Next
Previous
Showing posts with label বইঘর. Show all posts
0

বইঘর - ঋতবাক

Posted in


বইঘর

চারটি প্রবন্ধের বই
ঋতবাক


'আখির ইয়ে ওয়ক্ত্ কেয়া হ্যায়? কঁহা সে আয়া, কিধার গয়া হ্যায়? ইয়ে কবসে, কবতককা সিলসিলা হ্যায়? ইয়ে ওয়ক্ত্ কেয়া হ্যায় আখির?' জাভেদ আখতারের অমর কবিতা 'ওয়ক্ত্।' যে প্রবন্ধে এটি ঊদ্ধৃত হচ্ছে তার নাম 'সময়'। প্রবন্ধকারের নাম নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী। আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই পড়েছেন নামটা। মহাভারতের টীকাকার অনায়াসেই, দিন, মাস, বছরে গড়া কালতুরঙ্গের বর্ণনা তুলে আনতে পারতেন মহাকাব্য থেকে। তা না করে, তিনি বলছেন -

ইয়ে ওয়ক্ত্ সাকিত হো অওর হম্ ভি গুজর রহে হোঁ
সফরমে হম্ হ্যাঁয়, গুজরতে হম্ হ্যাঁয়,
জিসে সমঝতে হ্যাঁয় গুজরতা হুয়া, উয়ো থমা হুয়া হ্যাঁয়, 
আখির ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যাঁয়? কেয়া হ্যাঁয় আখির?

বইঘরে স্বাগত বন্ধু। ঋতবাক নির্মিত 'মন্দকথা' বইয়ের নৃসিংপ্রসাদকে আমরা দেখিনি কখনও। এই নৃসিংহ জাভেদ আখতার শুনিয়ে সাফ বলেন তিনি বুড়ো হবেন না। স্মার্ট ভঙ্গীতে লেখেন, কর্পোরেট যুগের গীতাভাষ্য 'Smart গীতা।' যেখানে টিম লীডার বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, 'Stop neuter gendering yourself'! ভুল করবেন না। ভঙ্গী সর্বস্ব নয় এই বই। কনটেন্ট স্তরে কোথাও আপোস করেননি লেখক। ক্ষমতা নামের সর্বগ্রাসী শয়তান কেমনভাবে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রকে এক করে তোলে তার কথা বলেছেন। বলেছেন সিচুয়েশনাল এথিক্সের কথা : যার বিচারে মিথ্যে একটা সিচুয়েশনাল নেসেসিটি। আমি জানি, আপনি কী বলবেন। আপনি বলবেন, 'মহাভারত: নীতি অনীতি দুর্নীতি' বইতে এসব আপনি পড়েছেন। আপনি জানেন, লেখক বলেছেন, অবস্থা ভেদে ধর্মকে অধর্মের মতো আর অধর্মকে ধর্মের মতো দেখতে লাগে : মানুষকে তার বুদ্ধি, শীলন, মেধা দিয়ে ধর্ম আর ন্যায়কে বুঝে নিতে হয় - বিদ্বাদসস্তং সম্প্রশ্যন্তি বুদ্ধ্যা। বলবেন, এসব আপনার আগেই পড়া। না, পড়া নয়। আপনি সেই নৃসিংপ্রসাদকে পড়েননি যিনি এলিয়ট, বোদলেয়র আর মহাভারত মিলিয়ে কথা বলেন; 'শেয়ালদা স্টেশনের ঝগড়া অ্যাবসর্ব করার ক্ষমতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি'-র মতো সপাট বাক্য লিখতে পারেন; সংযম প্রসঙ্গে চুলকুনি আর তার দার্শনিক তাৎপর্য টেনে আনেন; মুচকি হেসে বলেন, 'চাওয়াটাকে কমাতে হবে বাছা'! সবচেয়ে বড় কথা, এই বইয়ের লাইনে লাইনে নিজের জীবনকে অকপটে মেলে ধরেছেন নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী। বলেছেন ছোটবেলার অনটনের কথা, লোকের কাছে চাওয়ার স্বভাবের জন্য মায়ের লজ্জা পাওয়ার কথা। বলেছেন বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে নির্মম ভাবে মার খাওয়ার কথা। তারপর, সেই অভিজ্ঞতা থেকে দার্শনিক উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন। এর আগে নৃসিংপ্রসাদ এরকম বই লেখেননি? এর আগে কোথাও নিজেকে উপজীব্য করে, বিশ্লিষ্ট করে বোধিতে এসে পৌঁছনোর রচনা প্রকরণ ব্যবহার করেননি তিনি। প্রথম করছেন এই বইয়ে। কারও তোয়াক্কা না করে বলছেন, 'একান্তে বসলেই আমাদের মনের মধ্যে হিজিবিজি ভাবাবেগ জাগে। ...আর তখনই মানুষ সত্য কথা বলে - নিজের সম্বন্ধেও, পরের সম্বন্ধেও। তখন, মুখোশ থাকে না, থাকে না ভদ্রতার আবরণ। যা দেখে খারাপ লাগে, সেটা সরাসরি বলতে লজ্জা পাই না এই সময়।' এই সব কথা সবসময় শ্রবণসুখকর হয় না। তাই, লেখক তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘মন্দকথা’।

*****************************

‘কখনও কোনো নতুন তথ্য আবিষ্কার করে ইচ্ছে হয়েছে সকলকে জানানোর; কখনও আবার নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো সুপণ্ডিতের কাঁচা ভুল ধরিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারি নি। কোনো কোনো বিষয়ে ভুল ধারণা কাটানোর জন্যও কলম ধরতে হয়েছে। তার বিষয় সাহিত্যও হতে পারে, দর্শনও হতে পারে।’

বস্তুবাদী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বখ্যাত হলেও রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আজীবন সাহিত্যেরই অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর ‘খোলা চোখে, খোলা মনে’ বইয়ের উনিশটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু তাই যুক্তিবাদ, বাঙালি সমাজ, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সাহিত্য, অনুবাদ কবিতা এবং অবশ্যই চার্বাক/ লোকায়ত দর্শন।

অপরাজিত উপন্যাসে বিভূতিভূষণ অপর্ণাকে প্রথম দেখার পর অপুর মনোভাব বোঝাতে তার মনে এক বিদেশি উপন্যাসের লাইনের গুনগুন করার কথা লিখেছেন। ‘অপরাজিত-য় ধ্বনিময় এক ঊদ্ধৃতি’ প্রবন্ধে লেখক জানিয়েছেন সেই উপন্যাসের নাম-ঠিকানা। দেখিয়েছেন কেমনকরে অন্য ভাষার ধ্বনিময়তার সাহায্যে বিভূতিভূষণ তাঁর নায়কের মনের ভাব অপূর্ব দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন। নীরদচন্দ্রের মতো পণ্ডিত কেমন করে যে লিখে বসলেন অপু ইংরিজি কবিতার লাইন বিড়বিড় করছিল, বিয়ের আগেই অপর্ণাকে অপুর বউই বা বানিয়ে দিলেন কেন, তা সত্যিই বোঝা দায়! একটা ফুটনোট কতটা সরস আর কৌতুকোজ্জ্বল হতে পারে, তা লেখকের নীরদচন্দ্রের ‘কাঁচা ভুল’ ধরানোর পদ্ধতি না পড়লে বোঝা যাবে না। অধ্যাপক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন কীভাবে শেক্সপীয়ার পড়তে নেই। বিষ্ণু দে-র অনুবাদে ইয়েটস্‌- নিয়ে আলোচনা করেছেন। টেরি ইগল্‌টনের ‘আফটার থিওরি’ বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে উত্তর-আধুনিকতাবাদকে তুলোধোনা করেছেন। পাণ্ডিত্য কতটা নির্ভার হতে পারে, কতটা সরলভাবে গভীর চিন্তাকে বাঙ্ময় করা যায়, তা জানতে গেলে এই বই পড়তেই হবে। ঋতবাকের নির্মাণ এই বইটির মতো বই বাঙলায় খুব বেশি নেই।

*****************************

চারদিকে যখন এক অদ্ভুত আঁধার ঘিরেছে বর্তমানকে, তখন অধ্যাপক সুদিন চট্টোপাধ্যায় স্মরণ করছেন তাঁর প্রধানশিক্ষককে। বইপাগল মানুষটি কেমনভাবে ইংরিজি সাহিত্যের প্রাণস্পন্দন পৌঁছে দিতেন তাঁর ছাত্রদের কাছে; কেমন করে তাঁর বিশাল বইয়ের সংগ্রহ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেশবিদেশের লাইব্রেরিতে বলছেন সে কথা। মনে করছেন সেই অদ্ভুত শর্ত। কোথাও দেওয়া থাকবে না দাতার নাম। বইয়ের ভিড়ে মিশে গিয়েই সার্থকতা পাবে তাঁর বইগুলো। পাগল লোক! আর, এমন পাগলেরই আজ বড় অভাব। ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’ এমন এক প্রবন্ধের বই, যেখানে বারবার, আজকের দিনে নিষ্ঠা, আদর্শ এবং নিরপেক্ষ বিচারের কথা বলা হয়েছে। বিখ্যাত পণ্ডিত ও মননশীল প্রাবন্ধিকের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়ানো লেখা একত্র করে ঋতবাকের তৈরি এই প্রবন্ধসংকলনে আছে নানা বিষয় নিয়ে লেখা। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা আছে, আছে সাঁওতাল গণ-অভ্যুত্থান হুল নিয়েও। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, গান্ধীজি ছাড়াও দিলীপ কুমার রায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে লেখা যেমন আছে; তেমনই আছে হর্ষবর্দ্ধন ঘোষের ‘ছদ্মনামের অভিধান’ বইটি নিয়ে আলোচনা; আছে শিক্ষাচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধও। অতি মনোগ্রাহী ভাষা। অতি সরল উপস্থাপনা। 

*****************************

‘এত বড়ো ভারতবর্ষে একটা যার মন্দির নেই, সেই সরস্বতী আবার দেবী, আর তার আবার পুজো!’

১৯৪৮ সালে ছোটদের জন্য লেখা ‘কমলাদেবী’ গল্পে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কথাটা ভেবে দেখার মতো। তাহলে কে এই দেবী সরস্বতী ? দেবী দুর্গার স্বরূপই বা কী? সত্যিই কি এক সাঁওতালি রমণী দেবী কালিকার আদিরূপ? শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামে কেন জাতের বিচার নেই? বঙ্গীয় স্মৃতি নিবন্ধ অনুসারে দুর্গোৎসব একমাত্র ম্লেচ্ছ অধিকার স্বীকৃত পূজা, শবরোৎসব যার এক অপরিহার্য অঙ্গ। কেন?

জানার ইচ্ছে আছে, কিন্তু জানানোর মতো মানুষ বিরল। উত্তর আসছে হয় দলে টানার উদ্দেশ্য নিয়ে, নাহয় এত জটিল পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছি আমরা। কবির ভাষা একটু বদলে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, নিতে চাই, দিতে কেহ নাই! ঠিক এরকম সময়ই প্রয়োজন ছিল শিবাংশু দের ‘দেবতার সন্ধানে-একটি অনার্য অডিসি’ –এর মতো এক বইয়ের। 

এ বইতে লেখক অতি সরল ভাষায় কথা বলে গেছেন । একটি বাড়তি কথা নেই তাঁর শব্দে আঁকা ছবিতে। আপনি তাঁর সঙ্গে দেশ বেড়াবেন। পুরীতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি আপনাকে জানাবেন কেমন করে আর্যদের সেরিব্রাল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে, এক অনার্য ঐশীধারণা নীলমাধব, দারুব্রহ্ম রূপ নেন আর্য প্যান্থিয়নে। সরস্বতী নদী কীভাবে দেবী হলেন, আর এই অতি স্বাধীন দেবীটিকে নিয়ে কী বিপাকেই পড়েছিলেন পুরষতন্ত্রের ধারক-বাহকরা তাও জেনে নেবেন আপনি। জানবেন দেবীটিকে শ্বেতবর্ণা করার গূঢ় কারণ। ক্রীট, ব্যাক্ট্রিয়া বা বালখ্‌ অঞ্চলের এক সিংহবাহিনী দেবী কেমন করে শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম ভারতবাসীদের দ্বারা বিন্ধ্যপর্বতে কাত্যায়নী ও কৌশিকী নামে পূজিতা হতে হতে ক্রমে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হয়ে উঠলেন; কোন উপায়ে পারিবারিক এককের রক্ষণশীল নির্মাণ হয়ে উঠল বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা, তাও জানবেন আপনি। অনার্য পূজিতা মাতৃকাশক্তি, বাংলা আর আসামের কৌমজনতার আরাধ্যা এক ঘোরশ্যামা দেবীকে, সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে, তাঁর তন্ত্রসার গ্রন্থে দেবী মহাকালী রূপে অবয়বদান করেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তারপর এক অতি জটিল আত্মীকরণ প্রক্রিয়া। স্ববিরোধ ও সমন্বয়ের পথপরিক্রমা। মাতৃতান্ত্রিক আত্মসন্ধান অনার্যমননের অন্দরমহলে। এই সন্ধানে সামিল হবেন আপনিও।

কালীতত্ত্ব, প্রকৃতপক্ষে ইতরবর্গীয় সংখ্যাগুরু দেশবাসীর আত্মপ্রতিষ্ঠার একটি স্বীকার্য খতিয়ান। গোষ্ঠীগত অধ্যাত্মবৃত্তের বাইরের মানুষ হয়তো নিজস্ব বোধে বিনির্মাণের এই তত্ত্বকে অন্যভাবে বুঝতে পারবে। আনুগত্যের বিচারে সনাতনধর্মীয়রা সামগ্রিকভাবে এই দেবীর প্রতি সতত নিবেদিত থাকলেও তাঁর স্বরূপসন্ধান একান্তভাবে একটি অনার্য অডিসি।

কালী সম্বন্ধে এ কথা বললেও এই বইয়ের মূল কথা এটাই। আজ যখন সনাতনের মৌলিক রূপ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, চলেছে ভারতবর্ষের কৃষ্টি-সংস্কৃতির উৎস-সন্ধান; তখন আপনাকে সঙ্গে নিয়ে দেবত্ব আর মানবতার স্বরূপের খোঁজে বেরিয়েছেন লেখক।


********************

চারটি প্রবন্ধের বই। চার রকম ভাবে বিচার। কিন্তু, মিল আছে। কোথায়? চার প্রাবন্ধিকই কোথাও, একটিবারের জন্যও পণ্ডিতি ফলাননি। ভাষাকে অকারণ জটিল করেননি। আর, সবচেয়ে বড় কথা, পাঠকের মেধাকে তুচ্ছ করেননি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পড়ানোর সময় ছাত্রদের বলতেন, ‘তোমরা তো সবই জানো।’ এই ‘সবই’-র মধ্যে নন্দনতত্ত্ব থেকে সাম্প্রতিকতম সাহিত্যতত্ত্ব, সবকিছুই পড়ত। ছাত্ররা বুঝতো, কথাটা পুরোপুরি ঠিক হতে পারে না। তবু, এই গুরুত্ব দেওয়াটায় তারা একেবারে গলে যেত। প্রাণপণ চেষ্টা করত কথাটার মর্যাদা রাখতে। এই চারটে বইও আমাদের ওপর একই আস্থা রেখেছে। একই সম্মান দিয়েছে আমাদের বোধশক্তিকে। এবার আমাদের দায় তাদের মান রাখা। আর সেটা আমরা পারবই।
0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in


বইঘর 


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট



বইয়ের নাম : গ্রাস

রচয়িতা : অমিতাভ মণ্ডল

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ১০০ টাকা

প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ, জীবনসত্য সব কিছু নিয়ে সরল ভাবে কবিতা রচনা করেছেন কবি। মন ছোঁয়া তাঁর লেখনী। অকপট সারল্য তাঁর মূলধন। রবীন্দ্রানুরাগী কবি চেয়ে দেখেন সুন্দরকে গ্রাস করতে চলেছে লোভ, মোহ, ক্ষমতালিপ্সা। কোনও ভণিতা না করে তিনি ফুটিয়ে তুলেন তাঁর অন্তর্বেদনা। সে বেদনা পবিত্র। সে যন্ত্রণা হৃদয়স্পর্শী। 



বইয়ের নাম : দ্বিখণ্ডিত বার্লিন

রচয়িতা : সন্তোষ ব্রহ্ম

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ৩০০ টাকা

বাবুঘাট থেকে বার্লিন। প্রেমের যাত্রা। জার্মানীর উত্তাল ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানব সম্পর্কের ওঠাপড়া। লেখকের অভিজ্ঞতা, বোধ আর জীবনদর্শন মিলে গড়ে ওঠা এ উপন্যাস পাঠককে স্পর্শ করে।

বইয়ের নাম : গান্ধারীর শোক

রচয়িতা : প্রান্ত পলাশ

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ১২৫ টাকা





একা রাতে মাকে মনে পড়ে। ভারতবাসী বুড়োর মুখে চাটগাঁর জবান। দেশের কথা মনে আসে। পণ্যরতির বেহায়াপনা খেপিয়ে দেয়। প্রাণহীন সংগম অবসাদ আনে। পুলিশের গুলির শব্দ, জেলের স্মৃতি, ভেতর পোড়ায়। আশপাশে চেয়ে উমার স্রোতে বিহ্বল শংকরকে দেখেন কবি প্রান্ত পলাশ। বিগত যৌবনা ধরিত্রী,সভ্যতার পোড়ো জমি আর রক্তে ধোয়া ব্রহ্মাবর্ত এক হয়ে ওঠে। সবরকম অর্থে নিখুঁত কবিতার এই সংকলনকে তাই তিনি বলেন, গান্ধারীর শোক। 



বইয়ের নাম : আবহে জয়জয়ন্তী

রচয়িতা : পল্লববরন পাল

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ১২৫ টাকা

কবিতায় লেখা উপন্যাস। মধ্যবিত্ত জীবন সংকট, অস্তিত্বের যাতনা, সম্পর্কের ঘাত প্রতিঘাত, সব নিয়ে গড়া এই বই। ভাঙাচোরা জীবনেও প্রেম, বাঁচার ইচ্ছে, সৃষ্টিসুখ আবহে বাজায় জয়জয়ন্তী রাগিনী।



বইয়ের নাম : জ্যাক মিশেলিনের কবিতা

রচয়িতা : শুভঙ্কর দাশ

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ৬০ টাকা

আমেরিকান কবি জ্যাক মিশেলিন (১৯২৯-১৯৯৮) রাস্তা ঘাটে কবিতা পড়ে বেড়াতেন। কোনও বড় প্রকাশক তাঁর কবিতার বই ছাপেনি কখনও। বেশির ভাগই বেরিয়েছে লিটল্‌ ম্যাগাজিনে। তাঁকে বিট্‌ জেনারেশন-এর কবি বোলা হলেও, মিশেলিনের নিজের মতে ‘বিট্‌ জেনারেশন’ একটা মিডিয়া ফ্যানটাসির নাম। এই প্রথম বাংলায় তাঁর কবিতা অনূদিত হলো।



বইয়ের নাম : নানারঙে বিবেকানন্দ - শিকাগো থেকে শোভাবাজার (স্মারকগ্রন্থ)

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ২২৫টাকা

সারাভারত ঘুরে, হিন্দুধর্ম প্রচারের জন্য তিনি গেলেন আমেরিকা। বেদান্তের এক মানবিক ভাষ্য রচনা করলেন। দেশে ফিরে এলে প্রথম নাগরিক সম্বর্ধনা দিল রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের অধিনায়কত্বে শোভাবাজার রাজবাড়ি। তাঁর অবদানের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করলেন রবীন্দ্রনাথ। যুক্তিবাদীর দৃষ্টি তাঁর শিকাগো বিজয়ের কাহিনীর মধ্যে পেল অসঙ্গতি। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রাণ পুরুষও ভাবা হলো তাঁকে। মানুষী সম্পর্ক তাঁকে দিয়ে লেখালো ইংরিজি গীতি কবিতা, বাংলা গদ্যেও আনলেন নতুনত্ব। কিন্তু, শেষ অবধি যেন ট্র্যাজেডির নায়কের মতো একাই রয়ে গেলেন তিনি। স্বামী বিবেকানন্দকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এই বইতে দেখেছেন অতি শক্তিশালী লেখকেরা। রয়েছে দুষ্প্রাপ্য ছবি। নানারঙের বিবেকানন্দ: শিকাগো থেকে শোভাবাজার এক অবশ্য সংগ্রহযোগ্য বইয়ের নাম। 

বইয়ের নাম : ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যা ২০১৮



নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ২৭৫ টাকা

কল্পে-প্রকল্পে-অণুকল্পে এবারও সেজেছে ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যা। লেখা দিয়েছেন বাংলার তিন কাব্য প্রজন্মের তিন প্রতিভূ – শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী এবং শ্রীজাত। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, সুদিন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ রথী-মহারথীর রচনা ছাড়াও রয়েছে বর্তমান প্রজন্মের প্রতিভার নিদর্শনও।



বইয়ের নাম : দেবতার সন্ধানে-একটি অনার্য অডিসি

রচয়িতা : শিবাংশু দে

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময়মূল্য : ১৬৫ টাকা

এই বই জানায় কেমন করে আর্যদের সেরিব্রাল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে এক অনার্য ঐশীধারণা দারুব্রহ্ম রূপ নেয় আর্য প্যান্থিয়নে। ব্যাখ্যা করে কেমন করে শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম ভারতবাসীদের দ্বারা পূজিতা এক সিংহবাহিনী দেবী ক্রমে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হয়ে উঠলেন। জানায় সরস্বতী নদী কীভাবে দেবী হয়ে ওঠে। অনার্য পূজিতা মাতৃকাশক্তি, বাংলা আর আসামের কৌমজনতার আরাধ্যা এক ঘোরশ্যামা দেবীকে, সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে, তাঁর তন্ত্রসার গ্রন্থে কীভাবে দেবী মহাকালী রূপে অবয়বদান করেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। আর্য ও অনার্যমননের অন্দরমহলে সন্ধান চালিয়ে এক অতি জটিল আত্মীকরণ প্রক্রিয়ার খোঁজ – এক স্ববিরোধ ও সমন্বয়ের পথপরিক্রমার মাধ্যমে আত্মসন্ধান : এই সব মিলিয়ে এ এক অভিনব বই।



বইয়ের নাম :আঁধার রাতে একলা পাগল

রচয়িতা :সুদিন চট্টোপাধ্যায়

নির্মাণ : ঋতবাক

বিনিময় মূল্য : ২০০ টাকা

বিখ্যাত পণ্ডিত ও মননশীল প্রাবন্ধিকের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়ানো লেখা একত্র করে তৈরি এই প্রবন্ধসংকলনে আছে নানা বিষয় নিয়ে লেখা। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা আছে, আছে সাঁওতাল গণ-অভ্যুত্থান হুল নিয়েও। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, গান্ধীজি ছাড়াও দিলীপ কুমার রায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে লেখা যেমন আছে; তেমনই আছে হর্ষবর্দ্ধন ঘোষের ‘ছদ্মনামের অভিধান’ বইটি নিয়ে আলোচনা; আছে শিক্ষাচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধও। অতি মনোগ্রাহী ভাষা। অতি সরল উপস্থাপনা।
0

বইঘর - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





বইঘর


বুদ্ধদেব বসুর ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



যে বয়সে এই বইটা প্রথম আমার হাত এসেছিল, সে বয়সে এই কবিতাশৈলী বোঝার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ঠিক যেভাবে কিছু দুর্ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে যায়, সেভাবেই আমি বইটা বারো বছর বয়সে প্রথম পড়ি। না, ভালো লাগেনি তখন। তবে অদ্ভুতভাবে ভুলে যেতেও পারিনি বইটার কথা। ভালো লাগেনি সেরকম, কারণ বুদ্ধদেব বসুকে ততখানি আধুনিক কবি মনেই হয়নি। জীবনানন্দ সবে পড়ছি সে সময় আমি বা আমার বয়সী আরও অনেকেই। প্রকৃতির মাধুর্য, প্রেমের জটিলতা, এসব বিষয়ের কাব্যিক প্রকাশ দেখে সম্পৃক্তি ঘটে যাচ্ছে আমাদের মনোজগতে খুব সহজ বিক্রিয়ায়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসুকে স্পর্শ করাটা সহজ নয়, বয়স একটা বড় অন্তরায়। দুর্ঘটনার বছরদুয়েক পরে প্রথম যে কবিতায় মনে হয়েছিল যে বুদ্ধদেব বসু আবার পড়া দরকার, অদ্ভুতভাবে সেই কবিতা এই বইতে নেই। তবে কবিতাটা জীবনের একটা অদ্ভুত সত্যের দিকে আঙ্গুল তোলে। ‘ইলিশ’ কবিতা শিরোনাম দেখে পড়তে গিয়েছিলাম যে হয়তো বা কোনও ছেলেভুলানো ছড়া হবে। ভীষণ ধাক্কা খেলাম, ‘নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়’ পড়ে। প্রথম লাইনে ‘আকাশে আষাঢ় এলোঃ বাংলাদেশ বর্ষায় বিহ্বল’। বুঝে উঠতে পারি না কবি বর্ষাকে ভালবাসেন না ঘৃণা করেন! এত নিঃস্পৃহ হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে তার বর্ষার কবিতারা।

এত কিছুর পরেও এই বইয়ের বেশ কিছু বর্ষার কবিতা মন টানে বার বার। ‘শ্রাবণ’ কবিতার ছন্দের রূপ চমকে দেয়। খুলে গেছে কঠোর অন্তমিলের শৃঙ্খল। ‘জানো কি’ শব্দের সাথে ‘জোনাকি’, ‘দেবো তা’ শব্দবন্ধের সাথে ‘কবিতা’ এসে রচনা করছে উচ্চারণের এক মাধুর্যলোক। এ কবিতা শুধুই নিজে পাঠ করে অনুভবে সমৃদ্ধ হবার জন্য নয়, সম্ভবত বার বার পাঠ করে অন্যকে অনুভব করাবারও বটে! পরম যত্নে নির্মিত কবিতার শরীরে যখন এরকম এক্সপেরিমেন্‌ট লুকিয়ে থাকে, তাকে আধুনিকতা বলে কুর্ণিশ করা ছাড়া উপায় থাকেনা। 

শুধু ছন্দশৈলীর দিক থেকে বৈচিত্রময় কবিতা নয়, সুন্দর চিত্রকল্পের সহজ ভঙ্গিমার কবিতাও আছে এই বইটিতে। ‘রবিবারের দুপুর’ কবিতায় যেন ঝলমলে এক উৎসবের আলো ফুটে ওঠে নিচের পঙক্তিগুলিতে-

‘গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে তিনটি তরুণী, 
রোদের পৌরুষে ঢেলে লাল নীল হলদে বেগুনি ...’ 

এরকম চিত্রকল্প আরও দেখি ‘পৌষপূর্ণিমা’ কবিতায়; তবে এখানে ভঙ্গিমা সহজ নয়। অদ্ভুত শব্দঝঙ্কার, যা হয়তো শুধুমাত্র তারই বিশেষত্ব, প্রকাশ পায় এই পঙক্তিগুলিতে...

‘বালিগঞ্জের বাড়ির গম্ভীর ভিড় যদি কোনো ফাঁকে
মেলে দেয় একটু সবুজ, ইলেকট্রিক আলো জ্বেলে 
অচন্দ্রচেতন যুবা ঘণ্টা দুই ব্যাডমিনটন খেলে।’ 

এই ‘অচন্দ্রচেতন’ শব্দটি প্রথম পেয়েছিলাম তারই কবিতায়। ব্যাডমিনটন শব্দের সাথে সমানুপাত সাযুজ্য শুধু নয়, তৈরি করেছেন কবি শব্দটি। হ্যাঁ, এই শব্দবন্ধ নির্মাণ করে স্পর্শ করতে চেয়েছেন শহুরে নির্লিপ্তি এবং স্বার্থপর আত্মমগ্নতাকে। 

এই কাব্যগ্রন্থে কবির রবীন্দ্রদ্রোহিতার কোনও চিহ্ন পাইনি। ভেঙে বেরিয়ে এসে কোথাও ভীষণভাবে অস্বীকার করছেন রাবীন্দ্রিক উচ্চারণ, এরকম মনে হয়নি কোনও কবিতাতেই। বরং মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ রেখে গিয়েছেন যে সংগঠিত ভিত্তি, বুদ্ধদেব বসু তার উপরেই স্তম্ভ তৈরি করে সেতু বেঁধেছেন আধুনিক কাব্যশৈলীর সাথে। হয়তো সেই কারণেই আমার অপরিণত বয়সের প্রথম পাঠে তার কবিতাকে ততটা আধুনিক বলে মনে হয়নি। 

বুদ্ধদেব বসুর কবিতার কথা বলতে গেলে অতি অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে প্রেমের কবিতার কথা। এই বইতে বেশ কিছু সুন্দর প্রেমের কবিতা আছে, কিংবা এভাবেও বলা যেতে পারে যে প্রায় সব কবিতার মধ্যেই আমরা খুঁজে পেতে পারি প্রেমের বহমান ধারা। কোথাও সে ধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মতো লুক্কায়িত, কোথাও বা উচ্চকিত জলপ্রপাতে কলনাদিনী। প্রেমের অন্য পিঠে যে বিরহ, সেও প্রেমের আরেক প্রকাশ। ‘কোনো মৃতার প্রতি’ কবিতায় উচ্চারিত হয় যেন জীবনের এক অমোঘ সত্য... ‘ ‘ভুলিবো না’ – এত বড়ো স্পর্ধিত শপথে/ জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।’ মাত্র সাত লাইনের এই কবিতার শেষলাইনের অতি সাধারণ কথায়, ‘তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে’ প্রেমে যেন এক আর্তির মতো উচ্চারিত হয়।

সব কবিতা, প্রায় সব কবিতার মধ্যেই প্রেম। হ্যাঁ, প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে যেন কবি প্রেয়সীকেই সম্বোধন করেন। ‘সলজ্জ আষাঢ়’ কবিতার শিরোনামেই লেগে আছে পূর্বরাগের আবেশ। আষাঢ় যেন দ্বিধাগ্রস্ত প্রিয়া। কবি বলছেন, ...

‘কেন থরোথরো দ্বিধাভরে যাও থমকি’
পরুষ রৌদ্রপরশে সহসা চমকি,

কেন এসে তবু আসো না।’ ... ‘পরুষ রৌদ্রপরশে’ শব্দগুলির মধ্য দিয়ে আষাঢ়ের মেঘসজ্জার এক বিপরীত দ্বন্দ্বমুখর মেরু নির্মাণ করেন কবি। 

যেকোনো কবির প্রিয় বিষয় হল কবিতা নিয়ে কবিতা লেখা। ‘নূপুর’ কবিতায়, কবিতাই হয়ে উঠেছে কবির প্রেয়সী। কবি পরম যত্নে যেন নববধূর সাজে তাকে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু সে কি বধূ বা সাধারণ কোনও প্রেয়সী? সে যেন অভিসারিকা। কবি কান পেতে থাকেন কখন সে আসবে। তার প্রতি পদক্ষেপে বেজে উঠবে নূপুর। হয়তো কবিতা নিয়ে তার মূল ভাবনাটিই বিম্বিত হয়েছে এই কবিতায়। বলে ওঠেন, ...

‘তোমার চোখে পড়বে ব’লে বিকালে
অস্তরবির রঙিন লিপি লিখালে, 
বৃষ্টি পড়া রাতের চাঁদে মাখালে 
অশ্রু মেশা হাসির নেশা নববধূর-
পরো নূপুর, পরো নূপুর, পরো নূপুর।’ 

‘দুই পূর্ণিমা’ কবিতাতেও প্রধান উপজীব্য কবিতা। কবির বিভিন্ন বয়সে লেখা কবিতা মিলেমিশে ‘চিরকালের বঁধু’ হয়ে জেগে আছে হৃদয়ের মাঝে। 

প্রেম বড় সুন্দর এবং প্রেমের উচ্চারণ যেন মন্ত্রের মত মহিমামণ্ডিত মনে হয় যখন কবি বলেন, 

‘কঙ্কা, তুমি এই স্তব্ধ গম্ভীর আদিম অন্তিম
রাত্রি, শান্তি; ...’ (কালো চুল) 

প্রেমের আবাহনে যেন কবিতায় যেন এক সম্মোহনী আবেশের আলো-ছায়া নেমে আসে...

‘তা’হলে উজ্জ্বলতর করো দীপ, মায়াবী টেবিলে
সংকীর্ণ আলোর চক্রে মগ্ন হও, যে- আলোর বীজ 
জন্ম দেয় সুন্দরীর...’ (মায়াবী টেবিল) 

প্রেমের প্রত্যাখ্যানও যেন মাধুর্যময় হয়ে ওঠে তার কবিতায়। 

‘বার বার করেছি আঘাত
খোলে নি দুয়ার। 
নিরুত্তর নির্বোধ প্রাসাদ
অবরুদ্ধ অন্তপুর নিঃসাড় পাষাণে।’ (নির্বোধ প্রাসাদ)

তবে তাকে বাস্তববিমুখ, নির্লিপ্ত প্রেমের কবি, কিংবা শুধুই তাত্ত্বিক মননশীল বলে মেনে নিতে কষ্ট হবে যদি কেউ একটু ভেবে এবং মন দিয়ে পড়েন তার কবিতাগুলি। আসলে হয়তো কবিতা এমন একটা শিল্প যেখানে শত আড়াল সত্ত্বেও মানুষ তথা কবি নিজের মনের দরজাগুলি বারে বারে খুলে দিতে পারেন, কারণ কবিতা এমনটাই দাবী করে। হৃদয়ের অন্তস্থলের সত্য স্পর্শ ছাড়া কবিতা প্রাণ পায় না। হ্যাঁ, নৈরাশ্য আছে বটে তার কবিতায়। কিন্তু সে প্রকাশ অবাস্তব নয়... 

‘হায় রে, মানুষ করেছে ফন্দী 
প্রকৃতির হবে প্রতিদ্বন্দ্বী! 

কেড়েছে শক্তি, শেখে নাই তার ছন্দ।...’ (কার্তিকের কবিতা)। একটু নতুন করে হয়তো আবার ভাবা দরকার এই নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এবং পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে, যে কবি কোন বার্তার দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন কাব্যিক নৈরাশ্যের বাতাবরণে ঢেকে। 

এই কাব্যগ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে; তখন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কবিতাগুলি লেখা হচ্ছিল তার কিছুসময় আগে থেকেই। ভুললে চলবে না সে ছিল আমাদের সমাজের, দেশের তথা পৃথিবীর এক রক্তাক্ত সন্ধিক্ষণ। মনে হয় না কি, এ এক নিদারুন চ্যালেঞ্জ ছিল কবির সামনে? কঠিন, কুৎসিত, অন্ধকার সময়ে সুন্দর থাকার চেয়ে বড় স্পর্ধা আর কিছু হতে পারে কি? সেই অস্থির সময়ে কবিতায় নৈরাশ্য প্রতিফলিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আশা নিরাশার দ্বন্দ্বের ছবি এক নৃত্যমুখর ছন্দে ফুটে ওঠে ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ কবিতায়... 

‘আকাশে তারই স্বৈরাচার-
কখনো নীল মেঘের ভার, 
আলোর বাঘ কখনো ছায়া- 
হরিণে করে তাড়া;
আশার দাঁত চিবিয়ে ছেঁড়ে 
দ্রৌপদীর শাড়ি...’

যাকে আশা বলে মনে হয়, যাকে আলো বলে মনে হয়, দ্রুত বদলে যায় তার রূপ মরীচিকার মত। মহাকাব্যের থেকে তুলে আনা এই বস্ত্রখণ্ড তবুও এক দুরপনেয় আশার ইঙ্গিত বহনকারী পতাকার প্রতীকে বদলে যায়, যখন শেষ স্তবকে কবি উচ্চারণ করেন... 

‘অসম্ভব দ্রৌপদীর 
অন্তহীন শাড়ি।’ 
0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in


বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট



বইয়ের নাম : মন্দকথা 
লেখক : নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
নির্মাতা : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২৫০ টাকা

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী নামটা যে কোনও শিক্ষিত বাঙালির পরিচিত। এই নাম উচ্চারণ করলে যে নামটা মনে আসবেই সেটা হলো – মহাভারত। বাল্মিকীর রাম ও রামায়ণ তাঁর প্রথম বই হলেও, মহাভারতের টীকাকার হিসেবেই তিনি সুখ্যাত। মন্দকথা-তেও মহাভারত নিয়ে লেখা আছে। সুরগর্ভা কুন্তীর উল্লেখ আছে। বিভিন্ন রচনায় বারবার এসেছে এই মহাকাব্যের অনুষঙ্গ। কিন্তু, লেখকের অন্যান্য সব বই থেকে মন্দকথা আলাদা। সত্যি কথা বলতে, ঠিক এ রকম বই নৃসিংহপ্রসাদ এর আগে লেখেননি। এই বইতে চলিষ্ণু জীবনের নানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের পাণ্ডিত্যকে মিশিয়ে এক জীবনভাষ্য রচনা করেছেন তিনি। সত্যমাপ্রিয়ম্‌কেই মূল্য দিয়ে এমনসব সোজা সাপটা কথা বলেছেন, যেগুলো অনেকেরই ভালো লাগবে না। তাই, এই বইয়ের নাম মন্দকথা । পরিষ্কার ভাষায় লেখক জানাচ্ছেন, ক্ষমতার রঙ সব যুগে, সব কালে এক। গণতন্ত্রই হোক বা রাজতন্ত্র, ক্ষমতাসীনের থেকে আগুন বেশি ভাল। কেননা, আগুনের কাছে গেলে আগুন ব্যক্তিবিশেষকে পোড়ায়; কিন্তু, রাজরোষের আগুনে পুড়ে ছাই হয় জ্ঞাতি-গোষ্ঠী-জনপদ : কাছেই থাকুক বা দূরে। রেফারেন্স ছাড়া সেকালেও কাজ হতো না, একালেও হয় না। রাজা, পুরোহিত, গণতান্ত্রিক নেতা বা স্বৈরাচারী একনায়ক সবাই এক সর্বগ্রাসী শয়তানের কাহিনীর চরিত্র। কোনও রকম ভান-ভণিতার তোয়াক্কা না করে লেখক মুখের ওপর বলছেন, রোজকার আটপৌরে জীবনে মিথ্যে কথা বলা একটা সিচ্যুয়েশনাল নেসেসিটি! ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়েও সোজাসুজি বলছেন, ভগবান আমাদের নিত্যকার ভাল-মন্দের দায় নেন না। পাপ-পুণ্য-সুকৃতী-দুষ্কৃতির দায়িত্ব মানুষ এবং তার ফ্রী-উইল-এর : নাদত্তে কস্যচিত পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভু। কথা বলছেন গো-বধ, অপশব্দ, কলহ, ম্লেচ্ছ, সহিষ্ণুতার ক্ষয়, রোল মডেল নির্মাণ, ভক্তি সব কিছু নিয়ে। আর, সব কথার শেষে, যে উপলব্ধিতে পৌঁছন লেখক তার নাম গভীর একাকীত্ব বোধ। নিজের কাজ, বিচার-বিবেচনা, শিক্ষা-সামর্থ্য – এই সব নিয়ে একা মানুষ আর তার সামনে নিরুত্তর সময় এবং মহাবিশ্ব। মাঝখানে আর কেউ নেই। কারোরই মন যোগানো কথা এই বইতে বলেননি নৃসিংহপ্রসাদ। তাই, এই বই তাঁর মন্দকথা-র সংকলন।



বইয়ের নাম : খোলা চোখে খোলা মনে
লেখক : রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।
নির্মাতা : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২৫০ টাকা

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে সারা পৃথিবী বস্তুবাদী দার্শনিক হিসেবে চেনে। তবে, সারাজীবন তিনি ইংরিজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। সাহিত্য, দর্শন আর ইতিহাসের জগতে তাঁর অবাধ চলাফেরা। তাঁর লেখা বইগুলোর তালিকায় ঋতবাক যোগ করল নতুন একটি নাম। খোলা চোখে খোলা মনে। অনুবাদ-কবিতা, দর্শন-ধর্ম, বাঙালি সমাজ, ভারতীয় আর পাশ্চাত্য সাহিত্য, যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদ, আন্তর্জালে লেখালেখি – এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা প্রবন্ধের সংকলন এই বইটি। বিষ্ণু দে-র অনুবাদে ইয়েটস্‌, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত লা মার্শেই,অপরাজিত -তে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহার করা ইংরিজি উপন্যাসের ঊদ্ধৃতি, তথ্যের অধিকার … এরকম নানা বিষয় নিয়ে সহজ, সরল, সুললিত গদ্যে আলোচনা করেছেন লেখক। পাণ্ডিত্য আর কৌতুকবোধ একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছে এই বইটিতে। এরকম গদ্য রচনা বড় বিরল। বাংলা ভাষায় এই জাতীয় বই খুব বেশি নেই।



বইয়ের নাম : চেম্বার ডায়েরি- ফিরে দেখা ও তৎসহ
লেখক : বেলাল হোসেন
নির্মাতা : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২০০ টাকা

এক স্টেশনমাস্টারের ছেলে ডাক্তার হয়ে উঠলেন। অর্জিত সাধারণ মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ আর জগতের প্রচলিত নিয়মের বাধল সংঘাত। ডাক্তারবাবুর ডায়েরির পাতা থেকে সরাসরি উঠে এল এক বই: চেম্বার ডায়েরি- ফিরে দেখা ও তৎসহ । এই বই এমন একটা বই, যেটা হাতে নিলে পাঠকের মনে হবে, তিনি ডাক্তারবাবুর চেম্বারে বসে আছেন। বাড়ি ফেরার পথে দুদণ্ড গল্পগাছা করে নিচ্ছেন তাঁর সঙ্গে। বই শুরু হয়েছে ‘ফিরে দেখা’ অংশটি দিয়ে। তারপর এসেছে ‘চেম্বার ডায়েরি’; আর সবশেষে ‘ক্যাবলাকান্ত সিরিজ।’ মানে, বইটায় তিনটে ভাগ আছে। কিন্তু, ন্যারেটিভের স্রোত একটাই। প্রথম অংশ লেখকের আঁত-এর সঙ্গে পরিচয় ঘটায়। দেখা যায় বেলাল হোসেনের জীবন যাপন কেমন করে তাঁর আত্মন বা সেলফহুড্‌ গড়ে তোলে। এরপর কথার পালা। চেম্বারে আসা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে অনুভূতি বিনিময়ে সমৃদ্ধ হচ্ছেন ডাক্তারবাবু। পাঠককে শোনাচ্ছেন সেই কথা। আর, শেষ পর্যায়ে তিনি নিজেকে বর্তমান সমাজের মাপকাঠিতে মেপে ক্যাবলাকান্ত আখ্যা দিচ্ছেন। তার মানে, এই অংশ তাঁর মূল্যবোধের বাখান। সব জুড়ে বেলাল হোসেনের আত্মকথন। এ বইয়ের ভাষার একটাসরাসরি আবেদন, যাকে ইংরিজিতে বলে ইমিডিয়েসি, আছে : আর, তাকে বিনা মেক আপে পাঠকের দরবারে এনে হাজির করা চলতে পারে। বলা যায়, এক ভিন্ন গদ্যরীতির নমুনা তুলে দেওয়া হয়েছে পাঠকের হাতে। উচ্চ-ভ্রু সাহিত্য বলতে প্রতিষ্ঠান আমাদের যা বোঝায়, এ তা নয়। একে বলা যেতে পারে, আঁত ও কথা। আঁতমহলের কথা : লেখক যা বলছেন পাঠককে আত্মজন বলে জেনে।



বইয়ের নাম : ছড়ার ফেরিওয়ালা
রচয়িতা : বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
নির্মাতা : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ১৬৫ টাকা

হরেক রকম খেলনা পাবে
মনের মতো জিনিস সবার
ফেরিওয়ালা হাঁক দিয়ে যায়,
ফুরিয়ে গেলে পাবে না আর।

চনমনে ছন্দ আর প্রাণপ্রাচুর্য ঝোলায় ভরা। হাঁক দিয়ে চলেছেন ছড়ার ফেরিওয়ালা বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকৃতি, জীবন, বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব, অদ্ভুতুড়ে জগৎ - সব কিছুর সঙ্গেই বাঙালি খোকাখুকুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। ছোটদের জন্য লেখা এই বই। তাই ছড়াকারের দায়িত্ব অনেক। সৌন্দর্যবোধ, জীবনচেতনা, সুস্থ রুচি পড়ুয়াদের মধ্যে চারিয়ে দিতে হবে, কিন্তু, গুরুমশাই সাজলে চলবে না। খেলার ছলে বলতে হবে এমন সব কথা, যা তাদের জীবনের ভিতটা পাকা করে গড়বে। শিশুর মনে রঙ ধরানো নয় তো সহজ কাজ : এই কথা বলেছিলেন বনফুল। ছড়ার ফেরিওয়ালা বইয়ে সেই কঠিন কাজটাই খুব সহজে করে ফেলেছেন কবি।

3

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


সূর্যনগরীর কান্না
চয়ন



‘দুর্গম গহন অরণ্য, তার মধ্যে আছে হিংস্র জন্তু, নির্জন মরুর চেয়েও শুষ্ক বিশাল পর্বত-রাজ্য- তারই আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকবে লাল-মানুষের সতর্ক চক্ষু। সে সব নিষ্ঠুর চোখ যখনই আমাদের আবিষ্কার করবে তখনই ছুটে আসবে উত্তপ্ত বুলেটের ঝটিকা।’ (সূর্যনগরীর গুপ্তধন : হেমেন্দ্রকুমার রায়;১৯৪৪)

‘বন্দর-নগর টম্‌বেজ যে অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ এক অজানা রাজ্যের একটি সীমান্ত ঘাঁটি মাত্র তা বুঝতে তাঁর দেরী হয়নি। সর্বত্র রাস্তায় ঘাটে দেবস্থানে সোনা-রুপোর ছড়াছড়ি দেখেছেন,দেখেছেন সেই আশ্চর্য প্রাণী যার কোমল মসৃন লোম ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পশমকেও হার মানায়- অজানা সভ্যতায় ব্যবহৃত নতুন কয়েকটি শব্দ শিখেছেন যেমন কুরাকা, যেমন মিনি মারেস্‌, যেমন ইঙ্কা।’ (সূর্য কাঁদলে সোনা :প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৬৯)

দুই কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। এক পটভূমি – পেরু। দু’জন লেখক। জগৎ চিন্তার দুটি মেরু। সূর্যনগরীর গুপ্তধন এবং সূর্য কাঁদলে সোনা। হেমেন্দ্রকুমার রায় আর প্রেমেন্দ্র মিত্র। ১৫৩২ সালে স্পেনের ফ্রান্‌সিস্‌কো পিজারো, চরম নীচতা আর বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে পেরুর সম্রাট ইংকা নরেশ আতাহুয়াল্পাকে হারিয়ে পেরু জিতে নেন। পেরুবাসীর ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। শেষে সম্রাটকে খুনও করেন পিজারো। সম্রাটের মুক্তিপণ হিসেবে রাশি রাশি সোনা নিয়ে আসছিল প্রজারা। রাজহত্যার খবর পেয়ে সেই সোনা তারা কোনও গোপন স্থানে লুকিয়ে ফেলে। সূর্যনগরীর গুপ্তধন বিংশ শতকে এই লুকোন সম্পদ দেখতে যাওয়ার কাহিনী বলে। সূর্য কাঁদলে সোনা বলে পিজারোর পেরু বিজয়ের গল্প। 

প্রথমটির নায়ক বিমল-কুমার। বা আরও স্পষ্ট করে বললে বিমল। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, অসীম দৈহিক বল, রাইফেলে ক্র্যাক্‌শট, বাঙালির ঘরকুনো বদনাম ঘোচাতে মরিয়া। তার ঘোষণা- ‘ঘরকুনো বাঙালির ঘরে জন্মেও আমরা হতে চাই বিশ্বমানবের আত্মীয়, আমরা ধন-মান-খ্যাতি কিছু প্রার্থনা করি না, আমরা চাই শুধু ঘটনার আবর্তে ঝাঁপ দিতে, উত্তেজনার পর উত্তেজনা ভোগ করতে, নব নব দৃশ্য আর সৌন্দর্যের মধ্যে তলিয়ে যেতে’ (সোনার পাহাড়ের যাত্রী, নজরটান আমার)। দ্বিতীয়টির নায়ক ঘনরাম দাস। ১৫০৩ সালে ভারতের ‘পশ্চিম উপকূলের সমুদ্রে পর্তুগীজ বোম্বেটেদের লুট- করা, জ্বালিয়ে- দেওয়া তাম্রলিপ্তির সদাগরী জাহাজ থেকে রক্ষা পেয়েও ধরা পড়ে প্রায় অর্ধেক যৌবন পর্যন্ত পোর্টুগ্যাল, স্পেনে এবং এখন যাকে আমরা কিউবা আর মেক্সিকো বলে জানি, সেই দুই দেশে ক্রীতদাস হয়ে কাটিয়ে... [পরে] দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও নিজের বংশের ধারার ওই চরম গ্লানি ও পরম গৌরবের অধ্যায় চিরস্মরণীয় করে রাখবার জন্য দাস পদবীই গ্রহণ করেছিলেন’ (সূর্য কাঁদলে সোনা)। শ্যামলকান্তি, সুপুরুষ ঘনরাম তলোয়ার চালান কিংবদন্তীর এল্‌ সিড্‌ কম্পিয়াডরের মতো; ফার্নানদেজ দে ওভিয়েদো ঈ ভালদেজের মতো পণ্ডিত তাঁর শিক্ষাগুরু। তাঁর আত্মঘোষণা, ‘স্পেনের শত্রু আমি নই, অবিচার অন্যায় নীচতা দম্ভ পাশবিকতা লোভ পৃথিবীর সব সাধারণ মানুষের মতো আমি শত্রু এই সব কিছুর।’ এই স্বর আমরা আবার শুনি তাঁর অধঃস্তন দ্বাবিংশতিতম উওরপুরুষ একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ ঘনশ্যাম দাসের গলায়। অমানুষ ধলা-আদমি ফিংককে তিনি বলেন, ‘আমার দেশের নাম মানুষের দুনিয়া। আপনার দক্ষিণ আফ্রিকা তার মধ্যে নেই’ (‘জল’:প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৬৪। নজরটান আমার)।

আপনি জানতে চাইছেন, এই নজরটান গুলো ঊদ্ধৃতির মধ্যে আমি দিচ্ছি কেন? আসলে, একই পটভূমিতে লেখা দু’টো কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসকে সামনে রেখে বইঘর বুঝে নিতে চাইছে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের এক বিশেষ ধরণকে। একটু পিছিয়ে যাই। উনিশ শতক, ঔপনিবেশিক শিক্ষার দৌলতে গড়ে উঠল এক নতুন শ্রেণী। বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়। ইংরিজি সে শিখল বটে, কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই বোঝা গেল যে সে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রোডাক্ট, যার উদ্দেশ্য হলো সুশীল, রাজভক্ত প্রজা বানানো। এই শ্রেণীর একটা বিশেষত্ব ছিল। একদিকে, এরা বৃটিশরাজকে ভয়,ভক্তি করতো, আর একটা প্রবল হীনমন্যতায় ভুগত ইংরেজের ক্ষমতার আস্ফালনের সামনে। মনে মনে চাইত প্রভুর সমান হতে। অন্যদিকে, ‘ছোটলোক’ সম্প্রদায়কে ঘেন্নার ব্যাপারে এরা ছিল একেবারে এককাট্টা। ঔপনিবেশিক শিক্ষার সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল নিরন্ন, অপুষ্ট, অশিক্ষিত প্রকৃত ভারতথেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এই দু’রকম দিকেরই প্রতিফলন ঘটে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে। আমরা তার একটা দিককে দেখতে চাইছি। বিশের শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকেই বাংলা ছোটদের লেখায় এক ধরণের চরিত্রের দেখা পাওয়া যেতে থাকে। এরা গতে বাঁধা জীবন নিয়ে প্রচণ্ড অসন্তুষ্ট; অজানার আহ্বানে চঞ্চল পাখা মেলতে তাদের মন-বলাকা হামেশা তৈয়ার। তারা জগৎ দেখতে চায়, অ্যাডভেঞ্চার চায়,সাহেব প্রভুদের মতো শক্ত সমর্থ হতে চায়। কিংসটন-ব্যালেন্টাইন-হেন্‌টি-হ্যাগার্ড-কিপলিং-ওয়ালেস পড়া বাঙালি লেখককুল গড়ে তুললেন ইচ্ছেপূরণের দুনিয়া, যেখানে বাঙালির ছেলে বদ্ধঘর ছেড়ে বেরোতে চায়। গোলটাও বাধল ঠিক এখানেই। নিজের অজান্তেই ঔপনিবেশিক বয়ানের ফাঁদে পড়লেন তাঁরা। যেসব সাহেব সুবোর নাম করলাম তাঁদের লেখার উদ্দেশ্যই ছিল সাহেবখোকাদের (খুকুদের নয়) গ্লোরিয়াস এম্পায়ার রক্ষার তালিম দেওয়া। সাদা মানুষের অসভ্য কালা-আদমিদের সভ্য করে তোলার বোঝা বওয়ার মতো মজবুত কাঁধ বানাতে মদত করা। ঠিক এই ছাঁচেই পড়ে গেল ছোটদের জন্য লেখা বাংলা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসগুলো। সঙ্গে মিশল মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীচরিত্র। দু’ইয়ে মিলে ফল দাঁড়ালো এই যে, ঘরের বাইরে বেরোতে চেয়েও ঘরেই রয়ে গেল ডানপিটে অভিযানকারীর দল। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য বইয়ে লিখেছেন,

উত্তেজনার খোঁজে বেরিয়ে পড়া বাঙালিরা-আফ্রিকা, লাতিন- আমেরিকা, চীন, ব্রহ্মদেশ, ভারত যেখানেই যাক, যত বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে আসুক, যত আলাদা রীতি-নীতি ধ্যানচিন্তার আবহে প্রবেশ করুক, অচেনা ভুবনগুলি তারা নেহাতই স্পর্শকের মতো ছুঁয়ে যায়, অপরিসীম অবজ্ঞা ও নাকউঁচু মনোভাব নিয়ে এড়িয়ে যায়। ফলে তাদের মনে চেনা অচেনার কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হয় না, যে চেনা জগৎ ছেড়ে তারা বেরিয়েছে সেই জগৎটাই ছাপিয়ে উঠে গ্রাস করে নেয় অচেনা জগৎকে। (গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৮৬)

তাই বিভূতিভূষণের শঙ্কর রোডেশিয়া গেলেও চাঁদের পাহাড় – এর কোথাও সাদাদের অমানবিকতা নিয়ে ঘনশ্যাম দাসের মতো স্পর্ধিত উচ্চারণ নেই। আসলে এক উপনিবেশের প্রজা অন্য উপনিবেশের প্রজার মধ্যে নিজেকে দেখতে চায় না। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘একদিকে যারা সাড়ম্বরে বিজ্ঞাপিত করে তারা স্বভাব বাউণ্ডুলে, সৃষ্টিছাড়া, তারাই আবার নিজেদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। অন্যের মাপকাঠিতে নিজেকে যাচাই করার দায় থেকে রেহাই পেতে চায় বলেই বিকল্প জীবনযাত্রাকে তারা আমল দেয় না।’(গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৮৬)

এই কারণেই, বিমলের বিশ্বমানবের আত্মীয় হওয়ার ইচ্ছে আর ঘনরাম- ঘনশ্যামের মানুষের দুনিয়া-র মধ্যে আড়াআড়ি বেধে যায়। সূর্যনগরীর গুপ্তধন যদি ভালো করে পড়েন তবে দেখবেন বইটার মধ্যে রামায়ণের আদল আছে। নিষিদ্ধ সূর্যনগরীতে সবান্ধব বিমল, কুমার আর ফিলিপ সাহেব ঢুকতে পারেন বিভীষণ ইক্‌নিটাইক্‌-এর সাহায্যে। এখানে একটা কথা মনে রাখলে ভালো। ইংকা সাম্রাজ্যের বর্ণনা দেওয়ার সময় ফিলিপ সাহেব পিজারোকে নিষ্ঠুর, বিশ্বাসঘাতক, দস্যু প্রভৃতি বাছা বাছা বিশেষণে বিশেষিত করেন। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় ভিন্ন সভ্যতা সম্বন্ধে তাঁর মনে একটা খোলা ভাব আছে? না। একেবারেই না। গুলি খাওয়া ইক্‌নিটাইক্‌ যখন জল চাইছে তখন,

ফিলিপের ওষ্ঠাধরে ফুটল কঠিন হাসি। তিনি বললেন, “ইক্‌নিটাইক্‌, তুমি যে আমাদের পরম শত্রু, সে কথা আমরা জানি। আমাদেরই অনিষ্ট করবার জন্যে কাল তোমরা এখানে এসেছিলে, তাই ভগবান তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন। আমাদের কাছে জল চাইতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না?”

একেবারে পেশিবহুল কেরেস্তানি গলার স্বর। তাহলে, এই বই কি পুরোপুরি সাহেব ভজনায় ভর্তি? তাও নয়। আসলে ব্যাপারটা এত সোজা সাপটা হলে কোনও সমস্যাই থাকত না। এই বই পড়লে দেখবেন ন্যারেটিভ স্তরে একটা বিপুল টানাটানি আছে। ইংকা সভ্যাতার উন্নত দিকটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না আবার তাদের নিষ্ঠুর প্রথার কথা ভেবে সভ্য ভাবতে বাধছে! ১৯৪৪এ দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালি লেখক রোমান ক্যাথলিকদের ইন্‌কুইজিশন্‌-কে সমালোচনা করছেন, একইসঙ্গে ইংরেজ জমানায় সিডিশনের দায়েও পড়তে চাইছেন না। তার ওপর আবার,ভিন্নতাকে কদর দেওয়ার প্রশিক্ষণও তাঁর নেই। ফলে বইটা টেনশনে ভরা। এই টেনশনটাই ঔপনিবেশিক কালে আমাদের মধ্যবিত্ত মনের গহীনে চারিয়ে গিয়েছিল। আজও বোধহয় আমরা সেটা কাটিয়ে উঠিনি। কিন্তু, সেটা আলোচনার জায়গা বইঘর নয়। যাই হোক, এই টেনশনের দায়ে এই বই ভুলে যায় যে ইংকা বা ইন্‌কা একটা জাতির নাম! কয়েক পাতা আগে যাদের সভ্যতার কথা বলা হচ্ছিল, শেষের দিকে দেখা যায় সেই ইন্‌কা বলতে রাজা বোঝানো হচ্ছে! রাজা বলব, না ‘অসভ্য জাত’-এর সর্দার বলব? মৃণুর গানের অবজ্ঞার ধরণে তাই মনে হয় যে!


ইন্‌কা যদি করত আমায় ইন্‌কী রে!

চক্ষে তবে জ্বলত আমার

অগ্নিরাগের ফিন্‌কি রে!

এক চড়ে তার ঘুরত মাথা,

কুঁচকে যেত বুকের ছাতা,

ভাবত বোকা- ‘এমনি ভাবেই

কাট্‌বে আমার দিন কি রে,-

এ যে বিষম ইন্‌কী রে!’



শেষ পর্যন্ত অটুটই থাকে ঔপনিবেশিক বয়ান। আর,ঠিক এখানটাতেই সূর্য কাঁদলে সোনা আলাদা হয়ে যায়। পঁচিশ বছরের মধ্যে বদলে গেছে বাঙালি কিশোর সাহিত্যিকের চিন্তাবিশ্ব। হীরোর মডেল একই আছে। শস্ত্র-শাস্ত্র নিপুণ, রূপে-গুণে অদ্বিতীয়। কিন্তু, পালটে গেছে দেখার ধরণ। একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে। যে ইন্‌কা নিয়ে মৃণুর গান, তাঁর সম্ব্বন্ধেই বলছে কথককন্ঠ-

এই নতুন মহাদেশে এ পর্যন্ত এস্‌পানিওলরা অনেক কিছু দেখেছে, বড় ছোট অনেক মানুষের সংশ্রবে এসেছে। তুষার ঢাকা অভ্রভেদী পাহাড়ের বুকে ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’র দেশ যত রহস্যময়ই হোক সত্য-মিথ্যা নানা বর্ণনা শুনে তার রাজ্যেশ্বর ইংকা আতাহুয়াল্পা সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা তাই পিজারো আর তাঁর দলবলের মনে গড়ে উঠেছিল।

আতাহুয়াল্পার চাক্ষুষ যে রূপ দেখা গেছে তার সঙ্গে সে ধারণার একেবারে মিল নেই।

আতাহুয়াল্পার মতো এরকম সত্যিকারের সম্রাটোচিত চেহারাই এর আগে এদেশে কোথাও পিজারো বা তার সঙ্গীদের কারুর চোখে পড়ে নি।

দে সাটো আর হার্নাণ্ডো পিজারোর এই ইংকা নরেশের সামনে আপনা থেকেই নিজেদের কেমন ছোট মনে হয়েছে।


দু’টো আলাদা জীবন ধারার সংঘাতের কাহিনী লিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর সব শর্ত মেনেই। তাঁর গল্প বরং হেমেন্দ্রকুমারের থেকে বেশ একটু জটিল। মারপ্যাঁচ অনেক বেশি। থ্রিল আছে, সাসপেন্স আছে, নায়ক-নায়িকা আছে, খলনায়ক-খলনায়িকাও আছে। কিন্তু, সব চেয়ে বেশি করে আছে ভিন্ন সংস্কৃতিকে সম্মান দেওয়া। নিরপেক্ষ মূল্যায়নের চেষ্টা। এর জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন লেখক, বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে তা অন্তত আমার চোখে আগে পড়েনি। নায়ক ঘনরাম স্পেন আর পেরু দু’জায়গাতেই বহিরাগত। যতই বিদেশে বড় হোন না কেন, তাঁর মনে পড়ে আছে জন্মভূমিতে। তাই, তাঁর পক্ষেই সম্ভব কোনও পক্ষই না নেওয়া। তিনি কতগুলো আদর্শের পক্ষে। অজানাকে জানা, জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো, মানুষে মানুষে মিতালি। মানে, যেটা আগের নায়করা চেষ্টা করেও পারেননি, ঘনরাম অবলীলায় সেটা পেরেছেন। তার ওপর ক্রীতদাসের জীবন কাটানোর ফলে নিপীড়িতের যন্ত্রনা তিনি একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানেন। তাই তিনি এক সুপার-কমন্‌-ম্যান্‌। তাঁর বাসভূমি সত্যিই মানুষের দুনিয়া । এরকম নায়ক সৃষ্টি দেশ স্বাধীন না হলে হতো কি না, সে তর্কে ঢুকছি না। শুধু ভাবছি, প্রেমেন্দ্রও তো পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষাতেই শিক্ষিত হয়েছিলেন, ভদ্রলোক সম্প্রদায়ভুক্তও ছিলেন, তাহলে এই খোল নলচে বদলানোর কাজটা তিনি করলেন কীভাবে? জবাব বোধহয় আছে। প্রেমেন্দ্রের সামনেও একটা মডেল ছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভোম্বল সর্দার । বাংলা ছোটদের লেখার জগতে প্রথম আউটসাইডার। ‘অতিথি’র তারাপদর কথা তুলবেন না। প্রথমত, ওটা ছোটদের কথা ভেবে লেখা নয়; দ্বিতীয়ত, তারাপদ একটা মেটাফর। ভোম্বল তারাপদর মতো মূর্তিমান সারল্য নয়। সে জেদি, গোঁয়ার,অবাধ্য। তার চোখে ধরা পড়ে গ্রামের দারিদ্র্য, পীড়ন, অপুষ্টি। তার চলা আর দেখে চলা প্রসঙ্গে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘ভোম্বলের ওই নিষ্পলক দৃষ্টি যেন বলছে, জন্মলগ্ন থেকে বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায় কর্মসূচির যে খসড়া লিখে চলেছে তা এবার আগাপাশতলা পালটানো দরকার’ (গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৯৬)।

আমি একবারও বলছি না যে প্রেমেন্দ্র খগেন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত। সেটা সম্ভবও নয়। কারণ, ভোম্বল সর্দার –এর প্রথম খণ্ড ১৯৩৬এ বেরোলেও, দ্বিতীয় আর তৃতীয় খণ্ড বেরোয় যথাক্রমে ১৯৫৫ ও ১৯৭৫ এ। সূর্য কাঁদলে সোনা-র প্রথম প্রকাশ ২৫শে বৈশাখ, ১৩৭৬। আমি বলতে চাইছি, চালু বয়ানের প্রতি-বয়ান থাকবেই। একই সামাজিক পরিবেশ থেকে বিরোধী স্বর জন্ম নিতে বাধ্য। তাই, হেমেন্দ্র যে স্বরের প্রতিনিধি তার উলটো স্বরের প্রতিনিধিত্ব করেন খগেন্দ্র-প্রেমেন্দ্র।

সূর্যনগরীর গুপ্তধন আর সূর্য কাঁদলে সোনা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের দু’টো ভিন্ন ধারার প্রতিভূ। নামেই তার প্রমাণ। হেমেন্দ্র জোর দিয়েছেন অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের চিরাচরিত গুপ্তধন মোটিফের ওপর। এর সঙ্গে মিশে থাকে একটা জিতে নেওয়ার গন্ধ। ভিন্ন সংস্কৃতি ইত্যাদি এখানে গৌণ। প্রেমেন্দ্র ভাবছেন পেরুর লোককথা নিয়ে। সোনাকে যে বলে সূর্যের চোখের জল। নামই বলছে ‘অপর’-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা। বলছে এস্‌পানিওলদের ইস্পাতের তলোয়ারের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত পেরুবাসীর চোখের জলের প্রতি তাঁর মমত্বের কথা। 

এক পটভূমি। দু’টো বই। বিশ্বপ্রেক্ষার দুই ভিন্ন মেরু।
0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in








বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট





বইয়ের নাম : ধূসর যাপন
লেখক : সোমঙ্কর লাহিড়ী
প্রকাশক : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২০০ টাকা

বুলেটের শিস। রক্তের গন্ধ। বোমার আগুন। খুন। ষড়যন্ত্র। এক ভিন্ন যাপন কথা। এক বাস্তব যা চোখের আড়ালে থাকে। সাদা নয়। কালো নয়। জীবনের রঙই তার রঙ। এ যাপন ধূসর যাপন।

রহস্য-রোমহর্ষ। লোভ। কাম। নানা বাঁক ও মোচড়। রতন-বিল্লা-রাম ঠাকুর-আলিবাবা-জীবন সাহা-চায়না-মায়া। এদের যাপন। ধূসর যাপন। থ্রিলার। হুডানিট নয়। ক্রাইম ডাজ্‌ নট্‌ পে কি না, তা নিয়ে লেখক খুব একটা ভাবিত নন। এ বইয়ের ছত্রে ছত্রে শিহরণ। এককথায় আনপুটডাউনেবল্‌।



বইয়ের নাম : ঠিক বারোটা
লেখক : কর্ণ শীল
প্রকাশক : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ১৭৫ টাকা

অন্য রাস্তায় যেতে কিসের ভয়?... সাজুর খিদে মেটে কিসে?... মাছ শিকার করতে গিয়ে গা হিম কার?... কার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে মানুষের রক্ত-মাংস? ...

ঠিক বারোটা-র হাড় হিম করা কথাবিশ্বে উত্তর মিলবে। এক ডজন গল্পের সংকলন এ বই শুধু একটা বই নয়। এ হলো জমাট বাঁধা আতঙ্ক। রাতের বেলা এই বই পড়া মানা।

ভয় বা আতঙ্ক এই দুটো শব্দকেই হরর কথাটা দিয়ে বোঝানো যায়। ল্যটিন horreere থেকেএসেছে এই ইংরিজি শব্দ। এর অর্থ হলো মাথার চুল খাড়া করিয়ে দেওয়া আর কাঁপুনি ধরানো। তার মানে, যে ধরণের গল্প পড়লে ভয়ে কাঁটা হয়ে, আমরা কাঁপতে থাকব, তাই হলো সার্থক ভয়ের গল্প। ঠিক বারোটা সব রকম অর্থে ভয়ের গল্পের সংকলন।






বইয়ের নাম : আম্মা এবং...
লেখক : রাজা ভট্টাচার্য
প্রকাশক : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২০০ টাকা

আম্মা এক বাস্তব চরিত্র। আম্মা এক প্রতীক। নিষ্কলুষ শৈশবের প্রতীক। যার চোখে বড়দের জগতের অসঙ্গতিগুলো সব ধরা পড়ে। আম্মা চিরকেলে মা। আম্মা চিরশিশু। বাস্তব জগতের আম্মা বড় হয়ে গেলেও লেখার দুনিয়ায় তার বয়স বাড়ে না। তাই, তার দিব্যদৃষ্টিও অটুট থাকে। আম্মা এবং –এ আম্মা একা নয়। তার বন্ধু বান্ধবরাও হাজির। তারা আমাদের দম চাপা পৃথিবীতে এক ঝলক তাজা বাতাস আনে। এই বই লেখকের কলম শুদ্ধ করার প্রক্রিয়ার নাম। এই বই পড়া মানে গঙ্গা স্নান।





বইয়ের নাম: চিতে ডাকাত ও অন্যান্য
লেখক : সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক : ঋতবাক 
বিনিময়মূল্য : ২০০ টাকা

দুটো অণু উপন্যাস, চোদ্দটা গল্প আর চোদ্দটা অণুগল্প। নানা রঙ, নানা গন্ধ, নানা স্বাদ। সব মিলে একটা নাম – জ্যান্ত জীবন। বাস্তব যাপন। ভাষার মায়াতুলিতে বাস্তবকে মায়ায় ভরে এই বই। মায়া মানে মমত্ব, মায়া মানে জাদু। বাস্তব উপাদান, লেখকের সমানুভূতি আর ভাষার সুদক্ষ প্রয়োগ – তিনে মিলে চিতে ডাকাত ও অন্যান্য এক সৃষ্টির নাম। মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, জীবন-রাজনীতি-ইতিহাসের কথোপকথন আর লেখকের অভিজ্ঞতার প্রসার থেকে উঠে আসা বাস্তববোধ এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে বইটিকে।
0

বইঘর - সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া

Posted in


বইঘর


বীর্যশুল্কা - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া



বাংলা সাহিত্য সোপানের রথী মহারথীবৃন্দে শরদিন্দুর স্থান আজও অনির্ণীত। পাঠকপ্রিয়তা আর গুণমানে বিরোধ আছে বলে বিশ্বের তাবৎ সমালোচক নিঃসন্দেহ; আর তাতেই শরদিন্দুর স্থান নির্ণয়ে আরও জটিলতা। তঁর পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ নেই, গুণমান নিয়ে প্রশ্নও ধোপে টেঁকে না। তাঁর গোয়েন্দা-চরিত্র নিছক গোয়েন্দা নন, একজন মেধাবী সমাজ-মনস্তাত্বিক, তাঁর ঐতিহাসিক কাহিনীসমূহের বিন্যাসে ইতিহাস আর কল্পনা কত অনুপাতে মিশেছে তা মাপতে গিয়ে কাহিনীর ফাঁদে মজে যেতে হয় পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচককেও। তাঁর ছোটগল্পগুলি কুললক্ষণে রোমান্টিক হলেও তাতে বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তির ধারা কদাচিৎ ছিন্ন হয়। শরৎশশীর মায়াডোর অনুভবের পূর্বেই সে যেমন হরণ করে নেয় আমাদের মন, প্রশংসাকুণ্ঠ সমালোচকের প্রশংসা আদায়ের আগেই তাঁর হৃদয়ে আসন পেতে বসেন শরদিন্দু। 

‘বীর্যশুল্কা’ শরদিন্দুর অধিকাংশ গল্পের মতই রোমান্টিক। রোমান্টিক কেবল ভাবপ্রবণতায় নয়, ফুরফেরে প্রেমের গল্পের আদল স্পষ্ট শুরু থেকেই। গল্পগুলির গল্প না হয়ে ওঠা নিয়ে আর যার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা যাক, শরদিন্দুর দিকে যাবে না। রাজা রাণী মন্ত্রী সান্ত্রী পাত্র মিত্রদের কেবল মাপমতো আসনে বসিয়েই দরবার জাঁকিয়ে তোলেননি তিনি, বীর্যবান রাজার দরবারের সব আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত করে দিয়েছেন অষ্টাদশী সুমিত্রার আননে অধরে হাস্যে লাস্যে বিলোল কটাক্ষে। তাঁর রূপ লাবণ্যের পেছনে কেবল রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র কোটালপুত্রদের ঘুরিয়ে মারেন না তিনি, বেঁধে রাখেন পাঠকের মনও। 

কিন্তু শরদিন্দু জানেন রাজা রাণী পাত্র মিত্র দিয়ে ছেলেভোলানো রূপকথা হয়। আর নিছক ছোটদের জন্য রূপকথায় সম্ভবত ‘বীর্যশুল্কা’ সন্তুষ্ট নয়। তাই অনুপান হিসেবে ভাবতে হয়েছে আরো অনেককিছু। প্রেক্ষাপটে কতখানি ইতিহাস থাকলে বাঁধা পড়তে হয়, প্রাপ্তমনস্ক বাঙালি পাঠককে তা রপ্ত করিয়েছেন অন্য সাহিত্য চন্দ্রমা বঙ্কিম স্বয়ং। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘রাজসিংহ’-ই কেবল নয়, রমেশচন্দ্র দত্ত-র ‘মাধবীকঙ্কণ’, ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’, ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’-য় ঐতিহাসিক কাহিনীর আর একরকম পরিপুষ্টি পেয়েছে বাঙালি পাঠক। প্রত্নতাত্বিক পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়লেও রাখালদাসের ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’, ‘করুণা’-র কথা-ও নিশ্চই বিস্মৃত ছিলেন না দেশি বিদেশি ঐতিহাসিক কাহিনির নিষ্ঠ পাঠক শরদিন্দু। রবীন্দ্রনাথও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বাঙালি পাঠককে গল্প শুনিয়েছেন ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’, ‘রাজর্ষি’-তে। তাই প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের গন্ধ থাকলেই যে বাঙালি পাঠক চিত্তকে উদ্বেল করা যাবে এমন সামান্য ভাবনা নিশ্চই শরদিন্দুর ছিল না। একদিন যিনি ‘কালের মন্দিরা’ (১৯৫১), থেকে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ (১৯৭২) লিখে বাংলায় ঐতিহাসিক কাহিনীর অবিসম্বাদী সম্রাট হয়ে উঠবেন, এবং কোনো কোনো সমালোচক যাঁকে ঐতিহাসিক কাহিনী রচনায় এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রেরও ওপরে স্থান দেবেন, তাঁর সলতে পাকানোতেও যে থাকবে বুড়ো আঙুলের নির্ভুল ছাপ তা ‘বীর্যশুল্কা’-র (১৯৩৪) পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন নিশ্চই। 

গল্পের শুরুতেই যখন জানা যায়, ‘রাজকুমারী সুমিত্রার আর কিছুতেই বর পছন্দ হয় না।’ তখন পাঠক-মাত্রেই কল্পনা বিকাশের একটি নিশ্চিন্ত আশ্রয় পান; বোঝা যায় এ সেই রাজা রাণী পাত্র মিত্রের চিরচেনা কল্প-জগৎ এবং গল্প নিশ্চই আবর্তিত হবে রাজকুমারীর ‘বর’ পাওয়া ঘিরে। পুরুষ পাঠকের নিজেকে সুমিত্রার সম্ভাব্য পানিপ্রার্থী-রূপে আর পাঠিকার নিজেকে সুমিত্রার আসনে বসিয়ে সম্ভাব্য বরের কল্পনায় হারিয়ে যেতে বাধা নেই। মাত্র দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে সুমিত্রার মনও কিছুটা জানা হয়ে যায় পাঠকের; নিজের দৃঢ় শারীরিক গঠনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণভাবে সে (বিবাহযোগ্যা সুন্দরী অষ্টাদশীকে নিশ্চই কেউই ‘আপনি/ আজ্ঞে’-র অপরিচয়ের দূরত্বে স্থাপন করতে চাইবে না) কিছু দৃঢ়মনাও বটে। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো ‘মোমের পুতুল’ তার না পসন্দ। 

গল্পের অনির্ণীত প্রেক্ষাপট, সুমিত্রার দেশ-কাল কিছু স্পষ্ট হয় সামান্য পরেই; তক্ষশীলা, শক বংশ। কুতুহলি পাঠক মানচিত্রে তক্ষশীলার অবস্থান নির্ণয়ে না দৌড়েও নিশ্চই বুঝতে পারবে, এ নিছক ঘরের কথা নয়। নিছক রূপকথা বাদ দিলে ঘরের কথা নিয়েই এতকাল ঐতিহাসিক উপন্যাস জমিয়েছেন বঙ্কিম থেকে রাখালদাস। পাশাপাশি এ কথাও নিশ্চই শরদিন্দুকে মাথায় রাখতে হয়েছে, সুমিত্রার মত রাজকন্যা ঠিক বাঙালির ঘরে লভ্য নয়। আবার রূপকথার গল্পই হোক বা ইতিহাস, দৃঢ় রাজকুমারী চরিত্র-ই বা কোথায়। দুর্গেশনন্দিনী-তে আয়েষা বা দেবী চৌধুরানির ঐতিহাসিকতায়, নারী চরিত্রকে খুব বেশিদূর কল্পনাশ্রয়ী করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু যে পথ তাঁর সাহিত্যগুরু (শরদিন্দু, বঙ্কিমচন্দ্রকে তাঁর সাহিত্যগুরু হিসেবে বারে বারে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে) দেখিয়ে গেছেন, তা নিয়ে কিছুদূর নাড়াচাড়া করার ইচ্ছা নিশ্চই শরদিন্দুর ছিল। আবার ‘শূদ্রই হোক আর চণ্ডালই হোক’ বীর্যবত্তাকেই বরণ করার আকাঙ্খাও যে কখনই বাঙালি-কন্যা সুলভ হত না সে বুঝতেও সমাজ-মনস্তত্বে পণ্ডিত শরদিন্দুর ভুল হবার কথা নয়। সব মিলিয়ে রাজকুমারী সুমিত্রাকে শক-কন্যা হিসাবে উপস্থাপনা, শরদিন্দুর কাহিনী নির্মানের মুন্সিয়ানাকে চমৎকার ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি শরদিন্দু মানস যে উনিশ শতকী উদার ‘হিউম্যানিজম’-এ ঋদ্ধ; জাতি ধর্ম বর্ণগত বাধা যে মিলনের উদার কল্পনায় ব্যাহত হতে পারে না, সে কথাটুকুও সূক্ষাকারে পাঠক মানসে তুলে ধরা হয়তো শরদিন্দুর সচেতন পরিকল্পনাতেই ছিল। ‘সেকালে শুদ্রকে কেউ এত ঘৃণা করত না-’ এই বক্তব্য সর্বৈব ইতিহাসহাস সম্মত না হলেও, নতুন যুগে যে তাই হওয়া উচিত, প্রয়োজনে ইতিহাসকেও যে নতুন করে ‘রচনা’ করা উচিত, এমন ভাবনা শরদিন্দু যে ভাবেননি, সে কথা তাঁর সামগ্রিক রচনাবলির নিরিখে জোর করে বলা যায় না। বক্তব্যের সমর্থনে যে যুক্তি তার পরের পংক্তিতেই আছে, তা অপরিপক্ক পাশ্চাত্য-ভাবাপন্ন ‘আধুনিক’দেরও হয়তো স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। 

শরদিন্দুর কাহিনির গতি সর্বদাই আপাত ধীর। ছোটগল্পের সামান্য পরিসরেও স্থান কাল প্রেক্ষিত উপস্থাপিত হয় স্পষ্টভাবে। তারপর কুমারী সুমিত্রা চিত্রণে কিছু নতুন বর্ণ যোজনা ঘটে। তাঁর স্বয়ম্বর ঘোষণা হয়। ‘বাহুবল, হৃদয়বল আর বুদ্ধিবল’ যে তার কাছে সমান বিবেচ্য, তা পানিপ্রার্থীদের পাশাপাশি জানতে পারে পাঠকও। এই ত্রিস্তরী ইউরোপীয় ‘হিউম্যানিজম’, সে যুগের শক কন্যাকে সূচিত করে কি না, ‘ইতিহাস’ এত বিস্তৃত খবর দেয় না, পাঠকের কিন্তু ‘আধুনিক’ এক ভাবনার ‘ইতিহাসায়ন’ নিয়ে মজে যেতে বাধা থাকে না। 

কাহিনির নামকরণ থেকে কাহিনীর কেন্দ্রিয় চরিত্র যে নারী সে কথা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। সে চরিত্রে পাঠককে কিছুদূর নিমজ্জিত করে নতুন চরিত্রের উপস্থাপনা। আম পাঠকের মন কেন্দ্রিয় কাহিনিতে এতদূর মজ্জিত থাকে যে, সে হয়তো খেয়াল করে না, আসলে দুটি নতুন চরিত্র উপস্থাপিত হয় প্রায় একই সঙ্গে। মকরকেতু রাজ্যের একজন সেনানী। পাঠক যেন বেখেয়াল না হন ‘মকরকেতু’ কার নাম এবং কী তার বৈশিষ্ট্য। মকরকেতুর চরিত্র এবং সেই চরিত্র বর্ণনায় কিছু বেশি মনোযোগ থেকে, পাঠক তাঁর সম্ভাবনা নিয়ে কিছু কল্পনার সুযোগ নিতেই পারেন। মকরকেতু কেবল যে বিশালদেহী যুবা তাই নয়, সভায় আগন্তুকের উপস্থিতি এবং মকরকেতুর প্রতিক্রিয়া থেকে পাঠক তাঁর অতিপ্রতিক্রিয়ার কারণ আন্দাজ করে না এগোলে, চরিত্রটিকে সামান্য পরিসরেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার অভিসন্ধিটি নষ্ট হয়। 

একই সঙ্গে অন্যতর যে চরিত্রকে আমরা দেখি, সে ধীর প্রবাহী কাহিনীতে প্রায় ঝঞ্ঝা নিয়ে আসে। ছোটগল্পের পরিসরে কাহিনিকে পরিণতির দিকে আকর্ষণের পক্ষে যথেষ্ট সময় পাওয়া গেছে। আগন্তুকের নাটকীয় প্রবেশ এবং ক্রম পরিচয়ে পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে কুমারী সুমিত্রার মনেও যে উত্তেজনার সঞ্চার তা প্রকাশে শরদিন্দুর মুন্সিয়ানা সন্দেহাতীত। কুমারী সুমিত্রার কাছে আগন্তুকের পরিচয় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পাঠকের সঙ্গে তাঁর অপরিচয়ের দূরত্ব শুধু ঘোচে তাই নয়, যুবকের মনস্কামনার সঙ্গে যেন যুক্ত হয়ে যায় পাঠকের প্রার্থনাও। ১৯৩৪-এর ভারতবর্ষের ইতিহাস বাঙালির ক্রম-ম্রিয়মানতার ইতিহাস। সুভাষচন্দ্র ছাড়া তার হাতে বলার মতো কিছু নেই। সেই প্রেক্ষিতে গল্পে ‘বাঙালি’ কুশীলবের প্রবেশে বাঙালি যে নবোদ্যমে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতে চাইবে, তাঁর ‘জয়’ প্রার্থনা করবে আর সেই সূত্রে পাঠক চিত্তে কাহিনীটি অমোঘ হয়ে ঠাঁই নেবে, ততটুকু মনস্তত্বের জ্ঞান শরদিন্দু্র ছিল। বাঙালি পাঠকের কথা ভেবে রচিত গল্পে সুমিত্রা হেন নায়িকার জন্য ছদ্মবেশে যে বাঙালি নায়ককেই আসতে হবে তা প্রায় একপ্রকার নিশ্চিত ছিলই। শরদিন্দু সেই অবশ্যম্ভাবী কল্পনাকে গল্পে বাস্তবায়িত করেছেন। 

‘শক বংশের অনেক ক্ষত্রপ’ যখন ‘ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে রাজত্ব করছিলেন’, তখন ‘আর্যাবর্তের পূর্ব সীমান্তে’, ‘বঙ্গ’ বলে একটি প্রদেশের অস্তিত্ব ইতিহাস-সম্মত হলেও তার রাজা ভাষিক পরিচয়ে ‘বাঙালি’ হয়ে উঠেছিলেন এমন প্রমাণ ইতিহাস দেয় না। পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখা দরকার, শরদিন্দু ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে বসেননি। বঙ্গ দেশের লোকেদের ‘পাখির ভাষা’-র খ্যাতি/অখ্যাতি তখনই দেশে বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে কি না সে চুলচেরা বিচারে পাঠকের কোনো লাভ নেই; বরং বঙ্গ-দূত চণ্ড যখন নিজেদের ভাষাকে কোকিল-কণ্ঠের মধুরতার সঙ্গে তুলনীয় করে, রাজসভার পরিহাসকে সম্মানে পর্যবসিত করে, তখন বাঙালি পাঠক মুঘল যুগ থেকে চলে আসা প্রচলিত পরিহাসের একটা যুতসই জবাব পেয়ে খুশি হয়।

বঙ্গ-দূত চণ্ডের প্রবেশ প্রথমাবধি নায়কোচিত, কিন্তু কখনই অতি-নায়কোচিত নয়। সে যে বীর তার করণ-কৌশল তার প্রমাণ, কিন্তু একাধিক রাজ প্রহরীর সঙ্গে দ্বন্দে সে পরাজিত, বন্দি ও ভূলুণ্ঠিত হয়। তাতে তার শ্লাঘার যে কোনো হানি হয়নি পরক্ষণেই তার করণে বচনে তা পরিস্কার। ‘বন্ধন-মুক্ত হয়ে যখন সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন এই ছিন্নবেশ বিদেশী যুবার চেহারা দেখে কুমারী সুমিত্রার তীব্রজ্জ্বোল চোখদুটি ক্ষণকালের জন্য নত হয়ে পড়ল। তিনি উত্তরীয়টি ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন।’ মধুর রসের আখ্যানে, আদি রসের যে সূক্ষ শালীন প্রকাশ শরদিন্দু রাখেন, তাতে একদিকে যেমন বিভিন্ন বয়সী পাঠক রোমাঞ্চিত হতে বাধ্য, অন্যদিকে কাহিনী রসসিক্ত হতে বাধ্য। সূক্ষাকারে যে প্রতিনায়কের ইঙ্গিত পাঠক মকরকেতুর মধ্যে দেখেন, ক্রমে তার সঙ্গে চণ্ডের মোলাকাত এবং এবং পরিণতি কেবল পাঠককে উল্লসিত করে না, রাজকুমারি সুমিত্রাকেও কিছু প্রভাবিত করে বই কি। 

বাহুবল, বুদ্ধিবলের সমস্ত জটিল পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে সুমিত্রা বীর্য শুল্ক দিয়েই জয় করে নেয় রাজকুমারী সুমিত্রাকে। কিন্তু বনান্তরালের নির্জনতায় যে হৃদয়বলের পরীক্ষা স্বেচ্ছায় দেয় ছিন্নবেশ, রুক্ষকেশ ভিনদেশি যুবা, তার কাছে ‘স্বেচ্ছায়’ ‘আত্মসমর্পণ’ না করে পারে না ‘অহংকারী’ রাজকন্যা। ক্রমে সুমিত্রার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও জানতে পারে, অজ্ঞাতকুলশীল চণ্ড বঙ্গ-কুমার কিছু ‘রসিক’ বটেন। তবে পাঠক নিশ্চই মানবেন, পরিহাসপ্রিয়তা বঙ্গ-কুমারের ছদ্মবেশের একমাত্র কারণ না’ও হতে পারে। ছদ্মবেশের পেছনে একদিকে যেমন কুমারীর হৃদয় জয়ের পর তাঁকে চমকিত করার বাসনা থাকতে পারে যেমন আমরা দেখি আরো বহু রূপকথা এমনকি সাম্প্রতিকতম ব্লক বাস্টার ‘বাহুবলী-২’-তে, তেমন থাকতে পারে স্বদেশ স্বজাতির সম্মান-গৌরবের প্রতি দায়বোধও। ভিনদেশে শেষপর্যন্ত যদি সফল না হওয়া যেত তাতে সাধারণ প্রতিনিধির পরাজয়ের সঙ্গে সমগ্র জাতির কলঙ্কেরর সম্ভাবনা থাকত না। কিন্তু রাজ-পুত্রের পরাজয়ের মধ্যে জাতিগত কলঙ্কের সম্ভাবনা থাকে। পরিচয় গোপন করে যুদ্ধে যোগদান এবং জয়লাভের পর পরিচয় ব্যক্ত করার মধ্যযুগের ইওরোপীয় ধারা থেকে শরদিন্দুও নিজের কাহিনী বিন্যাসকে স্বতন্ত্র করতে পারেননি। কৌশলটি বহুব্যবহৃত হলেও, তার সাফল্য যে নিশ্চিত তা হয়ত বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক শরদিন্দুর ধারণা ছিল। 

তবে কৌশলে কুমারী হৃদয়ের ওপর প্রভাব বিস্তারের অতিনাটকীয় কৌশলটি হয়ত বঙ্গ-কুমারের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। বঙ্গ-কুমাররে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ আর কুমারীর প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিক যে বিবরণ লেখক দিয়েছেন তাতে এ কাহিনী নিছক প্রথম দর্শনে প্রেম। হস্তমুষ্ঠি থেকে মুক্তা আহরণই হোক বা স্বর্ণকলসে শরবিন্ধন- কুমারীর প্রতিক্রিয়ায় ‘আশঙ্কা কি আনন্দ’ লেখক সন্দেহ প্রকাশ করলেও পাঠক বোধ করি করেন না। শেষ পর্যন্ত কুমারকে সুমিত্রার পরীক্ষা যেন আত্মপরীক্ষা দানে পর্যবসিত হয়- তিনি নিজে কুমাররে কতদূর যোগ্য তা নির্ণয়ের পরীক্ষা। 

কাহিনী শেষ পর্যন্ত কাঙ্খিত লক্ষ্যে শেষ হয়। বীর্য শুল্কে কুমার কুমারীকে জয় করেন, না কি আত্মসমর্পণে অহংকার-মুক্ত-কুমারী, চণ্ড-কুমারকে স্নিগ্ধ চন্দ্র-কুমারে পর্যবসিত করেন তা পাঠক নির্ণয় করুক, লেখক সে কথা স্পষ্ট করে রসভঙ্গ করেননি। তবে এ কথা গোপন করতে পারেননি, কাহিনী চিরকালীন পুরুষবাদী, জাতিসত্বাবাদী প্রায়-একরৈখিক শাশ্বত কাহিনী। এ কাহিনীতে অহংকারি কুমারী, কুমারের বির্যবত্তায় ক্রমে দ্রবীভূত হবেন, এ কাহিনিতে ‘বাঙালি কুমার’ (সম্ভবত হিন্দু) শক-কুমারিকে (সম্ভবত জৈন বা বৌদ্ধ) লাভ করতে বীর্যবত্তার সঙ্গে সঙে হৃদয়বত্তায়ও ‘আধুনিক পুরুষ’ হয়ে উঠবেন, এ কাহিনীতে কুমারী বিজিত হওয়ার পরও জয়ী হবার সুযোগ পাবেন (না হয় পুরুষের হৃদয়বত্তা, স্ফূট হবে না)। এ কাহিনী-র ‘পোলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ নিয়ে সমালোচক গূঢ় তত্ব করুন, লেখক পাঠক-চিত্ত জয়ে কোনো তীরই অব্যবহৃত রাখবেন না। তাই পাঠক-চিত্ত জয়ে কাহিনীর সাফল্য নিয়ে পাঠকের আগেই হয়ত লেখক নিশ্চিত ছিলেন। 
0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in

বইঘর


বইয়ের খবর

গ্রন্থকীট



বইয়ের নাম -কলাবতী কথা 
প্রকাশক - আনন্দ 
লেখিকা- ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ হয় শারদীয় সানন্দাতে। আর তারপরই বই আকারে প্রকাশ পায় এই নভেলাটি। 'কলাবতী কথা'। লেখিকা ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, নিয়মিত লেখায় আছেন। তাঁর বিভিন্ন গল্প, রম্যরচনা, ভ্রমণ সাহিত্য, এবং গবেষণাধর্মী লেখা, বাণিজ্যিক ও সবুজপত্র, দুয়েতেই দেখতে পাওয়া যায়। এই উপন্যাসটি প্রধানত একটি আদিবাসী মেয়ের পাওয়া না পাওয়ার কাহিনী হিসেবে আঁকা হলেও উপন্যাসের মূল চরিত্র হলো আদিবাসী সমাজের বহুবর্ষব্যাপী অত্যাচার ও অবিচারের শিকার হয়ে থাকা এবং তা থেকে একটি উত্তরণ। উড্ডীন হওয়া সেই স্বপ্নে, যা দেখতে চাওয়া তাদের কাছে অপরাধের সমান । অথচ, আমরা অস্বীকার করলেও সত্যিটা মিথ্যে হয়না। বাংলার প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি-সঙ্গীত-শিল্পকলা এইসব ভূমিপুত্র ও ভূমিকন্যাদের দান।

এদের অস্পৃশ্য দলিত বলে দেগে দেয় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নিষ্ঠুর ক্ষমতার ব্যবহার। আমরা ভুলতে বসেছি যে, নাগরিক সভ্যতায় মুখ- ঢেকে- রাখা আমরা এক অতি সম্পন্ন সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করি। 

গল্প শুরু হয় লতু বা লতিকা নামক প্রান্তিক মানুষটির জীবন সংগ্রাম দিয়ে। যার পুত্রবধূ কনক একজন শিল্পী। পটচিত্র আঁকায় পারদর্শী সে। আস্তে আস্তে সে শিখে নেয় পটের সঙ্গে পটকথা গাওয়া। এও যেন তার সহজাত। 

"মনসা জগতে গৌরী জয় বিষহরি, পদ্মফুলে জন্ম মা তোর মনসা কুমারী" 

কনক গিয়েছে কুরুম্ভেরায়। মেলায় বাংলার গ্রামীণ শিল্পের বেসাতি। সেই বেসাতিতে আদিবাসী মেয়ে কলাবতীও পণ্য হয়ে যায়। কনকের অসীম সাহস আমরা দেখতে পাই। 

কলাবতীর নিজের ছোট্ট আকাশ থেকে বিশ্বময় উড়ে যাওয়ার গল্প কলাবতী কথা। 

এই প্রথম যেন একটি মেয়ে সামাজিক অনুশাসনকে তুচ্ছ করে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত হতে দেখল। নারীর যৌনতার অধিকারও সেখানে ডানা মেলল। 

এই যাপনে এক থেকে আরেক নারীর আশ্রয় শেষ পর্যন্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় মুক্তির। পুরুষের ভূমিকা অনেকটা সাইডকিকের মতো। 

কলাবতী একাই এক ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের হয়ে প্রতিষ্ঠা কেড়ে আনে প্রথম বিশ্ব থেকে। 

এ উপন্যাস উদযাপনের। নারীর অধিকার, শিল্পের অধিকার, অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অধিকার, আর সর্বশেষে আপনমনে বাঁচার অধিকারের। 

*******************************

বইয়ের নাম – বাজার সরকারের ডায়েরি
লেখক- বিজনকুমার ঘোষ
প্রকাশক – লালমাটি
বিনিময় মূল্য – ১০০ টাকা।

১৯৯০ এর ৩১ ডিসেম্বর থেকে প্রতি সোমবার আনন্দবাজার পত্রিকা তে প্রকাশিত হতো ‘বাজার সরকারের ডায়েরি।’ এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মানুষ দেখা। বাজারে-হাটে বিচিত্র মানুষ দর্শন। অথবা, বাজার ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। আর, একই সঙ্গে বাজারের খবরও দিয়ে চলা। ঠাকুরনগরের ফুলবাজার। বনগাঁ লাইনে। সেখানকার ফুলের দামের খবর পাবেন। বেহালার ঘোলসাহাপুর বাজারের খবর দেওয়ার আগে বাজার সরকার আপনাকে জানাবেন নেশার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের আন্দোলনের কথা। সত্যেন বোস, স্বামীজি, ঈশ্বরচন্দ্র, নকশালবাড়ি, শঙ্খচূড় ও বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পাগল... কী নেই বাজার সরকারের থলিতে? লেখক পরিষ্কার জানাচ্ছেন, ‘একটা সময় ছিল যখন খদ্দেরকে লক্ষ্মী বলা হতো। সে সব দিন চলে গেছে। ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ যখন সমাজের সর্ব স্তরে কর্পূরের মতো উবে যাবার অপেক্ষায়, তখন বিকিকিনির হাটেই বা তা কেন টিকে থাকবে?’ ১৯৯২ সালে লেখা লাইনগুলো আজও কী প্রাসঙ্গিক, তাই না? কেরানিতন্ত্রের আস্ফালন আমাদের সকলেরই খুব চেনা। বাজার সরকার এ বিষয়ে একটা গল্প বলেছেন। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি এক সময়ের কথা। সাদামাটা চেহারার এক বৃদ্ধ রেশন কার্ডের অফিসের কাউন্টারে গিয়ে একটা ফর্ম জমা দিলেন। ছোকরা কেরানির জিভ চুলবুলিয়ে উঠল।

- বলি বয়েস তো অনেক হলো, ‘শ্রী’ বানানটাও ইংরিজিতে শুদ্ধ করে লিখতে শেখেননি?

- আজ্ঞে, ওটা ‘শ্রী’ নয়, স্যর। আমার নাম স্যর যদুনাথ সরকার।

অলমিতি বিস্তারেণ। বইটা কিনে পড়ে ফেলুন।

************************************

বইয়ের নাম – সুবর্ণরেখা
কবি- শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক – ধানসিড়িটির তীরে
বিনিময় মূল্য – ১০০ টাকা।

কবিতায় সমাহিত এই বইয়ের কবি। কবিতার ডাকে রোজ মরার ছাইয়ের গাদা থেকে ফিনিক্স হয়ে তিনি ডানা মেলেন আকাশে।

তোমার জন্য আকাশ জমিন সব একাকার,
তোমার জন্য ডানায় অচিন ওড়ার নেশা...
তোমার জন্য কন্ঠীবদল বাউল ফকির,
তোমার জন্য হারিয়ে যাওয়া ধোঁয়ায় মেশা।
কবিতাকে কবি সব দিতে পারেন। কবিতাই প্রেম হয়ে ওঠে।
খুনসুটি আর রোজনামচার
চলতি খাতা,
আখরমালার জমাট বাঁধন
তোমায় দিলাম
এই জীবনের পুঞ্জীভূত
হাসির উজান,
ইতিহাসের হলুদ কাগজ
তোমায় দিলাম।

এই হলুদ কাগজটা দিয়েছেন বলেই কবি জানেন যে জঙ্গলমহলের টিয়ারা বড় কষ্টে আছে। লাশ হওয়া কন্যের জন্য গলা ফাটানো পৃথিবী যে আদতে বদলাবে না, সে কথা বোঝেন। বারুদের গন্ধ বুকে নেওয়া শিশুটির আঁতের কথা অনুভব করেন। তবু, শেষ পর্যন্ত কবি নতজানু অনাবিল জীবনের সখ্যের কাছে।

বন্ধু শুধু সাড়া দেয় বন্ধুত্বের মনকাড়া গানে
তখন হঠাৎ হাজার সূর্যের আলো ক্রমশ উদ্ভাস
সহসা এ পৃথিবীকে নির্দ্বিধায় বেশি করে ভালবাসা যায়।

অতি অবশ্য সংগ্রহে রাখুন এই বই।