গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য
Posted in গল্প“মা!মা!”
গলার আওয়াজ না মেলাতেই হৈমন্তী মালিনীর ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর গটগট করে হেঁটে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিল।
“কি ফার্স্ট ক্লাস রোদ উঠেছে দেখ!”
মালিনী চশমা ছাড়াই বাইরের নীল আকাশ আর বরফের পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পেল।
“আজ আমরা রিচুয়ালটা সেরে ফেলি? আবার কবে এরকম ওয়েদার পাব কে জানে?”
মালিনী বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাঝে নাকের ওপরটা চেপে ধরল। এত সকাল সকাল ওর চিন্তা করতে কষ্ট হয়।
“কারা কারা আছেন এখন?”
হৈমন্তী গড়গড় করে বলে গেল,
“এভারেস্টে সোনিয়া চৌধুরী আছেন, কাল চেক আউট করবেন। তিস্তায় অভিষেক ব্যানার্জি আর ওনার ওয়াইফ – অনুজা। মংপু আর রডোডেনড্রন খালি আছে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় মিস্টার শ্রীনিবাসন উঠেছেন।”
“ওই পেইন্টার ভদ্রলোক? এসে গেছেন?”
“হ্যাঁ, কাল চেক ইন করেছেন। তোমাকে বললাম তো!”
মালিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতদিন অবধি সে-ই কৃষ্ণচূড়া লজের সব ব্যবস্থাপনা করে এসেছে, কোনদিন একটা ছোট ভুলও হয়নি, কিন্তু আজকাল সবকিছুর কেমন খেই হারিয়ে যাচ্ছে। যেন বহুবার বাজিয়ে তানপুরার তার ক্ষয়ে গেছে।
“ঠিক আছে, আজকেই করে ফেলা যাক,” বলে মালিনী বিছানা থেকে উঠে পড়ল। “পেমাকে বল আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যেতে। আর আজ আমি ঘরেই ব্রেকফাস্ট করব।”
“কেন মা?” হৈমন্তী ভুরু কুঁচকে এগিয়ে এল, “তোমার শরীর ভালো নেই?”
“না সেরকম কিছু নয়। বয়স হচ্ছে তো।”
হৈমন্তী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কৃষ্ণচূড়া লজের বেডরুমগুলো দোতলায়, লবি আর খাবার ঘর এক তলায়। মেনু নির্দিষ্ট থাকলেও, আগে থেকে বলে রাখলে অতিথিদের পছন্দের খাবারও তৈরী করা হয়। আগে মালিনী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করত। এখন সেই ভারটা হৈমন্তী নিয়েছে। গেস্টদের ব্রেকফাস্ট শেষ হয়ে এলে হৈমন্তী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
“অনেকদিন পরে এত সুন্দর রোদ উঠেছে। তাই আজ আমরা এই কৃষ্ণচূড়া লজের একটা ট্রাডিশন সেরে ফেলব।”
অতিথিরা সন্তর্পণে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কৃষ্ণচূড়া লজের ট্রাডিশন? কি করতে বলবে রে বাবা?
“বাইরের যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখেছেন, যার নামে আমাদের এই লজের নাম, ওর নীচে আমরা গেস্টদের সঙ্গে একদিন পিকনিক করি,” হৈমন্তী মিষ্টি হেসে বলল। “আজ যেহেতু রোদ আছে, চলুন ওখানেই চা-কফি আর আড্ডা হয়ে যাক।”
ঘরের মধ্যে আটকে থাকা নিঃশ্বাস এবার ছাড়া পেল।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এতো দারুণ প্রস্তাব,” অভিষেক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। “আউটডোর যখন, আশা করি স্মোকিং এ কারুর আপত্তি নেই।”
সোনিয়াকে দেখে মনে হল তার ধূমপানে যথেষ্ট আপত্তি আছে, কিন্তু গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর কথা কে-ই বা শুনেছে? সবাই মিলে হইহই করে গাছের দিকে রওনা দিল।
কৃষ্ণচূড়া গাছটা লজের ডানদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে একটা কাঠের টেবিল আর বেঞ্চ। নীচে পাহাড়ের ঢালে পাইনের বন, আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝকঝক করে। সবাই বেঞ্চের ওপর পছন্দসই জায়গা বেছে বসে পড়ল। একটু পরে মালিনীও এসে সবার সঙ্গে যোগ দিল।
“এই হাইটে সাধারণত কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখতে পাওয়া যায় না, তাই না?” অনুজা মালিনীকে জিজ্ঞেস করল।
মালিনী ক্লান্ত হাসি হাসল। প্রায় প্রত্যেকটা পিকনিকে এই কথাটা ওঠে। উত্তরটা মালিনীর মুখস্থ হয়ে গেছে।
“একদম ঠিক। আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন, শুধু দেবদারু আর রডোডেন্ড্রনের জঙ্গল। আসলে আমার স্বামীকে একজন এই গাছের একটা ডাল গিফট করেছিলেন। আমার স্বামীও এমনিই, প্রায় অবহেলা করেই ডালটা পুঁতে দিয়েছিলেন। সবাই ভেবেছিল, দু'দিন পরে হয়তো আপনেই মরে যাবে। ওমা, কিছুদিন পরে দেখা গেল ডালটা একটু বড় হয়েছে। আমাদের কিন্তু এতে কোন কৃতিত্ব ছিল না! না গোড়ায় জল দিয়েছি, না পাখির হাত থেকে বাঁচিয়েছি, না কিছু। শুধু শুধু, বিনা যত্নেই গাছটা বড় হতে লাগল। এই এত বড় হয়েছে। কিন্তু মজার কথা হল, আজ অবধি একটাও ফুল ফোটেনি।”
“সেকি? ফুল ফুটল না কেন?”
মালিনী কাঁধ ঝাঁকাল।
“সেটা একটা রহস্য। আমার মনে হয়, হয়তো এখানকার জল হাওয়ার কারণে।”
“দ্যাট ইজ সো ইন্টারেস্টিং!” সোনিয়া সাদা লোমের শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিল। এমনিতে তেমন ঠান্ডা না থাকলেও গাছের তলায় বেশ একটা হিমেল ভাব আছে। “ভেরি মিস্টিরিয়াস!”
“চা, না কফি, কোনটা আনাব?” হৈমন্তী কৃষ্ণচূড়ার ইতিকথায় যতি টানল।
“দার্জিলিংএর এত কাছে এসে কফি কে খাবে?” অনুজা নাক কুঁচকে বলল, “আমার জন্য দার্জিলিং টি! নো মিল্ক, নো সুগার।”
বাকিরাও চায়েই সম্মতি দিল। হৈমন্তী লজের দিকে রওনা দিল।
“বাই দ্য ওয়ে, আজ আমাদের মধ্যে একজন সেলেব্রিটি উপস্থিত আছেন,” মালিনী শ্রীনিবাসনের দিকে নির্দেশ করলেন, “ইনি স্বনামধন্য চিত্রকর মিস্টার এম শ্রীনিবাসন!”
“ও মা!” অনুজা হাঁ হয়ে গেছে। “আমি কাল থেকে ভাবছি আপনাকে কেন চেনা চেনা লাগছে!”
“আমি দেখেই চিনতে পেরেছিলাম,” সোনিয়া হাসতে হাসতে বলল, “কিন্তু বুঝতে পারিনি আপনি পরিচয় দিতে চান কি না।”
“এখন যখন পরিচয় হয়েই গেল, আপনি আমাদের জন্য কিছু আঁকুন না!” অভিষেক সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল।
অনুজা ওর হাঁটুতে হাল্কা করে চাপড় মারল।
“ওরকমভাবে বলে দিলেই কি এঁকে ফেলা যায় নাকি? আর্টিস্টের মনের ভেতর থেকে সাড়া আসতে হবে। তাই না, শ্রীনিবাসন বাবু?”
“আমি শুনেছি, একজন বড় অভিনেত্রী অনেকবার শ্রীনিবাসন বাবুকে তাঁর বরের ছবি আঁকতে অনুরোধ করেছিলেন,” সোনিয়া জুতো খুলে বেঞ্চে পা মুড়ে বসল। “কিন্তু শ্রীনিবাসন বাবু কিছুতেই রাজি হন নি।”
“কেন?” অভিষেক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল। “টার্মসে পোষায় নি?”
শ্রীনিবাসন মৃদু হাসল।
“উনি যেমন ছবি চেয়েছিলেন, তেমন আঁকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।“”
অনুজার চোখ গোল হয়ে গেল। “কোন কুরুচিকর ছবি?”
“নো নো,” শ্রীনিবাসন মাথা নাড়ল, “সেরকম না। উনি ছবিতে ওঁর বরের চোখে ওঁর প্রতি যে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছিলেন, আমি সেটা দেখতে পাইনি। ওঁর স্বামী সেই ভালোবাসা অন্য কোথাও খুঁজছিলেন। সেরকম ছবি আঁকলে উনি খুশী হতেন না।”
“তার মানে, আপনি আঁকার মাধ্যমে মানুষের সত্যিটা বের করে আনেন?”
“…সেরকম কিছু বলতে পারেন।”
“নাউ কাম অন, শ্রীনিবাসন বাবু,” অভিষেক সিগারেটটা বুটের নীচে থেঁতলে দিল। “এবার আমার প্রচণ্ড আগ্রহ হচ্ছে। আপনাকে আমাদের ছবি আঁকতেই হবে! আমি দেখতে চাই আপনি আমাদের মধ্যে কি দেখতে পাচ্ছেন।”
হৈমন্তী ফিরে এসেছে। সে-ও অভিষেকের সঙ্গে গলা মেলাল।
“হ্যাঁ, প্লিজ! একটা ছবি আপনাকে আঁকতেই হবে! আমরা খুব সম্মানিত হব। ছবিটা বাঁধিয়ে লবিতে রেখে দেব!”
“ওকে, ওকে!” শ্রীনিবাসন হেসে উঠল। “আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু দুটো কথা আমি আগে থেকে বলে রাখছি। সাবধান বাণীও বলতে পারেন। এক, আমি যে সত্যটা দেখতে পাচ্ছি শুধু সেটাই আঁকব। আর দুই, ছবিটা আঁকার পর আমাদের মধ্যে থেকে কোন একজন হারিয়ে যাবেন।”
গাছের নীচে যেন মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সবাই সোজা হয়ে বসল। সোনিয়া একটু শিউরে উঠল।
“হারিয়ে যাব, মানে?”
“হারিয়ে যাব মানে লস্ট,” অভিষেক অস্বস্তি ঢাকার জন্য হেসে উঠল। “খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
“লস্ট মানে আমি জানি,” সোনিয়া ঠান্ডা চোখে অভিষেক দিকে তাকাল। “কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানে তন্ময় হয়ে যাওয়া, বা নিজেকে ভুলে যাওয়াও তো হয়। এক্ষেত্রে উনি কোনটা বলছেন তাই জানতে চাইছিলাম।”
শ্রীনিবাসনের হাসি মুছে গেল, “সেটা যে হারিয়ে যাবে, সে বুঝতে পারবে। অন্য কেউ বুঝবে না।”
অভিষেক, অনুজা আর সোনিয়া পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। মালিনী অন্যমনস্ক। যেন কোন কথা শুনতেই পায়নি।
“সাউন্ডস লাইক ফান,” হৈমন্তী হাততালি দিয়ে উঠল। “আপনাকে কোন আঁকার সরঞ্জাম দিতে হবে?”
“একটা কাগজ আর পেনসিল হলেই চলবে।”
কয়েক মিনিটের মধ্যেই সরঞ্জাম যোগাড় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে চা-ও এসে গেল। শ্রীনিবাসন কাজে লেগে গেল।
“আমাদের কি পোজ দিয়ে বসতে হবে?” অভিষেক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল।
“না, আপনারা যেমন খুশী থাকুন। আমার যা দেখার ছিল, দেখা হয়ে গেছে।”
“অলরাইট দেন।”
অভিষেক চায়ের কাপ হাতে খাদের দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গভীর, নীল আকাশ - যেন কোন দূর অতীতে রঙ করা হয়েছিল। সেই রঙ আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। পাহাড়ের টাটকা হাওয়া। চোখ ঝলসানো বরফের পাহাড়।
“কি সুন্দর, না?”
অভিষেক খেয়ালই করেনি কখন অনুজা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
“হুঁ।”
“আচ্ছা, ওই অভিনেত্রীর মতো যদি আমিও তোমার ছবি আঁকতে বলি, তাহলে তোমার চোখে উনি কি দেখবেন?”
“শ্রীনিবাসন?” অভিষেক আবার সিগারেট ধরাল, “ওর কথায় তুমি বিশ্বাস কর নাকি? মানুষের ভেতরের সত্যিটা টেনে বের করে আনে…ওসব গিমিক শুধু। কারুর সত্যিটা জেনে ফেলা অত সোজা নয়।”
“তবু যদি তর্কের খাতিরে বলি-”
অভিষেক জঙ্গলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
“ওসব বোকা বোকা তর্কের কোন মানে হয় না।”
অনুজা আনমনে চায়ের কাপটা দু'হাতের পাতায় জড়িয়ে ধরল - যেন ধোঁয়া হয়ে পালিয়ে যাওয়া উত্তাপটুকু ধরে রাখতে চাইছে। সোনিয়া একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে আছে। হৈমন্তী গিয়ে ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।
“প্রথম সোলো ট্রিপ কেমন লাগছে?”
সোনিয়া হেসে উঠল।
“আপনারা ওয়েবসাইট পড়েন? আমি তো ভাবলাম বোধহয় ওগুলো স্ট্যান্ডার্ড ফিল আপ করতে হয়!”
“না, না। আমরা গেস্টদের সব অনুরোধ খুব মন দিয়ে পড়ি, এবং যতদূর সম্ভব ব্যবস্থা করার চেষ্টা করি। আমার মা তো প্রত্যেক গেস্টের রুচি অনুযায়ী ঘর আর ভিউও ঠিক করে। যেমন, আপনি নিরিবিলি আর শান্তি চেয়েছিলেন বলে কোণার ঘরটা আপনার জন্য রেখেছিলাম।”
সোনিয়ার হাসিতে অপরাধবোধের ছায়া পড়ল।
“বর, বাচ্চা, চাকরি, সব সামলে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই আমার বর বলল, একটা সোলো ট্রিপ করে এস।”
“একদম ঠিক করেছেন।”
সোনিয়া চার ধারে নজর ঘোরাল।
“এই লজটা আপনি আর আপনার মা চালান?”
হৈমন্তী কাঁধ ঝাঁকাল।
“এই মুহূর্তে তাই। আসলে এটা আমার ঠাকুরদার বাড়ি। মা যখন বিয়ে করে এল, তখন ঠিক করল বাড়িটা মেরামত করে একটা গেস্ট হাউস বানাবে। একদম ঘরোয়া ব্যবস্থা। বাড়ির একদিকে আমরা থাকব, আর অন্য দিকে কয়েকজন গেস্ট। ওই সময়ে কিন্তু হোমস্টের আইডিয়াটাই ছিল না! মা আর বাবা মিলে একটা নতুন জিনিস শুরু করল। তারপর আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন বাবা মারা যায়। সেই থেকে মা একাই বিজনেস চালিয়েছে। ইদানিং আমি আর আমার বরও জয়েন করেছি। ও এখন একটা কাজে কোলকাতা গেছে। আপনি আর ক'দিন থাকলে আলাপ করাতাম।”
“এরকম নির্জন একটা জায়গায় আপনারা দু'জন শুধু থাকতেন? ভয় করত না?”
“দু'জন না। আমি দার্জিলিঙে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। তারপর দিল্লিতে। মা একাই থাকত। কিন্তু বাহাদুর, পেমা, তেনজিং – ওরা সবাই মায়ের বিশ্বস্ত। বাবাকেও এখানে সবাই খুব ভালোবাসত। যদি বিজনেসের কথা বলেন তাহলে মা একাই পুরোটা দাঁড় করিয়েছে। আমি গল্প শুনেছি, যে বাবা যখন মারা গেছে সেই মাসেও কুক থেকে মালী, একজনেরও মাইনে বাদ পড়েনি।”
“আমাদের আর্টিস্ট বাবু কি করছেন?” অভিষেকের গলা ভেসে এল। “কিছু আঁকতে পারছেন, নাকি রণে ভঙ্গ দিয়েছেন?”
সবার দৃষ্টি কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চলে গেল। কিন্তু শ্রীনিবাসন কই? বেঞ্চ খালি। শুধু টেবিলের ওপর কাগজটা পাথর চাপা দেওয়া রয়েছে। আবার সেই নৈঃশব্দ্য নেমে এল। অবিশ্বাস সত্বেও সবাই ভয়ে ভয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ নিখোঁজ হয়ে গেল কি না। না, গুনতি ঠিক আছে। অভিষেক গলা খাঁকারি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পাথর সরিয়ে কাগজটা তুলে নিল। তারপর হোহো করে হেসে উঠল।
“আচ্ছা বুর্বক বানালো লোকটা…হেঃ হেঃ হেঃ!”
সাহস পেয়ে বাকিরাও টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
***
দুপুরে সবাই লাঞ্চ খেতে গেলে মালিনী দু'হাতে কাগজটা তুলে নিল। যে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় সবাই বসে চা খাচ্ছিল শ্রীনিবাসন সেই গাছটার ছবি এঁকেছে। শুধু নীচের টেবিল আর বেঞ্চটা নেই। তার বদলে আছে ফুল – গাছটার ডালে ডালে ফুলের ছড়াছড়ি। নীচেও গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল পড়ে আছে।
পাহাড়ের দিক থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ছুটে এসে মালিনীর চোখ বন্ধ করে দিল। এক মুহূর্তর জন্য। চোখ খুলে সে চমকে উঠল।
আকাশে আগুন লেগে গেছে!
না, আগুন নয়। সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছের বন। লাল শিখার চেয়েও উজ্জ্বল, জ্বলন্ত, অশান্ত…ঠান্ডা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, তারপর তুমুল আবেগে ডাল থেকে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে স্তূপাকার হচ্ছে। কোথায় এই কৃষ্ণচূড়ার বন? এ তো আজকের নয়…কত যুগ, কত শতাব্দী আগের গাছ এরা? যেন চিরকাল পৃথিবীর বুকে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
মালিনী দেখতে পেল কৃষ্ণচূড়ার বন পেরিয়ে দূরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মালিনী সেদিকে এগিয়ে গেল।
“শ্রীনিবাসন?”
শ্রীনিবাসন উত্তরে শুধুই মুচকি হাসল।
“আপনি জানতেন, আমিই এই ছবির ভেতর হারিয়ে যাব?”
শ্রীনিবাসন মাথা নেড়ে 'না' বলল।
“আমার ছবি শুধু একটা আমন্ত্রণ। কে সাড়া দেবে আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু যখন আমার ভেতর থেকে আমন্ত্রণ আসে, আমি জানি কেউ না কেউ সাড়া দেবেই।”
গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। গভীর, আরো গভীর…সমুদ্রের গর্জনের মতো…
“অন্য কোথাও গিয়ে বসা যাক?”
“নিশ্চয়ই,” শ্রীনিবাসন মাথার পেছন চুলকে বললেন, “কিন্তু কোনদিকে যাব?”
“মানে? এটা আপনার বাগান নয়?”
“একেবারেই না। আমি শুধু আসার পথটা তৈরী করেছি। বাগানটা সম্পূর্ণ আপনার,” শ্রীনিবাসন এদিক ওদিক তাকাল, “আপনি তো আগেও এই বাগানে এসেছেন।”
মাথার ভেতরের এক অন্ধকার কোণায় উড়তে থাকা প্রজাপতির মতো অনুভূতিটা এতক্ষণে মালিনী চিনতে পারল। সত্যিই তো! এই বাগানে তো সে আগেও এসেছে। ওই তো, ওই রাস্তাটা দিয়ে কিছুদূর গেলেই ফুলের বাগান। কিন্তু তখন তো কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি ছিল না।
শেষ কবে সে এই বাগানে এসেছিল?
বিস্মৃতির পর্দা ঠেলে একটা ছবি ভেসে উঠল।
“তুমি চলে গেছ বলে হৈমন্তী আর আগের মতো হাসে না, কথা বলে না। তোমার মা পাপাইয়ের বাড়ি থাকতে চলে যাচ্ছেন। আমি কাউকে খুশী করতে পারছি না…”
চোখের জলের মতো ঝরে পড়া ফুলের বনকে পেছনে ফেলে মালিনী এগিয়ে চলল। সমুদ্রের গর্জন বন্ধ হয়ে হাওয়া শান্ত হয়ে এল। বাগানের এই দিকটা মালিনীর সবচেয়ে প্রিয়। দুই ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল গোলাপ ফুটে আছে। তার সঙ্গে আছে হলুদ গাঁদা, সাদা জুঁইফুল, চন্দ্রমল্লিকা…দূর থেকে জলের শব্দ আসছে। মালিনী জানে, ওখানে একটা শ্বেত পাথরের ফোয়ারা আছে, আর একটা বসার জায়গা।
“আপনি অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন…”
শ্রীনিবাসনের কথায় মালিনী চোখের তারায় প্রশ্ন এঁকে ঘুরে তাকাল।
“আপনার স্বামী মারা যাওয়ার পরে হৈমন্তীর দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব, কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব – সবকিছু আপনার ওপর এসে পড়েছিল। শক্ত থাকা ছাড়া আপনার কোন উপায় ছিল না। তাই একমাত্র এই বাগানে এসে আপনি নিজের দুঃখ উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন। একমাত্র এখানেই, যখন আপনি সম্পূর্ণ একা ছিলেন।”
মালিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাথরের সীটে বসে পড়ল।
“আমার স্বামী…রজত…ও তখন সবে চলে গেছে। আমাদের জীবনের সব থেকে দুঃখের সময় ছিল সেটা। সেই শেষবারের মতো এই বাগানে এসেছিলাম।”
“উনি খুব স্পেশাল মানুষ ছিলেন?” শ্রীনিবাসনও বসে পড়ল।
“ওর মতো মানুষ আমি দেখিনি। ওর কাছে সাহায্য চাইতে এসে কেউ খালি হাতে ফিরে যায়নি। কত লোককে যে টাকা ধার দিয়েছে…আমরা যখন কৃষ্ণচূড়া লজ খুললাম, যে চাকরি চাইতে এসেছে ও তাকেই কাজে রেখেছে। এতজনের মাইনে দিতে টানাটানি হবে জেনেও। অনেকে ওর এই স্বভাবের সুযোগও নিয়েছে। আমি ওকে বলতাম, এই যে তুমি অমুককে এত টাকা ধার দিচ্ছ, ও কিন্তু জীবনে ফেরত দেবে না। রজত বলত, না দিক। ওর কাজটা তো হয়ে যাবে। রজত বোকা ছিল না, ও জানত পৃথিবীতে সৎ, অসৎ, দু'রকম মানুষই আছে। তা জেনেও, মানুষের মনের অন্ধকার দিকটা বুঝেও, ও সকলের উপকার করত।”
শ্রীনিবাসন অল্প হাসল।
“সত্যি অসাধারণ মানুষ ছিলেন।”
মালিনী মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল।
“আমি সময় থাকতে সেকথা বুঝতে পারিনি। রজতের স্বভাবের জন্য দিন দিন ওর সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠছিল। শেষে…” মালিনী ঢোঁক গিলল, “শেষে আমি ভাবতে শুরু করলাম, যদি কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব আমি একা সামলাই তাহলে কত বেশী টাকা বাঁচবে, আমরা কত ভালোভাবে থাকব, হৈমন্তী কত ভালো স্কুলে পড়তে পারবে…রজত যেদিন চলে গেল সেদিনও এই কথাই ভেবেছি…”
মালিনী শ্রীনিবাসনের দিকে তাকাল, যেন ভর্ৎসনা শোনার আশায়। কিন্তু শ্রীনিবাসন কিছু না বলে মালিনীর দিকে তাকিয়ে রইল।
“সেদিন আমরা সবজি কিনতে বেরিয়েছিলাম,” মালিনী একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল। “কাছাকাছি একটা বাজার বসে, তাই পায়ে হেঁটেই গেছিলাম। ফেরার সময়ে একটা গাড়ি ব্রেক ফেল করে সোজা আমার দিকে ছুটে এল। ভয়ে বা বিস্ময়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পা অচল হয়ে গেল। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম গাড়িটা আমার দিকে ছুটে আসছে।” বরফ হয়ে জমে থাকা কান্নার একটা ফোঁটা মালিনীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। “যখন সম্বিৎ ফিরল, দেখলাম আমি রাস্তার এক ধারে পড়ে আছি। আর রজতের রক্তাক্ত শরীর রাস্তায় লুটোচ্ছে। আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার আগে, আমাকে বাঁচানোর আগে রজত একবারও নিজের জীবনের কথা ভাবেনি!”
মালিনী আকাশের দিকে তাকাল। আকাশটা যেন দিন দিন আরো দূর হয়ে ওর নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
“অন্যের জীবন চুরি করে বেঁচে থাকার গ্লানি – এ এক ভয়ংকর বোঝা। সারা জীবন ধরে এই বোঝা টেনে টেনে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন আমার সকালে চোখ খুলতেও ইচ্ছে করে না। জানেন, সেদিন যদি রজতের বদলে আমি মরে যেতাম, রজতের জীবনের গতি পালটাত না। কারণ ও শুধু দিতেই শিখেছিল, কারুর থেকে নিতে শেখেনি। তাই ওর নিজের মতো করে বাঁচার জন্য সেভাবে কাউকে প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমরা যারা ওর থেকে নিতে অভ্যস্ত ছিলাম – প্রতিদিন, খেয়ালও না করে নিয়েই যেতাম, আমাদের জীবন ওকে ছাড়া চৌচির হয়ে গেল। আমি যদি রজতের জীবন চুরি করে না নিতাম, সেদিন যদি রজতের বদলে আমি মরে যেতাম – তাহলে? এই প্রশ্নটা আমি সবার চোখে দেখেছি। এমনকি হৈমন্তীরও…”
মালিনী কথাটা শেষ করল না। হয়তো শেষ করার মতো কোন কথা বাকি ছিল না। কোথাও একটা পাখি একটানা ডেকে চলেছে। গোলাপ ফুলের ওপর একটা ভ্রমর ঘুরপাক খাচ্ছে। মালিনী দু'হাতে নিজের রগ টিপে ধরল।
শ্রীনিবাসন মৃদু গলা খাঁকারি দিল।
“কিন্তু সেদিন আপনাকে না বাঁচাতে পারলে আপনার স্বামী কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন? তিনি কি সারা জীবন অপরাধবোধে ভুগতেন না?”
“সেটাই হওয়া উচিৎ ছিল। রজতের বদলে বেঁচে থাকার জন্য আমি মনে মনে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এমনকি রজতের কাছেও। কিন্তু ক্ষমা আমার কপালেই নেই। আমি যে এতবার ভেবেছি – কোনভাবে যদি কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব আমার একার হাতে চলে আসে – সেটা কি রজতের মৃত্যু কামনা করাই ছিল না? তারপর রজতের মৃত্যুতে আমি কোন অধিকারে ক্ষমা চাইতাম, বা চোখের জল ফেলতাম? সেটা কি শঠতা ছাড়া কিছু নয়?”
“তাই আপনি মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে শুধু নিজের কর্তব্য করে গেছেন। কৃষ্ণচূড়া লজ দাঁড় করিয়েছেন, মেয়েকে ভালো স্কুল কলেজে পড়িয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন, শাশুড়ীকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন – নিজের সবটুকু দিয়ে আপনার স্বামীর অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউ দেখেনি আপনি সেটা করতে গিয়ে নিজের ওপর কতটা অত্যাচার করেছেন – সম্ভবত আপনি নিজেও বোঝেননি…যে আপনি ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।”
শ্রীনিবাসনের কথাগুলো তুলোর মতো মালিনীকে জড়িয়ে নিতে লাগল। মালিনী ঢুলে পড়ল। যেন কতদিনের জমা ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরেছে। আর এক মিনিটও চোখ খুলে রাখতে পারছে না।
“আমি যা করেছি সেটা আমার ন্যায্য প্রায়শ্চিত্ত।”
“প্রায়শ্চিত্তরও শেষ থাকে। আপনার স্বামী নিজের জীবনের পরিবর্তে আপনাকে যে উপহার দিয়েছেন, আপনি তাকে শাস্তি বানিয়ে নিলেন…” শ্রীনিবাসন উঠে পড়ল। “এই বাগানটা ক্লান্ত, একাকী মানুষের জন্য তৈরী। ঘুম পেলে আপনি এখানে ঘুমতে পারেন। কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।”
“ঘুমব? সত্যি ঘুমব? কতক্ষণ ঘুমতে পারব?”
“যতক্ষণ না কেউ আপনাকে ডাকতে আসে।”
***
“মা! মা!”
হৈমন্তী উদ্বিগ্ন হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।
“বেডরুম মে দেখা হ্যায়?” পেমা কোমরে দু'হাত রাখল। গেস্টদের ডিনার হয়ে গেছে। এবার তার বাড়ি যাওয়ার সময়।
“হ্যাঁ, দেখে এলাম তো। এতক্ষণ তো তাই ভাবছিলাম, যে মা হয়তো ঘুমচ্ছে। এখন গিয়ে দেখলাম ঘর খালি। সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, বলল মা-কে দুপুরের পর আর দেখেনি।”
“উস পের কে নীচে তো নেহি?”
“পের? কৃষ্ণচূড়ার নীচে? যেখানে চা খাচ্ছিলাম?”
বলতে বলতে হৈমন্তী সেদিকে পা বাড়াল। লন্ঠনের আবছায়া আলোয় বেঞ্চটা ফাঁকা বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু…
“মা!”
হৈমন্তী ডাক দিতেই যেন শূন্য থেকে মালিনীর অবয়ব ফুটে উঠল। হৈমন্তী এক ছুটে বেঞ্চের কাছে চলে গেল। কাছ থেকে মা-কে দেখে ভারী মমতা হল ওর। বাচ্চার মতো বেঞ্চে বসে টেবিলের ওপর মাথা রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সামনে শ্রীনিবাসনের ছবিটা রাখা।
“মা! উঠে পড়! রাত হয়ে গেছে তো!”
হৈমন্তীর ডাকে মালিনী উঠে চোখ কচলাতে লাগল। ওর মাথা থেকে একটা কৃষ্ণচূড়ার ফুল পড়ে গেল।
কৃষ্ণচূড়ার ফুল? এখানে?
হৈমন্তী চমকে ওপর দিকে তাকাতেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
আকাশ ভর্তি তারা, আর তার নীচে, কাল অবধি একটাও ফুল না ফোটা কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রত্যেকটা ডাল থেকে আগুনের মতো লাল ফুল থোকা থোকা ঝুলে আছে।
0 comments: