0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in







৩০

যুদ্ধটা হল বলেই মিসেস সুজান অনেক টাকা রোজগার করতে পারলেন। কিন্তু এই কথাটা ভাবতে তার একটুও ভাল লাগে না যে হয়তো বা তার স্বামীর মত কর্মঠ মানুষ ভেনজেলকে এই যুদ্ধের জন্যই রোমানিয়াতে বেকার বসে থাকতে হয়েছিল। বসে থাকতে থাকতে কী ভাবে যেন গুলি খেয়ে লোকটা মরে গেল। সৈনিকেরা যে কাজের কাজ কিছুই করে না, সেটা তো তিনি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছেন। সময় নষ্ট করে, সারা বছর ধরে একগাদা টাকা খরচ করছে এরা। একবার গুলি করল, কোথায়? না জঙ্গলে নড়েচড়ে বেড়ানো হরিণের গায়ে। আরেকবার গুলি করল, কোথায়? না, এক গরিব বিপন্ন মহিলাকে, যে নিজের বাচ্চাকে রাতের বেলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। পুরো ব্যাপারটা ন্যক্কারজনক এবং হাস্যকর। এমন এক কাজে দেশের ছেলেগুলোকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে সবাই আলসে হয়ে গেছে। তিনি নিজে কত পরিশ্রম করেন সারাদিন ধরে। গরু, মুরগি, শুয়োরের সেবাযত্ন করা থেকে শুরু করে সৈনিকদের জন্য রান্না করা, তাদের পোশাক কাচাকুচি করা সবকিছু। কোনো কোনো সৈনিক তো নিজের জুতোটাও নিজে পালিশ করে না, মোজাজোড়াও নিজেরা কাচে না। মিসেস সুজান অর্থের বিনিময়ে সব কিছু করেন। গত মাস থেকে একজন চাকর রাখতে হল তাঁকে। টেসার্জি গ্রাম থেকে একটা লোক পেয়েছেন তিনি। কারণ, গর্ভবতী হবার পর থেকে মারিয়া আর তাঁকে কোনো কাজে সাহায্য করতে পারে না। ওই সার্জেন্টের ঘরেই সে থাকে এখন তার বউয়ের মত। ওই লোকটার সকালের নাশতা বানিয়ে দেয়, পোশাক কাচাকুচি করে, আবার মাঝে মাঝে সে সার্জেন্টকে বকুনিও দেয়।

সৈনিকদের এই বাড়িতে থাকার ঠিক তিন বছর পরে একদিন সকালে, একজন খুব উঁচু পদের অফিসার এলেন, যার ট্রাউজারে লাল ডোরা, সোনালি কলার। মিসেস সুজান পরে শুনেছিলেন যে ইনি সত্যিকারের জেনারেল। আরও কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে খুব দ্রুতগতির এক গাড়িতে করে টেসার্জির দিক দিয়ে এলেন তিনি। মুখটা বেশ হলদেটে, দুঃখী দুঃখী ভাব। কিন্তু এসেই তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পিটারের উপরে প্রচণ্ড চোটপাট শুরু করলেন তিনি, কারণ পিটার কোমরের বেল্ট আর পিস্তল ছাড়াই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

সেই অফিসার রাগে গজগজ করতে করতে তার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। মিসেস সুজান তাঁকে মাটিতে অধৈর্য হয়ে পা ঠুকতে দেখেছিলেন। জেনারেলের মুখটা রাগে আরও হলদেটে, আরও ছোট হয়ে যাচ্ছিল। পাশে দাঁড়ানো আরেক অফিসারকে প্রচণ্ড চিৎকার করে ধমকাচ্ছিলেন। সেই অফিসারের কাঁচাপাকা চুল, বয়স অনেক, প্রায় ষাটের উপরে হবে। ধমক খেয়ে টুপির উপরে রাখা লোকটার সন্ত্রস্ত আঙুলগুলো কাঁপছিল। মিসেস সুজান এই বয়স্ক অফিসারকে চেনেন। কারণ মাঝে মাঝে এই অফিসার সাইকেল চালিয়ে টেসার্জির রাস্তা ধরে এখানে আসেন। খুব নরম সুরে সার্জেন্ট আর অন্যান্য সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলেন এই বাড়ির খাবার ঘরে বসে। আবার সাইকেল নিয়ে ফিরে যান। পিটার তাঁকে এগিয়ে দিতে যায়। কিছুটা রাস্তা সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে কথা বলতে বলতে যান। যাই হোক, সেদিন অবশেষে পিটার তাড়াতাড়ি কোমরে বেল্ট আর পিস্তল নিয়ে সবার সঙ্গে নদীর পাড়ে গেল।

নৌকা করে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল সৈনিকেরা। কিছুক্ষণ পরে ফেরত এলো। ভাঙা ব্রিজের সামনে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে রইল তারা। তারপর ছাদে গেল। তারপর উচ্চপদস্থ অফিসার সমেত যে দলটা ঐদিন সকালে এসেছিল, তারা গাড়ি করে ফিরে গেল । তারা যাবার সময়ে পিটার আরও দুজন সৈনিককে দু’ পাশে নিয়ে তাদের গাড়ির সামনে হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইল। সম্ভবত গাড়িটা টেসার্জি পৌঁছে যাওয়া অবধি তারা ওইভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর রাগত অবস্থায় পিটার ঘরে ফিরে এলো। মারিয়াকে একটাই কথা বলেছিল সে, ‘মনে হচ্ছে যে ব্রিজটা এবারে বানানো হবে।’

তার ঠিক দু’ দিন পরে, আরেকটা গাড়ি, খুব দ্রুতগামী একটা ট্রাক এলো টেসার্জির দিক থেকে। সেই গাড়ি থেকে নেমে এলো সাত জন সৈনিক এবং একজন তরুণ অফিসার। সেই অফিসার তাড়াতাড়ি এসে ঢুকল এই বাড়িতে। তারপর সার্জেন্টের ঘরে গিয়ে প্রায় আধঘণ্টা ধরে কথা বলল। মারিয়া কথার মাঝে ঢুকবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওই তরুণ অফিসার তাঁকে বাইরে যেতে বলে। সে আবার ঢুকেছিল সেই ঘরে। এবার তাঁকে ওই তরুণ অফিসার বেশ রুঢ়ভাবে ঘরের বাইরে বের হয়ে যেতে বলে। পুরনো সৈনিকদের নিজেদের মালপত্র গোছাতে দেখে মারিয়া কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে সে লক্ষ্য করে যে নতুন সৈনিকদের দলটা নিজেদের মালপত্র টেনে ভেতরে নিয়ে আসছে। সে আধঘণ্টা ধরে কেঁদে যায়। প্রফেসর এসে তার কাঁধে হালকা একটা চাপড় দিলে সে রেগে ওঠে। তারপর পিটারকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। পিটার অবশেষে মালপত্র নিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরোয়। মুখ লাল, সে কথা বলতে থাকে মারিয়ার সঙ্গে; মারিয়াকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। পিটার গাড়িতে উঠবার আগের মুহূর্ত অবধি মারিয়া তাঁকে আঁকড়ে ধরে থাকে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেঁদে যায় সে যতক্ষণ না গাড়িটা দ্রুতগতিতে টেসার্জির রাস্তা ধরে। গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেলেও সে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে যে পিটার যদিও তাঁকে কথা দিয়েছে, কিন্তু সে আর ফিরে আসবে না…

ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হবার দিন দুয়েক আগে ফাইনহালস বার্কজাবা গ্রামে এসেছে। গ্রামে বাড়ি বলতে একটা পাব, আর দুটো বাড়ি, যার মধ্যে একটা বাড়ি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সে যখন এই বাড়িতে এলো, তখন আলু খেত থেকে উড়ে আসা বিশ্রী তিতকুটে ধোঁয়াতে চারদিক ঢেকে গেলেও এক অদ্ভুত নীরবতা, শান্তি বিরাজ করছে। কে বলবে দেশে যুদ্ধ লেগেছে…

লাল ফার্নিচার ভ্যানে করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরবার পরে ধরা পড়ে যে তার পায়ে একটা স্প্লিনটার লেগেছে। অপারেশন হবার পরে দেখা যায় যে সেটা বোমার টুকরো নয়, কাচের টুকরো। সেই টোকাইয়ার বোতলের ভাঙা টুকরো। তারপর তাঁকে নিয়ে অদ্ভুত বিব্রতকর একটা বিচার শুরু হয়। কারণ যুদ্ধে আঘাত পেলে রূপোর মেডেল পাবার কথা। কিন্তু কাচের টুকরো বেরনোর পরে প্রধান চিকিৎসক তাঁকে মেডেল দিতে অস্বীকার করেন। বরঞ্চ এমন সন্দেহ করা হয় যে পুরস্কার পাবার লোভে সে নিজেই নিজেকে আঘাত করেছে। অবশেষে লেফটেন্যান্ট ব্রেশট, যিনি পুরো দুর্ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, তার পাঠানো বিবৃতির ফলে ফাইনহালস অবশেষে ওই বিচার থেকে মুক্ত হয়। আঘাত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, কিন্তু সে প্রচুর ওয়াইন খেতো এই সময়ে। একমাস পরে তাঁকে এখানে, এই বার্কজাবাতে পাঠানো হল। সে নিচে পাবে বসে অপেক্ষা করছিল, যখন গ্রেস তাদের দুজনের জন্য কোন ঘরটা ফাঁকা, সেটার তত্ত্বাবধান করছিল। সে পাবে বসে ওয়াইন খেতে খেতে আগের ব্যাচের সৈনিকদের চলে যাওয়ার শব্দ শুনছিল আর ইলোনার কথা ভাবছিল। পুরনো সৈনিকেরা গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের জিনিসপত্র, পোশাক এসব খুঁজে খুঁজে নিজেদের মালপত্র গোছাচ্ছিল। বাড়িওয়ালী পাবের কাউনটারের পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন। একটু বয়স্ক হলেও বেশ সুন্দরী, এখনও সুন্দরী তিনি। কিন্তু তার মুখটা ভারি বিষণ্ণ। ভেতরে করিডোরে শোনা যাচ্ছে আরেকজন মহিলা চিৎকার করছে আর কান্নাকাটি করছে।

পুরনো সৈনিকদের নিয়ে ট্রাকটা ছেড়ে যাওয়ার সময়ে ফাইনহালস শুনতে পেল যে সেই মহিলা আরও চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে শুরু করেছে।

গ্রেস এসে ফাইনহালসকে তার ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটার ছাদ নিচু। ছাদে আর দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়ছে। কালো বিমের ছাদ। ঘরে কেমন বাসি গন্ধ। বাইরের দিকটা দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। বাগানটা সাজানো নয় বিশেষ। এলোমেলো। উঁচু উঁচু ফলের গাছ, ঘাসজমি, কিছু ফুলের গাছ, আস্তাবল, খামার, তার পিছনে একটা ছাউনিতে রঙ চটা একটা পুরনো নৌকা, এসব দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। বাইরেটা নিস্তব্ধ। পাঁচিলের উপর দিয়ে নদীতে জেগে থাকা ভাঙা ব্রিজের অংশ দেখা যাচ্ছে। মরচে ধরা শিকগুলো জেগে আছে জলের উপরে। কংক্রিটের স্তম্ভগুলো শ্যাওলায় ঢাকা। নদীটা খুব বেশি হলে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ গজ চওড়া।

এখন সে গ্রেসের খাটে শুয়ে আছে। গতকাল সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে তার সঙ্গে গ্রেসের আলাপ হয়েছে। আলাপ হওয়ার পর থেকেই ফাইনহালস ঠিক করেছে যে সে অকারণে গ্রেসের সঙ্গে কথা বলবে না। গ্রেসের বুকে চারখানা মেডেল। সে পোলিশ, রোমানিয়ান, ফরাসি, রুশি নানা জাতের মহিলাদের নিয়ে রসালাপ করতে পছন্দ করে। এদের সবার সঙ্গে তার কখনো না কখনো আলাপ হয়েছিল, সম্পর্ক হয়েছিল, তারপর কী ভাবে সম্পর্ক ভেঙে গেল ইত্যাদি আলোচনা করতে ভালবাসে গ্রেস। ফাইনহালসের এসব আলোচনা শুনতে ভালো লাগে না। এই কথাগুলো শুনতে শুনতে তার ক্লান্তি এবং বিরক্তি আসে, সে বিব্রত বোধ করে। কিন্তু গ্রেস এমন একজন মানুষ, যে মনে করে তার বুকে চারটে মেডেল আছে বলেই সবাই তার কথা শুনবে।

সে, ফাইনহালস, যার মোটে একটা মেডেল আছে, সে গ্রেসের কথা শুনবার জন্য আদর্শ ব্যক্তি। তাছাড়া সে কথা শুনে যায়, উল্টে কিছুই বলে না। কোনো কথার ব্যাখ্যা অবধি চায় না। নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে তার সঙ্গে আলাপ হয়ে, গ্রেস খুব খুশি। অবশ্য বার্কজাবাতে এই ঘরে এসে এসে ফাইনহালস তাড়াতাড়ি ঘুমোবার তোড়জোড় শুরু করে, কারণ গ্রেস এক স্লোভাক মহিলার হৃদয় কী ভাবে ভেঙেছিল, সেই গল্প আরম্ভ করবার উপক্রম করে।

আসলে ফাইনহালস বড় ক্লান্ত ছিল। প্রায়ই যখন সে ঘুমোতে যায়, তখন শোবার সময় ভাবে আজ সে যদি স্বপ্নে ইলোনার দেখা পায়। কিন্তু আজ অবধি এক রাতেও সে ইলোনাকে স্বপ্নে দেখেনি।



(চলবে)

0 comments: