0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








নোবেল জয়ী হান কাং-এর লেখায় টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ




প্রিয়বরেষু
বাসু,

তোমার চিঠি যখন হাতে পেয়েছি দোল পূর্ণিমার রঙ তখন আমার মর্মে লেগে আছে। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কয়েকটা দিন চুরি করে শান্তিনিকেতন কাটিয়ে এলাম। খুব চেয়েছিলাম তুমি আসো চুটিয়ে আড্ডা দেই তোমার সাথে। তুমি তো এলে না, হয়ত সত্যিই অসুস্থ ছিলে কিংবা নিছক অসুস্থতা দেখিয়ে এড়িয়ে গেলে। ভালোই হলো মুখোমুখি হলে হয়ত অতীতের অনেক কবর চাপা কথা জেগে ওঠতো। তোমার শরীর এখন কেমন? সুভাষ ডাক্তারকে তো সেই ছোটবেলা থেকেই দেখাচ্ছো এবার অন্য একজন ডাক্তার দেখাও। প্রায়শ তোমার অসুস্থতার কথা শুনি এত ঘনঘন অসুস্থতা ভালো লক্ষণ নয় মোটেই।

হারুকি মুরাকামি আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তার লেখা আমাকে খুব ভাবায়। সম্প্রতি ইজরাইলি গল্পকার, স্ক্রিপ্টরাইটার ও ফিল্মমেকার এটগার কেরেটের লেখাও আমার বেশ প্রিয়। ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার হান কাং কে তুমি কি পড়েছো? মানুষের জীবনের ভঙ্গুরতা, যন্ত্রণার কথা বার বার হানের কলমে উঠে এসেছে আর গদ্য হয়ে উঠেছে কবিতা। ফুটপাতে পুরানো বই ঘাঁটতে গিয়ে আমার হাতে আসে ২০১৬ সালে ডেবোরো স্মিথের অনুবাদে ইংরেজিতে হান কাংয়ের লেখা সবচেয়ে জটিল চিন্তার অভিনব উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্ট' যা 'সোনানিয়ন ওন্দা' নামে প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। তখন থেকে আমি হানের লেখার সাথে পরিচিত কিন্তু এত জলদি সে নোবেল পাবে ভাবিনি।

হিউম্যান অ্যাক্টস লেখা হয়েছে দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনায়। ইতিহাসভিত্তিক এ উপন্যাসের ভাষা আদতে কাব্যিক। ছয়টি অধ্যায় আর শেষে উপসংহার নিয়ে মোট সাত খণ্ডের উপন্যাসটিতে আছে চুন ডু হুয়ান নামের এক সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কিশোরের গল্প। স্কুলপড়ুয়া কিশোর দং হো ১৯৮০ সালের মে মাসে জড়িয়ে পড়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দানা বাধা গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় পাল্টে যায় পরিপ্রেক্ষিত। জেয়ং দে নামের আরেক নিহত কিশোরের বয়ানে এগোতে থাকে কাহিনি। পড়তে পড়তে কারও মনে পড়তে পারে ওরহান পামুকের মাই নেম ইজ রেড–এর কথা। এখানে নামহীন লেখকের চরিত্রটি হতে পারেন হান কাং নিজেই, যিনি গোয়াংজু অভ্যুত্থানের কিশোর শহীদ দং হোর কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে সম্মান জানিয়ে আসেন। তারপর সিউলে ফিরে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে। হানের হিউম্যান অ্যাক্ট পড়তে শুরু করে আমি রীতিমত অবাক হয়েছিলাম। বইটির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আমাদের নকশাল আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। ১৯৮০ সালে কোরিয়ার গোয়াংজুতে সংঘটিত গণতান্ত্রিক আনন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। সেসময় ঘটনাচক্রে আন্দোলনে যোগ দেয় উপন্যাসটির মূল চরিত্র স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী চরম নিপীড়ন চালায়। আন্দোলনকারী অনেক ছাত্রকে তারা হত্যা করে। স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো এরকম বেশ কিছু মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং তাদের লাশের উপর দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা বিছিয়ে দিতে দেখা যায়। যদিও বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র এবং ডংহোর বয়স ছিল সবার চেয়ে কম, তবুও স্বৈরাচারী শাসকের নিপীড়নের উপর বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। ডংহোর মা উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে।

সেসময় আন্দোলনকারীদের ধরতে রাতের বেলা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে অভিযান চালাতে দেখা যায়। স্কুল ছাত্র ডংহোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু জিয়োংকে তার চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। হপ্তাখানেকের মাঝে জিয়োংয়ের বোন জিয়োংমি নিখোঁজ হয়। এমতাবস্থায় সেই এলাকায় রাতে অভিযান করার জন্য আসে বাহিনী। ডংহোর মা তাকে রাতে বাসায় না ফেরার জন্য বলে, কারণ ডংহোকে অভিযান করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মা উদ্বিগ্ন থাকে। উপন্যাসটি লেখক ডংহোর মৃত বন্ধু জিয়োংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করা শুরু করে। সেখানে দেখা যায়, জিয়োং একটি লাশের স্তুপের মাঝে পরে আছে এবং সে বুঝতে পারছে তার নিখোঁজ বোন জিয়োংমিকেও সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে। সে তার জীবিত বন্ধু ডংহোকে নিয়ে ভাবে এবং এসব হত্যাকান্ডের শাস্তি একসময় স্বৈরশাসক পাবে তার আশা ব্যক্ত করতে থাকে। ঠিক সেসময়ই সে বুঝতে পারে একদল রাষ্ট্রীয় বাহিনী এসেছে লাশের স্তুপের কাছে, জনগণ থেকে লুকাতে তারা লাশগুলো পুড়িয়ে দিতে চায়। হানের এই লেখা পড়তে পড়তে আমার নকশাল আন্দোলনের শোনা গল্পগুলোর কথাই মনে পড়তে থাকে।

তোমার নিশ্চয়ই পরাগ মিত্রের কথা মনে আছে। যার কাছে নকশাল আন্দোলনের গল্প শুনতাম আমরা। কমরেড কাকার কাছেও বহু ইতিহাস আমরা শুনেছিলাম। তাঁর মুখেই শোনা সেইসময় নকশালবাদে যোগদানের জন্য অনেক ছাত্র কলেজ পর্যন্ত ছেড়েছিল। চারু মজুমদার ছাত্রদের নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই বিপ্লব শুধুমাত্র গ্রামীণ জনগণের জন্য নয়, বরং যারা ‘শ্রেণী শত্রু’ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই শ্রেণী শত্রুর তালিকায় পড়বে সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পুলিশ এবং আরো অনেকে। নকশালপন্থীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেয়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স নকশাল কার্যকলাপের জন্য অন্যতম ঘাটি হয়ে ওঠে। নকশালবাড়ি আন্দোলন বছরখানেকের মধ্যে অনেকটা স্তিমিত হয়ে এলেও অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পরও সেই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা এবং তাৎপর্য বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি। এটি স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসকে আমূলভাবে বদলে দিয়েছে। নকশাল আন্দোলন নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-গান-কবিতা লেখা হয়েছে। সমরেশ মজুদারের ‘উত্তরাধিকার’-এর চার প্রধান চরিত্র নকশালবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়। বুকার পুরষ্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এর একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। মহেশ্বেতা দেবী তার ‘হাজার চুরাশির মা’ এই আন্দোলনের পটভূমিতেই লেখেন। পরে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ঝুম্পা লাহিড়ী, অনুরাগ মিশ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরো অনেকের লেখনীতে নকশাল আন্দোলন বারবার উঠে এসেছে।

হান কাংয়ের লেখা কেমন? কী তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়? মূল ভাষার সৌন্দর্য বোঝার মুরোদ আমার নেই, তাই তাঁর অনুবাদক ডেবরা স্মিথের অনুবাদই ভরসা। তবে হিউম্যান অ্যাক্ট পড়ার পরে আমি খুঁজে খুঁজে তার অন্য উপন্যাসগুলো পড়েছি এবং পড়ার পরে মনে হয়েছে হান কাংয়ের লেখার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাহুল্য বিবর্জিত লেখা। কলেবরের জায়গা থেকে অতি সংক্ষেপিত এবং মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেই নোবেল জিতে নিয়েছেন তিনি। পৃষ্ঠার হিসেবেও সেটা ৬০০ থেকে কম। আমাদের পরিচিত অনেক লেখকের একটি উপন্যাসের চেয়ে কম, হান কাংয়ের সারাজীবনের গদ্য। চাইলে গোটা হান কাং পড়ে ফেলা যায় এক সপ্তাহে। বাহুল্য বিবর্জিত স্পষ্ট অথচ জটিল চিন্তার এই লেখাগুলোর দ্বারা দক্ষিণ কোরিয়ান কাব্যময় লেখার ভঙ্গিমায় হান কাং আমাদের নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে বাস্তবতার ভয়াবহতা টের পাওয়া যায় ক্রমেই। মৃত লাশের মনে হতে থাকে জীবিত নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, অথচ আমাদের মনে হয়েছিল মৃত্যুই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

হান কাংয়ের উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বুক’ র পটভূমি হিসেবে এসেছে যুদ্ধ-পরবর্তী পোল্যান্ডের ওয়ারশ। নিরস্ত্র কথকের ছোট বোনের মৃত্যু সম্পর্কে খণ্ড খণ্ড চিন্তামগ্নতা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। জন্মের দুই ঘণ্টা পর মৃত্যু হয় শিশুটির। ‘দ্য হোয়াইট বুক’ উপন্যাসের উপস্থাপনশৈলীর মধ্যে নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। দুঃখ, ক্ষতি এবং মানবাত্মার ভঙ্গুরতার কথা বলার জন্য ভাত, চিনির খণ্ড এবং বুকের দুধসহ মোট ৬৫টি সাদা বস্তুর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে। এখানে উপস্থাপিত কাহিনির সঙ্গে লেখকের বাস্তব জীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়, বিশেষ করে তাঁর বোনের শিশুবেলার মৃত্যুর সঙ্গে। হান কাংয়ের আরেক উপন্যাসের নাম ‘গ্রিক লেসনস’। উপন্যাসে বাকশক্তি হারানো একজন নারী প্রাচীন গ্রিক ভাষা পাঠ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার কাছে পাঠ নেবে তারও অবস্থা ওই নারীর মতোই: ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে।
তবে এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, ভালোবাসার প্রায়শ্চিত্তমূলক শক্তির মধ্যে আশাবাদী ও মানবীয় বিশ্বাস নিহিত থাকে। কারণ তাদের পাঠদান ও পাঠগ্রহণের প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। একজন আরেকজনের মানসিক যন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তার কথা জানতে পারে, অনুভব করতেও পারে। পর্যায়ক্রমে তারা আরো নিকটবর্তী হতে থাকে। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের পর হান কাংয়ের এই উপন্যাস বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ইতিবাচক সাড়া পায়।

এই সবগুলোই হয়ত তোমার পড়া কিন্তু আমাকে অবাক করেছে ১৯৭০ সালের শেষে জন্ম নেয়া হান কাং লেখালেখি শুরু কবিতার মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে। একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা হয় তার পাঁচটি কবিতা। পরের বছর ঔপন্যাসিক হিসেবে অভিষেক হয় তার। তিন দশকের লেখালেখিতে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি নজরে আসেন অনেক পরে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত 'দ্য ভেজেটেরিয়ান' উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। হিসেব করলে হান কাংয়ের আন্তর্জাতিক পরিচিতি মোটের উপর দশ বছর। এত কম সময়ের পরিচিতিতে নোবেল পুরস্কার জেতার ঘটনা আগে সেভাবে ঘটেনি। তার উপর এবারে নোবেল প্রত্যাশী যেসব লেখকদের নাম সামনে আসছিল, হান কাং তাদের মেয়ের বয়সীই হবে। এর বাইরেও মজার একটি বিষয় হলো, ২০১২ সাল থেকে (কাজিও ইশিগুরো ব্যতিরেকে) এক বছর পরপর সাহিত্যে নারী লেখককে নোবেল জিততে দেখা যায়। ২০২৪ সালের নোবেলেও এই ধারাবাহিকতা দেখা গেল। সব মিলিয়ে এবারের সাহিত্যের নোবেল বেশ অদ্ভুতই বটে। তুমি হান কাংয়ের কি কি পড়েছো জানিও। তুমি আরো গভীরভাবে হান কাংয়ের লেখার বিশ্লেষণ করতে পারবে আমি জানি।

হান কাংয়ের দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে একটা অভিনবত্ব চোখে পড়ে মোট আটটি কাহিনির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এ উপন্যাস। এখানকার ভিন্ন ভিন্ন পর্বে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যর্থতার চিত্র দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় তারা জীবনে কোনো আশা দেখতে পায় না। ‘মাই উওম্যান’স ফ্রুট’ অংশে হতদরিদ্র জেলেপল্লীতে জন্ম নেওয়া এক নারীর কথা বলা হয়েছে। নিজের চেষ্টায় সে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতে চায়। তবে তার বিশ্বাস হলো, জগতের রূপ দেখতে হলে বিয়ে করাও দরকার। সে জন্য স্বামীর সঙ্গে আগে সংসার পাতে সে। কিন্তু কিছুদিন পর তারা একে অন্যের প্রতি আর টান অনুভব করে না। এক পর্যায়ে স্বামীর কাছ থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে পাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। তারপর সে গাছ-লতা হয়ে ঘরের ছাদ পেরিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করে। এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে মানসিক ক্লান্তি আর আধুনিক জীবনের নিরাশা পেরিয়ে যাওয়ার মতো মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকার বিষয়। তবে দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান গল্পটির ভাবকাঠামোর পরিশীলিত রূপান্তর ঘটিয়ে দীর্ঘ দশ বছর পর ২০০৭ সালে এই গল্পটিকেই তিনি দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাসে রূপ দেন। এক নারীর নিরামিষাশী হওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে পারিবারিক সংকট আর সামাজিক নিষ্ঠুরতার গল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে দ্য ভেজিটারিয়ান। এটি লিখতে তিনি তিন বছর সময় ব্যয় করেন। এটির কেন্দ্রীয় ও নারী চরিত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য চরিত্রের পটভূমি এবং গাছপালা ও সূর্যকিরণের চিত্রকল্পের আবহ তৈরির জন্য তিনি অনেক ভাবনাচিন্তা ও পর্যবেক্ষণ করে মাসের পর মাস খেটে উপন্যাসটি সমৃদ্ধ করেন। দ্য ভেজিটারিয়ান তিনটি পর্বে বিভক্ত। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে অসুস্থ হওয়ার পর মাছ–মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইয়েয়ং হাই নামের এক বিবাহিত নারী। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তার স্বামী চেইয়ং দেখতে পায় ফ্রিজ থেকে সব প্রাণিজ আমিষ খাদ্য ফেলে দিচ্ছে সে। নিজে নিরামিষভোজী হয়েই ইয়েয়ং ক্ষান্ত নয়, স্বামীর জন্যও মাছ–মাংস রাঁধতেও সে অস্বীকৃতি জানায়। শান্তভাবে বলে যে দিনের মধ্যে দুই বেলাই যেহেতু চেইয়ং বাইরে খাওয়াদাওয়া করে, তাই এক বেলা নিরামিষ খেলে তার এমন কিছু ক্ষতি হবে না। উপন্যাসের প্রথম পর্বে ইয়েয়ংয়ের ভেজিটারিয়ান হওয়া নিয়ে অস্বস্তি, যা ক্রমে পারিবারিক সংকট, অতঃপর সংঘাতের রূপ নেয়—সেটুকু ইয়েয়ং হাইয়ের স্বামী চেইয়ংয়ের বয়ানে, সোজাসাপটা ভাষায় লেখা। মাঝেমধ্যে কেবল কিছু অংশ লেখা হয়েছে ইটালিকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেগুলো ইয়েয়ং হাইয়ের স্বপ্নের বিবরণ। তাতে যত না কাব্য, তার চেয়ে বেশি আছে ভয়ানক সব নৃশংসতার চিত্র। রক্তাক্ত, বীভৎস সেই সব দুঃস্বপ্ন ইয়েয়ংকে ভয়ানকভাবে তাড়া করে। স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠার পর প্রাণী হত্যা আর মাংস ভক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর বলে মনে হয় তার কাছে। যদিও প্রতি বেলা মুরগি, গরু, শূকর, অক্টোপাসসহ নানা ধরনের মাছ–মাংস সব সময়ই ছিল তাদের খাদ্যতালিকায়। ইয়েয়ং হাই নিজে খুব ভালো রাঁধুনি। ছোটবেলায় মায়ের কাছে প্রায়ই ওয়েস্টার খাবারের জন্য বায়না করত।

দ্বিতীয় পর্বে ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ লেখা হয়েছে সর্বদ্রষ্টা বক্তার (ওমনিশ্যান্ট ন্যারেটর) ভাষায়। এখানে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ইয়েয়ং হাইয়ের ভগ্নিপতির। আর তৃতীয় পর্ব ‘ফ্লেইমিং ট্রিজ’–এর বক্তা ইয়েয়ং হাইয়ের বোন ইন হাই। তিনটি অংশের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান দুই বছর করে। মূল চরিত্রের সরাসরি বক্তব্য খুব অল্প পরিমাণ হলেও তার প্রাণী হত্যা নিয়ে পরিবর্তিত মনোভাব অনেকটাই বোঝা যায়। নিজে খাওয়ার জন্য অন্য প্রাণকে ধ্বংস করার ব্যাপারটি সহ্য করতে না পারা ইয়েয়ং একপর্যায়ে স্বামীর ‘শরীরে মাংসের গন্ধ’ পায় বলে তার সঙ্গে যৌন সংসর্গও ত্যাগ করে। স্বামীর বয়ানে জানা যায়, এই প্রত্যাখ্যানের ফলে ইয়েয়ংকে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়।

ইয়েয়ং হাইয়ের নিজের শরীর ও জীবনের ওপর তার অধিকার না থাকার বিষয়টির উল্লেখ করে এ আখ্যানকে তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে দেখেছেন দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর বিশ্লেষক জুলিয়া পাসকাল। দ্য অস্ট্রেলিয়ান বইটিকে অদ্ভুতুড়ে বা ‘আনক্যানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গ্যাজেট ভ্যান আনটওয়েরপেন বলেছে, এটি হারুকি মুরাকামির ভক্তদের জন্য উপযোগী এক বই। আবার দ্য আইরিশ টাইমস একে দেখছে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার আখ্যানরূপে। আর দ্য গার্ডিয়ান–এর মতে, এই উপন্যাস নানা পীড়াদায়ক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে।

উপন্যাসে হান কাং এমন এক দুনিয়ার চিত্র তুলে ধরেন, যা দৈনন্দিনতায় ভরা; কিন্তু খানিকটা বীভৎস, অদ্ভুত। পারিবারিক পরিস্থিতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি উপস্থাপন করেন সমাজের সেসব রক্তাক্ত অনুভূতি, সচরাচর যেসব জনসমাজের সামনে আসে না। দ্য ভেজিটারিয়ান–এ বিষয়গুলো যেমন পোক্তভাবে উপস্থিত, তেমনি আছে হিউম্যান অ্যাক্টস–এও। মহান সাহিত্য যা করে, খবরের কাগজে পড়ে ভুলে যাওয়া একেকটি তথ্য বা গল্পের পেছনের বিশাল আখ্যানটিকে মহাকাব্যের মতো বিস্তৃতিতে নিয়ে যায়—হিউম্যান অ্যাক্টসও একই কাজ করেছে। ডং হো নামের কিশোরও হানের ছোটবেলায় পাওয়া সেই স্মরণিকা থেকে উঠে আসা। গোয়াংজুর গণহত্যার সময় নিহত আরও নাম না জানা কিশোর-তরুণেরাও উপন্যাসের চরিত্র হয়ে এসেছে। হান কাংয়ের কলমে বিভিন্ন নামের এসব শহীদ আসলে কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা হিউম্যান অ্যাক্টস–এর সঙ্গে পাঠকেরা নকশাল বা সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটল, তার মিল পেতে পারেন।

খুব বেশি না লিখেও দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেলজয়ী এই কথাশিল্পী আখ্যান রচনায় অনন্য আর নিজস্ব শৈলী সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। দ্য কনভারসেশন–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হান কাং যে কথা বলেন, সেটি হয়তো তাঁর লেখালেখির মূল মন্ত্র। কাংয়ের কথা হলো, মূলত তাঁর উপন্যাস মানবজীবনের যন্ত্রণা আর বেদনা নিয়ে লেখা। মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক বর্বর আচরণ, অসহনীয় নির্মমতা তাঁকে খুবই পীড়া দেয়।

এ কারণেই কি হান কাংয়ের লেখার অন্দরমহলে এত চাপা রক্তের ছাপ দেখা যায়, আর একের পর এক তিনি লিখতে থাকেন রক্তাক্ত মানুষের গল্প?

কোরিয়ান চলচ্চিত্রে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা এ ব্যাপারে একমত হবেন যে হত্যা, মৃত্যু, নৃশংসতাকে অন্য এক দৃষ্টিতে দেখার আর দেখানোর প্রবণতা আছে কোরিয়ানদের মধ্যে। সম্প্রতি অস্কার পাওয়া ছবি প্যারাসাইট–এও আমরা দেখেছি চরম দারিদ্র্যের ফলে মানবিক অধঃপতন এবং এর সমান্তরালে ধনকুবের এক পরিবারের বিলাসী জীবনযাপনের প্রতি বিদ্বেষ; ফলাফল হত্যা আর নিষ্ঠুরতা।

কাংয়ের লেখায় যে টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ, যে নিষ্ঠুরতা, তা বৃহদাকারের নয়, অনেকটা ফুটকির মতো; কাব্যিক ভাষার আচ্ছাদনে অজস্র রূপক দিয়ে ঘেরা। তাঁর উপন্যাসে ডুব দিলে অনুভব করা যায় সেই ‘আনক্যানি’ ভরা দুনিয়াকে।

বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা সহ-

তোমার সুস্মি
১২ এপ্রিল,২০২৫

0 comments: