1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in







এই রচনার মূলে একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ এবং সেই সূত্রে কিছু জানা-অজানা তথ্য সামনে আনা। আশির দশকের একেবারে শেষে একটি মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যিনি ছিলেন একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, নাম—পাহান। স্থান—রাজরাপ্পা।
বোকারো-পেটেরবার-রাজরাপ্পা-রামগড়-রাঁচীর বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বাস করেন বহু আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষ। অঞ্চলটি ঝাড়খন্ড নামক দেশের নতুন একটি রাজ্যের অন্তর্গত, যে রাজ্যটির জন্ম মাত্র ১৫ই নভেম্বর, ২০০০ সালে।
সমগ্র দেশের আট দশমিক তিন শতাংশ ( ৮.৩%) শতাংশ আদিবাসীর অবস্থান এই রাজ্যটিতে। রাজ্যটিতে বসবাস করেন প্রায় বত্রিশ রকমের জনজাতি। এই আদিবাসী ও জনজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আটটি জনজাতির প্রাধান্য এখানে খুব বেশি এবং তাদের আদিম যুগের আদিবাসী/জনজাতি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংখ্যার বিচারে তার মধ্যে অবশ্যই বীরহোর সম্প্রদায়ের প্রাধান্য অধিক।
যদিও শবরদের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয় না, কারণ তাদের উপস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর কিংবা উড়িষ্যার মত নয়, কিন্তু এই আলোচনা একজন শবর জাতির মানুষকে নিয়েই।
পাহান নামে আদিবাসী যার সঙ্গে পরিচয় রাজরাপ্পায়, তিনি ছিলেন শবর জাতির মানুষ। সেখানকার কোল-প্রজেক্টে কাজ করেন যে সব অফিসার, তাঁদেরই কোন একটি বাংলোতে তিনি মালির কাজ করতেন। শবর জাতির মানুষ ঠিক আধুনিক কায়দায় বাগানের পরিচর্যা করতে পারেন কিনা এই নিয়ে তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু সেই সময় ওই মানুষটি একটি বাংলোর বাগানের গাছপালা দেখাশোনার কাজেই নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর চেহারার বৈশিষ্টই তাকে জানিয়ে দেয় তিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত একজন মানুষ। নম্র, বিনয়ী, ঝকঝকে সাদা দাঁত চোখে পড়ে কথা বলতে গেলেই। নাক-চোখ-মুখের গঠন আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মতই। কিন্তু অত্যন্ত দরিদ্র, ক্ষয়াটে চেহারা। দেখে বেশ বয়স্ক মনে হলেও আদতে তা ছিল না। পাহানের পরনে প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া একটি রঙ্গিন কাপড়ের টুকরো কোনমতে কোমরে জড়ানো। খালি গা, খালি পা। ওই অবস্থাতেই প্রথম সাক্ষাৎ। পরে মালিকদের দেওয়া একটি আকাশনীল রঙের জামা আর খাকি রঙের একটি হাফপ্যান্ট তাঁর পরনে থাকত। আর অন্য কোন পোশাকে তাঁকে কখনও দেখিনি। মাথা নিচু করে কাজে আসতেন, কাঁধে একটি কুঠার। আসা-যাওয়ার সময় সর্বদাই কাঁধে ঝোলানো থাকত সেই কুঠার। স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছেই জানা যায় পাহান আদতে শবর জাতির অন্তর্ভুক্ত একজন, তাই সবসময় কাঁধে কুঠার ঝোলানো থাকে। তাঁকে কখনও উচ্চাসনে বসতে দেখিনি। সবসময় মাটিতে উবু হয়ে বসতেন অথবা দাঁড়িয়ে থাকতেন। তখনও তার মাথা নিচু। সেই ব্যক্তির মতে,পাহান একজন অচ্ছুৎ, নিম্নশ্রেণির মানুষ, তাই উঁচু জায়গায় বসেন না। সকলের সামনে মাটিতে বসে থাকেন।
সত্যি কথা বলতে কি,শবর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা ছিলনা। পরবর্তীকালে জানার আগ্রহ থেকে বইপত্র ঘেঁটে দেখেছি, আজকের দিনে শবরদের অবস্থা যাই হোক না কেন,শবরদের অতীত ছিল রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, হর্ষচরিত এবং চর্যাপদের পাতায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও শবরদের উল্লেখ আছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় জাতিটির প্রাচীনকালের অস্তিত্ব। তথাকথিত ‘আর্য’দের আগমনের পূর্বে যে সব ‘অনার্য’ জাতিগুলি বসবাস করত এদেশে, শবর জাতিটি ছিল তাদের অন্যতম।

জাতিতত্ত্ববিদদের মতে, শবররা কোলরীয় শ্রেণীর অন্তর্গত। হিমালয়ের উত্তরপূর্ব দিক থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল এইরকম অনুমান করা হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে মধ্যভারত, উড়িষ্যা ও উত্তর মাদ্রাজের দিকে তারা চলে যায়। প্রাচীন সব গ্রন্থে পুন্ড্র- শবর কথার উল্লেখ পাওয়া যায় কারণ অনেক আগে শবরদের পুন্ড্ররাজ্যে ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস ছিল।
সংষ্কৃত অভিধানে পাওয়া যায় যে শবররা পত্রপরিধান করত। পত্রপরিধানকারীদের শবর এবং ময়ুরপুচ্ছ পরিধানকারীদের কিরাত বলে সম্বোধন করা হত। কিছুদিন আগেও উড়িষ্যায় পত্রপরিধানকারী শবরদের দেখা মিলত।
.
প্রাক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও প্রাচীনতম গ্রন্থ হল চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। মনে করা হয় এগুলি পালরাজাদের সময়ে রচিত অর্থাৎ প্রায় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত এবং এই রচয়িতাগণ ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের কবি। চর্যাগীতিতে তৎকালীন অন্ত্যজ সমাজের প্রতিফলন দেখা যায়। লোকজীবনের বিশেষত নিম্নশ্রেণী ও অন্ত্যজশ্রেণীর জীবন গীতিগুলিতে সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। সেকালে যে আদিম কোলজাতির বসবাস ছিল যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল শবর জাতি,এইউল্লেখ চর্যাপদেও পাওয়া যায় । এই নিম্নশ্রেণীর মানুষগুলির বসবাস ছিল তৎকালীন সভ্য,নাগরিক সমাজ থেকে দূরে বড় বড় পাহাড়ের শিখরদেশে। চর্যাগীতিতে শবরদের সম্বন্ধে এমনই উল্লেখ পাওয়া যায়---
‘ বরগিরিসহর উত্তুঙ্গমুনি সবরেঁ জহি কিঅ বাস ‘( কাহ্নপাদ-১৯)
চর্যাগীতিতে শবরপাদ নামে একজন কবির কথা জানা যায়, সম্ভবত তিনিও ছিলেন জাতিতে শবর। চর্যাগীতিতে আরো পাওয়া যায়---
‘উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরো বালি।
মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিন সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী’ ইত্যাদি।
অর্থাৎ জনবসতি থেকে দূরে পর্বতে বাস করে শবর-শবরী। শবরীর গলায় গুঞ্জার মালা এবং ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করে আছে। এই প্রসঙ্গে মাত্র কিছুদিন আগেও উড়িষ্যার ঘনজঙ্গলে যেখানে শবররা বসবাস করে তাদের পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ ও পত্রপরিধান দেখা গেছে। আরো একটী চর্যাগীতিতে শবরদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে—‘ টালত মোর ঘর নাহি পরিবেশি’ ( ঢেন্‌ঢেনপাদ ৩৩ নং) অর্থাৎ উঁচু টিলার উপরে ঘর, যেখানে কোন প্রতিবেশী নেই।
এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত একটি ভাবনা মনে আসে, চর্যাগীতিতে শবর-শবরীদের কথা বলা হয়, চর্যাগীতিতে যে কবি শবরপাদকে শবর জাতি বলে মনে করা হয়, তবে কি রামায়ণে বর্ণিত ‘শবরীর উপাখ্যানে’র শবরীও কি এই শবর জাতির অন্তর্গত?
রামায়ণে শবরীর প্রতীক্ষার কাহিনি আমরা জানি। বহুযুগ আগে,সেই শবরীও কি শবরকন্যা ছিলেন? জাতিতত্ত্ববিদ দের মতে যদি জনগোষ্ঠী সম্পপ্রদায়ের মানুষেরা উচ্চবর্ণ ও তথাকথিত ‘আর্য’ দের তাড়নার ফলে নানাদিকে চলে যান। যার মধ্যে বন-জঙ্গলে, গুহা- গিরি-কন্দরে বসতি স্থাপন করারকথাওয়াছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে কিছু জন উত্তর মাদ্রাজের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণের দিকেও চলে যান। শবরী উপাখ্যানে আমরা দেখি তাঁর অবস্থান ছিল পম্পা সরোবর এবং তৎসংলগ্ন অরণ্যে। প্রাচীন পম্পা সরোবর হল বর্তমানের হাম্পি। তবে কি, প্রাচীন শবরজাতি পম্পাসরোবরঞ্চলেবসতি স্থাপন করেছিলেন? হয়তো এ সত্য নয়, তবু এমন একটি অনুমান করতে ক্ষতি কি!
আরও একটি কথা উল্লেখ করার মত, পুরীর জগন্নাথ দেবকে শবরদের দেবতা বলা হয়। উড়িষ্যায় যে অনেক শবরের বাস, সে আমরা সকলেই জানি। কোন একসময় যে শবরজাতি উন্নতির ফলে রাজা বা সেখানের প্রধান হয়ে উঠেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। পুরীর দেবতার অবয়ব দেখে অনেকেই অনুমান করেন তিনি আদিবাসী সমাজের দেবতা। পুরীতে উৎসবের সময় রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারীগণই পূজার অধিকারী হন।
.
বলতে গেলে ভারতে বৃটিশ শাসনের সময় থেকেই শবরদের অস্তিত্বের সংকট শুরু হয়। বন কেটে বসত নির্মাণের ফলে তাদের উৎখাত করা হয়। যে মানুষগুলি বন-জঙ্গলে লুকিয়ে একান্ত অরণ্যচারী জীবন যাপন করত, তারা প্রকাশ্যে এসে পড়ার ফলে দিশেহারা, নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। কাজকর্মের কোন সংস্থান না থাকায় অভাব-অনটন, তার ফলে যে কোন উপায়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে গিয়ে চুরি-চামারি এবং শেষ পর্যন্ত শবরদের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল দস্যুবৃত্তি বা অপরাধপ্রবণ জাতি হিসাবে পরিচিতি লাভ।
কিন্তু শুধুমাত্র ইংরাজদের কাছেই নয়, দেশীয় উচ্চবর্ণ, ও বর্ণহিন্দুদের কাছেও তারা সমাজে অস্পৃশ্য, অচ্ছ্যুত হিসাবেই একঘরে হয়ে রইল। সুতরাং তাদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলাই সমাজের উদ্দেশ্য হল। যদিও তারা নিজেদের হিন্দু বলেই মনে করে থাকে এবং লক্ষ্মী, মঙ্গলচন্ডী তাদেরও দেবতা বলে জানা যায়। শব দাহ করার রীতি তাদের মধ্যেও আছে, তবে অশৌচ পালনের জন যে মাথা মুন্ডনের প্রথা আছে, সেটি তারা নিজেরাই নিজেদের মাথা মুন্ডন করে থাকে।
শবর কথাটি এসেছে ‘সগর’ শব্দ থেকে, যার অর্থ কুঠার বা যাকে আমরা বলি কুড়ুল। শবরদের হাতে কুঠার দেখতে পাওয়া যায় এবং তারা সব সময় কুঠার নিয়ে ঘোরাফেরা করে, এটিই তাদের বৈশিষ্ট্য। শবরদের এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই পাহান মালির চেহারাটি চোখে ভেসে ওঠে। কারণ পাহানকে দেখেছি প্রতিদিন কাঁধে একটি কুড়ুল নিয়ে বাগানে কাজ করতে আতেন। বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে আরো জানা গেল যে, বিহার-উড়িষ্যার রিসার্চ সোসাইটির পত্রিকার দ্বিতীয় খন্ডে ( ১৯১৫ সালে প্রকাশিত) শবরদের কুঠার প্রাপ্তি নিয়ে একটি কাহিনি আছে।
কাহিনিটি এইরকম--- অনেকদিন আগে মানভূমের কয়েকটি জায়গায় তামার ফলক লাগানো কিছু অস্ত্র পাওয়া যায়। সেখানকার পোখুরিয়া গ্রামের এক পাদ্রীও ঠিক একইরকমের কয়েকটি তামার অস্ত্র আশেপাশের অঞ্চল থেকে পান এবং সেগুলি নিজস্ব সংগ্রহে রেখে দেন। পাদ্রির নাম ক্যাম্পবেল সাহেব। সেইসময় মানভূমের ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন রায়বাহাদুর নন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। তিনি এই অস্ত্রগুলিকে দেবী প্রতিমার বল্‌গা বলে চিহ্নিত করেন। পরে জানা যায় যে সেগুলি তাম্রযুগের অস্ত্রশস্ত্র এবং তা প্রকাশিত হয় সোসাইটির জার্নালে। প্রশ্ন জাগে,সেইকুঠার জাতীয় অস্ত্রগুলি কি প্রমাণ করে, সেই স্থান ছিল শবর জাতির একসময়ের বাসস্থান? পরে নানা তাড়নায় সেখান উৎখাতের ফলে অন্যত্র চলে যান? জানা হয়নি অনেক কিছুই।
একটি মানুষের কথা বলতে গিয়ে সেই মানুষটি সম্বন্ধে ও তাদের জাতির ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, এবং ভারতের ইতিহাসে সেই জাতির বৃত্তান্ত সম্বন্ধে কিছু জানা গেল।
অতীতের ঐতিহ্য তো এভাবেই খুঁজে চলা !

1 comment:

  1. খুবই তথ্যনির্ভর রচনা , ধন্যবাদ প্রবন্ধিককে ।

    ReplyDelete