Next
Previous
Showing posts with label রম্যরচনা. Show all posts
8

রম্যরচনা - সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়

Posted in


রম্যরচনা



বেণীমাধবের হয়রানি
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায় 



বেণীমাধব সাতজম্মে পেস্ট মুখে তোলেনি। রোজ সকালে ঝাড়া তিরিশ মিনিট একখানা নিম দাঁতন মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বাগানের পাকা পাতা, পোকাধরা পাতা বেছে ঝেড়ে তারপর নিজের চান জলখাবার সেরে দোকানে গিয়ে বসে। সারাদিনের কারবার সামলানোর আগে ওইটুকুই তার বিলাস বল বিলাস, আয়েস বল তো আয়েস। কিন্তু আজ আর সে সময় নেই। বাথরুমে ঢুকে বউয়ের সায়েবি কেতার পেস্ট থেকে খানিকটা নিমডালে লাগিয়ে ঘসঘস করে দাঁত মেজে গায়ে জল ঢালতে হল। 

খোঁজ পাওয়া গেছে শেষ অব্দি! রানাঘাট যেতে হবে আজই। মীরা স্টোর্সের বিধান গড়াই বলে দিয়েছে রানাঘাটেই বাড়ি তাঁর। ঠিকানা বলতে পারেনি। তবে কিনা তিনি নামী মানুষ। স্টেশনে নেমে গোঁসাইবাড়ি বললে কোন্‌ না একজন রিক্সাওলা নিঘঘাৎ চিনিয়ে নিয়ে যাবে 'খন। বেণী পাঞ্জাবীটা গলিয়ে বুকপকেটের চিরকুটে লেখা নাম দেখে নেয়। জয় গোস্বামী। কাল বিধানদার কাছে একটা বইয়ের পিছনে তার ফটোও দেখেছে। দিব্যি কেমন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী চেহারা, খাপচা দাড়ি গোঁফের জংলা মুখে একখান ছিপছিপে হাসি! এ মানুষটার জন্যেই বেণীর এত আতান্তর!

ট্রেন মোটামুটি ফাঁকাই। ভুলক্রমেঃ ভেন্ডার কামরার পরের কামরাতেই উঠেছে তাই একটা টক টক ছানার জলের গন্ধ মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে মাঝে সাঝে। দুটো স্টেশন পেরিয়েই বসার জায়গায় জুটে যায় একটা। ফিতে চুলের কাঁটা শিশুপাঠ্য চিরুনি ন্যাপথলিন নিয়ে একজন হকার ওঠে। খানিক হইচই লাগিয়ে নিজের জিনিসের গুণাগুণ শোনায়। ছবির কি কিছু লাগবে? মনে মনে ভাবার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বেণীমাধব। একটানা দুলুনিতে ঘুম এসে যায় একটু। 

- দাদা, কদ্দুর যাবেন! পাশের লোক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেণীমাধবের মাথাটা ঝেড়ে ফ্যালার ভঙ্গি করে জাগিয়ে দেয়। 
- একদম শেষ মাথা। রাণাঘাট...
- ওঃ, আমি তার আগে নামব। রাতে ঘুমোন না নাকি?

আর রাতে! বেণীর চোখে জল এসে যায়। কত রাত যে ভাল করে ঘুমোয়নি! সেইইই যে পঞ্চমীতে পাড়ায় পুজো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো, পাশের টাউনের এক মেয়ে বিদ্যা না সন্ধ্যা গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পাড়া ফাটিয়ে- বেণীমাধোওওওব বেণীমধোওওওব তোমার বাড়ি যাবোওও- বলে কবিতা শোনালো, ব্যাসসস... সেই থেকে সংসার জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ছবি ওই কবিতা শুনেই বাড়ি গিয়ে খিল দিল ঘরে। যত বোঝায় আরে আমি ওকে চিনি না! তো সে সমানে বলে, চেন না তো তোমাকে নিয়েই এত চেল্লানি কিসের! ক্যানও আর কোন ভাল কবিতা ছিলনা! তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে কিংবা মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে, মা কে' নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে... এসব কি বইতে নেই! 

ছবি নিজের গাঁয়ে ক্লাস ফাইভ পাস। কবিতা কি সে পড়ে নি! না জানেনা! ওইরকম বুক ফেটে কেঁদে কেঁদে বেণীমাধওওওব ডাক কোন বইতে কোনদিন দ্যাখে নি তো! পাঁচ বছরের বিয়ে। প্রতি বছর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে ছবি নতুন পাটভাঙ্গা শাড়ি পরে বরের সঙ্গে রিকশো করে ওদের গাঁয়ে আর লাগোয়া সদরটাউনে ঠাকুর দেখেছে। এবার ওই এক বিচিত্রানুষ্ঠানের জ্বালায় গোটা পুজোটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। ছবি এই ক'দিন ভাল মুখে কথা বলেনি। ভাতের থালা, মুড়ির বাটি এমন ভাবে সামনে ধরে দিচ্ছে যে ভাত মুড়ি কোলে ছিটকে উঠছে। এসব তবু যা হোক সইছিল, কিন্তু কাল দুপুরে দোকান থেকে ফিরে দেখে বউ তপতপে মুখে সুটকেশ গোছাচ্ছে। কিসের গোছগাছ জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল এমন পরঢলানে পুরুষমানুষের ঘর করার থেকে বাপের ভিটেয় গিয়ে নাকি গলায় দড়ি দেওয়াও সম্মানের। রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল সকালে মধুকে দিয়ে পাঠানো পাকা জ্যান্ত রুইটা মরা কাঠ হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। রান্নাবান্না কিছুই হয় নি। 

পর পর তিনটে প্রশ্ন একসঙ্গে বেণীর মাথায় ভীড় করে এল ... মাছটা এখনও বেড়ালে নেয় নি কি করে? দুপুরে খাওয়া দাওয়া কি আদৌ জুটবে না? আর সবচেয়ে মোক্ষম প্রশ্নটা হল গলায় দড়ি দিতে হলে বাপের বাড়ি গিয়ে কেন? ওদের গাঁয়ে কি বড় গাছ নেই! শেষ প্রশ্নটা ভেবেই বেণীমাধব নিজেকে দু গালে চড়াল। এসব কথাও মাথায় আসে এই আপৎকালে! ভেবে ভেবে অশান্তি সামলে সামলে মাথাটাই আউলে গেছে এক্কেবারে। এই সংসারে আবার ঘুম! 

তা এসব কথা তো অচেনা মানুষকে বলার না। বরং একবারে যাকে বলার তাকেই বলবে খন। বেণী নড়েচড়ে উল্টোবাগে ঘাড় হেলিয়ে ঝিমোতে ঝিমোতে স্বপ্নের মধ্যেও ছবির তপতপে মুখ আর কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে সুটকেস গোছানোই দেখতে পায়।

স্টেশনে নেমে এক্কেবারে ব্যোমকে গেল বেণীমাধব! বাপরে বাপ! কী লোকজন! বাইরে বেরুবার সময় চেকার হাত পাতার সময় পাচ্ছে না টিকিট নিতে। হুড়হুড় করে লোক বেরোচ্ছে। ধাক্কায় ধাক্কায় বেণীও বেরিয়ে আসে। একটু আফসোস হয়। অ্যাঃ, আগে জানলে টিকিট কাটতোই না। কেউ চেক করল না, এদিকে ফালতুতে খানিক পয়সা বেরিয়ে গেল! বেলা এগারোটার রোদ্দুর মাথায় চড়ে নাচছে। এদিকে কোন রিক্সাওলাই গোঁসাইবাড়ি চেনে না। একজন ভ্যানওলা অবশ্য এক গোঁসাইবাড়ির হদিস দিল। সে বাড়িতে নাকি এক বুড়ি থাকে তার নাতনী নিয়ে। বাড়ির সামনের দালানে গৃহদেবতার ভাঙা দেউল আছে। বছরে তিনটে পূন্নিমায় সিন্নি হয় তাদের। পুজোর জিনিস সামজ্ঞিরি সেই বুড়ি ওই ভ্যানওয়ালাকে দিয়েই আনায়। ওই একটাই গোঁসাইবাড়ি নামকরা। তবে জয়বাবু গোঁসাই বলে যে কেউ সে বাড়িতে নেই, তাও সে হলফ কেটে বলে দিল। 

বেলা গড়াচ্ছে ওদিকে এদিকে পেটে যেন পালোয়ানের মুগুর পড়তে শুরু করেছে! সকালের দুটি মুড়ি কোথায় তলিয়ে গেছে কে জানে! স্টেশনের রাস্তা ধরে ক'টা কচুরি জিলিপির দোকান। তার মধ্যেই একটু পরিষ্কার দেখে একটা দোকান বাছল বেণীমাধব। পেটে খিদে নিয়ে খোঁজার মানে নেই। গরম গরম পাঁচটা কচুরি কুড়ি টাকা। দুপ্লেট কচুরি খেয়ে মনটা একটু শান্ত হল বটে। দোকানদার লোকটা বেশ ভদ্রমত। দ্বিতীয়বার অর্ডার করার পর মাথার ওপরের পাখাটার একটু স্পিড বাড়িয়ে দিল। ক্যাশে পয়সা দিতে গিয়ে বেণীমাধব নিজেই একবার কথাটা পাড়ল... 

- মশাই এখানে গোঁসাই বাড়ি কোথায় চেনেন? 
- কি গোঁসাই? পুরো নাম জানেন? 
- জয় গোঁসাই 
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক ... নাম তো শুনিনি। কিসের ব্যবসা?
- ওই লেখালেখি ...
- বইয়ের দোকান? দোকানের নাম জানেন?
- আরে না, ভদ্রলোক কবিতা লেখেন...

দোকানদারবাবু একবার ওপর থেকে নিচ জরিপ করে নিয়ে হাত বাড়ালেন "চল্লিশ হয়েছে ... না মশাই ... ওর'ম কারুর বাড়ি চিনিনা"
তবে! কেউই চেনে না! বড় আশা নিয়ে এসেছিল যে জয়বাবুকবিকে বলবে ওই কবিতাটায় বেণীমাধব কেটে আর যা খুশি নাম বসিয়ে দিতে। দরকার হলে নিজের পয়সায় পাল্টানো নামের কবিতাটা নতুন করে ছাপিয়েই দেবে হাজার কপি। শুধু যেন বেণীমাধব নামটা লোকে ভুলে যায়, ব্যাস...

পকেটে মোবাইলটা কেঁপে ওঠে। বাড়ি থেকে হয়ত! শেষ অব্দি ছবিই কি... 
নাঃ , বিধানদা... 

- বেণী, তোর যে আজ রানাঘাট যাওয়ার কথা ছিল 
- হ্যাঁ, আমি রানাঘাটেই কিন্তু এখানে কেউ ওই গোঁসাইবাড়ি দেখাতে পারছে না। এ জায়গাও বিশাল। কেউ কারো খোঁজ জানেনা... 
- আরে শোন, উনি বোধহয় এখন আর রানাঘাটে থাকেনও না। আমার দোকানে একটা ছেলে আসে। এই সব কবিতার বই টই নেয় মাঝে মাঝে। ওর কাছে জানলাম উনি নাকি রানাঘাট ছেড়ে চলে গেছেন... হয়ত কলকাতায় থাকেন। বিখ্যাত মানুষরা তো কলকাতাতেই থাকে সবাই... 
- অ্যাঁ! চমকে হাত থেকে ফেরত দশ টাকাটা পড়ে যায়। কলকাতায়! হা ভগবান! তবে খুঁজব কেমন করে! 
- সে দেখা যাবে, তুই ফিরে আয়। আর রানাঘাটে ঘুরে কি হবে!

ফেরার পথে ট্রেনে বেশ ভীড়। কোনওরকমে একটা কোণ খুঁজে নিজেকে সেট করে নেয় বেণীমাধব। লোকটার আক্কেল দেখ! কী এক কবিতা লিখে বেণীর জীবন অতিষ্ঠ করে নিজে কলকাতায় গিয়ে বসে আছে! এদিকে বেণীর সংসার ভেঙ্গে খানখান হতে বসেছে তা কে বোঝে! 

বাড়ি ফিরতেও ভয় লাগে। ট্রেন থেকে নেমে আগে বিধানের দোকানেই যায় 

- কি রে? ফিরলি? শোন, ওই ছেলেটা বলল বটে কলকাতায় থাকে ভদ্রলোক কিন্তু ঠিকানা টিকানা তো জানে না... তাছাড়া তুই তার সঙ্গে দেখা করেই বা কি করবি? কি বলবি! শুনলাম ওনার ওই কবিতা নাকি খুব বিখ্যাত। ক্যাসেট রেকর্ডে অনেক বিখ্যাত মহিলারা নাকি ওই কবিতা গান গেয়েছে আবৃত্তি করেছে! 

ওরে বাবা! আরও মেয়ে? বেণীমাধবের আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে! শ্বশুরবাড়ির খিড়কির পাশের নিমগাছে ডুরে শাড়ি পরা চোখ ঠিকরনো ঝুলন্ত ছবিকে দেখতে পায় পষ্ট। 

- কি হল রে! চুপ মেরে গেলি কেন? তুই তো বিখ্যাত রে বেণী!

কোন কথা না বলে ধুলো পায়ে নীতিন উকিলের বাড়ির দিকে দৌড় দেয় বেণীমাধব। আর ভাবার সময় নেই। এখন একমাত্র উপায় হল বাপ মায়ের দেওয়া নাম পালটে ফেলা। গোঁসাইকবিকে খোঁজার আগেই ছবি যদি ওসব ক্যাসেট রেকর্ডের কথা জানতে পারে তো কুরুক্ষেত্র করবে। তার চেয়ে একটা যাহোক কিছু নাম পছন্দ করে নিজেকে বাঁচাতে হবে... যত তাড়াতাড়ি সম্ভব...
0

রম্যরচনা - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in




রম্যরচনা


যাদব চক্কোত্তির ইতিকথা
পিনাকী চক্রবর্তী



ডিমের নীচের পাটীর সামনের একটা দাঁত দুইদিন ধরে নড়ছে। ব্যাটা আমাদের আগে বলেনি। বললে কিছু করে দেখা যেত, দু’একটা ঘুঁসি মারলে পড়বে না – এমন দুধের দাঁত আমাদের অন্তত দেখা নেই। তবে কিনা, আমাদের দুধের দাঁতের কারবার চুকেবুকে গেছে অনেকদিন আগেই। ডিম ব্যাটা দেখতেও ছোটখাট, আর ওর ধরণধারণও বাচ্চাসুলভ। ওই জন্যেই ওর নাম ডিম, মানে এখনও ডিম ফুটে বেরোয়ই নি। আর তাই বোধহয় ওর এতদিন পরে দুধের দাঁত নড়ছে। তাও সবে নড়ছে, কিন্তু পড়ছে না!

যাই হোক, সেদিন সকাল থেকে ডিম একমনে জিভ দিয়ে ঠেলে যাচ্ছে দাঁতটাকে। সকালবেলা ক্লাস টীচার, ফাদার ওয়াভরেইল, ইংরিজী পড়ালেন, বেঁটে মস্তান ফিজিক্সের ক্লাস নিয়ে গেলেন, সান্যাল স্যার বাঙলা না পড়িয়ে ট্র্যান্সলেশন করালেন – ডিমের ধ্যান জ্ঞান সব ওই দাঁতেই আটকে থাকলো। কিন্তু দুঃখের কথাটা হল, এত চেষ্টা চরিত্র করে অনেকটা বেরিয়ে এলেও পুরোটা উপড়ানো হল না ওর সেই ইনসাইজর না কি যেন বিটকেল নামের দাঁতটাকে।

ওর পাশে বসতো শুভঙ্কর, আর একটা ছোটখাটো ছেলে, ফার্স্ট বেঞ্চে। আমাদের স্কুলের নিয়মে হাইট অনুযায়ী ছেলেদের বসানো হত ক্লাসে। আমাদের মতো তেঢ্যাঙ্গা লম্বুদের জায়গা ছিলো লাস্ট বেঞ্চ, তা সে বাপু তুমি যতই ভালো স্টুডেন্ট হও না কেন। আর আমার পাশে বসতো সব মার্কামারা ত্যাঁদড় পার্টী, টিপিকাল লাস্ট বেঞ্চার। আমি নিজে কেমন ছিলাম, সে কথা আর নিজের মুখে নাই বা বললাম।

তা, সেদিন টিফিনের সময় শুভঙ্কর আমাদের জানালো ব্যাপারটা। আমরা সোৎসাহে ডিমকে খুঁজতে বেরোলাম, ওর সব দাঁত আমরাই পারি সেরেফ খালি হাতে উপড়ে দিতে। কিন্তু সেই ভয়েই বোধহয় ব্যাটা বাথরুমে বা অন্য কোথাও লুকিয়ে কাটিয়ে দিলো পুরো টিফিন টাইমটা। ওর টিকির দেখাও পেলাম না আমরা। পরে আফসোস হল কম না, ওর ইঁদুরে দাঁতের জন্যে আমাদের একদিনের বাস্কেটবল খেলাটা বাদ পড়ে গেল। এতটা বন্ধুবৎসলতা মাঠেই মারা গেল। ধূরররর...

টিফিনের পরের ক্লাসটাই ছিলো অঙ্কের। পড়াতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ এস পি বি। কাঠ বাঙাল ভদ্রলোক, প্রচণ্ড অ্যাকসেন্টেড ইংরিজীতে পড়াতেন... ‘‘ল্যাট অ্যা পইন্ট পি মুভ টু দ্যি পইন্ট পি ডেশ, শাচ দেট ইটশ ডিশটানশ ফ্রম দি পইন্ট অ্যা রিমেইনশ কনোশট্যান্ট... এ্যই যে ছুকরা, তুমার মিক্ক্যানিকশ পড়া অইত না, তুমি বিওলজি পড়গা যাও...’’ ইত্যাদি। ফাদারেরা কি করে ওনার কথা বুঝতেন কে জানে ? ওঁর ভয়ে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। অল্পেতেই রেগে যেতেন, ক্ষেপে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতেন। হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে পিটতেন। মেজাজ খারাপ থাকলে বোর্ডে অঙ্ক কষতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলতেন, এবং যেদিন এই ঘটনা ঘটতো, সেদিন কেউ না কেউ অনিবার্য ভাবে ঠ্যাঙ্গানি খেত। শোনা যায়, ইনি বাড়ীতে পুরোদস্তুর মেনী বিড়ালের রূপ ধারণ করে থাকতেন, এবং আমাদের ওপর ব্যাঘ্রঝম্পনটা নাকি ওঁর এই জবরদস্তি মেকুড়িপনার রিকয়েল এফেক্ট। স্কুলের কাছেই থাকতেন বলে অনেক ছাত্র ওঁকে পাড়াতুতো ভাবেও জানতো, আর তাই আমাদের ওঁর পারিবারিক অনেক কথাই জানা ছিলো, যদিও সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতেই পারে। একটা প্রচলিত কাহিনী ছিলো এইরকম, আমাদের গুরুমাতা, যাঁর নাম কমলা, তিনিও নাকি অঙ্কের ছাত্রী ছিলেন এবং স্যারের থেকে অনেক ভালো ছাত্রী ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসার ছিলেন, তা থাকুন। কিন্তু স্যারের না পারা অঙ্কগুলো নাকি ম্যাডাম বাড়ীতে সলভ করে দিতেন। কি কারবার, দেখুন দেখি...!!!

যাই হোক, সেদিন স্যারের মেজাজটা দারুণ খারাপ। একটা অঙ্ক বোর্ডে তিনবার সলভ করার চেষ্টা করলেন, তিনবারই ঘষ ঘষ করে মুছে ফেললেন। শেষবার চেষ্টা করতে করতে আবার মুছবেন কিনা ভাবছেন, ডানহাতে যাদব চক্কোত্তির গাব্দা পাটিগণিত বইটা ধরা, বাঁ হাতে টেবিল থেকে ডাস্টারটা তুলে নিয়ে গভীর চিন্তার সাথে বোর্ডের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখছেন অঙ্কটাকে আপাদমস্তক। এর মধ্যে হঠাৎ ঢ্যাঙ্গা পার্থ (একটা বেঁটে পার্থও ছিলো, তাই এরকম নামকরণ) হুবহু স্যারের গলা নকল করে বলে উঠলো, “...ইশশশ, অখন কি অইবো কও দেহি, কোমোলা...?”

ক্লাসের মধ্যে দিয়ে একটা হাসির হররা একটা ঝোড়ো হাওয়ার মতো হুশ করে বয়ে গেল। পরমুহূর্তেই সব চুপচাপ, একটা পালক পড়লে শব্দ শোনা যাবে – এমন নিস্তব্ধতা। স্যার বোঁ করে ঘুরলেন...

...এবং তাঁর চোখে পড়ল ডিমের হাসিমুখ। ডিম কিন্তু হাসছিলো না। আপনারা জানেন, আমরাও জানতাম যে ডিম প্রাণপণে তার নীচের পাটীর ইনসাইজরের গোড়ায় জিভ দিয়ে ঠেলছিলো। কিন্তু স্যার এটা জানতেন না। এই জিভ দিয়ে দাঁত ঠেলাঠেলির সময়ে দন্তপাটী বিকশিত করে রাখতে হয়। নাহলে দাঁতের ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট ব্যাহত হয় – তখন ঠেলাঠেলিতে কোন কাজ হয় না। কিন্তু ওই বিকশিত দন্তরুচী দেখলে যাঁরা ওয়াকিফ-এ-হাল নন, তাঁরা পষ্ট দেখবেন দাঁত কেলানে হাসি। স্যার তাই দেখলেন...

একটা জান্তব হুঙ্কার শোনা গেল ... তার পরেই একটা প্রশ্ন ... “এত হাসি ... হাসি ... হাসো কেনো?” এবং জবাবের জন্য বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে ডানহাতে ধরা যাদব চক্কোত্তির পাটিগণিত বইটা স্যার ছুঁড়ে মারলেন ডিমের দিকে।

ডিম অবশ্য এত কিছু জানতো না, বুঝতেও পারে নি যে কি ঘটতে চলেছে। স্যারের অঙ্ক আটকানো, ঢ্যাঙ্গা পার্থের কমেন্ট, ওর হাসিমুখ ... এইসব কথা বোধহয় ও আজও জানে না। যদি আমার এই লেখাটা পড়ে, তবে হয়তো বুঝবে। সেদিন সকাল থেকে ও ওর মনপ্রাণ নিয়ে ওর পড়েও না পড়া দাঁতের মধ্যে ঢুকে ছিলো। দাঁত ছাড়া প্রথম যে বস্তুটি ওর মাথায় সেদিন ঢুকেছিলো, মানে ঠিক না ঢুকলেও... ঢোকার চেষ্টা করেছিলো, সেটি হল যাদব চন্দ্র চক্রবর্তীর পাটিগণিত বইটা।

যাদব চক্কোত্তির পাটিগণিত বইটার ওড়ার ক্ষমতা সাধারণ ভাবে একটা থান ইঁটের সমান। কিন্তু বইটার শিরদাঁড়া বরাবর পাকড়ে ধরে সীম বোলারের মত ছুঁড়লে এর ব্যবহারটা একটু অন্যরকম হয়। একটু উড়েই বইয়ের হার্ড কভারের মলাট দুটো ডানার মতো খুলে যায়, আর বাকী বইয়ের পাতাগুলো লতপত করে ওড়াউড়ি করে এয়ার স্পীডটা অনেকটা কমিয়ে আনে। নয়তো ওইদিন ডিম ভেঙ্গে যেত। ওর কপালজোরে, সেই লতপত করা অংশটা ওর টেবিলে পড়ে সামান্য লাফিয়ে ওর পতনোন্মুখ দাঁতের গোড়ায় সরাসরি আক্রমণ করে। আর ওর দু’তিনদিনের চেষ্টায় যা হয় নি, সেই দাঁত কোন এক অদ্ভুত কায়দায় নাটকীয় ভাবে টেবিলের সামনে এসে পড়লো (ভেতরদিকে গিয়ে, গলা হয়ে পেটে চলে যাওয়া উচিৎ ছিলো, আমার মতে, যাই হোক...)। কিছুটা কাঁচা ছিলো বলে খানিকটা রক্তও বেরিয়েছিলো, তবে একটা স্ট্যান্ডার্ড দাঁত ফেলতে যতটা রক্ত বেরোয়, তার থেকে বেশী না ... ডিম যাদব চক্কোত্তির ওপর মাথা রেখে পতন ও মূর্ছা গেল ... না, না, পতন না, তবে খানিকটা ঢপের মূর্ছা গেল ...

মিশনারী স্কুলে যা সাধারণত হয় না, এর পর আমাদের ক্লাসে তাই হল। প্রথম থেকে শেষ বেঞ্চের ছাত্রের দল সবাই সীট ছেড়ে উঠে উঠে ডিমকে দেখতে এল। সবচেয়ে আগে এলো বসন্ত কুমার, আপনার আমার থেকে বেশী তুখোড় বাঙলা বলা মারোয়াড়ী। ছিপছিপে, শ্যামলা বরণের ছটফটে ছোকরা, টিপিক্যাল মারোয়াড়ীর টোটাল অ্যান্টিথিসিস। শুধু সেই বয়েসেই সমস্ত দাঁত আর ঠোঁট পানের ছোপধরা। এসেই চিল চীৎকার ছাড়লো, ‘‘স্যার, কি করলেন স্যার, ছেলেটাকে মেরে ফেললেন ? কি রক্ত, স্যার, কি রক্ত! মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছেন স্যার, ও আর বাঁচবে না!!!’’

স্যারের অবস্থা দর্শনীয়! পোডিয়াম থেকে নেমে ভীড় ঠেলে ডিমের কাছে পৌঁছে ওকে তুললেন যাদব চক্কোত্তির কোল থেকে। তার পর মনিটরকে বললেন জল আনতে। তারপর ডিমের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগলেন, ‘‘এতো হাসো কেনো বোলোতো, ক্লেশের মধ্যে...?’’ ডিম বোঝাতে গেল যে ও হাসছিলো না আদৌ, এ বাবদে ওর কোন দোষ নেই, কিন্তু দন্তবর্ণগুলো সব ফসকে যেতে লাগলো সদ্য ভাঙ্গা দাঁতের ফাঁক দিয়ে। বসন্ত এর মাঝে ডিমের পিঠে এক মোক্ষম চিমটি কেটে ইশারায় ওকে চুপ করতে বললো। আর, জীবনে অন্তত একবার বসন্ত আর স্যার একমত হলেন। ডিমের মাথায় হাত বুলিয়ে স্যার বললেন, ‘‘কোথা বোলো না, কোথা বোলো না, কোষ্টো বাড়বে...’’

এরপর মনিটরকে সাথে দিয়ে ডিমকে পাঠানো হল ইনফারমারি (মিনি ফার্স্ট এইড কেন্দ্র বলতে পারেন)। স্যারের সাময়িক অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বসন্তও গেল ডিমের সাথে সাথে। ডিমকে বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এটা ধরে নিয়ে বসন্ত হিসেব কষে ফেলেছিলো, ও আর ডিম একই পাড়ায় থাকে, সুতরাং ওর ওপর ডিমকে বাড়ী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সে কথাটা ও ফাদার প্রিফেক্ট-কে জানিয়েওছিলো (ফাদার প্রিফেক্ট ডিসিপ্লিন মেন্টেইন করার ভারপ্রাপ্ত পাদরীবাবার পদ)। ফাদার বলেছিলেন অফিসের থেকে একজন করণিক গিয়ে ডিমকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। বসন্ত ক্ষীণ আপত্তি জানিয়ে বলেছিলো, যিনি যাবেন, তিনি তো ডিমের বাড়ী চিনবেন না। ফাদারের বক্তব্য, ডিম নিশ্চয়ই চিনবে নিজের বাড়ী, ঠিক যেমন বসন্তের এখন চিনে ফেলা উচিৎ তার ক্লাসের রাস্তা। যাই হোক, ডিম গেল ট্যাক্সি চড়ে বাড়ী। বসন্ত ফিরলো ক্লাসে।

ডিমের এই অসাধারণ স্বার্থত্যাগের (দন্তত্যাগের?) ফলে আমাদের সে বছরটা অঙ্ক ক্লাসগুলো কেটেছিলো তুলনামূলকভাবে নিরুপদ্রবে। কিন্তু তাও আমি বলি কি, শিক্ষকদের স্কুলের পাড়ায় বাড়ী ভাড়া করে থাকা উচিৎ নয়... নিজেদের স্বার্থেই। নিজগুণে বুঝে নিন আপনারা, কেন আমি বললাম এ কথাটা...
0

রম্যরচনা - গৌতম দত্ত

Posted in








রম্যরচনা



কৌণ্ডৈ
গৌতম দত্ত



কর্মজীবনের শেষ দিকে দাঁড়িয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে যায়।

কত রকম আলোচনা, গল্প-কথায় কেটে যেতো সেই প্রথম জীবনের দিনগুলো। দাদাদের সস্নেহ প্রশ্রয়ে একটু একটু করে সিনিয়র হচ্ছিলাম। বস্তুতপক্ষে, আমার জীবনের দোলাচলে এই অধ্যায়টুকু না থাকলে জীবন হয়তো অন্যরকম হতো। প্রায় আটত্রিশ বছরের টানা কর্মজীবনশেষ হতে চলেছে। এর মধ্যেই আমায় ঘুরতে হয়েছে আমাদের কলকাতার নানা অফিসে। কিন্তু আমার প্রথম জীবনের সেই “ডিভিশন এইট” এর স্মৃতিগুলো চিরটাকাল আচ্ছন্ন করে রাখবেই আমার মানসপট। আমাদের ইন্স্যুরেন্সে’র অফিসগুলো মূলত ডিভিশন আর ব্রাঞ্চেই পরিব্যপ্ত। এছাড়া রয়েছে রিজিওনাল অফিস আর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’র মতো এইচ ও বা হেড অফিস।

তা আমার চাকরীজীবনের প্রথম বিশ বছর কেটেছে ওই ডিভিশন আটেই। আগেই বলেছি, সেটা ছিল সেটা বার্ড কোম্পানীর প্রাক্তন ইন্স্যুরেন্স সেকশন। ডালহাউসি এলাকার একটি প্রাচীন স্থাপত্যের বাড়ি, নাম ‘চার্টাড ব্যাঙ্ক বিল্ডিং’।

কত দাদা তখন। সে অবসরের কাছাকাছি বয়স হলেও দাদা। আর আমার সৌভাগ্য এই যে এই সব দাদাদের অকুন্ঠ ভালবাসায় ঋদ্ধ হয়েছি বারংবার যা এখনো অটুট রয়েছে। কিন্তু সেইদিনগুলোর মতো আড্ডা আর তো ফিরে আসবে না কোনোদিন। তাই আমার স্মৃতির ঝুলি থেকে কিছু বেড়াল না হয় বারই করে, আপনাদের শোনাই।

এ ঘটনাটা যাঁর মুখ থেকে শোনা, ধরে নিন তার নাম অমল বা বিমল অথবা কমল কিংবা ইন্দ্রজিৎ। একটা নাম খুব কমন ছিল আমাদের অফিসে, আর তা ছিল হারাধন। হারাধন এক, হারাধন দুই, হারাধন তিন এইভাবে সিনিয়রিটি অনুযায়ী ছিল দাদাদের নাম। বলা বাহুল্য তখনো সেই রক্তকরবীর মতো “৬৯ এর ঙ”-র কোড আমাদের আসে নি। সেটা এসেছে অনেক পরে, এমপ্লয়ী নাম্বার হিসেবে। আবার কখনো কখনো ঐ হারাধন এক হয়ে যেতেন কালীঘাটের হারু’দা বা বড়বাবু হারু’দা। স্যালারী শীটে কিন্তু ওই এক, দুই, তিনই লেখা হতো। এছাড়া অনেকেরই ডাকনামও আমরা জেনে গেছিলাম আমাদের মেলামেশার সূত্রে। তেমনই এক দাদা ছিলেন আমাদের গল্পের ভাঁড়ার। তিনি ছিলেন আমাদের বাচ্চুদা। 

যাই হোক, এবার আসল কথাটা, মানে গপ্পোটা শোনাই। এটা ওই বাচ্চুদার মুখ থেকেই শোনা। বলি আমার জবানীতে। তা না হলে ঠিক জমবে না।

সেবার বেড়াতে গেলাম কন্যাকুমারী। সেটা ছিল সত্তরের কোনো একটা বছর, আর আমার জন্য তিন বারের বার। ঐ সঙ্গ দিতে যাওয়া আর কি!

যাঁরা গেছেন কন্যাকুমারী তাঁরা নিশ্চই বোটে করে গেছেন বিবেকানন্দ রক। আর তাঁরা অবশ্যই দেখেছেন যে, এটি একটি দ্বীপ আমাদের ভারত ভূখণ্ড থেকে অনতিদূরে। স্বামী বিবেকানন্দ এই ভারতের শেষ ভূখণ্ড থেকেই বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ সাঁতরে গিয়ে উঠেছিলেন এই দ্বীপে। পরবর্তী কালে এই দ্বীপে গড়ে ওঠে একটি স্মারক মন্দির, একটি ধ্যানগৃহ ইত্যাদি। এই দ্বীপে যেতে হলে মোটরবোটে করে ঐ উত্তাল সমুদ্রের ওপর দিয়েই পৌঁছতে হয়। ভারতের ম্যাপে যেমনটি দেখেন, তেমনই দেখা যায় ঐ শেষ ত্রিভুজাকৃতি জায়গাটা, যদি একটু পিছিয়ে দাঁড়ান। বাঁ দিকে বঙ্গোপসাগর, যেখানে ভোরে দেখা যায় সূর্যোদয়। আর ডান দিকে অপরূপ আরব সাগরের বিস্তার। সূর্যাস্ত দেখতে গেলে তাকাতে হয় এই দিকেই। সূর্যাস্তের কিছু আগেই ওই জলের ধারে পড়ে থাকা বিভিন্ন আকৃতির বোল্ডারগুলো ভরে ওঠে মানুষের ভীড়ে। সবাই খুঁজে নেয় কোনো না কোনো একটা বোল্ডার,একটু আয়েস করে বসে সূর্যাস্ত দেখবার জন্য। ফ্ল্যাশের ঝলক আর ক্যামেরার ক্লিকে রোজই এমন সময়ে মুখরিত হয়ে ওঠে ভারতের শেষ প্রান্তের এই নিস্তব্ধপাথুরে সাগরবেলা। এখানেই সূর্যদেব তাঁর লাল গোলাকার শরীরটা আস্তে আস্তে ডুবিয়ে দেন আরব সাগরের লোনা জলে।

এমনই এক বিকেলে আমরা গিয়ে একটু উঁচু বোল্ডারে বসে গল্প করছিলাম। সূর্যাস্তের রঙ তখনো ছড়ায়নি পশ্চিম আকাশে। 

ঘড়ির কাঁটা তার নিয়মেই এগোতে থাকে। আর এগিয়ে আসতে থাকে সূর্যাস্তের সময়। ভীড় বাড়তেই থাকে। আর স্পন্দিত হতে থাকে শব্দের ডেসিবল। সারা ভারতের কত রকম ভাষায় কত রকমের যে আবাহনের ডাক হতে পারে, তা এমন কিছু কিছু জায়গায় বেশ কানে বাজে।

আগেই বলেছি, আমরা ছিলাম বেশ একটা উঁচু বোল্ডারের ওপরে বসে। পিছনে বঙ্গোপসাগরের গর্জন বেজেই চলছিল তানপুরার মতো। আর ঠিক মাঝামাঝি - যেখানে বঙ্গোপসাগর এসে গলা মেলাচ্ছে আরব সাগরের জলে, সেখানে উঠছিল তুমুল জলোচ্ছ্বাস দুই সাগরের ঢেউগুলোর পারস্পরিক সংঘর্ষে। অপরূপ সে দৃশ্য !

জলের হাল্কা ঝাপ্টা সহ্য করেই বসে থাকতে হচ্ছিল সবাইকেই। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে সাজছিল রাঙা আলোয়। নববিবাহিতা বধূটির মতো। উজ্জ্বল সেই লাল রঙ পরিবর্তিত হচ্ছিল কমলায়। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছিল পশ্চিমের দিগন্ত। 

আমার চোখ তখন ঘুরছিল বিভিন্ন মানুষের অদ্ভুত আচরনের দৃশ্যে। যেহেতু এর আগে দুবার দেখেছি এই সূর্যাস্ত, তাই আমি দেখছিলাম সমস্ত প্রদেশের মানুষজনকে পিছন দিক থেকে। সিনেমা হলের মতো। সামনে সূর্যাস্তের দিগন্ত বিস্তৃত স্ক্রীন। আর এই অগণিত মানুষ জন অপেক্ষা করছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। আমার মনে গুনগুন করছিল – 

“সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো
গোধূলির রঙে হবে এ ধরণী স্বপ্নের দেশ তো
তারপরে পৃথিবীতে আঁধারের ধূপছায়া নামবেই
মৌমাছি ফিরে গেলে জানি তার গুঞ্জন থামবেই
সে আঁধার নামুক না, গুঞ্জন থামুক না
কানে তবু রবে তার রেশ তো...”

প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি, ধুতি, শাড়ি, সালোয়ার ইত্যাদির কত বাহার! দক্ষিণী মহিলাদের পিছন থেকে চেনা যায় তাদের মাথায় দুরঙা কবরী দেখে। তামিল ভাষায় এই কবরী কে বলা হয় ‘কৌণ্ডৈ’। সাধারণত একটা সাদা আর একটা অন্য রঙের মালায় সজ্জিত করেন দক্ষিণী মহিলারা তাঁদের খোঁপা। 

মিষ্টি ফুলের গন্ধ ছড়াচ্ছিল তাঁদের মাথায় গোঁজা ওই যুঁই কিংবা বেলীর কৌণ্ডৈ থেকে। আমার চোখদুটো খুঁজতে চাইছিল সুন্দরীদের, কিন্তু তার বদলে হঠাৎ করে চোখে পড়লো এক নধর ছাগল। খুব সম্ভবত পাঁঠাই হবে। সে খুঁজে চলেছে ঐ বোল্ডারের খাঁজে খোঁজে যদি কিছু খাবার মেলে, এই আশায়।

এদিকে সময় এগিয়ে আসছিল। এক ঝলক সূর্যদেব কে দেখে নিয়েই চোখের তারা সার্চলাইটের মতো ঘুরছিল আমার। জনসমাগমে তখন পরিপূর্ণ আরব সাগরের দিকে সব বোল্ডারগুলো। রঙবেরঙের পোষাকে রঙিন তখন গোটা জায়গাটা।

আস্তে আস্তে ডুবছে সূর্য। জলে ঠেকলো লাল গোলার তলার অংশটুকু। তার পর ক্রমশডুবতেথাকলো সাগরের জলের ভেতর। গনগনে সূয্যিঠাকুর তখন জলের ছোঁয়ায় নিস্তেজ হচ্ছেন আস্তে আস্তে। একবারের জন্যে নিস্তব্ধতা সারা জায়গা জুড়ে। যেন ইডেন গার্ডেনে আর এক রান করলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত জিতবে, তার প্রতীক্ষায় সবার ঠোঁটদুটো মিশে আছে পরস্পরের সাথে। প্রহর গোনার পালা বার্স্ট হবার। চীৎকারে গ্যালারী মাতিয়ে তোলার অপেক্ষা যেন, সারা ইডেন জুড়ে।

অবশেষে এল সেই প্রহর। চারদিকে আলো কমে এসেছে। দূর আকাশে অল্প আলো থাকলেও বেশ অন্ধকার অন্ধকার ভাব আমাদের চারপাশে। কথাবার্তা থেমে গেছে চোখের দৃষ্টিতে। পলক পড়ে না কারো। ক্যামেরার শাটারে আঙুলের অপেক্ষা। ঝুপ করে ডুবে গেল সূর্য সাগরের জলে, আর তখনি এক মিশ্র ধ্বনি উঠলো যার যার ভাষায়। ধ্যান ভাঙলো এত মানুষের।

হঠাৎ এক চিল চিৎকার। ভাষাটা দক্ষিণের। সূর্যাস্তের আবেশ ছেড়ে সবার চোখ তখন সেই দিকে। একটি মেয়ে কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না তার খোঁপায় আটকানো ফুলের মালা, সেই পাঁঠাটার মুখ থেকে। সে টেনেই চলেছে ঐ মেয়েটির মাথায় গোঁজা মালা,পেছন থেকে একটা উঁচু বোল্ডারের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে। ছাড়ায় কার সাধ্যি!

মদের নেশা ছূটে যাবার মতো সূর্যাস্তের আবেশ গেল হারিয়ে। জনগনের সমবেত চেষ্টায় অবশেষে মুক্তি পেল সেই দক্ষিণী মেয়েটি।
0

রম্যরচনা : পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


ঘুরন্ত মাথা
পিনাকী চক্রবর্তী



সেই আমলে, মানে সত্তরের দশকে, এখনকার মত প্রফেসরের ছড়াছড়ি দেখা যেত না ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে। একজন, বা কদাচিৎ দুজন প্রফেসর থাকতেন, বাকিরা রীডার, লেকচারার আর ডেমন্সট্রেটর। সবার থেকে সিনিয়র হবার সুবাদে প্রফেসর হতেন বিভাগীয় প্রধান। আর এই দায়িত্বটুকু তাঁকে তাঁর অবশিষ্ট কর্মজীবন ধরে বহন করতে হত। বয়সের ভারে বা অন্য কোনও কারণে তিনি এই ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে নিতান্ত অপারগ হলে তাঁকে প্রফেসর এমেরিটাস গোছের কিছু একটা পদে ভূষিত করে পরের জনকে হেড বানানো হত। মোটামুটি এই ছাঁদেই চলতো ডিপার্টমেন্টগুলো।

আর এখন? শুনুন তাহলে, এখন কি হয়...! ক’বছর আগে মে মাসে কলকাতায় গিয়েছিলাম ভাইঝির বিয়েতে। বিয়ে থা মিটে যাওয়ার পরেও, কিছু না কিছু টুকটাক কাজের জন্যে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম রোজই। একদিন দুপুরবেলা বালীগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এমন বিশ্রী রকম ট্র্যাফিক জ্যামে আটকালাম যে, বিরক্ত হয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম বেলতলার দিকে, প্যাচপ্যাচে গরম মাথায় করে নিয়ে। পথে পুরোনো কলেজ, পুরোনো স্কুল। স্মৃতি বিজড়িত এই রাস্তা, এটার নাম বালীগঞ্জ সার্কুলার রোড না হয়ে মেমরি লেন হলেই ঠিক ছিল। খানিকটা সেই স্মৃতিরই ধাক্কায় বেলতলা যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়ে গোঁত্তা খেয়ে ঢুকে গেলাম সায়েন্স কলেজের ভেতরে।

কলেজের ভেতরে ঢুকতেই একটা বহু পরিচিত স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা ভাব শরীর মন সব জুড়িয়ে দিলো। এক মিনিটেই ফিরে গেলাম সেই গরমের ছুটির দিনগুলোতে, যখন কলেজের থেকে নিখরচায় আরামদায়ক জায়গা গ্রীষ্মের দুপুরে আর কোথাও ছিলো না। ডিপার্টমেন্টের করিডোর দিয়ে হাঁটছি আর এক একটা ঘর বাইরে থেকে দেখে দেখে পুরানো সেই দিনের কথা মনে পড়ছে, মনের ভাবটা এই বৈশাখী দুপুরেও বেশ হৈমন্তী সন্ধ্যার মতো ধোঁয়াশায় মাখোমাখো হয়ে উঠছে, এমন সময়ে অচেনা এক ভদ্রলোক, যাঁকে দেখে মনে হল তিনি গৌরীদার জায়গায় নতুন এসেছেন, মৈথিলী টানের হিন্দিতে পেছন থেকে হাঁক পেড়ে আমাকে একটু দাঁড়াতে বললেন। তারপর কাছে এসে জানালেন যে হেড আমাকে ডাকছেন। কেন হে বাপু, পুরোনো ডিপার্টমেন্টে ঢোকাটা কি বেআইনি, না কি স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে করিডোরে পায়চারি করাটা অন্যায়? অত শত উনি জানেন না, শুধু জানেন যে স্যার আমাকে ডাকছেন...

উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু ইনি জানলেন কি করে যে হেড আমাকেই ডাকছেন? আমি এঁকে চিনিনা, ইনিও নিশ্চয় আমাকে চেনেন না। অন্তত সেই সম্ভাবনা কম। ইনি নবীন, আমি প্রবীণ। ইনি দ্বারভাঙ্গা কিম্বা মধুবনীর বাসিন্দা, আর আমি মুম্বাই নিবাসী গত প্রায় বিশ বছর যাবত। এই শতাব্দীতে এই আমার প্রথম ডিপার্টমেন্টে পা রাখা। বর্তমানে কে হেড আর কেইবা টেল আমার জানা নেই, কারণ আমার সাথে এখন ডিপার্টমেন্টের সম্পর্কটা খুবই অল্প। আর তা ছাড়া বয়েসটা যেমন তাড়াহুড়ো করে ষাটের দিকে দৌড়োচ্ছে, ডিপার্টমেন্টে আমার চেনাশোনা লোকজনের সংখ্যাও তার সাথে তাল রেখে কমে যাচ্ছে, বর্তমানে গোণাগুণতি জনা দুয়েক হবেন হয়তো, মুস্কিলসে। তাই আমার মনে হল এটা এই মৈথিলী ভদ্রলোকের ভ্রান্তিবিলাস। কিন্তু দেখলাম এনার অগাধ আত্মবিশ্বাস। জানালেন স্যার আমাকে দেখেছেন ল্যাব থেকে নিজের ঘরে ফেরার সময় এবং স্বয়ং আমাকে পেছন থেকে দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন আমাকে ডেকে নিয়ে আসতে। কি বিপদ রে বাবা...! একটু যে নিজের মনে স্মৃতিচারণার সাথে পদচারণা করব নিরিবিলিতে, তারও উপায় নেই। তার ওপর স্থানমাহাত্মটা একবার দেখুন, হেড ডাকছেন শুনলে এই বয়েসেও কেমন যেন পেটের মধ্যেটা গুড়গুড় করে ওঠে!

তা ডাকছেন যখন, তখন তো যেতেই হবে! গেলাম গুটিগুটি পায়ে সুবোধ বালকটির মত। ভেতরে ঢুকতে যাব, তো সেই ভদ্রলোক হেঁকে বললেন ওটা না, ওটা না, পাশের ঘরটা। বুঝুন কারবারটা! শুধু হেডই না, এই ক’দিনে হেডের ঘরটাও আমার কাছে সমান অচেনা হয়ে উঠেছে। পাশের ঘরটা তো আমাদের সময় অফিসঘর ছিল, যাকে বলে নৃপেনদার চারণভূমি। অবশ্য, ঘরটা অনেকটা বড় ছিল ঠিকই, হেডের ঘরের থেকেও অনেকটা বড়। কিন্তু তাই বলে এতটাই বদলে যাবে সবকিছু সময়ের সাথে? ঠিক আছে, আমীন, সো বি ইট, তবে তাই হোক, গেলাম পাশের ঘরে। দরজায় টুকটুক করতেই ভেতর থেকে সাদর আহ্বান, এসো এসো পিনাকীদা।

কি রে বাবা, এরকমভাবে তো কোনো হেড জীবনে কখনও অভ্যর্থনা করেন নি? ভেতরে ঢুকে দেখি একমুখ হাসি আর এক গাল কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ নিয়ে বসে আছেন এক চেনা চেনা ভদ্রলোক। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আরে দূর, ভদ্রলোক হতে যাবে কেন, ওটাতো সুশীতল, উরফ্ সিতু। আমাদের থেকে পাঁচ ছ’বছর জুনিয়ার, কিন্তু বাঁদরামোতে আমাদের জ্যাঠামশাই। হ্যাঁ, একবার শুনেছিলাম বটে সিতুটা ইউনিভারসিটিতে পড়াচ্ছে আজকাল। “আরে সিতু, তুই এখানে কি করছিস? উঠে আয়, উঠে আয়। তোদের হেড আমাকে ডেকেছে, এক্ষুণি এল বলে। ওই চেয়ারে তোকে দেখলে বাবার নাম ভুলিয়ে দেবে।” দেখলাম সিতু এখন অনেকটাই সুশীতল হয়েছে, মোটেই ঘাবড়ালো না। উলটে আমাকেই প্রবোধ দিল – “কিছু বলবে না, পিনাকীদা, তুমি বসো।”

বসলাম বটে, কিন্তু কেমন যেন একটা সন্দেহ হল। বললাম ‘‘হ্যাঁ রে, তুইই কি এখন হেড নাকি?’’ সিতু মিষ্টি করে হাসলো। আমি অবিশ্বাসভরে বললাম, “তোর থেকে ঢের ঢের সিনিয়র লোকের নাম দেখলাম ওদিকের দরজাগুলোতে। তাদেরকে ছাপিয়ে তুই হেড? কেন, তুই কি ভিসির নাতজামাই? তোকে হেড বলে মানে ওরা? চালাস কি করে ডিপার্টমেন্ট?” সিতুটা হেড হোক বা নাই হোক, বেশ জ্ঞানীগুণী হয়ে উঠেছে। চট করে হাসিটা বন্ধ করে কলৌ মলৌ করে কি সব সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতে লাগলো। আমি চটে গিয়ে বললাম “তোর লজ্জা করে না, ব্রাহ্মণসন্তানকে ডাকিয়ে আনিয়ে মন্তর পড়ে ঘায়েল করছিস?” সিতু বললো, ‘‘মন্ত্র পড়ে সত্যযুগে ঘায়েল করা যেত, কিন্তু ত্রেতাযুগে তন্ত্রের দরকার হয়ে পড়লো, দ্বাপরে কৌশলো কিরি কাজ হাসিল করা হত আর এখন এই চার পো কলিতে প্রয়োজন হয় টীমওয়ার্কের। এই আপ্তবাক্যটাই বলছিলাম তোমাকে, তা তুমি তো শুনলেই না!’’

আমি বললাম, “হেডেদের বুঝি পাতি বাংলায় কথা বলতে মানা আছে? তুই এখানকার হেড না হয়ে সচ্ছন্দে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হতে পারতিস। যাই হোক, এখন পরিষ্কার করে খুলে বলতো কেসটা কি?” 

সিতু বললো, ‘‘কেস গুরুচরণ...! আমাদের আজকাল খুব মাথা ঘোরে।’’

“সে কি রে? মাথা ঘোরে মানে? সকলের একসাথে মাথা কি করে ঘুরবে? ইয়ারকি মারছিস আমার সাথে?”

সিতু বললো,‘‘ইয়ারকি না পিনাকীদা, এটা একটা খুব খারাপ ধরণের সংক্রামক রোগ। সকলেরই হয়, এর নাম রোটেশনাল হেড, গোদা বাংলায় ঘুরন্ত মাথা। মানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবারই হেড হবার সুযোগ পাওয়া। যদি তুমি আজ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হয়ে ঢোকো, তবে আট দশ বছরের মধ্যে তুমিও বিভাগীয় প্রধান হতে পারবে, তবে কিনা মাত্র দু’বছরের জন্যে। দুই বছর পরে আবার পুনর্মূষিকোভব। এই গণতান্ত্রিক মাথা ঘোরা রোগটা মহামারীর মত দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।’’

“দুই বছর পরে আবার পুনর্মূষিকোভব, মানে? হেড থেকে একেবারে আবার টেইল? প্রেস্টিজে একেবারে গ্যামাক্সিন, যাকে বলে...! কিন্তু তারপর?” সিতু মাথা নেড়ে সায় দিলো হেড থেকে টেইলের কথাটায়, আর দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে সাধুবাবাদের মত আবার শুরু করলো, “পুনরপি জননম, পুনরপি মরণম, পুনরপি জননী জঠরে শয়নম ...” আচ্ছা, রোটেশনাল হেড সিস্টেমটা চালু হবার পর থেকে কি জিওলজির ক্লাসগুলো সংস্কৃতে নেওয়া হচ্ছে? 

“থাম তুই,” আমি ওকে জোরসে দাবড়ানি দিয়ে থামালাম। “আজ সকালে দাড়ি কামাস নি কেন? ভারিক্কে দেখানোর জন্যে ? তা দাড়িই রাখ আর যাই কর, তোকে তো সবাই হাড়ে হাড়ে চেনে। দু’দিনের হেড হয়ে বসা তোর মত একটা বাচ্চা রীডারের কথা এক একজন প্রবীণ প্রফেসর মানেন?” 

সিতু বললো, ‘‘এতে মানামানির কি আছে? এই ভাবে ভাবো না - আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে!’’

সবাই রাজা হলে তো রাজায় রাজায় যুদ্ধ বেধে যাবে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা কল্পদৃশ্য – সেনেট হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছাতা দিয়ে একে অপরকে ঠ্যাঙ্গাচ্ছেন আর পোর্টফোলিও ব্যাগগুলো হ্যাভারস্যাকের মত ঝুলিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাচ্ছেন। সিতুর কথামত ভাবতে গিয়ে আমি শিউরে উঠলাম। ‘‘নাঃ, এর থেকে আমাদের সময় ঢের ঢের ভালো ছিলো, বুঝলি সিতু!’’

সিতু কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো, ‘‘স্মৃতি বিগতকালের আলোকে সততই সুন্দর লাগে, আবার আগামীকাল জাগায় অনেক অপূরণীয় আশার স্বপ্ন, জ্ঞানীজন তাই শুধুমাত্র আজকের দিনটিকেই অবলোকন করেন।’’

হেড হয়ে সিতুর মাথাটা সত্যি করেই ঘুরে গেছে! ওর কথামতো দু’বছর পরে যদি ওর মাথা ঘোরা সেরেও যায়, ততদিনে ওর ছাত্রদের যে কি গতি হবে এই দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি সেদিন কলেজ ছেড়েছিলাম!
0

রম্যরচনা : প্রদ্যুৎ মিত্র

Posted in


রম্যরচনা


পিটার রুদ্র
প্রদ্যুৎ মিত্র



- বইমেলার ক্লোসিং সেরিমনি কেমন লাগল লালমোহন বাবু?

- বেশ একটা বিজয়া বিজয়া ফিলিং মশাই… শুধু দিদিমনি-র ক্লোসিং স্পীচ-এর সময় এক ছোকড়া বেমক্কা প্রশ্ন করে তাল কেটে দিল!!

- সে কি? কি ভাবে?

- আর বলবেন না স্যার… মাননীয়া তখন ল্যাংচা হাব-এর সাকসেস্ নিয়ে মুক্তমঞ্চে বক্তব্য রাখছেন… আমিও সেই আবেগে ভাবছি জেনে নিই কবে হাসপাতালে নলেন ফ্লেবার স্যালাইন পাওয়া যাবে…। ঠিক তখন-ই ইন্দ্র ফলস্‌... মানে ইন্দ্রপতন!! এক পিস বেয়াড়া প্রশ্ন ধেয়ে এল ~ “রেশনে কম দামে হাঁদা ভোঁদার কাণ্ডকারখানা দেওয়া হবে কবে?’’ ব্যাস!! 

- তারপর?

- আর তারপর... তুমুল ডিস্পিউট!! বাই দা ওয়ে “চায় পে চর্চা” আপনার কেমন লাগে মিঃ মিত্তির?

- কোনওদিন দেখিনি, তবে আশ্বস্ত বোধ করি এই ভেবে যে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই কোনওদিন এই রকম কিছু ভাবেননি!! এনিওয়ে, আপনার ট্রেডমার্ক মাঙ্কি ক্যাপ টি দেখছি না?

- আর বলবেন না স্যার! লেপের অবস্থা জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মত। ফ্যানখানি গুলশন গ্রোভারের মত চেয়ে আছে। শীত কিডন্যাপড্!! মাঝখানে বসন্তটা ফেঁসে গেছে!!

- এইটা জানাতেই কি এত সাত সকালে ছুটে এলেন?

- ইয়ে না… মানে একটা কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার হল… বইমেলার শ্রেষ্ঠ অবদান ধুলোমাখা বেগুনীর এফেক্ট কি না জানি না, বাট কাল রাতে একটা বিটকেল স্বপ্ন দেখলুম!

- কি দেখলেন?

- মাইন্ড টি নট্ স্যার, বাট মগনলালের এত সাহস আপনাকে উইগ খুলতে বলে? মিঃ মিত্তির! 

- কোনও দিন যদি স্বপ্ন সত্যি হয় তাহলে কি করবেন?

- এই কথা রইল। হয় এর বদলা নেব, নয়তো রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখা ছেড়ে দেব!

- আই এম অনার্ড, লালমোহনবাবু… অনাদি কনফার্মড… মোগলাই পে মন কি বাত্… কেমন হবে?? 

- ওয়ান্ডারফুল!! তবে মনে আরও একটা প্রশ্ন রাইজ করেছে মশাই… মানে ধরুন ডি-ক্লাসিফাইড ফাইল থেকে জানা গেল নেতাজী ভেজ ছিলেন? তখন? বাঙালি কি করবে? 

- উফফ … আপনার প্রশ্ন গুল দিন দিন বড্ড প্যাঁচালো হয়ে উঠছে… এর চেয়ে জটায়ুর “হুতম প্যাঁচার হাহাকার”-এর প্রুফ রিড করা বেটার … 

- হে হে … এবারে কিন্তু এই ডিজিটাল ইন্ডিয়া-র থিম ক্যাপচার করতে নেক্সট উপন্যাস টা ফেসবুকে ফেলব ঠিক করেছি… “ফেসবুকে ধুকপুক”… 

- উত্তম প্রস্তাব… তা স্টেটাস আপডেট সম্পর্কে আইডিয়া আছে? বা ফেসবুক ওয়াল?

- টু হান্ড্রেড পারসেন্ট্!! প্রথমে একটু খটমট লাগত!! ওয়ালে কি লিখব ভেবে পেতাম না। এতকাল দেখে এসেছি দেওয়ালে লেখা মানে তো শুধুই “এখানে প্রস্রা…” থুড়ি… কিন্তু পরে বুঝলাম!

- কি বুঝলেন?

- বুঝলাম যে ঠিক ঠাক স্টেটাস আপডেট দিতে পারাটা একটা আর্ট!

- যেমন?

- এই ধরুন ~ “ঝমঝম করে বৃষ্টি; কী ভালো লাগছে”। ক্ল্যারিটি: হাই, স্টেটাস- পাতি!“বৃষ্টির ঝমঝম ভাসিয়ে দিচ্ছে হৃদয়ের ম্যানহোল”। ক্ল্যারিটি- ০, স্টেটাস-কবি।

- ক্লিন বোল্ড্!! উপন্যাসের প্লট ঠিক হয়ে গেছে?

- ইয়েস স্যার!! খুনি পরিচয় লুকাতে ফেসবুকে নিজের নামের বানান বদলাচ্ছে।

- যেমন?

- ইয়ে।

- কিয়ে?

- ইয়ে, মানে সোজাসুজি মুখার্জী না লিখে শেষে “ই এ” করে দিচ্ছে 



- বাবা, আপনার লেখনীর জয় হউক… শুধু খেয়াল রাখবেন ভুল করে পিটার রুদ্র লিখে ফেলবেন না যেন… চলুন অনাদি ডাকছে…
0

রম্যরচনাঃ পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


ফ্রিজ বিভ্রাট
পিনাকী চক্রবর্তী



কখনও কোনওরকম বিপাকে পড়ে যদি আপনার মনে হয় এইসব ঘটনা শুধু আপনার সাথেই কেন ঘটে থাকে, তাহলে আজকের পর থেকে একবার করে আমার এই অমূল্য অভিজ্ঞতার কথাটাও ভেবে নেবেন। আপনার দুঃখের ভার তাতে কতকটা লাঘব হলেও হতে পারে, অন্তত আমার ধারণা তো সেইরকম।

আমি ছুটির দিনে বাড়ীর কাজ যে একেবারেই করি না, এ ধরণের রটনা আসলে বিরোধীপক্ষের অপপ্রচার। উদাহরণ স্বরূপ এই তো, দেখুন না, গতকাল রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পরে গৃহিণীর নিত্যকর্মের খানিকটা অংশ নিজের হাতে করে দিয়ে কাজ এগিয়ে দিয়ে কিছু ব্রাউনী পয়েন্ট রোজগারের ধান্দায় ছিলাম। তিনি চোখের বালি দেখুন, আমি টেবিল খালি করি, এই আর কি! নিত্যকর্ম মানে খাবার টেবিল থেকে অতিরিক্ত ভাত, ডাল, তরকারী ইত্যাদি উঠিয়ে নিয়ে সেগুলোকে ছোট ছোট টাপারওয়্যারের বাটীতে ঠেসে রাখা। এই পদ্ধতিতে যে হাঁড়ি, কড়াই, প্যান ইত্যাদি খালি হলো, তাদের সিঙ্কে নামিয়ে জলে ভিজিয়ে রেখে দেওয়া। অবশ্য, ওদিকে আর বেশী এগোনো উচিৎ হবে না, ওগুলো মেজে রাখতে গেলে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, এত কষ্ট করে জমানো যাবতীয় গুডউইল নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং ওদিকে না গিয়ে ভাবলাম এবার বরং বাটীগুলোকে ঠান্ডা মেশিনে তুলে রাখি।

রেফ্রিজারেটারের দরজার নীচের পাল্লাটা খুলতেই চিত্তির। দেখি ক্রিস্পার ট্রেতে ফুলকপি বাঁধাকপির ফাঁকে ফাঁকে মেট্রো তৈরীর সময়কার মনোহরদাস তড়াগের মতো খানিকটা তলানী জল। ওপরের সব কটা বাসন কোসনের ওপরেই শীতের সকালের মতো ফোঁটা ফোঁটা শিশিরবিন্দু। তড়াক করে ওপরের ডীপ ফ্রিজের দরজাটা খুলতেই দেখা পেলাম একটু আঁশটে গন্ধ সমেত আধা শুকনো এক আরল সাগর। ফ্রীজের আলো জ্বলছে, টেম্পারেচার কন্ট্রোল প্যানেলেও আলো আছে, মানে কোনও বিদ্যুৎ সরবরাহ জনিত বিভ্রাট আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো রেফ্রিজারেটরটা হঠাৎ জবাব দিয়ে দিয়েছে। কেন, কি বৃত্তান্ত, এইসব জিজ্ঞেস করবেন না। আমি এঞ্জিনীয়ার নই, তাই কারণটা আমার জানা নেই।

অবশ্য আপনারা জিজ্ঞাসা না করলেও, সকলকে তো আর আমি আটকাতে পারি না। আমার এক অস্ফুট কাতরোক্তিতে বিভাগীয় প্রধান টিভি ছেড়ে উঠে এসেছিলেন। ব্যাপার স্যাপার দেখে সরাসরি জিগ্যেস করলেন, “এটা তুমি কী করেছ?” আমি সবিনয়ে জানালাম আমি কিছু করি নি। তিনি হয়তো এই রকম উত্তরই আশা করেছিলেন, পাত্তা না দিয়ে বললেন, “তাহলে এরকমটা হলো কি করে?” আপনাদের যেমন বলেছিলাম, ওঁকেও সেইরকম ভাবেই বললাম, “আমি এঞ্জিনীয়ার নই, তাই সঠিক কারণটা আমার জানা নেই।’’ অবশ্য, এঞ্জিনীয়ার হলেও যে খুব একটা তফাৎ হতো তা তো মনে হয় না। কারণ আমার স্বচক্ষে দেখা আছে, এঞ্জিনীয়ারদের বাড়ীর ফ্রিজও খারাপ হয়, এবং সেই অবস্থায় তাঁরাও নিজেরা বেশী কারিগরী বিদ্যে না ফলিয়ে তাঁদের ফ্রিজ বানানেওয়ালা কোম্পানীর কল সেন্টারেই সোজাসুজি ফোন করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে এঞ্জিনীয়ারের প্রসঙ্গ তোলাটা একটা অনিচ্ছাকৃত ফাউল হয়ে গেলো। আমার ছোট শ্যালক বিশাল হোমড়া চোমড়া এঞ্জিনীয়ার। গৃহিণী তাই ব্যাপারটা আগ বাড়িয়ে নিজের গায়ে টেনে নিলেন। ধ্যাতানি দেওয়ার সুরে বললেন, “বাজে না বকে ফোন লাগাও !”

তাই লাগালাম। তাড়াহুড়োতে হাতের কাছে যে মোবাইলটা ছিলো, সেটা দিয়েই নম্বর টিপলাম কোম্পানীর কল সেন্টারের। প্রথম চেষ্টাতেই ফোন বাজলো, একবার বেজে উঠেই থামলো এবং এক যান্ত্রিক ঘোষিকা হিন্দীতে আমাকে তাঁদের উপভোক্তা সহায়তা কেন্দ্রে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর তিনি জানতে চাইলেন আমি হিন্দী, ইংরিজী, উর্দু, গুরমুখী ইত্যাদির মধ্যে কোন ভাষায় সহায়তার কথা শোনা পছন্দ করবো। আমার ইংরিজী পছন্দ জানতে পেরে তিনি পরবর্তী প্রশ্ন করলেন ইংরিজীতে। জানতে চাইলেন আমি এয়ার কন্ডিশনার বা রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন কিম্বা ভিডিও প্লেয়ার, ক্যামেরা না মোবাইল ফোন ... কি জাতীয় যন্ত্রের জন্যে সহায়তা চাইছি ? বোতাম টিপে টিপে, ধাপে ধাপে এগিয়ে মিনিট খানেক পরে তেনাকে বোঝানো গেলো আমার উদ্দিষ্ট যন্ত্রটি একটি ফ্রিজ, আমি সেই যন্ত্রটি কেনার জন্যে নয়, সারানোর ব্যাপারে আগ্রহী এবং যান্ত্রিক ভাবে নয়, আমি কোন সহায়কের সাথে নিজে কথা বলে সাহায্য পাবার ব্যাপারেই উৎসাহী। তিনি সব শুনে টুনে নিয়ে কথা থামাতেই শুরু হলো বেশ হাল্কা পাশ্চাত্য ধাঁচের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। বাজনাটা শুনতে নিতান্ত মন্দ নয়, কিন্তু আমি তেমন আপ্যায়িত হয়ে শুনতে পারছিলাম না, অবস্থাবিশেষে। কারণ, আমার অন্য কানের পাশে বাজছে অন্য বাজনা, গৃহিণী জানতে চাইছেন “ওরা কি ওঠালো ফোন?” এবং আমার মাথা নাড়া নেতিবাচক উত্তর পেয়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করছেন, “এমা, কেন?” ওরা কেন এখনও ফোন ওঠাচ্ছে না, এই তথ্য আমার কাছে ততটাই অজানা, যতটা অজানা ছিলো ফ্রিজ খারাপ হওয়ার কারণটা।

আধ মিনিট ধরে সেই বাজনা বাজিয়ে আবার ঘোষিকা ফিরে এলেন, এবং এলেন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ফেরফিরতে হিন্দীভাষিনী হয়ে। জানালেন ওই সেন্টারের সমস্ত কর্মী এখন অন্য উপভোক্তাদের সাথে কথোপকথনে ব্যাস্ত আছেন। আমি অপেক্ষমানেদের কাতারে আছি। আমার নম্বর ছয়, এবং আমার অপেক্ষা করার সময় সীমা আন্দাজে বারো মিনিট! হাত নেড়ে অর্ধাঙ্গিনীকে ডাকলাম, তিনি ফ্রিজের পেছন দিকে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন, আমার মুখে সব শুনে ভ্রুকুটি করে বললেন, “কথা বলতেই যদি বারো মিনিট সময় নেয়, তাহলে সারাবে কতদিনে? তুমি আলিফকে ফোন করো।” 

নামটা আলিফ নয়, আতিফ, কিন্তু তাঁকে ফোন লাগিয়ে কি হবে? আতিফ ভাই তো এই কোম্পানীর এয়ার কন্ডিশনার সারান! সেই সূত্রেই আমার সাথে আলাপ তাঁর, কিন্তু ফ্রিজ আর এসি কি এক হলো? তবে যেহেতু দুটোই ঠান্ডা করার যন্ত্র, এবং যেহেতু সেই যুক্তিকে কাটার মতো কোনও জোগাড়যন্ত্র আমার কাছে ছিলো না, তাই আতিফকে ফোন করতেই হলো। এক কানে বাজনা, অন্য কানে আতিফ ভাই, সামনে রুষ্টা এবং চিন্তিতা গৃহিণী, তাঁর পেছনে ভাসমান (?) ফ্রিজ, ফ্রিজের ভেতর ঠাসা সেদিনেরই বাজার করা আনাজপত্র, সাথে আধখানা রুই মাছ আর একটা ঝোলো মুরগীর দেহাবশেষ (ব্রয়লার মানে তো ঝোল বানানোর উপযুক্ত, তাই না?) ... আমার অবস্থাটা অনুধাবন করুন একবার!!!

আতিফ ভাই অত্যন্ত সজ্জন ব্যাক্তি। ধীর স্থিরও বটেন। বললেন, “আপনি কোম্পানীতেই খবর দিন। আমি ফ্রিজের কাজ করি না। আমার কোন সহকর্মী করে তাও জানি না। আর আমার চেনাজানার মধ্যে আছে একজন লোক যে এই কাজ করে, কিন্তু আপনাকে আমি তার কথা বলতে পারি না। সে প্রাইভেটে কাজ করে, আপনার ওয়ারেন্টি থাকবে না ওকে দিয়ে করালে।” বললাম, “ওয়ারেন্টি মাথায় থাক। আমার অবস্থা এখন কাহিল। কোম্পানী থেকে হয়ে গেলে তো ভালোই হবে, কিন্তু নেহাত যদি ওই পথে সুবিধে না হয়, মানে এই যে, দেখুন না, আমি অন্য কানে কোম্পানীকে ফোন লাগিয়েই রেখেছি আর প্রায় মিনিট দশেক ধরে গানবাজনা শুনছি... তা আপনি তাঁর নম্বরটা মেসেজ করে দেবেন একটু...” আতিফের প্রাণে দয়া মায়া আছে, তিনি দিলেন সেই প্রার্থিত নম্বরটি... সেই টেকনিশিয়ান ভদ্রলোকের নাম রাজ... রাজ আরিয়া, অর্থাৎ রাজ আর্য্য...। আচ্ছা, দেখা যাক, এই কোম্পানীকে দিয়ে ব্যাপারটা মিটলে ভালো, নইলে এঁকে নিয়ে পড়া যাবে।

অন্য কানে বাজনা বেজেই চলেছে, যেন আবহমান কাল ধরে, থামাথামির নামই নেই… বেশ অনেকক্ষণ পরে তেনাদের দয়া হলো, বাজনা থামিয়ে ঘোষিকা জানালেন আমার সাথে কোম্পানীর সহায়কের যা কথা হবে, সেটা তাঁরা রেকর্ড করে রাখবেন, তাঁদের সহায়কদের শিক্ষাদান এবং সহায়তার মান বজায় রাখার জন্যে। আমার গলা রেকর্ড আর ক’জন সেধে এসে করতে চায়…! আমি আবার আপ্যায়িত হলাম। তারও খানিকটা পরে, মোটামুটি ফ্রিজ ঘটিত অঘটনের ঘটনাটা আবিষ্কারের থেকে প্রায় পৌণে ঘন্টা সময় জলাঞ্জলি দেবার পর কোম্পানী নিয়োজিত সহায়কের গলা ভেসে এলো ইথার তরঙ্গ বেয়ে। “শুভসন্ধ্যা, দাবিন্দর চাড্ডা মহোদয়, অমুক কোম্পানীর তরফ থেকে আমি অভিজিৎ কথা বলছি। বলুন, আমরা আপনার কি সহায়তা করতে পারি?”

সত্যি বলতে কি, এইবার আমি বমকে গেলাম! মানে আমি এমন চমকে গেলাম যে আমার বাক্যি হরে গেলো। চাড্ডা পদবীটা আমার মোটেই ভালো লাগে না একটা কারণে, সেটা অন্য কোনওদিন খোলসা করবো। যতদূর মনে পড়ে, আমার নিজের নামের পদবী হিসাবে চাড্ডার ওপর আমার কোনও দাবী নেই, কোনওদিন ছিলো বলেও জানতাম না। কিন্তু সাথে দাবিন্দর থাকলে ব্যাপারটা আরো কেমন গুলিয়ে যায়। আমি তো আমিই, কিন্তু এই দাবিন্দর চাড্ডা ভদ্রলোকটি কে? এই অভিজিৎ-ই হয়তো সাপ দেখতে ব্যাঙ দেখছে তার কম্পিউটারে। একটু ঘনিষ্ঠ জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখি।

বিনীত ভাবে বললাম, “আজ্ঞে, আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে কোথাও। আমি দাবিন্দর কিম্বা অন্য কোনওরকম চাড্ডাই নই। আমার নাম পিনাকী চক্রবর্তী। আদি নিবাস কলকাতা, অধুনা নয়ডাবাসী...” আর এগোনোর আগেই অভিজিৎ হই হই করে উঠলো, ‘‘নয়ডা? নয়ডা কোথায়? নয়ডা আবার এর মধ্যে কোত্থেকে এলো? না, না, আপনি থাকেন তো দিল্লীর পশ্চিম বিহারে, জায়গাটা ঠিক এইখানে...’’ আমার আপত্তিকে নস্যাৎ করে সাংঘাতিক রকম বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল একটা পশ্চিম বিহারী ঠিকানা সে আমাকে শুনিয়ে দিলো।

আমি আবার চেষ্টা করলাম, ‘‘ভাই অভিজিৎ, আমি দিল্লীর পশ্চিম বিহার চিনিনা, কোনওদিন যাইনি সে পাড়ায়। আমার কাছে পশ্চিম বিহার মানে বিহারের আরা, ছাপড়া, চম্পারণ...’’ অভিজিৎ বললো, ‘‘স্যার, আমাদের এখন খুব ব্যাস্ত সময় চলছে। আপনি যদি দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি বলেন আপনার ফ্রিজে ঠিক কি ধরণের গণ্ডগোল হচ্ছে, তাহলে আমি আপনাকে হয়তো সাহায্য করতে পারি। নাহলে…’’ বলে সে এমন ভাব দেখালো যেন ফোনের লাইনটা এক্ষুণি কেটে দেবে। যাব্বাবা! এ তো দেখি সবাই ধ্যাতায় আমাকে। নিজের গিন্নি, কোম্পানীর সহায়ক, এদের সকলের বকা খেতে খেতে আমি তো তখন অসহায়, নিরুপায়, ইত্যাদি ইত্যাদি… পশ্চিম বিহার, চাড্ডা, এইসব অদরকারী প্রসঙ্গ একপাশে সরিয়ে রেখে ঝটপট কাজের কথায় এলাম। বললাম, ‘‘আমার ফ্রিজ চলছে না, শুধু এইটুকুই গণ্ডগোল। জলে ভরে গেছে সে। আর খানিকক্ষণ বাদে সেই জল ফ্রিজ ছাড়িয়ে আমার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াবে, এরকম সম্ভাবনা খুব প্রবল।’’

অভিজিৎ আমাকে দিয়ে ফ্রিজের সুইচ চালু করিয়ে, বন্ধ করিয়ে, আমার কাছ থেকে কিছু চোখা চোখা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে, আমাকে বললো, ‘‘আপনার ফ্রিজে গ্যাসের অভাব ঘটে নি। যা হয়েছে সেটা খুব সম্ভবত রিলের প্রবলেম। না হলে থারমোস্ট্যাটটা গিয়েছে। অথবা সেন্সর কাজ করছে না। আপনি, স্যার, ছয় ঘন্টা ফ্রিজের দরজা খুলে সুইচ অফ করে রেখে দিন। কালকে সকালে আবার চালু করবেন। চালু করার সময় এই রকম সেটিং রাখবেন... আর, তখনও যদি চালু না হয়, তবে আমাদেরকে আবার জানাবেন। আমরা ঠিক করে দেব। আচ্ছা স্যার, আপনার ফ্রিজের সিরিয়াল নাম্বারটা একবার ভেরিফাই করে দেবেন। আমার খাতায় যা আছে, সেটা হলো এই...’’ দেড় গজ লম্বা একটা এবিসিডি ১২৩৪ সঙ্কলিত নম্বর পড়ে শোনালো সে। আমি বললাম, ‘‘দাঁড়াও বাপু, এই নম্বরটা ফ্রিজের কোথায় লেখা থাকবে?সে বললো, ফ্রিজের বাইরের দিকের যে কোনও এক পাশের গায়ে, স্টিকারে লেখা থাকে। আমি দেখলাম আছে সেইরকম চার পাঁচটা স্টিকার, ফ্রিজের একপাশে, পায়ের কাছ ঘেঁষে। টর্চ এনে, মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে সেই নম্বর পড়তে পড়তে অভিজিতকে বললাম, ‘‘আবার বলো তো হে ছোকরা তোমার নম্বরটা।’’ সে বললো, ‘‘আমার না, আপনার ফ্রিজের নম্বরটা হলো এই...’’ আমি মাঝরাস্তাতেই হাঁকপাঁক করে আপত্তি তুললাম, ‘‘না হে, নম্বর মিলছে না...।’’

এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথমবার তাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখলাম। সে বললো, ‘‘আচ্ছা, মডেল নাম্বারটা দেখুন তো ... এই আছে কি না?’’ আমি বললাম, ‘‘না।’’ সে এবার খুব গম্ভীরভাবে বললো, ‘‘বেশ, আপনি তাহলে পড়ে শোনান তো আপনার ফ্রিজের মডেল আর সিরিয়াল... এই দুখানা নম্বর!’’ আমি পড়ে পড়ে শোনাতে লাগলাম তাকে... শেষ সংখ্যাটা পড়া শেষ হতেইসে বলে উঠলো, ‘‘আচ্ছা, আপনার নাম কি পিনাকী চক্রবর্তী ? আপনি কি নয়ডায় অমুক কোম্পানীর সরকারী আবাসনে থাকেন?’’একেই ইংরিজীতে বলে চোখ থেকে পেনী খসে পড়া। অ্যান্ড দেন দ্য পেনী ফেল ফ্রম হিজ আইজ!

চোখের থেকে পেনী খসে পড়ার জন্যেই হোক বা অন্য যাই কারণে হোক না কেন, অভিজিৎ দেখলাম বেশ বিরক্ত আমার ওপর।কিছুটা রুক্ষভাবেই ভাবে এবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘‘আপনি আপনার রেজিস্টারড মোবাইল থেকে ফোন করছেন না কেন?’’ আমি বললাম, ‘‘তোমার কাছে যে নম্বরটা লেখা আছে, আমি এখন আর ওই মোবাইল নম্বরটা ব্যবহার করি না, সরকারী আবাসনেও আর থাকি না। দুটোর কারণই এক। আমি চাকরী থেকে অবসর নিয়েছি। আমার এই ফোন নম্বরটা আমি সদ্য সদ্য হাতে পেয়েছি, হয়তো এটা পশ্চিম বিহারী কোন চাড্ডার কাছে থেকে থাকবে এর আগে, আর সেই চাড্ডাও নিশ্চয়ই আমারই মতো ভুলভাল ফ্রিজ কিনে পস্তাচ্ছে। যদিও আমি এটা আন্দাজে বলছি, সত্যি মিথ্যে আমার জানা নেই। তবে তুমি বাপু তোমার জ্ঞাতার্থে একটু লিখে রাখো কোথাও, আমার বর্তমান বাড়ির ঠিকানা হল এই…’’

এখনকার সমাচার বুলেটিন এই রকম - আজ সারাদিন ধরে অভিজিতের পাঠানো ইঞ্জিনীয়ার এসে পৌছাতে পারে নি। বিকেলের দিকে রাজ আর্য্যকে ফোন করে দিয়েছিলাম। দেখলাম রাজ কার্যে বেশ চৌকশ... সন্ধ্যের একটু পরে ফ্রিজ চালু হয়ে গেলো। তরি তরকারী, মায় মাছ মাংসের পর্যন্ত কিছু হয় নি। এমনকি দুধটাও কাটে নি জ্বাল দেওয়ার সময়ে। দিল্লী অঞ্চলে শীত তার মানে এসে গেছে।

শেষ হয়ে গেছিলো আমার কথা, কিন্তু শেষ লাইনটা আবার পড়তে গিয়ে একটা কথা মনে পড়লো। আমি ২০১২ সালে পশ্চিম সাইবেরিয়া গেছিলাম।যেখানে গেছিলাম সে জায়গাটা প্রায় আর্কটিক সার্কেলের ওপর। ওখানে বাড়ীঘরগুলোতে ডবল ডবল জানালা থাকে কাঁচের। এক সেট বাইরে, এক সেট ভেতরে। মাঝে বেশ হাত খানেকের ফারাক। ওই গ্যাপটা ইন্স্যুলেটরের কাজ করে। বাইরে -৩৫° সেলসিয়াস হলেও ভেতরে আরামদায়ক +১৫° সেঃ রাখা চলতে পারে। দুই জানালার মাঝখানের থাকটাতে ০°থেকে -৫° মতো থাকে তাপমান। তা এমন জায়গাতেও লোকে ফ্রিজ ব্যবহার করে শীতকালে। তবে সুইচ বন্ধ করে ফ্রিজের ভেতর গরম রান্না রাখে, অনেকটা সাহেবদের হটকেসের ধাঁচে। শাকপাতা গুলো রাখে ঘরের ভেতরে, জানলার গায়ে। রান্নাবান্না তরি তরকারী রাখে দুই জানালার মাঝের থাকে। আর মাছ মাংস রাখার জায়গা বাইরের জানালার বাইরে। একটু হয়তো অসুবিধে হয় বরফের স্তুপের নীচে মাছটা কোথায় আর মাংসটা কোথায় রাখা আছে সেটা খুঁজতে। কিন্তু বুদ্ধিমানেরা রঙিন ফিতে লাগিয়ে রাখেন প্যাকেটের গায়ের থেকে জানালার ওপরের স্নো-শেড পর্যন্ত। ফিতের রঙেই সব রহস্যের সমাধান হয়। তবে সেগুলোকে বের করে আনতে হয় কোদাল দিয়ে কুপিয়ে। ঝঞ্ঝাট মনে করলেই ঝঞ্ঝাট, কিন্তু এটাও ভেবে দেখুন, মাসের পর মাস মাছ মাংস স্টোর করা থাকে, কিচ্ছুটি খারাপ হয় না।

সাইবেরিয়ায় নাকি এমন একটা ম্যামথের আস্ত দেহ পাওয়া গেছে পার্মাফ্রস্টের বরফের নিচ থেকে, যার পেটের মধ্যে থেকে তার সদ্য খাওয়া কিন্তু হজম হওয়ার আগেই জমে যাওয়া ঘাস পাতা এবং ঘাসের ফুল সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ঘাসের বীজগুলো তুলে নিয়ে লাগালে ১২,০০০ বছর আগেকার দুব্বোঘাস আবার গজাবে!!!


পরিভাষায়, “ক্ষী ক্ষারবার!!!”
0

রম্যরচনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in


রম্যরচনা

সেজদা 
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী 


কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিকে বাদ দিলে ফেসবুকের বন্ধুরা সব কেউ ছবি পোস্ট করেন বা কেউ লেখা পোস্ট করেন। উদ্দেশ্য মূলত একটাই – আমাকে দেখুন, আমাকে শুনুন। আমি ব্যতিক্রমী নই। তবে আমার মুখটি কদাকার ও বৈশিষ্ট্যহীন বলে আমি ছবি পোস্ট বড় একটা করি না। তার বদলে নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা লিখে যাই। বন্ধুরা হয়ত বিশ্বাস যাবেন না, তবে ফেসবুকের দিব্যি, আমি একটা কথাও বানিয়ে লিখি না। দুঃখ একটাই – দু-চার জনের বেশি কেউ আমার লেখা পড়েন না। তাই আজ আর নিজের সম্বন্ধে কিছু না লিখে আমার আপন সেজদার গল্প লিখব বলে ঠিক করলাম। 

গল্পটা কথার কথা। আসলে নির্জলা সত্য ঘটনা। আমার সেজদার মাথাটি আমারই মতো কিঞ্চিৎ স্থূল ছিল বলে বাড়ির চাপে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দু-দুবার বসেও পাশ করতে পারেনি। তবে তার চেহারাটি ছিল চমৎকার। উচ্চতা একটু কম হলেও অন্য সব দিকে কোন ঘাটতি বা বাড়তি ছিল না। বৃষস্কন্ধ, প্রশস্ত ছাতি, দৃঢ়-পেশিওয়ালা হস্তপদ, কনকবর্ণ গাত্র। মারাদোনার ছবির কথা ভাবুন। আমার সেজদা ছিল তারই দ্বিতীয় সংস্করণ। কিশোর বয়স থেকেই তার নিজস্বী ছিল। এই নিজস্বী মানে সেলফি নয়। একটি গরু এবং আধ ডজন কুকুর ছিল তার নিজস্বী। গরুটির দুধ সে সরাসরি বাঁট থেকেই পান করত। বাছুরের মতো নয়, গরুর পেটের তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে আঙুলের চাপে দোহনধারা নিখুঁত লক্ষ্যে নিজের হাঁ-করা মুখে চালান করে দিত। আর কুকুরগুলি ছিল তার সর্বক্ষণের অনুচর। 

ফুটবল প্লেয়ার হিসেবে অঞ্চলময় খ্যাতি ছিল সেজদার। অঞ্চলের বাইরেও তাকে হায়ার করে খেলতে নিয়ে যেত অন্যান্য টিম। সেকালে গ্রামাঞ্চলেও ভালো ভালো ফুটবল টিম ছিল। তাদের দর্শক-সমর্থক-পৃষ্ঠপোষক-এরও অভাব ছিল না। আমার সেজদার যথেষ্ট সংখ্যক অবুঝ ফ্যান ছিল। তার গোলার মতো শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তারা কম আহ্লাদিত হত না। কিন্তু ক্রমেই সেজদাকে নিয়ে গুরুতর সমস্যা পাকিয়ে উঠতে লাগল খেলার মাঠে। সে যেখানেই খেলতে যাক না কেন, তার সারমেয় অনুচরগণও সেখানে উপস্থিত হত। এমনিতে তাদের নিয়ে বিশেষ সমস্যা ছিল না। তারা মাঠের সাইডলাইনের বাইরে বসে থেকে অন্যান্য দর্শকদের মতোই নিবিষ্ট হয়ে খেলা দেখত। সকলেই জানেন, মাথা মোটা হলে তা অল্পেই গরম হয়ে যায়। আর ফুটবল যেহেতু গা-ধাক্কাধাক্কির খেলা, সেজদা তার সবল শরীরের অ্যাডভান্টেজ নিতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষের কোনও প্লেয়ার যখন বুদ্ধি প্রয়োগে সেজদার শরীরকে এড়িয়ে বল নিয়ে বেরিয়ে যেত, তখনই তার মাথাটি ঘুলিয়ে গিয়ে গরম হয়ে উঠত আর বলের ঠিকানা ভুলে গিয়ে সেই প্লেয়ারটির শরীরই হয়ে উঠত তার পা এবং হাতেরও লক্ষ্যবস্তু। মারপিট একবার শুরু হলে তাতে অংশ গ্রহণ করার লোভ সম্বরণ করা দায়। ফলে তখন খেলার মাঠ রণক্ষেত্রে পরিণত হত। তবে সেকালে গ্রামাঞ্চলের লোকেরা বই-টই তেমন পড়ত না বলে ‘গান্ধারীর আবেদন’-এর দুর্যোধনের ‘যার যাহা বল পিতঃ অস্ত্রের সম্বল’-মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে এখনকার মতো রণক্ষেত্রে হাতিয়ার নিয়ে নেমে পড়ত না। স্ব স্ব হাত-পায়ের যদৃচ্ছা প্রয়োগই ছিল যুদ্ধের প্রকরণ। কিন্তু সেজদার কুকুরগুলিকে সে কথা কে বোঝাবে! তারা দুর্যোধনের ভাবশিষ্য বিধায়ে প্রভুর পক্ষ-বিপক্ষ ভেদ না করে যুযুধান সমস্ত খেলোয়াড়-দর্শকের বিরুদ্ধে দাঁত-নখের ব্যবহারে পিছপা হত না। তবে তাদের কাণ্ডজ্ঞানের কোনও অভাব ছিল না। এমনই পরিমিত ছিল সেসবের ব্যবহার যে কারও শরীরেই আঁচড়টুকুও পড়ত না, কেবল তাদের জার্সি বা জামাকাপড় ফালাফালা হয়ে যেত। ফলে অচিরেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত, কেননা যোদ্ধাগণ তখন যুদ্ধ ভুলে যে-যার আব্রু রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আর সারমেয়গণ প্রভুকে জটলা থেকে উদ্ধার করার কৃতিত্বে তার আদরের প্রত্যাশায় পালা করে এক এক জন তার বুকে দুটি পা তুলে গাল চাটার চেষ্টা করে যেত। এভাবেই সেজদা ও তার প্রিয় অনুচরদের কৃতিত্বে পরিত্যক্ত ম্যাচের সংখ্যা বাড়তে থাকায় মাঠে তার কদর কমতে কমতে একদিন নিঃশেষই হয়ে গেল। 

সেজদার ম্যাচ জেতার ইচ্ছেটা অবশ্যি অদম্যই থেকে গেল। পরবর্তী জীবনে খেলার ধরনটা কেবল পালটে গেল। উদাহরণ স্বরূপ একটা ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট হবে। সেদিন কুড়ুল নিয়ে জ্বালানির কাঠ চেরায় ব্যস্ত ছিল সেজদা। স্থানঃ জঙ্গল-সংলগ্ন নির্জন চাষ-বাড়ি। সময়ঃ ভরা গ্রীষ্মের শুনশান দ্বিপ্রহর। একটু পরেই একজন দর্শক এসে হাজির। এক গরু-বাগাল। জঙ্গলে গরুদের চরার স্বাধীনতা দিয়ে ছায়ায় একটু শরীর জুড়োতে এসেছিল। সেজদা বলল, -- আছে তোদের গাঁয়ে কোনও মরদ এক এক কোপে দু-ফালি করতে পারে এইরম মোটা গুঁড়ি? 

বাগাল পাশে পড়ে থাকা একটা মোটা শালের গুঁড়ি দেখিয়ে বলল,-- পারবে ঠাকুর এইটা এক চোটে? 

সেজদা ঠোঁট উলটে বলল, -- অনায়াসে। না পারলে তোকে পাঁচ টাকা দেব। পারলে তুই কী দিবি? 

বাগাল ভেবেচিন্তে বলল, -- এক কাঁদি তাল পেড়ে দুবো। 

-- ফুঃ! তাল তো আমিও পাড়তে পারি। তোর নিজের তো একটা গাই আছে। এক শিশি গাওয়া ঘি দিবি। 

বাগাল রাজি হয়। সেজদা গুঁড়িটাকে ডান পায়ে চেপে ধরে কুড়ুল তোলে মাথার ওপরে। কুড়ুল প্রবল বেগে নেমে আসার সময় সেজদার পায়ের চাপে গুঁড়ি বোধ হয় একটু মাথা তুলে ফেলেছিল। ফলে কুড়ুলের বেগ গুঁড়িতে আটকে না গিয়ে পিছলে সরে এল পেছন দিকে। নিমেষে সেজদার ডান পায়ের কড়ে আঙুল পুরোটা আর তার পাশের আঙুলের আদ্ধেকটা ছিটকে বেরিয়ে গেল পা থেকে। রক্তে ভিজতে লাগল মাটি। গতিক দেখে বাগাল পাঁচ টাকার মায়া ত্যাগ করে জঙ্গলের দিকে হাঁটান দিল। সেজদা নির্বিকার চিত্তে দেড়খানা আঙুলের টুকরো বাঁ হাতের মুঠোয় নিয়ে কুড়ুল-কাঁধে রওনা হল পাশের গাঁয়ের দিকে। আফসোস একটাই – -সামান্য ভুলে এক শিশি গাওয়া ঘি হাতছাড়া হয়ে গেল! পাশের গাঁয়ে আছে একজন হাতুড়ে ডাক্তার। সেজদার একরকম বন্ধুই বলা চলে তাকে। এককালে খেলার মাঠে তার সঙ্গে অনেক মারামারি হয়েছে। তার বাড়ি পৌঁছে আঙুল দেড়খানা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, -- দে তো এগুলো পায়ে লাগিয়ে। 

ডাক্তার দেখেশুনে বলল, -- এটা তো পারা যাবেনি। 

-- তাহলে আর তুই কিসের ডাক্তার! –-বলেই, সম্ভবত ডাক্তারের প্রতি ঘেন্নাবশতই, আঙুলের টুকরোগুলোকে সামনের ডোবায় ছুঁড়ে দিয়েই পেছন ফিরেছিল সেজদা। ডাক্তার অবশ্যি অনেক অনুনয় বিনয় করে তাকে বসিয়ে কাটা পায়ের ধুলোকাদা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে তবে বাড়িতে পাঠায়। 

বাড়িতে ফিরেই সেজদা সর্বরোগহর গাওয়া ঘি দিয়ে নিজের কাটা পায়ের চিকিৎসা শুরু করে দেয়। পদ্ধতি অতি সরল। ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজ খুলে ফেলে কাটা জায়গায় তিনবেলা ঘি-এর প্রলেপ আর ঘি-মাখা ভাত এবং গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি সেবন। বাকি সময় নিশ্ছিদ্র নিদ্রা। টেড ভ্যাক বা অ্যান্টি বায়োটিকের পরোয়া না করে পনের দিনের মধ্যেই সেজদার পায়ের ক্ষত সম্পূর্ণ সেরে উঠল। চাই কি, তার হাড়মোটা চেহারায় একটুখানি ঘি-চুকচুকে লাবণ্যও দেখা গেল। 

সেকালে গ্রামাঞ্চলে বিয়ের যুগ্যি মেয়ের বাবারা কেবল ছেলের বাড়িতে ধানের মরাই আর গোয়ালের গরু দেখে জামাই পছন্দ করতেন। সেজদার বাড়তি যোগ্যতা ছিল তার প্রায় রাজপুত্রের মতো চেহারা। কাজেই যথাসময়ে একটি ফর্সা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। সন্তানাদি হতেও দেরি হল না। কিন্তু ম্যাচ জেতার নেশা ছাড়ল না তাকে। 

এখনকার মতো না হলেও তখনও ব্যতিক্রম হিসেবে গ্রামসমাজে কিছু চলমানতা দেখা যেত। আমাদের গ্রামের কুণ্ডুদের অতি সামান্য জমিজমা ছিল। পানের বরজ থেকে যেটুকু আয় হত তাতেই কায়ক্লেশে সংসার চলত। অনেকগুলি সন্তান ছিল তাদের। তারা বড় হয়ে টুকটাক ব্যবসা শুরু করে এবং অতি অল্প কালের মধ্যেই তাদের বিবিধ-ব্যবসা মহীরুহ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সেই সমৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলের জোতদারদেরও অকল্পনীয় ছিল। সেজদা ঘোষণা করল, সে অনায়াসেই কুণ্ডুদের ওপরে উঠতে পারে। চাষবাসে কোনও আয় নেই, ব্যবসাই হল লক্ষ্মী। কাজেই চাষবাস ছেড়ে বউদির গয়না হাতফেরি করে একই সঙ্গে সে মিষ্টি ও কাপড়ের দোকান খুলে ফেলল পৈতৃক জমিতে। মিষ্টির আদ্ধেক সে একাই খেতে লাগল আর কাপড় দেদার ধারে বিকোতে থাকল। ওই সামান্য ক্যাপিট্যালে কুণ্ডুদের টেক্কা দেওয়া যায় না। সেই যুক্তিতে সে আত্মীয়বাজার থেকে টাকা তুলতে লাগল। কিন্তু আত্মীয়বাজারে টাটা-বিড়লা কেউ ছিল না বলে কুণ্ডুদের সঙ্গে সেজদার ম্যাচটা তার ওয়াটারলু হয়ে গেল। এইভাবে জ্ঞাতি ও আত্মীয় পরিত্যক্ত হয়ে সে সম্পূর্ণ রিক্ত হাতে মাঝ বয়সের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। তবে জমিজমা সব বাবা-কাকাদের নামে থাকায় সেগুলি তার ব্যবসার হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়। তার একান্নবর্তী পরিবার তার পরিণত বয়স সত্ত্বেও বিপজ্জনক খেলোয়াড়ি মনোভাবে চমৎকৃত হয়ে পরিবারকে তার সংস্রবমুক্ত করতে তাকে তার অংশ মোতাবেক জমির ভাগ বুঝিয়ে দিয়ে পরিবার থেকে পৃথক করে দিল। কিন্তু ব্যবসার মসৃণ পথের তুলনায় চাষবাসের বন্ধুর পথে চলাচল তার নেহাতই নিম্নরুচিসুলভ বোধ হওয়ায় তার জমির সিংহভাগই অনাবাদী পড়ে রইল। ফলে অভাব অনটনের চক্রান্তে জেরবার হতে হতেই বাড়তে লাগল সেজদার বয়েস। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছতে না পৌঁছতেই অবশ্যি তার দুই কিশোর পুত্র পড়াশোনা ছেড়ে চাষবাসের জোয়াল নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ায় সংসারের হাল আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে। খাওয়া-পরায় স্বাচ্ছন্দ্য আসার সঙ্গে সঙ্গে সংসারে সেজদার কর্তৃত্বের রাশও হাতছাড়া হতে থাকে। কিন্তু বিশ্বসংসারের সমস্ত খেলায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে তার প্রবল বিশ্বাসটি অমলিনই থেকে যায়। 

ঘটনাক্রম অতীত কালের ক্রিয়ারূপে বর্ণনা করলাম বলে কেউ যেন ভেবে না বসেন যে সেজদা অতীতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তিনি বহাল তবিয়তে বর্তমান। বাড়িতে প্রশ্রয় পায় না বলে সারমেয়দের সঙ্গ তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছে, কিন্তু তিনখানি গরুর সেবায় তাঁর সময় মন্দ কাটছে না। তবে কেউ যদি কখনও কোনও ব্যাপারে কারোর সাফল্যের কথা তাঁর সামনে উত্থাপন করে, তখন তাঁর অবধারিত মন্তব্য হবে --ও আর কী এমন ব্যাপার, আমার কাছে কিচ্ছু না – অনায়াসে ওসব করতে পারতাম। ভাগ্য, বুঝলি, আমার হল ভাগ্যের মার...
0

রম্যরচনাঃ পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


হাঁড়িপ্রসাদ
পিনাকী চক্রবর্তী


সরস্বতী পুজো এলেই আমার মনে পড়ে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরসিয়ার কথা। না, না, তিনি মা সরস্বতীর বরপুত্র বলেই ঠিক নয়, এর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার আছে।

মুম্বাইয়ের গোকুলধামে সরস্বতী পুজোর বড় ধুমধাম, এখন তো সকাল বিকেল চলচিত্র জগতের শিল্পীদের আনাগোনা লেগে থাকে শুনেছি। কিন্তু বছর কুড়ি আগে ব্যাপারটা অনেকটা বড়সড় বাড়ীর পুজোর মতই হতো। সাথে থাকতো মণ্ডপের লাগোয়া মাঠে বাচ্চাদের গল্প বলা, ছবি আঁকা, আরও সব হরেকরমবা মনোরঞ্জনের বন্দোবস্ত। বড়দের জন্যে সন্ধ্যেবেলা গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি থাকতো অবশ্য, কিন্তু সেটা দরকার মতো ছাঁটাই করে দেওয়া হত যদি বাচ্চারা বেশী সংখ্যায় এসে পড়তো অংশগ্রহণ করতে। বাচ্চাদের সংখ্যাটা পঞ্জিকা এবং গোকুলধাম হাই স্কুলের পরীক্ষার সময়সূচীর ওপর নির্ভর করতো।

বড়রাও একদম বাদ পড়তো না সারাদিনের ধূমধাড়াক্কার থেকে। তেনাদের জন্যে উৎসাহী কর্মকর্তারা ভোগ খাওয়ার পরে একটা অনুষ্ঠান অবধারিত ভাবে রাখতেন, সেটা হল হাণ্ডিফোড়, বা হাঁড়িভাঙ্গা। সিঁড়িভাঙ্গা ভগ্নাংশের থেকে খুব বেশী সহজ নয় কিন্তু খেলাটা। চোখ বেঁধে হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দিয়ে দশ বারো বার পাক খাইয়ে ছেড়ে দেওয়া হত খেলুড়েদের এক এক করে। অনতিদূরে ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা একটা মাটির হাঁড়ি, তার মধ্যে সারপ্রাইজ গিফট। আন্দাজমত ঠিক জায়গায় গিয়ে লাঠি দিয়ে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিলেই খেলা শেষ। কিন্তু এই ভাঙ্গাভাঙ্গি যা করার বা না করার, একটামাত্র অ্যাটেম্পটেই করে ফেলতে হবে। একবার না পারিলে দেখো শতবার, ওই আপ্তবাক্যটি এই খেলার নিয়মে অচল।

একবার আমার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো, মানে হাঁড়ি ভাঙ্গলো আমার লাঠির ঘায়ে। ওপর থেকে হাঁড়ির টুকরো টুকরো ভগ্নাংশের সাথে সাথে বেশ খানিকটা পুষ্পবৃষ্টি হলো। সুদীপটা রসিক ছেলে, কুচো ফুল দিয়ে হাঁড়ি ভরে রেখেছিলো –ওর থিওরিটা এইরকম ছিলো যে, কেউই তো আর হাঁড়িটা ভাঙ্গতে পারে না, অন্তত পারে নি এতদিন, আর ভবিষ্যতে কেউ যে কোনওদিন পারবে সেই সম্ভাবনাও কম, তাই খামোকা একটা এক্সট্রা প্রাইজ ওর মধ্যে রেখে নষ্ট করে কি হবে ? পরে অডিটরকে নাকি ওরই জবাব দিতে হবে। কিন্তু কমিটির প্রেসিডেন্ট বাবলুদা বেশ বিরক্ত হলেন এই ফাঁকিবাজির কথা শুনে। বললেন, না না, নিয়ম ইজ নিয়ম। বলেছ যখন দেবে প্রাইজ, তখন প্রাইজ দিতেই হবে।

শেষমেশ রাত্তিরের অনুষ্ঠানের প্রাইজের ব্যাগ থেকে একটা ক্যাসেট তুলে এনে আমাকে দেওয়া হলো– পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরসিয়ার রাগ পাহাড়ী আর মিশ্র পিলু। আমি অবশ্য রাগ সঙ্গীত তেমন বুঝিটুঝি না, বাঁশী শুনতে ভালো লাগে, তাই মধ্যে মধ্যে ইচ্ছে হলে বসে বসে শুনি। একদিন সন্ধ্যেবেলা ঘর অন্ধকার করে সোফায় এলিয়ে বসে শুনছি – হঠাৎ ঘন্টা বাজলো টিং টং... দরজা খুলে দেখি, দেবু। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, বৌদি কি কলকাতায় গেছে নাকি, পিনাকীদা? কেন রে বাপু, তাতে তোর কি ? তা ছোকরা মোটেই লজ্জা পেলো না। বললো – না হলে সন্ধ্যেবেলা ঘর অন্ধকার করে বিরহী যক্ষের মত বসে বসে বাঁশী বাজাচ্ছো কেন? আমি জানতাম না যক্ষদের বিরহের পাসটাইমগুলো ঠিক কি কি রকমের হয়, কিন্তু দেবু্র কথা শুনে মনে হল ও বেশ যক্ষদের খবর টবর রাখে। তাই ওর কথায় উদ্বুদ্ধ হলাম। কালিদাস কালিদাস টাইপের ফিলিং হতে লাগলো। ভাবছি ছেলেটার জন্যে চায়ের অর্ডার দেবো ওর বৌদির কাছে, হঠাৎ ছোঁড়া বলে কিনা – পিনাকীদা, এটা তোমার সেই হাঁড়িপ্রসাদের ক্যাসেটটা না ? তোমার সেই হাঁড়ির প্রসাদে পাওয়া... 

চায়ের অর্ডারটা আর দিই নি, রেগেমেগে...

তাই বলছিলাম, সরস্বতী পুজোর সাথে হরিপ্রসাদের একটা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে আমার কাছে।
0

রম্যরচনাঃ তন্ময় বসু

Posted in


রম্যরচনা



ফ্রেঞ্চ রেসিপি
তন্ময় বসু



"ভণ্ডুল, অ্যাই ভণ্ডুল, শোন না। দাঁড়া না বাবা, কি যে করিস না! উফ্! হাঁপিয়ে গেলাম।" ততক্ষণে দুজনে কাছে এসে গেছে, টিংকী আর রাশি। পরাগ একটু গম্ভীর স্বরেই বলে "এত লতিয়ে পড়ার কি হলো?"

"ও-হো, ভণ্ডুল বলেছি বলে, ঠিক আছে মণ্ডলবাবু, চলুন ক্যান্টীনে যাবেন?" কপট হাসি চেপে রাশি বলে। সবে সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হলো। নীচের তলায় ক্যান্টীনেই যাচ্ছিলো পরাগ। সিঙারাগুলো খুব ভালো বানায়। দামও কম, ভাল তেলে তৈরী। বেশীর ভাগ দিন ব্রেকফাস্ট করার সময় থাকে না। ডট নটায় ক্লাসে ঢুকতেই হবে, নাহলে সেদিন গেলো।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই উদ্বায়ী বাষ্পে ওদের সম্পর্ক সহজ হয়ে গেল।

তিনজনে সিঙাড়া চা নিয়ে বসতেই টিংকীর আবদার শুরু হল, "ভণ্ডুল, সরি সরি, বলে ফেলেছি, শোন না, ফ্রেঞ্চ রেসিপিটা একবার বল না, প্লীজ।"

"তাড়াতাড়ি চলো, অংশুমান আছে এবার, হি হি করে দাঁত ক্যালাচ্ছো, দাঁত ঢুকিয়ে দেবে। বাপকে জানো তো কখন আসে কোনও ঠিক নেই।"

রাশি বলে "বল না বাবা, তোর না সবেতেই ভাউ চাই।"

"ঠিক আছে চল, যেতে যেতে বলছি"

এতবার বলেছে শালা, তাও সবার দাবী মেটাতে গিয়ে পরাগ নিজেই জানে না কবে থেকে মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। তবু বলতে হয় -
"টেক আ গ্লাস অফ ভ্যাঁ (vin)
অ্যান্ড আ লোফ অফ প্যাঁ (pain),
অ্যান্ড টু ওউফস্ (oeuf)।

নাউ পুট দ্য প্যাঁ ইনটু ভ্যাঁ
দেন বীট দ্য ওউফস্ --"

বলতে বলতে দোতলায় উঠে দ্যাখে অংশুমান স্যর যাচ্ছেন, তিনজনে পড়িমড়ি করে কোনরকমে ক্লাসে ঢুকলো।
1

রম্যরচনাঃ অরিন্দম চন্দ্র

Posted in


রম্যরচনা



অফিস-অ-ফিস
অরিন্দম চন্দ্র



ডালহৌসীর বুকে বিমার আপিসে কাজ করি। না না, “বিমার” নই। ২০ বচ্ছরের বিষ নিয়েও না। আধেক-জীবন পার হয়ে মগজে কার্ফু নিয়ে কারো গোয়ালে ধুনো বা ফুঁ কিচ্ছুই দিতে পারবো না। অনেকের কথা আসবে, কেউ মিল পেলে মারবেন না প্লীজ।

মিলনদা-আদরের মিলুদা। রিটায়ার করবার ঠিক মুখেই দেখা। ৫০ এর বাংলা উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা ক্ষয়াটে রোগা অবিন্যস্ত মিলুদা। এত ডাক্তার দেখাতে হয়েছে যে অনেকে ডক্টর রে বলে ডাকতো। গালেতে খোঁচা দাড়ি, তেলচিটে জামা-প্যান্ট, নাক দিয়ে গড়ানো সর্দি ও নস্যির অবিরাম ধারাপাত নিয়ে চেক হ্যান্ড-ডেলিভারী দিতেন। চেক যে বয়ে আনতো অ্যাকাউণ্টস থেকে, সেই তারককে বলেই রাখতেন সকাল সকাল চেক দিতে, আর সে দিতো প্রত্যেক দিন আপিস ভাঙ্গার ঠিক আগে। একদিন বিকেল ৪ টায় তারকের আবির্ভাব... “মিলনদা, এই যে আপনার খাবার।” এক-কাঁড়ি লোক, চারধারে তাকালেনও না, হুঙ্কার... “শোন তারক, তোমার ইয়েটা এই ভাবে ধরে ওইটা ঘ্যাঁচ করে কেটে দেবো।”

এ-হেন মিলুদাকে ম্যানেজমেন্ট মাঝেমাঝেই অপদস্থ করার চেষ্টা করতো। উনিও বিশুদ্ধ ইংরাজীতে পত্রাঘাত করতেন। কোনও এক বার চিঠির শেষে লিখেছিলেন “I wish I had thanked you.” পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন এই রামচিমটির জ্বালা,আমি আর জ্বালাবো না।

ডালহৌসীর এক বিখ্যাত পাগলী আপিসে মাঝে মাঝেই জ্বালাতো। একদিন সে মহিলা ব্যাগ থেকে বোতল বের করে জল ভরছেন, পাশের টয়লেটে মিলুদা ইয়ে করছেন। এক বড়বাবু, ব্যানার্জিদা ঢুকলেন। ভরাট গলায় জানালেন, “Yes, Dr. Ray, you have a patient out there.” এক সেকেণ্ড পরেই মিলুদার পালটা, “She is not my patient, she is my prospect.”

মিলুদার আর এক নেশা ছিল জর্দাপান। খিলিতে মুড়ে দুইখান পান বেয়ারা রামখিলাড়ি এনেছে। উনি আনমনে প্রাণপনে চিবিয়ে যাচ্ছেন, রস আর আসে না। বেয়াড়া ব্যাপারটা বোঝা গেল কিছু পরে, খিলিশুদ্ধু পান মুখে দিয়েছেন, তাই পান বা জর্দা নয়, বিশুদ্ধ কলাপাতার স্বাদ আসছে।

আমার নতুন কেনা জলের বোতলের ছিপির রং লাল দেখে comment মেরেছিলেন, ‘‘It is a bit sexy.” ভাগ্যিস সে কালে Facebook ছিল না!