প্রবন্ধ - কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধকথামুখ
সুধীজন, আজ এমন একজনকে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো তাঁকে অনেকে মনে রেখেছেন হয়তো কিন্তু এটাও পাশাপাশি ঠিক বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন তিনি৷আপনারা মনে হয় অনেকেই নিশিপদ্ম বা হিন্দিতে অমরপ্রেম দেখে মুগ্ধ হয়েছেন৷মুগ্ধ হয়েছেন বাংলা নিশিপদ্মে উত্তমকুমার আর হিন্দি অমর প্রেমে রাজেশ খান্নার অসামান্য অভিনয়ে৷ আসল গল্পে এই চরিত্র দুটি ছিল না৷বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে এই চরিত্রর অস্তিত্ব ছিল না৷ এই চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা চলচিত্রের চিত্রপরিচালক এবং হিন্দি ;অমরপ্রেমের; চিত্রনাট্যকার এক এবং অদ্বিতীয় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷হ্যাঁ,া আজকের আলোচনা তাকে নিয়েই৷
১৯৪৮ সালে সামনে এল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমা ‘ধাত্রীদেবতা’। আর তাতে হঠাৎই সুযোগ পেয়ে গেল ওই ছেলেটি, রামরতন মাস্টারের চরিত্রে। সেখান থেকেই শুরু হল এক অবিস্মরণীয় যাত্রা। তারপর সময় এগিয়েছে, নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছে ছেলেটিও। ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে কালক্রমে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পাড়ি দিয়ে হয়েছে স্বনামধন্য একজন পরিচালক। সেদিনের আনকোরা ছেলেটিকে নিজের নামেই চেনে সবাই— অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার জগতে এই নামটির স্থান ঠিক কোথায়, নতুন করে বলার দরকার নেই নিশ্চয়ই। শুধু একটাই কথা; সেদিনের কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমায় পার্ট পাওয়ার জন্য যারা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও ছিলেন আরও দুজন। তাঁরা অবশ্য তখন সেই সিনেমায় সুযোগ পাননি তাদের দুজনের নাম জহর রায় আর শম্ভু মিত্র৷ অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় যাঁর অগ্রজ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় যাকে আমরা সবাই বনফুল বলে চিনি৷ বাংলা সাহিত্যে বিশেষত উপন্যাস বা ছোটগল্পে তার মত সাহিত্যকীর্তির নজীর খুব কমই আছে৷
১৯১৯ সাল, ১৮ই জুন জন্ম হয় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের৷ পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের কর্মক্ষেত্র ও স্থায়ী বাসস্থান বিহারের পূর্ণিয়া বিভাগের কাটিহার জেলার মণিহারীতে। মাতা মৃণালিনী দেবী। ভ্রাতা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়৷ এঁদের আদি পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শিয়াখালা গ্রাম। তাঁদের পরিবার "কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে" নামে পরিচিত ছিল৷ অরবিন্দের পড়াশোনা কাটিহারে। স্থানীয় স্কুল থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করার পর চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। সেই সময় কলাভবনে তার সহপাঠী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শ মতো সাহিত্য পাঠ করতেন। নাটক গল্প ইত্যাদিতে তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান-পাঠ শেষ করে ভর্তি হন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু মন পড়ে থাকে নাটক, গল্প সিনেমায়। তৃতীয় বর্ষে কলেজের ভিতরেই তার পরিচালিত নাটক দেখে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন -
' ঢুলু, তোমার আর্টের লাইনে যাওয়াই ভালো। ওটাই তোমার ঠিক জায়গা।'
প্রসঙ্গত ঢুলু; ছিল অরবিন্দের ডাক নাম। পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র জগতে তিনি ঢুলুদা বা ঢুলুবাবু নামেই পরিচিত হন। কলকাতায় ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে এসে বিমল রায়ের উদয়ের পথে সিনেমা দেখে আরো বেশি উৎসাহিত হন।
সময়টা তখন ভীষণ অশান্ত৷ ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ৷চারদিকে টালমাটাল , যাকে বলা যায় বিধ্বস্ত অবস্থা৷ধ্বস্ত বাংলার মধ্যবিত্ত জীবন৷ অরবিন্দ বাবু তুলে নিলেন দায়িত্ব৷পরিচালনা করলেন একের পর এক ছবি৷ মধ্যবিত্ত সমাজ হাসতে শিখলো,নতুন প্রাণশক্তিতে উদ্বেল হয়ে উঠলো৷অফুরান প্রাণশক্তিতে হয়ে উঠলো ভরপুর৷দু একটি নাম করলেই বুঝবেন কি সব অসামান্য চলচিত্র যেমন মৌচাক, ধন্যি মেয়ে, নিশিপদ্ম৷অসামান্য চিত্রনাট্য,পরিচালনা আর অভিনেতা নির্বাচন এই তিনটি জিনিষের ত্র্যহস্পর্শে ম্যাজিক হয়েছিল ৷ চরিত্রানুযায়ী সঠিক অভিনেতা নির্বাচনে অসম্ভব মুন্সীয়ানার পরিচয় বহন করেছেন স্বনামধন্য পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ৷ আজও বহু সমালোচক মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেছেন ৷এইসব চলচিত্র যেন মধ্যবিত্ত জীবনের জলছবি৷একঝলক টাটকা বাতাস৷ একেবারে দৈনন্দিন জীবন থেকে উঠে আসা কোনও অতিনাটকীয়তা নেই, নেই কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া৷
আগেই বলেছি নিশিপদ্মর কথা৷নিশিপদ্ম’ সিনেমাটির মূল গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। এর হিন্দি রিমেক ‘অমর প্রেম’ও তাই। কিন্তু এই সিনেমার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুটো অদ্ভুত তথ্য। প্রথমত, উত্তমকুমার বা রাজেশ খান্নার যে চরিত্রটি আমরা পর্দায় দেখি, সেটি বিভূতিভূষণের সৃষ্ট চরিত্র নয়, তার নির্মাতা স্বয়ং অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। একথা আগেই লিখেছি ৷ মূল প্রভেদ অবশ্য দ্বিতীয় কারণের জন্য শুধুমাত্র একটি গল্পের ওপর ভিত্তি করেই সিনেমাটি তৈরি হয়নি। বিভূতিভূষণের দুটি ছোটগল্প মিশিয়ে তারপর সেটাকে নিজের মতো রূপ দিয়েছিলেন অরবিন্দবাবু। ‘অমর প্রেম’-এর চিত্রনাট্যকার হিসেবে ফিল্মফেয়ারও পেয়েছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷
২৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচিত্র , ৩টি টেলিফিল্ম ও একটি সিরিয়াল নির্মাণ করেছেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷
বিশ্বযুদ্ধ,অরবিন্দর চলচিত্র ও সমাজচিন্তাঃ-
ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি যে বছর শান্তিনিকেতনে পড়তে যান ঠিক সেই বছরই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪২ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে ডাক্তারি পড়তে যান বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে। সে বছরই ভারত জুড়ে চলছে বৃটিশদের বিরুদ্ধে ”ভারত ছাড়” আন্দোলন। ১৯৪৫ সালে অগ্রজ ড. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) উৎসাহে চলচ্চিত্রে শিল্পে যোগ দেন যে সময় সারা ভারত উত্তাল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। নিজের পরিচালনায় প্রথম ছবি ১৯৫৯ সালে, বনফুলের গল্প নিয়েই ‘কিছুক্ষণ’।
শেষপর্যন্ত চতুর্থ বর্ষের ডাক্তারি পড়ায় ইতি টেনে চলে এলেন চলচ্চিত্র জগতে। প্রথমে অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন । পরে কলকাতার বীরেন সরকারের নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেন বিমল রায়ের অ্যাসিস্টান্ট হিসাবে। সেখানেহৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় তার সহকর্মী ছিলেন। পরে নিজেই বড়দা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) গল্প নিয়ে 'কিছুক্ষণ' ছবিটি করেন। প্রথম ছবির পরিচালনাতেই মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছিলেন। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়। এরপর একের পর এক ছবি করেছেন তিনি।
আহ্বান, নতুন জীবন, পিতাপুত্র, নায়িকার ভূমিকায়, ধন্যি মেয়ে, নিশিপদ্ম, মৌচাক, অগ্নীশ্বর এর মতো ছবি আজও তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
মনে রাখা কিছু ছবিঃ-
প্রবল অস্থির সময়ে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কিন্তু ওনার ছবি অস্থিরতা মুক্ত। দীনতা বা ভাঙনের কথা উনি শোনাতে চাননি, বরং ক্রমাগত ধ্বস্ত হওয়া মধ্যবিত্তের জীবনে উনি আনতে চেয়েছেন কিছুক্ষণের আরাম। নায়িকার ভূমিকায়, পিতাপুত্র, অজস্র ধন্যবাদ, নতুন জীবন, ধন্যি মেয়ে, মৌচাক, বর্ণচোরা, মন্ত্রমুগ্ধ, হুলুস্থুলু, কেনারাম বেচারাম সব ছবির মধ্যেই একটি সাধারণ বার্তা রয়েছে–মধ্যবিত্তের আপাত বিবর্ণ জীবন যাপনেও রয়েছে অজস্র রঙিন অবসর, রয়েছে অনেক কৌতুকময় মুহূর্ত।
‘ক্ল্যাসিক’ চলচ্চিত্র বানানোর চেষ্টা করেননি বলেই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কোনও অতি অভিনয় বা অহংকার ছিল না। সিনেমা যে একটি বিনোদন মাধ্যম এবং গল্পের টানেই যে দর্শক হল-মুখী হন এই সরল সত্যের প্রতি অনুগত ছিলেন সারাজীবন ৷কোনও সত্যের অপলাপ না করেই সারাজীবন মাধ্যমের প্রতি সৎ থেকেছেন৷ সরাসরি চলচিত্রের মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছেন যেন৷কোনও পুরস্কারের জন্য পরোয়া করেননি৷ দর্শকদের ভালোবাসাই তাঁর একমাত্র পুরস্কার ও অহংকারের জায়গা৷
অরবিন্দর শান্তিনিকেতনঃ-
১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। আসলে, অরবিন্দের অগ্রজ ‘বনফুল’ বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় গুরুদেবের স্নেহধন্য ছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ একটু কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন এই কিশোর সম্পর্কে। তখন অনিল চন্দ রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবে কাজ করতেন। তিনি অরবিন্দকে পরামর্শ দেন যে বার্ধক্যে কবির শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়ায় অরবিন্দ যেন একটু জোরে কথা বলেন। প্রণাম করার পরই গুরুদেবের জিজ্ঞাসা, ‘‘তুমি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’’ অরবিন্দ স্বর উচ্চগ্রামে তুলে উত্তর দিলেন, ‘‘না, আমি অরবিন্দ।’’ গলার জোর শুনে রবীন্দ্রনাথের সহাস্য মন্তব্য, ‘‘না, তুমি কানাই নও সানাই।’’
অরবিন্দবাবু তো বটেই, প্রায় সবাই শান্তিনিকেতনের ছাত্রাবাসে থাকতেন। সবসময় তো শান্ত থাকা যায় না, আর তখন সবার অল্প বয়স; সবাই ঘরের মধ্যেই দৌরাত্ম্য করতেন। একটা স্বাধীন পরিবেশ ছিল। এরমই একদিন অরবিন্দবাবু ও তাঁর বন্ধুরা ঘরে বালিশ ছোঁড়াছুড়ি খেলছেন। এমনই মগ্ন হয়ে গেছেন যে খেয়ালও করেননি ঘরে আরেকজন এসে উপস্থিত হয়েছেন। সেই সময়ই একটি বালিশ ওই আগন্তুকের পায়ে এসে পড়ল। সেটা তুলে নিয়ে আগন্তুক বললেন, “তোমাদের দেখে বেশ হিংসে হচ্ছে আমার। আমি এমন মজা করতে পারছি না।”
আগন্তুকের নাম জওহরলাল নেহরু; তিনি পরিদর্শনে এসেছিলেন হোস্টেলে…
আর একটি ঘটনার কথা না উল্লেখ করলেই নয়৷ গল্পটা এরকম অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় যে সময় শান্তিনিকেতনে পড়তেন, তখন তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ। সবাই মিলেই নানা অনুষ্ঠান করতেন। অভিনয়, নাটক তো ছিলই। একবার একটি নাটকে নায়ক ও নায়িকার ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র। এছাড়াও ছিল নিজেদেরই একটি পত্রিকা, নাম ছিল ‘একেবারে যাতা’! তাতে প্রকাশকের জায়গায় লেখা থাকত ‘তুমি’, আর সম্পাদকের জায়গায় ছিল ‘আমি’। তারই প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। যাই হোক, একবার দোলের সময় একটি রংভরা চৌবাচ্চার মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফেলে দিয়েছিলেন অরবিন্দবাবু। নিছক মজার জন্যই এমন করা।
কিন্তু কণিকা গেলেন রেগে! সোজা চলে গেলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। বিকেলে বসল বিচারসভা। রথী ঠাকুরের সঙ্গে উপস্থিত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। সমস্ত ঘটনা শুনে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যবস্থা’ করলেন। দুজনকে ডেকে পরস্পরের হাত মিলিয়ে দিলেন। বললেন, আর যেন তোরা দুটিতে কোনো ঝগড়া না করিস। সেই সময় শান্তিনিকেতনের গঠন, শিক্ষা এবং পরিবেশ কীরকম ছিল এইরকম টুকরো টুকরো ঘটনাই তাঁর প্রমাণ।
সিনেমার অরবিন্দ, অরবিন্দর সিনেমাঃ-
শুরু করব বিখ্যাত চলচিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে যিনি যথার্থই বলেছেন, বাণিজ্যিক সিনেমাও যে সুন্দর- লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সংলাপ যে আদৌ অসম্ভব নয়- কিছুক্ষণ একদা তা প্রমাণ করতে চেয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের সেই স্বর্ণযুগে তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অগ্রগামী ও অগ্রদূত যেমন স্মরণীয়, তেমনই স্বচ্ছ ও সুস্থ বাণিজ্য ধর্মের জন্য অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় অভিনন্দনযোগ্য থেকে যাবেন।
যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন তিনি৷ এখানেই অরবিন্দবাবুর সার্থকতা সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মেলবন্ধন ঘটেছিলো তাঁর হাত ধরেই৷ যেমন কাহিনী তেমন বাজারে হিট৷মুনাফা তুলেছে ছবি অর্থাৎ বাণিজ্যিক ভাবে চূড়ান্ত সফল৷
শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মিলে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন তিনি। নাটকে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে।
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের চলচিত্রে সঙ্গীতঃ-
সংগীতেরও অনুরাগী ছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷তাই তাঁর ছবিতে অসাধারন গানে ভরপুর৷"যা বলে ওরা বলে বলুক বা ধন্যি মেয়েতে 'বাঙালীর সেরা খেলা ফুটবল'; বা মৌচাক এর বিখ্যাত গানগুলি আজও ভোলা যায়না৷
";ফিল্মে গানের প্রয়োগেও অরবিন্দ কাকার মতো পরিচালকের বিরাট ভূমিকা। গানটা বুঝতেন তিনি,” বলেছেন সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ। অরবিন্দের বহু ছবির সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ‘বাঙালির তুমি ফুটবল’ থেকে বহু গানেই বাজিয়েছেন। অরবিন্দবাবুর ভাবনায়, ফিল্মে গান হবে সিচুয়েশনাল, প্রক্ষিপ্ত নয়। আবার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ‘আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’-র লিরিক শুনে গানটির কথা ভেবেই নিশিপদ্ম-র চিত্রনাট্য পাল্টেছেন। বিভিন্ন গীতিকারকে দিয়ে চেষ্টা করিয়ে প্রণব রায়ের লেখা, ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা’-ই বাছাই করেন ধন্যি মেয়ে-তে। হেমন্তের ‘এখানে সবই ভাল’, ‘লাজবতী নুপূরের রিনিঝিনিঝিনি’, সন্ধ্যার ‘তিরবেঁধা পাখি’, ‘আমার সকল সোনা’, শ্যামল মিত্রের ‘আহা গোলাপগুলি’, ‘রাজার পঙ্খী উইড়া গেলে’, বা মান্নার ‘এ বার ম’লে সুতো হব’ কী ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’-এর মতো গানের জন্য অরবিন্দের ছবির কাছে বাঙালির ঋণ জন্মেও শোধ হবে না।
নাটকে ও থিয়েটারে অবদানঃ-
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তখন নিউ থিয়েটার্সে সহকারী পরিচালক। তুলসী চক্রবর্তী সেখানে প্রায় প্রতি ছবিতেই অভিনয় করেন আর দেদার আড্ডা দেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখের সঙ্গে, ভাল গাইতেন বলে তাঁরা তাঁকে এক দিন গাইতে অনুরোধ করলেন। অরবিন্দবাবু লিখছেন ‘‘তুলসীদা বললেন— পঙ্কজ, তুমি তো বাবা রবীন্দ্রসংগীত গাও, আমি একটা নিজের সংগীত শোনাই। ‘বেশ বেশ’ সবাই বলে উঠল। তুলসীদা ডান হাতটা ডান কানে রেখে বাঁ হাতটা তুলে আ-আ-আ— করে তান ধরলেন, তারপর কাফি রাগে শুরু করলেন:— শিবরাত্রির পরের দিন/ শিবের হল সর্দি কাশি/ ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে/ জ্যেঠি কাকি মামি মাসি/ তাই শিবের হল সর্দি কাশি/ আদা দিয়ে চা করে...।’’ তাঁর সরস গদ্যে এ রকমই স্মৃতির আখ্যান ছবি বিশ্বাসকে নিয়েও। ১৯৫৪-য় নিউ থিয়েটার্স বন্ধ হয়ে গেলে অরবিন্দবাবুরা কয়েক জন মিলে নতুন কাজের সন্ধানে একটা ছবির ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছেন ছবিবাবুর কাছে, তিনি বললেন ‘পাঁচশ টাকা করে পার ডে দিবি।’ সতীর্থ বন্ধু সুনীল বসু হাতজোড় করে কাঁচুমাচু মুখে ‘আড়াইশ’ দিতে পারবেন জানালেন, শুনে ছবিবাবুর মন্তব্য ‘একেবারে নীল ডাউন হয়ে হাফটিকিটের প্যাসেঞ্জার হয়ে গেলি যে, ডেটগুলো দিয়ে যা।’
ঢুলু বাবু চলে গেলেন রেখে গেলেন সবঃ-
সারা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে চিনতো ঢুলু বাবু বলে৷ একটা ঘটনার উল্লেখ করে শেষ করব ৷অগ্নিশ্বর’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে উত্তমকুমারের নাম ঘোষিত হয়। কিন্তু আর কোনো পুরস্কার দেওয়া হবে না। পরিচালক হিসেবেও অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় কোনো পুরস্কার পাবেন না। এই খবরটা জানতে পারার পর উত্তমকুমার সবিনয়ে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “এই ছবিটা সফল হওয়ার পেছনে শুধু আমি নই, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ও আছেন। তাঁর অবদান কোনো অংশে কম নয়। তাঁকে যদি পুরস্কার না দেওয়া হয়, তাহলে আমিও নেব না।” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এগুলো নিয়েই বেঁচে ছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়।
২০১৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী বার্ধক্যজনিত রোগে ঢুলু বাবু চলে গেলেন অমরলোকে ৷বয়স তখন তাঁর ৯৭৷ এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা কালে অসামান্য চলচিত্রের নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য৷এসব কালোত্তীর্ন সৃষ্টি থেকে যাবে আমাদের কাছে৷সব ভুলতে বসা আজ বাঙালী মধ্যবিত্তের এ এক অহংকার৷
তথ্যসূত্রঃ
The Wall
আনন্দবাজার পত্রিকা
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
আলোছায়ার দিনগুলি/অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, দেজ