0

প্রবন্ধ - অরিন্দম ব্যানার্জী

Posted in




















বহুদিন পর গতকাল মাঝরাতে ছাদে উঠেছিলাম। অন্ধকার নিশুতি রাতে তারাভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে চোখ দু'টো যেন জুড়িয়ে গেল। একমনে অনেকক্ষণ সেইদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল ছায়াপথ জুড়ে ওই যে অগণ্য আলোকবিন্দুর মত নক্ষত্র, এরা সব কোথা থেকে এলো? কোটি কোটি সৌরজগৎ যেন নিঃসীম অন্ধকারে ভাসছে; কত অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ – আমাদের পৃথিবীর মত আরো কত অগুনতি পৃথিবী হয়ত সেখানে আছে। আমাদের চেতনার নাগাল থেকে অনেক দূরে প্রকৃতির আরো কত আশ্চর্য আয়োজন রয়েছে হয়ত সেইসব জগতে, ভাবলে বিস্ময় জাগে! সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারে, নক্ষত্রখচিত বিরাট শামিয়ানায় বসে ভাবতে লাগলাম, এসবের উৎস কী? এই প্রতীয়মান বিশ্ববৈচিত্রের অন্তরালে কোন একক সত্য আছে কি, যার থেকে এই এত কিছু সৃষ্টি হয়েছে? আর যদি তা থাকেও, তার সাথে আমাদের রোজকার জীবনের সুখ-দুঃখ, ওঠা-পড়া, জয়-পরাজয়ের সম্পর্কই বা কী?

আমার এক বন্ধু ছিল যে সারা সারা রাত জেগে শুধু তারাদের ছবি তুলতো। আকাশগঙ্গা, এ্যান্ড্রোমেডা, এইসব ছায়াপথের দিকে ক্যামেরা তাক করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো। ও বলতো, তারাভরা আকাশে কি একটা গভীর রহস্য আছে, ছায়াপথের স্তিমিত আলোয় তাই অমন ভাবগম্ভীর মৌনতা! ও আমাকে একদিন বলেছিল, ভেবে দেখ, মহাবিশ্বের এই অকল্পনীয় পরিব্যাপ্তির তুলনায় পৃথিবীর স্থান কতটুকুই বা! বরং এই যে চিরপরিচিত শস্যশ্যামলা গ্রহটাকে আমরা আমাদের ঘর বলে জানি, তার চতুর্পাশে যে বিপুল মহাশূন্যতা আছে, তার পরিসীমা কেমন দুর্লঙ্ঘ‍্য, তার ভাষা কেমন দুর্বোধ্য! তা সত্ত্বেও মানুষ যে সেই অসীমকে তার চিন্তার পরিধিতে বাঁধতে চায় তার কারণ মানুষের মনে একটি শাশ্বত জিজ্ঞাসা আছে যা তাকে কেবল তার ক্ষুদ্র পরিসরটুকু নিয়েই তৃপ্ত থাকতে দেয় না, অজানার আহ্বানে তাকে সাড়া দিতে হয়। ঠিকই, আজ বুঝি, এই অজ্ঞাত অনন্তকে জানার চেষ্টা মানুষের একটি চিরকালের প্রবণতা – সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ এই বিশ্বধাঁধাকে নানাভাবে ধরতে চেয়েছে, এই বিরাট অনন্ত ব‍্যোমে তার ক্ষুদ্র অস্তিত্বের মূল্য কতখানি তা বারংবার মেপে দেখতে চেয়েছে। এইভাবেই জন্ম হয়েছে কত থিওলজির, সৃষ্টি হয়েছে কত দর্শন এবং বিজ্ঞানের। সময়ের সাথে সাথে মত-পথের বিভিন্নতা বেড়েছে, পুরাতন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নতুন দর্শনের কখনো সহাবস্থান হয়েছে আবার কখনো হয়েছে সংঘাত। ইতিহাসজুড়ে বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-বিবাদ কিছু কম হয়নি, তবে কোনদিনই বিশ্ব-রহস্যের কোন একটিমাত্র ব্যাখ্যা, কোন একটিমাত্র ছবি পৃথিবীতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য পায়নি। সমাজ চিরকালই এই ব্যাপারে শতধাবিভক্ত থেকেছে। চিন্তাশীল মানুষ অনেকসময় বিভ্রান্ত হয়েছে, ভেবেছে, কোন মতটা ঠিক! কোন পথে গেলে সে তার অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পাবে! তবে চিন্তাধারার এই বৈচিত্র এবং দ্বন্দ্ব শুধু অতীতকালেরই বৈশিষ্ট নয়– আমাদের এই সমকালের মর্মেও নিহিত আছে এই সূক্ষ সংশয়বাদ, মানুষের সেই শাশ্বত জিজ্ঞাসা আজও তৃপ্ত হয় নি। আজও বিশ্বরহস্যের সর্বসম্মতিক্রমে কোন নিষ্পত্তি হয়নি। কেউ বলতেই পারেন: বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে এইসব প্রশ্নের কী মূল্য? পৃথিবীটা তো আজ শুধু 'বোকাবাক্সে' নয়, সাড়ে পাঁচ-ইঞ্চির মুঠোফোনের মধ্যে এসে ঢুকেছে। ঠিকই, কিন্তু সভ্যতার এই অগ্রগতির পরেও অস্তিত্ত্বের মৌলিকতম প্রশ্নগুলি যে একই রকম অমীমাংসিত রয়ে গেছে, সে কথাও কি অস্বীকার করা যায়?


আমার যেমন প্রায়ই মনে হয়, বিশ্বের কোন রূপটা সত্যি? যেটা মানুষে দেখে নাকি যেটা জীব-জন্তুরা দেখে? মানুষ রামধনুর সাতখানা রং দেখতে পায় কিন্তু একটি কুকুর তুলনায় অনেক কম রঙিন একটা পৃথিবী দেখে, তার চোখ অত রঙের বৈচিত্র বোঝে না। উল্টোদিকে, একটা হামিং-বার্ড মানুষের চাইতে বেশি রং দেখতে পায় – তার কাছে পৃথিবীটা মানুষের চাইতে আরো অনেক বেশি রঙিন। আশ্চর্য নয় কি? বিভিন্ন পশুপাখি বিভিন্ন ভাবে বিশ্বকে দেখে। তাহলে এত দেখার মধ্যে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গিকে ঠিক বলে ভাবব – মানুষের নাকি ওই অসংখ্য জীবজন্তুদের?

অনেকেই বলবেন, সত্যটা আসলে আপেক্ষিক, যার যার তার তার। কিন্তু তার উত্তরে বলা যায়, এই পৃথিবীতে তো বেশ কিছু কোটি প্রজাতির জীব রয়েছে, তার মানে সত্যটা কি ওই অত কোটি ধরণের? তাও কি হয়? যে-পৃথিবীটাকে সব প্রাণী একই সময়ে একই সাথে ভোগ করছে তার স্বরূপ একই সময়ে কোটি রকমের কি করে হবে? মুহূর্তের একটি ভগ্নাংশে 'লাল' রং তো লাল-ই – লালটা এক রঙেরই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা কি করে হবে? বিজ্ঞান বলবে: আলোক-রশ্মিতে সব রঙের সহাবস্থান আছে – বস্তুগুলি (objects) আলোর কিছু রং প্রতিফলিত ক'রে বাকি রং শুষে নেয়; সেই প্রতিফলিত আলোর সংস্পর্শে বিভিন্ন প্রাণী তাদের চোখের গঠনতন্ত্রের প্রকারভেদে একই বস্তুতে রঙের বিভিন্ন মাত্রা দেখে, অর্থাৎ, আলোর রঙেই বস্তু রঙিন হয়। এই যুক্তি একেবারে অকাট্য । কিন্তু তাহলেও একটি ক্ষণে সেই বস্তুটির কোন্ রংটাকে যথার্থ বলে মানবো সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এতে নির্ধারণ করা গেল না! নিরপেক্ষ সত্য কোনটা?

জীব-জন্তুদের কথা না হয় বাদ দিলাম, একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষেরই কি কিছু কম তফাৎ! একজনের রুচি, বিশ্বাস, চিন্তা, আদর্শ অপরজনের সাথে মেলে না। ইতিহাসজুড়ে তাই মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে কতই না বিরোধ, কতই না দ্বন্দ্ব। চিন্তার ভিন্নতাই সভ্যতাকে পথ দেখিয়েছে। তা বলে সবাই যে অবশ্য এই ভেদাভেদকে স্বীকার করেছেন এমন নয়, কেউ কেউ একেবারে ব্যতিক্রমী চিন্তাও করেছেন – যেমন প্রাচীন গ্রীসের সোফিস্ট দার্শনিক প্রোডিকাস্ (খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী), যিনি বলেছিলেন, মানুষে-মানুষে কোন বিষয়ে তর্ক বা মতবিরোধ একেবারেই অসম্ভব কারণ দু'জন মানুষ যদি কোন বিষয় নিয়ে তর্ক করে তাহলে বুঝতে হবে তারা মোটেই এক বিষয়ে কথা বলছে না – তাই বিরোধ নিরর্থক। কথাগুলো প্রথম পড়ে অবাক হয়েছিলাম, যেখানে দ্বন্দ্ব আর তর্কই নিজের মতামত প্রকাশের প্রতিষ্ঠিত উপায় সেখানে এই রকম চিন্তা করলে কি চলে!


যাই হোক, মোটের ওপর তার মানে একটি কথাই নিশ্চিত করে বলা যায় – বিশ্বের স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের কোন নিশ্চয়তা নেই; জগৎটা কেমন সেটা পরোক্ষভাবে বলা গেলেও, সরাসরিভাবে বলা সম্ভব নয়, কারণ যে যার নিজের মতো করে বিশ্বকে দেখে। যেমন আগেই বলেছি, একই বিশ্বের এই বিভিন্নতা চিরকালই মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিভিন্ন দিকে প্রেরিত করেছে। প্রোডিকাসের সমসাময়িক আরেক গ্রীক দার্শনিক, স্বনামধন্য সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন, বিশ্বটা কেমন সেটা জানা কোনমতেই সম্ভব নয়, তাই সেই প্রশ্নে বৃথা সময় নষ্ট না করে, 'কি ভাবে বাঁচা উচিত' সেই প্রশ্নে মনোনিবেশ করাই ভাল। তাই তিনি অধিবিদ্যা (Metaphysics) থেকে নীতিতত্ত্ব (Ethics)-এ চলে এসেছিলেন। গ্রীক-দর্শনের একাংশের কাছে বিশ্বের স্বরূপ হল অবর্ণনীয় এবং অনিশ্চিত – তাঁদের ভাষায় "এ্যাপোরিয়া" (aporia)। এই কারণে, সেই প্রাচীন গ্রীসেরই স্কেপটিক দার্শনিকেরা বলেছিলেন, নিশ্চিত জ্ঞান বলে কিছু হয়না– 'Knowledge is impossible!' সক্রেটিসের কথায় আরেকজন বিশ্ববিখ্যাত মনীষীর কথা মনে পড়ে – তথাগত বুদ্ধ। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, কারও পায়ে যদি হঠাৎ একটি বিষাক্ত তীর এসে ঢোকে, সে কি তখন সেই তীরন্দাজের ঠিকুজি-কুষ্ঠী জানতে চাইবে নাকি আগে ওই তীরটা পা থেকে বের করে ব্যথার উপশমের চেষ্টা করবে? তাঁর কাছেও অধিবিদ্যার তুলনায় নৈতিকতাই ছিল বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ। সেই কোন প্রাচীন কালের দু'জন মনিষী, যাঁরা পৃথিবীর দুই প্রান্তের অধিবাসী ছিলেন এবং যাঁরা কোনদিনও একে অপরের সংস্পর্শে এসেছেন বলে জানা নেই, তাঁদের চিন্তার এই সাদৃশ্য বিস্ময়কর বলে মনে হয়!


বিশ্বের দর্শন নিয়ে কথা হলে ভারতের ষড়দর্শনের অন্যতম, অদ্বৈতবেদান্তের কথা আপনিই চলে আসে। ভারতীয় চিন্তানায়কদের আড়াই সহস্রাব্দব্যাপী দর্শনচিন্তার ফলশ্রুতি হল অদ্বৈতবাদ। দর্শনের ইতিহাসে অদ্বৈতবেদান্ত নিশ্চিত ভাবেই একটি মাইলস্টোন, যা পূর্ববর্তী বা পরবর্তী ভারতীয় দর্শনগুলিকে পূর্ণতা দেয়। এই অদ্বৈতবেদান্তেও বিশ্বকে 'অনির্বচনীয়' বলা হয়েছে। খ্রীষ্ট পরবর্তী সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে গৌরপাদ-নামক এক দক্ষিণভারতীয় সন্ন্যাসী প্রথম অদ্বৈততত্ত্বকে পূর্ণাঙ্গ দর্শন হিসেবে প্রচার করেছিলেন যদিও তাঁর জগদ্বিখ্যাত উত্তরসূরি শঙ্করাচার্যের মাধ্যমেই অদ্বৈবেদান্ত একটি বিশ্বমানের দর্শনে পরিণত হয়েছিল। অদ্বৈতবাদীরা বললেন, এই দৃশ্যমান জগৎ হল "রজ্জুতে সর্পভ্রমের" মত একটি ভ্রান্তি যার অপর নাম হল "মায়া"। তবে এই ভ্রান্তিজনিত জগতের আড়ালে একটা সার সত্য আছে যা অপরিণামী এবং শাশ্বত। সেই নিরপেক্ষ চিরসত্যের একটা সুন্দর নাম আছে – 'ব্রহ্ম', যাঁর ওপর আপেক্ষিক এই বিশ্বের অস্তিত্ব নির্ভর করে। অন্ধকার পথে দড়ি বা রজ্জুকে আমরা সাপ ভুল করি, বেদান্তের পরিভাষায় রজ্জুতে সাপের 'অধ্যাস' হয়। ঠিক তেমনই, অপরিণামী ব্রহ্মকে আমরা মায়ার প্রভাবে পরিবর্তনশীল জগৎ বলে ভুল করি, অর্থাৎ ব্রহ্মে জগতের অধ্যাস হয়। ব্রহ্মই অবশ্য একমাত্র সত্য, এই জগতের উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ। এই অধ্যাস-সৃষ্ট বিশ্বটা সত্য না মিথ্যে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়– বিশ্বের স্বরূপ তাই "অনির্বচনীয়"। অদ্বৈতবেদান্তের উৎস যেহেতু ব্রহ্মসূত্র ( খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) এবং উপনিষদ, তাই একথা বলাই যায় যে এই অদ্বৈতচিন্তা প্রাচীন ভারতে অন্তত উপনিষদের যুগ থেকেই ছিল (প্রাচীনতম উপনিষদগুলি খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল)। ঋগ্বেদে বহুবার "মায়া" শব্দটি ব্যবহার হয়েছে তবে যে-অর্থে শঙ্করাচার্য এই শব্দ ব্যবহার করেছেন তা পূর্ণরূপে প্রথম পাওয়া যায় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী)।

ভারতে দর্শনের যেটি আদিযুগ তার প্রায় সমকালে, ভারতবর্ষ থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে, প্রাচীন গ্রীসের ইলিয়া অঞ্চলে একজন দার্শনিক জন্মেছিলেন যাঁর নাম ছিল পারমিনিডিস্ (খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী), যাঁকে কেউ কেউ সক্রেটিসের গুরু বলেও মনে করেন। তিনিও বলেছিলেন যে বিশ্বটা আসলে অলীক এবং এই পরিবর্তনশীল দৃশ্যমান বিশ্বের পেছনে একটি অপরিণামী সত্য আছে, যাকে তিনি 'এক' বা One বলেছেন। অবশ্য, তাঁর "এক" আর উপনিষদের "সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ" ব্রহ্মের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। পারমিনিডিসের সমসাময়িক আরেক গ্রীক মনিষী হেরাক্লিটস্ আবার বলেছেন, বিশ্বটা যুগপৎ এক এবং বহু। এই জগতে স্থিরতা বলে কিছু নেই – একই নদীতে আমরা দু'বার পা রাখতে পারি না। এই কথাগুলিও প্রাচীন বৌদ্ধদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়। বৌদ্ধমতে, এই বিশ্বের সবকিছুই ক্ষণিক, প্রতি মুহূর্তে বিশ্বটা বদলে বদলে যাচ্ছে। তবে এই পরিবর্তনের ঘূর্ণির আড়ালে কোন অনাদি-অনন্ত সত্তা বা ব্রহ্ম নেই।


দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মনে হয়, যে প্রাচীনযুগে ভারত এবং গ্রিসের চিন্তা একে অপরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো, সক্রেটিসের শিষ্য। তাঁর চিন্তার সাথে আমাদের দেশের অদ্বৈততত্ত্বের অনেক মিল আছে (অমিলও অবশ্য প্রচুর)। প্লেটো বলেছেন সত্যের দু'টি স্তর আছে। নিরপেক্ষ ধারণার (Forms) স্তর আর আপেক্ষিক বস্তু-জগতের স্তর। ধারণা বা আকারই হল স্থির সত্য। পরিদৃশ্যমান এই জগৎটা সেইসব আকারের অপূর্ণ অনুকরণ মাত্র। এই বস্তুজগৎ সম্বন্ধে কোন নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব নয়, বড়জোর জগৎকে আপেক্ষিক বলা যেতে পারে। মজার ব্যাপার, প্লেটোর শিষ্য এ্যারিস্টটল তাঁর নিজের গুরুর তত্ত্বকেই "transcendental moonshine" বা অতীন্দ্রিয় অবাস্তবতা বলে উপহাস করেছেন। এ্যারিস্টটলের মতে এই বিশ্বটা সৎ, তা কখনোই আপেক্ষিক কিংবা অলীক নয়।

অনেক কথাই তো বললাম, কিন্তু এত কথার মধ্যে বিজ্ঞানকে বাদ দিলে কেমন করে চলবে? আমরা তো বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির যুগে বাস করছি !পদার্থ বিজ্ঞানের দু'টি ধারা আছে –ক্ল্যাসিক্যাল আর কোয়ান্টাম ফিজিক্স। আর এই দু'টির মধ্যখানে জমিয়ে বসে আছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theories of Relativity)। ক্ল্যাসিক্যাল তত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের তত্ত্ব, উভয়েরই সিদ্ধান্ত হল এই যে, কোন একটি বস্তুর বর্তমান গতি এবং অবস্থান যদি জানা থাকে তাহলে সেই বস্তুর ভবিষ্যতের গতি-অবস্থানেরও পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। কিন্তু অপরদিকে কোয়ান্টামের বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিছুতেই একটি বস্তু (বা কণার) বর্তমান অবস্থা থেকে তার ভবিষ্যতের অবস্থার নিশ্চিত পূর্বগণনা সম্ভব নয় – হয় আমরা কণাটির গতি জানতে পারি না হয় অবস্থান, দু'টি একসাথে কখনোই নয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবার ঐখানেই থেমে না থেকে বলছে, একটি কণা শুধুমাত্র কণাই নয়, সেটি কখনও কণা, কখনও তরঙ্গ– রীতিমত রঙ্গ! আইনস্টাইন সাহেব কোয়ান্টামের এই অনিশ্চয়তাকে মানতে পারেননি, তিনি বলেছিলেন, "God does not play dice" – ঈশ্বর পাশা খেলেন না। বলা বাহুল্য, ঈশ্বর বলতে তিনি প্রচলিত মতে ঈশ্বরের কথা বলেননি, জড়প্রকৃতির কথা বলেছেন। একসময় এই নিয়ে আইনস্টাইনের সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা নিলস্ বোরের পর পর কিছু তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল যা পরবর্তীকালে "Bohr-Einstein debate"-নামে সর্বজনবিদিত হয়েছে।


এত কথার পর একটি বিষয়ই শুধু স্পষ্ট হল: দর্শন এবং বিজ্ঞানের আবহমানকালের প্রয়াস সত্ত্বেও বিশ্বরহস্য সম্বন্ধে মানবমনের অন্তর্নিহিত সংশয়ের নিশ্চিত নিরসন আজও সম্ভব হয়নি। কত সভ্যতা এসেছে, ইতিহাসের কালখণ্ডে নিজেদের পদচিহ্ন রেখে দিয়ে আবার সময়েরই খরস্রোতে মিশে গেছে। তাদের জায়গায় জেগেছে নতুন সভ্যতা, নতুন আদর্শ নিয়ে। কত মহামনীষী যুগে যুগে তাঁদের সমকাল এবং উত্তরকালকে মহতী চিন্তার শক্তিতে ধন্য করেছেন, আমরা সবাই তাঁদের কাছে ঋণী। কিন্তু আজ এত বছর পরেও, মানুষ সৃষ্টির মৌলিকতম প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পায়নি। জীবনের উপাদান কী? এই বিশ্ব কোথা থেকে এলো? বিশ্বের বিরাট আয়োজনে আমাদের প্রয়োজনই বা কী? এইসব জিজ্ঞাসা এখনো পর্যন্ত আলোর প্রতীক্ষায় আছে।

ওই নক্ষত্রখচিত আকাশ তাই মানুষের কাছে আজও একই রকম বিস্ময়কর। আজও তার কুহক তিন হাজার বছর আগের কোন রাত্রির মতোই এক "এ্যাপোরিয়া"।



তথ্যসূত্র:

১) The History of Philosophy – A C Grayling

২) A History of Indian Philosophy : Vol I – Surendranath Dasgupta

৩) Greek Philosophy : Thales to Aristotle – Reginald E Allen.

৪) পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস: প্লেটো ও এ্যারিস্টটল – দেবব্রত সেন।

৫) Brahmasutras: According to Sri Sankara – Swami Vireswarananda

৬) Brief Answers to the Big Questions – Stephen Hawking

৭) Wikipedia

৮) Internet Encyclopedia of Philosophy (https://iep.utm.edu)

0 comments: