Next
Previous
Showing posts with label ব্যক্তিগত গদ্য. Show all posts
0

ব্যক্তিগত গদ্য - গৌতম দত্ত

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য



ঋতু : মন ও প্রকৃতি
গৌতম দত্ত



“প্রকৃতি তাঁর নিজের ভক্তদের যা দেন, তা অতি অমূল্য দান। অনেক দিন ধরিয়া প্রকৃতির সেবা না করিলে কিন্তু সে দান মেলে না। আর কি ঈর্ষার স্বভাব প্রকৃতিরাণীর—প্রকৃতিকে যখন চাহিব, তখন প্রকৃতিকে লইয়াই থাকিতে হইবে, অন্য কোনও দিকে মন দিয়াছি যদি, অভিমানিনী কিছুতেই তাঁর অবগুন্ঠন খুলিবেন না।

কিন্তু অনন্যমনা হইয়া প্রকৃতিকে লইয়া ডুবিয়া থাকো, তাঁর সর্ববিধ আনন্দের বর, সৌন্দর্যের বর, অপূর্ব শান্তির বর তোমার উপর এত অজস্রধারে বর্ষিত হইবে, তুমি দেখিয়া দেখিয়া পাগল হইয়া উঠিবে, দিনরাত মোহিনী প্রকৃতিরাণী তোমাকে শতরূপে মুগ্ধ করিবেন, নূতন দৃষ্টি জাগ্রত করিয়া তুলিবেন, মনের আয়ু বাড়াইয়া দিবেন, অমরলোকের আভাসে অমরত্বের প্রান্তে উপনীত করাইবেন। ”

“বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।– ” - রবীন্দ্রনাথ।

কি অপূর্ব, তাই না!

মন-প্রকৃতি-ঋতু – এই তিনটে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় হলেও আমার ধারণায় এরা একে অপরের পরিপূরক। অভিধানের হয়তো অনেক অর্থ হয় আর সেগুলোর অনেক রকম ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে, কিন্তু আমি ঐ তত্ত্বজ্ঞানীদের দলে না গিয়ে আমার ভাবনাটাই বলি।

আমার তো শরীরে দখিন হাওয়া লাগলেই মনে পড়ে যায় সেই চিরন্তন প্রেমের আর তার সাথে সাথেই বিপরীত শব্দ বিরহের কথা। আপনাদেরও নিশ্চই এমনই অনুভব হয় ! এর জন্যে কি আমাদের ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে চাওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে? নিশ্চয়ই না। এই একটা উদাহরণের সূত্র ধরেই বলতে পারি যে এই মন-প্রকৃতি-ঋতু কেমন করে আমাদের অগোচরে আমাদের মনে বাসা করে ফেলে।

আমার ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার উপকন্ঠে এক শহরতলীতে। গাছ-গাছালি, ডোবা-পুকুর, মাঠ-ঘাট আর আকাশ-মাটিকে ছুঁতে পারতাম প্রতি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। বর্তমান জগতের প্রোমোটারী-রাজ তখনো অধরা। খুব সম্ভবতঃ এই ডাকাতিয়া শব্দটার সাথে পরিচয় ও ছিল না তখন। সেটা আমাদের অশেষ সৌভাগ্যই বলবো। প্রাণভরে আস্বাদ নিয়েছি এ সব কিছুরই। আজ আর বাড়ির জানালা দিয়ে পূবাকাশের প্রথম সূর্য-রশ্মি অথবা বিকেল বেলার কনে দেখা আলোয় ভরা, নারকেল গাছের মাথা লুপ্তপ্রায় এক স্বপ্ন। তাই মনও ছোট হয়ে গেছে !

আমাদের বাড়ির সামনে ছিল চওড়া কালো পীচঢালা এক পাকা সড়ক। তাই সেদিকটাকে আমি বলতাম শহর কলকাতা। আর আমার প্রাণের গ্রাম ছিল বাড়ির পেছন দিকে। রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর আর পূজোর ঘরের প্রশস্ত টালির চালা যেখানে শেষ হয়েছে তার পরে একটা ছোট্ট বাগান পেরিয়েই ছিল পুকুর। পাড়ার পুকুর। তাই সকাল থেকেই তার ঘাটে ঘাটে চলতো চলন্ত জীবন। শুধু ঋতুবদলে একটু আধটু সময়ের অদল বদল ছাড়া পুকুরপারে’র এই জীবন তার নিজের ছন্দেই চলতো।

ঘোর বর্ষায় যখন বৃষ্টির সুতীব্র ফোঁটাগুলো সজোরে জলের বুকে আছড়ে পড়তো তখন যে কি অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি হল সেই পুকুরের বিস্তৃত জলে তার বর্ণনা করার ভাষা আমি এখনো আয়ত্ত করতে পারি নি। বৃষ্টিপাতের তীব্র শব্দে মন উঠতো নেচে। হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজতো দামামা। শুধু মনে হতো সেই কদম ফুলের গন্ধে কেউ যদি পাশে এসে বসে আমার এই অনুভবের স্বাদ একটু ভাগ করে নিত, কি মধুময় হয়ে উঠতো পৃথিবীটা তাহলে!

আর রাতের ঘন বৃষ্টিতে যখন সামনের রাস্তায় যান চলাচল যেত স্তিমিত হয়ে তখন কান পেতে শুনতাম শব্দের আরেক অন্য রূপ। গাছের পাতায় আর পুকুরের জলে পড়া সেই বৃষ্টির অব্যক্ত ধ্বনি কানের ভিতর দিয়ে পশে যেত মরমের অন্তঃস্থলে। একা ঘরে মিটমিটে সবুজ আলোয় মনে পরতো বারংবার :

“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়--
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার--
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব--
আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥” – বর্ষার দিনে – মানসী – রবীন্দ্রনাথ।

ওই বয়সেও একলা শুয়ে শুয়ে চোখের ভেতরে ঘোরাফেরা করতো আমার কল্পনার রানী। আমার মানসীকে। হৃদয়ের সব কিছু যাকে উজাড় করে দেওয়া যায় সেই মানসসুন্দরীকে চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করতো :

“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো কোন্‌ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী!
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর,
'কোথা আছ ওগো করহ পরশ
নিকটে আসি'। ” - নিরুদ্দেশ যাত্রা (সোনার তরী) - রবীন্দ্রনাথ।

ডাকি তো কত! কিন্তু আসে কে?

প্রকৃতিরানী শুধু আমার হৃদয় আর মনের খেলা দেখতেন অলক্ষ্যে থেকে। আর তাই এই লেখা লিখতে লিখতে বারে বারেই মনে হচ্ছে যে ঋতু বৈচিত্রের অনুষঙ্গেই যোগ দেয় আমাদের মন আর হৃদয়। এর জন্যে আধুনিক ভাষায় যাকে “এট্যাচমেন্ট” বলে, সেটার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না কখনও।





0

ব্যক্তিগত গদ্য - অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য



আমার জীবনে সাদা দাড়ির যুবকটি
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য



না, আমি জীবনস্মৃতি লিখতে বসিনি। আমি অতি নগন্য মানুষ। আমার জীবনের স্মৃতি কেউ পড়বে, এটা আমি আশা করি না। তবু আমি বলে মিলায় আমি। জীবনটা যখন আমার, কিছু স্মৃতি তো আছেই। সেই পুরনো দিনের কথা ভাবতে গেলে মনে আসে উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষার দিনটা। বিজ্ঞানের ছাত্র আমি। জয়েন্ট-এর প্রিপারেশন করতে করতে বাংলা পরীক্ষার কথা ভুলেই গেছিলাম। এক রাত পড়ে পরীক্ষার হলে। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে প্রথমে তো মাথাতেই আসছে না কোথা থেকে এসেছে প্রশ্নটা। সেদিনও উদ্ধারকর্তা একজনই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'পল্লী গ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন' করতে গিয়ে কবিগুরু বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত - এবার ফিরাও মোরে। ছোটবেলায় পড়া কবিতাটা থেকে লিখে গেলাম - এই সব শান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা। ডাকিয়া বলিতে হবে মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে। ...উতরে গেলাম বাংলা পরীক্ষা সেই যাত্রায়। এবার ফিরাও মোরে অবশ্য আমায় মাধ্যমিকেও প্রচুর সাহায্য করেছে। সেই সময় বেঙ্গল বোর্ড-এ 200 মার্কস-এ 153 পেয়েছিলাম বাংলা পরীক্ষায়। আর সাত নম্বর পেলে পত্র লাভ হত। ভাবসম্প্রসারণ - আবার সেই রবীন্দ্রনাথ। বসুন্ধরা কবিতার উপকার - জলহীন ফলহীন আতঙ্ক পাণ্ডুর উষর মরুক্ষেত্রে মরীচিকার প্রেতনৃত্য। মৃত্যুঞ্জয়ও সাথ দিয়েছে অনেক। রে রুদ্র তব সঙ্গীত আমি কেমনে গাহিব কহে দাও স্বামী। ...প্রকৃতির বর্ণনায় তো পুরোটাই রবিঠাকুরের অবদান। অথবা গানের লাইন। নগরে গ্রামে কাননে দিনে নিশীথে নম প্রাণ উচ্ছসিত আজই... আবার সেই রবীন্দ্রনাথ। ইংলিশ essay-তেও কম উপকার পাইনি। The Religion of Man এর অনুসরণ এ আমার লেখা - Man's History is made not by the heroic deed men did but by the number of hurdles they overcame... যাই হোক সে অনেক পুরনো স্মৃতি। 

হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে। কথায় বলে বাঙালি ছেলে কবিতা না লিখলে আর প্রেম না করলে নাকি জীবন সফল হয় না। আমার যৌবনের প্রথম লগ্ন, তখনো মোবাইল ফোন আসেনি। প্রেমপত্র লিখতে বসেছি। কিন্তু কি যে লিখি! মাথায় তো ঘুরছে কনসেনট্রেটেড সাল্ফিউরিক অ্যাসিড বা মেকানিক্স-এর প্রবলেম। 

আবার সেই ধার করলাম রবীন্দ্রনাথ থেকে। প্রহর শেষে আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস ‌/ তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ। তারপর? সূচনা তো লিখে ফেললাম। বাকিটা? এবার ধার দিল শেষের কবিতা। পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী...।

যাই হোক, পথ চলতে চলতে পেরিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। কারিগরী বিদ্যাতেও একটু আধটু সফলতা পেয়েছি। Indian Engineering Service ভারতীয় কারিগরী পরীক্ষার কঠিনতম (সম্ভবত) অথবা অন্যতম কঠিন পরীক্ষায় সফল হয়েছি। কিন্তু আজও ইচ্ছে করে কাব্য গড়ার কারিগর হতে। নতুনকরে ভাবতে। তাই রবীন্দ্রনাথের গান... নদী আপন বেগে পাগল পারা...গাইতে গাইতে মনে হয় এটা কি নদীর আত্মকথা না বিবর্তনবাদ? আমি সদা অচল থাকি গভীর চলা গোপন রাখি...? এ তো ডারউইন-এর বিবর্তনবাদ। তাহলে নদীর আপন বেগ আসলে জীবন পরিবর্তনের স্রোত। যা সব সময় চলেই যাচ্ছে। অথবা অন্ধকারের উত্স হতে উত্সারিত আলো...? এখানেও বিজ্ঞানের ছটা। নতুন করে ভাবায়। জানি তার পণ্যবাহী পোত কালের তরঙ্গ স্রোতে রেখা মাত্র চিহ্ন রাখবেনা। এত বড় ভবিষ্যৎ বাণী অভাবনীয়।

আজ কম্পিউটার-এ এতটাই অসহায় যে বাংলা লিখতে গেলেও টাইপ করার জন্য ভুল বানান ঠিক করতে পারিনা বা মনেরমত শব্দ লিখতে পারিনা। সবই কম্পিউটার কন্ট্রোল করে। এটা আমার সীমাবদ্ধতা। তবু তারই মাঝে মনে পড়ে একটা দিন -পঁচিশে বৈশাখ। হে নূতন দেখা দিক আর বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক জায়গায় বলেছিলেন - বন্ধুদের আড্ডায় গান গাইতে গেলে প্রথমেই মনে আসে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আজ বম্বে কাঁপিয়ে ভারত নাচিয়ে যখন গায়ক গায়িকাদের - হাল মে পানি নেহি মিলতা হ্যায় - তখনও সেই রক্ষাকর্তা রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমার যেটুকু সাহিত্যের জ্ঞান, দর্শন বোধ, তার প্রায় সবটাই একজনের অবদান - রবীন্দ্রনাথ। অতি নগন্য আমি। আমার এই চলার পথে, সদ্য পার হয়ে আসা পঁচিশে বৈশাখ স্মরণে তাই জানালাম সেই সাদা দাড়ির চিরযুবক রবীন্দ্রনাথকে আমার প্রণাম।
1

ব্যক্তিগত গদ্য - শিবলী শাহেদ

Posted in

ব্যক্তিগত গদ্য


প্রিয় অরুন্ধতী
শিবলী শাহেদ



প্রিয় অরুন্ধতী,

জানিনা কিভাবে শুরু করব। হয়ত শুরুটা হয়ে গেছে অনেক আগেই, টের পাইনি। হয়ত আরও একটা নবাগত সূচনার লক্ষ্যেই সতীর্থ কথাদের অলিখিত চুম্বন লেগে আছে গায়ে। এই যেমন শহুরে রৌদ্ররশ্মি তোমার গালে এসে পড়লে হিংসে হয়। আজও। প্রতিরাতে ক্লান্ত পালকের ওম নিয়ে তুমি ঘুমোতে যাও। প্রতিটি ভোরে হয়ত দূরাগত আজানের সুরে জেগে ওঠো প্রিয় পাখি আমার, তোমার মতো করে একটা দিন কাটুক আমারও। বাইরে আলেয়ামুখী রাত নেমেছে। নৈঃশব্দ্যের প্রলোভনে দু-একটা অন্ধকার-বেড়াল মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রাতের বেলা বেড়ালের চোখে চোখ পড়লে কালো পর্দা সরিয়ে দিতে হয়। এই মুহূর্তে আমি পতঙ্গভুক লণ্ঠন জ্বালিয়ে তোমাকে লিখতে বসেছি। লিখতে বসেই আবিষ্কার করেছি, তোমার ভিতরেই শরীর-সমুদ্রের দ্বীপ, উজানস্রোতের কেন্দ্রাতিগ টান। ফলে অজস্র শব্দের ভীড় ঠেলে একটা যথাযথ বাক্যপ্রাণ দাঁড় করাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। স্থিতিপাঁজড়ের পৃথিবীতে, এই সময় আর কেউ যে নেই। অরুন্ধতী, প্রতিটি মুক্তোমাখা সকালের রেশ তোমার চোখে লাগুক। আমার সমস্ত জেগে-থাকা-রাতের সমূহ প্রাপ্তিযোগ তোমার হোক। তোমার বুকের জলবায়ুতে দ্যাখো আমার নামে উড়ে গেছে কিছু তৃষ্ণা-কর্পূর... 



ইতি



এক নিষিদ্ধ শব্দ বণিকের উত্তরপুরুষ
0

ব্যক্তিগত গদ্য : শৌনক দত্ত

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


বেডরুম, মধ্যরাত, বসন্ত...
শৌনক দত্ত 


বসন্ত যে এসে গেছে কেউ তা বলেনি। জানালার মরচেপড়া গ্রিল ধরে বাইরে তাকাই। রঙীন একটা শূন্যতা,বাতাসে বসন্ত গন্ধ।আমার মন ভালো নেই, এ বছর মা নেই। কোকিল ডাকছে। মা ছাড়া এর আগে আমি অনেক বসন্ত কাটিয়েছি, শিমূল গাছটি অবাক তাকায় আর বিস্ময়ে জানতে চায় প্রেমিকার কথা।আমার যে প্রেম নেই সে বসন্ত জানে। কিন্তু মা যে নেই তা বসন্ত জানে না।পলাশের রঙ মেখে চোখে যে দিকে তাকাই, মনে হয় আমার আকাশটা ছোট হয়ে যাচ্ছে রোজ। মা যে আকাশ, সে আমায় বসন্ত শিখিয়ে দিয়েছিলো। তখন বুঝিনি। আজ বুঝতে পারছি সে কথা! 

আমি সেবার গোটা মাস জুড়ে শান্তিনিকেতন। শীতের তীব্র ঠান্ডার পর হঠাৎ মৃদু শান্ত আর মিষ্টি একটি বাতাস গায়ে এসে লাগছে। টের পাই, এই বুঝি বসন্ত এসে গেছে। সেই প্রথম কোপাইয়ের ধারে বসে মনে হয়ছিলো লিখে রাখি কিছু!কি সব লিখেছিলাম আজ আর কিছুতেই তা মনে করতে পারিনা। অথচ মনে মনে লিখে ফেলতে ইচ্ছে করে বসন্তের 36 এপিটাফ। খুব ইচ্ছে করে নৈঃশব্দের আপন সুর বিরহ পাড়ার দেয়ালে রেখে লিখে দিই আনন্দ বসন্ত সমাগমে মেয়েমাছের হাসি। ইচ্ছে, তোমার ভেতর যাই। সেই বার কি এইসবই লিখেছিলাম... পোকাদের নীরব অথচ চঞ্চল মরণপ্রয়াসী আনন্দের মত কোন আদি কবির চোখে প্রথম ফুটে উঠেছিল বসন্ত রূপ, প্রথম ধরা দিয়েছিল ফাল্গুন, সে আখ্যান আমার লেখা সেইসব দিনের মতোই অজানাই রয়ে গেছে। 

সেবার শান্তিনিকেতনে থেকে মনে হয়েছিলো বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস, জয়দেব কারও মধ্যেই তো বসন্তের রূপ খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে না। কোপাইয়ের ধারে বসে চুরি যাওয়া আলোয় সেবার কি গান গেয়ে উঠেছিলাম ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দ কোমল হাহাকার ছুঁয়ে গেলো। আপন মনেই গেয়ে উঠলাম– আমার প্রাণের পরে চলে গেলো কে... বসন্তের বাতাসটুকুর মতো। খুব প্রিয় গানটিই কি সেইদিন গেয়েছিলাম? নাকি মা হারানো শীতকালের হাওয়া বসন্তের বাতাসে শূন্যতা ছুঁয়ে দিয়েছে? কাদম্বরীর মৃত্যুর পর লেখা এই গানে বসন্ত বাতাস কি তবে সুন্দরের ফিরে যাওয়া? তবে কি রবীন্দ্রনাথই বসন্তের প্রথম কবি? কিংবা অন্তত শ্রেষ্ঠ কবি? তাঁর মাঝে যেভাবে বসন্ত জাগ্রত হয়েছে, উন্মোচিত হয়েছে ফাল্গুন, তা পৃথিবীর অন্য কবিদের মধ্যে সেভাবে কোথায়?

মা বলতো আমার বসন্ত পূর্ণিমা আছে, আবীর-রাঙা ফাগুয়ার উৎসব আছে।পাহাড়ে পাহাড়ে রঙীন চেলি পরা সুন্দরীদের নাচ আছে। আমি বিমোহিত হয়ে যাই আর ভাবি বসন্ত ঈশ্বরের কী অপরূপ সৃষ্টি, কী অমর কবিতা। মা আজ নেই যেই ভাবি, তক্ষুনি মনে হয় তবে কি গ্যেটে শীতের অরণ্যে ফুল ফুটতে দেখেই বলে উঠেছিলেন-'আনন্দের মৃত্যু নেই'। সেই কি তবে গ্যেটের চোখে দেখা প্রথম বসন্ত, অনাবিষ্কৃত ফাল্গুনের রূপ আবিষ্কার? কিন্তু এলিয়ট তো এই এপ্রিলকেই বলেছিলেন- 'এপ্রিল ইউ দ্য ক্রুয়েলেষ্ট মান্থ! 'এপ্রিলও তো বসন্তই, এই বাংলার অতুলনীয়া, অসামান্যা বসন্ত।আমার মায়ের ভাবনার অমর কবিতা। 

আমাদের সময় ভালোবাসা দিবস বলতে কিছু ছিলো না। ছিলো সরস্বতী পূজা। সেও ফাল্গুনে। আজ অতীত হাতড়ে মনে হয়, সেইসব দিনে যে আপনি স্কুলে কলেজে ঘুর ঘুর করেছেন, বছর বিশ ত্রিশ পিছনে ফিরে গিয়ে সেই আপনি ও শিহরিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, ফাল্গুন মানেই ভালোবাসা। ভালো লাগার অনুভূতি। প্রেমিক প্রেমিকার চুম্বনের প্রথম পলাশ ফুল। মনে পড়ে যাচ্ছে কি বসন্তের সাথে জড়িয়ে থাকা কান্নাভেজা চোখ, না পাওয়া প্রেম, পাবার আনন্দ? ভালবাসায় ছুঁয়ে দেওয়া হাত? প্রথম শিহরণ, কত অকথিত কাহিনী, অকথিত প্রেম,অকথিত বিরহ! মনটা কি হু হু করে উঠলো বহুদিন দেখা না হওয়া প্রিয় বন্ধুটি কিংবা বান্ধবীটির কথা মনে পড়ায়? মনে পড়ে গেলো কি লুকিয়ে প্রথম সিনেমা দেখা দুজনের? 

বসন্ত এত মোহময়, এত সুরভিত, এত আর্দ্র, এত উন্মাতাল... কিন্তু পবিত্র, সমস্ত সুঘ্রাণ, সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত রূপের মিলিত অবয়ব বসন্ত।

আকাশ ছোট হয়ে আসছে রোজ।মা নেই কোত্থাও। তবু মনে হয় এই বসন্তেই মা আমার ভিতর বাহির, মেঘমহলের সন্ধ্যাপ্রদীপ আমার সুখ দুঃখ শব্দ নৈঃশব্দ। তাই এই বসন্তে একচিলতে আকাশ দেখতে দেখতে শান্তিনিকেতন ভাবতে ভাবতে মা-হীনতাতেও মনে হয়, বসন্ত আছে বলেই হয়ত জীবন আজও বসন্তের মতো সত্য।
3

ব্যক্তিগত গদ্যঃ সুস্মিতা বসু সিং

Posted in

 ব্যক্তিগত গদ্য




অপেক্ষা
সুস্মিতা বসু সিং


কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিনদুয়েক পর। উৎসবের রেশ স্তিমিতপ্রায়। হেমন্তের শেষ বিকেলটা সেদিন বিষণ্ণতায় মাখামাখি। হঠাৎ বেজে উঠলো ফোনটা। অচেনা নম্বরে ‘‘হ্যালো’’ বলতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো, ‘‘কেমন আছো? চিনতে পারছো কি?’’ গভীর গম্ভীর অথচ অসম্ভব মিষ্টি সুরেলা এক পুরুষ কন্ঠ। ভীষণ চেনা বাচনভঙ্গী... আমি ঠিক চিনেছি কি? দ্বিধান্বিত গলায় আবার প্রশ্ন করি,‘‘কে বলছেন?’’ উত্তর এলো, ‘‘সেকি? চিনতে পারছো না? শিমুল...’’ আমার উত্তেজনার বাঁধ ভাঙলো, ‘‘আরে...কবে এলে? বলো নি তো? হ্যাঁ...তাই তো, ঠিকই তো!! এখানকারই নম্বর তো? আমার নম্বর পেলে কি করে? কতোদিন আছো? থাকবে তো এখন??’’ ---- ওপাশ থেকে সহাস্য উত্তর এলো, ‘‘দাঁড়াও, দাঁড়াও... তুমি তো সব প্রশ্ন একসঙ্গেই করে ফেললে! আরে তুমি এতো উত্তেজিত হবে জানলে তো তোমার বাড়ীতেই চলে যেতাম। তোমার এই অসম্ভব এক্সাইটেড ঝলমলে হাসি হাসি মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে যে!’’ আমার প্রশ্ন তখনও শেষ হয় নি, ‘‘শুনেছিলাম এখানে আসো না আর, কোথায় ছিলে এতদিন? একা এসেছো? কোথায় উঠেছো এখানে? তোমাদের বাড়ীটা তো...’’ প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়েই উত্তর এলো, ‘‘হ্যাঁ, বাবা চলে যাওয়ার পর বাড়ীটা এখন আর নেই, আমি তো চিরকালই একা... হা হা হা...’’ সেই একই রকম প্রাণখোলা হাসি, হঠাৎ-ই গলাটা খাদে নামিয়ে জানতে চাইলো, ‘‘কাল দুপুরে দেখা হতে পারে? এইচ.এইচ.আই। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। যদি অবশ্য তোমার কোনও কাজ না থাকে!’’ আমার কাজ!!! থাকলেও কি ‘যাবো না’ বলতাম? নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘‘আচ্ছা, কাল সকালে বলছি, এটা কি হোটেলের নম্বর? এই নম্বরে ফোন করবো?” বললো, ‘‘হ্যাঁ, এটা হোটেলেরই নম্বর। কিন্তু তোমায় কষ্ট করতে হবে না, আমি ফোন করে নেবো... কখন করবো, বলো।’’ ‘‘দশটা?’’ ‘‘আচ্ছা, তাহলে কাল দেখা হচ্ছে। অনেক কথা আছে। রাখি এখন?’’ ‘‘রাখো’’ বলতে না বলতেই ‘‘গুড নাইট’’ বলেই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা রেখে দিলো। বুঝলাম, ভেতরে ভেতরে শিমুলও যথেষ্টই উত্তেজিত।

এই শিমুল লোকটার সঙ্গে সেই কিশোরী-বেলা থেকে কতবার যে দেখা হলো, তার ঠিক নেই। কোনও বারই খুব বেশী দিনের জন্য নয়। তবুও কেমন যেন একটা দাগ রেখে গেছে প্রতিবারই। শিমুলের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হাজারিবাগে। ক্লাস টেন পরীক্ষা দিয়ে ছোটো পিসির বাড়িতে বেড়াতে গেছি তখন। পিসিদের একেবারে একই পাঁচিলের প্রতিবেশী রমা কাকিমার মেয়ে লাজো-দিদির বিয়েতে এসেছিলো ওরা। রমা কাকিমার দাদার ছেলে ও। বিয়ের চার-পাঁচদিন আগে থেকে বৌভাতের দু-তিনদিন পর পর্যন্ত, প্রায় দিন দশেক... খুব ভাব হয়ে গিয়েছিলো। শিমুলও সেবার ক্লাস টেন দিয়েছিলো। তারপর কলকাতায় ফিরে অবশ্য আর কোনও যোগাযোগ ছিলোনা যথারীতি। শিমুলের সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয় আমার ইউনিভার্সিটির শেষ দিনে। সেকেণ্ড ইয়ারের রেজাল্ট তুলতে গেছি, লাইনে মারপিট লেগে গেলো। ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়লো, ছিপছিপে রোগা রোগা নেই আগের মতো, তবুও বিলক্ষণ চেনা যায়। জার্নালিজম পড়ছিলো এখানে, আর আমার কম্পারেটিভ। আশ্চর্য!! দু’বছরে একদিনও দেখা হলো না কেন, ভেবেই মন খারাপ লাগছিলো। যাই হোক, অনির্দিষ্ট কালের জন্য রেজাল্ট বিলি স্থগিত রাখা হলো। আমাদের তো পোয়া বারো। পরের একমাস প্রায় রোজই দেখা হতে লাগলো, যত দিন না রেজাল্ট হাতে পাওয়া যায়। সেই সময় নম্বর এক্সচেঞ্জ হয়েছিলো। তারপর বেশ কিছু দিন টুকটাক ফোন, টেক্সট চালাচালি, কিন্তু নিজেদের ব্যস্ততায় ধীরে ধীরে কমে আসতে আসতে তাও বন্ধ হয়ে গেলো একদিন। এর পরে অন্তত আরো দু’বার দেখা হয়েছিলো শিমুলের সঙ্গে। একবার একটা পত্রিকার অফিসে আর দ্বিতীয়বার একটা প্রেস কনফারেন্সে। এগুলো তেমন বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়। যদিও প্রতিবারই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, দেখা হলে আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগে, আর এই ভালো লাগাটা আমরা কেউই চেপে রাখতেও পারি না।

কিন্তু শেষ বারের দেখা হওয়াটাই খুব সিগনিফিক্যান্ট। ১৭ই জানুয়ারি, ২০১০। সাল তারিখ এই ভাবে মনে থাকার একটা কারণ আছে। বলছি সেই কথাটাই। সেবার অফিসের কাজ পড়লো কাশীপুর কলেজে। সোমবার সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছতে হবে কলেজে। তাই আগের দিন, মানে রবিবার ভোরবেলা চেপে বসলাম রূপসী বাংলায়। ট্রেনটা ঘন্টা খানেক লেট। ট্রেন থেকে নামার আগেই শুনলাম দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর জ্যোতি বসু চলে গেছেন, সোমবার সব বন্ধ। আদ্রা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সবে মাত্র পা রেখেছি, পিছন থেকে নিজের নাম ধরে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম। দেখি একগাল হাসি নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিমুল। পিঠে মস্ত একখানা ব্যাগ। হেসে এগিয়ে যেতেই শক্ত করে দুহাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,‘‘তোমাকে এখানে দেখবো স্বপ্নেও ভাবতে পারার কথা নয়। কোথায় এসেছো? কাল সব বন্ধ, জানো তো?’’ বললাম আমার কথা। শুনলাম ও-ও এসেছে কাজেই। ইদানিং থাকে কেপটাউনে। গ্রামবাংলার লুপ্তপ্রায় স্থাপত্যের উপর একটা ইন্টারন্যাশনাল জার্নালের জন্য তথ্যানুসন্ধান ও ছবি সংগ্রহের কাজ নিয়ে ডিসেম্বরে বারো সপ্তাহের জন্য এসেছে দেশে। আমার গাড়ী বলা ছিলো। আদ্রা স্টেশনের বিখ্যাত মাটির সরায় গরম গরম সাম্বর-ঢালা ইডলি খেয়ে সেই গাড়ীতে করে আদ্রার একমাত্র বাসযোগ্য হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম একসঙ্গেই। আমার সোমবার বিকেলের আরণ্যকে ফেরার কথা, শিমুলের মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। এখন একদিন করে পিছিয়ে যাবে। শিমুল বললো, ‘‘আরও একদিন থেকে যাও, অনেকগুলো মন্দির দেখাবো, বৃহস্পতিবার ভোর বেলা আসানসোল থেকে অমৃতসর মেল ধরে সক্কাল সক্কাল পৌঁছে যাব কলকাতা।’’ 

ইতিহাসের হাতছানি অপ্রতিরোধ্য, তাই প্ল্যান চেঞ্জ। হোটেলে এসে চটপট কিছু প্রয়োজনীয় ফোন কল, স্নান খাওয়া সেরে গাড়ী নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কাশীপুর রাজবাড়ী দেখতে। শীতের দুপুরে তখন রোদের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে। লাল ইঁট, পাথর ও কাঠের তৈরি রাজবাড়ীর স্থাপত্য ও শিল্পকলা অসাধারণ। মুঘল আক্রমণের সময় পঞ্চকোট রাজারা তাঁদের গড় কাশীপুরে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরদিন খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কাশীপুর রাজার কেল্লা, গড়পঞ্চকোট দেখতে। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমান্তে পুরুলিয়া জেলার উত্তর-পূর্ব কোণে পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই গড়পঞ্চকোট। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, শাল পিয়ালের নিভৃত অবকাশে পাহাড়ী পথ বেয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাখির কলকাকলি। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, গড়পঞ্চকোটের অতীত ইতিহাসও যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী। পঞ্চকোট রাজবংশের অতীত ইতিহাস নিয়ে পাহাড়ের উপরের অংশেই রয়েছে মন্দির ক্ষেত্র। এই মন্দির ক্ষেত্রই ছিল পঞ্চকোট রাজবংশের রাজধানী। টেরাকোটার শিল্পবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কয়েকটি মন্দির আজও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। একসময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত পঞ্চকোট রাজার এস্টেট ম্যানেজার হিসাবে চাকরি করতেন। গড়পঞ্চকোটের পাহাড়ী পথে একটি সুন্দর ট্রেকিং রুটও রয়েছে। গোবাগ মোড় থেকে পাঞ্চেৎ জলাধারে যাওয়ার পথে তিন কিলোমিটার দূরে পঞ্চকোট পাহাড়ের পশ্চিম দিকে হদহদি নামে আরেকটি জলাধার রয়েছে। এই হদহদি থেকে সাত কিলোমিটার ট্রেক করে পাহাড়ের চড়াই উতরাই পেরিয়ে বৈচিত্র্যময় শাল, পিয়াল, কেন্দুর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় ২১০০ ফুট উচ্চতায়। ফেরার পথে এখান থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মাইথন ড্যাম ও কল্যাণেশ্বরী মন্দির দেখে ফিরলাম। বিশেষ দ্রষ্টব্য, মন্দিরের পিছন দিকে মন্দির চত্বরের বাইরে একটা ছোট্ট স্বচ্ছতোয়া ঝিরঝিরে ঝর্ণা। যেন ঝলমলে পোশাক পরা একটা ছোট্ট মেয়ে নাচতে নাচতে তিরতির করে লাফিয়ে লাফিয়ে কুলকুল শব্দে হাসতে হাসতে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

পরদিন সকালটা আমার কলেজ নিয়ে আর ওর সারাদিনটাই কতকগুলো সরকারী দপ্তরের কাজ নিয়েই কেটে গেলো। কাজের মধ্যে কাজ, সন্ধ্যার পর কোথা থেকে একটা বাইক জোগাড় করে নিয়ে এলো। বললো, “গ্রামের রাস্তায় বাইক নিয়ে চলাফেরা করা সহজ, কাল আমরা বাইকে যাব।”

বুধবার খুব ভোরে বেরনোর ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু শীতের সকালে রেডি হয়ে বেরতে বেরতে আটটা বেজে গেলো। পুরুলিয়ায় যে এতো দর্শনীয় স্থাপত্য কীর্তি আছে, ধারণা ছিলো না। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছে এই জেলা। কল্পসূত্র থেকে জানা যায়, খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর এই জেলা পরিভ্রমণ করেন। এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা আজও জৈন ধর্মের প্রথাগুলিকে সযত্নে লালন পালন করে চলেছেন। মহাবীরের সময় থেকেই এই জেলা জৈন ধর্মের সংস্পর্শে এলেও এই ধর্ম পূর্ণবিকশিত হয় যখন অনন্ত বর্মন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গদেশ দখল করে বাঁকুড়ার অম্বিকা নগরে তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। অনন্ত বর্মন ছিলেন জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। সেই কারণে জৈন ধর্ম রাজানুকূল্যে প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হয়, এবং এর সূত্র ধরে একাদশ ও দ্বাদশ শতকে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার বিভিন্ন স্থানে পরশনাথ ও মহাবীরের সম্মানে বেশ কিছু মন্দির গড়ে ওঠে। কিন্তু রাজা অনন্ত বর্মন পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং বেশ কিছু জৈন মন্দিরকে বিষ্ণু ও শিবের মূর্তি সম্বলিত হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করেন। এখনও পুরুলিয়ার বেশ কিছু জৈন মন্দিরের মূর্তিগুলি সেই রূপান্তরের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি হলো, পুরুলিয়ার এক বিরাট অংশ, যা তেলকূপি নামে খ্যাত, সংরক্ষণ ও নথিকরণের অভাবে ডি ভি সি-র বাঁধের জলে নিমজ্জিত হয়ে যায়। তেলকূপি ছিল একটি বিখ্যাত জৈন-বসতি, যেখানে নবম শতকে পাল বংশের আমলে নির্মিত অসংখ্য জৈন মন্দির ও স্থাপত্য কীর্তি ছিল। 

এ সমস্ত তথ্য অবশ্য নেট ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। সারাদিন সর্বাঙ্গে ইতিহাস মেখে এবং বিশেষত দুর্লভ স্থাপত্যগুলির বিলুপ্তপ্রায় ধ্বংসাবশেষ দেখে পরিশ্রান্ত, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শেষ বিকেলের দিকটায় ফেরার পথ ধরতেই হলো। শীতের বিকেলে অন্ধকার নামছে দ্রুত, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠাণ্ডা। ফুলস্পীডে আমাদের বাইক ছুটে চলেছে কখনও মাঠের মাঝখান দিয়ে, কখনও নিবিড় জঙ্গল চিরে, কখনও গ্রামের মাঝ-বরাবর, কখনওবা গ্রামগুলোকে একপাশে রেখে। এমনই এক গ্রামের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখলাম কাঁচা রাস্তা থেকে প্রায় একশো হাত দূরে একটা গাছের চারপাশে গোল হয়ে কিছু আদিবাসী নারীপুরুষ। অনেকগুলো মশাল জ্বলছে। অসম্ভব ঠাণ্ডায় একটু আগুনের লোভে বাইকটাকে একটু দূরে পার্ক করে পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হলাম ওদের কাছে। একজন প্রৌঢ় মানুষ ইনিয়ে বিনিয়ে একঘেয়ে করুণ সুরে গেয়ে চলেছে–

পাঁচেত ডেমে বুধনী
গেল কাম করতে
এক ডঁড়রী ভাতের লাগ্যে
হামি বঁলিয়েছিলি যা'স না বিটি।
যুয়ান বিটি বললেক
কাম না করল্যে খাব কি বাপ্
চাষ গেল বাস গেল, মাথার উপর
খাপরার চালটাও গেল
ঘর খাঁয়েছে দুয়ার খাঁয়েছে
হামদের গাঁ টাও খাঁয়েছে
গতরখাওকি ডেমে---
----------
বুধনী আমার হারাঁয় গেল জলে।
পাঁচেত ডেমের জল নকি কাল
খড়ি গুনে বলত ঠাকুর
বিটির আমার এমন ক্যেনে হল্য।
তবে কি পাঁচেত ডেমও জাত খুয়াল্য?

লোকটার পাশে বসে বসে আরেকজন মাদলে তাল দিয়ে যাচ্ছে... ধিম ধিম ধিম... কেমন এক ছায়া ছায়া ভৌতিক পরিবেশ। আমরা যে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, মনে হলোনা কেউ লক্ষ্য করেছে। বুঝলাম, মহুয়া আর হাঁড়িয়ার নেশায় বুঁদ সবাই। গাছের নীচে কমলা আর লাল সিঁদুর মাখা কতকগুলো পাথর। শিমুল বলল, মারাংবুরু – ওদের দেবতা। তারপর ওর দেখাদেখি আমিও মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করলাম দেবতাকে। বুঝলাম, প্রশ্নটা এখানে আমাদের নয়, ওদের বিশ্বাসের - এই মাঝরাতে যেটা না ঘাঁটানোই ভালো। আদিবাসীদের বৃত্তটার বাইরে এসে জিন্সের হাঁটুর কাছের ধুলো ঝাড়ছি, শিমুল নিচু হয়ে একমুঠো লাল কাঁকর ওয়ালা ধুলো তুলে আমার জামাকাপড়ে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘‘এখানকার ধুলো ঝাড়তে হয়না, বোকা, মাখতে হয়।’’ 

আগুনের মায়া ত্যাগ করে ফেরার পথ ধরলাম আমরা আবার। ঘড়িতে তখন আটটা বেজে গেছে। কাছাকাছি সময়ে মনে হয় পূর্ণিমা ছিলো বা আছে। চারিদিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বচরাচর শুনশান, একটানা কেবল ঝিঁঝিঁর ডাক আর মাঝে মাঝে কিছু রাতজাগা পাখীর ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। মাঘের হিম সোয়েটার জ্যাকেট জামা কাপড় ভেদ করে হাড় পর্যন্ত কনকনিয়ে দিচ্ছে। হাতপায়ের অঙ্গুলগুলো সব অবশ হয়ে গেছে। আধমড়া অবস্থায় যখন হোটেলে ফিরলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় হাত জোড়া করেছে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আবার বেরতে হবে, তাই আর ঘুমনোর সাহস হল না। ঠিক করলাম, বাকি সময়টুকু গল্প করেই কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আমার এবার শরীর খারাপ করতে শুরু করেছে। আমার একটু ঠাণ্ডার ধাত, বুঝলাম হিম লেগে গেছে বেশ। তিনটে চারটে কম্বলের নীচেও কাঁপছি ঠক ঠক করে। রুম হিটারে কাজ হচ্ছে না। হঠাৎ টের পেলাম কম্বলের নীচে আমার ঠাণ্ডা পা দুটো ওর কোলের ওপর তুলে নিয়ে জোরে জোরে মাসাজ করতে শুরু করলো। আমার অবশিষ্ট সমস্ত শক্তিটুকু দিয়ে একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হলো না দেখে ওর উষ্ণতার আহ্বানে আত্মসমর্পন করলাম একপ্রকার নিরুপায় হয়েই।

এর পর আর আমাদের একটাও কথা হয়নি। না, সেই মাঝরাত থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত একটাও কথা নয়। কেমন যেন ওর দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। শুধু হাওড়া স্টেশনে নেমে প্রিপেড ট্যাক্সি বুথের দিকে এগোতে এগোতে পিছন ফিরে দেখলাম, নতুন প্ল্যাটফর্মের এগজ়িট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তখনও। দিনতিনেকের মধ্যে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো ফেসবুকে, অ্যাকসেপ্ট করলাম, কিন্তু ওই... কথা হলো না কিছুই। এর প্রায় মাস চারেক পর হঠাৎ ইনবক্সে শিমুল– ‘‘আজ সারাটা দিন ধরে আকাশের মুখ ভার। তোমার নিবিড় সমন্বিত আদুরে সংসারে ঝলমলে রোদ কি? ইচ্ছে করে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে আনি তোমায়। একটু মেঘের ভাগ দিই, একটু রোদের ভাগ নিই। তারপর আলোছায়ার বোঝাপড়ায় অতলস্পর্শী খেলা। তলিয়ে যেতে যেতে গভীরে গহনে আরও গভীরে...শেষমেষ নির্ভার, নিষ্কাম শুধু চেতনার আলোটুকু নিয়ে উদ্বেল, উদ্ভাসিত একাকার অস্তিত্ব হয়ে নদীগর্ভে শুয়ে থাকা পাশাপাশি অনাদি, অনন্ত কাল।’’

পড়লাম, অনেকবার। কিন্তু কি উত্তর দেবো বুঝতে পারলাম না বলেই আর উত্তর দেওয়া হলো না। তারপর কেটে গেছে কতগুলো দিন, কতগুলো বছর… কতশত পুরনো স্মৃতি আর নানান রকম সম্ভাবনার কথা একসঙ্গে ভীড় করে আসছে মনের মধ্যে। কখন যে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত্রি নেমেছে চুপিসারে, টেরও পাইনি। শুধু বুঝেছি, আজ আর সারারাত ঘুম হবে না। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াই আমার বড়ো প্রিয় দক্ষিণের বারান্দায়। এখানেই বসি একটু এই উঁচু ব্যাকরেস্ট-ওয়ালা আরাম কেদারাটায়। আজও আকাশে সেই সেদিনের মতোই এত্ত বড় সোনার থালা চাঁদ... জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চারিদিক! এমনই কোনও জ্যোৎস্নারজনীতে মনে কি পড়েছিলো আমায় তার! কখনও কোনও পরিশ্রান্ত দিনান্তের অবসন্ন অখণ্ড অবসরে! বলছিলো, অনেক কথা আছে... অনেক কথা? কত কথা? কি কি কথা? কখন থেকে সেই একই কথা ভেবেই চলেছি। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই পরেরদিন দুপুরের জন্য। কিন্তু ক্লান্তিতে চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসছে... দুপুরবেলা এতো জ্যোৎস্না এলো কোথা থেকে? আমার জিন্সেও কতো ধুলো... ধুলো মাখতে হয়... ধুলো মাখতে হয়... মারাংবুরু, মারাংবুরু, বুধনী একা একা কোথায় হারিয়ে গেলো? একা একা! একা? তুমি তো চিরকালই একা... আমিও খুব একা, জানো! আমি আসছি, শিমুল... আসছি... আসছি... অপেক্ষা করো, প্লীজ... অপেক্ষা করো... অপেক্ষা... অ পে ক খ্‌ খ্‌ আ আ...
0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ অমলেন্দু চন্দ

Posted in

ব্যক্তিগত গদ্য





ফুটবল – বাঙ্গালী – বঙ্গাল 
অমলেন্দু চন্দ



টেরিকটের ময়লা পাঞ্জাবীটার বুকের বোতাম নেই, নিকুচি করেছে - বলে দূষ্মন্ত বেরিয়ে এলো হাওয়াই চটিটা গলিয়ে। দরজার বাইরেই পাড়ার দু তিনটে কুকুর - রকের ছায়ায় দিবা তন্দ্রার ঘোরে আরাম পেঁদাচ্ছিলো - দু তিনখানা চমকে ওঠা ঘেউ, দূষ্মন্ত চমকে উঠে লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল - একেই এত চাপ মাথায়, তার ওপরে আবার ইন্সটিঙ্কটের পাছায় ঘেউয়ের পয়জার, শালা খালি যেন মদ্দা গুলোকে খোজা করে দিলেই পাড়ায় শান্তি এসে যাবে, দূষ্মন্ত ঠিক করল এবারের ভোটে গাড়োল কাউন্সিলারটাকে আর ভোট দেবে না। কেউ যদি তার দায়িত্ব ঠিক ঠাক ... নিজে এতদিন ধরে দায়িত্ব টায়িত্ত্ব গুলোকে ইস্তিরি করা পায়জামা পাঞ্জাবীর মত থাক থাক করে সাজিয়ে রেখে সময়মতই পাট ভেঙেছে - এখন... অজান্তেই দূষ্মন্ত ময়লা পাঞ্জাবিটার বুকের বোতাম খুঁজল। সামনের বাসটায় উঠে পড়ল সে, পেছনে পরে রইল বৌমার স্বর – ও খোকন, দাদু কে বল মেটের ঝোল করেছি, দাদুর খেতে ভাল লাগে। খোকনের তখন কলেজের তাড়া – ‘তুমি বল না’ বলে সে পিট্টান দিয়েছে। 

আজকাল আর পেরে ওঠে না। খোলা রোদে গরম বাতাসে টাকের শরীরটা গরম হতেই খুলির ভেতরটা ঠাণ্ডা হতে শুরু করল - ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর। পলিটিক্যাল সাইন্সের শিক্ষক – ছিলেন। দেশভাগের রাজনীতি আর তাই নিয়ে পলিটিক্যাল পার্টি গুলোর মানে তাদের নেতাদের কম্ম অপকম্ম গুলোকে নিয়ে একদিন রেস্ট রুমে বিশাল কচকচি, সেদিন ওর বাগ্মিতায় বেকায়দায় প্রিন্সিপ্যাল অব্দি, নাকাল হয়ে গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, আপনি আমার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন। সেটা সত্তরের দশকের শেষ প্রান্ত। তারপর যথারীতি প্রাইভেট কলেজের গভারনিং বডির দোহাই, আপনার এইসব কথা তাদের কানে গেলে, বুঝতেই তো পারছেন, আমরা বজায় আছি অন্যের বদান্যতায়, সেটা বন্ধ হলে কলেজটা - প্রিন্সিপ্যালের পিতাঠাকুর কলেজটা খুলেছিলেন, অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে কলেজ স্পন্সর পেয়েছে একটা গোষ্ঠীর, পরের ধাপ পূর্ণ অ্যাফিলিয়েসান। সেদিন বিকেল পর্যন্ত দুষ্মন্ত ময়দানের তাঁবু গুলোর আশে পাশে ঘুরে বেরিয়েছিল। ও ফুটবল খুব ভালবাসে। নিজে খুব একটা খেলে নি, কিন্তু অনেক অপূর্ণ সাধের দ্বেষ ভেতরে উথলে উঠলে ও মাঠে চলে আসে দেখতে – আর ওই লাথালাথিটা যেন পরোক্ষে ওর অনেক কিছুকে ল্যাথাতে চাওয়ার বিকল্প চেহারা নেয়, আর তখন গোল হলে ও উল্লাসে ফেটে পড়ত – গো ও ও ও ল।

সেদিন নিজের শিক্ষা দীক্ষার প্রতি দায়িত্ত্বের একটা পাঞ্জাবীর পাট ভেঙ্গেছিল দুষ্মন্ত, রেজিগ্নেসান দিয়েছিল, এই বলে - যেটা শিখেছি, জেনেছি, বুঝেছি কষ্ট পেয়ে, (দুষ্মন্তের পরিবারের অনেকেই দেশভাগের বলি হয়, বিশেষ জেঠুদাদু আর তার ছেলে মেয়ে, ও পার ছেড়ে এ পারে আসেন নি সময়মত) সেটা আপনাদের রুটির লাথি খেয়ে ভুলতে পারব না। দেশভাগের আগে চলে আসার কারণ যে খুব আনন্দের ছিল এমন নয়। নানা কারণ ছিল, ভিটে থাকলেও হয়ত থাকা যাচ্ছিল না। আর এ দিকও যে খুব বুক বাড়িয়ে টেনে নিয়েছিল, এমনও নয়। ফলে কোথায় যেন একটা ছিন্নমূল তকমার বক্রতার মুখোমুখি হতে হত অহরহ। তবু একটু জমিন ছিল – রবীন্দ্রচর্চা, কবিতা, সংস্কৃতিচেতনা আর ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এ সমস্ত বুঝতে বুঝতে পঞ্চাশের দশক শেষ হয়ে এসেছে। শহরের পথে সেই সময়ের অদ্ভুত সব শব্দ আর গন্ধও, পুনর্বাসন, জমি দাও-এর দাবি দাওয়ার সব আওয়াজ, অবর্ণনীয় সব দুর্দশার ছবি।

জেঠুদাদু, বাবার বড় ভাই। ঠাকুরদার দুটো বিয়ে ছিল, প্রথম পক্ষের সন্তান জেঠুদাদু বয়েসে বাবার থেকে প্রায় বছর আঠেরোর বড়। সেই জেঠুদাদুর - ছিন্নমূল, উচ্ছেদের যন্ত্রণা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই, আর তার সাথে বেঁচে থাকার লড়াই, সব একসাথে। ৪৭ এ আসেন নি, ভেবেছিলেন - কি ভেবেছিলেন, সেটা অবান্তর। মেলে নি সে হিসেব। পরে সেই ৫১ এ আসা। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন, ভূস্বামী রাতারাতি ভূমিহীন, সেও এক অদ্ভুত শ্রেনীচ্যুতি। সম্বলহীন অসহায়, স্বজনের কালীঘাটের ভাড়া বাড়িতে। দরজার বাইরে গলিতে এক চিলতে সকালের রোদে ঝিম মেরে জেঠুদাদুকে বহুদিন দেখেছে দুষ্মন্ত একটা বেতের মোড়া টেনে বসে থাকতে, সাইকেল বা রিক্সা গেলে সসংকোচে দীন মুখে প্রায় মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতেন মোড়া হাতে। 

বাবা চাকরি সূত্রে কলকাতায়, বাসা পেয়েছিলেন কালীঘাটে, তার মামার কল্যাণে। দুষ্মন্ত ওই বাড়িতেই স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সেরেছে, দেখেছে জেঠুদাদু ট্যাহা পয়সার সন্ধানে দিয়েছেন মুড়ি চপ তেলেভাজার দোকান। অথচ বাবার মুখে শুনেছে ওই জেঠুদাদু নাকি ছিলেন জবরদস্ত তালুকদার, তাল পুকুর ছিল আর ঘটিও ডুবত সেখানে। তবে জেঠুদাদুর মুখে তালুক মুল্লুকের গপ্পো কোনদিন শোনেনি। কান্তিময় বৃদ্ধ অনেক জোড়হাত দেখেছেন, কিন্তু গজনভী মেজাজের হয়ে যান নি। তাই এপারে এসে পরার পর জোড়হাত হয়ে থাকতে থাকতে একদিন চলে গেছেন। সব দেখেছে দুষ্মন্ত আর অধীর হয়েছে।

দুনিয়ার সমস্ত ভাগের পেছনের রাজনীতি – মধ্যস্বত্ত প্রথা, সেই নিয়ে আর এক রাজনীতি, পুনর্বাসন, তার ফলপ্রসূ হওয়া বা না হওয়ার দরুণ অনেক অসহায়তার নির্মম ছবি, সব কিছু যেন আড়াল হয়ে যেত ফুটবলের মাঠে। ইস্টবেঙ্গল – নামে কোথায় যেন একটা সেই হাতছানির সুর, সেই পুকুর পার, বাঁশ ঝাড়ের ঝুঁকে পরা পাতার তলা দিয়ে পথ, মাছের চাষ, গরু-বাছুর, মেঠো আলপথ, ধানক্ষেতের আলের পাশে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত দক্ষতায় জলে ভরা ক্ষেতের ওপর নির্দিষ্ট দূরত্বে নির্ভুল নিশানায় ধানের চারার আঁটি গুলো ছুঁড়ে দেওয়া, জনেরা কাজ করবে যখন তখন ওই আঁটির থেকে গাছ ছাড়িয়ে নিয়ে মাটিতে অভ্যেসের অবহেলায় পুঁতে দেবে, সব সব যেন ওই নামটার মধ্যে কোথায় নিসচিন্দিপুরের হাতছানির মত।

দুষ্মন্ত নিজের মনেই হেসে ফেলে। ওই ক্লাবটার গোড়াপত্তনের সঙ্গে ও পারের যোগাযোগ অদ্ভুত, অন্তত ক্লাবটার ইতিহাস তাই বলে। ও একটু পড়াশুনো করেছে এ নিয়ে। ক্লাবের গোড়াপত্তনের সঙ্গে সন্তোষের রাজা মন্মথ চৌধুরী জড়িয়ে ছিলেন, সে কথা পরে।

১৯১১ তে মোহনবাগান প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আই এফ এ শিল্ড জিতল। সেটা তখন রাজ-রাজত্বের সময়। ক্লাবের এ হেন সাফল্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চাগার দিয়ে উঠল নতুন এক অনুভূতির জোয়ারে। এদেশিরা নেটিভ, খালি পায়ে খেলে। সাহেবদের বদান্যতায় একটু আধটু, তার সঙ্গে আছে সেই সাহেবি কালচারের কলোনিয়াল প্রসারণ আর একীকরণের ব্যাপার তাই মাত্র দুটো ক্লাব ফার্স্ট ডিভিশন খেলতে পায়। এর মধ্যেই আবার কলোনিয়াল পলিটিক্স, বাংলা ভাগ করার চেষ্টা হয়ে গেছে কয়েক বছর আগে, খোদ রাজাকে এসে অবস্থার সামাল দিতে হয়েছে। সে সময়ে কুমারটুলি সেকন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হলেও ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায় নি, কারণ দুটো দল – নেটিভদের – ফার্স্ট ডিভিশন খেলছে। তাই কুমারটুলিদের মত ক্লাব কে ওই সেই কুচবিহার ট্রফি খেলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হত। ১৯১৭, ১৯১৮ আর ১৯১৯ পর পর তিনবার কুমারটুলি সেকেন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়। 

সেটা ১৯২০ সাল। মোহনবাগানের ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট এর সঙ্গে একটা সংঘাত বাধল তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট সুরেশ চন্দ্র চৌধুরীর। সেই কুচবিহার ট্রফি তে মুখোমুখি হয়েছে মোহনবাগান আর জোড়াবাগান ক্লাব। এক অজানা কারণে জোড়াবাগানের স্টার ফুটবলার শৈলেশ বোস কে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে তারিখটা ছিল ২৮শে জুলাই ১৯২০। চৌধুরীবাবুর অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বোস খেলতে পারলো না, জোড়াবাগান এবং মোহনবাগানের সাহেবী এবং আধা সাহেবী নিয়ম নিষ্ঠতার অজুহাত, চৌধুরী ক্ষেপে গেলেন।

ঈন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বলে কথা, তায় তৎকালীন সব রাজা টাজা দের সাথে ওঠা বসা, কৃপানাথ লেনের শোভাবাজারের বাড়িতে বসে মিটিং হল সেদিনই। শোনা যায় রাজা মন্মথ চৌধুরী, বোস নিজে, অরবিন্দ ঘোষ, রমেশ চন্দ্র সেন – কে ছিলেন না সেই মিটিঙে। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল নতুন ক্লাব ১লা আগস্ট ১৯২০, নাম হল ইস্ট বেঙ্গল। একটা তথ্য অবশ্য নামকরণের পেছনে হয়ত কাজ করেছিল, মন্মথ চৌধুরী ছিলেন সন্তোষের রাজা, আজকের বাংলা দেশে সেই জায়গা, আর তার নামেই সন্তোষ ট্রফির নামকরণ। এরা সকলে নাকি জার্সির জন্য তুমুল তর্ক বিতর্ক করে সেই সময়ের হোয়াইটয়ে ল্যাডল এর চৌরঙ্গীর বিরাট অ্যারিস্টোক্র্যাটদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের শো কেসে ঝোলানো লাল-হলুদ একটা জামা পছন্দ করেছিলেন, আর সেটাই ক্লাবের রং হয়ে গেল। উত্তর কলকাতার কুমারটুলি পার্কে শুরু হল অনুশীলন আর খেলা। ১৯২৫ সালে প্রথম ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান মুখোমুখি হল, এর আগে ১৯২৪ এ ইস্টবেঙ্গল প্রথম যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেকেন্ড ডিভিসানে ক্যামেরুন বি নামে একটি ইংরেজদের ক্লাবের সঙ্গে। প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই বাজী মাত, ইস্টবেঙ্গল ১ মোহনবাগান ০, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের চলেছে বহু বহুকাল, যেন অনন্তকাল। রিটার্ন ম্যাচে ফলাফল উল্টো, মোহনবাগান এর প্রতিশোধ। 

ইস্টবেঙ্গল প্রথম আই এফ এ শিল্ডের সেকেন্ড ডিভিসানে জায়গা পেল আর এক রাজার বদান্যতায়। তাজহাট ক্লাবের মালিক রাজা গোপাল রায়ের চেষ্টায় ইস্টবেঙ্গল তাজহাট ক্লাবের স্থলাভিষিক্ত হল, মজার ব্যাপার এ নিয়ে মোহনবাগান আর আরিয়ান ক্লাব – অনেক জল ঘোলা করেছিল বলে শোনা যায়। 

নিয়তির পরিহাস, ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা তখন ক্লাবের জন্য ময়েদানে একটা জায়গে খুঁজতে আরম্ভ করেছেন, এমন সময়ে জানা গেল যে মোহন বাগান গ্রাউন্ডের পার্টনার ন্যাশনাল এ সি দেউলিয়া হয়ে গেছে। সেটা ছিল বেহালার এক জমিদারের ক্লাব। মোহনবাগান তখন নিরবিচ্ছিন্ন পুরো জায়েগাটা ব্যাবহার করছে। ইস্টবেঙ্গল পত্র দিল তৎকালিন অথরিটিদের। মোহনবাগানের বিরাট প্রটেস্ট সত্ত্বেও ১৯২২ সালে কুমারটুলি পার্কের গোল পোস্ট তুলে এনে ন্যাশনাল এ সি’র রেড রোডের দিকের ভাগের মাঠে পোঁতা হল। রাইভ্যালরি শুধু মাঠেই ছিল না, মাঠের বাইরেও ছিল। ইস্টবেঙ্গল যখন ১৯২৪ এ যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হল, যেহেতু ক্যামেরুন ক্লাবের এ টিম অলরেডি ফার্স্ট ডিভিশন খেলছিল, তাই কথা উঠল ইস্টবেঙ্গলের উঠে আসার, কিন্তু যেহেতু আই এফ এর নিয়ম ছিল মাত্র দুটো টিম থাকবে আর সেই টিম দুটো ছিল মোহনবাগান আর আরিয়ান, তাই গভারনিং বডি’র মিটিঙে প্রস্তাব উঠল নিয়ম পরিবর্তনের, আর মোহনবাগান তার তীব্র বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু বাকি ব্রিটিশ ক্লাব গুলো সমর্থন করায় নিয়মের বদল হয়ে যায় আর ইস্ট বেঙ্গল প্রথম ডিভিসানে জায়েগা পায়।

বোধহয় এই রাজা মন্মথ রায়ের যুক্ত থাকার কারনেই ক্লাবটা এরকম ধারনায় বাঙ্গালদের ক্লাব হয়ে উঠল – অন্তত মেজাজের দিক থেকে, আর একটা নতুন ডাইমেন্সান এলো কলকাতার ফুটবল মাঠে – ঘটি বাঙ্গালের লড়াই। তারপর একদিন আইডেন্টিটির খোঁজে আসা পার্টিসানের পরের মানুষগুলো ইমোসন্যালি এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল।

১৯৪২ এ প্রথম আই এফ এ শিল্ড বিজয়, ১৯৫১ তে ডুরান্ড কাপ, তার মধ্যে তিনবার আই এফ এ বিজয়। এর মধ্যে কলকাতা ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন ১৯৪২, ১৯৪৫, ১৯৪৬ – সব পার্টিসানের আগে। ১৯২৫ সালের এপিক প্রথম লড়াইয়ের কথা ক্লাবের ওয়েবসাইটে পেপার কাটিং এ দেখতে পাওয়া যায় – স্টেটসম্যানের রিপোর্ট। আর সেদিনের সেই লড়াইয়ে যে খেলোয়াড়কে কেন্দ্র করে বিবাদের দরুন ইস্টবেঙ্গলের জন্ম হয়েছিল সেই এস বোস খেলেছিল মোহনবাগানের হয়ে। আয়রনি। একমাত্র গোলটি করেন এন চক্রবর্তী। সেদিনের খেলায় মোহনবাগানের হয়ে একজন খেলেন – ভাদুরি, সম্ভবত দ্বিজদাস ভাদুরি। ২৭শে মে’র কাগজের কাটিং দেখাচ্ছে স্টেটসম্যান বলছে মাঠে একটা বিরাট ভিড় প্রত্যাশিত, আর ২৮শে মে’র ছবি দেখাচ্ছে গ্যালারিতে মাথা ছাড়া কিছু নেই। কলকাতার ফুটবল মাঠের সবচাইতে বড় ভিড় এই ক্লাবের সঙ্গেই জড়িত। ১৯৯৭ সালে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে – প্রায় ১৩১০০০ লোক জড় হয়েছিল ডার্বি কাপের সেমি ফাইন্যালে। 

দুষ্মন্ত ফিরে এল তার নিজের সময়ে। কিছুদিন আগেই পড়ছিল অধ্যাপক প্রফুল্ল চক্রবর্তীর মারজিন্যাল মেন নামের বইটির একটি আলোচনা। কি ভাবে সব ছিন্নমূল আস্তে আস্তে এ পারের রাজনীতিতে একটা সম্ভাবনাময় বদলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার আলেখ্য। ও আবার হেসে ফেলে। সম্ভাবনাময় অস্তিত্ত্ব, নাকি এ আর এক জোটবন্ধন। 

মানুষের বাঁচার লড়াইয়ে এই সব ছিন্নমূল কাকা কাকিমা দাদা ভাই রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়ান লোক, ঝুড়ি মাথায় অপেক্ষায় থাকা মজুর, এমনকি একটু অবস্থাপন্ন হয়ে ওঠা লোকটা – কেউ বিচ্ছিন্ন নয়, সবাই এই লড়াইয়ের ময়দানে এক একটা প্রতীক, আর অবিরাম সেই দ্বন্দ্ব আর দ্বন্ধের খেল। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান – মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল। 

এই লড়াইয়ের মধ্যেই যেটা আন্তর্জাতিকতার সুর বাজিয়েছে, তা হল ১৯৫১ তে দিল্লি আর ১৯৬২ তে জাকার্তায় গোল্ড মেডাল। এখানেই শেষ নয়, ১৯৫৬ তে মেলবোর্নে প্রথম এশিয়ান নেশন হিসেবে অলিম্পিকে সেমি ফাইন্যাল খেলা। কলকাতার মাঠ গরবিনী জনমদায়িনী সেই সব ফুটবলারদের বৈশিষ্টের। ১৯৫১ তে ছিলেন ভরদারাজন, শৈলেন মান্না, নুর মুহাম্মদ, সন্মুগম, রুনু গুহ ঠাকুরতা, ভেঙ্কটেশ, সালেহ, মেওয়ালাল – সব অনবদ্য খেলোয়াড়। ফাইন্যালের জয়সূচক গোলটি করেছিল মেওয়ালাল। 

১৯৫৬ র দলের সদস্য ছিলেন তুলসিদাস বলরাম, পি কে ব্যানার্জী, থঙ্গরাজ, সমর (বদ্রু) ব্যানার্জী, কান্নন, কেম্পিয়াহ, নিখিল নন্দি, নুর মুহাম্মদ, লতিফ, রহমান – সব চাঁদের হাট। ১৯৫৬ সালে যখন পি কে ব্যানার্জী এই দলের সদস্য হন, তখন তার বয়েস মাত্র কুড়ি। টিমের গ্রীন হর্ন। আগের বছর কোয়াড্রাঙ্গুলার কাপে ঢাকায় গায়ে তুলেছেন ন্যাশনাল টিমের জার্সি। ক্লাব ফুটবলে খেলছেন মোহনবাগানে। সেমি ফাইন্যালের যাত্রা পথে ভারত হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া কে ৪-২ গলে। ভারতের পক্ষে হ্যাট্রিক করেছিলেন নেভাইল ডি সুজা। ফুটবলের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত একমাত্র এশিয়ান, যে অলিম্পিকে হ্যাট্রিক করেছে। সেমি ফাইন্যালে ইউগোস্লাভিয়ার কাছে ১-৪ গোলে হেরে যায়। অবশ্য এই যাত্রার শুরু ১৯৪৮ এর অলিম্পিকে, যেখানে টি আও এর নেতৃত্বে ভারত কোয়ার্টার ফাইন্যালে পৌঁছে হেরে যায়। 

১৯৬২ র দলে ছিলেন থঙ্গরাজ (মহমেডান স্পোর্টিং), জার্নেল সিং (মোহন বাগান), অরুণ ঘোষ (ইস্টবেঙ্গল), রাম বাহাদুর (ইস্টবেঙ্গল), প্রশান্ত সিন্‌হা (ইস্টবেঙ্গল), পি কে ব্যানার্জী (রেলওয়েস), চুনি গোস্বামী (মোহন বাগান) তুলসিদাস বলরাম (ইস্টবেঙ্গল), অরুময় নৈগম (মোহন বাগান)। কলকাতার মাঠের ক্লাব দুটো দিয়েছে অনেক। আর সেটাই ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ। ১৯৫৯ এর মারডেকা কাপে ভারতের রানার্স আপ হওয়া সেই যুগের শেষ বিজয়। লতিফ সেই টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। 

মোহনবাগানের গেল শতকের গোড়ার দিকের খেলোয়াড় ছিলেন। সেই সময় মাঠের প্রবাদপ্রতিম দ্বিজ দাস ভাদুরি। তিনি ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন চার বছর। গোষ্ঠ পাল খেলেন সেই বছর চারেক, তার পরেও খেলেছেন ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত, সে সময়ের আরেক দিকপাল উমাপতি কুমার। এ ছাড়া করুণা ভট্টাচার্য, বেনি প্রসাদ, সতু চৌধুরী। ১৯৪২ সালে শৈলেন মান্না খেলতে শুরু করেন মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে। সঙ্গী টি আও। 

আটাত্তর বছরের দুষ্মন্তের বুকে আজও সেই সময়ের দাপানি রয়ে গেছে। চল্লিশের সেই একেবারে শুরুর দিকে বাবার সাথে মা আর পিসিমা কে নিয়ে কলকাতায় এসে পড়া। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গড়ের মাঠ উদ্বাস্তু শৈশবের সব বুনিয়াদি ব্যাপার স্যাপারের মাঝে নিজের অজান্তেই চলতে শেখা বাল্যকাল। রিফিউজি এডুকেসান স্কিম - রাজ্যের তৈরি করা বরিষা কলেজ, আজকের ভিভেকানন্দ কলেজে ভর্তি হওয়া। সেটা ছিল ১৯৫২। বেহালায় কলেজ করতে যেতে হত, কালীঘাট থেকে। কলেজ থেকে ফিরে চলে যাওয়ার জায়গা ছিল গড়ের মাঠ, আর ফুটবলের ক্লাবগুলোর আশে পাশে ঘোরাঘুরি। 

১৯৭০ এ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য হলেন। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের রাইভ্যালরির সেটা তুঙ্গের সময়। সেই অনন্য দিনটাকে আজও ভুলতে পারেন নি দুষ্মন্ত – ১৯৭৫ এর ২৯শে সেপ্টেম্বর। ইস্টবেঙ্গল হারিয়েছিল মোহনবাগান কে ৫-০ গোলের ব্যবধানে। শ্যাম থাপার সেই অনবদ্য ভলি কিকের গোল, দুটো গোলের মধ্যে একটাতে, সুরজিত সেনগুপ্তর বক্সের মাথা থেকে আচম্বিতে করা সপাটে কিকের গোল, আরও দুজনের দুটো গোল, বাসের মধ্যে দুষ্মন্তর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আজ অব্দি এত মার্জিনে দু ক্লাবের আর কোন খেলায় জয় পরাজয় হয় নি। সেটা ছিল আই এফ এ শিল্ডের ফাইন্যাল। 

সত্তর থেকে ছিয়াত্তর – দুষ্মন্তের বুকটা একটু ফুলে ওঠে আজও ভাবলে – যে বছর তিনি ইস্টবেঙ্গলের সদস্য হলেন সেই বছর থেকে শুরু করে একটানা ছ বছর ১৯৭৫ অব্দি ইস্টবেঙ্গল লিগ চ্যাম্পিয়ন, যেন দুষ্মন্তকে একটা শিল্ড দিয়েছিল এভাবে ক্লাব টা। এ ছাড়া ১৯৭০, ৭২ থেকে ৭৫ অব্দি আই এফ এ শিল্ড, দুষ্মন্তরাই তখন ময়দানের রাজা। সুকল্যান ঘোষদস্তিদার, বলাই রায়, সুভাষ ভৌমিক, প্রণব, পরিমল দে, কান্নন, কাজল ঢালি, নাইমুদ্দিন, প্রশান্ত মিত্র, উল্গানাথন। ১৯৭৬ এ এলো কয়েকটি তরুণ – জমাট খেলা। সুব্রত ভট্টাচার্য, সমরেশ চৌধুরী। কোরিয়ার পিঅং ইওঙ্গ এর সঙ্গে সমরেশ চৌধুরী সুভাষ ভৌমিকের সে কি খেলা, আজও মনে আছে। আরও কত জনের কথাই তো মনে পড়ে – সুধীর কর্মকার, আকবর, হাবিব, বিদেশ বোস, শেষ হয় না ভাবতে বসলে। 

আস্তে আস্তে মেজাজটা নরম হয়ে আসছিল বৃদ্ধের। কানে ভেসে উঠল বউমার গলা – খোকন দাদু কে বল মেটের ঝোল করেছি, এখন না বেরোতে। ছিয়াত্তর বছরের দুষ্মন্ত বাস থেকে নেমে ফেরার বাস ধরল। এক সময়ের কোথাকার মানুষ ঘরে ফেরার পথ ধরল। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – এটা লেখার সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ওয়েবসাইটের তথ্যবহুল পাতা ব্যবহার করা হয়েছে সে জন্য ক্লাবের কাছে কৃতজ্ঞ। এ ছাড়া আরও অনেক ওয়েবসাইটের সাহায্য নেওয়া হয়েছে তথ্যের প্রয়োজনে – সবাইকার কাছে আমি কৃতজ্ঞ;













1

ব্যক্তিগত গদ্যঃ সীমা ব্যানার্জী-রায়

Posted in

ব্যক্তিগত গদ্য 



রবিঠাকুর, একটা গল্প লিখবে ?
সীমা ব্যানার্জী-রায়







প্রিয় রবিঠাকুর,
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, কলকাতা ৭০০০০৭।

তোমার ১৫৫তম জন্মদিনের সুরের মাধুর্যে মেতেছে সোনালী আকাশ, বাতাস। ফেলে আসা দিন গুলোর স্মৃতিতে মনটা ব্যকুল হয়ে উঠেছে। বেলি ফুলের সমারোহের সাথে গোলাপ আর মাধবীলতার আহ্লাদী ভাব ঠিক এই সময়। গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটকে চারিদিক থেকে তোমাকে জানাবে প্রণামী অর্ঘ্য। আমার নেই তেমন কোন অর্ঘ্য কবিবর, আছে শুধু এক উদ্ধত অনুরোধ। একটা গল্প লেখো। দোহাই তোমার রবিঠাকুর, একটা অসামান্য মেয়েকে নিয়ে গল্প লেখো।

কল্যাণীকে নিয়ে লিখেছিলে 'অপরিচিতা'। ষোড়শীর পরিচয় দিয়েছিলে 'তপস্বিনী'তে। কাদম্বিনীকে অমর করলে 'জীবিত ও মৃত' গল্পে। 'সাধারণ মেয়ে' তে আঁকলে মালতীর আলেখ্য। 'সাগরিকা'য় রূপ দিলে অনন্যা তরুণীর স্বপ্নমায়াকে। এমন কি ডানাহারা, উড়োপ্রাণ, বাংলাদেশের মেয়ের বিদ্রোহীবুকের ব্যাথালিপি রূপায়িত করলে 'বাঁশিওয়ালা' র সুরে। কিন্তু তোমার লেখনীতে প্রকাশ পায়নি একটি অসাধারণ বাঙ্গালী মেয়ের প্রতিবিম্ব। 

আমি তোমায় জানাতে চাই একটি দৈবলব্ধ জীবনের কাঠামো যার রস তীব্র ও মধুর। শুনবে তার কথা? লিখবে, বলো, তার গল্প, রবিঠাকুর? সেই অসামান্যা মেয়ের নাম সুরুচি। সবাই তাকে ডাকে সুরুদি। প্রথম সন্তান মা বাপের। বাবার বড় আদরের মেয়ে ছিলেন সুরুদি। স্বপ্ন ছিল বাবার সুরুচি হোক সর্বজ্যোতির্ময়ী, সর্বকল্যাণপারদর্শিনী, ভুবনজয়িনী কন্যা।

বাবা ছিলেন ডাক্তার খুলনায়। কিন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে 'ষড়যন্ত্র করার দোষে' হয়েছিলেন কর্মহারা। পূর্ববঙ্গের গাঁয়ে সরকার তাঁর ডাক্তারি করার অনুমতি তুলে নিয়েছিলেন। সুরুদির বাবা জীবিকাধারণের খোঁজে চলে যান এ শহর থেকে অন্য শহরে। দিয়ে যান সংসার, এক বোন, দুই ভাই আর মায়ের দায়িত্ব সুরুচির ওপর। তার বয়স তখন মাত্র নয় বছর। যে সময় ছোট মেয়েরা পুতুল খেলায় থাকে মত্ত। সুরুচিদির কাজ ছিল ভাইবোনদের নিয়ম কানুনে মানিয়ে রাখা। বিপদের বাইরে বাঁচিয়ে রাখা। মেয়েবেলা পেরবার আগেই সুরুচিদির জীবনে এল প্রৌঢ়ত্ব।

এগারো বছর বয়সেই সুরুদি জানতেন তার ভবিষ্যৎ। বলেছিলেন মাকে 'আমি ডাক্তার হয়ে বিদেশে যাব, সেখানে রয়েছে আমার অন্ন মাপা। একাই থাকব অধিকাংশ জীবনটা।' বলেছিলেন মা হেসে, 'পাগলী মেয়ে, সবে মাত্র দশ পেরলি। এখনই জানিস কি করে কি আছে তোর ভবিষ্যতের গর্ভে?'

তুমি জানো রবিঠাকুর, সুরুদির বিচক্ষণতার বিষয়ে মায়ের এই বিশ্লেষণ কিন্তু ঠিক ছিল না। ওই কচি বয়সে সুরুদি চলে যেতেন আলতো পায়ে মায়ের পেছন পেছন গাঁয়ের পুকুর পাড়ে, মায়ের অজান্তে। বাবার অবর্তমানে ওই একাদশী সুরুচিদি যে ছিলেন সংসারের প্রকৃত কর্তৃ। শ্যেনচক্ষু সুরুদি জেনেছিলেন মায়ের মনোবেদনা। 'বিদেশে' স্বামী। ছোট, ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে গাঁয়ের বধু হয়ে কাটত কি করে মায়ের দিন। বর্ষার যৌবনে টলমল করত পুকুর। 'জলের সঙ্গে স্থলের যেন গলাগলি(“ঘাটের কথা”)। বাসন ধোয়ার নামে মা নেমে যেতেন ঘাটের ধাপে ধাপে। ভরা সন্ধ্যায়, কালো আকাশের তলায়, জলের স্রোতে ভাসান দিতেন যেন অন্তর্জালা।

পরের ছুটীতে বাবা বাড়ী এলে তরুণী সুরুদি বাবাকে বোঝালেন “এমন করে মাকে একা রেখে যাওয়া চলবে না। যেখানেই থাকো, যেমন করেই থাকো, আমার এই একটা কথা শোনো বাবা। মাকে এমন করে ফেলে রেখে যেও না গাঁয়ে। বাসন ধুতে গিয়ে জলের গভীরে তলিয়ে যাবেন কবে। এই আমার আশঙ্কা, এই আমার একমাত্র ভয়, বাবা।”

তুমিই আমায় বলো রবিঠাকুর এই দৃশ্যটা তোমায় মনে করিয়ে দেয় না - “ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এল-যেন সে হঠাৎ পাওয়া নতুন ছন্দ বাল্মীকির... “(বাঁশীওয়ালা)”। 

সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাবা এলেন কলকাতায়। পাকে চক্রে অল্পদিনের মধ্যেই সব গুটিয়ে নতুন করে সংসার পাতলেন বেনারসে।

সুরুচিদির ভাগ্যলিপিতে যাই থাক না কেন, ভবিষ্যতের পন্থা গড়ে উঠল বাবা-মেয়ের মিলিত সিদ্ধান্তে। বাবার সাহায্যে দুবছর বাড়িয়ে দিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলেন সুরুচিদি ১৪ বছর বয়সে। স্কলারশীপ নিয়ে পাশ করার পর সিদ্ধান্ত হল ডাক্তারী পড়া। শুরু হল সুরুচির জীবনে আর একটা অধ্যায়, বিহারের দানাপুর শহরে।

এ্যনাটমির জনপ্রিয় অধ্যাপক ডক্টর মাইক গোল্ডস্টাইন-এর ক্লাশে ছিল বহু ছাত্রছাত্রী। তাদের মাঝে সুরুচিদি এক কোণে চেয়ার টেনে বসলেন। অধ্যাপনার মাধ্যমে জোসেফের চোখে পড়ল সুরুচিদির বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গসম তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। জোসেফের নরম কথায়, চটুল হাসিতে ঝলমলিয়ে নেচে উঠল সুরুচিদির মনপ্রাণ। দুজনের বয়সের ব্যবধান ১৮ বছরের। তার ওপর জোসেফ ছিলেন ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বী। আমাদের সমাজের চোখে এ বিয়ে এখনও অসম্ভব। সুরুচিদি বাড়ীতে বললেন, “মাইক-কে ছাড়া আর কাউকে আমি বিয়ে করব না।” মা ঘরে বন্দী করলেন মেয়েকে। 

“চারুলতা” - সিনেমাটা দেখেছো তুমি, রবিঠাকুর? দেখোনি? ওই যে গো, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় “নস্টনীড়” ছোটগল্পের চলচ্চিত্র রূপায়ণ। বর্হিজগতের সঙ্গে চারুলতার যোগাযোগ ছিল জানালার খড়খড়ির মাধ্যমে। বাঁদর খেলার বাজনা শুনে চারু এঘর থেকে ওঘরে ছুটে ছুটে দেখত আর ডুগডুগির শব্দটা অনুসরণ করত...। সুরুচিদির তাও সম্ভব ছিল না। সিন্দুকের মত ছোট একটা ঘরে মা তাকে করেছিলেন নজরবন্দী। একটাই ছিল জানলা, তাও বেশ উঁচুতে গাঁথা। সেই “গারদখানার” মাঝে বসে পথে চলা রিক্সাগাড়ির ঘণ্টা শুনে সুরুচিদি স্বপ্ন দেখতেন বিয়ের যজ্ঞের, পুরোহিতের মন্ত্রের...। কিন্তু মা ও নাছোড়বান্দা, সুরুচিদিও পেছপা হবার মেয়ে নন। পাড়ায় পাড়ায় হৈ হৈ পড়ে গেল সুরুচিদির জেদের, তেজ নিয়ে। শেষে বাবার আনুকুল্যে হল এই আন্তর্ধমী বিয়ে, মায়ের আশীর্বাদ ছাড়াই। না নতুন শাড়ী, না নতুন গহনা। না সাজল কনে, না সাজল বর। না বাজল সানাই। না পরাল কেউ যুঁই, রজনীগন্ধা, বেলিফুলের মালা। না গাইল কেউ বিয়ের আসরে গান। অন্তরের ঐশ্বর্য্য দিয়ে মাইক আলিঙ্গন করলেন অনন্যা সেই সুরুচিদিকে। মিলনের সৌরভে তাদের যুগল জীবন হল শুরু।

তুমি বুঝেছিলে নারীর মর্মব্যথা, তার স্বাক্ষর দিয়েছিলে তোমার কবিতা, গল্পে, উপন্যাসে। তুমিই রচনা করেছিলে চারুলতার স্বামী ভূপতি আর দেবর অমলেশের চরিত্র। তুমি কি জানতে মাইক-কে? আমার মনে হয় তুমি তাকে জানতে। নয়ত ভূপতিকে কিভাবে আবিষ্কার করেছিলে? ভূপতির মতই মাইক জানতেন সুরুচিদির মনে আছে মহত্বের বীজ। আর বয়েসেরও অনেকটা ব্যবধান ছিল বলে তিনি সুরুদিকে চিনতে একটুও ভুল করেন নি। তাই মাইক দূরদর্শিতা দিয়ে সুরুচিদিকে পাঠালেন বিদেশে বিশেষজ্ঞের পারদর্শিতা অর্জন করার জন্য। দেশে মনস্তত্ত্ববিদদের যতই সম্মান আর যশ থাকুক না কেন, মাইক জানতেন বিদেশের ডিগ্রীর দাম অনেক। আরও একটা কারণ ছিল। তাদের চার ছেলেমেয়ে তখন বোর্ডিং স্কুলে পড়ছে। ভারতবর্ষের সরকারী ডাক্তারের আয়ে এত খরচ চালানো কি সম্ভব? ডলারের মূল্য সেখানে অনেকবেশি তাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেছপা হবে না।। সুরুচিদি গেলেন পড়তে অ্যামেরিকায়। ছেলেমেয়েসহ স্বামী থেকে গেলেন ভারতবর্ষে। অ্যামেরিকায় এসে সুরুচিদি একটার পর একটা ডিগ্রী অর্জন করতে শুরু করলেন। ছোটবড় হাস্পাতালে সংযুক্ত থেকে মনস্তত্ত্ববিদের পেশাও তার সাথে চালিয়ে যেতে লাগলেন।

২০১০ সালে, এক অনির্বচনীয় কালের ব্যবধানের পর মাইক এলেন অ্যামেরিকায় সুরুচিদির সাথে পুনর্মিলনের অভিসারে। এলেন কিন্তু এক অজানা রোগভুক্ত হয়ে। মাইকের আদরের সুরুরানীর সেবাশুশ্রুষায়, অসীম যত্ন পেয়ে মাইক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন অ্যামেরিকায়। সাধারণ বাঙালী মেয়ে হলে হয়ত বাক্স পেঁটরা গুটিয়ে ফিরে যেতেন দেশে। সে রকম মেয়ে মোটেই নন সুরুচিদি। স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে ফিরে গেলেন দেশে। ছেলেমেয়েদের সবকিছু সাক্ষাতে বলতে এবং বোঝাতে। আর গেলেন বিধাতার সাথে আরো একবার বোঝাপড়ার হিসেব কষতে। শান্ত মাথায়, নিপুণ হাতে ব্যবস্থা করলেন কি করে চার ছেলেমেয়েকে অ্যামেরিকায় নিয়ে আসা যায়। 

আসতে আসতে সব ছেলেমেয়েদের, পুত্রবধুকে নিয়ে এলেন অ্যামেরিকায়। দাঁড় করালেন সবাইকে নিজের পায়ে। বিয়ে দিলেন দুই মেয়ের। তুমি হয়ত ভাবছ আরো কত ভারতীয় মেয়েই তো বিদেশে এই রকম কাজ করছেন। তাই তো? তা কিন্তু ঠিক নয়। সুরুচিদি এসেছিলেন একা, ছিলেন একা, জীবন যুদ্ধ করেছিলেন একা। বিদেশের বাঙালী সমাজের সহায়তায় নয়। মা চন্ডীর মত, মা জগদ্ধাত্রীর মত, মা দুর্গার মত এই মেয়ের অপরিসীম শক্তি। সেই শক্তি ও উৎসাহ পেতেন মাইকের পুরানো চিঠিতে।

সবদেশেই কর্মক্ষেত্রে যেমন প্রতিযোগিতা, রেষারেষি ও বিশ্বাসঘাতকতা হয়। অ্যামেরিকাতেও তা যথেষ্ট ছিল এবং এখনও আছে। এর প্রভাবে ক্রমশঃ একের পর এক ঝড়ঝাপটায় সুরুদির শরীরে হৃদরোগের বাসা বাঁধল হঠাৎ। বছর খানেক বিশ্রামে থেকে সুরুচিদি আরেকটা অধ্যায় আরম্ভ করলেন তার “নতুন” জীবনের।

যে গল্পের সুচনা হয়েছিল আজ থেকে ৬৫+ বছর আগে, তার প্রকাশ স্বরূপ নিয়েছে। বিরাট পশার এখন সুরুদির অ্যামেরিকার এক ছোট শহরে। নাতিনাতনী ছড়িয়ে আছে পৃ্থিবীর সর্বত্র। কেউ পড়ছে Harvardএ, কেউ পড়ছে MITতে, কেউ যাচ্ছে গবেষণামূলক কনফারেন্সে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে তে। সকলের সাহায্যে আছে সুরুচিদি। ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনীদের মনের দিগন্ত ছড়ানোর জন্য নিয়ে যান তাদের তখন নিজের সাথে স্পেন, সাউথ অ্যামেরিকা, অ্যাফ্রিকা, আস্ট্রেলিয়া- তে। রোগীদের স্বাবলম্বী করার জন্য এবং তাদের চিকিৎসার সাথে এবং অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করেন সুরুচিদি। নিজে অবসর সময় গান শেখেন, পিয়ানো বাজান, ছবি আঁকেন, লেখেন-মন কালো করে। “আমার কি হোল”, “আমার কি হোল” বলে হা হুতাশ করে বসে থাকেন না চার দেওয়ালের পিছনে। অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যান নিষ্কর্মাদের। তার সাহায্যে নিঃস্ব মহিলাদের ও শিশুদের জন্য স্কুল ও ক্লিনিক তৈরী হচ্ছে ভারতবর্ষের নানা দুস্থ অঞ্চলে। সুরুচিদি এসবের জন্য কোন অহংকার করেন না। বলেন, “সবই করতে পারছি মাইক উৎসাহ দিতেন বলে, অনুপ্রেরণা দিতেন বলে, এখনও আমার সাথে রয়েছেন বলে সব সময়”। " ভুবন হবে নিত্য মধুর জীবন হবে ভালো-/-মনের মধ্যে জ্বালাই যদি--ভালোবাসার আলো।”

তুমি কি বলো রবিঠাকুর? তোমার কি মনে হয় তেল ছাড়া সলতের প্রদীপ জ্বলে? গলায় সুর না থাকলে কি কোকিল গাইতে পারে মন মাতানো গান? লেখার তাগিদা না থাকলে কি গড়গড় করে লেখা যায়? সুরুচিদি বলেন, “আমার জীবনীশক্তির অশেষ উৎস হচ্ছে জোসেফের অপরিমেয় প্রেম আর ওষুধ হচ্ছে মাইক-এর আমার প্রতি বিশ্বাস।” 

নাও, দিলাম তুলে তোমার হাতে একটা নতুন গল্পের কাঠামো। এখন তোমার কাজের পালা। ওগো আমার প্রিয় কবিগুরু, তুমি যদি না লেখো তো কোথায় যাব? আমার আর এক প্রিয় কথাশিল্পী শরৎবাবুর কাছে? তুমিই তো বলেছিলে, “মানুষের জীবন বিশাল একটা বনস্পতির মত। শুধু তার আয়তন, তার আকৃতি সুঠাম নয়। দিনে দিনে বেড়ে চলছে তার মধ্যে এলোমেলো ডালপালার পুনরাবৃত্তি। এই স্তূপকার একঘেয়েমির মধ্যে হঠাৎ একটা ফল ওঠে-সে নিটোল, সে সুডোল, বাইরে তার রং লাল কিংবা কালো, ভিতরে তার রস তীব্র কিংবা মধুর। সে সংক্ষিপ্ত, সে অনিবার্য, সে দেবলব্ধ, সে ছোটগল্প” (“শেষ কথা”)।

দোহাই তোমার, রবিঠাকুর, তুমি দাও সুরুচিদির চরিত্রায়ণ। একটু দয়ার চোখে দেখে লিখো। যে সুরুচিদি রয়েছে পরিচয়ের অন্তরালে। এই আদর্শনীয়া অনন্যাকে করো স্মরণীয়া।

তোমার এই শুভ ১৫৫ তম জন্মদিনে তোমার চরণে শতকোটি প্রনাম জানিয়ে, শুধু এইটুকু প্রার্থনা করি...

“বড় আশা করে এসেছি গো
কাছে ডেকে লও
ফিরাও না......”। 

তোমার আশীর্বাদের অপেক্ষায়...


তোমার চির স্নেহবন্ধ পাগলি মেয়ে,

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়
ডালাস, টেক্সাস







0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ নারায়ণ রায়

Posted in

ব্যক্তিগত গদ্য



গরম রসগোল্লা কিম্বা একটা রেলগাড়ির মৃত্যু
নারায়ণ রায়



যে কোন মৃত্যুই দুঃখের, তবে কোন কোন মৃত্যু কেমন যেন মনটাকে নাড়া দিয়ে যায়। সম্প্রতি তেমনই একটি মৃত্যুর খবর পেলাম আজকের সংবাদ পত্রে। বধর্মান-কাটোয়া লাইট গেজ রেল লাইনটি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। ১৯১৫ সালে-এ চালু হওয়া এই রেলপথটিকে ঠিক শতবর্ষের মাথায় বন্ধ করে দেওয়া হ'ল এবং যুগের সঙ্গে তাল রেখে এরপর এই লাইন হবে ব্রডগেজ। আর বনগাঁ কিম্বা ব্যান্ডেল লোকালের মত এখানেও চলবে বিদ্যুত চালিত ই এম ইউ কোচ। আজ কত কথা মনে পড়ে, কথায় বলে বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ...আজ মনে পড়ে ওই ট্রেন-এর সাথে আমার বাল্যকালের কত স্মৃতি কতআবেগ জড়িয়ে আছে। চোখ বুজলেই আজও যেন পরিষ্কার সব দেখতে পাই।

সে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। বাবার চাকরি সুত্রে আমরা তাখন উত্তর চব্বিশ পরগনার একটা মহকুমা শহরে থাকতাম। আর বছরে একবার করে আমাদের গ্রামের বাড়ি-তে যেতাম। সে এক দারুন উত্তেজনা ।.. তবে সেবার আমরা যাচ্ছিলাম আমার নিজের এক জেঠতুতো দাদার বিয়েতে, তাই আনন্দ আর উত্তেজনা অন্যবারের চেয়ে চারগুন বেশী। ভোর ৪টে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে পোটলা-পু্টলি গুছিয়ে নিয়ে দিনের প্রথম বাস-টিতে উঠতাম। তখন কলকাতা শহর দেখবো, দোতলা বাস-এ চাপবো এসব ভেবেই শিহরিত হওয়ার বয়স। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন এখনকার মত প্রাইভেট বাসের কলকাতা শহরের ভিতরে প্রবেশ করার অধিকার ছিলনা, ঐ বাসগুলো শ্যাম বাজার খাল ধার পযর্ন্ত আসতো আর ওখান থেকে বাবা আমাদের ট্যাক্সি করে নিয়ে যেতে চাইলেও আমরা ভাই-বোনেরা দোতলা বাসে চাপার জান্য বায়না করতাম। আমাদের মত মফঃস্বলের ছেলেদের দোতলা বাসের দোতলায় চাপার আনন্দই ছিল আলাদা। 

তখনো হাওড়া থেকে ই এম ইউ কোচ চালু হয়নি। বিশাল দৈত্যের মত দেখতে কানাডিয়ান ইঞ্জিন ভস ভস করে বাস্প ছেড়ে যাচ্ছে আর লাল রং-এর বগির থার্ড ক্লাসে চেপে শশা আর ঝাল মুড়ি খেতে খেতে আমরা বর্ধমান পৌঁছতাম। সেখানেও জানলার ধারে বসার জন্য আমাদেরর ভাই বোনেদের মধ্যে মারামারি হত। কিন্তু যে ইঞ্জিনের দিকে মুখ করে জানলার ধারে বসতো সে ভীষণ ভাবে ঠকতো..কয়লার ইঞ্জিন, ...তাই খুব ঘন ঘন কয়লার গুড়ো উড়ে এসে চোখে পড়ত...। অবশেষে রেল কাম ঝমা ঝম করতে করতে বেলা ১ টা নাগাদ আমরা বর্ধমান এসে পৌঁছতাম। সেখানে পৌঁছে আর এক প্রস্থ দৌড় দৌড়ি। ওভার ব্রিজ দিয়ে স্টেশনের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে আবার নতুন করে ছোট লাইন এর ট্রেন-এ চাপতে হ’ত। সে এক মজার রেলগাড়ি, খুব-ই সাধারণ ছোট ছোট কাঠের তৈরি বগি আর লম্বা লম্বি ভাবে চার সারি বসার যায়গা । কাগজে কলমে টাইম টেবিল একটা আছে বটে কিন্তু ট্রেন চলে তার নিজের মর্জি অনুযায়ী। তাই বেলা দুটোয় ছাড়ার কথা থাকলেও বেলা তিনটে পযর্ন্ত আমাদের সবাইকে গলদঘর্ম করে তবে তিনি নড়তে শুরু করলেন। 

ইতিমধ্যে ভীড়ও ভালই হয়েছে, বসার জায়গাগুলো সব ভর্তি। তবে যাত্রির চেয়ে মালপত্র বেশী। ওইটুকু একটা কামরায় চতুর্দিকে যাত্রীদের লটবহরের ঠেলায় যাত্রীদের দম বন্ধ হওয়ার মতন অবস্থা। এ গাড়ির সামনে ছোটার চেয়ে পাশা পাশি হেলা দোলা যেন বড্ড বেশী। ফলে ট্রেন চলার সাথে সাথে যাত্রীরা বার বার একজন আর একজনের ঘাড়ের উপর ঢলে পড়ছে। তখন গ্রমাঞ্চলে জাতপাতের বিভাজন ভীষন ভাবে চালু ছিল। তাই মেয়েরা ওরই মধ্যে চেষ্টা করত ছোঁয়া-ছুই যতোটা সম্ভব এড়ানো যায়। কিন্তু সব চেয়ে বিরক্তিকর ওই পরিবেশে অনেকের বিড়ি ধরানো...। ওই রকম ধীর গতি-তে চলা ট্রেন এর ভীড়ের ভিতর বিড়ির ধোঁয়ায় ভর্তি কামরায় সে এক নারকীয় পরিবেশ, তার মধ্যে আমার কোলে একটা ঢাউস ব্যাগ ...। এই বেঞ্ছটাতে আমাদের পরিবারের আমি একা, সামনের সীটে আমার দিকে পিছন ফিরে আমার বাবা-মা এবং ভাই বোনেরা বসে আছে। আমার সামনের সীটে আমার মুখো মুখি দুজন বয়স্ক মহিলা মেয়ের বিয়েতে কত টাকা পণ দিতে হয়েছে তাই নিয়ে গল্পে মশগুল। কিন্তু আমার সব চেয়ে সমস্যা আমার সামনে কে একজন একটা ছাগল রেখেছে...তার-ও ঐ পরিবেশটি মোটেই ভাল লাগছ না, তাই থেকে থেকে সেও ব্যা ব্যা করে ডেকে চলেছে। বিড়ির ধোয়া আর ছাগলের গন্ধে আমার তখন অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার মত অবস্থা। 

যাত্রীরা প্রায় সকলেই পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত। তাই ..."কিরে ভ্যাবলা কোথায় গেসলি,... আরে এটা তোর বেটা নাকি ...। কত বড় হয়ে গেছে রে ?" কিম্বা, "আরে নন্দোদা যে অনেকদিন পর দেখা হল, তা এবার আলুর ফলন কেমন ? আমাদের গাঁয়ে তো সব ধসায় মেরে দিলে" এই ধরনের আলোচনায় মুখর। চলন্ত ট্রেনের দরজায় ঠেস দেয়া এক ভদ্রলোক খুব ঘন ঘন আমার মাথার উপর রাখা মুখ বন্ধ একটা চটের থলের দিকে তাকাচ্ছে। ঠিক সেই সময় ঝুপ করে ঐ থলেটা আমার কোলে রাখা ব্যাগের উপর পড়ে আপনা থেকেই নড়া চড়া করতে লাগলো আর তাই দেখে আমি ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে দিতেই দরজায় ঠেস দেয়া ভদ্রলোক দৌড়ে এসে আমার কোল থেকে ব্যাগটা নিয়ে খুলতেই তার ভিতর থেকে একটা জ্যান্ত মুরগি কক কক করে ডেকে উঠল। তাই দেখে কামরার সবাই হই হই করে হেসে উঠে ঐ লোক টাকে উদ্দেশ্য করে বললে, “কিরে কামাল, শেষ কালে শ্বশুর বাড়ি থেকে জ্যান্ত একটা মুরগি-ই চুরি করে নিয়ে চলে এলি?” কামাল বললো, “ছি ছি কি যে বলো, শালা দিলে তার ভাগ্নের জন্য... তাই......।” তবে তারপর সারা পথ ঐ কামালভাই থলেটা আর নিজের হাত ছাড়া করেননি। 

আর ঠিক সেই সময় আমাদের কামরায় একজন চেকার ঊঠলেন, ৩৫-৩৬ বছর বয়সের এক ভদ্রলোক, ধুতির উপর একটা কালো কোট গায়ে আর হাতে একটা সাড়াশির মত যন্ত্র। ভদ্রলোক নিজে থেকে কাউকে টিকিট চাইলেন না, গোটা কামরায় আমরা ছাড়া কেউ টিকিট দেখালোও না, বরং তিনি সবার সঙ্গে হই হই করে গল্প করতে শুরু করলেন। “আরে ভজা তোর ছেলে কেমন আছে ? কি রে কামাল তোর জামাইবাবুর সঙ্গে সেদিন বদ্দমানে দেখা হ’ল।” এদিকে আমাদের তিনটে টিকিট আমার, বাবার আর মা’র, টিকিটগুলো আমার পকেটেই ছিল, আমি সেগুলো দেখাতেই অনেকটা বিরক্ত হয়েই আমার হাত থেকে টিকিট গুলো নিয়ে পাঞ্ছ করে আমার হাতে ফেরত দেবার সময় জানতে চাইলেন আর দুজন কোথায়? আমি সামনে আঙ্গুল দেখাতেই দেখি আমার বাবা পিছন ফিরে ঐ চেকারবাবুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর ঐ চেকারবাবু তো একেবারে লম্ফ দিয়ে বলে উঠলেন, “আরে তিনু দা যে? আর আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে, বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এ তোমার বেটা না কি গো ? তা অনেক বড় হয়ে গেছে ত? তা হাবলার বিয়েতে যাচ্ছ নিশ্চই...। তা বউদি কেমন আছ গো?” মা ঘাড় নেড়ে বললো, “হ্যা ভালো আছি তুমি ভালো আছো তো? প্রতিমা কেমন আছে?” বুঝলাম প্রতিমা ওই চেকারবাবুর বৌএর নাম। কিন্তু এবার ঐ চেকারবাবু সবার সামনে সেই মোক্ষম কথাটি বললেন, “তা জানো তো এই লাইনে তোমার গদাই ভাইটি আছে, তা টিকিট কাটার কি দরকার ছিল? আমি না থাকলেও আমার নাম বললেই তো যথেষ্ট। তোমাদের আশীর্বাদে এই বদ্দমান কাটোয়া লাইনে এই গদাই সামন্তকে সবাই মান্যি গন্যি করে। এখনো পযর্ন্ত একদিন গদাই না থাকলে রেলের চাকাও ঘুরবে না।“ বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা হা করে হাসতে লাগলেন। এতক্ষণে বাবা মুখ খুললেন বললেন, “তা তোর মত আর দু চারটে চেকার থাকলে এই রেলের চাকা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।” ইতিমধ্যে পরের স্টেশন এসে গেছে চেকার বাবুটি হা হা হা করে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললেন,“তা হলে ঐ কথাই থাকল, বিয়ে বাড়ীতে দেখা হচ্ছে ।“ 

ভদ্রলোক নেমে যাওয়ার পরে জানলাম উনি আমার বাবার নিজের পিসতুতো ভাই। এবার ট্রেন স্টেশন ছেড়ে সেই যে দাঁড়াল আর নড়াচড়ার কোন লক্ষণ নেই। দুটি স্টেশনের মাঝখানে দুদিকে ধানের জমি আর মাঝে মাঝে ঝোপ ঝাড় জঙ্গল। চলন্ত ট্রেন থেকে সব সময় আসে পাশের সব কিছু খুব সুন্দর দেখতে লাগে। সবুজ ধানের ক্ষেত, কত রকমের গাছ পালা। গরমে প্রায় ১৫-২০ মিনিট কষ্ট করার পর হটাৎ লক্ষ্য করলাম লাইন থেকে একটু দূরে একটা ঝোপের ভিতর থেকে আমার সদ্য পরিচিত গদাইকাকু এক হাতে একটা লোটা আর এক হাতে ধুতির কাছা-কোছা ঠিক করতে করতে বেরচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা আমাদের স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। স্টেশনে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গরু কিম্বা মোষের গাড়ি আসতো, আর আমরা তাতে চেপে আমাদের গ্রামের বাড়ি পৌঁছে যেতাম।

সে যুগের গ্রামের বিয়ে বাড়ির পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। সব কিছুই নিজেদের বাড়িতে পাড়ার লোকেরাই ব্যবস্থা করতেন। বৌভাতের দিন চারিদিকে আত্মীয় কুটুম লোক লশকরে ভর্তি। সকাল থেকেই পুকুরে মাছ ধরার জন্য জাল ফেলা হচ্ছে , মিষ্টি তৈরীর ভিয়েন বসেছে, উঠনে ৫/৭ জন মিলে শুধু তরকারি কেটেই যাচ্ছে। আমরা ছোটরা কি করবো ভেবে পাচ্ছি না, এক সঙ্গে আমরা কত দিক সামলাবো? এই বোধ হয় সব চেয়ে বড় কাতলা মাছটা জালে ধরা পরে গেল তো, ওদিকে আবার উনোন থেকে বোঁদের কড়াই নামানো হয়ে গেল, কিম্বা গরম রসগোল্লাগুলো এত ক্ষণে নিশ্চয়ই খাওয়ার মত ঠান্ডা হয়েছে... আমরা শুধু দৌড়েই বেড়াচ্ছি। আবার তারই মধ্যে মাঝে মাঝে মহিলা মহলে আমাদের নতুন বৌদিকে দেখে আসছি। আর এক জনকে দেখলাম বিনা কাজে আমাদের চেয়েও ব্যস্ত তিনি হলেন আমার গদাইকাকু। আমাদের মত তিনিও সর্বত্র দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। আর মাছ ঠিক মত ভাজা হয়েছে কিনা, টেস্ট করে যাচ্ছেন। কখনো বিজ্ঞের মত বলছেন মাংসটা একটু নুন কম হয়েছে। গদাইকাকুর মেয়ে মিনু সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। ও নাকি একটা ঝি ঝি পোকা পুষেছে, তাকে কচি জাম পাতা খেতে দেয়। তার নাম দিয়েছে পতঙ্গিনী। বাবা মাঝে মাঝে গদাইকাকুর পিছনে লাগছে,” কিরে গদাই, আজকে তোর রেলের চাকা ঘুরবে তো?” আর আড়ালে বাবা বলছে গদাইটা এখনো সেই দশ বছরের শিশুই রয়ে গেল। আমার ঠাম্মি আমাদেরকে একটা পদ্ম পাতায় বেশ কয়েকটা গরম রসগোল্লা এনে খেতে দিল। শহরে অত সুন্দর রসগোল্লা পাওয়া যায় না। আমরা সবাই ভালো করে তাকাবার আগেই গদাই কাকু কোথা থেকে দৌড়ে এসে ছো মেরে পাতা থেকে কয়েকটা রসগোল্লা তুলে নিতে গিয়ে পুরো পাতাটাকেই উলটে দিলো মাটিতে। তাই দেখে আমাদের সে কি কান্না। ঠাম্মিও কাকুকে খুব বকলো। বাবাও বললো, “তুই কোনদিনই বড় হবি না।”

বৌভাতের পরদিন সকালে গোটা বাড়িটা কেমন যেন ছন্নছাড়া ভাব। সবার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ, জিনিস পত্র সব চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো। একে একে আত্মীয় কুটুমরা বিদায় নিচ্ছে। গদাই কাকুও তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে একদিন পর বিদায় নিলেন। গদাইকাকু আর কাকীমা বয়স্কদের সবাইকে প্রণাম করে বার বার ওদের বাড়িতে আমাদেরকে একবার যাওয়ার জন্য বললেন। বাবাও বার বার ওদেরকে বাবার চাকরিস্থলে আমাদের বাড়িতে যেতে বললেন। যাওয়ার সময় মিনুতো রীতিমত কেঁদেই ফেললো।

দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে। ইতি মধ্যে আমরাও বাড়িঘর করে শহরেই থেকে গেছি গ্রামের সঙ্গে তেমন আর যোগাযোগই নেই। গদাইকাকুর সঙ্গে গত পঞ্চাশ বছরে মাত্র একবার বর্ধমান শহরে একটা অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। আমার পরিচয় পেয়ে আশি বছরের বৃদ্ধ গদাই কাকু তার এই ষাট বছরের ভাইপোর হাত দুটি ধরে বলে ছিল, “একবার সবাইকে নিয়ে আমার বাড়িতে আয়, আমাদের মোংলি গাইটা এখন প্রতিদিন এক সের করে দুধ দিচ্ছে, বাড়িতে ছানা কেটে তোকে গরম রসোগোল্লা তৈরী করে খাওয়াব।” আমি বলেছিলাম, “তোমার ভাইপোর কি আর সেই বয়স আছে? এখন তেল, ঘি, মিস্টি সব খাওয়া বারন।” শুনালম কাকীমার শরীরটাও নাকি একদম ভালো যাচ্ছে না, মিনুর ছেলে গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকা গেছে। মনে মনে ভাবলাম মিনুর কি এখনো সেই ঝি ঝি পোকাটা আছে? এখনো কি তাকে জামপাতা খাওয়ায়? গদাই কাকু সেদিন বেশীক্ষণ বসেননি। কারণ বর্ধমান-কাটোয়া লাইন–এ এখন অনেক ভালো ভালো বাস রুট হওয়া সত্বেও কাকা এখনো সেই ছোট লাইন এর ট্রেনেই যাতায়াত করেন, আর রাত আটটাতেই লাস্ট ট্রেন।

গিন্নীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। বললো আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আমার এক ভাইপো ফোন করেছে......। ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই, অপর প্রান্ত থেকে আমার ভাইপো পুকাই উভয় পক্ষের সুসংবাদ লেনদেন করার পর বললো, কাকা তোমাকে একটা খবর জানাচ্ছি, আমাদের সেই গদাই দাদু গত কাল রাত্রে মারা গেছেন। শুনলাম ৮৬ বছরের মত বয়স হয়েছিল। দিদার শরীরটাও নাকি ভাল যাচ্ছে না। শুনেছি তোমারো তো শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবু যদি পারো আগামী ২৪শে এপ্রিল শ্রাদ্ধের দিন একবার এসো। হটাৎ মনে পড়ল আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের গদাই কাকার সেই কথা টা। “তোমাদের আশীর্বাদে এই বদ্দমান কাটোয়া লাইনে এই গদাই সামন্তকে সবাই মান্যি গন্যি করে। এখনো পযর্ন্ত একদিন গদাই না থাকলে রেলের চাকাও ঘুরবে না...”




0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ তন্ময় গুপ্ত

Posted in



ব্যক্তিগত গদ্য



ফল্গু
তন্ময় গুপ্ত



(২)
বছর দশেক পর। অফিসের কাজে এসেছি গৌহাটি। কয়েকটা চা বাগান ও চায়ের কারখানাকে পরিদর্শন করার কাজ আছে। চা বাগানের ম্যানেজারটি বেশ তৎপরতার সাথে আমাকে সবকিছু দেখাতে লাগল। সঙ্গের ড্রাইভারটিও বেশ চটপটে, নির্দিষ্ট দিনের দুদিন আগেই সমস্ত কাজ সেরে ফেলা গেল। সেদিন সন্ধ্যা বেলায় ম্যানেজার বলল- “স্যার আপনার ফেরার ফ্লাইট তো আগামী পরশু, হাতে এখনো দুদিন সময়। শিলং-এর আবহাওয়া এখন জবরদস্ত। যাবেন নাকি?”

-যাওয়া যেতে পারে, যদি আপনি সঙ্গে চলেন। হেসে বলি।

-কি যে বলেন, স্যার। আপনি বললেন, এতেই আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি রামদিন কে বলে দিচ্ছি। সে সব ঠিক করে রাখবে। গাড়ী, হোটেল সবকিছু।

পরদিন ভোরবেলায় শিলং পৌঁছে গেলাম। আগেও এসেছি দুবার। শহরটাকে বেশ লাগে আমার। দুপুরে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলবেলায় বেরিয়ে পড়লাম। পোলিশ বাজার শিলং এর মুখ্য বাজার। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা দোকানের শো-কেস এর সামনে দাঁড়িয়ে কি কেনাকেটা করা যায় ভাবছি, হঠাৎ মনে হল একটা লম্বা লোক যেন দ্রুত সরে গেল। কেউ কি আমার পিছু নিয়েছে? শিলং এমনিতে খুব নিরাপদ। এছাড়াও রামদিন একটু তফাতে থেকে নিঃশব্দে ছায়ার মতো আমার ওপর নজর রাখছে। আমি তাই চাপমুক্তই আছি। দোকানে ঢুকে স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে তৈরি একটা জ্যাকেট কিনলাম।

শিরশির করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, হঠাৎ পিঠে একটা থাবড়া –হেইই বাপি! তুই?

আমি প্রচণ্ড চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখি একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোটবেলার সেই খ্যাপাটে বন্ধু-শোভন।

-আরিব্বাস! তুই? এখানে?

-আরে, আমিতো এখন এখানেই পোস্টেড।

-তাই নাকি? বাহ্‌। তো বাড়ি যাস না? কলকাতায়? 

-না রে! ভাল্লাগেনা।

আমি চুপ করে গেলাম। কথা ঘুরিয়ে বললাম-কফি খাওয়াবিনা? ব্যাটা কিপটে?
বলেই দুজনে হোহো করে হেসে উঠলাম।

-কফি কিরে? চ’ আজ তোকে ডিনার করাব।

রামদিনের সাথে আলাপ করিয়ে দিই-মেরা বচপন কা দোস্ত।

কিছুদূর এগোতেই আমায় অবাক করে দিয়ে একটা বছর দশেকের ফুটফুটে ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এসে শোভনের কোমর জড়িয়ে ধরল।

-কত্ত দেরি করছ বাপি? আমরা আরও কতক্ষণ ওয়েট করব?

আমি অবাক হয়ে শোভনের মুখের দিকে তাকাই। শোভন হাসি ছড়িয়ে বলে-সান্নি। আমার ছেলে। বাবা এই দেখো-বাপী কাকু।

ছেলেটা ঝপ করে নিচু হয়ে আমায় প্রনাম করল। ফর্সা টুকটুকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। আমি আদর করে দিলাম। শোভন একটা রেস্টুরেন্টএর সামনে এসে বলল-সান্নি, তুমি কাকু কে নিয়ে মাম্মির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও। আমি ডিনার-এর অর্ডারটা দিয়েই আসছি।

আমায় বলল-যা ব্যাটা। আমার বৌয়ের সাথে পরিচয় কর গিয়ে। আমার মুখে তোর অনেক কথা শুনেছে। যা চমকে দে গিয়ে।

আমারও কৌতূহল ছিল। কেমন হল শোভনের বৌ।

ছেলেটা হাত ধরে নিয়ে গেল একটা টেবিলের কাছে। ভদ্রমহিলা দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে ছিলেন। সান্নি বলল-মাম্মি, দেখো একটা কাকু এসেছে।

ভদ্রমহিলা মুখ ঘোরাতেই আমি চমকে উঠলাম।–একি? মুন্নি? তুই?

মুন্নিও একই ভাবে চমকে উঠল-আরে বাপীদা! তুমি!

আমি হতভম্ব হয়ে বসে পড়লাম মুন্নির সামনে। এরপর মুন্নি যা বলল তাতে আমি হতবাক।

মুন্নির জীবনে তখন সেই চরম দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সদ্য পরলোকগত স্বামী তার চিহ্ন রেখে গিয়েছেন। মুন্নি সন্তানসম্ভবা। অকূলপাথারে পড়ে মুন্নি কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। ভাস্কর নিজে গিয়ে মুন্নিকে নিয়ে এসেছে বাড়ীতে। শ্বশুরবাড়ীর লোকেরাও মেনে নিয়েছেন যে মুন্নি তার বাবার কাছেই বাকী জীবনটা কাটাবে।

এমন একদিন শোভনকে দেখা গেল। ঝড়ের মতো ভাস্করদের বাড়ি গিয়ে সিধা মুন্নির সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে খেঁকিয়ে বলল-“হয়েছে? লোকের বাড়ীতে গিয়ে থাকার শখ মিটেছে? এবার চল” ভাস্কর বাইরে থেকে সব শুনছিল। সেও বিলক্ষণ জানে শোভনের আচার-ব্যবহার। এবার ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করে-“কি করতে চাস তুই শোভন”? শোভন সপাটে উত্তর দেয়, “ওকে আর আলাদা রাখবনা। আমার কষ্ট হয়। তুই ব্যবস্থা কর”।

-“তুই সবকিছু জানিস?”

-“জানি,সব জানি। কিছুদিনের মধ্যে আমি বাবা হ’ব, এও জানি”।

মুন্নি বলতে চায়, এ হয়না। 

শোভন ছোটবেলার মতই ধমক দেয়-“তোকে কে পাকামো করতে বলেছে?”

মুন্নির বাড়ীর লোকেরা প্রচণ্ড অবাক হয়। শোভন ছোটবেলা থেকে তাদের বাড়ি যাতায়াত করেছে, কিন্তু কেউ কোনদিন শোভনের মনের মাঝের এই ফল্গু নদীর হদিশ পায়নি। 

শুধু মুন্নি জিজ্ঞাসা করে ছিল-“দয়া করছ?” ওর প্রশ্ন শুনে খেপে গেছিল শোভন।

যথারীতি বলেছিল-“মারব একটা কিল? অনেক তো কষ্ট দিলি এবার দয়া কর। আমি কি করব? কষ্ট হয়। তোকে ছাড়া আমার কষ্ট হয়। অসুবিধা হয়। হয়েছে”? 

এরপর রেজিস্ট্রি ম্যারেজ, সান্নির জন্ম আর সবাই মিলে শিলং-এ চলে আসা।

এই ঘটনা বলে মুন্নি বলল- ব্যাপীদা, ও খ্যাপা ভোলানাথ।

শোভন এসে হাসতে হাসতে বলল- কিরে? কেমন বুঝছিস?

আমি হাসব কি রাগব! ওকে বেশ কয়েকটা বাছা বাছা গালাগালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু তাও হলনা। সান্নি আছে সামনে।

সবাই মিলে বসলাম। অর্ডার সার্ভ করা হয়ে গেছে। আমার পাশে সান্নি, সামনে শোভন আর মুন্নি। মুন্নি খাওয়া শুরু করতে যাবে এমন সময় শোভন খেপে গেল-“আবার? দেখলি দেখলি বাপী? তোকে বলেছিলাম না?”

-কি হল রে?

-হাত ধোয় নি । নোংরা।

এই বলে পরম স্নেহে মুন্নির হাত টা সযত্নে ভেজা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে লাগল। আনন্দাশ্রুতে আমার দু চোখ ভিজে গেল। আমি শোভন-মুন্নির “সান্নি’ কে আদর করতে লাগলাম, আর অনুভব করলাম প্রেম যতো পুরনো হয়, ততই পবিত্র হয়, খাঁটি হয়, গাঢ় হয়।