0

সম্পাদকীয়

Posted in






হেমন্তের বিষণ্ণ বিকেলে ছায়া ফেলে যায় ফিকে হয়ে আসা একটা ছোটোবেলা। মনে পড়ে, এমনই বিকেলে বসে বই পড়তাম। না পাঠ্যবই নয়। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও যেখানে ছিল বিশাল এক বইয়ের পৃথিবী। পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার বলে একটা বিষয় ছিল। সেখানে খুদে পাঠককে বাবা-মা পৌঁছে দিচ্ছেন, এটি ছিল এক পরিচিত দৃশ্য। সেই ছেলেমেয়ের দল এক হয়ে শুরু করেছে আরেকটি পাঠাগার তারপর আরেকটি, এটি ছিল সেই শৈশব, কৈশোরের চালচিত্রের এক অংশ। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল বইয়ের নেশা ধরানোর সেই জায়গাগুলি। শিশু-কিশোরের দল খুঁজে পেলো তাদের পরবর্তী গন্তব্য, যেখানে অনেক কিছু থাকলেও বই নেই।

রে ব্র্যাডবেরির 'ফারেনহাইট ৪৫১' মনে পড়ে? কালোত্তীর্ণ সেই উপন্যাস অবলম্বনে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো নির্মাণ করেছিলেন মহাকাব্যিক এক চলচ্চিত্র। এক কাল্পনিক ভবিষ্যতের রক্ত হিম হয়ে যাওয়া ছবি দেখেছিলাম আমরা। আগুন নেভানো যাদের কাজ, তারাই জ্বালিয়ে রাখছে সেই চিতা, এক নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কাগজ যেখানে পুড়ে খাক হয়ে যায়! শেষ অবধি এলো একটি ছোটো মেয়ে যে বই ভালোবাসে। ততদিন পর্যন্ত আগুনে মদত দিচ্ছিল যারা, তারাও নড়েচড়ে বসলো।

সম্প্রতি দেখলাম মহল্লায় আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন একটি বই-বিপণি। এখনও কি তাহলে আশাবাদী হওয়া যায়? প্রতীক্ষায় থাকা যায় সেই ছোটো মেয়েটির?

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর 

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in






সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির প্রাণের যোগ । নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু বোধহয় তার একটা কারণ । বাল্যকালে কবিতা বা ছড়া লেখেন নি , গান শুনে মুগ্ধ হন নি , এমন বাঙালি বিরল । তবে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা , বৈঠক , সম্মেলন –এ সব ব্যাপার মধ্যযুগে ছিল না । এটা পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল । উনিশ শতকের নবজাগরণেই তার সূত্রপাত । । উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সাহিত্যকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধ হবার প্রয়াস দেখা যায় । ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সভা’ গঠিত হয় ১৮৩৬ সালে । তার আগে হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও গঠন করেছিলেন ‘ অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন । ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ , অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী’ , বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করেও তৈরি হয়েছিল লেখক গোষ্ঠী । সেখানে লেখকরা মাঝে মাঝে মিলিত হয়ে সাহিত্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন ।

আধুনিক সাহিত্য সম্মেলনের ভ্রূণ ছিল ‘বঙ্গ একাডেমি’ অথবা ‘ বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজে’র ( ১৮৭২) মধ্যে । এই একাডেমির প্রস্তাবক কোন বাঙালি নন , একজন ইংরেজ সিভিলিয়ান , জন বীমস । বাংলা ভাষার স্থিরতা বিধানের জন্য তিনি এই একাডেমি গঠনের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন । একাডেমিটি বাস্তবায়িত হলে সেখানে অবশ্যই বাংলা ভাষার আলোচনার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিত । কিন্তু তখনকার কালের বিশিষ্ট বাঙালিরা জন বীমসের প্রস্তাবকে গ্রাহ্য করেন নি । ১৮৮২ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলিকাতা সারস্বত সম্মেলন’ , বঙ্কিমচন্দ্র যার নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘ একাডেমি অব বেঙ্গলি লিটারেচর’ । এই সংগঠনটি অল্প কিছুকাল পরে ‘সারস্বত সমাজ’ নামে পরিচিত হয় । ১৮৯৩ সালে জন্ম হল আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের । তার নাম ‘দ্য বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচর’ । এর উদ্যোক্তা ছিলেন বিনয়কৃষ্ণ দেব , এল লিওটার্ড , হীরেন্দ্রনাথ দত্ত , ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী প্রমুখ ।

এই বেঙ্গল একাডেমি থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের জন্ম ১৮৯৪ সালে । সাহিত্যানুরাগী যে কোন মানুষ এর সদস্য হতে পারতেন । সভাপতি , সহকারী সভাপতি , দুই সম্পাদক ও ৬ সদস্য নিয়ে গঠিত হয় এর কার্যনির্বাহক সমিতি । সাহিত্য পরিষদের তিন ধরনের অধিবশন হত – মাসিক অধিবেশন , বিশেষ অধিবেশন ও বাৎসরিক অধিবেশন । রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে সাহিত্য পরিষদের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন হয় ১৮৯৫ সালের ৫-৬ এপ্রিল । সাহিত্য পরিষদের ১২টি বার্ষিক অধিবেশনের বিবরণ পাওয়া যায় ড. অমরনাথ করণের বইতে । বাংলার বাইরে পরিষদের বিস্তৃতির মূলে আছে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব । পঞ্চম বার্ষিক অধিবেশনে তিনি প্রস্তাব করেন বাংলার বিভিন্ন জেলায় পরিষদের শাখা স্থাপন করা হোক এবং অনুষ্ঠিত হোক বার্ষিক অধিবেশন ।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯০৬ সালে বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনের মঞ্চে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয় এবং রবীন্দ্রনাথকে নির্বাচিত করা হয় সভাপতি । তবে এই সম্মেলন পণ্ড হয় ইংরেজ সরকারের দমনমূলক নির্দেশে । ১৯০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় ‘সাহিত্য সম্মিলন’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছিল , যার সভাপতি ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন । ‘সাহিত্য সম্মিলনে’র উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৯ জানুয়ারি যে সারস্বত সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন তাঁর ‘সাহিত্য সম্মিলন’ প্রবন্ধটি, যা বরিশাল প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনের জন্য তিনি লিখেছিলেন ।

প্রতি বৎসর বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ । এর প্রথম অধিবেশন হয় বহরমপুরের কাশিমবাজারে , ১৯০৭ সালের ৩-৪ নভেম্বরে । সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ; উপস্থিত ছিলেন মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী , যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় , রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী , ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , হেমচন্দ্র রায় , শশধর রায় , অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় , জগদানন্দ রায় , শিবচন্দ্র বিদ্যানিধি প্রমুখেরা । প্রথম অধিবেশন থেকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত (১৯৩৮) দ্বাবিংশ সম্মেলন পর্যন্ত নিয়মিত হয়েছে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের অধিবেশন । তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় তার কার্যক্রম বন্ধ থাকে । ১৯৫৯ সালে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে মেদিনীপুরের বৈষ্ণবচকে যে ত্রয়োবিংশ অধিবেশন হয় , সেখানে সংগঠনটি ‘বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’ নাম ধারণ করে ।

বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো উত্তরবঙ্গেও সাহিত্য পরিষদের শাখা স্থাপিত হয় । উত্তরবঙ্গের শাখার উদ্যোগে আয়োজিত হয় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের । এখানে ১৯০৮ সালের ২৭ জুন প্রথম সম্মেলন হয় রংপুরে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের সভাপতিত্বে । পরবর্তী সম্মেলনগুলি হয় বগুড়া , গৌরীপুর , মালদহ , কামাখ্যাধাম , দিনাজপুর , পাবনা , রাজশাহি , রংপুর, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে ।

বাংলাদেশের বাইরে , ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জীবিকার সূত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন বহু বাঙালি । সাহিত্য রসপিপাসা চরিতার্থ করার জন্য তাঁরা স্ব স্ব অঞ্চলে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্য সংগঠন । যেমন লাহোরের ‘বঙ্গ সাহিত্যসভা’ , সিমলার ‘বান্ধব সমিতি’ , কাশীর ‘বঙ্গসাহিত্যাশ্রম’ , কানপুরের ‘বঙ্গ সাহিত্য সমাজ’ । কিন্তু প্রবাসী বাঙালিরা একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্যমঞ্চের জন্য আকাঙ্খিত ছিলেন , যেখানে নানা রাজ্যের বাঙালি প্রতিনিধিরা মিলিত হতে পারবেন । ১৯২২ সালে সাহিত্য পরিষদের বারাণসী শাখার এক অধিবেশনে কানপুরের সুরেন্দ্রনাথ সেন , লক্ষ্মৌএর অতুলপ্রসাদ সেন , কাশীর ললিতবিহারী সেনের উপস্থিতিতে ‘ উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের’ পরিকল্পনা করা হয় । ১৯২৩ সালের ৩-৪ মার্চ কাশীতে উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন হয় । সম্মেলনে আগ্রা , লাহোর , পাটনা , দিল্লি , রামপুর , বারাণসী , এলাহবাদ , কানপুর , লক্ষ্মৌএর বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা যোগদান করেন । সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ । ১৯২৩ সালের ২৬-২৭ ডিসেম্বর এলাহবাদে এর দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় প্রমথনাথ তর্কভূষণের সভাপতিত্বে । অমরনাথ করণ লিখেছেন , “ এর পর লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় অধিবেশনে (১৩৩১) সংস্থাটি ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে । ১৯৫২ সালে কটকে অনুষ্ঠিত অষ্টাবিংশতি অধিবেশন পর্যন্ত এই নামে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে সম্মেলন হয়েছে । এর মধ্যে ১৯২৯ সালের ১৩ জুন লক্ষ্মৌতে সম্মেলনটি ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ নামে রেজিস্ট্রিও করা হয় । ” ১৯২৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত প্রবাসী বঙ্গে সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে বারাণসী , এলাহবাদ , লক্ষ্মৌ , কানপুর , দিল্লি , মীরাট , ইন্দোর , নাগপুর , আগ্রা , এলাহবাদ , গোরখপুর , কলকাতা , দিল্লি , রাঁচি , পাটনা , গৌহাটী , কানপুর , জামসেদপুর , বারাণসী , এলাহবাদ , দিল্লি , কানপুর , মীরাট , কলকাতা , বোম্বাই , দিল্লি , পাটনা , কটক প্রভৃতি স্থানে ।

১৯৫৩ সালে জয়পুরের অধিবেশনে আবার পরিবর্তিত হয় সংগঠনের নাম । ‘প্রবাসী’ শব্দটি অনেকের আপত্তির কারণ হয় । নতুন নাম হয় ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ । ১৯৮১ সালের ২১ ডিসেম্বর এই নামেই সংস্থাটিকে রেজিস্ট্রি করা হয় । ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন দেবেশ দাস , নীহাররঞ্জন রায় , দেবীপ্রসাদ রা্যচৌধুরী , হুমায়ুন কবীর , নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত , সত্যেন্দ্রনাথ বসু , কালিদাস রায় , দিলীপকুমার রায় , শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় , তুষারকান্তি ঘোষ , বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় , প্রেমেন্দ্র মিত্র , আশাপূর্ণা দেবী , অশোককুমার সরকার , শিবনারায়ণ রায় , প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত , প্রবোধচন্দ্র সেন , অন্নদাশংকর রায় , রাধারাণি দেবী , সত্যেন্দ্রনাথ রায় , সমরেশ বসু , লীলা মজুমদার , জগদীশ ভট্টাচার্য , অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় , প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র , সুভাষ মুখোপাধ্যায় , মনিশংকর মুখোপাধ্যায় প্রমুখেরা । ২০২২ সালে শতবর্ষে পা দিয়েছে এই সংগঠন । শতবর্ষের সে অনুষ্ঠান হবে কলকাতায় । আগামী ডিসেম্বর মাসে । ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা তো থাকবেনই , তার সঙ্গে ভারতের বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে । আমন্ত্রণ জানানো হবে মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে । আয়োজকরা একটি চমৎকার প্রদর্শনী ও তথ্যচিত্রেরও পরিকল্পনাো করেছেন । [ লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত ( ভারত সরকার ) গবেষক ও কলামিস্ট ]

ঋণ :

সাহিত্য সম্মেলনের গবেষক ড. অমরনাথ করণের ‘ সাহিত্য সম্মেলনের ইতিবৃত্ত’ ( নবজাতক প্রকাশন , ১৯৯৪ ) ; ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশন ও রবীন্দ্রনাথ’ ( বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ , ২০১৩) ; ‘সভাপতির অভিভাষণ/ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন ১৯০৭-১৯৩৯’ ( লালমাটি , ১৪২৪ ) ; ‘সভাপতির অভিভাষণ / উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’ ( লালমাটি , ২০১৯ )

0 comments:

2

বিশেষ নিবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in





এক একটা সময়কে মনে পড়ে যায় তাদের সঙ্গে ওতপ্রোত কিছু অনুষঙ্গে। শরৎকালে বিশেষ একটা হলুদ রোদের ঝলমল টেনে নিয়ে যায় কোনও ছোটো বেলায়। পুজোর ছুটির আগে শেষদিন খালি পায়ে হেঁটে চলেছি ইশকুলে। কাল 'মহালয়া' হয়ে গেছে। আধোঘুমে, ঘোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মায়াবী স্বর। পাড়ার দুর্গাঠাকুর তৈরি হয়ে গেছে। শুধু রং পড়া বাকি। রোদের আলোটাকে বলি, 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়।' একটা সময়। বালক বয়সে এক সুন্দরীতমাকে দেখেছিলুম, যার শাড়ির রং ফিরোজা। মা বলেছিলেন। তার পর থেকে 'ফিরোজা' শুনলেই সেই নারীকে মনে পড়ে। তার মুখ কিছু মনে নেই। সময়টা আছে। বহু দিন পরে কোনও একটি সুগন্ধির সঙ্গে এক প্রিয়তমা নারীর অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়ে গেছে। আর কিছু নেই। থাকার মধ্যে শুধু সেই বিনিসুতোর মালা। সে রামও নেই। অযোধ্যাও। অগণন ভিখারির রাস উৎসব দিয়ে গড়া স্বপ্নের জীবন আমাদের। কালীদা সেই সব স্বপনকে কি মনে রাখে? জানি না। তবে আমাদের প্রজন্মের বঙ্গীয় বালকরা একজন 'স্বপন'-এর জন্য খানিকটা সময় মনের কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দেয়। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তাকে।

গত ​​​​​​​শতকের ​​​​​​​তেষট্টি-চৌষট্টি ​​​​​​​সাল ​​​​​​​নাগাদ ​​​​​​​আমাদের ​​​​​​​প্রথম ইশকুল ​​​​​​​যাওয়া ​​​​​​​শুরু ​​​​​​​হয়। ​​​​​​​আমি ​​​​​​​তখন ​​​​​​​তিন ​​​​​​​কেলাশ। ​​​​​​​পঁয়ষট্টির মধ্যেই আমাদের ইশকুল যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান একজন রহস্যময় লেখক। নাম, শ্রীস্বপনকুমার। তাঁর আসল নাম যে কী ছিলো, তখনও তা জানা যায়নি। পরে জানা গেছে তাঁর পৈতৃক নাম শ্রী সমরেন্দ্র নাথ পাণ্ডে। রাজশাহী থেকে কলকাতায়, এক আগন্তুক বঙ্গসন্তান। তিনি পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে ভূরি ভূরি জ্ঞান রাখতেন। ডাঃ এস এন পাণ্ডে নামে বটতলা থেকে প্রচুর 'ডাক্তারি' বইও বেরোতো তাঁর। অন্যদিকে 'শ্রীভৃগু' নাম নিয়ে জ্যোতিষের বই। ক্ষণজন্মা মানুষ ছিলেন তিনি। বিবিধ বিষয়ে দুহাতে লিখে বটতলার 'বাজার' আলো করে রাখতেন তিনি। পরবর্তীকালে এও জানা গেছে, যেমনই হোক, এই পরিমাণ বিপুল সংখ্যার গ্রন্থরাজির প্রণেতা দারিদ্র্য প্রপীড়িত জীবন কাটিয়েছেন। শেয়ালদা ইশটিশনের ওয়েটিং রুমে নিখরচায় আলো-পাখার সুবিধে পেতে সেখানে বসেই সারা রাত ধরে একেকটি চটি রচনা করতেন। 'গল্প' হিসেবে এই ঘটনার মাহাত্ম্যও কম নয়।

শোনা যেতো, জেমস হ্যাডলি চেজ সাহেব ( আট-নয় কেলাশে যাবার পর তিনি শ্রীস্বপনকুমারকে হটিয়ে আমাদের অধিকার করে নেন ) এবং সিডনি শেলডন সাহেব ছিলেন নাকি দুটি ‘নৈর্ব্যক্তিক’ ব্র্যান্ড। ব্যক্তিবিশেষ নন। এক দল অক্ষর কারিগর মিলেমিশে দিস্তে দিস্তে রোমাঞ্চকর সাহেবি দাস্তান ​​​​​​​ছাড়তেন বাজারে। আমাদের মতো বালকরা গোগ্রাসে গিলতো সে সব। 'আমাদের জীবনে 'নো অর্কিড ফর মিস ব্ল্যান্ডিশ' আবির্ভূত হবার আগে পর্যন্ত শ্রী স্বপনকুমারই ছিলেন দ্য কিং অফ ডিটেক্টিভ থ্রিলার। কিছুদিন আগে এক ​​​​​​​বন্ধুর ​​​​​​​সঙ্গে স্বপনকুমারকে নিয়ে ফোনে আড্ডা হচ্ছিলো। 'ল্যাখাপড়া' চুলোয় যাক, কে কতোগুলো স্বপন-সিরিজ 'শেষ' করতে পেরেছে তাই নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো অবিরাম। ন-দশ বছর বয়েসে প্রথম শ্রীস্বপনকুমার শুরু করি। তখন ​​​​​​​থেকে ​​​​​​​বারো-তেরো ​​​​​​​পর্যন্ত, ​​​​​​​সিরিজের ​​​​​​​পর ​​​​​​​সিরিজ, ​​​​​​​চৌষট্টি ​​​​​​​পাতার ​​​​​​​বহাদুর ​​​​​​​কা ​​​​​​​খেল ​​​​​​​আমাদের ​​​​​​​তৃষ্ণা ​​​​​​​মেটাতো।

যখন থেকে আমাদের হরমোন জাগতে শুরু করে, তখন থেকে একটা জিজ্ঞাসা বাজারে বেশ চালু ছিলো। মেয়েরা কি স্বপনকুমার পড়ে? মনে হয় পড়তো না। কারণ সে বিষয়ে তাদের থেকে কিছু শোনা যায়নি। সে কালে মেয়েদের ফ্রেমটাই ছিলো অন্য রকম। বাঁধা গতের বাইরে সব কিছুই 'অসভ্য'। এই বিশেষণটির এগজ্যাক্টলি যে কী তাৎপর্য ছিলো সেটা বুঝতে বুঝতে আমাদের 'বিয়ের বয়স' হয়ে যায়। যাঁরা 'ভূতপ্রেত' বা অলৌকিকের চর্চা করেন, তাঁরা বলেন সব কিছু নাকি 'বোঝা' যায় না। 'না বোঝার' মধ্যে যে 'বোঝা' সেটাই নাকি প্রকৃত জ্ঞান। শুধু ভৌতিক প্রপঞ্চ নয়, কাব্যিক সন্দর্ভেও এই কথাটাই চলে। সেকালে মেয়েদের সাইকিতে 'অসভ্য' বিশেষণটিও সে রকমই কিছু একটা ব্যাপার ছিলো হয়তো। কিন্তু শ্রীস্বপনকুমারের কী ভূমিকা ছিলো তাতে, সেটা পোয়েস্কার হয়নি কখনও।

রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়তুম ​​​​​​​তখন। ​​​​​​​সেখানে ​​​​​​​একটা ​​​​​​​বিষয় '​​​​​​​পড়ানো' হতো। তার ​​​​​​​সরকারি ​​​​​​​নাম ​​​​​​​ছিলো ​​​​​​​'মরাল ইন্স্ট্রাকশনস'। আমরা বলতুম ধর্মক্লাস। প্রতি সপ্তাহেই একটা-দুটো করে 'ধর্মক্লাস' থাকতো। দিনের ​​​​​​​শেষ ​​​​​​​পিরিয়ড। সেই সময়ে যে শিক্ষকমশায়ের আসার কথা তিনি একবার এসে বলে দিতেন, তোরা ক্লাসের দরজা বন্ধ করে গল্প কর। কিন্তু খবরদার কোনও হল্লা যেন না হয়। গোলমাল হলে এসে চাবকাবো। আমরাও সুবোধ বালক, শিক্ষকের কথা শিরোধার্য। শংকর নামে আমাদের এক সহপাঠী, তার কাছে ছিলো সীমাহীন স্বপনসমগ্র। ধর্মক্লাসের ​​​​​​​পবিত্র ​​​​​​​পরিবেশে সে পড়ে শোনাতো দীপক চ্যাটার্জি এবং রতনলালের রোমাঞ্চকর কীর্তিকলাপ। তারা ছিলো দেশি হোমস আর ওয়াটসন জুড়ি। ফর্ম্যাট বিচার করতে গেলে মোটামুটি দস্যু মোহন এবং কিরীটি রায়ের গরিব আত্মীয় বলা যেতে পারে। আমরা এক কথায় পুলকিত। রোমাঞ্চিত হয়ে শুনতাম। যেহেতু 'বিশ্বচক্র' সিরিজের বইগুলো ছিলো 'কঠোর ভাবে' 'কলেজ স্টুডেন্ট’দের জন্য, তাই সেখানে ডিটেক্টিভ ছাড়াও অনেক সুন্দরীদের আনাগোনা থাকতো। থাকতো সুচিত্রার মতো পিয়ানোতে বসা নায়িকা আর কমল মিত্রের মতো পাইপ ও ড্রেসিংগাউন ওয়ালা বাবারা। অধিকন্তু থাকতো যত্রতত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের উদ্ধৃতি (বাঙালির বাজার এতো সুন্দর আর কে বুঝতে পেরেছে?) । গপ্পোগুলো ছিলো মোটামুটি ভাবে শহর কলকাতার সীমারেখার মধ্যে। শ্যামবাজার থেকে বালিগঞ্জের বর্ডার। অবশ্য আফ্রিকার জঙ্গল বা চিনের মরুভূমি, আফঘানিস্তানের পাহাড় বা ব্রাজিলের ক্রাইম সিন্ডিকেট থেকে বিচিত্র লোকজনের আনাগোনাও চলতো সমানে। কিন্তু আমাদের লেভেলের পাঠকদের বাদ দিলে, এই সব চরিত্রের ব্যাপার-স্যাপার খতিয়ে দেখার চেষ্টা ছিলো ভালো রকম 'ইনজুরিয়াস টু হেলথ'। পুলিশের চরিত্রগুলি ছিলো গবেট 'সুন্দরবাবু'র ছাঁচে। এই সিরিজগুলির প্রকাশনা ইত্যাদির অকুস্থল ছিলো বটতলা। সম্ভবত ঝামাপুকুর থেকেও বেরোতো।

মলাট ও ছবি আঁকতেন প্রধানত তুষার চ্যাটার্জি (তুকাচ) । কখনও প্রতুলচন্দ্রের ছবিও থাকতো ( আহা, প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যো , ওঁর মতো ইলাস্ট্রেটর বাংলায় আর আসেননি। হ্যাঁ, আমি সুধীর মৈত্র, পূর্ণ চক্রবর্তী বা নারায়ণ দেবনাথকে স্মরণে রেখেই বলছি)। পরের দিকে আঁকতেন নারায়ণ দেবনাথ। নায়িকাদের যে সব চেহারা বইয়ের মলাটে দেখা যেতো সেগুলি বেশ মনোহরণ। সবারই মুখের ডৌল সুচিত্রা সেনের মতো। তন্বী, পাফ দেওয়া কেশবিন্যাস, লবঙ্গলতা গোছের। চম্পাকলির মতো আঙুল (কেন এরকম বলা হয়, সিম্পলি জানিনা) দিয়ে পিয়ানো বাজাতেন তাঁরা। সচ্চরিত্র নায়করাই তাঁদের বিবাহ করতে পারতেন। সব মিলিয়ে দশ-পনেরো বছর বয়সের উৎসুক বালকদের জন্য সে সব ছিলো খুব উপাদেয় বস্তু। বিশ্বচক্র ছাড়া যে সিরিজগুলো মনে পড়ছে, যেমন, রক্তচক্র সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ, বাজপাখি সিরিজ ইত্যাদি। এই সিরিজগুলোতে নারায়ণ দেবনাথ এঁকেছেন। একটি ডার্ক চরিত্র ছিলো পাগল বৈজ্ঞানিক। যার কীর্তিকলাপ ছিলো টিপিক্যাল জিঘাংসু টাইপের। আর দাড়িটা থাকতো আমার মতো।

শ্রীস্বপনকুমার ​​​​​​​অবশ্য ​​​​​​​সেকালে ​​​​​​​নীহার ​​​​​​​গুপ্তের ​​​​​​​সামনে ​​​​​​​ম্লান ​​​​​​​হয়ে ​​​​​​​যেতেন। নীহার গুপ্তকে বেনামে বই লিখতে হতোনা। নিজের নামে তাঁর একটি বিপুল ও স্থায়ী বাজার ছিলো।‘বাংলা ​​​​​​​সাহিত্যের ​​​​​​​জনপ্রিয়তম’ ​​​​​​​পত্রিকা ​​​​​​​'নবকল্লোলে' তাঁর ​​​​​​​লেখা ​​​​​​​বাঁধা ​​​​​​​থাকতো। আমার ​​​​​​​এক ​​​​​​​বন্ধুর ​​​​​​​মতে ​​​​​​​ঐ ​​​​​​​কাগজটি ​​​​​​​রেশন ​​​​​​​কার্ডের ​​​​​​​থেকেও ​​​​​​​বেশি ​​​​​​​সংখ্যায় ​​​​​​​ছাপা ​​​​​​​হতো। ​​​​​​​অন্য আর ​​​​​​​এক ​​​​​​​জনের ​​​​​​​মতে ​​​​​​​বাঙালির ​​​​​​​সফ্ট ​​​​​​​পর্নো ​​​​​​​পড়ার ​​​​​​​আহ্লাদকে ​​​​​​​বৈঠকখানায় সাজিয়ে ​​​​​​​রাখার ​​​​​​​সুযোগ ​​​​​​​করে ​​​​​​​দিয়েছিলো ​​​​​​​এই ​​​​​​​পত্রিকাটি। গদ্য শৈলীর কথা যদি আসে, তাহলে বাংলা হলুদ মলাট বইয়ের ভাষার ​​​​​​​উৎস আসলে কে ​​​​​​​ছিলেন, স্বপনকুমার ​​​​​​​না নীহার গুপ্ত, ​​​​​​​তা ​​​​​​​নিয়ে অনেক ​​​​​​​মেধাবী ​​​​​​​আলাপও ​​​​​​​চলতো ​​​​​​​সেকালে।

মোদ্দা কথা, যাত্রায় স্বপনকুমার আর গোয়েন্দা চটির স্বপনকুমার আমাদের বাল্যকাল ভরিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের না ছিলো টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট, ফ্ল্যাট বাড়ি, এসি বা বাইকের বিলাসিতা। ভোর ছটা থেকে ইশকুল। বিকেল চারটে থেকে মাঠে ফুটবল আর সন্ধে ছটা থেকে ন'টা দুলে দুলে 'পড়া করা'। উপরি বোনাস, ইশকুল থেকে বাড়ি, সর্বত্র প্রত্যহ মনে করিয়ে দেওয়া, আমরা চরম আবেগে 'উচ্ছন্নে'র পথে ভেসে যাচ্ছি। আজ বুঝছি, স্নেহময় পিতামাতা ও শিক্ষকদের ভবিষ্যদবাণী 'সত্য' প্রমাণ হয়েছে। নয়তো ধর্মক্লাসের সরকারি টেক্স্ট বই স্বামীজীর 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে'র আলোচনা না করে এই বয়সে শ্রীস্বপনকুমারকে নিয়ে এহেন স্মৃতিমেদুরতা কোন প্রবৃত্তিতে আসে? এ কি 'দেশদ্রোহ' নয়? হয়তো এই বিচ্যুতির জন্যই আমাদের না ​​​​​​​হলো ​​​​​​​'দীপক ​​​​​​​চ্যাটার্জি' ​​​​​​​হওয়া। ​​​​​​​না সেই কালজয়ী লেখকের চৌষট্টি পাতা চটির মলাটে আঁকা নায়িকারা আমাদের নসিব হলেন । যাঁরা যোধপুর পার্ক বা নিউ আলিপুর নামক নির্জন পাড়াগুলির বাগান ঘেরা প্রাসাদ আলো করে থাকতেন। আর অর্গান বাজিয়ে গাইতেন,

'স্বপন পারের ডাক শুনেছি
জেগে জেগে তাই তো ভাবি ...'

2 comments:

0

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in







অনেক সময়ই কোন স্থান কিংবা রাস্তার নাম থেকে সেই স্থান বা রাস্তার অতীত সম্বন্ধে জানা যায়। যেমন, আমি যে মফস্বল শহরে থাকি, তার একটি রাস্তার নাম হল –পাকমারা গলি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, ওই অঞ্চলে এক সময় ছিল পাখিমারাদের বসবাস। হতেই পারে। রাজা-রাজড়া, তারও আগে নবাবদের অধীনে ছিল এই অঞ্চল। তাঁরা বসবাস করেছেন যখন পায়রা-বুলবুলি যে উড়বে এই অঞ্চলে এ আর বিচিত্র কি? তাই পাখিমারাদেরও সেখানে বসবাস স্বাভাবিক। পাখিমারা থেকে ক্রমশঃ চলতি কথায় তা রূপ নিয়েছে -পাকমারা। আবার অন্য ব্যাখ্যাও আছে। কেউ কেউ বলছেন,গলিটা সোজা নয়, কয়েক পাক দিয়ে যেতে হয়,তাই পাকমারা। হবেও বা। আবার এই শহরেই অন্য একটি গলির নাম জানতাম—তুলা গলি। কারণ কি? ওই অঞ্চলে নাকি আগে ধুনুরীদের বাস ছিল। বছর তিরিশেক আগেও ওই গলির আশেপাশে সত্যি সত্যিই অনেক লেপ-তোষকের দোকান দেখেছি। ধুনুরীরা লেপ ইত্যাদি তৈরি করত। আজ অবশ্য এসব দেখে বোঝার উপায় নেই। সব ভেঙ্গেচুরে ঝাঁ চকচকে দোকান, নার্সিং হোম তৈরি হয়েছে। সে যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে যাচ্ছে, আসল কথায় আসি।

‘পাখিমারা’, ‘কাকমারা এসব নাহয় শুনেছি কিন্তু ‘হনুমারা’? এ নাম কতজন জানেন জানিনা। কিন্তু অনেকদিন আগে একদল হনুমারাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। শুধু পরিচয় নয়, তাদের কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও হয়েছিল। আজ হনুমারাদের কথা একটু বলি।
.
‘হনুমারা’ নামে যে কোন গোষ্ঠী আছে আমার জানা ছিলনা। বস্তুত, এইনামে কোন দল বা গোষ্ঠীর নাম আমরা কোথাও পাই না। আদিবাসী এই গোষ্ঠীটি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যাযাবর শ্রেণীর। নানা স্থানে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় আবার পছন্দমত জায়গা পেলে দীর্ঘদিন বসবাসও করে। আমি যে গোষ্ঠীটিকে দেখেছি, তারা দীর্ঘদিন ওই একই স্থানে বাস করছে। বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহর থেকে কালনা যাবার যে হাইওয়ে তার আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে আমার এদের সঙ্গে দেখা। মেদিনীগড়, টিকরখাঁজি, নলাহাটি, নলাহাটি সংলগ্ন গঙ্গার চরের আশেপাশেও এদের কয়েক ঘরের বসবাস। এইভাবেই কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এই গোষ্ঠীটির বেশ কিছুজনকে বসবাস করতে দেখেছি। এরা আদিবাসী সমাজভুক্ত, কিন্তু সাঁওতাল নয়। যে ধরনের কাজকর্ম করে, তাতে মনে হয়েছিল এরা বীরহোড় সম্প্রদায়ের কিন্তু তারা নিজেরা বলে তারা ‘হনুমারা’।
বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে কাকমারা, পাখিমারাদের দেখেছি। অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন, নোংরা জামাকাপড় পরনে, শিশুদের তাও নেই, একেবারে উলঙ্গ । সঙ্গে ভাঙ্গা বাসনকোসন, ছেঁড়া বিছানাপত্র যা আছে সব নিয়ে দলবেঁধে দুপুরে গৃহস্থের বাড়িতে কিংবা কোন অনুষ্ঠান বাড়ির আশেপাশে এদের খাবার জন্য ভাত চাইতে দেখেছি। সঙ্গে বাসনকোসন না থাকলে নোংরা শতচ্ছিন্ন কাপড়েই খাবার বেঁধে নিয়ে যেতেও দেখেছি। অভাব, দারিদ্র্যের সঙ্গে স্বভাবও কিছুটা এইরকমই । .
হনুমারা গোষ্ঠীটি ঠিক ততটা না হলেও খুব যে পরিচ্ছন্ন তেমন কথা বলা যায় না। কিন্তু গোষ্ঠীটির নাম’ হনুমারা’ কেন? কেননা, তারা হনুমান দেখলেই পাথর ছুঁড়ে, তীরধনুক নিয়ে তাড়া করে যেভাবেই হোক মারার চেষ্টা করে। গ্রামবাসীদেরই মুখে শোনা এরা আদতে নাকি রাবণের ভক্ত, তাই হনুমান দেখলেই মেরে ফেলে। কারণ সহজেই অনুমেয়, হনুমান লঙ্কা দহন করেছেন, সীতা উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ইত্যাদি। যদিও এই যুক্তির সপক্ষে কোথাও কোন তথ্য পাইনি। তবে গ্রামবাসীদের একাংশ কোন এক সময় হনুমান মেরে ফেলার জন্যই হয়ত তাদের এই নাম দিয়ে থাকবেন। মুখে মুখে বহুদিন ধরে সেই থেকে গোষ্ঠীটির নাম হনুমারাই হয়ে গেছে। বস্তুত,তাদের জিজ্ঞাসা করলেও তারা এখন নিজেদের ওই নামই বলে থাকেন—হনুমারা।
যে সকল গ্রামে তাদের দেখেছি অবস্থা সকলেরই প্রায় একই রকমের। ঘর বা গৃহ বলতে যা বুঝি তেমন কিছু নয়। গ্রামের একপ্রান্তে কোন এক জলাশয়ের ধারে গাছ-গাছালিতে ঘেরা জায়গায় থাকে। একদিকে এবড়োখেবড়ো মাটির দেওয়াল কিংবা কোনো পুরনো বাড়ি থেকে ভাঙ্গা ইঁট তুলে নিয়ে এসে কোনোরকমে একটা দেওয়াল জাতীয় কিছু খাড়া করে তার মাথায় গাছের ডাল,পলিথিন, প্লাস্টিক কিংবা ছেঁড়া চট যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই ছাদ ঢাকা দেয় ও এভাবেই তৈরি করা একটা ঘরে এক একটা পরিবার থাকে। অতজন মিলে কিভাবে থাকে তা সত্যিই বিস্ময়কর। হতদরিদ্র মানুষগুলির কাছে মূল্যবান কিছু থাকতে পারে এমন কথা ভাবাই যায় না। যদিও তাদের বাড়ির আশেপাশে থাকে বেশ কয়েকটি কুকুর। তারা রাস্তার কুকুর হলেও হনুমারাদের বশ্যতা স্বীকার করে।
অনেকের মতে, হনুমারা দলটি আদতে ‘বেদে’ শ্রেণীর। যেমন পাখিমারা, কাকমারাদের দল। হতেই পারে। Risley ‘র ‘ Tribes and Castes of Bengal’ বইতে তিনি বেদেদের সম্বন্ধে লিখছেন--- Bediya, the generic name of a number of vibrant gypsy-like groups, of whom it is different to say whether they can properly described as castes.’
বস্তুতঃ, বেদেদের জীবনযাপনের প্রণালীর ওপর নির্ভর করেই তাদের নামকরণ। যেমন—পাখিমারা কাকমারা ইত্যাদি। সুতরাং এই গোষ্ঠটির নামও যে ক্রমে ক্রমে ‘হনুমারা’ হতে পারে, এটি স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।
খাদ্যদ্রব্য বলতে ভাতই প্রধান খাদ্য। তবে খুবই গরীব বলে ভাতের ব্যবস্থা সব সময় থাকেনা। গরু, মোষ, ছাগল, শুয়োর, বনবিড়াল,পাখি সব ধরনের মাংস এরা খায়। গ্রামবাসীদের কাছে শোনা এরা হনুমানের মাংসও খায়। সত্যি কি মিথ্যা জানা নেই।
অনাহার, অপুষ্টি, চিকিৎসা সম্বন্ধে অজ্ঞানতা এদের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলে খুব বেশিভাবে। আর আছে অবাধ যৌনতা। গোষ্ঠীতে যখন যার সঙ্গে থাকার ইচ্ছে, তার সাথেই জীবন কাটানো এদের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। ফলে প্রায় প্রতি বছরই শিশুদের জন্ম এবং প্রায় প্রতি বছরই শিশুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আবার গর্ভধারণ এদের অবাধ যৌনতার ফল। যদিও বিবাহ নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই হয়। কিন্তু প্রয়োজনে বা ইচ্ছা হলে স্বামী ছাড়া গোষ্ঠীর অন্য পুরুষমানুষের কাছে যেতে কোন দ্বিধা করে না। নারী-পুরুষ নির্বিচারেমদখেয়ে পড়েথাকে। মদ খাবার জন্য কি আকুলি-বিকুলি! তার জন্য টাকা-পয়সা চাইতেও দেখেছি। মেয়েদের শরীর অসুস্থ, শিশুদের মৃত্যু এসব হলেও তার প্রভাব জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। তবে সভ্য সমাজের কাছাকাছি ও পাশাপাশি থাকার ফলে কিছু উন্নতি দেখা যাচ্ছে, এটুকুই আশার কথা। অন্তত, অপেক্ষাকৃত যুবতী এবং এই প্রজন্মের মেয়েরা স্বাধীন হলেও জীবনের লাগাম কিছুটা টেনে রাখতে শিখেছে। সমাজও সংসারে নারীর প্রাধান্যই বেশি বলে মনে হয়েছে।
মির-শিকারীদের মত এরাও সুতো বা দড়ি দিয়ে নানা ধরনের কাজকর্ম করতে পারে যা শিকার করার পক্ষে উপযুক্ত। হাঁড়ি বা ভাঁড় টাঙ্গিয়ে রাখার জন্য দড়ির ‘শিক’ তৈরি করতে পারে। কিন্তু এসব হাতের কাজ তৈরি করলেও তা বাজারে বিক্রি করে উপার্জনের পথে তারা খুব একটা যায় না। অর্থাভাব অনুভব করলেও উপার্জনে সক্ষম নয়,অনীহাও আছে। দরিদ্র হলেও তাদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তি নেই,যা তাদের একটি বড় গুণ।
মৃত্যুর পর দাহ করার রীতি ওদের সমাজে থাকলেও অর্থাভাবে কবরই বেশি দিয়ে থাকে। সবচেয়ে মজার কথা, হনুমান সংক্রান্ত যে সকল ব্যাখ্যা বা মুখে মুখে চলে আসা গল্প-কাহিনি গুলি শোনা যায় এখন তারাও সেগুলি অস্বীকার করে। হয়ত সভ্য সমাজের কাছাকাছি থাকার ফল। তবে ইতিমধ্যেই মেদিনীগড় নামে একটি গ্রামের হনুমারার দল ইতিমধ্যেই অন্যত্র চলে গেছে। অর্থাৎ যাযাবর বৃত্তি তাদের মধ্যে এখনও আছে।

আদতে বেদে সম্প্রদাভুক্ত হনুমারা নামক আদিবাসী গোষ্ঠীটির বৈশিষ্ট্য এখনও বর্তমান।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






উনবিংশ শতকের বাংলায় যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও মহিমাময় ঘটনাটি ঘটেছে বলে আমরা ধন্য, তা হল শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অধ্যাত্মজগতে পদার্পণ। অদ্ভুত, অলৌকিক, অবতার, ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত করে তাঁকে ঠেলে দূরে সরিয়ে না রেখে বরং একান্ত আত্মজনের মতন হৃদয়ে ধরলে আমরা এক এমন মানুষকে আমাদের মধ্যে পাব, যিনি প্রেমে ভালোবাসায় আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই অমৃতলোকে যেখানে তাঁর নিজের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। না, তাঁর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তিনি একক। তিনি অনুপম। ভালোবেসে তাঁকে অনুসরণ করা চলতে পারে, কিন্তু তাঁকে কোনো গণ্ডিতে বা গোষ্ঠীতে আবদ্ধ করা মূর্খের কাজ। তিনি সার্বজনীন। সর্বকালের।

আসুন, তাঁকে ফিরে দেখি।

ঈশ্বরতত্ত্ব এমনই তত্ত্ব যা মানুষ বিনা ধারণা হয়না। এরকমই একটি সত্যের প্রকাশ করেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন একনিষ্ঠভাবে শুধু ঈশ্বর অনুভবেই পূর্ণ। জাগতিক আর যা কিছু আমরা মনে করে থাকি, বা বলা ভালো আমাদের ভাবনার ভুলে, মনে করি আবশ্যক, সেসব তাঁর জীবনে অনাবশ্যক। বেঁচে থাকতে গেলে যতটুকু ব্যবহারিক জীবন প্রয়োজন সেটুকুই ছিল তাঁর। তাই বলতেন, আমি খাই দাই আর থাকি। আমি খাই দাই আর মায়ের নাম করি। মা মানে ঈশ্বরী, সগুণ ব্রহ্ম। তিনি বলছেন, ম মানে ঈশ্বর, রা মানে জগৎ। আগে ঈশ্বর পরে জগৎ। ‘মরা’ ‘মরা’ শুদ্ধমন্ত্র ঋষি দিয়েছেন বলে। এই ম’য়ে আকার দিলে মা। নিরাকার ব্রহ্ম সাকার হলেন। সাকার কী রূপে? মানুষের রূপে। কারণ, মানুষই একমাত্র ঈশ্বর চিন্তা করতে পারে। হাতি এত বড়ো জন্তু কিন্তু ঈশ্বর চিন্তা করতে পারেনা। পারে কেবল মানুষ। এ এক অভিনব ঘটনা। এমন শ্রেষ্ঠ প্রাণী কিনা পাশবিক কর্মে লিপ্ত থাকবে? তাই হয়? তাই মুক্তকণ্ঠে বলছেন – মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর দর্শন। তারপর আর একটু এগিয়ে বলছেন – মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। শুধু দর্শন করলেই হবেনা। লাভ করতে হবে। শুধু দেখলে কী হবে? তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে হবে। ক্রমে তিনি বুঝিয়ে দেবেন, তুই আর আমি কি আলাদা? আমরা তো এক! ঠাকুর গল্পের ছলে জানিয়ে দিচ্ছেন গভীর সত্য। বাবুর কাছে গিয়ে কেউ চুপ করে একদিকে দাঁড়িয়ে। তার বাবুর কাছে চাইবার কিছু নেই। সকলেই এটা ওটা আর্জি নিয়ে এসেছে। বাবু নায়েবকে হুকুম করছেন সেসব মিটিয়ে দিতে। হঠাৎ চোখ পড়ল এই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে। বললেন, কি গো কি চাই? সে বলল – কিছু চাইনা। সে শুধু বাবুকে দেখতে এসেছে। সে বাবুকে ভালোবাসে কিনা, তাই দেখতে এসেছে। বাবু তখন নির্জনে তাকে ডাকলেন আর কাছে বসালেন। বললেন – নে এখানে বোস। তুই আর আমি কি আলাদা? অতএব ঈশ্বরলাভ মানে মানুষটা নিজেই ঈশ্বরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সেই অনন্য অনুভূতির প্রকাশ ঘটছে যখন তিনি বলছেন, যে জ্ঞানী সে শুধু জেনেছে ঈশ্বর আছেন, আর যে বিজ্ঞানী সে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছে। এখন আলাপ হয় কী করে? দর্শনই যেখানে দুঃসাধ্য! কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের সামনে অতি সরল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন পরমতত্ত্ব। প্রথমে ঠাকুরের কথা ধরে চলে যাই সেকথায়। তারপর গভীর কথাটি উপনিষদের আলোয় যাচাই করা যাবে। ঠাকুর নিজেই যেখানে বলছেন – আমার কথার দুটি অর্থ, শব্দার্থ আর মর্মার্থ। মর্মার্থটাই লও না কেন? তাই তাঁর কথার খেই ধরে প্রবেশ করি তাঁর অধ্যাত্ম চিন্তার জগতে।



পণ্ডিত শশধর তর্কবাগীশের দাদা ভূধর এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। তিনি মায়ের মূর্তি দেখে আনন্দ প্রকাশ করছেন। বলছেন, শুনেছি নবীন ভাস্করের নির্মাণ। ঠাকুর তার উত্তরে বলছেন – তা জানিনে, জানি মা আমার চিন্ময়ী। অর্থাৎ, ঠাকুরের মা জ্যোতির্ময় আলোকে তাঁর অন্তরে প্রকাশ পান। এ জ্যোতি বাইরে থেকে আসেনা। আসে ঠাকুরের মধ্যে থেকেই। সেই জ্যোতির্ময়ী প্রতিমা সপ্রাণ। সেই মূর্তি বাইরের প্রস্তরমূর্তিতে প্রতিফলিত হয়। ঠাকুর দেখেন মৃন্ময়ী প্রতিমা চিন্ময়ী হয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। রঙ্গ করছেন। এই উন্মেষ কীভাবে হয়? ঠাকুর বলছেন, মা চাইলেই হয়। আমরা চাইলে হয়না। ছোটো ছেলে নতুন কাপড় পরে সকলকে দেখাচ্ছে আর বলছে আমার বাবা দিয়েছে। সকলেই তাকে মজা করে বলছে, কাপড়খানা দাও। সে দেবেনা। বলছে, উঁ, আমার বাবা দিয়েছে। এখন একজন চুপ করে বসে ছিল। সে চায়নি, কিন্তু ছেলে তাকেই কাপড় দিল। এই যে না চাইতেই পাওয়া, এই ধর্মলাভ, ঈশ্বর লাভ। কিছু করে পাওয়া যায়না। ঠাকুরের কথা- বিজয় তুমি হাজার চেষ্টা করো, তাঁর কৃপা ব্যতীত কিছুই হবার নয়। আবার তাঁর কৃপা হলে ‘হাজার বছরের অন্ধকার ঘর এক নিমেষে আলো হয়। একটু একটু করে হয় কি?’ তাহলে কথাটা ‘কৃপা’। কৃপার অর্থ আপনা থেকে হওয়া। স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।

সাধনা করে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়না। সাধনা একরকম অহংকারের জন্ম দেয়। ‘কি? আমি এত জপ করেছি, অত পুরশ্চরণ করেছি!’ অহংকার জ্ঞানের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা। যেকোনো কিছু শিখতে চাইলে আগে ছাত্র হতে হয়। তাহলে এত যে গুরু চারিদিকে? ঠাকুর নিজেও কি আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন না? এইখানে জানার কথাটা এই যে, ঠাকুর তাঁর জীবনে কাউকে কোনোরকম দীক্ষা দেননি। মন্ত্র তো নয়ই, খুব বেশি হলে পাত্র বুঝে শাক্তি করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দিই বরং। প্রথমটি অবশ্যই শ্রদ্ধেয় স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি নরেনের বুকে পা দেওয়াতে নরেনের সামনে থেকে জগৎ অন্তর্হিত হয়ে গেল। এক অস্বাভাবিক ঘূর্ণনের মধ্যে তাঁর নিজের অস্তিত্ব যেন পাক খেতে লাগল। সে নিজেকে খুঁজে না পেয়ে আর্তস্বরে বলে উঠল – ওগো আমার যে বাপ মা আছে, এ তুমি কি করলে? তাহলে স্বামীজির মতন আধারও এই শক্তিসঞ্চারের জন্য প্রস্তুত ছিল না! দ্বিতীয় উদাহরণ পণ্ডিত শ্যামাপদ ভট্টাচার্যর। তাঁর মনে দুঃখ ছিল, ঠাকুর কেন নরেনের মতন তাকেও ছুঁয়ে দিলেন না। ঠাকুর তাই তাকেও দিলেন। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম পণ্ডিত মশাই দুঃখ করছেন – কই নরেনের মতন তো আমার কিছু হলনা? তৃতীয় উদাহরণ রাখাল মহারাজ ওরফে শ্রদ্ধেয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজ। ঠাকুর তাঁর জিভ টেনে ধরে কি যেন লিখে দিলেন। নাহ, কিচ্ছু লেখেননি। এও শক্তিই সঞ্চার করলেন। ফল জগতে প্রকাশিত।

একটু বরং দেখা যাক, ঠাকুর যা চাইলেন তাঁর সঙ্গকারীরা সেদিকে কতটা অগ্রসর হতে পারলেন। ঠাকুরকে গুরু হতে বললে তিনি বলতেন, ‘গুরু বাবা কর্তা এই তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা দেয়। গুরু এক সচ্চিদানন্দ। সচ্চিদানন্দ বই গতি নাই। গুরুগিরি বেশ্যাগিরি। যারা শিষ্য করে বেড়ায় তারা হালকা থাকের লোক। আমার কোনো শালা চেলা নেই’। এই সমস্ত কথার মধ্যে প্রমাণিত ঠাকুর জগতে প্রচলিত গুরুশিষ্য পরম্পরা অস্বীকার করছেন। প্রচলিত ধর্মের সংস্কার ত্যাগ করছেন। তাঁর কথা অনুসারে দেহস্থ চেতনাই শুদ্ধ হয়ে ঈশ্বরে পরিবর্তিত হয়। সেখানে বাইরে থেকে কারুর প্রয়োজন নেই। এমনকি, ধর্মকথায় তিনি সেবা দান আদি পুণ্যকাজেরও অবদান অস্বীকার করেছেন। তিনি শম্ভু মল্লিককে বলছেন – ঈশ্বর যদি তোমার সামনে এসে দাঁড়ান তাহলে কি তুমি কতগুলো হাসপাতাল ডিসপেনসারি চাইবে? বলছেন – সেবা যারা করবে তারা অন্য থাকের লোক। অর্থাৎ তাদের ঈশ্বরতত্ত্ব ধারণা হবেনা। অথচ আমরা জানি যে, ঠাকুর ধর্মসম্পর্কে ইতিবাচক কথাই বলে গেছেন। তাঁর কথায় – দুটো আছে। অস্তি আর নাস্তি। অস্তিটাই লও না কেন?

তাহলে তিনি অস্তিবাচক কি দিলেন? তিনি বললেন – জগতে একরকমের মানুষ জন্ম নেয়। এরা যেন হোমাপাখি। এ পাখি আকাশে থাকে। সেখানেই ডিম দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। বাচ্চা মাটিতে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে তার চোখ ফোটে। সে যেই দেখতে পায় যে সে মাটিতে পড়ছে, আর মাটি গায়ে লাগলেই দেহ চুরমার, তখনই সে প্রাণপণে ওপরে উঠতে চেষ্টা করে। তার ডানা মেলে সে উড়তে থাকে ওপরে। সেই হোমাপাখির মতন মানুষও এই পার্থিব মায়ায় আটকায় না। সে জন্মেই এমন মাথা নিয়ে জন্মায় যে মায়ায় আটকানোর আগেই তার মন উর্দ্ধমুখী। সে চোঁ চা করে উঠতে থাকে। যতক্ষণ না তার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। আবারও বলি, ঠাকুরের মা কোনো প্রতিমা নয়, মা মানে সাকার ঈশ্বর। ঠাকুর তাই কেশবচন্দ্র সেনকে বলছেন – তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো আমি তারেই মা বলে কই। এখন সবাই তো হোমাপাখি হয়ে জন্মায় না। যার পূর্বপুরুষের অর্জিত সংস্কার মস্তিষ্কে যেমন ছাপ ফেলে সে সেই অনুপাতে প্রাণশক্তির উন্মেষ ধারণা করতে পারে।

কিন্তু এর ওপরের কথাটা ঠাকুর যা বললেন তা হল, হোমাপাখি বা নিত্যসিদ্ধ ছাড়াও কয়েকরকমের সিদ্ধি হয়। তিনি যে আরও সিদ্ধির কথা বলেছেন সেগুলো হল, স্বপ্নসিদ্ধ, হঠাৎসিদ্ধ, ধ্যানসিদ্ধ, কৃপাসিদ্ধ, এবং সাধনসিদ্ধ। ঠাকুরের কথায়, ‘হঠাৎসিদ্ধ কিনা – গরিবের ছেলে বড় মানুষের নজরে পড়ে গেছে। বাবু তাকে মেয়ে বিয়ে দিলে। সেই সঙ্গে বাড়ি ঘর গাড়ি দাস দাসী সব হয়ে গেল’। এর মর্মার্থ কী? বাবু – ভগবান। মেয়ে বিয়ে দেওয়া – দেহের মধ্যে ভাগবতী তনু, যা ঈশ্বর অনুভবের অপরিহার্য অঙ্গ। বাড়ি – ভূমি বা চক্র। সাততলা। সপ্তভূমি। ঘর – প্রতি ভূমির অনুভূতি। গাড়ি – অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি বা কুণ্ডলিনীর উর্দ্ধগতি। দাস – ইন্দ্রিয় দাস। দাসী – মায়া দাসী। স্বপ্নসিদ্ধ হল সে যার স্বপ্নে ঈশ্বর অনুভূতি হয়। ঠাকুর পূজনীয় মাষ্টারমশাই, কথামৃতকার শ্রীম’কে বলছেন – স্বপ্নে যদি আমাকে শিক্ষা দিতে দেখো, জানবে সে সচ্চিদানন্দ। মাষ্টারমশাই একবার বলছেন, তিনি একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি দেখেছেন একটি নদীতে অসংখ্য জাহাজ। সেগুলি ডুবে যাচ্ছে। তিনিও একটি জাহাজে। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ তাঁকে বললেন, এই আমি যাচ্ছি দেখো। জলের তলায় ধাপ আছে। তুমি আমাকে অনুসরণ করে চলে এসো। এই স্বপ্ন শুনে ঠাকুর বলেছিলেন যে তাঁর রোমাঞ্চ হচ্ছে। স্বপ্নটি শ্রদ্ধেয় মাষ্টারমশাইয়ের আসন্ন আধ্যাত্মিক বিকাশের ইঙ্গিত। এরকম স্বপ্নের কথা কথামৃতয় অনেক আছে। ঠাকুরের একটি মার্কামারা কথাই হল – স্বপ্নসিদ্ধ যেই জন মুক্তি তার ঠাঁই। ধ্যানসিদ্ধও অনুশীলনের নয়। যে ধ্যানসিদ্ধ তার আপনা থেকে ধ্যান হয়। যেমন, একটা ময়ূরকে রোজ বিকেল চারটের সময় আফিম দেওয়া হতো। সে তারপর রোজ বিকেল চারটে বাজলেই আফিমের আশায় চলে আসত। আফিমের এই ঘড়িধরা আমেজ হল ধ্যানসিদ্ধের উপমা। যে ধ্যানে সিদ্ধ তার আপনা থেকে দিনের নির্দিষ্ট সময় চোখ বন্ধ হবে ধ্যানে। আমরা স্বামীজির জীবনে এর উপমা পেয়েছি। কৃপাসিদ্ধ যেন আনকোরা একজন যে ধর্ম বা অধ্যাত্মচেতনা সম্পর্কে একেবারেই অনভিজ্ঞ। যেমন কেউ অমৃতসাগরের পারে এসেছে। কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। সেই ধাক্কায় সে অমৃত লাভ করল। এখন ধাক্কা কে দেয়? সচ্চিদানন্দ দেন, ঠাকুরের আশ্বাস। সাধনসিদ্ধের উপমা দেবার সময় ঠাকুর দুই বন্ধুর গল্প বলেছেন। গভীর বনে দুই বন্ধু শব সাধনা করতে গিয়েছে। সব উপচার প্রস্তুত। এমন সময় বাঘ পড়ল। এক বন্ধু সবে আয়োজন সেরে জপে বসতে যাবে। আর একজন বাঘ দেখে গাছে চড়ে বসল। যে আয়োজন করছিল বাঘ তাকে টেনে নিয়ে গেল। আর যে গাছে ছিল সে তখন নেমে শবের ওপরে বসে ধ্যান শুরু করল। তখনই সে মায়ের দেখা পেল। কিন্তু তার মনে দুঃখ। সে জিজ্ঞেস করল – মা, সে সব আয়োজন করল আর তাকেই কিনা বাঘে নিলো? আমি তো কিছুই করিনি। সাধন ভজনহীন। আমাকে কেমন করে দর্শন দিলে? মা হেসে বললেন – বাবা তোমার আর জন্মে সব করা ছিল। দেখা যাচ্ছে, ঠাকুর সাধনসিদ্ধের কথাতেও কৃপার কথাই বলছেন। সুতরাং কৃপাই যে সিদ্ধির উৎস এটি তাঁর অনুভব।

এসব কথার মধ্যে থেকে তাঁর গভীর ঈশ্বরচেতনার একটি খণ্ডচিত্র পাই। সম্পূর্ণ পাওয়া সম্ভব নয়। তাই একটু ভেতরে ডুব দিয়ে দেখা যাক, তাঁর কথার মধ্যেকার সারকথা কি। তিনি তো শাস্ত্র আলোচনার প্রয়োজনীয়তাকেও গৌণ বলছেন! ধ্যান জপও পথ নয়! যদিও ঘটি সোনার হলেও রোজ মাজতে হয় বলে তিনি অনুশীলনের কথা বলেছেন, তবু একে কখনই ঈশ্বরলাভের পথ বলেননি। অথচ যখন তিনি বলছেন, প্রতিমায় ঈশ্বরের পুজা হয় আর মানুষে হয়না? তখন বুঝতে পারছি যে মানুষকে তিনি ঈশ্বরের আসনে বসাচ্ছেন। যে মানুষ বিকশিত উদ্ভাসিত, সে মানুষ নিজেই ঈশ্বরত্বলাভ করে ঈশ্বর হয়েছে। এই ঈশ্বরত্বলাভ হয় কখন? যখন একটা মানুষ স্তরে স্তরে পাশব মানবিক ও বৌদ্ধিক চেতনা থেকে উন্নীত হয়ে ঐশ্বরিক চেতনায় স্থিত হয়। তখন তাঁর ইন্দ্রিয়সকল অন্তর্মুখ হয়ে তাঁকে পার্থিব স্থুল চেতনার স্তর থেকে মুক্তি দেয়। বার দুয়ারে তালা পড়ে – ঠাকুরের কথা। তখন কি সেই মানুষটা জগতের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে জগতকে হীন মনে করে? না, সে তখন গোটা জগতকে নিজের মধ্যে অনুভব করে। ঠাকুর বলছেন – বেলের শাঁস খোলা বিচিসহ গোটা বেল। সব জড়িয়ে এক। জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। জগৎকে নিজের মধ্যে পেলে সেই একাত্মতা তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত প্রেমের জন্ম দেয়। রস। সেই প্রেমের চিহ্ন স্বরূপ সেই মানুষটা জগতের সব মানুষকে আপন শুধু নয়, এক মনে করেন।

এবার উপনিষদের আলোয় দেখি পরমহংসদেবকে।

আমরা জানি, যে কোনও ধর্মের মূল উদ্দেশ্য ঈশ্বরদর্শন ও ঈশ্বরলাভ। এ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি তাই অতীতের ধর্মইতিহাস জানতে, অধ্যাত্মবিজ্ঞান জানতে শাস্ত্র পড়ে। শাস্ত্র তাই ঈশ্বর চেতনার পাঠ। শাস্ত্র আলোচনা এই অনুশীলনেরই একটা পর্যায়। শাস্ত্রে স্বাভাবিক ভাবেই অনুসন্ধান চলে যে কীভাবে সেই পরমরূপ কে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। ও তাঁকে লাভ করতে পারি। এযাবত বহু চেষ্টায়ও সেরকম কোনও নির্দিষ্ট পথের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কাল্পনিক ভক্তের ভগবান গোছের রূপের কথা এখানে হচ্ছেনা। যদিও ঠাকুরের অর্ধবাহ্য দশায় এমন ভক্তির প্রাবল্য অনেককে মুগ্ধ করেছে, তবু বলি, এ তাঁর প্রাণের সঙ্গে খেলা। কোনো দ্বিতীয় অস্তিত্ব এখানে নেই। তাঁর প্রাণের রূপ। যে রূপ স্বতোৎসারিত এবং স্বয়ংপ্রভ সেই রূপের কথা হচ্ছে। মানুষের কল্পনা রূপধারণ করতে পারে। তাকে পরম সত্য বলা যায়না। কারণ সত্য সকল কালে এক। আর কল্পনার মূর্তি নানা। আর তাইতেই যত ভেদাভেদ। উপনিষদ বলছেন, হিরন্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখ আবৃত। অর্থাৎ সত্য আছেই। তা সোনার পাত্রে ঢাকা। সোনার থালার রূপকটি কে সরল করতে চাইলে ভাবা যেতে পারে এটি দেহের কোনও অংশের একটি আবরণ। যেহেতু আমাদের অনুভূতি ও উপলব্ধির কেন্দ্র মস্তিষ্ক সেহেতু এমন ধরে নেওয়া ভুল নয় যে মস্তিষ্কের সেই মূলকেন্দ্রটি সোনার থালায় ঢাকা। কেন সোনার থালা? কারণ তা জ্যোতির্ময়, যেমন সূর্য। এই আবরণটি সরে গেলে উন্মোচিত হবে তৃতীয় নয়ন। এরপর উপনিষদ বলছেন – কেমন হবে সেই পুরুষের রূপ? তিনি অণু হইতেও ক্ষুদ্রতর আবার মহৎ হইতেও মহত্তর। শ্বেতকেতু আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, কি করে অণুপরিমাণ ও নামরূপ বিহীন আত্মা হতে এই সুবিশাল জগত উৎপন্ন হতে পারে? উত্তরে তাঁর পিতা বলছেন, বীজের সূক্ষ্ম অংশ থেকে যেমন বিশাল বটবৃক্ষ জন্মায় তেমন নামরূপবিহীন সূক্ষ্ম কারণ হতে এই জগত সৃষ্ট। এখানে দ্রষ্টব্য যে এই পরম কারণকে নামরূপবিহীন বলা হচ্ছে। তাহলে তাঁকে দর্শন করা যায় কিরূপে? উপনিষদ বলছেন পরমজ্যোতি রূপে। বলছেন সম্প্রসাদ, অর্থাৎ যিনি আত্মার প্রসন্নতা লাভ করেছেন, নিজের দেহ থেকে উত্থিত হয়ে পরমজ্যোতি রূপে সঙ্কলিত হবেন। দেহ থেকে উত্থিত হয়ে সঙ্কলন ঘটবে হিরন্ময় পাত্রে। সমস্ত দৈহিক চেতনা সঙ্কলিত হবে মস্তিষ্কে। জ্যোতি রূপে। অর্থাৎ আলো রূপে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, একজন এমন ব্যক্তি যার দেহের প্রতিটি কোষ অটুট, তাঁর প্রতি কোষের থেকে প্রাণশক্তি সঙ্কলিত হয়ে মেরুদণ্ডস্থিত প্রধান স্নায়ুসূত্রটির (সুষুম্না) মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে আসবে। যেহেতু মস্তিষ্কই দেহকে চালনা করে ও সমস্ত রকমের অনুভূতি ও উপলব্ধির কেন্দ্রও মস্তিষ্ক, সুতরাং এই সঙ্কলিত জ্যোতিকে মস্তিষ্কে সঙ্কলিত হতে দেখা যায়। কেমন করে? মস্তিষ্কের পিনিয়ান গ্ল্যান্ড যেখানে অবস্থিত সেটিকেই তৃতীয় নয়ন বলা হয়। মাথাকে যদি একটি বৃত্ত ভাবা যায়, তবে যে কোনও দিক থেকে একটি শলাকা তার কেন্দ্রে প্রবেশ করালে সেখানে ছোঁবে সেটিই তৃতীয় নয়ন। যদি সংশয় হয় যে এভাবে প্রাণশক্তিকে কি করে দেখা যায়, তাহলেও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ মাত্রেই জানবেন যে শক্তির একটি মাত্র প্রকাশই দেখা যায়। সেটি হোল আলো। এখন আলোর দ্বৈতসত্ত্বা আছে। শক্তি ও পদার্থ দুইই। উপনিষদ অনুসারে আলোর শক্তিসত্ত্বা সঙ্কলন শেষে পদার্থসত্ত্বা রূপে মস্তিষ্কে ধরা দেয়। প্রশ্ন হোল এই যদি হয় ঈশ্বরের জ্যোতির্ময় রূপ তবে তা আমাদের পরমপুরুষ প্রেমাস্পদ হবেন কেমন করে? আমাদের কল্পনার ইষ্টকে এখানে সযত্নে আলোচনার বাইরে রাখতে হবে। এ প্রশ্নের উত্তর ও উপনিষদে আছে। উপনিষদ বলছেন এই পুরুষ সহস্রশীর্ষ, সহস্র চক্ষুবিশিষ্ট। বাস্তবে এমন একটি পুরুষের কল্পনাও তো ভয়াবহ! এই রূপকটি কে সুতরাং ভাঙ্গা দরকার। হাজারটা মাথা বা হাজার হাজার মাথা হতে হলে হাজার হাজার মানুষ চাই। হাজার হাজার মানুষ অর্থাৎ জগতের মানুষ। অতএব উপনিষদ বলছেন জগতের প্রতিটি মানুষের সম্মিলিত প্রাণই ঈশ্বর। কোনও মানুষই এই বিশ্বব্যাপী অস্তিত্বের বাইরে নয়। সর্বব্যাপী সঃ ভগবান, তস্মাৎ সর্বগত শিবঃ। তাহলে তো এই বিশ্বব্যাপিত্বের উপলব্ধি একক মানুষে সম্ভব নয়। না তা কিন্তু নয়। একক ব্যাক্তিও এই বিশ্বপ্রানের উপলব্ধির অধিকারী। বিশ্বরূপ দর্শনের যে কথাটি আমরা জানি তা হোল এই, আত্মস্বরূপের মধ্যে প্রকাশিত বিশ্বস্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ হাঁ করলেন। তাঁর তালুর মধ্যে বিশ্বকে দেখলেন মা যশোদা। উপনিষদ বলছেন তালু থেকে লম্বমান মাংসপিণ্ডের অপর পারে সেই দ্বার। আঘাত করলে খুলে যাবে। তালুর অপর পিঠেই সহস্রার। মস্তিষ্কের সকল অনুভূতির কেন্দ্র। এই বিশ্ব প্রাণ উপলব্ধির ফলে ব্যাক্তি প্রাণে যে পরিবর্তন আসে তা বিস্ময়কর। ব্যাক্তি প্রাণ আর তখন কোনও দেহবদ্ধ চেতনা নয়। সে তার প্রাণে জগদপ্রাণ কে উপলব্ধি করে। অনুভব করতে পারে – আমি ও আমার সামনে এই জগত আসলে এক। আর এই অনুভূতির ফলে তার প্রকৃত ঈশ্বর চেতনার বিকাশ হয়। উপনিষদ বলছেন সঃ অহম। সঃ, সেই বিশ্বপ্রানই আমি। ‘আমি’ ছাড়া আর কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই। অদ্বিতীয়, অনুপম। একমেবাদ্বিতীয়ম। সঃ একঃ। দ্বিতীয় না থাকলে ভয় নেই, ঈর্ষা নেই, ক্ষমতার লড়াই নেই। অভয়ং বৈ জনক প্রাপ্তোহসি। জনক তুমি অভয়পদ প্রাপ্ত হইয়াছ। জনক - সত্যের জনক। জনক পুরুষ। পিতা তো পুরুষই হবেন। বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মহীরুহের মতন এই বিশ্ব সেই পুরুষের বীজেই নিহিত। অতীত, আগত ও অনাগত সমস্ত অস্তিত্ব এই বিশ্ব প্রাণে লুকিয়ে আছে। ইনিই ব্রহ্ম। যতক্ষন না এই বিশ্বপ্রানের সঙ্গে বা জনকের সঙ্গে একত্ব অনুভব করছি ততক্ষণ ব্রহ্মকে জানা হলনা। যেমন যীশু বলছেন I and my Father in heaven are but One। তাই এঁকে জানা না হলে ভালবাসা তো দুরস্থান। ভালবাসা কথাটির মধ্যে দ্বৈতবোধ আপাতদৃষ্টিতে প্রবল ভাবে বর্তমান। তুমি একটি ও আমি একটি। ভালবাসার পাত্র না হলে সে ভালবাসা কাকে দেওয়া যায়? কিন্তু এ হোল ভালবাসার অতি সাধারণ ধারণা। আত্মরতি বলে যে কথাটি বৈষ্ণব শাস্ত্রে বহুল প্রচলিত তার ব্যাঞ্জনা কিন্তু অসাধারণ। শ্রীরাধা তাঁর দেহসমেত শ্রীকৃষ্ণে পরিবর্তিত। নিজের আমি খুঁজে পাচ্ছেননা। তিনি নিজেই ঈশ্বরে পরিবর্তিত হয়ে আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়েছেন। বলা বাহুল্য এ শুধু আলোচনার খাতিরে। কারণ শাস্ত্রের ব্যাখ্যা স্বয়ংবেদ্য। তবে এই আলোচনা কেন? কারণ অনুশীলন। কে হবেন স্বয়ংবেদ্য? উপনিষদ বলছেন নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য, ন মেধয়া, ন বহুনা শ্রুতেন, যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্য, স্তস্যৈষ আত্মা বিবৃনুতে তনুং স্বাম। অর্থাৎ শাস্ত্র পড়ে, সাধন করে আত্মাকে জানা যায়না। আত্মা যাকে বরং করেন তাঁরই হয়। এই প্রেক্ষিতে একটি কাহিনীর অবতারণা করা চলে। শ্রীরামানুজ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের জনক। জীবজগৎবিশিষ্ট সর্বব্যাপী ব্রহ্মত্বের ধারণার জনক। ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত পরমাত্মার রূপ বর্ণনাকালে তাঁর গুরু শ্রীযাদবপ্রকাশ ব্যাখ্যা দিলেন, তাঁর রূপ বাঁদরের পশ্চাদ্দেশের ন্যায়। কপ্যাসং। কপি - মর্কট। আসম – পশ্চাদ্দেশ। রামানুজ এই বর্ণনা শুনে কেঁদে ফেললেন। পরম প্রেমাস্পদের রূপের এমন কদর্য তুলনা? যাঁকে মনে পড়লেই তিনি আনন্দসাগরে ভাসেন, কারণ রসো বৈ সঃ – তিনি রসস্বরূপ, তাঁর মুখের এমন তুলনা! গুরু জানতে চাইলেন তবে কি রামানুজ অন্য কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেন? রামানুজ এমন এক ব্যাখ্যা দিলেন যা একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। কি সে ব্যাখ্যা? কপি – অর্থাৎ বাল সূর্য। আসম – জলকণা। কপ্যাসং অর্থ ব্রহ্মের রূপ সেই উদীয়মান বাল সূর্যের ন্যায় যিনি জলকনা পান করেন। দিনের প্রারম্ভে প্রকৃতি জুড়ে যে হিমকণা থাকে, দিনের প্রথম সূর্যকিরণ তাকে পান করে। এই সময়ে সেই অরুণকান্তি সূর্যের রূপ ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনীয়।

উপরের পর্বের আলোচনাটি শ্রীরামকৃষ্ণের অধ্যাত্মচিন্তার আলোয় লিখিত। যাতে করে জ্ঞান ও ভক্তির একটি সাযুজ্য পাওয়া যায়। ঠাকুরের উদ্ধৃতি উহ্য রেখে আলোচনা করলেও মূল উদ্দেশ্য তাঁকেই প্রকাশ করা। কারণ তিনি যে বলেছেন – না দেখলে ভালোবাসবি কাকে? ক্ষুদ্র অনুভবে তাঁকে ধরা একরকম বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতন। তবু প্রকাশ করতে ইচ্ছে হয়। যাকে বয়ে চলেছি এই দেহের মধ্যে তিনি যদি নিজেকে জানান দেন তবে যে কী পরিমাণ আনন্দ জাগে তা বর্ণনার অতীত। আবার অদ্বৈতবাদে বলতে হলে, নিজের এই পরিবর্তন, নিজের অস্তিত্বের এই ঈশ্বরত্বের বিকাশে ক্ষুদ্র অস্তিত্বটি লোপ পায়, বৃহৎটি জাগে।

শ্রীরামকৃষ্ণ তবে কী বলে গেলেন? আমাদের যদি করার কিছুই না থাকে তাহলে কি আর বাকি থাকে? তিনি বলে গেলেন – সৎ একটি জীবন যাপন করতে। যেখানে শঠতা নেই ক্রুরতা নেই জটিলতা নেই। সৎ ও সরল জীবন আমাদের চেতনাকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। কোনোরকম পার্থিব আকর্ষণ থেকে আমরা নিজে নিজে মুক্ত হতে পারিনা। তাই আমরা আমাদেরই সেই মহৎ অস্তিত্ব, যাকে ঈশ্বর বলছি, তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাতে পারি – হে ঈশ্বর আমাকে মোহমুক্ত করো। এতে সেই মহৎ অস্তিত্ব কৃপা করতে পারেন কিংবা আমাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে। আমরা ক্রমাগত একই প্রার্থনা করতে করতে ক্রমে পরিবর্তিত হতে থাকি। একই কথা, একই চিন্তা আমাদের মস্তিষ্কে আঘাত করতে থাকে। আমাদের কোষ উন্মুক্ত হতে থাকে। এবং, এ হয়। ঠাকুর এর রেফারেন্স রাখছেন। তাঁর ভাগ্নে হৃদয় মুখুজ্যে যখন বলছেন, মামা তুমি রোজ রোজ এক কথা কও কেন? তোমার বুলিগুলো ফুরিয়ে যাবে যে। ঠাকুর তার উত্তরে বলছেন – বেশ করব। আমার বুলি আমি একশ বার বলব। তোর তাতে কি রে? এ কথারও গভীর দ্যোতনা আছে। একই কথা সমানে আওড়ালে তা ব্রেনে আঘাত করে।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস আসলে এসব কিছুর মাধ্যমে ধর্মের প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতাকে উড়িয়ে দিয়ে গেছেন। আশ্রমবাসী প্রতিষ্ঠানবাসী গুরুদের উচ্ছেদ করে গেছেন। কারণ, তাঁর মতে, ধর্ম কোনো সর্বসিদ্ধিদায়ী মাদুলি নয়, ধর্ম আমাদের চাহিদা পূরণের যন্ত্র নয়। ধর্ম হল নিজের ঈশ্বরচেতনার বিকাশ। আজ এই ধর্মব্যবসার সময়ে তাঁর কথার মর্ম উপলব্ধি করা আরও বেশি প্রয়োজন। তাতেই আমাদের মঙ্গল বলে মনে হয়।

[মাতৃশক্তি কল্পতরু সংখ্যা ২০২০]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

Posted in





মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) যিনি আল মাহমুদ নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে।তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং এই সময়ে অসামান্য সব রচনা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন৷

মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর।মাহমুদের বড় দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন।

কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। আগেই বলেছি আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাট দশকেই স্বীকৃতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন।অর্থাৎ কবিতার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছিল আগেই৷সাধনার ফল মিলেছিল অচিরেই৷


১৯৫৪ সাল অর্থাৎ কবির যখন ১৮ বছরের দুঃসহ বয়স, তখন থেকেই তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ "লোক লোকান্তর" (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস "কবি ও কোলাহল" যা সমালোচকমহলে প্রশংসা আনে৷

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন।এখানেই তার সাফল্য৷আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তির সাক্ষর রাখবে ।

১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।তবে সাহিত্য সমালোচকদের মতে তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম "সোনালি কাবিন"।

আল মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ সমকালীন বাংলা কবিতার একটি বাঁকের নাম। বলা হয়ে থাকে, তিনি যদি শুধু এই একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতেন, তাতেও বাংলা কবিতার রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে থাকতেন। কবি হিসেবে পরিচিত হলেও আল মাহমুদ একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক৷

রবীন্দ্র উত্তর আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে একেবারেই অন্যরকম নান্দনিকতায় আর বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী কবি হিসাবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন৷

যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়ত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কালের কলসের পরে ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটির কথা আগেই বলেছি৷এটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি যারা কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুক তারাও স্বীকার করেছেন একবাক্যে৷এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়। আর এমন কবিই উচ্চারণ করেন:

"আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোন দিনই বিহ্বল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মৃতর প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!

কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের নিঃসঃশয় গন্তব্য৷

এইভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, ‘সমকালীন যে দুজন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুনের মতে, ‘তিনি চল্লিশের পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি, নতুন কবি।’

পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ যখন গ্রামে ফেরেন এবং গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে লিখতে থাকেন

"এখন কোথায় যাওয়া যায়?
শহীদ এখন টেলিভিশনে।
শামসুর রাহমান সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন।
হাসানের বঙ্গ জননীর নীলাম্বরী বোনা
আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান।

অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, কেননা:

আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে। (আমার সমস্ত গন্তব্যে)

আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন।অর্থাৎ যেন একটা সাঁকো নির্মাণ৷ তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই শেষ ,একপ্রখর আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির অন্য ধারার কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক কাব্যজগতে অন্য আসন এনে দিয়েছে৷


"আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষির বিষয়
চাষির বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর
কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন
সীমাহীন মাঠ।

চাষির বিষয় নারী।

উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা।

পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী। (কবির বিষয়)"


ইমরাণ মাহফুজ বলছেন "স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন’ সনেট গুচ্ছকে করেছে অন্যান্য।"


"সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।"

আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে আর্থিক প্রলোভন মিথ্যে মেকী৷

"বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না
তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা (সোনালী কাবিন)

আবার কখনো লিখছেন

"কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!

কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।"

(কবিতা এমন/আল মাহমুদ)

"কাক ও কোকিল "আবার অন্ত্যমিলের কবিতা তাতে কবি লিখেছেন

"একবার এক শহুরে কাকের দলে
মিশে গিয়েছিলো গানের কোকিল পাখি
মনে ছিলো তার কোন মতে কোনো ছলে
শেখা যায় যদি জীবিকার নানা ফাঁকি।

শুধু গান ছাড়া বুদ্ধির নানা খেলা
শিখবে সে এই চালাক কাকের ভিড়ে,
পার হয়ে মহানগরীর অবহেলা
কন্ঠ সাধবে প্র‍ভাতের বুক চিরে।

কিন্তু বাতাসে ফিরে এলো ওর গান
জন জীবনের কোলাহলে ভয় পেয়ে
ধুলোয় হাওয়ায় কেবলি যে অপমান
কাকের কলহ আকাশের মন্দিরে।

কাকেরা যে বোঝেনা গানের ভাষা
রুক্ষ পালকে তীব্র‍ কন্ঠে হাসে
গানের পাখির নিভে যায় কত আশা
সবুজ পাহাড়ে একদিন ফিরে আসে।

মহুয়ার গাছে দুঃখের নানা শ্লোক
তারপর থেকে শোনা যায় রোজ রোজ
কার সঙ্গীতে কাঁপে অরণ্যলোক
কোন্ পক্ষীর হৃদয়ের নির্যাসে?"

এ কবিতা কী অসম্ভব প্রতীকি নয়?

কবি অতীত গৌরব, সাম্য মানসিকতা, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য, কাম থেকে প্রেম এবং কামকলার অভূতপূর্ব চিত্রায়নের সঙ্গে ধর্মের মিথলজিক্যালের ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজনিষ্ঠ।তার কবিকৃতি সব মিলিয়েই বহুযুগ ধরে আলোচিত হবে৷





তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ

ইমরান মাহফুজ
রাজীব হুমায়ুন
ডেলি হান্ট
শিবনারায়ণ রায়

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৩

‘দুর ছাই!...’ লেফটেন্যান্ট ফিসফিস করেন… ‘ব্যাপারটা ঝামেলার দিকে গড়াচ্ছে, এটা সত্যি সত্যি লড়াই!’ --- পায়ের শব্দগুলো ক্রমশ কাছে আসে। তবে এখন আর তারা কেউ দৌড়ে আসছে না।

‘অনর্থ কাণ্ড!’ ফাইনহালস নরমভাবে বলে… ‘ওরা কেউ রাশিয়ান নয়!’

লেফটেন্যান্ট জবাব দেন না।

‘আমি বুঝতে পারছি না এদের দৌড়াদৌড়ি করবার কী প্রয়োজন? তাও আবার এত শব্দ করে…’

লেফটেন্যান্ট জবাব দেন না।

‘এরা সব আপনার লোকজন!’ বলে ফাইনহালস। পায়ের শব্দগুলো এখন খুব কাছাকাছি।

যদিও এদের শারীরিক গড়ন এবং মাথায় স্টিলের হেলমেটের উল্টানো কোণ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে এরা জার্মান, তবুও লেফটেন্যান্ট মৃদুস্বরে বলে উঠলেন…

‘হল্ট! সঙ্কেত, হল্ট!’ লোকগুলো থেমে গেল। ফাইনহালস দেখতে পেল যে এরা বিষম চমকেছে।

‘ইসস… দূর ছাই!’ একজন বলে উঠল… ‘কী সঙ্কেত? দূর ছাই!’

‘তানেনবার্গ!’ বলে উঠল আরেকটা কণ্ঠ…

‘অভিশপ্ত জীবন!’ বলে উঠলেন লেফটেন্যান্ট… ‘আপনারা এখানে কী করছেন? শীগগির সব্বাই দেওয়ালের আড়ালে চলে যান। একজন কোণের দিকে থাকবেন এবং শুনে যান কী করতে হবে।’

ফাইনহালস এদের দেখে বিস্মিত হল। অন্ধকারে গুনবার চেষ্টা করছিল সে। ছয়, সাতজন হবে সব মিলিয়ে। ঘাসের গাদার উপরে বসে পড়ল তারা। ‘ওয়াইন আছে…’ লেফটেন্যান্ট বোতলগুলি হাতড়ে বের করে ওদের দিকে এগিয়ে দিলেন… ‘আপনারা ভাগাভাগি করে নিন।’

‘প্রিন্স’ লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন… ‘সার্জেন্ট প্রিন্স, কী ব্যাপার?’

কোণে যে ছিল, তার নাম প্রিন্স। ফাইনহালস দেখতে পেল যে অন্ধকারে তার বুকের মেডেলগুলো চকচক করছে।

‘লেফটেন্যান্ট’ প্রিন্স বলে ওঠে… ‘একেবারে যাচ্ছেতাই ফালতু ব্যাপার! বাঁদিক, ডানদিক দিয়ে ওরা বেরিয়ে গেছে। এবার এই একমাত্র জায়গা মধ্যিখানে, এই গ্রামের মাঝে, এই জঞ্জালের মাঝে যেখানে আমাদের মেশিনগান বসানো আছে, সেই ফ্রন্ট বন্ধ করতে হবে। এই ফ্রন্ট প্রায় কয়েকশ কিলোমিটার চওড়া… আর এই জায়গাটা সরু হয়ে দেড়শ মিটার… এবার এইখানে খামকা লড়াই করে আমরা নাইট ক্রস জিততে পারব না। বরঞ্চ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। এখানে আমাদের কথা কে ভাববে? আটকে গেলে… ‘

-‘ফ্রন্ট বন্ধ করা দরকার কোথাও… এখানে কি আপনারা সবাই আছেন?’

‘হ্যাঁ!’ বলে ওঠে প্রিন্স… ‘এখানে সবাই আছে… তবে আমার মনে হয় না অপেশাদার লোকজন আর যারা সদ্য আঘাত-অসুখ সারিয়ে লড়াইতে নেমেছে তারা ফ্রন্ট বন্ধ করতে পারবে। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, গেনৎস্কি আহত, ওর গুলি লেগেছে… গেনৎস্কি!’ সে নরমভাবে ডাকে… ‘তুমি কোথায়?’

একটা শীর্ণ অবয়ব দেওয়াল থেকে একটু সরে দাঁড়ায়।

‘বেশ!’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘আপনি চলে যান… ফাইনহালস সঙ্গে যাবেন। ফার্স্ট এড স্টেশন আছে, যেখানে আমাদের ট্রাক থেমেছিল। সেখানে চীফ যিনি আছেন, তাকে জানিয়ে দিন যে মেশিনগান ত্রিশ গজ পিছিয়ে দেওয়া হল। প্রিন্স, ওদের সঙ্গে আরেকজন কাউকে পাঠিয়ে দিন।’

-‘ভেকে, সঙ্গে যাও’ প্রিন্স এবার ফাইনহালসের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে… ‘তোমরাও কি ফার্নিচার ভ্যানে এলে এখানে?’

-‘হ্যাঁ’

-‘আমরাও’

‘এগিয়ে যান’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘ওই পে বুক আর পরিচয়পত্র চীফকে দেবেন!’

‘একজন মারা গেছে?’ প্রিন্স প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ’ অধৈর্য হয়ে বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘যান, এগিয়ে যান!’

ফাইনহালস ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে এগিয়ে যায় আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে। এখন দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক থেকে অনেক ট্যাঙ্কের শব্দ আসছে যেগুলি গোলা ছুঁড়ে যাচ্ছে। তাদের বাঁ দিকে, যেখানে প্রধান সড়ক গ্রামের দিকে চলে গেছে, সেখানে চিৎকার এবং গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল। এক মুহূর্ত থেমে তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।

‘অসাধারণ!’ বলে উঠল ছোটখাট চেহারার লোকটি, যার হাতে গুলি লেগেছে। তারা সবাই তাড়াতাড়ি এগোতে লাগল। তবে ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘সঙ্কেত?’

‘তানেনবার্গ!’ তারা সমস্বরে গড়গড়িয়ে বলে উঠল।

‘ব্রেশট? ব্রেশটের বাহিনী?’

‘হ্যাঁ!’ উত্তর দিল ফাইনহালস!

‘ফিরে আসুন। এখনই সব সুদ্ধ ফেরত আসুন, গ্রামের প্রধান সড়কের উপরে।’

‘দৌড়ে যাও!’ ভেকে বলে ওঠে ফাইনহালসকে… ‘তুমি দৌড়ে গিয়ে বল।’

ফাইনহালস দৌড়ে আবার নেমে যায় ট্রেঞ্চের মধ্যে। দৌড়ে গিয়ে ফিরে যায় দেওয়ালের কাছে, বলে ওঠে… ‘শুনছেন, লেফটেন্যান্ট ব্রেশট!’

‘কী হল?’

‘ফিরে আসুন। সব সুদ্ধ… গ্রামের প্রধান সড়কের উপরে…’

তারা সবাই ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে।

লাল ফার্নিচার ট্রাকটা প্রায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। ফাইনহালস ধীরে ধীরে ট্রাকের ঢালু পাটাতন ধরে উঠে গিয়ে সামনের দিকে বসে। তার পিঠটা একটু দেওয়াল খুঁজে নিয়ে হেলান দেয়, একটু ঝিমোবার চেষ্টা করে। ভয়ানক গোলাগুলির শব্দ চারদিকে, তার হঠাৎ এই সব কিছু ভীষণ হাস্যকর বলে মনে হয়। তার কানে আসে যে এখন জার্মান ট্যাঙ্ক গোলা ছুঁড়ছে নিজেদের পথ পরিষ্কার করবার চেষ্টায়। বড় বেশি গোলা ছুঁড়ছে এরা; সাধারণ ভাবে যা প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এগুলো সবই যুদ্ধের অঙ্গ।

সবাই ট্রাকে উঠে পড়েছে। একজন মেজর, যিনি মেডেল দিচ্ছেন তিনি ছাড়া। আর কিছু লোক মেডেল পাবে, তারাও ট্রাকে ওঠেনি। একজন সার্জেন্ট, তিনজন পদাতিক সৈন্য আর একজন ফিল্ড অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন কাঁচা পাকা চুলের ছোটখাট চেহারার মেজরের সামনে। মেজরের মাথায় কোনো টুপি নেই। তিনি তাড়াতাড়ি এদের হাতে মেডেল এবং সার্টিফিকেট তুলে দিলেন। দিয়েই চিৎকার জুড়ে দিলেন…

‘ডঃ গ্রেক, চীফ লেফটেন্যান্ট!’ নামটা উচ্চারণ করে দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘ব্রেশ্‌ট! লেফটেন্যান্ট ব্রেশট কোথায় গেলেন?’

ট্রাকের ভেতর থেকে সাড়া দিলেন ব্রেশট… ‘ইয়েস স্যার!’ তারপর ধীরে ধীরে ট্রাকের সামনের দিকে এসে মাথার টুপিতে হাত রাখলেন স্যালুটের ভঙ্গিতে, তারপর বলে উঠলেন ‘লেফটেন্যান্ট ব্রেশট, মেজর স্যর’

‘আপনার কম্পানির কম্যান্ডার কোথায়?’ মেজর প্রশ্ন করলেন। মেজরকে ঠিক রাগান্বিত নয়, বিরক্ত দেখাচ্ছে। যেসব সৈন্যরা এখনই পুরস্কৃত হল, তারা ট্রাকে উঠবার সময় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রেশটকে ধাক্কা মেরে মেরে ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল বার বার। মেজর গ্রামের রাস্তার উপরে একাকী তার হাতিয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রেশট একটু বোকা বোকা মুখ করে উত্তর দিলেন, ‘মেজর স্যার, আমার কোনো ধারণা নেই যে তিনি এখন কোথায়! ডঃ গ্রেক এইমাত্র আমাকে অর্ডার পাঠালেন কম্পানিকে নিয়ে এখানে একত্র হতে। তিনি অবশ্য পেটের যন্ত্রণায় বেশ কষ্ট পাচ্ছিলেন… ‘

‘গ্রেক!’ গ্রামের দিকে চেয়ে মেজর চিৎকার করে উঠলেন… ‘গ্রেক!’ ঘুরে দাঁড়ালেন এবার। মাথা নেড়ে হতাশার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন… ‘আপনার কম্পানি খুব ভালো লড়াই দিলো… কিন্তু আমাদের এখন বেরিয়ে যেতে হবেই…’

দ্বিতীয় জার্মান ট্যাঙ্কটা রাস্তার সামনে ডানদিকে গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে গেল। গ্রামের অনেকগুলো বাড়ি জ্বলছে। এমনকি গির্জাটাও… যেটা গ্রামের ঠিক মাঝখানে সব বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাও লালচে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। ফার্নিচার ট্রাকের ইঞ্জিনটা গুমগুম করে চলতে শুরু করল। মেজর পথের ধারে দ্বিধান্বিত অবস্থায় একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ট্রাকের চালকের দিকে চেঁচিয়ে উঠে নির্দেশ দিলেন…

‘এগিয়ে যাও…’

ফাইনহালস পে বুকটা খুলে দেখল… ‘ফিঙ্ক, গুস্তাভ, কর্পোরাল অফিসার, নাগরিক পেশা- সরাইমালিক, বাসস্থান- হাইডেসহাইম’ --- হাইডেসহাইম! জায়গাটার নাম দেখে ফাইনহালস স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার বাড়ি থেকে মোটে তিন কিলোমিটার দূরে। সে বহুবার দেখেছে সরাইখানাটা, বাদামী কালি দিয়ে লেখা সাইনবোর্ড ‘ফিঙ্কের ওয়াইন ট্যাভার্ন ১৭১০ সালে স্থাপিত’। ওই জায়গাটা দিয়ে বহুবার গাড়ি চালিয়ে গেছে সে, যদিও কখনো ভেতরে ঢোকেনি। দড়াম করে একটা শব্দ হল। লাল ট্রাকের দরজাটা বন্ধ হল। ট্রাকটা চলতে শুরু করল।



গ্রেক উঠে আসবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামের সড়কের উপরে সবাই অপেক্ষা করছিল তার জন্য। সে জানে, কিন্তু সে উঠে আসতে পারছিল না। পেটের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। তার মনে হচ্ছিল একটু মলত্যাগ করতে পারলে আরাম হবে। নোংরা ডোবা আর একটা বাড়ির দেওয়ালের মাঝের একটা জায়গা বেছে নিয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল সে। খুব সামান্য পরিমাণ মল বেরিয়ে এল তার মলদ্বার দিয়ে। কতটা পরিমাণ হবে? এক চামচেরও কম। অথচ, তার পেটের যন্ত্রণা সাঙ্ঘাতিক বেশি। সে ঠিকভাবে বসতেও পারছেনা ব্যথার জন্য। পেটে চাপ লাগছে। তবে উবু হয়ে বসে কোঁত পাড়লে একটু মল বেরোবে। হ্যাঁ, একটু মল বেরোলে, ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে আশা জাগে। আশা জাগে যে হয়তো ব্যথাটা একটু কমবে। এই ঘ্যানঘেনে ব্যথাটার জন্য শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে তার। ঠিকভাবে হাঁটতেও পারেনা সে যখন ব্যথাটা তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খায়। হাঁটতে পারেনা, হামাগুড়ি দিতেও পারেনা। তখন এগিয়ে চলার একমাত্র উপায় হল মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাতে ভর দিয়ে বুকে হেঁটে যাওয়া। সেটুকু যাওয়া তখন সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। তখনো প্রায় তিনশ মিটার দূরে ছিল সে। গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যেও সে শুনতে পেয়েছিল যে মেজর ক্রেনৎজ তার নাম ধরে ডাকছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে দুনিয়ার কোনোকিছু নিয়ে ভাবনাচিন্তা ছিলনা তার। বীভৎস পেটব্যথায় সে বেঁকে গিয়েছিল।

দেওয়ালটা ধরে ধরে উঠে দাঁড়াল সে। তার উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ব্যথাটা তার অন্ত্রের মধ্যে ঘূর্ণিপাকের মত ঘুরপাক খাচ্ছিল, ধীরে ধীরে জমে ওঠা বিস্ফোরক বারুদের মত, একটা রাক্ষসের মত বিশাল হয়ে উঠছিল। তারপর একটু কমল। কিন্তু বেশি মল নিঃসৃত হয়নি শরীর থেকে। ব্যথায় তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এই যুদ্ধটা নিয়ে এই মুহূর্তে তার আর কোনো মাথাব্যথা নেই। যুদ্ধের চিন্তা বেরিয়ে গিয়েছে তার মাথা থেকে। যদিও চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। এছাড়াও সে পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে গাড়িগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ। গাড়িগুলো গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ট্যাঙ্কগুলো গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে, সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে। এটা পরিষ্কার যে, এই গ্রামটাকে শত্রুপক্ষের বাহিনী একেবারে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তার শরীরের যন্ত্রণা, পেটব্যথা এগুলো অনেক বড়, অনেক ভয়ঙ্কর এই মুহূর্তে; এই ব্যথাটা শত্রুপক্ষের থেকেও অনেক কাছে এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে। তাকে একেবারে অবশ করে ফেলেছে। যত ডাক্তারকে সে অদ্যাবধি দেখিয়েছে পেটের সমস্যার জন্য, বুনো জন্তুর মত ভয়ানক ক্রুর হাসি হেসে হেসে যেন তারা তার সামনে দিয়ে মিছিল করে যাচ্ছে। ওই মিছিলের পুরোভাগে আছেন এক যাচ্ছেতাই রকমের বিষাক্ত মানুষ, তার জন্মদাতা পিতা। এদের হতাশাব্যঞ্জক মানসিকতা তাকে কোনোদিন বলেনি যে বেড়ে উঠবার বয়সে সাঙ্ঘাতিক রকম খাবারের অভাব, পুষ্টিগুণের অভাবই তার অসুখের প্রধান কারণ।

একটা গোলা এসে নোংরা ডোবার উপরে পড়ল। একটা ঢেউ তৈরি হল। ঢেউটা তাকে একেবারে ভিজিয়ে দিল। নোংরানগোলা জলের স্বাদ এসে লাগল তার জিভে। যতক্ষণ সে বুঝতে পারেনি যে ওই বাড়িটা সরাসরি ট্যাঙ্ক আক্রমণের আওতায় চলে এসেছে, ততক্ষণ সে কেঁদে যাচ্ছিল। এক চুল তফাতে গোলা পড়তে থাকে তার চারপাশে। তার মাথার উপর দিয়ে একটা গোলা চলে যায়। বাড়িটার কাঠামো কেঁপে ওঠে। কাঠকুটো ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িটার ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠের কান্নার শব্দ আসে। তার চারপাশে ধুলো, ধোঁয়া, কাঠকুটোর টুকরো উড়ছে। সে আবার বসে পড়ে। দেওয়ালের আড়ালে যায়। সাবধানে প্যান্টের বোতাম লাগায়। যদিও তার অন্ত্রের ব্যথার দমক মাঝে মাঝেই তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চাইছে, তবুও সে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢালু পাথরের রাস্তা ধরে ওই বাড়িটার চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। সে প্যান্টটা ঠিকভাবে পরে নিয়েছে। কিন্তু সে এগোতে পারেনা একচুল। ব্যথাটা তার সর্বাঙ্গ অবশ করে দিয়েছে। সে ওই জায়গাতেই শুয়ে থাকে। তার সারাটা জীবনের দৃশ্য ক্যালাইডোস্কোপের টুকরো টুকরো নকশার মত ঘুরতে থাকে চোখের সামনে। সেই দৃশ্যগুলির অধিকাংশ একঘেয়ে অকথ্য অত্যাচার আর অপমানের ঘটনায় ভর্তি। সেই মুহূর্তে শুধুমাত্র নিজের চোখের জলটা সত্য বলে মনে হয় তার। বাকি সব কিছু মিথ্যে। দু চোখ ছাপিয়ে নেমে আসা অশ্রু মিশে যায় নোংরা ধুলোর সঙ্গে। তার ঠোঁটে এখন নোংরা ধুলো, বর্জ্য আর খড়কুটোর স্বাদ। যতক্ষণ না একটা গুলি এসে পাশের খামারের চালে ঢুকে সেই চালটা উড়িয়ে দিল, এবং সেই খামার থেকে বিশাল খড়ের গাদা এসে তাকে চাপা দিয়ে দিল, ততক্ষণ অবধি সে কেঁদে যাচ্ছিল। (চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in





পর্ব ২৬

আস্পারাগাস আর বেকন – এক জার্মান প্রণয়গাথা

গ্রীষ্মকাল। এই শব্দটা মাথায় এলেই আমাদের মতো দেশে যে অনুষঙ্গগুলি অবধারিতভাবে এসে পড়ে, তার মধ্যে প্রধান অবশ্যই বিপুল এক সময় জুড়ে নির্মম দাবদাহের রাজত্ব। এর ঠিক বিপরীত চিত্রটিই চোখে পড়ে শীতপ্রধান দেশগুলিতে। গরমকালটি সেখানে উৎসবের। পারিবারিক অবসর যাপনের জন্য নির্দিষ্ট। পাশ্চাত্যে এই ছুটি কাটানোর রকমফের আছে। অনেকে সাইকেল নিয়ে সপরিবারে বেরিয়ে পড়ে দূর-দূরান্তরে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাবা-মা আর তাদের দুটি ছোট ছেলেমেয়ে সারিবদ্ধভাবে পরপর সাইকেল চালিয়ে চলেছে ফুটপাথে সাইকেল চালানোর জন্য চিহ্নিত অংশটি দিয়ে। নানান সরঞ্জাম তাদের সঙ্গে। যার মধ্যে নিশ্চিতভাবে নজর কাড়বে একটি তাঁবু আর একটি গ্রিল – যাতে যাত্রাপথের যেকোনও জায়গাতেই একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়, বিশেষত তা যদি সন্ধের দিকে হয়, তাহলে সেই গ্রিলের ওপর মাংস বা মাছের টুকরো ঝলসে নিয়ে জমে ওঠে সান্ধ্য অথবা রাত্রিকালীন আড্ডা।

কুড়ি বছরেরও বেশি সময় আগের এক গরমকাল। হঠাৎই সুযোগ এসে গেল উত্তর জার্মানির এক বিখ্যাত মুদ্রণসংস্থায় এক স্বল্পকালীন শিক্ষানবিশির। হামবুর্গ শহরের কাছে আহরেন্সবুর্গের সেই অস্থায়ী কর্মস্থলের খুব কাছে একটি ছোট গ্রামের এক সরাইখানায় থাকার বন্দোবস্ত হল আমার। প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার জন্য বন্ধু কারিন দিয়েছিল একটা সাইকেল। প্রাত্যহিক সেই আসা-যাওয়ার পথে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলাম, আমার ভিতরে প্রবেশ করছে তখনও পর্যন্ত অচেনা এক পৃথিবীর রং, রূপ আর গন্ধ। একইসঙ্গে বদলে যাচ্ছে সামনের দৃশ্যপট। নিঃসঙ্গ সেই সময়ে সপ্তাহান্তে মনি (মনিকা) আর রল্‌ফের হামবুর্গের বাড়িতে এবং অন্যত্র ওদের সঙ্গ ছাড়া আমার প্রধান সঙ্গী ছিল প্রকৃতি। তখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অপিরিচিত এক প্রকৃতি। এমনিতেই প্রায় শ্বাসরোধকারী নৈঃশব্দ ওদেশের প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য চারিত্রিকতা। তার সঙ্গে যখন মিশে যায় দিগন্তচুম্বি সবুজের সমারোহ, এক অনবদ্য ক্যানভাস তৈরি হয় তখন। সে বছর প্রথম আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। ঘন সবুজ ক্ষেত, সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দৈত্যাকার পাখা এসব তো ছিলই, হঠাৎ দেখলাম তার মধ্যে হলুদ, চোখ-ধাঁধানো হলুদ। জানতে পারলাম উজ্জ্বল পীতবর্ণ সেই শস্যের নাম রাপস্‌, যাকে আমরা রেপসিড বলে জানি। এইভাবে যখন প্রতিদিন সেই গরমকালের খুঁটিনাটি আবিষ্কার করছি, এক সপ্তাহান্তে কারিন আর ওর বন্ধু হ্বলে আমাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল উত্তর জার্মানির সীমান্তে সমুদ্রের ধারে টোডেনহফ বলে একটি ছোট্ট জনপদে। সেদিনের সান্ধ্য আড্ডা আর রাত্রিবাসের কথা আগেই সবিস্তারে লিখেছি। পরদিন ছিল রবিবার। দুপুরের পর আমাদের আবার ঘরমুখো হওয়ার কথা। সকাল দশটা নাগাদ প্রাতরাশের জন্য আমরা মিলিত হয়েছিলাম। জানতাম না আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করে আছে এক বিস্ময়। সেইদিনই প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম এই ‘সাদা সোনা’র সঙ্গে। জেনেছিলাম জার্মানদের সঙ্গে আস্পারাগাসের নাছোড় প্রেমকাহিনির কথা। সে প্রায় রূপকথার মতো। ২২ এপ্রিল থেকে ২৪ জুন সময়টা জার্মান ক্যালেন্ডারে বিশেষ উল্লেখের। এই সময়টায় জার্মানির কিছু বিশেষ অঞ্চলে পাওয়া যায় আস্পারাগাস। জার্মান ভাষায় যা ষ্পারগেল। আস্পারাগাসের জনপ্রিয়তা পশ্চিমি পৃথিবীর অনেক জায়গায় থাকলেও এই আপাত-সাধারণ খাদ্যটি নিয়ে জার্মান আবেগের কোনও তুলনা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এবং তার বর্ণ হওয়া চাই সাদা। এই সাদা ষ্পারগেলকেই সোহাগ করে ‘সাদা সোনা’ বলে সম্বোধন করে জার্মানরা। এক বিশেষ আবহাওয়ায় এবং মাটিতে জন্মায় এই ফসল। সঠিকভাবে বললে মাটির তলায়। এবং সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেই এর রং হয় সাদা। ভোরবেলা টাটকা ষ্পারগেল তুলে খেতে হবে দুপুরের আগেই বা দুপুরবেলা। তবেই যে স্বাদটি একটি গোটা জাতকে মজিয়ে রেখেছে অনেক শতাব্দী জুড়ে, তার ঠিকঠাক মূল্যায়ন হবে।

তথ্য বলছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ এ প্রথম আস্পারাগাসের খোঁজ পাওয়া যায় মিশর দেশে। তারপর ইতিহাসের অনেক অধ্যায় পেরিয়ে রোমানদের হাত ধরে ইউরোপে প্রবেশ ঘটে আস্পারাগাসের কিন্তু তারপর কোন মন্ত্রবলে তা হয়ে উঠল জার্মান হেঁশেলের ভিতরমহলের সদস্য, তার শিকড়সন্ধান না করেও একথা বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে অনেক বিষয় থেকে যায় ব্যাখ্যার বাইরে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে হারিয়ে যেতে পারে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মাধুর্যটি। তথ্য আরও বলছে সতেরো শতকে ফরাসিদেশে আজকের এই ষ্পারগেলের দেখা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এমন আভাস হয়ত সেদিনও ছিল না বছরের দু’মাস বস্তুটি এইভাবে জার্মানদের রান্নাঘরটি এইভাবে তার দখলে রাখবে। আগেই বলেছি জার্মানদের প্রিয় আস্পারাগাসের রং সাদা। ইউরোপের অন্যান্য দেশের খাবার টেবিলে সবুজ বা গোলাপি রঙা আস্পারাগাসের দেখা পাওয়া যায়। সাদা আস্পারগাসের সঙ্গে এদের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সবুজ বা গোলাপি আস্পারাগাস ফলে মাটির ওপর আর সূর্যকিরণের প্রভাবে আপন খেয়ালে রং ধরে তাতে। আর সাদা আস্পারাগাস বা ষ্পারগেল হয়ে থাকে অসূরজম্পশ্যা। এর স্বাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার জন্য কোনও মশলা ব্যবহার করা হয়না। সামান্য নুন দিয়ে সিদ্ধ করে নেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে সিদ্ধ আলু, গলানো মাখন আর বেকন অথবা হ্যাম। মাখনের বদলে হলান্ডিস সসও ছড়িয়ে নিয়ে খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেদিনের সেই শুরু থেকে যখনই ওই সময়ে ওদেশে থেকেছি আর ষ্পারগেল খাওয়ার সৌভাগ্য (হ্যাঁ ভেবেচিন্তেই লিখলাম, সৌভাগ্য) হয়েছে, গলানো মাখনকেই ষ্পারগেলের শ্রেষ্ঠ জুড়িদার বলে মনে হয়েছে আর সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই চেয়েছি শিঙ্কেন ওরফে বেকন।

বছরের কোনও এক সময়ে একটি বিশেষ সবজির ফলনকে নিয়ে এমন উছ্বাস আর তাকে কেন্দ্র করে উৎসব - পৃথিবীর নানান প্রান্তে খাদ্যবস্তু নিয়ে এই ধরনের উন্মাদনা বিরল নয়। এক্ষেত্রে নজর কাড়ার মতো বিষয়টি হল এর অনুপুঙ্খতা, যার জন্য উত্তর-পশ্চিম জার্মানির প্রায় সাড়ে সাতশো কিলোমিটারের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে ‘ষ্পারগেল সরনি’, এর মধ্যে লোয়ার সাক্সনির নিনবুর্গে রয়েছে একটি ষ্পারগেল যাদুঘর, যেখানে একটি চারশো বছরের পুরনো কাঠের বাড়িতে পাওয়া যাবে সুদূর অতীত থেকে এখনও পর্যন্ত সংগৃহীত ষ্পারগেল-সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞাতব্য। জানা যাবে কেমন ছুরি ব্যবহার করতে হয় ক্ষেত থেকে ষ্পারগেল কেটে আনার জন্য। কীভাবে কখন গলাধঃকরণ করতে হয় নরম, কোমল এই খাদ্যটিকে। মানের দিক থেকে যদিও সেরা বলে ধরে নেওয়া হয় বাডেন-হ্বুরটেম্বার্গের শোয়েৎসিঙ্গেনের ষ্পারগেল, যে কারণে শোয়েৎসিঙ্গেন-কে বলা হয় ষ্পারগেল রাজধানী।

টোডেনহফের সেই রবিবাসরীয় সকালে প্রথমবার ষ্পারগেল খাওয়ার সময়েও আসল বিষয়টি আবিষ্কার করতে পারিনি। সেদিনের কয়েকবছর পর আমাদের খাদ্যরসিক বন্ধু রল্‌ফের হামবুর্গের বাড়ির পিছনের বাগানে একদিন ষ্পারগেল-সমন্বিত মধ্যাহ্নভোজের আড্ডায় উপলব্ধি করেছিলাম মাটির সঙ্গে মানুষের আজন্মলালিত সম্পর্কই আসলে এমন আবেগকে উসকে দিতে পারে। সেই পথেই জন্ম নেয় এক একটি খাদ্য সংস্কৃতি। বাকিটুকু আড়ম্বর বললে অত্যুক্তি হবে না

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(৪)

' নৈকট্যের অভাব নেই আমাদের
শুধু একটা নদী নেই কাছে।
জ্বলে আকাশ ভরা তারা
তবু অমরত্ব বাঁচে।

কেন পাইনা ছুঁতে আলো
জমে মনের কোণে ক্ষোভ।
উন্মাদ হই আমি
আমার যে খুব লোভ...'

অরাতিদমনের পাঠানো এই লাইনগুলো আজ ইনবক্সে পড়তে পড়তে রাইএর ভেতর থেকে উদ্গত কান্নাগুলো সব গুঁড়ি মেরে ঠেলে বেরিয়ে এল। কিছু কিছু কথা সঙ্গোপনে রয়ে গিয়ে অকারণেই গভীরতার তল খুঁজে মরে। এই খোঁজাখুঁজিতে শান্তি নেই মোটেও তবুও যেন একটুখানি আঁকড়ে পাওয়ার আকাঙ্খাকে ছেড়ে দিতেও মন চায় না। সম্পর্কের সহজতায় আজকাল খুব তীব্র স্পর্শে অরাতিকে মাঝে মাঝে ছুঁতে ইচ্ছে করে রাইএর। একটা বাঁধভাঙা আদরের পর ক্লান্তিজর্জর রাগমোচন, যেটা এখনো পর্যন্ত অধরাই তার জন্য বেঁচে থাকতে লোভ হয়। ঐহিক সমর্পণের একটা চোরাটান সে আজকাল টের পায় ভিতরে ভিতরে। যদিও এভাবে অভিসারে যাওয়া আজকের দিনে খুব একটা কঠিন নয় মোটেও; কিন্তু তাও কেন এত হাজারো দ্বিধা সামনে এসে বারবার দাঁড়িয়ে পড়ে?

রাই একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ্য করেছে যে সে ফোন করলে বা ভিডিও কল করলে অরাতিদমন তা কখনো তা ধরে না বা পরে নিজেও কলব্যাক করে না। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে আজন্মকালের রহস্য মেলে ইনবক্সে সে পাঠায় তার কন্ঠের প্রত্যুত্তরের বার্তা কিংবা অজানা আদিম অক্ষরবৃত্ত আর মধুমূরলীর টুকরো সুর। রাই ভাবে ও হয়তো ধরা দিতে চায় না। বোধহয় বাঁধা পড়তে চায়না কিংবা হয়তো চরিত্র ভাল নয়, ক্যাসানোভা গোত্রীয় হয়তো।
কিন্তু অরাতির ঘনঘন বদলে যাওয়া প্রোপিক বা টাইমলাইনের ছবি গুলো দেখলে পালান খেতে চাওয়া গাভীর মত চঞ্চল হয়ে ওঠে রাই। এত বিদ্যূত ধরে রাখার স্পর্ধা কি করে পায় সে?

খানিক পরে তিতলির সাথে অনেকক্ষণ ধরে ভিডিও কলে কথা হল। ওর পরীক্ষার পর তিতলি চাইছে মা-বাবার সঙ্গে ওর বয়ফ্রেন্ডের পরিচয় করিয়ে দিতে। ছেলেটিরও অল্প বয়স ওদের ইনস্টিটিউটের নবীনতম অধ্যাপক, ভাল কবিতা লেখে আর ছেলেটি, নাকি তার বাবার চাকরিসূত্রে শান্তিনিকেতনে ছোটবেলায় থেকেছে ! ব্যস্ এইটুকুই বলল আপাতত! বাকি সংলাপ আর প্রলাপ হবে সাক্ষাতে।

আজ বিকেলের দিকে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটল। ওয়াটার পিউরিফায়ারটা সার্ভিসিং করাতে অনেকদিনই লোক ডাকা হয়েছিল। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটেয় বেল বাজার পর রাই দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে কখনো এভাবে এই বেশে দেখবে তা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। নামী বহুজাতিক ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানির সার্ভিস এক্সিকিউটিভের বেশে আবার কুড়ি বছর পর ঋজুর সাথে এভাবে আচম্বিতে দেখা হয়ে যাবে এ যেন এক অতিলৌকিক ব্যাপার।
দুজন দুজনকে খানিক্ষণ নিষ্পলকে দেখল। সব জমে থাকা কথা আর প্রতিশ্রুতি কুড়ি বছর ধরে একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে। অকস্মাৎ দেখতে পাওয়ার সেই বরফকঠিন শৈত্য কাটিয়ে ঋজুই আগের মত স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল,

' সম্বল নেই স্বর্ণ আনিনি এনেছি কনকবরণ ধান্য/ ও দুটো চোখের তাৎক্ষণিকের সাড়া পাব কি সামান্য?'

মুহূর্তবদলের তারুণ্যে কুড়িটা বছর পিছিয়ে গিয়ে রাই অস্ফূট স্বরে বলে ওঠে - ' হাতের ওপর হাত রাখা সহজ নয়/সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়...'

************

মীরার কাছে দুপুরের দিকে চম্পাবাঈ এসে ফিসফিস করে ভয়ংকর খবরটা দিয়ে গেল। রাণা বিক্রমজিৎ আজ পুজোর থালায় করে কালসাপ পাঠাচ্ছে তার জন্য। গিরিধারীর জন্য মালা গাঁথতে গিয়ে যাতে বিষাক্ত সেই সাপ মীরার শেষযাত্রাকেও নিশ্চিত করে, এই তার উদ্দেশ্য। মীরা এসব কিছুই জানতনা। কাল জন্মাষ্টমী, লালার জন্য বেসনের লাড্ডু আর হালওয়া বানাচ্ছে মীরা আর গুনগুন করে গাইছে-

" মেরে রাণাজী, মৈ গোবিন্দ গুণ গানা
রাজা রুঠৈ নগরী রাখৈ হরি রুঠ্যা কহঁ জানা!
রানৈ ভেজ্যা জহর পিয়ালা অমৃত কহি পী জায়!
ডরিয়া মে কালা নাগ ভেজ্যা
সালগরাম করি জানা।।
মীরাবাঈ প্রেম দিয়ানী সাঁয়লিয়া বর পানা।"

মীরার আজকাল ঐশী প্রেমের পরম খোঁজ চলছে আরো গভীরে। ইষ্টকে প্রেম নিবেদন করে আসলে সে খুঁজছে নিজেকেই। আজকের মধ্যবয়সে এসে পৌঁছেও তার মন প্রেমে বাঁধা পড়তে চায় এখনো। এই উন্মাদনা বাইরের লোকের বোধগম্য হয়না। তারা মীরাকে কূলটা ভেবেই আনন্দ পায়। তা পাক, মীরা এখন বীতস্পৃহ হতে শিখেছে। শ্যামসুন্দর যে তার অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দেন এটাই তো পরম কামনার ধন।। একদিন ওই কালো সায়রের দীঘিতেই হবে মীরার মরণ।

*********
চন্দ্রাবলীর কুঞ্জ থেকে খুব ভোরে কানহাইয়া লুকিয়ে বেরোতে গিয়েই আচম্বিতে রাধার সামনে পড়ে গেল। গতরাতের প্রেমবিলাসের রতিচিহ্ন কানহাইয়ার সর্বাঙ্গে। রাধার তা দেখেই ভিতরে জ্বলন হয়। কানহাইয়া কেন এত চঞ্চল? রাধার স্বামী আয়ান ক'দিন অসুস্থ বলে সে ঘাটে আসেনি। কুঞ্জপথেও তাকে কম দেখা গেছে এই কদিন। এরমধ্যেই কানহাইয়া এতটা বদলে গেল? কদিন আগের কানহাইয়া আর এই কানহাইয়া যেন অন্য দুটো মানুষ। চন্দ্রাবলীকেও দোষ দেওয়া যায়না। গোপবালাদের সবার প্রিয়তম তো কানহাইয়া একাই। কিন্তু রাধার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে এভাবে যে চন্দ্রায় আবিষ্ট হতে পারে,তা মানতে যেন মন চায়না। চন্দন বা অন্নসেবা না নিয়ে এতো একেবারে কায়াসমর্পণ করল চন্দ্রা!

রাধার কাছে ধরা পড়ে কানহাইয়া কিন্তু একটুও অপ্রস্তুত হয়না। তার সেই দুষ্টুমিমাখানো হাসি হেসে সে রাধার হাতটা এগিয়ে এসে ধরে। স্ফূরিত অধরে রাধা তার হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়। কানহাইয়া তবু নির্বিকার। মিটিমিটি হাসিতে তার দুচোখ জ্বলজ্বল করে।নির্লজ্জ কানহাইয়া আজ আর তার পীতাম্বরও ধারণ করেনি। অভিসারের পর চন্দ্রাবলীর প্রিয় কাষায় বস্ত্রটিই পড়েছে। এত সহজে কানহাইয়ার মন বদলে যায়! রাধার ভেতরে চাপা অভিমান ধিকিধিকি করে ওঠে। নাঃ এই লম্পট শঠের রাজা কানহাইয়ার অার সে মুখদর্শন করবেনা জীবদ্দশায়।

একটিও বিরুদ্ধবাক্য না বলে শুধু কানহাইয়ার প্রতি একটি তীর্যক কটাক্ষ হেনে দর্পিত পদক্ষেপে সে পা বাড়ায়।
রাধার এই চলে যাওয়াটি দেখতে দেখতে কানহাইয়া মনে মনে খুব মজা পায়। মাটি থেকে রাধার নূপূরের একটি মঞ্জীর ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। কানহাইয়া সেটিকে দেখতে পেয়ে যত্ন করে তুলে নেয় হাতে। একটি চুম্বন এঁকে সেটিকে শিখিপাখার উষ্ণীষে গেঁথে নেয় সে। যাক! বৃষভানু নন্দিনী এখন কিছুদিন দহন - জ্বলনে অতিষ্ঠ হবে, তার পরেই তো হবে আসল মিলনের আনন্দ ! সকল অবদমনের মুক্তি।
প্রকৃত প্রেমের প্রাথমিক অবস্থায় অভিমান, ঈর্ষা, অধিকার, জ্বলন এইসব পার্থিব বোধগুলি থাকবেই। অভেদসত্ত্বায় পরিপক্ক হতে আর রাধার আর একটু সময় লাগবে। তখন হবে সর্বদাই প্রেমানন্দস্বরূপের আস্বাদন ! কানহাইয়ার প্রেম অত সহজ ব্যাপার নয় মোটেও। 

(এই পর্বে বন্ধুনী/কবি শ্রী সেনগুপ্ত তাঁর -'নৈকট্যের অভাব নেই আমাদের' কবিতাটি উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহৃত করতে সম্মতি দিয়েছেন)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





সেই ঐতিহাসিক এডিটোরিয়াল বোর্ডের মিটিং আমাদের ঘরেই হয়েছিল। তাতে তিনজন বোর্ড মেম্বার ছাড়া অন্য বন্ধুরাও ছিল।
সবাই আমাকে খ্যাপাতে লাগল।
বলল আমি ওই অত্যাধুনিক কালজয়ী কবিতাটি ছাপিয়ে একটা শোরগোল তুলে দিতে পারতাম। তার বদলে বোকামি করে অমর হবার সুযোগ হেলায় হারালাম।
--দেখ, গুরু। তুমিও ভাল করেই জান যে কবিতা-টবিতা নয়, ওটা একটা অশ্লীল ছড়া -- যেটা নিয়ে শুধু হ্যা-হ্যা করে হাসা যায়, যেমন বিপ্লব হেসেছিল। কিন্তু ছাপানো?
-- অশ্লীল কেন? কোন অশ্লীল শব্দ তো হেডস্যারও খুঁজে পান নি।
গুরু গম্ভীর, কিন্তু চোখে দুষ্টুমি।
--আরে হেডস্যারের কথা ছাড়। তুমি ভাল করেই জান যে এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ভাবে একটা শরীরের ব্যাপার নিয়ে ছ্যাবলা ইয়ার্কি আছে।
প্রশান্ত ফিচেল হেসে বলল-- রবি ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু -এঁদের কবিতায় ও কত শরীরের বর্ণনা আছে, তাতে কবিতা অশ্লীল হয়ে গেল। তোর ভাটপাড়ার টুলো পন্ডিত হওয়া উচিত পোদো।
-- ফালতু কথা বলবি না তো! তুই কবিতার কি বুঝিস? রবি ঠাকুরের কবিতায় শরীর?
এবার বিপ্লব ফিকফিকিয়ে হাসে।
-- হল না পোদো। রাগের চোটে যুক্তি হারাচ্ছিস।
রবিঠাকুর লেখেন নি-- নিরাবরণ বক্ষে তব নিরাভরণ দেহে?
বুদ্ধদেব তো আরও এককাঠি এগিয়ে-- বক্ষ তব ঢাকিয়া দিনু চুম্বনেরই চাপে! ভাব তো-- এর চেয়ে নরেশের ওই " টালিগঞ্জ -বালিগঞ্জ" বেশি অশ্লীল কি? হেডস্যার তো ধরতেই পারেন নি।
আমি মরিয়া হয়ে বলি--ওটা কোন কবিতা হল? টিফিনেতে খেতে দেয় পাঁউরুটি কলা-- এতে অন্ত্যমিল -ছন্দ - একটা তির্যক প্রতিবাদ এসব রয়েছে। নরেশের ওটায় বখামি ছাড়া আর কি আছে? কয়েকটা স্টেশনের নাম লিখলে সেটা কবিতা হয় কি করে?
বিপ্লব আবার দাঁত বের করে।
-- শুধু স্টেশনের নাম? ওই বজবজ-বজবজের দ্বিত্ব একটি রেলওয়ে টাইমটেবিলের পাতাকে কাব্যিক সুষমায় মন্ডিত করিয়াছে। একেবারে অনেক- কথা- যাও যে বলে -কোন কথা না বলি--হয়েছে।
সবাই টেবিল চাপড়ে হেসে ওঠে। আমি রেগে মেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম করছি , ক্লাস সেভেনের কিশোর দৌড়তে দৌড়তে ঢুকে হাঁপাতে থাকে।
-- আরে অমিয়দা, বিপ্লবদা! আপনারা সব্বাই চলুন। শীগ্গির শীগ্গির! আমাদের বিজিত স্যার আবার পরীক্ষায় ফেল করেছেন। উনি কাঁদতে কাঁদতে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।

আমরা ঝগড়া ভুলে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগাই। ঘরে তালা দেওয়ার কথা কারও মনে নেই।


বিজিতদা আমদের আশ্রমের একটি চরিত্র যাকে সবাই ভালবাসে। এই ভালবাসার সঙ্গে কোথায় একটু করুণা মেশানো, কারণ ওঁর ডান পায়ের পাতা দোমড়ানো মোড়ানো; বেঁটে খাটো মানুষটি চলেন দুলে দুলে। পড়ান প্রাইমারি স্কুলে। আশ্রমে পেটভাতায় থাকেন আর রাত্তিরে ক্লাস সিক্স ও সেভেনের আশ্রমিক বাচ্চাদের ইংরেজি টেক্সট ও ট্রান্সলেশন পড়ান।
ওঁর সঙ্গে পরিচয় হলে মনে হয় ছোটবাচ্চাদের ভাল করে পড়ানো ছাড়া ওঁর জীবনে কোন উদ্দেশ্য নেই। বিয়ে করেন নি। একটি সাদা হাফ শার্ট , ধুতি ও হাওয়াই চপ্পল--ব্যস্‌। একজন মানুষের আর কি চাই!
ওঁর ভক্ত সংখ্যা অনেক। অনাবিল হাসি, একেবারে শিশুর মত। আর উনি খুব ভাল ভূতের গল্প বলতে পারেন। বলর ভঙ্গীতে ও মুখে নানারকম শব্দ করে উনি পরিবেশ এমন করে দেন যে নাইনে পড়ার সময়ও আমরা একে অন্যের গা ঘেঁষে বসতাম।
আমাদের উনি পড়াতেন না, কিন্তু বিজিতদা কবে গল্প বলবেন বললেই একটু ভেবে বলতেন শুক্রবার সন্ধ্যেয়। আমরা নিজেদের পড়াশুনো ছেড়ে ওঁর ক্লাসে ভিড় করতাম। সুনীল মহারাজ দেখেও দেখতেন না।
সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প হল-- যুদ্ধের সময় ছিটকে পরা এক বন্ধু স্ট্যানলি না ব্রিয়ারলি, অন্য ছোটবেলার বন্ধুর থেকে ইয়র্কশায়ারে গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পেল।
তারপর কি হইল সবাই জানে।
পরে আমাকে এক স্যার বলেছিলেন ওটা ওঁদের ম্যাট্রিকের কোর্সে একটি ইংরেজি কবিতার ন্যারেশন।


কিন্তু এই সর্বজনপ্রিয় বিজিতদাও একেক্দিন খেপে উঠতেন। ওঁর টিউটোরিয়ালের বেয়াড়া বাচ্চাদের ভালবেসে বুঝিয়ে সুজিয়ে যেদিন পোষ মানাতেন পারতেন না , সেদিন খুব হতাশ হয়ে খানিকক্ষণ মাথা নীচু করে মাটিতে পাতা সতরঞ্চির উপর বসে থাকতেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গালে চড় মারতেন -- মুখে আওয়াজ করতেন 'ত্যাট্‌ ত্যাট্‌!'
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলতেন--আমি এক ক্যালানে মাস্টার, সারাজীবন ধরে দাঁতকেলিয়ে যাব।
ছেলের দল হেসে কুটিপাটি।
এরপর খোঁড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এক খাট থেকে অন্য খাটে বাঁদরের সর্দারগুলোকে তাড়া করে বেড়াতেন। কেউ ভয় পেত না, উনি কাউকে জোরে মারতে পারতেন না, নিজেকেই শাস্তি দিতেন।
অন্য ক্লাসের ছেলেরা এসে তামাশা দেখত। তারপর বড়রা বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত করত। তখন ওঁর চোখে জল। বাঁদর ছাত্রগুলোকে জড়িয়ে ধরতেন।
এ হেন সুনীলদা কিছুতেই আর ম্যাট্রিকের বেড়া ডিঙোতে পারলেন না।আমাদের চোখের সামনে বার তিনেক প্রাইভেটে পরীক্ষা দিলেন-- প্রত্যেকবার একই ফল, অন্ততঃ দুই বিষয়ে ফেল। একটা অবশ্যই অংক।
পরীক্ষার দুদিন আগে থেকে ছুটি নিতেন , একবেলা উপোস করে হলে যেতেন, ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতেন। আমরা জেনেছিলাম --পাস করলে মিডল সেকশনে পড়াতে পারবেন, মাইনে বাড়বে।
এত ভাল পড়াতেন , ফেল কেন হচ্ছেন --এ এক রহস্য। আমরা এটাকে ভগবানের অবিচার মনে করতাম। পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগে আমরাও ওঁর জন্যে প্রার্থনা করতাম--ঠাকুর, অনেক পরীক্ষা নিয়েছ, এবার তো পাশ করিয়ে দাও। পাঁচ সিকে মানত করছি।
স্যারকে বলেছিলাম--কোন চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই আপনার জন্যে প্রেয়ার করেছি। এবার কেউ ঠেকাতে পারবে না।
কোথায় বিজিতদা?
ওই যে বেঁটে মত ধুতি পরা লোকটি খোঁড়াতে খোঁড়াতে দ্রুত পায়ে প্রেয়ার হলের দিকে যাচ্ছে।
আমাদের আগেই উনি পৌঁছে গেছেন হলে।
আমরা ঢুকেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। কেউ কেউ বারান্দায় থেমে গিয়ে জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম।
প্রায়ান্ধ জনহীন হল। শুধু ঠাকুর-মা-স্বামীজির ছবির সামনে পিলসূজের উপর পেতলের প্রদীপের শিখা। সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন বিজিত স্যার--আমাদের বিজিতদা। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে দুই গাল। কেঁপে কেঁপে উঠছে ঠোঁট। অস্ফুট স্বরে শোনা যাচ্ছে বুকভাঙা হাহাকার-- ঠাকুর, এ কী করলে তুমি, ঠাকুর!


এই বিংশশতাব্দীর আশ্রমের গল্প যেন ক্যান্টারবেরি টেলস্‌ । কত বিচিত্র জলছবির সমাহার। কত বর্ণাঢ্য চরিত্র। যেমন ছাত্রপ্রাণ খঞ্জ বিজিতদা, তেমনি একজন হলেন অন্ধ পাখোয়াজ বাদক নগেশদা।
শুধু শারীরিক পঙ্গুত্বে নয়, এঁদের দুজনের আসল মিল কাজের প্রতি সমর্পণে, নিজেকে উজাড় করে দেওয়ায়। আমার বালকবুদ্ধির মাপকঠিতে আশ্রমের ভাল কিছু জিনিসের মধ্যে এই দুজন প্রায় নায়কের স্থানে বসে আছেন।
প্রতিদিন সন্ধ্যেয় আরাত্রিক 'খন্ডন ভব বন্ধন' শুরু হওয়ার আগে দেখা যেত উনি কারও হাত ধরে বা একাই হাতড়ে হাতড়ে মাপা পা ফেলে প্রেয়ার হলে ঢুকছেন। পোদো ওর কাছে গিয়ে বসে একটা বড় আটার ভিজে তাল নিয়ে ওনার নির্দেশমত পাখোয়াজের বাঁয়ার দিকটায় চেপে চেপে বসিয়ে দিত।
অতি বিলম্বিত লয়ে চৌতালে শুরু হত আরাত্রিক। বলিষ্ঠ হাতের চাপড়ে বাজত চৌতালের ঠেকা। খঞ্জনি হাতে পোদো মেলাতে গিয়ে ঘেমে যেত। তারপর দুনি চালে রিপিট হত। পোদো ওনার হাতে দেখানো মাত্রা ও ইশারায় চারপাশের বন্ধুদের সামনে ঘ্যাম নিয়ে খঞ্জনি বাজাতো।
যেই না শেষের চার লাইনে 'নমো নমো প্রভু বাক্যগুণাতীত' আর 'ধে ধে ধে লঙ্গ রঙ্গ ভঙ্গ, বাজে অঙ্গ সঙ্গ মৃদঙ্গ'--- ত্রিতালে ও একতালে জলদ বাজত, নগেশদার পাখোয়াজও গুরু গুরু মেঘগর্জনের মত কথা বলে উঠত। শেষে তেহাই -টেহাই দিয়ে সমে এসে নগেশদা কাঁধের গামছা দিয়ে ঘাম মুছতেন। পোদোর বুকের মধ্যে ঝরণা কল কল বইত আর ও প্রেয়ার ভুলে গিয়ে একটা বড় সড় পেতলের খঞ্জনি নিয়ে পাখোয়াজের বাঁয়ার দিক থেকে সেই ভিজে আটার শুকিয়ে যাওয়া দলাটিকে ঘষে ঘষে তুলত যতক্ষণ না নগেশদা হাত বুলিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বলতেন --ঠিক আছে।
কালীপূজার রাত। চারদিকে তুবড়ি, ফুলঝুরি হাউয়ের সমারোহ। দোদুমা ও চকলেট বোমের কানফাটানো আওয়াজ।
জন্মবুড়ো পোদোর এর চেয়ে মন টানে প্রেয়ার হলের বারান্দায় জাজিম পেতে সারারাত্তির কালীকীর্তনের জমাটি আসর। কত খেয়ালিয়া ধ্রুপদীয়া এসেছেন। তবলা ও পাখোয়াজে সেই আদি ও অকৃত্রিম নগেশদা। আজ উনি একটা ধোপদুরস্ত শাদা শার্ট পড়েছেন, ধুতিও নীল লাগিয়ে কাচা। শীতের হালকা আমেজ, তাই গায়ে একটি চারটাকার মেটে রঙের মলিদা। আর আজকে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ির জায়গায় পরিপাটি করে কামানো গাল।
এসেছেন সুদূর হরিনাভি থেকে ধ্রুপদীয়া সংগীতাচার্য অমরনাথ ভট্টাচার্য। ধপধপে ফর্সা, টাক মাথা, চোখে ছানি, বয়েস সত্তর পেরিয়ে আশি ছোঁয় ছোঁয়। গায়ে গরদের পাঞ্জাবি ও মুখে এক অভিজাত গাম্ভীর্য।
যে কেউ গান গাইবে বলছে সে নগেশদার কানের কাছে ফিসফিস করছে আর উনি উঁচু আওয়াজে বলছেন--গুরুদেব , এবার বিশ্বনাথ একটি হামীর ( বা জয়জয়ন্তী) গাইতে চায়, আপনি অনুমতি দিন। উনি মাথা নাড়লে সে নবীন গায়ক তাঁর হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করে তানপুরা পিড়িং পিড়িং সেরে গান ধরছে।
এর পর অমরনাথ নিজে গাইতে লাগলেন। আগের মত দম নেই , লম্বা তান করতে পারছেন না, তবু সুর লাগানো দেখে ভক্তেরা আহা আহা করে উঠছে।
এদিকে পুজো শেষ, রাত ফুরিয়ে এল। এবার শান্তিজল নেবার পালা। যজ্ঞের আগুন কখন নিভে গেছে।
সবাই উঠি উঠি করছে; নগেশদা বললেন--গুরুদেব একটি ঝাঁপতাল গেয়ে শেষ করলেন। অমরনাথ ধরলেন ভৈরবীতে ঝাঁপতাল-- ভবানী দয়ানী, মহাবাক্যবাণী।
গান শেষ হল। কারও মুখে কথা নেই। নগেশদার অক্ষিগোলকহীন কোটর থেকে জল গড়াচ্ছে।

একজন নতুন ওয়ার্ডেন এসেছেন—রণজিৎ দত্ত। উনি বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে ইকনমিক্সে অনার্স পাশ করে বর্ধমান ইউনিভার্সিটির ইকনমিক্স বিল্ডিংয়ে এম এ'র ক্লাস করছেন। বছরখানেক আগে ওঁর বাবা মারা গেছেন। পড়াশুনোর খরচা উনি স্টাইপেন্ড থেকে সামলে নিচ্ছেন। কিন্তু থাকা খাওয়ার খরচা?

ব্যব্স্থা হল যে উনি আমাদের ওয়ার্ডেন হওয়ার শর্তে আশ্রমে পেটভাতায় থাকবেন, দিনের বেলায় ট্রেনে করে বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস করে বিকেল নাগাদ ফিরে আসবেন। ওঁর দায়িত্ব রাত্তিরে বড় ছেলেদের সামলে সুমলে ডিসিপ্লিনের মধ্যে রাখা এবং দরকারমত পড়াশুনোয় গাইড করা।

উনি অন্য ওয়ার্ডেনদের মত ধুতি পড়তেন না। আসমানি নীল রঙের স্লিপিং স্যুট পরে থাকতেন। আশ্রমের মধ্যে সেটা প্রায় ফ্যাশন শোয়ের মর্যাদা লাভ করল।
লম্বা ফর্সা চোপসানো গাল ও গর্তে বসা চোখের রণজিৎদার মুখে সারাক্ষণ একটি অনাবিল হাসি লেগে থাকত। উনি আমাদের পড়াতেন না, টেবিল টেনিস খেলতে শেখাতেন। গল্প বলতেন--নানারকমের গল্প। ইউনিভার্সিটির ক্লাসে বন্ধুদের হয়ে প্রক্সি দেওয়া ডাকসাইটে মেয়েদের গল্প। এবং অবশ্যই কিছু যৌনগন্ধী গল্প ও জোকস্‌।
আস্তে আস্তে উনি আমাদের বন্ধু হয়ে গেলেন।
একদিন ক্লাস সেভেনের একটা নতুন ভর্তি হওয়া বাঁদর ছেলে ওনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছড়া শোনালঃ
খ্যাঁচাদাদা যায়,
নীল পাজামা গায়,
বড় বড় মেয়েরা কেউ ফিরে না তাকায়,
খ্যাঁচা ফিরে ফিরে চায়।
উনি আমাদের ঘটনাটা বলেন নি। কিন্তু আমরা ছেলেটাকে ডেকে এনে ভাল করে চাঁটালাম। পরে রণজিৎদা যখন ছেলেটার ঘরে রাত্তিরে দরজা কেন বন্ধ নয় দেখে ঠেলে ঢুকতে গেলেন , অন্ধকারে ৪৫ ডিগ্রিতে ভেজিয়ে রাখা দরজাটার মাথায় রাখা এনসিসির বুট ও একটা মুড়ো ঝাঁটা ওঁর মাথায় পড়ল। চিৎকার চেঁচামেচির পরে আলো জ্বললে দেখা গেল ঝাঁটার মধ্যে গুঁজে রাখা একটা কালির দোয়াতও মুখ খুলে রাখা ছিল!


ওই ঘটনার পর থেকে ওয়ার্ডেন রণজিৎ দত্ত আমাদের সঙ্গে আরও মাই ডিয়ার হয়ে গেলেন। একেবারে হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না !
যদিও নীচুক্লাসের ছেলেপুলেরা কিঞ্চিৎ হতাশ।
কিন্তু আমাদের কপালটাই খারাপ। এই মধুচন্দ্রিমা বেশি দিন চলেনি। কোনটাই বা চলে!
দুমাসের মাথায় ঘটনাচক্রে সেই রণজিৎদার সঙ্গেই ক্লাস টেন ও ইলেভেনের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায় দাঁড়িয়ে গেল।
টালা পার্কে বিরাট মেলা। তাতে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিরাট একজিবিশন। আবার টেলিভিশন রাখা আছে। সেখানে গিয়ে চার আনা দিয়ে আপনিও গান গাইতে পারেন। পুরো পাবলিক আপনাকে পর্দায় গাইতে দেখবে। তবে দিনটা রোববার। ঠিক হল, আগে দুপুর বেলায় আমরা ময়দানে যাব। ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডানের ম্যাচ দেখব। তারপর সেখান থেকে টালা পার্কের প্রদর্শনী দেখে আশ্রমে ফিরব। পুরো প্রোগ্রাম ছকে নিয়ে আমরা সেক্রেটারি মহারাজের সঙ্গে দেখা করলাম।
উনি ও মেজ মহারাজ রাজি। কিন্তু এতগুলো ছেলে, প্রায় পনের জন , তার জন্যে আশ্রমের ডজ ভ্যানটা দেওয়া সম্ভব নয়। সবাইকে বাসে যেতে হবে। আর একজন ক্যাপ্টেন হয়ে আগে ভাগে সবার থেকে ভাড়ার টাকাটা জমা নেবে।
সব হিসেবমত চলছিল।
কিন্তু সেই চোরাগোপ্তা শ্রেণীসংগ্রাম! একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা। ক্লাস এইটের ছেলেগুলো মহারাজকে গিয়ে বলল-- ওরা যাচ্ছে, তো আমরা কি দোষ করলাম? আমাদেরও পারমিশন দিন।
--তোমরা ছোট।
--কীসের ছোট? আমরা দুজন তো প্রদ্যুম্নের সঙ্গেই পড়তাম। আমরা দুজন ক্যাপ্টেন হয়ে আমাদের ক্লাসের ছেলেগুলোকে সামলে সুমলে নিয়ে যাব।
-- এ হয় না। এতগুলো বাচ্চাকে তোমাদের দুজনের ভরসায় ছাড়া যায় না। হ্যাঁ, যদি কোন ওয়ার্ডেন সঙ্গে যেতে রাজি হন, তো ভেবে দেখতে পারি।
ওরা হোমওয়ার্ক করেই এসেছিল।
নরেশ বলল-- ঠিক বলেছেন মহারাজ। আমরা এটা আগেই ভেবেছি। নীচের তলার ওয়ার্ডেন বিনুদা রাজি হয়েছেন। আমরা শুধু পয়সা তুলে ওনার হাতে জমা দেব। উনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন --কোন অসুবিধে হবে না।
বড় মহারাজ পুরো একমিনিট নরেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন , তারপর বললেন--আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমরা যাবে।
কিন্তু মেজমহারাজ সেই ধর্মক্লাসের সময় থেকেই আমাদের উপর চটে ছিলেন। উনি বললেন--একযাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে? ক্লাস টেনের ছেলেরাও ওদের ওয়ার্ডেনকে সঙ্গে নিয়ে যাক, নইলে হবে না।
ক্লাস এইট মহা খুশি।
আমরা বল্লাম-- কুছ পরোয়া নেই। রণজিৎ দত্তকে রাজি করানো কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু কোথায় খচ হচ করছিল-- সিনিয়র ব্যাচের কোন মান-ইজ্জত নেই? ক্লাস এইটের নিয়ম আমাদের জন্যেও?

ভুল বলিনি। উনি রাজি হয়েছেন ---বড় ও মেজমহারাজ দুজনকেই জানিয়ে দিলাম। ব্যস্‌, হোস্টেলে সাজো সাজো রব। সবাই গড়ের মাঠের ফুটবল দেখার নামে প্রায় নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে। পরিমল দে বলে-- খড়দহ না বালি কোথাকার যেন--একজন নতুন প্লেয়ার খেলবে, তার পায়ের কাজ নাকি দেখার মত।
কেউ কেউ বলল-- ও আমাদের পাড়ার ছেলে, জানিস? ওর পাড়ার নাম জংলা।

যাওয়ার দিন আমরা খেয়ে দেয়ে তৈরি হয়েছি --কিন্তু রণজিৎ দার দেখা নেই। উনি সকাল থেকেই বেপাত্তা, কোথায় গেছেন কেউ জানে না। আমরা জানি উনি ঠিক সময়ে এসে পড়বেন।
ঘড়ির কাঁটা অন্যদিনের থেকে তাড়াতাড়ি ঘুরছে। এইটের ছেলেরা সেজেগুজে ওদের ওয়ার্ডেন বিনুদার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে নরেশ ট্যারা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওর সঙ্গীকে বলল-- একটা ইংরেজি প্রোভার্ব শুনেছিস? ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস্‌!
ওর সঙ্গী দোহার ধরল--ধুস্‌, ওসব পুরনো। আজকের লেটেস্ট শুনে নে। ক্লাস টেন প্রোপোজেস্‌, রণজিৎ ডিস্পোজেস্‌! হ্যা-হ্যা হ্যা-হ্যা!
নাঃ, রণজিৎদার কোন পাত্তা নেই। শেষে কি আমরা যারা পুরো প্রোগ্রামটাই বানালাম --আমরাই যেতে পারব না?
আমরা তৈরি হয়ে বড় ও মেজ মহারাজকে ধরলাম।
--আমরা সিনিয়র, ওয়ার্ডেন ছাড়াই যেতে দিন। কোন গন্ডগোল হবেনা।
মেজ মহারাজ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়েন। তা হয় না। ওয়ার্ডেন আসলে তবেই, নইলে নয়।
এমন সময় প্রশান্ত দৌড়তে দৌড়তে অফিসে ঢুকল। রণজিৎদা এসে গেছেন। কোন সমস্যাই নেই।
আমরা আবার লাফালাফি করে দোতলায় নিজেদের ঘরে। রণজিৎদা জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় পাজামা পরে লম্বা হয়েছেন।
-- এ কী স্যার ! শিগগির তৈরি হয়ে নিন। একদম সময় নেই। এক্ষুণি বেরোতে হবে।
--কোথায়?
--কোথায় মানে? আগে গড়ের মাঠ, তারপর টালা পার্ক।
--তোমরা যাও।
-- কী বলছেন! আপনি না গেলে অমাদের যেতে দেওয়া হবে না, জানেনই তো!
--আমি টায়র্ড, পারব না ।
--এসব কি বলছেন রণজিৎ দা? সেদিন যে কথা দিলেন?
উনি মুচকি মুচকি হাসছেন।
-- মিন্টু দাশগুপ্তের লেটেস্ট প্যারডি গানটা শুনেছ? সঙ্গম সিনেমার গানের?
'আমার চিঠিখানা পাবার পর, আমাকে তুমি নিজে ভুল বুঝো না।
যে কথা দিয়েছিলেম গো,
সেকথা আমি ফিরিয়ে নিলেম গো।'
তোমরা অন্য কোন ওয়ার্ডেনকে বল।
-- রণজিৎদা! স্যার! প্লীজ, এখন সময় নেই। উঠুন, জামাপ্যান্ট পরে নিন।
--বললাম তো! অনেকগুলো ক্লাস ছিল। ভীষণ টায়ার্ড। অন্য কাউকে--
গুরু অমিয়দা খিঁচিয়ে ওঠে।
--আগে বলেন নি কেন? এখন বলছেন? শেষ সময়ে কাকে বলব? ইয়ার্কি মারার আর--
ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন রোগা তালঢ্যাঙা রণজিৎদা--যেন নোয়ানো বাঁশের ঝাড়ের একটা কঞ্চি ।
--বেরিয়ে যাও! অল অফ ইউ! জাস্ট গেট আউট!

0 comments: