গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
Posted in গল্পআমি তাকে ডাকি নি।সে যখন বলল, আমি আজ আসব,আপত্তি করিনি। ভালো কথা।আসতে চাইছে আসুক। আমাদের বাড়ি শহর থেকে একটু দূরে। ট্রেনে করে একটা স্টেশনে এসে ১ নং প্ল্যাটফর্মে নামতে হবে। পাশেই অটোস্ট্যান্ড।তারপর অটো। তারপর বেশ কিছুটা হাঁটা... তারপর একটা চালু মিষ্টির দোকান। আমাদের বাড়ির নাম বললে ঠিক দেখিয়ে দেবে। বাগানওলা বাড়ি। চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয়।
এই লোকটাকে আমি ভালো করে চিনি না। কেবল নামে চিনি। ছবিতে মানুষকে কতটা চেনা যায়? আজকাল অনেকেই নকল ছবি লাগায়। তাছাড়া অপরিচিত মানুষকে বাড়ি গিয়ে চিনতে হবে? কে জানে?
ওর একটি কবিতা পড়ে আমার ভালো লেগেছিল। কবিতাটি ছিল তার প্রেমিকার জন্মদিন নিয়ে। কবিতার নামও 'প্রেমিকার জন্মদিন'। তার মধ্যে একটা লাইনে এসে আমি ছিটকে যাই।
লাইনটা হলো: তিস্তার চরের মতো দীর্ঘ বাল্যকাল।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম।
তারপর আমার প্রতিক্রিয়া জানাই।
এই কবিতার শেষ লাইন ছিল এই রকম।
আমন্ত্রিত লোকটিও জানেনা সে আগন্তক কিনা। দারুণ না?
সেই থেকে ওর কবিতা পড়ি। পড়তেই থাকি।ও রাতদিন কবিতা লেখে। মূলত সনেট। কিছু দীর্ঘ কবিতা, গানের লিরিক এসবও লেখে।
আমি নিজে কবিতা লিখতে পারি না। কিন্তু ভালো কবিতা পড়তে ভালবাসি। আগে গল্প লেখার চেষ্টা করতাম। এখন মাঝে মাঝে অনুবাদ করি। কিন্তু ঠিক হয়ে ওঠেনা। অণুগল্প মাঝে মধ্যে লিখি।
এই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ হতো ফেসবুকের মাধ্যমে। একদিন ও বন্ধুত্ব প্রস্তাব পাঠালো।এক সপ্তাহ পর আমরা বন্ধু হলাম।ও বলল: এত তাড়াতাড়ি?
আমি উত্তর দিইনি। কারণ আমার সময় লাগে। এটাই আমার স্বভাব। যদিও কিছু মানুষ ভাবে এটা আমার একটা সচেতন স্ট্রাটেজি।
যাই হোক ফেসবুক থেকে মেসেঞ্জার, পরে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে ওর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। কোনো ব্যক্তিগত কথাবার্তা নয় শুধু লেখা চালাচালির সম্পর্ক।
আমার গল্প পড়ে ও বলল , ভালো হয়নি। আরও ছোট করে লিখে দেখুন।আর অনুবাদগুলো ঠিক জমছে না। তবে মেঘাকে নিয়ে আমার লেখা একটা অণুগল্প ওর ভালো লেগেছে বলল।যে এত ভালো কবিতা লেখে তার প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে?
তবু সে তো ঠিক বন্ধু নয়। আগন্তকই বলা যায়। তবে আসতে চাইছে যখন আসুক।এর আগে কোনো সত্যিকারের কবিকে সামনে থেকে দেখেছি বলে মনে পড়েনা।
মুশকিল হলো ও আজ আসবে বলে লিখেছে। কিন্তু আজকেই বাড়িতে কেউ নেই। ফাঁকা বাড়ি। আমি কুঁড়ে এবং অপারগ একজন মানুষ। কিচ্ছু পারিনা। এখন আর আমন্ত্রণ বাতিল করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই।
অগত্যা কাজে হাত লাগালাম।চার পিস টোস্ট বানালাম। এটা পারি। দুটো মুরগির ডিম সহ পেঁয়াজকুচি,টোম্যাটো ও চিলি সস দিয়ে ওমলেট বানালাম। চানাচুর ও বিস্কুট ছিল। ভেজিটেবল চপ আনিয়ে নিলাম। ফ্রিজে গুড়ের পায়েস আছে। কফি বানিয়ে নিতে পারব।
এইবার নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করা যায়।
একদিন এই লোকটাকে আমার দেখা দরকার ছিল। ওকি সত্যিকারের মানুষ না একজন অলৌকিক কবি?ওর কবিতা পড়লে গা শিরশির করে।কেন?
এখনও আসছে না তাই নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলি :যদি দ্যাখো,জানলার শিক দিয়ে গলা বাড়িয়ে অবয়বহীন কোনো আগন্তুক তোমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,ভয় পেয়োনা। তোমার সবচেয়ে প্রিয় বইটার ওপর একবার হাত রাখো।
কোনো প্রিয়জনের দিকে ভুলেও তাকিও না,দীর্ঘশ্বাস যেন তাকে স্পর্শ না করতে পারে।
ভুলে যাও আজকের দিনে কী হয়েছিল বা কী হয়নি।আকাশি রঙের বুশশার্ট,খয়েরি ট্রাউজার্স আর
কালো রোদচশমা পরে বেরিয়ে এসো আগন্তুকের পিছু পিছু।তাকিয়ে দ্যাখো, বসন্ত কি মহা সমারোহে ফুটে উঠেছে চারপাশে। অথচ দ্যাখো এ বিচিত্র পৃথিবী তোমার পদছাপ নিতে অপারগ।
দুএকটি রাস্তার কুকুর চিৎকার করে এগিয়ে এসেও কী জাদুবলে থমকে যাবে।
দেখতে পাবে তোমার আসন্ন বই ও পুরনো ফোটোগ্রাফের ওপর কয়েকটি বাসি ফুল আর শত্রুদের হাহাকার পড়ে আছে। শুধু তোমার সেই প্রিয় বইটা শেলফে নেই। হারিয়ে গেছে না চুরি হয়েছে কেউ খোঁজ করেনি।
আলির কবিতা পড়ে আমার যা হয়েছিল লেখার চেষ্টা করলাম।আলি কবি আসবে বলেও আসেনি। আমার ভুল হয়েছিল।আলি কোথাও আসেনা।সে একজন আগন্তক এবং আমার কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী।
কিন্তু আমার প্রিয় বইটা শেলফ থেকে কোথায় হারিয়ে গেল? যেটা ছাড়া আমি এক লাইনও লিখতে পারি না।
সেই বইচোরকে আমি চিনিনা। আপনি চেনেন?
0 comments: