0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in






সম্প্রতি এক ISKCON সাধু স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে শিরোনামে এসেছেন। বিষয়টা নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা, সমালোচনা, নানান ভিডিও পোস্ট চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। সম্ভবত আমরা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি যখন ভালো কাজ করে শিরোনাম অর্জন করা খুব মুস্কিল। কাজটি আগেও মুস্কিলই ছিল কিন্তু বর্তমানে ভালোর প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও সম্ভ্রম ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বরং আগ্রহ বেড়েছে খারাপের প্রতি। তাই বিতর্কিত, বিকৃত ও বিরূপ প্রতিক্রিয়াতে মানুষ বেশি আকর্ষণ বোধ করেন। আর একটা বিষয় এসেছে যাকে বলে ট্রেণ্ড। আর অর্থাৎ কি চলছে। যা চলছে তার সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেওয়া এই সময়ে যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেই অনেক মানুষের দৃষ্টি পেতে আগ্রহী। বিষয়টার মধ্যে কতটা সততা, নিষ্ঠা ও পবিত্রতা আছে সেটা বিচার্য হচ্ছে না।

ছোটবেলায় স্কুলে রচনা লেখা হত, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ। এখন এমন কিছু লিখতে হলে সহজে বলা যাবে না বিষয়টা। বাজার অর্থনীতির যুগে এই বিষয়টা সবই বুঝে গেছেন যে মানুষের মধ্যে যে ভালো গুণ আছে তাকে জাগিয়ে তোলার থেকে খারাপ গুণ বা দোষকে জাগিয়ে তোলা যায় সহজেই। আর এই জাগিয়ে তোলাকে যদি একবার কাজে লাগানো যায় তাহলেই মুনাফা আসবে। বিষয়টা প্রথম বুঝেছিলেন মেগা সিরিয়াল নির্মাতারা। কাজেই সংসারের হাজার ভালো গল্প বাদ দিয়ে তারা দেখাতে শুরু করেন সম্পর্কের নোংরা, অন্ধকার দিকগুলো। ক্রমেই সংবাদ মাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া এমন কি নির্বাচিত সরকারগুলো পর্যন্ত এই অস্ত্র এখন বারংবার ব্যবহার করছেন। সাজানো ভাড়া করা লোক দিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো সারাদিন দুই ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী আলোচনা করছেন। বছর দশে আগেও যা ছিল অভাবনীয়। এক অনলাইন সংবাদ সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক উচ্চ পদস্থ আমলার নাম উল্লেখ করে দাবি করে, তিনি নাকি রোজ সকালে প্রতিটি জাতীয় টিভি চ্যানেলকে ফোনে নির্দেশ দেন আজ কোন কোন ধর্মীয় উস্কানি মূলক বিষয় তাদের প্রচার করতে হবে! বিষয়টা যদি সত্যি হয় তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতবর্ষ সর্বনাশের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।

যাই হোক, আমরা আবার সেই সাধুর কথায় ফিরে আসি। যিনি নিজের কিংবা তার সংস্থার স্বার্থে স্বামী বিবেকানন্দ ও ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের অপ-ব্যাখ্যা করেছেন। সাধু এবং তাদের গেরুয়া পোশাক ভারতীয়দের মনে একটা রূপকল্প তৈরি করে। যদিও আমরা জানি অধিকাংশ সাধুর বাস্তবিক রূপ এর থেকে অনেক আলাদা। হয়তো সম্পূর্ণ বিপরীতও হতে পারে। তবুও আমরা সাধু সম্পর্কে আমাদের চিরাচরিত ধারণা ছেড়ে দিতে রাজি নই। এর পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ আমরা ধর্মভীরু। দ্বিতীয় কারণ হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণ মানুষ ও ঈশ্বরের মাঝখানে সাধুদের যে আসন আমরা দিয়েছি তা এখুনি ফিরিয়ে নিতে আমরা রাজি নই। হয়তো আরও অনেক কারণ আছে। সাধুরা যে গেরুয়া পোশাক পরেন এই রং আসলে আগুনের সঙ্গে সমর্থক। আগুন যেমন সব কিছুকে পুড়িয়ে বিশুদ্ধতা দেয়, সাধুও তেমন সংসাররে সব কিছু ছেড়ে বিশুদ্ধ পথে ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাবেন এটাই কাম্য। কিন্তু অধিকাংশ সাধু তা করেন কি? আমরা জানি, করেন না। যোগ সাধনাকে ব্যাবহার করে এক সাধু হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। শুধু করেই যাচ্ছেন তা হয়। সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। তবুও মন্ত্রীদের নিয়মিত দেখা যাচ্ছে তার অনুষ্ঠানে। অন্য একজন সাধু ধর্ষণের মামলায় সাজা পেয়ে জেলে আছেন। এক সময়ে দেশের দক্ষিণ পন্থী নেতা মন্ত্রীর দল ধরে ঐ সাধুটির আশীর্বাদ নিতে ভিড় করেছিলেন। কাজই বোঝা যাচ্ছে বর্তমান সময়ে সাজানো সাধু ও সত্যি সাধুকে আলাদা করা মানুষের পক্ষে খুব মুশকিল। হয়তো সেই মুশকিল আগেও ছিল। তাই রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, ‘সাধুকে দিনে দেখবি, রাতে দেখবি। তারপর বিশ্বাস করবি’। কিন্তু আমরা কি তাই করি?

এবার আলোচনা করা যাক সাধুটি কি কি আপত্তিকর কথা বলেছেন। প্রথম কথা বিবেকানন্দ ধূমপান করতেন, দ্বিতীয় কথা তিনি মাছ মাংস খেতেন। একজন সাধু কোনদিন এমন করতে পারেন না! তৃতীয় যে বিষয়টা আলোচনায় প্রধান স্থান নিয়েছে সেটি রামকৃষ্ণ দেবের বাণী, যত মত তত পথ। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি কথা সাধুটি বলেছেন যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা অর্থহীন। আমার মূলত আলোচনাটি এই কয়েকটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো।

প্রথম প্রসঙ্গ, ধূমপান। নরেন্দ্র নাথ দত্ত প্রথম ধূমপান করেছিলেন শৈশব কালে। গল্পটা মোটামুটি ভাবে সকলের জানা। তাঁর উকিল বাবার কাছে নানান জাতের লোক আসতেন। আর তাদের জন্যে রাখা হত নানান রকমের তামাক সেবন ব্যবস্থা। নরেন্দ্র দেখলেন সেখানে ব্রাহ্মণদের হুঁকো আলাদা, অন্যান্য জাতের হুঁকো আলাদা। প্রশ্ন করে জানলেন এক জাতের লোক অন্য জাতের হুঁকো খেলে নাকি জাত যাবে। বিষয়টা পরীক্ষা করার জন্য তিনি সব জাতের হুঁকো খেয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন তাঁর জাত যায় কি না। বিবেকানন্দ কি সেই সময় থেকেই ধূমপান করতে শুরু করেন? মনে হয় না। সম্ভবত কলেজে পড়ার সময় থেকে তিনি ধূমপান করতে শুরু করেন। পরবর্তী কালে সাধু হওয়ার পরেও তিনি এই নেশা ছাড়েন নি। এই বিষয়ে আঙুল তোলার সময়ে আশাকরি ISKCON সাধুটির মনে শিব ঠাকুরের নাম একবারও আসেনি। যদি আসতো তাহলে তিনি স্বামীজীর ধূমপান বিষয়ে এই মন্তব্য করতে না। তান্ত্রিক মতে ভারতীয়রা শিবের যে পূজা করেন তার একটি বিশেষ উপকরণ হল ধূমপান সামগ্রী। যার মধ্যে গাঁজাও রয়েছে। নানান ধর্মীয় মেলায় আমরা গাঁজাখোর সাধুদের দেখি এবং কিছুই মনে করি না। তবে ISKCON সাধুটির পক্ষে নিশ্চয়ই এত কিছু মাথায় রাখলে মন্তব্যটি করা কঠিন হয়ে যেত। তাই তিনি এসব কিছুই মনে রাখেন নি। সম্ভবত তিনি এক ও একমাত্র কৃষ্ণের ভক্ত। শিবের মত গাঁজা খোর, শ্মশান বাসী অনার্য দেবতা কে তিনি পছন্দ করেন না। এমন কি মনে মনে ঘৃণাও করতে পারেন! মনে হয় মহাভারতের শান্তি পর্বটি তিনি পরেন নি। যেখানে নারায়ণ অর্থাৎ কৃষ্ণ বলছেন, শিব ও কৃষ্ণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যিনি শিব তিনিই কৃষ্ণ। কাজেই বিবেকানন্দের ধূমপান বিষয়টি এই সাধুকে কোন ভাবেই বুঝিয়ে পারা যাবে না।

এবার সাধুর মাছ মাংস খাওয়ার বিষয়ে আসা যাক। এই বিষয়টা নিয়ে অনেকের মনেই অনেক সংশয় আছে। আমরা ছোট থেকে দেখেছি বিধবা ঠাকুমা মাছ মাংস খান না আর ঠাকুর দেবতা নিয়ে থাকেন। আমাদের তাই মনে হয় ঈশ্বরকে পেতে গেলে নিরামিষ খেতেই হবে। বিষয়টা আজকের নয়। স্বামীজী যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখনও এই প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছে। অনেকে তাকে এ জন্যে ভণ্ড সাধু বলেছেন কারণ তিনি মাছ মাংস খান। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাধু তাই যা পাই তাই খাই। খাবার না পেলেও দোষারোপ করি না। নিরামিষ খাবারের দাবি করে এদের বিব্রত করতে চাই না। এত গেল বিবেকানন্দের কথা। আমরা যদি পৃথিবীর অন্যান্য সাধুদের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখব নানান জায়গার মানুষের খাদ্যাভ্যাস যেমন আলাদা তেমনই সাধুদের। উদাহরণ হিসাবে গৌতম বুদ্ধর জীবনকে দেখা যেতে পারে। যদি কেউ প্রশ্ন করে মৃত্যুর আগে গৌতম বুদ্ধ কি খাবার খেয়েছিলেন? তাহলে আমাদের বলতে হবে রুটি ও শুয়োরের মাংস। এই তথ্য নিশ্চয়ই ওই ISKCON সাধুটি জানেন না। জানলে বিবেকানন্দের খাওয়া বিষয়ে কথা বলতেন না। কিংবা এটাও হতে পারে যে তিনি গৌতম বুদ্ধকেও সাধু হিসাবে বিবেচনা করেন না! এই বিষয়ে তার মতামত না জেনে তাকে আক্রমণ করা উচিৎ নয়।

তবে আমিষ নিরামিষ বিষয়ে কয়েকটা কথা এখানে বলা যেতে পারে। আমিষাশীরা বলবেন, গাছেরও প্রাণ আছে। উত্তরে নিরামিষাশীরা বলবেন, গাছের ব্যথা লাগে না। আমিষাশীরা তখন প্রশ্ন তুলতে পারেন, ও তার মানে যার ব্যথা লাগে না তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই! আচ্ছা তাই যদি হবে তাহলে একটি মাছ প্রাকৃতিক ভাবে মারা গেলে কিংবা একটা ছাগল বুড়ো হয়ে মরলে কি তাকে নিরামিষ জ্ঞানে খাওয়া যেতে পারে? আসলে এই ভাবে ভাবলে জল ফুটিয়ে খাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ তাতেও বীজাণু আছে। তাই খাদ্য বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয় খাদ্য ধর্ম মতে তিন প্রকার। সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। আমরা নিরামিষ বলছি যাকে রান্নার গুনে সেটাও সাত্ত্বিক থেকে রাজসিক হয়ে যেতে পারে। শরীর রাখার জন্য খাবারের প্রয়োজন আছে এবং অনেক রকম খাবারের প্রয়োজন আছে। এই সত্য আমাদের মানতেই হবে। আর এটাও মানতে হবে যে আমাদের শরীরের একশো ভাগই আমিষ। এক দলা আমিষের মধ্যে বাস করে যিনি নিরামিষ খান তিনিই সাধু, এমন হাস্যকর যুক্তি না দেওয়াই ভালো। যে শিশু মায়ের স্তন্য পান করেছে যুক্তি দিয়ে ভাবলে বোঝা যায় সে নিরামিষ নয়, আমিষ খাচ্ছে। এই যুক্তিতে গরুর দুধও আমিষ। তবে ওই সাধুটি কথা বলে হাততালি পেতে এসেছেন। এইসব যুক্তির মুখোমুখি হতে মনে হয় রাজি হবেন না।

বিবেকানন্দ বিষয়ে বলতে গিয়ে সাধুটি বলেছেন, স্বামীজী নাকি শিকাগো ধর্মসভায় “হিন্দুত্ত্ব” বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। এখানে বলে নেওয়া ভালো, হিন্দুত্ত্ব শব্দের কোন অর্থ অভিধানে নেই। এবং স্বামীজী এই বিষয়ে ধর্মসভায় কোন কথা বলেন নি। তিনি হিন্দু ধর্মের কথা বলেছেন; সনাতন ধর্মের কথা বলেছেন। হিন্দুত্ত্ব শব্দটি সম্ভব আরএসএস-এর আবিষ্কার। নিবন্ধ লেখকের কাছে হিন্দুত্ত্ব কথাটির অর্থ হিন্দু ছাড়া অন্যান্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বোধ ছাড়া কিছু নয়। বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক রাম গুহ তাঁর একাধিক রচনায় হিন্দুত্ত্ব শব্দটির এই একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সম্ভবত এইসব জানার সুযোগ বা মানসিকতা ওই সাধুর এখনও হয়নি। যে ধর্মসভায় স্বামীজীর ভাষণের কথা তিনি বলেছেন সেই ভাষণ তিনি নিজে পড়েছেন কি না, উপলব্ধি করেছেন কি না, এই বিষয়ে নিবন্ধ লেখকের গভীর সন্দেহ রয়েছে।

এবার একটু বলা যাক, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে সাধুটি যে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন সেই প্রসঙ্গে। পৃথিবীতে মূলত দুই ধরনের মানুষ রয়েছেন। এক, যারা ঈশ্বর, আল্লাহ বা ওই জাতীয় নিজের থেকে বড় কোন শক্তিতে বিশ্বাস রাখেন আর একদল এমন কোন বিশ্বাস রাখেন না! বলাই বাহুল্য বিশ্বাস রাখা মানুষের সংখ্যাই এক্ষেত্রে বেশি। তবে বিশ্বাস রাখা মানুষরা সবাই যে একই মতে বিশ্বাস রেখেছেন এমন তো নয়। হিন্দু, মুসলমান কিংবা খ্রিস্টানদের বিশ্বাস যেমন আলাদা; তেমনই হিন্দুদের মধ্যেও আলাদা আলাদা বিশ্বাস রয়েছে। কেউ কালীকে বিশ্বাস করে কেউ বা কৃষ্ণকে। কেউ রামকে পূজা করে আবার কেউ হনুমানকে। কেউ আবার নিরাকারবাদী। বৌদ্ধ ধর্মে যেমন কোন ঈশ্বরই নেই। তাদের চেষ্টা অত্যন্ত শূন্যের অনুভূতি লাভ। শ্রী রামকৃষ্ণদেব নানান মতে সাধনা করে উপলব্ধি করেন, এই সব মতই আমাদের এক সত্যের কাছে পৌঁছে দেয়। সেই কথাটাই সহজ ভাবে তিনি বলেছেন, যত মত তত পথ।

ISKCON সাধুটি বলেছেন, সব পথ এক দিকে নিয়ে যেতেই পারে না। ব্যঙ্গ করে বলেছেন, GPS লাগিয়ে দেখুন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন! না, সাধুটিকে কিছু বোঝানো লেখকের উদ্দেশ্য নয়। কারণ তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই কথাটা বলেছেন। মনে মনে তিনি বেশ জানেন যে এই জীবনে তিনি এমন কিছু বলে যেতে পারবেন না যা, ‘যত মত তত পথ’ কথাটির সমতুল্য হবে! লেখকের উদ্দেশ্য সাধুটির কথা শুনে যে সব সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নে উঠেছে তাদের কাছে কয়েকটা প্রসঙ্গ তুলে দিতে যাতে তারা নিজেরাই বিষয়টা বিচার করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন।

যদি প্রশ্ন ওঠে ঈশ্বর, আল্লাহ ইত্যাদির মধ্যে কি কি গুণ আছে? অনেক উত্তর আসবে। জ্ঞান, দয়া, ক্ষমা, শক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি প্রশ্ন করা হয় এই গুণ গুলো তাদের মধ্যে কতটা পরিমাণে আছে? উত্তর আসবে অসীম! অর্থাৎ আমার ঈশ্বর এমন একজন যার জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি সহ সব কিছুই অসীম। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে যুক্তি বলে ঈশ্বর, আল্লাহ ইত্যাদি যা যা মানুষ কল্পনা করেছে তার প্রত্যেকটাই অসীম। এটা একটা যুক্তির বিষয়। পাঠকরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। এখন যদি যুক্তির বিচারে এটা হয় যে ঈশ্বর, আল্লাহ ইত্যাদি সবাই অসীম। তাহলে আর একটি প্রশ্ন উঠে আসে। আচ্ছা একাধিক অসীম কি এক সঙ্গে থাকতে পারে? জীবনানন্দ তার ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় লিখেছেন, ‘অনন্ত তো খণ্ড নয়’। ভাবলে সহজেই বোঝা যায় এটা হতে পারে না। অর্থাৎ অসীম একটি হতে বাধ্য। তবে কি তাকেই নানান মানুষে নানান ভাবে কল্পনা করছেন, নাম দিচ্ছেন? যেমন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পুকুরের উদাহরণ দিয়েছেন। নানান ঘাটে মানুষে একই বস্তুকে কেউ জল বলছে, কেউ পানি বলছে আবার কেউ বা বলছে ওয়াটার! এই চিন্তা থেকেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথার ব্যাখ্যা করতে হবে। তিনিই উপলব্ধি করেছিলেন নানান পথের সাধক শেষ পর্যন্ত একই উপলব্ধিতে কোন না কোন দিন পৌঁছে যাবেন। মনে হয় ISKCON সাধুর এখনো এই সব গভীর উপলব্ধির সময় আসেনি। প্রসঙ্গত একটা কথা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন। যারা কথামৃত পড়েছেন বিষয়টা তাদের কাছে নতুন নয়। যৌন সুখ বিষয়টা হাজার ব্যাখ্যা করলেও শিশুরা যেমন বুঝতে পারবে না, মনে হয় এই ‘যত মত তত পথ’ কথাটিও সাধুটির কাছে একই রকম।

প্রসঙ্গত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। যেখানে তিনি বলছেন, ছাদে অনেক ভাবে ওঠা যায়। সিঁড়ি দিয়ে, মই দিয়ে, দড়ির সাহায্যের বা আরও অনেক ভাবে। কিন্তু একটি পা সিঁড়িতে আর একটি পা মইতে দিয়ে ছাদে ওঠা যায় না। প্রসঙ্গটা ISKCON সাধুর বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, মহান মানুষের নিন্দা করে কোনদিন মহান হওয়া যায় না! ‘যত মত তত পথ’ কথটির একটি চমৎকার ইংরেজি অনুবাদ আছে। Infinite Paths to Infinite Reality অর্থাৎ অনন্ত সত্যের কাছে পৌঁছাবার অনন্ত পথ রয়েছে। এটাই শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ বলে গিয়েছেন।

অনেকে বলবেন ISKCON কর্তৃপক্ষ সাধুটির বিষয়ে কিছু শাস্তি মূলত ব্যবস্থা নিয়েছেন। আচ্ছা, ভিডিওটি যদি এভাবে ছাড়িয়ে না পড়তো কিংবা রামকৃষ্ণ ভক্তরা যদি ISKCON এর উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি না করতেন তাহলে কি তারা ব্যবস্থা নিতেন? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। তবে ISKCON কর্তৃপক্ষ এমন কোন আশ্বাস দিয়েছেন কি যে তাদের মঞ্চ কে ব্যবহার করে আগামী দিনে আর কোন সাধু এমন কথা বলবেন না, একটা তারা নিশ্চিত করবেন? বিষয়টা পাঠকদের চিন্তার জন্যে রাখা রইল। আসলে মহাপুরুষদের নামে বাজে কথা বলে মহাপুরুষদের অপমান করা যায় না। তবে তাদের যারা পছন্দ করেন, ভক্তি করেন সেই মানুষদের মনে কষ্ট দেওয়া যায়। যারা এমন বাজে কথা বলেন তাদের মূল উদ্দেশ্যও কিন্তু সেটাই। তাই বিষয়টা নিয়ে রামকৃষ্ণ ভক্তরা উত্তেজিত হতেই পারেন। কিছু দিন আগে এক রাজনৈতিক দলের নেতা সারদা দেবী সম্পর্কে ভুল কথা বললেও তার প্রতিবাদ হয়। হয়তো আগামী দিনেও এমন প্রতিবাদ হবে। কারণ যাদের নিজেদের আলো নেই তারা মহাপুরুষদের কুৎসা করে তাঁদের আলোর অংশ পেতে চেষ্টা করেন। ইতিহাস কোনদিন এদের মনে রাখে না।

0 comments: