4

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম ৩১ জানুয়ারী ১৯৪৩। সত্তর দশকের একজন প্রধান কবি হিসেবে তিনি পরিচিত। তার লেখা পাঁচটা কাব্যগ্রন্থ, একটা নির্বাচিত কবিতা সংকলন, এছাড়াও রয়ে গেছিল বেশ কিছু অগ্রন্থিত কবিতা, একটা পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়, কবির প্রকাশিত, অগ্রন্থিত বা অপ্রকাশিত কবিতাগুলোকে এক মলাটের মধ্যে ধরে রাখার। ২০২২ এর জানুয়ারীতে কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিকের সবিশেষ উৎসাহে, তাদের যৌথ সম্পাদনাতে প্রকাশিত হয় ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’।
তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ত্ব, যিনি রকে আড্ডা দিচ্ছেন, বন্ধ কারখানার গেটে শ্লোগান দিচ্ছেন, বাচ্চাদের সাথে দোলনায় ঝুলছেন, রাজনীতির জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন, বোহেমিয়ান হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, কবিতা লিখছেন, নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরী করছেন, গনসংগীতের মহড়ায় নীরব শ্রোতা বা গানে ঠোঁট মেলাচ্ছেন, নিজের বাড়ির ছোট্ট কামরায় বন্ধুদের নিয়ে সাহিত্যের আড্ডা বসাচ্ছেন, সম্পাদনা করছেন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা। এই হলেন আমাদের পার্থ দা, পার্থ বন্দোপাধ্যায় (বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বদলে তিনি নিজে বন্দোপাধ্যায় বানানই লিখতেন)।
প্রসঙ্গত জানাই পার্থ বন্দোপাধ্যায় জীবন কেটেছে কোলকাতার একটা সম্পন্ন অঞ্চলে, হাজরা রোডে। কিছু বামপন্থী গন আন্দোলনের সাথে প্রথম জীবনে যুক্ত ছিলেন। সেই হিসেবেই তিনি একজন বামপন্থী ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছুকাল একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন তারই এক অনুজ বন্ধু, শ্যামল ভট্টাচার্য – ‘পার্থদার রাজনীতি যত না মস্তিষ্কের ততোধিক হৃদয়ের। যত না তাত্ত্বিক গোঁড়ামির, তার চেয়ে বেশী মানবিক উদারতার’ [ সুত্র – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]।
তিনি মূলতঃ কবি হলেও নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। তার নির্মিত চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমাও তৈরী হয়েছে। জীবনের প্রথম দিকে ‘ফুল ফুটুক’ ও তার পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে ‘ম্যানিফেস্টো’ ও ‘পর্বান্তর’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দেশ জুড়ে রাজনৈতিক বিতর্কের দিনগুলোতে ‘ম্যানিফেস্টো’ একসময়ে খুব উল্লেখযোগ্য একটা পত্রিকা ছিল এবং একে ঘিরেই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ীতে বসতো বৈঠক, সাহিত্যসভা। সেখানে চলতো সাহিত্যিক আলোচনা ও নানান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক। পার্থ বন্দোপাধ্যায় সক্রিয়ভাবে একসময়ে যুক্ত ছিলেন শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলনে। তিনি গান ও সাংস্কৃতিক গ্রুপ ‘গণবিষাণ’-এরও একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী, নাট্যকার, নির্দেশক, গীতিকার। তার লেখার উপর গনবিষাণ-সংস্থা অন্ততপক্ষে ন’খানা গণসংগীত স্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। আর্থিক উপার্জন তার তেমন একটা ছিল না, একান্নবর্তী পরিবারে তিনি ছিলেন বে-রোজগারে বা কম রোজগেরে মানুষ। পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেন রত্না বন্দোপাধ্যায়কে। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান প্রাঙ্গণ। জীবনের শেষ দিকে এসে পার্থ বন্দোপাধ্যায় নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। বড় একা হয়ে গিয়েছিলেন। তছাড়া পায়ে বাতের জন্যে একা একা চলা ফেরা করতেও অসুবিধে হতো। অবশেষে তিনি প্রয়াত হন ১৭ মার্চ ২০১৫তে।
# # #

পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জীবন যেমন অধ্যয়ণের বিষয়, তার কবিতার বৈচিত্র্যময়তাও তেমনি আকর্ষনীয়! ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটির পরিপ্রেক্ষিতে তার কবিতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক। কবির ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি ‘মহাশ্বেতা’ পাঠকদের জন্যে তুলে ধরছি।
পাতার আগুন জ্বালি
জ্বলে ওঠে বসন্তের দিন
#
হলুদ শিখার নৃত্য মধুবাতাসের বুকে
কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে নিভে যায়
পড়ে থাকে অবশিষ্ট একরাশ শাদাকালো ছাই
#
তোমাকে দেবার মতো কিছু নেই বলে আজ
মহাশ্বেতা, ভষ্ম থেকে প্রতিমা বানাই (মহাশ্বেতা)

এতো কোনো কবিতা নয়, একটা ইতিহাস। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষের দিনে কেউ কেউ আগুন জ্বালতে চেয়েছিল। কিন্তু সফল হয় নি সেই চেষ্টা – সত্তর দশকে আগুন জ্বলেছিল বটে, কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে তা নিভে গেছে, পড়ে আছে ছাই এর অবশেষ। অন্য দিকে একসময়ে রাশিয়া, চীন, পূর্ব-ইউরোপ সাম্যবাদের ধ্বজা নিয়ে মানুষের আশা স্বপ্নের প্রতীক ছিল, তাও ততোদিনে ভেঙে পড়েছে। তবুও হাল ছাড়েন না কবি। যে স্বপ্নের প্রতিমাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল, আগুন নিভে গেলেও মহাশ্বেতা সময়ের জন্যে কবি অবশেষে নির্মান করেন তার ভষ্মের প্রতিমা। ‘মহাশ্বেতা’ সেইসব আশা-ভঙ্গুর সময়ের জন্যে নির্মিত একটা কবিতার ভাষ্কর্য! অবশ্যই এটা কবিতা হিসেবেও অনন্য!
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা লেখা শুরু সত্তরের দশকে। সত্তর দশকের সন্ত্রাস, ৭২ সালের নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গের পটপরিবর্তন, ৭৩ সালের খাদ্য-অমিল, ৭৪এর সরকার বিরোধী আন্দোলন, রেল ধর্মঘট, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশ জুড়ে এমার্জেন্সী, বন্দীমুক্তি আন্দোলন – এই সব বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ – যার রচনা কাল ১৯৬৮ -১৯৭৯, এখানকার লেখা কবিতাগুলো অনেকটাই সোজা সাপ্টা, বেশীর ভাগ বিবৃতিধর্মী, কোথাও আবেগময় এবং কোথাও কোথাও ছুঁয়ে আছে কাব্যিকতা!
সোজাসাপ্টা উচ্চারণে তিনি লেখেন –
‘পোষ্টার অথবা কবিতা
যে যা খুশি ভেবে নিতে পারো
আমি চাই কথাগুলো আটটা পাঁচটার গেটে অনায়াসে মিশে যাক
তেতে উঠুক অবস্থানের তাবু’। [পোস্টার অথবা কবিতা –১৯৬৮]
এরকমই ভাবেই পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার কবিতার মধ্য দিয়ে প্রান্তিক শোষিত সংগ্রামী মানুষদের প্রতি অনুগত থাকতে চান। এই দিনগুলোতে তার বক্তব্যের মধ্যে নেই কোনো কাব্যিক লুকোচুরি, সোজা সাপ্টা কথাতেই তিনি লেখেন –
‘শৃঙ্খলিত মানুষের চলার ছন্দের মধ্যে
জেগে উঠছে যে ঘুম-ভাঙার গান
হে সময়, আমাকে তুমি তার প্রতি অনুগত থাকতে সাহায্য করো
হাতুড়ির ঘা মেরে
প্রতিদিন রক্তের ভেতরে তোমার অবিরাম নির্দেশ পাঠাও।’
(আমাকে নির্দেশ দাও / রচনাকাল – ১৯৭০)।
উপরের লাইনগুলো কতোটা কবিতা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে এই কবিতার মধ্যে সময়ের যথার্থ আবেগ রয়েছে, রয়েছে সমাজ সচেতনতা। এরপরে ১৯৭৩ সাল, দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব। এ সময়ে লেখা কবিতার কথাগুলো পাঠকের হৃদয়কে বিদ্ধ করে, যখন পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার দীর্ঘ কবিতাটিতে লেখেন –
‘ভারতবর্ষ, তোমার চোখের মণিতে দুর্ভিক্ষের কালো থাবা
তোমার মাথার উপরে মৃত্যু .........
ভারতবর্ষ, তোমার অহিংসার মন্ত্র আমাকে দীক্ষিত করেনি – আমি ব্রাত্য
আমি কোনো ফতোয়া মানিনি
মৃত্যু আমার বাঁপাশে ডানপাশে
আমার দিকেও নেমে আসছে পুষ্টিহীনতার করাল প্রতিহিংসা
#
হাজার হাজার জেল গারদ তুলে কেউ আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না
...... আমি কাউকে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে তুলে নেবার জন্য প্ররোচিত করিনি
-আমি সেই চন্ডাল
প্রত্যেকটা চিতার পাশে জেগে থাকছি
প্রত্যেকটা চিতার পাশে, আগুন আগলে রাখছি ঘৃণায়।’ [ মার্চ ’৭৩]

১৯৭৪ সালে দেশ জোড়া রেল ধর্মঘট, কবি রেল ধর্মঘটের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন, লিখছেন কবিতা, যদিও তার লেখার লাইন অনেক জায়গাতেই শ্লোগানধর্মী! যেমন, উদ্ধৃত অংশের শেষের লাইনগুলো –
‘প্রত্যেকটি ধর্মঘটি রেল-কর্মীর মাথার উপরে ঝুলছে গ্রেপ্তারি-পরোয়ানা
.........
তবু এই প্রতিজ্ঞামুখর সময়
বার বার জ্বলে উঠছে আগুনের অপ্রতিহত ইস্তাহার
যার কিছুই নেই তার কিছু হারাবার ভয় নেই
(রেল ধর্মঘটের আজ চার দিন / রচনাকাল - ১১ই মে ১৯৭৪)

‘বৃষ্টির দিনে কলকাতার এক উপাখ্যান’ দীর্ঘ কবিতাটাতে কবি জলে ভেজা শহরের চিত্র তুলে ধরে ব্যক্ত করেন নিজস্ব ক্ষোভ। আরেকটি দীর্ঘ কবিতা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’এ কবি একজন ভিয়েতনামি মানুষের ধারাভাষ্যে সাম্রাজ্যবাদী চীন ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার বিরুদ্ধে উগরে দিয়েছেন তার ক্ষোভ ও ঘৃণা। প্রথম কাব্যগ্রন্থভুক্ত এইসব কবিতাগুলো মূলতঃ শ্লোগান বা বিবৃতিধর্মী; তবুও কবিতার ভেতর দু’চারটে দৃশ্য বা চমকপ্রদ বর্ণনা পাঠককে আকুল করে।
যদিও ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটির কিছু কবিতার উচ্চারণ কাব্যিক কারণে মনকে ছুয়ে যায়, কবিতা সেখানে শ্লোগান নয়। তিনি কবিতাকে লেখেন জীবনকে ছুঁয়ে, কবিতার ভাষা ছুঁয়ে থাকে প্রাচীন লোককথা, কবিতার লাইনগুলো গভীরতায় একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। যেমন –
শীতের প্রস্তুতি ছিল গাছে গাছে পাতায় পাতায় ......
যা ছিল না আজও নেই
সে কেবল গরিবের গরম পোশাক ......
দিন যায় রাত্রি আসে
পৌষের আকাশ নিয়ে অভাগী ফুল্লরা গায়
আজো সেই বুক-ভাঙা যন্ত্রণার গান
দঃখীর সম্বল বলতে
জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ ...(জানু ভানু কৃশানু / রচনা-১৯৭৪)
এই কবিতায় আসে অভাগী ফুল্লরার কথা। দুঃখী মানুষের সম্বল জানু, অর্থাৎ হাঁটু, যেটা জড়িয়ে সে শীত কাটায়। ভানু অর্থাৎ সূর্য, সেটাই কৃশানু বা রুগ্ন-দেহ বস্ত্রহীন মানুষের শীতের সম্বল। লোককথা এবং শব্দের গূঢ় ব্যবহার এই কবিতাটাকে নান্দনিক করে তোলে।
পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার অনেক কবিতাতে নিপুন ছন্দের স্বাক্ষর রেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে বক্তব্যের দিক থেকে মনোগ্রাহী একটা কবিতা, ‘হেলে’র কিছু লাইন।
ভয় পাস নে ভয় পাস নে ছেলে
কেউটে কিংবা গোক্ষুর নয় ও সাপ নেহাত হেলে
কামড়ে দিলে পা
খুব জোরতো দুচার দিনের ঘা
#
আর সাহস করে ছেলে
যদি তুলতে পারিস লাঠি
দেখবি ও সাপ পায়ের কাছে
ঠান্ডা মেরে গুটিয়ে আছে দিব্যি পরিপাটি ... (হেলে)।
এই কবিতাটা, যতদূর মনে পড়ছে, প্রতুল মুখোপাধ্যায় সুর করে নিজেই গেয়েছেন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার বিষয় সাধারণ মানুষ, নিরন্ন মানুষ, ফুটপাথের মানুষ। রাস্তার শিশুদের নিয়ে লেখা কবিতা ‘রাস্তায় যে বড়ো হবে’। এই কবিতার কয়েকটা লাইন –
‘একটি শিশু সোনার থালা’
মিথ্যে কথা – অলীক প্রতিশ্রুতি
তোর চাই নতুন বর্ণমালা
অ-য়ে অন্ন
আ-য়ে আশ্রয় ......
... এ পৃথিবী তোকে যতই বঞ্চিত করুক
তোর হাতেই নতুন পৃথিবী গড়বে
যদি তুই শিখে নিতে পারিস
শ-য়ে শ্রেনি
স-য়ে সংগ্রাম।
এই লাইনগুলোর মধ্যে দেখি কবি তার বিবৃতিধর্মীতা ভেঙে পাঠকদের দিকে ছুড়ে দেন কিছু নতুনতর শ্লোগান, যার আবেদনও অনবদ্য।
কবিতাসমগ্র-র পাতা পালটে আমরা পৌঁছে যাই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে – ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’, যার প্রকাশকাল মার্চ ১৯৮৬।
কবির প্রতিবাদী কন্ঠস্বর এখানেও অব্যাহত। একজন সংগ্রামী সচেতন মানুষের দৃষ্টিতে তিনি লেখেন –
‘পায়ের নিচে ফুঁসছে মাটি
মাথার ওপর রক্তমাখা আকাশ
তাকাস, তোরা যাত্রাপথে মাথার ওপর তাকাস।’ (দিন আসছে)
এই পর্বের কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায় পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার বাস্তব জীবনে জড়িয়ে আছেন বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে, ভাগ নিয়েছেন মজুরদের নুন্যতম দাবী দাওয়ার প্রশ্নে। তিনি পথ হেঁটেছেন শ্রমিকদের মিছিলে। তিনি ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের সাথে বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণায় বসেছেন।
‘রুগ্ন শিল্পের মজুরদের ধারাবাহিক রুগ্নতার প্যানপ্যানানি ভালো লাগছে না আপনার
জীবন যখন গলানো পিচের মতো ফুটতে থাকে অভাবের কড়াইয়ে
খিদে যখন মৃত্যুর ছায়ার মতো পাক খেতে থাকে তলপেটে
চেনা গন্ধমাখা বৌয়ের শাড়ি চাপা অন্ধকারে হয়ে যায় ফাঁসের দড়ি-
তাতে আপনার কী যায় আসে – আপনি আটতলার বাসিন্দা .....’ (খোলা চিঠি / মাননীয় অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র সমীপেষু)। এই কবিতাটা সে সময়ে বন্ধ-থাকা এ-স্টক কারখানার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা, যে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে কবি সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন।
কিংবা,
‘কারখানাতে / তালা মানেই / জীবন ফালাফালা / কেউ দিয়েছে গলায় দড়ি / কেউ দিয়েছে / রেল লাইনে গলা / কারখানাতে / তালা মানেই / শাদা থানের শাদা আকাশ / শূন্য ভাতের থালা ...... বন্ধ গেটের / অস্ত্রবিহীন তাঁবুর থেকে / উঠছে নতুন নারা / লোহার জাল / যতই কঠিন হোক / এসমা- ন্যাসা / হোকনা যতই জারি / লোহা গলানো হাতই পারে / ভাঙতে জারিজুরি’। ‘লোহার জাল’ শীর্ষক এই কবিতাতে দেখি কবি বিশ্বাস রাখেন শ্রমিকশ্রেণীর সংঘবদ্ধ সামূহিক শক্তিতে।
‘কারখানা লকআউট
দুমাস ছমাস নয়, পুরো চোদ্দমাস
ছেঁড়াফাটা রঙচটা তাঁবুর ভেতর বাড়ে দীর্ঘ হাহুতাশ ......
তাঁবু আগলে বসে থাকে মহিম-মাসুদ-পরিমল’। (সপ্তমী)
দুর্গা পূজা, সপ্তমীর দিন হিন্দু মুসলমান শ্রমিকেরা বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণা দিয়ে বসে আছে। এই কবিতা তার পক্ষেই লেখা সম্ভব, যেহেতু কবি নিজে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছেন, তাদের মিছিল মিটিং ধর্ণায় ভাগ নিয়েছেন।
এই পর্বের কবিতাগুলো যে শুধু শ্রমিক মজদুর ভাবনা নিয়ে লেখা তা নয়। সাধারণ বিষয় নিয়ে অনেক কবিতা আছে এই গ্রন্থে। যেমন ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ বিষয় হিসেবে একটা ব্যতিক্রমী কবিতা, উপেক্ষিত পাখি কাকেদের নিয়ে লেখা কবিতা। ‘আমি-র মুখে’ কবিতাটা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপ ভাঙ্গার কবিতা, আত্ম-আহমিকা বিসর্জন দেয়ার আহ্বানের কবিতা। লেকের রাস্তায় রঙচটা শাড়ি, ফাটা কামিজ পরা যুবতীরা তার কবিতার বিষয় হয়ে যায়( তিনটি যুবতী চলে যায়)। ‘প্রচ্ছদপট’ কবিতায় তিনি লেখেন ক্ষয়িষ্ণু বঞ্চনাময় এই সমাজ ও পৃথিবীর কথা –
‘নিরবধি কাল নয়, বিপুলা পৃথিবী নয়
এ মাটির কাছে তুমি চেয়েছিলে পিপাসার জল
এ মাটি দিয়েছে জল – তার চেয়ে ঢের বেশি ঢেলেছে গরল’

তবুও কবি বিশ্বাস করেন সাথীদের সাথে মিলে সংঘবদ্ধ সংগ্রামে। লেখেন এই সুপরিচিত কবিতাটা, যাকে একটা জনপ্রিয় গানেও রূপ দেয়া হয়েছে।
‘শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি চিনতে শিখি
নতুন মানুষজন
শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি বুঝতে শিখি
কে ভাই – কে দুশমন’ ( শ্লোগান থেকে )।

এরপর ১৯৯১ সালে প্রকাশ পেলো পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চটি কবিতার বই ‘তোমার জন্য, তোমাদের জন্য’। এখান থেকেই তার লেখার পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শ্লোগান, আন্দোলন, সমাজ ইত্যাদি বিষয় থাকলেও তার কবিতায় প্রেম বিষয়টা তেমনভাবে উচ্চারিত ছিল না। এই বইএর প্রথম কবিতা ‘তোমাকে’ – তাতে তিনি লিখলেন – ‘ঊর্মিমালা, আমাকেও ডাকো তুমি, ডাকো আজ অন্য কোন নামে’!
কবির নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখা প্রেম ভলোবাসার স্মৃতি এতোদিন কবিতায় উহ্য ছিল, জানি না কেন, তার কবিতার বইতে তিনি তেমন ভাবে প্রকাশ করেন নি! এই তৃতীয় বইটাতে দেখলাম, কবি তুলে ধরেছে তার জীবনে প্রেমের স্মৃতি – ‘উনিশ বছর আগে’ কবিতায় –
‘মনে আছে, আমরা ছিলাম মুগ্দ্ধ আমাদের শরীরের ঘ্রাণে ও আস্বাদে
ঊনিশ বছর আগে, এরকমই ঝমঝম সন্ধ্যার ভেতর #
তুমি, আমি, ভালোবাসা ... মেঘ বৃষ্টি ঝড়’।
কিংবা, যে প্রেমের কথা কবি এতোদিন বলেন নি, এবারে তা লিখলেন কবিতায়,
‘তুমি বলেছিলে
এক আকাশ ভালোবাসার নীচে
দুজন মানুষ অকুলান হবে না’ (রাত্রি যায়)।
অথবা, ‘এপ্রিলের মৃত্যু’ কবিতায় নারীকে নিয়ে লিখলেন অসামান্য এই লাইনগুলো –
‘খোলা মাঠে গাছের মতো সাবলীল যে মেয়েটি
একদিন বৃষ্টির দিকে খুলে রেখেছিল শরীর
তাকেও দেখতে পাবে
বিবাহের যৌতুকে সেও পেয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা’ – তাহলে কি কবির পর্যবেক্ষণে বিবাহ-পরবর্তী সময়ে মেয়েটি সুখী নয়? বিবাহ তাকে উপহার দিয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা?
প্রেম ভালোবাসা বিরহ এসব কবিতার পাশাপাশি এই বইতে আছে কয়েকটি অসামান্য কবিতা, যেমন ‘মহাশ্বেতা’ বা ‘আলেয়া’! ‘মহাশ্বেতা’ – কবিতাটার উদ্ধৃতি এই নিবন্ধর প্রথমেই দিয়েছি, ‘আলেয়া’ থেকে তুলে দিচ্ছি তার কবিতার প্রথম তিনটে লাইন –
‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি
ফাঁসজাল হয়ে সমানে টানছে, সামনে টানছে শুধু
কিছুই জানিনা কদ্দুর যাওয়া – নিবিড় তিমির ধূ ধূ’।

কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে বিতান ভৌমিক লিখেছেন, কবির “রাজনৈতিক কর্মীসত্তার সাথে ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থে আমরা দেখা পাই এক প্রেমিকের। দরদী মন তার কবিতায় রয়ে গেল। প্রেমিক স্বভাবও তার কবিতায় রয়ে গেল। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীর উপস্থিতি তুলনায় কমে এল।” [সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায় (এখানে আলোচিত বইটি)।]
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪এ। এই পর্বের কবিতার অভিমুখ কিছুটা আলাদা। প্রেম, জীবন, সমাজ, পরিবেশ অনেক কিছুই রয়েছে – শ্লোগান ও বিবৃতি কমে এসেছে।
এই পর্বের একটা অসামান্য কবিতা, নগরায়নের বিরুদ্ধে, পরিবেশ-ধ্বংসের বিরুদ্ধে –
‘ভীষণ ধারালো জিভে গোঁফ চেটে নিয়ে
বাঘিনিকে স্থির ভাবে বলেছিল বাঘ
-জঙ্গল ফুরিয়ে গেলে লোকালয়ে যাবো
শুয়োর হরিণ যদি না পাই তো ক্ষতি নেই
মানুষের হাড়মাংস খাব।’ (জঙ্গল ফুরিয়ে আসছে)
প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টা যে কতো মারাত্মক হতে পারে, তা চার লাইনে বাঘের ভয়াবহ ডায়ালগে এখানে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘ভিন্ন জীবন’ কবিতার প্রথম লাইন কাব্যিকতার মাধুর্যে পরিপূর্ণ, - ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ – এই লাইন আমাদের ভাবনাকে আরো বিস্তৃতি দেয়। ‘বাংলার বিবেক / ১৯৯০’ কবি লেখক কবি বুদ্ধিজীবিদের দিকে ছুঁড়ে দেন তীব্র কঠাক্ষ! ‘চাঁদিপুর’ কবিতায় প্রেমের এক তীব্র আর্তি –
‘জোয়ারের অপেক্ষায় ঝাউয়ের ছায়ার নীচে বসে আছি আমরা দুজন
কখন সমুদ্রে যাব শরীরের অসম্ভব আকাঙ্খা জুড়াতে যাব কখন – কখন
মরে যেতে ইচ্ছে করে কোনো দিন জীবনের অতিরিক্ত ভালোবাসা পেলে’।
প্রসঙ্গত বলি, উপরের কবিতাটা কবি লেখেন, বিয়ের পর বউকে নিয়ে যখন তারা চাঁদিপুর ঘুরতে গিয়েছিলেন। [ কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]
এমনি ভাবেই সময় এগিয়ে চলে। চলতে চলতে একসময়ে কি জীবনের রেস্ত সত্যিই ফুরিয়ে আসে, কেন তবে হাতের তালুতে কপাল সুদ্ধু মাথাটা ঢলে পড়বার ভয়, সে কি কোনো মৃত্যুর বিষণ্ণ চিন্তা? ‘শীতগ্রীষ্মের মাঝখানে’ কবিতায় কবি কেন উচ্চারণ করেন – ‘রেস্ত ফুরিয়ে আসছে ইয়ার’।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ প্রকাশিত হয় ২০০২এ, এর কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৯৯-২০০২। এটাই কবির শেষ কাব্যগ্রন্থ। যদিও নান্দীমুখ সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’।
যথাক্রমে কবির চতুর্থ ও পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ ও ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ সম্পর্কে বিতান ভৌমিকের নিরীক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ – “মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতার যে উন্মেষ দেখেছিলাম ‘সাদা পাতার দেশ’ কাব্যগ্রন্থে সেই মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতা ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ কাব্যগ্রন্থে আরও পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। নিচুতলার মানুষের প্রতি যে দরদ কবির সাথে ছায়ার মতো এতদিন জেগেছিল সেই দরদের ভেতরেও এবার দেখা দিল একধরণের দার্শনিক বোধ।” [ সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়]
কবিতাসমগ্র-র পরবর্তী অংশে আছে কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যার তিনি কোনো নামকরণ করে যান নি।
কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’ থেকে একটা পুরো কবিতা তুলে দিচ্ছি, যে লেখায় কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায় হয়তো নিজেকেই নিজে মেলে ধরেছেন – ‘কবির স্বভাবে নেই / দুদন্ড সুস্থির হয়ে / চুপচাপ বসা / স্বজনে বাচাল বলে / দুর্জনেরা বলে বোলচাল / কবি ভাবেঃ কেল্লা ফতে / এতদিনে করেছি কামাল / # / গ্রীষ্ম ও বর্ষায় নেই / কবির নিজস্ব কোনো / নিরাপদ ছাতা # / তুচ্ছাতি বিষয় নিয়ে এ সংসারে / কবে আর কার মাথা ব্যথা / # / রোদেই পুড়ুক / আর জলেই ভিজুক / ঋতুর তরঙ্গভঙ্গে / কবির আকাশ তবু / সত্যবদ্ধ খোলা সাদা পাতা’।
এ ছাড়াও রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সময়ে লেখা পুস্তকাকারে অগ্রন্থিত কবিতা। এই অংশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মণিমাণিক্যের মতো অনেক কবিতা, যা কিনা কবির কাব্যিকতা ও তার ব্যক্তিজীবনকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে।
জীবনের শেষর দিকের লেখা কবিতাতে দেখি, তার রাজনৈতিক ভাবনার বাঁক – এক্ষুনিই আমাদের এই পৃথিবীটাকে আমূল বদলে ফেলতে হবে - এই জাতীয় রাজনৈতিক তীব্র কর্মিসত্ত্বা তার মধ্যে যা কিছুটা ছিল, তা কালের প্রবাহে অবসিত হয়েছে। যে কাজ কবি পারেন নি, তা সম্পন্ন করার জন্যে তো তার উত্তরসূরীরা রয়েছে। ‘দিন কাটছে’ কবিতাটা পড়লে এই ভাবনার পরিবর্তনটা স্পষ্ট হবে –
‘সামনে উঁচু পাহাড়
ঠিক পেরিয়ে যাব আমি না পারলে আমার ছেলে
তেমন কোনো প্রতিজ্ঞা নেই আর’। (অগ্রন্থিত কবিতা)
‘জেগে থাকি’ কবিতায় খুঁজে পাই একজন জীবনানন্দীয় রোমান্টিক কবিকে – ‘ যতক্ষণ জেগে থাকি / এক পৃথিবীর গন্ধ লেগে থাকে বুকের ভেতর’ (অগ্রন্থিত কবিতা)।
সমস্ত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে একটা অসাধারণ লেখা হিসেবে পাঠকদের নজর কাড়বে ‘সে কাঁদেনি’, পুরো কবিতাটাই তার ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ থেকে তুলে দিলাম -
‘অঝোর বৃষ্টির রাত
একাই ভিজেছে আজ পাষাণপ্রতিমা
আমি জানি- আর কেউ সে কথা জানে না।
#
অবিশ্রান্ত ধারাপাত
সারা রাত সে কাঁদেনি – কেঁদেছে আকাশ।’


পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাতে যে সব বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, সেগুলোকে পরপর লিখলে এরকমটা দাঁড়ায় –
১- কবিতাতে দীর্ঘ বাক্যবন্ধের ব্যবহার।
২- কোথাও কবিতাতে নাটকীয় সংলাপ ধর্মিতা।
৩- কলাবৃত্ত, মিশ্র-কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত ইত্যাদি সব ছন্দর ব্যবহারে পারদর্শিতা।
৪- কবিতার মধ্যে চমৎকার নিয়ে আসেন চলতি বা তৎসম শব্দ, দেশজ শব্দ কিংবা প্রাচীন কবিতার উদ্ধৃতি বা লাইন। যেমন – ‘আয়মনকুলির শোকে উথালিপাথালি নদী আজো পাড় ভাঙে’ লাইনে দেশজ শব্দ ‘উথালিপাথালি’র নিপুন ব্যবহার।
৫- কবিতার বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্র্য। যেমন –‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ কবিতাটা, যা কিনা কবির মৌলিক কল্পনা প্রতিভারও একটা দৃষ্টান্ত ।
৬- কবিতার জগতটা বর্ণ, দৃশ্য, গন্ধ-স্পর্শের এক মিশ্রিত জগত। চিত্রধর্মিতা তার কবিতার একটা বৈশিষ্ট্য। তার কবিতা জনহীন বায়বীয় পরিবেশে ভেসে বেড়ায় না।
৭- কবির কবিতার বিষয় মূলত নাগরিক জীবন। তার সাথে মিলে যায় দৈনন্দিন জীবনের খুটিনাটি, মানুষের বেঁচে থাকার কষ্টকর চেষ্টা, মজদুর শ্রমিকের লড়াই, প্রতিবাদ-বিদ্রোহ, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, এমনকি নৈসর্গিক নানা চিত্রমালা।
৮- কবিতার বিভিন্ন জায়গাতে অসামান্য সব চিত্রকল্পের ব্যবহার। যেমন- ‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি’ কিংবা ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ ইত্যাদি সব লাইন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাচর্চা সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি রঞ্জিত গুপ্তর একটা মূল্যায়ন খুব প্রাসঙ্গিক – ‘সত্তরের কাব্য আন্দোলনের প্রথম দিনগুলিতে যে শিল্পহীন প্রচারধর্মীতার একমুখী চর্চা চলেছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের সেদিনের স্বরটি তার দ্বারা ছিল অনেকাংশে আক্রান্ত। তবু কবি তার অন্তর্লীন স্বভাবে ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কাব্যিক সুষমারিক্ত তার সেদিনের বিবৃতিধর্মীতার পেছনে আসলে কোন অকবিসুলভ অক্ষমতা ছিল না। বরং তিনি যেন সচেতনভাবেই চেয়েছিলেন প্রচলিত রূপবদ্ধ ভেঙ্গে কবিতার ভিন্নতর ভাষা খুঁজে নিতে।’ [ গ্রন্থসূত্র – কালের মন্দিরা – রঞ্জিত গুপ্ত]।
# # #
কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক সম্পাদিত ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ পড়তে পড়তে এই নিবন্ধটি লিখতে প্ররোচিত হয়েছি। এতোক্ষণ যা লিখলাম, তা বেশীর ভাগই কবির কবিতা নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া, কবির জীবনের দু চারটে কথা। প্রসঙ্গক্রমে জানাই পেশাগত কারণে আমি বহির্বঙ্গে থাকতাম, তবুও পার্থদার সাথে আমার সামান্য কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মনে পড়ে, আমি মধ্যপ্রদেশ থেকে কোলকাতায়, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সত্যেনদা’র ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছি, আমার ক্লাসমেট কবি তমাল ভৌমিকের সাথে দেখা করবো বলে। দেখলাম, কিছুক্ষণ পরে তমাল এলো, তার সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়! তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি মহলে বেশ পরিচিত। আমি তো বিনা নোটিশে পার্থদা’কে দেখে অবাক! জানলাম, পার্থদা আমার সাথে নাকি দেখা করতেই এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। এম্নিভাবেই পার্থদা ছিলেন সবারই বন্ধু – তিনি যেমন আমার বন্ধু, তেমনি অনায়াসে সম্ভবতঃ আমার ছেলেরও বন্ধু!
এবার ‘কবিতাসমগ্র’ বইটি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
এই বইটি নির্মাণে সম্পাদক-দম্পতি (কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক) অত্যন্ত সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যুর অল্প কয়েকটা বছরের মধ্যেই তার সবগুলো লেখাকে জড়ো করেছেন, তাকে ২৭২ পৃষ্ঠার একটা সুন্দর বইএর আকার দিয়েছেন। হয়তো তাদের সাথে আরো কিছু বন্ধুসাথীরা ছিলেন, যারা পেছনে থেকে এই বিশাল কর্মকান্ডটিকে সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন, যার সবটা আমি জানি না। তবে এক্ষেত্রে মূল উদ্যোগটি সংকলন সম্পাদক কাজরী ও বিতানেরই। মৃত্যুর পরে প্রায়শঃই কবি লেখকেরা হারিয়ে যায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মতো কবি ও একজন বিশেষ ব্যক্তির লেখাগুলোকে সংরক্ষিত রাখাটা অবশ্যই সময়ের বিচারে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ – যা সম্পাদকদ্বয় করে দেখিয়েছেন।
‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটা হাতে নিলেই বোঝা যায়, এটা কোনো দায়সারা গোছের কাজ নয়। অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদিত এই কবিতাসমগ্রে রয়েছে গ্রন্থ বা বিষয়ভিত্তিক এক একটা পর্ব, পর্বের প্রথমে প্রত্যেকটি প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচ্ছদের ছবি আছে, আর গ্রন্থভিত্তিক সূচি। পরিশিষ্টে আছে গ্রন্থতালিকা, প্রকাশকাল, প্রকাশকের নাম ঠিকানা। পরিশিষ্টে আরো আছে, পরিশ্রম করে তৈরী করা, সমস্ত কবিতাগুলোর বর্ণানুক্রমিক সূচি – যা ভীষণ উপযোগী।
কবিতাসমগ্রটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে যে দুটো বিশেষ পর্বের সংযুক্তিকরণে – (১) পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যা কবি তার জীবিত অবস্থায় প্রকাশের আলোয় আনতে পারেন নি। (২)অন্য পর্বটা পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ – যেগুলো পান্ডুলিপি, ডায়েরী বা অন্য কোনো সূত্রে জোগাড় করে গ্রন্থিত করা অবশ্যই কষ্টসাধ্য কাজ। যদিও কবির পরিবারের ও কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতা এখানে উল্লেখযোগ্য। তবুও এই মূল্যবান সংকলনটার সম্পাদক হিসেবে কাজরী ও বিতানের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
যথেষ্ট মোটা সাইজের বই, কাগজের কোয়ালিটি, বাঁধাই, প্রচ্ছদ ইত্যাদি খুবই ভালো। সুন্দর প্রচ্ছদটি এঁকেছে তন্ময় মৃধা। বইটার মূল্য মাত্র চারশো টাকা, বইটার প্রকাশক – অন্যতর পাঠ চর্চা কেন্দ্র, কোলকাতা – ৭০০০৪৭। গ্রন্থটি উৎসর্গীকৃত হয়েছে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয়, ‘কবিতার অনুরাগী পাঠকদের হাতে’। বইটাতে কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের নিজস্ব হাতে লেখা পান্ডুলিপি, ব্লার্বে তার ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া আছে।
এই গ্রন্থটি প্রকাশ করার আগে বন্ধুপ্রতিম বিতান ভৌমিক জানিয়েছিল তাদের এই পরিকল্পনার কথা। তার সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে কিছুটা অনুমান করতে পারি, সম্পাদকদ্বয় ও তাদের কাছাকাছি থাকা বন্ধুদের কতই না পরিশ্রম ও উদ্যোগ নিতে হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি প্রকাশ করবার জন্যে। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, এই গ্রন্থটি কোন বড় প্রকাশনা বা বিগ হাউজ পাবলিশার্সের আর্থিক বা ব্যবসায়িক আনুকুল্যে ছাপা হয় নি।
পরিশেষে আরো যে কথাটা বলতে চাই, কবির কবিতা পড়বার সাথে সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়কে জানাটাও খুব জরুরী - গ্রন্থটির ‘ভূমিকা’র মধ্যে এই কাজটি খুব সুন্দর ভাবে পাঠকদের জন্যে করে রেখেছেন বিতান ভৌমিক। প্রায় ১৫ পৃষ্ঠা দীর্ঘ ভূমিকা জুড়ে রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা, বিশ্লেষণ, কবির ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা, সাল-তামামি। এই সুন্দর ভূমিকাটির জন্যে বিতান ভৌমিককে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই।
সত্তর দশকের কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাহিক ভাবে একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। উপরের আলোচনায় তার কবিতাসমগ্রর একটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে এই কবির জীবনটাও স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার একটা বিষয়। যার মধ্য দিয়ে সত্তরদশক ও তার পরবর্তী সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ও শ্রমিক আন্দোলনের একটা ছবি আমরা খুঁজে পেতে পারি। আশা করি, ভবিষ্যতে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘গ্রন্থসমগ্র’ও প্রকাশিত হবে। তাতে তার সমগ্র সাহিত্য ও জীবন নিয়ে আরো বেশী আলোচনা ও চর্চার সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হবে, এবং তা হবে সময়েরই প্রয়োজনে।

4 comments:

  1. একটি কবিতা সমগ্র নিয়ে এত বিস্তারিত ও গভীর আলোচনা আগে পড়িনি। প্রাবন্ধিকের পর্যবেক্ষণ কে কুর্নিশ।

    ReplyDelete
  2. অনবদ্য আলোচনা। সমৃদ্ধ হলাম। প্রাবন্ধিককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ জানাই। - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

      Delete