প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী
Posted in প্রবন্ধযে দেশে দুর্নীতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে, সেখানে বিপদটা আসার আর বাকী নেই । এই বিষয়টাকে বুঝতে গিয়ে ঘরে ও বাইরে , দুদিক থেকেই আসা লড়াইটাকে সামলাতে গিয়ে দেখলাম বেশ গভীরতা ।
আসলে আমার আশঙ্কা , পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশের অধিকাংশ রাজ্যই কি তবে পৌঁছে গেল এমন একটি স্তরে, যেখানে দুর্নীতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে?
এই কথা মনে হওয়ার কারণ হিসাবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়।
তবে, পাশাপাশি এ কথাটিও ভুললে চলবে না, আর জি কর কাণ্ডের পরেই এ রাজ্যের মানুষ যে ভাবে রাস্তায় নেমে দিনের পর দিন প্রতিবাদ করেছেন, সেই প্রতিবাদ কিন্তু কিছু অনুদানের পরিপ্রেক্ষিতে ভুলে যাওয়ার কথা নয়, বা এমনও নয় যে, শিক্ষক নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির কথাও সাধারণ মানুষ ভুলে গিয়েছেন।
যদিও ঐ নিয়োগের দুর্নীতির ফল বেড়িয়ে গেছে , দুর্নীতি প্রমাণিত – দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে।
কাজেই শাসক নিয়েই এখন দেশের মানুষ চিন্তিত, তবে এ কথা সত্যি, শাসক পরিবর্তন করে ক্ষমতায় কাকে আনবে, তার দিশা আপাতত পশ্চিমবঙ্গে খুবই সমস্যার , কারণ নিরঙ্কুশ ভাবে গ্রহণীয় কথাটাই বোধ হয় আজকাল আর এখানে খাটেনা । শুধু দুর্নীতিটাই একমাত্র ইস্যু নয় ।
খোলা বাজারের কারণে মানুষ বা সমাজের সামনে অনেক দুয়ার খুলে গেছে , যেমন যার দ্বারা কিছুই হবেনা বলে ধরে রেখেছে তারই বাবা , সে এখন বিরাট প্রোমোটার হয়ে দুটো বাড়ির মালিক । অস্বাভাবিক মনে হয়না আজকাল । কা র ণ যোগ্য তা ব্যাপারটাই ঘেঁটে গেছে , যারা নিরুপন করবে , তাদেরও যোগ্যতার মাপকাঠি তে বিচার হয়নি । এরকমই একটা অবস্থায় চলছে ।
এগুলোর পেছনে যেটা কাজ করছে সেটা হলো – রাজনীতি যে সম্ভাবনাময় তারই ‘বহিঃপ্রকাশ’ বা ‘করোলারি’ । অনেক দিক খুলে দেয় , তারই একটা ছোট্ট সংস্করণ। ঐ ছেলেটিকে দেখে পাশের বাড়ির খোকাও বখে যাবে তারপরে কারুর হাত ধরে ঐ কাজই করবে ।
এটা একটা নিশ্চিন্তি , যার পক্ষে মাসে পাঁচ হাজার টাকা কামানো টা ছিল স্বপ্ন , সে পেলো হাতে দশ হাজার টাকা , ভগবান বলে তাকে তো মানবেই – যে দিলো টাকাটা -- এটাই করা হচ্ছে এবং হচ্ছে খুব ‘সুপরিকল্পিত’ ভাবে ।
শাসকের হাতে সারা দেশের সম্পদটাই ব্যবহার যোগ্য । নানান ভাবে । ঐ আমরা কিছু নাম দিয়েছি , গণতান্ত্রিক দেশ বলি তো , তাই , যেমন Municipality , panchyayat , gram sabha , যাদের হাতে থাকে দেশের সমগ্র খালি জায়গার লীজ । মানে শাসকের হাতে। সেটার ব্যবহার কেমন ভাবে হবে , কতটা আইন যোগ্য , কিভাবে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখান হবে , সবটাই শাসকের নিয়ন্ত্রনে।
ঐ কাজগুলোকে শাসক দল আপাতভাবে লীজ নেয় বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামে’ , যেমন রাস্তা মেরামতের কাজ , গ্রামের পুকুর কাটার কাজ , জঙ্গল পরিস্কার করার কাজ – সবই করবে সরকারি দপ্তর , কিন্তু সিদ্ধান্ত শাসকের ।
কাজেই এগুলোই হলো শাসকের মুলধন, যার আশে পাশে মৌ মাছি ঘুরঘুর করবে, আর শাসক তাদের আটকাবে ও জালে পুড়বে , তোতা পাখী বানাবে । শাসন ক্ষমতা চালাবে এই ভাবেই ।
কেন তারা শুনবে , কারণ তাদের নিজের আওকাত নেই , সাধারণ প্রক্রিয়াতে নিজেদের জীবন যাপনে তারা অভ্যস্ত নয় , হয় চুরি ছিনতাই , না হয় লোক ঠকানো – মার দাঙ্গা – পয়সা নিয়ে দাঙ্গা কেনা , চিটীং বাজী করে , অথবা শাসকের ধামা ধরে ।
যারা তাদের নেবে , অবশ্যই সেই শাসককে হতে হবে মিশন লেস আন রেজিমেন্টেড অ্যাজেন্ডার কান্ডারী । কোনো নিশানা নেই – একমাত্র ভোটে জেতা ছাড়া।
সাধারণ পদ্ধতিতে স্কুল কলেজে পড়াশুনো করে , চাকরির পরীক্ষা দিয়ে , কিংবা স্পেসালাইজড কোনো কোর্স করে নিজেকে উপযুক্ত করবার ইচ্ছাটা তাদের হয়না , আমাদের ছোটো বেলায় দেখা , বাবা বলতেন , গ্রাজুয়েট হয়েছিস একটু টাইপটা শিখেনে। যদি ইংরাজী জানতাম , তাহলে শর্ট হ্যান্ডটাও শিখে নে , দেখি কোথাও স্টেনো গ্রাফারের চাকরী পাওয়া যায় কিনা । আজকাল সেখানে কম্পিউটার ও তারই অনুষঙ্গ অনেক কিছু হয়েছে ।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে আলাদা কারণ, হয় তাদের মেধা নেই , না হয় কয়েক প্রজন্ম ধরে এর সাথে তাদের পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই । এদের রোজগার চিরকালই সরকার করিয়ে দেয় নানান রকম ভাবে। সংখ্যা আজও আছে , অনেক ।
শাসকের হাতে যদি এত কিছু থাকে নতুন কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেবে কেন । নতুন শিল্প নিয়ে মাথা ব্যাথা করবে কেন ? লোক দেখান কিছু শিল্প মেলাই যথেষ্ট।
এই মানুষ গুলোই তো শাসককে অর্থ যোগাবে , শ্রম যোগাবে, ভোটের সময় বুথ আগলাবে -- দরকারে দুচারটে লাশও ফেলবে নির্ভয়ে , কারণ প্রশাসনের রক্ষা কর্তা যে পুলিশ, সেও তো অনেকটাই এ সমস্ত কাজের সাথে যুক্ত।
ঐ ‘বাধ্য’ থাকা ।
‘বাধ্যতা’ই সৃষ্টী করতে হবে । দেশের শাসকের কাছে সেটাই প্রথম কাজ ।
কেউ স্বভাবতই বাধ্য, ‘অবস্থার প্রেক্ষিতে’ --কেউ আবার , ‘আরো চাওয়ার দলে’, সেও বাধ্য - কেউ আবার, ‘বিপদ বা অপকর্ম সামলাতে ’, সেও বাধ্য – কেউ আবার চায়, ‘অবস্থার পরিবর্তন’ – সেও বাধ্য – যেমন , ঐ যাদবপুরের ছোট ফ্ল্যাট বেচে সাল্ট লেকের সরকারি আবাসনের তিন কামড়া ফ্ল্যাট , সুযোগ চাই ।
‘বাধ্যে’র এই বিচিত্র বিভাগ থেকে শাসককে বাছতে হয় – ‘প্রায়োরিটি’ ঠিক করতে হয় , তবে না চলে দেশ ।
শাসক সমস্যায় পড়ে তাদের নিয়ে যাদের বোঝা বড়ই মুশকিল । বর্তমানে এরা সংখ্যায় কম হলেও , এরা মেধাবী গোত্রের । বোঝার দিকটা বেশ প্রখর । কাছে আসে নানান কাজের মধ্য দিয়ে । শাসক কে ‘অবলিগেটেড’ করে তোলে বা তোলার ক্ষমতা রাখে – নিজেদের মেধার জোড়ে। আবার সেই সুবাদে বিশাল সুবিধাও নিয়ে নেয় ঐ তালে গোলে । শাসক কিছু ক্ষেত্রে বিপদেও পড়ে। দেখা গেছে ।
উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই , আমাদের চোখে দেখা ,জানা , ঘুরে বেড়ানো মানুষ এরা।
দেশ চালানো কি অতই সহজ । অত সহজে কি চালানো যায় । আর এতদিন এ ভাবে টিকে থাকা যায় এ সমস্ত দিকগুলোকে না ভেবে। ।
তবে মানুষের অস্বস্তির প্রকাশ তো থাকবেই প্রতি বাদের মাধ্যমে । কাজেই প্রতিবাদ যদি হতে হয় – ঐ বাধ্যতা সৃষ্টীর অঙ্কুরেই আঘাত হানতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে , নইলে নিম্নমেধা রাজ করবে – যেমনটা বর্তমানে করছে – মেধার বৃদ্ধি মানেই আত্মনির্ভরতা – মানেই শাসকের আজ্ঞাবহ না হওয়া – মানেই নিজের মতবাদ তৈরি – ক্যাডারে ঘাটতি পড়বে , কোত্থেকে আসবে ক্যাডার যাদের আসার মূল কারণই নিজেদের কিছু করার সামর্থ নেই বলে ।
তবে আশার কথা হল মানুষ কিন্তু এখন নির্বাচনের চেয়েও প্রতিবাদের রাজনীতিতে আস্থা রাখতে চাইছেন। প্রমাণ বেশ মিলেছে গত কিছু সময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আঙ্গিনায় ।
কেবল বুঝছেনা প্রতিবাদের ভাষার রঙ্গটা কেমন হবে । এটা ঠিক যে অধিকাংশ মানুষই চান সুবিচার, অন্যায়ের প্রতিবাদ। প্রতিবাদের রাস্তাতেই যে একমাত্র আসল ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব—সেই মানসিকতাই এখন পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে কাজ করছে।
খুবই স্বাভাবিক , দেখা গেছে বিশেষত বেশ কয়েকটা ইভেন্টের পরে ।
যদিও আমার মনে হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের অনেকেই বুঝেছেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অন্য দলকে আনলেই যে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই , কারণ সিস্টেমের পচা ঘা সহজে যায়না – তবুও তুলুমূল্য বিচারের সময় এসেছে – মানুষকে বাছতে হবে – আধা এদিক আধা ওদিক করলে শাসক আবার বর্তমান শাসকের সব দোষগুলি নিয়ে নতুন রুপে আবির্ভূত হবে , যেটা কাম্য নয় ।
কাউকেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার এমন একটা জায়গা দেওয়া যাবেনা যেখানে বিরোধীদের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যাবে । আমরা গণতান্ত্রিকতার মূল কাঠামো পাল্টাতে পারবোনা । কিন্তু কিছুটা সংশোধন বোধ হয় করার কথা ভাবা যেতে পারে।
সংখ্যা গরিষ্ঠতার মাত্রা বেশী হওয়ার ফলে দেখা যাচ্ছে একটা অহংবোধ , তার থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে, কিভাবে ? কেবলমাত্র তখনই সম্ভব যখন শাসকের ভয় থাকবে, আসন হারানোর ভয়, ক্ষমতার থেকে দুরে চলে যাওয়ার ভয় থাকবে , ফেল করার ভয় থাকবে , তবেই দেশ বা রাজ্যকে ঠিকমতন বুঝবে । অর্থাত রোজ যেন পরীক্ষা দিতে হয় , প্রমাণ করতে হয় যে আমরা যা করছি সেটাই করা সম্ভব , আমার মনে হয় তখনই নাগরিক বেস্ট সরভিসটা পাবে। কি ভাবে করতে হবে সেটাকেই সাজাতে হবে – সবাইকে সাথে নিয়ে এক নির্মোহ আলোচনার মাধ্যমে।
এই গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সামনে রেখে পরিবর্তনটাকে এফেক্টিভ করতে একটা বিচার, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকের কাছ থেকে আশা করা বোধ হয় অমুলক নয় ।
0 comments: