0

সম্পাদকীয়

Posted in



































সম্প্রতি ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ হল মেয়েদের ক্রিকেট খেলায়। ইতিপূর্বে তীরে এসে তরী ডোবার ঘটনা স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে রাখলেও এবারের শাপমুক্তি আসমুদ্র হিমাচলকে জুড়ে দিয়েছে এক অদৃশ্য আনন্দবন্ধনে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে সেমিফাইনালের আগে এই গণজাগরণ ছিল অনেকটাই স্তিমিত।

বিষয়টি একাধিক কারণেই আহ্লাদের। প্রথমত ক্রিকেট বিশ্বের দৈত্য অস্ট্রেলিয়াকে সেমিফাইনালে হারানো এবং ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে কার্যত দর্শকে পরিণত করে বিজয়ী হওয়া সহজ ছিল না। দ্বিতীয়ত, ভারতের মতো একটি দেশে, যেখানে সংবিধান নারী পুরুষের সম মর্যাদার কথা বললেও সামাজিক স্তরে তার যথার্থ প্রতিফলন চোখে পড়ে না আজও, সেখানে এই জয়ের গুরুত্ব অসীম।

এতদূর পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। গোল বাধল বিজয়োৎসবের একটি বিশেষ মুহূর্তকে ঘিরে। মাঠের মধ্যে, পুরস্কার মঞ্চের কাছে জেমাইমা রডরিগস্ শুয়ে। পা দুটি তাঁর প্রসারিত। হাতদুটি মাথার ওপরে। এক আশ্চর্য প্রশান্তি তাঁর সর্বাঙ্গে আর তাঁর সতীর্থরা পুষ্পবৃষ্টি করছেন তাঁর ওপরে মেরি গো রাউন্ডের ভঙ্গিমায়। আজীবন ফ্রেম করে রেখে দেওয়ার মতো একটি দৃশ্য।

এক্ষেত্রে অনেকের প্রতিক্রিয়া হল বিপরীত। সমাজের এই স্বনিযুক্ত অভিভাবকরা মনে করলেন জেমাইমার উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভঙ্গিটি অতি কদর্য, অন্যদের প্রতি অতি নোংরা এক দৃষ্টান্ত!

এই যে দেখার চোখ, এটি তো যেকোনও সভ্য মানুষের এক অর্জন আর এখানেই ঘটে যায় যাবতীয় পার্থক্য। এই চোখের অসৌজন্যেই হস্তিনাপুরের এক পাশা খেলার আসরে পরাজিত হয়ে তাঁর সহধর্মিণীকে পণ রেখেছিলেন এক পুরুষ আর আজকের ভারতবর্ষে নেশাতুর এক স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পণ রেখে জুয়ায় হারলেন এবং সেই রমণী হলেন গণধর্ষিতা। তাঁরই প্রিয়জনের দ্বারা। কৃষ্ণার মর্যাদা বাঁচাতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের দুখিনী মেয়েটিকে এই ভয়াবহ নিগ্রহ থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি কেউই।

জেমাইমার উদ্‌যাপনের ভঙ্গিটির সমালোচকদের মননভূমিতে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে যে ধর্ষককূল, ভারতের বিজয়োল্লাসে সেদিন সামিল হয়েছিল তারাও। এমন ভাবা হলে তা অসঙ্গত হবে না।

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সোমা দত্ত

Posted in




আমার এক বোন ছিল যে খুব ছোটবেলায় অকারণে মিথ্যা কথা বলত। সেইসব মিথ্যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল খুব দুঃখজনক কোনো একটি বর্ণনা যেমন মা ছেড়ে চলে গেছে বা বাবা-মা সেপারেটেড এইরকম ধরনের। অনেক পরে আমরা তার এই মিথ্যা বলার প্রবৃত্তি টের পাই। আবার আমার এক বন্ধু ছিল যে খামোকাই আকাশ কুসুম মিথ্যা বলত যেটা আমরা উপভোগ করতাম। যেমন সে হয়তো বলল তার বাবা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিটিং এ ব্যস্ত আজ তাই তাকে নিতে আসবে না স্কুলে। আমরা খুব হাসলাম শুনে হয়তো। কোনো কোনো বন্ধু আবার পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর মিথ্যেই বাড়িয়ে বলত। বন্ধু শুধু কেন বন্ধুর মা-ও হয়তো বলল। এমনকি আমি নিজেও মফসসলের নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মে একটু দামী ইস্কুলে পড়ার জন্য আমাদের বাড়িতে টেপ রেকর্ডার না থাকাকালীন সময়ে বন্ধুদের মিথ্যে বলতাম যে আছে। একটু বড় হয়ে বাড়িতে মিথ্যে বলে বন্ধুদের সঙ্গে এদিক ওদিক যাওয়া ইত্যাদি তো আছেই। এইসব ছোটখাটো মিথ্যের সঙ্গে বড় হওয়ার অনেক পরে আমরা জানলাম মিথ্যে বলা একটি অসুখ। আর খুব ছোটবেলায় ‘কদাপি মিথ্যা বলিবে না’ পড়ার সময় আমরা জেনেই গেছিলাম যে ওটি অতি পুরাতন বিদ্যাসাগরীয় রীতি যার কিছুই আর ভ্যালিড নয়। তো যখন জানলাম মিথ্যা বলা একটি অসুখ তখন পাশাপাশি এটিও জানলাম যে সেইসব অসুখ হওয়া মিথ্যাগুলো অন্য, আমাদেরগুলো নয়। এবার এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ বিষয় কিন্তু মিথ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য কারণ অপরাধ যেমন ছোট থেকেই বড় হয় এবং অন্যান্য অনেক অভ্যাস এবং পরিবেশের মাধ্যমে জিনগত ভাবে রেপ্লিকেট করে তেমনি মিথ্যা বলার প্রবণতাও একইরকমভাবে এগোতেই পারে। অর্ধেকের উপর মিথ্যেকে আমরা আগে থেকেই বৈধতা দিয়ে রাখি জীবনে। এখানেই একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয় যে কোন কোন মিথ্যা তাহলে বৈধ? যেমন হোয়াইট লাইস বলে একটা প্রচলিত কথা আছে। যে মিথ্যায় কারো ক্ষতি হয় না বিশেষ করে হয়তো মঙ্গলই সাধন হয় তাকে বলা হয় ধরে নেওয়া যেতে পারে। এবার এইসব সফেদ শুদ্ধ মিথ্যা একজনের জন্য মঙ্গলদায়ক হলে যে আরেকজনের জন্য হবে সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। অশ্বত্থামা হত ইতি গজ এক পক্ষের জন্য মঙ্গলদায়ক হলেও অন্যপক্ষের জন্য ক্ষতি। বৃহত্তর স্বার্থের জন্য কোন ক্ষতিকে স্বীকার করা হবে তার কি কোনো প্রামাণ্য তালিকা আছে না থাকতে পারে। কতগুলো সাধারণ ঘটনা নিয়েই যদি ভাবি তাহলে কিছু উদাহরণ লাগবে। যেমন-

ঘটনা ১- এক উচ্চপদস্থ প্রাইভেট কোম্পানির বিপণন বিভাগের প্রোডাক্ট ম্যানেজার একজন ক্লায়েন্টকে নিজেদের প্রোডাক্ট সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন। উপস্থিত রয়েছেন কোম্পানির বিপণন বিভাগের কিছু শিক্ষানবিশ এবং বিপণন বিভাগের দায়িত্বে থাকা অন্যান্য জুনিয়র কয়েকজন। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের প্রস্তুতকারক ফর্মুলায় তৈরি বস্তুর গুণমান সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত ব্যাখা করছিলেন। কিন্তু বলার সময় অনেক অতিরিক্ত গুণের উল্লেখ করছিলেন যা আদপেই সত্য নয়। ক্লায়েন্ট চলে যাওয়ার পর একজন শিক্ষানবিশ সাহস সঞ্চয় করে এই ভুল ব্যাখার কারণ জানতে চাইলে ম্যানেজার বললেন ওটুকু বলতে হয়। এভাবেই বলবে।

ঘটনা ২- মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। ছেলের বাবা ছেলের রোজগার এবং পড়াশুনা সম্পর্কে কথা বলছেন ভাবি বেয়াই এর সঙ্গে। যা বলছেন বেশ খানিক বাড়িয়ে বলছেন। কথা সম্পূর্ণ হওয়ার পর ছেলেটির বোন এসে তার বাবার কাছে জানতে চাইল ওই অতিরঞ্জিত গুণগ্রাহিতার কারণ। বাবা বললেন, ওরকম বলতে হয়।

ঘটনা ৩ – বায়োডেটা তৈরি করার সময় সিনিয়র দাদা জুনিয়র বোনকে বলল কয়েক টেকনিকাল নলেজ এক্সট্রা লিখে দিলাম। বোন বলল আমি বিষয়গুলো জানিনা। দাদা বলল, না জানলেও চলবে কিন্তু এগুলো না লিখলে চাকরি হবে না। ওরকম একটু লিখতে হয়।

ঘটনা ৪ – অমিয়বাবু নিজের এপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ডকে প্রায়ই ব্যক্তিগত কাজে দোকানে পাঠান। বিনিময়ে তাকে বকসিস দেন দশ কুড়ি টাকা। একজন বাসিন্দা খবর পেয়ে সরাসরি অমিয়বাবুকে জিগ্যাসা করলে তিনি সত্য অস্বীকার করলেন। তার নাতি তাকে বলল, দাদু কেন মিথ্যে বললে? অমিয়বাবু বললেন প্রয়োজনে ওরকম একটু বলতে হয়।

ঘটনা ৫ – নতুন রান্নার লোক রাখছেন অমৃতা। বললেন পরিবারে তিনজন লোকের দুবেলার রান্না করতে হবে। একটা সবজি আর মাছ। কাজের লোক দ্বিগুণ মাইনে চাইল। দোনামনা করে হলেও রাজি হলেন অমৃতা। লোক চলে যাওয়ার পর শাশুড়ি বললেন তুমি এত কমিয়ে রান্নার কথা বললে কেন? আমাদের তো তিন চাররকম পদ হয়। এছাড়া সকালের খাবার তৈরি করতে হয়। অমৃতা বললেন ওসব ওরকমই বলতে হয়। পরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজ করিয়ে নেবক্ষণে।

এই যে ঘটনাগুলোর উদাহরণ এলো সেগুলো খুব নির্বিষ ধরনের বা খুবই নিরীহ ধরনের উদাহরণ। এই যে ছোট একটি কথা ওরকম বলতে হয় এর উপর নির্ভর করে আসলে ছোট থেকে শুরু করে যেকোনো বড় অপরাধও সংঘটিত হয়ে যায়। আমরা ভাবি আমরা তো অপরাধ করি না। আমরা সুশিক্ষিত, মার্জিত। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাই। কিন্তু আমরা জানিনা আমরা আসলে তা করি না। খুব সূক্ষ্মভাবে ভাবলেই দেখা যাবে অপঘাতে মৃত্যু হয় সত্যের কী অবলীলায়। সহজ করমর্দন করি আমরা বন্ধুর সঙ্গে মিথ্যা দিয়েই। নিজেকে কৈফয়ত দিই এমনই বলতে হয়। মিথ্যার সঙ্গে সহবাস করি অথচ কী অদ্ভুতভাবে তাকে বৈধতা প্রদান করি। মানুষ সাধারণভাবে নিজের রোজগার নিয়ে মিথ্যা বলে তাকে স্বাভাবিক মনে করে। নিজের অর্থনৈতিক উদারতার অভাবকে ঢাকতে মিথ্যা হিসেব নিকেশ নিয়ে মিথ্যা বলে। তারাই আবার অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলে। বড় হোটেলে খাওয়ার পরে টিপস দেয় দেড়শো টাকা কিন্তু বাইরে যে দারোয়ান মাথায় ছাতা ধরে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় তাকে দেয় দশটাকা। আইনক্সে সিনেমা দেখে পপকর্ণ খেয়ে নষ্ট করে দু’হাজার টাকা বাজারে পেঁপে কিনতে গিয়ে দরদস্তুর করে। এ এক বিচিত্র সভ্যতা যা আসলে অসভ্যতাকেই কোয়ালিফাই করে এগোয় প্রতিমুহূর্তে। ভালোমানুষেরা মিথ্যে বলার সময় তাকে সত্য বলে প্রতীয়মান করতে যৌক্তিকতার আশ্রয় নেন। মিথ্যেকে সত্যি করে তোলার অস্বস্তি তাকে আরও বেশি মিথ্যাবাদী করে তোলে। তবু কেন যে সত্যবাদী হওয়ার দাবি করি। আমরা কেন যে বুঝিনা আমরা খেলাঘরের পুতুলের মতো। ভিডিও গেমের প্রোগামের মতো। আমাদের চলাচল, আমাদের রীতি, অভ্যাস, সত্য মিথ্যা সব জড়িয়ে পেঁচিয়ে এক করে ফেললেও সে-সবই পূর্ব নির্দিষ্ট। আমাদের এরকম আর ওরকমের মাঝে একটা মস্ত বড় বাঁচার লড়াই থাকে। সেই লড়াই স্তরে স্তরে সভ্যতার সেই আদিম যুগ থেকে বাড়ছে। যত বাড়ছে তত জটিল হচ্ছে। যত জটিল হচ্ছে তত মিশিয়ে ফেলছে সত্য অসত্য। আমরা জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত হয়ে চলেছি। আমাদের নিউরোট্রান্সমিটার ভাষা পরিবর্তন করছে। একজন ব্যক্তির অবিচ্ছিন্নভাবে মিথ্যা বলার অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতাকে মিথোম্যানিয়া বলে। এটা এক ধরনের প্যাথোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। মিথোম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেকে নায়কের মতো দেখানোর জন্য এবং তাদের আশেপাশের লোকেদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা বা সহানুভূতি অর্জনের জন্য মিথ্যা বলে। মিথোম্যানিয়াকরা হয়তো বুঝতে পারে না যে তারা মিথ্যা বলছে এবং বিশ্বাস করে যে তারা তাদের কল্পনা দিয়ে যে চিন্তাভাবনা তৈরি করে তা বাস্তব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এইরকম মিথ্যা কথা বলা মানুষগুলো নিজেকেও মিথ্যাটা বলে। অর্থাৎ মিথ্যার প্রতি একটা বিশ্বাস তৈরি করে তাকে সত্য বানানোর প্রচেষ্টা চলে তাদের মধ্যে। পরিস্থিতির প্রভাবে যে মিথ্যেগুলো আমরা সাধারণত বলে থাকি সেগুলিকে সাদা মিথ্যে বলা যেতে পারে। মিথোম্যানিয়াকদের এইসব মিথ্যা হোয়াইট লাইজ বা সাদা মিথ্যার অন্তর্গত নয়। মনোবিজ্ঞানিদের মতে প্রত্যেক মানুষই দিনে একটি কি দুটো সাদা মিথ্যে বলে থাকে। যা মূলত প্রয়োজনে বলা হয় অর্থাৎ যার কোনো সদর্থক ভূমিকা থাকতে পারে। এই সদর্থক ভূমিকা কথাটিও বেশ গোলমেলে। কারণ যেকোনো বিষয়ে সদর্থক ভূমিকা ব্যক্তিসাপেক্ষে বদলে যেতে পারে। অর্থাৎ যাকে হোয়াইট লাইজ বলা হচ্ছে তা সর্বজনস্বীকৃতভাবে হোয়াইট নাও হতে পারে। যেমন যদি মনের রোগের কথাই ভাবি তাহলে বলা হয়, মিথোম্যানিয়ার মতো প্রায় একই রকম একটি মানসিক সমস্যা কনফ্যাবুলেশন। এতে দেখা যায় ব্যক্তি বাস্তব ঘটনার পরিবর্তে কিছু কাল্পনিক বা বিকৃত গল্প তৈরি করে যার প্রভাব খারাপ ভালো দুই-ই হতে পারে। ব্যক্তি সেই খারাপ বা ভালো সম্পর্কে কোনো সচেতনতা বহন করে না। মনোবিজ্ঞানিরা বলছেন যে এই ধরনের সমস্যাগুলো অন্য অনেক মানসিক রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যেমন ডিমেনশিয়া বা কোরসাকফ সিন্ড্রোম। এইরকম তথ্য খুঁজে যদি মিথ্যাকে প্যাথোলজিক্যালি কাঁটা ছেঁড়া করা হয় তাহলে অনেক ব্যাধি, অনেক উপসর্গ এবং সে-সবের অগুনতি উদাহরণ বেরোবে। কিন্তু যা সামনে আসবে না তা হলো সাদা মিথ্যের সঙ্গে মিশে থাকা ধূসরতা। এই ধূসরতা একটি অস্পষ্ট অবস্থার দিকে আঙুল তোলে যা সত্য এবং মিথ্যে দুটিকেই একাধারে ঘোলাটে করে তুলছে যুগের চলনের সঙ্গে সঙ্গে। এমন নয় যে এর উদ্ভব খুব সম্প্রতি হয়েছে। এই ধূসরতা রয়েছে পৌরাণিক কাল থেকেই। মিথ থেকেই এসেছে মিথ্যা। দেব দেবীর ম্যাজিক, তাদের তুষ্ট করে পাওয়া অলৌকিক ক্ষমতা কী মিথ্যা নয়? গল্প উপন্যাসের মিথ্যা সর্বজনস্বীকৃত মিথ্যা। কিন্তু তার মধ্যেও ভাগ রয়েছে। কল্পনাকে রূপায়িত করে লেখা উপন্যাস আর কাল্পনিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে তোলা বিশ্বাস এক নয়। উপন্যাস ঘোষণাপূর্বক কাল্পনিক। কিন্তু পুরান বা পৌরাণিক বিশ্বাস, ভগবানের লীলাখেলার কাল্পনিক গল্প ঘোষণাপূর্বক কাল্পনিক নয়। এখানে বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে এবং মিথ থেকে আসা সেইসব মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করবার জন্য অজস্র মিথ্যা বলে। মনোবিজ্ঞান এই মিথ্যাকে কীভাবে ব্যাখা করে? মেসিয়াহ কমপ্লেক্স বা নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে দেবত্ব আরোপ করাও একধরনের বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। কিন্তু সাধারণভাবে এই অন্ধত্ব দেখা যাওয়ার আগে পর্যন্ত সেটিকে স্বাভাবিক মনে করা হয়। তাহলে এরপর স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। অর্থাৎ কোন কোন প্যারামিটারের উপর ভিত্তি করে আপনি কাউকে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বলবেন? ধর্মন্মোত্ত মানুষ কি স্বাভাবিক? ধর্মন্মোত্ততার চূড়ান্ত নিদর্শন পাওয়ার আগে পর্যন্ত কি তাকে আপনি অস্বাভাবিক বলবেন? যুক্তি তর্কের বাইরে গিয়ে কাল্পনিক হয়ে ওঠার পরেও তার গ্রহণযোগ্যতা বৈধ থাকে কেন? ছোটবেলা থেকে শিশুকে বিশ্বাস অর্থে ঈশ্বর সম্পর্কিত অবাস্তব কাল্পনিক কাহিনি শোনানো হয় কেন? প্রফেসর শঙ্কু যদি কাল্পনিক চরিত্র হন তবে দুর্বাশা কেন কাল্পনিক নন? পাগলা দাশুর মিথ্যা যদি মিথ্যা হয় তবে হনুমানের পাহাড় তুলে নিয়ে আসার কাহিনি কেন কাল্পনিক নয়? এবং পৌরাণিক দেবতাদের এইসব কীর্তিকলাপকে নাল অ্যান্ড ভয়েড করে তুললে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষদের ধর্মন্মোত্ত ব্যবহার কেন মানসিক সমস্যা নয়? সত্যজিত ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে এর অনেকখানি চর্চা রয়েছে। চর্চা হয়তো আরও অনেক রয়েছে এই বিষয়ে কিন্তু মিথ্যে অলক্ষ্যে সত্যিতে পরিণত হচ্ছে আধুনিক সভ্যতাতে। যদি এইসমস্ত অলৌকিক বিশ্বাসকে বহন করে নিয়ে চলা হোয়াইট লাইজ হয় তাহলে জনৈক মিথোম্যানিয়াকের মিথ্যাই বা সাদা নয় কেন? এরপরে আসে রাজনৈতিক মিথ্যা। তারপরে রয়েছে সামাজিক মিথ্যা যার মধ্যে খানিকটা ওই বিশ্বাসের বিষয়টাও মিশে আছে। প্রতি মুহূর্তে মিথ্যা বলা হয় এবং তাকে বৈধতা দেওয়া হয়। সে মিথ্যে নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাকে যুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক ঘোষণা করা হয় এমনকি যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলেও তাকে মানসিক ব্যাধির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় না। কেন অকারণ মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতে বলা হয় ‘ওরকম বলতে হয়।’ কেন সাদা মিথ্যার মধ্যে থাকা ধূসর অংশকে ব্যাখা করা হয় না? হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন ‘কারণে মিথ্যা বলার চেয়ে অকারণে মিথ্যা বলতে মানুষ বেশি পছন্দ করে’। সে তো করেই কিন্তু সেই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যত মিথ্যা বলা হয় সে আরও জটিল প্রক্রিয়া। আসলে আমরা একটি প্যাথোলজিক্যাল মিথ্যার অভ্যাসকে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করে চলেছি প্রতিমুহূর্তে একথা বলতে বাধা কই? জিনগতভাবে আমরা প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তুলছি স্বাভাবিক মিথ্যা বলার অভ্যাসে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in




















বন্দে মাতরম্ – মাতৃবন্দনার এই সুবিখ্যাত স্তবগীতি, যা গত প্রায় দেড়শো বছর ধরে ভারতীয়দের উদ্বুদ্ধ এবং ভাববেগে আন্দোলিত করেছে, তার রচয়িতা যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সে তথ্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, বন্দে মাতরম-এর সুরস্রষ্টা কে, তবে একটু ভাবতে এবং জানতে হবে।


এক কথায়, বন্দে মাতরম্ শতাধিক বার সুরারোপিত হয়েছে। এবং অনেক সুরকারেরই পরিচয় অজ্ঞাত।


তাহলে প্রশ্ন ওঠে প্রথম কে সেই সুরকার যিনি এই স্তবগাথাকে গানে পর্যবসিত করেন ?


এ কথা সকলেই জানেন যে বন্দে মাতরম্ বঙ্কিমের আনন্দমঠ উপন্যাসে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। আনন্দমঠ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যা (মার্চ, ১৮৮০) থেকে শুরু করে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা (জুন, ১৮৮২) পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়। প্রথম মাসেই বন্দে মাতরম্ প্রকাশ পায়। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় শেষ কিস্তি প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পরই ১৮৮২ সালে পুস্তকাকারে আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়।


বন্দে মাতরম্ কিন্তু আনন্দমঠে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বেশ কিছু বছর, অন্তত চার-পাঁচ বছর, আগেই রচিত হয়েছিল। কবে এবং কোথায়, তা নিয়ে কিছু মতভেদ ছিল। বহরমপুর, লালগোলা, চুঁচুড়া, বারাসত ইত্যাদি স্থান দাবীদার হলেও, এখন মোটামুটি স্বীকৃত যে ১৮৭৫-৭৬ সালে প্রায় আট মাস তাঁর কাঁটালপাড়ার বাড়ীতে অবস্থান কালে কোন এক সময়ে বঙ্কিম বন্দে মাতরম্ রচনা করেন। চুঁচুড়াবাসী নবজীবন পত্রিকা সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁর ‘বঙ্কিম প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে কাঁটালপাড়ায় অবকাশযাপন করার সময়ে বঙ্কিম বন্দে মাতরম্ লিখেছিলেন বলে তিনি শুনেছিলেন, এবং পরে চুঁচুড়ায় অবস্থানের সময়ে বঙ্কিমকে তিনি বন্দে মাতরম্-এর কিছু অদল-বদল করতেও দেখেছেন। ১৮৭৪ সালে কোন একটি শীতের সকালে বন্ধুদের সকাশে আলাপরত বঙ্কিম সহসা, ‘আমি এখন জাতীয় গান রচনা করতে যাচ্ছি’, এই বলে ঘরে ঢুকে বন্দে মাতরম্ লিখে ফেললেন, এমন সব কাহিনি প্রচলিত থাকলেও তাদের পক্ষে জুতসই সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। প্রধাণত গল্প, উপন্যাস, প্রহসনের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র কেন বাংলা হরফে অধিকাংশ সংস্কৃত আর মাত্র কিছু বাংলা বাক্য মিশিয়ে এমন একটি গাথা রচনা করলেন, এবং এত বছর তাকে অপ্রকাশিত রাখলেন, সেও বহু আলোচিত বিষয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত (আষাঢ়, ১৩৪৫) আনন্দমঠ-এর যুগ্ম সম্পাদক শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীসজনীকান্ত দাস তাঁদের ভুমিকায় লিখেছেন, ‘“বন্দে মাতরম্” গান রচনা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বহু কিম্বদন্তী প্রচলিত হইয়াছে। অনেকের ধারণা ইহা ‘আনন্দমঠ’ লেখার পূর্ব্বে রচিত; কেহ কেহ মনে করেন বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে ডফিন্ সাহেব কর্তৃক অপমানিত হইয়া প্রতিহিংসাপরবশচিত্তে ইহা রচনা করিয়াছিলেন।‘ অবশ্য গোপালচন্দ্র রায় আবার তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থে মতপ্রকাশ করেছেন, ‘১২৮১ সালের আশ্বিনে বা ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বঙ্কিমচন্দ্র মালদহের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। পূজার ছুটিতে মালদহ থেকে কাঁটালপাড়ার বাড়িতে এসে বাড়ির দুর্গাপূজা দেখে প্রথমে “আমার দুর্গোৎসব” এবং পরে “বন্দে মাতরম্” রচনা করেছিলেন ... ।‘ এই উক্তিতে সময় নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও, স্থান নিয়ে বিরোধ নেই, এবং রচনার প্রেক্ষাপট ডফিন্ সাহেব নন, দুর্গাপূজা। সে যা হোক, রচনাটি বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই সময়ে প্রকাশনায় অসম্মত ছিলেন, তা তাঁরই ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় ব্যক্ত হয়েছে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত বঙ্কিমপ্রসঙ্গ গ্রন্থে তিনি বিবৃত করেছেন এই ঘটনা: “বন্দেমাতরম্” গীতটি উহার [অর্থাৎ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের] বহু দিন পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল।—বঙ্গদর্শনে মাঝেমধ্যে দুই এক পাতা matter কম পড়িলে পণ্ডিত মহাশয় [অর্থাৎ ‘বঙ্গদর্শন’-এর কার্যাধ্যক্ষ রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়] আসিয়া সম্পাদককে জানাইতেন, তিনি তাহা ঐদিনেই লিখিয়া দিতেন। —‘বন্দেমাতরম্’ গীতটি রচিত হইবার কিছু দিবস পরে পণ্ডিত মহাশয় আসিয়া জানাইলেন, প্রায় এক পাতা matter কম পড়িয়াছে। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বলিলেন, ‘আচ্ছা, আজই পাবে’। এক খানা কাগজ টেবিলে পড়িয়াছিল, পণ্ডিত মহাশয়ের উহার প্রতি নজর পড়িয়াছিল, বোধ হয় উহা পাঠও করিয়াছিলেন, কাগজ খানিতে ‘বন্দেমাতরম্’ গীতটি লেখা ছিল। পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন, ‘বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই গীতটি লেখা আছে, উহা মন্দ নয় ত—ঐটা দিন না কেন?’ সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বিরক্ত হইয়া কাগজ খানি টেবিলের দেরাজের মধ্যে রাখিয়া বলিলেন, ‘উহা ভাল কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না, কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে — আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব, তুমি থাকিতে পার।’” [‘বন্দে মাতরম্ এবং একটি উদ্ধৃতিচিহ্ণ’ – মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় / banglalive.com]


এই মাতৃবন্দনার গাথাকে বঙ্কিম একটি গীত হিসেবেই কল্পনা করেছিলেন, নেহাৎ একটি স্তোত্র হিসেবে নয়। যখন আনন্দমঠে তিনি অন্তর্ভুক্ত করলেন, তখন ভবানন্দ মহেন্দ্রকে এই গান গেয়ে মাতৃপরিচয় বোঝাচ্ছেন। তিনি নিজে সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন, এবং সঙ্গীত শিক্ষাও পেয়েছিলেন, এমন কথিত আছে। কিন্তু মৌলিক সুরস্রষ্টা তিনি ছিলেন না। ছাপার অক্ষরে প্রকাশে আগ্রহী না হলেও বঙ্কিম পরিচিত মহলে বন্দে মাতরম্ পাঠ করতেন, এবং তৎকালীন এক প্রসিদ্ধ সঙ্গীত বিশারদকে দিয়ে তাকে সুরবদ্ধ করতে প্রয়াসী হ’ন। ‘“বন্দে মাতরম্”-এর সুর : উৎস ও বৈচিত্র্য’ গ্রন্থে এর বিবরণে বলা হয়েছে: “... ‘বন্দে মাতরম্’ গানে প্রথম সুরারোপ করেন কে? এ-সম্পর্কে একই তথ্য এবং একই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন জগদীশ ভট্টাচার্য ও গোপালচন্দ্র রায়। সকলেই জানেন, ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয় বঙ্কিমচন্দ্রের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ দীনবন্ধু মিত্রের নামে। দীনবন্ধু মিত্রের পুত্র ললিতচন্দ্র মিত্র তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বন্দে মাতরম’ রচিত হইবার পরে বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহে তদানীন্তন সুকণ্ঠ গায়ক ভাটপাড়ার স্বর্গীয় যদুনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় ইহাতে সুরতাল সংযুক্ত করিয়া প্রথম গাহিয়াছিলেন।....”


এই যদুনাথ ভট্টাচার্য আর কেউ নন, বাংলায় যদুভট্ট নামে যিনি স্বনামখ্যাত। বঙ্কিম তাঁর কাছে গানও শিখতেন, এমনও শোনা যায়। সুতরাং ললিতচন্দ্র মিত্রের বয়ান অনুযায়ী যদুভট্টই বন্দে মাতরম্-এর প্রথম সঙ্গীতকার।


দুর্ভাগ্যবশত যদুভট্টের সৃষ্ট সেই বন্দে মাতরম্ কেমন ছিল তা আর আজ জানার উপায় নেই, কারণ এই সৃষ্টিকে তিনি বা অন্য কেউ যদি স্বরলিপিতে রূপান্তরিত করেও থাকেন, তা এখন আর উপলব্দ্ধ নয়। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে যদুভট্টের এই সুরারোপ আনন্দমঠ প্রকাশের অনেক আগেই ঘটে থাকবে। তার কারণ, আনন্দমঠ-এর প্রথম সংস্করণে যে বন্দে মাতরম্ ছাপা হয়েছিল, তার নীচে লেখা হয়েছিল, ‘মল্লার রাগ, কাওয়ালি তাল’। এখন কথা হচ্ছে যে, যদুভট্ট ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞ, যে ঘরানায় কাওয়ালি তাল কখনো ব্যবহৃত হয় না। অতএব ধরে নিতে হয়, যে বন্দে মাতরম্ আনন্দমঠে প্রকাশিত হয়, তার সুর যদুভট্ট রচিত সুর থেকে পৃথক।


এই প্রসঙ্গে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের একটি লেখার কিছু উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক। সম্ভবত তখনো আনন্দমঠ-এর একটি কল্পরূপই বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণায় ছিল, লিখিত আকার নেয়নি। অক্ষয়চন্দ্র লিখেছেন, “যখন আনন্দমঠ সূতিকাগারে, তখন ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায় এখানকার আর একজন ডেপুটি ছিলেন, বঙ্কিমবাবু ত একজন ছিলেন; উভয়ের পাশাপাশি বাসা। সন্ধ্যার পর তিনি আসেন, আমিও যাই। তিনি সুরজ্ঞ,বড় টেবল হারমোনিয়ম্ লইয়া তিনি ‘বন্দে মাতরম্’ গানে মল্লারের সুর বসান । বঙ্কিমবাবুকে সুরের খাতিরে যৎসামান্য অদল বদল করিতে হয়।“


এই সময়কাল ১৮৭৬ সাল নাগাদ হবে, কারণ সেই সময়েই বঙ্কিম হুগলীর ডেপুটি কালেক্টর হয়ে এসে চুঁচুড়ায় বসবাস করতেন। অক্ষয়চন্দ্র এখানে যাঁকে ক্ষেত্রনাথ নামে পরিচয় দিয়েছেন, সেই ‘আর একজন ডেপুটি’র আসল নাম ছিল ক্ষেত্রমোহন। লক্ষ্যনীয়, এখানে মল্লার রাগের উল্লেখ রয়েছে, পরবর্তীতে যা আনন্দমঠ-এ নিবদ্ধ হয়েছে। অবশ্য যদুভট্টও মল্লার রাগ ব্যবহার করে থাকতে পারেন, কিন্তু কাওয়ালি তাল তাঁর ঘরানাসিদ্ধ নয়। এই কারণে একটি মত এই যে ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ই বন্দে মাতরম্-এর আদি সুরকার। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সৃষ্ট বন্দে মাতরমকে সঙ্গীতরূপ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সুরকারদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন, আনন্দমঠ রচনার পূর্বেই। এই সব সুরের কিছুই আর পাওয়া যায় না, এটাই আক্ষেপ।


১৮৮২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাওয়ার পরের বছর ১৮৮৩তে আনন্দমঠ অভিনীত হয় দ্য গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে। কেদার চৌধুরী পরিচালিত নাটকে তৎকালীন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী দেবকান্ত বাগচী রাগ তিলক-কামোদে বন্দে মাতরম গেয়েছিলেন, এমন বিবরণ পাওয়া যায়। কথিত আছে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র এই নাট্যরূপ দেখেছিলেন, কিন্তু আশাহত হয়ে সাহিত্যিক শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের কাছে অত্যন্ত বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন।


আনন্দমঠ বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হবার সময় থেকেই সুধীসমাজে আগ্রহ এবং প্রসংসার তরঙ্গ তুলেছিল। কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রথম পরিবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী তার ব্যতিক্রম ছিল না। উপন্যাসের ঐ অপূর্ব বন্দনাগীত যুবক রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করল। তিনি এর আগের যদুভট্ট- বা ক্ষেত্রমোহন-কৃত সুরগুলি শুনেছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু নিজে মৌলিকভাবে সুরারোপের প্রচেষ্টা করেন, এবং প্রথম দেশ রাগে বন্দে মাতরম সঙ্গীতবদ্ধ করেন, এমনটাই অধিকাংশ ভাষ্যকারের বিবরণে প্রকাশ পেয়েছে।


প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্রজীবনী’তে লিখেছেন যে, শোনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতাবস্থায়ই রবীন্দ্রনাথ বন্দে মাতরম্ গানে সুর বসিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নেপাল মজুমদারও তা সমর্থন করেছেন [ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, প্রথম খন্ড]। “বন্দে মাতরম – প্রেরণা ও বিতর্ক” প্রবন্ধ সংকলন বইতে ‘বন্দে মাতরম ও রবীন্দ্রনাথ’ নিবন্ধে সন্তোষকুমার দে বঙ্কিম জন্ম শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের ভাষণের এই রকম উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “তাঁর (বঙ্কিমচন্দ্রের) বন্দে মাতরম্ গানে আমিই প্রথম সুর দিয়ে তাঁকে শোনাই। সবটা আমি গান করিনি, যতটা আমি সুর দিয়েছিলাম ততটা তাঁকে শুনিয়েছি। তিনি তাতে খুব প্রসন্ন হয়েছিলেন।“


রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃতিকে সত্য মেনে চললে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়।


প্রথমত, তিনি কেন বললেন যে তিনিই প্রথম সুর দিয়েছিলেন ? কারণ স্পষ্ট নয়, তবে খুব সম্ভবত তাঁর পূর্ববর্তী সুরকারদের সুর সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন না। যেহেতু কোন পূর্বতন স্বরলিপি ছিল না, এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।


দ্বিতীয়ত, তিনি ‘যতটা সুর’ দিয়েছিলেন, তা কতটা ? এ সম্বন্ধে সকলেই সহমত যে মোট ছয় স্তবকের প্রথম দুটি স্তবকই (বন্দে মাতরম্ ........ সুখদাং বরদাং মাতরম্) রবীন্দ্রনাথ দেশ রাগে সুরবদ্ধ করেন। নেপাল মজুমদারের ভাষ্য অনুযায়ী “রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির প্রথম অংশটি সুরসংযোগ করিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে শুনাইয়াছিলেন। এর বহুকাল পর ১৯৩৭-৩৮ সালে ..... কবি স্বয়ং তাহা স্বীকার করেন।“ সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞনদানন্দিনী, ঠাকুর পরিবারের থেকে প্রকাশিত ছোটদের জন্য ‘বালক’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকায় বিভিন্ন বিভাগের একটি ছিল সঙ্গীত-চর্চা সম্বন্ধীয়। রবীন্দ্রনাথের এক ভাগ্নী প্রতিভাসুন্দরী, যিনি ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় ধারার ধ্রুপদী সঙ্গীতে সুদক্ষ ছিলেন, ১২৯২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ (অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের মে) সংখ্যায় বন্দে মাতরম্-এর ওই প্রথম দুই স্তবকেরই ‘দেশ-কাওয়ালি সুরতালে নিবদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশ করেন’ (রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল)। কিন্তু সেখানে স্বরলিপিকার হিসেবে প্রতিভাসুন্দরীর নাম দেওয়া হলেও সুরকারের নাম প্রকাশ হয়নি। এই জন্য একটি ভ্রান্ত ধারণা এও আছে যে দেশ রাগে নিবদ্ধ এই অংশটির প্রথম সুরকার প্রতিভাসুন্দরী। তবে এই প্রথম বন্দে মাতরম্-এর কোন স্বরলিপি সর্বসমক্ষে এলো। তবে এর ১৪ বছর পর ১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথের অন্য এক ভাগ্নী সরলা দেবী প্রকাশিত ‘শতগান’ বইতে এই অংশটুকুরই দেশ রাগে নিবদ্ধ স্বরলিপি পুন: প্রকাশিত হয়, এবং সেখানে সুরকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মুদ্রিত স্বীকৃতি পান।


এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে এর চার বছর আগে ১৮৯৬ সালে কলকাতার বিডন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে গুরুদেব বন্দে মাতরম্ গেয়েছিলেন। প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ডে লিখেছেন, “.... কংগ্রেস অধিবেশনের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ গাইলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানের প্রথম দুটি কলি, .... সুরটি তাঁর নিজেরই দেওয়া।“ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রবোধচন্দ্র সেনও এই ঘটনা সম্পর্কে কবির দ্বারা বন্দে মাতরম্-এর প্রথমাংশ গাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯০৫ বা ১৯০৬ সালে হেমেন্দ্র মোহন বোস-এর টকিং মেশিন সিলিন্ডার রেকর্ডে ধরা রবীন্দ্রনাথের একটি বন্দে মাতরম্-এর রেকর্ডিং পাওয়া যায়, সেও ঐ দুই স্তবকই। অনেক পরে যখন স্বরবিতান সংকলিত হতে লাগল, তখন স্বরবিতান-৪৬এ প্রথম দুই স্তবকেরই স্বরলিপি সংযোজিত হয়।


অর্থাৎ যা কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, সবই নির্দেশ করে যে রবীন্দ্রনাথ ঐ প্রথম দুই স্তবকের আগে আর অগ্রসর হননি – সুরকার অথবা গায়ক হিসেবে। এর বহু পরে, ১৯৩৭ সালে যখন জাতীয় কংগ্রেস দেশের জন্য একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদের একটি প্রতিনিধি দল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, এবং গবেষকদের মতে, তিনি এই অভিমত দিয়েছিলেন যে, যদি বন্দে মাতরম্ দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয়, তবে তার প্রথম দুই স্তবকই নেওয়া উচিৎ। এর কারণ ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ এই স্তরে নেই, পরে কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করা যাবে। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে দেশের গণপরিষদ রবীন্দ্রনাথের দেশ রাগে সুরারোপিত বন্দে মাতরম্-এর প্রথম দুই স্তবককেই জাতীয় গানের মর্যাদা দেয়।


তৃতীয় প্রশ্ন হ’ল, রবীন্দ্রনাথ ঠিক কবে এই সুরারোপ করেছিলেন। সঠিক সিদ্ধান্তে আসা মুস্কিল। বঙ্কিমের দেহাবসান হয় ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। যদি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এই সুর শুনিয়ে থাকেন, তবে তার রচনা এর আগেই হয়েছিল। ১৮৯৬এর কংগ্রেস অধিবেশনে গুরুদেবের বন্দে মাতরম্ গাওয়ার কথা, যা আগেই বলেছি, তা সব ইতিহাসেই নথিবদ্ধ। কিন্তু তারও আগে, ১৮৯০এর কংগ্রেস অধিবেশন, যেটি কলকাতাতেই হয়েছিল, সেখানেও রবীন্দ্রনাথের বন্দে মাতরম্ গাওয়ার একটি বিবরণ আছে, যার উল্লেখ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। Calcutta Municipal Gazette, Special Issue, 1941-এ এই রিপোর্টে দেখা যায়: “{Tagore) … attends the sixth session of the Indian National Congress in Calcutta (Dec., 1890) under the presidentship of Pherozshah Mehta, when he sings the Bande Mataram on the opening day.” মনে রাখতে হবে, ১৮৮৬ সালেই প্রতিভাসুন্দরী-কৃত স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১৮৮৬ বা সমসময়ে রবীন্দ্রনাথ দেশ রাগের সুরসংযোগ করে থাকবেন, কারণ তার পরেই স্বরলিপি বা গায়নের উল্লেখ পাওয়া যায়।


এবার আসা যাক বন্দে মাতরম-এর অন্য কিছু সুরসংযোগের কয়েকটির উল্লেখনীয় দৃষ্টান্তে। কংগ্রেসের অধিবেশন ছাড়া সাধারণ জনসমাজে এই গান বহু বছর প্রায় সুপ্তই ছিল। এর পুনরুজ্জীবন ঘটল ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন ঘিরে। সে এক অভাবনীয় জাতিয়তাবাদের ভাবপ্রবনতা উদ্বেল করল বাংলা এবং দেশকে। শুধু গান নয়, বন্দে মাতরম্ এক রাজনৈতিক ধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল জনসমাজে। সে সময় ‘বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়’ নামে একটি গোষ্ঠি জায়গায় জায়গায় এই গান গেয়ে বেড়াত। তাঁরা সমবেত কণ্ঠে মিশ্র সুরে এই গান গাইতেন। ‘নারায়ণ’, ১৩২২ বৈশাখ সংখ্যায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন: “আজ আমার সেই দিনের কথাই মনে পড়িতেছে — তখন সমগ্র বঙ্গদেশ 'বন্দে মাতরম্' গানে মুখরিত। বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়ের উদাত্ত সুর হইতে আরম্ভ করিয়া বৈষ্ণবের কীর্তনের সুর পর্যন্ত কত সুরে কতজন এই গান গাহিতেছে।“ দক্ষিণাচরণ সেন বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়ের জন্য রাগ খাম্বাজে একটি সুর রচনা করেছিলেন। আবার অন্য আর এক দল, ‘ভবানীপুর সেবক সম্প্রদায়ের’ জন্য রাইচরণ মুখোপাধ্যায় রাগ মল্লারে অন্য একটি সুর বেঁধেছিলেন। মল্লারেই নারায়ণচন্দ্র মুখার্জির গাওয়া একটি সংস্করণও পাওয়া যায়। হিমাংশু দত্ত, অমলা দাস, সরলা দেবী, সতী দেবী, সাহানা দেবী, কনক দাস ইত্যাদি অনেক শিল্পীরা বঙ্গ প্রদেশে এই গান অনেক সুরে পরিবেশন করেছেন।


স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে দেশের অন্য রাজ্যেও বহু সুরকার এবং শিল্পীরা বন্দে মাতরম্-এর সুর নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর এই গানকে বেঁধেছিলেন যে রাগে তার নাম তিনি দিয়েছিলেন বঙ্গীয় কাফি । বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকার (কাফি), কেশবরাও ভোলে (দেশকর), বিষ্ণুকান্ত পাগনিশ (সারঙ) ইত্যাদি প্রমুখ শিল্পীরা সুরবৈচিত্র্যে গানটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯২৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মিশ্র খাম্বাবতী রাগে সুরবদ্ধ করে ভি ডি অম্বাইকার নাগপুরে গান্ধীজিকে মুগ্ধ করেছিলেন, পরে বাবাসাহেব আম্বেদকারও এই সুরটিকে জাতীয় সঙ্গীতের জন্য সুপারিশ করেন। সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে তিমিরবরণ রাগ দুর্গার ভিত্তিতে কুচকাওয়াজের ঢঙে সঙ্গীতবদ্ধ করেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও পরবর্তী কালে আনন্দমঠ ছায়াছবির জন্য দ্রুত লয়ে এই ধাঁচের একটি সুরারোপ করেছিলেন। দিলীপকুমার রায় একক কণ্ঠে ধ্রুপদ-ধামার ভাবে, এবং এম এস শুভলক্ষীর সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে মিশ্র রাগে গেয়েছেন। শুভলক্ষী পরে ভজনের ঢঙেও এই গান গেয়েছেন। মাষ্টার কিষণরাও ফুলামব্রিকার সুর বসিয়েছিলেন ঝিঞ্ঝোটি রাগে। পঙ্কজ মল্লিক, ভবানীচরণ দাস প্রভৃতি কত যে গুণী সঙ্গীত রচয়িতারা বন্দে মাতরম-এ সুর সংযোজনা করেছেন, তা বলে শেষ করা যায় না। এই নিবন্ধের শেষে তেমনই কিছু অল্পশ্রুত সুরের লিংক দেওয়া হ’ল।


বন্দে মাতরম্-এর সুর প্রসঙ্গ এই পর্যন্তই। এই বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি ভাবে সম্পর্কিত না হলেও, গানটিকে নিয়ে অনবরত যা কিছু বিতর্ক চলে আসছে, অনুসন্ধানকালে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য সামনে পাই, যার অনেকটাই হয়ত পাঠকরা অবগত থাকবেন। যাঁরা নন, তাঁদের সুবিধার্থে খুব সংক্ষেপে তা নিয়ে কিছু ব্যক্ত করলাম। এই বিবরণ নেহাতই তথ্য জ্ঞাপন, লেখকের ভুমিকা নৈর্ব্যক্তিক।


বন্দে মাতরম্-এর রচনাকালেই সংস্কৃতের শব্দ নির্বাচন নিয়ে কিছু বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল। কথিত আছে, বঙ্কিমের কন্যাও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, একটি শ্রুতিপাঠের আসরে প্রথম শোনার পর উপস্থিত অনেকেই মন্তব্য করেন যে, কিছু অংশ “অত্যন্ত শ্রুতিকটু হইয়াছে। শস্য শ্যামলাং শ্রুতিকটু নয় তো কি ? দ্বিসপ্তকোটী ভুজৈর্ধৃত খরকরবালে ইহাকে কেহই শ্রুতিমধুর বলিবেন না। বঙ্কিমচন্দ্র প্রায় এক ঘণ্টা ধরিয়া ধীর ভাবে শুনিলেন, তাহার পর বলিলেন, ‘আমার ভাল লেগেছে, তাই লিখেছি। তোমাদের ইচ্ছা হয় পড়, না হয় ফেলে দাও, না হয় প’ড় না।“


সব থেকে বেশি বিতর্ক জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বন্দে মাতরম্-এর নির্বাচন না হওয়া, এবং জাতীয় গান হিসেবে মাত্র দু স্তবকের ব্যবহার নিয়ে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রবীন্দ্রনাথের মতামতের একটা ভুমিকা নিশ্চিতভাবে ছিল। আগেই বলেছি, ১৯৩৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি একটি চার সদস্যের সাব কমিটি গঠন করে, বন্দে মাতরম্-কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার যুক্তিযুক্ততা এবং তার পরিণাম পর্যালোচনা করে অভিমত পেশ করার জন্য। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কালাম আজাদ ও আচার্য্য নরেন্দ্র দেব। এঁরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের মত ছিল, এর প্রথম দুটি স্তবক দেশমাতৃকার বর্ণনা এবং বন্দনা হিসেবে অতীব সৌন্দর্যময়, কিন্তু পরেরগুলি উপযুক্ত নয়। ১৯৩৭এর ২৬শে অক্টোবর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, “To me the spirit of tenderness and devotion expressed in its first portion, the emphasis it gave to the beautiful and beneficent aspects of our motherland made a special appeal, so much so that I found no difficulty in dissociating it from the rest of the poem and from those portions of the book of which it is a part, with all the sentiments of which, brought up as I was in the monotheistic ideals of my father, I could have no sympathy.”, কেন তিনি প্রথম দুই স্তবকের বেশি সুর সংযোজনায় বিরত থাকলেন, এই উক্তির মধ্যে তার কি একটা সম্ভাব্য কারণ পাওয়া যেতে পারে ?


এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য জানাতে হয়। আনন্দমঠ বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হওয়ারও আগে, এবং ১৮৮২তে গ্রন্থাকারে বেরোবার বহু পূর্বে, ১৮৭৯ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন, যাতে তিনি ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন (একসুত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন, এক কাজে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন - বন্দে মাতরম্)। এর থেকে একটি উপপাদ্য এও এসেছে যে বঙ্কিম শুরুতে গানের প্রথমাংশই শুধু লিখেছিলেন, যা কোন ভাবে তরুণ রবীন্দ্রনাথের গোচরে আসে এবং তাঁকে প্রভাবিত করে। উপন্যাসে সংযোজনের প্রয়োজনে বঙ্কিম পরে আরও স্তবক জুড়ে দেন। অবশ্য এই সবই জল্পনা, এবং প্রমাণ করার মত কোন উপাদান এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।


বন্দে মাতরম্-এর শেষ চার স্তবক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সহ অন্য বিরোধীদের মত ছিল যে ওগুলিতে যে মাতৃমূর্তির বন্দনা করা হয়েছে, আসলে তা হিন্দু দেবী দুর্গা বা কালীরই প্রতিরূপ। সুভাষচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ খোলাখুলি ভাবেই এই মত ব্যক্ত করেন। তাঁদের যুক্তিতে এর জন্যই এই গান সব সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হোত না। ১৯০৫ সালে যখন বন্দে মাতরম্ ধ্বনি সরকার নিষিদ্ধ করা নিয়ে চিন্তা করছে, তখন নাকি এই গানের যথার্থ অর্থ উদ্ধারের জন্য কোন তথাকথিত বিশেষজ্ঞ আমলার পরামর্শ নেওয়া হয়, যিনিও এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এই গানে উপাসিত মাতা আদতে কালীরই মূর্তি। সে যাই হোক, এ কথা স্বীকার্য যে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করেই বন্দে মাতরম্ সম্বন্ধে কংগ্রেস ও স্বাধীনতার পর গণপরিষদ নির্ণয় করে থাকবে।


অনেকের মতে, অন্য একটি বিষয়ও বিবেচনায় ছিল। একটি বহুস্বীকৃত দৃষ্টিকোণ ছিল এবং আছে যে বঙ্কিমচন্দ্র যে দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেছিলেন, সে দেশ ভারত নয়, সে আসলে অবিভক্ত বঙ্গদেশ। গর্গ চট্টোপাধ্যায় (History revisited: ‘Bande Mataram was written as a song about Bengal, not India / scroll.in, May 31, 2017) বলছেন, ১৮৭১এর আদমশুমারি অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৬.২৬ কোটি, যার ভিত্তিতে বন্দে মাতরম রচনাকালে বঙ্কিম লিখলেন ‘সপ্তকোটি কণ্ঠ’। ভারতবর্ষকে মাতা রূপে কল্পনা করলে তাঁর লেখা উচিত ছিল ‘ত্রয়োবিংশকোটি’, কারণ ঐ শুমারি মতে ভারতের জনসংখ্যা তখন ছিল ২৩.৮৮ কোটি। প্রসঙ্গত, ১৯০৫-এর বারাণসী কংগ্রেসে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী বন্দে মাতরম-এর প্রথম দুই স্তবকের পরবর্তী স্তবকও গেয়েছিলেন, এবং তখন স্বেচ্ছাকৃত ভাবে ‘সপ্তকোটি’কে পরিবর্তন করে ‘ত্রিংশকোটি’ বলে গেয়েছিলেন, যা তখন ভারতের জনসংখ্যা ছিল। (ঋষি) অরবিন্দ ঘোষ বন্দে মাতম-এর ইংরাজী অনুবাদ করে লিখেছিলেন: “It is difficult to translate the National Anthem of Bengal into verse in another language owing to its unique union of sweetness, simple directness and high poetic force.”


২০০৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি নিবন্ধে অমৃতসূদন ভট্টাচার্য আরও একটি বিতর্কিত প্রশ্নের অবতারনা করেন। তিনি বলেন, আনন্দমঠ-এ বন্দে মাতরম্ যখন প্রকাশ পায়, তখন তার ২৮ চরণের মধ্যে প্রথম ১২ চরণ (‘বন্দে মাতরম্’ থেকে ‘রিপুদলবারিণীং মাতরম্’ পর্যন্ত) ছাপা হয়েছিল উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, তার অর্থ কি ঐ প্রথম ১২ পংক্তি সাহিত্য সম্রাটের নিজের রচনা ছিল না ? বঙ্কিম সাহিত্যে উদ্ধৃতিচিহ্নের ব্যবহার চর্চা করে অন্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলেছেন যে শুধুমাত্র এই কারণের ওপর ভিত্তি করে এমন সন্দেহ অমূলক।


শেষ পর্যন্ত তবে এইটাই সার কথা যে বন্দে মাতরম্ গানের রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এবং দেশের জাতীয় গান হিসেবে যে অংশ গাওয়া হয়, তার সুর সংযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অন্য গায়ক-সুরকারের কিছু অল্পশ্রুত সৃষ্টির নিদর্শন নীচের লিংকগুলিতে রইল।


ওঙ্কারনাথ ঠাকুর (বঙ্গীয় কাফি)



বিষ্ণুপন্থ পাগনিস (সারঙ্গ)



বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকার কৃত সুর সুভদ্রা দেসাই-এর কণ্ঠে (কাফি)



বিনায়করাও দেশরাও অম্বাইকার (মিশ্র খাম্বাবতী)



কেশবরাও ভোলে (দেশকর)



নারায়ণচন্দ্র মুখার্জী (মল্লার, টপ্পা)



মাষ্টার কৃষ্ণরাও ফুলাম্ব্রিকার (ঝিঞ্ঝোটি)



সবলারাম্বোয়া সেজবল



দিলীপকুমার রায় (ধ্রুপদ/ধামার)



দিলীপকুমার রায় ও এম এস শুভলক্ষী (রাগমালিকা)


দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, জগন্ময় মিত্র, কনক দাস, দ্বিজেন চৌধুরী ও অন্যান্য (সুরকার সরলা দেবী)


0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in




















তুলসী চক্রবর্তী পাশ্ববর্তী চরিত্রে অভিনয় করেও সেকালের সিনেমায় বড়মাপের অভিনেতা। তার প্রমাণ আমরা পাই জনপ্রিয় সিনেমা 'সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ও ‘একটি রাত ' ইত্যাদিতে। তুলসী চক্রবর্তী অভিনয় অনন্যসাধারণ। সেসব ছবিতে তিনি কখনো মেসমালিক, কোথাও হোটেলমালিক, কোথাও সরাইখানার মালিক। নায়ক কিংবা খলনায়ক নন, তথাকথিত ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেও সব সিনেমায় স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন তিনি।সাদাকালো যুগের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর কথা বলছি। মূলত কৌতুক চরিত্রের শিল্পী হয়েও, কিন্তু আজও তিনি যেকোনো উঠতি অভিনেতা-অভিনেত্রীর অনুপ্রেরণা!
দেখতে কখনো তথাকথিত নায়কের মতো নন। সুদর্শনও বলা যাবে না। বড় বড় চোখ, এক মাথা টাক, অবিন্যস্ত দাঁত আর মোটা ভুঁড়ির ছোট চরিত্রের বড় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়–প্রতিভাকে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশপাথর’ বানাতে পারতেন না, এটা তিনি তাঁর শেষ জীবনে বলে গেছেন। এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় তুলসী চক্রবর্তীর নাম বলতে গিয়ে বলেছেন ‘তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না, কিন্তু তিনি যদি আমেরিকাতে জন্মাতেন, নির্ঘাত অস্কার পেতেন।’
গত শতাব্দীর ষাট–সত্তর দশকের বাংলা চলচ্চিত্র যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে তুলসী চক্রবর্তী অপরিচিত নন। এই নাম শুনলে অনেকেরই চোখে ভেসে ওঠে দুটি সিনেমা। একটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’, অন্যটি নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।
১৯৫৩ সালের কথা, মুক্তি পেল নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে ৭৪’। চারদিকে সাড়া পড়ে গেল, ছবিটির মাধ্যমে এক নতুন জুটি এসেছে পর্দায়। সে সময় একটু বয়েসি দর্শক মজেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীতে। তাঁদের দাবি, নায়ক-নায়িকা তো তুলসী-মলিনা, উত্তম-সুচিত্রা তো আসলে পার্শ্বচরিত্র! শোনা যায়, সে সময় টানা আট সপ্তাহ বক্স অফিসে চলেছিল ছবিটি। এখনো দেখা যায়, কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখা শেষে বের হতে হতে কোনো তরুণ বলে উঠছে, ‘কই, কোথায় গেলে গো?’ যুগে যুগে এ সংলাপ ফিরেছে সিনেমারসিকদের মুখে মুখে।
ইন্দ্রাণী ছবির সেটে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী।
অভিনয়জীবনে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিতে অভিনয় করে। শোনা যায়, সে ছবির শুটিংয়ের আগে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য পোশাক ডিজাইনার তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছে শুনে আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘উফ! এ আমি কখনো ভাবতেও পারিনি!’ শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য নয়, ‘পরশপাথর’ তাঁর জীবনের অন্যতম মাইলফলক এ ছবি নিয়ে নানা গল্পের কারণে। এ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তুলসী দাস নিয়েছিলেন মাত্র ১৫০০ টাকা। সত্যজিৎ রায় সম্মানী বাড়ানোর কথা বললে তুলসী দাস বলেন, এর থেকে বেশি নিলে বাকি শিল্পীরা কী দোষ করল! তারপর আর হয়ত কোনো ছবিতেই সুযোগ পাব না।
জন্ম ১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ হাওড়ায়। বাবার অকালমৃত্যুতে মা নিস্তারিণী দেবী কলকাতায় চলে এসে সদ্য তরুণ তুলসীকে নিয়ে মা জোড়াসাঁকোয় থাকতেন তুলসীর জ্যাঠা প্রসাদ চক্রবর্তীর বাড়িতে। জাঠ্যা কাজ করতেন স্টার থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীতের দলে। প্রসাদবাবুর সঙ্গে থিয়েটারে প্রথম যাতায়াত। এরপর আস্তে আস্তে থিয়েটারের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা। ১৯১৬ সালের কোনো একদিন স্টার থিয়েটারের অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নজরে এলেন তুলসী। স্টারে কাজ করা শুরু করলেন ট্রেইনি আর্টিস্ট হিসেবে। অভিনয়ের পাশাপাশি সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন গানে, তবলায়, পাখোয়াজে। ১৯২০ সালে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকের মাধ্যমে স্টেজ জীবন শুরু করেন। এরপর ১৯২৭ সালে মনমোহন থিয়েটারে যুক্ত হন, তারপর মিনার্ভা, রংমহল থিয়েটারে কাজ করে প্রায় ৪২টি প্রযোজনায় অভিনয় করেছিলেন।
অবশ্য কলকাতায় শুরুতে টানাপোড়েনে কেটে গেছে তুলসী চক্রবর্তীর জীবন। প্রথমে উত্তর কলকাতার একটি দোকানে বাসনপত্র ধোয়ার কাজ করেন, তারপর সার্কাসে জোকার হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। থিয়েটারে কাজ করতে করতে বাংলা সিনেমা জগতে প্রবেশ করলেন ১৯৩২ সালে ‘পুনর্জন্ম’ ছবির মাধ্যমে। এরপর একে একে ‘শচীদুলাল’, ‘মনোময়ী গার্লস স্কুল’, ‘শঙ্খ সিন্দুর’, ‘কবি’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘পরশ পাথর’, ‘মৃতের মর্ত্যে আগমন’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ইত্যাদি ছবিতে।
ছবি বিশ্বাসকে অনেকেই চেনেন হয়তো। সেই ছবি বিশ্বাস যিনি কিনা কোনোদিনও শুটিং করার সময় সংলাপ মুখস্থ করতেন না। শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন এবং তারপরই রীতিমতো অভিনয়ের দাপট! কিন্তু সহ-অভিনেতা যেদিন তুলসী চক্রবর্তী থাকতেন, সেদিন তাঁকে কোমর বেঁধে নামতে হতো। ছবি বিশ্বাস বলতেন, কী জানি কী প্যাঁচ তুলসী কষবে! ছবি বিশ্বাস খুব ভালো করে জানতেন যে সহ-অভিনেতা যখন তুলসী চক্রবর্তী, তখন অভিনয়টাও করতে হবে চ্যালেঞ্জ রেখে, টক্কর দেওয়ার মতো
তাঁর বিষয়ে বলতে গিয়ে মহানায়ক উত্তম কুমার বলতেন, ‘তুলসীদার মতো অভিনয় তো কোনোদিনই করতে পারব না, ওনার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। ওনাকে প্রণাম জানানোর মতো একটাই পথ আছে; পরিচালক প্রযোজকদের বলে যখনই কাজ পাই, তুলসীদাকে ডেকে নিই। উনি থাকলে সিনটা দারুণভাবে উঠে যায়। ওনার ঋণ তো কোনোদিন শোধ করতে পারব না, যেভাবে যেটুকু পারি সাহায্য করি।’ আর নিজের সম্পর্কে তুলসী চক্রবর্তী বলতেন, তিনি হলেন রান্নাঘরের হলুদ, যেখানে–সেখানে কাজে লেগে যাই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চোখ–কান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেড়াই। চরিত্রমতো যখন যাকে দরকার, তাকে তুলে ধরি। এসব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দরকার হয় নাকি? এসব তোমার–আমার চারপাশে ঘুরছে। যেকোনো একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।’
তিনি কমেডিয়ান না পূর্ণ অভিনেতা, সে প্রশ্ন দূরে থাক। তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা, সে কথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি এবং উর্দুতেও কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে বহু ছবির জন্য পারিশ্রমিকও নেননি শুধু ভালোবাসার জন্য। চরিত্র ছোট না বড়, গুরুত্ব আছে না নেই, এসব ভাবতেন না তুলসী চক্রবর্তী। মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করতেন।
সারা জীবনে ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টির মতো হিন্দি সিনেমা করলেও দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবু নিজের বাড়িও দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। ছোট্ট দুই কামরার বাড়িতে থাকতেন স্ত্রীকে নিয়ে। উত্তম কুমার, তরুণ কুমারদের ছেলে বলে ডাকতেন নিঃসন্তান তুলসী। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিম বাংলার সরকারের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনো বন্দোবস্ত ছিল না তখন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী উষারাণী দেবী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেলও নাকি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
অভিনয়জীবন ভালো কাটলেও যাপিত জীবন কষ্টে কেটেছে তুলসী চক্রবর্তীর। দুই বাংলার দর্শকের অন্তরে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন তিনি, এটাই মরণোত্তর জীবনের বড় পাওয়া হিসেবে থাকবে যুগের পর যুগ।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শৌনক ঠাকুর

Posted in










খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈষ্ণব পদাবলীর পাশাপাশি সমানভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল শাক্তপদাবলী। রামপ্রসাদ সেন , কমলাকান্ত ভট্টাচার্য , দাশরথি রায়সহ প্রমুখের লেখা গান লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। তবে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীত রচনাকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। যার বড় অংশই ছিল শ্যামাসংগীত। তবে রামপ্রসাদ , কমলাকান্ত বা প্রচলিত রীতি থেকে তাঁর শ্যামাগানের শব্দ-সুর-রীতি অনেকটাই আলাদা।


নজরুলের শ্যামাগান ব্যতিক্রমী হওয়ার অন্যতম কারণ হল শ্যামাসংগীতে প্রত্যক্ষ স্বদেশীয়ানার প্রচলন। দেবীকালী তার চোখে দেশমাতৃকা। ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার আগে এই প্রয়াস তেমন দেখা যায় নি। ‘আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে।’ এই গানটিতে ‘কালী’ যে দেশমাতার রূপক। তারই কৃপাতে পরাধীন ভারতবর্ষের আপামর জনগণের শৃঙ্খলমোচন সম্ভব তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যায় সুরের অভিনবত্ব। প্রচলিত শ্যামাসংগীতে একটা সুরগত টাইপ বা রীতি থাকে। কিন্তু নজরুলের শ্যামাসংগীতের মধ্যে রাগসঙ্গীত বা মার্গসংগীতের প্রভাব লক্ষণীয়। তাই তার বেশিরভাগ গানে খোলের পরিবর্তে পাখোরাজ বাজানো হত। (অবশ্য খোলের ব্যবহার যে একেবারেই নেই তা বলা যায় না)


ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পুঁজিবাদীদের রমরমা, মুদ্রাস্ফীতি, ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ইত্যাদি জনমানসে ভয় ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। শ্যামাসঙ্গীতকেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন কাজী নজরুল। ‘কালকে তুমি কাকে মারো?’ ইত্যাদি।


প্রাত্যহিক জীবনের অতিসাধারণ উপাদান তার লেখনি গুণে হয়ে উঠেছে অমূল্য সম্পদ। ভক্তি প্রসঙ্গে একটি গানে তিনি বলেছেন — ‘ভক্তি আমার ধূপের মত / ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত। অথবা
‘তোর রাঙা পায়ে মে মা শ্যামা / আমার প্রথম পূজার ফুল।’ কত সুন্দর দার্শনিকচেতনা ও রূপকের দ্যোতনা।


কাজী কবির চোখে এই নারী কখনও ‘ছিন্নমস্তা’ কখনও বা ‘রক্তখেপী’। এই নারীরাই পারে জগতের যা কিছু অমঙ্গলকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জাগরণ ঘটাতে। ‘শিখালি কাঁকন চুড়ি পরিয়াও নারী, / ধরিতে পারে যে উদ্ধত তরবারি।’ তাই কবির চোখে এই নারী মহাকালী করালবদনা। জাগরণের প্রতীক। মুক্তির দূত। ‘আমার মা আছে রে সকল নামে’ ,‘আমি কি তোকে ডাকিতে পারি’ ইত্যাদি নানান গানে কবি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন। আবার ‘আমার কালো মেয়ের পালিয়ে বেড়ায়’ এই ধরনের গানে কবি নারী-মুক্তি ও সম-অধিকারের বার্তা দিয়েছেন।


উর্ধ্বমুখী কুণ্ডলিনী বা সর্পশক্তিকে জাগরিত করাই হল প্রকৃত সাধনা। গীতিকার নজরুল বিভিন্ন শ্যামাগানে লৌকিক উপমা ব্যবহার করে এই দূরহ বিষয়টিকে সহজভাবে ব্যক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ‘শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধূপ-কাঠিতে’, ‘ধূলোয় ভরল ধরণী’ ইত্যাদি গানের কথা বলা যেতে পারে।


রহস্যময় জটিল সৃষ্টিতত্ত্বে পুরুষ সূক্ষ্ম, অব্যক্ত, নিত্য ও চৈতন্যরূপ সত্ত্বা। আর প্রকৃতি তার দোসর। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের ১০ মন্ডলের ১২৯ সূক্তে এই ভাবনারই প্রকাশ রয়েছে। বিদ্রোহী কবির একটি গানে দেখা যায় মহাকাল শিব বুক পেতে গ্রহণ করেছেন মহাকালীর শ্রীচরণ — ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় / দেখে যা আলোর নাচন।’


শুধু মাতৃরূপে নয় কন্যারূপেও মা কালীকে দেখেছেন তিনি। এ কন্যা আমাদের সাধারণ ঘরে। এ কন্যা হেসে খেলে নেচে বেড়ায়। আমাদের আদরের দুলালী। কবিও বলেছেন — ‘আদরিনী মোর শ্যামা মেয়েরে / কেমনে কোথায় রাখি’।


মায়ার আবরণে মানুষ অন্ধ হয়ে থাকে। তাই সংসারের জালে আবদ্ধ হয়ে কলুর বলদের মতই কেবল ঘুরে মরে। এই জীবনবোধ ও চিরন্তন সত্যকে কত খুবই সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন গীতিকার নজরুল —‘জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস মা শ্যামা কি তুই জেলের মেয়ে / (তোর) মায়ার জালে মহামায়া বিশ্বভূবন আছে ছেয়ে।’ এখানে ‘জাল’ শব্দটি মায়া ও ‘চতুর মীন’ সাধক অর্থে অর্থে প্রযুক্ত।


লৌকিক জগতকে আশ্রয় করে লোকোত্তর আর জগতের দ্যোতনা সৃষ্টি করায় তার সংগীতের মূল নান্দনিক রূপ। যেখানে থাকে অদ্বৈতবাদের পরমসত্তা এবং অতীন্দ্রিয় স্বপ্ন-সুখ।


শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে চিরকালীন একটা দ্বন্দ্ব বা মতপার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু বিদ্রোহী কবির কলমে শ্যাম ও শ্যামা একাত্মতা হয়ে গেছে। শ্যামকে শ্যামামায়ের কোলে বসিয়ে তিনি দেখিয়েছেন একই অঙ্গে দুটি রূপ। ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে / জপি আমি শ্যামের নাম।’ কিংবা ‘আমার মনের দো-তারাতে শ্যাম ও শ্যামা দুটি তার।’ পরমাত্মা কখনই ভিন্ন নয় এক ও অদ্বিতীয়। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এখানেই আধুনিকতা।


মানবতাবাদী কবি কাজী বলিদান প্রথার বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন বলিদান প্রথায় মনের পশুকে বদলে কেন বনের পশুকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মন্দিরের বদ্ধ আবরণীতে দেবীর প্রতিষ্ঠান নয় তিনি সর্বত্র বিরাজিত ভূতের স্থিত।


নজরুলের শ্যামাসংগীত জনপ্রিয়তার আরেকটি প্রধান কারণ হল আবেগধর্মিতা। বাঙালির শান্ত-স্নিগ্ধ-নরম হৃদয় এই গানগুলি তাই চিরকালীন সম্পদ হয়ে উঠেছে। যেমন ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে’, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’, ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়’। ‘মোর লেখাপড়া হ'ল না মা, আমি 'ম' দেখিতেই দেখি শ্যামা, আমি 'ক' দেখতেই কালী ব'লে নাচি দিয়ে করতালি’ ইত্যাদি।


আসলে নজরুলের ছিলেন একজন উদারপন্থী মুক্তমনা স্বাধীনচেতা মানুষ। তার কাছে ধর্ম-বর্ণ-বিভেদের উর্দ্ধে ছিল মানবিকতা। তার এই সমন্বয়পন্থী মনোভাবের জন্য বারে বারে মৌলবাদীরা তাকে আঘাত করেছে। অপমান করেছে কট্টর হিন্দুরা। একসময় পূর্ববঙ্গে রেডিওতে নজরুলের শ্যামাসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। এত কিছুর পরেও নজরুলের ভাবাদর্শকে কেউ বিন্দুমাত্র টলাতে পারে নি।
বাঙালির শ্বাস প্রশ্বাসের আজ ও বাহিত হয় নজরুলের শ্যামা সংগীত। শুধুমাত্র চিত্তবিনোদন বা আনন্দ প্রদান নয়, এর পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সমকালীন সমাজভাবনা রাজনৈতিক চেতনা। তাই সংগীতগুলো হয়ে উঠেছে তৎকালীন কালের বিশ্বস্ত দলিল। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এ গানগুলির জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমে নি। বরং বেড়েছে‌। এর সুর মূর্ছনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান।
আর শ্যামাসংগীতকার নজরুল আপন শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে হয়ে উঠেছেন এক পৃথক পথের যাত্রী।


_____________

ঋণ স্বীকার


১। গানের ভুবন : কাজী নজরুল : ড.মাধুরী সরকার
২। ‘কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’: করুণাময় গোস্বামীর
৩। ‘পঞ্চোপাসনা’ : শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,
৪। ‘বাংলা সাহিত্য নজরুল’ : আজহারউদ্দীন খান
৫। শক্তি সাধনা ও শাক্ত গান: আঠারো শতকের সমাজ ইতিহাসের দায়বদ্ধতা : অরিন্দম অধিকারী
৬। ‘নজরুল ও বাংলা শাক্ত-সংগীত’ : পল্লব চট্টোপাধ্যায়

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in





















১৩. ভার্জিনিয়া উলফ ও কবি লেখকের আত্মহত্যা





সুপরিচিতাসু সুস্মি,


ষষ্ঠীর রাত। ঘন্টাখানেক আগেই নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে ট্র্রেনে চেপেছি। অনেকদিন হলো তোমার কোন চিঠি পাইনা। ভালো আছো নিশ্চয়? কাজের প্রেশারে চিঠি লিখতে পারছো না মনে হয়। বৈশুর হাতে তৈরি লুচি আার আলুর দম দিয়ে ডিনার সেরে জানালার পাশে বসে আছি বহুক্ষণ। রাতের ট্রেন ছুটছে, এসির জানালায় দূরের কোন আলো কাঁপছে। মনটা আজ খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, তোমাকে খুব মনে পড়ছে। কেন পড়ছে জানিনা। কিংবা এভাবে তোমাকে মনে করা উচিত হচ্ছে কিনা তাও বুঝতে পারছিনা। আমরা আজো যেহেতু মোবাইল নম্বর দেয়া নেয়া করিনি সেহেতু তোমাকে লেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, পুরো কম্পার্টমেন্ট আধো ঘুমে আমি জেগে বসে তোমাকে লিখছি। আজ সন্ধ্যায় একটা সুইসাইড নোট পড়ছিলাম ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ শেষ বিদায়ের আগে প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশে লেখা এই চিঠিটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পড়া সুইসাইড নোটগুলোর একটি। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ওই চিঠিটি এখনও পড়েন বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীরা, আমিও আগে বহুবার পরেছি কিন্তু কেন জানিনা আজ পড়ার পর থেকেই খুব কষ্ট লাগছে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। এই চিঠি তোমারও নিশ্চয় পড়া। যেখানে আত্মহত্যাকারী লিখছেন—



প্রিয়তম,

আমি বুঝতে পারছি, আমি আবারও পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি এবার হয়তো আমাদের এই কঠিন সময় অতিক্রান্ত হবে না। আমি নানা রকম স্বর শুনতে পাচ্ছি, কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছি না। তাই যা সবচেয়ে ভালো মনে হচ্ছে তা-ই করতে যাচ্ছি আমি। তুমি আমাকে যতটুকু সম্ভব সুখী করেছ। তুমি সে সবই করেছ যা যা কোনও মানুষের তরফে করা সম্ভব। আমার মনে হয় না দুইজন মানুষ মিলে তোমার-আমার চেয়ে বেশি সুখী হতে পারতো, যতদিন না আমার এই ভয়ঙ্কর রোগটা দেখা দেয়। আমি আর এর সাথে যুদ্ধ করতে পারছি না। আমি জানি আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে ফেলছি, আমি না থাকলেই তুমি কাজ করতে পারবে। এবং তুমি করবেও, আমি জানি তা। এই দেখ, এই চিঠিটাও আমি ঠিকভাবে লিখতে পারছি না। আমি পড়তে পারি না। আমি সর্বার্থে বলতে চাই, আমার জীবনের সমস্ত সুখের জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী। তুমি আমার সঙ্গে চরম সহিষ্ণুতা দেখিয়েছ, অসাধারণ সহৃদয় আচরণ করেছ। আমি বলতে চাই- এ সত্য সকলেই জানে। কেউ যদি আমাকে বাঁচাতে পারতো, সেটা হতে তুমিই। তুমি এত ভালো!- আমি তোমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে পারি না। আমার মনে হয় না আমাদের দুজনের চেয়ে বেশি সুখী আর কেউ হতে পারবে।



এই কথাগুলো আমারও হতে পারে কিংবা যেকোন সংবেদনশীল মানুষের কথাও হতে পারে তাই না? নিশ্চয় বুঝে ফেলেছো এটা কার সুইসাইড নোট। তার মৃত্যুও কাব্যিক ব্যঞ্জনার। নিজের ওভারকোটের পকেটে নুড়ি পাথর বোঝাই করে হেঁটে নেমে গিয়েছিলেন খরস্রোতা পাথুরে নদীতে। আর কোনদিন ফিরে আসেননি। বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম অ্যাডলিন ভার্জিনিয়া স্টিফেন উলফ নারীদের হয়ে লিখে গেছেন বহু চিঠি এবং ডায়রি। তাঁর ডায়রিতে বর্ণিত ঘটনাগুলি সেই সময়ের এক বিশ্বস্ত দলিল। পনের বছর বয়েসে তিনি প্রথম ডায়রি লেখেন। আর শেষ লেখাটি লিখেছিলেন মৃত্যুর ঠিক চারদিন আগে অর্থাৎ ২৪ মার্চ। তিনি তার লেখা খুব যত্ন করে রঙিন কাগজের মলাটের ভিতরে গুছিয়ে রাখতেন। অতীতচারণা করার সময়ে ডায়রির সাহায্য নিতেন, পরবর্তীতে এই বিষয়ের উপরে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। তিনি লন্ডনের একটা কলেজে ইংরাজি ও ইতিহাস পড়ানোর পাশাপাশি দ্য গার্ডিয়ান, দ্য টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট এবং বিভিন্ন প্রকাশনার জন্যে নিবন্ধ, রিভিউ লেখেন সমসাময়িক এবং ধ্রুপদী সাহিত্য বিষয়ে। এই সময়ে তিনি এবং তাঁর স্বামীর কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা বৌদ্ধিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলেন। লন্ডনের গর্ডন স্কোয়ারে ১৯০৬ সালে ‘থার্সডে ইভিনিং’ এবং পরে ‘ফ্রাইডে ক্লাব’-এ সাহিত্য, শিল্পকলা, বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলত। লেখার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন”। এই উক্তি বিশ্ব সাহিত্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া নারী মুক্তির অগ্রদূত, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার, লিঙ্গবৈষম্য, রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজ বিশ্লেষক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য উদ্দেশ্য করে ভার্জিনিয়ার ভাষ্য, যদি নিজস্ব একটা ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেয়া হয়, নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারবে। জেইন অস্টেন থেকে ব্রন্টি ভগ্নিদ্বয়, জর্জ এলিয়ট ও মেরি কারমাইকেল পর্যন্ত সব লেখিকাই অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শেকসপীয়রের স্তরে উন্নীত হতে পারছে না আর্থিকভাবে সামর্থ না থাকার কারনে। আর তাই নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর। আর নারীদের নিচে ফেলে না রাখলে পুরুষরা বড় হবে কি করে- এই মনোভাব বজায় রাখলে নারীদের মুক্তি মিলবে কিভাবে? তদানীন্তন সময়ে ঝাঁঝালো এই প্রশ্ন ব্রিটিশ পুরুষতান্ত্রিক সুশীল সমাজের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়।



জীবনের পরিবর্তনশীলতা, সময়, স্মৃতি, সামাজিক সম্পর্ক, এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভার্জিনিয়ার লেখা তার শেষ উপন্যাস বিটুইন দ্য এ্যাক্টস তোমার খুব প্রিয় আমি জানি। তুমি জানো নিশ্চয় ভার্জিনিয়া শিক্ষা, গির্জা, চিকিৎসা, আইন ইত্যাদি নানা জায়গায় কাজের জন্যে শিক্ষিত নারীদের প্রবেশাধিকারের সমস্যা নিয়ে কলম ধরেছিলেন। অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ থেকে নারীদের বহিষ্কারের ফলে তাঁর কলম গর্জে ওঠে। নারী পুরুষের সমতা নিয়ে তাঁর লেখা উপন্যাস, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রামসে’ পড়েছো কি? কিংবা তার বায়োগ্রাফি ‘ফ্লাস’? রোডলফ বেসিয়ারের একটি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিকশনধর্মী এই উপন্যাসটি একটি কুকুরের চোখ দিয়ে পুরো থিমটি তুলে ধরা হয়েছে। ভার্জিনিয়া উলফ তার আন্টি ফটোগ্রাফার জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুনের জীবনের নানা দিক নিয়ে ‘ফ্রেশওয়াটার’নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। আমার অবশ্য ভালো লাগে ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘এম আই এ স্নব’। বইটিতে মূলত সমাজের ধনাঢ্য শ্রেণী এবং সেই সাথে সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি হওয়ার যে সংকট তা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও তাঁর জেকবস্ রুম, ওরলানডো, দ্য ওয়েভস্ উপন্যাসগুলোও আমার ভালো লাগে।



আমার মাথায় একটা প্রশ্ন সন্ধ্যা থেকে ঘুরছে, লেখকের মৃত্যু, বিশেষত আত্মহত্যা তাঁকে মহান করে কি? বিশ্বসাহিত্যে শতাধিক খ্যাতনামা কবি-লেখকের খোঁজ মিলবে, যাঁরা আত্মহত্যায় নিজেদের জীবনের ছেদ টেনেছেন। খোঁজ নিলে আরও দেখা যাবে, তাঁদের লেখালেখিতে নিজেদের মনোজগতের ছাপ পড়ুক বা না-ই পড়ুক, তাঁরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিজীবনে প্রবল মানসিক চাপ বয়ে বেড়িয়েছেন, যা প্রায়ই তাঁদের এক দুঃসহ বিষণ্নতা ও মনোবৈকল্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অতি বিখ্যাত আত্মহননকারী হিসেবে যাঁদের নাম প্রথমেই মনে আসে—প্রত্যেকেই মনোরোগের নানা লক্ষণে আক্রান্ত ছিলেন। ভার্জিনিয়া উলফের হৃদয়বিদারক সুইসাইডের কথা ভেবে উঠতে উঠতে তোমাকে আরও কয়েকটা নাম মনে করিয়ে দিই— সিলভিয়া প্লাথ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইয়ুকিও মিশিমা। প্রত্যেকে আত্মহন্তারক। মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বড় যত্নে ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের বিছানার পাশে প্লাথ সাজিয়েছিলেন দু-গ্লাস গরম দুধ আর রুটি, তারপর মাথাটা গুঁজে দিয়েছিলেন জ্বলন্ত ওভেনের ভেতরে। হেমিংওয়ে তাঁর সেই আত্মঘাতী রাতে শুতে যাওয়ার ঠিক আগে খেয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক স্ট্রিপ স্টেক, বেকড পোট্যাটো আর সিজার স্যালাড, সঙ্গে ছিল দুর্মূল্য বোরদো। কী এক অসহ্য তাড়না তাঁকে ডেকে নিল গহীন ঘুমের ভেতর থেকে, আর সুষুপ্তির অন্তরালে পার্শ্ববর্তিনীকে ফেলে রেখে নীচের বারান্দায় গিয়ে তিনি গুলি চালালেন নিজস্ব করোটি ফুঁড়ে। ‘আত্মহত্যা নিয়ে আমার না আছে কোনও শ্রদ্ধা, না আছে কোনও মায়ামমতা’— এমন পঙ্‌ক্তিমালা লেখার পরেও গ্যাসের নব নিজের হাতে খুলে দিয়ে নিজের শ্বাস রোধ করে মৃত্যু চেয়েছিলেন কাওয়াবাতা। আর মিশিমা? অনেক আশার বারুদ ঠাসা ছিল তাঁর বুকে, সেই সব স্বপ্নজাগরের অকালমৃত্যুসম্ভাবনায় আপন হাতে পেটের নাড়িভুঁড়ি চিরে বের করে বেছে নিলেন হারাকিরি মৃত্যু। সিলভিয়া প্লাথ ভেবে দেখবেন একবার, যেই মুহূর্তে আপনি জানলেন এঁদের প্রত্যেকের আত্মহননবৃত্তান্ত, এঁদের লেখার মোহের চাইতেও এঁদের আত্মহত্যার বয়ানটি জানার দুর্মর লোভ চেপে কি বসছে না আপনার মনে? ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা’ করা সেই ‘বিপন্ন বিস্ময়’ সম্পর্কে অনন্ত কৌতূহল কি আপনাকে কি গ্রাস করছে না? উলফও জানতেন সে-কথা। জানতেন, হাজার আলোর রোশনাই এসে পড়বেই তাঁর জলে ভিজে হেজে-যাওয়া মৃত মুখে, শ্যাওলা-জড়ানো চুলে, পাথরের ভারে ছিঁড়তে বসা পকেটের খাঁজে। লেখকের ‘সুইসাইড নোট’ও সাহিত্যবিচারের আতসকাচের তলায় পড়তে পারে, এ-কথা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই, স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লেখা সেই শেষ চিঠিতে কৈফিয়তের জবানিতে লিখে গেলেন— ‘দ্যাখো, এ চিঠিটাও আমি ঠিকমতো লিখতেই পারছি না। পড়তেও পারি না আর।’ তবু রেহাই মেলেনি। তিন সপ্তাহ পর অর্ধগলিত সেই শবদেহ যখন শনাক্ত করছেন লিওনার্ড উলফ, ইতিমধ্যেই হাজার অভিযোগের তির ধেয়ে এসেছে তাঁর দিকে। ‘ঘোড়ার মতো মুখ আর হাত-কাঁপার জন্মগত রোগ’ওয়ালা এই কপর্দকশূন্য ইহুদিটাকে কেন এককালে বিয়ে করেছিলেন ভার্জিনিয়া স্টিফেন, নিশ্চয় এর অযত্ন আর অবহেলাতেই প্রাণ গেল সম্ভাবনাময়ীর! এমন চিত্রনাট্য তখন রোজ ছাপা হয় খবরের কাগজে। প্লটটা অবশ্য মুখ থুবড়ে পড়ল, কারণ কাগজে-কলমে লিওনার্ড প্রমাণ করলেন, ভার্জিনিয়া ভুগছিলেন বাইপোলার ডিজঅর্ডারে। ভয়াবহ ডিপ্রেশন আর ম্যানিয়াগ্রস্ত উত্তেজনা যে-রোগের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।



সৃজনশীলতার সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার কি কোনো সংগোপন সম্পর্ক রয়েছে? কারও কারও ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, ব্যাপারটা এমন একধরনের মানসিক বিকার (কখনো কখনো অসুস্থতার কাছাকাছি), যা সৃজনশীলতাকে উদ্দীপ্ত করতেও সাহায্য করে, আবার অন্যদের ক্ষেত্রে তা হয়তো একপর্যায়ে বিনাশী রূপ ধরেই আসে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, লেখালেখি বা শিল্পচর্চা ছাড়াও সামগ্রিকভাবে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যাঁরা লিপ্ত, তাঁরা সমাজের অন্যদের থেকে কমপক্ষে ৮ শতিংশ বেশি বিষণ্নতা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তবে কবি-লেখকদের বেলায় এই ঝুঁকি আতঙ্কিত হওয়ার মতো বেশি। ভুক্তভোগীদের শতকরা ৫০ জনই আত্মহত্যায় জীবনের ছেদ টেনেছেন এমন তথ্য রয়েছে। মার্কিন ঔপন্যাসিক ই এল ডকটোরো এ বিষয়ে খোলাখুলি মতামত দিয়েছেন এই বলে যে লেখালেখি সামাজিকভাবে অনুমোদনপ্রাপ্ত একধরনের সিজোফ্রেনিয়া।



ভার্জিনিয়া উলফের বিষয়ে ধারণা করা হয়, তাঁর শেষ উপন্যাস বিটুইন দ্য এক্টস-এর (মৃত্যুর পর প্রকাশিত) পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার পরপরই তাঁকে প্রচণ্ড বিষণ্নতা পেয়ে বসেছিল। ইতিপূর্বেও একাধিকবার এমন হয়েছিল—পরিবারের আপনজনের মৃত্যুতে এবং বই প্রকাশের পর অসন্তুষ্টিতে। তবে সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকবলিত পৃথিবীর নানা দুর্যোগও তাঁর বিষণ্নতাকে মনোবৈকল্যের এক চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। একার অন্ধকারে ডুবে মরা এই ভার্জিনিয়ার জন্য কোথাও ছিল না একফোঁটা চোখের জল। সবাই তাঁর মেধার দখলস্বত্ব বুঝে নিতে চায় শুধু। একের পর এক খবর তখন সিলমোহর দিয়ে জানান দিচ্ছে ভার্জিনিয়ার মৃত্যুজনিত বিষণ্নতা আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীর শহুরে ক্লান্তি আর বিষণ্নতার দ্যোতক। তাদের নির্মম তাত্ত্বিক দর্শনের পুঁজি উপুড় করে এই মৃত্যুকে মুড়ে ফেলতে চাইছে গবেষণার শুখা কাগজে। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে জীবন দুর্বহ হয়ে পড়ার ঘটনা খ্যাত-অখ্যাত বিস্তর কবি-সাহিত্যিকের বেলায় ঘটেছে। কেবল খ্যাতনামাদের তালিকাই কম দীর্ঘ নয়; তবে এই বিষণ্নতা সবার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তা বলা যাবে না। ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিষণ্নতাসহ নানা বিতর্ক দাঁড় করালেও এর পেছনে বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁর বৈরিতাজনিত হতাশাকে মূলত দায়ী করা হয়ে থাকে। সৃজনশীলতা, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যা—এই তিনের অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। বইপত্রও লেখা হয়েছে। সুরাহা হওয়ার বিষয় নয়, তবু কোথাও যেন একই সুতার টান টের পান কেউ কেউ, বিশেষত মনোবিশ্লেষকেরা।



তোমাকে লিখতে লিখতে রাত পেরিয়ে পুবের আকাশ রাঙা হয়ে উঠছে। ব্রহ্ম মূহুর্ত পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। আকাশটা প্রথমে গভীর নীল, তারপর ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছে। দিগন্তে যেন কেউ হালকা হলুদ রঙের তুলির আঁচড় টেনে দিয়েছে। সেই আঁচড়ের ভেতর থেকে বেরোতে শুরু করেছে লালচে আভা। আর কয়েক ঘন্টা পরেই বেনারস নামবো। ভাবছি বহুবছর পরে আবার যখন এসেছি বাবু মায়ের পিন্ডটা দিয়ে যাবো। আবার কবে আসবো আদৌ আসবো কিনা জানিনা। ট্রেনের কামরা জেগে ওঠছে। চিঠিটা বেনারস নেমে পোষ্ট করবো। নিরন্তর ভালো থেকো।



অন্তে প্রীতি হোক

বাসু

২৮ সেপ্টেম্বর,২০২৫

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















১৫

গের্ট হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ইনেসের দিকে।

-‘উকিল হয়ে পাশ করলে… কিন্তু সেটা তো আলাদা ব্যাপার। সেটা তো পেশা!’

-‘পেশা হোক বা ব্যক্তিগত জীবন… আসল ব্যাপারটা তো তোমাকে নিয়েই। যাই হোক, আমার মতে তোমার মনের জোর যে কম শুধু তাই নয়, তুমি অদ্ভুত কাপুরুষের মত আচরণ করছ।’

-‘কাপুরুষের মত?’

-‘হ্যাঁ। কারণ বের্শেন চলে গেছে বলে তুমি কষ্ট পাচ্ছ এবং কষ্ট পেয়ে নিষ্কর্মার মত বসে আছ। কোনও কাজ না করার ফলে তোমার কষ্ট আরও বেড়ে যাচ্ছে। তুমি নিজেও জান যে তোমার মনের জোর নেই এবং সেই কারণেই তুমি পড়াশুনায় ফিরতে চাইছ।’

-‘সেই কথাটা তোমার আমাকে না বললেও চলবে। ও হ্যাঁ, ভাল কথা… ঠিক কী কারণে বের্শেনকে আমার ভালবাসা উচিত নয়?’

-‘এটা তো আমারও প্রশ্ন! শোনো গের্ট, তুমি তো আর কচি খোকা নও। নিজের প্রতি সৎ থাকো। আসল কথাটা কী?’

-‘আমার ভীষণ একা লাগছে ইনেস। সহ্য করতে পারছি না আমি।’

-‘পড়াশুনা শুরু করলে অবশ্য একদিকে ভালই হবে। তুমি তো আগে কখনও সেভাবে খাটবার চেষ্টা করনি।’

-‘এইরকম একাকিত্ব আমি সহ্য করতে পারছি না!’

-‘অনেকেই তো একা। তাছাড়া তোমার সঙ্গে তো আমি আছি, ফ্লক আছে। তুমি যদি চাও, বের্শেনের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারো। সে হতভাগা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।’

-‘ভুল করছ… আমি তো বের্শেনের কাছে কিছু চাইনি। বরঞ্চ সে চলে যাবার পরে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। ওর সুন্দর মাথার গড়ন, মিষ্টি শিশুসুলভ মুখ… এসব দেখেই আমার অসহ্য লাগতো। ও সব সময় আমাদের সঙ্গে চিপকে থাকতো… সব সময়! পুরো ব্যাপারটাই বিরক্তিকর!

- ‘থামো! তুমি নিজেও জানো যে যা বলছ সেটা তুমি বিশ্বাস কর না।’

কিন্তু গের্ট থামে না। থামতে চায় না সে। ইনেসের দুটো হাত শক্ত করে ধরে আছে সে। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে প্রচণ্ড আবেগমথিত স্বরে সে বলে যায়…

‘ইনেস, ও আমাদের বিরক্ত করত। আমি একদম নিশ্চিতভাবে, ঠিকভাবে ভেবেই বলছি তোমায় যে ও আমাদের জ্বালিয়ে খেত। তুমি ওকে কত প্রীতি ভালবাসা দিয়েছ, আমিও দিয়েছি। তুমি সব সময় ওকে আগলে দেখে রাখতে, যখন আমরা সন্ধ্যায় একসঙ্গে বেরতাম লং ড্রাইভে। আমরা ওকে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।’

‘এবং সে শান্ত হয়ে ফ্লককে কোলে নিয়ে তার কলারটা চেপে আমাদের মাঝে বসে থাকত; সেও সব সময় আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ প্রীতি দেখিয়েছে।’

‘কিন্তু তুমি তাকে আমার চেয়েও বেশি ভালবাসা দিয়েছ। আমার ব্যাপারে তুমি সেভাবে পরোয়া কর না।’

‘ছেলেমানুষি কোর না গের্ট!’

‘ওহ… ইনেস, আমি চাই যে তুমি আমায় ভালোবাসো!’ গের্ট আরও শক্ত করে চেপে ধরে ইনেসের দুই হাত। এতটাই শক্ত করে ধরে যে তার কব্জি ফ্যাকাসে হয়ে যায়; ইনেসের হাতের পাতায় সে নিজের মুখ চেপে ধরে। এক অদ্ভুত সমর্পণে কম্পিত হয়ে আনত হয় তার শরীর। মুখমণ্ডল উত্তেজনায় সাদা হয়ে যায়। ইনেস গের্টের গলা জড়িয়ে ধরে তার দুই হাতে। কিছুক্ষণ পিছনদিকে হেলিয়ে রাখে তার মাথা। তারপর হঠাৎ চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে কেঁদে ওঠে তীব্রভাবে।

-------------------









প্রথমে বের্নহার্ড চার্লসকে জেরাল্ডের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেনি। তবে যাবার কথা উঠতো মাঝে মাঝেই। বিকেলের দিকে সময়টা ফাঁকা থাকত। ইচ্ছে হলে পরদিনই যেতে পারত তারা। এরকম একটা অদ্ভুত ব্যাপার বেশিদিন ফেলে রাখা ঠিক নয়। কিন্তু চার্লসের এক গোঁ; সে যেতে একেবারেই রাজি নয়। সে বলল যে তার ভয় করছে। এখন এই ভয়ের ব্যাপারে বের্নহার্ড আর কী বা করতে পারে? চার্লস উল্লেখ না করলে জেরাল্ডের বাড়ি যাবার ব্যপারে বের্নহার্ড আর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছুই বলবে না ঠিক করল।



অবশ্য বের্নহার্ড নানা ব্যাপারে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অচেনা জায়গা, সবকিছুই অজানা অচেনা তার কাছে। ফলে অনেক সময় তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তাছাড়া আসল কথা হল যে তার আরও অর্থ প্রয়োজন। মাসের প্রথমে বাবা যে টাকাটা পাঠিয়ে দেন, তাতে ঘর ভাড়া আর দুই বেলার খাওয়া হিসেব করে চললে কুলিয়ে যায়। কিন্তু লন্ড্রির খরচ, স্বরলিপি কিনবার খরচ, পিয়ানোর ভাড়ার খরচ ছাড়াও শীতের জন্য বেশ কিছু পোশাক কেনা প্রয়োজন, যেগুলো সে এখনও কিনে উঠতে পারেনি। এছাড়া বাসভাড়া থেকে শুরু করে চার্লসকে সিগারেট কিনতে ধার দেওয়া পয়সা… খরচের কি শেষ আছে? মোট কথা হল যে তার টাকা দরকার।

আশ্চর্য হয়ে সে লক্ষ্য করল যে চার্লস এবং অন্যান্য বন্ধুদের কাছে সে যেরকম পরিস্থিতির কথা অতীতে শুনেছে, সে নিজেই এখন সেরকম পরিস্থিতিতে পড়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি সামলে নেবার জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত নয়। তার টাকার দরকার এবং সে জানে না যে কী ভাবে সেই টাকা যোগাড় হবে। চার্লস সে কথা শুনে শুধুই কান এঁটো করা হাসি দিল। বের্নহার্ডের একেবারেই ভাল লাগল না তার এই অদ্ভুত ব্যবহার। কারণ বের্নহার্ড তাকে গত বেশ কয়েকটা সপ্তাহে বারেবারে সাহায্য করেছে। তাছাড়া পরের কিস্তির টাকা মাদাম দুবোয়ার কাছ থেকে পেতে আরও আটদিন বাকি আছে এবং সে কথা শুনে কী ভাবে কারো হাসি পায়, সেটাও বের্নহার্ড ভেবে পেল না।

বের্নহার্ড তার সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে জানালো তার সমস্যার কথা। সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে একটা নয়, একাধিক উপায় জানা আছে এই সমস্যার সমাধান বের করবার। এখন বের্নহার্ডকে বেছে নিতে হবে সে ঠিক কোন কাজটা করতে চায়।

‘আপনি তো নিজেও সঙ্গীত শিক্ষা দিতে পারেন, আপনার অগ্রগতি প্রশংসনীয়!’

প্রশংসা শুনে বের্নহার্ড লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

‘কিন্তু আপনাকে দেখতে খুবই তরুণ… আসলে দেখে মনে হয় স্কুলের শিক্ষার্থী!’

বের্নহার্ড এই কথাটা হাসিমুখে একেবারে অগ্রাহ্য করে। কারণ, যে উপায়গুলি তার সামনে এসেছে, সেগুলো বেশ আকর্ষণীয়। যেমন, একজন ভদ্রমহিলা এসেছেন আমেরিকা থেকে, মাতৃভাষা জার্মান, পোষা একটা বাঁদর আছে বাসায় এবং তিনি কণ্ঠসঙ্গীত শিখতে চান। বের্নহার্ডের শিক্ষকের নামডাক শুনে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছেন। এই ভদ্রমহিলা খুব ধনী এবং গায়িকা হতে চান; অথচ তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না যে কেন শিক্ষক প্রতিদিন তাঁকে সঙ্গীতশিক্ষা দিতে রাজি হন না।

এছাড়া আছে একটা রাশিয়ান কয়ার, যারা একজন বাজিয়ে খুঁজছে, যে স্বরলিপি দেখে চট করে বাজিয়ে দিতে পারবে এবং অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী এবং কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে রিহার্সাল দেবার সময় বের করতে পারবে।

আর আছে একটা জ্যাজ ব্যান্ড, যারা একজন প্রতিভাবান পিয়ানোবাদকের সন্ধানে আছে। এরা সিন নদীর উত্তরে শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা ছোট বারে নিয়মিত কনসার্ট করে। দিনে চার ঘণ্টা এদের সঙ্গে বাজাতে হবে। অনুষ্ঠানের সময় শিল্পীরা লাল স্যুট আর সাদা লাল চেক টাই পরে এবং বের্নহার্ড এদের সঙ্গে বাজালে দিনে ১৫০ ফ্রাঁ রোজগার করতে পারবে, কারণ এই ব্যান্ডটার বেশ নামডাক আছে।

কিন্তু এই তরুণ পিয়ানোবাদককে সব বিষয়গত খুঁটিনাটি ভালভাবে জানতে হবে এবং সেই ব্যান্ডে অন্তর্ভুক্ত হবার আগে একটা অডিশন পরীক্ষায় উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু বের্নহার্ডের মনে একটু সন্দেহ ছিল যে এই কাজটা সে ঠিকভাবে সামলাতে পারবে কি না। ফলে সে ওই আমেরিকান ভদ্রমহিলা, যার পোষা বাঁদর আছে, তাঁকে সঙ্গীতশিক্ষা দেবার কাজটা বেছে নিল। তার শিক্ষক তার যোগ্যতা বিষয়ে সুপারিশ করে খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখে দিলেন। চিঠিটা নিয়ে দিনের শেষে বের্নহার্ড খুব ক্লান্ত হয়ে নিজের বাসায় ফিরল।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















২৩.২

রঙ্গনাথের প্রিন্সিপালের কথায় বাধা দিয়ে কিছু বলার সাহস হল না। তাই বলল, “হ্যাঁ, প্রিন্সিপাল

সাহেব, ঠিকই আছে’।


হঠাৎ প্রিন্সিপাল খেপে গেলেন। “ঠিক তো বটেই রঙ্গনাথ বাবু, আমায় চার চার বোনের বিয়ে দেয়া

বাকি। পকেটে একটা ফুটো কড়িও নেই। কাল বৈদ্যজী যদি আমায় কান ধরে কলেজ থেকে বের করে দেন

তো কেউ ভিক্ষাও দেবে না।

“তাহলে আমি ওই খান্না-বান্নাকে বাপ বলে ডাকব, নাকি বৈদ্যজীকে? তুমিই বলে দাও”।

গোড়ার কথাবার্তায় প্রিন্সিপালের একটা মানবিক এবং সংবেদনশীল চেহারা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু

এখন উনি যা করছেন তাতে সেই চেনা বাংগড়ুপনা বা ক্যাওড়ামিই প্রকট হচ্ছে। এভাবে ওঁর তৈরি

সাময়িক আবেগঘন মায়ার প্রভাব গায়েব হয়ে গেল।

রঙ্গনাথ আগের মত হালকা মেজাজে। বলল, “না না; আপনি যা করছেন- সব ঠিক। আর যেখানে যা আছে,

সব ঠিকই আছে। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হলে বেশি কি হত? এখানে আপনি কোন ভাইস চ্যান্সেলরের

চেয়ে কম নাকি”?

এতক্ষণে প্রিন্সিপাল একটু হাসলেন। বললেন। “ হ্যাঁ, সে তো বটেই। আমি তো নিজেকে ভাইস

চ্যান্সেলরের থেকেও সেরা ভাবি। আজকাল ভাইস চ্যান্সেলরের জীবনও নরক সমান। সকাল থেকেই

নিজের মোটরগাড়ি চড়ে সমস্ত আমলাদের সেলাম ঠুকতে বেরোয়। কখনও চ্যান্সেলরের সামনে হাজির

হও, কখনও কোন মন্ত্রীর, কখনও সেক্রেটারির। গভর্নর বছরে অন্ততঃ চারবার বকুনি লাগান।

দিনরাত ক্যাঁও -ক্যাঁও, চ্যাঁও -চ্যাঁও! ছাত্রের দল মুখের উপর মা-বোন তুলে গালি দিতে দিতে মিছিল

বের করে। সবসময় মার খাওয়ার ভয়! পুলিস ডাকো তো এসপি হাসে। বলে -দেখ এই ভাইস

চ্যান্সেলরকে! ছেলেদের উপর বছরে দশ- বিশবার লাঠি তলোয়ার না চালিয়ে এনার শান্তি নেই। এই তো

অবস্থা, বাবু রঙ্গনাথ”!

গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বললন,”এখনও প্রিন্সিপালগিরিতে এসব ঝামেলা শুরু হয় নি। আর যেখানে

বৈদ্যজীর মত ম্যানেজার, সেখানে প্রিন্সিপাল, ধরে নাও, কোন বব্বর সিংহের চেয়ে কম নয়। আমি

কাউকে খোশামোদ করতে চাই না। বৈদ্যজীর খুঁটি ছুঁয়ে রেখে সবাইকে জুতোর আগায় ঠিক রাখি। তুমি কী

বল, বাবু রঙ্গনাথ”?

“যা বলছেন, একদম ঠিক”।

“আর সত্যি কথা জানতে চাও তো বলি—ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার না হওয়াতে আমার কোন দুঃখ

নেই। ওখানে আরো বড় নরক, একেবারে কুম্ভীপাক! রাতদিন খোসামুদি। কোন সরকারি বোর্ড দশ

টাকার গ্রান্ট দেয়, তো কান ধরে যেমন ইচ্ছে থিসিস লিখিয়ে নেয়। যাকেই দেখ, একটা না একটা

রিসার্চ প্রোজেক্ট বগলদাবা করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলে—রিসার্চ করছি। কেমন রিসার্চ?

যার খাচ্ছ, তার গুণ গাইতে থাক, ব্যস। এদের কী যেন বলে? একটা বিশেষ শব্দ? হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ল-

-বুদ্ধিজীবী। অবস্থা এমন যে এইসব বুদ্ধিজীবীরা বিলেত যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজের বাপের

নাম বদলে দিতে পারে। এদের চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দশবার জুতোপেটা কর, কিন্তু একবার তো

আমেরিকা ঘুরে আসতে দাও! এই হল তোমার বুদ্ধিজীবী”।

এবার উনি নিজের মাতৃভাষা অবধী থেকে একটি প্রবাদ আউড়ে দিলেন।

“গু খেতে হলে হাতির গু খাব। আমি তো এটাই ভেবেছি যে বৈদ্যজীর খোসামোদ করলে আর কাউকে তেল

দেবার দরকার নেই। লেকচারার হওয়া আমার পোষাবে না”।




প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে লেকচারার হবেন না জানিয়ে দিলেন। ওনার মুখের ভাবে মনে হল যেন সংসারের

সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকের ছায়া নেমেছে।

“এটা একদম ঠিক বলেছেন”, রঙ্গনাথ সায় দিল।

প্রিন্সিপাল তীক্ষ্ণ চোখে রঙ্গনাথকে দেখতে লাগলেন। তারপর ফিকে হেসে ধীমে স্বরে বললেন, “কী

ব্যাপার বাবু রঙ্গনাথ? আজ আমি যাই বলি সবতাতেই হ্যাঁ বলছ যে”?

রঙ্গনাথ বলল, ‘ভাবছি, আপনার অভিজ্ঞতা থেকে শিখব। কী দরকার কারও কথার ভুল বের করার? যে

যাই বলুক, আমি বলব –ঠিক বলেছেন”।

প্রিন্সিপাল সাহেব হা-হা করে হেসে উঠলেন, “তুমিও ঠিক বলেছিলে, রঙ্গনাথ বাবু। যখন পিকাসোর নাম

নিলাম, তোমার নিশ্চয়ই বমি পাচ্ছিল, এটা বুঝি—।

“এতে অবাক হবার কী হয়েছে? এসব কথার প্রভাব মেশিনের উপরেও পড়ে। তোমায় একটা ঘটনার কথা

বলি।

“একটা হাওয়াই জাহাজ ইন্ডিয়া থেকে ইংল্যাণ্ড যাচ্ছিল। যাত্রীদের মধ্যে একজন তামাক ব্যবসায়ী

ছিল। শালার সারা জীবন কাটল বিড়ি-সিগ্রেটের কারবার করে। হঠাৎ ওর কী যে হল, ব্যাটা লিটারেচার

আর ফিলজফির তত্ত্ব আওড়াতে লাগল। ব্যস, তক্ষুণি হাওয়াই জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল।

বিমান একহাজার ফুট নীচে নেমে এল। আতংক ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ভাবল কোন দুর্ঘটনা হয়েছে, কিন্তু

একটু পরে আবার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। বিমান উড়তে লাগল।

“হাওয়াই জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার কারণ খুঁজে কী পেল জান? ওই তামাকের ব্যবসায়ী হঠাৎ কার্ল

জেসপার্সের নাম নিয়েছিল। আর সেই ঝটকায় বিমানের ইঞ্জিনের হার্ট ত্থেমে গেল।তখন সব যাত্রী

ওই লোকটাকে মিনতি করতে লাগল—মশাই, হয় চুপ করে থাকুন, নয় শুধু তামাক নিয়ে কথা বলুন। নইলে

অ্যাকসিডেন্ট হবে”।

রঙ্গনাথ হেসে উঠল,”আজ আপনি ভারি মজার কিসসা শোনাচ্ছেন”।

প্রিন্সিপালের চেহারায় উদাস ভাব। “আপনার জন্য রোজ এমন সব কিসসা শোনাতে পারি। কিন্তু আপনি

আমাকে কোথায় পাত্তা দিচ্ছেন? আপনি তো আজকাল খান্না মাস্টারের কথায় নাচছেন”।




ওরা এখন ফেরার পথ ধরেছেন। আঁধার নেমেছে। বাতাসে শীতের আমেজ। রাস্তার ধারে কয়েকজন

যাযাবর শ্রেণীর লোক বসে আগুন পোহাচ্ছিল আর অভিজাতকুলের অবোধ্য কোন ভাষায় নিজেদের

মধ্যে গল্প করছিল। যেভাবে লোকে পথের ধারে পড়ে থাকা গরু -মোষকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায়,

প্রিন্সিপাল তেমনই করে ওদের এড়িয়ে চলতে লাগলেন। রঙ্গনাথ একবার পেছন ফিরে ওদের দেখে

মন্তব্য করল—“বেশ ঠান্ডা পড়েছে”।

প্রিন্সিপাল সাহেব আবহাওয়া নিয়ে কোন কথা বলার মুডে ছিলেন না। উনি আগের কথার খেই ধরে

বললেন,”তোমরা এখনও লোক চিনতে শেখ নি। রূপ্পন তো শুনলাম খান্না মাস্টার চক্করে পড়েছে।

কিন্তু, বাবু রঙ্গনাথ! এই খান্না মাস্টারটি কেমন চিজ সে তো তোমার বোঝা উচিত।




“খান্না বড় চালু মাল। দেখ, সেদিন কলেজে মারপিটের পরিস্থিতি হল কিনা? ওর তো কিছু এসে যায় না।

কিন্তু কলেজের ইজ্জত গেল”।

রঙ্গনাথ, “আমি তো শুনেছি ঝগড়ায় দু’পক্ষেরই দোষ ছিল”।

প্রিন্সিপাল সাধু-সন্তের মত বললেন, “তোমার শোনা -না -শোনায় কি হয় বাবু রঙ্গনাথ? মামলা তো

এখন কাছারিতে পৌঁছে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট যেমন বুঝবেন, ফয়সালা করবেন”।

--“এ তো বড় খারাপ কথা”!

--‘খারাপ মানে? এক ঘটি জলে ডুবে মরার সমান, রঙ্গনাথ বাবু! কিন্তু খান্না মাস্টারের লজ্জা-শরম

বলতে কিছুই নেই। আমাকেই ওর গলায় পাথর বাঁধতে হবে, তবে না ডুববে”!

উনি এখন সরকারের প্রচার বিভাগের মত নিস্পৃহভাবে—অর্থাৎ কেউ শুনুক, না শুনুক, আমি তো

বলবই—বলতে লাগলেন।

“ পুলিস জবরদস্তি দু’পক্ষেরই নামে ধারা ১০৭ এর মামলা শুরু করেছে। এটা পুলিসের হারামিপনা। খান্না

করল বদমাইসি। ওর সঙ্গীসাথীরা মারামারির জন্যে উসকে দিল। আর পুলিস চালান কাটল দুপক্ষের

নামে! এ তো একদম ‘অন্ধের নগরী চৌপট রাজা’ 1 কেস।

“কালকেই শুনানি ছিল। আমাকে বলল মিটমাট করে নাও। আমি বললাম—তার কি দরকার? আমাকে

সোজা ফাঁসিকাঠে চড়িয়ে দিন—ঝামেলা খতম। শিবপালগঞ্জে শুধু খান্না মাস্টার থাকবে, আর থাকবে

ওর গুণ্ডার পাল। ফের কিসের ঝগড়া, কিসের বিবাদ?

“আমি তো চুপচাপ চলে এলাম। কিন্তু ওদের দেখ—সত্তরটা ছেলে নিয়ে ‘প্রিন্সিপাল মুর্দাবাদ’ মিছিল

বের করেছে। শহরের আদালত। অনেক ভালো লোকের নিবাস। ওরা জিজ্ঞেস করছিল—এইসব ছেলেপুলে

কোথাকার? খান্না মাস্টার আগ বাড়িয়ে বলে দিল –ওরা ছঙ্গামল কলেজের ছাত্র।

“বেশরম হতে হয় তো ওর মত”।

ফের উনি অবধী বুলিতে তিন নম্বর প্রবাদ আউড়ে দিলেন—'ন্যাংটোর পোঁদে জুটেছে ইজের, তো নেচে

নেচে বলছে-এই তো ছায়া পেয়েছি’।

“ বুঝেছ বাবু রঙ্গনাথ! এই হচ্ছে তোমাদের খান্না মাস্টার। রূপ্পন বাবুকে বলে দিও—ওর সঙ্গে বেশি

গা ঘষাঘষি না করতে। নইলে একদিন কাঁদতে হবে”।




এবার ওরা থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। লণ্ঠন হাতে ক’টা সেপাই এদিক করছে। ভারি শোরগোল।

কয়েকটা ছোঁড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোরাস গাইছে। থানার পাশে দারোগাজির কোয়ার্টারের সামনে তিনটে

ট্রাক দাঁড়িয়ে, তাতে মালপত্র তোলা হচ্ছে। হো-হল্লার আসল কারণ ওটাই।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, “মনে হচ্ছে দারোগাজীর হয়ে গেছে”! বলতে বলতে উনি রঙ্গনাথের কাঁধ

ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন, “এই ব্যাপার! পুরো এলাকা নোংরা ময়লায় ভরে গেছল। এবার সাফ হচ্ছে”।

1 হিন্দি কথা সাহিত্যের প্রখ্যাত ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের লেখা ‘অন্ধের নগরী চৌপট রাজা”।

প্রবাদের অর্থ যে দেশে নিয়ম কানুন নেই, রাজা গায়েব।




রঙ্গনাথ,”বুঝতে পারছি না, এত তাড়াতাড়ি অর্ডার এসে গেল! কী ভাবে? দুপুর বেলাতেও কোন খবর

শুনিনি তো”।

প্রিন্সিপাল সাহেবের খুশির কোন সীমা নেই। দেখে মনে হচ্ছে এবার উনি ডানা মেলে আকাশে উড়ে

সামনের গাছের ডালে গিয়ে বসবেন আর বুলবুলির মত সুরেলা শিস দেবেন। বললেন, “বাবু রঙ্গনাথ,

এতদিন মামার সঙ্গে থেকেও ওনাকে চিনতে পারোনি? আগের দারোগাকে উনি বারো ঘণ্টার মধ্যে

শিবপালগঞ্জ থেকে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। এই দাওগা তো তবু চব্বিশ ঘন্টা টাইম পেয়ে গেল”।

এরপর ফিসফিসিয়ে, “বৈদ্যজীর মহিমা কেউ বুঝতে পারে? যেদিন উনি জোগনাথকে জামিনে ছাড়লেন না,

সেদিনই বুঝেছিলাম যে এনার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তার সাথে আমার ১০৭ ধারার মামলা। তুমিই বল বাবু

রঙ্গনাথ, এর কোন দরকার ছিল? কিন্তু এনাকে বোঝাবে কে? ইনি রামাধীনকে বাপ ডেকেছেন। ও যেমন

ইচ্ছে, তেমনই নাচিয়েছে—সে তো তুমি দেখেছ। এখন এটাও দেখলে যে দশটা দিন গেল না, ওর শমন

এসে গেল”।

ছোকরার দলের কোরাস জারি—“দারোগাজী, ট্রাকে চড়লেন, দারোগাজী, ট্রাকে চড়লেন”।

ওরা দলবেঁধে ট্রাকে দারোগাজীর মালপত্র তোলা দেখছে।

একটা ট্রাকে শিশু কাঠের কিছু বড় বড় পালংক উঠে গেছে আর খালি জায়গাটুকুতে একটা চমৎকার

ভাল জাতের গরু আর তার বাছুর। প্রিন্সিপাল সাহেব দেখে টেখে প্রশ্ন করলেন, “মোষ দেখছি না যে!

মুররা জাতের দুধেল মোষ”?

রঙ্গনাথ বোঝাতে লাগল, “ এই গরুটা টিকৈতগঞ্জের ঠাকুর পরিবার দিয়েছিল। বিধবা ছেলে বৌয়ের পেট

খসানোর মামলা। গোদান করে পাপমুক্ত”!

উনি বিশেষ কাউকে লক্ষ্য না করে উঁচু আওয়াজে বললেন, “মোষটা কোথায় গেল? দেখছি না যে”!

অন্ধকারে কারও স্বর ভেসে এল—“বিক্রি হয়ে গেছে”।

“কোথায়”?

“শহর থেকে এক গোয়ালা এসেছিল”।

“কততে গেল”?

“একশ’তে আর কত? তুমি কি ভেবেছিলে-- হাজার”?

“আমি তো এখনও তাই ভাবছি”, প্রিন্সিপাল মজা করে বললেন।

তারপর রঙ্গনাথের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। ভাবটা—তুমিও কথাবার্তার মজাটা উপভোগ কর।

এখন ট্রাকের পাশে সেরেফ কিছু পালংক পড়ে আছে। রঙ্গনাথ শুনেছিল যে দারোগাবাবুর শখ নানারকম

পালংক জোগাড় করা। এখন নিজের চোখে দেখল। খুব হৈচৈ আর চেঁচামেচির মধ্যে ট্রাকে পালংক তোলা

হচ্ছে। কিছু উঠে গেছে, কিছু উঠছে, কিছু উঠবে। রাস্তায় কোরাস গাওয়া ছেলের দল এখন অন্ধকারের

মধ্যেও ট্রাকের কাছে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ভারি উৎসাহের সঙ্গে ট্রাকে পালংক তোলা দেখছে।

এক সেপাই ট্রাকে রাখা পালংকের উপর চড়ে হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে নীচের লোকজনকে পালংক তুলতে

নির্দেশ দিচ্ছে। “আবে ও! কব্জাটা ভেঙে ফেললি তো! জানতাম, এ ব্যাটা না ভেঙে ছাড়বে না”।




ওর হুঙ্কার শুনলে সবাই মানবে যে পালংকের কব্জা ভেঙে ফেলাটা আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে

বড় দুর্ঘটনা বটে! রঙ্গনাথও পালংক যারা ট্রাকে তুলছিল তাদের সান্ত্বনা দেবার জন্যে শীতল স্বরে

বলল, “হাঁ ভাই, কব্জা-টব্জা ভেঙো না। সামলে সুমলে ট্রাকে তোলো”।

প্রিন্সিপাল সাহেব রঙ্গনাথের কথা শুনে জোরে হেসে উঠলেন। এক সেপাই পালংক তোলার কাজ

করতে করতে নিজের জায়গা থেকে বলল, “কে বটে? প্রিন্সিপাল সাহেব নাকি? জয়হিন্দ্‌ সাহেব”।

“কী হয়েছে ভাই? জয়হিন্দ! বদলি হয়েছে কি”?

“হ্যাঁ, প্রিন্সিপাল সাহেব। দারোগাজী এসপি সাহেবকে দরখাস্ত দিয়েছিলেন। মেয়ের পড়াশুনোর জন্যে

শহরে বদলি চেয়েছিলেন”।

“আমার কলেজে ভর্তি করাতেন। শিবপালগঞ্জ কোন শহর থেকে কম নাকি”?

“আপনার কলেজ তো একটা হিন্দুস্থানী স্কুল। উনি ইংরেজিতে পড়াতে চান। ভগতিন স্কুলে। বেবির

উর্দি তৈরি হয়ে গেছে। নীল নীল উর্দি। গায়ে চড়ালে একদম ইংরেজ মেয়ের মত দেখায়”।

“তাহলে শহরে বদলি হয়েছে। বেশ, ভাল কথা। কিন্তু গরু কোথায় রাখবেন? খড় ভুষি কোথায় পাবেন?

গরুটা বেচবেন কি”?

সেপাই এবার একটা বড় পালংক হেঁইয়ো করে সর্বশক্তি দিয়ে ট্রাকে তুলছিল। কোঁকাতে কোঁকাতে

বলল, “না। গরু থাকবে সৈনিক ফার্মে। দারোগার ভাইসাহেব ওখানেই চাকরি করেন। এখানে গাই বেচারার

ঠিক মত খাওয়া জুটত না। এখন ওর খাওয়ার দিন আসছে”।

ট্রাকের উপরে সওয়ার সেপাইয়ের পুরো নজর পালংকের কবজায় আটকে ছিল। ও দাঁতে দাঁত পিষে

বলছিল, “ ঠিক সে। আবে ঠিক সে। আরে, আরে, এবার অন্য পালংকটাকেও ভাঙবি নাকি! যদি ভাঙে তো

সালা ---“।

কেউ বলল যে বৈদ্যজী এক্ষুণি দারোগাজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বলছিলেন—উনি থাকতে ওনার

বদলি কী করে হতে পারে? আদেশ বদলে দেবেন।

প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বললেন, “যদি চোখের চামড়া থাকে, তাহলে দারোগাজী ভোরের মোরগ ডাকার

আগে শিবপালগঞ্জ ছেড়ে চলে যাবেন”।

খানিকক্ষণ ট্রাকে চড়া মালপত্তর খুঁটিয়ে দেখা হল। রঙ্গনাথ বলল, “ দারোগাজীর শখ ছিল নানারকম

পালংক”।

“ওনার শখ যা কিছু মিনি মাগনা পাওয়া যায় তা হাতিয়ে নেয়া”। হঠাৎ উনি ট্রাকের উপড় চড়ে থাকা

সেপাইকে ডাক দিয়ে বললেন, “ আরে ভাই সেপাইজি! ওই কব্জা ভাঙা খাটিয়াটা ছেড়ে দাও না! যদি

টাকাখানেক দামে নীলামে ওঠে তো আমিই কিনে নেব”।

সেপাই বলল, “আপনি এত বড় মানুষ হয়ে কেন ছোটলোকের মত কথা বলছেন? নেবেন তো পুরো ট্রাক

নিয়ে নিন। বলুন, আপনার ঘরে পুরো ট্রাক পাঠিয়ে দিই”?

“হেঁ-হেঁ-হেঁ! একটা গোটা ট্রাক নিয়ে আমি কি করব? আমি তো মামুলি এক মাস্টার”। ফের গলার স্বর

বদলে মোটা আওয়াজে বললেন, “দারোগাজী ঘরেই আছেন তো? বৈদ্যজীও রয়েছেন? তো চলুন বাবু




রঙ্গনাথ, দারোগাজীকে সেলাম করে আসি। বেচারি বড্ড ভালমানুষ ছিলেন। কখনও কাউকে কষ্ট দেন

নি। কারও থেকে কিছু চাইতেন না। ভগবান যা দিতেন তাই চোখ বুঁজে নিয়ে নিতেন”।

হ্যাঁ, সত্যিই ভালোমানুষ ছিলেন, তাই চলে যেতে হল—রঙ্গনাথ ভাবছিল।

(চলবে)

0 comments: