গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য
Posted in গল্পকে? কে ওখানে?
হাল্কা সুতির পর্দার ওপারে কার যেন অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রামেসিস একটু খাড়া হয়ে উঠে বসল।
কে?…তিয়ে! তিয়ে তুমি এসেছ? সত্যি? দূরে দাঁড়িয়ে কেন? আমার কাছে এস।
বয়সের সাথে বোধহয় মানুষের বুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে যায়। নাহলে রামেসিস কখনও তিয়ের গায়ের সুগন্ধি চিনতে না পারে!
কি হল তিয়ে, কাছে আসবে না?
তিয়ে যেন একটু ইতস্তত করছে। তারপর ধীরে ধীরে পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল। যেন নববধূটি।
রামেসিস নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আজও তিয়ের রূপ তাকে পাগল করে দেয়। সেই কাজলটানা মদির চোখ, পাটে বসা সূর্যের চেয়েও লাল ঠোঁট, গোলকধাঁধার মতো রহস্যময় হাসি...
কি এক দুঃখ হঠাৎ তীর হয়ে তার বুকে বিঁধে যায়।
তুমি আর আমার কাছে আস না কেন, তিয়ে?
তিয়ে ধীরে ধীরে রামেসিসের কাছে এসে দাঁড়াল। আবার সেই রহস্যের চেয়েও গভীর হাসি – যা সহজ উত্তরকেও গোলমাল পাকিয়ে দেয়।
“তুমি জান না কেন আসি না?”
রামেসিস তিয়ের হাত দুটো টেনে একেবারে নিজের কোলের কাছে বসিয়ে নিল।
“জান তিয়ে, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম পদ্মপুকুরের ধারে…পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তোমার মুখের ওপর, সন্ধের হাওয়া তোমার চুলের সুগন্ধ সারা বাগানে ছড়িয়ে দিয়েছিল...আমার মনে হয়েছিল তোমার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কেউ নেই!”
তিয়ের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল।
“সত্যি? আমি এত সুন্দর? কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তো আইসিস আর তিয়িতির নাম লেখা হবে বলে শুনছি।”
রামেসিস তিয়েকে নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। ইয়ামোসে যেমন করে হাতে সাপ জড়িয়ে খেলা দেখায়।
“তুমি সাধারণ গৃহবধূ নও তিয়ে। তুমি রাজার স্ত্রী। এইসব কথা কি তোমার মুখে মানায়? আইসিসকে আমার বিয়ে করতে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। আর তিয়িতি আমার বোন, তাকে তো স্বীকৃতি দিতেই হবে। সেসব তো প্রেমের বিয়ে নয়, তুমি সেকথা ভালোভাবেই জান।”
“তোমার অন্তঃপুরে কি শুধু আমরা তিনজনেই আছি?”
রামেসিস হেসে ফেলে। আজও মেয়েটার ছেলেমানুষী গেল না।
“আরো অনেকে আছে। কিন্তু তুমি আমার নেফারতারি। নেফারতারি তার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিল, জান তো? আমিও তোমার চোখে চাঁদ সূর্য উঠতে দেখি!”
তিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাল।
“কই, নেফারতারির মতো আমার কোন মন্দির তো এখানে দেখছি না। আমাকে দেবী হাথরের প্রতিমূর্তি বলে আঁকা কোন ছবিও দেখছি না।”
“যার নামে আমার নামকরণ হয়েছিল, সেই রামেসিসও কি নিজের রাজধানীতে নেফারতারিকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছিলেন? তাই তো মরুভূমি পেরিয়ে অতদূর যেতে হয়েছিল মন্দির বানানোর জন্য।”
তিয়ির চোখে ছায়া নেমে আসে।
“আমাদের ছেলেও তো শুনলাম রাজা হবে না।”
রামেসিসের হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আসে।
“নিয়ম অনুযায়ী আমার বড় ছেলেই রাজা হবে। এ নিয়ে তুমি আর জেদ ক'র না।”
“বড় ছেলে, তাই রাজা হবে, না তিয়িতির ছেলে তাই রাজা হবে?”
“এসব ঈর্ষা মনে পুষে রেখে তুমি কি পাচ্ছ, তিয়ে? দিন দিন তোমার আর আমার মধ্যের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। পেন্তাওয়ারেতকে আমিও ভালোবাসি। সে আমারও ছেলে। কিন্তু ঐতিহ্য আর যোগ্যতা, দু'দিক থেকেই এই রাজ্য রামেসিসকেই যুবরাজ বলে দাবি করছে।”
তিয়ে রামেসিসের হাতের ওপর আঙুল বোলায়।
“তোমার আর আমার মধ্যের সব সমস্যা ওই সিংহাসনকে ঘিরে। তুমি আমার ছেলেকে যুবরাজ ঘোষণা করে দাও, আমি আবার আগের মতো তোমার কাছে ফিরে আসব। তুমি চাও না, আমি আবার আসি?”
“চাই…খুব চাই…”
কিন্তু…
“তুমি জান না তুমি কি চাইছ, তিয়ে। সিংহাসন চেয়ে তুমি পেন্তাওয়ারেতের জন্যে সুখের চাবিকাঠি কিনছ না।”
আমি রাজ্য অধিকার করে নিয়েছি, কিন্তু তোমাকে সুখের চাবিকাঠি দিয়ে যেতে পারব না...
হঠাৎ করে তিয়ের মুখটা পালটে গিয়ে বাবার মুখ হয়ে যায়। কিভাবে তা সম্ভব হল তা নিয়ে রামেসিস প্রশ্ন করে না। বরং ভাবে, কতদিন বাবাকে দেখেনি! তিরিশ বছরের ওপর তো বটেই।
“চারিদিকে শত্রুরা থাবা মেরে বসে আছে। রাজ্যের মানুষ যুদ্ধে যুদ্ধে জর্জরিত। বাড়িঘর ছেড়ে সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে। এই সময়টা সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার পক্ষে প্রশস্ত, সিংহাসন ধরে রাখার পক্ষে নয়। পারবে তুমি, নিজের পুরুষকার দিয়ে পরিস্থিতির গতি বদলে দিতে?”
“পেরেছি।”
নিজের গলা শুনে রামেসিসের কেমন অসঙ্গতি বোধ হয়। তারপর বুঝতে পারে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় এই কথাগুলো বলেছিল তখন তা শুনেছিল তরুণ রামেসিস। আজ বর্ষিয়ান রামেসিস তার জবাব দিচ্ছে – যার যুদ্ধ জেতা বলিষ্ঠ হাত এখন কুঁচকে গেছে, দাড়িতে পাক ধরেছে, পেটের ডানদিকে চিনচিনে ব্যথা। রাজবৈদ্য গোপনে জানিয়েছে, রাজার দিন এখন হাতে গোনা মাত্র।
সেতনাখতে সামনে রাখা মদের পাত্র তুলে নিলেন। ঈষৎ ভুরু নাচিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বটে? পেরেছ? তা কিভাবে পারলে?”
রামেসিস সামান্য ঝুঁকে বসল। এটা বাবার মৃত্যুশয্যা নয়। বরং দু'জন রাজা মুখোমুখি দুটো আরামকেদারায় বসে আছে, শুধুই খোশগল্প হচ্ছে।
“তুমি মারা যাওয়ার পরে রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল।”
সেতনাখতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
“রাজ্য দখল করেছিলাম শুধু। শাসন করার সময় পাইনি।”
“সেই জন্যই তো প্রথম কিছু বছর যুদ্ধ, বাণিজ্য, সবকিছু মুলতবি রেখে রাজ্যে ঐক্য আনার আর সেনাকে মজবুত করার কাজে লেগে পড়ি। পাঁচ বছর বাদে যখন লিবিয়ার শত্রুরা আক্রমণ করে, আমাদের সেনা তখন প্রস্তুত। সহজেই তাদের হারিয়ে দেয়। সেখান থেকে শুরু।”
সেতনাখতের মুখে কৌতুক ঝিলিক দিল।
“ওহো! লিবিয়ার ওরা আবার হেরে বাড়ি গেল বুঝি? জান নিশ্চয়ই, রাজা মারনেপ্টাহের সময়েও একই ব্যাপার হয়েছিল।”
রামেসিসের সামনেও ভেল্কির মতো মদের পাত্র এসে গেছে। সে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল।
“সে তো কিছুই না। আসল বিপদ ঘটল যখন সমুদ্র মানবরা আক্রমণ করল।”
“সমুদ্র মানব? কারা তারা?”
“পেলেসেত, দেনিয়েন, শারদানা, মেশোয়েশ – অসভ্য বর্বর জাতি সব। শুনেছি অনেক বড় বড় সভ্যতাকে নষ্ট করতে করতেই আসছিল। রাজ্যে এসে প্রথমে তারা স্থলপথে আক্রমণ করেছিল। জাহির যুদ্ধে তাদের হারিয়ে দিই। তখন তারা জলপথে আক্রমণ করে।”
“সেকি! আমাদের নৌবাহিনী তো খুবই দুর্বল! তুমি কি তাদেরও মজবুত করেছ?”
রামেসিস মাথা নেড়ে 'না' বলল।
“সেই সুযোগ পাই নি। আক্রমণের কথা জানতে পেরেই রাজ্যের সব জাহাজকে হুকুম দিলাম নীলনদের মোহনার মুখে চলে যেতে। সেনা না পৌঁছনো অবধি কেউ যেন জায়গা থেকে না নড়ে। জাহাজের পেছনে তীরন্দাজদের দাঁড় করিয়ে দিলাম। শত্রুর জাহাজ আসামাত্র তীরন্দাজরা নির্মম আক্রমণ শুরু করল। শত্রুপক্ষ তীরের জবাব দিতে ব্যস্ত এমন সময়ে আমাদের নৌসেনা ওদের জাহাজে উঠে পড়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করে দিল। ওরা পালানোর পথ পেল না।”
“সাবাশ! এতো ঐতিহাসিক বিজয়!”
রামেসিস মনে মনে সম্মতি জানায়। আবার মদে চুমুক দেয়।
“লিবিয়ার নির্লজ্জগুলো আরেকবার আক্রমণ করেছিল, আবার গোহারান হেরে ফেরত গেছে। তারপর থেকে সীমান্ত সুরক্ষিতই রয়েছে।”
সেতনাখতে নাকের ডগাটা চুলকে নিলেন। রামেসিসের মনে পড়ল, কোন অপ্রিয় প্রসঙ্গ তোলার আগে এটা করা বাবার অভ্যেস ছিল।
“তা, রাজ্যের লোকজন এসব ঘটনার ব্যাপারে কি মনে করে?”
“যুদ্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই ভাণ্ডারে টান পড়ে। সবাই তাই নিয়ে খুশী হয় না। বিশেষ করে যুদ্ধ যখন নিজের সীমান্তে হয় তখন ক্ষয়ক্ষতির আকড় লুকিয়ে রাখা একটু মুশকিল হয়ে যায়। তার ওপর ভালো শস্য না হওয়ার দরুন সেত মা'আত হের ইমেনতি ওয়াসেতের কবর খননকারী আর চিত্রশিল্পীদের মাইনে আর খাবার পৌঁছাতে কিছু দেরি হয়েছিল।”
“তাই নিয়ে তারা বিদ্রোহ শুরু করে?”
“বিদ্রোহ ঠিক নয়, কর্মবিরতি বলতে পার। মন্দিরের সামনে ধর্না দিয়েছিল বলে শুনেছি।”
“কর্মবিরতি? ধর্না? এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি!”
“সব খবর আমার কানেও আসেনি। আমার মন্ত্রীরাই সামলে নিয়েছে।”
“এখন পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে?”
রামেসিস আরামকেদারায় হেলে বসল।
“সমস্যা এখনো চলছে। কিন্তু পুন্তের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছি। তিমনার খনি থেকে প্রচুর পরিমাণ তামা আনিয়েছি। সাইনাই থেকে দামী পাথর এসেছে।”
“আর মন্দির? নতুন স্থাপত্য কিছু বানিয়েছ?”
“আমার জন্য 'তৃতীয় রামেসিসের কোটি বছরের আবাসন, চিরকালের জন্য আমুন ভগবানের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত' বানিয়েছি। তাছাড়া রাজ্যের অনেক মন্দিরে জমি দান করেছি, সোনার মূর্তি বসিয়েছি।”
“তার মানে আমি রাজ্যকে যে অবস্থায় রেখে গেছিলাম তুমি তার আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছ। তোমার ছেলের জন্য সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি রেখে যাচ্ছ, যা আমি তোমার জন্য করে যেতে পারিনি।”
রামেসিস গালের ওপর হাত বুলিয়ে নিল।
“জানিনা, বাবা। রামেসিস বার বছর বয়স থেকেই যুবরাজ হয়েছে। অনেক কাজ শিখেও উঠেছে। কিন্তু রাজা হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। মোটে একুশ বছর বয়স ছেলেটার। ও কি পারবে সামলাতে?”
“আলবাত পারবে!” সেতনাখতে হাঁটুতে চাপড় মেরে বলেন। “একুশ বছর বয়সে জানার আগ্রহ থাকে, শেখার আগ্রহ থাকে। রাজার ভূমিকা পালন করতে করতে অভিজ্ঞতা আপনেই এসে যাবে। কিন্তু তুমি…”
দেখতে দেখতে সেতনাখতের মুখ এক দিব্য আভায় ভরে উঠল।
“তুমি যেভাবে আমার বংশে গরিমা এনেছ, যেভাবে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছ, তার জন্য ইতিহাস তোমাকে চিরকাল মনে রাখবে। আমার আশির্বাদ আর মা'আতের কৃপায় তুমি অনন্তকাল আমুনের রাজ্যে বাস কর।”
“সত্যি? সত্যি বলছ?”
কিন্তু সেতনাখতে ততক্ষণে মিলিয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় রাখা আছে তুলাদণ্ড। তার একদিকে মা'আতের পালক। অন্যদিক ফাঁকা। রামেসিসের হৃৎপিণ্ড সেখানে রেখে যাচাই করা হবে। সামনে আনুবিস দাঁড়িয়ে৷ আর কিছু দূরে হোরাস।
এ তো শেষের বিচার…
“রামেসিস,” আনুবিস গম্ভীর গলায় ডাক দেন, “তুমি কি পেরেছ রাজা হিসেবে সফল হতে? মা'আতকে ধরে রাখতে পেরেছ? তুমি দেশের রাজা – অন্য সব পরিচয়ের থেকে এটাই কি তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হয়েছে?”
রামেসিস ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে। চোখের সামনে এক এক করে ছবি ভাসতে থাকে – সমুদ্র মানবদের বিরুদ্ধে লড়াই, লিবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই, রামেসিসকে যুবরাজ ঘোষণা করা, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা, মন্দির বানানো…
তারপর হঠাৎ করে সব মুছে গিয়ে তিয়ের মুখটা ভেসে ওঠে।
“তোমার বাবার প্রশংসার এখানে কোন জায়গা নেই,” আনুবিস কঠোর স্বরে বলে চলেন, “তোমার নিজের হৃদয়কে যাচাই করে দেখ, তুলাদণ্ডে ফেললে তার কি পরিণতি হবে।”
রামেসিস তিয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পলক।
প্রিয়তমা স্ত্রী তিয়ে…আমার নেফারতারি…
কিন্তু…
রামেসিস আর তিয়ের মধ্যে যোজনব্যাপী দূরত্ব তৈরী করা সেই 'কিন্তু'…
আমাকে ক্ষমা কর তিয়ে, শুধু তোমার স্বামী হয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে যতই ভালোবাসি না কেন, রাজার কর্তব্যকে অবহেলা করে তোমার অন্যায় আবদার মানতে পারব না।
“এটাই কি তোমার সিদ্ধান্ত?” আনুবিস প্রশ্ন করেন।
“…হ্যাঁ…”
পর্দার আড়ালে টুংটাং আওয়াজ ওঠে। ঘরের মধ্যে পদ্মের সুগন্ধ ফেলে রেখে তিয়ের অবয়ব মিলিয়ে যায়। শুধু তেরচা করে আসা চাঁদের আলো রামেসিসের বন্ধ চোখের ওপর আলতো করে আঙুল বোলায়।
রাত আরো গভীর হলে ধারাল অস্ত্র হাতে আততায়ীর দল রাজার ঘরে ঢুকে আসে। রাজা তখন আরামের বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে। মুখে প্রশান্তির হাসি।
****
সেদিন সন্ধেবেলায় গুপ্তচর এসেছিল। রামেসিস তখন রাজ্যের করব্যবস্থা দেখতে মগ্ন। গুপ্তচরকে দেখে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কি সংবাদ?
গুপ্তচর কয়েক পা এগিয়ে এল। গলা নীচু করে বলল,
“সংবাদ ভালো নয়, মহারাজ। রানী তিয়ে তাঁর ছেলে রাজপুত্র পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য চক্রান্ত করছেন। রাজপ্রাসাদেরই কয়েকজন সদস্য চক্রান্তের মধ্যে আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।”
“কেমন চক্রান্ত?”
গুপ্তচর গলা আরো নামিয়ে আনল।
“মহারাজের প্রাণ সংশয় হতে পারে।”
“কবে?”
“সে খবর এখনো পাইনি। সম্ভবত কিছু ঠিক হয়নি এখনো।”
“বুঝলাম।”
রামেসিস চোখ বন্ধ করে বসে রইল।
তিয়ে? শেষটায় তিয়ে আমাকে মারতে চায়?
সেটা অবশ্য বিষ্ময়কর নয়। খুব ঈর্ষা, খুব অভিমান তার। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও খুব। নিজেই কতবার বলেছে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার কথা। রামেসিস প্রত্যেকবার হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু… এবার তো মহা ফ্যাসাদ হল।
“ইহজগতের দুঃখ আর আপনাকে বেশীদিন ভোগ করতে হবে না।”
রাজবৈদ্যের বলা কথাগুলো রামেসিসের কানে বাজতে থাকে।
কারা চায় না আমার পরে রামেসিস রাজা হয়? যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে রাজভাণ্ডার খালি হয়ে যাচ্ছে বলে যারা অনুযোগ করছে তারা? নাকি তাদের অন্য কোন দাবি আছে? তাদের বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হওয়ার আগেই যদি আমার দিন ফুরিয়ে যায়?
তাহলে আমার মৃত্যুর পরে গৃহবিবাদ লেগে যাবে। রামেসিসের বিরুদ্ধে পেন্তাওয়ারেতকে সদস্য খাড়া করে চক্রান্ত চলতে থাকবে। আমার অন্য ছেলেরাও সুযোগ বুঝে দাঁও মারার চেষ্টা করবে। রামেসিসের মাত্র একুশ বছর বয়স। এই বয়সে রাজার দায়িত্ব বুঝে নিতেই ওর সময় চলে যাবে। তার ওপর গৃহবিবাদ সামলানো ওর দ্বারা সম্ভব হবে না। আর এসব খবর বাইরে গেলে শেয়াল কুকুরের দলের থাবা মারতে ছুটে আসতে সময় লাগবে না। আমার সারা জীবনের চেষ্টায় রাজ্যে যে শান্তি, যে সুরক্ষা এনেছি, এক মূহুর্তে তা নষ্ট হয়ে যাবে।
টুকরো টুকরো ছবি পরপর বসে গালিচা বনে যায়। রামেসিসের মাথায় সমাধানটা স্পষ্ট হয়।
নাঃ, আমাকে তিয়ের চক্রান্তেই মরতে হবে। আর তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতকে আমার সঙ্গে মরতে হবে। রাজদ্রোহের দায়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। গুপ্তচরের খবর এতক্ষণে রামেসিসের কাছেও পৌঁছে গেছে। কাল আমার মৃতদেহ পাওয়া গেলে রামেসিস অনুসন্ধান শুরু করতে পারবে। উত্তরাধিকারের লড়াই তখন খুনের মামলায় রূপান্তরিত হবে। চক্রান্তকারীরা হয়ে যাবে রাজদ্রোহী। তবেই রামেসিসের হাতে সুরক্ষিত রাজ্য তুলে দিতে পারব। আমার পূর্বপুরুষদের কাছে মুখ দেখাতে পারব। বলতে পারব, নিজের পুরুষকার দিয়ে ভাগ্যের প্রতিকুলতাকে জয় করতে পেরেছি।
রামেসিস যখন চোখ খুলল ঘর তখন খালি। গুপ্তচর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে প্রধান পরিচারক পেবেক্কামেনকে ডেকে পাঠাল।
তিয়ে যদি সত্যিই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে থাকে, তাহলে আমার প্রধান পরিচারককে দলে না নিয়ে তার উপায় নেই। একটা হিসেবের খেলা খেলে দেখি, কি হয়।
“মহারাজ ডেকেছেন?” মার্জিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে পেবেক্কামেন মাথা নোয়াল।
“হ্যাঁ। আজ আমার রাতের খাবারের পরে তুমি মদের ব্যবস্থা করবে।”
“যথা আজ্ঞা।”
“সে মদ যেন এমন হয় যে হাজার ডাকাডাকিতেও আমার সারারাত ঘুম না ভাঙে।”
মূহুর্তের জন্যে পরিচারকের মুখের অভিব্যক্তি কি পালটে গেল, না তা শুধুই রাজার কল্পনা?
“অবশ্যই, মহারাজ।”
“যাও, প্রস্তুতি শুরু কর।”
পেবেক্কামেন চলে গেলে রাজা মিটিমিটি হাসে। সুখের চাবিকাঠি পরপারের সম্পত্তি। এই পৃথিবী শুধুই দুঃখ ভোগ করার জন্য। একদিন চলে যেতে হবে সবাইকেই।
কিন্তু রাজার চাল চেলে যাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয় ক'জনের?
· হারেম চক্রান্ত : প্রাচীন মিশরের রাজা তৃতীয় রামেসিসের স্ত্রী তিয়ে এবং রাজার হারেম এবং প্রাসাদের কিছু সদস্য মিলে রাজাকে হত্যা করেন, তিয়ের ছেলে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য। কিন্তু চক্রান্তকারীরা ধরা পড়ে যান, এবং অধিকাংশই মৃত্যুদণ্ড পান। তৃতীয় রামেসিসের হত্যার পর তাঁর ছেলে চতুর্থ রামেসিসই রাজা হন।
0 comments: