Next
Previous
Showing posts with label বিশেষ রচনা. Show all posts
0

বিশেষ রচনা : রিয়া চক্রবর্তী

Posted in


বিশেষ রচনা



নারীদিবস
রিয়া চক্রবর্তী 



নারীদিবসের উৎসবে ঝলমল করছে পাহাড় ও নদী। চুপচাপ গাছের আড়ালে ফিসফাস শব্দ, যেসব পরিযায়ী পাখিরা তাদের আস্তানা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম দক্ষিণে, একটু উষ্ণতার জন্য। তারা একে একে ফিরছে সেই চেনা পৃথিবীর গন্ধে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে রাতে ঘরে ফেরে শিশুটির মা, অবসন্ন তার শরীর। উনুনে ফুটছে ভাত আর আলু সেদ্ধ, রাতের বিছানায় জোর করে প্রেমের উষ্ণতায় ভেঙে পড়ছে শরীর। এই ভূতগ্রস্ত জীবনের অন্ধকার কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তা - অঙ্কের কোন সংখ্যা দিয়েই বিচার করা যাবেনা। সকালে শিশুটি দুহাত মেলে দেয় মায়ের দিকে,  অস্ফুট শব্দে ডাগর চোখে মাকে দেখে আজ সে কিছুতেই যেন ছাড়বেনা, তবুও নিবিড় আলিঙ্গন থেকে ছেলেকে নামিয়ে  চলে যায় তার কাজে। রাতে ফেরার পথে পথ আটকায় চারজন পুরুষ, জোর করে বিবস্ত্রা করে তাকে লুঠ করে তার বশিষ্ট লজ্জা। পথের ধারে পরে রইলো নিথর দেহ প্রাণ ছেড়ে গেছে বিষাদলোক।

আচ্ছা, কবরের আড়ালে কফিনে গিয়ে পৌঁছোবে তো নারীদিবসের উৎসবের স্লোগান!
0

বিশেষ রচনা : পলাশ কুমার পাল

Posted in


বিশেষ রচনা


আমি নারী
পলাশ কুমার পাল




আমি নারী। এই জন্যই হয়তো আমার বিশেষত্ব। সাম্যতা আনার চেষ্টায় পুরুষ দিবসের না-অস্তিত্ত্বে নারীদিবস পালিত হয়। উৎসব! অনুষ্ঠানমুখর পরিবেশে কথার বেলুন সেজে ওঠে... বাতাসের অস্তিত্ত্ব ফুরালে সে বেলুন আর বেলুন নয়।

আসলে দোকানে দেখানদারি পুতুলের মতো এই 'নারী' শব্দের চমকে প্রত্যেকে স্বচ্ছ হয়ে উঠতে চায়। সেখানে নারী নিজেও বাদ যায় না। যেমন ধরুন আমি। নিজের জন্মের মুখরতা কতটা বর্ণময় বা বনেদী ছিল জানি না। তবে জন্মের পরবর্তী ক্ষেত্রে বড়ো হয়ে ওঠার মাপনীতে বয়সের বৃদ্ধির পাশাপাশি কিছু দাগ ক্রমশ সহযাত্রী হয়ে ওঠে আমার নির্বাক শিরদাঁড়ায়, যে দাগই নির্দেশ করে 'আমি নারী ওরা পুরুষ'।

আমি বিবাহের মঞ্চে চন্দনে-ফুলে সেজে বসে পড়ি সাতপাকের গভীর জলে... সুবাসিত রজনীগন্ধা ও অলংকারের মুখোশী আলাপে স্বপ্নগুলো যেন প্রজাপতি হয়ে ওঠে; যার কোনও শিরদাঁড়া নেই, নেই শিকড়! কেবল এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেড়াবার বৈশিষ্ট্যগুণে নিজেদের মানিয়ে নিই। দেশ শিক্ষিত হয় বর্ণমালায়, যুক্তিতে শাণ লাগে, বিবাহিত জীবনে শৈশবের অঙ্কিত পদবী কুষ্ঠিকে জীবন কুষ্ঠি রূপে সচল রাখি; আর বলি, "এই দেখো, আমরা নারী নিজেদের পরিচিতিকে নিজের মতো করেই রেখেছি। আমরা এখন স্বাধীন পাখি!"

কিন্তু সাতপাকের পরের সময়ে? পুরুষদের শিকড় আর আমাদের না-শিকড় দুই উদ্ভিদের পার্থক্যকে বাড়িয়ে দেয়। না-শিকড় মানে জড় বলছি না! শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত বেড়ে ওঠা বাগানের পরিবেশকে বিদায় জানিয়ে পাকাপাকিভাবে অন্য বাগানে বাসা বোনার মধ্যে যতটা তোমরা নতুন স্বপ্নের কথা বলো, তার থেকে বেশি ব্যর্থতা আমি বা আমাদের নারীদের দুর্বল করে। করণ শৈশব থেকে যে পরিবেশে নিজের শিকড় তৈরি হয়, তা সাতপাকের চক্রাবর্তে বিনষ্ট হয়ে যায়। নতুন সংসার, নতুন দেয়াল, নতুন মানুষজনের পরিবেশে শৈশবের মতো নতুনভাবে নিজেকে আবারও শিকড় তৈরি করতে হয়। ব্যতিক্রম হয়তো কিছুজন থাকে। তবে সময়-কাল-সভ্যতার অভিনবত্বের মাঝে নিজেরা যখন স্বাধীনতার রঙীন বেলুন ওড়াই আধুনিকতার আকাশে, ঠিক তখনই অ-বিবর্তিত এই লাটাই আর সুতো বলে দেয় ভূমির অস্তিত্ত্বের কথা।

সভ্যতা সৃষ্টির আদিমতা যে ভূমিতে জন্ম, সে বিবাহ। বিবর্তিত সভ্যতার মাঝে নারী-পুরুষের এই মিলন মানবসভ্যতার মূল বীজ। কিন্তু দুই পরিবেশের দুই মানুষের মিলিত সভ্যতা কোন পরিবেশে লালিত হবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হয়তো আদিকালে নিজেদের জন্মভূমিকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষিত আত্ম জাগরিত নারীরা? এই প্রশ্ন খুব একটা শুনিনা। আমরা নারীরা বা আমি নানা নারীবাদী প্রশ্নের বুদবুদে ফেণিত হলেও শ্যাম্পেন হয়ে রয়ে যাই বোতলে বা সভ্যতার ঠোঁট বেয়ে সভ্যতার মজ্জায়...

অনেকটা টবের গাছের মতন। আলোর সন্ধান চাই! চাই মাটিও! অথচ সজ্জিত থাকি বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় বা উঠানে বেড়ে ওঠা পুরুষের আলংকারিক হয়ে। গাছ হয়ে না-ওঠার ব্যর্থতায় শুধু নীল আকাশ দেখা, নিজেদের জন্মভূমির আটচালাকে বিদায় জানিয়ে নতুন মাটির সন্ধানে শিকড়ের 'বিবাহ উপকথা'। নারীবাদের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এক সমুদ্র নারী ঢেউয়ের নোনতায় সভ্যতার সমুদ্র সৈকতে ভেঙে পড়া...

আমি সেই সমুদ্র বা সামুদ্রিক ঢেউয়ের নারীদের অস্তিত্ত্ব! তোমরা পর্যটনের সুখ উপভোগ করো, শরীরে মাখো ঢেউ... স্ফূর্তিতে! আমি নারী বা আমরা নারীরা টবের সীমাবদ্ধতায় অট্টালিকার ব্যর্থতা! নারীদিবস আসে-যায় অতিথির মতো সাদা ধবধবে লালপাড় শাড়িতে। আসলে ধবধবে শুভ্রতার নারীবাদে লালপাড় হল এই ব্যর্থতার রক্তলেখা।
0

বিশেষ রচনাঃ মেরিন মুখার্জী

Posted in



বিশেষ রচনা


রোহিতের জন্য
মেরিন মুখার্জী



“When you are an untouchable and smart, you have no idea where you are going no matter how well you perform in class. You become a little mad. ... You are not likely to understand this. This is a country with several time zones at the same time. People like us are living in the middle of the 19th century. There are manual scavengers, also untouchables, who live in the eighth century. And then there are well-to-do urban elites who live in the future.”




রোহিত-কে নিয়ে লেখাগুলো পড়ে ফেলতে চাইছিলাম। দৃষ্টি ক্রমশই ঘোলাটে হয়ে আসছে, ঘোলা করে দেওয়া হচ্ছে। খুব সূক্ষ্ম ভাবে কিছু কথা হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিমধ্যেই। অসাধারণ একটি মৃত্যু-পরবর্তী কাল্পনিক সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম; ভালোই লাগছিল, সুর কেটে গেল শেষে এসে... সেখানে মন্তব্যের জায়গায় কেউ একজন দিব্যি ওঁকে “র‍্যাবিড, অ্যান্টি-হিন্দু, অ্যান্টি-ন্যাশনাল কমি” বলে ফেলেছেন। রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ওকে নিয়ে শিডিউল্‌ড্‌ কাস্ট না কি ওবিসি, এই ক্যাটিগরির মধ্যে লোফালুফি শুরু করে দিয়েছে। দলিত কি দলিত না এই নিয়েও তর্ক চলছে। কেউ কেউ একটা আপাত সঙ্গত প্রশ্ন তুলছেন – দলিত না হলে এই খুনের নামান্তর আত্মহনন কি লেজিটিমেট তকমা পেত? মানে দলিত বলেই কি রাষ্ট্রের এই নিষ্পেষণ অন্যায়? বর্ণ হিন্দুকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা যায় বুঝি? শুনতে ভালোই লাগছে। এবং উত্তর অবশ্যই না হতে পারে না।

কিন্তু আমি তো উত্তর দিচ্ছি না। আমি বোধহয় ঠিক মতো ভাবতেও পারছি না। আমার পিঠে হঠাৎ দুর্মুশের মতো একটা বাড়ি পড়েছে। দুই দশক আগে শোনা একটা ইতিহাসের অভিজ্ঞতা-লব্ধ বাক্য আমার বারবার মনে পড়ছে। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ির দান করে দেওয়া একটা বাড়ির প্রায়ান্ধকার ঘরে আমাদের দু-তিনজনকে মাস্টারমশাই অনেক বড়ো একটা আলোচনার মধ্যে বলেছিলেন “রাষ্ট্র (তোমাদের) দেগে দেবে; দেগে দিয়ে লেজিটিমাইজ করবে।” রাষ্ট্র দেগে দেয় – শব্দগুলো চেনা – উগ্রপন্থী, শ্রমিক, কমিউনিস্ট, মাইনরিটি, মেয়েমানুষ, লেসবিয়ান, অস্পৃশ্য, ছোটলোক, কুষ্ঠ বা এড্‌স্‌ আক্রান্ত, ডাইনি – যখন যেটা কাজে লাগে; লেজিটিমাইজ করার কাজে। 

তাই বলছিলাম কি, নিজেদের একটু ওই পাল্টা দেগে নেওয়া দরকার। আমি দলিত। আমাকে মারা তাই একটু বেশী অন্যায়। ‘মোর ইক্যুয়াল দ্যান আদার্স’ যদি হয়, তাহলে ‘মোর আন-ইক্যুয়াল দ্যান আদার্স’ নামক আন্ডারপ্রিভিলেজ্‌ড্‌ কেন হবে না? তোমার প্রয়োজনে যদি তুমি টেক্সট-এর মিমিক্রি করো, আমিও তবে তাই করবো; ওটাই আমার কন্টেক্সট, এন্ট্রি পয়েন্ট। 

একটা জানা গল্প আবার বলি। সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ থেকে ধার নেওয়া – ১৯২৬ সালে, কলকাতায়, মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়সে ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ি আত্মহত্যা করেন। প্রায় দেড় দশক এই আত্মহত্যার কোনও কিনারা হয়নি। এটুকু জানা ছিল, ভুবনেশ্বরী কোনো গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির সদস্যা। আর রটানো হয়েছিল (কে রটিয়েছিল? ব্রিটিশ পুলিশ না আত্মীয় পরিজন? জানি না; জরুরিও নয়) এ এক অবৈধ প্রেমের পরিণতি। বিবাহ বহির্ভূত গর্ভধারণের গল্প; এককথায় চরিত্রহনন। [“রাষ্ট্র (তোমাদের) দেগে দেবে”; এই রাষ্ট্র বাবা, মা, আত্মীয়-পরিজন, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতি যে কেউ হতে পারে] অনেক পরে জানা যায়, ভুবনেশ্বরীকে একটি সশস্ত্র বিপ্লবীদল একটি রাজনৈতিক খুনের দায়িত্ব দেয়। মানুষ খুন করার সংস্কার আর ঔচিত্যের মানসিক টানাপোড়েনের ফলে ওই আত্মহত্যা।

কিন্তু রহস্য একটা থেকেই গেল। সন্দেহটা হয়েছিল ময়নাতদন্তের একটি সূত্র ধরে। মেডিক্যাল রিপোর্টে ছিল আত্মহত্যার সময় ভুবনেশ্বরী রজঃস্বলা ছিলেন। বিবাহ বহির্ভূত গর্ভধারণের গল্প এখানেই ধূলিসাৎ। 

প্রশ্নটা ছিল “কুড দ্য স্যাভেজ [sa(va)ge] স্পিক?” আমরা শিখেছিলাম কিভাবে ডমিনান্ট ডিস্‌কোর্স দিয়েই (এক্ষেত্রে মেডিক্যাল রিপোর্ট, যা কি না পাশ্চাত্য বিজ্ঞান) ডমিনান্ট ডিস্‌কোর্সকে মারতে হয় (এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের কুৎসা)। মারছে কে? একজন মার্জিন অফ মার্জিন (একে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী সংগঠন, তায় আবার তার এক মহিলা সদস্যা) মৃত ভুবনেশ্বরী কথা বললেন আমাদের সাথে (ভবিষ্যতের কোনও জীবনীকারের সাথে) এমন ভাষায় যা কি না রাষ্ট্রও নেগেট করতে দুবার ভাববে। কোথাও পড়েছিলাম, so much so that she rewrote the social text (read: prestige) of Sati suicide in an interventionist way. She waited for the onset of her menstruation. In the way she not only denied but also displaced, through the physiological inscription of her body, its imprisonment within legitimate passion of a single male. 

রোহিত আত্মহত্যা করে আম্বেদকার স্টুডেন্টস্‌ অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা জড়িয়ে। আচ্ছা, ও কি কিছু বলতে চেয়েছিল? ওর দুর্জয় দারিদ্র, কঠিন পিতৃহীন শৈশব, আজীবন তাড়া করে আসা সমস্ত ভয়, আশঙ্কা, রাষ্ট্রের বিপুল বঞ্চনা, এবং শেষের এই দিনগুলোর বন্ধুহীন একাকীত্ব, রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করতে করতে খাদের ধারে বাস... 

রোহিতের একজন রায়ান দরকার। বোর্‌হেসের গল্পের রায়ান। রোহিতের জন্য নয়, আমাদের জন্য। 

ফার্গাস কিল্‌প্যাট্রিকের নাতি রায়ান। হিরো ফার্গাস কিল্‌প্যাট্রিক। আইরিশ রিপাব্লিক্যান আর্মির ফার্গাস কিল্‌প্যাট্রিক। ১৮২৪-এ বিপ্লবের প্রাক্কালে বুর্জোয়া গুলিতে মৃত ফার্গাস কিল্‌প্যাট্রিক। ঘটনার একশো বছর পরে জীবনীকার রায়ান খুঁজেছিল দাদুর হত্যাকারীকে। আর অতিকষ্টে খুঁজে পেয়েছিল আশ্চর্য সব (সাজানো) ঘটনার চিহ্ন। খুঁজে পেয়েছিল সেই দলিল যা অনুসরণ করেছিল শুধু ইতিহাস নয়, একেবারে জাতশত্রু ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়ারের নাটককে। কিভাবে দাদুর মৃত্যুর চিত্রনাট্য অনুসরণ করেছিল জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুকে। এতবড় সমাপতনে আশ্চর্য হতে হতে হাতে পেয়েছিল সেই মৃত্যুর পরোয়ানা, যাতে নিজের মৃত্যুদণ্ডে সই করছেন কিল্‌প্যাট্রিক নিজেই। বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে কিভাবে বিশ্বাসঘাতক কিল্‌প্যাট্রিক এক বিশাল নাটকে অভিনয় করতে করতে থিয়েটারে ঢুকে অপেক্ষা করেছিলেন অজানা অন্ধকার থেকে ছুটে আসা বহু আকাঙ্ক্ষিত একটি প্রি-ডিটারমাইন্ড্‌ বুলেটের। কিভাবে এই সাজানো ঘটনার পরম্পরা ধার করা হয়েছিল শুধু জুলিয়াস সিজার নয়, ম্যাকবেথ থেকেও। Traces and pieces of truth। কিল্‌প্যাট্রিকের প্রিয় কমরেড নোলানের লেখা চিত্রনাট্য ছিল এইসব অসম্পূর্ণ, আলো-আঁধারি চিহ্নে ভরা... ভবিষ্যতের রায়ানের জন্য। খুঁজে নেবার জন্য। বাদাবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিরো ফার্গাস কিল্‌প্যাট্রিক না কি ট্রেটর ফার্গাস কিল্‌প্যাট্রিক! ভবিষ্যতের বিপ্লবকে আজকের বারুদ দিতে কিভাবে নোলান তৈরী করেছিল এই সুবিশাল নাট্যমঞ্চ; বিপ্লবকে ধ্বংস করার প্রতিনায়ক কিল্‌প্যাট্রিক থেকে নায়ক কিল্‌প্যাট্রিক। 

কে লিখবে আমাদের এই থিম অফ আ ট্রেটর অ্যান্ড আ হিরো?



0

বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত

Posted in




বিশেষ রচনা




বৈষ্ণব সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ 
শৌনক দত্ত


সুস্মি থাকতে সুস্মির কাছে লেখা খুব একটা কেউ নিতো না। ওর চলে যাবার পর ওর লেখার কদর বেড়েছে। গতকাল রবীন্দ্র জয়ন্তীতে গিয়েছিলো বাসু। এর আগে বহুবার সুস্মি আর বাসু এসেছে নন্দনে, কেউ ফিরেও তাকায়নি। অথচ কাল বাসুর কাছে এগিয়ে এসে কত চেনা অজানা মুখ কথা বলে গেছে। কেউ কুশল বিনিময় করে গেছে। কেউ কেউ তো আবার সুস্মির লেখা চেয়ে বসেছে। বাসু আজ সকাল থেকেই সুস্মির লেখা নিয়ে বসেছে। অনেক লেখার ভীড়ে রবীন্দ্রনাথ ও বৈষ্ণবসাহিত্য শিরোনামে একটি লেখা পেয়ে থামে বাসু। তারপর পড়তে থাকে। 

রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রত্যুষকাল থেকে প্রদোষকাল পর্যন্ত বৈষ্ণবপদাবলীর অনেক অবিস্মরণীয় পংক্তি ভিন্ন ভিন্ন তাত্‍পর্যে রবীন্দ্রসাহিত্যে দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাছে বৈষ্ণবপদাবলীর আবেদন চিরকালের এবং সেই আবেদন মূলত সাহিত্যিক। বৈষ্ণব কবিতা তাঁর মতে বৈকুন্ঠের গান নয়। চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের পরিচয় বৈষ্ণব পদাবলীর সাথে। ষোল থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মাঝেই রচিত ভানুসিংহের পদাবলী। এই কাব্য রচনার প্রেরণা সম্পর্কে বলা যায়, বৈষ্ণব কবিতার ভাষা মাধুর্য তার ছন্দের ঝংকার তার অপরূপ রসবৈচিত্র্য তরুণ রবীন্দ্রনাথের মনকে একেবারে উন্মথিত করে দিয়েছিলো। প্রশ্ন জাগে কবি কেন ভানুসিংহের আড়ালে থেকে এই কাব্য লিখেছিলেন? উত্তরটি খুঁজতে রবীন্দ্রনাথের নিজের কৈফিয়ৎ পড়া যাক।

রবীন্দ্রনাথ ১২৮৬ এ ভারতী-র শ্রাবণ সংখ্যায় লিখছেনঃ 'একটি প্রাচীন ভাষায় রচিত ভালো কবিতা শুনিলে তাহারা বিশ্বাস করিতে চায় যে, তাহা কোনো প্রাচীন কবির রচিত। যদি তাহারা জানিতে পারে যে, সে সকল কবিতা একটি আধুনিক বালকের লেখা তাহা হইলে তাহারা কী নিরাশ হয়।....এইরূপ অবস্থায় একজন যশোলোলুপ কবি-বালক কি করিবে?'

সুস্মি কি যশোলোলুপ ছিলো? বাসু অতীত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুস্মিকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই সুস্মির যশোলোলুপতা খুঁজে পায় না। কিচেন থেকে ঠান্ডা কফির মগ হাতে বাসু আবার পড়ায় ফিরে আসে। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে রাধা কৃষ্ণের প্রেম লৌকিক প্রেমেরই বলিষ্ঠ প্রকাশ। এই প্রেম বিশ্বব্যাপী। এই প্রেমই অধ্যাত্মশক্তির রূপক। সৌন্দর্য ও প্রেমের পূজারী। রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে প্রেমের অতল গভীরতা ও সৌন্দর্যের অসীমতা খুঁজে পেয়েছেন। রবীন্দ্রসাহিত্যে বৈষ্ণব কবিতার উদ্ধৃতির সংখ্যা বৈচিত্র্য খুব বেশি নয়, প্রয়োগ বৈচিত্র্যই বিস্ময়কর। কয়েকজন শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদকর্তার মুষ্টিমেয় কয়েকটি শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবপদের প্রসিদ্ধ অংশ বিশেষ রবীন্দ্রসাহিত্যে নানাভাবে ঘুরে ঘুরে দেখা দিয়েছে। সংখ্যায় তারা সামান্যই। কিন্তু প্রত্যেকবার একই উদ্ধৃতি নব নব বক্তব্যের তাত্‍পর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে। এর ফলে উদ্ধৃতির অংশটুকু কেবল উদ্ধৃতিমাত্র না হয়ে বিভিন্ন বক্তব্যের সংস্পর্শে এসে নতুন নতুন ব্যাখ্যা হয়ে উঠেছে।

বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে চন্ডীদাসই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয় কবি। চন্ডীদাসের পদের অব্যক্ত অর্থগৌরবের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন তাঁর 'চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি' প্রবন্ধে। চন্ডীদাসের পদের ব্যবহারও রবীন্দ্রসাহিত্যতে স্বভাবতই বেশি। কারণ চন্ডীদাসের পদের অর্থ তাত্‍পর্যের সম্ভাবনা অনেক। চন্ডীদাসের আক্ষেপানুরাগ বা নিবেদনের এক একটি পদের অংশবিশেষ সেই পদের আবেষ্টনী ভেদ করে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় বিভিন্ন তাত্‍পর্যে উপস্থাপিত হয়েছে। ভানুসিংহের রাধার উক্তিতে যেখানে অভিলাষ পূরণের ইচ্ছাই প্রবল করে দেখা দেয়, কৃষ্ণই যেন রাধার আনন্দবিধানের উপায়। কৃষ্ণের আহ্লাদের তিনি কারণ হন না। "বঁধূয়া, হিয়া পেরে আওরে মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মৃদু ভাষয়ি হমার মুখ পরে চাওরে।" সেখানে চন্ডীদাসের রাধা বলে- "বহুদিন পর বঁধূয়া এলে। দেখা না হইতে পরাণ গেলে। একে সহিল অবলা বলে।" পদাবলীর রাধা প্রিয়মিলনের সময় এত কথা বলতে পেরেছেন কি? যে রাধা বঁধূয়ার দর্শনে আনন্দে মূর্ছা যান, মিলিত অবস্থায় যিনি বিরহ অনুভব করেন, এ রাধা সে রাধা নন। 

লেখা থেকে চোখ তুলে দেয়ালে তাকায় বাসু। সুস্মির ছবির দিকে চোখ পড়তেই বুকটা হু হু করে উঠে তার। সুস্মির অকাল প্রয়াণকে আজো সরল ভাবে মেনে নিতে পারেনি বাসু। শিঞ্চন তাকে এখনো মানসিক রোগী হিসেবেই ট্রিট করে। অথচ কাউকে সে বলতেও পারেনা, সুস্মি কোত্থাও যায়নি। সুস্মি তার সাথেই আছে, তার পাশে।


0

বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত

Posted in



বিশেষ রচনা 



ঈর্ষা নামে আবেগের ঢেউ... 
শৌনক দত্ত



সুস্মি প্রায়শঃ বলতো বাসুর ইগো নেই ভুতেও বিশ্বাস করবেনা। সুস্মি নেই এটা মানতে না পারাও কি ইগো? ঘরময় ছড়িয়ে সুস্মি। বাসু কফি বানাতে বানাতে আনমনেই বিড়বিড় করতে থাকে- 'বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি। নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুষ্পদল। নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহবল। বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার আত্মজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলঙ্কৃত করে ওষ্ঠতল। আমি একা ফুটতে পারি না আমি একা ফোটাতে পারি না রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও। আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।' [বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি,পূর্ণেন্দু পত্রী] আজ ছুটির দিন, কফি নিয়ে বসে বাসু সুস্মির ডাইরি মেলে পাতার পর পাতা উল্টায় একটি পাতায় চোখ আটকে যায় তার। যেখানে লেখা- 'O, beware my Lord of jealousy, It is green-eyed monster which doth mock The meat it feeds on. 'ওথেলো তে শেক্সপিয়র বলেছিলেন। কফিমগে চুমুক দেয় বাসু। সুস্মির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক তারপর বলে ওঠে সুস্মি আমি কি চিনি ঈর্ষা? সুস্মি ছবিতে মৃদু হাসে তারপর বলে ওঠে মানুষ যখন অন্যের চরিত্রে এমন কিছু দেখে, যেটা তার নেই, থাকলে ভালো হতো, তখনই তার ভেতর এই রিপু জেগে ওঠে।

কিছু হারানোর আশঙ্কায় অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও ঈর্ষার জন্ম দেয়। আর এই প্রতিক্রিয়া যখন মনে অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে তখন তা হয় ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বা হিংসা। তাছাড়া 'আমিত্ব'বড় হয়ে ওঠে যখন তখনই ঈর্ষা বাসা বাঁধে বুকের গহীনে। আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ঈর্ষা জন্মে না তাই প্রকৃত সন্ন্যাসীর ঈর্ষা আছে বলে শোনা যায় না। গৌরাঙ্গ শাস্ত্র গুলে খেয়ে যখন গঙ্গায় ভাসিয়ে চৈতন্য হলেন তখন তার আর কোন আকাঙ্ক্ষা ছিলো না তাই তার ঈর্ষাও ছিলো না। সেই জন্যই মাতালের কাছে আঘাত পেয়েও তিনি ঈর্ষা বা হিংসা না করে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের তবে ঈর্ষা ছিলো? বাসু প্রশ্ন করে। সুস্মি হাসে আবার দশদিককে বেদিশা করে দিতে থাকে। বাসু কফি মগে চুমুক দেয়। 'মোরে আরো আরো দাও প্রাণ' মোবাইল বেজে ওঠে, ডাক্তার শিঞ্চনের কল। বাসু কলটা ধরে না। সে জানে শিঞ্চন বলবে, ওষুধ খেয়েছিস? বিশ্বাস করবে না সে সুস্মির সাথে কথা বলছে। মোবাইল বেজে যায়। বাসু মোবাইলের সুইচটা অফ করে দেয়। ডাইরির পাতা উল্টায়। পবিত্র কোরান শরীফের একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- 'এবং বেহেশতে তোমরা প্রবশে করবে ঈর্ষামুক্ত অবস্থায়।' এর সরল অর্থ দাঁড়ায় শুধু বেহেশতের মানুষ ঈর্ষামুক্ত, ধুলাবালির পৃথিবীতে নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি ঈর্ষা এক অর্থে আমাদের চালিকাশক্তি। সভ্যতার বিকাশে এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ? পৃথিবীর ধুলোবালিতে যখন তার প্রিয় সখী দ্রৌপদী লাঞ্চিত হলেন নোংরা পুরুষতন্ত্রের ঈর্ষায় তখন শ্রীকৃষ্ণ ঈর্ষা পরায়ণ হয়েছিলেন সভ্যতার কারণেই। এই মানবিক দুর্বলতামুক্ত হওয়া মহাপুরুষের পক্ষেও সম্ভব নয় হয়ত!

বাসু উঠে যাও কফির শেষ চুমুক ফেলে রেখে। সুস্মির ছবির পাশে রাখা মনোবিজ্ঞানের বইটি নেবার আগে ছবিতে পরশ বুলিয়ে বইটি তুলে আনে। তার বুকের ভেতর ঈর্ষার পরাণ টলমলো। সুস্মি হাসে, আমাকে নিয়ে তোমার ঈর্ষা ছিলো, মনে পড়ছে বাসু? তিনশ বার পাতাটি পড়ো বইটির। বাসু পাতা উল্টে পড়তে থাকে ঈর্ষা একজন স্বাভাবিক মানুষের অস্বাভাবিক প্রবৃত্তি বা আবেগ। এটি কখনো দৃশ্যমান, কখনো অপ্রকাশ্য। এই প্রবৃত্তির পরিধি কিন্তু খুব ছোট। মানুষের চেনাজানা গন্ডির ভেতর এর আবর্ত। আপনার বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী আপনাকে ঈর্ষা করে। কেন করে? যখন আপনি এমন কিছু করেন বা প্রাপ্ত হন, তখন অন্যের না পারার বা না পাবার বেদনাই সৃষ্টি করে ঈর্ষা বা হিংসা। পৃথিবীর সকল মানুষের সকল প্রাপ্তির পেছনেই আছে ঈষার বিষ। ঈর্ষার অপর পিঠেই খোদাই করা আছে ক্ষতি করার প্রবণতা। আপনি যখনই কিছু অর্জন করবেন, তখনই জানবেন আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে কিছু মানুষ, ঈর্ষানেশ্বীর লাইন। যারা এখন আপনার ক্ষতি বা অপপ্রচার করার জন্য প্রস্তুত। বাসু উঠে দাঁড়ায় আজ কি সে ঈর্ষাহীন চৈতন্য, হিংসাহীন লোক যার পেছনে কারো লাইন নেই কেবল হাহুতাস। জানালার ওপার থেকে ভেসে আসছে শবযাত্রার ধ্বনি হরি বোল, বোল হরি। পলকে ঘুরে দাঁড়ায় বাসু সুস্মির চোখে এক অলৌকিক সময় যেন ঈর্ষা মরে গেছে কিংবা ঈর্ষা করা শবের পেছনে ঈর্ষার যাত্রা যাত্রা যাত্রা কেবল...





3

বিশেষ রচনাঃ ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in


বিশেষ রচনা


কৃষ্ণচূড়া আখ্যান
ঈশানী রায়চৌধুরী



সে ছিল এক পাগলী কৃষ্ণচূড়া | এক্কেবারে পাগলী | তার বাবা সামান্য কেরাণীর চাকরি করতেন | মাসের মধ্যে অর্ধেক দিনই ট্যুরে | মা নিপুণ হাতে দরাজ বুকে আগলে রাখতেন খুব স্বল্প স্বাচ্ছন্দ্যের সংসার | অর্থের অভাব ছিল হয়ত, প্রাচুর্য ছিল না ; কিন্তু মনের দৈন্যও তো ছিল না ! দু'টি খুদে ভাই বোন ছিল | তাদের জন্য পরাণ ফাটত তার | ভাই বড় চঞ্চল | সারা দুপুর উঠোনে ক্রিকেট | দিদির সঙ্গে | মা দুপুরে দু'চোখের পাতা বুজতে পারেন না | রেগেমেগে গুমগুমিয়ে কিলোতে এলে দিদি পিঠ পেতে দেয় নিজের | ভাইটা যখন একবছরের , ওরা থাকত বেঙ্গল কেমিক্যালে | সেখানে খালের জলে ডুবে যাচ্ছিল ভাইটা | সাঁতার না জেনেই তার ছ'বছরের খুদে দিদি জলে ঝাঁপ দিয়েছিল সেদিন | বাকিটা মাঝিমাল্লার গল্প |

মেয়েটা বড় বুদ্ধিমতী | অঙ্কে খুব মাথা | কিন্তু ওই যে, খালি ঝোঁক পড়ার বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই লুকোনোর | বই কিনে আর কত পড়বে ! চেয়েচিন্তে আনে | আর ক্যারাম | এখন ওরা বেঙ্গল কেমিক্যালের পাট চুকিয়ে ভবানীপুরে | বাবা বড্ড কড়া |নিম্ন মধ্যবিত্ত বা টেনেটুনে মধ্যবিত্তের সংসারে পড়াশুনো করতেই হবে ! তাই অসময়ে ক্যারাম পিটলে লালচোখ করে বাবা দেশজ ভাষায় বলেন , " ছেমড়ি , তর ওই ক্যারাম বোর্ড কাইট্যা আজ আখায় দিমু অনে |"

তাহলে মেয়েটা পাগলী কেন ? কারণ সে সাজুগুজু নিয়ে মাথা ঘামায় না | বায়নাবাটি করে না | এলোঝেলো হয়ে থাকে | আঁক কষা তার নেশা | চটি ছিঁড়ে গেলে সেফটিপিন লাগিয়ে কাজ চালায় | দুপুরে ইস্কুল থেকে ফিরলে একটা বড় বগি থালায় ভাত মেখে গোল্লা পাকিয়ে তার মা খাইয়ে দেন তিনজনকে | সে দেখেই না , তার ভাগের মাছটা ভাই খেয়ে নিল কিনা...সে পিঁড়িতে বাবু হয়ে বসে কোলে গল্পের বই রেখে পড়েই যায়, পড়েই যায় |

স্কুল শেষ হল | রেজাল্ট ভালো হল, কিন্তু আশানুরূপ হল না | কারণ একটা জ্যামিতির এক্সট্রা, ১২ নম্বরের, সে প্রশ্ন পড়তে ভুল করেছিল | সেটা নিয়ে রগড়াতে রগড়াতে চলে গেল সময় | অঙ্কে লেটার হল. একশ' হল না |

হল না তো আরও অনেক কিছুই | সার্জেন হতে চেয়েছিল, বায়োলোজি ক্লাসে নিখুঁত ডিসেকশন করত | বাবার টাকার জোর ছিল না | ডাক্তারী পড়তে, প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে | ইঞ্জিনীয়ারিং ? ছবি আঁকার হাত খুব ভালো | একমাত্র মেয়ে, যে অত বছর আগে পরীক্ষা দিয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করে চান্স পেয়েছিল আর্কিটেকচার পড়তে | হল না | শিবপুরে তখন এ. সি . রায়ের আমল | তিনি বলেছিলেন, " তুমি একা মেয়ে | হোস্টেল দিতে পারব না | তুমি বাড়ির কাছে কোনো কলেজে পড় | তুমি তো অঙ্কে এক্সেলেন্ট, ফিজিক্স নিয়ে পড় |"

তাই সই | মর্নিং কলেজ | খুব ঘুমকাতুরে | সকালে রোজ দেরী | তাই রাতেই চুলে দু'বিনুনি বেঁধে শুতে হয় | সকালে উঠে চায়ে রুটি ডুবিয়ে খেয়ে কোনক্রমে আলনা থেকে একটা শাড়ি নামিয়ে শরীর ঢেকেঢুকে একছুটে কলেজ | তাকে কলেজে সবাই চেনে | যে মেয়েটা চুল না আঁচড়ে আসে রোজ রোজ, যে মেয়েটা দেখনহাসি |

পাগলী এবং দেখনহাসি | তার প্রেমে পড়েন অন্যবিভাগের এক সুপুরুষ অধ্যাপক | তিনি আবার বাপ মায়ের এক পুত্র এবং সুপুত্র | তাঁদেরও মধ্যবিত্ত সংসার | কিন্তু তাতে কী ? পাত্রপক্ষ তো ! প্রেমপর্ব চলছে | দাদারা, বন্ধুরা মধ্যস্থতা করছে | এর মধ্যে মেয়েটি স্নাতক স্তর উত্তীর্ণ হয়ে যায় | তার বাবা তখন উইদাউট পে বাড়িতে | দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম | মেয়েটি স্কুলে চাকরি করছে | বাড়িতে টাকার তো দরকার খুব | মাস্টার্স ? সে হবে'খন | না হয়, এক বছর পর | পাত্রের বাবা গোবেচারা, ভালোমানুষ | মা রণং দেহি | এই মরকুটে হাভাতে গরীবঘরের কালো মেয়ের হাসিতে মজেছে ছেলে ! বিয়ে হবে | কিন্তু গোড়া থেকে মেরে রেখে দাও | "আমাদের বাড়ির বউরা চাকরি করতে বাইরে যায় না |" মেয়েটি তখন মাত্রই উনিশ | তার বাবা বলেছিলেন, " এত ভালো পাত্র , আমি যেভাবে পারি চালিয়ে নেব | তুই চাকরিটা ছেড়েই দে | ওঁদের যখন ইচ্ছে নয় !"

ছেড়ে দিল সে চাকরি | স্কুলের চাকরি | সাউথ পয়েন্ট স্কুল | চেয়েচিন্তে কিছু ধারধোর করে বিয়ে হয়ে গেল তার | ছোট ভাইবোন কপাটের আড়াল থেকে দেখল দিদি যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি |

ফুলশয্যার রাতেই তার বর বলে দিয়েছিল, " আমি এক ছেলে | মায়ের অবাধ্য হতে পারব না | তোমায় মারুক, কাটুক..সইতে হবে |"
" আমি মাস্টার্স করব না ?"
" করবে | কিন্তু তা বলে সংসার চুলোয় দিয়ে নয় |"

রান্নার লোক ছিল এতদিন | এখন বউ এসেছে | কী দরকার ? আর এ বাড়ির সবাই টুকটুকে ফর্সা | বৌয়ের না আছে রূপের জোর .না আছে রুপোর | আর কালো রঙে উনুনপাড়ে গেলেই কী, না গেলেই কী |

সে রান্না করে , ঘর গোছায় | তোলা কাজের লোক না এলে বাসন মাজে , কাপড় কাচে| তারপর হাতের কাজ মিটলে ধুঁকতে ধুঁকতে ইউনিভার্সিটি যায় | আর ফিজিক্স নয় |এবার বিশুদ্ধ গণিত | প্র্যাক্টিকালের ঝামেলা নেই... তাই | সে ঠিক আছে | অঙ্ক মেয়েটির বিশল্যকরণী |

যেদিন বাড়িতে অতিথি এসে পড়েন কেউ, সেদিন কলেজ কামাই | চা জলখাবার দেবে কে ! তবে কোনো কোনো বিশেষ অতিথি এলে, বড়মানুষ অতিথি...সেদিন চা জলখাবার বানাতে হয় না বটে, তবে কলেজেও যাওয়া হয় না | সেদিন তাকে পুরো সময়টা তার শাশুড়ি বাথরুমে বন্ধ করে রাখেন | কালো বউ | ছি :|

মেয়েটি ভাবে, বাবার টাকা থাকলে তার রঙের জলুস বাড়ত কি ? একটু ?

সন্তানসম্ভবা হয় সে | এবং জন্ম দেয় এক কন্যার | এখানেও শাশুড়ি মুখ বেঁকান | "হয়েছে তো এক ডোমের চুপড়ি ধোয়া মেয়ে ! " প্রথম প্রথম নাতনীকে কোলেই নিতেন না | তারপর অবিশ্যি নাতনির গায়ের রংটি দেখে কিঞ্চিত মজেন | মেয়ের জন্ম দিয়ে তরুণী মা মরমে মরে থাকে | তার লেখাপড়া শিকেয় ওঠে | এত কথা... এত কথা... এত অত্যাচার... সে যখন ৭ মাস গর্ভবতী, মনের জ্বালা সইতে না পেরে গিয়েছিল গর্ভপাত করাতে | বলেছিল, "চাই না "| অনেক দেরী হয়ে গেছে | ডাক্তার রাজী হননি| সেই খুকী জানে, সে অবাঞ্ছিত ছিল | তার মায়ের কাছে | জানে, অনেক যন্ত্রণায় তার মা ছুটে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে | এও জানে, খোঁটার ভয়ে, যদি আবার মেয়ে হয়... সেই ভয়ে... তার মা কাকবন্ধ্যা রয়ে গেছে |

এরপর হল এক মজা | খুকী যেই বড় হল একটু, তার ঠাকুমা তাকে কুক্ষিগত করলেন| খুকী তাঁর কাছে খাবে, ঘুমোবে | খুকীর মা দূর থেকে দেখে, মেয়ে ঠাকুমার আঁচল ধরে গুটিগুটি হাঁটে | ঠাকুমার গলা জড়িয়ে গল্প শোনে | খুকীর মা বলে, "আয় না, আমার কাছে শুবি |" খুকি গা মুচড়ে বলে, "যা:, ঠাম্মা কাঁদবে |"

তরুণী মা রাঁধে বাড়ে, কর্তব্য করে | আত্মীয়স্বজনের যত্ন করে দু'হাতে | এখন লোকের চোখে কালো রং সয়ে গেছে | খুকী পড়ে -..তার মায়ের কাছে | ফ্রক সেলাই করে... মা | চুল বেঁধে দেয়... মা | মা তার প্রয়োজনের জায়গা | ঠাকুমা তার আব্দারের, আহ্লাদের |

তরুণী মা | চারাগাছ থেকে ফুলধরানো ডাল | খুকী | খুকী বড় হয় | ইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি...

খুকী অঙ্কে ভালো | কিন্তু মেধায় সে তার মায়ের পায়ের নখের যুগ্যি নয় | খুকীও চারাগাছ ছিল, কিন্তু তাতে জল পড়েছে, সার পড়েছে | খুকীর মা ? গাছ বেড়েছে, পরিচর্যা পায়নি |

খুকীর মায়ের চুলে রুপোর তার | অনেক | অনেক | কিন্তু চুলের আড়ালে তীক্ষ্ণ মেধায় এখনও যেকোনো অঙ্ক কষা হয়ে যায় হেলায়, কঠিনতম সুডোকু বা অঙ্কের ধাঁধা রেকর্ড সময়ে, যেকোনো হাতের কাজ নিখুঁত পারদর্শিতায়, আই কিউ লেভেল পরীক্ষা করতে ভয় পায় খুকী | জানে, মায়ের কাছে হেরে ভূত হয়ে যাবে |

দেখনহাসি আছে আগের মতোই | চোখের দীপ্তিও | তেমনই ঝকঝকে | বয়সের সর পড়েছে সামান্য | তাতে সৌন্দর্য এখন অন্য মাত্রায় |

খুকী চোখ বুজলেই দেখতে পায় , তার মায়ের ডুরে শাড়ির আঁচল মিলিয়ে যাচ্ছে ট্রামলাইন পেরিয়ে | ইউনিভার্সিটির দিকে |

দেখনহাসি নাকি নিজের কথা লিখেছে একটা | মোটা রুলটানা খাতায় | কাউকে পড়ায়নি | কে জানে ! সঙ্কোচে, নাকি অভিমানে?

এ এক অন্য কৃষ্ণচূড়া | কতটা আকাশ ছুঁয়েছিল.. জানি না | তবে ছায়া দিয়েছিল | ফুলও |
0

বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত

Posted in


বিশেষ রচনা



সুস্মিতার ভাষা ও একান্ত ছায়া 
শৌনক দত্ত


বাংলাভাষার আত্মত্যাগের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারী যেদিন বিশ্বমাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেলো বাসু আর সুস্মিতা সেদিন ঢাকায়। বাসুর বড় আক্ষেপ বাংলাভাষার জন্যই যদি এত প্রাণত্যাগ, তবে ৮ই ফাল্গুন বলতে মানা কোথায়? সুস্মিতা কিসব বুঝিয়ে ছিলো। কলিং বেলের শব্দে ঘোর কাটে, -টগবগে কিছু ছেলেমেয়ে। বাসুর অবাক চোখের চাউনিকে পলকে পাল্টে বলে উঠলো সুস্মিতা দির খবরটা পেয়েও আসতে পারিনি। ওনার একটি লেখা এবছর ভাষা সেরা পুরস্কার পাচ্ছে। দিদি তো নেই, আপনি এলে খুশি হবো। কথাটা শেষ করার আগেই একটি ছেলে একটি দুই ফর্মার বই বাড়িয়ে দিলো শহীদমিনারের পাশে সুস্মিতার ছবি, নাম - বাসুর সাথে ভাষার খোঁজে। ছবিটা বাসুই তুলেছিলো। তোমরা ভেতরে এসো? না দাদা আজ নয় বরং চলি। বাসুর সাথে ভাষার খোঁজে - নামটা পড়তে চোখটা ছলছল করে উঠলো স্মৃতির বাক্সো‌ খুলে উড়ে এলো ন্যাপথলিন স্মৃতি। ঐ বছর বাংলাদেশ, মনিপুর, আসাম কোথায় যায়নি। সেসময়ের বিরক্তি আজ বড় শূন্য করে দিচ্ছে বাসুকে। তবু বইটি খুলতেই যেন কর্পূরে স্বপ্নের ঘ্রান। কি লিখেছিলো সুস্মিতা? কত শখ ছিলো পুরষ্কার পাবে, পেলো সেই ওর কথা মতই - 'বাসু আমার ভেতরে জীবনানন্দ, আমাকেও দেরীতেই চিনবে পৃথিবী!' এ কি আক্ষেপ, নাকি আত্মদর্শন?

ভাষা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষার উদ্ভব এবং ক্রমান্বয়ে তার বিকাশ ও পরিপূর্ণতা আমাদের মানব সভ্যতাকে দিয়েছে এক বড় পরিবর্তনের আলোক সূচনা। তাই ভাষা আমাদের জন্ম ও বিকাশের সাথে প্রত্যক্ষ সংযুক্ত। শিশু এই পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলে যখন, তার কানে ধ্বনিত হয় কোন ভাষা - সেই ভাষা, সেই ধ্বনির সাথে তার ধীরে ধীরে পরিচয় হয় আর তা হয়ে ওঠে তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষাই কেন? কারণ একটি শিশু সবচেয়ে বেশি সময়, ভালবাসা আর উষ্ণতা লাভ করে তার মায়ের কাছেই, আর তাই মায়ের ভাষাই তার আপন হয়ে ওঠে অনেক বেশি। তাই মায়ের ভাষা প্রতিটি মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। শোক, ক্ষোভ, আনন্দ উচ্ছ্বলতায় মানুষ তাই তার অনুভূতি সত্যিকার অর্থে প্রকাশ করে তার মাতৃভাষাতেই। বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। তাই সে বাংলাতেই কথা বলে, কিন্তু ইতিহাসের পাতা উড়ে এলেই দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে বাঙালির প্রাণের ভাষাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে বা ষড়যন্ত্র হয়েছে বারবার। বিশ্ব ইতিহাসে এই বাংলা ভাষাকে নিয়ে যত ষড়যন্ত্র বা দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে তেমনি এই বাংলাভাষার জন্য যে এই প্রাণ বিসর্জন আর কোন ভাষার জন্য এভাবে দেখা মেলে না।

ভাষা আন্দোলন; পটভূমি থেকে মাতৃভাষা দিবস ১৭৭৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মত পোষণ করেন একজন ব্রিটিশ লেখক। তার নাম ন্যাথিনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। ১৯১৮ সালে ভারতের ঐতিহ্যবাহী শান্তিনিকেতনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ভারতের সাধারণ ভাষা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রবিঠাকুর ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে মত পোষণ করেন। এ প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেন ওই সভায় অংশগ্রহণকারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তার বক্তব্যে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। ওই সময়ে হিন্দি- প্রেমিকরা হিন্দিভাষাকে সমর্থন করে গান্ধীজীর দরবারে একটি পত্র লেখেন, তা হলো- the only possible national language for intercourse is hindi in India. ১৯২১ সালে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী লিখিত আকারে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে পেশকৃত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা প্রবন্ধে আব্দুল হক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। ১৯৪৮ সাল নবগঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে করাচিতে। বৈঠকের শুরুতেই উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা হয়। 

পূর্ব বাংলার বিরূপ প্রতিক্রিয়া: গণপরিষদ সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কুমিল্লা) সভায় একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাতে তিনি উর্দু-ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি জানান। পূর্ব বাংলার সব মুসলিম সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা এক জোটে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। পূর্ববাংলায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। ‘‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’’ দাবিতে ছাত্রসমাজের বৈপ্লবিক পদক্ষেপে ঢাকার রাজপথ সরগরম হয়ে ওঠে। 

ভাষা-বিক্ষোভ ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ: বঙ্গীয় সমাজে বাংলাভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের আত্ম-অন্বেষায় যে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যার চরম প্রকাশ ঘটে। এইদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে বরকত, জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক সহ ছয়জন ছাত্র-যুবক হতাহত হন। 

রাজপথে প্রতিবাদী মিছিল: এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে সমবেত হন। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জমাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। এদিন নবাবপুর, রণখোলা ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এ দিনে শহীদ হন শফিউর রহমান, আব্দুল আউয়াল ও অহিদুল্লাহসহ একাধিক ব্যক্তি। 

শহীদ মিনার স্থাপন ও ভাঙ্গন: ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখের রাতে ছাত্রজনতার এক বৈঠকে নেতৃবৃন্দ শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই রাতের অন্ধকারেই গুলিবর্ষণের স্থানে নিজেদের নকশা অনুযায়ী ইট দিয়ে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে পুলিশ এ শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেয়। সে জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে প্রথম শহীদ দিবস পালনের জন্য কাগজ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরের দুই বছরও ঐ স্থানে কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে শহীদ মিনারের অভাব পূরণ করা হয়। 

যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিমলীগ হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীর মিলিত যুক্তফ্রন্টের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয় বিপুল ভোটে। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মাঝে ২২৩ টি আসন পায়। মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯ টি আসন। বাংলাদেশিদের দাঁতভাঙ্গা জবাবে পূর্ব পাকিস্তানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মুসলিম লীগ। 

বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি: অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে সরকার বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। স্বীকৃতি পেল ২১ ফেব্রুয়ারি। 

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পাওয়ার পিছনেও রয়েছে দীর্ঘ সাধনা, সংগ্রামের ইতিহাস। কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের প্রতিষ্ঠিত “The mother language lover of the world” সংগঠন ১৯৮৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করে একটি চিঠি পাঠান। এ চিঠিতে সাত জাতি ও সাত ভাষার দশজন স্বাক্ষর করেন। এর এক বছর পর, ইউনেস্কো সদর দফতরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া রফিকুল ইসলামকে ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ সম্মতিসূচক চিঠি লেখেন, Regarding your request to declare the 21 February as International Mother Language day. The idea is indeed very interesting. 

অবশেষে Bangladesh National Commission -র পক্ষে সচিব কফিল উদ্দিন আহমদ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে প্রস্তাবটি ইউনেস্কো সদর দফতরে পেশ করেন। ইউনেস্কোর ২৮ টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাব লিখিতভাবে সমর্থন করে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে শোকার্ত দিন নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন গোটা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। রক্তের আলপনা এঁকে যে ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের বাঙালি সন্তানরা, রাজকীয় ভাষা হিসেবে। তাঁদের আন্দোলনের সূত্র ধরেই ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাঁরাই আমাদের গর্বিত ধন, তাঁরাই আমাদের মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠাতা।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র আহত হয়। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান। সেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তাঁর মনে হয়, এটা যেন নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষনাৎ তাঁর মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে'ও এটি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কবিতাটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন। আব্দুল লতিফ তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেন। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল। গানটি গাওয়া ও লিখার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১জন ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদ, যিনি সেসময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। 

প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায়। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।

বাসু কিছুক্ষণ বসে থাকে তারপর উঠে গিয়ে কফি দুটো মগ নিয়ে এসে আবার পড়ে। তার মনের ক্যালেন্ডার উড়তে থাকে - মনে পড়ে যায় এই লেখাটার জন্য কত বই আর কত জায়গায় ছুটেছে সে, কখনো সুস্মিতা আর সে। এই লেখাটার সময় একটা নেশা পেয়ে বসেছিলো বাসুর, সুস্মিতার নিশ্চয় আরো বেশি মনে পড়ে, এই ছুটোছুটি পড়ালেখার জন্য বাসুর চাকরী গেলো। সুস্মিতা লেখা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলো, বাসু তা হতে দেয়নি। ডিপোজিট ভেঙ্গে ছুটলো আসাম, মনিপুর। এক পলক সুস্মিতা কে দেখে মগে কফির চুমুকে স্মৃতির রোদগন্ধ মিশিয়ে পড়তে লাগলো-

প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে বাংলাদেশের বাঙালীরাই একমাত্র জাতি নয় যারা আপন মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এবং বুকের রক্ত ঝরিয়েছে। কিন্তু এই রকম উন্নাসিক চিন্তা ও মিথ্যা বয়ানের প্রচুর নজির আমরা পাই আমাদের গল্প ও ইতিহাসের বইগুলোতে যা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে প্রকারন্তরে প্রশ্নবিদ্ধ করে, বাংলাভাষী সংগ্রামী জাতি হিসেবে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত লজ্জিত করে। বাংলার জন্য শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিরাই জীবন উৎসর্গ করেনি, করেছে আসামের জনগণও। এছাড়াও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন ইতিহাসের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলন বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দিয়েছেন সালাম, রফিক, সফিয়ুর, বরকত ও জব্বার। বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের রাজ্য আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন ভাষাশহীদ। দুঃখের বিষয় ইতিহাস তাঁদের তেমন মনে রাখেনি। আসাম রাজ্যর প্রধান ভাষা অহমীয়া হলে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, কাছাড় এবং শিলচর হলো বাঙালীদের ঘাঁটি। দেশবিভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালী (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় । কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালী থেকে যায় আসামে । ১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষনা করে দিলে ক্ষোভ দানা বাঁধে বাঙালীদের ভেতর । ক্রমশঃ তা রূপ নেয় আন্দোলনে। প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস । 

১৯৬১ সালের ১৯ মে । আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে এদিন শিলচরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করা হয়। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ করছিল তখন নিরাপত্তারক্ষায় নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দেয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আসাম রাইফেলস গুলবর্ষন করলে ঘটনাস্থনে প্রাণ হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী। আহত হন অর্ধশতাধিক। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষনা দেয়া হয়। সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন বীর শহীদ আত্মবলি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ, সতের বছরের তরুনী কমলা ভট্টাচার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুজন নারী মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন- একজন শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জন শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ, যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন। ১৯ মের ১১ জন ভাষাশহীদদের তালিকা- ১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য ২. শহীদ শচীন্দ্র পাল ৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর ৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী ৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর ৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব ৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস ৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস ৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ ১০. শহীদ সুনীল সরকার ১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ। আসামে ১৯ মে এখনও ভাষাদিবস পালন করা হয়।

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনে ১৯৫৫ সন থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন(১৯৫৫-১৯৯৬) শুরু হয় ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার’ ১৯৫৫ সালের দাবীর ভেতর দিয়েই, যেখানে তাদের দাবী ছিল আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভাষার অধিকারের দাবীতে ভাষা পরিষদের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাতটি দাবীর ভেতর ছিল : আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাষ্ট্রীয় বেতার কার্যক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচার, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, কেন্দ্র ও রাজ্য সভাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আসন সংরক্ষণ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কোটা সংরক্ষণ, ভাষিক সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর সংশোধন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবী দিবস পালন করে। ১৯৬১ সনের ২৫ জুলাই আসাম রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ১৯৬৩ সনের ২২ মার্চ শ্রী ডি এন বাজপেয়ি নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদের সাথে দেখা করেন। ভাষা পরিষদ ১৯৬৪ সালের ৭ জুলাই আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৪ সালেরই ২৮ জুলাই বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। ১৯৬৫ সালের ২৮ জুলাই ভাষা দাবী সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ স্টেট বোর্ড অব ইলিমেন্টারি এড্যুকেশন এর সেক্রেটারি শ্রী কে কে শর্মার সাথে সাক্ষৎ করেন এবং তাঁকে আসামে দ্রুত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই ‘দাবী সপ্তাহ’ ১২ দিন দীর্ঘায়িত করা হয় এবং কাছাড় জেলার সর্বত্র পাবলিক সভা সমাবেশ করা হয়, এইসব সভায় আদমশুমারী জালিয়াতির বিরুদ্ধে জোড়দার বক্তব্য রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ভাষা পরিষদ নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে জনপরিসংখ্যান উত্থাপন করেন এবং কাছাড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা দেখান ৬৬,৬২৩ জন। ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণশ্লোগানের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসেই পাবলিক সভা গুলো আরো ব্যাপক বিস্তৃত হয় এবং ১৯৬১ সনের উপনিবেশিক আদমশুমারী প্রতিবেদন পোড়ানো হয়। ১৯৬৮ সনেরই ২৫ জুলাই আসামের শিক্ষামন্ত্রী জে বি হেগজার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ভাবনা তুলে ধরেন। একই সনের ৩০ আগস্ট কাছাড়ের জনগণ আবারো আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবী দাওয়া সংবলিত মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর কাছাড়ের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ রক্ত দিয়ে রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে। এর পর পরই ভাষা আন্দোলন আরো চূড়ান্ত গণ রূপ নেয় এবং ব্যাপক ধর্মঘট, ধরপাকড়, বন্ধ কর্মসূচি চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর কাতিগড়া বন্ধ কর্মসূচি থেকে ৭ জন ভাষাবিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সনে পূর্ব পাকিস্থানে একদিকে যেমন চলতে থাকে গণঅভ্যুত্থান একই দিকে বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন বন্ধ-ধর্মঘট- ঘেরাও-গ্রেফতারের ভেতর দিয়ে জনরূপ নেয়। 

নরসিংহপুর, রাতাবাড়ি, শালচাপড়া বন্ধ(৫-২৯ অক্টোবর,১৯৬৯)। জাপিরবন্দ বন্ধ(৩০ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়, এখানেই প্রথম কোনো নারী ভাষাবিপ্লবীও গ্রেফতার হন। মেহেরপুর বন্ধ (৩১ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ৫ জন নারী আন্দোলনকারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পয়লা নভেম্বর’ ১৯৬৯ সালের পিকেটিং থেকে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়, ৩ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার হন ৩৮৫ জন, ১ থেকে ৫ নভেম্বরের ভেতর তিন জেলার ডিসি অফিসে পিকেটিং করে চেয়ার দখল করে নেয়া হয়, ৪ অ ৫ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার করা হয় ১১১ জনকে। রাষ্ট্রের ধরপাকড় ও নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর, ১৯৬৯ শিলচর শহরে বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন হয়। শিলচর, নরসিংহপুর, হাইলাকান্দি ও পাথারকান্দিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ফেলেন ভাষাবিপ্লবীরা, এই ঘটনায় সরকার ২৩৮ জনকে গ্রেফতার করে। ১৭ নভেম্বর ১৯৬৯ শিলচর বন্ধ থেকে ৩০০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়। হাইলাকান্দির ওএসএ মাঠে বিশাল সমাবেশ ডাকা হয় একই সনের ২১ নভেম্বর, হাইলাকান্দি বন্ধ থেকে সবচে’ ব্যাপক ধরপাকড়টি হয়, প্রায় ১৫০০ জন ভাষাবিদ্রোহীকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘ডিসি অব লিংগুস্টিক মাইনরিটিস ইন ইন্ডিয়া’ শিলচর আসেন এবং মহাসভার সাথে বৈঠক করেন।

১৯৭০ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন অন্য মোড় নেয়। ১৯৭০ সালের ১৯ থেকে ৩০ এপ্রিলের ভেতর কাছাড়, ত্রিপুরা ও শিলং-এ ২৪ ঘন্টার গণঅনশণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাবিদ্রোহীরা। ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর কাছাড়ের সর্বত্র ৪৮ ঘন্টার গণঅনশণ, ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ কাছাড়ের সর্বত্র ৭২ ঘন্টার গণঅনশণ পালন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের সর্বত্র ‘সংখ্যালঘু বাঁচাও দিবস’ পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন বাঙালির মাতৃভাষা দিবস, সেই তারিখে ১৯৭৯ সালে সমগ্র কাছাড়ে পালিত হয় অবস্থান ধর্মঘট। ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি আসামের শিল্প মন্ত্রণালয় ও ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের’ ভেতর একটি বৈঠক হয়। ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা’ এবং ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ যৌথভাবে অবিলম্বে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে স্বীকৃতির দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার কাছে মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৮৩ সালের ২৫ অক্টোবর আসামের রাজ্য সরকারের কেবিনেট মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করার। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কেবলই সিদ্ধান্তই থেকে যায় এর কোনো বাস্তবায়ন হয় না। ১৪ নভেম্বর ১৯৮৩ তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু বিষয়ক একটি নোটিফিকেশন হয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৩ তারিখে তা স্থগিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ ঠার ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রা ও দাবীসমূহ নিয়ে প্রকাশিত দলিল (খবঃ যরংঃড়ৎু ধহফ ভধপঃং ংঢ়বধশ ধনড়ঁঃ গধহরঢ়ঁৎরং) আকারে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেয় না। আবারো ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৫ সালের ২ জুলাই ‘ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ দাবীদিবস পালন করে। ১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় জাপিরবন্দ-সোনাপুরে জনসভা ও রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে ছাত্র ইউনিয়ন। 

আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিবাদ মিছিল করে ১৯৮৯ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নলিনী সিংহ, নির্মল সিংহ, কৃপাময় সিংহ, সুরচন্দ্র সিংহদের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা ১২ ঘন্টা ‘রেল রোকো কর্মসূচি’ পালন করে। ১৯৮৯ সালের পয়লা ডিসেম্বর বিধান সভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রিলে অনশন পালিত হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ জুলাই তারিখে সরকার আবারো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালুর জন্য আরো একটি নোটিফিকেশন করে এবং ৬ আগস্ট ১৯৮৯ তারিখে তা স্থগিত করে। ১৯৯০ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চলে এল.পি স্কুলের ক্লাস বয়কট করা হয়।

শীতের এই সময় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে। বাসু উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে মনে হলে মনিপুরে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এমনই এক বৃষ্টিতে ভিজেছিলো তারা, যদিও তখন ঘোর বর্ষা। তবু আজ যদি সুস্মিতা পাশে থাকতো, কবিতা আওড়াত্‌ নয়ত গান। কি কবিতা বলতো কিংবা কি গান? ভাবতে ভাবতেই বাসু আবার পড়ায় মন দেয়।

১৯৯১ সালের সালের ২৬ জানুয়ারি রাজকুমার অনিলকৃষ্ণ মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং সুরচন্দ্র সিংহ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদের নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালের ৬,১০,১৯ আগস্ট শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ জেলার ডিআই অফিসে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। লড়াকু ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে ১৯৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১৫ দিনের ভেতর বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা চালু করার দাবী জানিয়ে চরমপত্র দেয়। ঐদিন শিলচর গান্ধিবাগ ময়দানে প্রায় দশহাজার মানুষের এক বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে এই চরমপত্র দেয়া হয়। কিন্তু ঐ চরমপত্রকে কোনো গুরুত্ব না দেয়ায় ভাষা-আন্দোলন আরো দ্রোহী হয়ে উঠে এবং ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রবিশংকর সিংহ ও কুলচন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বরাক উপত্যকার বারমুনি, কাটাখাল, কালানি, পাথাবরকান্দিতে ২৪ ঘন্টার জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। 

১৯৯২ সালের পয়লা নভেম্বর আন্দোলনকারীরা জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে। ১৯৯২ সালের ১৬ নভেম্বর ৩৬ ঘন্টার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি আহ্বান করা হয়। ১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া দিসপুরে এক বৈঠক আহ্বান করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী স্তরে এটিই ছিল কোনো প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। রাষ্ট্রীয় বৈঠকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আন্দোলনকারীরা পুনরায় ১৯৯৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ৪৮ ঘন্টার সড়ক অবরোধ শুরু হয়। আসামে বিধানসভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ ৩৬ ঘন্টার গণঅনশণ কর্মষূচি পালিত হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১০১ ঘন্টার রেল রোকো কর্মসূচি আরম্ভ হয় ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল হতে বুরুঙ্গা, কাটাখাল, পাথারকান্দি এলাকায়। এই কর্মসূচির ফলে বরাক উপত্যকায় রেল চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। এই রেল রোকো কর্মসূচির ফলে অনেক সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির তিন জেলার ডিআই এবং ডিইইও অফিসে ১২ ঘন্টা পিকেটিং করা হয় এবং এর ফলে শিক্ষা বিভাগের অফিস পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বরও বরাক উপত্যকার অনেক সড়কে ৭২ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ২৬ মে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল গুলোতে(মূলত: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত এলাকায়) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করে। কিন্তু আন্দোলনের কেন্দ্রীয় এলাকা আসাম রাজ্যে এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকার তখনও গড়িমসি ভাবই বজায় রেখেছিল।

আসামের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৬ মার্চ একটি রক্তক্ষয়ী দিন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভাষাবিপ্লবীরা বরাক উপত্যকায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভাষা আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে আন্দোলনকারীদের উপর। এই ঘটনায় অনেক ভাষা বিদ্রোহী আহত হন এবং ব্যাপক ধড়পাকড় হয় এবং মাতৃভাষার অধিকার চাইতে গিয়ে রাষ্ট্রের নৃশংস বন্দুকের গুলিতে জান দেন বিলবাড়ি গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিপ্লবী সুদেষ্ণা সিংহ। বরাক উপত্যকাতেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ শহীদ হোন বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ও প্রথম আদিবাসী নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ। ঐদিন পুলিশের গুলিতে আহত হোন সহস্রাধিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাযোদ্ধা এবং পরে হাসপাতালে প্রাণ হারান আরো একজন শহীদ সলিল সিংহ। 

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসকে আর উপক্ষা করতে পারে না আসাম রাজ্য সরকার। আসাম রাজ্যের ইলিমেন্টারি এডুকেশন এর ডেপুটি ডিরেক্টর ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত গ্রামের ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার প্রথম পাঠ্য পুস্তক ‘কনাক পাঠ’ তৃতীয় শ্রেণীতে চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ৮ মার্চ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ শব্দটি লেখার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মৈতৈ মণিপুরী এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিতর্কের একধরনের স্থিতি ঘটে। ভাষা বিদ্রোহীদের দাবী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এলাকার জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে সকল এলাকাতেই চালু করার। তাছাড়া এখনও স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষকেরা পড়ানোর দায়িত্ব পাচ্ছেন না। শহীদ সুদেষ্ণার স্মরণে ভারত ও বাংলাদেশের মণিপুরীরা ১৬ মার্চ ভাষাদিবস পালন করে থাকে।

বাসু সুস্মিতার ছবির সামনে দাঁড়ায়। তারপর চশমাটা মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে 'তুমি কি কেবলই ছবি' ...উত্তর শুনতে পায় বাসু 'না গো আমি তোমাতেই বাস করি তোমার হয়েই' -শিঞ্চন কে ডাকতে ইচ্ছে করছিলো বাসুর, বলতে ইচ্ছে করছিল - এই শোন ডাক্তার, সুস্মিতা কথা বলছে। পাশের গির্জা থেকে দুটো ঘন্টার আওয়াজ ভেসে এলো। বাসু আরেক দফা কফি এনে পাতা ওলটালো-

১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের ধারে পিষ্ট সেই কালো মানুষগুলো তাদের ভাষা সংগ্রামে কি দিয়েছিল আর কি পেয়েছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল এবং ভঙ্গ করেছিল ১৪৪ ধারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। যার ফলাফল ছিল ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং সালাম, রফিক, বরকতের মতো ভাষাসৈনিকের শাহাদাত বরণ। অনেকটা তেমনভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকার সয়েটো হাইস্কুলের কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছিল। ১৯৭৬ সালে সরকার আফ্রিকান ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে স্ট্যান্ডার ও ফাইভ থেকে সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য। সে সময় বলা হয় ওই শ্রেণীর অংক ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে আফ্রিকান ভাষা এবং ইংরেজি ব্যবহৃত হবে সাধারণ বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে। তখন সরকারের এ সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করে আফ্রিকান অভিভাবক, স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সাংবাদিকরা পর্যন্ত। সবাই এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিল এবং অনেক শিক্ষক আফ্রিকান ভাষায় শিক্ষকতা করতে পারবেন না বলে চাকরি ছেড়ে দেন। অবস্থার অবনতি ঘটে ওই বছরেরই মাঝামাঝি সময়ে। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ যখন ছেলেমেয়েরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল এ ব্যবস্থায় লেখাপড়া করতে। সে সময় দি ওয়ার্ল্ড নিউজ নামক সংবাদপত্রে একটি ছাত্রের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছিল ‘আমাদের অভিভাবকরা প্রস্তুত আছেন শ্বেতাঙ্গদের এ অত্যাচার সহ্য করতে। তারা তাদের জীবনের অনেকটা সময়ই পার করে এসেছেন এ আইনকে মেনে নিয়ে এবং তারা আর এখন এ শাসকগোষ্ঠীর কোন কিছুতেই ভীত নন। আমরা দৃঢ়ভাবে এই রায় প্রত্যাখ্যান করে বলছি যে এ শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা মেনে নেব না। এটির উদ্দেশ্যই হবে আমাদের নিজ জন্মভূমিতে ক্রীতদাস হিসেবে তৈরি করার।’ এছাড়াও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিটি বাচ্চার পড়াশোনার পাঠ্যবই, স্টেশনারি এবং স্কুলের ভবন তৈরি বাবদ তাদের মায়েদের বাৎসরিক বেতনের অর্ধেকটাই কেটে রাখা হতো, সেখানে শেতাঙ্গ বাচ্চাদের জন্য কোনও খরচই ছিল না। ওই বছরেরই ১৩ জুন তিশীতিশ মাসিনিনি নামক ১৯ বছরের এক যুবক একটি মিটিংয়ের আহ্বান করেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। সেখানে তিনি এ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সকলকে একসঙ্গে আন্দোলন করার আহ্বান জানান এবং তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, তাদের পরিবারকে এ পরিকল্পনার কথা জানাবে না। অতঃপর ১৬ জুন, সওটনের স্কুলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কুয়াশাকে উপেক্ষা করে সবাই উপস্থিত হলেন পূর্ব নির্ধারিত সময়ে। তারা সিদ্ধান্ত নেন ভিলাকাজি স্ট্রিটের অরল্যান্ডো ওয়েস্ট সেকেন্ডারি স্কুল থেকে তারা অরল্যান্ডো স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করবেন। সেসময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, সেদিন প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজারের মতো স্কুলের পোশাক পরা ছাত্রছাত্রী ছিল। এ অবস্থা দেখামাত্র সেখানে পাঠানো হল একটি পুলিশ স্কোয়াড। তারা প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের বাধা দেয়। তারা তা না শুনলে পুলিশ কিছু কুকুর ছেড়ে দেয় এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্রছাত্রীরাও তার জবাব দেয় পুলিশের দিকে পাথর ও বোতল ছুঁড়ে। 

পরবর্তী সময়ে একজন সাংবাদিকের করা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সে দেখেছে একজন পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মাঝে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আর একজনও শুরু করল যার ফলাফল ২৩টি শিশুর মৃত্যু এবং ২০০-এরও বেশি আহত। বারো বছর বয়সী হেকটো পিটারসন গোলমালের মধ্যে মারাত্মক আহত হয়ে পড়ে আছে রাস্তায় আর তার পাশে কাঁদছে তার ছোটবোন। রাস্তার অপর পাশ থেকে ছুটে এসে পিটারসনেরই আর এক সহপাঠী তুলে নিয়ে গেল তাকে। আর এ দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দি করেছিল দি ওয়ার্ল্ডের ফটোগ্রাফার সাম নজিমা। পিটারসনের শেষ সময়কার সে ছবিগুলো ঘুরে বেড়িয়েছিল সারাবিশ্ব আর প্রতীক হয়েছিল জাতিগত বৈষম্যের নিষ্ঠুরতার। দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়লে সয়েটো এর বাইরের শহর যেমন উইটওয়াটারেসরানও প্রিটোরিয়া, ডারবান এবং কেপটাউনসহ বিভিন্ন জায়গায় এবং এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিল। যার ফলাফল বছর শেষে মৃত্যু প্রায় ৫৭৫ জনের এবং আহত প্রায় ৩ হাজার ৯০৭ জন। সে সময় সয়েটো এর ওই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ ছিল। এর পর থেকেই তাঁরা তাদের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে থাকেন বিভিন্ন সময়ে। যার ফলাফল আসে ১৯৯৪-এ তাঁদের স্বাধীনতা দিয়ে। ওই আন্দোলনের পর যে সুবিধাটি তাঁরা সবার আগে পান তাহল ছাত্রছাত্রীরা কোন মাধ্যমে পড়াশোনা করবে তা তাঁরা নিজেরাই পছন্দ করতে পারবেন। এছাড়া টিচারদের বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দিয়ে তাঁদের দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থাও নেয়া হয়। ওই ঘটনার পর সয়েটোতে আরও অনেক স্কুল তৈরি করা হয় নতুন করে এবং অনেক শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে পরিবর্তনটি আসে তাহল বহু পুরনো সেই আইনকে বাতিল করে কৃষ্ণাঙ্গদের শহরে আসা ও বসবাসসহ ব্যবসা করার স্থায়ী অনুমতি দেয়া হয়। যা আগে শুধু শেতাঙ্গরা পেত। এমনকি ডাক্তার, আইনজীবী ও অন্য পেশার মানুষ শহরে এসে ওই পেশা ধরে রাখতে পারবেন। সয়েটো আন্দোলনের ৩০ বছর পর ১৬ জুন ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থারো এমবেকি প্রতিষ্ঠা করেন হেক্টোর পিটারসেন মেমোরিয়াল এবং মিউজিয়াম। যার প্রবেশের মুখেই রাখা আছে সাম নজিমা এর সেই বিখ্যাত ছবিটি যার ক্যাপশনে লেখা আছে, ‘সেই যুবদের স্মরণে যারা প্রাণ দিয়েছিল মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে।’

বইটা পড়া যখন শেষ হলো তখন বাসুর মনে হলো বিনিদ্র কালের ভেলা হারাতে দেইনি, ভাষা কবিয়াল ধরেছে পাঁচালী, সুনীল সংসারে পেতে বসেছি মহাশূন্য অকালের, তুমি ক্যাডবেরী ঠোঁটে করে নিয়ে ফিরে এলে ভোরের আলোয়, ...বাজে সঙ্গীত ...বাজে ফেরারী ভাষার পান্ডুলিপি, একুশে ফেব্রুয়ারি...





তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরে, মহাম্মদ শাফী, গবেষক পাভেল পার্থ, শিলচর ও ভাষা, আসামের ভাষা শহীদ, ভাষা জাদুঘরের স্মারকগ্রন্থ
0

বিশেষ রচনা: শৌনক দত্ত

Posted in


বিশেষ রচনা



সুস্মিতার বইমেলা সুস্মিতার তিনি...
শৌনক দত্ত

সময়ের কলিংবেলে জানুয়ারী বাজচ্ছে।জানুয়ারী মানেই ঘর ময় নতুন বইয়ের গন্ধ আর রোজ বইমেলায় বইয়ের সন্ধান জানুয়ারী শেষ তো চলো বাংলাদেশ একুশে বইমেলায়।এবার সেই পরিকল্পনা নেই। বড়দিন চলে গেলো টাকা পয়সা বইয়ের ক্যাটালগ নিয়ে সুস্মিতা বসেনি। অফিস ক্লান্ত বাসু কোনদিন লিখতে পারেনি যদি পারতো, তবে এক জীবন সুস্মিতা লিখতো। গোমট অনেকটা কেটে গেলেও ফাঁকা, নির্জনা একাকীত্ব এখনো কাটেনি। বাসু ফ্রেশ হয়ে দুই মগ কফি নিয়ে ছবির সামনে বসে সুস্মিতা তাকে বলেছিলো, কলকাতার বইমেলা ১৯৭৬এর ৫ইমার্চ শুরু হলেও বাংলাদেশের এখন যেটা অমর একুশে গ্রন্থ মেলা সেটা আরো বছর খানেক প্রাচীন। সেটা ১৯৭২সনের ৮ই ফেব্রুয়ারী।

মাসখানেক ধরে বাসু সুস্মিতার ছবির সাথে কথা বলে, সুস্মিতা তার উত্তর দেয়, কতকথা বলে বন্ধু ডাঃ শিঞ্চন এটাকে ইলিউশান বলছে কিছু ওষুধ ও দিয়েছে। বাসু এটা ইলিউশান মানতেই চায় না। তবু রুটিন চেক আপ এবং ওষুধ চলছে বাসুর।বুক সেলফ থেকে সুস্মিতার পরশ মাখা মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে' বইটা বুকে জড়িয়ে বসতেই সুস্মিতা এলো।
-ন হন্যতে পড়বে বুঝি?
-হ্যাঁ।
-তোমার মির্চা ইলিয়াড পড়া হয়নি। ২০০৮এ উনার জন্মশর্তবর্ষে তোমাকে যে তার কথা বলেছিলাম তোমার মনে আছে বাসু?
বাসু মনে করতে চেষ্টা করে। চলমান সময় অতীত নদীর সভ্যতার মতো জেগে ওঠে।

-কি মনে করতে পারলে না তো?

আজ থেকে ছয়বছর আগের ধুলোময় বইমেলার ধুলো সরিয়ে কফি মগে চুমুক দেয়। মনে পড়ে যায় ২০০৮ ছিলো দিকপাল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু ও মির্চা ইলিয়াডের জন্মশতবর্ষ। কলকাতার পত্রপত্রিকা বাকী দুজনকে যতটা আলোকিত করেছিলো ঠিক ততটাই উপেক্ষার আঁধারে এড়িয়ে গেছে। সুস্মিতা হেসে ওঠে যেন। এতটা বাসু মনে রাখবে তা যেন ভাবতেই পারেনি সুস্মিতা।

ক্যালেন্ডারের পাতায় খসে পড়বে আরেকটি সময়কে লালন করে। বাসু কফি শেষ জানালা গলে ঢুকে পড়া নিয়ন আলো আবছায়ায় তাকে ভাবায়; ঐসময়টায় কি অস্থির সুস্মিতা বারবার বলতো, দ্যাখো বাসু মির্চার জীবন ও কীর্তির কোনও মূল্যায়ন কোথাও নেই অথচ এই শহরের সঙ্গে তার বিশেষ ধরনের একটা সম্পর্ক ছিলো। সেই সম্পর্ক শুধু এই বিদগ্ধ মানুষটির ব্যক্তিত্ব ও বৌদ্ধিক বিকাশেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, সাহিত্যের ইতিহাসেও একটা ছাপ রেখে দিয়েছে।

বিশ শতকের যে সমস্ত শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী তাদের স্বকালের এবং পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তা ও অনুভবের পথরেখা নির্মান করেছেন, ইলিয়াড তাঁদের অন্যতম একজন। ভারতীয় দর্শনে তার মতো আত্যন্তিক অনুপ্রাণিত পাশ্চত্য মনীষা সম্ভবত আর মাত্র একজনই ছিলেন। মেক্সিকান কবি ও নিবন্ধকার অক্টাভিও পাজ।


ঠান্ডা হয়ে আসা কফিমগে বন্ধু ডাক্তার শিঞ্চন ভাগ বসালো। সুস্মিতার মগটায় শিঞ্চন চুমুক দিক বাসু মনে মনে চাইছিলো না। শিঞ্চন হয়ত বুঝেছিলো, উঠে গিয়ে অন্য মগে কফিটা ঢেলে এসে বসলো।
তা আজ কি কথা বলছিস তোরা?
বাসু তোরা শুনে খুশি হয়ে বললো, মির্চা ইলিয়াড।
মির্চা মানে সেই মৈত্রেয়ী দেবীর প্রেমিক?
বাসু জানে আজ রুটিন চেক আপের ডেট, তাই শিঞ্চন এসেছে।
মির্চা নিয়ে তুমি কি কি পড়েছো?
তুই তো জানিস সুস্মিতা পড়তো, তারপর আমায় গল্পের ছলে বলতো।
তারমানে মির্চা ইলিয়াড নিয়ে তোর পড়া নেই কোন কিছু?
ঠিক তা না। ২০০৮এ ওনার শতবর্ষে সুস্মিতা আমাকে মির্চার লেখা পড়িয়েছে, শুনিয়েছে।
কলকাতায় মির্চা কেন এসেছিলেন?
বাসু মুচকি হাসে তারপর একটু থেমে গম্ভীর স্বরে বলে, শিঞ্চন বিশ্বাস কর ইলিউশান নয় সুস্মিতা আমার কাছে আসে এখনো তোর পাশেই বসে আছে সুস্মিতা। শিঞ্চন পাশে রাখা ছবিটা দেখে একপলক। তারপর এক গহীন নীরবতা। নীরবতা টুকরো টুকরো করে বাসু বলে ওঠে, কলকাতায় মির্চা ইলিয়াড তার দেশ রোমানিয়া থেকে ১৯২৮সালে এই শহরে পা রাখলেন সংস্কৃত শিখবেন বলে। পুরোদস্তুর গুরুশিষ্যের পরম্পরা মেনে তিনি তালিম নিতে মনস্থ করলেন প্রখ্যাত পন্ডিত অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে।


শিঞ্চন ফিরে গেছে অনেকক্ষণ। খাবার গরম করে খেতে বসেছে বাসু। তখনি সুস্মিতার আর্বিভাব, কি বাসুবাবু তারপর আর বলতে পারলেন না। আরে বুদ্ধু তারপরের গল্পটা ভুলে গেলে? বাসু মাথাটা দুই তিন বার সামনের দিকে ঝুঁকালো। সুস্মিতা একঝাঁক পাখির উড়ে যাবার মতো হাসলো আর বলতে লাগলো সেই গুরু সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের বাড়িতেই মির্চা থাকতে লাগলেন পেয়িং গেস্ট হয়ে।অনেকটা ঠিক সেই হাম দিল দে চুকে সনম সিনেমার সলমনখান আর ঐশ্বর্যরাই। যাক তেইশ বছর বয়সি এই ছাত্রটি অচিরে অধ্যাপক দাশগুপ্তের ষোড়শী কন্যা ঐশ্বর্য মানে মৈত্রেয়ীর প্রেমে পড়লেন। গুরু যখন টের পেলেন তার এই ইউরোপীয় শিষ্যটির কীর্তি তাকে বাড়ী ছাড়ার আদেশ দিলেন।মির্চা চিরতরে কলকাতা ছেড়ে গেলেন। প্রথমে আশ্রয় নিলেন হিমালয়ে গিয়ে।গবেষণা শুরু করলেন তার যোগ বিষয়ক প্রথম বইটির জন্যে। পরে দেশে ফিরে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তার গভীর সংরাগের বর্ণনা দিয়ে ১৯৩৩সালে একটা উপন্যাস প্রকাশ করলেন রোমানিয়ান ভাষায়। বইটার আদলে উপন্যাসের আবরণ কিন্তু পরিষ্কার তা প্রায় আত্মজীবনী। এমনকী তিনি মৈত্রেয়ী নামটাও পর্যন্ত রেখে দিলেন এবং বইটির শিরোনাম হল ওই নামে।
তীক্ষ্ণধী এই বিদ্বান মানুষটির সাথে কলকাতার আক্ষরিক অর্থেই তিক্তমধুর সম্পর্ক।

মৈত্রেয়ী বইতে মির্চা দাবি করলেন, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তার শুধু রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল না, দৈহিক সম্পর্কও ছিল। কোলকাতার অগোচরে রোমানিয়াতে বইটি বেস্ট সেলার হল এবং কথাসাহিত্যিক হিসেবে মির্চা ইলিয়াডের খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত হল।
-সুস্মিতা তবে কি খ্যাতির জন্য মির্চা প্রেম কে খাটো করলো? এটা তো প্রতারণা প্রেমকে পন্য করে বড় হয়ে ওঠা সেটা তো প্রেম নয়?
তা হয়ত নয় কিংবা এই প্রেম লিখেছিলেন বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসে তিনি প্রকাশ করলেন বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে তার 'পবিত্রতার তত্ত্ব'। মহতী এই সার্বজনীন তত্ত্ব তাঁকে এক দিব্যদর্শী মনীষায় বিভাসিত করল। অনেকটা ধরো রাধা ছেড়ে আসা কৃষ্ণের বিরহ। কিংবা চৈতন্যের রাধা ভাব। তাই প্রেম কে খাটো করেছেন বলা ঠিক হবে না হয়ত। তারপরের ঘটনা তো আরো রোমহর্ষক। ইলিয়াড যখন১৯৫৭সনে চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন তার ও বছর দুই তিন পর তার উপন্যাসের নায়িকা মৈত্রেয়ী দেবী জানতে পারলেন যে মির্চা তাদের প্রনয়সখ্য নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন।ইটালিয়ান, জার্মান, ফরাসি এবং স্প্যানিস ভাষায় সে বইয়ের তর্জমা বেরিয়েছে, কিন্তু ইংরেজী অনুবাদ তখনও হয়নি।

গিন কামানি তার 'অন্তর্ভেদী চোটঃ মৈত্রেয়ী দেবীর বইয়ের অকথিত নেপথ্যকথা'(A Terrible Hurt:The Untold Story behind the publishing of Maitreyi Devi)নিবন্ধে যা লিখেছিলেন তা আরো বেশি অবাক করা রহস্য'...১৯৭২সাল পর্যন্ত কিছু হয়নি। এই সময় ইলিয়াডের একজন ঘনিষ্ঠ রোমানিয়ান বন্ধু সেরগুই আল জর্ঘ কলকাতায় এলেন। তার কাছে উক্ত দেবী অবশেষে জানতে পারলেন যে ইলিয়াড তার বইতে তাদের যৌন সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন। পরে তার এক বন্ধু উপন্যাসটা ফরাসি থেকে অনুবাদ করে দিলেন এবং তা পড়ে তিনি আঁতকে উঠলেন।''

জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতার শেষ কয়েক পংক্তির মতো ১৯৭৩এ মৈত্রেয়ী দেবী রবীন্দ্রনাথের উপর বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হলেন শিকাগোতে। মৈত্রেয়ী দেবী গেলেন নদীর সব লেনদেন শেষ করে মির্চার মুখোমুখি বসতে। কলকাতা ছাড়ার চল্লিশ বছর পর দুটি বিচ্ছিন্ন প্রেমিক চিকাগোর নদী পাশে দেখা করলেন। তখন কি কোথাও বাজচ্ছিলো 'আবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়' তা আমাদের জানা হয়না তবে মির্চা কথা দিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর জীবদ্দশায় বইটির কোনও ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হবে না।
-বাসু, এটা কি প্রেম নয়? এটা কি প্রেম ও প্রেমিকার প্রতি শ্রদ্ধা নয়। এটা কি বৃন্দাবনের ধুলো আঁকড়ে বাঁচা নয়?

ভাব যেখানে গভীর ভাষা সেখানে মূক। চিকাগো থেকে ফিরেই মৈত্রেয়ী দেবী 'মৈত্রেয়ী'উপন্যাসের জবাবে নিজে ১৯৭৪সনে লিখে ফেললেন তার নিজের দিকের গল্পটা, যে বইটি 'ন হন্যতে' এই উপন্যাসে তিনি তার গল্পটা বললেন ভারতীয় পাঠকের কাছে মৈত্রেয়ী পড়ার সুযোগ আসার আগেই।

মৈত্রেয়ী নিয়ে ফরাসী তরুন চিত্রপরিচালক নিকোলাস ক্লোত্‍স বাংলার রাত(Bengal Night)চলচ্চিত্র তৈরী করেন অনেক বির্তক মামলা মোকদ্দমার মাঝে গিনু কামানির লেখা থেকে জানা যায় ভারতবর্ষে একবারই এই চলচ্চিত্রটি দেখানো হয়েছিলো ১৯৮৯সনে ভারতীয় চলচ্চিত্র উত্‍সবে। ১৯৯০সালে মৈত্রেয়ী দেবী মারা যাওয়ার চার বছর পরে একটি আমেরিকান সংস্করণে শেষ পর্যন্ত মৈত্রেয়ীর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সহযোগী খন্ড হিসেবে থাকল মৈত্রেয়ীদেবীর জবাবী উপন্যাসটিও। মৈত্রেয়ীর কোন ভারতীয় সংস্করণ কখনো হয়নি।

যতদূর শোনা যায় মির্চা আর কখনো ভারতের মাটিতে পা রাখেননি। যদিও তার আত্মজীবনীতে তিনি ভারতবর্ষ এবং ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে গভীর অনুরাগ ব্যক্ত করেছেন, স্পষ্ট বোঝা যায় মানসিকভাবে পরে আর তিনি তার যৌবন অভিযাত্রার দিনগুলোর মুখোমুখি হতে পারেননি। কলকাতার সঙ্গে এইটুকুই তার সম্পর্ক। এইটুকুই সম্ভবত দেবীর মতোই তার মনেও গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। অবশ্য স্রেফ কলকাতা দেখতে আসা, তার মতো উচ্ছল তরুন একজন ইউরোপীয়ের চেয়ে ভারতীয় নারী হিসেবে মৈত্রেয়ী দেবীর ব্যাপারটা অনেক বেশি মর্মস্পর্শী।

এত কিছুর পর মির্চা কে মনে রাখা কেন?
জানালা গলে ঢুকে আসা মৃদ্যু ঠান্ডা বাতাসে যেন বাসুর চুলে সুস্মিতা বিলি কেটে দিলো।
দেখো বাসু প্রেম কার বেশি? অবশ্যই মির্চার!
কেন?
মৈত্রেয়ী দেবী মরমে জ্বলেননি। মির্চার মরমে মরমে দহন অনেকটাই আমাদের প্রচলিত রাধা বিরহী কৃষ্ণ নয় -ধারনার মতো অথচ রাধার চেয়ে শতগুণ বিরহী কৃষ্ণ, সে কথা তোমায় পরে একদিন শোনাবো।

মির্চা কে যেসব সৃষ্টির জন্য কলকাতা কিংবা ভারতবর্ষ শতবর্ষে উপেক্ষিত না রেখে আলোকিত করতে পারতো তার মাঝে 'মহাবিশ্ব এবং ইতিহাসঃ শাশ্বত প্রত্যাবর্তনের কথকতা'(Cosmos and History:The Myth of Etemal Return,1954)'পবিত্র ও পার্থিবঃ ধর্মের প্রকৃতি'(The Sacred and the profane:The Nature of Religion,1959)এবং কল্পকথা ও বাস্তবতা,(১৯৬৩)। মির্চা ইলিয়াডের আর ও ডজনখানেক অন্যান্য উপন্যাস ও গল্প সংগ্রহ আছে। শ্রীরামপুরের রাত, বুড়োটা এবং আমলাটি ছাড়াও তিনি তার ভারতের দিনলিপিও প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলে রাখা যায় যে, তাতে তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সাক্ষাত্‍কারের বর্ণনা দিয়েছেন।

এ ছাড়া তার আরও অনেক দিনলিপি ও স্মৃতিকথা আছে। ভারতবর্ষ তার কাছে অনেকখানি। একই সঙ্গে এখানে ফিরতেও আবার ভয় পেয়েছেন তিনি। তার জন্মশতবর্ষে স্পষ্টবক্তা আবেগপ্রবণ এই মানুষটিকে ভারতের স্মরণ করা উচিত ছিলো।

এল্যার্মের শব্দে বাসুর ঘুমটা ভেঙে যায় কোথাও সুস্মিতা নেই, পর্দা গলা আলোয় সুস্মিতার ছবির পাশে মির্চা ইলিয়াডের লা নুই বেঙ্গলী আর তার বুকের উপর মৈত্রেয়ীদেবীর ন হন্যতে ।



1

বিশেষ রচনা : শৌনক দত্ত

Posted in




বিশেষ রচনা


নিঃসঙ্গ সৃষ্টিতে...
শৌনক দত্ত

সুস্মিতার সাথে অভিমানের পর্ব যখন চরম, বাসু তখন ছাদে। পঞ্চমীর চাঁদ তখন আধখাওয়া রুটির মত একা। বাসু তখন কবিতা বলতে থাকে নিঃসঙ্গ আকাশের দিকে চেয়ে। বাসু জানে সুস্মিতা এখনই জীবনানন্দ শুনে উঠে আসবে অভিমান ভেঙ্গে পড়বে জীবনানন্দীয় বোধে আর নিঃসঙ্গতায়। সুস্মিতাও নিজের পছন্দের কবিতা জুড়ে দেবে।

বেশ কিছু কবিতা আওড়ানোর পর ও যখন সুস্মিতা এলো না, বাসু অবাকই হলো। অনিচ্ছায় নেমে এলো। ঘরের কোথাও সুস্মিতা নেই, বিছানায় পড়ে আছে কমলকুমার মজুমদার আর জীবনানন্দ দাশের পাশে নির্জনতা। বাসু এ ঘর সে ঘর দেখে আর অবাক হয় সুস্মিতা কোত্থাও নেই। গন্ধ খোঁজে বাসু।জীবাননন্দের বইটি তুলে নিতেই তার মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের অন্তত বারো কিংবা চৌদ্দোটি উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্ভবত আরো চারটি লুক্কায়িত আছে তার পান্ডুলিপির জীর্ণ স্তুপে। ছোটগল্প প্রায় একশ কুড়িটি।রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের সংখ্যা বারটি এবং ছোটগল্প একশোর কমই হবে।রবীন্দ্রনাথ সবই দেখে গেছেন মুদ্রিত অবস্থায়। জীবনানন্দের মত একজন আপাদমস্তক কবি কোন রকম পাঠক প্রত্যাশা না করেও কেন একটিও গদ্য কাহিনী প্রকাশ করতে চাননি, সে রহস্য আর বোধহয় উদঘাটিত হবার নয়।বাসু সুস্মিতা কে ডাকতে থাকে..

সুস্মিতার মত হাস্যোজ্জ্বল একটি ব্যক্তিত্ব মনের কোথাও কোনো গহীনে কি একা ছিলো? আজ এ প্রশ্ন জেগে ওঠে কমলকুমার মজুমদারের বইটি তুলে নিতেই। সুস্মিতার খুব প্রিয় দুটি বই বড় পছন্দের দুজন স্রষ্টা, অথচ দুজনেই বড় বিচিত্র। কমলকুমার মজুমদার উপন্যাস লিখেছেন আটটি এবং কিছু গল্প। উপন্যাসগুলি এবং প্রায় সব গল্পই প্রকাশিত হয়েছে এক্ষণ, কৃত্তিবাসের মতন পত্রিকায়। কমলকুমার জীবনানন্দের মতন নিঃসঙ্গতা বিলাসী ছিলেন না। সুস্মিতা কমলকুমার মজুমদার নিয়ে কিসব যেন লিখেছিলো। বাসু সুস্মিতার ডাইরী হাতড়ে বেড়ায় সেলফে, টেবিলে, ড্রয়ারে কোথাও নেই তখনই চোখে পড়ে ডাইরীটা পড়ে আছে বাসী দৈনিক পত্রিকার পাশে ধুলোময়। সযত্নে বাসু ডাইরীটা বুকে চেপে ধরে রাখে অনেকক্ষণ তারপর পাতা উল্টেপাল্টে পড়তে থাকে সুস্মিতার লেখা-

কমলকুমার মজুমদার[১৯১৪-১৯৭৯]বাংলা সাহিত্যে বিতর্কে কন্টকাকীর্ণ, নির্মাণে নিঃসঙ্গ এক নাম। স্বতন্ত্র শিল্পরীতি আর বর্ণাঢ্য যাপিতজীবন মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার চেয়ে আলাদা, মহামহিম। জীবদ্দশায়ই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ। আড্ডায়, পান্ডিত্যে, রসিকতায়, পরনিন্দা, পরচর্চায় ও নতুন নতুন কাহিনী সৃষ্টিতে তিনি নিজেই কাহিনী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন।

লেখাটা পড়তে পড়তেই বাসু উঠে দাঁড়ায় রান্না ঘরে উঁকি দেয়। সুস্মিতা নেই।দুই মগ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে ফিরে আসে। কফির গন্ধ ছাপিয়ে সুস্মিতার গন্ধ নাকে লাগে বাসু তার লেখা সুস্মিতার খুব প্রিয় দুটি লাইন আনমনেই বলে ওঠে 'তোমাকে খোঁজার বেদনায় দেখো ফুটে আছে বয়স, আমার খুব গভীর মৌন রাতে তোমায় মনে পড়ে, সব মনে পড়ে তোমার রোদগন্ধ নাকে এসে লাগে!' একটা দীর্ঘশ্বাস কফি মগে রেখে অন্য একটি মগে ঠোঁট রাখে বাসু আর চোখে ভেসে উঠে সুস্মিতার ছায়া অক্ষর।

কমলকুমার অল্প সংখ্যক পাঠক পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, পরনিন্দা, পরচর্চা ও অপরের চরিত্রহরণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শৈল্পিকতায় আর সাহিত্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক পর্যায়ে যা আমাদের বোধ, অনুভূতি ও পরিপার্শ্বের সব রঙ, রেখা ও উচ্চতাকে ধারণ করে হয়ে উঠেছে এক ভিন্ন উচ্চতর সৃষ্টি।হয়তো তিনি সচেতন ছিলেন, তার রচনারীতি বৃহত্তর পাঠক সমাজের জন্য নয়। সেই জন্যই হয়ত তিনি একটার পর একটা উপন্যাস ছোট পত্রিকায় লিখে গেলেও রচনাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল না, যতদূর জানা যায় তার একটি মাত্র উপন্যাস 'অন্তর্জলী যাত্রা' এবং একটি গল্প সংকলন 'নিম অন্নপূর্ণা' প্রকাশিত হয়েছিল তার জীবিতকালে।

খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় লেখেননি কমলকুমার, অর্থের জন্য তো নয়ই। যতদূর জানা যায় এক্ষণ পত্রিকায় সন্মানী দেবার রেওয়াজ ছিল না, কমলকুমার কিছু পেয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি, তবে কৃত্তিবাস থেকে তিনি যে একটিবার চেয়ে তিরিশ টাকার নিয়েছিলেন, তা জানা যায়, আর জানা যায় যে গুটিকয়েক বিদ্যার্থী কে তিনি ফরাসী ভাষা শিক্ষা দিতেন, তাদের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা নিতেন মাসিক একটি টাকা। কফি শেষ হয়। দীর্ঘশ্বাস মাখা মগের কফি তখনো ঝিমুচ্ছে। সুস্মিতা আসেনি। বাসু নিজের সাথে কমলকুমার কিংবা জীবনানন্দ কে মেলাতে মনের শ্লেটে অংক কষে তার ও তো কোন খ্যাতি নেই। অর্থের জন্য সেও তো লেখেনা। তবে সে কে জীবনানন্দ নাকি কমলকুমার? সুস্মিতাই বা কে লাবণ্য নাকি দয়াময়ী? দ্বান্দিকতার বুদবুদ বাড়তে থাকে সুস্মিতাকে তার দয়াময়ী মনে হয়। কমলকুমারের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদার স্বয়ং বিদুষী এবং সুলেখিকা। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে সধবা অবস্থায় তার এইসব পরিচয় কিছুই জানা যায়নি, তিনি ছিলেন অন্তরালবর্তিনী। এমনকী কমলকুমার তার প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি পত্নীকে উত্‍সর্গ করলেও সেখানে সহধর্মিনীর নাম উল্লেখ করেননি, শুধু লিখেছিলেন 'স্ত্রী কে', সেই দয়াময়ীই কমলকুমারের অকালমৃত্যুর পর উপন্যাসগুলি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধার করেন।

বাসু ছাদে উঠে আসে হাতে সুস্মিতার ডাইরী। বারকতক ডাকে, সুস্মি, এই সুস্মি, তুমি কোথায় সামনে এসো। কান ধরছি এবার ক্ষমা করে দাও প্লীজ। সুস্মিতার প্রিয় হাসনাহেনা গাছে ফুল ফুটেছে দেখেই সে দৌড়ে নীচে নেমে আসে বলতে গিয়েও আবেগটা খানিক লাগাম টেনে বলে, তোমার লাগানো হাসনাহেনায় আজ প্রথম ফুল এসেছে দেখবে এসো। উত্তর আসেনা একরাশ নির্জনতার হাওয়া ফিসফিস বয়ে যায়। ডাইরীটা বুকে চেপে বসে পড়ে বাসু। সুস্মিতার লেখা এর আগে তার এত মন দিয়ে পড়া হয়নি আজ ভীষন কষ্ট হচ্ছে। এত ভাল লেখা এর আগে কেন পড়েনি এই আক্ষেপ বোধ তাকে ঘুনপোকার মত কুড়ে কুড়ে খায়।ডাইরীর পাতা উল্টে আবার সুস্মিতাকে ছুঁয়ে দেয় বাসু। কমলকুমারের সাহিত্য রচনার প্রেরণা খুঁজে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে তিনি ছিলেন উত্তম পড়ুয়া, তাঁর সময়ে, একশো বছরের বাংলা গদ্য সাহিত্য ছিলো তার নখের ডগায়, বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বঙ্কিম এবং রাজশেখর বসুর, এই ভাষার ঐশ্বর্য নিয়ে তার গর্ব ছিল, তবু কিছু একটা অভাববোধ ও ছিল। অদ্ভুত, সব কিছুকে আপাতভাবে ব্যাখ্যার মধ্যে নেওয়া যায় এমন এক জীবন যাপন করেছেন তিনি।

কমলকুমার শুধু সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হননি, তিনি নতুন ধারার প্রবর্তনে উদ্যত হয়েছিলেন, তার প্রথম উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা বাংলা সাহিত্যে এসে পড়েছে কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া সহসা, এই গদ্যরীতি ও কাহিনী বিন্যাস একদম নতুন। এমন রচনার মাঝে ডুবে যাবার জন্য বাংলার পাঠকরা ডুবসাঁতারে পারঙ্গম নয়। তার ভাষা শুধু সাধু বাংলা নয়, বাক্য বিন্যাস ও ছিলো একেবারে স্বতন্ত্র। কমলকুমারের সমস্ত রচনার উপাদান দেশজ এবং মূলত গ্রাম ভিত্তিক।আমাদের সাহিত্যে গ্রাম বাস্তবতা বড় বেশি গ্রাম্য এবং আঞ্চলিক শব্দে কন্টকিত। কমলকুমার গ্রামের মানুষদের তুলে দিয়েছেন উচ্চ পর্যায়ে, তারা হয়ে গেছে চিরকালীন মানুষ। খেলার প্রতিভা উপন্যাসে একটি মৃত ভিখিরির লাঠিটা নিতেও যাদের বিবেক দ্বন্দ হয়, তারা অনায়াসেই মহাভারতীয় চরিত্র হয়ে ওঠে।সত্যজিত্‍ রায় বলেছেন 'আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তার মধ্যে ছিল যেমন আর কোনো মানুষের মধ্যে দেখিনি'। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন বলে তিনি রবীন্দ্রনাথ কে 'বেম্মো' বলে অবজ্ঞা করতেন, অথচ শানু লাহিড়ী লিখছেন, দাদা প্রায় সময় হেলেদুলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। রবীন্দ্র উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র করার কথা ভেবেছিলেন। রবীবাবুর নাটক অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মঞ্চায়ন করেছেন।

কমলকুমার বাক্য বিন্যাসে স্বতন্ত্র। তিনি যে সাবলীল, ঝকঝকে চলিত ভাষাও লিখতে পারতেন, তার অনেক নিদর্শন আছে। বড় পত্র পত্রিকায় শিল্প সমালোচনা এবং নানা বিষয়ে নিবন্ধ লিখতেন চলিত ভাষায়। উপন্যাস গল্পের ভাষা সম্পর্কে তার বিশেষ চিন্তা ছিল, এ ভাষায় দায় নেই সহজ বোধ্যতার, এ শিল্প নির্মাণের ভাষা, যে কোনো উচ্চাঙ্গ শিল্পের মতনই এর রস গ্রহণ করার জন্য পাঠকদের দীক্ষিত হতে হবে। যেহেতু কমলকুমারের ভাষার কোনো পূর্ব নজির নেই, অন্য কোন লেখকের সাথে তার তাই ভাষার তুলনা চলেনা। তাই তাকে বারবার পড়েই লেখার মর্ম উদ্ধার করতে হবে। আর তাই কমলকুমারকে বারবার পড়তে হয়। তিনি নিজে অনেকসময় বলতেন, বাংলা গদ্যের সিনট্যাক্স হুবহু ইংরেজি গদ্যের অনুকরণে, তিনি সেই প্রথা ভেঙে ফেলে ফরাসি গদ্যের প্রকরণ আনতে চান। তার এই উক্তি আক্ষরিক অর্থে গ্রহন না করেও বলা যায় কমলকুমার এক আশ্চর্য মিনার যা বাংলা সাহিত্যে চিরকাল স্বতন্ত্র হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। জীবনানন্দ দাশ আর কমলকুমার মজুমদারের তুলনা এ কারণেই আমায় ভাবায়। গদ্য নয়, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে জীবনানন্দ যে কাব্যভাষা গ্রহণ করেছিলেন তা অননুসরণীয় এবং বাংলা কবিতায় তা পূর্বাপর রহিত। জীবনানন্দীয় গোত্রের দ্বিতীয় কোনো কবিকে খোঁজা যেমন নিরর্থক তেমনি একটি ছোট অথচ মনোযোগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরী করবেন বলেই যেন কমলকুমার কাহিনীগুলিতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরো সুদৃঢ় করেছেন। তিনি সব পাঠককে সহজে তার লিখনবিশ্বে ঢুকতে দিতে চান না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপমা দিয়ে বলেছিলেন, ফুলবাগানের চারপাশে যেন কাঁটার বেড়া দিয়ে রেখেছিলেন। যাতে অনাকাঙ্খিতরা প্রবেশ করতে না পারে। কমলকুমার কে একবার এত কঠিন করে কেন লিখেন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন 'বলা কঠিন'। তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, 'আমার যে খুব সহজ, তরতরে লেখা পড়তেও কষ্ট হয়, হোঁচট খাই।' কিন্তু আমার বারবার মনে হয় যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই পাঠক হবার জন্য এগিয়ে যেতে পারে। এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজ শব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয়। এক কথায় বললে শব্দের বাচকতা, এটা কমলকুমারের সঠিক পরিচয় আর তার লেখা উপন্যাসগুলো আসলে আধুনিক চম্পু। রাত কেটে সূর্যের প্রথম কিরণ পর্দার ফাঁক গলে দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিতে বিচ্ছুরিত হচ্ছে বাসুর ঘোর কেটে যায় টেবিলের খালি মগটির পাশে শীতল ব্ল্যাক কফির মগটি দীর্ঘশ্বাস মুছে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। বাসুর চোখের তারায় তখন সুস্মিতা, গত পরশুই সুস্মিতা ছবি হয়ে গেছে। ছবিতে এখনো আধ শুকনো ফুলের মালা। বাসুর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সে কি অশ্রু নাকি বিচ্ছেদ শিশির..?