0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in






এখন ফোন ইন্টারনেট সহ অন্যান্য ডিভাইস আমাদের জীবনের এতখানি
দখল করে নিচ্ছে যে বাস্তবের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছিনা।
প্রতিক্ষণ আমাদের মনে হচ্ছে দুনিয়ায় হরেক রকমের ইভেন্ট ঘটে
চলেছে । সে সবের সঙ্গে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত না থাকতে পারলে বেঁচে থাকা
অর্থহীন । তাই আমি আইসক্রীম কিনতে গিয়ে ভারচুয়াল দুনিয়ায় একটানা
সফর করতে থাকি , আর এমনটা বুঁদ হয়ে যাই , শেষ মেশ আইসক্রীম আর
কেনা হয়না । হয়তা অন্য কিছু করে বাড়ি এলাম , আসল কাজটা এভাবেই
হয়না। এই প্রবণতা কে বলা হয় ‘ফোমো’ – যার অর্থ -- ফিয়ার অফ
মিসিং আউট । যার সঙ্গে মিশে থাকে বেশ মিঠে কড়ায় দানা বাঁধা আশঙ্কা
, উদ্বেগ ।

‘ফোমো’ র আগের ধাপ ‘ইয়েলো’ (ইউ অনলি লিভ ওয়ান্স)।
‘ফেমো’ র স্রষ্টা প্যাট্রিক ম্যাকগিনিস এর বিবরণ দিয়েছেন নিজের
জীবনের আখ্যান দিয়ে । নতুন শতকের একেবারে শুরুর পর্ব সেটা।
এই ফোমোর বিষয়টা এখন বেশ চালু। দেখা যায় সব সময় । একসময় আমি
ভাবতাম ‘ফোমো’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশাল কোনো অঘটন বা আঘাত বা
এমন কিছু ঘটনা যা অনুমেয় যোগ্যও নয় – যেমন ৯/১১ দিনটির
ভাঙ্গচুরময় অভিজ্ঞতা। কিন্তু দেখলাম সেটা ঠিক নয় । ভুল ভেবেছিলাম ।
ফোমো মানুষের চেতনে অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছে । বহু মানুষ আছে
যাদের দেখা যায় দিনের শুরু থেকেই শুধু খুঁজে ফেরে সুযোগ , সে কম পয়সায়
খাবার পাওয়া থেকে আরম্ভ করে , বেশী ডিসকাউন্টে ইলেকট্রনিকস
গুডস পাওয়া – সব কিছুর খোঁজ তার নখ দর্পনে। তাদের পাওয়ার জন্য
মরিয়া , এদের কাছে হারিয়ে যাওয়ার অপশন অনেক , কোনোটাকেই তাই
ছাড়তে চায়না , হয়ত মোবাইলের মতন এক জায়গায় দেখতে পায়না কিন্তু
খোঁজ পায় , কথা বলে , নিজের জীবনের ঝুঁকিকে সামনে রেখেও চলে এই
বাক্যালাপ , এটা তার আনন্দ , না হারিয়ে ফেলার আনন্দ , একেবারেই
‘ফোমো’য় আকৃষ্ট নিবিষ্ট – এক প্রকৃষ্ট বা ক্লাসিকাল উদাহরণ ।
তবে ঐ ‘ফোমো’ ও তার কনসেপ্টকে -- সোস্যাল মিডিয়া – এখনকার
ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম – সম্ভবত আগুনের শিখার মতন একেবারে উসকে
দিয়েছে । করে তুলেছে ফোমোকে একটা ভয়াল ‘মডার্ন এপিডেমিক’ ।
প্যাট্রিক জে ম্যাকগিনিস, এই ফোমো কনসেপ্টের স্রষ্টা , দেখতেন তার
বন্ধুদের মধ্যে , যখন তিনি হার্ভার্ডে পড়তেন , কি ভীষণ রকমের
উত্তেজনা – ঐ ফেসবুক , ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে । কি অপরিমিত সময়
তারা ব্যবহার করত সেই সময় । এটাকেই উনি দেখতেন একটা ‘ক্রনিক
সিন্ড্রোম’ হিসাবে , এবং পরবর্তী কালে তাদেরকেই দেখতেন , যে তারা
আর পারছেনা তাল মিলিয়ে চলতে জগতের সঙ্গে ।এটা ক্ষতি , চরম
ক্ষতি। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যাঙ্গাত্মক লেখা ম্যাকগিনিসের খুব মনে
পড়ে , সেখানে তিনি Two Fo’s নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন , একটা
ফো হলো ‘ফোমো’ যা আগেই বলেছি আর একটি হলো ‘ফোবো’ – ফিয়ার
অফ আ বেটার অপশন।

আরও আশ্চর্য লাগে যখন ম্যাকগিনিস সম্বন্ধে পড়ি এবং জানতে পারি
যে উনি বেশী চিন্তিত ছিলেন ‘ফোবো’ নিয়ে অথচ সারা দেশ চিন্তিত ছিলো
‘ফোমো’ নিয়ে। ওনার যুক্তি ছিল, যে, ফোমো কখনও আপনাকে নষ্ট করে
দেবেনা, আপনাকে আত্মা অবধি ব্যার্থ ও ক্ষয়িষ্ণু করে তুলবেনা ।
কিন্তু ফোবো তা করতে পারে । তার মতে, ফোবো আসলে মানুষকে কমিটেড
হতেই দেয়না। তাকে একটা সংশয়ের মধ্যে রাখে, সম্ভবত, হয়তো, এই
দোলায় সারাক্ষণ দোলায় । আসলে ফোবো একটি সিদ্ধান্তহীনতার
অভিশাপ ।

কোনো পরিকল্পনাকেই স্বতস্ফুর্ত ভাবে গ্রহণ করবার মতন মানসিকতা
তৈরি করতে দেয়না । এই ভয়টা আছে । অনেকেই বা বহু ক্ষেত্রেই মনের
মধ্যে একটা ‘আরো ভালো’ অথবা বোধ হয় ‘আরও একটু দেখা’ যেতে পারে
– এই সমস্ত ভাবনাগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। তারা সব সময় ‘আরো ভালো’র
সন্ধানে মত্ত থাকে , আসল কাজের জিনিষটা শেষে পাওয়া হয়না । এই
ভীতিটা ম্যাকগিনিসের আছে এবং তার ব্যাক্ষায় বেশ দেখা যায় ।
দেখা যায়, দুটো চাকরীর অফার, ঠিক করতেই পারলোনা, দ্বীধায়,
সিদ্ধান্ত নিতে পারলোনা -- কোনোটাতেই শেষে জয়েন করা হলোনা । কিংবা
বেড়াতে যাওয়ার জন্য নানান জায়গার অপশন, বাছাবাছি করতে করতে
ভ্যাকেশন শেষ, যাওয়া হলোনা – এমনটা হয় , হচ্ছে , আর এটাই ‘ফোবোর’
ফল।

আসলে দ্বীধার মাত্রাটাকে বড় বেশী জোড় দেওয়া হয়, তাই সিদ্ধান্তের
ক্ষেত্রেও ততটাই শিথিলতা ।

‘ফোমো’ তে ব্যাক্তি মানুষ নিজে কষ্ট পায় । কিন্তু ফোবোর যাতনা সইতে
হয় আরও অনেক মানুষকে । ‘ফোবো’ ছেড়ে চলে যায়না, ফলটা চলতে থাকে
জীবনের অনেক দুর পর্যন্ত, কাজেই কাছ ছাড়েনা। অবচেতনকে কখনো
ছাড়েনা । বেশী বয়সে গিয়ে মনে পড়ে, ভুল সিদ্ধান্ত, জ্বালায়, করার কিছুই
থাকেনা । মানুষকে আরও আত্মসর্বস্ব বানায় ।

এখন দেখা যাক উপায় কী ? দেখা যাক না যে জীবন , শান্ত , বাগানে
দোয়েলের টানে --ফড়িংয়ের হুটোপুটিতেও শান্তভাবে পাখী শিস দিয়ে গান
গায় – এমন অবস্থাটাকে বরণ করা যায় কিনা । আরো ভাল কিছু না পাওয়া
অবধি পক্ষ অবলম্বন করবনা, এমন নির্বোধ আচরণ না হয় নাই–ই বা
করলাম । কারন আরো ভালোর কোনো নিশ্চয়তা নেই – এটাকে মাথায়
রাখতে হবে – ভবিষ্যতের উপর নিজের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়
, ফল ভালো হয়না , তার প্রমাণ আছে ঝুড়ি ঝুড়ি – সমাজ থেকে কিংবা
পুরান থেকে - অনেক আছে জীবনে – তাই ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ বলতে পারা অনেক
ভালো , ‘হয়তো’ বলার চেয়ে।

এতেই জীবন সহজ ও আনন্দময় হয় । গ্যারান্টি দিচ্ছেন কিন্তু সেই
মানুষটিই যিনি ‘ফোমো’ আর ‘ফোবো’, এই দুইয়েরই স্রষ্টা।

0 comments: