প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধপ্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে সমগ্র দেশবাসীকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে বলেছেন সাইবার জালিয়াতির বিরুদ্ধে। কোভিড পরবর্তী যুগে সাইবার ক্রাইম মহামারীর ন্যায় অত্যধিক হারে বেড়ে যাওয়ায় জনগণ ভীত, সন্ত্রস্ত। একেকটা দিন যায় আর যারা তখনও ‘টার্গেট’ হয়নি শ্বাস ফেলে। যারা আক্রান্ত তারা প্রায় সর্বস্বান্ত।
সব সময়েই সমাজে ভাল ও মন্দ দু ধরনের মানুষ থাকে, একদল যখন কিছু ভাল কাজ করে অন্যদল তার বিপরীতে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে যখনই কোন নতুন আবিষ্কার বা পুরনোকে উন্নত করেছে তখনই অন্য এক গোষ্ঠী তাকেই সম্বল করে মানুষের ক্ষতি সাধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা পারমাণবিক ‘ফিউশন’ বা একীকরণ হোক অথবা ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশের মত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। পারমাণবিক একীকরণ মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করার আগেই তৈরি হয়ে গেল মানব বিধ্বংসী পারমাণবিক বোম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার পরীক্ষাও করা হোল, বিনা দোষে মারা গেল দেড় থেকে আড়াই লক্ষ লোক, চিরকালের মত পঙ্গু হয়ে গেল আরও বেশি এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের শরীরে সেই বিষ বহন করতে লাগল।
বৈদ্যুতিক থেকে বৈদ্যুতিন দুনিয়ায় প্রবেশ করে এসে গেল কমপিউটার। কায়িক শ্রম লাঘব করে শুরু হোল নতুন এক শ্রমজীবন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং পেশার অধিকারী ব্যক্তি, আদতে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। এই শ্রমে ঘাম ঝরে না কিন্তু ঘুম কাড়ে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবার ও সমাজ জীবন ধাক্কা খাচ্ছে। অতিরিক্ত শ্রমে ক্লান্ত যুব সমাজকে ক্লান্তি দূর করতে নানা ভোগ্যপণ্য ও উৎকট বিনোদনে মজিয়ে দিচ্ছে। হাতের মুঠোফোনে বিরামহীন হরেক বিনোদন, শ্লীল অশ্লীলে ভেদাভেদ ঘুচে যাচ্ছে বয়সের ভেদাভেদ না মেনেই। আর্থিক বৈষম্যের শিকার সমাজ, একদলের হাতে অর্থ অফুরন্ত অন্যদের বাড়ন্ত। বাড়ছে দ্বেষ হিংসা ঘৃণা পরিবার থেকে সমাজে, বৃহত্তর সমাজে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক এই সুযোগে জাগিয়ে তুলছে মানুষের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ একাধিক প্রক্রিয়ায়, এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কেও। শহরের এই ব্যধি অচিরেই ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত গ্রাম্য জীবনে। সারা পৃথিবী এক অস্থির অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে এল ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের পরিচয় নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা। ডিজিটাল পরিচয় পত্র অনেক সুবিধেজনক ও সুরক্ষিত, ব্যক্তিগত পরিচয় এবং আর্থিক লেনদেন।
আধার কার্ডে প্রত্যেকের পরিচয় সরকারের ঘরে সুরক্ষিত বলা হলেও সব জায়গায় সেই সুরক্ষাকবচ খুলে দিতে হচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে ফোনের সিম, হাসপাতাল থেকে শ্মশান সর্বত্র। ওঁৎ পেতে ছিল দুষ্টু লোকেরা। ঝাঁপিয়ে পড়ল টাকার ঝাঁপি নিয়ে। দুর্নীতির বাজারে বিক্রি হয়ে গেল আমাদের পরিচয়, যেন আমরাই বিক্রি হয়ে গেলাম। আর কিছু গোপন রইল না। “গোপন কথাটি রবে না গোপনে”, রবি ঠাকুরের গান যে এইভাবে সত্যি হয়ে উঠবে এত বছর পরে তা কি উনি জানতেন? আমতা আমতা করে সরকার একসময় স্বীকার করতে বাধ্য হোল কিছু ছাঁকনি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরে ছাঁকনিটাই তো ফুটো। সুরক্ষিত রাখার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াই হয়নি। চোর আটকাতে সদর বন্ধ, খিড়কী দরজা হাট খোলা। আমাদের সব ডেটা এখন ক্রিমিনালদের হাতে। তারা রীতিমতো অফিস চালাচ্ছে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ তাদের হাতে, নিত্যনতুন ক্রাইমের ফর্মূলা লিখছে। তাদের মাথায় এমবিএ ডক্টরেট মহাজ্ঞানীজন। শলাপরামর্শ দেওয়ার শিক্ষক আছে। আছে মনস্তাত্বিকও। তাদের পরিচালনা করছে কিছু মাফিয়া যাদের সঙ্গে রাজনীতিকদের যোগাযোগ রয়েছে। বিশাল ব্যবসা। একাধিক জায়গায়। ফাঁদ পাতা রয়েছে এ ভুবনে সর্বত্র।
এক দশকেরও আগে আমার জি-মেল সে হ্যাক করেছে বলে এক কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র আত্মীয় জানালো। পড়াকালীন অবস্থায় শিখে নিচ্ছে জালিয়াতির পাঠ। চেকপয়েন্ট গবেষণা অনুসারে সারা বিশ্বে প্রতি বছর আগের বছরের চেয়ে তিরিশ শতাংশ করে সাইবার ক্রাইম লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। গত বছর সাড়ে বারো বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং অনুমান আর চার বছরে চোদ্দ ট্রিলিয়ন ডলার ছোঁবে। এটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের হিসেব। এবছর দ্বিতীয় কোয়ার্টারে গড়ে প্রতি সংস্থায় প্রতি সপ্তাহে ১৬৩৬ বার আক্রমণ হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি বছর তেরো শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতে এবছর প্রথম চার মাসে ৭৪০,০০০ সাইবার ক্রাইম কেস নথিভুক্ত হয়েছে যার মধ্যে ৮৫% অনলাইন আর্থিক জালিয়াতি। এর মধ্যে ১,১৭,২০০ টির হদিস মিলেছে। বিশ্বে এবং এশিয়াতে যথাক্রমে দশম ও ষষ্ঠ স্থানে আছে ভারত। এ বছর সংস্থা এবং ব্যক্তি উভয়েই অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রতি এক লাখে ৪৪৬ জন আক্রান্ত। তথ্যপ্রযুক্তি রাজধানী শহর বেঙ্গালুরুতে সব থেকে বেশি ক্রাইম নথিভুক্ত হয়।
খুব প্রচলিত কয়েকটি সাইবার ক্রাইম হোল – অন্যের কমপিউটার বা নেটওয়ার্কে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া বা হ্যাকিং, সন্দেহজনক সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার কমপিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া, পরিচিতি তথ্য চুরি, ইলেকট্রিসিটি ফোন বা জলের বিল নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিয়ে টাকা মেরে দেওয়া, ব্যক্তিকে প্রলোভিত করে তথ্য বা টাকা পাঠাতে বলা, চাকরি পাওয়ার নাম করে টাকা হাতানো। কোনরকম ভয় দেখিয়ে যেমন পর্নোগ্রাফি, বেআইনি লটারি, মধুচক্র বা মাদক সংক্রান্ত কোনো চক্রের নাম করে তার সাথে যুক্ত থাকার খবর পুলিশ বা সিবিআই নাম নিয়ে কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসানো।
প্রতি ৩৭ সেকেন্ডে একজন আক্রান্ত হচ্ছে ভারতে বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ষোল থেকে চব্বিশ বছরের ছেলে বা মেয়ে। মধ্যবয়সী থেকে প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধদের বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে পঁচাত্তর বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিরা কম আক্রান্ত হলেও সহজে তাদের কব্জা করে টাকা আদায় করা যায়। প্রবীণদের প্রধান সমস্যা বয়সের জন্য অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে না পারা, সহজেই পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়া বা রক্ষা করা। তারা কোনো কাগজে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড তার সাথেই লিখে রাখেন যা সবসময় বিপদের। এছাড়া ফোনে বা হোয়াটস অ্যাপে বা মেইলে এমন কোনো মেসেজ বা ছবি পাঠানো হয় এবং তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি বা ডিজিটাল অ্যারেস্টের হুমকি দেওয়া হয় যার ফলে সেই ব্যক্তি সামাজিক অবমাননার সম্মুখীন হতে পারে এমন সংবাদে সহজেই আনমনা বৃদ্ধকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তাকে তার থেকে উদ্ধারের নামে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা আজকাল খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। গত বছর প্রায় লক্ষাধিক পেনশনপ্রাপক এই ধরনের জালিয়াতির শিকার।
ব্যক্তিগত স্তরে জটিল পাসওয়ার্ড বানানো (এটা প্রবীণদের পক্ষে মনে রাখা মুশকিল) এবং মাঝেমাঝে বদলে ফেলা, সামাজিক শিক্ষা ও সচেতনতা, সফটওয়্যার আপডেট, ফায়ারওয়াল ব্যবহার, ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা, সমাজমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়। সাইবার অপরাধ মোকাবিলা করার জন্য সরকারিভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে কাজ শুরু হয়েছে এবং পুলিশের প্রতি থানা ও হেড কোয়ার্টারে অপরাধ নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সব থেকে সুবিধেজনক ব্যক্তিগত স্তরে অচেনা নম্বরে সাড়া না দেওয়া বা ভুল করে ধরলেও যখন বোঝা যাচ্ছে সন্দেহজনক তখন তিরিশ সেকেন্ডের আগেই ফোন কেটে দেওয়া। ফোনের দখল যেন কোনভাবেই অপরাধীর হাতে না চলে যায়।
যতই প্রধানমন্ত্রী বলুন সদা সতর্ক থাকার কথা, মানুষের মন বিশেষত প্রবীণ মন অন্যমনস্ক, বিষাদগ্রস্ত, চিন্তাশীল, ক্লান্ত থাকেই আর সেই দুর্বল মুহূর্তে নিজেকে সচেতন রাখা মুশকিল। সেই সুযোগটাই নেয় সাইবার অপরাধীরা, হাতিয়ে নেয় কষ্টোর্পাজিত লাখ লাখ টাকা। সরকার উপযুক্ত সতর্কতা ও যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিয়ে সব নাগরিককে তাদের পরিচয় ও গোপন তথ্য সর্বত্রগামী করে দিয়ে বিপদের সামনে ফেলেছে।
0 comments: