ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৫
ওরা কোনো কথা শোনে না। হাসতে থাকে সবাই। একসঙ্গে অন্তত গোটাদশেক হাত বের্শেনকে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে। বসার ঘরে যেখানে টেলিফোন আছে, সেখানে সবাই মিলে ওকে নিয়ে যায়। সেখানে গের্ট একটা চওড়া চামড়া দিয়ে মোড়া আরামকেদারাতে বসে টেলিফোনে ডায়াল করছে। গের্ট বের্শেনকে নিজের হাঁটুর উপরে বসিয়ে হাতে টেলিফোনের রিসিভার ধরিয়ে দেয়।
‘হ্যালো’… বের্শেন কণ্ঠ থেকে বিরক্তির ছাপ এখনও মুছে ফেলতে পারেনি… ‘আমি কি ফ্রয়লাইন ইনেসের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
কেউ একজন ওপাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কে কথা বলছেন ফোনে?’
‘বের্নহার্ড’ বলে কয়েকমুহূর্ত পরে বের্নহার্ডের খেয়াল হয় যে তার একটা ডাকনাম আছে এবং ইনেস তাকে সেই নামেই ডাকে। ইনেস তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে ঠিকঠাক আছে কি না।
-‘না’ বলে বের্শেন, ‘কিন্তু তোমার আজ আসা উচিত ছিল একবার। সবাই ভেবেছিল তুমি আসবে। গের্ট, ফার্দিনান্দ… ‘
-‘কিন্তু তাতে তোমার কী, বের্শেন?’ ইনেসের কণ্ঠস্বরে শীতলতা, বন্ধুত্বের উষ্ণতা একটু কম মনে হয়।
-‘আ… আমি জানি না, জানি না’ বের্শেন তুতলে যায়… ‘আমি… আমরা ফেয়ারওয়েল পার্টি করছি।’
-‘আচ্ছা, বুঝলাম। সেইজন্য সবাই মাতাল হয়ে গেছে! কিন্তু বের্শেন, তুমিও?’
বের্শেন থমকে যায়….
-‘আরে… কথা তো বলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ বাকিরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বের্শেনের হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইনেস লাইন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। সমস্বরে চিৎকার এবং এরকম অদ্ভুত অভিযোগ সে একেবারে পছন্দ করে না।
কিন্তু ফার্দিনান্দকে থামানো যাচ্ছে না। সে বসবার ঘরের সিঁড়ি দিয়ে সমানে ওঠানামা করছে। তার মুখটা সাঙ্ঘাতিক ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বড় বড় চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
‘একবার, অন্তত একবার কি সে আসতে পারত না আমায় বিদায় জানাবার জন্য?’ বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে ফার্দিনান্দ বলে যায়… ‘তোমাদের কি মনে হয় না যে তার আসা উচিত ছিল?’ ঘরের সিলিঙের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে অভিযোগ জানাবার ভঙ্গিতে সে বলে আর পায়চারি করে।
ছেলেরা প্রায় কেউই খেয়াল করেনি কখন দরজার বেল বেজেছে। হঠাৎ লুডভিগ তাড়াতাড়ি নিচে দৌড়ে গেল আর সবাই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে উঠবার আগেই দেখল যে ইনেস এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। ফার্দিনান্দের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। ফার্দিনান্দের দৃষ্টি একদম শূন্য।
‘শুভ সন্ধ্যা, ভদ্রমহোদয়গণ!’ ইনেস বলে… ‘শুভ সন্ধ্যা ফার্দিনান্দ! কিন্তু আপনার কী হয়েছে? আপনাকে অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে।’
ফার্দিনান্দ হঠাৎ হেসে উঠল। তার কাঠখোট্টা মুখটা একেবারে বদলে গেল এই হাসিতে। দেখে মনে হল বেদনাদায়ক অন্ধকার রাত অতিক্রম করে হঠাৎ এক আলোকোজ্জ্বল ভোরের সময়ে কেউ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। সে অনেকক্ষণ ধরে ইনেসের দিকে তাকিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এক অসুস্থ মানুষের দিকে লক্ষ্য রাখার মত করে বাকিরা দূর থেকে একদৃষ্টে তার দিকে নজর রাখে…
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টির সন্ধ্যাতেই বের্নহার্ডের বাবা হঠাৎ করেই আগেভাগে কিছু না জানিয়ে শহরে এসে উপস্থিত হন এবং ছেলেকে বাড়িতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান। যদিও বের্নহার্ডের বিষয়ে ঠাকুমা সবসময় ভাল ভাল কথাই বলে থাকেন, তবুও ক’দিন ধরেই তার বাবার মনে বেশ কিছু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। তাঁর মনে এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে বের্নহার্ড যথেষ্ট পরিশ্রমী ছাত্র। কারণ স্কুল এবং সঙ্গীতশিক্ষালয়, এই দুই জায়গা থেকেই ভাল ফল করছে সে বরাবর। কিন্তু অল্পসংখ্যক যে পরিবারগুলির সঙ্গে বের্নহার্ডকে মেলামেশা করতে বলা হয়েছিল, সে তাদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না। শুধু স্কুলের বন্ধু কার্লের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে তার। সাধারণভাবে সবাই তার সম্বন্ধে বলছে যে ‘আকর্ষণীয় এবং আদবকায়দাদুরস্ত ছেলে’; কিন্তু কেউই তাকে বেশি দেখতে পায় না। এলাকার সম্মানীয় মানুষজন, সরকারি অফিসার, যাদের বেশ ভাল পরিবার আছে, বের্নহার্ডের বয়সী বাচ্চাকাচ্চা আছে, তাদের কারো সঙ্গে বের্শেন মেশে না। তাছাড়াও সন্ধেবেলায় তাকে বলা হয়েছিল নাচের স্কুলে ভর্তি হবার জন্য। সে বলেছিল যে তার নাকি সময় নেই। সে কথা যে ডাহা মিথ্যে, সেটাও পরিষ্কার।
বের্নহার্ডের ঠাকুমা অবশ্য তার পক্ষেই দাঁড়ালেন এবং বললেন যে বের্নহার্ড মিথ্যে কথা বলেনি। সাধারণত প্রতিদিন সে রাত এগারটা অবধি খাটে। সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে বেরয়, যদি কোথাও বাজনার অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করল যে এর বেশি আর ঠাকুমা কিছুই বললেন না। উল্টে তার বন্ধুদের সম্বন্ধে বেশ আপত্তিজনক কথা বলতে লাগলেন, বিশেষত গের্ট আর ইনেস সম্বন্ধে। কারণ, বের্নহার্ডের বাবা তাদের সম্বন্ধেই জানতে চাইছিলেন। পরিষ্কার বললেন ঠাকুমা যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার তার মাথায় ঢোকে না বিশেষ। বের্শেন এই বন্ধুদের পছন্দ করে, করতেই পারে; এদের সঙ্গে লং ড্রাইভে যায়, সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এদের তিনি ঠিকঠাক বোঝেন না। ঠাকুমা নিজেও অল্পবয়সে খুব ভাল পিয়ানো বাজাতেন। তার প্রতিভাও ছিল। বের্শেন যখন বাজায়, তার ভারি ভাল লাগে। বের্শেনকে তিনি ভালবাসেন, এটাও ঠিক। বের্শেন যথেষ্ট প্রতিভাশালী। কিন্তু বের্শেনকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। তাঁর অন্যান্য নাতিনাতনিদের থেকে বের্শেন অনেকখানি আলাদা স্বভাবের। তাঁর নাতিনাতনিদের মধ্যে অনেকেই বের্শেনের থেকে বয়সে বড়; অনেকেরই বেশ ভাল শিক্ষাদীক্ষা, অনেকেই যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী ( এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বের্শেনের দিকে তাকিয়ে তাঁর একথা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে)। কিন্তু কেউই বের্শেনের মত স্বাধীনচেতা নয়। জীবনে কী করতে চায়, সেসব ভাবনার বিষয়ে তারা অনেক সহজ। যেমন, রল্ফ… সে তো কখনই ভাবেনি যে সঙ্গীতজ্ঞ হবে; স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে সোজা বাবার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় যোগ দিয়েছে।
কিন্তু বের্নহার্ড? সে স্কুলের পাশাপাশি সঙ্গীতের পাঠ নিচ্ছে এবং সেটা নিয়েই সে ভবিষ্যতে এগোতে চায়। বাইরে খুব নরমশরম চেহারার হলেও এই ছেলে ভিতরে ভিতরে যা ভাবে, সেটাই করে। নিজের ভাবনাচিন্তার বিষয়ে অত্যন্ত একগুঁয়ে এবং উদ্ধত। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার হল যে সে সবসময় নিজে বন্ধু নির্বাচন করে থাকে এবং এক্ষেত্রে কারো উপদেশ মানে না। বের্শেনের এইধরণের আচরণে ঠাকুমাও বাবার মতই চিন্তিত। মাত্র সতের বছর বয়সের এক কিশোরের পক্ষে এই আচরণ অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে অভিভাবকদের। তাছাড়াও, চেনাজানা যে বিশিষ্ট পরিবারগুলির সঙ্গে তাকে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছিল, সে তাদের ধারকাছ দিয়ে যায় না। বের্শেনদের মত সম্মানিত পরিবারে এহেন অদ্ভুত আচরণ একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। এটাই ঠাকুমার আসল চিন্তা, যেটা একটা চাপা তিক্ততার জন্ম দিচ্ছে। আসলে এমন একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না যে বলবে যে বের্শেন ভাল ছেলে নয়। বের্শেনের সুন্দর মুখ, খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আদবকায়দাদুরস্ত ব্যবহার সবার মন টানে। তবুও যখনই বের্শেনের প্রসঙ্গ উঠছে, কোথায় গিয়ে যেন তাল কাটছে। সবাই বলে যে সে খুবই ভাল ছেলে… তবে…; এই তবে অব্যয়টাই অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোথাও কি অবিশ্বাসের একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে? প্রত্যেকে বলছেন যে বের্শেনের প্রতিভা এবং অন্যান্য ক্ষমতা নিঃসন্দেহে তুলনাহীন, কিন্তু কোনো একটা জায়গায় সম্ভবত তাকে কেউ বুঝতে পারছে না। সে যেন এই জগতসংসারে এক অচেনা আগন্তুকের মত অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে বাঁধা আছে। বাঁধনটা অদৃশ্য, তাই তাকে কেউ বুঝতে পারছে না ঠিকঠাক এবং পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না। এই অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই অনেকের কাছে বের্শেনকে বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে।
(চলবে)
0 comments: