাই, প্রেমিকার বিট্রেয়াল, তার চলে যাওয়াকে এক দার্শনিক মহিমায় বিশ্লেষণ করে, খুব সহজে গ্রহণ করেন তিনি, মাটির নারীর জন্য কাতর হন না, রবীন্দ্র -নজরুলের মত, এগুলোকে গ্রহণ করেন জীবনের সাবালক স্বাভাবিকতায়, বলেন-‘যেতে হবে বলে/তুমি গেছ চলে/সবাই চলিয়া যায়/সকলের যেতে হয় বলে!’ কেউই আসলে যায় না, যেতে হয়-এই সত্য আজ আমাদের সামনে কত পষ্ট !

রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের নারীপুজা আর কামনার অর্ঘ্যদানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, নারীর দেহরূপের পুজা। নারীর দেহখানা তাদের কবিতায় যত এসেছে, মন তত নয়, যেটুকুওবা এসেছে, তা খণ্ডিত। বিপরীতে দাঁড়িয়ে, জীবনানন্দই খুব শাদামাটাভাবে নারীকে বলেছিলেন, ‘সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।’ যে রূপের জন্য নারীর এত বন্দনা, সেই রূপকে তিনি ‘মৃত’ ঘোষণা করছেন। সুদর্শনাকে বলছেন ‘তোমার মতন এক মহিলা!’ রূপের বর্ণনা যে দেন নাই জীবনানন্দ, তা নয়। তা কেমন তার নারীর রূপ?

‘বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা’ দেহ, ‘কড়ির মতন শাদা মুখ’, হিম হাত, চোখে হিজল কাঠের রক্তিম চিতা, পাশাপাশি সেই আগুনের তলেই ‘শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার’, ‘করুণ শঙখের মত’ স্তন-এরকম প্রেমিকা এ পৃথিবী একবার পায় না শুধু, এ পৃথিবীর একজনই এরকম প্রেমিকার কথা ভাবতে পারেন, তিনি জীবনানন্দ। খেয়াল করার ব্যাপার, রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমিকাদের প্রতি লোকের মুগ্ধ হওয়ার মতন যদি কিছু থাকে, তা হলো তাদের দৈহিক রুপ, তাদের দেবীর মত মহিমা। অথচ জীবনানন্দের ‘নারী’-র প্রেমিকা নয়। তার রূপ রহস্যময়, এই বর্ণনা থেকে খুব সুদর্শন কোন নারীর ধারণা আমরা পাই না, কেবল অস্পষ্ট, রহস্যময় একটি নারী অস্তিত্বের ধারণা পাই।

বাঙলা কবিতার পাঠককে নারীর দেহপুজা থেকে কীভাবে তার মনের রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন জীবনানন্দ, বাঙালি নারীদের কীভাবে গয়নাগাটি আর ফর্শা ফর্শা মুখশ্রী ছাড়াই অপরূপ করে তুলছেন জীবনানন্দ। তিনি মননশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, টের পাওয়া যাচ্ছে কী? আশ্চর্য হলো, স্তনের মত সেন্সুয়াল অঙ্গটির উল্লেখ করেও জীবনানন্দ পাঠককে নারীর শরীরের প্রতি কামোন্মত্ত হতে দেন না, ‘করুণ শঙখের মত’ উপমার পরে, স্তন দুধে আর্দ্র হোক বা না হোক, বোধের অতলান্ত থেকে নারীদেহের প্রতি সস্তা ক্ষুধা জাগে না অন্তত। জীবনানন্দ স্তনের উপমায় ব্যবহার করেছেন আরো বিপন্ন বিস্ময়কর উপমা, ‘সেই জলমেয়েদের স্তন/ঠাণ্ডা, শাদা বরফের কুচির মতন!’ অশ্লীলতা-শ্লীলতার প্রশ্ন না, সেসব ভেবে কবিতা লেখা জীবনানন্দের ধাতে ছিলও না। কিন্তু নারীকে দেহের উর্ধ্বে এক মননশীল জায়গায় তুলে ধরতে তার এই প্রয়াস, বিমুগ্ধচিত্তে প্রশংসার্হ!

নারীকে জীবনানন্দ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাউকে মানুষ বানাতে গেলে, তাকে শয়তান বা জন্তুর বা ভোগ্যপণ্যের পর্যায় থেকে উঠিয়ে আনা যেমন জরুরি, তেমনি এঞ্জেল, হুর, দেবী বা ঈশ্বরীর জায়গা থেকে নামিয়ে আনাও জরুরি। সে কাজটিও করেছেন জীবনানন্দ। উপন্যাসে ও গল্পে তো করেছেনই, সেদিকে যাব না। পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো সুন্দরীদের কানে জ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, মানুশের অর্জন, কবিতা-এসব অমূল্য জিনিষের কথা বলে যে লাভ নাই, ওনারা যে সেগুলো বোঝেন না, সেকথা তিনিই প্রথম বলেছেন। সুন্দরীদের তিনি বলেছেন ‘মূর্খ’, ‘সোনার পিত্তলমূর্তি’! অনেকে ভাবতে পারেন, প্রেমের ব্যর্থতা থেকে এই কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জীবনানন্দ প্রেমিক হিসেবে এ যুগের অনেক রোমিওর চেয়ে সফল ছিলেন। কাজিনকে বিয়ে করা হিন্দুধর্মে নিষেধ, সেই বোনকে বদ্ধ ঘরে চুমু দিয়েছেন, তার সাথে ওরাল সেক্স করেছেন। তার সাহস ছিল বলতে হবে! এবং, একদিন নয়, অনেকদিন! ফলে, প্রেমে ব্যর্থতা তার থাকলেও, ‘প্রাপ্তি’ যে কিছু ছিল না, তা নয়! যাহোক, নারীকে তিনি ঘৃনাও করেছেন, সেকথাও আমরা তার ‘বোধ’ কবিতায় দেখি। ‘পরী নয়, মানুষও সে হয়নি এখনো’-নারী তার যোগ্য মর্যাদা পায়নি, ঠিক, তবে সে পরী নয়, আর পরী করা রাখলে যোগ্য মর্যাদা সে পাবেও না, একথা জীবনানন্দ ছাড়া কে বলতে পারতেন! নারীর ভেতরের পাপ, পতন, ক্লেদ, স্খলন, তার সৌন্দর্যের অনিত্যতা বারবার উঠে এসেছে তার লেখায়। নারীকে মানুষ হিশেবে পেতে হলে, আগে ‘পরী’র ধারণা ভাঙা জরুরি, এই বোধ জীবনানন্দের স্বোপার্জিত।
জীবনানন্দের কবিতায় নারীচরিত্রের মহত্তম প্রতিনিধি যিনি, বনলতা সেন, তিনিও রবিঠাকুরের পূর্বজন্মের প্রিয়ার মত ‘মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে/কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে’টাইপ সাজসজ্জায় অতিশয় নিমজ্জিত কোন নারী, কিংবা নজরুলের ‘তোমারে বন্দনা করি, স্বপ্ন-সহচরী/ লো আমার অনাগত প্রিয়া’-র মত দেবীটাইপ কেউ নন। জীবনানন্দ নাম ধরে ডেকেছেন, বনলতা সেন, ‘প্রিয়া’, ‘দেবী’, ‘প্রিয়তমা’, ‘আফ্রোদিতি’টাইপ কিছু বলেন নাই। এই যে নাম ধরে ডাকা, এর মধ্যে আছে নারীকে বাস্তবপৃথিবীর এক পুরুষ বা মানুশের চোখে দেখার ইঙ্গিত। ‘প্রিয়া’ বললে কেবল প্রেমের, অধিকারের সম্পর্ক তৈরি হয়, স্বাভাবিক মনুষ্যপরিচয় তৈরি হয় না। বনলতা সেনকে জীবনানন্দ সেই পরিচয় দিয়েছেন, যেকারণে, রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতার প্রিয়াদের কেউ চেনে না, অথচ বনলতা আজ জীবনানন্দের চেয়েও বিখ্যাত! জীবনানন্দ তার কবিতায় প্রায় সব নারীকেই নাম ধরে ডেকেছেন-বনলতা, শ্যামলী, মৃণালিনী ঘোষাল, অরুনিমা স্যানাল- এই নামগুলো নারীকে যে বাস্তবতায় তুলে ধরেছেন ।

রবিঠাকুরের প্রেমিকার মত ভারী ভারী গয়নায় সাজিয়ে, তার নিজের চে ওই গয়নার বর্ণনায় দশলাইন বেশি খরচ করেন নাই, নজরুলের মত না-পাওয়ার বেদনায় ভক্তের মত পুজার ভেট হাতে পড়েও থাকেন নাই জীবনানন্দ। তিন প্যারার কবিতার একটিমাত্র প্যারায় রূপের বর্ণনা এসেছে, তাও মাত্র তিনটি অঙ্গের। গয়নাগাটির বালাই নাই। তাও সে কেমন রূপ? বনলতার চুল ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন নগরীর রাতের অন্ধকারের মত, মুখও ইতিহাসের পাতায় জেগে থাকা বিখ্যাত এক শহরের স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। বনলতার আর একটি মাত্র অঙ্গের বর্ণনা জীবনানন্দ দেন, চোখ। পাখির নীড়ের মত। এসব উপমায় খুব সুশ্রী কোন নারীর চেহারা ভাসে না। নারীকে সুশ্রী দেখানোই যেখানে কবিদের যাবতীয় উপমার আরাধ্য ছিল, জীবনানন্দ সেখানে, নারীর সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করলেন ইতিহাসচেতনা আর বোধের সমান্তরালে! এর মাধ্যমে নারীও কি কোন মেসেজ পেতে পারে না? যারা তাদের দেহবন্দনায় মেতে তাদের চোখকে অন্ধ করে রেখেছে ইতিহাস, দর্শন, শিল্প, রাজনীতি-পৃথিবীর যাবতীয় মহৎ বিষয় থেকে, তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নারীদের ইতিহাসের সমান্তরালে উপস্থাপন, এ যে তাদেরকে প্রচ্ছন্নভাবে ইতিহাসের উত্তরাধিকার গ্রহনের আহ্বান, ভাবতে খুব কি দোষ!

জীবনানন্দের কবিতা পড়ে অনেক মূর্খ নারীবাদী কিংবা টিপিকাল বাঙালি মূর্খতাপ্রিয় নারী কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু, ‘পরী নয়, মানুষও সে হয়নি এখনো’- বলে শিল্পসাহিত্যে নারীকে যে পূর্ণ মানবিক প্রতীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনানন্দ, তাতে নারীর প্রতি পুরুষের গত শতাব্দীর মেকি দরদের স্বরুপ ধরা পড়ে গেছে, ধরা পড়ে গেছে পুঁজির যুগে নারীকে পণ্য বানানোর পেছনে এইসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক মদদও! আর অন্যদিকে, সাহিত্যের নারী বাস্তবের নারীর কাছাকাছি যেতে পেরেছে। ফলে বলা যায়, আমাদের সাহিত্যে, রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমকাতরতামূলক পদ্যের বিপরীতে, জীবনানন্দের কবিতাই প্রেম ও নারী বিষয়ক সবচেয়ে বাস্তব ও মানবিক কবিতা।