Next
Previous
Showing posts with label স্মৃতির সরণী. Show all posts
1

স্মৃতির সরণী - সুনৃতা মাইতি

Posted in


স্মৃতির সরণী 


আগল খুলে... স্মৃতিপথে
সুনৃতা মাইতি



আমাদের মতো পাঁচপেচি লোকের আবার স্মৃতিকথা কি হে মশাই! এমন দুঃসাহসের কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে। এত সিধে সাপটা হিসেব। হিস্টিরি মানেই তো সব মান্যিগন্যি লোকেদের জীবনচর্চা। নয় বলুন? তবুও একখানি আশার কথা আছে বইকি! ওই ইতিহাস পরীক্ষা দিতে গেলে কিছু প্রশ্ন হয়না? এই অমুক যুগের পাব্লিকের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বেত্তান্ত বমন করুন।হে হে, এইরকমই অনেকটা ব্যাপার আর কি! আর ভারী আশ্চর্যের কথা যে, আজকাল ইতিহাসে নাকি ব্যক্তি মানুষের চেয়ে সামাজিক জীবনের কদর বাড়ছে? তাই কি? কি যেন বাপু? তবে এটাই যা ভরসা যোগান দিলো। তাই খাতাকলম নিয়ে বসলাম এই আর কি!

কিন্তু এই যে লিখতে বসেই এত ভ্যানতারা করে চলছি, তার একটাই কারণ দিদি ! এই একটু স্মৃতিকথাটথা লিখব ভাবলাম। তবে এর সাথে ইতিহাসের তুলনা আনাটা ঠিক হলো কিনা আদৌ জানিনা। কারণ আজ থেকে পনেরো কুড়ি বছর আগের সময়টা ইতিহাসের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়নি সেটা বিলক্ষণ জানি। তবে স্মৃতির সারণীতে ঠাঁই পেয়েছে তো বটেই। আর কে না জানে, স্মৃতি মাত্রই খানিকটা ইয়ে গোছের। কোনও কোনও স্মৃতি খানিক বেয়াড়া, ফচকে হেসে ঠ্যাং দোলায় মগডালে।আবার কিছু স্মৃতি ন্যাকাবোকা কিংবা কাদাটে থকথকে। কেউবা আবার ভারী গুরুগম্ভীর, আগাপাশতলা ঈশপের গল্পের মতো শিক্ষণীয়।ধরে আনতে গেলে বেঁধে আনতে হয়।

সে যা হোক, সেই সময় নব প্রযুক্তি কড়া নাড়ছে দেশ কালের দরজায়। অর্থনীতি নব মূল্যায়ণের দোড়গোড়ায়। রূপোলী পর্দায় ম্যাজিক রিয়েলিজম ঢুকছে গুটি গুটি পায়ে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে পর্দায় তুতলিয়ে চলেছেন শাহুরুখ। পাশে প্রথা ভাঙা সুন্দরী কাজল। ডুবু ডুবু সূর্য মাধুরীর মুখে একটি দুটি বলিরেখার চিহ্ন। রাস্তা ঘাটে কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, কুছ কুছ হোতা হেয়। আজ্ঞে হ্যাঁ, সময়টা নব্বই এর দশক।

একেবারে ধূসর পাতায় ঠাঁই না পেলেও এখনকার থেকে সে সময়টা একটু অন্যরকম ছিলো বইকি! তার ওপর পাহাড়ের ছায়া মাখা আমাদের সবুজ মফস্বলী জীবন ছিলো অনেকটাই অন্য স্বাদের। উত্তর বঙ্গের অতলান্ত সৌন্দর্য মাখা গভীর অনুভূতিময়। একে ফ্রেমবন্দী করা অসম্ভব। তাই বেছে নিলাম জলপাইগুড়ির কলেজ জীবনের কিছু এলমেলো স্মৃতি।

উচ্চমাধ্যমিকে গাদাগুচ্ছের নম্বর পেয়ে আমরা ভর্তি হয়েছি ইংরেজী সাহিত্যে। উত্তরবঙ্গের একটি নামী কলেজে। মনের ভেতর আনন্দঘন এবং উচ্চস্তরীয় একটি অনুভূতি বুজকুড়ি কাটছে বটে, কিন্তু নিজেদের ইংরেজী জ্ঞানের বহরখানির কথা চিন্তা করেই মিইয়ে যাচ্ছি সময়ে সময়ে। একদল ঠেঁট কনভেন্ট থেকে আসা নাক উঁচু ছাত্রছাত্রী, অন্যদল ঘেমো ঘেমো ভীতুপনা বাংলা মিডিয়ম। বলা বাহুল্য, আমি দ্বিতীয়টিরই দলে। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই পৌষালী কে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম " এই, তুই ফ্লুয়েন্ট ইংরেজি বলতে পারিস ? ওই ওদের মতো?" পৌষালী মৌরী চাবাতে চাবাতে নির্বিকার মুখে এক্স কনভেন্ট পড়ুয়াদের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো " হ্যাঁ আ আআ... ওই এ টু জেড।"

যে যার দল বুঝে বসেছি ক্লাসে। তাকালেই শ্রেণীবিভাগটি বেশ বোঝা যাচ্ছে। সি এন টি এর ক্লাসটিই ছিলো প্রথম। তিনি মানুষটি মোটের ওপর ভালোই। দোষের মধ্যে কিঞ্চিৎ অর্ধেক আকাশ প্রেমি। প্রথম দিন ছাত্রী সংখ্যা একটু কম বলে তিনি পড়াতেই উৎসাহ পাচ্ছেন না। উপরন্তু পড়াতে বসেছেন মান্ধাতা আমলের ঘ্যানঘ্যানে শেক্সপীয়েরের সনেট। এমন সময় ক্লাসে ঢুকলো তুমুল সুন্দরী রিয়া। বকো মধ্যে হংসো যথা। অমনি জোড়ায় জোড়ায় চোখ ঘুরে গেলো তার দিকে। সি এন টি ও নড়েচড়ে বসলেন। এহেন পরিস্হিতিতে মিডিয়াম নির্বিশেষে বাকি সব কটি মেয়ে আপাদমস্তক জ্বলে একসা। এই জ্বলনটিই মেয়েদের মধ্যে তুরন্ত একটি অজীব একতার সৃষ্টি করে দিলো মুহূর্তে। ক্লাস শেষ হবার আগেই আমরা খুঁজে ফেল্লাম রিয়ার সৌন্দর্যের বিবিধ ত্রুটি। এর মধ্যে অন্যতম তার উচ্চকিত ওষ্ঠাধর। দেখলেই মনে হয় সদা চুম্বনোদ্যত। আর তৎক্ষণাৎ সামুহিক সিদ্ধান্ত হলো ... এটাই আসলে রিয়ার প্রতি ছেলেদের এত আগ্রহের কারণ ।

ক্লাসের বাইরে ছিলো অতলান্ত সবুজ। যেদিকে তাকাই। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই থই থই নীলচে আলোর রোশনাই। চারিদিকে উপচে পড়ছে প্রেমরস। কলেজ মাঠের ঘন সবুজের প্রেক্ষাপটে প্রচুর সংখ্যক প্রেমিক প্রেমিকা যুগল। আর কলেজের ঠিক গেটের সামনেই অহোরাত্র দাঁড়িয়ে থাকতেন সানি দা। হুবহু সানি দেওলের যৌবনের প্রতিরূপ। চেহারা গুণে তার আসল নামটি সবাই ভুলে মেরে দিয়েছে। কলেজের পুরোনো পাপী। পাশটাস দিয়ে কওবে উৎরে গেছেন, তারিখ পে তারিখ পেরিয়ে গেছে, তিনি কিন্তু কলেজের মায়া ছাড়তে পারেননি। কলেজের উল্টো দিকে বিশুদার ক্যান্টিন। ছাত্র সংসদ এবং বিরোধী দল উভয়েরই কর্মাকর্মের সব ব্লু প্রিন্ট এখানেই তৈরী হতো। অসীম নিরপেক্ষতা সহ বোবা কালা গান্ধারী সেজে বিশুদা সকলের সমান তদারকি করে যেতেন।

ধীরে ধীরে জীবনটা মোটামুটি আকর্ষণীয় লাগতে শুরু হলো। কলেজে নানারকম পাব্লিক। নানাস্তরীয়। আশে পাশে প্রচুর চরিত্র। কোনওটা রাংতায় মোড়া ঝলমলে, কোনওটা বা বটের আঠার মতো চিটচিটে কিংবা শিরিষ কাগজের মতো খরখরে। বেশ লাগছিল। প্রতিদিন নতুন নতুন খোরাক। চরিত্রচর্চা? অঢেল। ধরুন সঙ্গীতা ছিলো বেশ কয়েকজন। অতএব প্রয়োজন ছিলো বিশেষীকরণের। অনেকটা এইরকম .. সিরিয়াস সঙ্গীতা, সঙ্গীতা বিজলানী এবং রঙ্গিলা সঙ্গীতা। বিজলানী সঙ্গীতার স্বভাবটাই ছিলো পরের বয়ফ্রেন্ডের প্রতি ছোঁকছোঁক করা। আর রঙ্গিলা সঙ্গীতা তখন পানওয়ালার সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে ফুচকাওয়ালার সাথে নতুন বন্ধুত্বের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। সোজা মুখশুদ্ধি থেকে স্টার্টারে। উল্টোপথে। মাঝখানে মেইন কোর্সের কথা ভাবছেই না। ভাবখানা যেন....

"ফুচকা তোর সঙ্গে টকঝাল জীবন কাটাব
ফুচকা তোর সঙ্গে গোলগাল কাটাব জীবন।"

এর ওপর ছিলো সুচন্দ্রা। বিয়ে পাগলী। প্রতিদিন নতুন নতুন পাত্রের খোঁজ নিয়ে হাজির হতো সে। পাত্র তালিকায় সেইসময় তার নবতম সংযোজন জনৈক তবলাবাদক। তালমণি এবং তালভারতি উপাধি প্রাপ্ত। এ ছাড়া ছিলো অপালা। অপালা অতিশয় জ্ঞানী। ওর সাথে কথা বলা অত্যন্ত আরামপ্রদ। কিন্তু সমস্যা একটিই। ওর দৃঢ় বিশ্বাস একদিন সব লাল হো যায়েগা। প্রতিটি আলোচনার উপসংহারে সে গরুর রচনার মতো ওই বক্তব্যটিকেই প্রতিষ্ঠিত করে। 

ইংরেজী সাম্মানিক বটে তবে আবশ্যিক বিষয় ছিলো বাংলা। আর বাংলার অধ্যাপক শিবেন্দুবাবু অতিশয় ভদ্রলোক। তার ক্লাসে অনবরত হই হট্টোগোল চলে। ধোপদুরস্ত শিবেন্দুবাবু তৎসম শব্দের বহুল ব্যবহার করেও সেই চেঁচামেচি থামাতে পারেন না। তার এই তৎসম ভদ্রতা সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত জনশ্রুতি ছিলো। সত্য মিথ্যা জানিনা। তিনি নাকি দিনবাজারে মাছ কিনতে গিয়ে মাছওলাকে শুধিয়েছিলেন...

" বাছা, ওই পরলোকপ্রাপ্ত মৎসটির মূল্য কত হয়?"

বাংলা সাহিত্যের টিপু ইংরেজী ভাষাকে সাংঘাতিক সমীহ করে। একদিন সে হাঁপাতে হাঁপাতে কলেজে এসে হাজির। অবশেষে জানা গেলো ভাগ্যক্রমে অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে এক সাহেব টুরিষ্ট তাকে ধরেছিলো। টিপু নাকি তার সঙ্গে ইংরেজী বলে কদমতলায় ভিড় জমিয়ে দিয়েছে। পরে জানা গেলো, সাহেব তার ঠোঁট নাড়িয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন জানতে চাইছিলেন। সবই যাচ্ছিল টিপুর মাথার উপর দিয়ে। তাই টিপু এইচ এসের সময় ঝেড়ে মুখস্থ করা "অটাম সিজন" রচনাটি দাঁড়ি, কমা সহ আগা সে গোড়া বলে দেয় সাহেব বাবাজি কে। তারপর তার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা না করেই একদৌড়ে দুদ্দাড় কলেজে এসে উপস্থিত হয়।

ক্রমে ক্রমে কলেজের বুকে একটি খতরনাক নারী বাহিনী গড়ে উঠলো আমাদের। ভালো মন্দ নির্বিশেষে সব ছেলেদের কাছে মুর্তিমান ত্রাস এবং সবিশেষ সমীহের বস্তু। সুতনুকা দলের পাণ্ডা। প্রভাতে ঘুম থেকে উঠেই চাট্টি বাছা বাছা না দিয়ে সে জলস্পর্শ করেনা। ওর মতো গালাগালির স্টক এ জীবনে আমি খুব কম লোকের মধ্যেই দেখেছি। অজন্তা ডাকসাইটে সুন্দরী। আর ছিলো রাজন্যা, তানিয়া, সঞ্চিতা ও মন্দিরা। এর মধ্যে আমি খানিক কবি স্বভাববিশিষ্ট। সেইসব সময়ে আমার নাক, মুখ, কান, জিহ্বা এবং ত্বক দিয়ে অনর্গল লাভাস্রোতের মতো কবিতা বেরিয়ে চলেছে। সেই আগুনে প্রবাহকে রুখতে না পেরে অবশেষে আমি একটি কাব্যোপন্যাস লিখতে শুরু করলাম। অতএব পড়াশোনার পাট শিকেয় তুলে একটি গাবদা খেরোর খাতা নিয়ে চাদ্দিকে ঘুরছি। যাকে পাই তাকেই কবিতা শোনাতে বসি। শেষে এমন হলো যে আমাকে দেখলেই যে কোনও ভীড় পাতলা হয়ে যায়। আশেপাশে শুনশান খাঁ খাঁ করে। কলেজের ঠিক ডানপাশ ঘেঁষে দীপুদার ঘর। দীপুদা কলেজের বেতনভূক দারোয়ান। কিন্তু ওই কাজটি ছাড়া সে বাকি সবরকম কাজ করতো। সকাল বিকেল ছাত্র পড়াতো, হেসে খেলে আড্ডা দিতো এবং উদ্বৃত্ত সময়ে দুটি পুরুষ্টু গতরবিশিষ্ট ছাগলের দেখভাল করতো। একদিন এক নীল নির্জন দুপুরে কাউকে না পেয়ে শেষে দীপুদাকেই কবিতা শোনানো মনস্থ করলাম। দীপুদা তখন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ছাগলদুটিকে জাবনা খাওয়াচ্ছিলো। খাতা সহ অকুস্থলে পৌঁছে দেখি দীপুদা ধাঁ। এমনকি তার দরজার সামনে খুঁটে বাঁধা ছাগলদুটো পর্যন্ত বেপাত্তা! কি হতাশাজনক বলুন ! কবিতা কি এতই খারাপ ?

কি কথায় কি এসে গেলো। সে যা বলছিলাম। নারীবাহিনীর অসাধারণ সব কীর্তির মধ্যে দুটি বলেই ফেলি। একদা বসন্ত সমীরণে আকূলিত দ্বিপ্রহরে তাদের মনে সহসা ধুম্রপান করবার ইচ্ছে মুকূলিত হলো। আসলে হাতে কলমে বুঝে নেবার ইচ্ছে ... ইহা কি এবং কেন? মুখের কথা খসতে না খসতেই জোগাড় হয়ে গেলো অজস্র সিগারেটের প্যাকেট, বিড়ির বান্ডিল এবং একাধিক দেশলাই। অজন্তা খানিক উচ্চমার্গীয়। বিড়ির দিকে বুর্জোয়া দৃষ্টিপাত করেই সে একটি ফকফকে সিগারেট তুলে নিলো সাগ্রহে। অমনি তার সিগারেটের ডগায় আগুন দিতে ছেলেদের ভীড় জমে গেলো রীতিমতো। রাজন্যা আবার কেন জানিনা বিড়ির প্রতিই দুর্বল। বিড়ি খানি জ্বালিয়েই সে ধোঁয়া ছুড়ে দিলো তার তত্কালীন প্রেমিকপ্রবর টনির মুখে। এর অনেক পরে যখনই "বিড়ি জ্বালাইলে জিগর সে পিয়া" গানটা শুনতাম অবধারিত ভাবে দৃশ্যগুলোর কথা মনে পড়ে যেতো। 

শুধু কি বিড়ি ! আমাদের জলপাইগুড়ির মূল কেন্দ্র কদমতলা। ওই কদমতলা চৌমাথার ডান দিক ঘেষে পুরোনো আমলের একটা সিনেমাহল ছিলো। নামখানি তার দীপ্তি। অন্ধজনে আলোর নিশানা দেখাতো বলেই হয়তো তার এরূপ নাম ছিলো। তাতে সাংঘাতিক সব সিনেমা আসতো। এই যেমন ... "খাটিয়ামা জবানি কা লহর" কিংবা "টারজান অউর কামসুত্র"। ভদ্র ছেলেরা ওই তল্লাটের ছায়া পর্যন্ত মাড়াত না।পাছে কেউ দেখে ফেলে। এক শারদী বিকেলে কলেজের শেষ দুই তিনখান ক্লাস বাঙ্ক করে কয়েকটি অকালপক্ব অসীম সাহসী তরুণী দীপ্তি হলে হাজির হলো। কৌতূহলের বাপান্ত এবং ভ্রাতান্ত করে! হলে তখন রমরমিয়ে চলছে " জংলী জবানী উপচাইল বা"। হলের ভেতরে নিকষ অন্ধকার ! দর্শকাসনে কতিপয় মানুষ অপরাধী অপরাধী মুখ করে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খিকখিক, হি হি, ফ্যাঁক ফ্যাঁক, ফিচফিচ এবং ওই জাতীয় বহু মেয়েলী শব্দের জোরালো উদ্ঘোষে হলের মধ্যে একটি তুমুল গোলযোগ সৃষ্টি হলো। নীলছবির এইরকম অমনোযোগী, অসমঝদার এবং বেআক্কেলে দর্শক ভুভারতে কোথাও পাবেন না। ইতিমধ্যে হাফটাইম হতেই সুতনুকা রায়কত পাড়ার বুবুদাকে খুঁজে পেয়ে গেছে। সুতনুকা স্বভাবে এমনিতে খুব সামাজিক মেয়ে। পরিচিত লোক দেখলে সে তার পারিবারিক এবং সাংস্কৃতিক খবর না নিয়ে ছাড়ান দেয় না। তাই তিন চার রো দূর থেকেই সে বুবুদার সাথে কথোপকথনে প্রবৃত্ত হলো। বুবুদার তখন ধরণী দ্বিধা হও পরিস্হিতি। এর মধ্যেই পরিষ্কার চোখে দেখতে পেলাম বাবুপাড়ার হাবলু, কেরাণী পাড়ার সমীরন সিনেমা অসম্পূর্ণ রেখেই হলের বাইরে বেরিয়ে গেলো চুপিচুপি।

কথায় কথায় তিস্তা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেলো। অতএব সেন্সর করা যাক। আসলে স্মৃতি ব্যাপারটাই এরকম। একলা বা দোকলা আসেনা... আসে দলবেঁধে ...হুড়হুড় করে তুমুল গতিবেগে। আর তা গোছগাছের মুখাপেক্ষী নয় মোটেই। আসলে নাছোড়বান্দা চিটচিটে গুড়ের মতোই সে ঘাঁটি গাড়ে অস্তিত্ব জুড়ে। স্মৃতির হাওয়ায় বেসামাল বান্দা তাই হয়তো এক এক সময় মুখ ফসকে বলেই বসে

"আমি ভাবতে পারিনি... তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার... শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ



...এখন অনেক রাত... তোমার কাঁধে আমার নিশ্বাস... আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়...
0

স্মৃতির সরণী - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in

স্মৃতির সরণী


সরকারী খেতাব!
কী করব আমি এখন!
সব্যসাচী ভট্টাচার্য


তখন শেষ বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। চারপাশ উদ্বেল, বাজারী ব্যস্ততায়, উৎসবের ব্যগ্রতায় -- এক সন্ধেবেলায় বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম ছায়া হিন্দোলে --- আচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর বাড়ী। নামটি বলা বাহুল্য, আচার্য দেবের দেওয়া। যাদবপুর থানা থেকে ট্রামরাস্তায় যেতে ডানদিকে, লর্ডস মোড়ের কাছে। দোতলায় উঠে দেখা করতে চাইলাম আচার্য দেবের সঙ্গে। উনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের পরিচয় ও তাঁর কাছে আসার কারণ জানতে চাইলেন -- পরনে ফতুয়া ধুতি। বললাম। মানে, আমার বাবাই বললেন যে আমি সংগীতের চর্চা করি, তাই ওঁর আশীর্বাদ চাই। 

জিজ্ঞাসা করলেন, 'কার কাছে কী শেখ?' 

উত্তর, 'সন্তোষকুমার গাঙ্গুলী, ঈশ্বর গাঙ্গুলী স্ট্রীটে থাকেন।' 

চক্রবর্তী মশাই খুব খুশী হলেন। বললেন, 'ও, তুমি নাকুর ছাত্র! তা সে পাগলটা আছে কেমন? অনেকদিন আসেনি।'

এখানে বলে রাখি তারাপদবাবুর ডাকনাম ছিল 'নকু' আর আমার সে সময়ের গুরুর নাম ছিল 'নাকু।' যাই হোক, আচার্য তারপর আমার স্কুল, পড়াশোনা, তখন কী রাগ শিখছি -- এই সব বিষয়ে জানতে চাইলেন। এর মধ্যে চা, খাবার সব এল। আপত্তি টিঁকলো না, খেতেই হলো। 

এখানে যখন এইসব কথা হচ্ছে তখন কোনও একটা ঘরে গান রেওয়াজ হচ্ছে। আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি দেখে উনি বললেন, 'আমার ছেলে মানস। চেনো তো? গান শেখাচ্ছে। নিজেও ভালো গায়। মেয়েও ভালো গান করে -- শ্রীলা। তা, বাবা তুমি যখনই ইচ্ছে করবে চলে আসবে; শুনবে। শুনেও অনেক কিছু শেখা যায়।' আমি ক্রমশঃ অবাক হচ্ছিলাম। এত বড় মাপের একজন সংগীত সাধক, শিক্ষক; কত সহজ সরল! 

এবার আমি আমার খাতা এগিয়ে দিলে উনি আশীর্বাণী লিখে দিলেন। এরপর আমি যা করলাম সেটির জন্য পরে আমার খুব অনুতাপ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম -- 'আপনি পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দিলেন কেন?' আমার বাবাও খুব বিব্রত হয়েছিলেন এই প্রশ্ন শুনে। কারণ, উনি জানতেন যে তারাপদবাবু মুহূর্তে রেগে ওঠেন। 

ঠিক তাই হলো! 

আচার্যদেব রাগে জ্বলে উঠে বললেন ---

'পদ্মশ্রী দেখাচ্ছো? পদ্মশ্রী খেতাব ধুয়ে কি আমি জল খাব? আজ বাদে কাল চিতায় উঠব! একটা শেখাবার ভালো জায়গা পেলাম না, যেখানে একটা প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে চেয়েছিলাম। ওতে বেশী উপকার হতো। তোমরা বুঝলে না! পদ্মশ্রীর কোনও দরকার ছিল না। এখন স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই আর গাইতেও পারি না।' ---- 

বলে খানিক্ষণ চুপ করে রইলেন, চোখে মুখে বিষণ্ণতা। একটু পরে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, 'বাবা, রাগ কোরো না। তোমাকে বলিনি। তুমি ছেলেমানুষ, আমার নিজের দুঃখ প্রকাশ করলাম মাত্র।' বাবার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বললেন, 'মাপ কোরো ভাই।' 

আমাদের কিছু বলার ছিল না। 

প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। 

মনে মনে বাঙালী জাতটার হয়ে আচার্যদেবের কাছে ক্ষমা চাইলাম।
0

স্মৃতির সরণী - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in


স্মৃতির সরণী


আমরা খেলব
                  তুমি খাবে

সব্যসাচী ভট্টাচার্য



তখন সত্তর দশকের শুরুর দিক। ৭২-৭৩ হবে বোধহয়। আমার জ্যেঠামশাইয়ের সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়েছি। নিজের কোনও উদ্দেশ্য ছিল না, বলাই বাহুল্য; এমনিই গিয়েছিলাম, যেমন যেতাম। সেই ছোটবেলা থেকে- উন্মুখ হয়ে থাকতাম কবে যাব! এখানে বলি আমার জ্যেঠামশাই (প্রয়াত ফণিভূষণ ভট্টাচার্য) ছিলেন নেশায় সাংবাদিক, পেশায় তৎকালীন বিহারের একটি মাইকা কম্পানির ম্যানেজার। সেই ১৯৩৩ সালে ওঁকে সাংবাদিকতার জগতে হাত ধরে নিয়ে আসেন আনন্দবাজারের প্রতিষ্ঠাতা প্রফুল্ল সরকার আর সুরেশচন্দ্র মজুমদার মশাই। আর সেই শুরু -শেষ ১৯৮৭ সালে। জীবনের শেষ তিন চার মাস ছাড়া উনি নিয়মিত লিখে গিয়েছেন আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড (পরবর্তী কালে যেটি দ্য টেলিগ্রাফ হয়), ইণ্ডিয়ান নেশন ইত্যাদি আরও অনেক কাগজে ঝুমরীতিলাইয়া (কোডারমা) থেকে। যাই হোক, যে দিনটির কথা বলতে শুরু করেছিলাম ---

সে দিন দুপুরে আমাকে সঙ্গে নিয়ে জ্যেঠামশাই ঢুকলেন সন্তোষকুমার ঘোষের ঘরে। আগে ছবিতে দেখেছি এবার সামনাসামনি মুহ্যমান ব্যাঙ আমি! ততদিনে সন্তোষবাবুর দু'চারটি গল্প উপন্যাস (বুঝতে পারিনি মোটে) বয়সের তুলনায় ইঁচড়ে পাকা আমি পড়ে ফেলেছি ততোধিক পাকা স্কুলসহপাঠী বন্ধু সৌমিত্রের (ডঃ সৌমিত্র বসু) প্ররোচনায়। 

ঘরে ঢুকতেই সন্তোষবাবুর সাদর সম্ভাষণ, 'আরে আসুন, আসুন ফণিদা। কবে এলেন? এটি কে সঙ্গে?' 

-- 'আমার ভাইপো। আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে তাই নিয়ে এসেছি।' 

-- 'তা বেশ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে এই বাচ্চা ছেলেটির কী দরকার?' বলে হাসতে লাগলেন, 'পত্রিকা করে বুঝি? লেখা দরকার? একেবারেই দুগ্ধপোষ্য (তখন আমি ক্লাস নাইন বা টেন)। নাম কী?'

বললাম সব। স্কুল, ক্লাস ইত্যাদি...। অটোগ্রাফ লাগবে, সেটাও বললাম খাতা এগিয়ে দিয়ে।

-- 'আমার কোনও লেখা পড়েছ?' 

-- 'হ্যাঁ, কিনু গোয়ালার গলি, শেষ নমস্কার, শ্রীচরণেষু মা কে' ( দু একটি ছোট গল্পের নামও বলেছিলাম, কবিতার নামও...এই মুহূর্তে মনে আসছে না)।

-- ' বাবা, এ তো বেশ পাকা ছেলে!' 

খাতাটি নিলেন -- বললেন, 'কিন্তু কী লিখি বলতো? শুধু নাম?' 

এরপর খাতায় লিখলেন, 

এ যুগে নামৈব কেবলম্
                   তাই শুধু নামটাই সই 

                               সন্তোষকুমার ঘোষ।


এরপর যা হলো সেটি আমার কাছে একইসঙ্গে মজার এবং বিস্ময়ের। সন্তোষবাবু ফোনে হিমানীশ গোস্বামী আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে আনলেন নিজের ঘরে। বললেন --

'ফণিদা এঁদের তো চেনেন? আসুন একহাত হয়ে যাক।' (অর্থাৎ দাবা)। 

এতজন ছবির মানুষকে সামনাসামনি দেখে আমার গোল্লা। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন --

'বাবা, আমরা খেলব, তুমি খাবে।' বলে আনন্দবাজারের ক্যান্টিন থেকে সোনালী টোস্ট (এখন কি আর পাওয়া যায়?), ওমলেট, বড় তালশাঁস সন্দেশ আর আমি ওঁর কাছে 'ছোটছেলে' বলে বড় এক গ্লাস দুধ! 

-- 'এত খেতে পারব না' যেই বলেছি অমনি ধমক: 

--- 'ঠিক পারবে, ছোট ছেলে, আর একটা কাজও করবে, এই নাও আলমারীর চাবি, ইচ্ছেমতো বই নিয়ে পড়তে পার। শেষ না হলে বাড়ী নিয়ে যেও, পড়ে ফেরৎ দিও, যখন হোক।' 

আমি ভাবতেই পারছিলাম না। এমনটাও হয়? বই পড়তে দিচ্ছেন আবার বাড়ী নিয়ে যেতেও দেবেন! ওঁরা খেলা শুরু করলেন। আমি খাওয়াপড়ায় মেতে গেলাম।

ওহো! বলতে ভুলে গিয়েছি। সেদিন ঐ ঘরে আর একজনও উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায় যাঁর ছেলে স্কুলে আমার এক বছরের সিনিয়র ছিল (এখনকার বিশিষ্ট সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়)। সেদিন অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় ছিলেন খেলার দর্শকমাত্র।

আরও কিছু কথা ভেসেছিল সেদিন চায়ের ধোঁয়ায়, সিগারেটের ধোঁয়ায় ---

সময়ের জলে এতদিনে ধুয়ে গিয়েছে ....

বড় আফশোষ হয়।
2

স্মৃতির সরণী - সুদেষ্ণা চক্রবর্তী

Posted in


স্মৃতির সরণী


আমি ও আমার পরাণবঁধুয়া
সুদেষ্ণা চক্রবর্তী


জ্যোতিষ শাস্ত্রে ভারী পণ্ডিত আমার কর্তা সাত্যকি বলে, কেতু-মঙ্গল নাকি আমার জীবনে ঝঞ্ঝা সৃষ্টি করে। আমি বাপু গ্রহ-গ্রহাদির রহস্য কিছু বুঝিনা। তবে এটা বেশ অবগত আছি যে, আমি একটি আস্ত দুর্ঘটনাপ্রবণ মানুষ। দুর্ঘটনা আমায় গ্রাস করে না আমি তার কন্ঠলগ্না হই, সেটাই গূঢ় প্রশ্ন।

আমি জন্মেছিই নাকি একখানা ভাঙা পা নিয়ে। অন্তত ডাক্তারি শাস্ত্র তাই বলে। যদিও সাড়ে বত্তিরিশ বছর ধেইধেই করে নেত্য করার পর হঠাৎ একদিন তা ধরা পড়ল। বলুন, কি আমোদের কথা... নয়?

আরে, দুর্ঘটনা আমার পরাণবঁধু একথা বাড়ির লোক কিছুতেই মানে না। এইতো গতবছর পুজোর আগে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেয়ে পড়লাম। কি ভাগ্যি জায়গাটায় ফাটল ধরেনি, চিড় ধরেছিল শুধু আমার কাঁধের হাড়ে। তা সেও তো জোড়া লেগেছে নাকি। তার দু’বছর আগে চন্দননগরের রাস্তায় জনৈক ব্যক্তির বদান্যতায় ফুটপাত থেকে পড়ে পায়ে তিন জায়গায় চিড় ধরেছিল, মা তখন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আইসিউতে ভর্তি আর বাবা বাড়িতে শয্যাশায়ী। ফলে দিন পনেরো প্লাস্টার করারও সময় পাইনি। পা টেনে টেনেই নার্সিংহোম আর বাড়ি করেছি যতক্ষণ না মা নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফিরেছেন। জীবনটা তো এমনই। কোনও কিছু কি আর আমার সুবিধেমাফিক ঘটবে? তবু থেমে তো থাকার উপায় নেই।

সেই আড়াই বছর বয়সে এক দীপাবলীর সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনে জ্যাঠার বাড়িতে বাবা ব্যস্ত বাজি পোড়াতে, মা শব্দদূষণের আতঙ্কে ঘরে খিল এঁটে বসে আছেন। আমি উঁচু দাওয়ায় বসে দাদা দিদিদের আনন্দউৎসব দেখছি। এমন সময় কোন বৃহস্পতিজাতক একখানা জ্বলন্ত ফুলঝুরি আমার হাতে ধরিয়ে গেল কে জানে! আমি তো বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই অপরূপ আলোকছ্বটা দেখলাম। ধীরে ধীরে আগুন নিভে গিয়ে যখন তারাকাঠি লাল হয়ে উঠল, তখন শিল্পী বাপের রোমান্টিক কন্যা আমি পরম মুগ্ধতায় রক্তিম খণ্ডটিকে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরেছিলাম। ফলতঃ --- আর বলতে হবে?

আমার আট বছর বয়স অবধি আমরা উত্তরপাড়ার মাখলায় থাকতাম। প্রতিদিন খেলতে গিয়ে হাতে পায়ে অজস্র কাটাছেঁড়া, এনিয়ে তখন কেউ মাথা ঘামাতো না। সেসব ক্ষত চিহ্ন আমার বয়সী অনেক বন্ধুই এখনো সগর্বে দেহে বহন করছেন। আমরা তো আর ঘরে বসে স্মার্ট ফোনে গেম খেলতাম না, রীতিমতো ছুটোছুটি করে খেলাধুলা করতাম। সে সবতো ঠিক আছে, কিন্তু চ্যাটার্জী পাড়ায় আবার প্রচুর পুকুর। মা তাই আতঙ্কিত থাকতেন কোনদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনবেন তাঁর অতি শান্ত মেয়ে কোন পুকুরে ডুবে গেছে। তা একদিন তাঁর সেই আতঙ্ক খানিকটা সত্যিই হয়ে গেল। মেয়ে হয়ে রাঙালাঠি খেলায় জিতে যাওয়ার অপরাধে আমার এক বালক বন্ধু আমায় বর্ষার ভরাপুকুরের ডুবন্ত সিঁড়িতে ঠেলে ফেলে পিঠের উপর চেপে বসে ছিল। যাঁদের পুকুর সেই বাড়ির নতুন বৌ ভাগ্যিস তাঁর বৈকালিক কেশচর্চাটি তাঁদের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সারছিলেন, তাই তো আজ এই আগডুম বাগডুম লিখতে পারছি।

এরপর দু’বছর শান্তিনিকেতনে আশ্রমে প্রচুর অসুস্থতা সত্ত্বেও বিনা দুর্ঘটনায় কেটেছে কি করে কে জানে! অথচ ওখানেই আমি গাছে চড়তে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম। চন্দননগরে আসার পর আরও একবার জলডুবি হতে যাচ্ছিলাম বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে। সেবার পাড়ার এক তথাকথিত গুণ্ডা আমায় রক্ষা করেন, যাঁকে আমার জীবনদাতা হিসাবে এখনো আমি প্রণাম করি।

স্কুল জীবনে আমার একখানা সাইকেলের বড় সাধ ছিল। জানতাম কেনা সম্ভব নয়, তা না হলে বাবা রোজ এত কষ্ট করে দু’তিন বার বাজার যান অতখানি পথ ঠেঙিয়ে? অবশ্য ঐ দু’তিন বার যাওয়ার কারণ, বাজারে গিয়ে গল্পের ঠেলায় অর্ধেক জিনিস নিতে ভুলে যাওয়া বা নিয়ে ফেলে আসা।

কলেজে ভর্তি হতে শেষ অবধি একখানা লেডিস রেসিং সাইকেল কেনা হলো, যা শিখতে গিয়ে মাঠের গোলপোস্টে ধাক্কা খেয়ে এক মারাত্মক দুর্ঘটনাবশত একমাস শয্যাশায়ী আমি মৃত্যুর বন্দনায় গাইতাম “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন ------”। মৃত্যু অবশ্যই আসেনি, তবে ঐ লেডিস সাইকেল বরাবরের মতো আমার বাবার কুক্ষিগত হলো।

ভাইজাগে গিয়ে বেশ কয়েকবছর পর অনেক কাকুতি-মিনতির জোরে মার অজান্তে বাবার কাছ থেকে একটি সানি স্কুটি আদায় করলাম।বাবার নিজের ইচ্ছেও অবশ্য ষোলো আনাই ছিল। তা সে সানিকে প্রথম দিনেই এমন চোট উপহার দিলাম যে সে মালিক হিসেবে আমার থেকে সাত্যকিকেই আপন করে নিল। কিন্তু সাত্যকির তো একখানা বাজাজকাব ছিলই, তাই আমার সানি এক বছরের মধ্যেই মালিকানা বদল করতে বাধ্য হলো।

এর বেশ কয়েক বছর পর পায়ের ত্রুটি ধরা পড়ার জন্য নাচ বন্ধ, নাচের স্কুল বন্ধ। সারাদিন গুমরে গুমরে থাকি। এদিকে সাত্যকির অফিসে প্রচণ্ড চাপ। বাড়ি ফেরে অনেক দেরীতে। আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে নিজের বাহন না থাকলে বাজার দোকান যাওয়া খুব মুশকিল।সবই দূরে দূরে। কি করি? মাকে বলতেই মা জানিয়ে দিলেন মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে যদি তাঁকে গোপন করে একটি টাকাও খরচ করেন বাবা, তাহলে সেই দণ্ডেই মা গৃহত্যাগ করবেন। বৃদ্ধ বয়সে গৃহিণী হারানোর ভয়ে বাবা যখন মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তখন স্ত্রী স্বাধীনতার মোক্ষম বাণটিতে সাত্যকিকে বিদ্ধ করা ছাড়া আর আমার উপায় কি ছিল?

এবার এল মেরুন রঙের স্পিরিট। সাত্যকি প্রতিরাতে যত্ন করে ধরে ধরে আমায় স্কুটি চালাতে শেখালো। আমি কি সুন্দর দুপাশে ঠ্যাং ছড়িয়ে মৌখিক হর্ন দিয়ে স্কুটি চালাতে পারছি দেখে ছ' মাসের জন্য জামাই-এর বাড়িতে বেড়াতে আসা মা পুলকিত হলেন, কন্টকিতও বা। তাই প্রতিদিন মাকে বারান্দায় বসিয়ে আমি সামনের রাস্তায় স্কুটাভ্যাস করতাম।

একদিন মায়ের আতঙ্ক দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার কাছে পরাজিত হয়েছে বুঝে আমি স্কুটি নিয়ে ধাঁ। মিশন - পেট্রল ভরা। তখন কাছাকাছি পেট্রল পাম্প অন্ততপক্ষে ছয় কিলোমিটার দূরে, স্টীলপ্ল্যান্ট যাওয়া আসার পথে। “চলি চলি চলি চলি পথের যে নাই শ্যাষ।” আমার গতি ঘন্টায় দশ কিলোমিটার। পাশ দিয়ে সাইকেল চলে যাচ্ছে। যা। আমার কোনও তাড়া নেই। হঠাৎ মনে হলো পেছনে আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু কোনও দু চাকা বাহন তো নজরে আসছে না। তবে কি ভূত? এই নির্জন রাস্তা সম্পর্কে রাত্রিকালীন অনেক কিসসা কাহিনী আছে। আমি থামলে ভূতুড়ে আরোহীও থামছে। বেশ কয়েকবার এমন বিরতির পর বুঝলাম, রামোঃ! কি নজ্জা। এ তো আমারই বাহনের হাওয়া কাটার শব্দ।

এবার কিন্তু আর অশরীরী উপস্থিতি নয়। একেবারে সত্যিসত্যিই কেউ অনুসরণ করছে বুঝলাম। তখন গলায় একটা তিনভরির মোটা লম্বা চেন পরতাম। তবে কি ঐটে ছিনিয়ে নিতে এসেছে? প্রায় পৌঁছে গেছি, সামনে এসে দাঁড়ালো মহাকাশচারী। হেলমেট খুলতেই চিনতে পারলাম, আমার এক ছাত্রীর বাবা। এগিয়ে এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি কি না। দরকার হলে তিনি আমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে পারেন। তাঁকে আসল সত্যিটা বলি কি করে? সুতরাং কিছু একটা ভুজুংভাজুং দিয়ে পেট্রল নিয়ে কেটে তো পড়লাম। কিন্তু ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে মনে হলো আমার নিরাপত্তা নিয়ে উনি তখনো যথেষ্ট চিন্তিত।

ধীরে ধীরে দুই প্রসারিত পদযুগল পাদানিতে স্থান পেলো, মুখের বদলে স্পিরিটের হর্ন বাজাতে অভ্যস্ত হলাম। স্পীড বিশ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় উঠল।

ছোটো মেয়ে মিতুলের ক্লাস টু’র পরীক্ষা। বাবাই ওকে গিয়ে নিয়ে আসতেন। ডিপিএস স্কুল আমাদের সেক্টর টেনের ফ্ল্যাট থেকে বেশী দূর নয়। তবে সদ্য দোলপূর্ণিমার পরের দিন। চড়চড়ে রোদ। আমি ঘরের কাজ মিটিয়ে শুয়ে আছি, বড় ঘুম পাচ্ছে। তখন কি আর জানি, আগের বেশ বেশী রাতে আমার হাঁপানির দমক ওঠাতে, সাত্যকি ডেরিফাইলিনের সঙ্গে একখানা সেট্রিজিনও দিয়েছিল।

বাবা এসে বললেন, “তুই কি মিতুলকে নিয়ে আসতে পারবি? আমার শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না।”

বাবা সচরাচর নিজের অসুস্থতার কথা প্রকাশ করেননা। আমি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে স্কুটি নিয়ে বেরোলাম। হাওয়ায় বিচ্ছিরি ভাবে উড়ছে কামিজ, আমার খুব লজ্জা করছে। বাঁহাতে সামাল দিতে গেলাম, ঠিক একটা বাঁকের মুখে। এখন ভাবি দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশেই দায়ী মানুষের ভিমরতি। পাশে গ্যারেজ তৈরীর কাজ চলছিল বলে রাস্তায় স্টোনচিপ্স ছড়ানো ছিল। আমি টার্ন নিতে গিয়েই স্কিড করলাম। বাঁহাত তখনও ব্রেক থেকে দূরে। আমার বাহন আমায় চারফুট গভীর নর্দমায় ফেলে ওপারে গিয়ে আর্তনাদ করতে লাগল।

পড়ে গিয়ে সর্বপ্রথম অনুভূতি হলো “এইতো বেশ আকাশ দেখতে পাচ্ছি, তাহলে বেঁচে আছি?” তবে থুতনি, হাত, পা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।আমার স্কুটির ডাকে লোকজন ছুটে এল। আমায় টেনে তোলা হলো। ভাগ্যিস তখন ৬০কেজি ছিলাম। তাই অন্তত ক্রেন দরকার পড়েনি।

সবাই আমায় নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে। বলি কি করে? অত কাণ্ডের মধ্যেও জ্ঞান টনটনে। আমার লাইসেন্স নেই। ওখানে ফাঁকা রাস্তায় মহিলারা অনেকেই বিনা লাইসেন্সে মোটরগাড়ীও চালান। অন্য কারুর কি হবে জানিনা, কিন্তু আমায় যদি পুলিস ধরে? বাবারে!

ওদিকে মিতুল এতক্ষণে নিশ্চয়ই গেটের কাছে এসে মাকে খুঁজছে। মেয়েটা সকাল বেলায় জ্বর গায়ে নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেছে। কি হবে?

ভিড়ের মধ্যে কেউ বলছে বাড়ি পৌঁছে দেবে, কারণ আমার স্পিরিটের ঘাড় মটকে গেছে। কেউ বলছে তক্ষুণি আমায় হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার কথা। মুহূর্তে মিতুলের অশ্রুপ্লাবিত মুখটা মনে পড়ল। আমি জোরের সাথে ঘোষণা করলাম, আমার কিচ্ছু হয়নি। উপস্থিত জনগনের কেউ যদি একটু সদয় হয়ে আমার বাহনটিকে তখনকার মতো চালু করার ব্যবস্থা করে দেন। আমি স্থানীয় বাসিন্দা নই,টাউনশিপের বাইরে অনেক দূরে থাকি। লোকে কি বুঝল কে জানে, অমন ভেউ ভেউ করে আমায় কাঁদতে দেখে দু’জন সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে এসে স্কুটি কোনওমতে খানিকটা সোজা করে স্টার্ট দিয়ে দিলেন। আমি আমার একটিমাত্র চপ্পল পাদানিতে রেখে অন্যটির মায়া ত্যাগ করে নগ্নপদে মেয়েকে আনতে গেলাম। আমাকে অমন রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে মিতুল ককিয়ে উঠলেও, বাধ্য মেয়ের মতো আমাকে জাপটে ধরে চুপ করে বসে রইল। ওকে না উল্টিয়ে ঐ আধভাঙ্গা স্কুটিতে কিভাবে যে বাড়ি পৌঁছলাম, সে বুঝি শুধু মা বলেই।

বাড়ি ফিরতে দেখেই বাবা দূর থেকে ঠিক ঠাওর করতে না পেরে হাসতে হাসতে বললেন, “এখনও হোলি খেলা শেষ হলো না?”

আমি তখন যন্ত্রণার চোটে আর কথাই বলতে পারছিনা।

এতক্ষণের ফোঁপানো মিতুল এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বাবলি সেদিন বাড়ীতে। ওর আবার পরের দিন পরীক্ষা। বোনকে অমন আর্তনাদ করতে দেখে সেও কান্না জুড়ে দিল। আমি ততক্ষণে কোনওমতে দোতালায় উঠে আসতে পেরেছি। আমার প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করে এবার বিরাশী বছরের বাবার সে কি কান্না! দেখলাম একমাত্র মা-ই মাথা ঠাণ্ডা রেখে তুলো ডেটল খুঁজে পেতে আনলেন। সাত্যকিকে খবর দেওয়ার কথা হচ্ছে, তিনি স্বয়ং হাজির তাঁর বক্সার নিয়ে। প্রচণ্ড বকুনির তোড়ে এবার সমবেত রোদনে আমিও যোগ দিলাম। জানি স্বামীর কথার অবাধ্যতা করেছি, কিন্তু আমার যে আর কোনও উপায় ছিল না। সাত্যকির সেদিন ইউনিয়ানের নেতাদের সাথে জোরদার মিটিং ছিল, আমার নির্বুদ্ধিতার কারণে তাকে ওখান থেকে উঠে আসতে হয়েছে। বুঝলাম, আমি মিথ্যা পরিচয় দিলেও কিছু মানুষ আমায় চেনেন। তাঁদেরই মধ্যে কেউ সাত্যকিকে খবর দিয়েছেন।

হসপিটাল পর্যন্ত সারাটি পথ আমায় ধমকাতে ধমকাতে গেলেও ফেরার সময় যেই দেখলাম বকবকানি থেমেছে, মুখটাও অত পাথরের মতো শক্ত নেই, তখন প্রাণে সাহস সঞ্চয় করে বললাম, “আমার বাঁ পায়ের নূপুরটা না পড়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে।" ভাবলাম, এইরে আবার বুঝি দাঁতখিঁচুনি খেতে হয়। কিন্তু না, আমার ফাটা মুখ দেখেই হোক, বা আমার নূপুরপ্রীতির কথা অবগত থাকার জন্যই হোক কিম্বা হঠাৎ বসন্তের হাওয়া লেগে সাত্যকির বুকে তখন বোধহয় প্রেমের ঢেউ উঠেছে। ও বাইক দাঁড় করিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে এদিক ওদিক অনেক খুঁজল।কিন্তু "হায় রে, হায় রে নূপুর ----"।

এরপর বেশ কিছু বছর বিনা দুর্ঘটনায় কেটে গেল। আমার বাড়ির লোক, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজন, ওখানকার রাস্তার কুকুরবেড়াল, এমনকি পাশের গ্রাম থেকে চরতে আসা ছাগলের পালও নিশ্চিন্ত হলো আমার দ্বিচক্রযান চালনা আয়ত্তে আসা সম্পর্কে।

ডিপিএস স্কুলে বিশ্ব নৃত্য দিবস পালিত হচ্ছে। আমি প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছি। ওঁরা আমায় গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে আমি বিনয়ের সাথে জানিয়েছি, আমি নিজেই চলে যাব। ওঁরা ভেবেছিলেন আমার স্বামী আমায় পৌঁছে দিয়ে যাবেন। সাত্যকিরও তাই মনোবাসনা ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমার স্বাধীনতাপিয়াসী স্বত্তা জেগে উঠল। আমি আমার বাহনেই যাব। তা গেলাম। শাড়ি টাড়ি পরে, সেজেগুজে স্কুটি নিয়ে ডিপিএস-এর গেটের কাছে পৌঁছলাম।

দেখলাম, ফুলের তোড়া হাতে ভিতরে সবাই আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু মুশকিল হলো, গেটের দারোয়ান আমায় চেনে আমার দুই মেয়ের মা হিসেবে। সে আমায় স্পষ্ট জানিয়ে দিল, এক্ষুনি প্রধান অতিথি এসে পৌঁছবেন, সুতরাং আমি যেন গেটের থেকে দূরে স্কুটি পার্ক করি।

অনুষ্ঠানে ইংরাজিতে আমায় বক্তৃতা দিতে হবে। সাত্যকি বলেছিল, ও কাগজে লিখে দেবে নাকি? কিন্তু ঐ সেই গুমোর পোকার কামড়।আমিই বলবো, তাৎক্ষণিক। এতক্ষণ সেই বক্তৃতার টেনশন, তার মধ্যে দরোয়ান সাহেবের হ্যাটা, মাথার মধ্যে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। দিলাম অটোমেটিক স্টার্ট বাটনটি টিপে। আমার বাহন আমায় হেঁচড়ে নিয়ে খানিক এগিয়ে গেল। দারোয়ান তখন ছুটেছে ভিতরে, সবাই দৌড়ে এল। প্রধান অতিথি মহোদয়া ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আতিথ্যবরণ করলেন। অবশ্যি ভাষণটি জব্বর দিয়েছিলাম। এরপর, অনেকবার ঐ স্কুলে নাচের প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছি, এবং প্রত্যেকবারই ওঁরা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুশকিলটা অন্য জায়গায় হলো। এরপর থেকে আমায় স্কুটিতে চেপে দূর থেকে আসতে দেখলেই ডিপিএস-এর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিজের সবুজ রঙের অল্টো রাস্তার একঠেরে দাঁড় করিয়ে দিতেন। আমি পেরিয়ে গেলে তবে নিশ্চিন্তে গাড়িতে স্টার্ট দিতে তাঁর সাহস হলো।

মিতুল যখন ক্লাসএইটে উঠল, সাত্যকির এক বাল্যবন্ধু ও সহকর্মীর হঠাৎ পিতৃবিয়োগের খবর এল চন্দননগর থেকে। সাত্যকি তৎক্ষণাৎ ছুটল যাবার টিকিটের ব্যবস্থা করতে। সময় খুব কম। ওদের জন্য রান্না করার আর অবকাশ নেই তখন। কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে দেওয়া যেতে পারে। আমি স্কুটি নিয়ে দোকানে বেরোতে যাব, বাবা বললেন টুপি মাথায় দিয়ে যেতে, যা রোদ! যদিও আমি টুপি পরতে এবং পরাতে দু’টোই ঘোর অপছন্দ করি, তবু পিতৃআজ্ঞা বলে কথা। মাথায় সাত্যকির একখানা ক্যাপ পরে বেরোলাম।

বাড়ি থেকে মোড় নিয়েই বড় রাস্তা। সাত্যকির মস্ত মাথার মুকুট কি আর আমার মাথায় শোভা পায়! টুপি সামনে নেমে এসে আমার চোখ ঢেকে দিল। অতিপক্ক আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে স্বস্থানে ফেরত পাঠাতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে দড়াম করে বাহন শুদ্দু কেতরে পড়লাম। শুনশান রাস্তায় তখন একটিমাত্র দর্শক এক বাইক আরোহী তাড়াতাড়ি এসে আমায় উদ্ধার করলেন। দেখা গেল, শেষ মুহূর্তে দুহাতে ব্রেক চেপে ধরায় আমার বাহন একটু বেঁকে গেছে আর আমি হাতেপায়ে অজস্র চোট পেয়েছি।

আমি কোনওমতে উঠে দাঁড়ানোর পর আমার উদ্ধারকর্তা আমায় আমার নাম ঠিকানা শুধোলেন। বোধহয় ইচ্ছা, বাড়ি পৌঁছে দেবার। হুঁ, ঠিকানা বলি আর কি? এইপাশেই বাড়ি শুনলে উনি আমায় বাড়ি দিয়ে আসুন আর আমার বাবা তখন ঐ ঘায়েল অবস্থায় আমাকে যেন বন্ধুকৃত্য করতে দেবেন? সুতরাং আমি আর কি করি, বোকার মতো প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকলাম। ভদ্রলোকএবার জিজ্ঞাসা করলেন,“Where are you going?”

নির্মল প্রশ্ন। সহজ ভাবে উত্তর দেওয়া যেত, এই সামনে দোকানে, বা বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মাথাটা তখন কিঞ্চিৎ ঘেঁটে গেছে। বললাম, “My husband's friend's father is no more. So I am going to his house.”

“Oh! Where?”

“In Calcutta.’’

ভদ্রলোক আমার বাক্যের শুরুর prepositionটা খেয়ালই করলেন না, বোধহয় ভাবলেন, আমি স্কুটি চালিয়ে কলকাতা যাওয়ার কথা বলছি।ফলে আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে ওঁর প্রবল সন্দেহ দেখা দিল। উনি আর একবার আমার নাম, স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে নিরুত্তর দেখে এবার সম্ভবত ওঁর সন্দেহ দৃঢ়মূল হলো। খুব আতঙ্কের গলায় বললেন, “Are You Ok madam?”

“I am perfectly alright” বলে আর দাঁড়ানো সমীচিন হবে না বুঝে, আমার উদ্ধারকর্তাকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে, লগবগে স্কুটিতে স্টার্ট দিয়ে কেটে পড়লাম। যাওয়ার পথে দোকানে চিপস, বিস্কুট ইত্যাদি কেনার পর সেই পরিচিত দোকানদারের কাছে একটু ডেটল চাওয়াতে, উনি আমার দিকে একখানা হাফ লিটারের ডেটলের বোতল এগিয়ে সেটিরও দাম ধরে, দন্ত বিকশিত করে জানালেন, অবিলম্বে কেটে যাওয়া ক্ষতে অ্যান্টিসেপ্টিক না লাগালে তা বিষিয়ে উঠবে। আমি ওঁর ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও, ডেটল নিতে প্রত্যাখ্যানই করলাম।

এরপরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত।

সাত্যকির বন্ধুর পিতৃশোক ভুলে আমার শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে পড়া।

আমার বাহনটিকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো।

সমবেত বিচারে আমার দ্বিচক্রযানে স্বাধীন ভ্রমণে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিতাদেশ।

হিহিহি। এত শাসনে রেখেও আমার প্রিয়তমের সঙ্গে কি আমার প্রণয়ে ইতি টানা গেছে?
2

স্মৃতির সরণী - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in


স্মৃতির সরণী


সুর যায় - সুর ভাসে
সব্যসাচী ভট্টাচার্য

তখন শুদ্ধবসন্তহীন পরাহ্ন রোদ্দুর। হলুদ গোলাপ ছুঁয়ে কখনও ভাটিয়ার, কখনও হেমন্ত, মেঘ বা উদাসী মাণ্ড্। কয়কদিন আগে জানুয়ারীর ২৭ তারিখে অনন্ত সম্মেলনে বাজাতে চলে গিয়েছেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। সাল ১৯৮৬। তার ছিঁড়ে গেছে মাঝপথে। 

আমরা, তাঁর অনুরাগীর দল, জমা হয়েছি তাঁর দেহ ঘিরে মহাশ্মশানে; স্বতঃস্ফূর্ততায়। ওই অঞ্চলের বহু প্রাচীন বাড়ীগুলির একটির বাসিন্দা এবং নিখিলবাবুর ঘনিষ্ঠ আমার সঙ্গীতগুরু শ্রী সুশীল সরকার মহাশয় ব্যক্তিগত শোক চেপে রেখে আশ্চর্য দক্ষতায় শেষকৃত্যের আয়োজনে ব্যস্ত। আমার কোলে নিখিলবাবুর ছোট মেয়ে দত্তা। বিকচমান প্রতিভা, পরবর্তীকালের বিশিষ্ট তবলাবাদক শুভেন চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকের নিখিলবাবুর বাজনা নিয়ে আলোচনা, স্মৃতিচারণা শুনছি। 

এমন সময়, আমার মাস্টারমশাই আমায় একান্তে ডেকে নিয়ে আলাপ করিয়ে দিলেন একজনের সঙ্গে। জনান্তিকে বললেন, "তুমি একটু ওঁকে সামলাও।" দেখলাম বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় যথেষ্টই স্খলিতপদ। শোক এবং অন্যকারণে। দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। এখানে একটা কথা বলি। তখন কেওড়াতলা শ্মশানে পুরনো জঙ্গলাবৃত বিষ্ণুমন্দিরে (বর্তমানে নবকলেবরে মাইশোর গার্ডেন্) মাস্টারমশাই আমাদের কয়েকজনকে তালিম দিতেন গভীর রাত পর্যন্ত। আমার মতো ক্ষীণতনুর পক্ষে চিন্ময়বাবুর মতো দীর্ঘদেহী ও স্খলিতচরণ একজনকে সামলানো প্রায় অসম্ভব মনে হওয়ায় আমি ওঁকে নিয়ে সেই মন্দিরে গেলাম। মন্দিরের মধ্যে সেতার, তানপুরা, তবলা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,

---"তোরা এখানে রেয়াজ করিস?" বললাম, "হ্যাঁ, অনেক রাত পর্যন্ত।" একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "জানিস, আমি আর নিখিল ছোটবেলায় একসঙ্গে পড়তাম। গানবাজনা করতাম।" বলেই হাউ হাউ ক'রে কাঁদতে লাগলেন। 

বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একটু পরে বলতে শুরু করলেন, 

"ও সেতার শিখত, আর আমি গান শিখতাম ভীষ্মদেব চট্যোপাধ্যায়ের কাছে। ও যা শিখত আমাকে শোনাত, আমি যা শিখতাম ওকে শোনাতাম। পরের দিকে ও যখন পরিপূর্ণভাবে আসরে বাজাতে শুরু করল, কলকাতার কোনও আসরই আমি মিস্ করতাম না। বড় ভালো সুরের বন্ধু ছিল ও আমার। ... ও এখন পুড়ছে... ওইখানে...।" আবার বাঁধভাঙা কান্না। 

এরপর যেটা ঘটল, সেটা আমার মতো একজনের কাছে একজীবনের অভিজ্ঞতা। 

তানপুরা টেনে নিয়ে, সুর মিলিয়ে ভয়রোঁ আলাপ। দশ পনেরো মিনিট ধরে, খোলা আওয়াজে। এ এক অন্য, অনন্য চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়! এঁকে সাধারণ মানুষ চেনে না। শেষের দিকে কান্নায় গলা বুজে আসছিল...।

আমার মুখে কথা ছিল না কোনও। ইতোমধ্যে, একজন এসে বললেন, "চিন্ময়দা', গাড়ীর মধ্যে সব রেডি হয়ে গিয়েছে, চলুন।" উনি বললেন, "তুই যা, আমি আসছি একটু পরে...।" অর্থাৎ, আবার জলে ভাসা, ওই দুপুরে। আমাকে বললেন, "ওঠ্ আমাকে ধ'রে নিয়ে চল্।"

হঠাৎ, আমাকে জড়িয়ে ধ'রে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন বার বার ----

"হ্যাঁ রে, আমি চলে গেলে এই রকম চারদিকে সাজিয়ে আমার গাওয়া গান বাজাবি তো? বল্? ভুলিস না কিন্তু।" 

বললাম, "এসব কেন বলছেন?"

---"খুব লোভ হচ্ছে রে।... ভুলিস না বাবা।"

ওদিকে তখন সব শেষের পথে। চিন্ময়বাবুকে পৌঁছে দিলাম গাড়ী পর্যন্ত। ঘোরের মধ্যে তখন উনি --- সুর, সুরা আর সুরস্মৃতি...।

পরে ওঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েও যেতে পারিনি অফিসের কারণে। শুনেছিলাম, শেষ হয়েছে চলে যাওয়া "তেমন অসাধারণভাবে নয়।"

মনে মনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি­­­­ রাখতে পারিনি।
0

স্মৃতির সরণী - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


বাবা
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


কতগুলো বছর হয়ে গেল বাবা চলে গেছে। তারও কতগুলো বছর আগে আমরা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে চলে এসেছি। কিন্তু বাবার কথা মনে এলেই প্রথমে নাকে আসে কয়লার উনুনের ধোঁয়া… ভোরের আকাশবাণীতে "বিশেষ বিশেষ সংবাদ" …ঘুম ঘুম চোখে কয়লার ধোঁয়ায় বসে মায়ের খুন্তি থেকে ভেসে আসা ছ্যাঁকছোঁক শব্দ… সদ্য স্নাত বাবার চুল থেকে ঝরে পড়া টুপটুপ জল। 

অনেকদূরে অফিস বাবার …সেই গার্ডেনরীচ। সাতটার ইছামতী লোকাল ধরতে হবে। তাই ভোরবেলা থেকে শুরু হয় ব্যস্ততা।

বাবার নির্দেশে আমাদের দুই ভাইবোনকেও উঠে পড়তে হয় ভোর ভোর… নয়তো পড়া মুখস্থ হবে না। জীবনে নিয়মানুবর্তিতা আসবে না। ঘুম তাড়াতে তাড়াতে দাঁত মেজে আসি যখন, তখন চলটা ওঠা মেঝেতে সুন্দর আসন পেতে বাবা খেতে বসে… সামনে চুড়োকরা ধোঁয়া ওঠা ভাত, দু'তিন রকম তরকারি। মা তখন বাবার টিফিনবাক্স গোছাচ্ছে পাশে বসে। মা'কে জাদুকরের মতো লাগে। অফিস যেতে ইচ্ছে করে গরম ভাত আর টিফিনবাক্সের লোভে! লোভটা নিশ্চয় চোখ অব্দি পৌঁছে যায়। তা না হলে রোজ বাবার বাম হাঁটুতে বসে দু'গাল ভাত কেন জোটে!

বাবা সেই পৌনে সাতটায় বেরোয়, আর রাত সাড়ে আটটায় ঘরে ঢোকে। বাবা বেরোলে দুই ভাইবোনের যে দৌরাত্ম্য শুরু হয়, সেটা থামে রাতে আটটা পনেরোর ইছামতীর হুইসেলে। বাবাকে আমরা যমের মতো ভয় করি। বাবা সুপুরুষ এক মানুষ, যার প্রশস্ত কপালে, উন্নত নাসিকায়, থুতনির গভীর খাঁজে জ্ঞান আর গাম্ভীর্য পাশাপাশি বসবাস করে। বাবা গুরুজন... তার সাথে ইয়ার্কি, ঠাট্টা করা যায় না। তাকে শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রম করতে হয়। মুশকিল হলো, শিশুদের কাছে শ্রদ্ধা বা সম্ভ্রম হলো ভয়েরই নামান্তর। অতএব বাবাকে আমরা ভয় করি। আমাদের সাপ্তাহিক দুষ্টুমি সোম থেকে শুক্রবার অব্দি চলে। বাবার অফিস শনি-রবিবার বন্ধ। সুতরাং শনি আর রবিবার আমাদের শান্ত-শিষ্ট হয়ে থাকার দিন। এই দুইদিন দাঁত মাজাবেন বাবা(মুখের মধ্যে ভূমিকম্প হয়ে যায়)…স্নান করাবেন বাবা (ভয় হয়, ছোবড়ার ঘষায় গায়ের চামড়া না উঠে আসে)… খাওয়াবেন বাবা(উচ্ছে আর শাকও খেতেই হবে)… এবং পড়াবেনও বাবা(ভুল করা যাবে না, অন্যমনস্ক হওয়া যাবে না, মার খেলেও কাঁদা যাবে না)।

শনি-রবিবার আমাদের দুরবস্থা দেখেও মায়ের কষ্ট হয় না, কারণ ঐ দুটোমাত্র দিনই তো বাবাকে বাড়ির আরাম আর পঞ্চ ব্যাঞ্জন পরিবেশনের সুযোগ মেলে। অবশ্য আমাদের দুরবস্থাতেও প্রলেপ লাগে, যখন বাবা পাত থেকে মুরগীর হাড় বা কচকচি তুলে দেন আমাদের পাতে।

আজও শনি-রবিবারের দুপুরগুলো আমার খালি খালি লাগে। শনিবারের দুপুরে বাবা হাতের কাজ সারতে সারতে রেডিও চালিয়েছেন… "শনিবারের বারবেলা" …ঘোষকের গা ছমছমে স্বর…।

রবিবার দুপুরবেলা আমাদের গল্প বা কবিতা শোনার দিন। বাবার দুই পাশে দুই ভাইবোন… বাবা বেতালের গল্প শোনাচ্ছেন… অথবা ঘুমের মধ্যে ডুব দিতে দিতে বাবার কন্ঠস্বর কানে বাজছে- "দিনের আলো নিবে এলো, সুয্যি ডোবে ডোবে/ আকাশ ঘিরে মেঘ জমেছে চাঁদের লোভে লোভে/ মেঘের উপর মেঘ জমেছে, রঙের উপর রং/ মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা বাজলো ঢং ঢং…"

ব্যারিটোন ভয়েস… তার মাঝে একটু ফরিদপুরী টান… 'চ'-এর উচ্চারণে 'স'-এর ছায়া…সমস্ত চেতন অবচেতন জুড়ে আজও বাবার সেই মেঘমন্দ্রস্বর…


3

স্মৃতির সরণী - অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in

স্মৃতির সরণী


বিশ্বভরা প্রাণ*
অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়



১৯৭৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা যখন দিলাম, তখন সাকুল্যে আমার বয়স চোদ্দোর একটু বেশি। বাড়িতে একটা বাম রাজনীতির আবহ ছিল, আর ছিল একটি নিম্নবিত্ত সংসার। সেই পারিবারিক প্রেক্ষিতে দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে গান শিখতে চাওয়া এবং যাওয়া। একটু বাড়াবাড়িই শোনাল, যখন আমার মা আমাকে এই প্রস্তাবটা দিলেন। তখন আমার গান শোনার একমাত্র উপায় একটি মারফি ট্রানজিস্টার রেডিও। বাড়িতে হারমোনিয়ামও ছিল না। ৭টা ৪০ আর রবিবার ২টো থেকে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম। এছাড়া রবিবার সকালে ‘সংগীত শিক্ষার আসর’ হতো। সে সময় কিছুদিন গান শিখিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। ‘ভুবনেশ্বর হে’ এবং ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ – গান দু’টি বড় যত্ন করে শিখিয়েছিলেন পঙ্কজবাবু। গান দু’টো শেখা গিয়েছিল। আমাদের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট পাড়ার প্রতিবেশী ছিলেন সমর পাত্র, ডাকনাম গোবরদা। তিনি রবিবার—রবিবার ১১টা নাগাদ ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ –এই লং-প্লেয়িং রেকর্ডটি মাঝেমধ্যে চালাতেন। বলা বাহুল্য, দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া। ওঁর বাড়ির সামনে গিয়ে গান শুনতাম। আরও ছিল। ‘বিজলী’ সিনেমার পাশে একটা সাউথ ইণ্ডিয়ান রেস্তোরাঁ ছিল ‘মেঘদূত’ নামে। সেখানে ‘বৈশাখ হে মৌনী তাপস’ – এই Season Song-টির লং-প্লেয়িং চালানো হতো। মাঝে-মাঝে বিকেলের দিকে সুযোগ পেলে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম।

এই ছিল আমার গান শেখার সম্বল। সেই অবস্থায় দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে গান শিখতে চাওয়া - প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল। তবে ততদিনে প্রত্যক্ষভাবে দেবব্রত বিশ্বাসের গান শুনেছি তিনবার। দু’বার রবীন্দ্রসদনে, একবার ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হল-এ সকালের একটা অনুষ্ঠানে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আজও তাই আছি।

যাকগে, মার উৎসাহে উদ্দীপ্ত হয়ে এক রবিবার, সম্ভবত যেদিন মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়, তার ঠিক পরের রবিবার, ট্রামে চেপে ট্রাঙ্গুলার পার্ক স্টপে নামলাম। পারিবারিক কোনও কাকা বা মামার কাছ থেকে ওঁর ঠিকানার হদিশ জোগাড় করে দেন আমার মা। স্টপেজে নেমে ঠিকানা খোঁজ করতে গিয়ে বুঝলাম, খালি হাতে কোনও বাঘের বাড়ির খোঁজ করছি আমি, আমার ওই বয়সে। তখনও হাফপ্যান্ট পরতাম। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা মিস্টির দোকান। শান্তি সুইট্‌স। পাশের গলি দিয়ে ১৭৪ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। ঢুকে দেখলাম ঘর ভর্তি লোক। সব্বাই বয়স্ক এবং বয়স্কা। জোর কথাবার্তা চলছে। সঙ্গে চা, সিগারেট আর রান্না হওয়ার গন্ধ। আমাকে দেখে আওয়াজটা একটু পাতলা হলো। 

কাগে চাই, কী ব্যাবার? একটা গম্ভীর আওয়াজ বেরল, যার কণ্ঠ হতে, তিনিই আমার ‘তিনি’। ওহো, একটা আসল এবং অত্যন্ত জরুরী কথা তো বলা হয়নি। খুব ছোটবেলা থেকেই বাই ডিফল্ট আমার গলার আওয়াজটা অস্বাভাবিক ভারী ছিল, বয়সের তুলনায়। কারণটা হলো সেপ্‌টিক টনসিলাইটিস। এই ত্র্যাহস্পর্শের পরিণামগত তীব্রতার যোগফল ছিল আমার একটা ‘অ্যাবনরমাল বেস’ আওয়াজ। যাকে বাংলা বাজারে বলা হতো ‘হেঁড়ে গলা’। স্কুলে বা পাড়ার বা খেলাধুলোর জায়গায় আমি কথা বললেই, বিশেষত বয়স্করা বলতেন, এই, তুই কথা বলবি না। তার সঙ্গে ছিল তোতলামো। ভীষণ তোতলা ছিলাম। ফলে ছেলেবেলাটা বেশ বিড়ম্বনাতেই তখন কাটছিল। তাই আমি কেন দেবব্রতবাবুর কাছে গান শিখতে চাই, ওঁর গান কতটা ভালবাসি, আমার পারিবারিক পরিচয় কী এবং সর্বোপরি উনি গান শেখালে আমি যে কোনও সম্মান-দক্ষিণা দিতে পারব না - সেসব কিছু একটা চিঠিতে লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে তোতলামির বিষয়টা উল্লেখ করা ছিল। 

যেটা বলছিলাম। আমি কোনওরকমে নিজের নামটা বলে ওঁর হাতে চিঠিটা দিলাম। 

কার চিডি, কীসের চিডি বলে এক লাইন লেখাটা পড়ার পরই জিজ্ঞাসা করলেন, হাতের লেহাটা কার? বললাম। কিছুটা পড়ার পরে বললেন, আমি তো আর কাউরে গান শিহাই না। আপনি গান শিখসেন কারুর কাছে?

আমি বললাম, না, মা'র কাছেই যেটুকু শেখা। 

শুনে বললেন, ‘আমিও মা'র কাছে শিখেছি। তবে আমি তো গান আপনারে শিহাতে পারব না। শরীরও ভাল নয়। আপনি অন্য কারও কাছে যান। আমার পাশের রাস্তায় অশোকবাবু থাকেন। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। ওঁরে কন্‌ গিয়া। উনি আপনারে গান শিহাইবেন। ভাল trainer।

আমি জিগ্যেস করলাম, আমাকে আপনি বলছেন কেন? 

উনি বললেন, আমার পিতায় কইসেন। সে থাউকগ্যা। আপনারে আমি গান শিহাইতে পারুম না। 

ঘরের সবাই চুপ করে আছেন। একজন ভদ্রলোককে দেখলাম একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই চলেছেন, খেয়েই চলেছেন। খুব সৌম্য অথচ খুব রাশভারী। দেবব্রতবাবুকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করছেন। আমি স্বাভাবিক ভাবে কয়েকবার অনুরোধ করলাম এবং প্রত্যাখ্যাত হলাম। অনুরোধগুলো, বলাই বাহুল্য, তোতলামি-সহ। একটু পরে আমি কেঁদে ফেললাম। 

জানি না, ওই কান্নাটা ঘরের সবাইকে বোধহয় স্পর্শ করেছিল। বিশেষত ঠোঁটের কোণে সবসময় সিগারেট ঝোলানো মানুষটিকে। উনি দেবব্রতবাবুর পাশে গিয়ে কী একটা বললেন। পরে জেনেছিলাম, উনি ওঁর প্রাণের বন্ধু সোমেন গুপ্ত। যিনি ওঁকে বকুনি দিতে পারতেন এবং দেবব্রতবাবু শুনতেন। সোমেন বাবু বললেন, তুমি একটা গান শোনাও। 

আমি বললাম, আমি দু’টি গান শোনাব। 

কেন? দু’টো কেন? 

বললাম, প্রথমটা ততটা ভাল হবে না, নার্ভাস হয়ে যাব তো। তবে দ্বিতীয়টায় তা হবে না। 

কথাটা শুনে ঘরের সবাই একটু আওয়াজ করে হাসলেন। হাসলেন না দেবব্রতবাবু। জিজ্ঞাসা করলেন, কোওন স্কেল? 
আমি বললাম, জানি না। বাড়িতে হারমোনিয়াম নেই। 

শুনে মাথা নেড়ে গান গাওয়ার সম্মতি দিলেন। আমি ওঁকেই হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ‘এ মণিহার আমায় নাই সাজে’ এবং ‘তোরা যে যা বলিস ভাই’ গান দু’টো শোনালাম। পরপর। এখন থেকে জর্জদাই বলছি। গান শেষ হলো। জর্জদা কিছু বললেন না। ঘরের সবার চোখে একটা ভাল লাগার ছাপ, স্নেহের দৃষ্টি। সোমেনবাবু এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আবার কেঁদে ফেললাম, মাথা নিচু করে। কারণ জর্জদা আমাকে শেখাবেন বা শেখাবেন না – সেটা তো কিছু বলছেন না। 

সোমেনবাবু বললেন, জর্জের শরীরটা ভাল নেই। তোমাকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি চিঠিটা নিয়ে স্বপনের কাছে চলে যাও। স্বপন গুপ্ত, ওঁর ছাত্র। জানো তো? ও সাউথ এন্ড পার্কে থাকে। চিঠিতে সব বলা থাকবে। ওর কাছে কিছুদিন গান শেখো তুমি। 

আমি বললাম, ওঁর নাম শুনেছি, তবে কখনও দেখিনি আর সাউথ এন্ড পার্ক জায়গাটা আমি চিনি না। 

ততক্ষণে জর্জদার চিঠি লেখা হয়ে গিয়েছে স্বপন গুপ্ত’কে। জলদগম্ভীর গলায় বললেন, এই চিডিটা নিয়ে যান। স্বপনেরে দিবেন। ঠিক আসে?

আমি বললাম, আমি তো আপনার কাছে শিখতে চাই। তা ছাড়া আমি তো ওঁকে গান শেখানোর পয়সা দিতে পারব না।

ক্যান, পিতায় কী করেন ?

আমার বাবা কারখানার শ্রমিকের কাজ করেন। ওঁর কারখানা উষা কোম্পানি মাঝে মাঝেই ৪ মাস, ৬ মাসের জন্য বন্ধ থাকে। আমি তো চিঠিতে লিখেছি, আমার গান শেখার পয়সা নেই। আপনি দয়া করে শেখান।

আমার মুখে এ কথা শুনে ঘরের সবাই হতবাক আর জর্জদার সে কী হাসি। হা হা করে হাসছেন। হাসি থামিয়ে বললেন, আপনার পিতা শ্রমিক! আপনি শ্রমিকের সন্তান? শহরে শ্রমিক আসে? এহানের তো সব্বায়ের পিতা বা মাতায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, বৈজ্ঞানিক। সেহানে আপনের পিতা শ্রম করেন, তিনি শ্রমিক ?

আমি ভাবছি উনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আর এতে এত অবাক হওয়ারই বা কী আছে? ঘরের অধিকাংশ মানুষ দেখি মাথা নিচু করে আছেন। 

তার একটু পরে বললেন, আমি স্বপনেরে টেলিফোনে যা কওনের কইয়া দিমু। আপনি ওঁর কাছেই যান। তা গিয়া কী করবেন, চিডিটা হাতে দিবেন? 

আমি ঘাড় নাড়লাম। উনি বললেন, স্বপনেরে আপনি দ্যাখছেন?

আমি বললাম, না। উনি বললেন, he is blind। ওঁরে গিয়া চিঠিটা পইড়া শুনাইবেন। আপনি চা খান? 

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, না। 

শুনে বললেন, তাইলে আইজ আসেন। 

আমি ওঁকে প্রণাম করতে গেলাম। করতে দিলেন না। শুধু এইটুকু বললেন, গানটা মন দিয়া শিহেন।

আমি নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এলাম। মা’কে এসে বলতে মা-ও আনন্দে কেঁদে ফেললেন। মাধ্যমিকের ছুটি তখন। দু'একদিনের মধ্যেই চিঠিটা নিয়ে শ্রী স্বপন গুপ্তর সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে চলে গেলাম। পড়ে শোনালাম চিঠিটা। ততদিনে জর্জদার সঙ্গে স্বপনদার সম্ভবত কথা হয়ে গিয়েছে। কারণ টাকাপয়সার কথাটা তুলতে উনি বললেন, সেটা কোনও অসুবিধে হবে না। গান শোনাতে বললেন। শোনালাম। চুপ করে রইলেন। বললেন, রবিবার করে আসতে। তারপরের রবিবারই গেলাম। উনি নেই। তারপর আরও দু'দুটো রবিবার গেলাম। শেষ রবিবারে গিয়ে বুঝতে পারলাম উনি বাড়িতে আছেন। বাড়ির লোকেরা বললেন, উনি নেই। কারণটা আমার আজও অজানা।

খুব মনখারাপ নিয়ে পরের দিন অর্থাৎ সোমবার জর্জদার বাড়িতে গেলাম। সকাল ১০:৩০ নাগাদ। দেখলাম, জর্জদা একদম একলা। বাড়িতে কাজের লোক আছেন। নাম অনন্তদা এবং শ্রীকান্তদা। অনন্তদাকে উনি মাঝে মাঝে ‘অন্ত’ বলে ডাকতেন। তা ওঁকে গিয়ে বললাম। কোনও অভিযোগ করিনি। শুধু ঘটনাটা জানালাম। সব শুনে বললেন, আপনার আর কোথাও যাওনের প্রয়োজন নাই। ঠিক আসে। আপনি আমার কাছেই গান শিখেন। 

আবার কেঁদে ফেললাম। আস্তে আস্তে বাড়ির কথা, স্কুলের কথা, ওপার বাংলা থেকে উৎখাত হয়ে এদেশে একবস্ত্রে চলে আসার কথা – সব জানালাম। চা খেতে অনুরোধ করলেন। খেলাম। তখন আমি স্বপ্নের ঘোরে। বললেন, কাল সকালে কী করছেন, অর্থাৎ মঙ্গলবার। আমি জানালাম, কোনও কাজই নেই। তো পরের দিন আসতে বললেন। 

গেলাম পরদিন। ১০:৩০ নাগাদ। গিয়ে দেখি, আগের দিনের প্রসন্নতাটা নেই। একজন ভদ্রলোক কিছু কাগজ দিয়ে চলে গেলেন। আর একজন অভিজাত মহিলা বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার।

আমি বললাম, আপনি আসতে বলেছেন। 

শুনে বললেন, আধঘন্টা একটু ঘুইরা আসেন। 

ফিরলাম আধঘন্টা পরে। তখন উনি একা। মন দিয়ে কী সব লিখছেন। আমাকে দেখে ভিতরে আসতে বললেন। ভিতরে আসতে বললেন। মানে, মেন গেটের ভিতরে ঢুকেই ডানদিকে ছোট একটা লাল সিমেন্টের বার-বারান্দা মতো। সেটা পেরিয়ে ওঁর সেই বিখ্যাত, বহুশ্রুত ঘর। 

ভিতরে আসার পর একটা মোড়ায় আমাকে বসতে বললেন। তারপর লিখতে লিখতেই বললেন, আপনার ডানদিকে ‘গীতবিতান’-টা নিয়ে ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে’ গানটি বের করুন।

করলাম। এবার বললেন, পড়ে যান, গানডা। 

একটু অবাক হয়ে মনে-মনে গানটি পড়তে লাগলাম। শেষ হলো পড়া। জানালাম। 

বললেন, পড়ে যান – জোরে জোরে, আজ গানটা পড়েন, পড়তে থাকেন। 

চার-পাঁচবার পড়ার পরেও একই কথা বললেন। আরও কয়েকবার পড়ার পর বুঝতে পারলাম, আমার পড়ার মধ্যে একটা সুর আসছে – যা লেখাটার অর্থটাকে জানান দিচ্ছে। এবং পড়তে বেশ ভালই লাগছে। 

এরকম হওয়ার পর বললেন, আইজ এই পর্যন্ত। 

আবার পরের দিন সকালে চলে আসতে বললেন। ভাল লাগছে। আবার একটু খারাপও লাগছে। গানটা তো শেখাচ্ছেন না, হয়তো গরীবের ছেলে বলে এইভাবে ঘোরাচ্ছেন, যাতে আমি বিরক্ত হয়ে আর না আসি। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, শেষ দেখে ছাড়ব। ভাবুন, তখন তো মাধ্যমিকের ছুটি। কোথায় আড্ডা মারব, সিনেমা দেখব বন্ধুদের সঙ্গে, বা খেলব, তা না করে গানের পিছনে, থুড়ি গানের কথার পিছনে পড়ে থাকতে হচ্ছে। ঠিক আছে, চলো।

আবার যাওয়া। গিয়ে দেখি সোমেন গুপ্তর সঙ্গে গল্প করছেন। সঙ্গে একজন ভদ্রলোক। যথারীতি ঠোঁটে সিগারেট ঝুলছে। আমাকে দেখে একটা প্রসন্ন হাসি হাসলেন। জর্জদাও। বললেন, পোলাডারে গানডা পড়তে কইছি। আজও পড়বো। সোমেনদাকে গানটার উল্লেখ করলেন। সোমেনদা ঘাড় নাড়লেন সহাস্যে। পড়ছি। ওঁরা শুনছেন। হঠাৎ সোমেনদা বললেন, তোতলামিটা কি তোমার ছোটবেলা থেকে? ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন? এটা সেরে যায়। 

আমি কিছু বলার আগেই জর্জদা বললেন, ওর ওটা আমি সারামু। বলে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানেন, কোনও তোড্‌লাই গান গাওনের সময় তোড্‌লায় না? 

আমি সেটা জানতাম না। তবে নিজেকে দেখেছিলাম গান গাওয়ার সময় তোতলাচ্ছি না। এই সময় অনন্তদা সবাইকে চা ও চিঁড়েভাজা দিয়ে গেলেন। খেলাম। জর্জদা বললেন, গান শুরু।

কিন্তু শেখাতে শুরু করলেন, ‘কুজনহীন কাননভূমি, দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে’ দিয়ে। ‘আজি শ্রাবণঘন গহন মোহে’ দিয়ে নয়। সে কী হারমোনিয়াম বাজানো, সে কী গান। আমি চুপ। দু’বার তিনবার ‘কুজনহীন’ থেকে ‘শ্রাবণঘন’-তে ফিরে এলেন। গান থামিয়ে বললেন, গানের ব্যাকরণ পরে হবে। স্বরলিপির আগে প্রথমে সুরলিপিটা শিখেন। গানডা ভাল কইরা শুনেন। Visualize করেন। Atmosphereটারে feel করেন। একটা থমথমে ভাব। এইডা জানতে হইবো।

...এই শুরু হলো গান শেখা। বলে দিলেন, আপনার কোনও দিন নাই। যেই দিন আইবেন, সেই দিন কইয়া দিমু, পরদিন কবে আইবেন। এখন ছুডির সময়। সকালের দিকে সোম-শুক্র কিছুটা ফাঁকা সময় পাইলে চইল্যা আসবেন।

গানটা করলাম।

সেদিন গানটা দেখে গেয়েছিলাম। বাড়িতে ‘গীতবিতান’ ছিল না। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে একটা খাতায় গানটা লিখে নিলাম বাড়ির জন্য। আর একটা কপি করে পাতাটা ছিঁড়ে জামার পকেটে পুরে নিয়ে চলে গেলাম পরের ক্লাসে। সেদিনও গম্ভীর মুখ। শরীরটাও ভাল নয়। খুব কাশছিলেন। হাঁপের টানটাও বেড়েছে। বললেন, আজ তাড়াতাড়ি চইল্যা যাইবেন। গানটা করেন -বলে হারমোনিয়ামে সুর ধরলেন।

আমি পকেট থেকে কাগজটা বের করে গানটি শুরু করতে যাব, এমন সময় জর্জদা বললেন, ওইডা কী? 

আমি গানটির কথা বললাম। শুনে এক্কেবারে ফায়ার। চোখমুখ লাল হয়ে গেল। একে শরীরটা খারাপ।

বললেন, ‘কুজনহীন কাননভূমি’ আপনি পাতা দেইখ্যা গাইবেন? এদ্দুর গ্যাসেন? আপনে এক্ষুনি বায়ের হইয়া যান। আপনার কিস্যু হইবো না। আপনি পাতা দেইখ্যা ‘কুজনহীন কাননভূমি’ গাইবেন। শোনেন, একডা কাম করেন। আপনার পিতার নাম যখন কেউ জিগাইবো তহন পকেট থিক্যা কাগজ বায়ের কইর‍্যা পিতার নামডা কইবেন।

আমি হতভম্ব! দোষটা কী করেছি বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, দোষ করেছি। বললাম, আর করব না, কোনও দিন করব না।

উনি চুপ করে রইলেন। অনন্তদা একবার আমায় বললেন, বাড়ি চলে যেতে। উনি হাত তুলে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই ভীষণ স্নেহভরে আমাকে গানটির রূপ ও বোধ ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, এই বোধ অন্তরে অনুভব না করলে তা গানের চেহারায় ফুটে উঠবে না। গানের কথাগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। মোট কথা আমায় দেখে গান গাওয়া চলবে না, যদি ওঁর কাছে গানটা শিখতে হয়।

আমার ভয় ছিল, যদি সত্যিই আমাকে গানটা না শেখান রাগ করে। ফলে গান মনে রাখার অভ্যেসটা শুরু করলাম। তাতে কিছুদিন পর দেখলাম, দারুণ কাজ দিল। কয়েক মাসের মধ্যে কিছু মানুষজন বন্ধুবান্ধবরা জেনে গেলেন আমি জর্জদার কাছে গান শিখি এবং গান গাইতে বললে না-দেখে বেশ কয়েকটা গানও গেয়ে ফেলতে পারি।

মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হলাম নিউ আলিপুর কলেজে। কো-এড কলেজ। অঙ্কে ভাল নম্বর পাইনি বলে সায়েন্স পেলাম না। আর্টস নিলাম। প্রচুর মেয়েরা পড়তেন আমার সঙ্গে। ছেলেরাও ছিলেন। সংখ্যায় বেশি ছিলেন মেয়েরাই। ক্লাস অফ থাকলে গান গাইতাম। কিছুদিনেই বন্ধুপ্রিয় হয়ে উঠলাম। তখন তোতলামিটা থাকলেও, কেন জানিনা, ব্যাপারটা অতটা ছিল না। সে-বছরেই পুজোর ছুটির সময় একদিন সকালে জর্জদার কাছে গিয়েছি। উনি বললেন, আপনার হাতের লেখাতো পরিস্কার। একটা লেখা ‘কপি’ করতে হবে। 

আসলে জর্জদা যা লিখতেন, যাকে লিখতেন তার একটা করে কার্বন কপি থাকত। সেই সময় কিছুদিনের জন্য কোনও কারণে বাজারে কার্বন পেপার পেতে অসুবিধে হচ্ছিল। তো, আমি আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। ওঁর কাজ করার সুযোগ। তা ছাড়া তখন প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও একটা স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওঁর তো অসামান্য হাতের লেখা। ঝকখকে, ঝরঝরে। লিখতে গিয়ে বুঝলাম, উনি কোনও একটা বই লিখছেন। ওঁর রাজনৈতিক জীবন ও সেই সংক্রান্ত ওঁর ভাবনা ও অভিজ্ঞতার কথা ওই লেখাটায় ছিল। উনি জানালেন, একটা কপি প্রেসে পাঠাতে হবে। তাই এই লেখার কাজ। আমি দিন দুয়েকের মধ্য লেখাটা শেষ করেছিলাম। কপিটার লেখাটা জর্জদা মঞ্জুর করলেন। পরবর্তী কালে লেখাটিকে দেখার সুযোগ হলো ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ বইটিতে। পরিচ্ছেদটির নাম ছিল সম্ভবত ‘বামের/বাঁয়ের রাস্তা’ এই রকম একটা কিছু।

গান শেখা চলছে। এখনও একা, কখনও দলের সঙ্গে, মহিলাই বেশি। তবে সবাই উচ্চশ্রেণির। আমার বয়সি একজনও কেউ ছিলেন না।

মাঝে মাঝে শ্রীমতী মায়া সেন, সুচিত্রা মিত্র, সুবীর সেন, বিভা সেনগুপ্তদের দেখতাম। শুক্রবার বিকেলে আমার আসা একেবারে বারণ ছিল। এমনিতেই বিকেলবেলা আসাই হতো না। উনি বলতেন, শুক্রবার বিকেলের দিকে উনি তাসের দেশে থাকেন।

৭৮-এর বন্যায় কলকাতা ভেসে গেল। রবীন্দ্রসদনে প্রোগ্রাম। শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল দু’দিন। কার্পেট, সিঁড়িতেও লোকভর্তি।

একদিন সকালে গান শিখছি। মনে আছে ‘গোধূলিগগনে মেঘে’ গানটি। ‘চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি, আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি।’ উনি বলছেন, co-ed-এ তো পড়েন? প্র্যাম করেন? আপনার গান শুইন্যা আপনার প্র্যামে কেউ পড়ে? 

আমি ‘না’ জানাতে বললেন, এই আঁখি-ডা প্র্যামে না পড়লে দেহন যায় না, বুঝনও যায় না।

ভরসা দিলেন, তখনও কেউ প্রেমে না পড়লেও ভবিষ্যতে পড়বে যদি মন দিয়ে গানটা করি। এই সময় একজন বিখ্যাত গায়ক এসে হাজির। সুদর্শন গায়কটিকে দেখে একগাল হেসে বসতে বললেন। মোড়াটা এগিয়ে দিলাম। কথায়-কথায় উনি, মানে সেই গায়কটি বললেন গতকাল তাঁর ফাংশন ছিল।

উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ফলাফলটা কী? কাল কেমন কইর‍্যা গান কইলেন? 

শিল্পী মানুষটি একটু জোর গলায় বললেন, ‘কথাবার্তা’ ছিল না। 

উনি বললেন, সেইডাই তো কইত্যাচি। গান কাল কেমন কইর‍্যা কইলেন? 

উনি কীরকম অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। ভাবলেন, জর্জদা ওঁর সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। আমার মতো ছোট একটা ছেলের সামনে। উনি বেশ স্পষ্ট করে বললেন, আমার গান ছিল।

 গাইলেন? কী কী গান গাইলেন? -গম্ভীর গলা জর্জদার।

উনি বললেন, ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার’ 

জর্জদা শুনে মুচকি হাসলেন। একটু জর্দা মুখে দিলেন। চিবোতে চিবোতে বললেন, আপনি কইছেন vowel কিন্তু শ্রোতারা শুনছে consonant। যাউকগ্যা, আজ আসেন। পরে কথা হইব। 

তো উনি চলে গেলেন। যাওয়ার পর জর্জদা বললেন, প্রতিদিন আপনি একই কথা একইভাবে কন, না একডু আলাদা করেন? চিন্তার variation না থাকলে কথাতেও তার প্রকাশ হয় না। রবিঠুকুরের গান করে, রসিকতা বুজে না। শুধু বম্বে গিয়া গান গায়।

আমি বললাম, vowel-consonant টা কি ?

বললেন, বুঝলেন না? উনি কইত্যাছেন এ পথে(A-পথে) – শ্রোতারা শুনছে বিপথে (B-পথে)। এ পথ যে অন্য পথ থেকে আলাদা। সেটা তো বুঝাইতে হইব? সবই একই পথ -বলে হাসলেন। 

তখন বুঝতাম না। আজ সাতচল্লিশ বছর বয়সে এসে বুঝি, কী গভীর দৃষ্টি, বিশ্লেষণ ছিল তাঁর প্রতিটি গানে।

‘আকাশভরা সূর্য তারা’ – গানটি শেখাচ্ছেন। অনেকে আছেন। বারে বারে ‘তাহারি মাঝখানে’ জায়গাটা গাইতে বলছেন। বলছেন, feel করেন। you are surrounded by the cosmic elements and energies। আপনি তার মাঝখানে, feel করেন। 

ঐ মাঝখান-এর মধ্যে উনি জানালেন কীভাবে eternal India-র সুর লেগে আছে — ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’র সেই সুর। 

একদিন উনি একজনকে একটা চিঠিতে লিখেছেন – মাঝে মাঝে পাওয়া চিঠি পড়ে পড়ে শোনাতেন, আবার চিঠির উত্তরও শোনাতেন— সেরকমই একটা চিঠিতে উনি জানাচ্ছেন ‘প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে’ গানটির প্রসঙ্গে : আপনারা চিন, ভিয়েতনাম, রাশিয়ার বিপ্লবের কথা জানেন এবং শুনেছেন, হয়তো দেখেছেনও। মানুষের মুক্তির কথা সেই বিপ্লবে বলা আছে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন আলো-আঁধারের আনন্দ বিপ্লব — এতে রক্তপাত নেই, হত্যা নেই। শ্রেণীশত্রু নিধন নেই। আর লিখেছিলেন, ওই একটি গানের লাইন-ই রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর সারকথা হতে পারে। তা হলো ‘বহুজনতার মাঝে অপূর্ব একা’। সারাজীবন রবীন্দ্রনাথ তাই ছিলেন। 

...কথাগুলো বলছেন, জর্জদার গলা ভারী হয়ে আসছে। চশমা খুলে চোখ মুছছেন। 

আর একদিন না বলেই গিয়েছি। গিয়ে দেখি, বিশিষ্টা এক গায়িকার হাতে ‘স্বরবিতান’। আমাকে দেখে বললেন, আজ আপনার কী চাই?

বললাম, এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই আপনার একটু খবর নিয়ে গেলাম এই আর কী। 

বললেন, থাকেন পোটোপাড়ায়, এই বয়সে এইখানে কাম পড়ে। বসেন — বলে গায়িকাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এনারে চিনেন?

আমি নাম বললাম। সবাই চেনে, আমিও চিনি। 

—গান শুনসেন? কী গান শুনসেন? 

আমি ওঁর গাওয়া একটি গান শুনেছি তখন। গানটির উল্লেখ করলাম। 

শুনে বললেন, আর একটি গান কন। 

আমি তো জানি না। 

বললেন, আপনি ক্যান উনিও জানেন না। কেউই জানে না।

শুনে ওঁর স্বামী ও উনি হাসতে লাগলেন। উনি ওঁকে ডাকছিলেন ‘দিদিমণি’ বলে। বললেন, আর কি জানেন উনার সম্পর্কে? 

আমি তো আর কিছু জানি না। 

শুনে বললেন, উনি রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট শিক্ষিকা। 

আমি ভাবলাম এটা তো আমি জানি, যেটা জানি না সেটা হলো জর্জদার ভাষায়, এহানে গান শিহানোর সবার গ্রুপ আসে, ওঁর ট্রুপ আসে। 

তো গানটি শেখাচ্ছেন। আমার পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, পোলাটা আমার কাছে গান শিহে। না না গান শিহে না – গান গ্যালে। যাই কই, তাই গিল্যা লয়। 

ওঁদের হাসি। তবে দিদিমণিটি এমনিতে আপাতভাবে খুব গম্ভীর। বুঝতে পারলাম অনেক সকাল থেকে গান শেখাটা চলছে। তখন ১১:৩০ কী ১১:৪০। গানটি ছিল ‘তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই, কতই কী চাই—’। দ্বিতীয় অন্তরা অর্থাৎ ‘একটি চাওয়া ভিতর হতে ফুটবে তোমার ভোর আলোতে/প্রাণের স্রোতে--/অন্তরে সেই গভীর আশা বয়ে বেড়াই/তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই, কতই কী চাই—’

গানটা শেখাচ্ছেন। আমি বাইরের ছোট বারান্দায় বসে আছি। যতবার ‘একটি চাওয়া’-র লাইনটা সেই শিক্ষিকা গাইছেন ততবারই জর্জদা একটু হেসে বলছেন, হইলো না, আবার গান – বলে একবার দু’বার গেয়ে দেখাচ্ছেন। একদম ঠিক সুরে উনিও গাইছেন। জর্জদা নাকচ করে দিচ্ছেন। 

এইবার গায়িকাটি বেশ বিরক্ত, জর্জদা আপনার problemটা কী বলুন তো, যা গাইছেন তাই গাইছি, স্বরলিপিতেও কোনও ভুল নেই – অসুবিধেটা কোথায়? 

কথা থামাতে জর্জদা মুচকি হেসে পানের ডিবে থেকে দু’টো পান বের করে মুখে দিলেন। তারপর বললেন, দিদিমণি, রবীন্দ্রনাথের সিরিব্রাল হইলে কি দোষডা আমার? আগের অন্তরায় কইসেন ‘সে সব চাওয়া’ আর এখন কইত্যাসেন ‘একটি চাওয়া’। একইভাবে কওন যায়? A Single solitary desire…from within। আর শুনেন, রবীন্দ্রনাথের ভোর হইতো চাইরটার সময়। আপনার ভোর হইত্যাছে বেলা দশডায়। অত Zo-রে অত স্পষ্ট কইর‍্যা ভোর হয় না। ভোর হয় অস্ফুটভাবে। ফিল করতে হইব। 

দিদিমণি চুপ। ওঁর স্বামীর চোখে জল। জর্জদার মুখ থমথমে। 

আমার সঙ্গে ভালবাসার গাঢ়ত্বটা বাড়ল ’৭৮-এর শেষ বা ’৭৯-এর গোড়ার দিকে। সময়টা সঠিকভাবে মনে নেই। উনি আসতে বলেছেন। গিয়ে দেখি, ইজিচেয়ারে বসে আছেন জর্জদা, চোখ-মুখ বিস্ফারিত, উঠতে পারছেন না, হাতড়াচ্ছেন কিছু একটা। আমি ঢুকতেই তাকালেন অসহায় যন্ত্রণার দৃষ্টি নিয়ে। 

বুঝতে পারলাম, পানের পিকসমেত চিবোনো পানসুপুরি জর্দা কোনওভাবে গলায় আটকে যাওয়াতে দমের কষ্ট হচ্ছে ভীষণ আর হাতড়াচ্ছেন পিকদানিটা। আমি তাকিয়ে, পিকদানিটা যেখানে সাধারণত থাকে, দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। 

আমি বললাম, আমার হাতে ফেলুন ওটা, আপনি জানেন যে ওটা আমি খেয়ে নিতেও পারি। আমার হাতে ফেলুন এক্ষুনি। বিমুঢ় বেদনার দৃষ্টিতে জর্জদা আমার দিকে তাকিয়ে হাতে ফেললেন পান পিকের প্রথম ভাগ এবং পরে দ্বিতীয় ও শেষ ভাগ। আমি বাইরে ফেলে দিয়ে, হাত ধুয়ে যখন ঘরে ঢুকলাম জর্জদা নিঃশব্দে হাত নেড়ে আমাকে ওঁর একদম পাশে আসতে বললেন। যাওয়াতে, সেই নিঃশব্দেই আমার মাথাটা ওঁর হাফহাতা গেঞ্জি পরা বুকে চেপে ধরলেন কিছুক্ষণ। তারপর ছেড়ে দিলেন। ‘ফিল’ করলাম, ভালবাসার আশীর্বাদ কীভাবে ট্রান্সমিটেড হয়। 

সেদিনের পর থেকে জর্জদা বাহ্যিক কোনও প্রকাশ না-করে ওঁর সংগীত ভাবনার নির্যাস আমাকে দিয়ে যেতে লাগলেন। যার ফল আমি এখনও পাচ্ছি। একদিন জিগ্যেস করলেন, আমার গান লোকের এত ভাল লাগে কেন? যদি বলেন গলার আওয়াজ, হেমন্তবাবুর গলার আওয়াজ আমার থেকে অনেক অনেক গুণ ভাল— তবু রবীন্দ্রনাথের গানে আমাকে লোকেরা এত চায় কেন এবং যে সে লোক নয়, সাধারণ শ্রোতা থেকে মনস্ক শ্রোতা পর্যন্ত – ফলে এত রেকর্ড, অনুষ্ঠানে এত ভালবাসা কেন ?

আমি জানালাম যে, জানি না। 

উনি বললেন, শোনেন, আমার গান হুইন্যা হক্কলের মনে হয় গানডা আমারই লিখা, আমারই সুর করা এবং আমারই গাওয়া – অর্থাৎ ইডা রবিবাবুর গান নয়, আমার গান, আমার গান আমি গাই, আমি অপরের গান গাই না। এই বোধটা আমি শ্রোতাদের বুঝাইতে পারসি। I do believe those songs। এই যে কয়, আমি এর কাছে গান শিখি, যন্ত্র শিখি – কথাটার মানে কী? আমি রবীন্দ্রনাথের গান আলাদা করে কী করে শিখাব? শেখানো মানে ইন্টারপ্রিটেশন শেখা, শব্দপ্রয়োগের ভঙ্গি শেখা, উচ্চারণের বৈশিষ্ঠ শেখা, তার কারণ শেখা, যতিচিহ্নের প্রয়োগের যুক্তি শেখা। সবাই গায় ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ/জ্বেলে দিবস/গেলে করবে নিবেদন।’ কথাটা তো তা নয়। ‘জ্বেলে দিবস’ মানে কী? দিবস জ্বালিয়ে দেবে? কথাটা হলো— ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে/দিবস গেলে করব নিবেদন।’ তবে কথাটার মানে হয়। বা ‘দিনশেষের রাঙামুকুল’ গানটিতে ‘রাত যেন না বৃথা কাটে প্রিয়তম হে, এসো এসো প্রাণে/মম গানে/মম হে।’ এই ‘মম হে’ কথাটার মানে কী? কোনও মানে নেই। কথাটার মানে হয় যখন বলা হয় ‘এসো এসো প্রাণে মম/গানে মম/হে’, তখন।

১৯৮০ সালে চলে গেলেন উত্তমকুমার। ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ি আশুতোষ কলেজে। জর্জদার শরীরটা ভাল নেই। হেমন্তবাবু, বাণী ঠাকুর ‘কিংশুক’-এর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রসদনে ওঁকে সম্বর্ধনা দিলেন। জর্জদার মুখে তখন দাড়িগোঁফের বোঝা।

একদিন বললেন, শুনেন গাঙ্গুলিমশয়, যেই দিন আপনার হইতে বিনয় চইল্যা যাইবো, সেই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ আপনারে ত্যাগ করব। এহন গানডা মন দিয়া করেন। হারমোনিয়াম শিখতে সময় লাগব না। আর হারমোনিয়ামের সুর গলায় অনেক ত্রুটিরে ঢাইক্যা দেয়। ও আপনেরে শিখাইয়া দিমু। খালি গলায় করেন।

একদিন সকালে গান শেখানোর পর জর্জদা জিগ্যেস করলেন, বটুকের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত হুনসেন? 

আমি বটুক বলতে গীটারবাদক বটুক নন্দীর কথাই শুধু জানতাম। তিনি যে রবীন্দ্রনাথের গানও করেন, তা জানতাম না। আমার অজ্ঞতার কথা ওঁকে জানাতে উনি একটু হেসে জানালেন যে, ‘নবজীবনের গান’-এর রূপকার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তাঁর স্বজনমহলে ‘বটুক’ নামেও পরিচিত। আমি ওঁকে একবারই আসতে দেখেছি। কারণ সে-বছরই, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালেরই সম্ভবত অক্টোবর মাসে, উনি সবাইকে ছেড়ে হঠাৎই চলে যান। শুনেছিলাম হাওড়া স্টেশনের ট্রেনের কামরায় ওঁর নিষ্পন্দ শরীরটি পাওয়া গিয়েছিল। জর্জদা শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। 

যাক গে, যা বলছিলাম, জর্জদার জিজ্ঞাস্য ছিল আমি ওঁর গাওয়া ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ গানটি শুনেছি কি না। আমি শুনিনি বলায়, জর্জদা আবারও একটু হেসে বললেন, বটুকের গান হুইন্যা মনে হয় এই ‘আনন্দযজ্ঞে’ যিনি নিমন্ত্রণ করসেন আর যিনি নিমন্ত্রিত, তাদের স্ট্যান্ডার্ড ইক্যুয়াল। আর বাদবাকি গায়করা নিমন্ত্রিতই নন। নিজেরাই আইস্যা ঢুইক্যা পরসে। মনে আর কন্ঠে এত দুঃখ লইয়া আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণের গান গাওন যায়।

এটা ’৭৮ সালের ঘটনা। গান শিখতে গিয়েছি সকাল। কলেজে গরমের ছুটি চলছে। ঢুকতে-ঢুকতে শুনতে পেলাম জর্জদা গান গাইছেন। আমাকে দেখে অনন্তদা ঠোঁটে আঙুল চাপার ইঙ্গিতে কোনওরকম আওয়াজ করতে নিষেধ করলেন। দেখলাম ঘরে ধুতি পাঞ্জাবী পরা প্রায় পৌঢ় একজন ভদ্রলোকের পিঠের দিকটা। তিনি হারমোনিয়ামে সংগত করছেন জর্জদার সঙ্গে। হারমোনিয়াম, না বেহালা প্রায় বুঝতেই পারছি না। সে কী অসামান্য কান-পবিত্র-করা বাদন। আর জর্জদা গাইছেন, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’। সে কী আর্তি, সে কী বেদনের উচ্চারিত গায়ন। গেয়েই চলেছেন। বারবার। বিভিন্ন এক্সপ্রেশন-এ গাইছেন আর সঙ্গে ওই অসামান্য হারমোনিয়ামের সংগত। বুঝলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরেই গানটি গাওয়া চলছে। আর যিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন তিনি মাঝে-মাঝে বেলো ছেড়ে তাঁর বাম হাতের ওপরের দিকটা নিজের মুখের কাছে উঠিয়ে নিচ্ছেন। পরে বুঝেছিলাম, চোখ মুছছিলেন। 

গান থামল। চোখ-ভরা জল নিয়ে দু’জনে দু’জনের হাত চেপে আছেন। আমার চোখেও জল। আলাপ করিয়েছিলেন সেই পুণ্যশ্লোক মানষটির সঙ্গে। সুযোগ পেলাম তাঁর চরণ স্পর্শ করার। সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।

তোতলামিটা জর্জদা সারিয়েছিলেন। অসামান্য একটি উপায়ে। একদিন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বইটি আমার হাতে দিলেন। যেখানে বসতাম, তার ডানদিকের র‍্যাকে বইটি ছিল। দিয়ে বললেন, বিভিন্ন লয়ে লেখাটি অর্থাৎ চতুর্দশপদী ছন্দোবদ্ধ কাব্যটি আওয়াজ করে 
জোরে-জোরে tail drop না করে সচেতনভাবে পড়ুন ও প্র্যাকটিস করুন। 

মাস 'ছয়েক বিভিন্ন লয়ে প্র্যাকটিস করার পর দেখলাম তোতলামিটা আর সেভাবে নেই। গলার আওয়াজটাও বদলে গিয়েছে। যে কথা বলার জন্য বিড়ম্বিত হতাম সেই কথাই রূপান্তরে মানুষের ভাল লাগার কারণ হয়ে উঠেছে। ওঁরই চিঠি নিয়ে ‘আকাশবাণী ভবন’-এ যাই অডিশন ফর্ম দিতে। কিন্তু জর্জদাকে আমার বেতার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ শোনাতে পারিনি। কারণ ততদিনে জর্জদা আমার হাত ছেড়ে দিয়েছেন। 

১৬ই অগাস্টে শেষ গিয়েছিলাম ওঁর কাছে।

১৮ই অগাষ্ট সকালবেলা আমার মা আমাকে সাতটা নাগাদ ডেকে দিলেন। আমি সাড়ে সাতটার আগে ঘুম থেকে উঠতাম না। উঠিয়ে বললেন, চা-টা খেয়ে নাও। মা-বাবার মুখটা থমথমে। ছোট বোনও ঘুম থেকে উঠে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম না। মুখ ধুয়ে, চা খেতে-খেতে ‘স্থানীয় সংবাদ’-এ খবরটা শুনলাম। 

মুহূর্তে বাড়ির পোশাক বদলে একছুট। খালি পা, ছুটে সর্দার শংকর রোডে আমার বন্ধু রাহুল সেনের বাড়ি। ও বলল, তুই এগো, আমি আসছি। আর একছুট – গলির মুখে প্রচুর ভীড়, ভীড় সরিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতে গিয়ে একজনের পেটে আমার ধাক্কা লাগল। ভীষণ ভারী গলার আওয়াজ তাঁর। ‘অ্যাই, ঠিক করে’—তাকিয়ে দেখলাম সত্যজিৎবাবুকে, পাশে রুমা গুহঠাকুরতা, পিছনে জ্যোতিবাবু। পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলাম। প্রচুর মানুষ। ন্যাশনাল প্যানাসোনিক-এর চ্যাপ্টা টেপ রেকর্ডারে বাজছে ওঁর গলা ‘তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই’। আওয়াজটা মনে হচ্ছিল, ওঁর বুক থেকে বাজছে। 

আর এক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী উপস্থিত ছিলেন সেখানে। বললেন, মরদেহ ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে রাখা হবে – সেখান থেকে ব্রাহ্মসমাজ হয়ে শ্মশান। প্রতিবাদ উঠল। শরীর রবীন্দ্রসদনে যাবে। গেলোও। রবীন্দ্রসদন থেকে বেরল। আবার ফতোয়া। সেই একই ব্যক্তি। হরিশ মুখার্জী রোড দিয়ে এবার নিঃশব্দ শোকমিছিল। ঠিক করে ফেললাম, আমি কি করব। অনেক পরিচিত মুখ। মিছিলের একদম সামনে আমি, কিছু চেনা মানুষ, মাঝে বিখ্যাত লোকরা, নাটকের, গানের। পিজি হাসপাতাল পেরিয়ে গুরুদ্বারে মিছিলটা পড়ামাত্র আমি একা শুরু করলাম ‘আকাশভরা সূর্য-তারা’। একটু পরেই গানটা হয়ে গেল সমবেত। তখন থেকে ব্রাহ্মসমাজ হয়ে কেওড়াতলা শ্মশান পর্যন্ত গান গাওয়া চলল। কোনও এক অলৌকিক কারণে গান শুরু করছিলাম আমি, তাতে গলা মেলাচ্ছিলেন বাকি সবাই। আমার পাশে ডানদিকে বাঁদিকে জায়গা বদল করছেন সাগর সেন, প্রদীপ ঘোষ, হেমাঙ্গবাবুর ছেলে মৈনাক বিশ্বাস, প্রমুখ। 

গান শেষ হলো মিছিলও শেষ হলো, তার গন্তব্যে। শেষ হলো ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে’ গানটি দিয়ে।


*পুনর্মুদ্রিত