0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






একটি মানুষ শিশু ভালোবাসেন। মানুষটি বিখ্যাত। সারা দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের মনে তাঁর সম্পর্কে একটি স্বপ্নের রাজকুমার গোছের ভাবমূর্তি তৈরি করতে এই স্বাভাবিক বৃত্তিটিকে অনেক বড় করে মহৎ করে দেখাতে হয়েছে। ফলশ্রুতি – আমাদের একটি জাতীয় দিবস। শিশু দিবস। যেন শিশুকে ভালবাসতে গেলে বিশেষ হতে হবে। অথচ সেই কবেই যেন কে বলে গিয়েছেন, যে মানুষ শিশু ফুল আর গান ভালবাসেনা সে খুন করতে পারে। সুতরাং এটি মানুষের স্বাভাবিক মনের বৃত্তি। আস্বাভাবিক বৃত্তিই তো প্রাণ নেওয়া!

বাচ্চাদের দেখতে, তাদের সঙ্গে থাকতে, তাদের হাসি কথা আহ্লাদিপনা দেখে আদর করতে সকলেরই ইচ্ছে করে। আমার দেখা এমন মানুষ আছেন যারা প্রকৃতপক্ষে খুবই রাশভারী, গম্ভীর, হাসেন কম। কিন্তু একটি শিশুর উপস্থিতিতে তাঁর মুখের সেই সরলরেখা আস্তে আস্তে বাঁকা চাঁদের মতো হয়ে উঠতে দেখেছি। কাউকে আবার একপাল বাচ্চার মধ্যে হঠাৎ খুশিতে মেতে উঠে তাদেরই মতো হয়ে উঠতে দেখেছি। ভারী সুন্দর সেই সব অভিব্যক্তি। বলা বাহুল্য যে নিজে দর্শক হয়ে নির্মল আনন্দ পেয়েছি। নিজেকে যে ভারী আস্তরণের আবরণে অহর্নিশি ঢেকে রাখা আছে তা সরে গিয়ে ভেতরকার সেই সরল শিশুটি বেরিয়ে আসে। একজন প্রকৃত মানুষ, যার মান হুঁশ সদাজাগ্রত ছিল, সেই তাঁর একটি কথা মনে পড়ে। ‘পরমহংস নিজের সঙ্গে কটি বালক রাখতে ভালোবাসে। তাদের ভাব আরোপ করবে বলে’। আদতে আমাদের প্রতিদিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা কৃত্রিমতা, সামাজিক ছাঁচে ফেলে মনকে নির্দিষ্ট নৈতিক রূপে ও মাপে তৈরি করা, বহু জ্ঞান ও অজ্ঞানতাকে জাহির করা ও ঢেকে রাখার অদম্য প্রয়াসে, যা নিয়ে জন্মেছি সেই সরল মন, ভেতরের সেই শিশুটিকে হারিয়ে ফেলি। প্রকৃত মানুষটি কিন্তু বলেছিলেন জীবনের সবচেয়ে জরুরী পাঠ হল তিলতিল করে তৈরি করা সেই মহার্ঘ আবরণটিকে বর্জন করে ভেতরের আদি অকৃত্রিম শিশুকে খুঁড়ে বের করে আনা। সেই প্রকৃত ‘আমি’। বাকিটা ‘অহং’।

এখন দেখি ম্যানেজমেন্ট গুরুদের লেখা কেতাবে আবশ্যিক একটি শর্ত তুলে ধরা হয় – ইগো ভয়ানক বস্তু। এ থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকো। কিন্তু একে বর্জন করি কিভাবে? জানা নেই।

একটি শিশুদের ব্যবহার্য পণ্যপ্রস্তুতুকারী সংস্থা বিনামূল্যে বিলি করেছে একটি পুস্তিকা হাতে এলো সেদিন। তাইতে নানারকম দরকারী কথার সঙ্গে দেখি শিশুদের প্রতি আমাদের কেমন ব্যবহার করা উচিত তার একটি দীর্ঘ তালিকা। দেখে চমকিত হলাম। তাহলে এতদিন ধরে না জানি কত ভুল করে এসেছি! এটি তো কেউ কখনও শেখায়নি? নীতিশিক্ষার নতুন ক্লাস? খুব প্রয়োজন? মনে মনে রেগে উঠছি। সযত্নচর্চিত ইগোয় আঘাত লাগছে। ‘আমাকে’ আবার শিখতে হবে? গর্বিত মা আমি! দুটি শিশুকে রাতকে দিন করে বড় করেছি! সেই মা কিনা এক ব্যবসায়ীর থেকে শিখবে শিশুর প্রতি ব্যবহার! বিরক্ত হয়ে পুস্তিকাটি সরিয়ে রেখেছি। খবরের কাগজ হাতে তুলেছি। প্রথম পাতা থেকেই শুরু হল নানা কিসিমের মানুষের ইগোর সংঘাত। নেতা ব্যবসায়ী ডাক্তার উকিল মন্ত্রী খেলোয়াড়, এমনকি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। এরই মধ্যে কেউ পুরস্কার পাচ্ছেন, তার ছবি। ঝলমলে মুখ। ভেতরের পাতায় পৌঁছলাম। একটি রঙিন পত্র। ‘শিশুদের ছোট ভাববেন না’। তার পাশের পাতাতেই তিন বছরের শিশুটির মৃত্যু সংবাদ। শরীরে ছুঁচ ফুটিয়ে কে জানে কি চেয়েছিল লোকটা, শিশুটি যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। মারা গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজ বন্ধ করি। মনে পড়ে শিশুটির মায়ের জবানবন্দী। অজস্র পরস্পর বিরোধী কথা। কেন? কি করে এই মায়ের সহজাত বোধ লোপ পেয়েছে? নীতিশিক্ষার ক্লাস করেনি? নাকি শৈশবে কেউ তাকে ভালোবাসা দেয়নি? আরও সে কি চেয়েছিল জীবন থেকে? সন্তান লাভের পরেও? কাগজ সরিয়ে রাখি। পুস্তিকাটি তুলে নিই। চোখে পড়ে একটি লাইন – কখনও কোনও বাচ্চাকে শরীর স্পর্শ করার আগে তার অনুমতি নিন। সে অনুমতি না দিলে তাকে আদর করতে যাবেন না। সে স্বচ্ছন্দ বোধ করেনা। নিজের ভেতরে ভয়ানক ভুমিকম্প টের পাই। তাই তো! এত রীতি নীতি, এত শিশুরক্ষা আইন, শেষ পর্যন্ত কটি শিশুকে তারা রক্ষা করতে পারছে? অসম্ভব যে! আমাদের চাওয়ার তালিকা এমন দীর্ঘ হয়ে চলেছে যে তা থেকে শিশুও রক্ষা পাচ্ছেনা। একটু ভাবতে বসি। নিজের পুত্রকন্যা অতৃপ্ত জীবনবাসনা পূরণের জাদু-ই-চিরাগ হবে, এ থেকে শিশুদের যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণ পর্যন্ত চলে গিয়েছে বাসনারেখা। না না, আঁতকাবার কিচ্ছু নেই। যারা ভাবছেন ছেলেমেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার করে সমাজের ভালো করতে চাই। সেটার সঙ্গে দ্বিতীয় অমানবিক কর্মটি এক হল কি করে? বলি। প্রথমটি নিজের মানসিক আনন্দ লাভ। বাসনা পূরণ। আর সেটি করতে গিয়ে বাচ্চাদের যে কত যন্ত্রণা কত অত্যাচার সইতে হয় সে আমরা সবাই জানি। আমরা মানে, মা বাবারা। দ্বিতীয়টিও তো তাইই!! শিশুটির জন্ত্রনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক অত্যাচারীর আনন্দ লাভ! জানি এ পর্যন্ত পড়ে সরিয়ে দিয়েছেন লেখাটি। তাই রাখা উচিত। কারণ সমাজ এখনও এই নীতিটি তৈরি করেনি যার মধ্যে দিয়ে আমরা দর্পণে নিজেদের মুখ দেখতে পাই। তবু যদি কখনও নির্জনে বসে ভাবা সম্ভব হয় তাহলে দেখতে পাবো, জীবনে আমরা বহু বাসনায় পর্যুদস্ত হয়ে চলেছি। অবিরত নিজের অহংকে আরও আরও বাসনার ঘৃতাহুতি দিয়ে আরও আনন্দের অনুসন্ধান করে চলেছি। তবে উপায়?

উপায় সহজ। সহজাত। ‘নির্বাসনা হও’। কারো কাছে কিছু চেয়ো না। নিজের কাছেও নয়। সন্তান তোমাকে একটি নির্মল আনন্দ দিয়েছে জন্মমুহূর্তেই। এর অধিক আর কিচ্ছুটি চেয়োনা। বরং ধীরে ধীরে নিজের ওপরে স্তুপ করে তোলা ইগোর আবর্জনা সরিয়ে দাও। যদি পেরে ওঠা যায় তবে ভেতরের সেই আদি অকৃত্রিম শিশু জেগে উঠবে। যে শিশু এই বিরাট বিশ্ব লয়ে আনমনে খেলা করে। সেই অহেতুক আনন্দ আমাদের অহংজাত শতেক নিরানন্দকে দূর করে দেবে। স্বভাবে ফিরতে পারব। দর্পণে নিজের স্বরূপ ভেসে উঠবে। সত্যস্বরূপ।

[শব্দের মিছিল ওয়েবম্যাগ ডিসেম্বর ২০১৭]

0 comments: